১৮১ নং- সুওয়াল: মৌলবাদ শব্দটি নিয়ে ইতিমধ্যে আমাদের দেশে যথেষ্ট তোলপাড় হয়েছে। কেউ কেউ মুসলমান হয়ে মৌলবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব করেন, আবার কেউ বলেন যে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা ঠিক নয়। এমতাবস্থায় প্রকৃত ফায়সালা জানালে খুবই উপকৃত হবো।


সুওয়াল: মৌলবাদ শব্দটি নিয়ে ইতিমধ্যে আমাদের দেশে যথেষ্ট তোলপাড় হয়েছে। কেউ কেউ মুসলমান হয়ে মৌলবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ব করেন, আবার কেউ বলেন যে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার করা ঠিক নয়। এমতাবস্থায় প্রকৃত ফায়সালা জানালে খুবই উপকৃত হবো।


জাওয়াব: মৌলবাদ শব্দটি মূলতঃ খ্রীষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। যারা বাইবেলের প্রতিটি বিষয়ের যথার্থতায় এবং আক্ষরিক ব্যাখ্যায় যুক্তিবিহীনভাবে, যাচাই-বাচাই ব্যতিরেকে, ধর্মান্ধের ন্যায়, কুসংস্কারচ্ছন্ন, চরমপন্থীদের মত বিশ্বাসী ছিল।
ইতিহাস :
মৌলবাদ আমেরিকার প্রোটেষ্ট্যান্টদের একটি ব্যাপক আন্দোলনের নাম। মৌলবাদ আন্দোলন স্বাধীন চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে খ্রীষ্টধর্মের মূল তত্ত্বসমূহকে সংরক্ষণের জন্য হয়েছিল।
          উনিশ শতকের শেষের দিকে অনেক স্বাধীন বা উদারমনা ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ বাইবেলের সঠিকত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে। তারা খ্রীষ্ট মতবাদ বা বিশ্বাসের প্রতি ঐতিহাসিক গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়ে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। এই উদারমনাগণ চেয়েছিলেন, খ্রীষ্ট মতবাদ বা বিশ্বাসসমূহকে বিজ্ঞানের নতূন আবিষ্কারের সাথে সমন্বয় করতে। বিশেষ করে জীববিদ্যা ও ভূ-তত্ত্বের ক্ষেত্রে। অনেক খ্রীষ্টানরাই মনে করতো যে, উদারমনাদের এসব কাজ খ্রীষ্টানদের খাঁটিত্ব বজায় রাখার এমনকি খ্রীষ্ট মতবাদ বেঁচে থাকার জন্য বিশেষ রকমের হুমকীস্বরূপ।
          ১৯১২ সালের দিকে কিছু বেনামী লেখক ১২টি ছোট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভলিউমে --- নামে বই বের করে এবং এই বইয়ের নামকরণ থেকেই এই আন্দোলন --- বা মৌলবাদী আন্দোলন নামে আখ্যায়িত হয়।
          লেখকগণ তাদের বইসমূহে এই ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন যে, তারাই যা মনে করছেন, তাই মূল খ্রীষ্টানতত্ত্ব- যা কোনরূপ প্রশ্ন ব্যাতীরেকেই গ্রহণ করতে হবে। এই মতবাদের মধ্যে মূল ছিল পাঁচটি। যথা-
(১) বাইবেলের চূড়ান্তরূপে সঠিকত্ব।
(২) যীশুর মায়ের কুমারী অবস্থায় তাঁর জন্মগ্রহণ।
(৩) যীশুর দেবত্ব।
(৪) পৃথিবীর পাপাচারের জন্য যীশুর জীবন উৎসর্গকরণ।
(৫) ক্বিয়ামত দিবসে শারীরিকভাবে যীশুর পূণরায় আবির্ভাব।
          দুজন ধনী ভ্রাতার খরচে এসব বই চারিদিকে ছড়ানো হয়।
          ১৯৩০ সালের দিকেও এই খ্রীষ্ট মৌলবাদ টিকে ছিল। ১৯৪১ সালে উগ্র মৌলবাদী আমেরিকান কাউন্সিল অব ক্রীষ্টিয়ান চার্চেস গঠিত হয়। পরবর্তী বছর অধিকতর মধ্যপন্থীদের নিয়ে গঠিত হয়; এরাও প্রোটেষ্ট্যান্টদের একটি সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের মৌলবাদীদের রক্ষনশীল ইভানজেলিক্যাল বলা হয়। নব্য মৌলবাদীদের একটি নতূন জাগরণ হয়েছিল ১৯৫০ সালের দিকে। এদের প্রচারের ফলে তা অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করে।
          উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা ও ইতিহাস আলোচনার পর আমরা মৌলবাদ শব্দ ব্যবহার করা জায়েয কিনা, তা তাহক্বীক করবো। ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে মৌলবাদ শব্দটি ব্যবহার করা জায়েয নেই। কারণ, মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
يا ايها الذين امنو لا تقولوا راعنا وقولوا انظرنا واسمعوا. وللكاقرين عذاب اليم.
অর্থঃ- হে ঈমানদারগণ! তোমরা রঈনা বলোনা উনজুরনা বলো এবং শ্রবণ করো (বা শুনতে থাক) আর কাফিরদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।
          এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার শানে নযুলে বলা হয়, ইহুদীরা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দেবার জন্য রঈনাশব্দ ব্যবহার করত যার একাধিক অর্থ। একটি অর্থ হলো আমাদের দিকে লক্ষ্য করুন যা ভাল অর্থে ব্যবহৃত হয়, আর খারাপ অর্থে হে মূর্খ, হে মেষ শাবক! এবং হিব্রু ভাষার যা একটি বদদোয়া। ইহুদীরা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে রঈনা বলে সম্বোধন করত। যাতে প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল খারাপ অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করা। অন্যান্য হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনারা রঈনাশব্দের ভাল অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সম্বোধন করলে তখন ইহুদীরা খারাপ অর্থ চিন্তা করে হাসাহাসি করত। এটা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ভালোভাবে নিতেন না, তবুও কিছু বলতেন না। কেননা, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ওহী ছাড়া কোন কথা বলতেন না। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে-
وما ينطق عن الهوى ان هو الاوحى يوحى.
অর্থঃ- তিনি (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওহী ব্যতীত নিজের থেকে মনগড়া কোন কথা বলেন না।” (সুরা নজম ৩,৪ পবিত্র আয়াত শরীফ)
          এর ফলশ্রুতিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র আয়াত নাযিল করে রঈনাশব্দের বদলে উনজুরনা শব্দ ব্যবহার করতে বললেন। কারণ রঈনাশব্দ ভাল-খারাপ উভয় অর্থে ব্যবহৃত হলেও উনজুরনাশব্দ শুধুমাত্র ভাল অর্থেই ব্যবহৃত হত। তাই যে সকল শব্দ ভাল মন্দ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়, সে সকল শব্দের পরিবর্তে উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ মোতাবেক ওটার সমার্থক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করতে হবে, যা শুধুমাত্র ভাল অর্থই ব্যবহৃত হয়।
          সাধারনতঃ মৌলবাদ শব্দটি দুঅর্থে ব্যবহৃত হয়- আভিধানিক ও ব্যবহারিক। আভিধানিক অর্থে মৌলবাদের অর্থ হলো- যে কোন ধর্মের মূল তত্ত্ব বা মৌলিক বিষয়সমূহ বা মৌলিক মতবাদসমূহ।
          আর ব্যবহারিক অর্থে ধর্মান্ধ চরমপন্থী আমেরিকান খ্রীষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের বাইবেল সম্পর্কীয়  মতবাদকে মৌলবাদ বলে এবং এই অর্থেই এটা অধিক মশহুর।
          উপরোক্ত আয়াত শরীফ অনুযায়ী এক শব্দের যদি একাধিক অর্থ হয়, অর্থাৎ ভাল ও মন্দ হয়, তবে সেটা ব্যবহার করা যাবেনা এবং এ কারণে মৌলবাদ শব্দটি আভিধানিক অর্থে মন্দ না হলেও ব্যবহারিক দিক দিয়ে খুবই খারাপ। কারণ খ্রীষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্টদের প্রতি অবমাননামূলক উক্তি হিসেবে এর উৎপত্তি। আর খ্রীষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্টদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় এটি মুসলমানদের জন্য ব্যবহার করা জায়েয নেই।



মুসলমানদেরকে
মৌলবাদী বলা যাবে কিনা

          মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করেন,
ولا تلمززت تمفسكم ولا تنابزوا با لا لقاب- بئس الاسم الفسوق بعد الا يمان- ومن لم يتب فاولئك هم الظالمون.
অর্থঃ- তোমরা পরষ্পর পরষ্পরকে দোষারূপ করোনা এবং পরষ্পর পরষ্পরকে অশোভনীয় লক্বব (বা উপাধি) দ্বারা সম্বোধন করোনা। (কেননা) ঈমান আনার পর অশ্লীল নাম দ্বারা ডাকা গুণাহ এবং যারা এটা হতে তওবা করলো না তারা জালেমের অন্তর্ভূক্ত।(সুরা হুজুরাত শরীফ)
          উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের নিজেদেরকে দোষারোপ করতে এবং পরষ্পর পরষ্পরকে অশ্লীল, বিশ্রী, অশোভনীয়, খারাপ ও শরীয়তবিরোধী লক্বব (বা উপাধি) দ্বারা সম্বোধন করতে নিষেধ করেছেন। আর  আল্লাহ পাক এটাও বলেছেন, ঈমান গ্রহণ করার পর কাউকেও কুফরী, ফাসেকী লক্বব (উপাধি) দ্বারা সম্বোধন করা গুণাহ্ এবং নিকৃষ্টতম কাজ। কারণ কাউকে যদি অশালীন, অশোভনীয়, অযৌক্তিক মানহানিকর লক্বব (উপাধি) দ্বারা সম্বোধন করা হয়, তবে স্বভাবতঃই সে মনে কষ্ট পেয়ে থাকে। আর  হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, “মুসলমানকে কষ্ট দেয়া কুফরী
          অন্যত্র বলা হয়েছে,
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
মুসলমান সেই, যার হাত ও যবান হতে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।             
আরো বলা হয়েছে,
والمؤمن امنه الناس على دمائهم واموالهم.
মুমিন সেই, যার কাছ থেকে মানুষ তাদের রক্ত ও মাল- সম্পদের ব্যাপারে নিরাপদ থাকে।
          সর্বোপরি এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি কুরআন শরীফে বলেন,
والذين يؤذون المؤمنين والؤمنات مااكتسبوا فقد احتملوا بهتانا واثما مبينا.
যারা কোন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।(পবিত্র সুরা আহযাব শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৮)
          কাজেই উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও  পবিত্র হাদীছ শরীফ অনুযায়ী-
(১) খ্রীষ্টান প্রোটেষ্ট্যান্টদের সাথে তাশাব্বুহ্ বা মিল হওয়ায়,
(২) ভাল অর্থের চেয়ে মন্দ অর্থেই বেশী মশহুর হওয়ায়,
(৩) অশালীন ও অশোভনীয় লক্বব হওয়ায়,
(৪) মুসলমানদের দোষী সাব্যস্ত করায়,
(৫) মুসলমানদের মনে কষ্ট দেয়ায়,
(৬) মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটি একটি অপবাদ হওয়ায় এবং আরো নানাবিধ কারণে ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে মুসলমানদের মৌলবাদী বলা জায়েয নেই।
          অতএব, ইসলামী শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে কোন মুসলমানের পক্ষে মৌলবাদী নাম ধারণ করে ফখর বা গর্ব করা বা গর্ববোধ করা জায়েয নেই। তবে যদি কোন বিধর্মী বা নাস্তিকরা মুসলমানদেরকে মৌলবাদী বলে সম্বোধন করে, তাহলে সেটাও শরীয়তের দৃষ্টিতে গালি হিসেবে গণ্য হবে।
আবা-১৭

0 Comments: