৫৬৪ নং- সুওয়াল :‘আখিরী যুহর’ নামায পড়তে হবে কিনা? কেউ কেউ বলেন যে, আখিরী যুহর নামায না পড়লে বছরের ৫২ ওয়াক্ত যুহরের নামায কাযা হবে, এ বিষয়ে মতামত জানতে চাই।


সুওয়াল : মাসিক পৃথিবী ডিসেম্বর-৯৫ ইং সংখ্যায় নিম্নোক্ত প্রশ্নের উত্তর ছাপানো হয়-
প্রশ্ন : আখিরী যুহরনামায পড়তে হবে কিনা? কেউ কেউ বলেন যে, আখিরী যুহর নামায না পড়লে বছরের ৫২ ওয়াক্ত যুহরের নামায কাযা হবে, এ বিষয়ে মতামত জানতে চাই।
উত্তর : কুরআন হাদীছ ও ফিকহের কোন কিতাবে কোথাও আখিরী যুহর নামে কোন নামাযের হদীস পাওয়া যায়না। কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ যে নামাযের কোন অস্তিত্ব নেই তা পড়ার কথা বলা যায়না। আখিরী যুহর না পড়লে বছরে ৫২ ওয়াক্ত যুহর নামায কাযা হবে, একথাটি ঠিক নয়।
মাসিক পৃথিবী পত্রিকায় প্রদত্ত আখিরী যুহর সম্পর্কিত এ উত্তর কতটুকু শুদ্ধ? নির্ভরযোগ্য দলিল সহ জানায়ে উপকৃত করবেন।

জাওয়াব : কিল্লতে ইলম, কিল্লতে ফাহম (কম জ্ঞান কম বুঝই) হচ্ছে ফিতনার মুল কারণ। আখিরী যোহরেরপবিত্র হাদীছ শরীফ সম্পর্কে মাসিক পৃথিবীর উত্তর শুধু অশুদ্ধই নয়, বরং সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও দলীল বিহীন। যা অনুসরণীয় ইমাম, মুজতাহিদ, ফক্বীহগণের এবং ফতোয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরুদ্ধ মত।
নিম্নে মাসিক পৃথিবীর দলীল বিহীন আপত্তিকর ও বিভ্রান্তিমূলক ভুল উত্তরের সঠিক জাওয়াব দেয়া হলো-
আমরা ইসলাম বলতে মূলতঃ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদেরকেই বুঝে থাকি। অর্থাৎ কোন বিষয় ইসলাম বা শরীয়তসম্মত হওয়ার মাপকাঠি হলো- উপরোক্ত চারটি বিষয়। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আখিরী যোহর বা এহতিয়াতুয যোহর অবশ্যই ইসলামের অন্তর্ভূক্ত। কেননা যদিও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের সরাসরি আখেরী যোহরের কথা উল্লেখ নেই, কিন্তু ইজমা ও ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহের কিতাবসমূহে তা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যেমন- বিখ্যাত কিতাব মারাক্কিউল ফালাহ”-এ উল্লেখ আছে যে,
قوله بصلاة اربع بنية اخر ظهر عليه هو الاحسن. (صفد ৩২৬(
অর্থ : মুছান্নেফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আখেরী যোহরের নিয়তে চার রাকায়াত নামায পড়ে নেয়া সর্বোত্তম।
ইমাম-মুজতাহিদগণ মূলতঃ আখেরী যোহর বা এহতিয়াতুয যোহর পড়ার আদেশ একারণেই দিয়েছেন যে, যেহেতু ইমাম আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে ইমাম আবূ ইউছুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন যে, এক শহরের একের অধিক জায়গায় জুমুয়ার নামায পড়া জায়িয নেই। তবে শহর যদি বড় হয় এবং শহরের মধ্যখান দিয়ে যদি নদী-নালা প্রবাহিত হয়ে থাকে, তাহলে এক শহরে একের অধিক স্থানে জুমুয়া পড়া জায়িয।
আর ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, এক শহরে একের অধিক স্থানে জুমুয়া বিনাশর্তে জায়িয এবং এটার উপরই ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে।
উপরোক্ত ইখতিলাফ বা মতভেদের কারণে পরবর্তী হযরত ইমাম-মুজতাহিদ বা ফক্বীহ উনারা ইজতিহাদ করতঃ ফতওয়া প্রদান করেন যে, ইহতিয়াত বা সাবধানতার জন্য জুমুয়ার নামায আদায় করার পর চার রাকায়াত ইহতিয়াতুয যোহর বা আখেরী যোহরের নিয়তে পড়া উত্তম। যেমন বিশ্ব বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাব শরহে বেকায়াতেউল্লেখ আছে যে,

ঊদূ লেখা ঢুকবে.......................

অর্থ : জুমুয়ার নামাযের পর চার রাকাত (আখেরী) যোহর পড়তে হবে কিনা? ফতোয়ায়ে শামী কিতাবে পড়াকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ঘরের ভিতরে চুপে চুপে পড়ে নিবে। আর ওস্তাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, জুমুয়ার পর বিনা জামায়াতে চার রাকায়াত (ইহতিয়াতুয-যোহর) পড়া মোস্তাহসান (উত্তম)। (১ম জিঃ পৃষ্ঠা ১৭২ উর্দ্দু শরাহ)
ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব রদ্দুল মোহতারেউল্লেখ আছে যে, 
كل موضع وقع الشك فى كونه مصرا اوتعددت الجمة ينبغى لهم ان يصلوا بعد الجمعة اربعا بنية الظهرا حتياط (ج صفه ৪৫)
অর্থ : যে স্থান শহর হওয়ার ব্যাপারে অথবা এক শহরে একের অধিক স্থানে জুমুয়া জায়িয হওয়া না হওয়ার মতবিরোধের কারণে সন্দেহ দেখা দেয়, সে স্থানে জুমুয়ার নামাযের পর আখিরী যোহরের নিয়তে ইহতিয়াত বা সাবধানতার জন্য চার রাকায়াত নামায পড়ে নেয়া উচিত।
উক্ত কিতাবে আরো বলা হয়েছে যে,
لما ابتلى اهل هرو باقامة الجمعتين فيها مع اختلاف العلماء فى جواز هما امرائمة هم بالاربعة بعد هااحتياطا- لا يمنع الشريعة الاحتياط للتقوى.
অর্থ : যখন ইমামগণ একের অধিক স্থানে জুমুয়া জায়িয হওয়ার ব্যাপারে আলিমগণের মতবিরোধ জানতে পারলেন, তখন ইমামগণ জুমুয়ার নামাযের পর চার রাকায়াত ইহতিয়াতুয যোহর পড়ার হুকুম দেন। কেননা শরীয়তে তাক্বওয়ার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করতে নিষেধ করা হয়নি।” (২য় জিঃ ১৪৫)
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে আবেদীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতওয়ায়ে শামীতে বলেন,   
قلت على انه لو سلم ضعفه فالخروج عن خلافه اولى فكيف مع خلاف هئلائ الائمة وفى الحديث متفق عليه فمن اتقى الشبهة استبرأ لدينه وعرضه- ولذا قال بعضهم فيما يقضى صلاة عمره مح انه لم يفيته منها شئ لا يكره لانه احذ بالاحتياط-
অর্থ : আমি বলি এক স্থানে একাধিক মসজিদে জুমুয়া নাযায়িয হওয়ার দলীল জঈফ হলেও যেহেতু এটাতে ইমামগণ মতভেদ করেছেন, সেহেতু চার রাকায়াত ইহতিয়াতুয যোহর পড়ে নেয়াই উত্তম। বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ উনাদের মধ্যে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, যে ব্যক্তি সন্দেহ হতে বাঁচল, সে তার দ্বীন ও সম্মান রক্ষা করলো।
এর উপর ভিত্তি করে কোন কোন ফক্বীহ ফতওয়া দেন যে, যে ব্যক্তির নামায কাযা হয়নি, এমন ব্যক্তিও যদি উমরী কাযা আদায় করে, তবে মাকরূহ হবেনা। কেননা সে এটা ইহতিয়াত বা সাবধানতার জন্য পড়েছে।
উপরোক্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ববিখ্যাত কিতাবসমূহের বরাত দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইহতিয়াত বা সাবধানতার জন্য জুমুয়ার নামাযের পর চার রাকায়াত আখিরী যোহর পড়ে নেয়া জায়িয ও মোস্তাহসান (উত্তম), আর এটাকে অস্বীকার করা গোমরাহীর নামান্তর।
পক্ষান্তরে এটাও দিবালোকের ন্যায় উজ্জ্বল হলো যে, আখিরী যোহরের পবিত্র হদীছ শরীফ সম্পর্কে মাসিক পৃথিবীরবক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল ও জিহালতপূর্ণ। আর তারা ইলমে ফিক্বাহ ও ফিক্বাহের কিতাব সম্পর্কে নেহায়েত অজ্ঞ। কারণ অসংখ্য ফিক্বাহের কিতাবের দলীলের দ্বারা প্রমাণিত যে, আখিরী যোহর বা ইহতিয়াতুয যোহর পড়া জায়িয ও মুস্তাহসান। অতএব, ফিক্বাহের কিতাবের সাথে যাদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই, তাদের পক্ষে আখেরী যোহরের হাদীছ না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
উপরোক্ত দলীল ছাড়াও নিম্নোক্ত কিতাবসমূহে আখেরী যোহর পড়া জায়িয বলা হয়েছে-
ফতওয়ায়ে আলমগীরী, বাহরুর রায়িক, মুহীত্ব, ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, কাফী, দুররুল মুখতার, আইনী, ক্বিনইয়া, গায়াতুল আওতার, কবীরী, ছগীরি, কিতাবুল ফিক্বাহ আলা মাযাহিবিল আরবা, শরহুল বিক্বায়া, ফতহুল ক্বাদীর, ফতওয়ায়ে আযীযী, বাহারে শরীয়ত, ইলমুল ফিক্বাহ, রুকুনুদ্দীন, ফতওয়ায়ে আমিনীয়া ইত্যাদি।
মোটকথা হলো- আখিরী যোহর বা ইহতিয়াতুয যোহর পড়া জায়িয, যা সুন্নাতে উম্মত মোস্তাহসান। এটাকে ফরয, ওয়াযিব মনে করা যেমন জায়িয হবে না, তদ্রুপ জুমুয়া ছহীহ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করাও সঠিক হবে না। তাক্বওয়ার জন্য পড়ে নেয়া উত্তম, তবে না পড়লে গুণাহগার হবে না এবং জুমুয়ার নামাযেরও কোন ক্ষতি হবেনা।
সুতরাং যারা বলে যে, আখিরী যোহর না পড়লে বছরে ৫২ ওয়াক্ত নামায কাযা হবে, এটা তাদের মনগড়া বানানো কথা, যা সম্পূর্ণ শরীয়ত উনার খেলাফ।

0 Comments: