৭৫৮ নং- সুওয়াল : মাসিক মদীনা জানুয়ারী ’৯৭ সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তরটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। আমরা আপনাদের আল বাইয়্যিনাতের সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে তার সঠিক ফায়সালা দিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন করার জন্য অনুরোধ করছি। প্রশ্ন : তবলীগের লোকেরা বলতেছে, দাওয়াত দেয়া এখন ফরযে আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোজাহেদরা বলতেছে জেহাদ করা ফরযে আইন হয়ে দাড়িয়েছে, কোনটা ঠিক?



সুওয়াল : মাসিক মদীনা জানুয়ারী ৯৭ সংখ্যায় প্রশ্নোত্তর বিভাগে নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তরটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। আমরা আপনাদের আল বাইয়্যিনাতের সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে তার সঠিক ফায়সালা দিয়ে বিভ্রান্তি নিরসন করার জন্য অনুরোধ করছি।

প্রশ্ন : তবলীগের লোকেরা বলতেছে, দাওয়াত দেয়া এখন ফরযে আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোজাহেদরা বলতেছে জেহাদ করা ফরযে আইন হয়ে দাড়িয়েছে, কোনটা ঠিক?

উত্তর : উভয়ই ঠিক কথা বলতেছেন। দাওয়াত দেয়া স্ব-স্ব সামর্থ্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলমানেরই দায়িত্ব। তেমনি জেহাদের ডাক আসলে তাতে যোগ দেওয়াও মুসলমানের দায়িত্ব। এটা তেমনি যেমন নামায পড়া ফরয। আবার বছরান্তে মালের যাকাত দেওয়াও ফরয। দাওয়াত এবং জেহাদ একটা আর একটির পরিপূরক। একটি ছাড়া আর একটি পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনা। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, প্রত্যেক মোজাহিদই একএকজন দাওয়াতকর্মী। কারণ জেহাদর অর্থই হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক উনার দ্বীনের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, দ্বীনের মর্যাদা রক্ষা বা বৃদ্ধি কল্পে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা। অপর পক্ষে মহান আল্লাহ পাক উনার দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশে যাওয়ার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, অনেক সংঘাত সংঘর্ষের মোকাবেলা করতে হয় এর নামও তো জেহাদ।

জাওয়াব : মাসিক মদীনার দাওয়াত ও জ্বিহাদ ফরজে আইন হওয়া সংক্রান্ত উক্ত উত্তর সম্পূর্ণ অশুদ্ধ ও জেহালতপূর্ণ হয়েছে। আর এরূপ অশুদ্ধ ও জেহালতপূর্ণ উত্তর স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ফিৎনা সৃষ্টি করে।

দাওয়াত ও জ্বিহাদ ক্ষেত্র ও ব্যক্তিবিশেষে ফরজে আইন, ফরজে কেফায়া ও হারাম। ফরজে আইন হচ্ছে এমন ইবাদত, যা প্রত্যেক ব্যক্তিকেই আলাদাভাবে ফরজ হিসেবে পালন করতে হয়। যেমন-নামা, রোজা ইত্যাদি।

আর ফরজে কেফায়া হচ্ছে এমন ইবাদত, যা প্রত্যেক ব্যক্তিকেই আলাদাভাবে আদায় করতে হয়না। কেউ বা কিছু লোক আদায় করে নিলেই সকলের পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়। যেমন- জানাযার নামাজ পড়া, আলেম হওয়া, হাফেজ হওয়া ইত্যাদি।

মুসলমানদের সমষ্টিগত কাজসমূহ যে ফরজে কেফায়া, সে প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,

ما كان المؤمنون لينفروا كافة.

অর্থ : মুমিনদের জন্য উচিৎ হবেনা যে, তাদের একসাথে কোন কাজে বের হওয়া।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১২২)

ইমাম-মুজতাহিদগণ এ পবিত্র আয়াত শরীফ হতে উসুল বের করেছেন যে, মুমিনদের জন্য সম্মিলিতভাবে কোন কাজ করা ফরজে আইন নয় বরং তা ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। দাওয়াত হচ্ছে এমন একটি ইবাদত, যা ক্ষেত্র ও ব্যক্তিবিশেষে ফরজে আইন, ফরজে কেফায়া ও হারাম। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি যে তার পরিবারের প্রধান, তার জন্য নিজ পরিবারভূক্ত বা অধীনস্থদেরকে আল্লাহ পাক উনার প্রতি দাওয়াত বা আহ্বান করা অর্থাৎ তাকীদ বা উৎসাহ দিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত ও মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম,  হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে থাকার জন্য কোশেশ করা ফরজে আইন।

আর এর জন্য উক্ত পরিবারের প্রধানের বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই।

আর আম বা ব্যাপকভাবে দাওয়াত প্রদান করা ফরজে আইন নয়, বরং তা ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত এবং এ দাওয়াত প্রদান করার জন্য শর্ত হচ্ছে- হক্কানী-রব্বানী আলেম হওয়া, যা হক্কানী-রব্বানী আলেম হওয়া ব্যতীত কোন পরিবারের প্রধানের জন্যও হারাম।

আর যারা সাধারণ লোক (হক্কানী-রব্বানী আলেমও নয় বা কোন পরিবার, গোষ্ঠী বা সমষ্টির প্রধান নয়) তাদের জন্য উভয় প্রকার দাওয়াত দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।

উল্লেখ্য, দাওয়াতের মত জ্বিহাদও একটি ইবাদত, যা সাধারণতঃ ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু ক্ষেত্র বা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তা ফরজে আইন ও হারাম হয়ে থাকে।

জ্বিহাদ দুপ্রকার-  (১) জ্বিহাদে আসগর (ছোট জ্বিহাদ), (২) জ্বিহাদে আকবর (বড় জ্বিহাদ)।

জ্বিহাদে আকবর হচ্ছে- নফসের জ্বিহাদ, যা সর্বাবস্থায় প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য করতে হয়- ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।

এই জ্বিহাদ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে- মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণকে নিয়ে তাবুকের জ্বিহাদ হতে ফেরার পথে ইরশাদ মুবারক করেন,

رجعنا من الجهاد الاصغر الى الجهاد الاكبر.

অর্থ : আমরা ছোট জ্বিহাদ থেকে বড় জ্বিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম।

কাজেই নফসের জ্বিহাদ যেমনি ঘরে নিরিবিলি বসে থেকে করতে হয়, তেমনি জ্বিহাদের ময়দানেও করতে হয়। অর্থাৎ জ্বিহাদের ময়দানে তরবারী বা যুদ্ধাস্ত্র পরিচালনা করবে, তা আল্লাহ পাক উনার জন্য, না গায়রুল্লাহ জন্য? অথবা অন্যের সাথে মুয়ামেলাত-মুয়াশেরাত করবে, কিম্বা নিজে নিজের জন্য কোন কিছু করবে, তা নফসের তাড়নায়, না আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির জন্য?

মূলত জ্বিহাদে আকবর, সাধারণভাবে সকলের জন্যই সর্বাবস্থায় ফরজে আইন। কিন্তু জ্বিহাদে আসগরকে ফরজে আইন বলা সম্পূর্ণরূপে বিভ্রান্তি মূলক ও গোমরাহীপূর্ণ।

মহান আল্লাহ পাক উনার কালেমাকে বুলন্দ করতে গিয়ে মুসলমান ও কাফেরদের মাঝে যে যুদ্ধ হয়, তাকে জ্বিহাদে আসগর বলে।

সাধারণতঃ প্রত্যেক মুসলমান দেশে, দেশ রক্ষা করার জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্যবাহীনি থাকে। যদি কোন বিধর্মী দেশের সৈন্যরা মুসলমান দেশের উপর আক্রমণ করে, তাহলে তাদেরকে প্রতিহত করার দায়িত্ব সৈন্যবাহীনির উপর। তখনও সাধারণভাবে জ্বিহাদ ফরজে আইন হবেনা।

মহান আল্লাহ পাক না করুন যদি মুসলমান সৈন্যবাহিনী পরাস্ত হয়, তাহলে বিধর্মী সৈন্য যে এলাকা দিয়ে মুসলমান দেশে প্রবেশ করবে, সে এলাকার লোকেদের জন্য জ্বিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। আল্লাহ পাক না করুন অতঃপর সে এলাকার লোকেরাও যদি পরাস্ত হয় এবং ব্যাপকভাবে বিধর্মী সৈন্যরা মুসলমান দেশে প্রবেশ করতে থাকে, তাহলে পর্যায়ক্রমে নিকটবর্তী এবং পরবর্তীতে সমস্ত মুসলমান পুরুষের উপর জ্বিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। আল্লাহ পাক না করুন মুসলমান পুরুষরাও যদি পরাস্ত হয়ে যায়, তাহলে মহিলাদের উপরও জ্বিহাদ ফরজে আইন হয়ে যাবে।

আর যদি জ্বিহাদ বলতে বর্তমান প্রচলিত গণতান্ত্রিক ভিত্তিক আন্দোলনকে বুঝানো হয়, তাহলে এ আন্দোলন করা ফরজে আইন বা ফরজে কেফায়া কোনটা তো নয়ই, বরং এ আন্দোলন ইসলাম ও জ্বিহাদের নামে করা হারাম বা কুফুরীর অন্তর্র্ভূক্ত, যা থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফর-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

মূলত সাধারণভাবে দাওয়াত ও জ্বিহাদ কোনটাই ফরজে আইন নয়। যারা ফরজে আইন বলে থাকে, তারা ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।

আবা-৪২

0 Comments: