শরীয়তের উসূল কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস

Image result for শরীয়তের উসূল কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসশরীয়তের উসূল কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস

শরীয়তের কোন বিষয়ের মীমাংসা বা ফায়সালা করতে হলে তা কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতেই করতে হবে, এর বাইরে কোন কথা বা কাজ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, শরীয়তের ভিত্তি বা দলীলই হলো উপরোক্ত চারটি। এ প্রসঙ্গে উসূলের কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে,
“মূলতঃ শরীয়তের ভিত্তি হলো তিনটি। কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা এবং চতুর্থ হলো- ক্বিয়াস।” (নুরুল আনোয়ার)
(৪) ক্বিয়াসঃ
-----------
(ধারাবাহিক)
ক্বিয়াসের প্রকারভেদ
--------------------
ক্বিয়াস দু’প্রকার- (১) হক্ব ক্বিয়াস, (২) বাতিল ক্বিয়াস।
হক্ব ক্বিয়াসের সংজ্ঞাঃ- মুজতাহিদ ক্বিয়াস করার সময় যদি কুরআন শরীফ ও সুন্নাহ্ শরীফ অনুযায়ী ক্বিয়াস করেন, তাহলে তাকে হক্ব ক্বিয়াস বলে।

উদাহরণ
--------
(১) আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেছেন,
حرمت عليكم امها تكم وبناتكم.........
অর্থঃ- “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, তোমাদের মাতা ও কন্যাদেরকে।”
(সূরা নিসা/২৩)
এখান امهات শব্দের দ্বারা মাতাকে বিবাহ করা হারাম বুঝায়। শরীয়তে নানী, দাদী বা নাতনীকে বিবাহ করা হারাম, কিন্তু কুরআন শরীফ বা হাদীস শরীফ-এর কোথাও নানী, দাদী বা নাতনীকে বিবাহ করা হারাম তার প্রকাশ্য কোন এবারত নেই। সুতরাং যারা ক্বিয়াসকে অস্বীকার করে বা কুরআন শরীফ-হাদীস শরীফ ব্যতীত অন্য কোন ইজতিহাদী কওল গ্রহণ করতে নারাজ, তারা এ ব্যাপারে কি মত গ্রহণ করবেন? ক্বিয়াস অস্বীকার করে নানী, দাদী ও নাতনীকে বিবাহ করবেন? নাকি ক্বিয়াস স্বীকার করে হারাম হতে নিজকে রক্ষা করবেন?
উক্ত আয়াতের امهات শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত, তাই মুজতাহিদ তথা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইমামগণ মাতার সাথে ক্বিয়াস করে উর্দ্ধতণ যত নারী আছে যেমন নানী, দাদী তার মা, তার মা প্রমুখ এবং بناتكم দিয়ে মেয়ে, তার মেয়ে (নাতনী) তার মেয়ে (প্রো নাতনী) প্রমূখ সকলকেই বিবাহ করা হারাম সাব্যস্ত করেছেন। যারা মাযহাব মানেন না, তারা নিশ্চয়ই এই রায় মেনে নিয়ে মাযহাবী হয়ে আছেন, কেননা এটা হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী চার মাযহাবেরই রায়। তাই এখন যদি কেউ ক্বিয়াসকে অস্বীকার করেন ও মাযহাবের বিরুদ্ধে মত পোষণ করেন, তা হঠকারিতা বৈ আর কিছুই নয়।
(২) সাইয়্যিদুল মুরসালিন, ইমামুল মুরসালিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ ফরমান,
عن ابى سعيد خدرى رضى الله عنه قال قال
رسول الله صلى الله عليه وسلم الذهب بالذهب
والفضة بالفضة والبربالبر والشعير بالشعير والتدر
بالتمر وااملح بامللح مثلا بثل بدا بيد فمن زاد
او استزاد فقد اربى الاخذ والمعطى فيه مواء
অর্থঃ- হযরত আবু সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “স্বর্ণ স্বর্ণের বিণিময়ে, রূপা রূপার বিণিময়ে, গম গমের বিণিময়ে, যব যবের বিণিময়ে, খুরমা খুরমার বিণিময়ে এবং লবন লবনের বিণিময়ে লেনদেন করা হলে সমান সমান, নগদ, হাতে হতে হবে। অতঃএব যে ব্যক্তি বেশী দিবে বা বেশী গ্রহণ করবে, সে সুদ গ্রহণকারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে। আর এক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহিতা উভয়ই সমান গুণাহগার হবে।”
কোন কোন রেওয়ায়েতে كيلابكيل ও وزنابوزن শব্দটি উল্লেখ আছে, কায়েলের (টুকরির) পরিবর্তে কায়েল ও ওজনের (kg-এর মাপ) পরিবর্তে ওজন। যে জিনিস টুকরির মাপে ক্রয় বিক্রয় হয়, (কিছু কাল আগে অবশ্য এভাবেই হতো) যথা- গম ইত্যাদি সেখানে এবং যে জিনিস ওজনে বিক্রয় হয়, যথা- সোনা চান্দি সেখানে সমপরিমাণ একই সময় লেনদেন হতে হবে, অন্যথায় সুদ হবে।
যারা ক্বিয়াস অস্বীকার করে থাকে তারা চাউল, তিল, ডাল যা এখনও গ্রামে চালু রয়েছে, এটার মীমাংসা কিভাবে করবেন? কেউ যদি এক কেজি ভাল চাউল দিয়ে দুই কেজি খারাপ চাউল ক্রয় করে, তাহলে কিভাবে মীমাংসা করবেন? হাদীস শরীফে তো চাউলের কথা উল্লেখ নেই। মাযহাব অস্বীকারকারীগণ আপনারা এক্ষেত্রে ক্বিয়াস অমান্য করে সুদ খেয়ে কি জিন্দেগী বরবাদ করবেন, না ক্বিয়াস স্বীকার করে হারাম হতে নিজকে রক্ষা করবেন?

এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে,
عن ابى سعيد و ابى هريرة رضى الله عنهما ان
رسول الله صلى الله عليه وسلم استمل رجلا
على خيبر وجا بتمر جنيب فقال اكل ترخيبر
هكذا قال لا والله يا ر سول الله انا لنا خذ الصاع
من هذا بالصاعين والصا عين بالثلاث فقال لا تفعل
بع اجلمع بالدراهم ثم ا بتع بالد راهم جنيبا و قال
فى الميزان مثل ذلك.
অর্থঃ- হযরত আবু সাঈদ খুদরী ও হযরত আবু হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে- রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে খায়বরে চাকরি দিয়েছিলেন। ঐ ব্যক্তি ওখান থেকে ভাল খুর্মা নিয়ে আসল, রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “খায়বরের সকল খুর্মাই কি এরূপ?” ঐ ব্যক্তি বললেন- না। হে আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, আমরা এক ছা দিয়ে দু’ ছা এবং দু’ ছা দিয়ে তিন ছা খুর্মা গ্রহণ করে থাকি। রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “এরূপ বিণিময় করো না, বরং খারাপ খুর্মা মুদ্রায় বিক্রি করে ওটা দ্বারা ভালো খুর্মা ক্রয় কর।” রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটাও বললেন, “বাটখারা দিয়ে যেসমস্ত জিনিস ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তা সম্পর্কেও একই হুকুম কার্যকর হবে।”
তাই হাদীস শরীফে বর্ণিত ছয় প্রকার জিনিসসহ অন্য যে কোন জিনিসেরও একই হুকুম হবে। অর্থাৎ قدر ও جنس (পরিমাণ ও জাত) যদি এক হয়, আর ওটা একই সময় ও হাতে হাতে না হয় তাহলে সুদ হবে, এটারই নাম ক্বিয়াস।
বাতিল ক্বিয়াসের সংজ্ঞাঃ------------------------
বাতিল ক্বিয়াস হলো- ক্বিয়াসকারী যদি মনগড়াভাবে কুরআন শরীফ-হাদীস শরীফ-এর খেলাফ কোন ক্বিয়াস করে, তা বাতিল ক্বিয়াস হিসাবে পরিগণিত হবে।
সাইয়্যিদুল মুরসালিন, ইমামুল মুরসালিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ-এর (তাফসীরে) স্বীয় রায় অনুযায়ী কথা বলে, সে তার অবস্থানকে যেন দোযখে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরতিযী শরীফ)
অন্য হাদীস শরীফে আছে, “যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ-এর (তাফসীরে) স্বীয় মতানুযায়ী কথা বলে, সে সত্যে উপনীত হলেও ভুল করলো।” (তিরমিযী, আবু দাউদ শরীফ)
উদাহরণ
----------
(১) কিছু সংখ্যক লোক বলে থাকে যে, মোস্তাহাব আমলের ভিতরে বিদয়াত প্রবেশ করলে মোস্তাহাব আমলকে ছেড়ে দিতে হবে, এটাও বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত। এর “দলীল হলো আশুরার রোজা।” প্রথমতঃ আশুরার রোজা ১০ই মুহররম একটি রাখার নিয়ম ছিল, কিন্তু যখন হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ বললেন যে, ইহুদীরাও ১০ই মুহররম একটি রোজা রেখে থাকে, তখন সাইয়্যিদুল মুরসালিন, ইমামুল মুরসালিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
صوموا يوم عاشورأ وخالفوا فيه اليهود
وصوموا قبله يوما وبعدء يوما.
অর্থঃ- “তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ এবং তার পূর্বে একদিন বা পরে একদিন রোজা রেখে ইয়াহুদীদের খিলাফ কর।”
এখানে বিদয়াত তো দূরের কথা, তাশাব্বুহ বা হারাম হওয়া সত্বেও সাইয়্যিদুল মুরসালিন, ইমামুল মুরসালিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশুরার রোজাকে বাদ দিলেন না বরং মূল আমলকে ঠিক রেখে তা তাশাব্বুহ দূর করে দিলেন, আরেকটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে। সুতরাং উক্ত মত পোষণকারীদের ক্বিয়াস দলীল বহির্ভূত এবং বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত।
(২) খারেজীদের মত হচ্ছে- আল্লাহ্ পাক কুরআনুল করীমে বলেছেন,
ان الحكم الا لله
অর্থঃ- “হুকুম হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর।”
উক্ত আয়াত শরীফ-এর মর্ম অনুযায়ী খারেজীরা বলে যে, একমাত্র আল্লাহ্ পাক-এর হুকুম ব্যতীত কারো হুকুম, কথা, মত গ্রহণযোগ্য নয়। খারেজীদের এরূপ মন্তব্য সম্পূর্ণই অবান্তর ও কুরআন শরীফ-হাদীস শরীফ-এর বিপরীত। কেননা আল্লাহ্ পাক বলেন,
وما اتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا.
অর্থঃ- “রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে হুকুম করেন, তোমরা তা গ্রহণ কর। আর যা হতে নিষেধ করেন, তা হতে বিরত থাকো।”
সাইয়্যিদুল মুরসালিন, ইমামুল মুরসালিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত উম্মতের মধ্যে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, ইমাম মুজতাহিদগণের রায়ও যে গ্রহণযোগ্য, তার প্রমাণ হলো মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে বলেন-
اطيعوا الله واطيعو الرسول و اولى الامر منكم.
অর্থঃ- “তোমরা অনুগত্য কর আল্লাহ্ পাক-এর। অনুসরণ কর, তাঁর রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর। আর অনুসরণ কর উলিল আমরগণেরও।”
এছাড়া সাইয়্যিদুল মুরসালিন, ইমামুল মুরসালিন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ইয়েমেন প্রেরণ এবং সেখানে স্বীয় হুকুম অনুযায়ী মুকাদ্দমা ফায়সালা করার অনুমতি ও উৎসাহ প্রদান অনুসারে খারেজীদের উক্ত ক্বিয়াস বাতিল ক্বিয়াস হিসেবে পরিগণিত হয়।” সুতরাং কুরআন শরীফ-সুন্নাহ্ শরীফ ভিত্তিক ক্বিয়াস শরীয়তে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং তা শরীয়তের অকাট্য দলীল। আর মনগড়া কুরআন শরীফ-সুন্নাহ্ শরীফ বিরোধী ক্বিয়াস শরীয়তে সম্পূর্ণই পরিত্যাজ্য এবং তা বাতিল ক্বিয়াস হিসাবে গণ্য।
কাজেই আমাদের কোন বিষয়ের শরঈ ফায়াসালা করতে হলে, প্রথমে কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফ-এর দ্বারাই তা করতে হবে। কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে যদি তার সুস্পষ্ট বিধান না পাওয়া যায়, তবে ইজমা ও ক্বিয়াসের দ্বারা তার ফায়সালা করতে হবে। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের দলীলের ভিত্তিই হলো উক্ত চারটি, এর বাইরে কোন কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। অতএব মনগড়া ক্বিয়াসের ভিত্তিতে কখনো তার মীমাংসা হতে পারে না, বরং ফিৎতা-ফাসাদ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
মহান আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ করেন,
الفتنة اشد من القتل.
অর্থঃ- “ফিৎনা কতলেন (হত্যার) চেয়েও কঠিন।”
মহান আল্লাহ্ পাক আমাদের সকলকে কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের পরিপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণ করার তৌফিক দান করুন এবং ফিৎনা-ফাসাদ থেকে হিফাজত করুন । আমীন ।


0 Comments: