ইসলামে ছোঁয়াচে নামে কোন রোগ নেই । ছোঁয়াচে রোগের বিশ্বাস করা কুফুরি ।

ইসলাম কি ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্ব অস্বীকার করে?



বৈজ্ঞানিক অসামাঞ্জস্য বিষয়ক অভিযোগের জবাব

আল্লাহর সৃষ্টি এ পৃথিবীতে নানা উপকারী নিয়ামতের পাশাপাশি আছে বহু রোগ-ব্যাধি, অসুখ-বিসুখ। ইসলাম বিরোধীরা দাবি করে যে, রোগ সংক্রমণ সম্পর্কে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর হাদিসের বক্তব্য বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। নাউযুবিল্লাহ !!! এ দাবি প্রমাণের জন্য তারা কিছু হাদিস দেখায়। ---

وَعَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: «لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ، وَيُعْجِبُنِي الفَأْلُ» قَالُوا : وَمَا الفَألُ ؟ قَالَ: «كَلِمَةٌ طَيِّبَةٌ»
হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিততিনি বলেনআল্লাহর  হুযুর পাক () বলেছেন, ‘‘রোগের সংক্রমণ ও অশুভ লক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে শুভ লক্ষণ মানা আমার নিকট পছন্দনীয়।”
[লোকেরা] বললশুভ লক্ষণ কী?
তিনি বললেনউত্তম বাক্য।’’ [1]
 আমরা দেখছি যে এ হাদিসে বলা হচ্ছে রোগের সংক্রমণ(عدوى) বলতে কিছু নেই। এটা দেখিয়ে অনেকে বলতে চায় – আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানায় জীবাণুর বিস্তারের দ্বারা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রোগের সংক্রমণ ঘটে; কাজেই হাদিসের বক্তব্য সঠিক নয়। যারা এরূপ বলে, তারা আসলে অর্ধেক সত্য উপস্থাপন করে। আমরা যদি এ সংক্রান্ত আরো হাদিস সামনে আনি তাহলে দেখব যে, এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রোগের জীবাণু ছড়ায় না । 

হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেনহুযুরপাক () বলেছেনঃ সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই। কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই সফর মাসকেও অশুভ মনে করা যাবে না এবং পেঁচা সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত রয়েছে(هَامَّةَ) তাও অবান্তর। তখন এক বেদুঈন বললোহে আল্লাহর রাসুল (! আমার উটের পাল অনেক সময় মরুভূমির চারণ ভূমিতে থাকেমনে হয় যেন নাদুস-নুদুস জংলী হরিণ। অতঃপর সেখানে কোনো একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এসে আমার সুস্থ উটগুলোর সাথে থেকে এদেরকেও চর্মরোগী বানিয়ে দেয়। তিনি বললেনঃ প্রথম উটটির রোগ সৃষ্টি করলো কে? তার মানে , সংক্রমক বা ছোঁয়াচে নামে কোন রোগ নেই । 
মা‘মার রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেনযুহরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেনঅতঃপর এক ব্যক্তি হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে বর্ণনা করেনতিনি হুযুরপাক() উনাকে বলতে শুনেছেনঃ রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের সাথে একত্রে পানি পানের জায়গায় না আনা হয়।’’ ... [2]

“…কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকোযেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো।” [3]

এক উট থেকে অন্য উটে রোগের জীবাণু সংক্রমিত হয় না । এ ছাড়া কুষ্ঠ রোগীর নিকটে গেলে এর জীবাণু সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা নেই। [4] উপরের হাদিসগুলোতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই” 

আমরা আরো একটি হাদিস দেখতে পারি—
যখন তোমরা কোন্ অঞ্চলে প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শোনতখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান করসেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না।” [5]  
প্লেগ রোগ কখনও কাফির মুশরিকদের উপর গযব আকারে এসেছে আবার মহামারী আকারেও এসেছে । তাই বলে প্লেগ কোন ছোঁয়াচে রোগ নয় ।  
কতই না উত্তম ও কার্যকর একটি ব্যবস্থা। মহামারী আক্রান্ত অঞ্চল থেকে রোগীরা যদি বেরিয়ে না যায় এবং সে অঞ্চলে যদি বাইরে থেকে লোক না আসে, তার মানে এই নয় যে রোগ এটা কোন ছোঁয়াচে রোগ । 
 হাদিস শরীফে  “সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই” ? এর উত্তর হাদিসের মূল বক্তব্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে।
পূর্বে উল্লেখিত সুনান আবু দাউদ ৩৯১১ নং হাদিসে সাহাবীগণ যখন এক উটের সংস্পর্শে অন্য উটের রোগাক্রান্ত হবার ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন, তখন হুযুরপাক (ﷺ) বললেন, “প্রথম উটটির রোগ সৃষ্টি করলো কে?”
অর্থাৎ এই রোগের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন আল্লাহ। যখন কেউ রোগাক্রান্ত ছিল না, তখন এই রোগ তিনি সৃষ্টি করেছেন। প্রথম রোগাক্রান্ত প্রাণী তো কারো নিকট থেকে সংক্রমণের শিকার হয়নি।  আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সুস্থ রাখেন, যাকে ইচ্ছা রোগাক্রান্ত করেন। বিষয়টি তাকদিরের সাথে সম্পর্কিত। [6] সাধারণ পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিও এটাই বলে যে – জীবাণু সংক্রমিত হওয়া মানেই রোগ সংক্রমিত হওয়া না। জীবাণু সংক্রমিত হলেও অনেক সময়েই মানুষ রোগাক্রান্ত হয় না। যেমনঃ বসন্ত রোগীর সংস্পর্শে থাকলে কেউ কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়, আবার কেউ কেউ আক্রান্ত হয় না। আলোচ্য হাদিসটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা থাকলে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবার আর কোনোই সুযোগ থাকে না। এ হাদিসের প্রেক্ষাপট হলোঃ জাহেলী যুগে আরবের মানুষদের ধারণা ছিলো রোগ নিজে নিজেই অন্য দেহে সংক্রমণ করে। এই ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করে হুযুরপাক (ﷺ) তাদেরকে জানালেন - ব্যাপারটি মোটেও এমন নয়। আর সব কিছুর মতো রোগ-ব্যাধিরও স্রষ্টা মহান আল্লাহ। তাঁর পক্ষ থেকেই রোগ অবতীর্ণ হয়। রোগের নিজে নিজে সংক্রমিত হবার কোনো ক্ষমতাই নেই। [6.1]


“....সুতরাং যদি জানা যায় যেকোন বস্তু সংঘটিত হওয়াতে সঠিক কারণ রয়েছেতাহলে তাকে কারণ হিসাবে বিশ্বাস করা বৈধ। কিন্তু নিছক ধারণা করে কোন ঘটনায় অন্য বস্তুর প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করা ঠিক নয়।  হুযুরপাক () বলেছেন, “অসুস্থ উটের মালিক যেন সুস্থ উটের মালিকের উটের কাছে অসুস্থ উটগুলো নিয়ে না যায়।” সুস্থ উটগুলো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয়ে হুযুরপাক () এ রকম বলেছেন।
হুযুরপাক () আরো বলেনঃ “সিংহের ভয়ে তুমি যেমন পলায়ন করকুষ্ঠ রোগী দেখেও তুমি সেভাবে পলায়ন কর।” আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হুযুরপাক () কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।  হুযুরপাক () সতর্কতা অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।” (সূরা বাক্বারাহ ২:১৯৫)
যদি বলা হয় যেঃ--- হুযুরপাক () যখন বললেনরোগ সংক্রামিত হয় নাতখন একজন লোক বললহে আল্লাহর রাসূল ()! মরুভূমিতে সম্পূর্ণ সুস্থ উট বিচরণ করে। উটগুলোর কাছে যখন একটি খুজ্‌লিযুক্ত উট আসেতখন সব উটই খুজ্‌লিযুক্ত হয়ে যায়। তিনি বললেনপ্রথম উটটিকে কে খুজ্‌লিযুক্ত করল?
উত্তর হলঃ--- হুযুরপাক () এর উক্তি “প্রথমটিকে কে খুজ্‌লিযুক্ত করল?” এর মাধ্যমেই জবাব দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগের জীবাণু অসুস্থ ব্যক্তির নিকট থেকে সুস্থ ব্যক্তির নিকট গমণ করে থাকে। তাই আমরা বলব যেপ্রথম উটের উপরে সংক্রামক ব্যতীত আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগ নাযিল হয়েছে। কোন ঘটনার পিছনে কখনো প্রকাশ্য কারণ থাকে। আবার কখনো প্রকাশ্য কোন কারণ থাকে না। প্রথম উট খুজ্‌লিযুক্ত হওয়ার পিছনে আল্লাহর নির্ধারণ ব্যতীত অন্য কোন কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় উট খুজ্‌লিযুক্ত হওয়ার কারণ যদিও জানা যাচ্ছেতথাপি আল্লাহ চাইলে খুজ্‌লিযুক্ত হত না। তাই কখনো খুজলিতে আক্রান্ত হয় এবং পরবর্তীতে ভা্লোও হয়ে যায়। আবার কখনো মারাও যায়।একই ঘরের কয়েকজন আক্রান্ত হয়। কেউ মারা যায় আবার কেউ রেহাই পেয়ে যায়। মানুষের উচিৎ আল্লাহর উপর ভরসা করা। বর্ণিত আছে যে, ‘একজন কুষ্ঠ রোগী লোক হুযুরপাক () উনার কাছে আসলেন। তিনি তার হাত ধরে বললেনআমার সাথে খাও।’ আল্লাহর উপর তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও ভরসা থকার কারণেই তিনি তাকে খানায় শরীক করেছিলেন। ...” [7]

এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হুযুরপাক (ﷺ) যে যুগের মানুষ ছিলেন, সে যুগে পুরো পৃথিবী ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিভিন্ন প্রকার কুলক্ষণ, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস সে যুগে প্রচলিত ছিল। জাহেলী যুগে আরবরা হাম্মাহ(هَامَّةَ) বলতে কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসকে বুঝে থাকতো। তাদের ধারণামতে ‘হাম্মাহ’ ছিল হুতুম পেঁচা যা গভীর রাতে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার পরিবারের লোকদেরকে ডাকাডাকি করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার উৎসাহ দেয়। তাদের কেউ কেউ ধারণা করত যে, নিহত ব্যক্তির আত্মা পাখির আকৃতি ধরে উপস্থিত হয়েছে। তৎকালিন আরবরা এ পাখির ডাককে কুলক্ষণ মনে করত। কারো ঘরের পাশে এসে এ পাখি ডাকলে তারা বিশ্বাস করত যে, সে মৃত্যু বরণ করবে।  আরবরা সফর মাসকে অপয়া মাস মনে করত। কোন জিনিস দেখে, কোন কথা শুনে বা জানার মাধ্যমে কুলক্ষণ মনে করাকে ‘ত্বিয়ারাহ’(طِيَرَةَ) বলা হয়। নবী(ﷺ) এর যুগে এই সমস্ত ভ্রান্ত জিনিস আরবরা বিশ্বাস করত। [8] যে হাদিসগুলো দেখিয়ে ইসলামবিরোধীরা বলতে চায় যে এগুলোতে ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে ‘ভুল’(!) তথ্য আছে, সেই হাদিসগুলোতেই প্রাচীন আরবদের এই সমস্ত কুসংস্কারের অপনোদন করা হয়েছে। ভুল তথ্য থাকা তো অনেক দূরের কথা, এই হাদিসগুলোতে কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এমনকি কুলক্ষণ বিশ্বাস করার মত জিনিসকে ইসলামে শির্ক বলে অভিহীত করা হয়েছে। [9] কিন্তু যাদের অন্তরে ব্যধি আছে, তাদের অন্তর এই হাদিসগুলো থেকে শুধু ভুল(!)ই খুঁজে বের করে।

অতএব হাদিসের বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, সংক্রমক বা ছোঁয়াচে নামে কোন রোগ নাই । রোগ হিসেবে যা আসে তা কাফিরদের জন্য গযব বা মহামারী ।   কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সফলকাম করেন, আর যাকে ইচ্ছা ব্যর্থ করে দেন।


তথ্যসূত্রঃ

[1]  সহীহ বুখারী ৫৭৭৬, সহীহ মুসলিম ৫৯৩৩-৫৯৩৪
[2]  সুনান আবু দাউদ ৩৯১১
[3]  সহীহ বুখারী ৫৭০৭

 আল্লাহর রাসুল(ﷺ) বলেন, ‘‘কিছুকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা শির্ক। কিছুকে কুপয়া মনে করা শির্ক, কিছুকে কুলক্ষণ মনে করা শির্ক। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার মনে কুধারণা জন্মে না। তবে আল্লাহ (তাঁরই উপর) তাওয়াক্কুল (ভরসার) ফলে তা (আমাদের হৃদয় থেকে) দূর করে দেন।’’ [মুসনাদ আহমাদ ১/৩৮৯, ৪৪০, আবু দাউদ ৩৯১২, তিরমিজী, ইবন মাজাহ, ইবন হিব্বান, হাকিম প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ ৪৩০]