দাড়ি ও গোঁফের আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া ( ১ নং )

দাড়ি ও গোঁফের আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া
গবেষণা কেন্দ্র- মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ
সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উনার এবং অসংখ্য দুরূদ ও সালাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফেরফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামায ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরয নামাযের পর মুনাযাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইনজেকশন নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহর নামাযে বা অন্যান্য সময় পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর ত্রয়োদশ ফতওয়া হিসাবে দাড়ি ও গোঁফের শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।
সৃষ্টির সেরা মানুষ তবে .......
সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন উনার দরবারে, যিনি অসংখ্য মাখলূকাতের মধ্যে একমাত্র মানব জাতিকে তথা মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদা দান করেছেন, অর্থাৎ আশরাফুল মাখলূকাতকরেছেন। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন উনার পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
لقد كر منا بنى اذم.
অর্থ : আমি বনী আদম তথা মানবজাতিকে সম্মানিত করেছি।
কিন্তু কথা হলো- শুধু মানুষ বা আশরাফুল মাখলূকাতহিসাবে সৃষ্টি হওয়াই কি কামিয়াবী বা সফলতা? কখনো নয়। কারণ, যদি তাই হতো তবে আবূ জাহিল, আবূ লাহাব জাহান্নামী হতোনা, কেননা তারাও মানুষ ছিল।
মূলতঃ মানব জাতির আশরাফিয়াততখনই বজায় থাকবে, যখন সে মহান আল্লাহ পাক উনার বিধানের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আনুগত্যতা প্রকাশ করবে। আর যদি এর বিপরীত হয়, তবে সে হবে মাখলূকাতের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। আর তাই এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لقد خلقنا الا نسان فى احسن تقويم ثم رددناه اسفل سافلين الا الذين امنوا وعملوا الصالحات- (سوره طين)
অর্থ : নিশ্চয়ই আমি মানব জাতিকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদেরকে জাহান্নামের অতল তলে পৌঁছিয়ে দিব, একমাত্র তাদেরকে ব্যতীত, যারা ঈমান আনবে এবং নেক আমল করবে।” (পবিত্র সূরা ত্বীন শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, মানব জাতির মধ্যে যারা মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন ইসলাম উনার ব্যাপারে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত ভিত্তিক আক্বীদাহ পোষণ করবে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস মুতাবিক আমল করবে, একমাত্র তারাই আশরাফিয়াত বা শ্রেষ্ঠত্ব তথা পূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারবে। এছাড়া শুধুমাত্র আক্বল-বুদ্ধি, ধন-দৌলত, বংশ মর্যাদা দ্বারা কখনোই কামিয়াবী বা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করা সম্ভব নয়। আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انا خلقناكم من ذكروانثى وجعلناكم شعوبا وقبائل لتعارقوا ان اكر مكم عند الله اتقاكم.
অর্থ : নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন মহিলা হতে সৃষ্টি করেছি এবং একজন আরেক জনের পরিচয় লাভের জন্যে বিভিন্ন গোত্রে ও বংশে বিভক্ত করেছি। (তবে) নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট সবচেয়ে বেশী সন্মানিত, যে ব্যক্তি অধিক মুত্তাক্বী বা পরহেজগার।” (পবিত্র সূরা হুজরাত শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৩)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হওয়ার শানে নুযূল সম্পর্কে বলা হয় যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন মক্কা শরীফ কাফিরদের কবল হতে মুক্ত করলেন, তখন হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে কাবা শরীফ উনার মধ্যে আযান দেয়ার নির্দেশ দিলেন। দ্বীন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন, হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পবিত্র কাবা শরীফ উনার মধ্যে আযান দিলে কেউ কেউ বলতে লাগলো যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আর কোন লোক পেলেন না? তিনি একজন হাবশী, কৃতদাস হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে আযান দিতে বললেন? উনার চেয়েও তো সুন্দর আকৃতির, উত্তম বংশীয় লোক ছিল। ঠিক তখনই মহান আল্লাহ পাক উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করে জানিয়ে দিলেন যে, মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট উত্তম আকৃতি, উত্তম বংশ ইত্যাদির কোনই মূল্য নেই, যদি তার মধ্যে তাক্বওয়া বা পরহেযগারী না থাকে।
অতএব, উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও শানে নুযূলের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, যদি কেউ কামিয়াবী তথা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই তাক্বওয়া অর্জন করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তাক্বওয়াকি? মুত্তাক্বী কাকে বলে এবং কি করে মুত্তাক্বী হওয়া যাবে?
মূলতঃ হাক্বীক্বী তাক্বওয়া হলো- সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হওয়া। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসক উনাদের পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ করা। আর যে ব্যক্তি তা করবে, সে ব্যক্তিই হাক্বীক্বী মুত্তাক্বী বা পরহেযগার।
এখানে উল্লেখ্য যে, মহান রাব্বুল আলামীন, উম্মতে হাবীবী উনাদের জন্যে দ্বীন ইসলামক উনাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে যে,
اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الاسلام دينا.
অর্থ : আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম, তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সমাপ্ত করলাম এবং তোমাদের জন্যে পবিত্র ইসলাম উনাকেই দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম।” (পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩)
আর তাই মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন ঈমানদারগণকে লক্ষ্য করে ইরশাদ মুবারক করছেন যে,
 يا ايها الذين امنوا ادخلوافى السلم كافة ولا تتبعوا خطوات التيطان انه لكم عدومبين.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! দ্বীন ইসলামউনার মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর। শয়তানের পদানঙ্ক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয় শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, হাক্বীক্বী মুত্তাক্বী বা ঈমানদার হতে হলে- পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস তথা দ্বীন ইসলাম উনাকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে হবে। কেননা মহান আল্লাহ পাক তো বলেই দিয়েছেন,
وما اتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا.
অর্থ : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা আদেশ করেছেন, তা আঁকড়িয়ে ধর, আর যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তা থেকে বিরত থাক।” (পবিত্র সূরা হাশর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৭)
সুতরাং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা তথা উনার পরিপূর্ণ ইত্তেবা বা অনুসরণ করাই হচ্ছে হাক্বীক্বী তাক্বওয়া। কেননা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হচ্ছেন আতক্বা অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ মুত্তাক্বী। অতএব যারা উনার পুঙ্খানুপুঙ্খ ইত্তেবা বা অনুসরণ করবে, একমাত্র তারাই মুত্তাক্বী হিসাবে গণ্য হবে। আর এর বিপরীত যারা করবে, তাদের পক্ষে হাক্বীক্বী মুত্তাক্বী বা ঈমানদার হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
 عن انس بن مالك رضى الله عنه قال- جاء ثلاثة رهط الى ازاج النبى صلى الله عليه وسلم- يسئلون عن عبادة النبى صلى الله عليه وسلم-
فلما اخبروا بها كانهم تقالوها- ثم قال- اين نحن من النبى صلى الله عليه وسلم؟ قد غفرالله له ما تقدم من ذنبه وما تأخر- فقال احدهم- انا اصلى الليل ايدا ولا ارقد وقال الاخر انا اصوم الدهر ولا انطر وقال الاخر انا اعتزل النساء- فجاء النبى صلى الله عليه وسلم اليهم وقال انتم الذين قلتم كذا وكذا ثم قال- اما والله انى لا خشى كم لله واتقاكم له ولنى اصلى وارقد واصوم وافطر راتزوج النساء فذالك من سنتى من رغب عن سنتى فليس منى.
অর্থ : হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, (একবার) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইবাদত সম্পর্কে জানার জন্যে উম্মুল মুমিনীন উনাদের নিকট তিনজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা আসলেন। যখন উনাদেরকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইবাদত সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হলো, তখন উনারা ধারণা করলেন যে, উনার ইবাদতগুলো পরিমাণে কম। পরক্ষণে চিন্তা করে বললেন, আমরা উনার তুলনায় কোথায়? মহান আল্লাহ পাক তো উনার পূর্বের ও পরের সকল গুণাহখাতা ক্ষমা করেছেন, অর্থাৎ উনি মাছূম বা নিষ্পাপ। (কাজেই উনার অল্প ইবাদত করলেও চলবে, কিন্তু আমরা তো মাছূম নই, তাই আমাদের আরো বেশী ইবাদত করতে হবে।) সুতরাং উনাদের মধ্য হতে একজন বললেন, আমি (আজ থেকে) সারা রাত্র নামায পড়বো, ঘুমাবো না। দ্বিতীয়জন বললেন, আমি সারা বৎসর রোজা রাখবো, ভঙ্গ করবোনা।
তীয়জন বললেন, আমি স্ত্রীর নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাকবো। (এমন সময়) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লøাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের নিকট এসে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, তোমরা কি এরূপ কথা বলেছ? সাবধান! মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! তোমাদের চেয়েও আমি মহান আল্লাহ পাক উনাকে অধিক ভয় করি এবং আমি তোমাদের চেয়েও অধিক মুত্তাক্বী। (তারপরও) আমি রাত্রে নামায পড়ি ও ঘুমাই, রোযা রাখি আবার রাখিনা এবং আমি বিয়ে-শাদী করেছি। সুতরাং এগুলো আমার সুন্নত উনার অন্তর্ভূক্ত, যে ব্যক্তি আমার সুন্নত থেকে ফিরে যাবে, সে আমার উম্মত নয়।” (মিশকাত শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ভিত্তিতে দুটো বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ১। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হলেন, ‘আতক্বাঅর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ মুত্তাক্বী। ২। কেউ যদি হাক্বীক্বী মুত্তাক্বী হতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই প্রতি ক্ষেত্রে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। অর্থাৎ উনি যে দ্বীন তথা শরীয়ত নিয়ে এসেছেন, উক্ত দ্বীন বা শরীয়ত মোতাবেক চলতে হবে।
আর তাই মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ومن يبتغى غير الاسلام دينا فلن يقبل منه وهو فى الاخرة من الخاسرين.
অর্থ : যে ব্যক্তি ইসলামব্যতীত অন্য কোন ধর্ম তালাশ করবে, তার থেকে উহা কবুল করা হবেনা, বরং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮৫)
অতএব, কেউ যদি পরকালে ধ্বংস হতে নাযাত পেতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই দ্বীন ইসলাম উনার যে নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা রয়েছে, তা পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে হবে। এক কথায় সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিপূর্ণ ইত্তেবা বা অনুসরণ করতে হবে। আর তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
كل امة يدخلون الجنة الامن ابى قيل ومن ابى يارسول الله صلى الله عليه وسلم قال من اطعنى دخل الجنة ومن عصانى فقد ابى.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “আমার প্রত্যেক উম্মত জান্নাতে যাবে একমাত্র ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে আমাকে অস্বীকার করেছে। জিজ্ঞাসা করা হলো- কোন ব্যক্তি আপনাকে অস্বীকার করলো ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, যে ব্যক্তি আমাকে অনুসরণ- অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। আর যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করেছে অর্থাৎ আমাকে অনুসরণ-অনুকরণ করেনি সে ব্যক্তিই মূলতঃ আমাকে অস্বীকার করেছে।” (মুসলিম শরীফ)
অতএব, স্পষ্টই প্রমাণিত হলো যে, ইহকালীন ও পরকালীন সফলতা তথা মহান আল্লাহ পাক উনার ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি লাভ করতে হলে, দ্বীন ইসলাম অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসক উনাদের অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। কারণ, পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসক উনাদের অনুসরণ-অনুকরণ করার অর্থই হচ্ছে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অনুসরণ-অনুকরণ করা, যা মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের পূর্ব শর্ত। আর তাই মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন, উনার পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক ফরমান,   
قل انكمتم تحبون الله فاتبعونى يحبيكم الله وغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم.
অর্থ : হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি বলুন, তোমরা যদি মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভালবাসতে চাও, আমার ইত্তেবা কর। তবেই মহান আল্লাহ পাক তোমাদেরকে মুহব্বত করবেন এবং তোমাদের গুণাহসমূহ ক্ষমা করবেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩১)
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, মানুষ আশ্রাফুল মাখলূকাত সত্য কথাই, তবে এই আশ্রাফিয়তই নাযাত পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট নয়, বরং নাযাত পেতে হলে সর্ব প্রথম আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত ভিত্তিক ঈমান বা আক্বীদাহ পোষণ করতে হবে।
অতঃপর তাক্বওয়া অর্জন করতে হবে। আর তাক্বওয়া অর্জন করার একটাই পথ, তা হলো- সর্বক্ষেত্রে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদেরকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা। কাজেই দাড়ি ও গোঁফের ব্যাপারেও পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাকেই অনুসরণ করতে হবে।
মানুষ শ্রেষ্ঠ আকৃতির অধিকারী :
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন, মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলূকাতহিসাবে সৃষ্টি করার সাথে সাথে মানব জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সর্বোত্তম আকৃতি দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক নিজেই ইরশাদ মুবারক করেন যে,
لقد خلقنا الانسان فى احسن نقويم.
অর্থ : আমি মানুষকে সর্বোত্তম ছূরত বা আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি।
আবার পুরুষ ও মহিলা উভয়ের মধ্যে আকৃতিগত পার্থক্য বজায় রাখার জন্যে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন কিছুটা পার্থক্য রেখেছেন। তাছাড়া যেকোন প্রাণীই হোক না কেন, তাদের মধ্যে কোনটা পুরুষ আর কোনটা মহিলা, তা বুঝার একটি লক্ষণ বা আলামত নিশ্চয় রয়েছে। যেমন- সিংহের পুরুষের ঘাড়ে কেশর রয়েছে, কিন্তু সিংহীর ঘাড়ে কেশর নেই।
অতএব, অনুরূপ মানুষের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা পার্থক্য করার জন্যেও মহান আল্লাহ পাক বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন কিছু আলামত বা লক্ষণ দান করেছেন। তার মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য ও লক্ষণ হলো- দাড়ি ও গোঁফ। অর্থাৎ পুরুষকে দাড়ি ও গোঁফ দান করেছেন, কিন্তু মহিলাকে তা দেওয়া হয়নি। সুতরাং যাকে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটাই তার জন্যে সর্বোত্তম আকৃতি। অতএব, যে পুরুষ তার দাড়ি ও গোঁফ চেঁছে ফেললো বা কামিয়ে ফেললো, সে মহান আল্লাহ পাক উনার দেয়া সর্বোত্তম আকৃতিকে বিনষ্ট করলো। মূলতঃ মহান আল্লাহ পাক উনার দেয়া সর্বোত্তম আকৃতিকে বিকৃত করা ইবলিস শয়তানকে অনুসরণ-অনুকরণ করারই নামান্তর।
অভিশপ্ত ইবলিস শয়তানের অঙ্গীকার :
কারণ, মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যখন হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে সিজদা না করার কারণে ইবলিসের গলায় লানতের তবকা পরিয়ে জান্নাত থেকে বের করে দেন, তখন মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে ইবলিস যে অঙ্গীকার করেছিল, তা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
ولامرنهم فليغيرن خلق الله ومن يتخذ الشيطان وليا من دون الله فقد خسر خسرانا مبينا.
অর্থ : “(ইবলিস শয়তানের অঙ্গীকার) আর আমি তাদের (বান্দাদের) মহান মহান আল্লাহ পাক উনার সৃষ্টিকৃত আকৃতি পরিবর্তন বা বিকৃত করার আদেশ করবো। (মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন এ ব্যাপারে) যারা মহান আল্লাহ পাক ব্যতীত শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তারা প্রকাশ্য ক্ষতিগ্রস্থের অন্তর্ভূক্ত।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১৯)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় তাফসীরের কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে যে,


اور بھی تعلیم دونگا جس سے وہ اللہ تعالی کی بنائی ھر ئی صورت کو بیگارــ اور یہ اعمال ناسقی سے ھے جیسے دارھی مند انا ........... (تفسیر بیان القران ج2 صفہ 157)
অর্থ : “(ইবলিস বলেছিল) আমি আরো শিক্ষা দেব, যার কারণে তারা (মানুষেরা) মহান আল্লাহ পাক উনার সৃষ্টিকৃত আকৃতি পরিবর্তন করবে। মূলতঃ এটা ফাসিকী কাজের অন্তর্ভূক্ত। যেমন- দাড়ি মু-ন করা .........” (তাফসীরে বয়ানুল কুরআন ২য় জিঃ পৃষ্ঠা-১৫৭)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, দাড়ি ও গোঁফ চেঁছে ফেলা বা কামিয়ে ফেলা মূলতঃ ইবলিস শয়তানের আদেশ পালন করারই নামান্তর। উপরুন্ত আকৃতি বিকৃত বা পরিবর্তন হওয়ার কারণ, অর্থাৎ পুরুষের দাড়ি ও গোঁফ চেঁছে ফেলার কারণে মেয়ে লোকের সাদৃশ হয়ে যায়।
আকৃতি বিকৃত করার পরিণাম :
অথচ পুরুষের জন্যে মেয়ে লোকের আকৃতি ও মেয়ে লোকের জন্যে পুরুষের আকৃতি ধারণ করা শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন যে,
عن ابن عباس رضى الله عنه قال- لعن رسول الله صلى الله عليه وسلم المتشبهين من الرجال بالنساء والمتشبهات من النساء لالرجال. (بخارى شري)
অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঐ সকল পুরুষের প্রতি অভিসম্পাত (লানত) করেছেন, যারা মেয়ে লোকের আকৃতি ধারণ করে। অনুরূপ যে সকল মেয়ে লোক পুরুষের আকৃতি ধারণ করে, তাদের প্রতিও অভিসম্পাত বা লানত করেছেন।” (পবিত্র বুখারী শরীফ)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, পুরুষের জন্যে তার দাড়ি ও গোঁফচেঁছে ফেলা ইবলিস শয়তানকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা ও মেয়ে লোকের আকৃতি ধারণ করার নামান্তর, যা শরীয়তে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। উহা অমান্য করা আল্লাহ পাক উনার গযব বা লানত প্রাপ্তির কারণ।
হযরত লূত্ব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে ধ্বংস করার কারণ :
আর তাই দেখা যায়, মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পূর্ববর্তী অনেক ক্বওম বা গোত্রকে এ ধরণের অনেক অপকর্মের বা নাফরমানীর কারণে ধ্বংস করে দিয়েছেন। যেমন- ক্বওমে লূত্ব, ক্বওমে আদ, ক্বওমে ছামূদ ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
هجيناه من القرية التى كانت تعمل الخبائث.
অর্থ : আমি হযরত লূত্ব আলাইহিস সালাম উনাকে নাযাত দিয়েছি, আর উনার ক্বওম বা গোত্র যারা অপকর্মে লিপ্ত ছিল, উক্ত অপকর্মের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছি।” (পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৭৪)
মুফাসসিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় তাফসীরের কিতাবসমূহে উল্লেখ করেন,
 قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- عشرخصال عملتها قوم لوط بها هلكوا ....... وقص اللحية وطول الشارب- الخ (تفسير روح المعانى)
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে দশটি অপকর্ম বা নাফরমানীর কারণে হযরত লূত্ব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে ধ্বংস করা হয়েছিল, তার মধ্যে ... দাড়ি কাটা ও গোঁফ লম্বা করা, এ নাফরমানীও ছিল।” (তাফসীরে রুহুল মায়ানী)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, পুরুষের জন্যে দাড়ি ও গোঁফ চেঁছে ফেলা, আকৃতি বিকৃত হয়ে মেয়ে লোকের সাদৃশ হওয়ার কারণ। আর শয়তানের আদেশ মান্য ও মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ অমান্য হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ পাক উনার গযব বা লানত প্রাপ্তির কারণ। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, দাড়ি চেঁছে ফেলা ও গোঁফ অধিক লম্বা করা নাজায়িয ও বিধর্মীদের সাথে তাশাব্বুহ বা সাদৃশ হওয়ার কারণ।
বিধর্মীদের অনুসরণ করা হারাম :
মূলতঃ দাড়ি চেঁছে ফেলা ও গোঁফ লম্বা রাখা বিধর্মীদের অনুসরণ করার শামিল, যা শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম। এ প্রসঙ্গে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- من فطرة الاسلام اخذ الشارب واعفاء اللحى فان المجوس تعفى سواربها وتحفى لحاها قخالفوهم خذوا شواربكم واعفرا لحاكم- (رواه ابن حبان)
অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “গোঁফ কাটা (ছোট করা) ও দাড়ি লম্বা করা ইসলামী ফিতরাতের অন্তর্ভূক্ত। কেননা মজুসীরা (অগ্নী উপাসকরা) গোঁফ লম্বা রাখে ও দাড়ি চেঁছে ফেলে। অতএব, তোমরা (মুসলমানরা) মজুসীদের বিরুদ্ধাচরণ কর, গোঁফ ছোট রাখ ও দাড়ি লম্বা কর।” (ইবনে হাব্বান)
উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে দাড়ি চেঁছে ফেলা ও গোঁফ লম্বা রাখাকে মজুসীদের (অগ্নি উপাসকদের) শেয়ার বা বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর দাড়ি লম্বা করা ও গোঁফ ছোট রাখা ইসলামী শেয়ার বা বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভূক্ত।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن ابن عمر عن النبى صلى الله عليه وسلم- قال خالفو المشر كين ونر واللحى واحفوا الشوارب. (بخارى شويف)
অর্থ : হযরত ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “তোমরা (মুসলমানরা) মুশরিকদের বিপরীত করো, অর্থাৎ দাড়ি লম্বা কর ও গোঁফ ছোট কর।” (পবিত্র বুখারী শরীফ)
উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, দাড়ি চেঁছে ফেলা ও গোঁফ ছোট রাখা মুশরিকদের আমল বা শেয়ার। সুতরাং যারা দাড়ি চেঁছে ফেললো ও গোঁফ লম্বা রাখলো, মূলতঃ তারা মুশরিক, মজুসী তথা বিধর্মীদের অনুসরণ-অনুকরণ করলো। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে অসংখ্য স্থানে বিধর্মী তথা ইহুদী-নাছারা, মজুসী, মুশরিকদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন, পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ولن ترضى عنك اليهود ولا النصرى حتى تتبع ملته قل ان هدى الله هوالهدى ولشن اتبعت اهواء هم بعد الذى جائك من العلم مالك من الله من ولى ولا نصير.
অর্থ : ইহুদী ও নাছারারা কখনোই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবেনা, আপনি তাদের (ইহুদী-নাছারার) ধর্মের (নিয়ম-নীতির) যতক্ষণ পর্যন্ত অনুসরণ না করবেন। বলে দিন, মহান আল্লাহ পাক উনার হিদায়েতই প্রকৃত হিদায়েত। আপনার নিকট ইলম (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম) আসার পরও যদি আপনি ইহুদী-নাছারাদের নিয়ম-নীতির অনুসরণ-অনুকরণ করেন, তবে আপনার জন্যে মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ হতে কোন অভিভাবক এবং সাহায্যকারী পাবেন না।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১২০)
পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে এ প্রসঙ্গে আরো ইরশাদ মুবারক করা হয়েছে,
يا ايها الذين امنوا لا تتخذوا اليهود والنصرى اولياء- بعضهم اولياء بعض ومن يتو لهم منكم فانه منهم. (مائده)
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই দলভূক্ত হবে।” (পবিত্র সূরা মায়েদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৫১)
আর এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن جابر عن النبى صلى الله عليه وسلم- حين اتاه عمر- فقال- انا نسمع احاديثا من يهود تعجبنا- افترى ان نكتب بعضها- فقال امتهو كون انتم كما تهوكت اليهود والنصرى لقد جئتكم بها بيضاء نقية ولو كان موسى حيا ماوسعه الا اتباعى. (رواه احمد، بيهقى)
অর্থ : হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, একদিন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট এসে বললেন, (ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা ইহুদীদের থেকে তাদের কিছু ধর্মীয় কথা শুনে থাকি, যাতে আমরা আশ্চর্য্যবোধ করি, ওটার কিছু আমরা লিখে রাখবো কি? তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আপনারাও কি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন? যেরকম ইহুদী-নাছারারা দ্বিধা-দন্দ্বে রয়েছে? অবশ্যই আমি আপনাদের নিকট পরিপূর্ণ, উজ্জ্বল ও পরিস্কার দ্বীন নিয়ে এসেছি। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম তিনিও যদি দুনিয়ায় থাকতেন, তবে উনাকেও আমার অনুসরণ করতে হতো।” (মুসনদে আহমদ, বায়হাক্বী শরীফ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
عن عبد الله بن عمر رضى الله عنه قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- من تشبه بقوم فهو منهم- (مسند احمد، ابودود)
অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আলাইহিস সালাম উনার হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্য রাখবে, সে ব্যক্তি তাদেরই দলভূক্ত হবে।” (মুসনদে আহমদ, আবূ দাউদ শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের বর্ণনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, কোন অবস্থাতেই বিধর্মীদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করা, তাদের সাথে সাদৃশ্য রাখা জায়িয নেই বরং হারাম। আর তাই ফিক্বাহের বিশ্ব বিখ্যাত কিতাব তাহতাবী ৩য় জিঃ৪৬০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে যে,
والتسبه بهم حرام.
অর্থ : ইহুদী ও অগ্নি উপাসকদের সাথে সাদৃশ্য রাখা হারাম।
অতএব, যারা দাড়ি চেঁছে ফেলে ও গোঁফ লম্বা রাখে, তারা মূলতঃ ইহুদী-মুশরিক, মজুসী ইত্যাদি বিধর্মীদের সাথেই সাদৃশ্য রাখে। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দৃষ্টিতে তাদের অর্থাৎ দাড়ি চাঁছা মুসলমানদের হাশর-নশর উক্ত বিধর্মীদের সাথেই হবে। মোটকথা হলো- দাড়ি চেঁছে ফেলা ও গোঁফ লম্বা রাখা বিধর্মী বা বিজাতীয়দের শেয়ার বা আলামত। আর দাড়ি লম্বা করা ও গোঁফ ছোট করে রাখা ইসলামের শেয়ার বা ফিতরাত।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলাম উনার নামে গণতন্ত্র ভিত্তিক আন্দোলন করা, নির্বাচন করা, হরতাল করা, লংমার্চ করা, ব্লাসফেমী আইন চাওয়া ইত্যাদি সবই বিজাতীয় বা বিধর্মীদের অনুসরণ-অনুকরণ করার শামিল। কারণ, উল্লেখিত সবই বিধর্মীদের প্রবর্তিত পদ্ধতি বা পন্থা। অতএব মুসলমান উনাদের জন্যে তা অনুসরণ করা হারাম।
দাড়ি শেয়ারুল ইসলাম বা মুসলমানের আলামত ও সকল নবীগণ উনাদের সুন্নত :
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম যে, পুরুষের দাড়ি চেঁছে ফেলা ও গোঁফকে লম্বা করে রাখা বিধর্মী বা বিজাতীয়দের শেয়ার বা তাদের ধর্মীয় মৌলিক আমলের অন্তর্ভূক্ত। আর মুসলমানদের জন্যে বিধর্মীদের বিপরীত করা অর্থাৎ দাড়ি লম্বা করা ও গোঁফ ছোট করা শেয়ারুল ইসলাম বা দ্বীন ইসলামের মৌলিক আমলের অন্তর্ভূক্ত।
এ প্রসঙ্গে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
عن عائشة رضى الله تعالى عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم عشر من الفطرة- قص الشارب واعفاء اللحية- ( رواه ابودود)
অর্থ : হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহিস সালাম উনার থেকে বর্ণিত- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “দশটি জিনিস মানুষের জন্যে ফিতরাত অর্থাৎ সৎ স্বভাব নবী আলাইহিমুস সালাম গণের সুন্নত ও দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা ও দাড়ি লম্বা করা অন্যতম।” (আবূ দাউদ শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় আবূ দাউদ শরীফ উনার বিখ্যাত শরাহ বজলূল মাজহুদে উল্লেখ আছে যে, (فطرة) ফিতরাত অর্থ- হযরত আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিমুস সালাম উনাদের সুন্নত বা তরীক্বা। অধিকাংশ হযরত উলামায়ে কিরাম ফিতরাতের এই অর্থই বর্ণনা করেছেন। কেউ কেউ ফিতরাতের অর্থ তরীক্বায়ে ইব্রাহীমী বলে উল্লেখ করেন। কেউ আবার ফিতরাতের অর্থ করেছেন, সৎ স্বভাব। অর্থাৎ সৎ স্বভাব যে বিষয়কে পছন্দ করে এবং গ্রহণ করে, উহাই ফিতরাত। তবে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ফিতরাত শব্দ দ্বারা দ্বীনকেই বুঝানো হয়েছে। যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
فطرة الله التى فطر الناس عليها لا تبديل لخلق الله ذالك الين القيوم ولكن اكشر الناس لا يعلمون.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক উনার সেই দ্বীন, যা তিনি মানুষের জন্যে পছন্দ করেছেন, তা অনুসরণ কর। স্রষ্টার সৃষ্টির কোন পরিবর্তন (করতে) নাই। এটাই সত্য-সরল দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা বুঝেনা।” (পবিত্র সূরা রোম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন ফিৎরাত বলতে দ্বীনকেই বুঝিয়েছেন। অতএব, পুরুষের দাড়ি লম্বা করা ও গোঁফ ছোট করা ফিৎরাত বা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ ইসলাম বা মুসলমানের লক্ষণ বা আলামত। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হলো যে, দাড়ি লম্বা করা ও গোঁফ ছোট করা শুধু সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত বা তরীক্বা নয় বরং সকল নবী আলাইহিস সালামগণের সুন্নত বা তরীক্বা। দাড়ি রাখা সুন্নত না ফরজ ?
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, দাড়ি লম্বা করা ইসলামী শেয়ার বা ফিৎরাতের অন্তর্ভূক্ত এবং সকল হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের সুন্নত। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- তবে কি দাড়ি রাখা উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তথা মুসলমান উনাদের জন্যে সুন্নত? এর জবাব হলো- হ্যাঁ, দাড়ি রাখা সাধারণভাবে সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত এ অর্থে, যেহেতু সকল হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা দাড়ি রেখেছেন। মূলতঃ এদিক দিয়ে শরীয়ত উনার সকল আমল যেমন নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিও সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু আহকামের দিক থেকে সেগুলো ফরজ। অনুরূপ দাড়ি রাখা যদিও সাধারণভাবে সুন্নত মনে করা হয়, কিন্তু আহকামের দিক থেকে দাড়ি রাখা ফরজ। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। তবে যারা ওয়াজিব বলেছেন, উনারা ফরজ অর্থেই ওয়াজিব বলেছেন। কেননা ওয়াজিব কোন কোন সময় ফরয অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যার প্রমাণ হাদীছ শরীফে রয়েছে। যেমন হাদীছ শরীফে উল্লেখ আছে যে,
عن ابن عباس قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- يا ايها الناس ان الله كتب عليكم الحج- فقام الاقرع بن الحابس- فقال افى كل عام يا رسول الله؟ قال لو قلتها نعم لو جبت ... 
অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “হে মানুষেরা (হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম) নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক আপনাদের উপর হজ্বকে ফরয করেছেন। তখন হযরত আকরাউ ইবনুল হাবিস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! প্রত্যেক বৎসরই কি হজ্ব করা ফরয? (জবাবে) নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “আমি যদি বলি হ্যাঁ, তবে প্রত্যেক বৎসরই হজ্ব করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। ........ (মিশকাত শরীফ-২২১)
উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে হজ্বকে ওয়াজিব হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, অথচ হজ্ব করা ফরয। মূলতঃ এখানে ওয়াজিবটা ফরয অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। মোটকথা হলো- দাড়ি রাখা মূলত ফরয/ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তিনি উনার পবিত্র কালাম পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেছেন,            
وما اتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا- (سوره حشر)
অর্থ : তোমাদের জন্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা নিয়ে এসেছেন (আদেশ দিয়েছেন), তা আঁকড়িয়ে ধর, আর যার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তার থেকে বিরত থাক।” (পবিত্র সূরা হাশর শরীফ)
মূলত : মহান আল্লাহ পাক উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উনার রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদেশ-নিষেধকে মান্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদেশ-নিষেধ মান্য করা ফরয/ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।
অতএব, পুরুষের জন্য দাড়ি রাখা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। কারণ, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসংখ্যবার দাড়ি রাখার আদেশ দিয়েছেন এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অসংখ্য স্থানে দাড়ি রাখার ব্যাপারে আদেশসূচক (امر) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن نافع- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- انهكوا الشوارب واعقوا اللحى. (بخارى شريف ج 2 صفه 875)
অর্থ : হযরত নাফে রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “তোমরা গোঁফ ভালরূপে কাট ও দাড়ি লম্বা কর।” (বুখারী শরীফ, ২য় জিঃ পৃষ্ঠা-৮৭৫)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে,
عن عيد اله بن عمر عن النبى صلى الله عليه وسلم- انه امر با حفاء الشوارب واعفاء اللحية.
অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করে বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি গোঁফ ছোট করার ও দাড়ি লম্বা করার আদেশ দিয়েছেন।
অতএব, উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দ্বারাও দাড়ি রাখা ফরয-ওয়াযিব প্রমাণিত হয়। কারণ, উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রাসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদেশ-নিষেধ মান্য করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উম্মতকে দাড়ি রাখার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং দাড়ি রাখা পুরুষের জন্যে ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।
তাছাড়াও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে দাড়ি সম্পর্কীয় যতগুলো পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে, তার প্রায়টিতেই ত্মব্জহৃ॥ত্র আদেশসূচক শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-(امر)
اعفوا- اوفوا- ارخوا- وفروا- ام
অর্থাৎ উল্লেখিত শব্দগুলো দ্বারা দাড়ি রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর উল্লেখিত সবগুলো শব্দই আমর বা আদেশসূচক। আর আমাদের হানাফী মাযহাবের গ্রহণযোগ্য উসূল হলো- যতক্ষণ পর্যন্ত আমর’-এর বিপরীত কোন দলীল-প্রমাণ পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরদ্বারা ওয়াজিব সাব্যস্ত হবে।
আর তাই ইমাম, মুজতাহিদ তথা ফিক্বাহবিদগণ উনাদের কিতাবে দাড়ি রাখা ফরয-ওয়াজিব বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন-
বিশ্ববিখ্যাত আলিমে রাব্বানী, ফক্বীহুল উম্মত, রঈসুল মুনাজিরীন, বাহরুল উলূম, হাফিযুল হাদীছ, উস্তাজুল উলামা ওয়াল মাশায়েখ, তাজুল মুফাসসিরীন ওয়াল মুহাদ্দিসীন, হযরতুল আল্লামা, শাহ সূফী, হযরত মাওলানা, রুহুল আমীন বশীর হাটী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ কিতাব ফতওয়ায়ে আমিনীয়ার১ম খন্ড, ৯০ পৃষ্ঠায় লিখেন- এক কব্জা পরিমাণ দাড়ি রাখা ফরয। কেননা ফরয ত্যাগ করা হারাম।
মিশকাত শরীফ উনার বিখ্যাত শরাহ আশয়াতুল লুময়াত১ম জিঃ ২২৮ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
وكزاشتن ان بعدر قبضه واجب است.
অর্থ : এক মুষ্ঠি পরিমাণ লম্বা দাড়ি রাখা ওয়াজিব।
তাছাড়া দাড়ি রাখা ফরয হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হলো এই যে, সকল ইমাম-মুজতাহিদ একমত যে, এক মুষ্ঠির কমে দাড়ি কাটা হারাম। আর মূলতঃ হারাম থেকে বেঁচে থাকা বা বিরত থাকা শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।
সুতরাং অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, দাড়ি রাখা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। দাড়ি কাটা সকলের ঐক্যমতে হারাম :
যেহেতু দাড়ি কাটার কারণে নানাবিধ কবীরাহ গুণাহ সংঘটিত হয়, যেমন- দাড়ি কাটার কারণে আকৃতির বিকৃতি ঘটে, বিজাতীয় ও বিধর্মীদের অনুসরণ করা হয়, মেয়ে লোকের সাদৃশ হয়ে যায়। যা মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পক্ষ হতে লানত বা অসন্তুষ্টি প্রাপ্তির কারণ। যেহেতু উল্লিখিত কাজগুলো শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে হারাম কাজের অন্তর্ভূক্ত। আর শরীয়ত উনার উসূল হলো-
ماادى الى الحرام فهو حرام.
অর্থ : যে কাজ হারামের দিকে নিয়ে যায়, সে কাজও হারাম।
কাজেই দাড়ি কাটার কারণে নানাবিধ হারাম কাজ সংঘটিত হয়, সেহেতু দাড়ি কাটা হারাম। আর তাই ফিক্বাহর বিখ্যাত কিতাব দুররুল মুখতার৪র্থ জিঃ ৫৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে,
واذا يحرم على الرجل قطع لحيته.
অর্থ : বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য হয় বিধায় পুরুষের জন্যে নিজ দাড়ি কাটা হারাম করা হয়েছে।
মিশকাত শরীফ উনার বিখ্যাত শরাহ আশয়াতুল লুময়াত১ম জিঃ ২২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
حلق كردن لحيه حرام است.
অর্থ : দাড়ি মুন্ডন করা হারাম।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, পুরুষের হন্যে দাড়ি কাটা হারাম। মূলতঃ দাড়ি কাটা হারাম হওয়ার ব্যাপারে হানাফী, মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের সকল ইমাম, মুজতাহিদগণ একমত। এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয় যে,
قد اتفقت المذاهب الاربعة على وجوب توفير اللحية وحرمة حلقها-
অর্থ : নিঃসন্দেহে চার মাযহাবের ইমাম উনারা এ ব্যাপারে একমত যে, দাড়ি (এক মুষ্ঠি পরিমাণ) লম্বা করা ওয়াজিব এবং কাটা বা মু-ন করা হারাম।” (কিতাবুল ইবদা)
এছাড়াও বাহরুর রায়েক, ফতহুল ক্বাদীর, শরাম্বলালিয়া ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত কিতাবসমূহেও দাড়ি কাটা নাজায়েয (হারাম) বলা হয়েছে।
সুতরাং অকাট্য ও সুস্পষ্ট দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হলো যে, সকলের ঐক্যমতে কমপক্ষে এক মুষ্ঠি পরিমাণ লম্বা দাড়ি রাখা ফরয এবং এর চেয়ে কম দাড়ি রাখা ও দাড়ি মু-ন করা হারাম। মূলতঃ এ ব্যাপারে সকল ইমাম, মুজতাহিদ উনাদের মধ্যে ইজমা বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।                       
দাড়ি রাখার ব্যাপারে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার নির্দেশ
মূলতঃ অসংখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দাড়ি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আর দাড়ি কাটতে নিষধ করছেন। যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- من فطرة الاسلام اخذ الشارب واعفاء اللحى. فان المجوس تعفى سواربها وتحفى لحاها فخالفواهم خذوا شواربكم واعفوالحاكم. (رواه ابن حبان)
অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসারীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “দাড়ি লম্বা করা ও গোঁফ ছোট করা ইসলামী ফিৎরাতের (দ্বীনের) অন্তর্ভুক্ত। মজূসীরা (অগ্নি উপাসকরা) গোঁফ লম্বা রাখে ও দাড়ি কেটে ফেলে। সুতরাং তোমরা তাদের বিপরীত কর, (অর্থাৎ) গোঁফ ছোট রাখ ও দাড়ি লম্বা কর।” (ইবনে হাব্বান)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
عن ابن عمر عن النبى صلى الله عليه وسلم قال- خالفوا المشر كين وقروا اللحى واحفوا الشوارب. (رواه البخارى)
অর্থ : হযরত ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে বর্ণনা করে বলেন, “তোমরা মুশরিকদের বিপরীত করা (অর্থাৎ) দাড়ি লম্বা কর ও গোঁফ ছোট কর।” (বুখারী শরীফ)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن عبد الله بن عمر رضى الله عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم- انه امر با حفاء الشوارب واعفاء اللحية.
অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে বর্ণনা করে বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নির্দেশ দিয়েছেন গোঁফ ছোট করার ও দাড়ি লম্বা করার।” (ডারহী কী শরয়ী হাইছিয়ত)
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা স্পষ্টই প্রমাণিত হলো যে, স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষের দাড়ি লম্বা করার ও গোঁফ ছোট করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- দাড়ি কতটুকু লম্বা করতে হবে এবং গোঁফ কতটুকু ছোট করতে হবে? আর শরীয়ত উনার মধ্যে এর কোন সীমারেখা বা পরিমাণ রয়েছে কিনা? তাছাড়া সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও হযরত ইমাম মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম দাড়ি কতটুকু পরিমাণ লম্বা করতেন?
(অসমাপ্ত )