জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া - ৮


জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া

গবেষণা কেন্দ্র- মুহম্মদিয়া জামিয়া  শরীফ
[সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের জন্যে এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, আখিরী রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি। মহান আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ রহ্মতে গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ যিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামায ফরযে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরয নামাযের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইন্জেকশন নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্-এর নামাযে বা অন্যান্য সময় কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়িয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, আযান ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, দোয়াল্লীন-যোয়াল্লীন-এর শরয়ী ফায়সালা এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, খাছ সুন্নতী টুপি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, নূরে মুহম্মদী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইমামাহ্ বা পাগড়ী মুবারকের আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়া এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্রের আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া পেশ করার পর ২১তম ফতওয়া হিসেবে জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়াপেশ করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।] জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ          সুন্নতের পথিকৃত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, দ্বীন ইসলামের নির্ভীক সৈনিক, সারা জাহান থেকে কুফরী, শিরিকী ও বিদ্য়াতের মূলোৎপাটনকারী, বাতিলের আতঙ্ক এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক মুখপত্র- মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় এ যাবৎ যত লিখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ হবে তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছূদ এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ মাসিক আল বাইয়্যিনাতেএমন সব লিখাই পত্রস্থ  হয়, যা মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ পরিশুদ্ধ করণে বিশেষ সহায়ক।    তদ্রুপ মাসিক আল বাইয়্যিনাতে” “জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার উদ্দেশ্য বা মাকছূদও ঠিক তাই। কেননা কিছু লোক ক্বিল্লতে ইল্ম ও ক্বিল্লতে ফাহ্ম”- অর্থাৎ কম জ্ঞান ও কম বুঝের কারণে বলে থাকে যে, “জানাযার পর দোয়া করা বিদ্য়াত ও নাজায়িয। তাদের উক্ত বক্তব্য একদিক থেকে যেরূপ ঈমান বা আক্বীদার ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ, অপর দিক থেকে আমলের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ ক্ষতির কারণ।           প্রথমতঃ ঈমানের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ এ জন্য যে, আমাদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া হলো কোন জায়িয আমলকে নাজায়িয বলা কুফরী। অর্থাৎ ঈমান বিনষ্ট হওয়ার কারণ। অথচ বান্দার ইবাদত-বন্দিগী বা নেক আমল কবূল হওয়ার জন্যে প্রধানতম শর্ত হচ্ছে- আক্বীদা শুদ্ধ থাকা অর্থাৎ আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার ন্যায় আক্বীদা পোষণ করা। কারণ বিশুদ্ধ আক্বীদা আমল কবূল হওয়ার পূর্ব শর্ত।           দ্বিতীয়তঃ আমলের ক্ষেত্রে ক্ষতির কারণ এ জন্য যে, তাদের উক্ত অশুদ্ধ বক্তব্যের কারণে যেরূপ মাইয়্যিতজীবিতদের দোয়া থেকে বঞ্চিত হবে তদ্রুপ জীবিতরা বঞ্চিত হবে হাদীস শরীফের উপর আমল করা থেকে। কারণ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্, আশিকে উম্মত, নূরে মুজাস্সাম, ফখরে দুআলম, রহমতুল্লিল আলামীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাইয়্যিতেরজন্য অধিক মাত্রায় এবং ইখলাছের সাথে দোয়া করতে বলেছেন বলে ছহীহ্ হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে। শুধু তাই নয় স্বয়ং আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেরূপ জানাযার নামাযে মাইয়্যিতের জন্য দোয়া করেছেন অনুরূপ জানাযার বাইরেও মাইয়্যিতের জন্য দোয়া করেছেন। সুতরাং মাইয়্যিতের জন্য জানাযার নামাযে দোয়া করা যেরূপ সুন্নত, তদ্রুপ জানাযার বাইরেও সুন্নত। তা জানাযার আগেই হোক বা পরে হোক। সুতরাং বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, তাদের বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষ একটি সুন্নত পালনের ফযীলত থেকে মাহরূম হবে নিঃসন্দেহে।           মূলকথা হলো, সকল মুসলমান যেন জানাযার পর দোয়া ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়সম্পর্কে সঠিক আক্বীদা রাখতে পারে এবং সুন্নত মুতাবিক আমল করে মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারে এ মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বহুল প্রচারিত মাসিক আল বাইয়্যিনাতে জানাযার পর দোয়া ও তাঁর প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়াদেয়া হলো।        মাসিক আল বাইয়্যিনাত-এর পূর্ববর্তী সংখ্যাগুলোতে প্রদত্ত জানাযাসম্পর্কিত আলোচনা দ্বারা যা ছাবিত হয়েছে তার সার সংক্ষেপ হলো মানুষ মাত্রই মৃত্যু বরণ করবে, মানুষের মৃত্যুর পর শরীয়তের নির্দেশ হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃত ব্যক্তির দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা এবং মৃত ব্যক্তির রূহের মাগফিরাতের জন্যে মৃত ব্যক্তির উপর ছলাতুল জানাযাবা জানাযা নামায আদায় করা। শুধু তাই নয় জীবিত ব্যক্তিদের উপর দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো মৃত ব্যক্তির মাগফিরাতের জন্যে অধিক পরিমাণে দোয়া বা মুনাজাত করা। তাই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
اكثرواالدعاءفاخاصوا له الدعاء
অর্থঃ- ইখলাছের সাথে ও অধিক পরিমাণে মৃত ব্যক্তির মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে দোয়া-মুনাজাত কর।         এখন প্রশ্ন হলো- মৃত ব্যক্তির জন্যে কখন দোয়া বা মুনাজাত করবে? অর্থাৎ শরীয়তে মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করার নির্দিষ্ট কোন সময় বর্ণিত আছে কি?          মূলতঃ শরীয়ত মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করার ব্যাপারে কোন সময় নির্দিষ্ট করে দেয়নি যে, অমুক সময় দোয়া করতে হবে, আর অমুক সময় দোয়া করা যাবেনা। বরং শরীয়তে মৃত ব্যক্তির জন্য যে কোন সময় দোয়া করার বিধান রয়েছে। যেমন ইন্তিকালের পর জানাযার পূর্বে, জানাযার নামাযের মধ্যে, জানাযার পর দাফনের পূর্বে এবং দাফনের পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যে কোন সময় মৃত ব্যক্তির জন্যে হাত তুলে ও সম্মিলিতভাবে দোয়া করা জায়িয ও সুন্নত। নাজায়িয বা বিদয়াত মোটেও নয়। এ সম্পর্কিত বহু দলীল-আদিল্লাহ কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, শরাহ, ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাব সমূহ থেকে পূর্ববর্তী সংখ্যাগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। (পূর্ব প্রকাশিতের পর) জানাযা নামাযের পর হাত তুলে, সম্মিলিতভাবে দোয়া-মুনাজাত করাকে বিদ্য়াত ও মাকরূহ্ বলে প্রচারকারীদের জিহালতপূর্ণ বক্তব্যসমূহের  খন্ডনমূলক জাওয়াব      বাতিলের আতঙ্ক, দ্বীনে হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায় বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতেপ্রদত্ত জানাযার পর দোয়া ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উল্লিখিত দলীল-আদিল্লাহ্র দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধু জানাযার পূর্বে ও দাফনের পরেই নয় বরং জানাযার পর দাফনের পূর্বেও মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করা জায়িয ও সুন্নত।যার স্বপক্ষে প্রায় ২১১টি দলীল মওজুদ রয়েছে যা আল বাইয়্যিনাতের ১০৭ ও ১০৮তম সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে। আর আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ ও ফক্বীহ্গণের অভিমতও এটাই। অথচ কিছু সংখ্যক দেওবন্দী ও ওহাবী মৌলভী কিল্লতে ইল্ম ও কিল্লতে ফাহম অর্থাৎ স্বল্প বিদ্যা ও অল্প বুঝের কারণে এবং ফিক্বাহ্র কিতাবের কোন কোন ইবারতের সঠিক মর্ম অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে প্রচার করে থাকে যে, জানাযার পর দাফনের পূর্বে মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া-মুনাজাত করা বিদ্য়াত ও মাকরূহ্। আর এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন দলীল-প্রমাণ না পেয়ে মনগড়া কিছু যুক্তি ও জিহালতপূর্ণ বক্তব্য পেশ করে থাকে। জানাযার পর দাফনের পূর্বে দোয়া-মুনাজাত করাকে বিদ্য়াত ও মাকরূহ্ প্রমাণ করার জন্যে তারা যে সকল মনগড়া যুক্তি ও জিহালতপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করে থাকে, নিম্নে পর্যায়ক্রমে নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে তা খন্ডন করা হলো- জানাযার পর মুনাজাত বিরোধীদের মনগড়া যুক্তি  ও জিহালতপূর্ণ বক্তব্য এবং তার  খন্ডনমূলক জাওয়াব-১           মুনাজাত বিরোধীরা বলে থাকে যে, “খাইরুল কুরুনে অর্থাৎ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, তাবিঈন, তাবেতাবিঈনগণের যুগে জানাযার পর দাফনের পূর্বে মুনাজাত করার কোন প্রমাণ নেই। তাই এটা বিদ্য়াত, মাকরূহ্।       মুনাজাত বিরোধীদের উক্ত বক্তব্যের জবাবে বলতে হয় যে, তাদের উক্ত বক্তব্য ডাহা মিথ্যা, জিহালতপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। কেননা, স্বয়ং আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ যে জানাযার পর দাফনের পূর্বে মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করেছেন তার বহু প্রমাণ আপনারা ইতোমধ্যে আল বাইয়্যিনাত-এর মাধ্যমে পেয়ে গেছেন। পাঠকগণের সুবিধার্থে এ আলোচনার শেষে তা পুনরায় উল্লেখ করা হবে।        মূলতঃ যদি ধরে নেই যে, জানাযার পর দাফনের পূর্বে দোয়া করার কোন প্রমাণ হাদীস শরীফে নেই। তথাপিও জানাযার পর দাফনের পূর্বে দোয়া করা বিদ্য়াত প্রমাণিত হয়না। কারণ কোন বিষয় সুন্নত বা বিদ্য়াত হওয়া বা না হওয়ার জন্যে খাইরুল কুরুনশর্ত নয়। মুনাজাত বিরোধীরা সুন্নত ও বিদ্য়াতের সঠিক সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা এবং তার শরয়ী আহ্কাম না জানার কারণেই জানাযার পর দাফনের পূর্বে দোয়া করাকে বিদ্য়াত বলে থাকে। তাই নিম্নে সুন্নত ও বিদ্য়াত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো- সুন্নতের সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও প্রকারভেদ       সুন্নতশর্ব্দের অর্থ হলো- মত, পথ, আদর্শ, তর্জ-তরীক্বা, নিয়ম-কানুন ইত্যাদি। ইমাম-মুজতাহিদগণ সুন্নতকেকয়েকভাবে বিভক্ত করেছেন। যেমন, ১।  سنة الله সুন্নাতুল্লাহ্।অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন-এর সুন্নত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক রব্বুল আলামীন তাঁর কালাম পাকে ইরশাদ করেন,
ولا تجد لسنة الله تبديلا.
অর্থাৎ- তোমরা মহান আল্লাহ্ পাক-এর সুন্নতের পরিবর্তন দেখবেনা।
২। سنة الرسول সুন্নার্তু রসূল ছল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম।  অর্থাৎ আখিরী নবী, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুবারক ক্বওল, ফেল ও তাকরীর। অর্থাৎ কথা, কাজ ও সম্মতি মুবারক।     যেমন, এ প্রসঙ্গে মিরকাত শরহে মিশকাতেউল্লেখ আছে,
المراد بالسنة ههنا اقواله عليه الصلوة والسلام وافقاله واحواله.
অর্থঃ- এখানে সুন্নত বলতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ক্বওল (কথা), ফেল (কাজ) ও আহ্ওয়াল (অবস্থা)কে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কথা, কাজ ও সম্মতিই হচ্ছে সুন্নত।    এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহ্র বিখ্যাত কিতাব তাহ্তাবীতেউল্লেখ আছে,
والسنة ما فمل النبى صلى الله عليه و سلم او واحد من اصحابه.
অর্থঃ- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্ নাবিয়্যীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা তাঁর ছাহাবীগণের মধ্য হতে কোন একজন যে কাজ করেছেন তাই সুন্নত।
৩। سنة الصحابة সুন্নাতুছ্ ছাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।অর্থাৎ হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের কথা, কাজ ও সম্মতি মুবারক।        এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عليكم بسئتى وسنة الخلفاء الرا شدين المهد ين.
অর্থঃ “(হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন) তোমাদের জন্য আমার সুন্নত এবং পথ প্রদর্শক, হিদায়েতপ্রাপ্ত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সুন্নত অনুসরণ করা লাযিম(আবশ্যক)।
৪। سنة الامة সুন্নতে উম্মত।অর্থাৎ  কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে উদ্ভাবিত ইমাম-মুজতাহিদ ও আউলিয়া-ই-কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণের আমল। যেমন, বর্তমান তরতীবে মীলাদ শরীফ পাঠ করা, বর্তমান পদ্ধতিতে মাদ্রাসায় পড়া ও পড়ানো ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
من سن فى الاسلام سنة حسنة فله اجر ها واجر من عمل بها من بعده.
অর্থঃ- যে কেউ দ্বীন ইসলামে উত্তম কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে (যা শরীয়ত সম্মত), তার জন্য সে সওয়াব পাবে এবং তারপরে যারা এ পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তার সওয়াবও সে পাবে।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তালীকুছ্ ছবীহ, মুযাহিরে হক্ব)      অতএব, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, খাইরুল কুরুনে ছিলোনা এরূপ আমলও সুন্নত তথা সুন্নতে উম্মত বা জায়িয হতে পারে। কাজেই খাইরুল কুরুনের দোহাই দিয়ে আমভাবে সকল বিষয়কে সুন্নতের খিলাফ ও বিদ্য়াত বলা জিহালত ও গোমরাহী বৈ কিছুই নয়।  বিদয়াতের সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা ও প্রকারভেদ         ঠিক তদ্রুপ খাইরুল কুরুনেছিলোনা বলেই যে তা বিদ্য়াত হবে তা নয় বরং খাইরুল কুরুনে থাকার পরও অনেক আমল বিদ্য়াত হতে পারে। আবার খাইরুল কুরুনে না থাকার পরও অনেক আমল বিদ্য়াত হবে না। বিদ্য়াত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বিদ্য়াতের সাথে খাইরুল কুরুনের কোন সম্পর্ক নেই। বিদ্য়াতের পরিচয়     আমাদের প্রথমে জানতে হবে বিদ্য়াত শব্দের  অর্থ কি? বিদ্য়াত কাকে বলে? এবং কত প্রকার ও কি কি?   
বিদ্য়াত (بدعة)  শব্দটি  اسم مشتق  একবচন (واحد) স্ত্রীলিঙ্গ (مؤنث) এবং তার বহুবচন (جمع) হলো  بدع   বিদ্য়াতের লোগাতী (আভিধানিক) অর্থসমূহ নিম্নরূপঃ- বিদ্য়াতের লোগাতী অর্থ          বিদ্য়াতের লোগাতী অর্থ হচ্ছে-
البدعة:- احدث فى الدين بعد الاكمال، اومااصتحدث بعد النبى صلى الله عليه وسلم من الاهواء والاعمال.
অর্থঃ- বিদ্য়াত হলো- দ্বীনের পূর্ণতার পর নতুন কোন বিষয় উদ্ভব হওয়া অথবা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর আমল ও খাহেশাত সম্পর্কিত কোন কিছুর নতুন উৎপত্তি।” (লোগাতুল কামূস আল মুহীত্ব ৩য় জিঃ ৩ পৃষ্ঠা, বয়ানুল লিসান ১১৫ পৃষ্ঠা, লিসানুল আরব ১ম জিঃ ২২৯ পৃষ্ঠা, তাজুল উরুস ৫ম জিঃ ২৭১ পৃষ্ঠা, লোগাতে হীরা ১৭৫ পৃষ্ঠা, গিয়াসুল লোগাত ৭১ পৃষ্ঠা)
البدعۃ. بغیر نمونہ کے بنا یء ھویء چیز.

অর্থঃ- বিদ্য়াত হলো- নমুনা ব্যতীত সৃষ্ট জিনিস।” (মিছবাহুল লোগাত ২৭ পৃষ্ঠা)
والبدعة، اصلها مااحدث على غير مثال سابق
অর্থঃ- বিদ্য়াত মূলতঃ তাকেই বলা হয়, যা পূর্ব নমুনা ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়েছে।” (ফতহুল বারী শরহে বুখারী ৪র্থ জিঃ ২১৯ পৃষ্ঠা, মিরকাত শরীফ)
بدانکہ فر چیز پیدا شدہ یعد از پیغمبر عایہ السلام بدعت است.
অর্থঃ- জেনে রাখ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরে উদ্ভব ঘটেছে এমন প্রত্যেক কাজই বিদ্য়াত।” (আশয়াতুল লুময়াত)
بدعة: نئ بات، نئ رسم
অর্থঃ- বিদ্য়াত হলো- নতুন কথা, নতুন প্রথা।” (আরবী ফিরোজুল লোগাত পৃঃ৫৩)
البدعۃ: وہ چیز جو بغیر کسی سا بق بثال کے بنای جائے
অর্থঃ- বিদ্য়াত তাকে বলা হয়, যা পূর্ব নমুনা ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়।” (লোগাত আল মুন্জিদ ৭৬ পৃষ্ঠা)
اليدعة : نئ بات.
অর্থঃ- বিদ্য়াত হলো- নতুন কথা।” (লোগাতে সাঈদী ৯৬ পৃষ্ঠা)   সুতরাং বিদ্য়াত শব্দের লোগাতী বা আভিধানিক মূল অর্থ হলো- নতুন উৎপত্তি, নতুন উদ্ভব, নতুন সৃষ্টি। পূর্বে যার কোন অস্তিত্ব ছিলনা। বিদ্য়াতের শরয়ী অর্থ বিদ্য়াতের শরয়ী অর্থ সম্পর্কে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ্ আল্লামা বদ্রুদ্দীন আইনী হানাফী রহমতুল্লহি আলাইহি লিখেছেন,
والبدعة فى الاصل احداث امر لم يكن فى زمان رصول الله صلى الله عليه وسلم.
অর্থঃ- প্রকৃতপক্ষে বিদ্য়াত হলো- এমন জিনিসের আবির্ভাব, যার নমুনা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা।” (উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী ৫ম জিঃ ৩৫৬ পৃষ্ঠা, আল ইতিছাম ১ম জিঃ ২০ পৃষ্ঠা)          আল্লামা ইসমাঈল নাবিহানী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,

قال العزدالدين ابن السلام البدعة فعل مالم يعهد فى عهد النبى صلى الله عليه وسلم.
অর্থঃ- (শায়খুল ইসলাম) ইজদুদ্দীন ইবনে সালাম বলেন, “বিদ্য়াত এমন একটি কাজ, যা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানায় সম্পন্ন হয়নি।” (জাওয়াহিরুল বিহার ২৮০ পৃষ্ঠা)    ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
وفى الشر ع احداث مالم يكن فى عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم.
অর্থঃ- শরীয়ত মুতাবিক বিদ্য়াত হচ্ছে- এমন সব নব আবিষ্কৃত জিনিসের নাম, যা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা।” (শরহে মুসলিম লিন নববী)    হাফিয ইবনে রজব রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
والمر اد باليدعة ما احنث مما لا اصل له فى الشريمة يدل عليه واما ماكان له اصل من الشرع يدل عليه فليس بيدعة شرعا وان كان بدعة لغة.
অর্থঃ- বিদ্য়াত ঐ বিষয়কে বলা হয়, যার ভিত্তি শরীয়তে নেই। সুতরাং শরীয়তে যে বিষয়ের ভিত্তি রয়েছে, শরীয়ত মুতাবিক তা বিদ্য়াত নয়, যদিও আভিধানিক অর্থে বিদ্য়াত বলা হয়।” (জামিউল উলূম ওয়াল হাকাম ১৯৩ পৃষ্ঠা, ইরশাদুল উনূদ ১৬১ পৃষ্ঠা)    ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
البدعة فى الشرع هى احداث مالم يكن قى عهد النبى صلى الله عليه وسلم.
 অর্থঃ- ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “বিদ্য়াতের শরীয়তী অর্থ হচ্ছে- এমন একটি  নতুন কর্ম, যা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানায় ছিলনা।” (তাহ্যীবুল আসমা ওয়াল লোগাত)      অতএব, শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদ্য়াত শব্দের মূল অর্থ হলো- ঐসব নতুন উদ্ভুত বিষয়, যার ভিত্তি কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসে নেই।           উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, বিদ্য়াত হলো- আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর হতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভাবিত প্রত্যেক নতুন বিষয়। এখন তা খায়রুল কুরুনেও হতে পারে অথবা তার পরেও হতে পারে। বিদ্য়াতের ব্যাখ্যা উপরোক্ত লোগাতী ও শরয়ী অর্থের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিদ্য়াত হলো হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর হতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভাবিত প্রত্যেক নতুন বিষয়। অতএব, নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ের কোন্টি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য ও কোন্টি পরিত্যাজ্য, তা অবশ্যই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।       এ বিদ্য়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্ব বিখ্যাত হাদীস শরীফের কিতাব মিশকাত শরীফের শরাহ্ মিরকাত শরীফেউল্লেখ করেন,
قال الشافعى رحمة الله عليه مااحدث مما يخالف الكتاب اوالسنة او الاثر اوالاجما غ فهو ضلالة. وما احدث مما لا يخالف شيأ مما ذكر فليس بمذموم.
অর্থঃ- ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে নব উদ্ভাবিত কাজ কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, আছার (অর্থাৎ হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের আমল বা ক্বওল) অথবা ইজ্মার বিরুদ্ধ বলে প্রমাণিত, তাই গোম্রাহী ও নিকৃষ্ট। আর যে নব উদ্ভাবিত কাজ উল্লখিত কোনটির বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়, তা মন্দ বা নাজায়িয নয়।” (মিরকাত শরহে মিশকাত ১ম জিঃ ১৮৯ পৃষ্ঠা)      ইমাম শারানী রহমতুল্লহি আলাইহি বলেন, “প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতিই যে নিকৃষ্ট বা নিষিদ্ধ হবে তার কোন যুক্তি নেই।” (আনওয়ারে কুদসিয়্যাহ্)         অথচ আজকাল কিছু জাহিল লোক সকল বিদ্য়াতকেই (নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতি) গোম্রাহী বলে থাকে এবং দলীল হিসাবে তারা নিন্মোক্ত হাদীস শরীফখানা পেশ করে থাকে।    যেমন, হাদীস শরীফে ইরশাদ করা হয়েছে,
كل بدعة ضلالة.
অর্থঃ- প্রত্যেক বিদ্য়াতই গোম্রাহী।” (মিশকাত শরীফ, মিরকাত, শরহুত্ব ত্বীবী, মুযাহিরে হক্ব, আত্ তালীকুছ ছবীহ, মিরয়াতুল মানাজীহ্) অথচ তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে তারা নেহায়েতই অজ্ঞ। এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় মিশকাত শরীফের শরাহ্ মিরকাত শরীফে উল্লেখ করা হয়,

قوله كل يدعة ضلالة قال فى الازهار اى كل بدعة سيئة ضلالة
 অর্থঃ- ছহিবে মিরকাত হযরত মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “আল আজহারনামক কিতাবে
كل بدعة ضلالة
(প্রত্যেক বিদ্য়াতই নিকৃষ্ট) হাদীস শরীফের এ অংশটুকুর ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে,
"اى كل يدعة سيئة ضلالة"
 অর্থাৎ- সকল  বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহই গোম্রাহী।  আর তাই শায়খ ইব্রাহীম হালবী রহমতুল্লহি আলাইহি বলেন,
وعدم النقل عن النيى صلى الله عليه وسلم وعن الصحابة والتا بعين رضى الله عنهم وكونه بدعة لا ينافى كونه حسنا.
অর্থঃ- নতুন উদ্ভাবিত কোন কাজ  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, তাবিঈনগণের নিকট হতে প্রমাণিত না থাকলে অথবা উক্ত কাজের প্রতি বিদ্য়াত শব্দ আরোপিত হলেই যে তা মন্দ বা গোম্রাহী, একথা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং তা ভালও হতে পারে।” (কবীরী শরহে মুনিয়াতুল মুছল্লী ২৫১ পৃষ্ঠা) হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিও তাঁর ইহ্ইয়াউল উলুমকিতাবের ২য় খন্ডের ২৬ পৃষ্ঠায় অনুরূপ মন্তব্য করেন।         কেউ কেউ আবার হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হতে বর্ণিত নিন্মোক্ত হাদীস শরীফখানা পেশ করে বলেন যে, “সকল বিদ্য়াতই পরিত্যাজ্য।  হাদীস শরীফে ইরশাদ করা হয়,
من احدث فى امرنا هذا ما ليس منه فهو رد
 অর্থঃ- যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের ভিতরে কোন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করবে, যার ভিত্তি এ দ্বীনে নেই, সেটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।” (বুখারী, মুসলিম, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস্ সারী, মিশকাত, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত, আত্ তালীকুছ ছবীহ, শরহুত্ ত্বীবী, মুযাহিরে হক্ব)         এ হাদীস শরীফের ব্যাখ্যায় ফতহুল মুলহিম শরহে মুসলিম”-এর ২য় জিঃ ৪০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
قوله ماليس منه يدل على ان الامور التى لها اصل من الكتاب او من صنة رسول الله صلى الله عليه وسلم اومن الخلفا. الر اشدين اوتعامل عامة السلف او الاجتهاد المعتبر بشروط، المستتد الى النصوص لاتسمى بدعة شرعية لاى (بدعة سيئة) فان هذه الاصول كلها من الدين.
অর্থঃ-   ما ليس منه হাদীস  শরীফের উক্ত শব্দ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয়, যে সকল দ্বীনী কাজের সনদ কুরআন শরীফ অথবা হাদীস শরীফ বা খুলাফা-ই-রাশিদীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের সুন্নত অথবা বুযুর্গানে দ্বীনের পারস্পরিক কার্যকলাপ অথবা গ্রহণযোগ্য শর্তাদীসহ শরীয়তের স্পষ্ট দলীলসমূহের ভিত্তিতে যে ইজ্তিহাদ করা হয়েছে, তার মধ্যে পাওয়া যায়, তবে সেগুলোকে নিকৃষ্ট বিদ্য়াত (বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্) বলা যাবেনা। কারণ সে ভিত্তিসমূহ দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত।        অতএব, যে সকল কাজ উল্লিখিত ভিত্তিসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা দ্বীন অর্থাৎ শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত বলেই বিবেচিত হবে।  অনুরূপ মুযাহিরে হক্বকিতাবের ১ম খন্ডের ৭০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ  রয়েছে,  হাদীস শরীফে ما ليس منه শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে- উদ্দেশ্য এই  যে, যে সকল কাজ কুরআন-সুন্নাহ্র বিরুদ্ধ নয়, সেগুলোকে বিদ্য়াতের গন্ডী বহির্ভূত করে রাখা। কারণ এ সকল কাজ নতুন উদ্ভুত হলেও গোম্রাহী বা নিকৃষ্ট নয়।    কেউ কেউ আবার মাহ্বুবে সুব্হানী, কুতুবে রব্বানী, কাউয়্যুমে আউয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একটি ক্বওল-এর ভুল ব্যাখ্যা করে বলে থাকে যে, বিদ্য়াত বলতেই গোম্রাহী। কেননা হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “আমি কোন বিদ্য়াতের মধ্যেই নূর দেখিনা, তা বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ই হোক বা বিদ্য়াতে হাসানাই হোক।অথচ হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর উক্ত ক্বওলটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমল অর্থাৎ সুন্নতের মধ্যে যে নূর রয়েছে, তা অন্য কারো আমলের মধ্যে নেই, আর তাই তো স্বাভাবিক। কেননা সুন্নতের মধ্যে যে নূর রয়েছে, তা বিদ্য়াতের মধ্যে কখনো পাওয়া সম্ভব নয়। আর তাই তিনি বলেছেন, “আমি কোন বিদ্য়াতের মধ্যেই নূর দেখিনা।অর্থাৎ সুন্নতের ন্যায় নূর দেখিনা। অবশ্য হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর উপরোক্ত কথার দ্বারা বিদ্য়াতে হাসানাহ্ যে পরিত্যাজ্য তা বুঝায় না। কেননা তিনি নিজেও অনেক বিদ্য়াতে হাসানাহ্ আমল করেছেন ও তা আমলে উৎসাহিত করেছেন, যেমন তাসাউফের সমস্ত তরীক্বাগুলো। যেহেতু খাইরুল কুরুনেতাছাউফের মাকামাতগুলো বর্তমান তরীক্বাগুলোর ন্যায় সুবিন্যস্ত আকারে সন্নিবেশিত ছিল না।         অথচ হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাছাউফের বেশীরভাগ তরীক্বার সংস্কার সাধন করেন। বিশেষভাবে নক্শবন্দীয়া তরীক্বাকে আরো বিস্তারিত ও ব্যাপক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে নক্শবন্দীয়ায়ে মুজাদ্দিদিয়া নামক তরীক্বার প্রবর্তন করেন এবং নিজে এই সকল তরীক্বার মাকামের বিন্যাস, হাল-অবস্থা বর্ণনা করে মুরীদ-মুতাকিদগণকে তালীম-তাল্ক্বীন দিয়ে গেছেন। হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর জীবনে এরকম আরো অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তিনি বিদ্য়াতে হাসানাহ্ কাজকে কখনও পরিত্যাগ করেননি বা করতে বলেননি। কাজেই যারা হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ক্বওলের ভুল ব্যাখ্যা প্রচারে লিপ্ত, তারাই আবার তাঁর অন্যান্য বিদ্য়াতে হাসানাহ্ আমলগুলো সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে।            অতএব, তাদের কথা বা কাজ গ্রহণযোগ্য নয়। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিদ্য়াতে হাসানাহ্ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য, আর বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ অবশ্যই পরিত্যাজ্য। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, বিদ্য়াত মাত্রই পরিত্যাজ্য নয় এবং সকল বিদ্য়াতই গোম্রাহী নয়। যদি তাই হতো, তবে তারাবীহ্ নামায জামায়াতে পড়া জায়িয হতো না। কেননা একেও বিদ্য়াত বলা হয়েছে, অর্থাৎ উত্তম বিদ্য়াত।        এখন মূল বিষয় হলো- বিদ্য়াত কত প্রকার ও কি কি এবং তার মধ্যে কোন্টি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য আর কোন্টি শরীয়তে পরিত্যাজ্য তা নির্ণয় করা। বিদ্য়াতের শ্রেণী বিভাগ          ইমাম, মুজতাহিদগণ শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিদ্য়াতকে প্রথমতঃ দুভাগে বিভক্ত করেছেন-  ১। বিদ্য়াতে ইতিক্বাদী। অর্থাৎ আক্বীদা বা বিশ্বাসগত বিদ্য়াত। ২। বিদ্য়াতে আমালী। অর্থাৎ কর্মগত বিদ্য়াত।       বিদ্য়াতে ইতিক্বাদী বা আক্বীদাগত বিদ্য়াত হলো- যে সমস্ত আক্বীদা কুরআন-সুন্নাহ্র মূলনীতির বহির্ভুত। মূলতঃ এ আক্বীদাগত বিদ্য়াতের সবই হারামের পর্যায়ভূক্ত এবং অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন- খারিজী, মুতাজিলা, জাবারিয়া, ক্বদরিয়া, শিয়া ইত্যাদি বাতিল ফিরক্বার আবির্ভাব। এই নব আবির্ভূত ফিরক্বার ন্যায় আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী।       বিদ্য়াতে আমালী বা কর্মগত বিদ্য়াত প্রথমতঃ দুভাগে বিভক্ত- (ক) বিদ্য়াতে হাসানাহ্, (খ) বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্।  (ক)   বিদ্য়াতে হাসানাহ্ আবার তিন প্রকার- (১) বিদ্য়াতে ওয়াজিব, (২) বিদ্য়াতে মুস্তাহাব ও (৩) বিদ্য়াতে মুবাহ্।          আর এ বিদ্য়াতে হাসানাহ্  সম্পর্কেই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
من سن فى الاسلام سنة حسنة فله اجرها واجر من عمل بها من بعده.
অর্থঃ- যে কেউ দ্বীন ইসলামে উত্তম কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে (যা শরীয়ত সম্মত), তার জন্য সে ছওয়াব পাবে এবং তারপরে যারা এ পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তার ছওয়াবও সে পাবে।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী)         উল্লিখিত হাদীস শরীফের দৃষ্টিতে বিদ্য়াতে হাসানাহ্কে বিদ্য়াত লিদ্দ্বীন বলা হয়। কেউ কেউ আবার উক্ত হাদীস শরীফের  দৃষ্টিতে বিদ্য়াতে হাসানাহ্কে (بدعت لغوى) বিদ্য়াতে  লোগবীও বলে থাকেন। অর্থাৎ যদিও শাব্দিক অর্থে বিদ্য়াত বলা হয়েছে, মূলতঃ এগুলো সুন্নতেরই অন্তর্ভুক্ত। কারণ হাদীস শরীফে  (سنة) সুন্নাত শব্দ উল্লেখ রয়েছে। (খ) আর বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ দুপ্রকার- (১) বিদ্য়াতে হারাম, (২) বিদ্য়াতে মাকরূহ্।      এই বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ সম্পর্কেই হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
من احدث فى امرنا هذا ما ليس منه فهو رد.
অর্থঃ- যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের ভিতরে কোন নতুন জিনিসের প্রবর্তন করবে, যার ভিত্তি এ দ্বীনে নেই, তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।” (বুখারী, মুসলিম, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস্ সারী, শরহে নববী, ফত্হুল মুল্হিম, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, মুযাহিরে হক্ব, মিরয়াতুল মানাজীহ্, তালীক) আর এ বিদ্য়াত সম্পর্কেই ইরশাদ হয়েছে,
كل يدعة ضلالة.
অর্থঃ- প্রত্যেক বিদ্য়াতই (সাইয়্যিয়াহ্) গোম্রাহী।” (মিশকাত, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী)           উল্লেখিত হাদীস শরীফের দৃষ্টিতে বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্কে বিদ্য়াত ফিদ্দ্বীন বলা হয়। আর এ বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্কেই শরয়ী (شرمى) বিদ্য়াত বলা হয়।         মূলকথা হলো- যা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পর নতুন উদ্ভব হয় এবং তা দ্বীনের সাহায্য করে থাকে অথবা সাহায্যকারী না হলেও দ্বীনের কোন ক্ষতি করে না, তাই বিদ্য়াত লিদ্দ্বীন বা লোগবী বিদ্য়াত অর্থাৎ বিদ্য়াতে হাসানাহ্। আর যে নতুন বিষয় উদ্ভব হওয়ার কারণে দ্বীনের কিছুমাত্রও ক্ষতি হয়, তবে তাই হবে বিদ্য়াত ফিদ্দ্বীন বা শরয়ী বিদ্য়াত অর্থাৎ বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্।     উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিদ্য়াত বলতেই তা পরিত্যাজ্য নয়। অর্থাৎ যেই বিদয়াত  বা নতুন উদ্ভাবিত কাজ কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের বিপরীত তা অবশ্যই বর্জনীয়। আর তাই বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ হারামের অন্তর্ভুক্ত, যদিও তা কুরুনে ছালাছারমধ্যে উদ্ভাবিত হোক না কেন। আর যেই নতুন উদ্ভাবিত কাজ কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের অনুকুলে তা অবশ্যই জায়িয এবং উত্তম, আর একেই বিদ্য়াতে হাসানাহ্ বলা হয়। যদিও তা কুরুনে ছালাছারপরে উদ্ভাবিত হোক না কেন। বিদ্য়াতে  হাসানাহ্ ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্-এর বিশ্লেষণ      নিম্নে বিদ্য়াতে হাসানা ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্র উদাহরণভিত্তিক ব্যাখ্যা দেয়া হলো- ১। বিদ্য়াতে ওয়াজিবঃ- যা পালন না করলে ইসলামের ক্ষতি বা সংকট হবে, যেমন কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ কাগজে কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা, কুরআন শরীফের জের, জবর, পেশ দেয়া, মাদ্রাসা নির্মাণ করা, নাহু ছরফ, উছূল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিতাব লিখা ও পড়া। ২। বিদ্য়াতে মুস্তাহাবঃ- যা শরীয়তে নিষেধ নেই এবং তা সমস্ত মুসলমানগণ ভাল মনে করে ছওয়াবের নিয়তে করে থাকেন। যেমন- তারাবীহ্ নামায জামায়াতে পড়া, মুছাফিরখানা, ইবাদতখানা, লঙ্গরখানা, খানকা শরীফ ইত্যাদি জনহিতকর কাজ করা। খতীবের সম্মুখে আযান দেয়া, রমজান মাসে বিত্র নামায জামায়াতে আদায় করা ইত্যাদি।           এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে মাসঊদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ما راه الناس حسنا فهو عند الله حسن لاتجتمع امتى على الضلالة.
অর্থঃ- লোকে যা ভাল মনে করে তা আল্লাহ্ পাক-এর নিকটও ভাল। আমার উম্মতগণ কখনো গোম্রাহীর মধ্যে একমত হবে না।” (মিশকাত শরীফ) ৩। বিদ্য়াতে মুবাহ্ ঃ- ঐ সমস্ত নতুন কাজ যা শরীয়তে নিষেধ নেই, যেমন- পোলাও, বিরিয়ানী, বুট, মুড়ি, পিয়াঁজো ইত্যাদি খাদ্য খাওয়া। ট্রেন, মোটরগাড়ী, প্লেন ইত্যাদি যান-বাহনে চড়া। ৪। বিদ্য়াতে হারাম ঃ- যা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের পরিপন্থী। যা ফরয-ওয়াজিব আমলসমূহ ধ্বংসের কারণ। যেমন- ইহুদী, নাছারা ও ভন্ড ফকিরদের কু-প্রথা বা আক্বীদাসমূহ। ৫। বিদ্য়াতে মাকরূহঃ- যার দ্বারা কোন সুন্নত কাজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন- বিধর্মীদের পোশাক পরিধান করা, টাই পরিধান করা এবং বিধর্মীদের অনুসরণ করা ইত্যাদি।     কেননা হাদীস শরীফে রয়েছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مااحدث قوم بدعة الارفع مثلها من السنة قنمسك بسنة خير من احد اث بد عة.
অর্থঃ- হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যখনই কোন ক্বওম একটি বিদ্য়াতের উদ্ভব ঘটিয়েছে, তখনই একটি সুন্নত লোপ পেয়েছে। সুতরাং একটি সুন্নতের আমল করা (যদিও তা ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হয়) একটি বিদ্য়াত উদ্ভব করা হতে উত্তম (যদিও তা বিদ্য়াতে হাসানাহ্ হয়)।” (মুসনদে আহ্মদ, মিশকাত, মিরকাত, মুযাহিরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মিরয়াতুল মানাজীহ্)) বিদ্য়াতের অনুরূপ ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা নিন্মোক্ত কিতাবসমূহেও রয়েছে। যেমন- বুখারী শরীফের শরাহ ফাতহুল মুবীন, হাশিয়ায়ে মিশকাত, আশয়াতুল লুময়াত, ফতওয়ায়ে শামী, ইশবাউল কালাম, আসমাওয়াল লোগাত, হুসনুল মাকাছিদ ইত্যাদি আরো অনেক কিতাবসমূহে।     উল্লেখ্য আমাদের সমাজে নতুন এমন অনেক জিনিসই প্রচলিত রয়েছে, যা না হলে দ্বীনের মোটেও ক্ষতি হবেনা। যেমন- মসজিদে মিহ্রাব ব্যবহার করা, মিনারা ব্যবহার করা, ট্রেন, মোটরগাড়ী, প্লেনে চড়া ইত্যাদি। কাজেই সরাসরি দ্বীনের সাহায্যকারী না হলেই যে বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ হবে তা নয়। বরং এমন বিদ্য়াত যা দ্বীনের সাহায্যও করে না এবং কোন প্রকার ক্ষতিও করেনা, তা বিদ্য়াতে মুবাহ্। তবে সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, বিদ্য়াতে মুবাহ্ও অনেক ক্ষেত্রে দ্বীনের সাহায্য করে থাকে। যেমন, প্লেনের কারণে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে হজ্বব্রত পালন করতে পারি। পোলাও-বিরানী ইত্যাদি খাদ্য খেলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে, আর স্বাস্থ্য ভাল থাকলে ইবাদত-বন্দেগী সঠিকভাবে করা যায়। সে দৃষ্টিতে এগুলো কি দ্বীনের সাহায্যকারী নয়?        কেউ কেউ আবার বলে থাকে, খাইরুল কুরুনের পর আবিষ্কৃত প্রত্যেক নতুন জিনিসই বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্। অথচ এটা মোটেও শুদ্ধ নয়। কেননা যদি তাই হতো, তবে আমাদের সমাজে প্রচলিত এমন অনেক নতুন বিষয় রয়েছে, যা অবশ্যই পরিত্যাগ করা জরুরী হয়ে পড়তো। যেমন, (ক) বর্তমানে যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসায় ইল্ম শিক্ষা দেয়া হয়, এ পদ্ধতি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুরু করে খাইরুল ক্বুরুনপর্যন্ত কারো সময়ই ছিলনা।  (খ) বর্তমানে আমরা যেভাবে নাহু ছরফ শিক্ষা করে থাকি, তাও খাইরুল ক্বুরুনেছিল না।  (গ) বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে তারাবীহ্র নামায পড়ে থাকি, এ পদ্ধতিও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা। (ঘ) বর্তমানে আমরা মসজিদে জামায়াতের জন্য যে সময় নির্ধারণ করে থাকি, তাও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা। (ঙ) বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে জুমুয়ার ছানী আযান দিয়ে থাকি, এ পদ্ধতি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা। (চ) বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে (প্যান্ডেল, স্টেজ, মাইক ইত্যাদী দিয়ে) ওয়াজ মাহ্ফিল করে থাকি, ঐরূপ পদ্ধতিতে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়াজ মাহ্ফিল করেননি। (ছ) বর্তমানে আমরা যে পোলাও, বিরিয়ানী, কোর্মা, বুট, মূড়ি, পিয়াঁজো খেয়ে থাকি, তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাননি।   (জ) বর্তমানে আমরা যে সকল যান-বাহনে চড়ে থাকি, এবং তার মাধ্যমে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করি ও বিদেশ ভ্রমনে যাই,  যেমন- রিক্সা, মোটরগাড়ী, ট্রেন, রকেট, প্লেন,  জাহাজ ইত্যাদি তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা। তিনি ওগুলোতে কখনো চড়েননি।  (ঝ) বর্তমানে মানুষ যে সকল খাট-পালঙ্ক, শোকেস-আলমারী ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে, তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যবহার করেননি। (ঞ) বর্তমানে বিয়ে-শাদীতে যে কাবিননামা করা হয়, তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা।  (ত) বর্তমানে যে সকল আধুনিক যন্ত্রপাতি মানুষ ব্যবহার করছে, যেমন- ফ্যান, ঘড়ি, চশমা, মাইক, কম্পিউটার, ফটোকপিয়ার. ইত্যাদি, এগুলো সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা। (থ) বর্তমানে যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসার জন্য চাঁদা আদায় করা হয়, যেমন সদকা, ফিৎরা, যাকাত, কুরবানীর চামড়া, মান্নতের টাকা ইত্যাদি এবং যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসা তৈরী করা হয়, তা যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছিলনা; তদ্রুপ খায়রুল কুরুনেওছিলনা। এমনিভাবে আরো অনেক বিষয়ই রয়েছে, যা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা খায়রুল কুরুনেছিল না কিন্তু আমরা তা দায়িমীভাবে করছি।            বিদ্য়াতের উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, বিদ্য়াত বলতেই পরিত্যাজ্য বা বাতিল নয়। বরং বিদ্য়াতে হাসানাহ্, যা দ্বীনের সাহায্যকারী তা শরীয়তে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং অনুসরণীয়। সুন্নত ও বিদ্য়াতের উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, বিদ্য়াত হলো নতুন উদ্ভাবিত বিষয় তা খাইরুল কুরুনেও হতে পারে আবার খাইরুল কুরুনের পরেও হতে পারে। তবে নতুন উদ্ভাবিত যে বিষয়গুলো কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ নয় বরং কুরআন-সুন্নাহ্ সম্মত তা বিদ্য়াতে হাসানাহ বা উত্তম বিদ্য়াত। যা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য। আর নতুন উদ্ভাবিত যে বিষয়গুলো কুরআন-সুন্নাহ্সম্মত নয় বরং কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ তা বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্। যা শরীয়তের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য।       জানাযার পর দাফনের পূর্বে দোয়া করার বিষয়টি যদিও ধরে নেই যে, নতুন উদ্ভাবিত পূর্বে ছিলোনা তবুও তা জায়িয ও শরীয়তসম্মত। কারণ জানাযার পর দোয়া করা কুরআন-সুন্নাহ্র খিলাফ নয়। কেননা, কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও জানাযার পর দোয়া করতে নিষেধ করা হয়নি। কাজেই তাদের বক্তব্য অনুযায়ীই জানাযার পর দোয়া করা বিদ্য়াত প্রমাণিত হয়না। বরং প্রমাণিত হয় যে, জানাযার পর দাফনের পূর্বে দোয়া করা জায়িয।       স্মর্তব্য যে, যেখানে তাদের বক্তব্য ধরে নিলেও জানাযার পর দাফনের পূর্বে দোয়া বিদ্য়াত প্রমাণিত হয়না। সেখানে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের আমল দ্বারা প্রমাণিত থাকার পরও তা কি করে বিদ্য়াত-মাকরূহ্ হতে পারে?  স্বয়ং হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জানাযার পর দাফনের পূর্বে মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করার কতিপয় প্রমাণ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ্ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ যে, জানাযার পর দাফনের পূর্বে মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করেছেন; তার কতিপয় প্রমাণ পাঠকের সুবিধার্থে সংক্ষিপ্তভাবে এ সংখ্যাতেও উল্লেখ করা হলো। যেমন, বিশ্ববিখ্যাত হাদীস শরীফের কিতাব আবূ দাউদ শরীফ’-এর ২য় জিঃ ১০০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال صلى رسول الله صلى الله عليه وسلم على جنازة فقال اللهم اغفر لحينا وميتنا وصفيرنا وكبيرنا وذكرنا وانثا نا وشاهدنا وغائبنا اللهم من احييته منا فاحيه على الايمان ومن توفيته منا قتوفه على الاسلام اللهم لاتحرمنا اجره ولاتضلنا بعده.
অর্থঃ- হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক ব্যক্তির জানাযার নামায আদায়ের পর এরূপ দোয়া করেন, “ইয়া আল্লাহ্! আপনি আমাদের জীবিত ও মৃতদের ক্ষমা করুন। আমাদের ছোট ও বড়, পুরুষ ও স্ত্রী, উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলকে ক্ষমা করুন। ইয়া আল্লাহ্! আপনি আমাদের মাঝে যাকে জীবিত রাখেন, তাকে ঈমানের উপর জীবিত রাখুন এবং যাকে মৃত্যু দেন, তাকে ইসলামের উপর মৃত্যু দান করুন। ইয়া আল্লাহ্! আপনি আমাদেরকে বিনিময় হতে মাহরূম করবেন না এবং এরপর আর আমাদেরকে গোমরাহ্ করবেন না।  ইবনু মাজাহ্ শরীফ এর ১১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

عن الادرع السلمى قال جئت ليلة احرس التبى صلى الله عليه وسلم فاذا رجل قرائته عالية فخرج النبى صلى الله عليه وسلم هذا مراء قال فمات بالمد ينة ففر غوا من جهازه فحملوا نعشه فقال النبى صلى الله عليه وسلم ارفقوابه رفق الله به انه كان يحب الله ورسوله قال وحفر حقرته فقال اوسعواله اوسع الله عليه فقال بعض اصحا به يارسول الله صلى الله عليه وسلم اقد حزنت عليه فقال اجل اته كان يحب الله ورسوله.
অর্থঃ- হযরত আদরাসুলামী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একরাতে হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাহারা দেয়ার জন্য আসলাম। তখন জনৈক ব্যক্তি উচ্চ কক্তে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করছিলো। হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বের হলেন। তখন আমি বললাম, ঐ ব্যক্তি তো একজন রিয়াকার। রাবী বলেন, লোকটি মদীনা শরীফে মারা গেলে লোকেরা তার দাফন কাফনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তারা তার লাশ বহন করে নিয়ে গেলেন। হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,


ارفقوا به رفو الله به انه كان يحب الله ورصوله.
অর্থাৎ তোমরা তার প্রতি সদয় হও, আল্লাহ্ পাকও তার প্রতি সদয় হবেন। কেননা, সে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালবাসত।    রাবী বলেন, তার কবর খনন করা হলে হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তার জন্য কবর আরো প্রশস্ত কর। اوسع الله عليه আল্লাহ্ পাকও তাঁর প্রতি সদয় হবেন।কোন কোন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম বলেন; ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি তো তার ব্যাপারে চিন্তা করছেন। তিনি বললেন হাঁ। কেননা, সে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি মুহব্বত রাখত।   উক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, স্বয়ং রসূলে করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাফনের পূর্বে অর্থাৎ জানাযার পর মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করেছেন।    মিশকাত শরীফের১৪২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,

عن البراء بن عازب رضى الله عنه قال خرجنا مع النبى صلى الله عليه وسلم قى جنازة رجل من الانصار فانتهينا الى القير ولما يلحج فجلس رسول الله صلى الله عليه وسلم وجلسنا حوله كان على رؤسنا الطير وفى يده عود ينكت به فى الارض فرفع رأسه فقال استعيذوا بالله من عذاب القبر مر تين او ثلاثا.
অর্থঃ- হযরত বারা ইবনে আযিব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা একবার হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে আনছারীগণের মধ্যে এক ব্যক্তির জানাযায় গেলাম। আমরা কবরের নিকট গেলাম কিন্তু তখনো কবর খোঁড়া হয়নি। তখন হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসে পড়লেন, আমরাও তাঁর আশে পাশে বসে পড়লাম, যেন আমাদের মাথায় পাখি বসেছে (অর্থাৎ চুপচাপ-নিস্তব্ধ।) তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাত মুবারকে একটি কাঠের টুকরা ছিল, যা দ্বারা তিনি মাটিতে দাগ কাটছিলেন। অতঃপর তিনি মাথা মুবারক উঠালেন এবং বললেন,
استعيذوا بالله من عذاب القير.
অর্থাৎ তোমরা আল্লাহ্ পাক-এর নিকট কবর আযাব থেকে পানাহ্-পরিত্রাণ চাও।তিনি এটা দুবার কিংবা তিনবার বললেন।অনুরূপ মুসনাদু আহমদ ইবনে হাম্বল-এ উল্লেখ আছে।     নাছবুর রাইয়াহ লি আহাদীসিল হিদায়াহ’-র ২য় জিঃ ২৮৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
عن عبد الله بن ابى بكر قال: لما التقى الناس بمئونة، جلس رسول الله صلى الله عليه وسلم على المئبر، وكشف له ما بينه وبين الشام، فهو ينظر الى معر كتهم. فقال عليه السلام: اخذ الراية زيد بن حار ثة، فمضى حتى استشهد، وصلى عليه ودعا له، وقال استغفرواله، وقد دخل الجنة، وهو يسعى، ثم اخذ الر اية جعفر بن ابى طا لب، فمضى حتى استشهد، فصلى عليه رسول الله صلى الله عليه وسلم ودعاله، وقال: استغفروا له، وقد دخل الجنة، فهو يطير فيها بجناحين حيث شاء.
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ মাঊনানামক স্থানে মিলিত হলেন, হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে উঠে বসলেন। তখন তার কাছে শাম দেশের (মুতার যুদ্ধের) অবস্থা স্পষ্ট প্রকাশিত হচ্ছিল। তিনি হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের যুদ্ধের অবস্থা দেখতে ছিলেন। অতঃপর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, (যুদ্ধে) হযরত যায়িদ ইবনে হারিসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পতাকা ধরলেন, অতঃপর তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। তাই তিনি তাঁর উপর জানাযা নামায পড়লেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন এবং বললেন, তোমরাও তাঁর জন্য ইস্তিগফার কর। তিনি জান্নাতে চলে গেছেন,আর তা খুবই দ্রুত। হযরত জাফর ইবনে আবু তালিব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পতাকা ধরলেন অতঃপর তিনিও শহীদ হয়ে গেলেন। তাই, হযরত রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উপর জানাযা নামায পড়লেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন এবং বললেন, তোমরাও তাঁর জন্য ইস্তিগফারের দোয়া কর। তিনি তাড়াতাড়ি জান্নাতে চলে গেছেন এবং সেখানে দুটি ডানা নিয়ে যেখানে ইচ্ছা সেখানে উড়ে বেড়াবেন।” (অনুরূপ ফতহুল ক্বদীর ২য় জিঃ ৮১ পৃষ্ঠা, মাওয়াহিবুল্ লাদুন্নিয়া ২য় জিঃ ও নূরুল হিদায়াহ্ ১ম জিঃ ১৪৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। যাদুল্ আখিরাহ ৯ম বাব ১১২ পৃষ্ঠায় আছে)           জাগদ্বিখ্যাত মুহাদ্দিস, আলিম, ফক্বীহ হযরত আব্দুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর লিখা আশয়াতুল্ লুময়াতকিতাবের ১ম জিঃ ৬৮৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
واحتمال دارد کہ یر جنازة بمد ازنماز یا پیشس ازاں یقصد تبرک خواندہ باشد چنانکہ الان متعارف است واللہ اعلم.
অর্থঃ- সম্ভবতঃ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাযা নামাযের পরে অথবা পূর্বে বরকতের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন। যেমন, আজকাল এর প্রচলন দৃষ্টি গোচর হয়। আল্লাহ্ পাক অধিক জ্ঞাত।” (আশয়াতুল্ লুময়াত ১ম জিঃ ৬৮৬ পৃষ্ঠা)           মশহুর কিতাব যাদুল আখিরাত’-এর ৯ম বাব ১১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
ودر روایتے سب لہ رسول علیہ السلام بر عرجہ نماز گزاردپس بگفت اللهم ان  فلان بن فلان فی ذمتک دخل فی جوارک فقہ من فتنۃ القبر وعذاب النار وانت اھل الوفاء والحق اللھم اغفرلہ وارحمہ انک انت الففور الرحیم.
অর্থঃ- কোন কোন রিওয়ায়েতে রয়েছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাযা নামায পড়ে এ দোয়া করেছেন,
اللهم ان فلان بن فلان فى ذتك دخل مى جوارك فقه من فتنة القبر وعذاب النار وانت اهل الو فاء والحق اللهم اغفر له وارحمه انك انت الغفور الرحيم.
 অর্থাৎ আয় আল্লাহ্ পাক! অমুকের পুত্র অমুক আপনার জিম্মাদারী ও হিফাযতে রয়েছে। আপনি তাকে কবরের পরীক্ষা ও দোযখের আযাব হতে রক্ষা করুন। আপনি ওয়াদা ও হক্ব পূরণকারী। অতএব, আপনি তাকে মাফ করে দিন ও তার প্রতি রহম করুন। নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল ও মহা দয়াবান।         মুফতিয়ে আযম হযরত আল্লামা আমীমুল ইহ্সান রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর লিখিত হাদিয়্যাতুল্ মুছাল্লীন’ -এর ১১২ ও ১১৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
بعض روایتوں میں ھے کہ حضور صلی اللہ علیہ وسلم نے نماز جنازہ پڑھی پھر یہ دعا پڑھی. اللھم ان فلان (یھاں پرناملے) فی ذمتک دخل فی جوارک فقہ من فتنۃ القبر وعذاب النار وانت اھل الوفاء والحق اللھم اغفرله وار حمہ انک انت  الغفور الرحیم.
অর্থঃ- কোন কোন রিওয়ায়েতে আছে যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাযা নামায পড়ার পর এই দোয়া করেছেন,
اللھم ان فلان بن فلان (یھاں پرنام لے) فی ذمتک دخل قی جوارک فقہ من فتنۃ القبر وعذاب النار وانت اھل الوفاء والحق اللھم اغفرلہ وارحمہ انک انت الغفور الرحیم.
অর্থাৎ আয় আল্লাহ্ পাক! অমুকের পুত্র অমুক (এখানে মৃতের নাম বলবেন) আপনার জিম্মাদারী ও হিফাযতে রয়েছে। আপনি তাকে কবরের পরীক্ষা ও দোযখের আযাব হতে রক্ষা করুন। আপনি ওয়াদা ও হক্ব পূরণকারী। অতএব, আপনি তাকে মাফ করে দিন ও তাকে রহম করুন।নিশ্চয়ই আপনি মহা ক্ষমাশীল ও মহা দয়াবান।অনুরূপ যাদুল্ আখিরাহ কিতাবেও আছে।           ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব মাবসূত লিস্ সারাখসী’-এর ২য় জিঃ ৬৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
روى عن ابن عباس رضى الله عنهما وابن عمر رضى الله عنه انهما فاتهما الصلاة على الجنازة فلما حضرا مازادا على الاستغفار له.
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তাঁদের দুজনের একদা জানাযা নামায ফউত হলো। যখন তাঁরা (নামাযের পর মাইয়্যিতের কাছে) উপস্থিত হলেন, তখন মাইয়্যিতের জন্য অতিরিক্ত ইস্তিগফার করলেন।” (আল্ মাবসূত লিস্ সারাখসী ২য় জিঃ ৬৭ পৃষ্ঠা)           ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব মাবসূত লিস্ সারাখসী’-এর ২য় জিঃ ৬৭ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে, 
وعبد الله بن سلام رضى الله عنه فاتته الصلاة على جتازة عمر فلما حضر قال ان سبقتمونى بالصلاة عليه فلاتسبقونى بالدعاءله.
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন সালাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমীরুল মুমিনীন হযরত উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর জানাযা পাননি। (জানাযার পর) তিনি যখন (সেখানে) উপস্থিত হলেন তখন বললেন, “তোমরা জানাযা নামায যদিও আমার পূর্বে পড়ে ফেলেছ, তবে দোয়ার ক্ষেত্রে আমার থেকে অগ্রগামী হয়োনা।”(আল মাবসূত লিস সারাখসী ২য় জিঃ ৬৭ পৃষ্ঠা)           এছাড়াও আরো বহু দলীল-প্রমাণ রয়েছে যে, স্বয়ং আখিরী রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ জানাযার পর মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া করেছেন। সুতরাং জানাযার পর দোয়া করা জায়িয তো অবশ্যই বরং খাছ সুন্নত।           অতএব, যারা বলে, জানাযার পর দোয়া করার কোন প্রমাণ খাইরুল কুরুনে নেই তাই এটা বিদয়াত। তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্য,া ভুল ও দলীলবিহীন। শুধু তাই নয়, বরং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শানে মিথ্যারোপ করার কারণে সুস্পষ্ট কুফরীও বটে।
(অসমাপ্ত)

0 Comments: