প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ ( ১১ নং )

প্রচলিত তাবলীগ
জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া
গবেষণা কেন্দ্র
মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ


[ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি। মহান আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ রহ্মতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামাজ ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামাজ জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরজ নামাজের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইন্জেকশন নেওয়া রোজা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্-এর নামাজে বা অন্যান্য সময় কোরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্ নামাজ বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়  সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর চতুর্দশ (১৪তম) ফতওয়া হিসেবে (৩৫তম সংখ্যা থেকে) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ  করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]
[ বিঃদ্রঃ পাঠকগণের সুবিধার্থে ফতওয়ার ভুমিকার কিছু অংশ পুণরায় প্রকাশ করা হলো ]
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ
            মহান আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ করেন,
 
كنتم خير امة اخرحت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله.
অর্থঃ- তোমরা (হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং আল্লাহ্ পাক-এর প্রতি ঈমান আনবে।” (সূরা আল ইমরান/১১০)
            উপরোক্ত আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক তাবলীগ তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সাথে সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। সেটা হলো-  تؤمنونঅর্থাৎ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা। অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। তবেই সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ফায়দা বা আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব হবে।
            স্মরণযোগ্য যে, বর্তমান প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের বেশকিছু লেখনী, বক্তব্য, বিবৃতি, আমল ও আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের মনে নানাবিধ সংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারপাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ হতে মাসিক আল বাইয়্যিনাতেরআকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য বিভাগ সুওয়াল-জাওয়াববিভাগে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারিত বেশকিছু আপত্তিজনক আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ উল্লেখ করে অসংখ্য চিঠি আসে। কারণ আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন কালামে পাকে এরশাদ করেন,
فاسئلوا اهل الذكران كنتم لا تعلمون.
অর্থঃ- যদি তোমরা না জান, তবে আহ্লে যিকির বা হক্কানী আলেমগণের নিকট জিজ্ঞাসা করো।” (সূরা নহল/৪৩ ও আম্বিয়া/৭)
            অর্থাৎ তোমরা যারা জাননা বা দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান রাখনা, তারা যাঁরা জানেন, তাঁদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।
            অতএব, যাঁরা জানেন, তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব হলো- প্রশ্নকারীর প্রশ্নের শরীয়তসম্মত জাওয়াব প্রদান করা। কারণ যারা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাব প্রদান হতে বিরত থাকবে, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির কথা হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে। যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,  
من سئل عن علم علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.

অর্থঃ- যাকে দ্বীন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়জানা থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা গোপন করে অর্থাৎ জবাব না দেয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযা, আহ্মদ, মেশকাত, বজলুল মাজহুদ, উরফুশ্শাজী, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াজী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্ ইত্যাদি)
            অন্য হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, “তার জ্বিহ¡া আগুনের কেঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হবে।
            কাজেই উপরোক্ত হাদীস শরীফে, যে ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার থেকে বাঁচার জন্যে অর্থাৎ আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করার লক্ষ্যে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারঅগণিত পাঠক, গ্রাহক ও সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের প্রেরিত সুওয়ালসমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরীয়তসম্মত তথা কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে জাওয়াব বা ফতওয়া দেয়া হলো।
প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়
            এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় এই যে, মূলতঃ আমাদের সাথে কারো যেরূপ বন্ধুত্ব নেই, তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খেলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর জন্যেই হতে হবে।
            এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে যে,
من احب  لله وابغض لله وععطى لله ونع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থঃ- যে ব্যক্তি আল্লাহ্ পাক-এর (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মহব্বত বা বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, বজলুল মাজহুদ, উরফুশ্শাজী, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াজী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ্ ইত্যাদি)
            বস্তুতঃ মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি সবই উপরোক্ত হাদীস শরীফের মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
            কাজেই মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায়প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতসম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো- প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কেউল্লেখকৃত আক্বীদাসমূহের সঠিক, বিশুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত ফায়সালা প্রদান এবং প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতের কাজে যারা মশগুল রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা উক্ত আক্বীদাসমূহ জেনে হোক বা না জেনেই হোক বিশ্বাস করে এবং তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করে, নিজেদের ও জনসাধারণের ঈমান ও আমলের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের সে ঈমান ও আমলের হিফাযত করা ও সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণের নিকট সত্য বা হক্ব বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ইহ্লৌকিক ও পারলৌকিক এত্মিনান ও নাযাত লাভ করতে পারে।
            মূলতঃ মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তাই এক মুমিন অপর মুমিনের ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমানী আলামত। কারণ হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে যে,
            المؤمن مرأة المؤمن
অর্থঃ- এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে আয়না স্বরূপ।” (আবূ দাউদ শরীফ, বজলুল মাজহুদ)
            এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, আমীরুল মুমিনীন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) স্বীয় খিলাফতকালে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রীতিনীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত আনছার এবং মোহাজিরগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি আমি দ্বীনের হুকুম-আহ্কামকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে শরীয়ত বিরোধী কোন আদেশ দান করি, তবে তোমরা কি করবে?” উপস্থিত লোকেরা নীরব রইল। হযরত ওমর ইব্নুল খাত্তাব (রাঃ) দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই কথার পূণরাবৃত্তি করলেন। তখন হযরত বশীর ইব্নে সাঈদ (রাঃ) বললেন, “যদি আপনি এরূপ করেন, তবে আমরা আপনাকে এরূপ সোজা করবো, যেরূপ তীরকে সোজা করা হয়।এ কথা শুনে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বললেন, “তোমরাই আমার প্রকৃত বন্ধু, দ্বীনের কাজে সাহায্যকারী।” (আওয়ারেফুল মাআরেফ)
            সুতরাং উপরোক্ত হাদীস শরীফের আলোকে অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃ পূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল হিফাযতের লক্ষে বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো। যাতে করে সত্যান্বেষী, সমঝদার মুসলমান ও প্রচলিত তাবলীগকারীগণ সে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী ফায়সালা অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিজেদের ঈমান ও আমলের হিফাযত করে সঠিকভাবে দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খেদমত করে আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারেন।
            এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বীনের তাবলীগ যা খাছ ও আম তা শত-সহস্র লোক করবে এবং অবশ্যই করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করতে হবে। কারণ আক্বীদা শুদ্ধ না হলে দ্বীনী কোন খিদমতই আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে কবুলযোগ্য নয়। উপরন্ত কুফরী আক্বীদা থাকার কারণে তাকে হতে হবে চির জাহান্নামী।
            আল্লাহ্ পাক আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে দ্বীনী তাবলীগ (যা আম ও খাছ) করার তৌফিক দান করুন। (আমীন)
সুওয়াল ঃ- আমরা শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। কারণ আমরা অনেকদিন যাবত তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলাম এবং এখনো তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকের সাথে আমাদের মেলামেশা আছে। তাতে তাদের বেশ কিছু বক্তব্য বা আক্বীদা, যা আমরা অতীতেও জেনেছি এবং এখনো তা অবহিত হচ্ছি। তার মধ্যে অনেকগুলো তাদের লেখা কিতাবেও উল্লেখ আছে। সে সমস্ত আক্বীদাসমূহ আমাদের মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। সেগুলো আমরা নিম্নে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম -
(৬৫) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা কোরআন শরীফের       
(تبعوا من لا يسئلكم اجرا وهم مهتدون.
অর্থাৎ তোমরা এরূপ ব্যক্তিকে অনুসরণ কর, যারা তোমাদের নিকট কোন বিণিময় চাননা, অথচ তাঁরা হিদায়েত প্রাপ্ত।সূরা ইয়াসীন/২১) এ আয়াত শরীফকে দলীল হিসেবে পেশ করে বলে থাকে যে, মক্তব, মাদ্রাসা ও মসজিদে দ্বীন প্রচার বা তাবলীগের কাজে যারা নিয়োজিত আর যে সকল আলেমওলামাগণ ওয়াজ-নছীহতে ব্যস্ত, তারা সকলেই বেতন বা বিণিময় গ্রহণ করেন। আবার দ্বীন প্রচারের কাজে নিয়োজিত পীর সাহেবগণও হাদিয়া (তাবলীগ জামায়াতের মতে বিণিময়) গ্রহণ করেন। কিন্তু একমাত্র প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই উক্ত আয়াত শরীফের পূর্ণ অনুসারী, যারা দ্বীন প্রচার করে যাচ্ছে অথচ কোন বিণিময় গ্রহণ করেনা। কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই একমাত্র অনুসরণীয় দল।
(৬৬) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওঃ ইলিয়াস সাহেব তাঁর জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে কিছু কথা বলেন। যাতে ব্যক্ত হয় যে, তিনি কেন এই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের সূচনা করেছেন। তিনি বলেন যে, তিনি প্রথমাবস্থায় মাদ্রাসায় পড়াতেন এবং সেখানে ভাল ভাল ছেলেদের আগমণ বেড়েই চললো। কিন্তু এক সময় তিনি মনে করলেন যে, এভাবে আলেম বনার পর কেউ হয়তোবা হাকিম হবে, কেউ চাকুরী করবে অথবা কেউ মাদ্রাসায়ই পড়াবে। কিন্তু তাতে কোন ফায়দা হবেনা। একথা ভেবে মাদ্রাসায় পড়ানো হতে তার মন ফিরে গেল।
            এরপর তাঁর পীর সাহেব যখন তাকে খিলাফত দিলেন, তখন কিছুদিন তিনি মুরীদ করলেন ও ইল্মে তাসাউফের তালীম দিতে লাগলেন এবং তাঁর কথানুযায়ী তাতে মুরীদগণের তরক্কীও হতে লাগলো। কিন্তু তাতে তিনি ভাবলেন যে, এতে কি হবে? তাঁর ভাষায়- বেশীর চেয়ে বেশী ইহা হইবে যে, কিছু যিকির শোগল করনেওয়ালা লোক বাহির হইবে। অতঃপর মানুষের মধ্যে তাহাদের খুব সুনাম ছড়াইয়া পড়িবে। তখন হয়তো কেউ মোকদ্দমায় জিতিবার জন্য দোয়ার প্রার্থণা করিবে, কেউ আওলাদের জন্য তাবীজের দরখাস্ত করিবে। কেউ কারবার-ব্যবসার তরক্কীর জন্য দোয়া চাইবে। আর বেশীর চেয়ে বেশী হইবে যে, তাহাদের দ্বারা ভবিষ্যতে আরো কিছু জাকেরীনের জামায়াত তৈয়ার হইবে। এই চিন্তা করিয়া সেইদিক হইতেও আমার মন ফিরিয়া গেলঅতঃপর তিনি যা করলেন, তা হলো- বর্তমান ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক তাবলীগের প্রচলন এবং সেক্ষেত্রে তার বক্তব্য হলো- যদি এই কাজ হইতে থাকে, তবে এখন হইতে হাজার গুণ বেশী মাদ্রাসা এবং খানকাহ্ কায়েম হইয়া যাইবে। বরং প্রত্যেক মুসলমান স্বশরীরে একটি মাদ্রাসা এবং খানকাহ্ বনিয়া যাইবে।
            বলাবাহুল্য, উপরোক্ত আক্বীদাসমূহ যে বিশেষরূপে ভুলযুক্ত, কুফরী ও গোমরাহীমূলক, তা প্রদত্ত ফতওয়ায় কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যার দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এ সম্পর্কিত ফতওয়া দেয়া ইসলাম এবং ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সংশ্লিষ্টসহ সকল শ্রেণীর মুসলমানদের জন্য একান্ত আবশ্যক ছিল। যে কারণে প্রদত্ত ফতওয়া প্রকাশের পর থেকেই এটি যেমন সমঝদার লোকদের নিকট বিশেষভাবে আদরণীয় ও গ্রহণীয় হয়েছে, তেমনি তার সাথে সাথে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সংশ্লিষ্ট অনেকের জন্যই বর্ণিত ভুল আক্বীদা ছেড়ে তওবা নছীবের কারণ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
            মূলতঃ এখানেই মাসিক আল বাইয়্যিনাতে প্রকাশিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশের সার্থকতা। যেমন হযরত আলী র্কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “হে আলী! তোমার দ্বারা যদি একটি লোকও হিদায়েত হয়, তবে তা আসমান-যমীনে যা রয়েছে, তা থেকে উত্তম।” 
            উপরোক্ত সুওয়ালের আলোকে এখন আমরা জানতে চাই, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু ঠিক? এবং তা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু প্রয়োজনীয় ও কোন স্তরের আমলের অন্তর্ভূক্ত? কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে ঈমান ও আমল হিফাযত করণে সাহায্য করবেন।
জাওয়াব ঃ- (আপনাদের তরফ থেকে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন সুওয়ালসহ প্রায় শতাধিক (শত শত) চিঠি এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে যেসব সুওয়ালগুলি মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলির জবাব না দিলেই নয়, সেরূপ অর্ধ শতাধিক সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে এবং এরূপ প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সুওয়ালেরই জাওয়াব দেয়া হবে ইন্শাআল্লাহ্। তার মধ্যে গত (৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯ ,৪০  ৪১তম) সংখ্যায় যথাক্রমে (৭+৩২+৬+৮+৭+১+২) = ৬৩টি এবং (৪২, ৪৩ ও ৪৪তম) সংখ্যায় ১টি সুওয়ালের জাওয়াবসহ মোট = ৬৪টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে। বর্তমান (৪৫তম) সংখ্যায় দুটি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হলো। বাকীগুলোর জাওয়াব পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে ইন্শাআল্লাহ্।)
            আপনাদের বর্ণিত সুওয়াল মোতাবেক যদি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হয়ে থাকে, তাহলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই আপত্তিজনক, যা গোমরাহীমূলক, বিভ্রান্তিকর ও জেহালতপূর্ণ এবং তারমধ্যে কোন কোনটিতে কুফরীমূলক বক্তব্যও রয়েছে।
            তবে আপনারা যেহেতু দলীল ভিত্তিক জাওয়াব চেয়েছেন, তাই আমরা উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই শরীয়তসম্মত তথা কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের ভিত্তিতে জাওয়াব দিব। (ইন্শাআল্লাহ্)
            কারণ আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে পাকে বলেন,
فا سئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থঃ- তোমরা যারা জাননা, যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (সূরা নহল/৪৩)
            আর আল্লাহর রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থঃ- যাকে ইল্মের বিষয় সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করা হয়, আর সে জানা থাকা সত্ত্বেও তা চুপিয়ে রাখে, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পড়িয়ে দেয়া হবে।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্, আহমদ, মেশকাত, বজলুল মাজহুদ, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াযী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, উরফুশ্শাজী, তালীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত্ ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, লুময়াত)
            অন্য হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, “তার জিব কেটে দেয়া  হবে ইত্যাদি।
            তাই নিম্নে পর্যায়ক্রমে আপনাদের প্রেরিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহের কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের অকাট্য দলীলসমূহের ভিত্তিতে শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো-
তাবলীগের অর্থ ও প্রকারভেদ
            [সুওয়াল সমূহের জাওয়াব দেয়ার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করা অতি জরুরী। কারণ তাবলীগ সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ কি, তা জানতে হবে।
তাবলীগ (تبليع) অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দুপ্রকার অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দুভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১) তাবলীগে আম (عام)  বা    সাধারণভাবে,  (২) তাবলীগে খাছ  (خاص)বা বিশেষভাবে।  আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দুপ্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক) ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক)।
মুবাল্লিগে আম ও তার
হিদায়েতের ক্ষেত্র
 মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারক)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক কোরআন শরীফের সূরা তাহ্রীমের ৬নং আয়াত শরীফে বলেন,

يا ايها الذين امنوا قوا انفسكم واهليكم نارا.
অর্থঃ- হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।
            আর হাদীস শরীফে আল্লাহ্র রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته.
অর্থঃ- সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বোখারী, মুসলিম, মেশকাত, ফতহুল বারী , ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্, মিরআতুল মানাজীহ্ ইত্যাদি)
            আল্লাহ্র রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

            بلغوا عنى ولو اية.
অর্থঃ- তোমরা আমার থেকে একটি আয়াত (হাদীস) হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বোখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী)
            অন্য হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- তখন হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে না পার। (তিবরানী শরীফ)
            সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
الدين نصيحة.
অর্থঃ- দ্বীন হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।
            হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? নবীজী বললেন, “আল্লাহ্র জন্য এবং আল্লাহ্র প্রিয় রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
            উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।
            কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীস শরীফের আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীস শরীফের উপর আমল করবেন।
            ৃঅতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তালীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম-এর জন্য ফরজে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইব্নে কাছীর, কবীর)
মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র
            মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-এর মত নয়। অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন।             আর যাঁরা খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট দ্বীন প্রচারক, তাঁদের প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন,
ولتكن منكم امة يدعون الى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر و اولئك هم المفلحو.
অর্থঃ- তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (কোরআন-সুন্নাহ্ তথা ইসলামের) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ্ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।” (সূরা ইমরান/১০৪)
 অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইল্ম, আমল এবং ইখ্লাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক বলেন,

فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থঃ- কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইল্মে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (সূরা তওবা/১২২) (তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
            আর আল্লাহ্র রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.

অর্থঃ- তোমরা দ্বীনী ইল্ম শিক্ষা কর এবং  মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুত্নী, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, লুময়াত ইত্যাদি))
            মূলতঃ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁদেরকে অবশ্যই ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী, রব্বানী আলেমগণের প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক কোরআন শরীফে এরশাদ করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.        
অর্থঃ- নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই আল্লাহ্ পাককে ভয় করেন।” (সূরা ফাতির/২৮)
            এ আয়াত শরীফের তাফসীর হযরত ইমাম আহ্ম্মদ বিন হাম্বল (রঃ)কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ্ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলেম।
            আর হাদীস শরীফে রয়েছে,

من ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟ قال الطمع.
অর্থঃ- “(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলেম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ জিনিস আলেমের অন্তর থেকে ইল্মকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।”  (দারেমী, মেশকাত, মেরকাত, মোজাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্, আশয়াতুল লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ্, লুময়াত ইত্যাদি)
            অর্থাৎ যিনি ইল্ম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলেম।
            কাজেই যিনি ইল্ম, আমল ও ইখ্লাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলেম, আর তিনিই নবী (আঃ)গণের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থঃ- আলেমগণ হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (আহ্মদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াযী, মায়ারেফুস্ সুনান, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, উরফুশ্শাজী, তালীকুছ্ ছবীহ্)
            অর্থাৎ নবী (আঃ)গণের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁরা নবী (আঃ)গণের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে তাঁদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তালীম বা তাবলীগ ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে ওলামায়ে হক্কানী- রব্বানীগণ তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানানভাবে দাওয়াত ও তালীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আম-এর (ফরজে কেফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-এর (ফরজে আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ-এর যোগ্যতা ও তাবলীগে আম-এর শর্ত
            স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েয নেই।
            এ প্রসঙ্গে হযরত ইব্নে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক তাঁর সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল আয়াত শরীফের আমল করেছ?” যা কোরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) সূরা সফের ২নং আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক বলেন,
ياايها الذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থঃ- হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?”
            “তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(২) তিনি আবার বললেন যে, আল্লাহ্ পাক সূরা বাক্বারার ৪৪নং আয়াত শরীফে বলেছেন,
اتأمرون الناس بالبر وتنسون انفسكم وانتم تتلون الكتاب.
অর্থঃ- তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।
তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ আয়াত শরীফের আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব (আঃ) তাঁর ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انهاكم عنه.
অর্থঃ- আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খেলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (সূরা হুদ/৮৮)
            তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না।
            তখন হযরত ইব্নে আব্বাস (রাঃ) তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ আয়াত শরীফসমূহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।অর্থাৎ উপরোক্ত আয়াত শরীফের আমল ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়েয নেই।
            উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যেই ফরজে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলেমগণের জন্যেই প্রযোজ্য, যা তাঁদের জন্যে ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। অতএব, মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হবে।
            বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, “বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগযাকে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে, (যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে) যদি তাদের কথা মোতাবেক তাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই তা মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য করা উচিৎ ছিল। অথচ তা এমন সব লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লিগে খাছ তো নয়ই, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই মুবাল্লিগে আম-এরও উপযুক্ত নয়। যদিও কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগে আম রয়েছে।
            অতএব তাবলীগে আম মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্যই করা ফরজে কেফায়া। যা মুবাল্লিগে আম-এর জন্য করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। আর সাধারণ লোকেরতো প্রশ্নই উঠেনা।
            এখন হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় এমন কতক লোক, যারা মুবাল্লিগে খাছ ও আম কোনটাই নয়, তারা অনেকেই নামাজের জামায়াতে যাওয়ার সময় বা নামাজ পড়ার সময় অন্যকে নামাজে ডেকে নিয়ে যায়, রোজার মাসে রোজা রাখার কথা বলে, ইত্যাদি অনেক নেক কাজের কথাই বলে থাকে, যা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা তবে তার ফায়সালা কি? এটাও কি নাজায়েয ও হারাম?
            এর ফায়সালা হলো, ঐ সকল লোক মুসলিম শরীফের বর্ণিত হাদীস শরীফ-

الدين نصيحة.
অর্থাৎ দ্বীন হচ্ছে অপরের ভাল কামনা করা।এর মেছদাক বা নমুনা। অর্থাৎ এদেরকে কেউ হিদায়েতের দায়িত্ব দেয়নি বা এরা হিদায়েতের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। এরা হচ্ছে মানুষের খয়েরখাঁ বা হিতাকাঙ্খী।
            এখানে আরো উল্লেখ্য যে, তিবরানী শরীফের উপরোক্ত হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, সৎকাজ না করলেও অপরকে সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ কোরআন শরীফে আল্লাহ্ পাক বলেন, “তোমরা ঐ কথা বল কেন, যা তোমরা নিজেরা করোনা।
            তাহলে এই আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফের বক্তব্যের মধ্যে ফায়সালা কি?
            মূলতঃ এর ফায়সালা ওলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ দিয়েছেন। তাঁদের মতে তিবরানী শরীফের হাদীস শরীফে সৎ কাজ না করলেও সৎ কাজের দাওয়াত দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক)-এর জন্য। যেমন কোন বাবা নিজে নামাজ বা অন্যান্য নেক কাজ না করা সত্বেও তার সন্তান ও অধীনস্থদের নামাজ বা অন্যান্য নেক কাজের জন্য বলতে পারেন।
            আর কোরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফে নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা বলার জন্য যে নিষেধবাণী করা হয়েছে, তা হলো- মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা করতে বলা জায়েয নেই।
            এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,

عن انس قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مررت ليلة اسرى بى بقوم تقرض شفاههم بمقاريض من النار- فقلت يا جبريل من هؤلاء- قال هؤلاء خطباء امنك الذين يقولون مالا يفعلون.

অর্থঃ- হযরত আনাস ইব্নে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মিরাজ শরীফের রাত্রে এমন একটি ক্বওমের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের ঠোঁটগুলো আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। আমি হযরত জিব্রাঈল (আঃ)কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জবাবে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বলেন, এরা আপনার উম্মতদের মধ্যে ঐ সকল ওয়ায়েজ বা বক্তা, যারা এমন কথা বলতো, যেটা তারা নিজেরা আমল করতোনা।” (তিরমিযী, মেশকাত, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াজী, উরফুশ শাজী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্)
            অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যারা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক), তারা তিবরানী শরীফের বর্ণনা মোতাবেক সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), তারা কোরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ মোতাবেক নিজে সৎকাজ না করে অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন না। কারণ যদি সকলের জন্যে আমভাবে একথা বলা হয় যে, সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজের কথা বলা জায়েয, তবে মিরাজ শরীফের হাদীসে বর্ণিত লোকদের জিহ¡া কাটা হলো কেন? এতে বুঝা গেল যে, তিবরানী শরীফের উক্ত হুকুম সকলের জন্যে প্রযোজ্য নয়। বরং যারা মুবাল্লিগে আম, তাদের জন্যেই প্রযোজ্য। আর কোরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ ও মিরাজ শরীফ সম্পর্কিত হাদীস শরীফখানা যারা মুবাল্লিগে খাছ, তাদের জন্যে প্রযোজ্য।
            সুতরাং হাক্বীক্বতে উক্ত হাদীস শরীফ ও আয়াত শরীফের মধ্যে কোনই দ্বন্দ্ব নেই। অনেকে এর সঠিক ব্যাখ্যা না জানার ও না বুঝার কারণে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। মূলতঃ উক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়।]

সুওয়ালে উল্লেখকৃত
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের
আপত্তিকর বক্তব্যের  জাওয়াব -
৬৫নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়ালঃ- প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা কোরআন শরীফের
(اتبعوا من لا يسئلكم اجرا وهم مهتدون)
অর্থাৎ তোমরা এরূপ ব্যক্তিকে অনুসরণ কর, যারা তোমাদের নিকট কোন বিণিময় চাননা, অথচ তাঁরা হিদায়েত প্রাপ্ত।সূরা ইয়াসীন/২১) এ আয়াত শরীফকে দলীল হিসেবে পেশ করে বলে থাকে যে, মকতব, মাদ্রাসা ও মসজিদে দ্বীন প্রচার বা তাবলীগের কাজে যারা নিয়োজিত আর যে সকল আলেম-ওলামাগণ ওয়াজ-নছীহতে ব্যস্ত, তারা সকলেই বেতন বা বিণিময় গ্রহণ করেন। আবার দ্বীন প্রচারের কাজে নিয়োজিত পীর সাহেবগণও হাদিয়া (তাবলীগ জামায়াতের মতে বিণিময়) গ্রহণ করেন। কিন্তু একমাত্র প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই উক্ত আয়াত শরীফের পূর্ণ অনুসারী, যারা দ্বীন প্রচার করে যাচ্ছে অথচ কোন বিণিময় গ্রহণ করেনা। কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই একমাত্র অনুসরণীয় দল।
            এখন এ ব্যাপারে আমাদের সুওয়াল হলো যারা মকতব-মাদ্রাসায় পড়ায়ে, মসজিদে ইমামতী করে, ওয়াজ-নছীহত করে বিণিময় গ্রহণ করেন এবং যে সকল পীর সাহেবগণ হাদিয়া গ্রহণ করেন, উল্লিখিত আয়াত শরীফের দৃষ্টিতে তাদেরকে অনুসরণ করা জায়েয হবে কি? আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য বা দাবী কতটুকুই বা শুদ্ধ? সঠিক সমাধান দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব ঃ- প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর, বিভ্রান্তিমূলক ও জেহালতপূর্ণ এবং স্থান বিশেষে মারাত্মক কুফরীযুক্ত।
            কারণ তাদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, প্রথমতঃ যারা মকতব, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, ইমামতী, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদির বিণিময় গ্রহণ করেন, তাদেরকে অনুসরণ করা যাবেনা এবং তাঁরা হক্ব মত, হক্ব পথে নেই।
            তাদের বক্তব্য দ্বারা আরো বুঝা যাচ্ছে যে, উল্লিখিত ইবাদত সমূহের বিণিময় গ্রহণ করা জায়েয বা শরীয়ত সম্মত নয়। অথচ তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণই জেহালতপূর্ণ ও শরীয়ত বিরোধী। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে মকতব, মাদ্রাসায় পড়ায়ে, ইমামতী ও ওয়াজ-নছীহত করে বিণিময় গ্রহণ করা সম্পূর্ণ জায়েয ও শরীয়ত সম্মত। আর এটাকে নাজায়েয বলার অর্থই হচ্ছে- ইমাম, মুজ্তাহিদগণের ইজ্মাকে অস্বীকার করা, যা স্পষ্টতঃ কুফরী। কেননা ইমাম, মুজ্তাহিদ সকলের ইজ্মা বা ঐক্যমতেই মাদ্রাসায় পড়ায়ে, ইমামতী করে, ওয়াজ-নছীহতের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও শরীয়তসম্মত।
            মূলতঃ ওলামায়ে মুতাকাদ্দেমীন (পূর্ববর্তী) আলেমগণের মতে সর্ব প্রকার ইবাদতের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হারাম ছিল। আর ওলামায়ে মুতাআখ্খেরীনগণের (পরবর্তী আলেমগণের) অধিকাংশের মতে সময় অথবা স্থান নির্ধারণ করার শর্তে সর্ব প্রকার ইবাদতের বিণিময়ে পারিশ্রমিক বা উজরত গ্রহণ করা জায়েয।
            এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহের বিশ্ববিখ্যাত কিতাব জামিউর রুমুজে উল্লেখ আছে যে,

تبطل الاجارة عند المتقدمين للعبادات كالاذان والامأمة والتذ كير والتدريس والحج والغزو وتعليم القران والفقه وقرأ تهما ويفتى اليوم اى يفتى المتأخرون بصحتها اى الاجرة لهذا العبادات.
অর্থঃ- ওলামায়ে মুতাকাদ্দেমীনগণের অর্থাৎ পূর্ববর্তী আলেমগণের মতে আযান, ইমামতী, যিকির, শিক্ষকতা, হজ্ব, জ্বিহাদ, কোরআন শরীফ ও ফিক্বাহ্ শিক্ষা দিয়ে এবং ফিক্বাহ্ ও কোরআন শরীফ পাঠ করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা নাজায়েয ও বাতিল। আর বর্তমানে ফতওয়া হলো- অর্থাৎ ওলামায়ে মুতাআখ্খেরীনগণের (পরবর্তী আলেম) ফতওয়া মোতাবেক উল্লেখিত ইবাদতসমূহের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও সহীহ্। অনুরূপ তাফসীরে রুহুল বয়ান ও মূলতাকার হাশিয়াতেও উল্লেখ আছে।
            উপরোক্ত দলীলের ভিত্তিতে স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, যারা উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হারাম বলে, তারা মূলতঃ ওলামায়ে মুতাকাদ্দেমীনগণের মতকেই ফতওয়া হিসাবে গ্রহণ করে। যদি ওলামায়ে মুতাকাদ্দেমীনগণের মতকেই ফতওয়া হিসাবে গ্রহণ করা হয়, তবে তো সমস্ত দ্বীনী কাজের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা নাজায়েয ও হারাম হবে। যেমন- আযান, ইমামতী, শিক্ষকতা ইত্যাদি। অথচ তারাই আবার অন্যান্য দ্বীনী কাজের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করে থাকেন, এর দ্বারা কি তাদের স্ববিরোধীতা প্রকাশ পায়না? এবং এর দ্বারা কি কিতাবের কিছু অংশ অস্বীকার করা হয়না? অথচ আল্লাহ্ পাক বলেন,
افتؤمنون ببعض الكتاب وتكفرون ببعض.
অর্থঃ- তোমরা কিতাবের কিছু অংশ মান্য কর, আর কিছু অংশ অস্বীকার কর?” (সূরা বাক্বারা/৮০)
            কাজেই সুবিধা বুঝে কিছু মানবে, আর কিছু অমান্য করবে, তা হতে পারেনা। অর্থাৎ পুরোটাই মানতে হবে। মূলকথা হলো- ওলামায়ে মুতাকাদ্দেমীনগণের নিকট আযান, ইমামতী, হজ্ব, কোরআন শিক্ষা দিয়ে ও কোরআন শরীফ খতম বা তিলাওয়াত করেও উজরত গ্রহণ করা নাজায়েয ও হারাম ছিল। আর যখন পরবর্তীকালে সরকারী তরফ থেকে আলেমগণের ভাতা প্রদান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হওয়ায় (যেহেতু খেলাফত ব্যবস্থায় সরকারী তরফ থেকে আলেমগণের জন্য ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা থাকে) এবং মানুষের দ্বীনদারী-পরহেজগারী ও দ্বীনের খেদমতে আগ্রহ হ্রাস পাওয়ায়, পরবর্তী আলেমগণ অর্থাৎ ওলামায়ে মুতাআখ্খেরীনগণ ইজ্তিহাদ করতঃ ফতওয়া দেন যে, শর্ত সাপেক্ষে অর্থাৎ সময় অথবা স্থান নির্ধারণ করে দিলে উল্লিখিত ইবাদতের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে যে,
وافتى المتأخرون بصحة الاجرة للاذان والاقامة والتذكير والتدريس والحج والغزو وتعليم القرانوالفقه وقرأتهما لفتور رغبات اليوم.
অর্থঃ- ওলামায়ে মুতাআখ্খেরীনগণ, বর্তমানকালে দ্বীনের খিদমতে আগ্রহ শিথিল হওয়ার কারণে- আযান, ইক্বামত, ওয়াজ-নছীহত, শিক্ষা প্রদান, হজ্ব-জ্বিহাদ, কোরআন শরীফ ও ফিক্বাহ্ শিক্ষা দিয়ে এবং কোরআন শরীফ ও ফিক্বাহ্ পাঠ করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা সহীহ্ বা জায়েয ফতওয়া দিয়েছেন।
            অতএব, সময় অথবা স্থান নির্ধারণ করার শর্ত সাপেক্ষে কোরআন শরীফ খতম করাসহ উল্লিখিত সকল ইবাদতের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয বা হালাল।
            এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাস্সির রঈসূল মুহাদ্দেসীন, বাহ্রুল উলুম, জামিউল উসুলিয়্যীন, ফক্বীহুল উম্মত শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহ্লভী (রঃ) তাঁর তাফসীরে আযীযীতে উল্লেখ করেন,
محققين علماء قاعده مقرركردهاند كه ...... هر ..ه در حق شخص عبادت باشد- خواه فرض عين خواه فرض كفاية خواه سنت مؤكده بران اجرت كر فتن جائز نيست مثل تعليم قران، وحديث وفقه ونماز وروزه وتلاو وذكر وتسبيح وان ..ه بهيح وجه عبادت نيست مباح محض است بران اجرت كر فتن جائزاست مثل رقيه كردن بقران يا تعويذ نوشتن وامنال ذالك- وعبادات كه سيب تعيين مدت يا تخصيص مكان مباح ميشوند- نيز برأنها اجرت كرفتن جائزاست- مثل تعليم قران بطفل كسى درخانهء او ازصبح تاشام.

অর্থঃ- মুহাক্কিক (সূক্ষ্ম তত্ত্ববিদ) আলেমগণ একটি মূল্যবান (কায়েদা) নিয়ম স্থির করেছেন যে, তাঁরা বলেন, যা মানুষের প্রতি ইবাদত হিসাবে সাব্যস্ত, যেমন- ফরজে আইন হোক অথবা ফরজে কেফায়া বা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ হোক, যথা- কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ ও ফিক্বাহ্ পাঠ করে এবং নামাজ, রোজা, কোরআন শরীফ তিলাওয়াত, যিকির ও তাস্বীহ্ পাঠ করে ইত্যাদির বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয নেই। আর যে সকল ইবাদতসমূহ কারো জন্যে ইবাদত নহে (অর্থাৎ ফরজ-ওয়াজিব নহে) বরং স্পষ্ট মোবাহ্ কাজ হিসাবে সাব্যস্ত, যেমন- কোরআন শরীফ পাঠ করে শরীরে ফুক দেয়া, তাবীজ লেখা ইত্যাদির বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয এবং যে সকল ইবাদত সময় অথবা স্থান নির্ধারণ করাতে মোবাহ্ হয়ে যায়, যেমন- কারো সন্তানকে তার ঘরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোরআন শরীফ শিক্ষা দিবে, এরূপ ইবাদতের বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয।
            উল্লিখিত ইবারতে মূলতঃ তিনটি ছূরত বা অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে- (১) যে সকল ইবাদতগুলো ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্, তার বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হারাম। (মুতাকাদ্দেমীনগণের মতে)
(২) যে সকল ইবাদতগুলো খাঁটি মোবাহ্ কাজ, তার বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয, যেমন- তাবীজ লিখে।
(৩) (মুতাআখ্খেরীনগণের মতে) সময় অথবা স্থান নির্ধারণ করে দেয়াতে ইবাদতসমূহ মোবাহ্ কাজে পরিণত হয়ে যায়, তখন তার উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করাও জায়েয হয়ে যায়। কারণ তখন সে ব্যক্তি সময় অথবা স্থানের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে যায়।
            অতএব, তাকে যে উজরত বা পারিশ্রমিক দেয়া হবে, ওটা তার সময় অথবা স্থানে আবদ্ধ থাকার কারণে, ইবাদতের বিণিময়ে নয়। সুতরাং সময় অথবা স্থান নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে আযান, ইমামতী, হজ্ব, জ্বিহাদ, কোরআন শরীফ ও ফিক্বাহ্ শিক্ষা দিয়ে, কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করে ও ওয়াজ-নছীহত করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয, এমন কি উক্ত পারিশ্রমিক সে জোরপূর্বকও আদায় করতে পারবে।
            এছাড়াও নিম্মোক্ত বিশ্ব বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাব সমূহে মাদ্রাসায় পড়ায়ে, ইমামতী করে ও ওয়াজ-নছীহত, কোরআন শরীফ খতম বা তিলাওয়াত করে ইত্যাদির বিণিময়ে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয বলা হয়েছে। যেমন- তাফসীরে রুহুল বয়ান, তাফসীরে ইকলীল, তাফসীরে আযীযী, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ফতওয়ায়ে কাজরুনী, ফতওয়ায়ে আলী আফেন্দী, ফতওয়ায়ে ফয়জী, ফতওয়ায়ে আযীযী, ফতওয়ায়ে হানুতী, ফতওয়ায়ে আবী সউদ ইমাদী, মজমুয়ায়ে ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই, বাহরুর রায়েক, দুররুল মোখতার, আশবাহু ওয়ান নাযায়ের, জাওহারাতুন নাইয়্যারাহ্, তাতার খানিয়া, জামিউর রুমুজ, তাহ্তাবী ইত্যাদি।
            সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, ওলামায়ে মুতাআখ্খেরীনগণের নিকট সময় অথবা স্থান নির্ধারণ করার শর্ত সাপেক্ষে আযান, ইমামতী, মকতব-মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, ওয়াজ-নছীহত, কোরআন শরীফ খতম বা পাঠ করে উজরত বা পারিশ্রমিক নেয়া ও দেয়া উভয়টাই জায়েয ও শরীয়তসম্মত। আর যারা উল্লিখিত ইবাদতের বিণিময় গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে যাঁরা হাক্কানী আলেম তাঁরা অবশ্যই অনুসরণীয় এবং তাঁরা অবশ্যই হক্ব মত হক্ব পথে রয়েছেন।
            কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্য- যারা ইমামতী করে, মকতব-মাদ্রাসায় পড়ায়ে ও ওয়াজ-নছীহতের বিণিময় গ্রহণ করে, তাদেরকে অনুসরণ করা যাবেনা এবং তারা হক্ব মত-হক্ব পথে নেই।তা সম্পূর্ণই মনগড়া, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর, কোরআন-সুন্নাহ্র খেলাফ ও কুফরীমূলক।
            দ্বিতীয়তঃ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা আরো বুঝা যাচ্ছে যে, হাদিয়া বিণিময়ের অন্তর্ভূক্ত এবং হাদিয়া যাঁরা গ্রহণ করবেন, তাঁরা অনুসরণীয় ও হক্বপন্থী নয়।
            মূলতঃ তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণই কুফরীমূলক। কারণ হাদিয়া কখনোই বিণিময়ের অন্তর্ভূক্ত নয়। তাই প্রথমে বুঝতে হবে, হাদিয়া শব্দের অর্থ কি এবং হাদিয়া কাকে বলে।
            হাদিয়া শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো- উপহার, তোহ্ফা, নজরানা ইত্যাদি। শরীয়তের দৃষ্টিতে হাদিয়া বলা হয়-

من اتاه رزق كم عير مسئله
অর্থঃ- চাওয়া ব্যতীত যা আসে।অর্থাৎ যা পরস্পর পরস্পরের প্রতি মুহব্বত ও তাযীম-তাকরীমের কারণে দেয়া-নেয়া হয়।
            উল্লেখ্য, হাদিয়া গ্রহণ করা সুন্নাত। তবে হাদিয়ার সামগ্রী হালাল হওয়া ফরজ। কেননা কোরআন শরীফে এরশাদ হয়েছে,

ياايها الناس كلوا ممافى الارض حلالا طيبا ولا تتبعوا خطوات الشيطان انه لكم عدو مبين.
অর্থঃ- হে লোক সকল! তোমরা যমিন থেকে হালাল ও পবিত্র খাদ্য-সামগ্রী খাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয় শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাক্বারা/১৬৮)
            আর এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে,
لايدخل الجنة لحم نبت من السحت كل لحم نبت من السحت كانت النار اولى يه.
অর্থঃ- গোশ্তের যে টুকরাটি হারাম রিযিক দ্বারা তৈরী বা পয়দা হয়েছে, তা বেহেশ্তে প্রবেশ করবে না। প্রত্যেক গোশ্তের টুকরা যা হারাম রিযিক দ্বারা তৈরী হয়েছে, তার জন্য জাহান্নামের আগুণই যথেষ্ট।” (আহ্মদ, বায়হাক্বী, মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্)
            হাদীস শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে, “এক পয়সা হারাম খেলে চল্লিশ দিনের ইবাদত কবুল হয়না, খালেছ তওবা না করা পর্যন্ত।
            কাজেই সকলের নিকট থেকে হাদিয়া নেয়া জায়েয নেই। যার হাদিয়া হালাল হবে, তারটাই নেয়া যাবে। আর যারটা হালাল নয়, তারটা নেয়া যাবেনা।
            উল্লেখ্য, সকল নবী-রাসূল (আঃ) এমনকি আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও হাদিয়া গ্রহণ করেছেন।
            শুধু তাই নয়, হাদিয়া নবী-রাসূল (আঃ) এমনকি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা নিদর্শন। যেমন এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ও বুযুর্গ সাহাবী, হযরত সালমান ফার্সী (রাঃ)-এর পবিত্র ও বরকতময় জীবনীতে উল্লেখ আছে যে, মুহাদ্দিস-ই-কিরাম বা ঐতিহাসিকগণের মতে হযরত সালমান ফার্সী (রাঃ) ৫০০ বৎসর হায়াত পেয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ কমও বলেছেন। তবে সকলের মতেই কমপক্ষে দুশত বছর বলা হয়েছে।
            মূলতঃ হযরত সালমান ফার্সী (রাঃ) ছিলেন মজুসী বা অগ্নি উপাসকের সন্তান। কিন্তু তিনি পরবর্তীতে মজূসী ধর্ম পরিত্যাগ করে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুসেল, নসীবাইন ইত্যাদি নানা স্থান সফর করে পর্যায়ক্রমে এক পাদ্রী হতে অপর পাদ্রীর নিকটে গিয়ে হক্ব তালাশ করতে থাকেন। তিনি সর্বশেষ যে পাদ্রীর নিকটে যান, সে পাদ্রী তাকে বললো- হে সালমান! তুমি আমার পর আর কোন হক্ব পাদ্রী পাবেনা। এরপর তুমি আখেরী নবী, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আগমনের অপেক্ষায় থাকবে।
            পাদ্রী আখেরী নবী, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কিছু বৈশিষ্ট্য ও আলামত বা নিদর্শনের কথাও বলে দিল। পাদ্রী বললো- তিনি আগমন করবেন মক্কা শরীফে, ওয়াদিউল ক্বোরায়, আর হিজরত করবেন, মদীনা শরীফে। যে স্থান হবে- কঙ্করময় ও খেজুর বৃক্ষে পরিপূর্ণ। তাঁর পিঠ মোবারকে থাকবে- মহরে নুবুওওয়াত।আর তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, কিন্তু যাকাত-ফিৎরা খাবেন না।
            সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা শরীফে হিজরত করার পর হযরত সালমান ফার্সী (রাঃ) লোক মারফত সংবাদ পেয়ে একদিন কিছু খেজুর নিয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবার শরীফে আসলেন এবং খেজুরগুলো খেদমতে পেশ করে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এগুলো সদ্কা হিসেবে এনেছি। তিনি খেজুরগুলো হাতে নিয়ে গরীব সাহাবীদের দিয়ে বললেন, এগুলো তোমরা খেয়ে ফেলো, আমার জন্য সদ্কা খাওয়া জায়েয নেই।
            অতঃপর আরেকদিন কিছু খেজুর নিয়ে দরবার শরীফে আসলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এগুলো হাদিয়া স্বরূপ এনেছি। তখন হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা গ্রহণ করলেন, নিজে খেলেন এবং সকলকে খাওয়ালেন।
            উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা বস্তুতঃ এটাই প্রমাণিত হয় যে, হাদিয়া গ্রহণ করা শুধু সুন্নতই নয় বরং তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ বৈশিষ্ট্য ও নিদর্শন সমূহের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন।
            হাদিয়া গ্রহণ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,
وعن عائشة قالت- كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقبل الهدية ويثيب عليها.
অর্থঃ- হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন- রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করতেন।” (বোখারী, মেশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, তালীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত্ ত্বীবী, মিরআতুল মানাজীহ্, মোযাহেরে হক্ব)
            অন্য হাদীস শরীফে আরো উল্লেখ আছে যে,


وعن ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لود عيت الى كراع لا جبت ولو اهدى الى ذراع لقبلت.
অর্থঃ- হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যদি আমাকে (গরু-ছাগলের) ক্ষুরের হাড্ডি খাওয়ার জন্য দাওয়াত করা হয়, তাহলে আমি অবশ্যই তা কবুল করবো। আর যদি একটি রানও (বাহু) আমাকে হাদিয়া দেয়া হয়, তবে আমি অবশ্যই তা কবুল করবো।” (বোখারী, মেশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মিরআতুল মানাজীহ্, মোযাহেরে হক্ব)
            হাদীস শরীফের অন্যত্র আরো উল্লেখ আছে যে,
وعن ابى هريرة رضى الله عنه قال كان رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا اتى بطعام سأل عنه اهدية ام صدقة فان قيل صدقة قال لا صحابه كلوا ولم ياكل وان قيل هدية ضرب بيده فأكل معهم.
অর্থঃ- হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল, যখনই তাঁর কাছে কোন খাবার জিনিস আনা হতো, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করতেন, উহা কি হাদিয়া না সদ্কা? যদি বলা হতো- সদ্কা, তখন তিনি (গরীব) সাহাবী (রাঃ)গণকে বলতেন, তোমরা খাও এবং তিনি নিজে খেতেন না। আর যখন বলা হতো হাদিয়া, তখন তিনি তাতে হাত রাখতেন এবং তাদের সাথে খেতেন।” (বোখারী, মুসলিম, মেশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মিরআতুল মানাজীহ্, মোযাহেরে হক্ব)
            উল্লিখিত হাদীস শরীফের বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করতেন, তা যত সামান্য বস্তুই হোকনা কেন।
            আরো উল্লেখ্য যে, হাদিয়া শুধু হালালই নয় বরং হাদিয়া ক্ষেত্র বিশেষে হারামকেও হালাল করে দেয়। অর্থাৎ যার জন্যে সদ্কা-ফিৎরা খাওয়া জায়েয, সে যদি সদ্কা হিসেবে প্রাপ্ত কোন খাদ্য বা বস্তু এমন কোন ব্যক্তিকে হাদিয়া হিসেবে প্রদান করে, যার জন্য সদ্কা খাওয়া হারাম, তবে হাদিয়া হিসেবে দেয়ার কারণে তা খাওয়া তার জন্য সম্পূর্ণই হালাল।
             যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,
عن عائشة قالت كان فى بريرة ثلث سنن احدى السنن انها عتقت فخيرت فى زوجها وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم الولاء لمن اعتق ودخل رسول الله صلى الله عليه وسلم والبرمة تفور بلحم فقرب اليه خبز رادم من ادم البيت فقال الم اربرمة فيها لحم قالوا بلى ولكن ذالك لحم تصدقيه على بريرة وانت لا تأكل الصدقة قال هو عليها صدقة ولنا هدية.
অর্থঃ- হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “বারীরাহ্কে কেন্দ্র করে (ইসলামী শরীয়তে) তিনটি সুন্নত (বিধান) প্রবর্তিত হয়েছে। প্রথম সুন্নত (বিধান) হলো- সে দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছে, ফলে তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকা না থাকার ব্যাপারে তাকে ইখতিয়ার (অধিকার) দেয়া হয়েছে। (দ্বিতীয় সুন্নত বা বিধান) হলো- তার মিরাস সম্পর্কে) রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তাঁর মীরাসের অধিকারী সে লোকই হবে, যে তাকে মুক্ত করেছে। আর (তৃতীয় সুন্নত (বিধান) হলো) একদিন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীগণের ঘরে প্রবেশ করলেন (এবং দেখলেন) হাড়ীতে (কিছু) গোশ্ত পাকানো হচ্ছে। (অথচ খাওয়ার জন্য) তাঁর কাছে রুটি এবং ঘরের অন্য আর এক সালুন (তরকারী) উপস্থিত করা হলো। তখন তিনি বললেন, আমি কি দেখি নাই যে, হাড়ীর মধ্যে গোশ্ত পাক হচ্ছিল। তারা বললো- হ্যাঁ অবশ্যই, তবে তা এমন গোশ্ত, যা বারীরাহ্কে সদ্কা স্বরূপ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আপনি তো সদ্কা খাননা। (এ সময়) তিনি বললেন, তা বারীরাহ্-এর জন্য সদ্কা, আর আমাদের জন্য হাদিয়া।অর্থাৎ সে যদি আমাকে হাদিয়া হিসেবে দেয়, তবে তা আমার জন্য খাওয়া জায়েয। (বোখারী, মুসলিম, মেশকাত ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস্ সারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে মুসলিম, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মিরআতুল মানাজীহ্, মোযাহেরে হক্ব))
            আর তাই হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “যাদের জন্য সদ্কা-ফিৎরা গ্রহণ করা বা খাওয়া হারাম, তাদের জন্য কয়েক ছূরতে সদ্কা-ফিৎরা গ্রহণ করা বা খাওয়া জায়েয বা হালাল। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,
عن عطاء بن يسار مرسلا- قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تحل الصدقة لغنى الا لخمسة لغاز فى سبيل الله او لعامل عليه او الغارم اولرجل اشتر اها بماله اولرجل كان له جار مشكين فتصدق على المسكين فاهدى المسكين لغنى.
অর্থঃ- (তাবেয়ী) হযরত আতা বিন ইয়াসার (রঃ) হতে মুরসাল হিসেবে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন- রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সম্পদশালী (ধনী) ব্যক্তির জন্য সদ্কা গ্রহণ করা হালাল নয়। তবে হ্যাঁ পাঁচ প্রকার ব্যক্তির জন্য হালাল (যদিও সে সম্পদশালী হয়)- (১) আল্লাহ্র রাস্তায় জ্বিহাদে লিপ্ত গাজী। (২) যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী। (৩) ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি। (৪) যে ব্যক্তি নিজের মাল দ্বারা যাকাতের মাল ক্রয় করেছে। (৫) অথবা এমন ব্যক্তি যার প্রতিবেশী মিস্কীন। উক্ত মিস্কীনকে কেউ সদ্কা দিয়েছে, পরে সেই মিস্কীন (প্রতিবেশী) সম্পদশালী ব্যক্তিকে হাদিয়া (উপঢৌকন) দিয়েছে।” (মুয়াত্তায়ে মালেক, ইবনে মাযাহ্, মেশকাত, আওযাযুল মাসালিক, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীক্ছ্ ুছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্)
            সুতরাং বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, পৃথিবীতে যত হালাল খাদ্য রয়েছে, তার মধ্যে হাদিয়াই হচ্ছে- সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ হালাল খাদ্য। কারণ হাদিয়া এত পবিত্র বস্তু, যা অপবিত্রকে পবিত্র করে দেয়। আর হাদিয়া দেয়া ও নেয়া উভয়টাই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সুন্নত। তাই দেখা যায়- হালাল কোন বস্তু হাদিয়া হিসেবে আসলে তিনি তা কখনো ফিরিয়ে দিতেন না। কাজেই হাদিয়া (যদি হালাল হয়) ফিরিয়ে দেয়া বা গ্রহণ না করা শরীয়তসম্মত নয়।
            এ প্রসঙ্গে তায্কেরাতুল আওলিয়া (নামক) কিতাবে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে যে, বিশিষ্ট বুযুর্গ ও বিখ্যাত ওলী আল্লাহ্, হযরত ফতেহ্ মুহ্সেলী (রঃ)-এর দরবার শরীফে একদিন এক ব্যক্তি প্রায় এক লক্ষ দেরহাম হাদিয়াস্বরূপ পেশ করলো। তখন হযরত ফতেহ্ মুহ্সেলী (রঃ) বললেন, তুমি এত টাকা নিয়ে এসেছ, তোমার কি টাকার প্রয়োজন নেই? সে ব্যক্তি বললো, অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। তখন বুযুর্গ ব্যক্তি বললেন, এ টাকাগুলো তুমি নিয়ে যাও, আমার টাকার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তিনি হাদিয়াগুলো ফিরিয়ে দিলেন। তখন হাদিয়া দাতা বললো, হুজুর! হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,
من اتاه رزق من غير مشئلة فرده فانما يرده على الله تعالى.
অর্থঃ- যে ব্যক্তির নিকট চাওয়া ব্যতীত কিছু আসে অর্থাৎ হাদিয়াস্বরূপ আসে, অতঃপর সে যদি তা ফিরিয়ে দেয়, তবে সে নিশ্চয়ই তা আল্লাহ্ পাক-এর চেহারা মোবারকের উপর ফিরায়ে দিল।
            একথা শুনে হযরত ফতেহ্ মুহ্সেলী (রঃ) বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ, আমি এ হাদীস শরীফের উপর আমল করার জন্য এক দেরহাম গ্রহণ করলাম, বাকিগুলো তুমি নিয়ে যাও।
            সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, পীর সাহেব বা ওলী আল্লাহ্গণ হাদিয়া গ্রহণ করেন শুধুমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত আদায় বা পালন করার জন্যই। যেহেতু সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া গহণ করতেন এবং হাদিয়া কখনো ফিরিয়ে দিতেন না।
            অতএব, যদি বলা হয়- হাদিয়া বিণিময়ের অন্তর্ভুক্ত, তবে নবী-রাসূল (আঃ)গণও বিণিময় গ্রহণ করেছেন বলে সাব্যস্ত হয়। অথচ তা সম্পূর্ণ নবী-রাসূল (আঃ)গণের শানের খেলাফ। যা বিশেষ কুফরী।
            এবং এর দ্বারা আরো বুঝা যায় যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা নবী-রাসূল (আঃ), এমনকি আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চেয়েও শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। কেননা নবী রাসূল (আঃ)গণ দ্বীন প্রচারের বিণিময়ে হাদিয়া (তাদের মতে বিণিময়) গ্রহণ করেছেন, কিন্তু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা দ্বীন প্রচার করে অথচ হাদিয়া গ্রহণ করে না, যা স্পষ্টতঃ কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক)।
            মূলতঃ হাদিয়া, বিণিময় বা পারিশ্রমিকের অন্তর্ভূক্ত নয়। বরং হাদিয়া দেয়া ও নেয়া (যদি হালাল হয়) সুন্নতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সুন্নতে সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ), সুন্নতে আওলিয়া-ই-কিরাম (রঃ)। কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যদি সাধারণভাবে হাদিয়া গ্রহণ করা হতে বিরত থাকে, তবে তারা বিদ্য়াতীর অন্তর্ভূক্ত হবে। আর হাদিয়াকে বিণিময় বললে ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে কাফের হবে।
            ফলকথা হলো- সুওয়ালে উল্লিখিত কোরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ নবী-রাসূল (আঃ)গণের জন্য খাছ। অর্থাৎ নবী-রাসূল (আঃ)গণের জন্য হিদায়েত বা দ্বীন প্রচারের পরিবর্তে বিণিময় গ্রহণ করা তাঁদের শানের খেলাফ। তাই নবী-রাসূল (আঃ)গণ দ্বীন প্রচার করে বিণিময় গ্রহণ করতেন না। অতএব, কেউ যদি বিনা বিণিময়ে দ্বীন প্রচার করে, তবে তা তাঁর জন্য সুন্নত হবে। কিন্তু আমভাবে উক্ত আয়াত শরীফ সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়।
            সুতরাং সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, মকতব-মাদ্রাসায় পড়ায়ে, মসজিদে ইমামতী করে, ওয়াজ-নছীহত করে উজরত গ্রহণ করা জায়েয। আর তাদের মধ্যে যাঁরা হক্কানী আলেম, তাঁরা অবশ্যই অনুসরণীয়।
            আরো স্মর্তব্য যে, হাদিয়া বিণিময়ের অন্তর্ভূক্ত নয়, বরং হাদিয়া গ্রহণ করা খাছ সুন্নত। আর অনুসরণীয় ওলী আল্লাহ্গণ সুন্নত আদায় করার উদ্দেশ্যেই হাদিয়া গ্রহণ করে থাকেন। আর যারা সুন্নতের খেলাফ কাজ করে বা যারা বিদ্য়াতী এবং স্থান বিশেষে কুফরী আক্বীদা পোষণ করে, তারা কখনোই একমাত্র অনুসরণীয় দল হতে পারেনা। বরং তাদেরকে অনুসরণ করা হতে বিরত থাকাই সকলের জন্য ফরজ-ওয়াজিব।
            অতএব, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উক্ত বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর, নেহায়েতই অজ্ঞতামূলক ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। এ ধরণের আক্বীদা ও বক্তব্য প্রদান থেকে বেঁচে থাকা তাদেরসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই ফরজ-ওয়াজিব।
৬৬নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল ঃ-         প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওঃ ইলিয়াস সাহেব তাঁর জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে কিছু কথা বলেন। যাতে ব্যক্ত হয় যে, তিনি কেন এই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের সূচনা করেছেন। তিনি বলেন যে, “তিনি প্রথমাবস্থায় মাদ্রাসায় পড়াতেন এবং সেখানে ভাল ভাল ছেলেদের আগমণ বেড়েই চললো। কিন্তু এক সময় তিনি মনে করলেন যে, এভাবে আলেম বনার পর কেউ হয়তোবা হাকিম হবে, কেউ চাকুরী করবে অথবা কেউ মাদ্রাসায়ই পড়াবে। কিন্তু তাতে কোন ফায়দা হবেনা। একথা ভেবে মাদ্রাসায় পড়ানো হতে তার মন ফিরে গেল।
            এরপর তাঁর পীর সাহেব যখন তাকে খেলাফত দিলেন, তখন কিছুদিন তিনি মুরীদ করলেন ও ইল্মে তাসাউফের তালীম দিতে লাগলেন এবং তাঁর কথানুযায়ী তাতে মুরীদগণের তরক্কীও হতে লাগলো। কিন্তু তাতে তিনি ভাবলেন যে, এতে কি হবে? তাঁর ভাষায়- বেশীর চেয়ে বেশী ইহা হইবে যে, কিছু যিকির শোগল করনেওয়ালা লোক বাহির হইবে। অতঃপর মানুষের মধ্যে তাহাদের খুব সুনাম ছড়াইয়া পড়িবে। তখন হয়তো কেউ মোকদ্দমায় জিতিবার জন্য দোয়ার প্রার্থণা করিবে, কেউ আওলাদের জন্য তাবীজের দরখাস্ত করিবে। কেউ কারবার-ব্যবসার তরক্কীর জন্য দোয়া চাইবে। আর বেশীর চেয়ে বেশী হইবে যে, তাহাদের দ্বারা ভবিষ্যতে আরো কিছু জাকেরীনের জামায়াত তৈয়ার হইবে। এই চিন্তা করিয়া সেইদিক হইতেও আমার মন ফিরিয়া গেল।অতঃপর তিনি যা করলেন, তা হলো- বর্তমান ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক তাবলীগের প্রচলন এবং সেক্ষেত্রে তার বক্তব্য হলো- যদি এই কাজ হইতে থাকে, তবে এখন হইতে হাজার গুণ বেশী মাদ্রাসা এবং খানকাহ্ কায়েম হইয়া যাইবে। বরং প্রত্যেক মুসলমান স্বশরীরে একটি মাদ্রাসা এবং খানকাহ্ বনিয়া যাইবে।
            এখন আমাদের সুওয়াল হলো- মাওঃ ইলিয়াস সাহেবের এই ১৫৯নং মলফুযাতের উপরোক্ত কথাসমূহ কতটুকু শুদ্ধ? মাদ্রাসা পড়ানো বাদ দেয়া সম্পর্কিত এবং ইল্মে তাসাউফের তালীম বাদ দেয়ার প্রেক্ষিতে মাদ্রাসায় পড়া ও ইল্মে তাসাউফের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ কতটুকু সঠিক হয়েছে। আর তার প্রচলিত তাবলীগ করিলে সকলেই একটি ভ্রাম্যমান মাদ্রাসা ও খানকাহ্ হইয়া যাইবেএ কথাই বা কতটুকু সত্য হয়েছে? এবং এ প্রেক্ষিতে মাদ্রাসায় পড়ানো ও যিকিরের তালীম বাদ দিয়ে মনগড়া ৬ উছুল ভিত্তিক তাবলীগের প্রচলনের পদক্ষেপই বা কতটুকু সহীহ্, বাস্তবসম্মত ও ফলপ্রসু হয়েছে?
জাওয়াব ঃ-         সুওয়ালে উল্লেখকৃত মন্তব্যসমূহ আদৌ সঠিক হয়নি। বরং তা জেহালতপূর্ণ ও গোমরাহী মূলক হয়েছে। যা আবহমানকালের সকল অনুসৃত ইমাম, মুজ্তাহিদ ও আওলিয়া-ই-কিরামগণের মত-পথের খেলাফ। উল্লেখ করা যায় যে, হযরত ইমাম আযম আবূ হানীফা (রঃ)সহ হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী (রঃ) এবং আরো অনেক ইমামগণ দর্স দিয়েছেন, মাদ্রাসায় পড়িয়েছেন ও মাদ্রাসায় পড়ানোর জন্য তাকীদ করেছেন। এবং তারা দর্স-তাদরীস ও ইল্ম তলব হতে দূরে সরে যাওয়ার কাজকে চরম ক্ষতিকর ও শয়তানী ওয়াসওয়াসামূলক বলে অভিহিত করেছেন।
            এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে, শয়তান তার চেলাদের সমাবেশে হিসেব গ্রহণ করে যে, কোন চেলা কি কাজ করেছে। তখন বিভিন্ন চেলা বিভিন্ন প্রকার কাজের বর্ণনা দেয়। তার মধ্যে কোনটি চুরি, কোনটি ব্যভিচার, কোনটি খুন-খারাবী ইত্যাদি। শয়তান এসব শুনে মোটামুটি খুশী হয়। অতঃপর সে এক কিনারে এক ল্যাংড়া ও দূর্বল চেলাকে বসে থাকতে দেখতে পায়। সে তখন জিজ্ঞেস করে, কিরে তুই কিছু করিসনি? ল্যাংড়া শয়তান জবাব দেয় যে, সে সামান্য একটা কাজ করেছে। মূল শয়তান তখন আগ্রহভরে জানতে চায় যে, সে কাজটি কি? উক্ত চেলা তখন জবাব দেয় যে, একজন তালিব-ইল্ম বা মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্র মাদ্রাসায় পড়তে যাচ্ছিল কিন্তু সে তাকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে মাদ্রাসা পড়া হতে ফিরিয়ে দিয়েছে। একথা শুনে ইবলিস তখন মহা খুশীতে আটখানা হয়ে বলে, তুই সবচেয়ে বড় কাজ করেছিস। কারণ এই তালিব-ইল্ম বা ছাত্র যদি মাদ্রাসায় পড়ে বড় আলেম হতো, তবে সে দ্বীনের সহীহ্ বুঝ পেত। ফলে তার দ্বারা লক্ষ লক্ষ লোক হিদায়েত হতো। তার কারণে দ্বীনের আসল জরুরী কাজ ছেড়ে নামকাওয়াস্তে সামান্য কাজ নিয়ে মেতে থাকার ওয়াসওয়াসা হতে মানুষ বেঁচে থাকতে পারতো। তার কারণে ইল্মের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটতো। কিন্তু সেসব কিছুই পন্ড হয়েছে তোর কারণে। যেহেতু তুই তাকে মাদ্রাসায় পড়া হতে ফিরিয়ে দিয়েছিস।
            অতএব প্রমাণিত হলো যে, মাদ্রাসায় পড়া বা পড়ানো হতে দূরে সরে থাকার অর্থ হচ্ছে- খোদ শয়তানকে মহাখুশী করা ও তার বিশেষ ওয়াসওয়াসায় প্রতারিত হওয়া এবং ইল্ম ও ইসলাম হতে লোকজনকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং ইল্ম তথা ইসলামের আলো হতে লোকজনকে নিবৃত্ত করে অন্ধকারে নিপতিত করা তথা গোমরাহী ও কুফরীর পথে পরিচালিত করা।অপরদিকে মাদ্রাসায় পড়ানোকে অবজ্ঞা করার অর্থ হচ্ছে- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ সুন্নতকে অবজ্ঞা করা।
            এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে বর্ণিত রয়েছে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট একবার জানতে চাওয়া হয়েছিল- ব্যবসা করা কেমন? জবাবে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, “আলকাসেবু হাবীবুল্লাহ্অর্থাৎ যারা ব্যবসা করে, তারা আল্লাহ্ পাক-এর বন্ধু।ঐ সময় মজলিসের মধ্য হতে একজন লোক দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমার পেশা সম্বন্ধে কি বলেন? হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার পেশা কি?” সে বললো, আমি দর্জির কাজ করি। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার পেশা খুব উত্তম, যদি তুমি সততা অবলম্বন কর, কাল ক্বিয়ামতে হযরত ঈসা (আঃ)-এর সঙ্গে তোমার হাশর হবে।এবার আর একজন লোক দাঁড়িয়ে বললেন, আমার পেশা সম্বন্ধে আপনি কি বলেন? হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার পেশা কি?” তিনি উত্তরে বললেন, আমি হারছী” (শষ্য দানা)-র ব্যবসা করি। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, “এ ব্যবসাও উত্তম। হযরত জিব্রাঈল (আঃ), হযরত আদম (আঃ)কে এই পেশা শিখিয়েছিলেন। যদি মিথ্যা না বলো এবং চুরি না কর, তাহলে হাশরের দিন হযরত আদম (আঃ)-এর সঙ্গে তোমাকে উঠানো হবে এবং উত্তম বেহেশ্ত দান করা হবে, আর তুমি তাঁর প্রতিবেশী হবে।এবার আরো একজন লোক দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমার পেশা সম্বন্ধে কি আদেশ করেন? হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার পেশা কি?” তিনি উত্তর দিলেন, আমার পেশা (ব্যবসা) কশ্তকারী” (শব্জি তরকারি)। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমার ব্যবসা অত্যন্ত ভাল, হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এরও এ পেশা ছিল। আল্লাহ্ তায়ালা মঙ্গল করুন এবং সুফল প্রদান করুন। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এ পেশা অবলম্বনকারীদের জন্য দোয়া করেছিলেন- হাশরের দিন আমার সাথে তাদের হাশর হোক এবং তারা আমার প্রতিবেশী হোক।এবার অন্য একজন দাঁড়িয়ে বললেন, আমার পেশা শিক্ষকতা। হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “এ পেশাধারীকে আল্লাহ্ তায়ালা বন্ধু মনে করেন।আরো বললেন, “হাশরের দিন আমার সঙ্গে তোমার হাশর হবে এবং তুমি আজরে আযীম” (শ্রেষ্ঠ প্রতিদান) লাভ করবে। যদি পড়াবার সময় নির্ভূল ও মনোযোগ সহকারে পড়াও, তাহলে ফেরেশ্তাগণ তোমার জন্য এস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করবেন।” (আনীসুল আরওয়াহ্) 
            অতএব, মাদ্রাসায় দর্স-তালীম দেয়ার মত সেই মহৎ কাজ থেকে দূরে সরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে- আল্লাহ্র রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নত পরিত্যাগ করে নিজস্ব মনগড়া ও গোমরাহীর পথে পরিচালিত হওয়া।
            পাশাপাশি উল্লেখ করতে হয় যে, ইলিয়াস সাহেব মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে ছাত্রদের পরিণতি সম্পর্কে যে ধারণা করেছে, তা নিতান্তই তার মনগড়া ও ভ্রান্তিযুক্ত ধারণা। কারণ ওস্তাদ হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল, সকলকে দ্বীনী ইল্মের আসল উদ্দেশ্য ও তার পরিধি এবং আমল সম্পর্কে সচেতন করে তোলা ও তাদের সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করা। কিন্তু তা না করে শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে বিরূপ বা খারাপ উদ্দেশ্যজনিত মনোভাব পোষণ করা নিতান্তই গুণাহ্র কাজ হয়েছে।
            আর এ সম্পর্কে কোরআন শরীফে এরশাদ হয়েছে,
ان بعض الظن اثم.
অর্থঃ- নিশ্চয়ই অধিকাংশ ধারণাই ভুল।” (সূরা হুজরাত/১২)
            আরো উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রাসূল হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বড় আলেম হওয়াই অধিকতর খুশীর বিষয়। যেমন কোরআনে কারীমায় আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান,
قل هل يستوى الذين يعلمون والذين لا يعلمون.
অর্থঃ- হে হাবীব আপনি বলুন, যে জানে আর যে জানেনা তারা কি কখনো সমান?” (সূরা যুমার/৯)
            উল্লেখ্য এই আয়াত শরীফের তাফসীরে বড় আলেমদের প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এছাড়া কোরআন শরীফের অন্য বহু আয়াত শরীফের শেষে আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান,
لقد كان لكم فى قصصهم عبرة للاولى الالباب.
অর্থঃ- জ্ঞানীগণের জন্য এ ঘটনায় রয়েছে, বিশেষ নছীহত।” (সূরা ইউসুফ/১১১)
            এবং এরূপ জ্ঞানীর সংখ্যা অল্প হলেও তাঁদেরকেই আল্লাহ্ পাক বেশী পছন্দ করেন। যেমন আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান,

وقليل من عبادى الشكور.
অর্থঃ- আর অল্প সংখ্যক বান্দারাই আল্লাহ্ পাক-এর শোকর গুজারী করে।” (সূরা সাবা/১৩)
            আর তাঁদের সংখ্যা কম হলেও তাঁদের দ্বারাই কাজ হয় এবং দ্বীন বিজয়ী হয়। আল্লাহ্ পাক এরশাদ ফরমান,
كم من فئة قليلة غلبت فئة كشيرة باذن الله.
অর্থঃ- নিশ্চয়ই বহু ক্ষেত্রে কম সংখ্যক লোক বেশী সংখ্যক লোকের উপর কামিয়াব হয়েছে।” (সূরা বাক্বারা/২৪৯)
            অপরদিকে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
فقيه واحد اشد على الشيطان من الف عابد.
অর্থঃ- শয়তানের মোকাবিলায় একজন ফক্বীহ্ এক হাজার আবেদের চেয়েও ভয়ঙ্কর।” (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্, দারেমী, আহ্মদ, মেশকাত, উরফুশ্ শাজী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্)
            অন্য হাদীস শরীফে এসেছে,
من جاءه الموت وهو يطلب العلم لاحياء به الاسلام فبينه وبين النبيين درجة واحدة فى الجنة.
অর্থঃ- কেউ ইসলাম বুলন্দ করার জন্য ইল্ম তলব করতে করতে মারা গেল, তার মধ্যে আর নবীদের মধ্যে মাত্র এক দরজা পার্থক্য থাকবেঅর্থাৎ তাকে নুবুওওয়াত ব্যতীত সকল মর্যাদাই দেয়া হবে। (দারেমী, মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্)
            এছাড়া ইমাম-মুজ্তাহিদগণ, বিভিন্ন স্তরের লোকদের তাদের অবস্থা সাপেক্ষে ফরজে আইন ইল্ম হাছিল করার পরও উচ্চতর ইল্ম হাছিল করাকে ফরজে কেফায়া বলেছেন। বলাবাহুল্য সাধারণভাবে এগুলো মাদ্রাসায় শিক্ষা দেয়া হয়ে থাকে। অর্থাৎ মাদ্রাসার মাধ্যমে ইল্মে ফিক্বাহ্র সাধারণ সিলসিলা জারী রয়েছে। কিন্তু সে মাদ্রাসায় পড়ানো এবং পড়ার প্রতিও বিরূপ মনোভাব পোষণ করে, ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক প্রচলিত তাবলীগ বা মক্তবী কোর্সের প্রচলন করে এবং তাকেই হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রচারিত ইসলামের পরিপূর্ণ কাজ বলে অভিহিত করা এবং সেই সাথে এই মক্তবী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিকে স্বশরীরে একটি মাদ্রাসা বলে আখ্যা দেয়া চুড়ান্ত অজ্ঞতার কাজ। যা প্রকারন্তরে ইসলামের বুলন্দ দরওয়াজাকে ভূ-লুক্তিত করার প্রচেষ্টারও শামিল।
            এর সাথে আরো বলতে হয়, ছাত্রগণ ইল্মে দ্বীন শিক্ষা করে ডিস্পেনসারী দিবে, চাকুরী করবে বা মাদ্রাসায় পড়াবে এ কথার মধ্যে দোষের দায় কোথায়? ডিস্পেনসারী, ভাল চাকুরীর দ্বারা মানুষের উপকার তথা দ্বীনের কাজ হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ইলিয়াস সাহেবের মলফুযাতেই আছে যে, তিনি হাকীম বা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়েছেন। কাজেই মাদ্রাসা পাঠ শেষ করে যদি ইল্মদার লোকেরা এ কাজে জড়িত হয়, তাতে ইসলাম ও মুমিনের লাভ। নচেৎ কাফেরদের স্মরণাপন্ন হতে হলে মুমিনদেরই অসুবিধা কেননা শরীয়তে কাফের ডাক্তার বা হেকীমের সব রায় গ্রহণযোগ্য নয়। আর মাদ্রাসায় পড়ানোর দ্বারা ইল্মের প্রচার-প্রসার হয়।
            সুতরাং এসব কাজকে দোষযুক্ত করার প্রেক্ষিতে মাদ্রাসায় পড়ানো ও পড়াকে অবজ্ঞা করা সত্যিই অপরাধপূর্ণ ও গোমরাহী এবং জেহালতজনিত কাজের শামিল। তদুপরি কারো উদ্দেশ্য দ্বীনদারী নাও হতে পারে কিন্তু সকলের উদ্দেশ্যই যে গায়রুল্লাহ্জনিত হবে, এরূপ ধারণা করা অবশ্যই বড় গুণাহ্র কাজ। এজন্য মানুষের প্রতি সন্দেহ ও বদ্ ধারণা পোষণ করতে ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
            অতএব প্রমাণিত হয় যে, যেসব ধারণা বা ক্বিয়াস করে ইলিয়াস সাহেব মাদ্রাসায় পড়া ও পড়ানো হতে দূরে সরে গিয়ে ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক মক্তবী শিক্ষার প্রবর্তন করেছেন, যা মোট ইসলামী শিক্ষার ৫%ও নয়, সে ক্বিয়াস সম্পূর্ণই তার মনগড়া ও বাতিল ক্বিয়াস, যা মানুষকে গোমরাহ্ ও জেহালতের দিকেই ধাবিত করে।
            অপরদিকে পীর সাহেবের কাছ থেকে খেলাফত লাভের পর মুরীদকরণ ও তাদেরকে ইল্মে তাসাউফের যিকিরের তালীমের পর মুরীদদের পরিণতি সম্পর্কে ইলিয়াস সাহেব যে ধারণা ও মন্তব্য করেছেন, তা নিতান্ত অজ্ঞতাসূচক ও ওয়াসওয়াসামূলক। যাতে প্রতীয়মান হয় যে, ইলিয়াস সাহেব যেমন- ইল্মে ফিক্বাহ্র গুরুত্ব ও ফযীলত অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনিভাবে ইল্মে তাসাউফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কিত সহীহ্ সমঝ হাছিলেও ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ তিনি যদি ইল্মে ফিক্বাহ্র গুরুত্ব অনুধাবনে সামর্থ হতেন, তবে ইল্মে ফিক্বাহ্কে ফলপ্রসু করার জন্য ইল্মে তাসাউফের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করতেন। যেমনটি করেছেন- হযরত ইমাম মালেক (রঃ)। তিনি বলেন,
ومن جمع بينهما فقد تحقق.
অর্থঃ- যে ইল্মে জাহের ও বাতেন উভয়ই হাছিল করলো, সেই মুহাক্কিক্ক।” (মেরকাত শরীফ)
            উল্লেখ্য, ইলিয়াস সাহেব ইল্মে ফিক্বাহ্র শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে যেমন অযথা ওয়াসওয়াসামূলক বদ্ ধারণা পোষণ করেছেন, তেমনি ইল্মে তাসাউফ সম্পর্কেও তার এই ভুল ও গর্হিত ধারণা অতি মাত্রায় বেশী। কারণ তিনি ইল্মে তাসাউফের সফল শিক্ষার্থীকে অর্থাৎ ওলী আল্লাহ্গণকে চিহ্নিত করেছেন শুধু দোয়া-তাবিজের পাত্র হিসেবে। অথচ তাঁরা মহান আল্লাহ্ পাক-এর মহব্বত-মারিফতের পাত্র। যে মহব্বত-মারিফত হাছিলের যোগ্যতা ফেরেশ্তাগণেরও নেই এবং তাঁদের উছীলায় মানুষের দিল ইছলাহ্ হয়। প্রসঙ্গত ইলিয়াস সাহেব মাদ্রাসায় পাঠান্তে তার কল্পিত যে অগ্রহনীয় কার্যকলাপ আশঙ্কা করেছেন, তার পুরোটাই দূরীভূত হয়, মানুষ আল্লাহ্ ওয়ালা হয়, ইল্মে ফিক্বাহ্র পূর্ণ সফলতা ও সমন্বয় হাছিল হয়, দ্বীনের আসল বুঝ পয়দা হয়, শয়তান পরাস্ত হয়, বাতিল মাথা নত হয়, ইসলাম বিরোধী শক্তি অপসৃত হয়, ইসলাম পূনরুজ্জীবিত হয় এবং সাথে সাথে তাঁদের উছীলায় আল্লাহ্ পাক তাঁর কায়েনাত পরিচালনা করেন ও সমস্ত রহ্মত, বরকত নাযিল করেন, শুধুমাত্র এই ওলী আল্লাহ্গণের উছীলায়। আর সে সম্পর্কে ইলিয়াস সাহেবের সহীহ্ সমঝ অর্জিত হয়নি বললেই চলে। যদিও তিনি পীর সাহেবের খলীফা অর্থাৎ ইল্মে তাসাউফের লোক বলেই দাবী করেছেন।
            উল্লেখ্য, ইল্মে ফিক্বাহ্র ক্ষেত্রেও যেমন ফরজ পরিমাণ ইল্ম সম্পন্ন লোক, মক্তবী শিক্ষা সম্পন্ন লোক এবং বড় আলেম ইত্যাদি বিভিন্ন স্তরের লোক রয়েছেন, ইল্মে তাসাউফের ক্ষেত্রেও তদ্রুপ। আর ইল্মে ফিক্বাহ্র ন্যায়, ইল্মে তাসাউফের ক্ষেত্রেও সাধারণতঃ যারা নিম্ন স্তরের তাদের দ্বারাই সমাজে ভুল মত-পথ ও সিলসিলার প্রচলন ঘটে। যেমন হযরত হুসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ (রঃ)। গাউসুল আযম, বড় পীর, দস্তগীর, হযরত আব্দুল কাদির জ্বিলানী (রঃ) ও আফজালুল আওলিয়া, কাইউমে আউয়াল, হযরত মুজাদ্দিদ আল্ফে সানী (রঃ) তাঁকে তাসাউফের শিশু বলে আখ্যা দিয়েছেন। যদিও হযরত হুসাইন বিন মনসুর হাল্লাজ (রঃ)-এরও অনেক মুরীদ-মোতাক্বিদ ছিল এবং তাঁর দ্বারা বহু কারামতও প্রকাশ পেয়েছিল।
            কাজেই বুঝা যায়, পীর সাহেবের কাছে খেলাফত লাভ করলেও ইলিয়াস সাহেবের কথা ইল্মে তাসাউফের তথা কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের সম্পূর্ণই খেলাফ হয়েছে। সেই সাথে ৬ (ছয়) উছূলী তাবলীগ করলেই প্রত্যেকে একজন করে ভ্রাম্যমান মাদ্রাসার ন্যায় ভ্রাম্যমান খানকায়ে পরিণত হয়ে যাবে, তাও শরীয়তসম্মত নয়। কারণ ৬ (ছয়) উছূলী তাবলীগে ইল্মে ফিক্বাহেরই যৎসামান্য রয়েছে, আর ইল্মে তাসাউফ তো পুরোটাই বাদ। সুতরাং ইল্মে তাসাউফ একটুও শিক্ষা না করে তাসাউফে পারদর্শী বলে সার্টিফিকেট দেয়া নিতান্তই গোমরাহীমূলক, সত্যের অপলাপ ও জেহালতপূর্ণ।
            মূলতঃ ইলিয়াস সাহেবের এই মলফুযাত অবলম্বনে একদিকে যেমন প্রতীয়মান হয় যে, তিনি মাদ্রাসা ও খানকাহ্ সম্পর্কে উপরোক্ত অমূলক ও অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক মক্তবী মানের প্রচলিত তাবলীগকেই পরিপূর্ণ ও একমাত্র রাস্তা হিসেবে প্রবর্তন করেছেন, তেমনি অপরদিকে সঙ্গত কারণেই আরো প্রতীয়মান হয় যে, মাদ্রাসা ও খানকাহ্ সম্পর্কে তার উপরোক্ত ধারণা ও ক্বিয়াস পুরোটাই অশুদ্ধ, বিভ্রান্তিকর, গোমরাহীমূলক ও স্পষ্টতঃ শয়তানী ওয়াসওয়াসায় পরিচালিত। আর ইলিয়াস সাহেব তার মলফুযাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শয়তান মানুষকে প্রায়ই ইসলামের জরুরী কাজ ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভেতরেই মশগুল করে দেয়।এই কথার প্রেক্ষিতে যে ওয়াসওয়াসার বিবরণ দিয়েছেন, তার চেয়েও নিম্নস্তরের প্রবল ওয়াসওয়াসায় তিনি নিজেই পতিত হয়েছেন। তাই তিনি মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রূপায়িত ইসলাম এবং অনুসরণীয় সকল ইমাম, মুজ্তাহিদ ও আওলিয়া-ই-কিরামগণের মত-পথ তথা ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাসাউফকে বাদ দিয়ে মনগড়া, ভ্রান্ত আক্বীদাযুক্ত এবং অনেকাংশে গোমরাহী ও বিদ্য়াত মিশ্রিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রচলন করেছেন, যা মান হিসেবে মোট ইসলামী শিক্ষার ৫%ও নয় (যদি আক্বীদা শুদ্ধ থাকে)। আর এটাকেই একমাত্র নাযাতের পথ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি নিজেও যেমন শয়তানের ওয়াসওয়াসায় প্রতারিত হয়েছেন, তেমনি লক্ষ লক্ষ সাধারণ মুসলমানকে প্রতারিত করেছেন এবং সে প্রতারণার সিলসিলার পত্তন ঘটিয়েছেন। মূলতঃ এভাবে এ সিলসিলার দ্বারা যত লোক ইসলামের পরিপূর্ণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে, তার দায় ইলিয়াস সাহেবকেই বহন করতে হবে। কারণ এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
عن جرير قال- قال النبى صلى الله عليه وسلم. من سن فى الاسلام سنة حسنة فله اجرها واجرمن عمل بها من بعده ... ومن سن فى الاسلام سنة سيئة كان عليها وزرها ووزر من عمل بها من بعده. (رواه مسلم)
অর্থঃ- হযরত জরীর বিন আব্দুল্লাহ্ বাজালী (রাঃ) হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে কেউ ইসলামে কোন উত্তম পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে (যা শরীয়তসম্মত), তার জন্যে সে সাওয়াব পাবে এবং তারপর যারা এ পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তার সওয়াবও সে পাবে। ....... আবার যে কেউ দ্বীন ইসলামে কোন শরীয়ত বিরোধী পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে, তার গুণাহ্ সে পাবে এবং তার পরে যারা এ পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তাদের গুণাহ্ও তার আমলনামায় দেয়া হবে।” (মুসলিম, মেশকাত, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ)
            অতএব, সমঝদার সকলের উচিত ইলিয়াস সাহেবের মত প্রতারিত না হওয়া এবং মাদ্রাসা ও খানকাহ্ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব না রাখা। বরং ইল্মে ফিক্বাহ্ ও ইল্মে তাসাউফ উভয়টাই পূর্ণ হাছিল করা।
( অসমাপ্ত 

0 Comments: