ইয়েমেনের হুথিরা কেন লোহিত সাগরে হামলা চালায়?

ইয়েমেনের হুথিরা কেন লোহিত সাগরে হামলা চালায়?

যুদ্ধে একসাথে কতগুলো দিকে মনোনিবেশ এবং সক্ষমতা ব্যয় করতে হয় তা হচ্ছে, যুদ্ধের একটা বড় ফ্যাক্টর।  অর্থাৎ কোন দেশ যদি একটি দেশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় তখন দেশটি তার সকল যুদ্ধাস্ত্র এবং সৈন্য সংখ্যা একদিকে ব্যবহার করে।   কিন্তু একই সময় যদি দুই বা তিন দেশের সাথে যুদ্ধ লেগে যায়, তখন এই সামরিক শক্তি দুই বা তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়।  ফলে যুদ্ধে জয়লাভ করা তখন কঠিন হয়ে যায়।  

ফিলিস্তিনের মুক্তকামীদের হামলার প্রতিশোধে ইসরাইলের সেনাবাহিনী কেবল গাজার দিকেই মনোনিবেশ করে ছিলো।   ৮ অক্টোবর ২০২৩ তারিখ হিজবুল্লাহর হামলার পর ইসরায়েলী সেনাবাহিনীর একদিকে গাজা আরেক দিকে লেবাননের সাথে মনোনিবেশ করতে হয় এবং লেবাননের সিমান্তেও ইজরায়েলকে প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্য প্রেরণ করতে হয়।  কিন্তু সক্ষমতার দিক থেকে ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর একই সাথে লেবাননে হিজবুল্লাহ’র মতো শক্তিধর বাহিনীর সাথে এবং গাজাতে হামাসের মতো সুরঙ্গ ভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্যসংখ্যা নেই।   ফলে সহযোগীতার জন্য ইজরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের দারস্ত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র তখন বলে যে, ‍যদি হিজবুল্লাহ স্থলপথে ইজরায়েলে আক্রমণ করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলের পক্ষে যুদ্ধে করতে আসবে।  যার জন্য হিজবুল্লাহ স্থলপথে হামলা করা থেকে বিরত থাকে। 

কারণ, ‍যুক্তরাষ্ট্র লেবাননে হামলা করলে তা প্রতিহত করা হিজবুল্লাহ’র জন্য যেমন সামরিকভাবে কঠিন হয়ে যাবে, তেমন জনসমর্থনও ধরে রাখাটা হিজবুল্লাহ’র জন্য কঠিন হয়ে যাবে।  কেননা, শুধু দক্ষিণ লেবাননেই হিজবুল্লাহ’র আধিপত্য আছে।  কিন্তু উত্তর লেবাননে অনেক গ্রুপ হিজবুল্লাহ বিরোধী।  যারা লেবাননে ইসরাইলের হামলার  ব্যাপারে চুপ থাকলেও মার্কিনিদের হামলার মুখে তারা হিজবুল্লাহর উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করবে, বলবে- হিজবুল্লাহ’র কার্যক্রমের কারণে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের উপর হামলা করছে।  ফলে বিরোধী গ্রুপগুলো সাধারণ জনগণকে হিজবুল্লাহ’র বিরুদ্ধে আরো উস্কে দিবে এবং অনেকে মার্কিনিদের পক্ষ অবলম্বনও করবে।  এজন্য ইয়েমেনের হুথিরা লোহিত সাগরে হামলা চালিয়ে আমেরিকাকে ইয়েমেনের দিকে ব্যস্ত রাখতে চায়।  এমনকি হুথিরা চায় আমেরিকা ইয়েমেনে সৈন্য পাঠাক।  কারণ ইয়েমেন আফগানিস্তানের চেয়েও দূর্গম।  এসব দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় হুথিদের সাথে আমেরিকা পেরে উঠবে না।  আর ইয়েমেনে এবং লেবাননে যুক্তরাষ্ট্র একসাথে যুদ্ধ চালাতে পারবে না।  কারণ আমেরিকা ইউক্রেন যুদ্ধে আর্থিক ভাবে যুক্ত থাকায় আমেরিকার জন্য একসাথে এতগুলো জায়গায় যুদ্ধ চালানো কঠিন হবে ।  যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে-  আইআরজিসি'র পলিসি হলো, লেবানন এবং সিরিয়ায় ইজরায়েলকে ব্যাস্ত রাখবে যাতে ইজরায়েল গাজাতে ব্যাপকভাবে হামলা করতে না পারে এবং ইয়েমেন ও ইরাকে আমেরিকাকে ব্যস্ত রাখা যাতে লেবানন এবং সিরিয়াতে আমেরিকা ব্যাপকভাবে হামলা করতে না পারে।

মূলতঃ হুথিদের লোহিত সাগরে হামলার ফলে আমেরিকা এখন পুরোপুরি মনোযোগ ইসরায়েলকে দিতে পারছে না।  আর আমেরিকা ইজরায়েলকে যত কম মনোনিবেশ করতে পারবে হিজবুল্লাহ ততবেশি ইজরায়েলে হামলা করতে পারবে।


 হিজরাদের কেন করুণার পাত্র বানাবেন?

 

হিজরাদের কেন করুণার পাত্র বানাবেন?

সরকারের হিজরাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দাবী করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে নাকি সমাজে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। মিডিয়াতেও হিজরাদের নিয়ে অনেক ধরনের প্রচারণা আছে, যার মূল উদ্দেশ্য তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি তৈরী করা। কিন্তু আসলেই কি তৃতীয় লিঙ্গ ঘোষণা করে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন হয়েছে, নাকি তাদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে?

 প্রকৃত অর্থে কেউ যদি হিজরাদের জন্য কিছু করতেই চায়, তবে তাকে আগে জানতে হবে, হিজরাদের সমস্যাটা আসলে কী? পৃথিবীতে জন্মের সময় সকল শিশুই সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে জন্ম নেয় না। কিছু শিশু জন্মের সময় নানান সমস্যা বা অসুস্থতা নিয়ে জন্ম নেয়। যেমন- কোন শিশু জন্মান্ধ থাকে, কারো জন্মগত কানে সমস্যা থাকে, কারো হাতে সমস্যা থাকে, কারো পায়ে সমস্যা থাকে, কারো ঠোঁটকাটা হয় ইত্যাদি তেমনি হিজরা হচ্ছে তারা, যাদের জন্মের সময় প্রজনন অঙ্গে সমস্যা বা ত্রুটি থাকে হিজরারা হচ্ছে অস্পষ্ট বা ত্রুটিযুক্ত প্রজনন অঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশু তাই তারা একধরনের প্রজনন বা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী

 দেখা যায়, তাদের ত্রুটিযু্ক্ত লিঙ্গ অনেক সময় অস্পষ্ট হয়। যা দেখে কেউ কেউ ভুল ঝুঝেযেমন- জন্মের সময় ধাত্রী হয়ত অস্পষ্ট লিঙ্গ দেখে মন্তব্য করলো- বাচ্চা ছেলে হয়েছে কিন্তু বাচ্চা আসলে মেয়ে। তো ঐ বাচ্চাকে সবাই ছোট থেকে ছেলে মনে করা শুরু করলো। ছেলে হিসেবে বাবা-মা বড় করতে থাকলো। পোশাক-আশাক বেশ-ভূষা কিনে দিলো ছেলেদের মত কিন্তু ছেলে যত বড় হয়, তার আচরণ আর ছেলেদের সাথে মিলে না, মেয়েদের সাথে মিলে বয়ঃসন্ধিতে বিষয়টি আরো প্রকট হয়ে উঠে দেখবেন- মাঝে মাঝে সংবাদ আসে, ঘুম থেকে উঠে অমুক ছেলে মেয়ে হয়ে গিয়েছে কিংবা ঘুম থেকে উঠে তমুক মেয়ে ছেলে হয়ে গিয়েছে আসলে বিষয়টি ঘুম থেকে উঠার সাথে সম্পর্কিত না বরং ঐ ব্যক্তি আগেই ছেলে বা মেয়ে ছিলো কিন্তু লিঙ্গ জন্মগত অস্পষ্ট ছিলো আর সেই অস্পষ্ট লিঙ্গ দেখে কেউ শুরুতে তার ভুল লিঙ্গ চিহ্নিত করেছে, যা বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে স্পষ্ট হয়ে প্রকৃত লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায়

 এ ধরনের অস্পষ্ট লিঙ্গ পরিচয়যুক্ত কোন শিশুকে যদি কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়, তবে তিনি শিশুটিকে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলে দেন, শিশুটি ছেলে নাকি মেয়ে তবে পরিপূর্ণ সুস্থ হতে, অনেক সময় অপরেশনের প্রয়োজন হয় সঠিক চিকিৎসা পেলে, শিশুটি পরিপূর্ণ ছেলে বা মেয়ের শরীর লাভ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১ সালে ডিসঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগর উদ্বোধন হয়, যেখানে লিঙ্গে ত্রুটিযুক্ত শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়

 কয়েকদিন আগে এ বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জন মুহম্মদ নজরুল ইসলাম আকাশের সাথে তিনি কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, আমাদের কাছে অনেক বাবা-মা আসেন, যারা ঠিক বুঝতে পারেন না, তাদের সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় কী? সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে এ অবস্থায় আমরা যখন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত বলে দেই তার সন্তান ছেলে অথবা মেয়ে এটা শুনে তারা অনেক খুশি হয় অনেকে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় কারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় সে নিশ্চিত হয়, তার সন্তানের পুরুষ অথবা নারী হিসেবে একটি লিঙ্গ পরিচয় আছে। আর পুরুষ অথবা নারী হিসেবে লিঙ্গ পরিচয় লাভ করা অত্যন্ত জরুরী। কেউ চায় না, তার সন্তান পুরুষ বা নারী ভিন্ন অন্য কোন পরিচয়ে থাকুক।

 আসলে একজন মানুষের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যেমন তার মানবাধিকার, তেমনি একজন পুরুষের পুরুষ এবং একজন নারীর নারী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া তার মানবাধিকার কিন্তু তাকে যদি নারী বা পুরুষ লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তৃতীয় কিছু বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন তার মানবাধিকার নিশ্চিত তো হয়ই না বরং সে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এজন্য আসলে হিজরাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া ভুল পদ্ধতি হিজরারা তো পুরুষ অথবা নারী তারা তো তৃতীয় কিছু নয় তাদের তৃতীয় লিঙ্গ বলে দাবী করার অর্থই হচ্ছে তাদেরকে মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া।

 আসলে হিজরারা এক ধরনের জন্মগত রোগে আক্রান্ত তাদের রোগের নাম- ডিজঅর্ডার অব সেক্সুয়াল ডেভেলপমেন্টআর রোগের উপর নির্ভর করে কোন নতুন লিঙ্গ হয় না যদি রোগের উপর নির্ভর করে নতুন লিঙ্গ তৈরী করতে হয় তবে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে আলাদা ক্যান্সার লিঙ্গ বলতে হবে কিংবা অথবা অন্ধত্বের জন্য অন্ধত্ব লিঙ্গ বলতে হবে কিংবা মানসিক অসুখ সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্তদের আলাদা লিঙ্গ বলতে হবে যদি আমরা তাদের তেমনটা না বলি, তাহলে হিজরাদেরকে আলাদা লিঙ্গ বানাবো কেন?

 অনেকেই ভাবে, হিজরাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শণ করতে হবে এটা আসলে ভুল কথা। একজন অসুস্থ মানুষকে যদি আপনি চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করেন, তবে সেটাই তার প্রতি প্রকৃত সহানুভূতি প্রদর্শনসেটা না করে আপনি তার অসুস্থতাকে যতই স্বীকৃতি দেন, সেটা আসলে প্রকৃত সহানুভূতি প্রদর্শন হয় না, বরং অসুস্থতাকে আড়াল করা হয়।

 আসলে যেসব কথিত সেক্যুলার-লিবারেল বা মানতাবাদী বা এনজিও গোষ্ঠী হিজরাদের স্বীকৃতির কথা বলে, তাদেরকে আমি কখন দেখিনি হিজরাদের চিকিৎসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কথা বলতে। বরং হিজরাদের চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার প্রয়াসে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১ সালে ডিসঅর্ডার অব সেক্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগের উদ্বোধনের পর দেখেছি তাদেরকে ঐ বিভাগের বিরোধীতা করতে তারা বলছে, এর মাধ্যমে নাকি হিজরাদের অধিকার হরণ হবে!

 আসলে কিছু মানুষ আছে, যারা সমস্যা নিয়ে ব্যবসা করতে চায়, রাজনীতি করতে চায় কিন্তু সমস্যার সমাধান চায় না কারণ সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে তো তারা সমস্যাকে পূজি করে ব্যবসা বা রাজনীতি করা যায় না আজকে হিজরাদের কথা বলে যারা বিদেশী এনজিওদের থেকে ফান্ডিং পায়, তারা তো কখনই চাইবে না হিজরারা সুস্থ হয়ে যাক তারা যদি শিশু অবস্থায় সুস্থ হয়ে যায়, তবে তো সমাজে হিজরা বলে কেউ থাকবে না, ফলে হিজরাদের নিয়ে ব্যবসা বা রাজনীতি করারও সুযোগ থাকবে না

 এজন্য যখন মিডিয়ায় হিজরাদের জন্য মায়াকান্না দেখি কিংবা পাঠ্যপুস্তকে সহানুভূতি তৈরীর করতে বলা হয়, তখন তা মেনে নিতে পারি না কারণ সে কেন আমার সহানুভূতি চাইবে? কেন তাকে করুণার পাত্র করতে হবে? কেন তাকে পরনির্ভরশীল হতে হবে? কেন থাকে ভাতা নিতে হবে? তার তো অধিকার সু-চিকিৎসা পাওয়ার, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ধারণ করার সে সুস্থ থাকলে তো তার সহানুভূতি দরকার হবে না, কারো করুণার পাত্র হয়েও থাকতে হবে না। তাকে ভাতা কিংবা কোটা সুবিধা দিয়ে পরনির্ভরশীল না করে সু-চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে দিন, স্বনির্ভর করে দিন, এটাই তার জন্য বিশাল প্রাপ্তি।

 এজন্য যদি হিজরাদের জন্য প্রকৃত ভালোবাসা প্রদর্শন করতেই হয়, তবে সবার আগে দরকার তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা তবে এ জন্য বাবা-মায়েদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরী করতে হবে, যেন একটি শিশু জন্মের পর পর লিঙ্গে কোন সমস্যা দেখামাত্র তাকে নিয়ে চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয় এবং রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব সেই শিশুটির সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করা এর মাধ্যমেই শিশুটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে, সেটাই হবে তার মানবাধিকার কিন্তু তাকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের ব্যবস্থা না করে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হাজার বার স্বীকৃতি দিলে কখনই তার মানবাধিকার নিশ্চিত হবে না

 

 ছবি-ভিডিওতে জীবনের আনন্দ নষ্ট

 

ছবি-ভিডিওতে জীবনের আনন্দ নষ্ট

ছবি-ভিডিওর কারণে জীবনের আনন্দ নষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে মানুষের হাতে ক্যামেরা-মোবাইল আসার পর কোন কিছুতে সুখ আর আনন্দ বলে আর কিছু নেই। আগে কোন বিয়ে বাড়িতে গেলে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতো, সবাই কথা বলতো। এখন সেগুলো পুরোটাই শুটিং স্পট। শুধু ছবি-ভিডিও তৈরীর জন্য যেন সব আয়োজন, সুখ-আনন্দ অনুভূতি আদান প্রদানের কোন সুযোগ নেই।

 একটা খাবারের রেস্ট্রুরেন্টে যান, খাবারের স্বাদ পরখ পরে, আগে খাবারে সাথে সেলফি তুলতে হবে। খাবারের সাথে সেলফি তুলতে তুলতে গরম খাবার ঠাণ্ডা হবার উপক্রম। কোথাও বেড়াতে গেলে একই অবস্থা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য অনুভব না করে শুধু ছবি আর ভিডিও, এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড। মনের খোরাকের থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খোরাক তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

 আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুষ্ঠান হলে সবাই এক হতো, আনন্দ খুশি চলতো। কিন্তু এখন সব কিছু যেন শুটিং কেন্দ্রীক। ক্যামেরাম্যান আনো, প্রফেশনাল ভিডিও বানাও, সোশাল মিডিয়ায় আপলোড দাও, ভিডিও দেখলে মানুষ কী বলবে, শুধু সেই চিন্তা। সুতরাং সবার আনন্দ খুশি মাটি, ক্যামেরার ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সবাইকে পরিপাটি রাখতে হবে, সেটাই এখন বড়।

 শুধু কি অনুষ্ঠান? মসজিদ আর ওয়াজ মাহফিলও এখন শুটিং স্পট। মসজিদে খতিব সাহেব কিংবা মাহফিলের বক্তার মুখ এখন আর দেখা যায় না, ক্যামেরা আর ক্যামেরাম্যানের সারির কারণে। প্রতিনিয়ত উঠতে থাকে ছবি, ভিডিও। সেই ছবি ভিডিও আবার ইউটিউবে আপলোড করে টাকা ইনকাম করে খতিব বা বক্তারা। প্রাণীর ছবি তোলা দ্বীন ইসলামে হারাম, তো সেই ছবি থেকে যে ইউটিউব ফেসবুকে ইনকাম করা হয়, সেটা কি হালাল হবে?

 পবিত্র হজ্জেও একই অবস্থা। হাজীরা এখন আর হজ্জ করতে যায় না, শুটিং করতে যায়। হাতের মধ্যে একটা স্টিক সমেত ক্যামেরা লাগিয়ে একটু পর পর সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ দেয়। হাজীদের এমন সেলফি, লাইভ উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে সৌদি সরকার তাদের ওলামাদের দিয়ে সেলফির বিরুদ্ধে ফতওয়া দিয়েছে। ফতওয়ায় সৌদির ওলামারা বলছে- হজ্জে ছবি ভিডিও করলে লৌকিকতা প্রদর্শন হয়। সৌদির ওলামাদের এমন ফতওয়ার জবাবে সাধারণ জনগণ ছবি-ভিডিও বন্ধ করেনি, বরং উত্তরে বলেছে, হুজুর ! আপনারা যখন ছবি-ভিডিও করেন, তখন লৌকিকতা হয় না? আমরা করলেই কেন লৌকিকতা বা লোক প্রদর্শন হয়। আর তাছাড়া আপনারা কি আমাদের মনে খবর জানেন, আমরা লৌকিকতা প্রদর্শনের জন্য ছবি তুলছি কি না?

 আসলে সৌদি ওলামাদের উচিত ছিলো, হাদীস শরীফে প্রাণীর ছবিকে হারাম বলে যে সমস্ত হাদীস শরীফ আছে, সেই ভিত্তিকে ছবিকে হারাম বলা। কিন্তু তারা যেহেতু নিজেরা ছবি তুলে তাই সেদিকে তারা যায়নি, অন্যদিক দিয়ে ফতওয়া দিয়ে হাজীদের সেলফি বন্ধ করতে চেয়েছিলো, কিন্তু হাজীরা সেটা গ্রহণই করেনি। বরং আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আসলে বন্দুক যদি টার্গেট থেকে এক চুল সরে যায়, তবে গুলি লক্ষ্যস্থল থেকে শত হাত দূরে সরে যাবে, এটাই নিয়ম। যে আলেমরা সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব দিবে। সেই কথিত আলেমরা যখন অহরহ হারাম ছবি, ভিডিও সেলফি তোলা শুরু করেছে, তখন সাধারণ মানুষ তো ছবি-ভিডিওর সাগরে ভাসবে, এটাই স্বাভাবিক।

 আবার, ছবি-ভিডিও মানুষকে মানসিক প্রতিবন্ধী বানিয়ে ফেলেছে। নিজের প্রাইভেট জীবনের ছবি ভিডিও তুলে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করতে তারা আর লজ্জা পাচ্ছে না। মানুষ এতটা নিলর্জ্জ হয়ে গেছে যে, নিজের বেডরুমে ক্যামেরা বসিয়ে সেই ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করে টাকা কামাই করছে। নাউযুবিল্লাহ।

 আসলে ছবি-ভিডিও-সেলফির উৎপাতে এখন যেকোন পাবলিক প্লেসে অতিষ্ট লাগে। কোন যায়গায় গিয়ে শান্তি পাওয়া যায় না। এসব সেলফি খোরদের নিজেদের প্রাইভেসী তো নাই, অন্যদেরও প্রাইভেসী নষ্ট করে। বাংলাদেশে যে কোন প্রাইভেট প্লেসে ক্যামেরায় ছবি তোলা বা ভিডিও করা বা সেলফি তোলা নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ এসব প্রতিবন্ধীদের উৎপাতে অন্যদের প্রাইভেসী নষ্ট হয়। আপনি কোথাও বেড়াতে গেছেন, আপনার ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে, কিংবা সে নিজে ভিডিও করছে, সাথে পাশে থাকা আপনাকেও জুড়ে দিচ্ছে। আপনি জানেনও না, আপনার ছবি মিডিয়ায় প্রচার হয়ে গেছে। বিষয়টি কিন্তু খুবই বিপদজনক। বিশেষ করে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার যুগে আপনার ছবি বা ভিডিও যে কেউ কোন অপরাধজনিত কাজে ব্যবহৃত করবে না, সেটা কিন্তু আপনি নিশ্চিত না। তাই যে কোন পাবলিক প্লেসে ক্যামেরা বা ভিডিও নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ এর মাধ্যমে মানুষের প্রাইভেসী হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

 

 শিক্ষা ব্যবস্থা কেন ধ্বংস করা হয়?

শিক্ষা ব্যবস্থা কেন ধ্বংস করা হয়?

 শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড কোন জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা মানে তার মেরুদণ্ড ধ্বংস করা। কোন ব্যক্তির মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন সে আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না, তেমনি কোন জাতির শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হলে সে জাতি আর মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না নুয়ে থাকে

 ব্রিটিশরা অঞ্চলে আসার আগে অঞ্চলে মুসলমান প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত উচু দরের ছিলো সেই সময় মুসলমান প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো আরবী ফারসী ভাষার উপর নির্ভর মুসলমানরা তো অবশ্যই হিন্দুরাও সেই ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতো কিন্তু উঁচু দরের শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলে তো মানুষ উচু থাকবে, তাকে তো আর নিচু করা যাবে না, শাসন করা যাবে না তাই অঞ্চলে এসে ব্রিটিশরা প্রথমে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করেছিলো প্রবর্তন করেছিলো তাদের বানানো নিচু দরের শিক্ষা ব্যবস্থা

 কিন্তু ব্রিটিশরা যখন মুসলমান প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আসে, তখন শিক্ষিত মুসলমানরা সেই নিচু দরের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বর্জন করে ইতিহাসে বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা হয় বলা হয়, মুসলমানরা নাকি ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ না করে পিছিয়ে পড়েছে হিন্দুরা গ্রহণ করে এগিয়ে গিয়েছে আসলে বিষয়টি এমন না মুসলমানরা তখন উচ্চ শিক্ষিত এবং তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক উচু দরের কিন্তু ব্রিটিশরা যখন সেই শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আসে , তখন মুসলমানরা সেটা বর্জন করে কারণ উচু ছেড়ে কেউ নিচু জিনিস নিতে চায় না

 ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশরা কিন্তু কথা স্বীকার করে গেছে যেমন-

 . এ এম ই সি বেইলি বলে- তাদের কাছে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল, যেটা আমরা ধ্বংস করেছি যা দ্বারা অত্যন্ত উচ্চমানের বুদ্ধিগত প্রশিক্ষন ও বিকাশ ঘটানো সম্ভব। এই শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তির মাঝে কোনরুপ ত্রুটি নেই, যদিও এটির উপস্থাপন পদ্ধতিটি অত্যন্ত পুরনো, তারপরও এটি তৎকালীন ভারতের যেকোন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অসীম মাত্রায় শ্রেষ্ঠ। এই শিক্ষাব্যবস্থাই তাদেরকে বুদ্ধিগত ও উপাদানগত শ্রেষ্ঠত্ব এনে দিয়েছে। (তথ্যসূত্র: Hunter, W. W. Indian Mussalmans, p. 133)

 ২. ইংরেজ পণ্ডিত জেনারেল স্লিম্যান মন্তব্য করে, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার যে রকম অগ্রগতি হয়েছে, পৃথিবীর খুব কম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সে রকম প্রসার হয়েছে। যে ব্যক্তি মাসে ২০ টাকা বেতনের চাকুরী করেন, তিনিও তার সন্তানকে প্রধানমন্ত্রীর সন্তানের সমতূল্য শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেন। তারা আরবী ও ফারসী ভাষা মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করেন, যা আমাদের কলেজ যুবকেরা গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার মাধ্যমে ব্যকরণ, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কোশাস্ত্র, শিক্ষা পেয়ে থাকে। মাত্র সাত বছরকাল অধ্যয়নের পর একজন ‍মুসলমান যুবক মাথায় পাগড়ী পরিধান করে এবং অক্সফোর্ড থেকে পাশ করা নব্য যুবকের মতই- জ্ঞানের সেই সকল সংশ্লিষ্ট শাখায় পূর্ণতা লাভ করে থাকে। সে সক্রেটিস, এ্যারিস্টটল, প্লেটো, হিপোক্রেটিস, গ্যালন ও ইবনে সিনা সম্বন্ধে অনর্গল আলোচনা করতে পারে। (তথ্যসূত্র: Sleeman, W. H. Rambles and Recollections of an Indian Official, Vol-II, London, 1893, pp. 523-524)

 ৩. উইলিয়াম অ্যাডম তার রিপোর্টে (১৮৩৫-১৮৩৮) বাংলায় এক লক্ষ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিলো বলে উল্লেখ করেন। (তথ্যসূত্র: Long, J., Adam's Reports. pp. 18-19)

 উপরের ৩টি রেফারেন্স দ্বারা প্রমাণ হয়, ব্রিটিশরা আসার আগেই এ অঞ্চলের মুসলমানরা শিক্ষা-দীক্ষায় অসম্ভবরকম উন্নত ছিলো, শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক বিস্তৃত ছিলো, যা দর্শণে খোদ ব্রিটিশ দস্যুরাও অবাক হয়ে যায়। ব্রিটিশরাই বলছে তারা এ অঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। কারণ তারা জানত মুসলমানরা যদি ঐ শিক্ষা ব্যবস্থা ধারণ করে তবে তাদের কখন শাসন করা যাবে না। কারণ মাথা নিচু লোককে শাসন করা যায়, উচু লোককে করা যায় না। আর সেই উচ্চ মাথা নিচু করতেই উচ্চমানের ঐ শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে ব্রিটিশরা নিম্নমানের গোলামি শিক্ষা ব্যবস্থা এ অঞ্চলে চাপিয়ে দেয়, আর তার দরুণ এ অঞ্চলে ২০০ বছর শাসন করে ব্রিটিশরা। শুধু তাই না, ব্রিটিশ প্রবর্তিত গোলামির শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে এ অঞ্চলের মানুষ এখনও চিন্তাধারায় ব্রিটিশ গোলামির পিঞ্জর থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।

 বর্তমানেও বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে নতুন পাঠ্যপুস্তকে দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়-

. পাঠ্যপুস্তকে নীতি নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে

. পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞান পাঠকে আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস করা হয়েছে

 একটি জাতিকে নীতি-নৈতিকতাহীন করে দিলে, ঐ জাতি অপকর্মে জড়িয়ে যাবে আর নীতি-নৈতিকতাহীন জাতি কখনো মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবে না। আবার একটি জাতিকে বিজ্ঞান পাঠ থেকে দূরে ঢেলে দিলে সেই জাতি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে, অর্থনীতিতে মাথা তুলে দাড়াতে পারবে না। যেমন- বর্তমানে বিশ্বে যে সকল দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হয়, সেই সমস্ত প্রতিটি দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অন্য দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগামী থাকার কারণে তারা অর্থনীতিতেও এগিয়ে যায় এবং অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এখন বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলো যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ধিরে ধিরে আগাতে থাকে, তবে এক সময় বাংলাদেশও অর্থনীতিতেও এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের উপর সম্রাজ্যবাদীদের ক্ষমতা বা প্রভাব খাটানো সহজ হবে না এজন্য বাংলাদেশের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাঠকে উদ্দেশ্যমূলক হ্রাস করা হয়েছে, যেন বাংলাদেশীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানে দুর্বল হয়ে যায়। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে না এবং বাংলাদেশকে শাসন করাও সহজ হবে বাংলাদেশীরা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারবে না, বরং মানুষকে স্বল্পমূল্যে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহৃত করা যাবে।

 আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে যেমন ব্রিটিশরা যেমন এদেশে মুসলমান প্রবর্তিত উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিলো, ঠিক তেমনি বর্তমানেও সম্রাজ্যবাদীদের প্রেসক্রিপশনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের কার্যক্রম চলছে এর বিরুদ্ধে প্রত্যেকের সচেতন হওয়া এবং প্রতিবাদ করা অত্যন্ত জরুরী

 

  তরুণরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ইউরোপ-কানাডায়, কিন্তু সেখানে কেমন অবস্থা?

  

তরুণরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে ইউরোপ-কানাডায়, কিন্তু সেখানে কেমন অবস্থা?

 দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকাংশ শিক্ষিত তরুণ দেশ ছাড়তে আগ্রহী। তারা ভাবছে, দেশে সুযোগ নেই, বিদেশ গেলে হয়ত কিছু একটা হবে। সে আশায় আমেরিকাব্রিটেনকানাডাইতালি, ফিনল্যান্ড, পতুর্গালসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের ধারণা, একবার সেখানে যেতে পারলেই বোধ হয় ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাবে তাদের এ চিন্তার সাথে তাল মিলিয়ে দালালরাও সাজিয়েছে নিত্য নতুন পসরা দালালদের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে তাই ২০-৩০ লক্ষ টাকা খরচ করতে দ্বিধা করছে না মানুষ অনেকে জমি বিক্রি করে কিংবা ধার-দেনা করে চলে যেতে চায় বিদেশে কিন্তু সেসব দেশে কি অবস্থা চলছেসে সম্পর্কে না জেনেই নিয়ে ফেলেন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আর সে ভুলেই সম্মুক্ষীন হোন জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে

 ঘটনা- :

১৫ লাখ টাকা ঋণ করে ইতালি গিয়ে ৭ মাস বেকারঅতঃপর আত্মহত্যা

 সুদে ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে ১৫ লাখ ঋণ করে গত বছর ইতালিতে গিয়েছিলেন কুমিল্লার যুবক সুমন মিয়া (২৫) গত বুধবার রোমে একটি গির্জার পেছন থেকে তাঁর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয় পুলিশ। দূতাবাস ও পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে জানানো হয়সুমন আত্মহত্যা করেছেন। সুমনের বড় ভাই রুবেল জানানগত বছর এপ্রিল মাসে রোমানিয়া এবং জুন মাসে ইতালিতে যান সুমন। ইতালি যেতে ১৫ লাখ টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা ছিল সুদের দেওয়ার শর্তে ঋণ আর বাকি টাকা ছিল আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার করা। সে কোনো কাজ না পাওয়ায় টাকা পাঠাতে পারেনি। রুবেল বলেনআমার ভাইয়ের বিদেশ যাওয়ার জন্য ১৫ লাখ টাকা পুরোটাই ঋণের। এর মধ্যে এক বিঘা জমি বিক্রি করে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করছি। আমার ভাইয়ের মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। কীভাবে তার এই ঋণ শোধ করব সেটা নিয়ে আমরা পুরো পরিবার চিন্তায় আছি। এ ঘটনায় ইতালিপ্রবাসী মুরাদ মহিবুর নামে কুমিল্লার এক ব্যক্তি ফেসবুকে পোস্ট করেনসুমন মিয়া সাত মাস আগে ইতালির রোম শহরে এসেছেন। মাত্র ২৫ বছরের ওই যুবক ইতালিতে এসেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সাত মাস বেকার থেকে কোনো কাজ না পেয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছেন। (তথ্যসূত্র: আজকের পত্রিকা২৮ জানুয়ারি ২০২৪)

 ঘটনা-২ :

কানাডা থেকে রাশেদ দেশে ফিরলেন লাশ হয়ে

কানাডায় আসা রাশেদ তানভীরের লাশ স্থানীয় সময় ২২ নভেম্বর টার্কিশ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। গত ৫ সেপ্টেম্বর তানভির (২৮) নামের এই যুবক ১৯ লাখ টাকা খরচ করে ভিজিট ভিসায় এসে টরন্টোতে এ্যাসাইলাম নেয়। সে থাকতো বাংলা টাউনের ডেনফোর্থ এলাকার থায়রা এভিনিউতে। বিগত আড়াই মাসে অনেকের মতো নানান সংকটে সে হতাশ হয়ে পড়ে এবং গত ১০ নভেম্বর হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। জানা গেছেতানভীরের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে তিনি। ঢাকা কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে কানাডা যান। তবে স্বপ্ন পুরণ হলো না তার। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক২৩ নভেম্বর ২০২৩)

 ঘটনা-৩

বর্তমানে ফিনল্যান্ডের অবস্থা খুব খারাপ

 খারাপ কেন বললাম কারণ যারাই যাচ্ছে জব পেতে ৬-৮ মাস অপেক্ষা করা লাগতেছে। ফিনল্যান্ডের গ্রুপ গুলোর পোস্ট দেখলেই খারাপ লাগে। অনেকে টাকা ধার-দেনা করে চলে আসে। চিন্তা করে একবার ইউরোপ গেলেই হলোবাকিটা দেখা যাবে। ব্যাপারটা এত সহজ না। এখানে প্রতি মাসে থাকা-খাওয়া বাবদ আপনার ৫০-৮০ হাজার টাকার মত খরচ হবে। জব না করে কারোরই ৬-৮ মাস বসে খাওয়া সম্ভব না। বিশেষ করে যারা টাকা ধার-দেনা করে এসেছেন। বর্তমানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী জব লেস। (ফেসবুক স্ট্যাটাস, মোহাইমিনুল ইসলাম৮ অক্টোবর২০২৩)

 ঘটনা-

যুক্তরাজ্য : ব্যয় নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে প্রবাসীরা

 মুদ্রাস্ফীতিজ্বালানি‌ তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিবিশ্বজুড়ে যু‌দ্ধের নে‌তিবাচক প্রভাববেকারত্ব- সব মি‌লি‌য়ে যুক্তরা‌জ্যে ভালো নেই বাংলা‌দেশিরা। এ কমিউনিটির প্রায় ১২ লাখ মানুষের বে‌শিরভাগ এখ‌ন বে‌ড়ে যাওয়া ব্যয় নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বে‌ড়ে‌ছে ক‌য়েকগুণ। মুদ্রাস্ফী‌তির কার‌ণে বাড়ির ব্যাংক মর্টগে‌জের মা‌সিক কিস্তি দ্বিগুণ হ‌য়ে‌ছে অনেকের। গত দুই বছ‌রে বাড়ি ভাড়া বে‌ড়ে‌ছে প্রায় দ্বিগুণ। পু‌রোনো বাংলা‌দেশিরাই যেখা‌নে হিম‌শিম খা‌চ্ছেন সেখা‌নে গত তিন বছ‌রে স্টু‌ডেন্ট ভিসাওয়ার্ক পার‌মিট ও কেয়ার ভিসায় আসা বাংলা‌দেশিরা পার কর‌ছেন চরম দুঃসময়। বিশেষ করে লন্ড‌নে আবাসন সংক‌টে নাকাল কর্মহীন বেকার অবস্থায় বহু বাংলা‌দেশি। অনেকের থাকার জায়গা নেই। (বাংলা ট্রিবিউন২৩ অক্টোবর ২০২৩)

 ঘটনা-

লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার তুষার গত ৩রা অক্টোবর২০২৩ তারিখে এক পোস্টে জানানতার একজন বন্ধু দালালদের ক্ষপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের ভালো চাকুরী ছেড়ে লন্ডনে এসে বিপদে পড়ে গেছে বাংলাদেশে তার বন্ধু খুব আরামের চাকুরী করতোকিন্তু লন্ডনে এসে কোন চাকুরী পান না খুব কষ্ট করে একটা চাকুরী পেয়েছেনতবুও সেটা হচ্ছে থালা বাসন মাজার কাজ তার বন্ধু বলছেআমার জন্য তো নিজের দেশই ভালো ছিলো যে দালালের মাধ্যমে আসছিসে আমাকে বুঝিয়েছিলোতুমি তো শিক্ষিত মানুষবাংলাদেশে ভালো চাকুরী করতেসুতরাং লন্ডনেও ভালো কাজ পাবে কিন্তু লন্ডনে এসে দেখেবাংলাদেশের পড়ালেখা বা চাকুরীর যোগ্যতা কোন কিছুরই সেখানে দাম নাই কিন্তু তার পক্ষে দেশের ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়কারণ ২০-২৫ লক্ষ টাকা ঋণ করে এসেছে তুষার আরেক পরিচিত ব্যক্তির কথা তুলে আনেতুষার বলেভাই থালা বাসন মাজতে মাজতে এমন অবস্থাদম চলে যাচ্ছেএকদিন থালা-বাসন মাজার কষ্ট ভুলতে ৩ দিন পর্যন্ত ব্যথার ট্যাবলেট খেতে হয়

 ঘটনা-

ট্যুর এশিয়ার সিইও খালেদ সাইফুল্লাহ ২৯ জানুয়ারী, ২০২৪ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, দালালদের প্ররোচনায় পড়ে সেটেল হওয়ার উদ্দেশ্যে যারা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ভিজিট ভিসা কিংবা কৃষি ভিসার মত সিজনাল ভিসায় কানাডা কিংবা ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন তারা জেনে অথবা না জেনে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছেন। এদের অনেকেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবে কিংবা ধুকে ধুকে মরবে। কারণ বর্তমান বাস্তবতা খুবই ভয়াবহ।

 এজন্য বাংলাদেশী শিক্ষিত তরুণ সমাজকে বলবো, দালালদের চটকদার কথা শুনে ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার জন্য ঝাঁপ দিবেন না। বিদেশে যাওয়ার জন্য যে অর্থ খরচ করবেন, কিংবা বিদেশে গিয়ে যে পরিশ্রম করার কথা চিন্তা করছেন, সেই অর্থ ও পরিশ্রম দিয়ে দেশেই কিছু চেষ্টা করুণ, প্রবাস জীবনের থেকে বহুগুন ভালো থাকতে পারবেন ইনশাল্লাহ।