সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনি কে?

Published from Blogger Prime Android App

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনি কে?

বলতে পারেন, তিনি মহান বীর, যিনি ক্রুসেডারদের হারিয়েছেন বারবার এবং জেরুজালেমকে মুসলিম শাসনাধীন করেছেন। পরিচয় শুধু এটা না। আরও পরিচয় আছে। তিনি কীভাবে সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি হলেন, সেটাও তো দেখতে হবে। আসুন মিলিয়ে নেই- আমরা কি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার আকীদা-মানহাজে আছি কি না? 

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি পারিবারিকভাবে সায়্যিদুনা হযরত আবদুল কাদির জিলানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে সম্পৃক্ত। আল্লামা মাকরিযি রহমাতুল্লাহি আলাইহি জানিয়েছেন যে, সুলতানুল আউলিয়া বাযুল্লাহিল আশহাব শায়খ আব্দুল কাদির জিলানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনাকে দুআ করে দিয়েছিলেন। সময়টা ৫৩৩ হিজরী। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার শায়েখ সায়্যিদুনা হযরত আবদুল কাদির জিলানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার পরে উনার  সন্তান শায়খ আব্দুর রাজ্জাক ইবন আব্দুল কাদির জিলানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে সম্পর্ক  রাখতেন।

সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার পীর ছিলেন শায়খ হুসাইন ইবন ঈসা বা আল কাদিবুল বান আল জিলানি আল হুসাইনি রাহিমাহুল্লাহ (মৃ. ১১৭৭ খ্রি.)। তিনি সায়্যিদুনা আব্দুল কাদির জিলানি রাহিমাহুল্লাহর খাস শিষ্য এবং  জামাতা ছিলেন। সায়্যিদুনা জিলানির ইন্তিকালের পর তাঁর ওসিয়্যত মোতাবেক শায়খ কাদিবুল বান তাঁর গোসল দিয়েছিলেন। এই শায়খের সাথে সাক্ষাতের জন্য সালাহউদ্দীন আইয়ুবী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সুদূর বাগদাদ সফর করেছিলেন। শায়খ তাঁকে যোদ্ধাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য প্রেরণা দিয়েছিলেন, নিজের মুরিদান থেকে বিরাট একটা অংশ তাঁর সাথে পাঠিয়ে দেন। এই মুরিদদের একজন মুখ ঢাকা অশ্বারোহী যোদ্ধা ক্রসেডারদের একজন কমান্ডারকে হত্যা করে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। কেউ আর সামনে আগায়নি।  (নিহাযাতুল মাতালিব ফি আনসাবি ফাতিমাতিয যাহরা, পৃ. ১২)

সায়্যিদুনা হযরত আবদুল কাদির জিলানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার মাদরাসা থেকে কমপক্ষে ৪০০ নামজাদা এমন আলিম-সুফি বেরিয়েছিলেন, যারা তাঁর ইন্তিকালের পর মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছেন এবং মাদরাসা স্থাপন করেছেন। শায়খ জিলানি তাঁদের যে দ্বীনী জাগরণের শিক্ষা দিয়েছিলেন, এইসব শিষ্যরা তা ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং এর ফলেই সুলতান সালাহুদ্দিন সৈন্যবাহিনীর একটা বিরাট অংশ পুরোপুরি আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রাস্তায় ফেদায়ী বাহিনী হিসেবে পেয়েছেন। এটা কথার কথা না। 

হামিদ আল হাররানি (মৃ. ৫৬৯ হি.) বলেন, ‘আমি একদিন শায়খ জিলানির মাদরাসায় এসে একেবারে তঁর কাছে তাঁর জায়নামাযের উপর বসে পড়লাম। তখন আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘হামিদ! তুমি অবশ্যই রাজা—বাদশার গালিচায় বসবে।’ এরপর আমি যখন হাররানে ফিরে আসলাম, সুলতান নুরুদ্দিন জিঙ্গি আমাকে তাঁর সাথে থাকার আদেশ দিলেন। তিনি আমাকে অনেক কাছে আনলেন, নিজের গালিচায় বসালেন এবং ওয়াকফ মন্ত্রণায়লয়ের দায়িত্ব দিলেন। তখন আমার শায়খের সেই কথা মনে হতে লাগলো।

সালাহুদ্দীন আইয়ুবির যা হাত ধরে উঠে এসেছেন, সেই সুলতান নুরুদ্দীন জিংগি রহমাতুল্লাহি আলাইহি হামিদ আল হাররানিকে এতটাই পছন্দ করতেন যে, কেবল তাঁর জন্যই তিনি হাররানে মাদরাসাতুন নুরিয়্যাহ প্রতিষ্ঠা করেন। হাররানে তিনি ছিলেন তাঁর গভর্নর। ইমাম ইবন রজব হাম্বলি রাহিমাহুল্লাহ আয যাইল আলা তাবাকাতিল হানাবিলা গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। সেখানে শায়খ জিলানি হামিদ ইবন মুহাম্মদকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এ কে?’ লোকেরা বলেছিল, ‘এ হলো ফকিহ হামিদ আল হাররানি।’ তখন শায়খ বলেছিলেন, ‘রাজা—বাদশার এর সম্পর্ক হবে একসময়।’ ইবন রজব বলেন, ‘পরবতীর্তে সেটাই হয়েছিল।’

অনুরূপ শায়খ যাইনুদ্দীন ইবন ইবরাহীম ইবন নাজা আল আনসারী আদ দিমাশকীর কথা বলা যায়। তিনি শায়খ জিলানি (রহ.) এর কাছে বাগদাদে শিক্ষাগ্রহণ করার পর দামেস্ক ও মিশর ভ্রমণ করেন। এক সময় তিনি সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি (রহ.) এর খাস পরামর্শদাতায় পরিণত হন। এমনকি তাঁকে সালাহুদ্দিনের আমর ইবনুল আস বলা হতো। এ প্রসঙ্গে মাজিদ কিলানী ‘হাকাযা যাহারা জিলু সালাহিদ্দিন ওয়া হাকাযা আদাত আল কুদস’ বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। 

সুলতান সালাহুদ্দীন যেকোনো যুদ্ধে সুফি শায়খদের তাঁবু সৈন্যদের ঘাঁটিতে বসাতেন। সুফি শায়খ আল্লাহর কাছে দুআ করতে থাকতেন, সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকতেন। জেরুজালেম বিজয়ের সময় এইভাবে আশেপাশের সমস্ত সুফিরা জড়ো হয়ে মহাবিজয় প্রত্যক্ষ করেছিলেন বলেন আরব ঐতিহাসিক ইবনুল ওয়ার্দি আমাদের জানাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁর বিজয় মিশর ও শামের অনেক খিরকাধারী, যাহিদ ও আলিম ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এমনকি তাঁদের কেউই পিছে থাকেননি।’ (ইবনুল ওয়ার্দির তাতিম্মাতুল মুখতাসার ফি আরবাবিল বাশার, ২/১৪৭)

জেরুজালেম বিজয়ে যেসব বিখ্যাত সুফি শায়খ অংশ নেন, তাঁদের মধ্যে আবু আমর আর মাকদিসি, আবু সাওর প্রমুখ অন্যতম। আবু সাওর আসলে তাঁর মূল নাম না। সাওর বা একটা ষাঁড়ের পিঠে চড়ে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন, বলে আবু সাওর নামে তিনি প্রসিদ্ধ হয়ে যান। এই যুদ্ধের  আরেকজন যোদ্ধা সুফি শায়খ আব্দুল্লাহ আল ইউনানিকে অসাধারণ বীরত্বের জন্য সবাই বলতো আসাদুশ শাম বা শামের সিংহ।  

শুধু জেরুজালেম বিজয় নয়, মিশর থেকে শিয়াবাদ হটিয়ে সুন্নিয়ত প্রতিষ্ঠা করাও সুলতান সালাহুদ্দীনের অনেক বড় কৃতিত্ব। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সুলতানী ফরমান জারি করে মানুষের আকীদা সহিহ করা যাবে না। এজন্য তিনি ব্যাপকভাবে সুফিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ইমাম সুয়ুতি এবং মাকরিযির মতে,  মিশরে প্রথম সুফি খানকাহ (সাদুস সুআদা) তিনিই নির্মান করেন। বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি খানকার নামে ওয়াকফ করে দেন। এই খানকায় রুটি-মাংস ইত্যাদি খাবার ব্যবস্থা ছিল। শাসকদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক খানকা নির্মান করেছিলেন। তাঁর পদ্ধতি ছিল যেখানেই যেতেন একটি মাদরাসা এবং তার পাশে একটি রিবাত বা খানকা প্রতিষ্ঠা করা। ইসরায়েলে আক্কা শহর জয় করার পর তিনি দেখলেন, সেখানে ইসতেবার নামে বিরাট একটা দালান আছে। সেটার অর্ধেকটা তিনি ফিকহে শাফেঈর মাদরাসা এবং অর্ধেকটা সুফিদের খানকার জন্য নির্দিষ্ট করে দেন। ইবন জুবায়র তাঁর ভ্রমণকাহিনীতে এসব খানকা প্রতিষ্ঠার জন্য সুলতানের প্রশংসা করেছেন এবং সুফিদের পুরো ব্যাপারটাতেই তিনি চমৎকৃত হয়েছেন। 
সুফিরা সামা বা আধ্যাত্মসঙ্গীত শ্রবণ করে থাকেন। আইয়্যুবি সুফিদের এতটাই ভালোবাসতেন যে, ইবনুল আছির আমাদের জানাচ্ছেন যে, ‘দরবেশ আর সুফিরা তাঁর কাছে আসতেন। তখন তিনি তাঁদের জন্য সামার মজলিসের আয়োজন করতেন। সুফিরা [ভাবোচ্ছাসে] উঠে আন্দোলিত হলে (রকস) তিনিও উঠে দাঁড়াতেন এবং তাঁরা না বসা পর্যন্ত নিজে বসতেন না। (আল কামিল ফিত তারিখ, ১২/৯৭)

সুলতান সালাহুদ্দীন জীবিত ও মৃত বুযুর্গদের কাছ থেকে তাবাররুক হাসিল করতেন। তাঁরা জীবিত হলে সরাসরি দেখা করতেন। নয়তো তাঁদের কবর যিয়ারত করতেন। যেমন সুলতানের জীবনীকার ইবন শাদ্দাদ বলেছেন, সুলতান বরকতের জন্য ইমাম শাফেঈর কবর যিয়ারত করেছেন। (وقد زار  الإمام الشافعى تبركا به) অনুরূপ তিনি সায়্যিদুনা উমর ইবন আব্দুল আযিযের কবর যিয়ারত করেছেন। এবং সেখানে সুফি শায়খ আবু যাকারিয়া আল মাগরিবির সাথে তাঁর দেখা হয়েছে। এই ঘটনার বর্ণনা করে আবু শামা বলেছেন, ‘এসব যিয়ারতে আল মালিক আল মুযাফফর সালাহুদ্দিন মৃত ও জীবিত- উভয়ের থেকে বরকত হাসিল করেছেন। (فقد تبرك الملك المظفر صلاح الدين فى هذه الزيارة بالميت والحى) হালাব জয়ের পর একজন সায়্যিদের মাজার যিয়ারত করতে যেয়ে তিনি সেখানে দশ হাজার দিরহাম দিয়েছিলেন। এছাড়া তারিখুল খুলাফা গ্রন্থে ইমাম সুয়ুতি লিখেছেন, সুলতান সালাহুদ্দিন ইমাম শাফেঈর মাযারের উপর গম্বুজ নির্মান করেন এবং ফিলিস্তিনেও একটি মাজার নির্মান করেন। 

সুলতান সালাহিুদ্দীন মিলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপনকে অত্যন্ত গুরুত্বের চোখে দেখতেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মীলাদুন্নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উদযাপন করতেন। এমনকি কেউ মাউলিদ বিষয়ক কোনো গ্রন্থ লিখলেও লেখককে বিপুল পরিমাণ হাদিয়া দিতেন। ক্রসেডারদের সাথে যুদ্ধের সময় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় আলাদা নাত সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। কবিরা আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রশংসা করতেন এবং তাঁর ওসিলায় আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁর উম্মতের দুঃখ-দুর্দশা দূর করেন, সেই আবেদন ফুটিয়ে তুলতেন। (মুহাম্মদ যগলুল সালামের আল আদাব ফিল আসরিল আইয়ুবি, পৃ. ২৩৬)

এমন একজন কবি ছিলেন, শহীদ ইবন রাওয়াহা আল হামাভি। তিনি  রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াত এবং আল্লাহর কাছে তাঁর ওয়াসিলায় শাহাদাত লাভের আকাঙ্ক্ষায় রওজা শরীফ যিয়ারত করেছিলেন। তাঁর কবিতার দুটি লাইন ছিল:
يا خاتم الرسل سل الله لي + خاتمة محمودة العاقبة
ولاتردن يدي بعدما + مددتها مستشفعا خائبة
‘ওগো সর্বশেষ রাসুল! আল্লাহর কাছে আমার জন্য প্রশংসনীয় পরিণতি প্রার্থনা করুন। আপনার শাফায়াতের প্রার্থী হয়ে যে হাত আমি বাড়িয়েছি, সেই হাতকে আপনি নিরাশ করে ফিরিয়ে দিয়েন না।’ 
পরবর্তীতে ইবন রাওয়াহা যখন ঘুমিয়েছেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইবন রাওয়াহা। তোমাকে কবুল করা হয়েছে।’ এর পর ইবন রাওয়াহা জেরুজালেমে আক্কায় সালাহুদ্দীনের সাথে যোগ দেন এবং শহীদ হন। 

(শায়খ আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ আইনুল হুদা, আল ইহতিফাল বিল মাওলিদি বাইনাল ইফরাতি ওযাত তাফরিত, পৃ. ২৫৩-২৫৪)
আরও অনেক কিছু সুলতান সালাহুদ্দিন ওয়াদ দুনিয়া নিয়ে লেখার আছে। পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল। আরেকদিন ইনশাআল্লাহ জেরুজালেম বিজয়ে সুফিদের অবদান নিয়ে লিখবো। 
লেখায় ভুল-ত্রুটি যা হয়েছে, আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তথ্যগত বা বানানগত কোনো ভুল চোখে পড়লে জানাবেন। এতখানি লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
Abdullah Jobair

0 Comments: