৫৬২ নং- সুওয়াল :জুমুয়ার খুতবা পড়ার আগে যে আযান দেয়া হয়, এই আযানের শেষে কি আযানের দোয়া পড়তে হয়?


সুওয়াল : মাসিক মদীনা জানুয়ারী-১৯৯৬ইং সংখ্যায় নিম্মোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপানো হয়-
প্রশ্ন : জুমুয়ার খুতবা পড়ার আগে যে আযান দেয়া হয়, এই আযানের শেষে কি আযানের দোয়া পড়তে হয়?
উত্তর : খুতবা দেয়ার জন্য ইমাম যখন মিম্বরে চলে আসেন তখন থেকে শুরু করে যেকোন প্রকার নামায পড়া বা বাক্যালাপ করা হাদীছের সরাসরি নির্দেশ অনুযায়ী নিষিদ্ধ। এ কারণে খুতবার আযানের পর দোয়া পড়াও নিষিদ্ধ।
মাসিক মদীনার প্রদত্ত উক্ত উত্তর কতটুকু শুদ্ধ হয়েছে? নির্ভরযোগ্য দলীলসহ জানিয়ে পথভোলা মানুষের সঠিক পথের সন্ধান দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াব : মাসিক মদীনার প্রদত্ত উত্তর সম্পূর্ণই অশুদ্ধ ও ভুল হয়েছে। কেননা ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও দোয়া পড়া শুধু জায়িযই নয় বরং সুন্নত উনার অন্তর্ভূক্ত। যার স্বপক্ষে বহু নির্ভরযোগ্য দলীলসমূহ রয়েছে। তবে কেউ কেউ নিম্মোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা ছানী আযানের পর দোয়া করাকে নাযায়িয বলে থাকেন-
اذاخرج الامام فلاصلوة ولا كلام. (طير انى شريف(
ইমাম যখন (খুৎবার জন্য) বের হয়, তখন নামায পড়া ও কথা বলা নিষেধ। (তিবরানী শরীফ)
যা ইলমে হাদীছ ও ইলমে ফিক্বাহ সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার পরিচয় বহন করে। কেননা আলোচ্য পবিত্র হাদীছ শরীফখানা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন উদ্ধৃত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় ছাহেবাইন অর্থাৎ ইমাম আবূ ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা বলেন, ইমাম ছাহেব হুজরা (রুম বা কক্ষ) হতে বের হলে নামায পড়া নিষিদ্ধ, কিন্তু খুৎবা শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত (দ্বীনি) কথা বলা জায়িয। (আলমীরী, কাফী, সিরাজুল ওয়াহহাজ, তাহতাবী)
এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুয়াত্তা শরীফএ উল্লেখ করেন, ইবনে শিহাব জুহুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
خروج الامام يقطع الصلوة وخطبته يقطع الكلام.
অর্থ : ইমাম ছাহেবের আগমন নামাযকে বন্ধ করে দেয় এবং উনার খুৎবা কথাবার্তাকে বন্ধ করে দেয়।
অর্থাৎ ইমাম সাহেব যখন খুৎবার জন্য হুযরা (রুম বা কক্ষ) হতে বের হবেন, তখন নামায (সুন্নত বা নফল) পড়া নিষেধ। আর  যখন খুৎবা শুরু করে দিবেন, তখন নামাযের সাথে সাথে কথা-বার্তা বলাও নিষেধ। কাজেই খুৎবা শুরু করার পূর্বে দোয়া-দুরূদ, তাছবীহ-তাহলীল ও দ্বীনি কথাবার্তা বলা জায়িয। তবে জুমুয়ার ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া এবং ছানী আযানের পর দোয়া করা বা পড়া সম্পর্কে আইম্মায়ে মুজতাহিদগণের মধ্যে ইখতিলাফ (মতবিরোধ) রয়েছে। যেমন- কেউ কেউ বলেন, হযরত ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে মাকরূহ তানযীহী। কিন্তু ছাহেবাইন রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম আহম্মদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের মতে মুস্তাহাব। (হিদায়া, নূরুদ্দেরায়াহ, নূরুল হিদায়া, ইনায়া, নিহায়া, ইমদাদুল মুফতীন, মায়ারেফে মাদানিয়া)।
তবে ছহীহ ক্বওল মতে ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকটও ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও দোয়া পড়া মাকরূহ নয়। যেমন কিতাবে উল্লেখ করা হয়,
واماقبل الشروع بعد صعوده على المنبر فيكره الكلام الدنيوى اتفاقا- واما اللكلام الدينى كالتسبيح والتهليل قلايكره عند هما وروى بعض المشائخ عنه انه بكره- والاصح انه لايكره، عنده ايضا صرحبه فى النهاية وغيره- فقلى هذا لا يكره اجابة اذان الثانى ودعاء الوسيلة بعده مالم يشرع الامام فى الخطبة وقد ثبت ذالك من فعل معا وية رضى الله عنه فى الصحيح البخارى حاشيهء شرح وقاية.

অর্থ : ইমাম ছাহেব মিম্বরে উঠে খুৎবা পাঠ শুরু করার পূর্বে দুনিয়াবী (পার্থিব) কথাবার্তা বলা সর্ব সম্মতিক্রমে মাকরূহ। আর ইমাম আবূ ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে দ্বীনী কথাবার্তা যেমন, তাসবীহ-তাহলীল, দোয়া-দরূদ পাঠ করা মাকরূহ নয়।
কোন কোন মাশায়িখ বর্ণনা করেন যে, ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট জুমুয়ার ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া মাকরূহ। তবে অধিক সহীহ মত হলো- ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকটও ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া মাকরূহ নয়। এ ব্যাপারে নেহায়া ও অন্যান্য কিতাবে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও খুৎবা শুরু করার পূর্বে আযানের দোয়া পড়া মাকরূহ নয় (বরং জায়িয)। এটা ছহীহ বুখারী শরীফ উনার মধ্যে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আমল দ্বারাও প্রমাণিত। এরূপ শরহে বিকায়া, হিদায়া, নিহায়ার হাশীয়াতেও উল্লেখ আছে।
আর জুমুয়ার নামাযের ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া এবং পরে দোয়া করা হযরত ছাহাবা আজমাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের যুগেও পরিলক্ষিত হয়। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, 
عن ابى امامة قال سمعت معاوية بن ابى سفيان رضى الله عنهما وهو جالس على المبنزاذن المؤذن فقال الله اكبر الله اكبر الخ- فلما ان قضى التذين قال يا ايها الناس حين اذن المؤذن يقول ما سمعتم منى من مقالتى. (بخارى شريف، نسائ شريف(
হযরত আবূ উমামাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- আমি শুনেছি বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি জুমুয়ার দিন মিম্বরে বসে মুয়াজ্জিনের আযানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আযানের শব্দসমূহকে উচ্চারণ করেন এবং আযান শেষে বলেন, হে লোক সকল, আমি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জুমুয়ার দিন মিম্বরে বসা অবস্থায় মুয়াজ্জিনের আযান শ্রবণে এরূপ বলতে শুনেছি, যেরূপ তোমরা আমার থেকে শুনতে পেলে।” (বুখারী শরীফ, নাসায়ী শরীফ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত আছে,
قال النبى صلى الله عليه وسلم- من قال حين يسمع الاذان والاقامة اللهم رب هذه الدعوة الخ- حلت له شفا عتسى يوم القيامة. (بخارى شريف(
অর্থ : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আযান ও ইক্বামত শ্রবণ করে, আল্লাহুম্মা রব্বা হাজিহিদ দাওয়াতি ..... এ দোয়া পাঠ করবে, তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ অবধারিত। (বুখারী শরীফ) ওমদাতুর রিওয়াইয়্যাহ কিতাবে উল্লেখ আছে, “সানী আযানের পর দোয়া করা যাবে, কিন্তু ইমাম ছাহেবের খুৎবা শুরু করার পূর্বে তা করতে হবে।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, জুমুয়ার সানী আযানের জাওয়াব দেয়া জায়েয। আর ছানী আযানের পর খুৎবা শুরু করার পূর্বে যদি দ্বীনি কথাবার্তা বলা নিষেধ হতো, তবে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আযানের পর কথা বলতেন না। আর তাই বুখারী শরীফ উনার শরাহ আইনী কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
مما يستفد منه تعلم العلم وتعليمه من الامام وهو على المنبر وفيه اجبة الخطيب للمؤذن وهو على المنبر وفيه قول المجب "وانا كذالك" وظاهره ان هذا المقدار يكفى لكن الاولى ان يقول مثل قول المؤذن. (عينسى شرح بخارى(
অর্থ : উল্লিখিত (হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আযানের পর কথা বলা সংক্রান্ত) পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা (নিম্নলিখিত) বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, (১) খতীব মিম্বরে থাকা অবস্থায় মোক্তাদীগণকে কোন মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়া। (২) মোক্তাদীগণ কোন মাসয়ালা শিক্ষা করা। (৩) মুয়াজ্জিনের আযানে (আমি এরূপ বলেছি) শ্রোতাদের জাওয়াব দেয়া জায়িয।
প্রকাশ থাকে যে, ঐভাবে সংক্ষেপে জাওয়াব দিলেও চলবে, তবে পরিপূর্ণ জাওয়াব দেয়াই উত্তম।” (আইনী শরহে বুখারী)
উপরোক্ত কিতাবের ইবারত দ্বারাও প্রমাণিত হলো যে, ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া, দোয়া পড়া এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক শুনে দরূদ শরীফ পড়া জায়িয। শুধু তাই নয়, ছানী আযানের জাওয়াব দেয়ার সাথে সাথে আযানের পর খুৎবা শুরু করার পূর্বে হাত উঠিয়ে মুনাযাত করাও জায়িয।
অতএব, মদীনা সম্পাদকের উক্ত তাহক্বীক্ব বিহীন মনগড়া ফতওয়া প্রদান করা, জায়িযকে নাযায়িয আর সুন্নতকে বিদয়াত বলা, চরম গোমরাহীর নামান্তর।
[ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত শরীফ পত্রিকার ১৮তম সংখ্যা পড়ে দেখুন। সেখানে বিশ্ব বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাব হতে অসংখ্য দলীল-আদীল্লা দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও হাত তুলে মুনাযাত করা জায়িয। ]
 আবা-৩২

১০ নং- আযান ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহকাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-



0 Comments: