আযান ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহকাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া ( ২ নং )


আযান ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে  ফতওয়া
( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
গবেষণা কেন্দ্র
মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ
            সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি। মহান আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ রহ্মতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামাজ ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামাজ জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরজ নামাজের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইন্জেকশন নেয়া রোজা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্-এর নামাজে বা অন্যান্য সময় কোরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্ নামাজ বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া  প্রকাশ করার পর (১৫তম) ফতওয়া হিসেবে আযান ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করতে পারায় মহান আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]
আযান ও ছানী আযানের
জবাব দেয়ার শরয়ী বিধান
            অধিকাংশ ফক্বীহ গণের মতে আযান ও ছানী আযানের মৌখিক জবাব দেয়া ওয়াজিব। এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত। যা হাদীস শরীফ ও ফিক্বাহ্র কিতাবের বর্ণনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়। যেমন- এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,
عن عبد الله بن عمروبن العاص قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل ما يقول.           
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আছ (রাঃ) হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন তোমরা মুয়াজ্জেনকে আযান দিতে শুনবে, তখন তাঁর ন্যায় তোমরাও বলবে।” ............... (মুসলিম, মেশকাত, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
            হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে,
عن ابى هريرة قال كنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم فقام بلال ينادى فلما سكت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من قال مثل هذا يقينا دخل الجنة.
অর্থঃ- হযরত আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন, একদিন আমরা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। এমতাবস্থায় হযরত বেলাল (রাঃ) আযান দিতে লাগলেন। আযান শেষ হওয়ার পর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি ইখ্লাছের সাথে অনুরূপ বলবে। অর্থাৎ আযানের জবাব দিবে সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (নাসাঈ, মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
            হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে,
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: اذا اذن المؤذن فقولوا مثل قوله.
অর্থঃ- হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুয়াজ্জিন যখন আযান দেয়, তোমরা মুয়াজ্জিনের অনুরূপ বল।” (ইবনে মাযাহ্ ১ম জিঃ ১২১ পৃঃ)
            এ হাদীস শরীফ অনুসারে বুঝা যায় যে, আযানের শব্দ যা রয়েছে, শ্রবণকারী তাই বলবে, বোখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছে, “হাইয়্যা আলাছ্ ছলাহ্ ও হাইয়্যা আলাল ফালাহ্ শব্দদ্বয়ের স্থলে লা-হাওলা-ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্ বলবে।এটা হাশিয়ায়ে মুয়াত্তা ইমাম মুহম্মদ-এর ৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে। প্রদত্ত হাদীস শরীফ অনুসারে ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) ও আসহাবে জাওয়াহিরের মত হচ্ছে- আযানের মৌখিক জাওয়াব দেয়া ওয়াজিব। তবে কেউ কেউ আযানের জাওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব বলেছেন, এটা ঠিক নয় এ কারনে যে, অধিকাংশ রেওয়ায়েতই মৌখিক জাওয়াবের পক্ষে, তাছাড়া হাদীস শরীফের ইবারতে قولوا শব্দ امر বা আদেশ সুচক। আর  আমাদের হানাফীদের উছূল হচ্ছে- যে পর্যন্ত امر  এর  বিপরীত কোন দলীল পাওয়া না যাবে, সে পর্যন্ত   امر المطلق  কে  وجوبএর উপর রাখতে হবে। অর্থাৎ ওয়াজিব হিসেবে ধরতে হবে।
            আর তাই ফিক্বাহের কিতাব সমুহেও আযানের অনুরুপ জাওয়াব দেয়াকে ওয়াজিব বলা হয়েছে। যেমন-ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব ফিক্বহুল  ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু”-এর ১ম জিঃ ৫৫২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
يجب فى الراجح عند الحنفية لمن سمع الا ذان ....... فالاجبة انما هى باللسان وهو الظاهر عند الحنفية.

অর্থঃ-হানাফী ইমামদের নিকট প্রাধান্যপ্রাপ্ত ও জাহেরে রেওয়ায়েত মোতাবেক  আযান শ্রবনকারীর জন্য আযানের মৌখিক জবাব দেয়া ওয়াজিব।অনুরূপ, বাদায়ে, ফতহুল ক্বাদীর, দুররুল মোখতার, শরহুছ্ ছগীর, শরহুল কবীর, আল কাওয়ানীনুল ফিক্বহিয়্যাহ্, আল মাজমূ, মুগনিউল মোহ্তাজ, আল মাহ্যাব, কাশ্শাফুল ক্বিনা, ও আল মুগনী কিতাবেও উল্লেখ আছে।
ছানী আযানের জাওয়াব
            আযানের ন্যায় খুৎবার আযান বা ছানী আযানের জাওয়াব দেয়াও ওয়াজিব। স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ খুৎবার আযান বা ছানী আযানের জাওয়াব দিয়েছেন। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে,    

عن ابى امامة قال سمعت معاوية بن ابى سفيان رضى الله عنهما- وهو جالس على المنبر اذن المؤذن فقال الله اكبر، الله اكبر- الخ-
فلما ان قضى التأذين- قال يا ايها الناس انى سمعت رسول الله صلى الله عله سلم على هذا المجلس حين اذن المؤذن يقول ما سمعتم منى من مقالتى.
অর্থঃ- হযরত আবূ উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি শুনেছি সাহাবী হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) জুমুয়ার দিন মিম্বরের উপর বসে মুয়াজ্জিনের আযানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আযানের শব্দসমূহকে উচ্চারণ করেন এবং আযান শেষে বলেন, হে লোক সকল, আমি হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জুমুয়ার দিন মিম্বরে বসা অবস্থায় মুয়াজ্জিনের আযান শ্রবণে এরূপ বলতে শুনেছি, যেরূপ তোমরা আমার থেকে শুনতে পেলে।” (বোখারী, নাসাঈ, ফাতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী)
 আর তার ব্যাখ্যায় বোখারী শরীফের বিখ্যাত শরাহ্ আইনী কিতাবে উল্লেখ করা হয়,                     
مما يستفاد منه تعلم العلم وتعليمه من الامام وهو على المنبر وفيه اجابة الخطيب للمؤذن وهو على المنبر وفيه قول المجيب "وانا كذالك" وظاهره ان هذا المقدا المقدا ريكفى لكن الاولى ان يقول مثل قول المؤذن.
অর্থঃ- উল্লিখিত (হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর আযানের পর কথা বলা সংক্রান্ত) হাদীস শরীফ দ্বারা (নিম্নলিখিত) বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যায়, (১) খতীব মিম্বরে থাকা অবস্থায় মোক্তাদীগণকে কোন মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়া, (২) মোক্তাদীগণ কোন মাসয়ালা শিক্ষা করা, (৩) মুয়াজ্জিনের আযানে (আমি এরূপ শুনেছি) শ্রোতাদের জবাব দেয়া জায়েয। প্রকাশ থাকে যে, ঐভাবে সংক্ষেপে জবাব দিলেও চলবে, তবে পরিপূর্ণ জবাব দেয়াই উত্তম।
            উল্লেখ্য যে, অনেকে নিম্নোক্ত হাদীস শরীফের ভুল ব্যাখ্যা করে বলে থাকে যে, ছানী আযানের জবাব দেয়া জায়েয নেই। যেমন-হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
اذا خرج الامام فلا صلوة ولا كلام.
অর্থঃ- ইমাম যখন (খুৎবার জন্য) বের হয়, তখন নামাজ পড়া ও কথা বলা নিষেধ।” (তিবরানী শরীফ)
            অথচ উক্ত হাদীস শরীফ খানা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ, যেমন উক্ত হাদীস শরীফের ব্যখ্যায়           ইমাম মালেক (রঃ) তাঁর মুয়াত্তা শরীফে উল্লেখ করেন, ইমাম ইবনে শিহাব জুহুরী (রঃ) বলেন,
خروج الامام يقطع الصلوة وخطبته يقطع الكلام.
অর্থঃ- ইমামের  আগমন  নামাজকে বন্ধ করে দেয়, আর তাঁর খুৎবা কথা-বার্তাকে বন্ধ করে দেয়।
            অর্থাৎ ইমাম সাহেব যখন খুৎবার জন্য হুজরা (রুম) হতে বের হবেন, তখন নামাজ (সুন্নত বা নফল) পড়া নিষেধ। আর যখন খুৎবা শুরু করে দিবেন, তখন নামাজের সাথে সাথে কথা-বার্তা বলাও নিষেধ। আর তাই সাহেবাইন অর্থাৎ ইমাম আবূ ইউসূফ (রঃ) ও ইমাম মুহম্মদ (রঃ) বলেন, “ইমাম হুজরা (রুম) হতে বের হলে নামাজ পড়া নিষেধ, কিন্তু খুৎবা শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত (দ্বীনী) কথা বলা জায়েয।” (আলমগীরী, কাফী, সিরাজুল ওয়াহ্হাজ্, তাহ্তাবী)
            উল্লেখ্য,   জুমুয়ার ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া  সম্পর্কে আইম্মায়ে মুজ্তাহিদগণের মধ্যে ইখ্তিলাফ (মত বিরোধ) রয়েছে। হযরত ইমামে আযম আবূ হানীফা (রঃ)-এর মতে মাকরূহ্ তান্যীহী। কিন্তু সাহেবাইন (রঃ), ইমাম মালেক (রঃ), ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এবং ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রঃ)-এর মতে মুস্তাহাব। (হেদায়া, নূরুদ্দেরায়া, নুরুল হেদায়া, এনায়া, নেহায়া, এমদাদুল মুফতীন, মায়ারেফে মাদানিয়া)
 তবে      সহীহ্ ক্বওল মতে ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর মতেও ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও দোয়া পড়া মাকরূহ্ নয়। এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয়-
واما قبل الشروع بعد صعوده على المنبر فيكره الكلام الدنيوى اتفاقا- واما الكلام الدينى كالتسبيح والتهليل فلا يكره عند هما وروى بعض المشائخ عنه انه يكره. والاصح انه لا يكره عنده ايضاصرح به فى النهاية وغيره- فعلى هذا لا يكره اجابة اذان الثانى ودعاء الوسيلة بعده مالم يشرع الامام فى الخطبة وقد ثبت ذلك من فعل معاوية رضى الله عنه فى الصحيح البخارى.
অর্থঃ- ইমাম সাহেব মিম্বরে উঠে খুৎবা পাঠ শুরু করার পূর্বে দুনিয়াবী (পার্থিব) কথা-বার্তা বলা সর্ব সম্মতিক্রমে মাকরূহ্। আর ইমাম আবূ ইউসূফ (রঃ) ও ইমাম মুহম্মদ (রঃ)-এর মতে দ্বীনী কথা-বার্তা যেমন- তাস্বীহ-তাহ্লীল, দোয়া-দরূদ পাঠ করা মাকরূহ্ নয়। তবে কোন কোন মাশায়েখগণ ইমাম  আবূ হানীফা (রঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, “খুৎবা শুরু করার পূর্বে দোয়া-দরূদ, তাস্বীহ্- তাহ্লীল পাঠ করা মাকরূহ্, কিন্তু অধিক সহীহ্ মত হলো- ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর নিকটও ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া মাকরূহ্ নয়।এ ব্যাপারে নেহায়া ও অন্যান্য কিতাবে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও খুৎবা শুরু করার পূর্বে আযানের দোয়া পড়া মাকরূহ্ নয়। (বরং জায়েয) আর এটা সহীহ্ বোখারী শরীফের হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর আমল দ্বারাও প্রমাণিত হয়।” (হাশিয়ায়ে হেদায়া, নেহায়া, শরহে বেক্বায়া)
            এ প্রসঙ্গে মুয়াত্বায়ে মুহম্মদ-এর শরাহ্ আত্ তালীকুল মুমাজ্জাদের১০৭ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে যে,
وقد ثبت فى صحيح البخارى ان معاوية رضى الله عنه اجاب الاذان وهو على المنبروقال يا ايها لناس انى سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم على هذا المجلس حين اذن المؤذن يقول مثل ما سمعتم منى مقالتى. فاذا ثبت الاجابة عن صاحب الشرع وصا حبه فما معنى الكراهة.
           
অর্থঃ-  সহীহ্ বোখারীতে উল্লেখ রয়েছে, হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) মিম্বরে বসে ছানী আযানের জবাব দিয়েছেন এবং বলেছেন, হে মানুষেরা আমি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মিম্বরে বসে এরূপে জুমুয়ার আযানের জবাব দিতে শুনেছি, যেরূপ আমাকে তোমরা জবাব দিতে শুনলে। সুতরাং যখন  জুমুয়ার আযানের জবাব দেয়া হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ছানী আযানের জবাব দেয়া তাঁর সাহাবী (রাঃ)গণ হতে প্রমাণিত, তখন এটাকে মাকরূহ্ বলার অর্থ কি? (মূলতঃ এটা মাকরূহ্ নয়, বরং ওয়াজিব)
            আর ইবনে নজীম মিছরী (রঃ) তাঁর বিখ্যাত কিতাব বাহ্রুর রায়েকেলিখেন যে,
قال بعضهم انما كان يكره ما كان من كلام الناس واما التسبيح ونحوه فلا (بكره) وقال بعضهم كل ذالك مكروه والاول اصح.
           
অর্থঃ- কেউ কেউ বলেন, মানুষের কথা-বার্তা অর্থাৎ দুনিয়াবী কথা-বার্তা মাকরূহ্। আর তাস্বীহ্-তাহ্লীল এবং অনুরূপ (দোয়া - দরূদ) পড়া মাকরূহ নয়। আর কেউ কেউ বলেন, সবই মাকরূহ্। তবে প্রথমটিই সহীহ্ (বিশুদ্ধ) মত।” (অর্থাৎ জবাব দেয়া ও দোয়া পড়া মাকরূহ্ নয়)।
 ছানী আযানের জবাব দেয়া প্রসঙ্গে ওমদাতুর রেয়াইয়াকিতাবের ১ম জিঃ ২৪৪ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে,
علامۃ لکھنوی فرماتے ھین- فلاتکرہ اجابۃ الاذان الذی یؤذن بین یدی الخطیب و قد ثبت ذالک من فعل معاویۃ فی صحیح البخاری

অর্থঃ- আল্লামা লক্ষেèাবী বলেন, জুমুয়ার ছানী আযান- যা খতীবের সম্মুখে দেয়া হয়, তার জাওয়াব দেয়া মাকরূহ্ নয়। কেননা নিশ্চয় এটা হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ)-এর আমল দ্বারা সহীহ্ বোখারীতে প্রমাণিত রয়েছে।
            এ প্রসঙ্গে কিতাবে আরো উল্লেখ আছে যে,
           
قد ثبت اجابة الثانى عن النبى صلى الله عليه وسلم  ومعاوية رضى الله عنه ما اخرجه البخارى فاين الكراهة.
অর্থঃ- নিশ্চয় আযানের ও ছানী আযানের জবাব দেয়া হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) হতে প্রমাণিত রয়েছে। যেটা ইমাম বোখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সুতরাং মাকরূহ্ কোথায়?” (নাফ্উল মুফতী ওয়াস সায়েল পৃঃ১০৩)
            ছানী আযানের জবাব দেয়া যে জায়েয, তা ওলামায়ে দেওবন্দের কিতাবেও রয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে ইমদাদুল আহ্কাম”-এর ১ম জিঃ ৩২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
جمعہ کی اذان ثانی کا جواب دینا مختلف فیہ ھے، صاحبین کے نزدیک جائز ھے اور امام صاحب کے قول مین مختلف روایت ھین- ایک روایت سے جواز معلوم ھوتاھے- اور ایک روایت سے کراھت معلوم ھوتی ھے- اور طحطاوی نے اس کا اصح ھونا نقل کیاھے-
اور امام صاحب سے جویہ قول مشھور ھے کہ خروج امام قاطع صلوۃ و کلام ھے- اسکا مطلب یہ ھے کہ خروج امام  قاطع کلام الناس ھے اور قاطع سائر الکلام خطیۃ شروع ھوجا نا ھے- پس ابتداء خطبہ سے پھلے کلام دینی یعنی تسبیح و جواب اذان جائز ھے- ویہ وردت الاحادیث ناظفۃ کما ذکرتہ فی اعلاء السنن فعن ابی ھریرۃ مرفوعا- خروج الامام یوم الجمعۃ یقطع الصلوات و کلامہ یقطع الکلام اخرجہ البیھقی، وسندہ حسن-
           
অর্থঃ- জুমুয়ার ছানী আযানের জবাব দেয়ার মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সাহেবাইন-এর নিকট জায়েয এবং ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর ক্বাওলের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এক বর্ণনা মতে জায়েয প্রমাণিত হয়, আরেক বর্ণনা মতে মাকরূহ্ বুঝা যায় এবং তাহ্তাবী এটাকে অধিক সহীহ্ বলে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-এর প্রসিদ্ধ যে ক্বাওল রয়েছে, “ইমাম সাহেবের আগমন নামাজ ও কথা-বার্তাকে নিষেধ করেএ কথার মূল অর্থ হলো- ইমাম সাহেবের আগমন সকলের কথা-বার্তাকে বন্ধ করে দেয় এবং তিনি খুৎবা শুরু করার সাথে সাথে সর্ব প্রকার কথা-বার্তা নিষিদ্ধ। সুতরাং খুৎবা শুরু করার পূর্বে দ্বীনী কথা-বার্তা অর্থাৎ তাস্বীহ্-তাহ্লীল ও আযানের জাওয়াব দেয়া জায়েয। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। যেমন এলাউস সুনানকিতাবে উল্লেখ রয়েছে, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে মরফূ হাদীস শরীফ বর্ণিত- জুমুয়ার দিন ইমাম সাহেবের (খুৎবার জন্য) আগমন সকল নামাজকে নিষিদ্ধ করে দেয় এবং তার খুৎবা কথা-বার্তাকে বন্ধ করে দেয়। এটা বায়হাক্বী বর্ণনা করেছেন ও তার সনদ হাসান।
            আর কেফাইয়াতুল মুফ্তীর ৩য় জিঃ ২১৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
امام محمد رحمۃ اللہ کے نزدیک اذان  خطبہ کا جواب دینا جائز ھے-
امام  حضرت ابو یوسف و امام حضرت محمد رحمۃ اللہ علیھما خطبہ شروع ھونے سے پھلے غیر خطیب کیلئے کلام دینی کو جائز فرماتے ھین- تو اجابت اذان اور دعاء وسیلہ ان کے نزدیک جائز ھے-
            অর্থঃ- ইমাম মুহম্মদ (রঃ)-এর নিকট ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া জায়েয। ইমাম আবূ ইউসূফ (রঃ) এবং ইমাম মুহম্মদ (রঃ) খুৎবা শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত মোক্তাদীগণের জন্য দ্বীনী কথা-বার্তা বলা জায়েয বলেছেন। তাই ছানী আযানের জবাব দেয়া এবং মুনাজাত করা তাঁদের নিকট জায়েয।
            অতএব, উপরোল্লিখিত বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য অকাট্য দলীল-আদিল্লার ভিত্তিতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, সহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মতে আযান ও ছানী আযানের মৌখিক জবাব দেয়া ওয়াজিব। যারা এটাকে মুস্তাহাব বা নাজায়েয বলে ফতওয়া দেয়, তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল।
দলীলঃ- মুসলিম, নাসাঈ, আবু দাউদ, আহ্মদ, মেশকাত, শরহে নববী, বযলুল মাজহুদ, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্, বোখারী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্, ফাতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, কাশফুলগুম্মাহ্, বাহ্রুর রায়েক, ফতহুল ক্বাদীর, দররুল মোখতার, শামী, কবীরী, আলমগীরী, শরহে বেক্বায়া, আরকানে আরবা, হাশিয়ায়ে তাবযীনুল হাক্বায়েক, হাশিয়ায়ে তাহ্তাবী, গায়াতুল আওতার, ফতওয়ায়ে সিদ্দীকিয়া ইত্যাদি)
আযান ও ছানী আযানের পর দোয়া পাঠ করার ফযীলত
            আযান ও ছানী আযানের পর দোয়া পাঠ করা সুন্নত ও অশেষ ফযীলতের কারণ। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে বহু ফযীলত বর্ণিত রয়েছে। যেমন- এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
عن حابر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- من قال حين يسمع التداء-
اللهم رب هذه الدعوة التامة والصلاة القائمة ات محمدن الوسيلة والفضيلة وابعثه مقاما محمودان الذى وعدته- حلت له شفاعتى يوم القيامة.
           
অর্থঃ- হযরত জাবের (রাঃ) হতে বণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আযান শুনে অর্থাৎ আযানের পর আল্লাহুম্মা রব্বা হাজিহিদ দাওয়াতিত্ তাম্মাহ্ ওয়াচ্ছলাতিল ক্বইমাহ্, আতি মুহাম্মাদানিল ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাদীলাতা ওয়াব্ আছহু মাক্বামাম মাহ্মুদানিল লাজী ওয়া আদ্দাহু” (বায়হাক্বী শরীফে আরো উল্লেখ আছে ইন্নাকা লা তুখলিফুল মীয়াদ) এ দোয়া পাঠ করবে তার জন্যে ক্বিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ অবধারিত।” (বোখারী, মেশকাত, ফাতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
            এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ আছে যে,
عن سعد بن ابى وقاص قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- من قال حين يسمع المؤذن اشهد ان الا اله الا الله وحده لا شريك له وان محمدا عبد ورسوله رضيت با لله ربا وبمحمد رسول لا وبالا سلام دينا غفر له ذنبه.

অর্থঃ- হযরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) বর্ণনা করেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শুনে অর্থাৎ আযানের পর বলবে, “আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রসূলুহু রদীতুবিল্লাহি রব্বাও ওয়াবি মুহাম্মাদির রসূলাও ওয়াবিল ইসলামি দীনাতার গুণাহ্ খাতা সমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (মুসলিম, মেশকাত, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
            শুধু তাই নয়, হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ আছে যে, আযানের পর দোয়া নির্ঘাত কবুলযোগ্য। যেমন- এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,

عن انس رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- لا يرد الدءابين الا ذان والا ققامة.
অর্থঃ- হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেন- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আযান ও এক্বামতের মধ্যবর্তী দোয়া (আল্লাহ্ পাক) কখনো ফিরায়ে দেননা।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, মেশকাত, বযলুল মাজহুদ, মায়ারেফুস্ সুনান, উরফূশ্ শাজী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
            হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে,
عن سهل بن سعد قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- ثنتان لا تردان او قلما تردان الدعاء عند النداء وعندالبأس حين يلحم بعصهم بعضا.
অর্থঃ- হযরত সহল ইবনে সাদ (রাঃ)হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দুই সময়ের দোয়া ফিরায়ে দেয়া হয়না অথবা কমই ফিরায়ে দেয়া হয়- (১) আযানের সময়ের দোয়া (২) জ্বিহাদে যখন কাটাকাটি শুরু হয় সে সময়ের দোয়া।” (আবু দাউদ, দারেমী, মেশকাত, বযলুল মাজহুদ, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
            উল্লেখ্য, আযানের পর দোয়ায়ে উসীলা পাঠ করার পূর্বে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি দরুদ শরীফ পাঠ করার ব্যাপারে নির্দেশ এসেছে ও বিশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন- এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- اذا سمعتم المؤذن فقولوا مثل ما يقول- ثم صلوا على فائه من صلى على صلاة صلى الله عليه بها عشرا ثم سلوا لله لى الوسيله ...... فمن سأل لى الوسيلة حلت عليه الشقاعة.
অর্থঃ- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আযান শুনবে, তখন তোমরাও অনুরূপ বলবে। অতঃপর আমার প্রতি দরুদ শরীফ পাঠ করবে। কেননা যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ শরীফ পাঠ করবে আল্লাহ্ পাক তার প্রতি দশটি রহ্মত নাযিল করবেন। অতঃপর আমার জন্য উসীলার সুওয়াল করবে অর্থাৎ দোয়ায়ে উসীলা পাঠ করবে। ....................... যে ব্যক্তি আমার জন্য দোয়ায়ে উসীলা পাঠ করবে, তার জন্য শাফায়াত ওয়াজিব।” (মুসলিম, মেশকাত, হাশিয়ায়ে তাহ্তাবী, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাযীহ্)
ফতওয়ায়ে মাহ্মুদিয়াতেউল্লেখ আছে যে,

سوال:- اذان کے بعد مناجات کیسی ھے؟
جواب- اذان کے بعد دعاء و سیلہ مستحب ھے- کذا فی درمختار جصفہ ৪১২
অর্থঃ- সুওয়াল- আযানের পর মুনাজাত করা কি?
জাওয়াব- আযানের পর দোয়ায়ে উসীলা পড়া (অর্থাৎ মুনাজাত করা) মুস্তাহাব। অনুরূপ দুররুল মোখতার ১ম জিঃ পৃঃ৪১২ উল্লেখ রয়েছে।
            অতএব, আযানের ন্যায় ছানী আযানের পরও দোয়া পাঠ করা সুন্নত, কারণ ছানী আযান তা আযানেরই অন্তর্ভুক্ত।
            স্মর্তব্য যে, কেউ কেউ নিম্নোক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা ছানী আযানের পর দোয়া পাঠ করা নাজায়েয বলে থাকে। যেমন হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
اذاخرج الامام فلا صلوة ولا كلام.
অর্থঃ- ইমাম যখন (খুৎবার জন্য) বের হয়, তখন নামাজ পড়া ও কথা বলা নিষেধ।” (তিবরানী শরীফ)
            অথচ উক্ত হাদীস শরীফের দ্বারা যে, ছানী আযানের জবাব দেয়ার ন্যায় দোয়া পাঠ করাও নাজায়েয প্রমাণিত হয়না, তা পুর্ববর্তী আলোচনা দ্বারাই অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অর্থাৎ ইমাম আবূ হানীফা (রঃ), ইমাম আবূ ইউসুফ (রঃ), ও ইমাম মুহম্মদ (রঃ) তাদের সকলের মতেই ছানী আযানের পর দোয়া পাঠ করা জায়েয। কেননা তাঁদের মতে খুৎবা শুরু হওয়ার পুর্ব পর্যন্ত দ্বীনী কথা-বার্তা, তাসবীহ-তাহলীল, দোয়া- দরুদ ইত্যাদি পাঠ করা জায়েয।
            অতএব, সাব্যস্ত হলো যে, আযান ও ছানী আযানের পর দোয়া পাঠ করা শুধু জায়েযই নয় বরং সুন্নত ও অশেষ ফযীলত, বরকত ও রহ্মত ও শাফায়াত লাভের কারণ।
আযান ও ছানী আযানের পর
হাত তুলে মুনাজাত করা
            উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, আযান ও ছানী আযানের জবাব দেয়া ওয়াজিব ও তার পরে দোয়া পাঠ করা সুন্নত। আযান ও ছানী আযানের পর হাত তুলে দোয়া পাঠ করা বা মুনাজাত করাও মুস্তাহাব। জায়েয তো বটেই। কেননা কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে,
يسن رفع اليدين الى السماء فى كل دعاء.
অর্থঃ- সকল দোয়ায় (নামাজের বাহিরে) হাত উর্দ্ধে উঠানো সুন্নত।” (মেরকাত শরহে মেশকাত)
            মেশকাত শরীফের শরাহ্ মেরকাত শরীফে আরো উল্লেখ আছে যে,
استفيد من هذا الحديث والذى قبله- انه يسن رفع اليدين الىالسماء فى كل دعاء ...... وقال النووى ومن ادعى حضرها فقد غلط غلطا فاحشا.
অর্থঃ- “(দোয়ায় হাত উঠানো সংক্রান্ত হাদীস শরীফ দ্বারা) এটাই প্রমাণিত হয় যে, সকল দোয়াতেই হাত উঠানো সুন্নত। ............. ইমাম নববী (রঃ) বলেন, যে ব্যক্তি বলে কোন বিশেষ দোয়ায় হাত উঠানো জায়েয, তবে নিশ্চয় তার এ দাবী ভ্রমাত্মক।
            আর ফতওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে যে, 

يرفع هما لمطلق الدعاء فى سائر الا مكنة والازمنة على طبق ما وردت به السنة.
অর্থঃ- হাদীস শরীফের বর্ণনা মতে সর্বস্থানে, সকল সময়, সমস্ত দোয়াতে হাত উঠানো সুন্নত প্রমাণিত হয়।
            আযানের সময় হাত তুলে মুনাজাত করা সম্পর্কে ফাতহুল ক্বাদীরেআরো উল্লেখ আছে যে,
ووجهه عموم دليل الرفع للدعاء ويجاب بانه مخصوصة بما ليس فى الصلوة لا حماع على ان لا رفع فى دعاء التشهد.
অর্থঃ- দোয়ার মধ্যে হাত উঠানোর দলীল কোন দোয়ার জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট নয়। সকল দোয়াতেই হাত উঠানো জায়েয। তবে নামাজের মধ্যস্থিত দোয়ায় হাত উঠানো বিধেয় নয়, কেননা সর্বসম্মত মত হলো- তাশাহ্হুদের দোয়াতে হাত উঠানো জায়েয নয়।
            আর ইমদাদুল ফতওয়াতে উল্লেখ আছে যে,
سوال:- کیا فرمائے ھین علماء  دین وخلفاء شرع متین- اس مسئلہ مین کہ دعا مانگنا ھاتھ اطھاکر بعد اذان کے کیسا ھے؟
جواب:- بالتخصیص دعاء اذان مین ھاتھ اطھاناتو نھین دیکھا گیا مگر مطلقا دعا مین ھاتھ اطھانا احادیث قولیۃ، فعلیۃ، مرفوعۃ، مرقوفہ کثیرہ شہیدہ سے ثابت ھے من غیر تخصیص بدعاء دون دعاء – پس دعاء اذان مین بھی ھاتھ اطھانا سنت ھوگا- لاطلاق الدلائل-
অর্থঃ-  সুওয়াল- আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা সম্পর্কে ওলামায়ে দ্বীনের রায় কি?
জাওয়াবঃ- বিশেষভাবে আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা পরিলক্ষিত হয়না। তবে সাধারণভাবে (যে কোন) মুনাজাতের সময় হাত উঠানো সম্পর্কে বহু ক্বাওলী, ফেলী, মরফূ, মওকূফ ও বহু প্রসিদ্ধ হাদীস শরীফ বিদ্যমান রয়েছে। কোন দোয়াকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। সুতরাং আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করাও সুন্নত প্রমাণিত হয়। কেননা দলীলসমূহ মুত্লক্ব (ব্যাপক)।
            আর এ প্রসঙ্গে ফতওয়ায়ে দেওবন্দেউল্লেখ আছে যে,

سوال:- اذان کی دعا مین ھاتھ اطھا کر دعا پرھے مسنون کیا ھے؟
جواب:- ھرطرح درست ھے-
অর্থঃ- সুওয়াল - আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করবে কি? সুন্নত তরীক্বা কোনটি?
জাওয়াবঃ- প্রত্যেক অবস্থায় জায়েয আছে। অর্থাৎ হাত উঠায়ে এবং না উঠায়ে উভয় অবস্থায় জায়েয।” (তবে হাত উঠানোই উত্তম, কেননা দোয়ায় হাত উঠানো আদবের অন্তর্ভূক্ত)।
ফতওয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ ২য় জিঃ ১১০ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে,

سوال:- بعد اذان رفع یدین کرکے مناجات کرنا ثابت ھے یا نھین؟
جواب:- خصوصیت کے ساتھ اس موقع پر رفع یدین ثابت نھین ھے اگر چہ عموما دعاء مین رفعیدین کا مستحب ھونا اسکے استحباب کومقتضی ھے-
অর্থঃ- সুওয়ালঃ- আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা প্রমাণিত আছে কি?
জাওয়াবঃ- বিশেষভাবে আযানের মুনাজাতে হাত উঠানো প্রমাণিত নেই। তবে সাধারণভাবে যেহেতু মুনাজাতের মধ্যে হাত উঠানো মুস্তাহাব, তাই আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব হওয়ার প্রমাণই বহন করে।
            এ প্রসঙ্গে ফতওয়ায়ে রহীমিয়াতেউল্লেখ আছে যে,
اذان کے بعد کی دعا مین ھاتھ اطھانا منقول نھین ھے ویسے مطلقا دعا مین ھاتھ اطھانا قولی اور فعلی (حدیث) سے ثابت ھے- لھذا دعائے اذان مین ھاتھ اطھانے کو سنت کی خلاف ورزی نھین کھا جائیگا-
অর্থঃ- আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা  (আমল দ্বারা) বর্ণিত নেই। তবে সাধারণভাবে মুনাজাতে হাত উঠানো ক্বাওলী এবং ফেলী (উভয় প্রকার হাদীস শরীফ) দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে। তাই আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করাকে সুন্নতের খিলাফ (বিপরীত) বলা যাবেনা।
            আর কিফাইয়াতুল মুফতীতে উল্লেখ আছে,

سوال:- اذان کے بعد ھاتھ اطھاکر مناجات کرنا کیسا ھے....؟
جواب:- اذان کے بعد جوالفاظ ادا کیئے جاتے ھین وہ دعاکے الفاظ ھین اور رفع یدین اداب دعا  مین سے ھے- اس لئےھاتھ اطھانے مین مضائقہ نھین
অর্থঃ- সুওয়াল - আযানের পর হাত উঠায়ে মুনাজাত করা কিরূপ?
জাওয়াব- আযানের পর যে সকল শব্দসমূহ পড়া হয়, সেগুলো দোয়ার শব্দ। আর দোয়ার সময় উভয় হাত উঠানো আদবের অন্তর্ভূক্ত। তাই হাত উঠায়ে মুনাজাত করাতে কোন ক্ষতি নেই।
            হাফেজে হাদীস বাহ্রুল উলূম, ফক্বীহুল উম্মত, সাইয়্যিদুল মুনাজিরীন, রঈসুল মুহাদ্দিসীন, তাজুল মুফাস্সিরীন, শায়খুল মাশায়েখ, আমীরুশ শরীয়ত ওয়াত্ব ত্বরীক্বত হযরাতুল আল্লামা হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী মুহম্মদ রুহুল আমীন বশীর হাটী (রঃ) (খলীফায়ে ফুরফুরা শরীফ) তাঁর লিখিত জরুরী মাসায়েলকিতাবে উল্লেখ করেন, “আযানের পর হাত উঠায়ে দোয়া করা জায়েয।
            আযানের পর মুয়াজ্জিন ও স্রোতাদের হাত উঠায়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব। শুধু আযানের পর নয়, নামাজের মধ্যস্থিত (দোয়া কুনূত, দোয়ায়ে মাসূরা ইত্যাদি) দোয়া ব্যতীত সকল দোয়ার জন্য হাত উঠানো এবং উক্ত হাত মুখমন্ডলে মসেহ্ করাও মুস্তাহাব। (ফতওয়ায়ে সিদ্দীক্বিয়া পৃঃ১৪৫)
            অতএব, মূল কথা হলো- উপরোল্লিখিত বিস্তারিত ও নির্ভরযোগ্য অকাট্য দলীল-আদিল্লার ভিত্তিতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, জুমুয়ার দিন আযানের ন্যায় ছানী আযানের জবাব দেয়া জায়েয ও ছানী আযানের পর খুৎবা শুরু করার পূর্বে দ্বীনী কথা-বার্তা অর্থাৎ তাস্বীহ্- তাহ্লীলের ন্যায় আযানের পর দোয়া পাঠ করা ও হাত তুলে মুনাজাত করা জায়েয ও মুস্তাহাব, মাকরূহ্ মোটেও নয়। এটাকে বিদ্য়াত বা মাকরূহ্ বলা গোমরাহীর নামান্তর।
            সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
যামানায় আযান
            সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযানের ন্যায় জুমুয়ার দিনেও একটি মাত্র আযান জারী ছিল। যা মসজিদের বাইরে দরজার উপর দেয়া হতো। অনুরূপ খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর খেলাফত কালেও জুমুয়ার নামাজে একটি মাত্র আযান জারী ছিল। যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
عن السائب بن يز يد قال: كان الا ذان على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم وابى بكر وعمر اذا خرج الا مام- واذا اقيمت الصلاة- فلما كان عشمان زاد النداء الثالث على الزوراء.
অর্থঃ- হযরত সাইব ইব্নে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইব্নুল খাত্তাব (রাঃ)-এর সময় একটি মাত্র আযানের প্রচলন ছিল। আর তা ইমাম (হুজরা) হতে বের হলে দেয়া হতো। এর পর (খুৎবা পাঠ করার পর) নামাজের জন্য ইক্বামত দেয়া হতো, অতঃপর হযরত ওসমান (রাঃ) (খেলাফতে আসীন হবার পর) যাওরানামক স্থানে তৃতীয় আযান বৃদ্ধি করেন। (উল্লেখ্য হাদীস শরীফের রাবীগণ ইক্বামতকেও আযান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাই হযরত ওসমান (রাঃ)-এর আযানকে তৃতীয় আযান বলেছেন) ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীস শরীফকে হাসান সহীহ্ বলেছেন।
            শব্দের সামান্য তারতম্য করে ইমাম বোখারী, ইমাম আহমদ ইব্নে হাম্বল, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম নাসাঈ, ইমাম বায়হাক্বী, ইমাম ইব্নে মাজা (রঃ) উক্ত হাদীস শরীফখানা স্ব স্ব কিতাবে উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে অন্য হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে,
عن السائب بن يزيد قال كان يزذن بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا جلس على المنبر يوم الجمعة على باب المسجد وابى بكر وعمر.           
অর্থঃ- হযরত সাইব ইব্নে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জুমুয়ার দিন মিম্বরে বসতেন, তখন তাঁর উপস্থিতিতে মসজিদের দরজার উপর আযান দেয়া হতো। অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর (খেলাফত) কালেও দেয়া হতো। (আবু দাউদ শরীফ ১ম খন্ড, ২৮৫পৃঃ)
            উল্লিখিত হাদীস শরীফ হতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আমীরুল মুমিনীন হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ)-এর খেলাফতের পূর্বে মসজিদের ভিতরে ইমামের সম্মূখে ইক্বামত ভিন্ন অন্য কোন আযান এর প্রচলন ছিল না, তা ছাড়া জুমুয়ার দিন বাইরেও কোন আযান দেয়া হতো না, তখন একটিমাত্র আযান ছিল, আর ওটা দেয়া হতো মসজিদের দরজার উপর বা সন্নিকটে। এ আযানের পরেই খুৎবা পাঠান্তে ইক্বামত দিয়ে নামাজ শুরু হয়ে যেত।
            অনুরূপ বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য সকল তাফসীরের কিতাব সমূহে

يا ايها الذين امنوا اذا نودى للصلوة من يوم الجمعة.

            এ আয়াত শরীফের তাফসীরে উল্লেখ আছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় এবং খলীফাতু রাসূলিল্লাহ্, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর খেলাফত কাল পর্যন্ত জুমুয়ার নামাজে একটি মাত্র আযান জারী ছিল। যেমন এ প্রসঙ্গে তাফসীরে আহ্কামুল কোরআন লিলকুরতুবী ১৮ জিঃ ১০০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
وقد كان الا ذان على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم كما فى سائر الصلوات يؤذن واحد اذا جلس النبى على المنبر وكذالك كان يفعل ابو بكر وعمر رضى الله عنهما.
র্
অর্থঃ- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় জুমুয়ার পাঁচ ওয়াক্ত আযানের ন্যায় একটি মাত্র আযানই প্রচলিত ছিল। যা হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরে বসার পর দেয়া হতো। অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
            এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে রুহুল মায়ানী ১৪ জিঃ ৯৮ পৃষ্ঠায় আরো উল্লেখ আছে যে,
 وقد كان لرسول الله صلى الله عليه وسلم مؤذن واحد فكان اذا حلس على المنبر اذن على باب المسجد- فاذا انزل رسول الله صلى الله عليه وسلم اقامة الصلاة- ثم كان ابو بكر وعمر على ذالك.
অর্থঃ- হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় একটিমাত্র আযান প্রচলিত ছিল, যা তিনি মিম্বরে বসার পর দরজায় দেয়া হতো। অতঃপর যখন তিনি মিম্বর হতে অবতরণ করে, নামাজের জন্য দাঁড়াতেন, তখন নামাজের জন্য ইক্বামত দেয়া হতো। অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) পর্যন্ত একটিমাত্র আযানই প্রচলিত ছিল।
            উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও প্রথম দুখলীফা (রাঃ)-এর খেলাফত কাল পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযানের ন্যায় জুমুয়ার দিনেও একটি মাত্র আযানই দেয়া হতো, যা মসজিদের বাইরে দরজায় দেয়া হতো। অর্থাৎ সে সময় জুমুয়ার দিন ইক্বামত ব্যতীত মসজিদের ভিতরে কোন আযানই দেয়া হতো না।
মতলক্ব আযান মসজিদের
ভিতরে দেয়ার আহ্কাম
            মত্লক্ব আযান অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান ও জুমুয়ার প্রথম আযান মসজিদের বাইরে দেয়াই সুন্নত। আর তা মসজিদের ভিতরে দেয়া মাকরূহ্ তানযীহী। কারণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, খোলাফা-ই-রাশেদীন, হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ) ও তৎপরবর্তী যুগে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান ও জুমুয়ার প্রথম আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না।
            আর তাই ইমাম-মুজ্তাহিদগণ বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য প্রায় সকল ফিক্বাহের কিতাবেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান ও জুমুয়ার প্রথম আযান অর্থাৎ মতলক্ব আযানসমূহ মসজিদের ভিতরে দেয়াকে মাকরূহ্ তানযীহী বলে উল্লেখ করেছেন। যেমন এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব বাহ্রুর রায়েকের১ম জিঃ ২৫৫ পৃষ্ঠায় আযানের অধ্যায়ে বিখ্যাত ফক্বীহ্, বিশিষ্ট মুজ্তাহিদ, আবূ হানীফায়ে ছানী, আল্লামা ইব্নে নজীম শায়খ যাইনুদ্দীন মিছরী (রঃ) লিখেন,

وينبغى للمؤذن ان يؤذن فى موضع يكون اسمع للجيران ويرفع صوته ....... وفى الخلاصة ولا يؤذن فى المسجد..      
অর্থঃ- মুয়াজ্জিনের জন্য এরূপস্থানে আযান দেয়া উচিত যেন প্রতিবেশীরা ভালরূপে শুনতে পায় এবং মুয়াজ্জিন তার আওয়াজকে উচ্চ করবে। ......... আর খোলাছা কিতাবে উল্লেখ আছে যে, (মুয়াজ্জিন) মসজিদের ভিতর আযান দিবেনা।
            এ প্রসঙ্গে শায়খুল আজল, ইমামুল আকমাল, ফক্বীহুল আমজাদ, তাহের ইব্নে আব্দুর রশীদ আল বোখারী (রঃ) তাঁর বিখ্যাত ও মশহুর ফিক্বাহের কিতাব খোলাছাতুল ফতওয়া১ম জিঃ ৪৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন,
وينبغى ان يؤذن على الميذنة او خارح المسجد ولا يؤذن فى المسجد.
অর্থঃ- মিনারা বা উচ্চ স্থানে অথবা মসজিদের বাইরে আযান দেয়া উচিত, মসজিদের ভিতরে আযান দিবেনা।
            অনুরূপ ক্বাজীখান, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ফতহুল ক্বাদীর, তাহ্তাবী আলা মারাক্বিউল ফালাহ্, শরহে নেক্বায়া, খাযানাতুল মুফ্তিয়্যীন, গুনিয়া শরহে মুনিয়া ও ওমদাতুর রেয়ায়া হাশিয়ায়ে শরহে বেক্বায়া ইত্যাদি কিতাবসহ আরো বহু নির্ভরযোগ্য ও বিখ্যাত ফিক্বাহের কিতাব সমূহের আযানের অধ্যায়েউল্লেখ আছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান (জুমুয়ার প্রথম আযানসহ) মসজিদের ভিতরে দেয়া যাবেনা বা মসজিদের ভিতরে দেয়া মাকরূহ্।
            উল্লেখ্য যে, কেউ কেউ উল্লিখিত কিতাব সমূহের ইবারত উল্লেখ করে বলে থাকে যে, “জুমুয়ার ছানী আযানমসজিদের ভিতরে দেয়া মাকরূহ্ বা খেলাফে সুন্নত। অথচ তাদের এ বক্তব্য নেহায়েতই অজ্ঞতামূলক ও বিভ্রান্তিকর। সাথে সাথে ছানী আযান সম্পর্কে তাদের চরম অজ্ঞতাকেই পরিষ্ফুটিত করে তোলে।
            কারণ যে সকল কিতাবে মসজিদের ভিতর আযান দিতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে ছানী আযানের কথা বিন্দুমাত্রও উল্লেখ নেই। বরং মত্লক্ব আযান অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান ও জুমুয়ার প্রথম আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া যাবেনা বলে উল্লেখ আছে। আর তাই উল্লিখিত ফিক্বাহের কিতাবের জুমুয়ার অধ্যায়েছানী আযান মসজিদের ভিতর মিম্বরের নিকট দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন- ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব ফতওয়ায়ে আলমগীরী ১ম জিঃ ৮৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,

وقال الطحاوى الحنفى يجب السعى ويكره البيع عند اذان المنبر.
অর্থঃ- ইমাম তাহাবী (রঃ) বলেন, মিম্বরের নিকট আযান দেয়ার সময় সায়ী করা (মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া) ওয়াজিব ও বেচা-কেনা নিষিদ্ধ।
            অনুরূপ ফিক্বাহের নির্ভরযোগ্য ও মশহুর কিতাব ফতহুল ক্বাদীর ২য় জিঃ ১২০ পৃষ্ঠায় ও মারাকিউল ফালাহ্ ২৮২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
وكان المعتبر هو الاذان الثانى عند المنبر بين يدى الخطيب.
অর্থ- গ্রহণযোগ্য মত এই যে, ছানী আযান যা মিম্বরের নিকটে খতীবের সম্মুখে দেয়া হয়।” (তখন থেকেই মসজিদের দিকে সায়ী করা বা মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া ওয়াজিব)।
            এখন প্রশ্ন হলো- তাদের উল্লিখিত কিতাবের ইবারতের দ্বারা যদি ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া নাজায়েয প্রমাণিত হয়, তবে উপরে বর্ণিত ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ফাতহুল ক্বাদীর ও মারাক্বিউল ফালাহ্তে ছানী আযান মিম্বরের নিকট খতীবের সম্মুখে অর্থাৎ মসজিদের ভিতরে দেয়ার কথা বলা হলো কেন? যেহেতু মিম্বরের নিকট ও খতীবের সম্মুখে আযান দেয়ার অর্থই হলো- মসজিদের ভিতরে আযান দেয়া। তাই দ্বারা কি স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়না যে, তাদের উল্লিখিত কিতাবের ইবারত সমূহ ছানী আযান সম্পর্কিত নয়। বরং উল্লিখিত ইবারতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান ও জুমুয়ার প্রথম আযানের কথাই বলা হয়েছে। কারণ বিশ্ববিখ্যাত প্রায় তাফসীর ও ফিক্বাহের কিতাবেই জুমুয়ার ছানী আযান
عند المنبر بين يدى الخطيب.
অর্থাৎ মিম্বরের নিকট, খতীবের সম্মুখে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এমন একখানা নির্ভরযোগ্য দলীলও কেউ পেশ করতে পারবেনা, যেখানে উল্লেখ আছে যে, ছানী আযান
على باب المسجد او خارح المسجد.
অর্থাৎ মসজিদের দরজায় অথবা বাইরে দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
            তাছাড়া মত্লক্ব আযানের উদ্দেশ্য হলো- মুছল্লীদেরকে নামাজের সংবাদ দেয়া। সেজন্য ফিক্বাহের কিতাবে এরূপ স্থানে দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে আযান দিতে বলা হয়েছে, যাতে মুছল্লীগণ ভালরূপে শুনতে পায়। মসজিদের ভিতরে আযান দিলে যেহেতু মুছল্লীগণ শুনতে পাবেনা, সেহেতু ফক্বীহগণ মসজিদের ভিতরে আযান দেয়াকে মাকরূহ্ বলেছেন। আর তাই অন্যান্য আযানের ন্যায় জুমুয়ার প্রথম আযান মসজিদের বাইরে দেয়া সুন্নত ও ভিতরে দেয়া মাকরূহ্।
            অপরপক্ষে জুমুয়ার ছানী আযানের উদ্দেশ্য হলো- মসজিদে উপস্থিত মুছল্লীদেরকে খুৎবা শুনার জন্য সতর্ক করে দেয়া বা নিশ্চুপ থাকতে বলা। সুতরাং এ আযান যদি মসজিদের বাইরে দেয়া হয়, তবে মসজিদে উপস্থিত অনেকের পক্ষে এ আযান না শুনাই স্বাভাবিক। আর তাই ফিক্বাহের কিতাবে এ আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে বোখারী শরীফের নির্ভরযোগ্য শরাহ্ বা ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল বারী ২য় জিঃ ৩৯৩ পৃষ্ঠায় ও এলাউস্ সুনান ৮ম জিঃ ৬৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
والظاهر انه كان لمطلق الاعلام لخصوص الا نصات نعم لمازيد الا ذان الاول كان الذى يدى الخطبب الانصات.
অর্থঃ- প্রকাশ থাকে যে, নিশ্চয় (হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার) আযান সাধারণতঃ মানুষদেরকে নামাজ ও খুৎবার সংবাদ দেয়ার জন্যই দেয়া হতো। (তাই ওটা মসজিদের বাইরে দেয়া হতো, যাতে সকলে নামাজ ও খুৎবায় অংশ গ্রহণ করতে পারে) যখন জুমুয়ার প্রথম আযান বৃদ্ধি করা হলো, তখন খতীবের সম্মুখের আযানটি মূলতঃ মসজিদে উপস্থিত লোকদের চুপ হওয়ার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়। (তাই ছানী আযান মসজিদের ভিতরেই দেয়া হয়)
            কাজেই ছানী আযান মসজিদের বাইরে না হয়ে মসজিদের ভিতরে হবে, এটা নক্বলী দলীলের সাথে সাথে আক্বলী দলীলের দ্বারাও প্রমাণিত হয়।       স্মর্তব্য যে, ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়াই খাছ সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত। কেননা আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওসমান জিন নূরাইন (রাঃ)-এর নির্দেশক্রমেই সর্ব প্রথম মসজিদের ভিতর ছানী আযান দেয়া শুরু হয় এবং তিনিই এর প্রবর্তক। আর তখন থেকেই (توارثا) নিয়মিতভাবে ছানী আযানমসজিদের ভিতরে দেয়া হচ্ছে। যা তাফসীরে আহ্কামুল কোরআন, কুরতুবী, রুহুল মায়ানী, সিরাজুম্মুনীর, ওছমানী, কামালাইন, মায়ারেফুল কোরআন ইত্যাদি কিতাব সমূহের বর্ণনা দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। আর হাদীস শরীফে রয়েছে, ‘‘তোমাদের জন্য আমার ও খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত পালন করা লাযেম।
            তাই ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়াই উম্মতে মুহম্মদীর জন্য খাছ সুন্নত। যেহেতু তা তৃতীয় খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সুন্নত বা উদ্ভাবিত আমল।
            যদি তাই হয়ে থাকে, তবে কিরুপে বলা যেতে পারে যে, ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া মাকরূহ্?
 মূলকথা হলো- তাদের উল্লিখিত কিতাবের ইবারতের দ্বারা ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া কখনোই মাকরূহ্ প্রমাণিত হয়না। বরং উল্লিখিত কিতাবের ইবারত সমূহ সম্পূর্ণরূপেই মত্লক্ব আযানঅর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমুয়ার প্রথম আযানের জন্য প্রযোজ্য। তারা কিল্লতে ইল্ম ও কিল্লতে ফাহাম ও ছানী আযানের উৎপত্তি ও ইতিহাস সম্পর্কিত ইল্মের স্বল্পতার কারণেই এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছে।
ছানী আযানের উৎপত্তি ও ইতিহাস
            পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইব্নে খাত্তাব (রাঃ)-এর সময়ে জুমুয়ার নামাজে একটিমাত্র আযানের প্রচলন ছিল। যেমন হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে,
عن السائب بن يزيد قال كان يؤذن بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا حلس على المنبر يوم الجمعة على باب المسجد وابى بكر وعمر.

অর্থঃ- হযরত সাইব ইব্নে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জুমুয়ার দিন মিম্বরে বসতেন, তখন তাঁর উপস্থিতিতে মসজিদের দরজার উপর আযান দেয়া হতো। অনুরূপভাবে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর (খেলাফত) কালেও দেয়া হতো। (আবু দাউদ শরীফ ১ম খন্ড, ২৮৫পৃঃ)
            উল্লিখিত হাদীস শরীফ হতে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আমীরুল মুমিনীন হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রাঃ)-এর খেলাফতের পূর্বে মসজিদের ভিতরে ইমামের সম্মূখে এক্বামত ভিন্ন অন্য কোন আযানের প্রচলন ছিল না, তা ছাড়া জুমুয়ার দিন বাইরেও কোন আযান দেয়া হতো না। তখন একটি মাত্র আযান ছিল, আর ওটা দেয়া হতো মসজিদের দরজার উপর বা সন্নিকটে। এ আযানের পরেই খুৎবা পাঠান্তে এক্বামত দিয়ে নামাজ শুরু হয়ে যেত।
            এটার সীমাবদ্ধতা ছিল ২৪ হিজরী পর্যন্ত। হযরত ওসমান ইব্নে আফফান (রাঃ) ২৪ হিজরীর পহেলা মুর্হরম খেলাফতে আসীন হন। তিনি খলীফা হয়ে যে সকল বিধি-বিধানের প্রচলন করেন, তার মধ্যে অন্যতম জুমুয়ার নামাজে মসজিদের বাইরে মদীনা শরীফের একটি বাজারের যাওরা” (তুলনা মুলক উঁচু) নামক স্থানে অতিরিক্ত আযানের ব্যবস্থা করা এবং হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কালীন আযান অর্থাৎ বর্তমানের ছানী আযান মসজিদের দরজা হতে স্থানান্তরিত করে মসজিদের ভিতরে মিম্বরের নিকট খতীবের সম্মুখে দেয়ার ব্যবস্থা করা।
            আর এ আযানের উৎপত্তির ইতিহাস এই যে, কিছু সংখ্যক সাহাবী খলীফাতুল মুসলিমীন, হযরত ওসমান (রাঃ)কে অবহিত করলেন যে, ব্যস্ততার কারণে অনেকের পক্ষেই আযানের পূর্বে (রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার আযান) মসজিদে আসা সম্ভব হয়না। তাই সতর্কতামূলক মসজিদের বাইরে আরেকটি আযানের ব্যবস্থা করা হলে কেমন হয়?
            তখন হযরত ওসমান ইব্নে আফফান (রাঃ) বুযুর্গ সাহাবী (রাঃ)গণদের নিয়ে পরামর্শ করে তৃতীয় আযানের ব্যবস্থা করেন। যা বর্তমানে প্রথম আযানরূপে দেখা যায়। আর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার আযানকে স্থানান্তরিত করে মসজিদের ভিতরে মিম্বরের নিকট ইমামের সম্মুখে নিয়ে আসেন, তখন হতেই এটা ছানী আযান হিসেবে পরিগণিত। যেমন      এ প্রসঙ্গে বিশ্ব বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে খাযেন ও মাদারেকে উল্লেখ রয়েছে,     
فلما كان عثمان وكثر الناس زاد النداء الثانى على الزوراء.
           
অর্থঃ- অতঃপর হযরত ওসমান (রাঃ) খলীফা হওয়ার পর জনসংখ্যার আধিক্যতার কারণে যাওরানামক স্থানে জুমুয়ার দ্বিতীয় আযান (বর্তমানে প্রথম আযান) বৃদ্ধি করেন।
            আর বোখারী শরীফের শরাহ ফয়জুল বারীতে উল্লেখ রয়েছে,

والظاهر ان الا ذان الثانى هو الاول انتقل الى داخل المسجد.
অর্থঃ- প্রকাশ থাকে যে- ছানী আযান, যা প্রথম আযান ছিল (দরজার উপর দেয়া হতো)। অতঃপর স্থান পরিবর্তন করে মসজিদের ভিতরে নেয়া হয়।
অনুরূপ তিরমিযী শরীফের শরাহ্ আল আরফুশ শাফীতেও উল্লেখ আছে।
            অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওসমান (রাঃ) স্বয়ং নিজেই জুমুয়ার দিনে অতিরিক্ত একটি আযানের প্রবর্তন করেন এবং হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার দরজার আযানকে স্থানান্তরিত করে মসজিদের ভিতর মিম্বরের নিকট খতীবের সম্মুখে নিয়ে আসেন।
হযরত ওসমান (রাঃ) ও
ছানী আযান সম্পর্কিত ইজ্তিহাদ
            জুমুয়ার দিনে একটি আযান বৃদ্ধি করা ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে স্থানান্তরিত করা এটা মূলতঃ সেই আমীরুল মুমিনীন হযরত ওসমান ইব্নে আফফান (রাঃ)-এর ইজ্তিহাদ। যিনি জলীলুল ক্বদর ও মহা মর্যাদাবান সাহাবী। যাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেছেন, 
رضى الله عنهم ورضوا عنه.
অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ পাক তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট তাঁরাও আল্লাহ্ পাক-এর প্রতি সন্তুষ্ট।
            উল্লেখ্য, আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওসমান (রাঃ), সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অতি নিকটতম ও অত্যাধিক প্রিয় সাহাবী ছিলেন। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের দুমেয়েকে অর্থাৎ হযরত রুকাইয়া ও হযরত উম্মে কুলছুম (রাঃ)কে হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নিকট বিবাহ দেন। আর সে কারণেই তাঁকে জিন্ নূরাইনঅর্থাৎ দুই নূরের অধিকারী বলা হয়।
            তাঁরা দুজন ইন্তেকাল করার পর, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি আমার আরো মেয়ে থাকতো তবে, আমি তাকে অবশ্যই হযরত ওসমান (রাঃ)-এর নিকট বিবাহ দিতাম।
            আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওসমান (রাঃ) আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নিজ ধন-সম্পদ অকাতরে ব্যয় করেছেন। বিশেষ করে তাবুকের জ্বিহাদের সময় যুদ্ধের সামগ্রী ছাড়াও রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের জন্য কয়েক উট বোঝাই খাদ্য সামগ্রী উপস্থিত করেন। সে সময় সাইয়্যিদুল মরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আকাশের দিকে হাত উত্তোলন করে তিনবার একথা বলেন যে,
قال اللهم انى رضيت من  عشمان فارض عنه.
অর্থঃ- হে আল্লাহ্ পাক! আমি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর উপর সন্তুষ্ট আপনিও তাঁর উপর সন্তুষ্ট হোন।
            হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণকে নির্দেশ দিলেন, তোমরাও হযরত ওসমান (রাঃ)-এর জন্য দোয়া কর। সুতরাং তাঁর সাথে তাঁরাও দোয়া করলেন। আর তখনই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
ماضر عثمان ما عمل بعد اليوم.
অর্থঃ- আজ থেকে হযরত ওসমান (রাঃ) যে কাজই করুকনা কেন, তা তাঁর জন্য ক্ষতির কারণ হবেনা। (সুবহানাল্লাহ্) (মেশকাত পৃঃ/ ৫৬১)     
            এরূপভাবে হাদীস শরীফে আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওসমান জিন নূরাইন (রাঃ) সম্পর্কে বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন- হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,       
لكل نبى رفيق فى الجنة رفيقى فيها عثمان رضى الله عنه.
অর্থঃ- জান্নাতে প্রত্যেক নবীরই একজন বন্ধু রয়েছে, আর আমার জান্নাতের বন্ধু হলেন, হযরত ওসমান (রাঃ)।” (মেশকাত শরীফ/৫৬১)
            হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) যিনি বিশিষ্ট সাহাবী, তিনি বলেন,
رأيت النبى صلى الله عليه وسلم من اول الليل الى ان طلح الفجر يدعو لعثمان.
অর্থঃ- আমি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাত্রের প্রথম ভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত হযরত ওসমান (রঃ)-এর জন্য দোয়া করতে দেখেছি। (নুযহাতল মাজালিশ- ২য় জিঃ- পৃ/২৬৮)
            হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) যিনি রঈসুল মুফাস্সিরীন,” তিনি বর্ণনা করেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
يشفعن عثمان فى سبعين الغاممن قد استو حبوا النار حتى يد خلهم الجنة.
অর্থঃ- হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সুপারিশের কারণে জাহান্নামের উপযুক্ত সত্তর হাজার লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। (নুযহাতুল মাজালিশ- ২য় জিঃ- পৃঃ ২৬৮)
            বিখ্যাত সাহাবী, হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন,
اتى النبى صلى الله عليه وسلم بجنازة رجل لصلى فلم يصلى عليه فقبل يا رسول الله ما رأي تركت الصلوة على احد قبل هذا قال انه كان يبغض عثمان فابغضه الله.
অর্থঃ- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে এক ব্যক্তির জানাযা আসলো, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জানাযার নামাজ পড়ালেননা। জিজ্ঞাসা করা হলো- ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পূর্বে কারো জানাযা আপনাকে তরক করতে দেখিনি। (আপনি এ ব্যক্তির জানাযা পড়লেননা কেন?)। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই এ ব্যক্তি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে, তাই আল্লাহ্ পাকও এ ব্যক্তির উপর অসন্তুষ্ট।” (তিরমিযী শরীফ- ২য় জিঃ/২১২ পৃঃ)
            হযরত আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

انكم ستلقون بعدى فتنة واختلافا فقال له قائل من الناس فمن لنا يا رسول الله او ما تأمرنايه قال عليكم با لا مير واصحابه وهو يشير الى عثمان.
অর্থঃ- আমার বিদায়ের পর অতি শীঘ্রই তোমাদের মধ্যে ফিৎনা ও ইখতিলাফ দেখা দিবে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সে সময় আমরা কাকে অননুসরণ করবো? হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমাদের জন্য (সে সময়) আমীর ও তাঁর সাথীদের অনুসরণ করা লাযেম। আর তখন তিনি হযরত ওসমান (রাঃ)-এর প্রতি ইশারা করেন। (মেশকাত শরীফ/৫৬২-৫৬৩)
            অতএব, জলীলুল ক্বদর, আজীমুশ্ শান ও মহা মর্যাদাবান সাহাবী, আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওসমান জিন্ নূরাইন (রাঃ)কে অনুসরণ করা, তাঁকে মহব্বত করা ও তাঁর উদ্ভাবিত সুন্নত সমূহ পালন করা তথা ছানী আযান সম্পর্কিত সুন্নতকে অনুসরন করা প্রতিটি উম্মতে মুহম্মদীর জন্য অবশ্য কর্তব্য।
            স্মরণযোগ্য যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে ও প্রয়োজনীয়তায় এ ধরণের ক্বিয়াস ও ইজ্তিহাদ কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফেরই নির্দেশনা। যেমন আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ করেন,
 فاعتبررا يا اولى الابصار. 
অর্থঃ-হে চক্ষুস্মান ব্যক্তিগণ তোমরা গবেষণা কর।” (সূরা হাশর/২)
            আর হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়ায ইব্নে জাবাল (রাঃ)কে ইয়েমেনের গর্ভনর করে পাঠানোর প্রাক্কালে বলেছিলেন,
بم تقضى يا معاذ-؟ فقال بكتاب الله، فان لم تجد؟ قال بسنة رسول الله،  فان لم تجد، قال اجتهد برأئى، فقال الحمد اله الذى وفق رسول رسول الله بمايرضى به رسوله.
অর্থঃ-     হে মুয়ায! তোমার নিকট কোন মোকাদ্দমা আসলে কিভাবে তা ফায়সালা করবে? হযরত মুয়ায (রাঃ) বললেন, আল্লাহ্ পাক-এর কিতাবের দ্বারা। যদি তাতে না পাও, তাহলে? আল্লাহ্ পাক-এর রাসূল (হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহ দ্বারা। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, যদি তাতেও না পাও, তাহলে? আমি কিতাব ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ইজ্তিহাদ করে রায় দেব। এ উত্তর শুনে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ্ পাক-এর, যিনি তাঁর রাসূলের দূতকে এ যোগ্যতা দান করেছেন, যাতে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট হন।” (মেশকাত শরীফ)
            এটা হতে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুসলমানদের কল্যানার্থে ও  কোরআন-সুন্নাহর  দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করা আল্লাহ পাক ও তার রসূলেরই নির্দেশ।
            উল্লেখ্য, হযরত ওসমান যিন্ নুরাইন (রাঃ) যখন ইজতিহাদ করতঃ অন্য আরও একটি আযানের প্রচলন করেন ও ছানী আযানকে ইমামের সম্মুখে মসজিদের ভিতর দেয়ার ব্যবস্থা করেন, তখন প্রায় সমস্ত সাহাবা॥ই॥কিরাম (রাঃ) জীবিত ছিলেন। অথচ কেউ দ্বিমত পোষণ করেননি। আর এরই নাম ইজ্মা। যা ইসলামী শরীয়তের অকাট্য দলীল।
ইসলামী শরীয়তের উছূল
            শরীয়তের কোন বিষয়ের মীমাংসা বা ফায়সালা করতে হলে তা কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতেই করতে হবে, এর বাইরে কোন কথা বা কাজ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, শরীয়তের ভিত্তি বা দলীলই হলো উপরোক্ত চারটি। এ প্রসঙ্গে উছূলের কিতাবে উল্লেখ আছে যে,       

اصول الشرع ثلثة-القران- الحديث- الاجماع- ورابعها القياس.        
অর্থঃ- মূলতঃ শরীয়তের ভিত্তি হলো তিনটি। কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা এবং চতুর্থ হলো- ক্বিয়াস।” (নুরুল আনোয়ার)
(১) কোরআন শরীফ 
মূলতঃ কোরআন শরীফের সম্পূর্ণটাই আল্লাহ্ পাক-এর ওহীর অন্তর্ভূক্ত। কেননা আল্লাহ্ পাক বলেন,
وما ينطق عن الهواء ان هوالا وحى يوحى.

অর্থঃ- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কথাই নিজের থেকে বলেন না, ওটা ওহী ব্যতীত কিছুই নয়।
            শুধু তাই নয়, উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এটা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, হাদীস শরীফগুলোও কোরআন শরীফের ন্যায় ওহীর অন্তর্ভূক্ত। আর তাই ওহীকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে-
১। ওহীয়ে মাতলূ অর্থাৎ কোরআন শরীফ, যা তিলাওয়াত করা হয়।
২। ওহীয়ে গায়রে মাতলূ অর্থাৎ হাদীস শরীফ যা তিলাওয়াত করা হয় না।
            মূলতঃ কোরআন শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য কোরআন শরীফের হুকুম-আহ্কাম, আদেশ-নিষেধ মেনে চলা অপরিহার্য। কারণ বিপথগামী, পথভ্রষ্ট মানুষদেরকে হিদায়েতের পথে আনার জন্যই মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ইজ্জত পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফ অবতীর্ণ করেন।
            এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক কালামুল্লাহ্ শরীফে এরশাদ ফরমান,                          
كتاب انز لناه اليك لتخرج الناس من الظلمات الى النور.
অর্থঃ- আমি এ কিতাবকে আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, মানুষদেরকে গোম্রাহী হতে হিদায়েতের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।” (সূরা ইব্রাহিম/১)
            সুতরাং যাঁরা এ কোরআন শরীফের আদেশ-নিষেধ, হুকুম-আহ্কামের অনুসরণ করবে, তাঁরা হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে, আর যারা অনুসরণ করবেনা, তারা গোম্রাহীর মধ্যে নিপতিত থাকবে।
            আর তাই কোরআন শরীফের অসংখ্য স্থানে কালামুল্লাহ্ শরীফের হুকুম-আহ্কামের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন,
فاما يأتين كم منى هدى فمن بتع هداى فلاخوف عليهم ولا هم يحزنون.
অর্থঃ- আর যখন আমার পক্ষ হতে তোমাদের জন্য হিদায়েতের বাণী আসবে, আর এ হিদায়েতবাণীকে (কোরআন শরীফকে) যাঁরা অনুসরণ করবে, তাঁদের কোন ভয় নেই এবং চিন্তা নেই।”(সুরা বাক্বারা/৩৮)
            আল্লাহ্ পাক অন্যত্র আরো এরশাদ করেন,
اتبعوا ماانزل اليكم من ربكم.
অর্থঃ- তোমাদের প্রভুর পক্ষ হতে তোমাদের নিকট যা (কোরআন শরীফ) অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার অনুসরণ কর।” (সুরা আরাফ/৩)
 কালামুল্লাহ্ শরীফে এ প্রসঙ্গে আরো এরশাদ হয়েছে,
اتبعوا النبور الذى انزل معه اولئك هم المفلحون.
অর্থঃ- সেই নূরের (কোরআন শরীফ) অনুসরণ কর, যা তাঁর (রাসূলের) উপর অবতীর্ণ হয়েছে, (যারা এরূপ করবে) তারাই সফলকাম।” (সূরা আরাফ/১৫৭)
            আর তাই আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন,
خذوا ما اتبنا كم يقوة.
অর্থঃ- তোমাদেরকে যা দিয়েছি, (কোরআন শরীফ) তা শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধর।  (সূরা বাক্বারা/৬৩)
            সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, কোরআন শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং কোরআন শরীফকে অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর জন্য অবশ্যই কর্তব্য।
(২) হাদীস শরীফ
            কোরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল। কারণ হাদীস শরীফ ব্যতীত উম্মতের জন্য কোরআন শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করা কোন দিনও সম্ভব নয়। আর তাই হাদীস শরীফকে কোরআন শরীফের তাফসীর বা ব্যাখ্যা বলা হয়ে থাকে। মূলতঃ হাদীস শরীফও ওহীর অন্তর্ভূক্ত।
            অতএব, কোরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফ মানা ও তার অনুসরণ॥অনুকরণ করা অবশ্যই কর্তব্য। আর তাই আল্লাহ্ পাক কালামুল্লাহ্ শরীফে এরশাদ করেন,
وما اتاكم الرسول فخذوه وما نها كم عنه فا نتهوا.
অর্থঃ- আমার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন, তা আঁকড়িয়ে ধর এবং যার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তার থেকে বিরত থাক।”(সূরা হাশর/৭)
            উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা হাদীস শরীফের অনুসরণ-অনুকরণ করা ফরজ প্রমাণিত হয়। সুতরাং যারা হাদীস শরীফ অস্বীকার করবে এবং তার অনুসরণ-অনুকরণ করবেনা, তারা গোম্রাহ্ ও বাতিল এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। যেমন আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন বলেন,
فليحذر الذين يخالفون عن امره ان تصيبهم فتنة او يصيبهم عذاب اليم.                        
অর্থঃ- সুতরাং যারা তাঁর (রাসূলের ) আদেশের বিরোধিতা করে, তাদের ভয় করা উচিত যে, তাদের উপর এসে পড়বে কোন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।  (সূরা নূর/৬৩)
            আর এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
عن ابى رافع- لا الفئن احد كم متكئا على اريكته ياتيه الا مر من امرى مما امرت به او نهيت عنه- فيقول لا ادرى- ماوجدنا فى كتاب الله اتبعناه.
অর্থঃ- হযরত আবু রাফে (রাঃ) হতে বর্ণিত- রাসূলে মকবূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি তোমাদের কাউকে যেন এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে। আর তার নিকট আমার আদেশাবলীর কোন একটি আদেশ পৌঁছাল, যাতে আমি কোন বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ করেছি। তখন সে বলবে, আমি এসব কিছু জানিনা, আল্লাহ্র কিতাবে যা পাবো, তাই অনুসরণ করবো।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, আহ্মদ, মেশকাত, মায়ারেফুস্ সুনান, বযলুল মাজহুদ, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব)
            হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে,
عن العرباض بن سارية- قام رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال- ايحسب احد كم متكتا على اريكته يظن ان الله لم يحرم شيأ الا مافى القران الا وانى والله قد امرت ووعظت ونهيت عن اشياء- انها لمثل القران.
অর্থঃ- হযরত ইরবাজ ইবনে সারিয়া (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার গদীতে ঠেস দিয়ে একথা মনে কর যে, আল্লাহ্ পাক যা এ কোরআন শরীফে অবতীর্ণ করেছেন, তা ব্যতীত তিনি আর কিছুই হারাম করেননি? তোমরা জেনে রাখ, আমি খোদার কছম করে বলছি- নিশ্চয় আমি তোমাদের অনেক বিষয়ে আদেশ দিয়েছি, উপদেশ দিয়েছি এবং নিষেধও করেছি, আমার এরূপ বিষয়ও নিশ্চয়ই কোরআন শরীফের বিষয়ের ন্যায়।” (আবূ দাউদ, মেশকাত, বযলুল মাজহুদ, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব)
            এ হাদীস শরীফ দ্বারা বুঝা যায় যে, কোরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল।
            কাজেই উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং তার অনুসরণ ও অনুকরণ করা অবশ্যই কর্তব্য। সুতরাং যারা কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফকে অনুসরণ করবে না, দলীল হিসাবে মানবে না, তারা গোম্রাহ ও পথভ্রষ্ট হবে।  আর তাই হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
تركت فيكم امرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما كتاب الله وسنتى.

অর্থঃ- আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে গেলাম, যদি তোমরা এদুটিকে আঁকড়িয়ে ধরো, তবে গোমরাহ হবেনা। একটি হলো- আল্লাহ্ পাক-এর কিতাব কোরআন শরীফ, দ্বিতীয়টি হলো- আমার সুন্নত হাদীস শরীফ।” (মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব)
            সুতরাং যারা এ দুটোর অনুসরণ করবে, তারা হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে। আর যারা এর বিপরীত করবে, তারা অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে।
(৩) ইজ্মা
 যে বিষয়ে কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে স্পষ্ট কোন কিছু বলা হয়নি, সে বিষয়ে কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করতঃ হুকুম সাবিত করতে হবে। অবস্থার প্রেক্ষিতে ও প্রয়োজনীয়তায় এ ধরণের ইজ্তিহাদ করা আল্লাহ্ পাক ও রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম॥এরই নির্দেশ। যেমন॥ কালামে পাকে আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন,
فاعتبروا يا اولى الابصار.
অর্থঃ- হে চক্ষুস্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা কর।” (সূরা হাশর/২)
            আর হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রাঃ)কে ইয়েমেনের গভর্নর করে পাঠানোর প্রাক্কালে বলেছিলেন-
بم تقضى يامعاذ-؟ فقال بكتاب الله، فان لم تجد؟ قال بستة رسول الله، فان لم تجد، قال اجتهد برأئى، فقال الحمد الله الذى وفق رسول رسول الله بما يرضى به رسوله.
অর্থঃ-     হে মুয়ায, তোমার নিকট কোন মুকাদ্দমা আসলে কিভাবে তা ফায়সালা করবে? হযরত মুয়ায (রাঃ) বললেন, আল্লাহ্ পাক॥এর কিতাবের দ্বারা। যদি তাতে না পাও তাহলে? আল্লাহ্ পাক॥এর রসূলের সুন্নাহ দ্বারা। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, যদি তাতেও না পাও তাহলে? আমি কিতাব ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতে ইজ্তিহাদ করে রায় দেবো। এ উত্তর শুনে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লাহ্ পাক॥এর, যিনি তাঁর রসূলের দূতকে এ যোগ্যতা দান করেছেন, যাতে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট হন।” (মেশকাত)
            এটা হতে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে যে, মুসলমানদের কল্যানার্থে ও কোরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করা কোরআন ও হাদীস শরীফেরই নির্দেশ।
            উল্লেখ্য,যে ইজ্তিহাদকৃত মাসয়ালা এককভাবে রয়েছে, সেটাকে বলা হয় ক্বিয়াস। আর ইজ্তিহাদকৃত মাসয়ালার মধ্যে যেগুলোর উপর সকল মুজ্তাহিদগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন, শরীয়তে তাকেই ইজ্মা বলা হয়।
 ক্ষেত্র বিশেষে ইজ্মার অনুসরণ করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যই কর্তব্য। যে ব্যক্তি উক্ত ইজ্মাকে (ইজমায়ে আযীমতকে) অস্বীকার করলো, সে কুফরী করলো।
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
فيكون الا حماع حجة يكفر جاحده كالكتاب والسنة.
অর্থঃ- ইজ্মায়ে আযীমত কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের মতই একটি অকাট্য দলীল, যে তা অস্বীকার করলো, মূলতঃ সে কুফরী করলো।” (তাফসীরে আহ্মদী)
            উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ইজ্মা শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং তা অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য অবশ্যই কর্তব্য।
(৪) ক্বিয়াস
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যেসকল ইজ্তিহাদকৃত মাসয়ালা এককভাবে রয়েছে তাই ক্বিয়াস। আমাদের আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মতে ক্বিয়াস শরীয়তের অকাট্য দলীল।
ক্বিয়াসের দলীল হলো- কুরআন শরীফের এ আয়াত শরীফ-  
فاعتبروا يا اولى الابصار.
অর্থঃ- সুতরাং হে চক্ষুস্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা কর।” (সূরা হাশর/২)
ক্বিয়াস কে উপরোক্ত আয়াত শরীফের ভিত্তিতে শরীয়তের দলীল সাবিত করা হয়েছে। তাছাড়া হাদীছ শরীফের বহুস্থানে ক্বিয়াসকে শরীয়তের দলীল হিসাবে সমর্থণ করা হয়েছে।
ক্বিয়াস মূলতঃ নতুন কোন বিষয় নয়, বরং স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ক্বিয়াস করেছেন। তার প্রমাণ নিম্নোক্ত হাদীছ শরীফ 
عن ابن عباس رضى الله عنه قال اتى رجل الى النبى صلى الله عليه وسلم فقال ان اختى نذرت ان تحج وانها ما تت فقال النبى صلى الله عليه وسلم لو كان عليها دين اكنت فا قضيه قال نعم قال فاقض دين الله فهو احق بالقضاء.
অর্থঃ- হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট এসে বললো- হুযূর! আমার ভগ্নি হজ্জ করার মানত করেছিলো কিন্তু আদায় করার পূর্বেই সে ইন্তেকাল করেছে। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার ভগ্নির উপর কারো ঋণ থাকলে তুমি তা আদায় করতে কি?” সে বললো হ্যাঁ। হুযূর বললেন, “তাহলে আল্লাহ্ পাক উনার হক্ব আদায় করো। কেননা এটা আদায় করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ।” (বুখারী শরীফ, মুসলীম শরীফ)
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনার ক্বিয়াস করে সমস্যার সমাধান করতেন। যেমন  হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়,
ان ابا بكر رضى الله عنه اذا تراب به قضية لم يجد فى كتات الله اصلا ولا فى السنة اثرا فقال اجتهد يرائى فان يكن صوابا فمن الله وان يكن فمنى استغفر الله.
অর্থঃ- হযরত আবু বকর সিদ্দিক আলাইহিস সালাম উনার নিকট যখন কোন মুকাদ্দমা আসতো, প্রথমে কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্ শরীফ-এর প্রতি নজর দিতেন, সেখানে যদি কোন নির্দশন না পেতেন, তাহলে নিজের রায় অনুযায়ী ক্বিয়াস করে নিতেন, যদি সঠিক মতে পৌঁছতেন, তাহলে মহান আল্লাহ পাক উনার পুরস্কার আশা করতেন, আর যদি ভুল হতো, তাহলে ক্ষমা চাইতেন।” (তাবাকাতে ইবনে সাদ)
অনুরূপ হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার নীতি ছিল যে, তিনি ফায়সালা করার ক্ষেত্রে কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাহ্র পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক আলাইহিস সালাম ও হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনাদের রায়ের প্রতি নজর দিতেন, সেখানেও না পাওয়া গেলে বলতেন,فيه برائى   (অর্থাৎ নিজের রায় মোতাবেক ফায়সালা করতেন)। (মসনদে দারেমী, মোসতাদরেকে হাকেম)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা বুঝা যাচ্ছে যে, ক্বিয়াস শুধু শরীয়তের অকাট্য দলীলই নয় বরং ক্বিয়াসের মাধ্যমে মাসয়ালা সাবিত করা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাদের খাছ সুন্নতেরও অন্তর্ভূক্ত।
সুতরাং ক্বিয়াসের অনুসরণ করাও আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। শুধু তাই নয়, ক্বিয়াসের প্রতি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উম্মতকে উৎসাহিতও করেছেন। নিম্নের হাদীছ শরীফ থেকে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।  হাদীছ শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا حكم الحاكم فا جتهدا واصاب فله اجران واذا حكم فاجتهد فاخطا فله اخر واحد.
অর্থঃ- হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে- রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, “যখন কোন ফায়সালাকারী ফায়সালা করবে, সে যদি কামিয়াব হয়, দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে। আর যদি সে ভুল করে, তাহলে একগুণ সাওয়াব পাবে।” (বুখারী শরীফ)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, ক্বিয়াস কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ শরীফ্ সমর্থিত ও ফযীলতের কারণ এবং তা শরীয়তের অকাট্য দলীলরূপে পরিগণিত।
সুতরাং ক্বিয়াস অনুসরণ করার অর্থই হলো- কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্ শরীফকে অনুসরণ করা। আর ক্বিয়াসের বিরোধিতা করা, কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্ শরীফকে অস্বীকার করারই নামান্তর।
ক্বিয়াসের প্রকারভেদ:
ক্বিয়াস দুপ্রকার - (১) হক্ব ক্বিয়াস, (২) বাতিল ক্বিয়াস।
হক্ব ক্বিয়াসের সংজ্ঞা ঃ        মুজ্তাহিদ ক্বিয়াস করার সময় যদি কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্ শরীফ অনুযায়ী ক্বিয়াস করেন, তাহলে তাকে হক্ব ক্বিয়াস বলে।
হক ক্বিয়াসের উদাহরণ ঃ
(১) মহান আল্লাহ্ পাক তিনি ইরশাদ করেছেন,
حرمت عليكم امها تكم وبنا تكم........
অর্থঃ - তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, তোমাদের মাতা ও কন্যাদেরকে।” (সূরা নিসা আয়াত -২৩)        
এখানে  امهات শব্দের দ্বারা মাতাকে বিবাহ করা হারাম বুঝায়। শরীয়তে নানী, দাদী বা নাতনীকে বিবাহ করা হারাম, কিন্তু কুরআন শরীফ বা হাদীছ শরীফের কোথায়ও নানী, দাদী বা নাতনীকে বিবাহ করা হারাম তার প্রকাশ্য কোন ইবারত নেই। সুতরাং যারা ক্বিয়াসকে অস্বীকার করে বা কুরআন শরীফ ও  হাদীছ শরীফ ব্যতীত অন্য কোন ইজ্তিহাদী কওল গ্রহণ করতে নারায, তারা এ ব্যাপারে কি মত গ্রহণ করবেন? ক্বিয়াস অস্বীকার করে নানী, দাদী ও নাতনীকে বিবাহ করবেন? নাকি ক্বিয়াস স্বীকার করে হারাম হতে নিজকে রক্ষা করবেন?
            স্মর্তব্য উক্ত আয়াতের امهات শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত, তাই মুজ্তাহিদ তথা আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ইমামগণ মাতার সাথে ক্বিয়াস করে উর্দ্ধতণ যত নারী আছে যেমন নানী, দাদী তার মা, তার মা প্রমূখ এবং  بناتكم দিয়ে মেয়ে, তার মেয়ে (নাতনী) তার মেয়ে (প্রো নাতনী) প্রমূখ সকলকেই বিবাহ করা হারাম সাব্যস্ত করেছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, যারা মাযহাব মানে না, তারা নিশ্চয়ই এই রায় মেনে নিয়ে মাযহাবী হয়ে আছে, কেননা এটা হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী চার মাযহাবেরই রায়। তাই এখন যদি কেউ ক্বিয়াসকে অস্বীকার করে মাযহাবের বিরুদ্ধে মত পোষণ করে, তা হঠকারিতা আর কিছুই নয়।
বাতিল ক্বিয়াসের সংজ্ঞাঃ  বাতিল ক্বিয়াস হলো- ক্বিয়াসকারী যদি মনগড়াভাবে কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ-এর খেলাফ কোন ক্বিয়াস করে, তা বাতিল ক্বিয়াস হিসাবে পরিগণিত হবে।
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন,
من قال فى القران برايه فليتبوأ مقعده من النار.
অর্থঃ- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের (তাফসীরে) স্বীয় রায় অনুযায়ী কথা বলে, সে তার অবস্থানকে যেন দোযখে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী শরীফ)
অন্য  হাদীছ শরীফে আছে,
من قال فى القران برايه فاصاب فقد اخطأ.
অর্থঃ- যে ব্যক্তি কুরআন শরীফের (তাফসীরে) স্বীয় মতানুযায়ী কথা বলে, সে সত্যে উপনীত হলেও ভুল করলো।” (তিরমিযী, আবু দাউদ শরীফ)
বাতিল ক্বিয়াসের উদাহরণ ঃ
কিছু সংখ্যক লোক বলে থাকে যে, মোস্তাহাব আমলের ভিতর বিদ্য়াত প্রবেশ করলে মোস্তাহাব আমলকে ছেড়ে দিতে হবে, এটাও বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত। এর দলীল হলো আশুরার রোজা।প্রথমতঃ আশুরার রোজা ১০ই মহররম একটি রাখার নিয়ম ছিল, কিন্তু যখন ছাহাবা -ই -কিরাম  রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ বললেন যে, ইহুদীরাও ১০ই মহররম একটি রোজা রেখে থাকে, তখন হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
صوموا يوم عاشورأ وخالقوا فيه اليهود وصوموا قبله يوما وبعده يوما.                     
অর্থঃ- তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন রোজা রেখে ইয়াহুদীদের খেলাফ কর।
এখানে বিদ্য়াত তো দূরের কথা, তাশাব্বুহ বা হারাম হওয়া সত্বেও হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আশুরার রোজাকে বাদ দিলেন না, বরং মূল আমলকে ঠিক রেখে তা তাশাব্বুহ দূর করে দিলেন, আরেকটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে। সুতরাং উক্ত মত পোষণকারীদের ক্বিয়াস দলীল বহির্ভূত এবং বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত।
            আর এ ধরণের কোন ক্বিয়াসের উপর যদি কখনো ইজমা বা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সে ইজমাও বাতিল ইজমা হিসেবে পরিগণিত।
            কাজেই আমাদের কোন বিষয়ের শরয়ী ফায়সালা করতে হলে, প্রথমে কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের দ্বারাই তা করতে হবে। কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে যদি তার সুস্পষ্ট বিধান না পাওয়া যায়, তবে ইজ্মা ও ক্বিয়াসের দ্বারা তার ফায়সালা করতে হবে। কেননা আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের দলীলের ভিত্তিই হলো উক্ত চারটি, এর বাইরে কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।     (অসমাপ্ত)

0 Comments: