হুযুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র জীবনী মুবারক । (পর্ব- ৯২৫-১০৬৯) (ঠ)


আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র মু’জিযা শরীফ বাঘের কথা বলা:
বাঘের কথা বলা প্রথম হিজরী সালের উল্লেখযোগ্য একটি পবিত্র মু’জিযা শরীফ। বর্ণিত আছে যে, পবিত্র মদীনা শরীফ উনার বাহিরে একটি বাঘ এসে একটি পাল ছাড়া বকরী ধরে নিয়ে যায়। রাখাল সেই বাঘের পশ্চাদ্ধাবন করে বকরী কেড়ে নিতে সমর্থ হয়। তখন বাঘটি ক্ষোভে বললো, মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাকে জীবিকা দিয়েছেন, আর তুমি কিনা তা কেড়ে নিতেছো? রাখাল বিস্ময়ে অবাক হয়ে বললো, আশ্চর্য যে বাঘও কথা বলে। বাঘটি বললো, ইহা কোনো বিস্ময়ের কথা নয়। বরং আশ্চর্যের কথা এই যে, পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে একজন বিশেষ ব্যক্তি মরুময় প্রান্তরে শীতল সুমিষ্ট খেজুর বাগানময় স্থানে তাশরীফ মুবারক নিয়েছেন যিনি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত সকল কথা বলে দিতে পারেন এবং দিয়ে থাকেন। অথচ আপনি এখনো উনাকে হক্ব বা সত্য বলে মেনে নেননি।
এই রাখাল ছিলো একজন ইহুদী। সে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট এসে বাঘের কথা বলার ঘটনা ব্যক্ত করলো। আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন ইহা ক্বিয়ামত বা মহা প্রলয়ের একটি নিদর্শন। (মাদারিজুন নুবুওয়াত)
অর্থাৎ আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে, আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বিষয়টি সেই বাঘ বলে দিলো যে, হে ইহুদী রাখাল তুমি যেমন আমার কথা বলায় আশ্চর্য বোধ করছো তার চেয়ে আশ্চর্য বোধক হচ্ছেন আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক আগমন।

পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা:
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে হিজরত মুবারক করলেন। অতঃপর যখন পবিত্র মুহররমুল হারাম শরীফ মাস আগমন করলো তখন তিনি দেখতে পেলেন ইহুদীরা পবিত্র আশূরা শরীফ উনার সম্মানার্থে পবিত্র মুহররমুল হারাম শরীফ মাস উনার ১০ তারিখে এই দিনে রোযা রাখছে- তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জিজ্ঞাসা করলেন: হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা কেন এই পবিত্র আশূরা উনার দিবসে রোযা রাখো? তখন তারা বললো, এই দিনে আমাদের যিনি নবী ও রসূল হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি যালিম ফেরআউনের অনিষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ফেরআউন এবং তার সঙ্গীসাথী কিবতী সৈন্যরা লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায়। মহান আল্লাহ পাক উনার এই নিয়ামত স্বরূপ হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি এই দিনে রোযা মুবারক রেখেছেন। তাই আমরা এই দিবসে রোযা রেখে থাকি। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি তো তোমাদের চেয়ে আমার বেশি নিকটবর্তী এবং এ বিষয়ে আমরাই সবচেয়ে বেশি হক্বদার। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ঘোষককে ডেকে নির্দেশ দিলেন যে, সকল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে বলে দিন সকলেই যেনো এই দিনে রোযা রাখে। তারপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজে রোযা রাখলেন এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে রোযা রাখতে বললেন।
পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা রাখার ব্যাপারে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আদেশ-নির্দেশ মুবারক করেছেন।
পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
عَنْ حضرت أَبِى هُرَيْرَةَ  رضى الله تعالى عنه  قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم  أَفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللَّهِ الْمُحَرَّمُ
অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন, পবিত্র রমাদ্বান শরীফ উনার রোযার পর মহান আল্লাহ পাক উনার মাস মুহররমুল হারাম শরীফ উনার রোযাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ রোযা। (পবিত্র মুসলিম শরীফ, পবিত্র তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো এসেছে-
عن حضرت عبد الله بن عباس رضى الله تعالى عنه، قال حين صام رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم عاشوراء وأمر بصيامه قالوا يا رسول الله إنه يوم يعظمه اليهود والنصارى؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فإذا لئن بقيت الى قابل لاصومن التاسع
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা উনার থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন মুবারকে রোযা রাখলেন এবং উহাতে রোযা রাখার জন্য নির্দেশ মুবারক দিলেন। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বললেন- ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এই দিনকে তো ইহুদী-নাছারারা সম্মান করে। তখন আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন- যদি আমি আগামী বছর পর্যন্ত যমীনে অবস্থান করি তবে অবশ্যই আমি ৯ তারিখেও রোযা রাখবো।” (পবিত্র মুসলিম শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ)
অর্থাৎ পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা দুটি রাখা খাছ সুন্নত; একটা করা মাকরূহ। ক্ষেত্রবিশেষে কুফরী। কারণ আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন-
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
অর্থ: “যে যেই সম্প্রদায়ের সাথে আমল আক্বীদার দিক দিয়ে মিল রাখবে, সে তাদের দলভুক্ত হবে।” অর্থাৎ তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে যাদেরকে সে অনুসরণ করেছে। (সূনানে আবূ দাউদ শরীফ, মুসনাদে বাযযার শরীফ)
কাজেই পবিত্র আশূরা শরীফ উপলক্ষে দুটি রোযা রাখা খাছ সুন্নত। তবে পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা ব্যতীত সমস্ত নফল রোযাই একটি রাখা জায়িয।
তাই ফিক্বাহবিদগণ পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা একটি রাখা মাকরূহ বলে মত পেশ করেছেন। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
صوموا يوم عاشوراء وخالفوا فيه اليهود وصوموا قبله يوما أو بعده يوما
অর্থ: “তোমরা পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা রাখো এবং ইহুদীদের বিপরীত করো।  সুতরাং পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযার আগের দিন অথবা পরের দিন একটি (মোট দুটি) রোযা রাখো।” (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি শরীফ, ইবনে খুযাইমা শরীফ)
সুতরাং পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযা রাখার নিয়ত কেউ যদি করে তবে তাকে ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখে মোট দুটি রোযা রাখতে হবে।
পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযার ফযীলত সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
من صام يوم عاشورا كتب الله له عبادة ستين سنة بصيام نهارها و قيام ليالها
অর্থ: “পবিত্র আশূরা শরীফ উনার দিন যদি কেউ রোযা রাখে তবে মহান আল্লাহ পাক তিনি তাকে ৬০ বৎসরের দিনের রোযা রাখা ও রাত্রের ইবাদত করার সাওয়াব দান করবেন।” সুবহানাল্লাহ!
আরো পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে-
عن حضرت أبي قتادة رحمة الله عليه قال أن النبي صلى الله عليه و سلم قال صيام يوم عاشوراء إني أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله
অর্থ: “হযরত কাদাদাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত তিনি বলেন নিশ্চয়ই আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন- কোনো ব্যক্তি যদি পবিত্র আশূরা উনার দিবসে রোযা রাখে, তবে মহান আল্লাহ পাক তিনি তার পূর্ববর্তী এক বৎসরের গুনাহখতা মাফ করে দিবেন।” সুবহানাল্লাহ! (আল মুয়াত্তা)
পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযার ইফতারীর ফযীলত সম্পর্কে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
من أفطر مؤمنا في يوم عاشوراء فكأنما أفطر عنده جميع أمة محمد صلى الله عليه و سلم
অর্থ: পবিত্র আশূরা শরীফ উনার রোযার দিন কোনো ব্যক্তি যদি অপর কোনো রোযাদার মু’মিন ব্যক্তিকে ইফতার করায়, তবে সে যেন সকল উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে ইফতার করালো। সুবহানাল্লাহ! (ফাদ্বাইলুল আওক্বাত, ফাওয়ায়িদুল হাদীছ আবী যরিল হারবী)
এখন হয়তো সবাই মনে করবেন যে, সবাই যদি সবাইকে দাওয়াত দেয় তবে তা কি করে সম্ভব হবে যে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দাওয়াত গ্রহণ করবেন। এটা এক প্রদ্ধতিতে সম্ভব। যেমন কোনো ব্যক্তি যদি ইফতারের দাওয়াত অন্য কোনো ব্যক্তিকে দেয় তবে দ্বিতীয় ব্যক্তি সাথে করে কিছু ইফতারী নিয়ে যাবেন এবং তা এক সাথে মিলিয়ে ইফতারী করবেন। তাতে দু’জনেই পূর্ণ ফযীলত পাবেন। অর্থাৎ একজন রোযাদার লোককে ইফতারী করানোর ফলে প্রত্যেকেই সমস্ত উম্মতী হাবীবীকে ইফতার করানোর ফযীলত পাবেন। সুবহানাল্লাহ!

সম্মানিত ক্বিবলা পরিবর্তন:
হিজরী দ্বিতীয় সনে ক্বিবলা পরিবর্তন হয়। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র হিজরত মুবারক করার পর ১৬ বা ১৭ মাস পর্যন্ত মুসলমানগণ উনারা পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ উনার দিকে মুখ করে নামায আদায় করেন। আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে অবস্থানকালীন পবিত্র কা’বা শরীফ ও পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ উনাদের উভয়কে সামনে রেখে নামায আদায় করতেন। পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে হিজরত মুবারক করার পর পবিত্র কা’বা শরীফ একদিকে ও পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ অন্যদিকে পড়ে যায়; তাই তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ উনার দিকে মুখ করে নামায আদায় করেন। তবে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি চাচ্ছিলেন যেন পবিত্র ক্বিবলা হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার ক্বিবলাই আমাদের ক্বিবলা হয়। অবশেষে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করে সম্মানিত ক্বিবলা উনাকে পরিবর্তন করে দিলেন,
قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاء فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنتُمْ فَوَلُّواْ وُجُوِهَكُمْ شَطْرَهُ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِن رَّبِّهِمْ وَمَا اللّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ.
অর্থ: “আমি লক্ষ্য করেছি আকাশের দিকে আপনার বারবার তাকানোর বিষয়টি। অতএব, আমি আপনার আকাঙ্খিত সম্মানিত ক্বিবলা উনার প্রতিই আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি, যা আপনি পছন্দ করেন। অতএব, আপনি পবিত্র মসজিদে হারাম শরীফ উনার দিকে মুখ মুবারক ফিরিয়ে নামায আদায় করুন। আপনারা যেখানেই থাকুন না কেন, উহার দিকে মুখ ফিরান এবং যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারাও নিশ্চিতভাবে জানে যে, ইহা তাদের রব মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে প্রেরিত হক্ব বা সত্য। তারা যা কিছু করে সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি অবহিত।” (পবিত্র সূর াবাকারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪৪)
মাওয়াহিব ও সাবীলুর রাশাদ’ নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত বারা ইবনে মারূর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বিছাল শরীফ গ্রহণের পর উনার বাড়িতে তাশরীফ মুবারক নেন। হযরত বারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পুত্রের নাম ছিলো হযরত বাশার রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। উনার মাতা তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য খাবার প্রস্তুত করতে শুরু করলেন। ইত্যবসরে পবিত্র যুহর নামায উনার সময় হলো। উপস্থিত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে নিয়ে তিনি পবিত্র যুহর উনার নামায পড়া শুরু করলেন। দু’রাকায়াত নামায শেষ হতেই হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি ওহী মুবারক নিয়ে এলেন যে, এখন বাইতুল্লাহ শরীফ পবিত্র ক্বিবলা। আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ জামায়াতসহ পবিত্র কা’বা শরীফ উনার দিকে চেহারা বা মুখ মুবারক ফিরিয়ে অবশিষ্ট দু’রাকায়াত নামায আদায় করলেন। তখন থেকে বনী সালমার ওই মসজিদকে যুলক্বিবলাতাইন বা দু’কিবলা বিশিষ্ট বলা হয়।
মূলত, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ওই মসজিদে পবিত্র যুহর নামায উনার দু’রাকায়াত পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফ উনার দিকে এবং অবশিষ্ট দু’রাকায়াত পবিত্র মসজিদুল হারাম শরীফ উনার দিকে মুখ করে আদায় করেছেন। ওই নামাযে হযরত ইবাদ বিন বাশার রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি শরীক ছিলেন। পবিত্র নামায শেষে তিনি গৃহে গমনের পর একস্থানে দেখতে পেলেন যে, বনী হারিছার লোকেরা পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ উনার দিকে মুখ করে আছর উনার নামায আদায় করছেন।
তিনি তখন চিৎকার করে বললেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আমি পবিত্র যুহর উনার নামায আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সঙ্গে পবিত্র কা’বা শরীফ মুখী হয়ে আদায় করেছি। উনার কথা শুনে সমস্ত নামাযীগণ! তৎক্ষনাৎ পবিত্র বাইতুল্লাহ শরীফ উনার দিকে পবিত্র চেহারা বা মুখ মুবারক ফিরালেন।
হযরত বারা ইবনে আজিব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে ‘পবিত্র ছহীহ বুখারী শরীফ’  উনার মধ্যে উল্লেখ রয়েছে- পরিবর্তিত ক্বিবলা উনার প্রথম নামায ছিলো আছরের নামায। অন্যান্য বর্ণনায় এসেছে পবিত্র যুহর উনার নামায। (তাফসীরে মাযহারী শরীফ)
কু’বা এলাকায় মুসলমান উনাদের নিকট ক্বিবলা পরিবর্তনের সংবাদ পৌঁছেছিলো পরদিন পবিত্র ফজর উনার সময়। ‘পবিত্র বুখারী শরীফ ও পবিত্র মুসলিম শরীফ’ উনাদের মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত হয়েছে, পবিত্র কু’বা বাসীগণ পবিত্র ফজর নামায আদায় করছিলেন, এমন সময় একজন ব্যক্তি এসে জানালেন যে, পবিত্র ক্বিবলা পরিবর্তন হয়েছে। এখন থেকে ক্বিবলা পবিত্র বাইতুল্লাহ শরীফ। একথা শুনে সমস্ত নামাযীগণ তৎক্ষণাৎ বাইতুল্লাহ শরীফ উনার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেলেন। হযরত রাফে বিন খাদিজ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেছেন যে- আমরা বনী আব্দুল আসহাল গোত্রের মসজিদে নামায আদায় করছিলাম। এক ব্যক্তি এসে চিৎকার করে জানিয়ে দিলেন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি এখন থেকে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পবিত্র কা’বা শরীফ মুখী হয়ে নামায আদায়ের জন্য বলেছেন; সঙ্গে সঙ্গে আমাদের যিনি ইমাম তিনি ক্বিবলা পরিবর্তন করলেন। আমরাও ক্বিবলা পরিবর্তন করলাম। সুবহানাল্লাহ! (তাফসীরে মাযহারী শরীফ)
অত্র  পবিত্র আয়াত শরীফখানা সম্মানিত ক্বিবলা পরিবর্তন উনার প্রারম্ভিকা। আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে পবিত্র ১২ই রবীউল আউওয়াল শরীফ পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে হিজরত মুবারক করেন। আর সম্মানিত ক্বিবলা পরিবর্তন হয় পবিত্র হিজরত মুবারক উনার দ্বিতীয় বর্ষ ১৫ই রজবুল হারাম শরীফ উনার মধ্যে। এ সম্পর্কে একাধিক মত উল্লেখ রয়েছে। কাজেই বিশুদ্ধ মতানুযায়ী সম্মানিত ক্বিবলা পরিবর্তন হয় পবিত্র হিজরত মুবারক উনার ১৬ মাস (অথবা যারা ১৭ মাস বলেন উনারা মাসের খ- অংশকে পুরো মাস ধরে নিয়েছেন) পর।
উল্লেখ্য যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ উনার দিকে চেহারা মুবারক করে নামায আদায় করছিলেন তখন ইহুদীরা বলা-বলি করছিলো যে ইনি কেমন রসূল যিনি আমাদের ধর্মের বিপরীত চলেন কিন্তু আমাদের ক্বিবলাকে অনুসরণ করছেন। এতে ইহুদীরা চু-চেরা ক্বীল-ক্বাল করে যাচ্ছিলো। যখন সম্মানিত ক্বিবলা পরিবর্তন হয়ে গেলো তখন পুনরায় বলতে লাগলো, ইনি কেমন রসূল যিনি একবার এক ক্বিবলা আরেকবার অন্য ক্বিবলাকে অনুসরণ করেন। নাউযুবিল্লাহ!
মূলত, ইহুদীরা ছিলো দুষ্ট প্রকৃতির। তারা হচ্ছে চির লা’নতপ্রাপ্ত কাওম বা সম্প্রদায়। এজন্য তারা এরূপ বানোয়াটি, অপপ্রচারণা, দুষ্টামি করতো। মহান আল্লাহ পাক তিনি তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা করেছেন,
  لتجدن أشد الناس عداوة للذين آمنوا اليهود والذين أشركوا
অর্থ: “অবশ্যই তোমরা পাবে তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসাবে ইহুদী এরপর যারা মুশরিক তাদেরকে।”
অর্থাৎ আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এবং উনার যারা উম্মত তথা মুসলমান উনাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে ইহুদী অতপর মুশরিক তারা এরপর অন্যান্য বিধর্মীরা।
কাজেই ইহুদী ও মুশরিকরা সদা সর্বদাই আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র পাকাতো, ফন্দি-ফিকির করতো। নাউযুবিল্লাহ! সম্মানিত ক্বিবলা উনার ব্যাপারে তারা সেই চু-চেরা ক্বীল-ক্বাল ও দুষ্টামি করেছিলো। কাজেই সমস্ত ইহুদী, মুশরিক, খ্রিস্টান, হিন্দু বৌদ্ধ তথা সমস্ত বিধর্মীদেরকে শত্রু মনে করা মুসলমান উনাদের জন্য ফরয। যেমন ইবলিস শয়তান মুসলমান উনাদের প্রকাশ্য শত্রু। অনুরূপভাবে ইহুদী-নাছারা, কাফির-মুশরিক, বেদ¦ীন-বদদ্বীন এবং তাদের অনুসারী ওহাবী, খারিজী, রাফেজী, শিয়া, মুতাজিলা, জামাতী, প্রচলিত তবলীগী ইত্যাদি ফিরকাগুলো সম্মানিত মুসলমান উনাদের প্রকাশ্য শত্রু। এদের প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে জানতে হবে এবং এদের প্রতিহত করতে হবে।
মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সকলকে সমস্ত ইহুদী-নাছারা, কাফির-মুশরিক, বেদীন-বদদ্বীন তাদের চক্রান্ত থেকে হিফাযত করুন। (আমীন)
স্মরণীয় যে, সম্মানিত শরীয়ত উনার মধ্যে ৫ প্রকার ক্বিবলা রয়েছে। (১) সকল ক্বিবলা উনার বিলীনকারী ক্বিবলা হচ্ছেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি। (২) সকল কায়িনাতের ক্বিবলা হচ্ছেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। তাই উনাকে ক্বিবলা বা কা’বা বলা হয়। (৩) পবিত্র নামায উনার ক্বিবলা হচ্ছে, পবিত্র কা’বা শরীফ। (৪) দোয়া বা মুনাজাতের ক্বিবলা হচ্ছে, আসমান। (৫) পবিত্র ক্বলব উনার ক্বিবলা হচ্ছেন, মুর্শিদ বা পীর ছাহেব। একারণেই পীর ছাহেব বা মুর্শিদ উনাকে ‘ক্বিবলা’ বলা হয়ে থাকে। তবে এখানে ‘ক্বিবলা’ বলতে পবিত্র নামায উনার ক্বিবলা উদ্দেশ্য।
উল্লেখ্য যে, যখন সম্মানিত ক্বিবলা পরিবর্তন হলো তখন যারা ইহুদী ও মুনাফিক তারা চু- চেরা ক্বীল-ক্বাল শুরু করলো। তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করেন-
سَيَقُولُ السُّفَهَاء مِنَ النَّاسِ مَا وَلاَّهُمْ عَن قِبْلَتِهِمُ الَّتِي كَانُواْ عَلَيْهَا قُل لِّلّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ يَهْدِي مَن يَشَاء إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ - وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِّتَكُونُواْ شُهَدَاء عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنتَ عَلَيْهَا إِلاَّ لِنَعْلَمَ مَن يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّن يَنقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ وَإِن كَانَتْ لَكَبِيرَةً إِلاَّ عَلَى الَّذِينَ هَدَى اللّهُ وَمَا كَانَ اللّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ إِنَّ اللّهَ بِالنَّاسِ لَرَؤُوفٌ رَّحِيمٌ
অর্থ: নির্বোধ লোকেরা অচিরেই বলবে যে, উনারা এযাবৎ যে ক্বিবলা অনুসরণ করছিলেন তা হতে কিসে উনাদেরকে ফিরিয়ে দিলো? (হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলে দিন- পূর্ব ও পশ্চিম মহান আল্লাহ পাক উনারই। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন। এইভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি। যাতে তোমরা পূর্ববর্তী মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হতে পার এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তোমাদের জন্য হবেন সাক্ষীস্বরূপ। আপনি এতদিন যে ক্বিবলা উনার অনুসরণ করেছেন তাকে এ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছি যাতে আমি জানতে পারি কে আমার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসরণ করে এবং কে ফিরে যায়? মহান আল্লাহ পাক তিনি দয়া ইহসান করে যাকে সৎ পথে পরিচালিত করবেন তারা ব্যতীত অন্যান্যদের নিকট ইহা নিশ্চয়ই কঠিন। মহান আল্লাহ পাক তিনি এরূপ নন যে, তোমাদের পবিত্র ঈমান উনাকেকে বিনষ্ট করবেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সমস্ত মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ-১৪২, ১৪৩)
মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন সম্মানিত ক্বিবলা উনাকে পরিবর্তন করে দিলেন তখন আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদীদের মধ্যে কিছু নির্বোধ লোক তারা এই সম্মানিত ক্বিবলা পরিবর্তনের উপর আপত্তি আরোপ করে। নাউযুবিল্লাহ!
তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
سَيَقُولُ السُّفَهَاء مِنَ النَّاسِ مَا وَلاَّهُمْ عَن قِبْلَتِهِمُ الَّتِي كَانُواْ عَلَيْهَا قُل لِّلّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ يَهْدِي مَن يَشَاء إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ.
অর্থ: ‘নির্বোধ লোকেরা অচিরেই বলবে যে, উনারা এ যাবৎ যে ক্বিবলা অনুসরণ করছিলেন তা হতে কিসে উনাদেরকে ফিরিয়ে দিলো? (হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি বলে দিন- পূর্ব ও পশ্চিম মহান আল্লাহ পাক উনারই, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকেই সরল সঠিক পথে পরিচালিত করেন।’ 
অত্র পবিত্র আয়াত শরীফখানা নাযিল করে মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ঘোষণা মুবারক করে দেন- পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক তিনিই মহান আল্লাহ পাক যিনি এই সম্মানিত কিবলা উনাকে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। কাজেই আহলে কিতাব তথা ইহুদী-নাছারাদের উচিত ছিলো মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশ পালনার্থে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান এনে সম্মানিত ক্বিবলা উনাকে গ্রহণ করা।
মূলত এখানে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শারে’ শরীয়ত প্রণেতা- তিনি যমীনে তাশরীফ মুবারক আনার পর থেকে পবিত্র বিছাল শরীফ মুবারক পর্যন্ত যা কিছু করেছেন তা উম্মতের জন্য অনুসরণ অনুকরণ করা ফরয। যা মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার দ্বারা ছাবিত করেছেন।
এরপর মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
  وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِّتَكُونُواْ شُهَدَاء عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا
অর্থ: ‘এইভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি যাতে তোমরা পূর্ববর্তী মানবজাতির জন্য সাক্ষী স্বরূপ হতে পার এবং আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তোমাদের জন্য হবেন সাক্ষীস্বরূপ।’
অর্থাৎ যেভাবে আমি পবিত্র নামায উনার জন্য উত্তম ক্বিবলা নির্ধারণ করেছি এবং তোমাদেরকে তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম উনার ক্বিবলা উনার দিকে তোমাদেরকে চালিত করেছি, যিনি ছিলেন ‘আবুল আম্বিয়া’ তথা তৎপরবর্তী হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্মানিত পিতা, যে সম্মানিত ক্বিবলা উনার দিকে মুখ করে হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি এবং উনার পূর্ববর্তী হযরত নবী আলাইহিস সালামগণ উনারা নামায আদায় করতেন, ঠিক সেভাবেই আমি আপনাদেরকে সর্বোত্তম জাতি হিসেবে নির্ধারণ করেছি এবং সকল মাখলুকাতের মধ্যে সম্মান-ইজ্জতময় মর্যাদার অধিকারী করেছি এবং আপনাদের করেছি সৃষ্টিরমূল, নতুন পুরান সকলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদা সম্মানের অধিকারী করেছি। যাতে তোমরা ক্বিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষের উপর সাক্ষী হতে পারো, যখন তারা একত্রিত হবে তোমাদের নিকট এবং তারা তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্বের ঈঙ্গিত করতে পারে। যেমন পবিত্র ‘বুখারী শরীফ’ উনার মধ্যে রয়েছে,
عن حضرت أبي سعيد رضى الله تعالى عنه مرفوعا من استشهاد حضرت نوح عليه السلام بهذه الامة يوم القيامة وإذا استشهد بهم حضرت نوح عليه السلام مع تقدم زمانه فمن بعده بطريق الاولى والاخرى. ثم قال تعالى مبينا حكمته في حلول نقمته بمن شك وارتاب بهذه الواقعة. وحلول نعمته على من صدق وتابع هذه الكائنة.
অর্থ: হযরত আবূ সায়ীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে মারফু হিসেবে বর্ণিত হয়েছে যে, ক্বিয়ামতের দিন এ উম্মতের জন্য হযরত নূহ আলাইহিস সালাম  উনাসাক্ষীরূপে হাযির করা হবে। আর সময়ের দিক থেকে অনেক আগের হওয়া সত্ত্বেও যদি হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনাকে উম্মতে হাবীবী উনাদের জন্য সাক্ষীরূপে পেশ করা হয়, তাহলে পরবর্তীদেরকে তো অতি উত্তমরূপেই পেশ করা হবে। এরপর ক্বিবলা পরিবর্তন এর ঘটনাতে যারা সন্দেহ পোষণকারী তার প্রতি শাস্তিÍ আপতিত হওয়া এবং এ ঘটনাকে যারা সত্য বলে মেনে নেয় ও কায়েনাতবাসী যাঁরাই এর অনুসরণ করে, তাদের প্রতি নিয়ামত বর্ষণ হওয়াই স্পষ্ট দলীল সম্মত।
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنتَ عَلَيْهَا إِلاَّ لِنَعْلَمَ مَن يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّن يَنقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ وَإِن كَانَتْ لَكَبِيرَةً.
অর্থ: ‘আপনি এতদিন যে ক্বিবলা উনার অনুসরণ করেছেন তাকে এ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছি যাতে আমি জানতে পারি কে আমার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসরণ করে এবং কে ফিরে যায়? মহান আল্লাহ পাক তিনি দয়া ইহসান করে যাকে সৎ পথে পরিচালিত করবেন তারা ব্যতীত অন্যান্যদের নিকট ইহা নিশ্চয়ই কঠিন।’
অর্থাৎ অতঃপর মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, প্রথম ক্বিবলা শুধুমাত্র পরীক্ষামূলক ছিলো। তথা প্রথমে বাইতুল মুকাদ্দাস শরীফ ক্বিবলা নির্ধারণ করে পরে পবিত্র কা’বা শরীফ উনাকে ক্বিবলারূপে নির্ধারণ করা শুধু এই জন্যই ছিলো যে, এর দ্বারা হক্ব সত্য অনুসরণকারী উনাদের পরিচয় পাওয়া যায়। এবং আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিচয় লাভ করা যায়। আর সম্মানিত ক্বিবলা উনার কারণে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম থেকে অনেকে ফিরে যায়। মূলত, এটা বাস্তবিকই কঠিন কাজ, কিন্তু যাঁদের অন্তরে ঈমানের নূর ছিলো অর্থাৎ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম  উনারা ছিলেন মূলত; হক্ব বা ছদিক্বীন তাই উনারা মহান আল্লাহ তিনি যা আদেশ নির্দেশ মুবারক করেন এবং উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে আদেশ-নির্দেশ মুবারক করেন তাই পালন করেন এবং উনার যে নির্দেশ মুবারক উঠিয়ে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তা উঠিয়ে নেন, বরং মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের প্রতিটি কাজ- খুবই সুন্দর ও নিপুণতায় পরিপূর্ণ। আর মু’মিন তথা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের জন্য এই নির্দেশ মুবারক পালন করা মোটেও কঠিন নয়। আর যাদের অন্তর রোগাক্রান্ত তাদের কাছে কোনো নতুন নির্দেশ মুবারক এলেই তা তাদের নতুন ব্যথা শুরু হয়। নাউযুবিল্লাহ!
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন,
وَمَا كَانَ اللّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ.
অর্থ: ‘মহান আল্লাহ পাক তিনি এরূপ নন যে, তোমাদের পবিত্র ঈমান উনাকেকে বিনষ্ট করবেন।’
অর্থাৎ তোমরা যে বায়তুল মুকাদ্দাস শরীফ উনাকে ক্বিবলা করে যেসব নামায-কালাম আদায় করছো তার নেকী বা ছাওয়াব থেকে তোমাদেরকে বঞ্চিত করবো না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন যে, উনারা এর দ্বারা উচ্চমানের ঈমানদার হিসাবে সাব্যস্ত হয়েছেন। উনাদেরকে দুই ক্বিবলা উনার দিকে মুখ করে নামায আদায় করার ছাওয়াব দেয়া হবে। এর ভাবার্থ এটাও বর্ণনা করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এবং উনার সাথে আপনাদের সম্মানিত ক্বিবলা উনার দিকে ঘুরে যাওয়াকে বিনষ্ট করবেন না। এরপর বলা হয়েছে-
إِنَّ اللّهَ بِالنَّاسِ لَرَؤُوفٌ رَّحِيمٌ.
অর্থ: ‘নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সমস্ত মানুষের প্রতি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’
ছাহীহ হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
   أن رسول الله صلى الله عليه وسلم رأى امرأة من السبي قد فرق بينها وبين ولدها، فجعلت كُلَّما وجدت صبيًا من السبي أخذته فألصقته بصدرها، وهي تَدُور على، ولدها، فلما وجدته ضمته إليها وألقمته ثديها. فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: أترون هذه طارحة ولدها في النار، وهي تقدر على ألا تطرحه؟ قالوا لا يا رسول الله صلى الله عليه وسلم . قال  فوالله، لله أرحم بعباده من هذه بولدها
অর্থ: “একটি বন্দি মহিলার শিশু তার থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই মহিলাকে দেখেন যে, তিনি উন্মাদিনীর ন্যায় নিজ শিশুকে খুঁজছেন। শিশুকে খুঁজে না পেয়ে উক্ত মহিলা  তিনি যে শিশুকেই দেখতে পান তাকেই গলায় জড়িয়ে ধরেন। অবশেষে তিনি উনার শিশুকে পেয়ে যান। ফলে তিনি খুশিতে বাগ বাগ হয়ে (আত্মহারা) হয়ে পড়েন এবং লাফিয়ে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেন। অতঃপর তাকে জড়িয়ে নিয়ে আদর করতে থাকেন এবং মুখে দুধ দেন। এটা দেখে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আচ্ছা বলুন তো এই মহিলাটি কি উনার এই শিশুটিকে আগুনে নিক্ষেপ করতে পারেন? উনারা বললেন- ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কখনই না।
তিনি তখন বললেন- মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! এই মা তার শিশুর উপর যতটা স্নেহশীল, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার বান্দাদের উপর এর চেয়ে বহু বহুগুণে স্নেহশীল ও দয়ালু।” সুবহানাল্লাহ! (তাফসীরে ইবনে কাছীর)

0 Comments: