৫২০ নং- সুওয়াল : ‘মুসলিম শরীফ’ উনার দ্বিতীয় খণ্ডের ৩৩৬ পৃষ্ঠার একখানা পবিত্র হাদীছ শরীফ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে চাই। যা বর্ণনা করেছেন, হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যার মধ্যে তাক্বদীর সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ যার তাক্বদীরে যে পাপ লেখা রয়েছে, সে অবশ্যই সে পাপ করবে। তাহলে মহান আল্লাহ পাক কি বান্দার জন্য পাপ কাজ করা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন? পাপ কাজ কি বান্দা নিজ থেকে করে থাকে, না মহান আল্লাহ পাক করিয়ে থাকেন। দয়া করে আমাকে বিস্তারিত জানাবেন।


সুওয়াল : মুসলিম শরীফউনার দ্বিতীয় খণ্ডের ৩৩৬ পৃষ্ঠার একখানা পবিত্র হাদীছ শরীফ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত জানতে চাই। যা বর্ণনা করেছেন, হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। যার মধ্যে তাক্বদীর সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ যার তাক্বদীরে যে পাপ লেখা রয়েছে, সে অবশ্যই সে পাপ করবে। তাহলে মহান আল্লাহ পাক কি বান্দার জন্য পাপ কাজ করা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন? পাপ কাজ কি বান্দা নিজ থেকে করে থাকে, না মহান আল্লাহ পাক করিয়ে থাকেন। দয়া করে আমাকে বিস্তারিত জানাবেন।

জাওয়াব : হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি আদম সন্তানের জন্য ব্যভিচারের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে (আদম সন্তান যে ব্যভিচার করবে, সেটা মহান আল্লাহ পাক উনার ইলমে রয়েছে), তা নিশ্চয়ই করবে। চোখের জীনা হচ্ছে- দৃষ্টি করা, জবানের জীনা হচ্ছে- কথা বলা, নফস সেটা আকাঙ্খা করে এবং আগ্রহ প্রকাশ করে, আর লজ্জাস্থান সেটাকে সত্য বা মিথ্যায় পরিণত করে।” (পবিত্র বুখারী শরীফ পবিত্র মুসলিম শরীফ)
অনুরূপ সমার্থবোধক আরো পবিত্র হাদীছ শরীফ বুখারী ও মুসলিম শরীফ উনাদের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে প্রথমে তাক্বদীর সম্পর্কে বলা হয়েছে। অর্থাৎ আদম সন্তানের তাক্বদীরে যা থাকবে, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। দ্বিতীয়তঃ জীনার প্রকারভেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে হাক্বীক্বী জীনা, যা লজ্জাস্থান দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। অপরটি হচ্ছে- মাজাজী জীনা, যা অঙ্গ-প্রতঙ্গের দ্বারা সংঘটিত হয়।
প্রশ্নে প্রশ্নকারী যা জানতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাক কি বান্দার জন্য পাপ কাজ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, যা সে অবশ্যই করবে? না, মহান আল্লাহ পাক কোন বান্দার জন্য কোন পাপ কাজ নির্দিষ্ট করে দেননি। এ কথা বুঝতে হলে প্রথমে তাক্বদীর সম্পর্কে বুঝতে হবে।
তাক্বদীরের অর্থ হচ্ছে- নির্ধারণ করা। মহান আল্লাহ পাক যদি নিজের তরফ থেকে বান্দার তাক্বদীর নির্ধারণ করে দেন, তাহলে বান্দার নেক কাজের ও বদ কাজের হিসাব-নিকাশের ফয়সালার অর্থ কি হতে পারে?  মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
خلق المرت والحيوة ليلو كم ايكم احسن عملا.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক তিনি হায়াত ও মউতকে সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য, কার আমল উত্তম।” (পবিত্র সূরা মূলক শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২)
মূলত : মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন বান্দার জন্য বেহেস্ত বা দোযখ, ভাল-মন্দ কোন কিছুই নির্দিষ্ট করে দিননি। বরং সব কিছুই মহান আল্লাহ পাক উনার ইলমে রয়েছে। সে ইলম থেকে প্রত্যেক বান্দার আমল লৌহ মাহফুজে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন। আর এটাই হচ্ছে তাক্বদীর।
মহান আল্লাহ পাক তিনি হলেন,
عالم الغيب والشهادة
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য সব বিষয়ে সম্পর্কে অবহিত (বিনা মধ্যস্থতায়)।
অতএব, মহান আল্লাহ পাক তিনি বান্দাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ভাল-মন্দ যাবতীয় কার্যাবলী সম্পর্কে অবহিত। অর্থাৎ কে বেহেস্তে যাবে, কে দোযখে যাবে, কে নেক কাজ করবে, কে বদ কাজ করবে, মহান আল্লাহ পাক তিনি সবকিছুই জানেন। এর অর্থ এ নয় যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন বান্দাকে বেহেস্তী করে দিয়েছেন বা জাহান্নামী করে দিয়েছেন অথবা নেককার করে দিয়েছেন বা বদকার করে দিয়েছেন।
তাক্বদীরের ব্যাখ্যা সঠিকভাবে না বুঝার কারণে উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যা মানুষ ভুল করে থাকে। তাক্বদীর যদি মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হতো, তাহলে মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার শানে এ পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করতেন না। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
فاما يأتينكم منى هدى فمن تبع هذاى فلاخوف عليهم ولاهم يحزنون- والذبوا باياتنا فاولئك احصاب النار- هم فيها خالدون.
অর্থ : অতঃপর যদি আমার তরফ থেকে তোমাদের প্রতি কোন হিদায়েত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি সে হিদায়েতের ইত্তেবা করবে, তার কোন ভয় থাকবেনা এবং সে চিন্তিতও হবেনা। আর যারা কুফরী করে এবং আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যারোপ করে, তারাই হবে জাহান্নামী। সেখানে তারা অনন্তকাল ধরে অবস্থান করবে।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি বান্দাকে ভাল-মন্দ কাজ করার ইখতিয়ার দিয়ে দিয়েছেন।
তাক্বদীরের হাক্বীক্বত না বুঝার কারণে উম্মতে হাবীবী উনাদের মধ্যে কয়েকটি ফিরকার উদ্ভব ঘটেছে। যারা আহলে নাযীর অন্তর্ভূক্ত নয় বরং আহলে নারের অন্তর্ভূক্ত। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
ستفرق امتى على ئلاث وسبعين فرقة كلهم فى النار الاملة واحدة قيل من هى رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما انا عليه واصحابى.
অর্থ : অতিশীঘ্রই আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, তন্মধ্যে একটি দল ব্যতীত ৭২টি দলই জাহান্নামে যাবে। তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা জিজ্ঞাসা করলেন, কোন দল নাযাত প্রাপ্ত ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! তিনি বলেন, যারা আমি এবং আমার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মত ও পথের উপর কায়িম, তারা নাযাত প্রাপ্ত দল।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, আহমদ শরীফ)
অর্থাৎ উম্মতে হাবীবী উনাদের মধ্যে ৭৩ দল হবে। একদল হবে নাযাত প্রাপ্ত, আর বাকী ৭২ দল হবে জাহান্নামী। তার মধ্যে বিশেষ দুটি দল হচ্ছে- (১) ক্বদরীয়া, (২) জাবারীয়া। ক্বদরীয়া সম্প্রদায়ের মূল আক্বীদা হচ্ছে- তাক্বদীরের মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার কোন হাত নেই। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার কোন ক্ষমতাই খাটেনা তাক্বদীরের মধ্যে। তাক্বদীরের নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছে মানুষ স্বযং। অর্থাৎ তাক্বদীর মানুষের ইখতিয়ারে। এ আক্বীদার জন্য তারা জাহান্নামী।
আর জাবারীয়া সম্প্রদায়ের মূল আক্বীদা হচ্ছে- তাক্বদীর সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহ পাক উনার নিয়ন্ত্রণে। এতে মানুষের কোন ইখতিয়ার নেই। অর্থাৎ ভাল-মন্দ, নেক কাজ, বদ কাজ, জীনা করা, শরাব পান করা, সুদ খাওয়া, জুয়া খেলা, ঘুষ খাওয়া, চুরি করা, মিথ্যা বলা ইত্যাদি সর্ব প্রকার পাপ কার মানুষ মহান আল্লাহ পাক উনার হুকুমে করে থাকে। এ আক্বীদার জন্যই তারা জাহান্নামী।
উল্লেখ্য যে, একদিন জাবারীয়া আক্বীদাভূক্ত জনৈক ব্যক্তি এক মুসলমানের আঙ্গুর ফলের বাগানে গিয়ে চুরি করার নিয়তে ফল ছেড়া শুরু করলো। তখন বাগানের মালিক এসে তাকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কে? সে জাবারীয়া উত্তর দিল, আমি মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা। তুমি এখানে কি করতেছ? সে জাবারীয়া উত্তর দিল, মহান আল্লাহ পাক উনার ওয়াস্তে চুরি করতেছি। তখন বাগানের মালিক চিন্তা করলো যে, এখন আমি কি করবো। কারণ, সে তো মহান আল্লাহ পাক উনার ওয়াস্তে চুরি করতেছে। হঠাৎ মালিকের মাথায় বুদ্ধি আসলো, তখন সে একটা লাঠি নিয়ে সেই জাবারীয়াকে মারা শুরু করলো। তখন জাবারীয়া বললো, তুমি কে? মালিক বললো, আমি মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা। তখন জাবারীয়া বললো, আহা! তুমি কি করতেছ?  মালিক বললো, আমি  মহান আল্লাহ পাক উনার ওয়াস্তে মারতেছি। তখন জাবারীয়া বেদম প্রহার সহ্য করতে না পেরে বলতে লাগলো, “জাবারীয়া আক্বীদা থেকে তওবা করলাম। মানুষের (আমলের) ইখতিয়ার রয়েছে, ইখতিয়ার রয়েছে, ইখতিয়ার রয়েছে।ভাল-মন্দ করার ইখতিয়ার বান্দার রয়েছে।
তাক্বদীর প্রসঙ্গে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ক্বদরীয়া সম্প্রদায় বলে, তাক্বদীরের নিয়ন্ত্রণকারী মানুষ। এতে মহান আল্লাহ পাক উনার কোন ইখতিয়ার নেই। আর জাবারীয়া সম্প্রদায় বলে, তাক্বদীরের নিয়ন্ত্রণকারী মহান আল্লাহ পাক। এতে মানুষের কোন ইখতিয়ার নেই। কোনটি সঠিক?
তখন হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি প্রশ্নকারীকে বললেন, “দাঁড়াও।তখন সে এক পা উঠালো, পুনঃরায় তিনি তাকে বললেন, “দ্বিতীয় পা উঠাও।সে জবাব দিল হুযূর! দ্বিতীয় পা উঠাতে পারিনা। তখন হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, “তাক্বদীরের মধ্যে বান্দার এতটুকু ইখতিয়ার আর মহান আল্লাহ পাক উনার এতটুকু ইখতিয়ার। অর্থাৎ পা উঠানোর ব্যাপারে বান্দা যেমন একসাথে দুপা তুলতে পারেনা, তদ্রুপ তাক্বদীরের মধ্যে বান্দার পূর্ণ ক্ষমতা বা ইখতিয়ার নেই।
আর এক পা বান্দা নিজ ক্ষমতায় বা ইখতিয়ারে তুলতে পারে, যা মহান আল্লাহ পাক তিনি পূর্ব থেকেই বান্দাকে দিয়েছেন। তদ্রুপ তাক্বদীরের মধ্যে বান্দার ক্ষমতা বা ইখতিয়ার রয়েছে। আর মহান আল্লাহ পাক যদি ইখতিয়ার বা ক্ষমতা দেন, তাহলে বান্দা দুপা এক সাথেও তুলতে পারবে।
অর্থাৎ নেক কাজ বান্দা ইচ্ছে করলেই করতে পারবেনা। মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত ও ইখতিয়ার ছাড়া। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
وما اصابك من حسنة فمن الله.
অর্থ : তোমাদের প্রতি যে কল্যাণ বা হাসানাহ পৌঁছে (তোমরা যে নেক কাজ করে থাক), তা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে (মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতে)।অর্থাৎ বান্দার নেক কাজ করা মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
আর বদ কাজ বান্দা নিজ থেকে করে থাকে, যার সাথে বান্দার নফসের সম্পর্ক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
وما اصابك من سيئة فمن نفسك.
অর্থ : তোমাদের প্রতি যে মন্দ পৌঁছে বা উপস্থিত হয় (তোমরা যে মন্দ কাজ করে থাক), তা তোমাদের নিজ থেকে (নফসের তাড়নায়)।
আবা-৩০

0 Comments: