হযরত মাওলানা শাহ ছুফী আবুল খায়ের মুহম্মদ ওয়াজিহুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সংক্ষিপ্ত সওয়ানিহে উমরী মুবারক(যাত্রাবাড়ী দাদা হুযুর ক্বিবলা)


কুতুবুল আলম, আমীরুশ শরীয়ত, মাহতাবে তরীকত, সুলতানুল আরেফীন,
মাহিয়ে বেদয়াত, মুহ্ইয়ে সুন্নত, মুজাদ্দেদে যামান, হুজ্জাতুল ইসলাম, রঈসুল মোহাদ্দেসীন,
ফখরুল ফোকাহা, তাজুল মোফাসসেরীন, আলহজ্ব হযরত মাওলানা শাহ ছুফী আবুল খায়ের
মুহম্মদ
 ওয়াজিহুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সংক্ষিপ্ত সওয়ানিহে উমরী মুবারক

 বিলাদত শরীফ: ১৩৫২ হিজরী (১৯৩৪ ঈসায়ী) (আনুমানিক)
 বিছাল শরীফ : ১৪১৫ হিজরী (১৯৯৫ ঈসায়ী)
 বয়স মুবারক : ৬৩ বৎসর।
 --------------------------------------------
কুতুবুল আলম, আমীরুশ শরীয়ত, মুজাদ্দেদে যামান আলহজ্ব হযরত মাওলান শাহ ছুফী আবুল খায়ের মুহম্মদ ওয়াজিহুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি হিজরী ১৩৫২ সনে (১৯৩৪ ঈসায়ী) চাঁদপুর জেলার (কুমিল্লা) অন্তর্গত নানুপুর গ্রামে বিলাদতী শান মুবারক প্রকাশ করেন। উনার পিতার নাম জনাব মুহ¤মদ আহমদ উল্লাহ মুনশী ও মাতার নাম মোসা¤মাত আয়েশা খাতুন। মাতা পিতা উভয়ে অত্যন্ত পরহেজগার ও আল্লাহওয়ালা ছিলেন। হযরত পীর ছাহেব কেবলার বয়স যখন ৬/৭ বৎসর তখন উনার আব্বাজান ইনতেকাল করেন। পিতার ইন্তেকালের সময় উনারা সাত ভাই ও এক বোন ছিলেন। পীর ছাহেব ছিলেন ভাইদের মধ্যে ষষ্ট অর্থাৎ উনার বড় আরো পাঁচ ভাই এবং উনার ছোট এক ভাই ছিল। ভাইদের কেউ কেউ আলেম থাকলেও, অনেকেই ইংরেজীতে উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। ১৯৮২ইংরেজী সনের ৫ই নভেম্বর, রোজ শুক্রবার মাগরিবের পরে হুজরা শরীফে তিনি উনার শৈশব কাল স¤পর্কে আলোচনা কালে তিনি বলেন: “আমার অতি অল্প বয়সে আব্বাজান বিছালী শান মুবারক প্রকাশ করেন। আমার বড় ভাই-উনার ইচ্ছা ছিল আমি যেন ইংরেজী পড়ি। কিন্তু ইংরেজী পড়ার প্রতি আমার কোন আগ্রহই হলো না। আমি মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হই।” অত:পর তিনি স্থানীয় মাদ্রাসায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন এবং সব সময় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন। অত:পর ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে তফসীর বিভাগ ও ফিকাহ বিভাগে কামেল পরীক্ষায় (মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রী) প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন (অর্থাৎ ডাবল টাইটেল পাশ করেন) তিনি আলীয়া মাদ্রাসার রিসার্চ স্কলারও ছিলেন। অত:পর মাদ্রাসা আলীয়াতে তফসীরের অধ্যপনা করতে থাকেন। সুদীর্ঘ ২৭ বৎসর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার পর অবসর প্রাপ্ত হন।

            ছাত্র জীবন থেকেই তিনি মসজিদের ইমামতির পেশা গ্রহণ করেন। সর্বমোট ২৩ বৎসর ৬ মাস সময় তিনি মসজিদের ইমামতি করেছেন। তবে শেষের দিকে গেন্ডারিয়া লোহারপুল (ঢাকা) মসজিদে ইমামতি করেন।
            হযরত পীর ছাহেব কিবলার শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর ফুরফুরা শরীফের মাদারজাদ ওলী, সুলাতানুল আরেফীন, হযরত মাওলানা শাহ ছুফী নজমুস সায়াদাত ছিদ্দিকী রহমতুল্লাহি আলাইহি (ন’হুযূর কেবলা)-উনার হাতে মুরীদ হয়ে তরীকতের সবক মশক করতে থাকেন। কথিত আছে যে উনার মুরীদ হওয়ার পূর্বে হযরত ন’ হুযূর কিবলা একবার লোহার মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। হযরত পীর ছাহেব কিবলা (হযরত মাওলানা ওয়াজিউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি) তখন উক্ত মসজিদের ইমাম। উনার পেছনে নামায পড়ে ন’হুযূর ক্বিবলা উনার প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি গেন্ডারিয়াতে উনার আবাসস্থলে ফিরে গিয়ে হযরত মাওলানা ওয়াজিউল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট সংবাদ পাঠান যে, “ন’হুযূর ক্বিবলা আপনাকে ডেকেছেন।” তিনি ন’হুযূর ক্বিবলা উনার দরবারে উপস্থিত হলে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর উনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। বাইয়াত হওয়ার পর থেকে হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার খেদমতে নিজকে নিয়োজিত করেন এবং কঠোর রিয়াজত মোশাক্কাত সহকারে তরীকতের শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকেন। দীর্ঘদিন পর হযরত ন’হুযূর কিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে খিলাফত প্রদান করেন। ফুরফুরা শরীফের তৎকালীন গদীনশীন পীর, কাইয়ূমে যামান, হযরত মাওলানা শাহ ছুফী মুহ¤মদ আবদুল হাই ছিদ্দিকী রহমতুল্লাহি আলাইহি ছাহেবও উনাকে খিলাফত দান করেন।
            হযরত পীর ছাহেব কিবলা উনার খানকাহ শরীফ ছিল লোহারপুল মসজিদের দোতালায়। এখানে মসজিদের একটি খাম্বা (পিলার)-এর সঙ্গে হেলান দিয়ে তিনি মুরীদগণকে তা’লীম তালকীন দিতেন। এই খাম্বায় নিকটে নাকি উনার পীর ছাহেব হযরত ন’হুযূর কিবলা বসেছিলেন। প্রতি রবিবার আছরের পর থেকে জিকিরের হালকা শুরু হতো। (সে সময় অফিস আদালত রবিবারে ছুটি থাকত, সেজন্য রবিবারে জিকিরের সাপ্তাহিক জলসার সময় নির্দ্ধারণ করা হয়েছিল।) মাগরিবের পর থেকে ইশা পর্যন্ত জিকির-আজকার হতো। জিকির শেষে হুযূর ক্বিবলা কিছু ওয়াজ নসীহত করতেন। উনার ওয়াজ নসীহতে মানুষের মন বিগলিত হয়ে যেত। অনেক সময় মসনবী শরীফ হতে ও শেখ ছাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর রচিত ফার্সি শের-আশয়ার অত্যন্ত ভাবভোলা কন্ঠে পাঠ করতেন। জিকিরের মজলিসে মুরীদগণের কেউ কেউ ‘ওয়াজদ’ (আধ্যাত্মিক সংজ্ঞা-হীনতা)-এর হাল হয়ে যেত।
লোহার পুল মসজিদের অনতিদূরে (মসজিদের দক্ষিন-পশ্চিম পাশের্Ÿ) একটি স্বয়ং-স¤পূর্ণ ছোট্ট বাড়ীতে টিনের একচালা একটি ছাপরা ঘরে তিনি সপরিবারে দিনাতিপাত করতেন। বর্ষার দিনে বাড়ীর রাস্তায় পানি উঠে যেত। প্রবল বর্ষায় মসজিদ থেকে বাড়ী পর্যন্ত যেতে হাঁটু পানি ডিঙ্গিয়ে যেতে হত। উক্ত টিনের ঘরে দু’টি কামরা ছিল। একটি কামরায় একটি বড় চৌকি ছিল, যা কামরাটির অধিকাংশ স্থান দখল করে রেখেছিল। নীচে বসার বিশেষ জায়গা ছিল না। শুধু চলাচল করার মত জায়গা ছিল। এই কামরাটি “ড্রয়িং রুম” হিসাবে এবং “হুযরা শরীফ” হিসাবে ব্যবহƒত হত। মুরীদান বা মেহমান কেউ গেলে এখানেই বসতেন। কেউ বাইয়াত হওয়ার জন্য গেলে এখানে এই চৌকির উপর বসেই বাইয়াত গ্রহণ করতেন। মেহমানদের খাওয়ার পরিবেশনও এই চৌকির উপর করা হত। পার্শবর্তী অপর কামরাটিতে হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার আহালিয়া ও সন্তান সন্ততিগণ থাকতেন। উক্ত কামরার প্রবেশদ্বারে পরদা ঝুলিয়ে রাখা ছিল। এই ছোট্ট বাড়ীটিতে টিনের ছাপরার সামনে প্রশস্ত উঠান ছিল। কোন কোন মুরীদান হাদীয়া হিসাবে মোরগ নিয়ে আসতেন। মাঝে মাঝে দু’একটি মোরগ বাড়ীতে পালন করা হতো।
হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার মুর্শীদ হযরত ন’হুযূর ক্বিবলার মহব্বতে প্রায় গরক থাকতেন। তিনি সত্যিকারের ফানা ফিস-শায়েখ ছিলেন। জিকিরের মজলিসে মাঝে মাঝে এই শে’রটি অত্যন্ত ভাবভোলা হয়ে সুললতি কন্ঠে আওড়াতে থাকতেন :-
আয় মুরশীদে তরীকত্, এক রং ছে রাঙ্গা দে,
 যিছ্ রং ছে তু রাঙ্গা হ্যায়, উছ্ রং ছে রাঙ্গা দে।
উনার মুর্শীদ কিবলা শেষ জীবনে যখন অসুস্থ হয়ে যান, তখন উনার আরোগ্যের জন্য জিকিরের মজলিশে খত্মে শেফা এবং খত্মে খাজেগান পড়াতেন। এই খতমের সময় ছিল আছর থেকে মাগরিবের পুর্ব পর্যন্ত। খতমের জন্য অনেকগুলি তেতুলের বীচি রাখা হত। জাকেরীনদের যে কেউ আছর থেকে মাগরিবের পূর্বে আসত, এই খতম পড়ায় শামিল হয়ে যেত। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা ইশার নামাযের আজানের মুনাজাতে হাত তুলে দোয়া করতেন। আজানের দোয়া (বিস্তৃতভাবে) উক্ত মুনাজাতে আদায় করে একসঙ্গে ছওয়াব রেছানীর মুনাজাত শেষ করতেন।

            তিনি উনার পীর ছাহেব কিবলা স¤পর্কে অনেক ঘটনা বর্ণনা করতেন। একবার তিনি বলেন : প্রত্যেক লোকের কথা বলার একটি নিয়ম আছে। আমার পীর ছাহেব কিবলা যখন “আল্লাহ” নাম উচ্চারণ করতেন, তিন বলতেন আল্লাহ পাক। তিনি উনার কথাবার্তায় শুধু ‘আল্লাহ’ না বলে, বলতেন ‘আল্লাহ-পাক’ সেই নিয়ম আমিও মেনে চলি।
            তিনি বলেন : আমার পীর ছাহেব ক্বিবলা (ন’হুযূর কেবলা) ছিলেন মাদারজাদ ওলী। তিনি প্রথম জীবনে অত্যন্ত জালালী তবীয়তের ছিলেন। সচরাচর লোক উনার নিকটে ঘেষত না ভয়ে। যদি কারো আচার আচরণে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন, তৎক্ষণাৎ তার ক্ষতি হয়ে যেত। আমি উনার মুরীদ হওয়ার পর দেখতে পেলাম তিনি ইলমে মারেফাতের এক বিরাট সমুদ্র, এত সব নিয়ামত নিয়ে বসে আছেন, অথচ লোক উনার জালালিয়তের কারণে যথোপযুক্তভাবে উপকৃত হতে পারছে না, আমি উনার নিকট আর্জি পেশ করলাম তিনি যেন এই জালালী ভাব জামালী ভাবে রূপান্তরিত করেন। অত:পর তিনি জামালী ভাব ধারণ করেন। এখন লোকজন উনার মুরীদ হয়ে উনার ফয়েজ তাওয়াজ্জুহ হাসিল করছেন।

            হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাহবুব মুরীদ, জনাব মুজিবুর রহমান ছাহেব (তিনি তদানিন্তন সরকারী খাদ্য দপ্তরের সহকারী পরিচালক ছিলেন) বলেন : হযরত ন’ হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাড়ীতে অবস্থান কালে (এ বাড়ীতে তিনি দীর্ঘদিন বসবাস করেছিলেন। পরে এ বাড়ীতে উনার ছাহেবজাদা হুজ্জাতুল্লাহ ছাহেবকে রেখে তিনি ফুরফুরা শরীফ চলে যান।) হযরত মাওলানা ওয়াজিহুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে অত্যন্ত মহব্বত করতেন এবং সব সময় উনার নিকটে বসাতেন। ইহা দেখে উনার অনেক পুরাতন মুরীদ উনাকে ঈর্ষা করতেন।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার সম্মানিত পীর ছাহেব, হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জালালীয়ত স¤পর্কে বলেন : একবার কোন এক মজলিসে মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি সহ হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বসেছিলেন। এ সময় একটি জ্বীন আকাশ পথে উনাদের মস্তকের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি তা লক্ষ্য করেও কিছু বললেন না। হযরত ন’হুযূর ক্বিলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নজরে আসা মাত্র তিনি উক্ত জ্বীনের প্রতি জালালী নজরে দৃষ্টিপাত করেন। অমনি জ্বীনটি পুড়ে ছাই হয়ে উনাদের দু’জনের স¤মুখে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উক্ত জ্বীনের আত্মীয় স্বজনও এসে গেল। উক্ত জ্বীনের আত্মীয় স্বজন মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার নিকট এ কাজের বিচার প্রার্থনা করল। মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন : বাবা, তুমি এ কি করলে? আমি ত উক্ত জ্বীনটিকে দেখেছিলাম, কিন্তু আমি ত কিছু বলি নি। হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন : সে এত বড় বেয়াদব যে, মুজাদ্দিদে যামান বসে আছেন, আশে পাশে সে আর জায়গা পেল না, ঠিক উনার মাথার উপর দিযে উড়ে যেতে সাহস করল। এজন্য আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উক্ত জ্বীনের আত্মীয় স্বজনকে বললেন: জলদি দূর হও, নতুবা তোমাদেরকেও আমি শেষ করব। অত:পর মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি উপস্থিত জ্বীনদেরকে কোন মতে সান্ত¦না দিয়ে আশŸস্ত করে বিদায় দিলেন।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা বলেন : প্রথম প্রথম আমার নিজেরও জালালী অবস্থা ছিল। কারো স¤পর্কে মনে একটু কিছু আসলে তার ক্ষতি হয়ে যেত। লোহারপুল মসজিদে একবার একটা লোক আমার সঙ্গে কর্কস ব্যবহার করল। আমি মনে মনে ভাবলাম, এই লোকটা কেন অকারণে আমার সঙ্গে কর্কস ব্যবহার করল। কয়েকদিন পর দেখা গেল, লোকটি পাগল হয়ে গেছে, আর সুস্থ হয়নি। অত:পর আল্লাহ পাক আমার এই ভাব পরিবর্তন করে দিলেন।
            হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাশফ ও কারামত স¤পর্কে যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : একবার হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কিছু সঙ্গী নিয়ে কোন এক কবরস্তানের নিকট দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন, কবর থেকে ধোঁয়া নির্গত হতে দেখে তিনি কাশফুল কুবুর মোরাকাবায় বসেন। সেখানে তিনি লক্ষ্য করেন, একটি কবরে আজাব হচ্ছে। তিনি আল্লাহ পাক উনার দরবারে আবেদন করতে থাকেন, যেন উক্ত লোকটিকে আজাব থেকে মুক্তি দেয়া হয়। আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে ইলহাম হলো, সে ত শেরেক করেছে। তিনি তারপরও আবেদন করতে থাকেন : আয় আল্লাহ পাক ! আপনি ত রহমান রহীম, শেরেক করলেও ত আপনি তাকে ক্ষমা করতে পারেন। হযরত ন’হুযূর কিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি নাকি এরূপ সংকল্প নিয়েছিলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত লোকটাকে আজাব থেকে মুক্তি দেয়া না হবে, তিনি মুনাজাতের হাত নামাবেন না। অনেকক্ষণ পরে নাকি ইলহাম হলো : তোমার খাতিরে তাকে আজাব থেকে মুক্তি দিলাম। এদিকে উপস্থিত লোকজন দেখতে পেলেন, হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি মুনাজাতের হাত সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত উপরে তুলে আছেন, আর উনার সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে অনবরত ঘাম ঝরছে। কারো সঙ্গে তিনি কোন কথাও বলছেন না। সঙ্গীগন অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। এ সময় তিনি মুনাজাত শেষ করে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন।

            তিনি বলেন, হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : ঢাকার হাইকোর্টের পাশে তিন নেতার যিয়ারত করতে গেলাম। এই তিন নেতা হচ্ছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক ও খাজা নাজিমুদ্দীন। দেখতে পেলাম এ,কে, ফজলুল হক ছাহেব ও খাজা নাজিমুদ্দীন ছাহেবের অবস্থা ভাল। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী ছাহেব আটকা পড়ে গেছেন। আল্লাহ পাক উনার দরবারে অনেক আবেদন নিবেদন করে তাকে কোন মতে ছাড়িয়ে নিলাম। সোহরাওয়ার্দী ছাহেব নাকি উনার দূর স¤পর্কীয় আত্মীয় হতেন।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : প্রথম জীবনে হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি খুব পান খেতেন। মুযাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে এত পান খেতে নিষেধ করেন। অত:পর তিনি পান খাওয়া বন্ধ করে দেন। কিন্তু কিছদিন পর পূণরায় পান খাওয়া শুরু করেন। মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি এ স¤পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন: নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, বাবা, তুমি পান খাওয়া বন্ধ করলে কেন? আমি আপনার নিষেধের কথা বললাম। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন : বাবা, তুমি পান খাও, বন্ধ করো না। অত:পর তিনি উনার পিতাকে বলেন : এখন আমি কি আপনার কথা মানব, নাকি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-উনার কথা মানব? মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন : ঠিক আছে, বাবা, তুমি পান খাও।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন : মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বড় বড় খলীফাদের উপস্থিতিতে একবার বললেন : আল্লাহ পাক আমাকে যে নিয়ামত দিয়েছিলেন, তা থেকে আমি মাত্র চার আনা দিয়ে যেতে পারলাম, বাকী বার আনা নিয়ে বোধ হয় আমাকে কবরে যেতে হবে। কারণ লোক পেলাম না এসব নিয়ামত দেয়ার মত। সে মজলিসে হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহিও ছিলেন। তিনি তখন অল্প বয়স্ক। শুনে তিনি খুব দু:খিত হলেন। তিনি নিজ মনে মনে আক্ষেপ করে বললেন : আমরা অনুপযুক্ত হওয়ার কারণেই ত তিনি নিয়ামত অর্পন করে যেতে পারছেন না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন দেখা যাক কি ভাবে উপযুক্ত হওয়া যায়। অত:পর তিনি জঙ্গলে চলে গেলেন। উনার আ¤মাজান চিন্তা করতে লাগলেন, ছেলেটির কি হল, কোথায় গেল। কিন্তু মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি-উনার মনে কোন চিন্তা নেই। তিনি বলেন: আামার ছেলে জীবিত, সে আমার থেকে ফয়েজ নিচ্ছে, তা আমি টের পাচ্ছি। তোমরা তার জন্য কেউ চিন্তিত হয়ো না। দীর্ঘ দিন পরে তিনি জঙ্গল থেকে ফিরে আসলেন। কিন্তু বাড়ীতে এসে এক স্থানে আত্মগোপন করে রইলেন। মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি শুয়ে ছিলেন। হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি লুকিয়ে থেকে উনার পায়ের উপর ইত্তেহাদী ফয়েজ ছাড়লেন। মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি টের পেয়ে গেলেন এবং বললেন : কার সাহস আমার পায়ের উপর ফয়েজ ছাড়া? তোমরা দেখ তো কচি (হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ডাক নাম) এসেছে কিনা? সবাই খুঁজে উনাকে বের করল। তখন উনার চূল, নখ বড় হয়ে গেছে। অত:পর উনাকে নখ, চূল কেটে নতুন কাপড় পরিয়ে প্রকৃতিস্থ করা হলো। এর পর থেকে হযরত ন’ হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পিতা ও মুর্শিদ, হযরত মুজাদ্দিদে যামান রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার সঙ্গে ছায়ার ন্যায় থাকতেন।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার মুর্শিদ ক্বিবলা উনাকে অতিশয় মহব্বত করতেন। এমনকি উনার ছাহেবযাদাদেরকেও যথেষ্ট তা’জীম তাকরীম করতেন। হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বড় ছাহেবযাদা হযরত বাকী বিল্লাহ ছিদ্দিকী রহমতুল্লাহি আলাইিিহ উনার সাথে উনার খুব বেশী আন্তরিকতা ছিল। হযরত ন’হুযুর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাহবুব মুরীদ জনাব মুজিবুর রহমান ছাহেব বলেন : একবার হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার অনুপস্থিতিতে হযরত বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি কিছুটা আর্থিক অসুবিধায় ছিলেন। তখন উনার ঢাকা মাদ্রাসা আলীয়ায় পরীক্ষার ফীস দিতে অসুবিধা হচ্ছিল। যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার তখন দু’টি দোকান ছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ দোকান দু’টি বিক্রয় করে উনার মুর্শিদ ক্বিবলা উনার ছাহেবযাদা উনার ফীসের টাকা দিয়ে দেন। পরবর্তীতে হযরত বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি ফুফুরাহ শরীফ চলে যান। যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার শেষ জীবনে হযরত বাকী বিল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি একবার ফুফুরাহ শরীফ থেকে ঢাকা এসেছিলেন, তখন যাত্রাবাড়ীর খানকা শরীফে এসে খানকাহ শরীফ সংলগ্ন মসজিদে ওয়াজ নসীহত করেছিলেন।
            হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খুলাফা ও মুরীদানদের মধ্যে যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা ছিলেন বাংলাদেশে সর্বশ্রেষ্ঠ খলীফা। যখন উনার সুনাম চতুর্দ্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং চতুর্দিক থেকে আলেম ফাজেল, ইংরেজী শিক্ষিত অসংখ্য লোক উনার মুরীদ হতে লাগলেন তখন উনার অনেক পীরভাই উনাকে ঈর্ষার চোখে দেখতে লাগলেন। এজন্য যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি মাঝে মাঝে আফসোস করে বলতেন : তারা কেন আমাকে ঈর্ষা করে আমি জানি না। আল্লাহ পাকের নিয়ামত আল্লাহ পাক যাকে চান তাকে দেন, সকলকে দেন না। তিনি প্রায় বলতেন : আল্লাহ পাক জিচ্কো চাহতা, ছপ্পর ফাটকে দেতা। তিনি শোকরিয়া স্বরূপ বলতেন, তিনি উনার মুর্শিদ ক্বিবলা থেকে যেসব নিয়ামত লাভ করেছেন, তা গণনা ও হিসাব করে শেষ করা যাবে না।
            এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, যাত্রবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বড় হুযূর ক্বিবলা অর্থাৎ ফুরফুরা শরীফের তৎকালীন গদীনশীন পীর, কাইয়ূমে যামান, হযরত মাওলানা আবদুল হাই ছিদ্দিকী রহমতুল্লাহি আলাইহিও খিলাফত দিয়েছিলেন। তবে উনার প্রধান পীর ছাহেব ছিলেন হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি। সেজন্যই শাজরা শরীফে উনার পীর ছাহেব দু’জন দেখানো হয়েছে। বড় হুযূর ক্বিবলাও উনাকে অত্যন্ত মহব্বত করতেন। বড় হুযূর ক্বিবলা ঢাকা মিরপুর দারুস সালামে যখন ওয়াজ মাহফিল করতেন, তখন নামাযের ইমামতি যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনাকে করতে হত। একবার মাহফিলে ইশার নামাজের সময় নামাযের প্রস্তুতি নেয়া হলো। যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি কোন কারণে সেদিন মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন না। বড় হুযূর কিবলা বললেন: মাওলানা ওয়াজিহুল্লাহ ছাহেব কোথায়? লোকেরা বলল : তিনি মাহফিলে নেই। তখন বড় হুযূর ক্বিবলা বললেন : মাওলানা ওয়াজিহুল্লাহ ছাহেবকে খোঁজ করা হোক। তিনি যেখানে আছেন সেখান থেকে আনতে হবে। তিনিই নামায পড়াবেন। তিনি নাকি ভাবাবেগে বলেছিলেন : মাওলানা ওয়াজিহুল্লাহ নামায না পড়ালে আমি মনে শান্তি পাই না। অত:পর জামায়াত স্থগিত রাখা হলো। গেন্ডারিয়া লোহারপুল গিয়ে হযরত মাওলানা ওয়াজিহুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি (যাত্রাবাড়ীর পীর ছাহেব ক্বিবলা) উনাকে বাসা থেকে নিয়ে আসা হলো। তিনি এসে উপস্থিত হলে, তিনিই নামায পড়ালেন।
            জনাব মুজিবুর রহমান ছাহেব বর্ণনা করেন : যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, লোহার পুল থাকতে একবার ১৬/১৭ জন জ্বীন উনার নিকট মুরীদ হয়েছিল।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি ঈদে মীলাদুন্নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিছাল শরীফ উনার তারিখে (এগারই শরীফ), হযরত খাজা আজমীরি রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার বিছাল শরীফ উনার তারিখে, শবে বরাত, শবে মি’রাজ ইত্যাদি উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান পরিচালিত করতেন। এই সব অনুষ্টানের তারিখে প্রায়ই সারারাত জিকির আজকার, ওয়াজ নসীহত চলত। লোহার পুল মসজিদে একবার এইরূপ এক অনুষ্ঠানে (খুব সম্ভব এগারোই শরীফের অনুষ্ঠান ছিল) সাইয়্যেদ ফজলে হাসান নামে যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার এক অল্প বয়স্ক মুরীদ মাইকের সামনে যাওয়ার জন্য হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তখন কিন্তু ওয়াজ হচ্ছিল না, জিকির আজকার চলছিল। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা অনুমতি দিলেন। সাইয়্যিদ ফজলে হাসান (উনার বয়স তখন ১৫/১৬ বছর হতে পারে) মাইকের সামনে গিয়ে সবাইকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন : এইমাত্র বড় পীর হযরত গাওছে পাক সাইয়্যিদ আবদুল কাদের জিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি আমাকে কাশফের মাধ্যমে জানালেন, “তোমার পীর ছাহেব মুজাদ্দিদে যামান। এই কথা মাইকের মাধ্যমে সবার মধ্যে ঘোষণা করে দাও।” যেহেতু আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেজন্য আমি মাইকের সামনে এসে তা ঘোষণা করলাম।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব কিবলা উনার ছওয়াব রেছানীর মুনাজাত অত্যন্ত হƒদয়-গ্রাহী ছিল। ছওয়াব রেছানীর যে নিয়ম পদ্ধতি ফুরফুরা শরীফের সিলসিলায় চালু ছিল, তাই তিনি এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গীতে উপস্থাপন করেছিলেন। হযরত পীর ছাহেব কেবলা কোরআন শরীফের তফসীরে মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী হাসিল করেছিলেন। তিনি পবিত্র কোরআন শরীফের আলোকে ছওয়াব রেছানীর বিশেষ ফায়দা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নি¤œ উনার অভিমত প্রদত্ত হলো :-
            মহান আল্লাহ পাক ছদকা বা দান-খয়রাত প্রসঙ্গে কোরআন শরীফের ৩য় পারার সুরা বাকারার ২৬১ নং আয়াত শরীফে ইরশাদ মুবারক করেন :-
مَثَلُ الَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ كَمَثَلِ حَبَّةٍ اَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ
فِىْ كُلِّ سُنْبُلَةٍ مِئَةُ حَبَّةٍ - وَ اللهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَّشَاءُ - وَ اللهُ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ -
অর্থাৎ -- যারা আল্লাহ পাক উনার পথে ধন স¤পদ ব্যয় করে তাদের উদাহরণ সেই শষ্যদানার মত যা থেকে উৎপন্ন হয় সাতটি শীষ, প্রত্যেক শীষে একশতটি করে দানা উৎপন্ন হয় (অর্থাৎ মোট সাত শতটি হয়) আর আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা, এর থেকেও বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ পাক অতি প্রশস্ত ও সর্বজ্ঞানী।
            এই আয়াত শরীফে দানের ফজিলত স¤পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। তফসীরকারকগণ এখানে আল্লাহ পাক উনার পথ বলতে সকল প্রকারের নেক কাজকেই বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ যে কোন নেক কাজে ধন স¤পদ দান করা বা কোন ইবাদতের ছওয়াব দান করা আল্লাহ পাক উনার পথে দান করার সামিল। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন -- নামায, রোজা, জিকরুল্লাহ আল্লাহ পাক উনার পথে দান করলে তাও সাত শত গুণ বেড়ে যায় (মসনদে ইমাম আহমদ, তফসীরে ইবনে কাছীর) সুতরাং কেউ যদি তার জীবনের সমস্ত ফরজ, ওয়াজীব, সুন্নত, নফল, মোস্তাহাব ইত্যাদি নেক কাজের ছওয়াবসমূহ আল্লাহ পাক উনার পথে দান করে, তবে তার প্রতিদানও উপরোক্ত আয়াত শরীফ মোতাবেক হবে।
            এখন যদি কেউ তার নেক আমল হতে একটি ছওয়াব আল্লাহ পাক উনার পথে দান করে, তবে পূর্ব-বর্ণিত আয়াত শরীফ অনুযায়ী দানকারীর আমল নামায় ৭০০ গুণ অর্থাৎ ৭০০ ছওয়াব জমা হবে। আর এই প্রথম বারের ৭০০ ছওয়াব সে যদি পূণরায় দান করে, তবে দ্বিতীয় বার সে ৭০০ ঢ ৭০০ = ৪,৯০,০০০ ছওয়াব পাবে। এভাবে বার বার দান করলে প্রতবারে সে পূর্ব ছওয়াবের কমপক্ষে ৭০০ গুণ বেশী প্রতিদান পেতে থাকবে।
            তৃতীয়বার দান করলে ৪,৯০,০০০ ঢ ৭০০ = ৩৪,৩০,০০০০০ (চৌত্রিশ কোটি ত্রিশ লক্ষ) ছওয়াব পাবে। কেউ যদি তার জীবনের সমস্ত ছওয়াব দান করে, তবে সে প্রথমবার ৭০০ জীবনের ছওয়াব পাবে। এরূপ যতবার দান করবে, ততবারই উপরোক্ত হারে প্রতিদান পেতে থাকবে।
এখানে লক্ষণীয় যে, আয়াত শরীফ অনুযায়ী এটা কমপক্ষের হিসাব। আর আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা এর অপেক্ষা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। কারণ আল্লাহ পাক এর চেযেও প্রশস্ত এবং সর্বজ্ঞানী।
            ফিকাহের কিতাবে আছে যে, কোন মানুষ তার জীবনের সমস্ত ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মোস্তাহাব ও নফল ইবাদতের ছওয়াব অপরের নামে বখশিয়ে দিলে তা জায়েজ হবে (বাহরে শরীয়ত) সুতরাং কেউ যদি তার জীবনের সমস্ত ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, নফল, মোস্তাহাব ইত্যাদি নেক কাজের ছওয়াব সমূহ আল্লাহ পাকের পথে দান করে, তবে তার প্রতিদানও উপরোক্ত আয়াত শরীফ অনুযায়ী হবে। আর এই ছওয়াব জীবিত, মৃত সকলকেই দান করা যায়। ছওয়াব রেসানীর মাধ্যমে গোণাহগার লোকের গোণাহ মাফ হয়। বুযুর্গ লোকদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নবী রসুলগণ ও ওলীআল্লাহগণ যদিও কোন ছওয়াব রেসানীর মোহতাজ নন, ছওয়াব রেসানীর ফলে উনাদের নেক নজর ও দোয়া পাওয়া যায়।
            উপরোক্ত ছওয়াবের হিসাব কোরআন পাক উনার নির্ভরযোগ্য তফসীর ও হাদীছ শরীফের ভিত্তিতে যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার ইজতিহাদী অভিমত, যা কারো পক্ষে অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি সেজন্য বলতেন : কোন নেক কাজ আমি আমার নিজের জন্য রাখিনা। সব বন্টন করে আমি খালী হয়ে থাকি। উনার মুনাজাতের মাধ্যমেও আল্লাহ পাক উনার দানের এই প্রশস্ততার বহি:প্রকাশ দেখা যায়। যিকিরের পর ছওয়াব রেসানীতে তিনি অনেক লম্বা মুনাজাত করতেন। তিনি এভাবে ছওয়াব রেসানীর মুনাজাত করতেন :-
            আয় আল্লাহ পাক, আমরা দোয়া-দরূদ, তসবিহ-তাহলিল, ছালাত, ছাওম ইত্যাদি যা কিছু পড়েছি এবং জীবনে যত ফরজ-ওয়াজেব, সুন্নত, নফল ইবাদত করেছি, তাতে যা কিছু ভূল ত্রুটি হয়েছে আপনার রহমতের দ্বারা মাফ করে, এর অশেষ ছওয়াব মঞ্জুর করুন। সেই ছওয়াব সর্বপ্রথম আমাদের প্রাণের আঁকা তাজেদারে মদীনা, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূরে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খেদমত মোবারকে পৌঁছে দিন। এর ছওয়াব উনার আল ও আওলাদ, আজওয়াজে মোতাহহারাত, ছাহাবায়ে কেরাম, আহলে বায়ত, রিদওয়ানুল্লাহে তায়ালা আলাইহিম আজমাইন গণ উনাদের খেদমত মোবারকে পৌঁছে দিন।
            এর ছওয়াব তামাম আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামগণের পাক আরওয়াহ মোবারকে পৌঁছে দিন।
            এর ছওয়াব তামাম ছিদ্দিকীন, শোহাদা, ছালেহীন, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, আই¤মায়ে মোজতাহেদীন, মোহাদ্দেছীন, মোফাসসেরীন, ফোকাহা গণের পাক আরওয়া মোবারকে পৌঁছে দিন।
            এর ছওয়াব তামাম আই¤মায়ে তরীকত, পীরানে তরীকত, খাছ করে কাদেরীয়া, চিশ্তীয়া, নকশেবন্দীয়া, মোজাদ্দেদীয়া, সাবেরিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, বায়জেদিয়া, কলন্দরিয়া, উয়াইসিয়া, মালামাতিয়া, সাজেলিয়া এবং মুহ¤মদীয়া তরীকার সমস্ত ইমাম ও উনাদের সকলের মুরীদীন, মু’তাকেদীন, মুহেব্বীন, মুতায়াল্লেকীন ও খোলাফাদের পাক আরওয়াহ মোবারকে পৌঁছে দিন।
            এর ছওয়াব সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত জ্বীন ও ইনসানের মধ্যে যত মোমেনীন, মোমেনাত, মোসলেমীন মোসলেমাত ইন্তেকাল করেছেন, এখন রয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত আসবেন, উনাদের সকলের পাক আরওয়াহ মোবারকে এবং আমল নামায় পৌঁছে দিন।
            এর ছওয়াব আমাদের সকলের পিতামাতা, ভাইবোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী, মামা-মামী, ফুফা-ফুফু, চাচা-চাচী, Ÿশুর-শাশুড়ী, পীর-ওস্তাদ, দোস্ত-আহবাব, পাড়া-প্রতিবেশী, জীবিত এবং মৃত সমস্ত মুমীন জ্বীন-ইনসানের পাক আরওয়াহ মোবারকে পৌঁছে দিন। খাছ করে এই সমস্ত ছওয়াবের হাদিয়া আমাদের প্রাণের মামদুহ পীর ছাহেব ক্বিবলার আমলনামায় পৌঁছে দিন। এর ছওয়াব উনার সমস্ত আওলাদগণ, আছহাবগণ, আজওয়াজগণ, সমস্ত মুরীদীন, মোতাকেদীন, মুহেব্বীন, মুতাআল্লেকীন ও খোলাফাগণের আরওয়াহ মোবারক ও আমলনামায় পৌঁছে দিন। খাছ করে এর সমস্ত ছওয়াব আমাদের প্রাণের আঁকা, আপনার প্রিয় হাবিব, তাজেদারে মদীনা, আখেরী রাসুল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খেদমত মোবারকে হাদিয়া হিসাবে পৌঁছে দিন।”
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার অভিমত, সর্বশেষে যাঁর উপর ছওয়াব রেসানী হবে, উনার উপর সবচেয়ে বেশী ছওয়াব পৌঁছবে। আমরা যেহেতু নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসি, তাই আমাদের সমস্ত জীবনের ছওয়াবগুলি উনাকে প্রথমে ও শেষে হাদিয়া পাঠাই। এর ওসীলায় আল্লাহ পাক আমাদের দোয়াগুলিকেও কবূল করবেন, ইনশাআল্লাহ।
            ছওয়াব রেসানীর পর উনার মুনাজাত আরো অনেক লম্বা হতো, যা এখানে উল্লেখ করা হলো না। উপরোক্ত দোয়া থেকে বুঝা যায় হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা কতটুকু প্রশস্ততার সঙ্গে ছওয়াব রেসানীর দোয়া করতেন এবং আল্লাহ পাক উনার অফুরন্ত রহমতের উপর উনার কতটুকু আস্থা ছিল।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রায়ই আল্লাহ পাক উনার ইশ্ক-মহব্বতে গরক থাকতেন। অনেকক্ষণ পর পর এক নাগাদে স্বত:স্ফূর্তভাবে “আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ” বলতেন। এর মধ্যে কোন কৃত্রিমতা ছিল না। ইহা ছিল অন্তর থেকে উৎসারিত আবেগের স্বত:স্ফূর্ত বহি:প্রকাশ। প্রায়ই নিম্নের ফার্সি শে’র সমূহ অত্যন্ত আবেগের সাথে সুন্দর সুমিষ্ট স্বরে আবৃত্তি করতেন :-
            তু জান্নাত্রা বনে কা’দে মানে বদ্রা বদোজখ-বর,
             কে বছ বাসাদ মরা আঁজা তামান্নায়ে বেছালে তু।”
অর্থাৎ : আয় আল্লাহ পাক ! আপনি জান্নাত আপনার নেককার বান্দাদেরকে দিয়ে দিন এবং আমি বদকারকে দোজখে দিয়ে দিন। আমার জন্য এতটুকইু যথেষ্ট যে, আমি দোজখে বসে আপনার মিলনের আকাঙ্খা করতে থাকব।

            না উকবারা দোস্ত দারাম, না দুনিয়ারা খরিদারম,
 মরা চীজে নামি বায়াদ বজুজ দীদারে ইয়া আল্লাহ।”
অর্থাৎ : আমি আখেরাতকে দোস্ত রাখি না এবং দুনিয়ারও খরিদদার নই। আয় আল্লাহ পাক ! আমি আপনার দীদার ব্যতীত অন্য কিছুই চাই না।
            খুররম আঁ রোজেকে জি মনজিল বিরাঁ মিরাওয়াম,
 রাহাতে জাঁ তলবম, আজ পায়ে জাঁ না মিরাওয়াম।”
অর্থাৎ : আমি ঐ দিন খুশী হব, যেদিন এই বিরান দুনিয়া হতে প্রেমাস্পদ (আল্লাহ পাক)-উনার দিকে চলে যাব।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাকীকী আশেক ছিলেন। সুন্নতের পূর্ণ অনুসারী ছিলেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মহব্বত স¤পর্কে প্রায়ই ওয়াজ নসীহত করতেন। তিনি এই উর্দ্দু কবিতাটি প্রায়ই আবৃত্তি করতেন :-

            সব্ছে বড়া দরবার, দরবারে মুহ¤মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
 সব্ছে বড়া ছরকার, ছরকারে মুহ¤মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
 ইয়ে দরবার, দরবারে মুহ¤মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম),
             ইয়ে ছরকার, ছরকারে মুহ¤মদ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
            যাত্রাবাড়ী খানকা শরীফে হুযূর ক্বিবলা উনার হুজরা শরীফ উনার দেয়ালে উপরোক্ত পংক্তি কয়টি এখনও লিপিবদ্ধ আছে।
            যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি গেন্ডারিয়া-লোহারপুলে অবস্থানকালে পবিত্র হজ্ব সমাপন করেছিলেন (সম্ভবত: ১৯৭২-৭৩ ইংরেজী সনে) হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করে বিভিন্ন বিচিত্র অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা বলেন : “পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা অনুযায়ী পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মসজিদে হারামে (বায়তুল্লাহ শরীফে) প্রত্যেক নেক কাজের ছওয়াব পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় এক লক্ষ গুণ বেশী এবং পবিত্র মদীনা শরীফে মসজিদে নববী শরীফে পঞ্চাশ হাজার গুণ বেশী। সেই হিসাবে এ উভয় স্থানে এক রাকাত নফল নামায পড়লে যথাক্রমে এক লক্ষ রাকাত ও পঞ্চাশ হাজার রাকাত নফল নামাযের ছওয়াব হয়। ফরয নামাযের ফযিলত সকল নামাযের উপরে। সেই জন্য আমি হজ্বে গেলে এই উভয় স্থানে অন্যান্য নফল নামায অপেক্ষা ফরয ওমর কাযা বেশী বেশী আদায় করেছি, যাতে এই নামায ফরযের পরিপূক হয়।”
            তিনি যখন পবিত্র উহুদের ময়দানে যান, ভাবাবেগে আত্মহারা হয়ে যান। দীর্ঘক্ষণ সেখানে মুনাজাত করতে থাকেন। মনে মনে আল্লাহ পাক উনার নিকট আরজী পেশ করেন : আয় আল্লাহ পাক ! অপনার হাবীব, আমাদের প্রাণের আঁকা, এই উহুদের ময়দানে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তরঞ্জিত হয়ে ছিলেন। উনার পবিত্র দান্দান মোবারক শহীদ হয়। আমি জানিনা কোন্ দাঁত মুবারকটি উনার শহীদ হয়েছিলেন। হযরত উয়ায়েস করণী রহমতুল্লাহি আলাইহি আপনার হাবীব উনার মহব্বতে উনার সমস্ত দাঁত মুবারকগুলি নিজ হাতে উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি জানতে পারেন নি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কোন্ দাঁত মুবারকটি শহীদ হয়েছিলেন। আমি আপনার হাবীব উনার একজন দুর্বল উ¤মত। আপনার মেহেরবাণী দ্বারা হয়ত আমাকে জানিয়ে দিন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কোন দাঁত মুবারকটি শহীদ হয়েছিলেন, নতুবা উনার যে দাঁত মুবারকটি শহীদ হয়েছিলেন, আমার সেই দাঁতটি ছিন্ন করে দিন। মুনাজাতের মধ্যে এইভাবে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করতে থাকলে, উনার মুখ মুবারক থেকে একটি কাঁচা দাঁত উনার হাতের মধ্যে পড়ে যায়। সে দাঁত মুবারকটি তিনি উহুদের ময়দানে দাফন করে দেন।
            তিনি যখন পবিত্র মদীনা শরীফে রওজা পাক যিয়ারতে যান, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার নিজের পবিত্র হাতে হুযূর ক্বিবলার মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দেন। হুযূরের এক আশেক মুরীদ (উনার নাম জনাব মনসুর ছাহেব ; তিনি তখন সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন) উনার সঙ্গে ছিলেন। জনাব মুজিবুর রহমান ছাহেব (যিনি হযরত ন’হুযূর কিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ ছিলেন এবং পরে যাত্রাবাড়ীর হযরত পীর ছাহেব কিবলা উনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন)-উনার বর্ণনা অনুযায়ী মনসুর ছাহেব এই ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছিলেন।
            ১৯৭৬ ইংরেজী সনের অক্টোবর মাসে হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা লোহার পুল মসজিদ, গেন্ডারিয়া থেকে স্থানান্তরিত হয়ে যাত্রাবাড়ীতে একটি নুতন বাড়ীতে খানকাহ শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বাড়ীর জায়গা ছিল যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে একটু পশ্চিমে মেইন রোডের পাশে। ইহা প্রথমে একটি ডোবা (পানিপূর্ণ নীচূ জায়গা) ছিল, যার মালিক ছিলেন পার্শবর্তী বাড়ীর একজন ডাক্তার। সেই ডাক্তার ছাহেব হুযূর ক্বিবলার একজন আশেক মুরীদ ছিলেন। তিনি উক্ত জায়গা হুযূর ক্বিবলাকে হাদিয়া দেন। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা এই জায়গায় মাটি ভরাট করান। অত:পর সেখানে পাইলিং করে মসজিদ, খানকা শরীফ এবং নিজ পরিবার নিয়ে আবাসস্থল নির্মান করেন। দীর্ঘদিন এ নির্মানের কাজ চলেছিল। বিল্ডিং কনষ্ট্রাকশনের কাজে হুযূর ক্বিবলার অনেক মুরীদ কারিগর ছিলেন। তাছাড়া অন্যান্য অনেক মুরীদান স্বেচ্ছাকৃতভাবে ছওয়াব লাভের আশায় এ কাজে কায়িক শ্রম দিতেন। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার হুযরা শরীফ মসজিদের দক্ষিন পার্শে মসজিদের এইরূপ সংলগ্ন করে নির্মান করা হয়েছিল যে, হুযরা শরীফ থেকে মসজিদে শুধু এক কদমে প্রবেশ করা যায় এবং হুযরা শরীফ উনার দরজা জানালা খুললে মসজিদের মুছল্লী দেখা যায়। হুযরা শরীফ উনার দক্ষিণ পাশের্Ÿ একই কমপাউন্ডের মধ্যে পারিবারিক আবাসস্থল তৈরী করা হয়। কমপাউন্ডের মধ্যে মসজিদের স¤মুখে একটি বড় পানির হাউজ করা হয়, যেথানে ওযূ করা হত। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলার বর্ণনা অনুযায়ী, উনার হুযরা শরীফ নূরে মুজাসসাম, হাবিবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হুজ্রা শরীফ এবং মসজিদে নববী শরীফ উনার অবস্থানের সুন্নত পালনার্থে ঐরূপ করে নির্মান করা হয়েছে। হুজ্রা শরীফে একটি চৌকি একটি টেবিল ছিল। স¤মুখে খোলা জায়গা ছিল, যেখান ২০/২৫ জন লোক বসা যেত। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা চৌকির উপর বসতেন, অথবা উত্তর-দক্ষিনে লম্বমান চৌকিতে কেবলামুখী হয়ে শুতেন। তখন কোন কোন মুরীদান উনার পা মুবারক ও শরীর মুবারক দাবাতেন। কোন লোক বাইয়াত হতে হলে এখানেই বাইয়াত করা হত। যাত্রাবাড়ীতে আসার পর হুযূর ক্বিবলা মাদ্রাসা আলীয়ার শিক্ষকতার চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই হুযরা শরীফে বসেই তিনি তা’লীম তালকীন দিতেন, ওয়াজ নসীহত করতেন, মুরীদগণের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। সাপ্তাহিক যিকির আযকার মসজিদে অনুষ্ঠিত হত।
            হজরত পীর ছাহেব ক্বিবলা বলতেন : আল্লাহ পাক উনার ওলীগণ আল্লাহ পাক উনার মহব্বতে বিভিন্ন হালে থাকেন। কোন কোন সময় ফয়েজ, যজ্বা ও হালের চাপ শরীরের উপর প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাবের কারণে শরীর ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তখন অন্য কেউ শরীর দাবালে ইহা প্রকৃতিস্থ হয়। আবার এর মাধ্যমে মুরীদগণ পীরের ফয়েজ তাওয়াজ্জুহও পেয়ে থাকে।        কাজেই সাধারণ লোকের চোখে দৃষ্টিকটু হলেও এতে ফায়দা রয়েছে।
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা বিভিন্ন সময় অনেক সূক্ষ¥ বিষয়ে আলোচনা করতেন। যেমন একবার তিনি উল্লেখ করেন: পবিত্র হাদীছ শরীফে এসেছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মর্মে ইরশাদ মুবারক করেন : তিনটি জিনিষ আমার নিকট প্রিয় করা হয়েছে -- স্ত্রীলোক, সুগন্ধী এবং নামাযের মধ্যে চোখের শীতলতা। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যা এভাবে করেন যে, আল্লাহ পাক উনার হাবীব আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে ওহী আসার কারণে শারীরিক ভাবে প্রভাবিত হতেন। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে, শীতের দিনে ওহী আসতে থাকলে উনার ঘাম মুবারক নির্গত হতো, কোন বাহনে থাকা অবস্থায় ওহী নাযিল হতে থাকলে বাহন বসে যেত, এ অবস্থায় কোন লোকের সাথে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাঁটু লাগা থাকলে ওহীর প্রভাব সে লোকের শরীরেও প্রচন্ডভাবে অনুভূত হতো। এই অবস্থায় যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উ¤মাহাতুল মোমেনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, তখন তিনি স্বাভাবিক হতেন এবং আরাম বোধ করতেন। আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা অনুযায়ী ‘নামায মু’মিনের মি’রায” মিরায শরীফে গিয়ে আল্লাহ পাক উনার হাবীব আল্লাহ পাক উনাকে দর্শন করেছেন। চোখ দিয়ে দেখা হয়। সুগন্ধীর দ্বারা আধ্যাত্মিক আকর্ষন বাড়ে। কাজেই সুগন্ধি মেখে তিনি যখন নামাযে দাঁড়াতেন, তখন মি’রাযের অনুরূপ আল্লাহ পাক উনার দর্শনের কারণে উনার চক্ষু মুবারক শীতল হতো অর্থাৎ তিনি আরাম বোধ করতেন।
হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা অন্য এক সময় বলেন : কারো কারো মতে আনুষ্ঠানিকভাবে নবুয়তের পূর্বে সত্য স্বপ্নের ধারাবাহিকতা একাদিক্রমে ৬ মাস অবধি হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি একটি হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেছেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেছেন : সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ছেচল্লিশ অংশের এক অংশ (বুখারী শরীফ) কোন কোন আলেম এর ব্যাখ্যায় বলেন : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুষ্ঠানিক নবুয়তের সময়কাল ছিল ২৩ বৎসর। উনার নবুয়ত-পূর্ব সত্য স্বপ্নের ধারাবাহিকতা ছিল ৬ মাস। স্ইে হিসাবে সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ।
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা যাত্রাবাড়ী খানকা শরীফ মসজিদে প্রতি জুমুয়া বারে খোতবা দেওয়ার পুর্বে বসে খোত্বার বিষয় বস্তুর উপরে আলোচন করতেন।
            তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ শরীফ প্রতিষ্ঠা করেছেন। যাত্রাবাড়ী খানকা শরীফে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকার পাগলা বাজারের সন্নিকটে একটি বিরাট মহল্লা তিনিই নামকরণ করেছেন “শাহী মহল্লা” সেখানে তিনি সাধারণ কবরস্তান, মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে মসজিদ সংলগ্ন উনার পারিবারিক কবরস্তান রয়েছে। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার মাযার শরীফও এই পারিবারিক কবরস্তানেই রয়েছেন। এই মহল্লায় হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার অনেক মুরীদ বাড়ী ঘর করে বসবাস করছেন। ত¤মধ্যে হযরত ন’হুযূর ক্বিবলা উনার এক মাহবুব মুরীদ, অশিতিপর, প্রবীন বৃদ্ধ এবং হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার অতিশয় মহব্বতের লোক, জনাব মুজিবুর রহমান ছাহেব, তদানিন্তন সহকারী খাদ্য পরিচালক, এখানে বাড়ী করে সপরিবারে বসবাস করতেন (কয়েক বছর পূর্বে তিনি ইনতিকাল করেছেন)
            তাছাড়া হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার খানকা শরীফে মুরীদগণ সমবেত হলে বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াজ নসীহত, আলাপ আলোচনা করতেন। কোন কোন সময় রাজনৈতিক বিষয়েও আলোচনা করতেন। রাজনৈতিক বিষয়সমূহেও উনার গভীর জ্ঞান ছিল।
            তিনি বলতেন : কেবল চালাক চতুর হলেই টাকা পয়সা, রিযিক দওলত হাছিল করা যায় না, ইহা আল্লাহ পাক উনার দান। এ ব্যাপারে তিনি একটি লোকের উদাহরণ দিতেন। লোহার পুলের নিকটে কোন এক ধনী লোক এতই অশিক্ষিত এবং কম জ্ঞানের লোক ছিল যে, বাতাসকে বাসাত বলত। আর নিজের টাকা পয়সার গণনা সঠিক ভাবে জানত না। কিন্তু সে অগণিত টাকা পয়সার মালিক হয়েছিল। তার কর্মচারিরাই টাকা পয়সার হিসাব কিতাব করত। তাই তিনি বলতেন “আল্লাহ জিছকো চাহতা হ্যায়, ছপ্পর ফাটকে দেতা হ্যায়” আল্লাহ পাক যাকে চান, ছপ্পর ফেটে হলেও দেন।
            তিনি মুরীদগণকে সব সময় রিয়াজত মোশাক্কাতের জন্য উৎসাহ দিতেন। তিনি বলতেন : আগের যামানায় বড় বড় ওলী আওলিয়া হয়েছেন, এখন আর হতে পারবে না, এটা কোন কথা নয়। যে চেষ্টা করবে সেই লাভ করবে। হযরত বড় পীর ছাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত খাজা আজমিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, এই সমস্ত মহান বুযুর্গগণ অপেক্ষা বড় ওলীআল্লাহ আর কেউ হতে পারবেন না, এই ধরণের কথা কোথাও লেখা নেই। তিনি মনে করতেন চেষ্টা তদবীর ও আল্লাহ পাক উনার খাছ রহমত হলে উনাদের অপেক্ষাও বড় ওলীআল্লাহ হওয়া সম্ভব।
            তিনি সব সময় মুরীদগণকে উচ্চ সাহস দিতেন। তিনি বলতেন : ইমামতি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত। সুতরাং নামাযের ইমামতি করতে ভয় করতে নেই। তিনি বলতেন : আমাদের সিলসিলা হক সিলসিলা। আমার পীর ও মুর্শিদ ক্বিবলা (ন’হুযূর ক্বিবলা) সুলতানুল আরেফীন। কাজেই যাঁরা উনার খাদেম এবং কায়েম মকাম উনাদের শানও অতি উর্দ্ধে।
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা অত্যন্ত কর্মব্যস্ত জীবন অতিবাহিত করেছেন। তিনি যখন মাদ্রাসা আলীয়ায় শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, তখন একদিকে মাদ্রাসা আলীয়ার দায়িত্ব, অপরদিকে মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব, আবার মুরীদ মোতাকেদদের তা‘লীম তালকীন, যিকির আযকার, বিভিন্ন মাহফিলে ওয়াজ নসীহত, লোকের বিভিন্ন তদবিরে, যেমন, তাবিজ, ঝাড়-ফুঁক, বাইয়াত করা, ইত্যাদির জন্য প্রতি দিন শত শত লোকের সঙ্গে সাক্ষাত উনার দৈনন্দিন জীবনের রুটিন ছিল। তিনি বলতেন : আমি মাদ্রাসায় যাওয়ার সময শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া পসন্দ করতাম, কেননা ডাল দিয়ে ভাত খেতে খুব কম সময় লাগে। কারণ কর্মব্যস্ততা এত বেশী ছিল যে, পাঁচ মিনিট সময় বেশী ব্যয় করার অবকাশ ছিল না। তবে যাত্রাবাড়ী খানকা শরীফে আসার পর থেকে এই কর্মব্যস্ততা কিছুটা লাঘব হয়। কেননা শিক্ষকতার কাজ থেকে তিনি তখন অবসর গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু অল্পদিন পরেই তিনি ডায়বেটিস রোগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার শেষ বয়সে টয়লেটে পড়ে উনার মাথা মুবারক ফেটে যায়। আবার অপর এক সময় সিটে বসার সময় পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে যায়। ক্রমে উনার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যায় এবং তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। বেশ কিছুদিন তিনি টেবিলে বসে নামায পড়তেন। নীচে বসে নামায পড়তে পারতেন না। এ সময় মসজিদে ইমাম রাখা হয়েছিল এবং সাপ্তাহিক যিকির উনার খলীফাগণ পরিচালনা করতেন।
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা হিজরী ১৪১৫ সনে, ১২ই জিলকদ শরীফ, রোজ বৃহি®পতিবার সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে ( ১৩ই এপ্রিল, ১৯৯৫ ঈসায়ী, ৩০শে চৈত্র, ১৪০১ বাংলা) ঢাকা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে বিছালি শান মুবারক প্রকাশ করেন।

হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার বিছালী শান মুবারক প্রকাশের পূর্বের ও পরের ঘটনা নি¤œ প্রদত্ত হলো :-
            বিছালি শান মুবারক প্রকাশের পূর্বের দিন (বৃধবার দিবাগত) রাত্রে হুযূর ক্বিবলা হুযরা শরীফের দক্ষিন দিকের কক্ষে শায়িত ছিলেন। সচরাচর এখানেই তিনি রাত্রে থাকতেন। তিনি দেয়ালের দিকে ফিরে শুয়েছিলেন। রাত্র ৯ টায় উনার বড় ছাহেবযাদা মুহ¤মদ রিদওয়ান ছাহেব উনার নিকটে গেলে তিনি হঠাৎ দেয়ালের দিক থেকে এ পাশে ফিরে বললেন : রিদওয়ান ! আগামী কাল আমার জানাযা পড়ার জন্য লোকজনকে সংবাদ দিয়ে আয়। জনাব রিদওয়ান ভাই ছাহেব ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সেখান থেকে চলে আসেন। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, বাবা কেন এরূপ কথা বলছেন ! আধা ঘন্টা পরে তিনি পূণরায় উনাকে দেখতে গেলেন। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা তখনও দেয়ালের দিকে ফিরে শুয়েছিলেন। রিদওয়ান ভাই ছাহেব আবার উনার নিকটে গেলেন, হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনাকে দেখেন নি, কিন্তু হঠাৎ এ পাশে ফিরে আবার বললেন: কি রিদওয়ান ! কালকে আমার জানাযায় আসার জন্য লোকজনকে খবর দিয়ে এসেছিস? এবারও রিদওয়ান ভাই অপ্রস্তুত হয়ে কিছু না বলে সেখান থেকে সরে আসলেন। রিদওয়ান ভাই ছাহেব আধ ঘন্টা পরে আবার উনার আব্বাজান ক্বিবলাকে দেখতে গেলেন। এবারও তিনি দেয়ালের দিকে ফিরে শুয়েছিলেন। কিন্তু রিদওয়ান ভাই ছাহেব সেখানে উপস্থিত হওয়া মাত্র তিনি এ পাশে ফিরে গেলেন এবং রাগ করে ভৎস্যনার স্বরে বললেন: কি, তোকে আমি বার বার বলছি লোকজনকে খবর দেয়ার জন্য, তুই এখনও খবর দিস নি? এতক্ষণ উনার কোন অসুস্থতার লক্ষণই প্রকাশ পায় নি। রাত্র ১১টার সময় হঠাৎ উনার জিসিম মুবারকের বাম দিকে ব্যথা শুরু হলো। রাত্র ১২টায় ডাক্তার আসল। ডাক্তার উনাকে দেখে বললেন : উনার হার্টের সমস্যা হয়েছে। উনাকে অনতিবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। অত:পর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের এম্বুলেন্স আসল। তখন তিনি পূর্ণ হুঁশের অবস্থায় ছিলেন। তিনি ওজু করে জামা পরলেন এবং রাত্র ১ টায় উনাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে ইমার্জেন্সি ইউনিটে অক্সিজেন ইত্যাদি দিয়ে রাখা হলো। তখনও উনার হুঁশ ছিল। ডাক্তার উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন : আপনার এখন কেমন লাগছে? তিনি বললেন : কোন অসুবিধা নেই। আমি ভাল আছি।
            সকাল বেলা উনাকে দেখার জন্য লোকজনের সমাগম হলো। সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে উনার শŸাস প্রশŸাস বেড়ে গেল। কিন্তু তখনও তিনি সংজ্ঞা হারান নি। বেলা ১০ টা ৪৫ মিনিটে তিনি উত্তর দিকে মাথা রেখে নিজে নিজে ক্বিবলামুখী হয়ে শুলেন। উনার স¤মুখে উনার ভায়েরা ইঞ্জিনিয়ার গোলাম রসুল ছাহেব উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা শব্দ করে “আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ” উচ্চারণ করলেন। আর সে সময় উনার প্রাণ-বায়ূ বের হয়ে গেল। ইঞ্জিনিয়ার ছাহেব সে সময় এই আয়াত শরীফ পড়ছিলেন :
يَا اَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ارْجِعِىْ اِلَى رَبِّكِ الرَّاضِيَةً مَّرْضِيَّةً ، فَادْخُلِىْ
فِىْ عِبَادِىْ وَ ادْخُلِىْ جَنَّتِىْ - 
(অর্থ : হে প্রশান্ত আত্মা ! তোমার প্রতিপালকের দিকে সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে যাও, আর আমার বান্দাদের (দলে) দাখিল হও এবং আমার বেহেশ্তে প্রবেশ কর।)
اِنَّا لِلَّهِ وَ اِنَّ اِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ -
 (আমরা আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং উনারই দিকে আমাদের প্রত্যাবর্তন)
            সেদিন উনার জানাযা অনুষ্ঠানের পর উনাকে শাহী মহল্লায় মসজিদ সংলগ্ন নির্দিষ্ট স্থানে দাফন মুবারক করা হয়।
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিছালি শান মুবারক প্রকাশের তিন মাস পরে উনার মাযার শরীফের অভ্যন্তরে পানি উঠে যায়। উনার মুরীদগণের মধ্যে কেউ কেউ স্বপ্নে দেখেন, তিনি উনার জিসিম মুবারককে আরো উঁচূ করে কবরস্থ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। অনেক বাদ প্রতিবাদের পরে উনার মাযার শরীফ উম্মুক্ত করা হয়। দেখা গেল উনার কাফন মুবারক সহ জিসিম মুবারক অবিকৃত আছেন। উনার মাথা মুবারকের দিক থেকে এক অপূর্ব আতরের সুঘ্রাণ আসতে থাকে। উনার এক আশেক মুরীদ উনার হাঁটুর নিচের কাফনের কিয়দাংশ উ¤েমাচন করেন। দেখা গেল উনার জিসিম মুবারক হলুদ বর্ণ তৈলাক্ত অবস্থায় অবিকৃত আছেন, যা চিকচিক করছিলেন। তিন মাস পরেও এর কোন বিকৃতি ঘটে নি। অত:পর মাযার শরীফকে আর একটু উঁচূ করে উনার জিসিম মুবারক রাখা হয়। উনার মাযার শরীফ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডে পাগলা বাজার এলাকায় শাহী মহল্লায় অবস্থিত। নিকটে একটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা ও একটি সাধারণ লোকদের কবরস্তান রয়েছে।

হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পরিবার পরিজন
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার দুই সংসার ছিলেন। ঢাকা যাত্রাবাড়ী খানকা শরীফ সংলগ্ন আবাসস্থলে উনার বড় আহলিয়া (বড় পীর আ¤মাজান) উনার সন্তান সন্ততি নিয়ে বাস করতেন। এ সংসারে উনার ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে। এক মেয়ে, যিনি মাওলানা হোসাইন ছাহেবের আহলিয়া ছিলেন, বিছালী শান মুবারক প্রকাশ করেছেন। এ সংসারের বড় ছাহেবজাদা জনাব মুহ¤মদ রিদওয়ান ছাহেব বর্তমানে গদীনশীন। হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দ্বিতীয় আহলিয়া (ছোট পীর আ¤মাজান) হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার গ্রামের বাড়ীতে নানুপুর, চাঁদপুর (কুমিল্লা)তে বসবাস করতেন। এ সংসারে উনার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে।
            প্রতি মাসে এক সপ্তাহ হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা দেশের বাড়ীতে থাকতেন। সেখানেও খানকা শরীফ ও মসজিদ মাদ্রাসা ইত্যাদি ছিলেন। মাসের অবশিষ্ট দিন ঢাকায় যাত্রাবাড়ী খানকা শরীফের বাড়ীতে তিনি অবস্থান করতেন।
            সাধারণ লোক দ্বিতীয় বিবাহ করলে দ্বিতীয় আহলিয়াকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু এই দিক দিয়ে হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা ছিলেন স¤পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি বড় পীর আ¤মাজান ও উনার সন্তান সন্ততিগণ সহ ঢাকায় থাকতেন। আর ছোট পীর আ¤মাজানকে উনার সন্তান সন্ততিগণ সহ দেশের বাড়ীতে রাখতেন।

হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খোলাফা ও মুরীদান:
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার অনেক মুরীদ মোতাকেদ রয়েছেন এবং অনেক খলীফা এখনও বর্তমান আছেন।
            হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা উনার প্রধান খলীফা বর্তমানে রাজারবাগ শরীফ উনার হযরত পীর ছাহেব ক্বিবলা, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীকত, ইমামুল আই¤মা, মুহ্ইস সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, গাউছুল আ’যম, ইমামে আ’যম, হুজ্জাতুল ইসলাম, ছাহিবু সুলত্বানিন নাছীর, জাব্বারিউল আউয়াল, কাবিউল আউয়াল, আছ-ছাফফাহ, সাইয়্যিদুল আওলিয়া, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা, হযরত ইমামুল উমাম আল হাসানী ওয়াল হুসাইনী ওয়াল কুরাঈশী আলাইহিস সালাম।
অন্যান্য খলীফাগণের মধ্যে জগন্নাথ কলেজের ভূতপূর্ব ভাইস প্রিন্সিপাল প্রফেসার জহুরুল ইসলাম ছাহেব (তিনি ইন্তেকাল করেছেন), হুযূর ক্বিবলার বড় জামাতা, মাওলানা হোসাইন আহমদ ছাহেব ও হুযূর ক্বিবলার মেজো জামাতা, প্রফেসার দেলওয়ার হোসেন ছাহেব এবং মাওলানা আবদুল মান্নান ছাহেব (কিছুদিন পূর্বে তিনিও ইনতিকাল করেছেন) এতদ্ব্যতীত আমভাবে আরো অনেক খলীফা ও মুরীদ আছেন। হযরত পীর ছাহেব কিবলা উনার অত্যন্ত মাহবুব মুরীদের মধ্যে জনাব মুজিবুর রহমান ছাহেব, যিনি শাহী মহল্লায় হুযূর কেবলার মাযারের পাশে বাড়ী করে বসবাস করছিলেন। তিনি মূলত: ন’হুযুর কেবলার মুরীদ ছিলেন, পরে হযরত পীর ছাহেব কেবলার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তিনি লোকজনকে বাইয়াত করতেন না, তবে একজন উচু দরজার কাশফধারী ওলী-আল্লাহ ছিলেন। কয়েক বছর পূর্বে তিনি ইনতিকাল করেছেন। তিনি ইনতিকালের পূর্বে বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন।
 সূত্র : লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, হযরত পীর ছাহেব কিবলা উনার বড় ছাহেবযাদা,
 জনাব মুহ¤মদ রিদ্বওয়ান ছাহেব ও জনাব মুজিবুর রহমান ছাহেবের মৌখিক বিবৃতি।


0 Comments: