( পূর্ব প্রকাশিতের পর )
গবেষণা কেন্দ্র
মুহম্মদীয়া জামিয়া
শরীফ
সমস্ত প্রশংসা
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম আল্লাহ্ পাক-এর হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি। মহান আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ
রহ্মতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামাজ ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া,
মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী
সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার
প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামাজ জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার
সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরজ নামাজের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইন্জেকশন নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়
সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্-এর
নামাজে বা অন্যান্য সময় কোরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার
সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্ নামাজ বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে
ফতওয়া এবং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর (১৫তম) ফতওয়া হিসেবে আযান ও ছানী
আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করতে
পারায় মহান আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]
ছানী আযান সম্পর্কিত
ইজ্মায়ে আযীমতের ব্যাখ্যা ও আহ্কাম
আমীরুল মু’মিনীন, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ইজ্তিহাদ দ্বারা উদ্ভাবিত “জুমুয়ার ছানী আযান” শরীয়তের তৃতীয় দলীল ইজ্মায়ে আযীমত দ্বারা প্রমাণিত। অর্থাৎ জুমুয়ার ছানী আযান মসজিদের
ভিতরে, মিম্বরের নিকট দেয়ার ব্যাপারে হযরত
সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা তথা ইজ্মায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে
বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
الاجماع (ইজ্মা) শব্দের লোগাতী বা আভিধানিক
অর্থ হলো- “আল ইত্তেফাক্ব” (الاتفاق) অর্থাৎ ঐক্যমত।
আর اجماع
ইজ্মার শরয়ী বা ইস্তেলাহী অর্থ হলো-
اتفاق
مجتهدين صالحين امة محمد صلى الله عليه وسلم فى عصر واحد على امر قولى وفعلى.
অর্থঃ- “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মতের ছালেহ্ (নেক্কার) মুজ্তাহিদগণের
দ্বারা একই সময়ে কোন কথা বা কাজের মধ্যে ঐক্যমত পোষণ করা।”
(নূরুল আনোয়ার ফী শরহিল মানার)
এখানে লক্ষণীয়
বিষয় এই যে, মুজ্তাহিদ অর্থাৎ
যিনি ইজ্তিহাদ করবেন, তাঁকে অবশ্যই ছালেহীনগণের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে, আদেল হতে হবে, সুন্নতের পূর্ণ পাবন্দ হতে হবে, ছগীরাহ্ গুণাহ্ও তাকে পরহেয করতে হবে।
অতএব, কোন বিদ্য়াতী ও হারাম কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ইজ্তিহাদ শরীয়তে
গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন বর্তমানে অনেক ওলামায়ে “ছূ” বা দুনিয়াদার, তথাকথিত আলেমরা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ছবি তোলার কাজে
লিপ্ত, অথচ শরীয়তে ছবি তোলা সম্পূর্ণ হারাম।
তারা ইসলামী হুকুমত জারী করার দোহাই দিয়ে গণতন্ত্র ভিত্তিক আন্দোলনে জড়িত অথচ শরীয়তের
দৃষ্টিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পূর্ণই হারাম ও নাজায়েয। সুতরাং এ ধরণের কোন তথাকথিত আলেম বাহ্যিক দৃষ্টিতে
যতই ইল্মের দাবিদার হোক না কেন, হাক্বীক্বতে সে মুজ্তাহিদ হওয়ার বিন্দুমাত্র উপযুক্ত নয়। এরূপ ব্যক্তির দ্বারা
ইজ্তিহাদের প্রশ্নই উঠেনা। তা সত্ত্বেও যদি সে মুজ্তাহিদ দাবী করে বা কোন প্রকার ইজ্তিহাদ
করে তবে তার মেছাল হবে- ইবলীসের মতই। কারণ ইবলীসই সর্ব প্রথম মনগড়া ও গোমরাহীমূলক ইজ্তিহাদ
করেছিল। যার ফলে সে চির লা’নতী ও জাহান্নামী হয়ে যায়। যেমন- এ প্রসঙ্গে পবিত্র কালামে পাকে এরশাদ হয়েছে,
واذ قال
ربك للملا ئكة اسجدوا لادم فسجدوا الا ابليس.
অর্থঃ- “আর যখন আপনার রব (ইবলীস সহ) সকল ফেরেশ্তদের প্রতি হযরত
আদম (আঃ)কে সিজ্দা করার নির্দেশ দিলেন। তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই তাঁকে সিজ্দা করলো।” (সূরা বাক্বারা/২৪)
হযরত আদম (আঃ)কে সিজ্দা না করার কারণে মহান আল্লাহ্ পাক ইবলীসকে জিজ্ঞাসা করলেন,
ما منعك
الا تسجد اذا امرتك.
অর্থঃ- “(হে ইবলীস) কোন্ জিনিস (আদম (আঃ)কে) সিজ্দা করা থেকে তোকে
বিরত রাখলো।” (সূরা আরাফ/১২)
ইবলীস তখন (মনগড়া) ইজ্তিহাদ করে বললো,
انا خير
منه خلقتنى من نار وخلقته من طين.
অর্থঃ- “(হে আল্লাহ্ পাক) আমি তাঁর থেকে উত্তম। কারণ আপনি আমাকে
আগুণ থেকে তৈরী করেছেন, আর তাঁকে (আদম (আঃ)কে) মাটি থেকে তৈরী করেছেন। (সূরা আ’রাফ/১২)
কাজেই আগুণের
স্বভাব হলো- উপরে থাকা, আর মাটির স্বভাব হলো- নীচে থাকা, তাই আমি আগুণ হয়ে মাটিকে সিজ্দা করতে পারিনা।”
উল্লেখ্য, ইবলীসের উক্ত
ইজ্তিহাদ ছিল মনগড়া ও মহান আল্লাহ্ পাক-এর হুকুমের সম্পূর্ণই খেলাফ। যার ফলে তার সে
ইজ্তিহাদই তাকে চির জাহান্নামী, লা’নতী ও চরম গোমরাহীতে নিপতিত করেছে।
যে সম্পর্কে কালামে পাকে এরশাদ হয়েছে, ابى واستكبر
وكان من الكافرين.
অর্থঃ- “(ইবলীস) সিজ্দা করতে অস্বীকার করলো এবং অহংকার করে (মনগড়া
ইজ্তিহাদ করলো।) তাই সে কাফেরদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।” (সূরা বাক্বারা/২৪)
তদ্রুপ বলতে
হয়, যারা শরীয়তের খেলাফ প্রকাশ্য হারামগুলোকে
মনগড়া ও শরীয়ত বিরোধী ইজ্তিহাদ করতঃ হালাল করতে চায়, তারাও ইবলীসের খাছ অনুসারী এবং গোমরাহ্ রূপেই সাব্যস্ত।
এখানে আরো উল্লেখ্য
যে, উপরোক্ত হারাম বিষয়গুলোকে মা’জুর হিসেবে গণ্য করার কোন অবকাশ নেই। আর মা’জুরের ক্ষেত্রে নতুন করে ইজ্তিহাদ করারও কোন সুযোগ নেই।
কারণ এ সম্পর্কিত ইজ্তিহাদ পূর্ব থেকেই হয়ে আছে।
সুতরাং
"مجتهدين صالحين" (মুজতাহিদীনা
সলেহীনা) “নেককার মুজতাহিদ” বাক্য দ্বারা বিদ্য়াতী ও ফাসেক তথা ওলামায়ে “ছূ”দের মনগড়া ইজ্তিহাদ বাতিল বলে গণ্য হবে।
ইজ্মার রোকন
বা প্রকারভেদ
ও তার সংজ্ঞা
ইজমার রোকন দু’টি অর্থাৎ ইজ্মা দু’প্রকার-
(১) (عزيمت) আযীমত,
(২) (رخصت) রোখসত।
১। ইজ্মায়ে আযীমতের
সংজ্ঞা
মুজ্তাহিদ ইজ্তিহাদ
করার পর তাঁর যুগের কেউ যদি (যে কথা বা কাজের উপর ইজ্তিহাদ করা হয়েছে) সে বিষয়ে কোন
দ্বিমত পোষণ না করে অর্থাৎ সকলেই তা শরীয়তের হুকুম হিসেবে মেনে নেয়, যেমন এরূপ বলে যে, আমরা সকলেই এটা মেনে নিলাম অথবা ওটা যদি ল্পম্ল‘ৈ বা কাজ হয়, আর সকলেই ঐ কাজ
করতে শুরু করে দেয়, তবে এ ধরণের ইজ্মাকেই ইজ্মায়ে আযীমত বলে।
এ প্রকার ইজ্মার
মধ্যে সর্বত্তোম ও সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ইজ্মা হলো- হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের
ইজ্মা বা ঐক্যমত। এ ধরণের ইজ্মা কোরআন শরীফের আয়াত শরীফ ও মুতাওয়াতির হাদীস শরীফের
মতই হুজ্জত বা দলীল। যেমন- হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর খিলাফত বা খলীফা হওয়ার ব্যাপারে
সকল সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা বা ঐক্যমত। অনুরূপ বর্তমান আলোচ্য ফতওয়া অর্থাৎ
জুমুয়ার ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে দেয়ার ব্যাপারে রয়েছে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের সর্বসম্মত
রায় বা ইজ্মা। কারণ হযরত ওসমান (রাঃ) কর্তৃক ছানী আযান সম্পর্কিত হুকুম জারী হবার পর
তাঁর যুগে বা সময়কালে কোন সাহাবী (রাঃ) এ ব্যাপারে এখতেলাফ বা মতভেদ করেছেন, এমন কোন প্রমাণ নেই। পরবর্তীতে আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের
কোন ইমাম এখতেলাফ করেছেন, তারও কোন প্রমাণ নেই।
মূলতঃ এ ধরণের
ইজ্মাকে অর্থাৎ ইজ্মায়ে আযীমতকে অস্বীকার করা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।
২। ইজ্মায়ে রোখ্সতের
সংজ্ঞা
ইজ্তিহাদের বিষয়
নিয়ে মুজ্তাহিদগণের মধ্যে এখতেলাফ বা মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়া, কোন কোন সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের কোন কোন ফায়সালার ব্যাপারে
ইমামগণের মধ্যে মতদ্বৈততা সৃষ্টি হওয়া, কোন মুজ্তাহিদ কোন বিষয়ে মত প্রকাশের পর অন্য কোন মুজ্তাহিদ কর্তৃক সে বিষয়ে ভিন্নমত
পোষণ করে তা প্রকাশ করা বা না করা অথবা সে বিষয়ে কোন মত পোষণ না করে চুপ থাকা। আর এটাকেই
ইজ্মায়ে রোখ্সত বলে। ইজ্মায়ে রোখ্সতকে ইজ্মায়ে সুকূতীও বলে। আমাদের হানাফীদের নিকট
ইজ্মায়ে রোখ্সত বা সুকূতী গ্রহণযোগ্য, আর ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এটার বিপরীত মত পোষণ করেন।
ইজ্মার শরয়ী
আহ্কাম
মূলতঃ ইজ্মাকে
অর্থাৎ ইজ্মায়ে আযীমতকে অস্বীকার করা, কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফকে
অস্বীকার করারই নামান্তর, যেটা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই কুফরী। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক রাব্বুল আলামীন
কালামে পাকে এরশাদ করেন,
ومن
يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ما تولى ....
الخ.
অর্থঃ- “কারো নিকট হিদায়েত বিকশিত হওয়ার পরও যদি সে রাসূলে পাক
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচরণ করে, আর মু’মিনগণের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথের
অনুসরণ করে, আমি তাকে সে
দিকেই ফিরাবো, যে দিকে সে ফিরেছে।” (সূরা নেসা/১১৫)
বিখ্যাত মুফাস্সির, আলেমে হক্কানী, শায়খে রব্বানী, শায়খ আহ্মদ ইবনে আবূ সাঈদ মুল্লা জিউন (রঃ) উপরোক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে বলেন যে,
فجعلت
مخالفة المؤمنين مثل مخالفة الرسول فيكونجما عهم كخبر الرسول حجة قطعية.
অর্থঃ- “উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এটাই সাব্যস্ত হলো যে, মু’মিনগণের বিরোধীতা করা মূলতঃ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরোধীতা
করারই নামান্তর। তাই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস শরীফের ন্যায়
মু’মিনগণের ইজ্মাও অকাট্য ও প্রামান্য
দলীল বলে পরিগণিত হবে।” (নূরুল আনোয়ার)
আর সে কারণেই
মুল্লা জিউন (রঃ) তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে আহ্মদী”তে ইজ্মার আহ্কাম সম্পর্কে চুড়ান্ত রায় পেশ করে বলেন,
فيكون
الاجماع حجة يكفر جاحده كالكتاب وسنة.
অর্থঃ- “ইজ্মায়ে আযীমত কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের মতই একটি অকাট্য
দলীল। যে ব্যক্তি এ ইজ্মাকে অস্বীকার করলো, সে মূলতঃ কুফরী করলো।”
উল্লেখ্য, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে ইজ্মার
প্রয়োজনীয়তা ছিলনা। ইজ্মার প্রচলন ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণের যুগে। উক্ত আয়াত শরীফ যেহেতু তাঁদের সময়কালে নাযিল হয়েছে, তাই হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণই এটার খাছ লক্ষ্যস্থল।
আহ্কামে শরীয়তের
দিক নির্দেশনা ও তার ফায়সালার ক্ষেত্রে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা বা ঐক্যমত
সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পাক কোরআন মজীদে এরশাদ করেন,
كنتم خير
امة اخر حت للناس الخ.
অর্থঃ-“তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে...... ।” (সূরা ইমরান/১১০)
ইমাম ইবনে সালাহ্
(রঃ) এ আয়াত শরীফের তাফ্সীরে উল্লেখ করেন,
وقبل
اتفاق المفسرين على انه وارد فى اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم.
অর্থঃ-“মুফাস্সিরীনগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, এ আয়াত শরীফ রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর
হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্
পাক কোরআনুল কারীমে আরো বলেন,
محمد
الرسول الله والذين معه اشداء على الكفار رحماء بينهم الخ.
অর্থঃ- “মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাক-এর
রাসূল, আর তাঁর সাহাবা (রাঃ)গণ কাফেরদের
প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে একে অপরের প্রতি
সহানুভূতিশীল ..........।” (সূরা ফাতহ্ /২৯)
আল্লাহ্ পাক
আরো বলেন,
كذالك
جعلناكم امة وسطا لتكنوا شهداء على الناس.
অর্থঃ- “একইভাবে তোমাদেরকে
আমি ন্যায়পরায়ন (মধ্যস্থতাকারী) উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করেছি, যাতে তোমরা (ক্বিয়ামত দিবসে) অন্যান্য উম্মতের সাক্ষী
হতে পার।” (সূরা বাক্বারা/১৪৩)
ইমাম ইবনে সালাহ (রাঃ) “মোকাদ্দিমায়ে ইবনুস্ সালাহ্” কিতাবে এবং মুল্লা জিউন (রঃ) “নুরুল আনোয়ার” কিতাবে উক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা হযরত সাহাবা-ই -কিরাম (রাঃ)গণের ইজৃমা ছাবেত করেছেন।
অতএব, হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা, তা কোরআন শরীফের দ্বারাই প্রমাণিত। কাজেই “ইজ্মায়ে সাহাবাকে” অস্বীকার করা কোরআন শরীফের আয়াত শরীফকে অস্বীকার করার অনুরূপ, যা সকলের মতেই কুফরী।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য
যে, ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে দেয়াই ইজ্মায়ে আযীমত। যদিও সাইয়্যিদুল
মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে মসজিদের
বাইরে দরজায় দেয়া হতো। কেননা অবস্থার প্রেক্ষাপটে এমন অনেক মাস্য়ালাই প্রবর্তিত হয়েছে, যা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে
প্রচলিত ছিল, কিন্তু হযরত
সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের খিলাফতকালে তা পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন মহিলাদের মসজিদে গিয়ে
জামায়াতে নামাজ পড়া। এটা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে প্রচলিত
ছিল, কিন্তু হযরত ওমর ইব্নূল খাত্তাব
(রাঃ) খেলাফতে আসীন হয়ে মহিলাদেরকে মসজিদে এসে জামায়াতে নামাজ পড়া নিষেধ করে দেন।
অতঃপর মহিলারা
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করলে তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে এখন যেরূপ বেপর্দাবস্থা চালু হয়েছে, তা যদি আল্লাহ্
পাক-এর রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতেন, তিনিও তোমাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন।
অনূরূপভাবে যদিও
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে একটিমাত্র আযানের প্রচলন ছিল, হযরত ওসমান (রাঃ) অবস্থার পরিবর্তন হেতু হযরত সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণের পরামর্শক্রমে মসজিদের বাইরে আরেকটি আযানের ব্যবস্থা এবং হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার আযানকে (যা দরজায় দেয়া হতো) স্থানান্তরিত করে, মসজিদের ভিতরে ইমামের সম্মূখে, মিম্বরের নিকট দেয়ার ব্যবস্থা করেন, যার উপর হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা প্রতিষ্ঠিত
হয়। অর্থাৎ সকলেই তা মেনে নেয়। আর সে হতে আজ পর্যন্ত এ নিয়মেই জুমুয়ার আযান দেয়া হয়।
যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয়,
الاذان
الشالث هوا لا ول وحو دا اذا كان مشرو عيته با جتهاد عثمان وموا نقه سائر الصحابة
له بالسكوت وعدم الانكار فصار اجماعا.
অর্থঃ- “তৃতীয় আযান, এটাই মুলতঃ প্রথম আযান, (তৃতীয় এ জন্য বলা হয় যে, ইক্বামতকেও আযান বলা হয়) যা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ইজ্তিহাদের দ্বারা সাব্যস্ত করা
হয়। (যখন হযরত ওসমান (রাঃ) দ্বিতীয় আরেকটি আযানের প্রচলন করেন) তখন প্রায় সকল সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণই তা জ্ঞাত ছিলেন। কেউ এটার ব্যপারে প্রতিবাদ না করার কারণে এর উপর ইজ্মা তথা
ইজ্মায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হযে যায়। (আইনী শরহে বোখারী, হাশিয়ায়ে আবু দাউদ)
আমীরুল মু’মিনীন, হযরত ওসমান (রাঃ) যে শুধূ একটি আযান বৃদ্ধি করেছেন তা নয়, বরং হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সারৗাম-এর সময়কার
আযানকে (যা দরজায় দেয়া হতো) স্থানান্তরিত করে মসজিদের ভিতরে, ইমামের সম্মুখে, মিম্বরের নিকট দেয়ার ব্যবস্থা করেন। যেমন এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত ও মশহুর তাফসীর গ্রন্থ
তাফসীরে আহ্কামুল কোরআন লিল্ কুরতুবীতে” উল্লেখ আছে যে,
زاد
عشمان رضى الله عنه اذانا ثانيا يؤذنون بمدينة السلام ويعد اذان المنار بين يدى
الامام تحت المنبر.
অর্থঃ- “হযরত ওসমান (রাঃ) মদীনায় দ্বিতীয় আরেকটি আযান বৃদ্ধি
করেন। অতঃপর ছানী আযানটি ইমামের সম্মুখে, মিম্বরের নিকট দেয়া হয়।”
অতএব, খোলাফা-ই-রাশেদীন বা হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রাঃ)গণের উদ্ভাবিত
কোন বিষয় অনুসরণ করা আমাদের জন্য সর্বতোভাবেই ওয়াজিব, যেমনিভাবে রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুসরণ করা ওয়াজিব। কারণ
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
فعليكم
بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المديين.
অর্থঃ-“তোমাদের জন্য আমার ও আমার হিদায়েত প্রাপ্ত খোলাফা-ই-রাশেদীন-এর
(উদ্ভাবিত। সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরা ওয়াজিব।” (মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত্ ত্বীবী, মিরআতুল মানাজীহ্)
সুতরাং উপরোল্লিখিত
দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হলো যে, জুমুয়ার ছানী আযানের প্রচলন ও তা মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে দেয়া হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা তথা
ইজ্মায়ে আযীমত দ্বারা সাব্যস্ত এবং সুন্নতে সাহাবা (রাঃ)-এর অন্তর্ভূক্ত।
মোটকথা হলো-
মত্লক্ব আযান অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান ও জুমুয়ার প্রথম আযান মসজিদের বাইরে
দেয়া সুন্নত, মসজিদের ভিতরে
দেয়া মাকরূহ্ তান্যীহী। আর শুধুমাত্র জুমুয়ার ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, ইমামের সম্মুখে দেয়া সুন্নতে সাহাবা (রাঃ)। যা হযরত সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণের ইজ্মা তথা ইজ্মায়ে আযীমত দ্বারা প্রমাণিত। এ ইজ্মাকে অস্বীকার করা সকলের
মতেই কুফরী।
ছানী আযান সম্পর্কিত
কতিপয় সংশয় নিরসন
(১)
উল্লেখ্য, প্রদত্ত ফতওয়ায় জুমুয়ার ছানী আযান মসজিদের দরজায় বা বাইরে
দেয়ার পক্ষে পেশকৃত হাদীস শরীফকে মানসুখ বলা হয়েছে। এখন কেউ কেউ বলতে পারেন- উক্ত হাদীস
শরীফখানা যে মান্সুখ, তার পক্ষে দলীল কি? আর মান্সুখ অর্থই বা কি?
উপরোক্ত বক্তব্যের
প্রেক্ষিতে বলতে হয় যে, প্রদত্ত ফতওয়ায় যে হাদীস শরীফকে মানসূখ বলা হয়েছে, তা হাদীস শরীফের কিতাব “আবূ দাউদ” শরীফে উল্লেখ
আছে,
عن
السائب بن يزيد- قال كان يؤذن بين يدى رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا جلس على
المنبر يوم الجمعة على باب المسجد رابى بكر وعمر.
অর্থঃ- “হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জুমুয়ার দিন মিম্বরে বসতেন, তখন তাঁর সম্মুখে মসজিদের দরজার উপর আযান দেয়া হতো। অনুরূপভাবে
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর কালেও দেয়া হতো।”
এখানে স্মর্তব্য
যে, কিতাবে মান্সুখ (منسوخ)-এর একাধিক অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে।
তম্মধ্যে মান্সুখ-এর একটি অর্থ হলো- মাশ্রুহ্ (مشروح) বা ব্যাখ্যাকৃত। অর্থাৎ যার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, তা হচ্ছে- শারেহ্ شارح) অর্থাৎ ব্যাখ্যাকারী। আর যাকে ব্যাখ্যা করা হয়, তা হচ্ছে- মাশ্রুহ্
(مشروح)অর্থাৎ ব্যাখ্যাকৃত।
যেমন মসজিদের দরজায় আযান দেয়া সংক্রান্ত হাদীস শরীফখানা হলো- মান্সুখ বা মাশ্রুহ্ অর্থাৎ
ব্যাখ্যাকৃত। আর মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকট আযান দেয়া সংক্রান্ত হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা হলো- নাসেখ
বা শারেহ্ অর্থাৎ ব্যাখ্যাকারী।
কোরআন শরীফ ও
হাদীস শরীফে এ সম্পর্কিত বহু প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কিত দু’টি উদাহরণ পেশ করা হলো-
প্রথম উদাহরণ
ঃ- আল্লাহ্ পাক প্রথম এ আয়াত শরীফ অবতীর্ণ করেন,
وان
تبدوا ما فى انفسكم او تخفوه يحاسبكم به الله.
অর্থঃ- “তোমাদের অন্তরে যা উদিত হয়,
তা তোমরা গোপন রাখ অথবা প্রকাশ কর, সব বিষয়েরই হিসাব আল্লাহ্ পাক-এর নিকট দিতে হবে।” (সূরা বাক্বারা/২৮৪)
উক্ত আয়াত শরীফখানা
অবতীর্ণ হওয়ার পর হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ খুব চিন্তিত হয়ে গেলেন এবং বার বার সাইয়্যিদুল
মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে লাগলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যদি এটাই হয়ে থাকে, তবে আমাদের অবস্থা কি হবে? কারণ আমাদের অন্তরে তো অনেক কিছুই উদয় হয়।” তখন আল্লাহ্ পাক এ আয়াত শরীফখানা অবতীর্ণ করেন,
لايكلف
الله نفسا الاوسعها.
অর্থঃ- “কোন নফ্সকেই তার সামর্থের অতিরিক্ত কষ্ট দেয়া হবেনা।” (সূরা বাক্বারা/২৮৬)
এ আয়াত শরীফ
দ্বারা উপরোক্ত আয়াত শরীফের হুকুমকে মান্সুখ বা মাশ্রুহ্ অর্থাৎ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় উদাহরণ ঃ- আল্লাহ্ পাক রোযা রাখার ব্যাপারে প্রথম নিম্নোক্ত আয়াত শরীফ
অবতীর্ণ করেন,
وعلى
الذين يطيقونه فدية طعام مسكين.
অর্থঃ- “কোন সামর্থবান ব্যক্তি রোযা না রেখে ফিদ্ইয়া দিলেও চলবে।” (সূরা বাক্বারা/১৮৪)
কিন্তু আল্লাহ্
পাক পরবর্তীতে নিম্মোক্ত আয়াত শরীফ অবতীর্ণ করে উপরোক্ত আয়াত শরীফের হুকুমকে মান্সুখ
বা মাশ্রুহ্ অর্থাৎ ব্যাখ্যা করে দেন। আল্লাহ্ পাক বলেন,
فمن شهد
منكم الشهر فليصمه.
অর্থঃ- “তোমাদের মধ্যে (সামর্থবান) যে কেউ রমজান মাস পাবে, তাকে অবশ্যই রোযা রাখতে হবে।” (সূরা বাক্বারা/১৮৫)
এখানে দ্বিতীয়
আয়াত শরীফ দ্বারা প্রথম আয়াত শরীফের হুকুমকে মান্সুখ বা মাশ্রুহ্ অর্থাৎ ব্যাখ্যা করা
হয়েছে।
কাজেই মাসিক
আল বাইয়্যিনাতে যে লিখা হয়েছে, উক্ত হাদীস শরীফখানা মানসুখ, এ কথার অর্থ হলো- উক্ত হাদীস শরীফের আমলের হুকুম মাশ্রুহ্ বা ব্যাখ্যা করে পরিবর্তন
করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, হযরত সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণের ইজ্মা দ্বারা হাদীস শরীফের আমলের হুকুম মাশ্রুহ্ বা ব্যাখ্যা হয়ে পরিবর্তন
হওয়ার বহু প্রমাণ শরীয়তে বিদ্যমান রয়েছে। আর এ প্রসঙ্গে উছূলে ফিক্বাহর বিখ্যাত কিতাব
“নুরুল আনোয়ার”-এর ৫৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
اذا عدمت
صفة الوحوب للماموربه لا تبقى صفة الجواز عندنا هذا هوالاصح.
অর্থঃ- “হানাফীগণের মতে সহীহ্ মত এই যে, যখন কোন শরয়ী আমল (ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব)-এর
হুকুম ইজ্মার দ্বারা পরিবর্তন হয়, তখন তার জায়েয হওয়ার আমলের হুকুম বহাল থাকেনা।”
এ ব্যাপারে সর্বোৎকৃষ্ট
ও উজ্জলতম দৃষ্টান্ত হলো- মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া সম্পর্কিত ফায়সালা।
কারণ অসংখ্য সহীহ্ হাদীস শরীফের দ্বারা প্রমাণিত যে, মহিলারা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানায় ও খলীফাতু রাসূলিল্লাহ্
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর খিলাফতকালে মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সহিত নামাজ আদায় করতেন।
কিন্তু আমীরুল মু’মিনীন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) খিলাফতে আসীন হওয়ার পর
মহিলাদেরকে জামায়াতের জন্য মসজিদে যেতে নিষেধ করেন। অতঃপর মহিলারা হযরত আয়েশা সিদ্দীকা
(রাঃ)-এর নিকট গিয়ে হযরত ওমর (রাঃ)-এর নিষেধ সম্পর্কিত বক্তব্য পেশ করলে তিনি বললেন, তোমাদের মাঝে এখন যেরূপ বেপর্দাবস্থা চালু হয়েছে, তা যদি আল্লাহ্ পাক-এর রাসূল, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখতেন, তাহলে তিনিও তোমাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন। এভাবে
হযরত ওমর (রাঃ)-এর এ ইজ্তিহাদের উপর ইজ্মা প্রতিষ্ঠিত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সকল ইমাম-মুজ্তাহিদগণ
ফতওয়া দেন যে, মহিলাদের জন্য
মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী।
অতএব দেখা যাচ্ছে
যে, এ ক্ষেত্রেও ইজ্মার দ্বারা হাদীস
শরীফের আমলের হুকুম মান্সুখ বা মাশ্রুহ্ হয়ে পরিবর্তন হয়েছে। আর এটাই মূলতঃ ছানী আযান
সম্পর্কিত হাদীস শরীফের আমলের হুকুম মান্সুখ বা মাশ্রুহ্ হয়ে পরিবর্তন হওয়ার বড় প্রমাণ।
উপরোক্ত আলোচনা
দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মার কারণে ছানী আযান মসজিদের দরজায় দেয়ার হাদীস
শরীফের আমলের হুকুম মান্সুখ বা মাশ্রুহ্ হয়ে পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে ইজ্মাকেই
অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ ছানী আযান মসজিদের ভিতরেই দিতে হবে, দরজায় বা বাইরে নয়। কারণ ছানী আযান মসজিদের বাইরে দেয়ার
অর্থই হলো- হযরত ওসমান (রাঃ) এবং সম্মিলিত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্তিহাদকৃত ইজ্মায়ে
আযীমতকে অস্বীকার করা, যা কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফকে অস্বীকার করার নামান্তর অর্থাৎ কুফরী।
(২)
কেউ কেউ বলতে
পারেন যে, ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া ইজ্মায়ে
সাহাবা এবং হযরত ওসমান (রাঃ) ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া শুরু করেন। এ কথার পক্ষে
প্রদত্ত ফতওয়ায় দলীল হিসেবে মাওলানা আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী কর্তৃক প্রণীত “ফয়জুল বারী ও আরফুশ্ শাযী” কিতাবদ্বয়ের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ মাওলানা আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী সাহেব সকলের
নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং যদি হযরত ওসমান (রাঃ) বা হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ কর্তৃক
মসজিদের ভিতরে আযানে ছানী প্রচলন করার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য দলীল পাওয়া না যায়, তবে কিভাবে বলা যেতে পারে যে, ছানী আযান মসজিদের বাইরে দেয়া অগ্রহণীয়?
এ মন্তব্যের
প্রেক্ষিতে প্রথমতঃ বলতে হয় যে, “ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে দেয়া ইজ্মায়ে সাহাবা বা সুন্নত।” এ ব্যাপারে মাসিক আল বাইয়্যিনাতের ৯ম সংখ্যায় যে সংক্ষিপ্ত ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে, তাতে কেবল আনোয়ার শাহ কাশ্মীরীর দলীলই পেশ করা হয়নি বরং
বিশ্ব বিখ্যাত সর্বজন স্বীকৃত ও অনুসরণীয় তাফসীর, হাদীস শরীফের শরাহ্, ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাব যেমন- আহ্কামুল কোরআন, তাফসীরে কুরতুবী, রুহুল মায়ানী, তাফসীরে মোরাগী, আলমগীরী, বাদায়ে, মারাক্বিউল ফালাহ্, শরহে বেক্বায়া, ফতহুল ক্বাদীর ইত্যাদিসহ প্রায় ৫০টিরও অধিক নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বখ্যাত কিতাব সমূহের
বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। যার দ্বারা অকাট্যরূপেই প্রমাণিত হয় যে, ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে দেয়া ইজ্মায়ে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত ও ছানী আযান মসজিদের ভিতরে
দেয়াই সুন্নত।
এ প্রসঙ্গে আইনী
শরহে বোখারী ও হাশিয়ায়ে আবু দাউদ শরীফে উল্লেখ আছে যে,
الاذان
الشالث هو الاول وجودا اذا كانت مشروعيته باجتهاد عشمان وموا فقه سائر الصحابة له
بالسكوت وعدم الانكار قصار اجماعا.
অর্থঃ-“তৃতীয় আযান এটাই মূলতঃ প্রথম আযান, (তৃতীয় এজন্য বলা হয় যে, ইক্বামতকেও আযান বলা হয়) যা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ইজ্তিহাদের
দ্বারা সাব্যস্ত করা হয়, (যখন হযরত ওসমান (রাঃ) দ্বিতীয় আরেকটি আযানের প্রচলন করেন) তখন প্রায় সমস্ত সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণই এটা জ্ঞাত ছিলেন এবং সকলেই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিলেন। কেউ এটার প্রতিবাদ না
করার কারণে এর উপর ইজ্মা তথা ইজ্মায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।”
আর পবিত্র কোরআন
শরীফের বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “আহ্কামুল কোরআন লিল্ কুরতুবীতে” উল্লেখ আছে যে,
زاد
عشمان رضى الله عنه اذانا ثانيا يؤذنون بمدينة السلام وبعداذان المنار بين يدى
الامام تحت المنبر.
অর্থঃ- “হযরত ওসমান (রাঃ) মদীনায় দ্বিতীয় আরেকটি আযান বৃদ্ধি
করেন। অতঃপর ছানী আযানটি ইমামের সম্মুখে, মিম্বরের নিকট দেয়া হয়।”
অনুরূপ বিখ্যাত মুহাদ্দিস, হযরত মুল্লা আলী ক্বারী (রঃ) তাঁর রচিত বিখ্যাত কিতাব “মেরকাত শরহে মেশকাতে” উল্লেখ করেন,
وزاه
النداء الثالث على الزوراء- وامر بالاذان الاول خارح المسجد ليسمع الناس ثم الاذان
(يعنى الثانى) بين يديه.
অর্থঃ- “(হযরত ওসমান (রাঃ)) ‘যাওরা’ নামক স্থানে
তৃতীয় আরেকটি আযান (বর্তমানের প্রথম আযান) বৃদ্ধি করেন এবং তার প্রবর্তিত আযানটি মসজিদের
বাইরে দেয়ার হুকুম দেন, যাতে করে মানুষ আযান শুনতে পায়। অতঃপর (বর্তমানের দ্বিতীয়) আযান (হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার প্রথম আযানটি) তার সামনে দেয়ার হুকুম দেন।”
উক্ত বর্ণনা
দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরে নিকটে, ইমামের সামনে দেয়া হযরত ওসমান (রাঃ)-এরই প্রবর্তিত সুন্নত।
উল্লিখিত নির্ভরযোগ্য
ও সর্বজন মান্য কিতাব সমূহের বক্তব্য দ্বারা দিবা লোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আমীরুল মু’মিনীন, হযরত ওসমান
(রাঃ) স্বয়ং নিজেই ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার হুকুম দেন এবং এর উপর পরবর্তীতে হযরত
সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা তথা ইজ্মায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হয়।
অতএব, যদি তাই হয়ে থাকে, তবে কি করে বলা যেতে পারে যে, ফয়জুল বারী ও আরফুশ্ শাযী কিতাবদ্বয় ছানী আযান সম্পর্কিত প্রধান দলীল?
মূলতঃ উক্ত কিতাবদ্বয়
ছাড়াও পঞ্চাশেরও অধিক নির্ভরযোগ্য দলীলের দ্বারা প্র্রমাণিত যে, স্বয়ং হযরত ওসমান (রাঃ) নিজেই ছানী আযান মসজিদের ভিতরে
স্থানান্তরিত করেন এবং ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে দেয়া ইজ্মায়ে সাহাবা বা সুন্নতে সাহাবা, যা ইতিপূর্বের আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ বলতে
হয় যে, সর্বজন মান্য হওয়া, হক্ব বা নাহক্ব হওয়ার দলীল নয়। কারো কথা যদি কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসসম্মত হয়, আর তাকে যদি পৃথিবীর সকলেই প্রত্যাখান করে, তবুও তার কথা গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয়। অপরপক্ষে কারো কথা যদি কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের খেলাফ হয়, আর বিশ্বের সকলেই যদি তাকে মানে ও অনুসরণ করে, তবুও তার কথা গ্রহণযোগ্য বা অনুসরণীয় নয় বরং সম্পূর্ণই পরিত্যাজ্য। এ প্রসঙ্গে
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,
كلمة
حكمة من سفيه فا قبلها وكلمة سفيهة من حكيم فاتر كها.
অর্থঃ- “জ্ঞানমূলক কথা (যা শরীয়ত সম্মত), যদি মুর্খ লোকও বলে, তবে তা কবুলযোগ্য। আর মুর্খসূচক কথা (যা শরীয়ত বিরোধী), যদি জ্ঞানী (নামধারী) ব্যক্তিও বলে, তবে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।”
হাদীস শরীফে
আরো এরশাদ হয়েছে,
اوصيكم
بتقوى الله والسمع والطاعة ولو كان عبدا حبشيا.
অর্থঃ- “তোমাদেরকে আল্লাহ্ ভীতি সম্পর্কে নছীহত করছি। আর (তোমাদের
খলীফা) যদি হাবশী কৃতদাসও হয়, (সে যদি শরীয়ত মোতাবেক হুকুম করে) তবে তার কথা শ্রবণ কর ও তাকে অনুসরণ কর।” (মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, তা’লীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত্ ত্বীবী, মিরআতুল মানাজীহ্)
তাই এক্ষেত্রে
বলতে হয়, আনোয়ার শাহ্ কাশ্মিরীকে মূল্যায়ন
করে তার আরফুশ শাযী এবং ফয়জুল বারী কিতাবের বরাত দেয়া হয়নি বরং তার কিতাবদ্বয়ে সর্বজন
মান্য ও অনুসরণীয় ইমাম-মুজ্তাহিদ ও ফক্বীহ্গণের নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ববিখ্যাত কিতাব সমুহে
বর্ণিত দলীল-আদিল্লা হুবহু পেশ করা হয়েছে বিধায় তার বরাত দেয়া হয়েছে।
সুতরাং কোরআন
শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসসম্মত কথা যে কেউ, যে কোন কিতাবেই বর্ণনা করুক না কেন, তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কেননা তা অস্বীকার বা প্রত্যাখান
করার অর্থই হলো- হক্বকে অস্বীকার বা প্রত্যাখান করা, যা আদৌ শরীয়তসম্মত নয়।
(৩)
প্রসঙ্গতঃ আলোচ্য
যে, প্রদত্ত ফতওয়ায় বলা হয়েছে, “ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া ইজ্মায়ে
আযীমত দ্বারা প্রমাণিত, যা মানা ওয়াজিব ও অস্বীকার করা কুফরী। কিন্তু হযরত মাওলানা আহ্মদ রেজা খান বেরলবী
(রঃ) তার “ফতওয়ায়ে রেজভীয়া ও আহ্কামে শরীয়ত” কিতাবদ্বয়ে আর হযরত মাওলানা আব্দুল হাই লখনবী (রঃ) “ওমদাতুর রেয়ায়া” কিতাবে ও মাওলানা গরীবুল্লা মসরুর দেওবন্দী “সেক্বায়া” কিতাবে আযানে
ছানী মসজিদের বাইরে দেয়া সুন্নত লিখেছেন। সুতরাং প্রদত্ত ফতওয়া মোতাবেক তারা সকলেই
কি কাফেরে পরিণত হয়েছেন?
এ মন্তব্যের
আলোকে বলতে হয় যে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় জুমুয়ার দিন মসজিদের বাইরে আযান
দেয়া হতো। অতঃপর হযরত ওসমান (রাঃ)-তাঁর খিলাফতকালে মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে ছানী আযান দেয়ার রীতি চালু করেন। যার
উপর পরবর্তীতে ইজ্মায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, ইজ্মায়ে আযীমত মানা ওয়াজিব,
আর অস্বীকার করা কুফরী। এটা মূলতঃ মাসিক আল বাইয়্যিনাতের
নিজস্ব কোন বক্তব্য নয়। বরং বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে আহ্মদীর” বক্তব্য। যেমন উক্ত কিতাবে উল্লেখ আছে,
فيكون
الاجماع حجة يكفر جاحده كا لكتاب والسنة.
অর্থঃ- “ইজ্মায়ে আযীমত কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের মতই একটি অকাট্য
দলীল। যে ওটাকে অস্বীকার করলো, মূলতঃ সে কুফরী করলো।”
সুতরাং নির্ভরযোগ্য
দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত- “ছানী আযান সম্পর্কিত ইজ্মায়ে আযীমতকে অস্বীকার করা নিঃসন্দেহে কুফরী।” এখন তা যে ব্যক্তিই করুক না কেন।
তবে বিশেষভাবে
স্মরণীয় যে, প্রশ্নে উল্লিখিত
ব্যক্তিবর্গের কিতাবসমূহে সরাসরি ছানী আযান সম্পর্কিত ইজ্মায়ে আযীমতকে অস্বীকার করার
কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। যদিও একথা নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে, প্রশ্নে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ তাদের স্ব স্ব কিতাবে “ছানী আযান” সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তা ইজ্মায়ে আযীমতের খেলাফ হওয়ার কারণে গ্রহণযোগ্য নয়। সম্ভবতঃ ছানী আযান সম্পর্কিত
পূর্ণ তাহ্ক্বীকের অভাবেই তারা যেমন এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি, তেমনি তা পেশও করতে পারেননি। এমনও হতে পারতো যে, তাদেরকে ছানী আযান সম্পর্কিত সহীহ্ মতটি জানানো হলে, তারা তাদের উক্ত সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করতেন। যেমন এ
প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়- আফজালুল আওলিয়া হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রঃ)-এর একটি
ঘটনা- হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রঃ)-এর বিশ্বখ্যাত ইল্মে তাসাউফ-এর কিতাব “মকতুবাতে আল্ফে সানীতে” উল্লেখ রয়েছে- হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রঃ). তিনি তাঁর জীবনের প্রায় শেষ প্রান্ত
পর্যন্ত নামাজের তাশাহ্হুদে লা ইলাহা বলার সময় শাহাদাত অঙ্গুলী উত্তোলন করা যে সুন্নতে
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তা আমল করেননি। হযরত মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী (রঃ)কে এ আমল না করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা
করা হলে তিনি বললেন, এ বিষয়ের বর্ণনা বিশুদ্ধ রেওয়ায়েতে আমার কাছে পৌঁছেনি। যখন তাঁর কাছে বিশুদ্ধ
রেওয়ায়েত পৌঁছানো হলো, তারপর থেকে তিনি নামাজের তাশাহ্হুদে লা ইলাহা বলার সময় শাহাদাত অঙ্গুলী উত্তোলন
করতেন এবং ইল্লাল্লাহু শব্দের ‘হু’ বলার সময় শাহাদাত অঙ্গুলী নামাতেন।
অর্থাৎ তিনি এ সুন্নতের আমল শুরু করলেন।
স্মরণযোগ্য যে, কোন ব্যক্তি বা দলের প্রতি অন্ধ হয়ে কোরআন-সুন্নাহ্র
খেলাফ আমল করা, বক্তব্য পেশ
করা, সমর্থন করা আদৌ শরীয়ত সম্মত নয়।
মূলতঃ অনুসরণ
করতে হবে- কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসকে।
অর্থাৎ যার বক্তব্য-আমল উল্লিখিত দলীল ভিত্তিক, তাকেই অনুসরণ করতে হবে। তবে কোন বিষয়ে যদি এখতেলাফ বা মতবিরোধ দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে যে পক্ষের দলীল অধিক মজবুত বা শক্তিশালী, সেটাই গ্রহণ করতে হবে।
উল্লেখ্য, ছানী আযান মসজিদের বাইরে দেয়ার ব্যাপারে হযরত মাওলানা
আব্দুল হাই লাক্ষ্মোবী (রঃ) ও গরীবুল্লাহ্ মাসরুর দেওবন্দী “ওমদাতুর রেয়াইয়া ও সেক্বায়া”
কিতাবে লিখেছেন যে,
قوله
يديه اى مستقبل الامام فى المسجد كان او خارجه والمسنون هو الثانى.
অর্থঃ- “(ছানী আযান) তার সম্মুখে অর্থাৎ মসজিদের ভিতর, ইমামের সম্মুখে অথবা মসজিদের বাইরে হবে। তবে দ্বিতীয়টাই
সুন্নত।”
এখানে লক্ষ্যণীয়
বিষয় এই যে, তারা ছানী আযান
মসজিদের ভিতরে ও বাইরে উভয় পক্ষেই মত প্রকাশ করেছেন, তবে বাইরে দেয়াকেই সুন্নত বলেছেন।
এখন কথা হলো
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময় ছানী আযান যে মসজিদের বাইরে দেয়া
হতো, তা আমরাও বলি। কিন্তু হযরত ওসমান
(রাঃ)-এর সময়ে কৃত ইজ্মায়ে আযীমতের দ্বারা সে সুন্নতের হুকুম মানসূখ বা মাশরুহ্ হয়ে
পরিবর্তন হয়েছে। যার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। আর ইজ্মায়ে আযীমতের কারণে আমাদের
জন্য এখন ইজ্মায়ে আযীমতের হুকুমই অবশ্য পালনীয় এবং হযরত মাওলানা আহ্মদ রেজা খান বেরলবী
(রঃ), হযরত মাওঃ আব্দুল হাই লক্ষ্মোবী
(রঃ) ও গরীবুল্লা মাসরুর দেওবন্দীর বক্তব্য ইজ্মায়ে আযীমতের খেলাফ বিধায় গ্রহণযোগ্য
নয়।
উল্লেখ্য, হযরত মাওলানা আহ্মদ রেজা খান বেরলবী (রঃ) তাঁর “ফতওয়ায়ে রেজভিয়া ও আহ্কামে শরীয়ত” কিতাবদ্বয়ে ছানী আযান মসজিদের বাইরে দেয়া সম্পর্কে যে
দলীল পেশ করেছেন, তা ছানী আযানের
ক্ষেত্রে দলীল হিসেবে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন- ছানী আযান সম্পর্কে উক্ত কিতাবদ্বয়ে
দলীল হিসেবে নিম্নোক্ত বর্ণনা সমূহপেশকরাহয়েছে
(১)
فتوى
عالمكيرى طبع مصر جلد اول صفحه- ৫৫ لا يؤذن فى المسجد.
অর্থঃ- “ফতওয়ায়ে আলমগীরী, মিছরী ছাপা ১ম জিল্দ-৫৫, পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে- মসজিদের ভিতর আযান দেয়া নিষেধ।”
(২)
فتح
القدير جلد اول صفحه- ১৭১ – قالوا لا يؤذن
فى المسجد.
অর্থঃ- “ফতহুল ক্বাদীর ১ম জিল্দ ১৭১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, আলেমগণ মসজিদের ভিতর আযান দিতে নিষেধ করেছেন।”
(৩)
طحطاوى على
مراقى الفلاح جلد اول صفحه- ১৬৮ – يكره ان يؤذن
فى المسجد.
অর্থঃ- “মারাকিউল ফালাহ্ ১ম জিঃ ১২৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে, মসজিদে আযান দেয়া মাকরূহ্।”
অনুরূপ “ফতওয়ায়ে ক্বাজী খান, খোলাছাতুল ফতওয়া খাযানাতুল মুফ্তিয়্যীন, বাহ্রুর রায়েক্ব, শরহে নেক্বায়া বরজন্দী, গুনিয়া শরহে মুনিয়া এবং ওমদাতুর রেয়ায়া ও শরহুস্ সেক্বায়া কিতাবের ইবারত সমূহ উল্লেখ
করা হয়েছে।”
এ ব্যাপারে প্রথমতঃ
বলতে হয় যে, হযরত মাওলানা
আহ্মদ রেজা খান বেরলবী (রঃ) ছানী আযানের দলীল হিসেবে আলমগীরী, ফতহুল ক্বাদীর ও মারাকিউল ফালাহ্ ইত্যাদি কিতাব থেকে
যে ইবারত সমূহ্ উল্লেখ করেছেন, তাতে ছানী আযানের কথা বিন্দুমাত্রও উল্লেখ নেই। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে কিরূপে প্রমাণিত হয় যে,
উল্লিখিত কিতাবে ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দিতে নিষেধ
করা হয়েছে? মূলতঃ উল্লিখিত
কিতাব সমূহের ইবারতের সাথে ছানী আযানের বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই। বরং উল্লিখিত ইবারতসমূহ
সম্পূর্ণরূপেই মত্লক্ব আযান (যে আযান সাধারণতঃ মুছল্লীদেরকে নামাজের দিকে আহ্বান করার
জন্য দেয়া হয়। যেমন- জুমুয়ার প্রথম আযানসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আযান)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত।
আর তাই উল্লিখিত কিতাবের ইবারত সমূহ্ “মত্লক্ব আযানের অধ্যায়ে” উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ছানী আযান সম্পূর্ণরূপেই জুমুয়ার অধ্যায়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
যার ফলে ফিক্বাহ্রে কিতাব সমূহে ছানী আযান সম্পর্কিত বর্ণনা জুমুয়ার অধ্যায়েই উল্লেখ
করা হয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ বলতে
হয় যে, হযরত মাওলানা আহ্মদ রেজা খান বেরলবী
(রঃ) বর্ণিত, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ফতহুল ক্বাদীর ও মারাকিউল ফালাহ্-এর উল্লিখিত ইবারতসমূহ্
যে ছানী আযান সম্পর্কিত নয়, উল্লিখিত কিতাব সমূহেই তার প্রমাণ রয়েছে। যেমন উক্ত ফতওয়ায়ে আলমগীরী ১ম জিল্দ ৮৮
পৃষ্ঠার “জুমুয়ার অধ্যায়ে” উল্লেখ আছে যে,
وقال
الطحاوى الحنفى يجب السعى ويكره البيع عند اذان المنبر.
অর্থঃ- “ইমাম তাহাবী (রঃ) বলেন, মিম্বরের নিকট আযান দেয়ার সময় সায়ী করা (মসজিদের দিকে ধাবিত হওয়া) ওয়াজিব ও বেচা-কেনা
নিষিদ্ধ।”
অনুরূপ উক্ত
ফতহুল ক্বাদীর ২য় জিল্দ ১২০ পৃষ্ঠার ও মারাকিউল ফালাহ্ ২৮২ পৃষ্ঠার “জুমুয়ার অধ্যায়ে” উল্লেখ আছে যে,
وكان المعتبر
هو الاذان الشانى عند المنبر بين يدى الخطيب.
অর্থঃ- “গ্রহণযোগ্য মত এই যে, ছানী আযান যা মিম্বরের নিকটে, খতীবের সম্মুখে দেয়া হয়। (তখন থেকেই মসজিদের দিকে সায়ী করা বা ধাবিত হওয়া ওয়াজিব)।”
এখানে উল্লেখ্য
যে, উল্লিখিত কিতাব সমূহের “জুমুয়ার অধ্যায়ে” বর্ণিত ইবারত সমূহে একদিকে যেরূপ (منبر) মিম্বরের কথা উল্লেখ আছে, অপরদিকে (اذان الثانى) অর্থাৎ ছানী আযানের কথাও স্পষ্টাক্ষরে
উল্লেখ আছে।
এখন প্রশ্ন হলো-
হযরত মাওলানা আহ্মদ রেজা খান বেরলবী (রঃ) বর্ণিত, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ফতহুল ক্বাদীর ও মারকিউল ফালাহ্ কিতাব সমূহে যদি ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়া
নাজায়েয ও মাকরূহ্ বলা হয়, তবে সেই একই কিতাব সমূহের “জুমুয়ার অধ্যায়ে” ছানী আযান মিম্বরের নিকট, খতীবের সম্মুখে দেয়ার কথা বলা হলো কেন? এ বিরাট এখতেলাফ বা মতবিরোধের ফায়সালা কি? বস্তুতঃ উক্ত এখতেলাফ বা মতবিরোধের ফায়সালা সুস্পষ্ট। অর্থাৎ “আযানের অধ্যায়ে” বর্ণিত ইবারত সমূহ” মত্লক্ব আযান যেমন- জুমুয়াসহ পাঁচ ওয়াক্ত আযানের জন্য প্রযোজ্য। তাই উক্ত আযানসমূহ
মসজিদের ভিতরে দেয়া মাকরূহ্ েতানজিহী যা নিষেধ।
আর “জুমুয়ার অধ্যায়ে” বর্ণিত ইবারত সমূহ জুমুয়ার ছানী আযানের জন্য প্রযোজ্য। তাই ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে, খতীবের সম্মুখে দেয়াই সুন্নতে সাহাবা যা ইজ্মায়ে আযীমত। এ সম্পর্কে মাসিক আল বাইয়্যিনাতের
গত (৪৮তম) সংখ্যায়ও “মত্লক্ব আযান” শিরোনামে দলীল ভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
স্মর্তব্য যে, হযরত মাওলানা আহ্মদ রেজা খান বেরলবী (রঃ) মূলতঃ ছানী
আযানকে মত্লক্ব আযানের উপর ক্বিয়াস করে ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়াকে মাকরূহ্ ও নাজায়েয
বলেছেন।
সুতরাং ছানী
আযান সম্পর্কিত মাসিক আল বাইয়্যিনাতের ফতওয়াই মজবুত দলীল ভিত্তিক, সহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য। আর ফতওয়ায়ে রেজভীয়া, আহ্কামে শরীয়ত, ওমদাতুর রেয়ায়া, শরহুস্ সেক্বায়া ইত্যাদি কিতাবের বক্তব্য যেহেতু দলীলবিহীন ও ইজ্মায়ে আযীমতের খেলাফ
সেহেতু তা গ্রহণযোগ্য নয়।
উল্লেখ্য, হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ইজ্মায়ে
আযীমতের পর সমস্ত ফক্বীহ্ তথা পরবর্তী ইমাম-মুজ্তাহিদগণ হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের
ইজ্মাকেই বলিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছেন এবং স্ব স্ব কিতাবে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। সুতরাং
তাদের মোখালেফ দু’এক ব্যক্তির
বিচ্ছিন্ন বক্তব্য আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারেনা। যেহেতু পরবর্তী সকল উম্মতের চেয়ে হযরত
সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ অধিক মাত্রায় জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ এবং সমঝদার। এ ব্যাপারে সমস্ত
উম্মত একমত।
(৪)
প্রদত্ত ফতওয়ায়
“আযীযুল ফতওয়ার” বরাত দিয়ে লিখা হয়েছে, মক্কা ও মদীনা শরীফসহ সমগ্র মুসলিম রাষ্ট্রে ছানী আযান মসজিদের ভিতরে মিম্বরের
নিকটে দেয়া হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে কেউ কেউ বলে বেড়ান যে, এখনো মক্কা ও মদীনা শরীফে ছানী আযান মিম্বরের নিকটে দেয়া
হয়না। শুধু তাই নয়, আরব দেশসহ ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের অনেক স্থানেই আযানে ছানী মিম্বরের
নিকট দেয়ার নজীর পাওয়া যায়না। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আল বাইয়্যিনাতের “ছানী আযান” সম্পর্কিত ফতওয়াকে
কিভাবে সঠিক বলে ধরে নেয়া যায়?
এখানে বলতে হয়
যে, মাসিক আল বাইয়্যিনাতে বিবৃত “ছানী আযান” সম্পর্কিত ফতওয়া, আযীযুল ফতওয়া বা কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল নয়। বরং কোরআন শরীফ,
হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের উপরই নির্ভরশীল। কারণ ইসলামী শরীয়ত কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র ও অধিকাংশ লোককে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেনা এবং তাদেরকে অনুসরণ করার নির্দেশ
দেয়না, যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র ও অধিকাংশ লোক কোরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের
উপর পরিপূর্ণ কায়েম না থাকবে।
অতএব, প্রদত্ত ফতওয়ায় আযীযুল ফতওয়া থেকে ছানী আযান সম্পর্কিত
যে এবারত উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি আযীযুল ফতওয়াকে মূল্যায়ন করে নয়। বরং আযীযুল ফতওয়ার ছানী আযান সম্পর্কিত ফতওয়াটি
পূর্ববর্তী ইমাম মুজ্তাহিদগণের ফতওয়ার হুবহু নকল হওয়ার কারণেই তা দলীল হিসেবে পেশ করা
হয়েছে।
উল্লেখ্য, মক্কা ও মদীনা শরীফে ছানী আযান মসজিদের বাইরে দিলে ও
অধিকাংশ লোক তা অনুসরণ করলেই যদি তা দলীল হয়, তবে সৌদি আরবে যে টেলিভিশন, ভি.সি.আর, ভি.ডি.ও ইত্যাদি
চালু রয়েছে এবং যমীনের অধিকাংশ লোক শরাব খাচ্ছে, তাহলে তাদের বক্তব্য মোতাবেক টেলিভিশন, ভি.সি.আর, ভি.ডি.ও দেখা, শরাব পান করা ইত্যাদি সবই জায়েয। যেহেতু তা সৌদি আরবে
রয়েছে এবং অধিকাংশ লোক করছে। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক) এবং এ ক্ষেত্রে আরো উল্লেখ্য
যে, পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই কাফের। সেক্ষেত্রে
অধিকাংশকে মূল্যায়নের নীতি গ্রহণ করে কি কুফরী করাও জায়েয হবে? অথচ আল্লাহ্ পাক বলেন,
وان تطع
اكشر من فى الارض يصلوك عن سبيل الله.
অর্থঃ- “যদি তুমি যমীনের অধিকাংশ লোককে অনুসরণ কর, তবে তারা তোমাকে আল্লাহ্র রাস্তা থেকে গোমরাহ্ করে ফেলবে।” (সূরা আনআম/১১৬)
মূলতঃ মক্কা-মদীনা
শরীফ ও অধিকাংশ লোক শরীয়তের দলীল নয়। তাই মক্কা-মদীনাসহ অধিকাংশ মসজিদেও যদি আযানে
ছানী মসজিদের বাইরে দেয়া হয় (যদিও তা দেয়া হয়না), তবুও তা গ্রহণযোগ্য হবেনা। কারণ তা সম্পূর্ণই ইজ্মায়ে আযীমতের খেলাফ। অর্থাৎ ছানী
আযান মসজিদের ভিতরে মিম্বরের সম্মুখে দেয়াই ইজ্মায়ে আযীমত ও বাইরে দেয়া তার খেলাফ।
আর এখানে বিশেষভাবে
উল্লেখ্য যে, মক্কা ও মদীনা
শরীফের কোন কোন স্থানে ছানী আযান মিম্বরের নিকট দেয়া না হলেও মসজিদের ভিতরে দেয়া হয়
অবশ্যই। কেননা মদীনা শরীফের মসজিদে নববীতে
যে স্থানে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন সাহেব আযান দেন, সে স্থানটি “রওজাতুম মির
রিয়াজিল জান্নাতে” অবস্থিত। আর এর মধ্যে কারো দ্বিমত নেই যে, “রওজাতুম মির রিয়াজিল জান্নাহ্” সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়কার মসজিদের ভিতরেই অবস্থিত।
অনুরূপ মক্কা
শরীফেও কা’বা শরীফের চার পাশে যে হেরেম শরীফ
নির্মাণ করা হয়েছে, সে হেরেম শরীফের ভিতরেই ছানী আযান দেয়া হয়, আর হেরেম শরীফ সকলের মতেই মসজিদের অন্তর্ভূক্ত।
অতএব, নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে, মক্কা ও মদীনা শরীফে এমনকি আরাফাতে অবস্থিত মসজিদে নামিরাহ্ ও মিনায় অবস্থিত মসজিদে
খায়েফেও আযানে ছানী মসজিদের ভিতরেই দেয়া হয়। আর মসজিদের ভিতরে আযান দেয়ার অর্থই হলো-
ইজ্মায়ে আযীমতকে অনুসরণ করা। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে কি করে বলা যেতে পারে যে, ছানী আযান মসজিদের ভিতরে মিম্বরের নিকটে দেয়ার নযীর পাওয়া যায়না।
উল্লেখ্য যে, শুধু মক্কা-মদীনা শরীফেই নয়,
বরং বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব মসজিদেই ছানী আযান মসজিদের
ভিতরে মিম্বরের নিকটে দেয়া হয়। তাই আরব দেশসহ ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র সমূহে ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের সম্মুখে দেয়াার নযীর নেই, কথিত প্রত্যক্ষদর্শীর একথা সম্পূর্ণই ভুল ও দলীল বিহীন।
উপরোক্ত আলোচনা
দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, মাসিক আল বাইয়্যিনাতে বর্ণিত “আযীযুল ফতওয়ার” ছানী আযান সম্পর্কিত বক্তব্য অশুদ্ধ নয়। অতএব, মাসিক আল বাইয়্যিনাতে বর্ণিত ছানী আযানের ফতওয়া সঠিক,
দলীল ভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য।
(৫)
প্রদত্ত ফতওয়ায়
উল্লেখ করা হয়েছে, “ছানী আযানের ব্যাপারে সকল সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণ একমত। অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে ইজ্মা
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অথচ “তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহ্মানে” উল্লেখ আছে, চতুর্থ খলীফা, আমীরুল মু’মিনীন, হযরত আলী (রাঃ)
যখন কুফায় ছিলেন, তখন জুমুয়ার
দিন একটি মাত্র আযান দিতেন। সুতরাং তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহমানের বক্তব্যের দ্বারা কেউ
এই সন্দেহে পতিত হতে পারেন যে, যদি হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের মধ্যে ইজ্মাই হতো তবে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আলী
(রাঃ) জুমুয়ার দিনে একটি মাত্র আযানের ব্যবস্থা করলেন কেন?
এর দ্বারা কি বুঝা যায় না যে, ছানী আযানের ব্যাপারে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের
মধ্যে ইজ্মা হয়নি।
এক্ষেত্রে বলতে
হয় যে, “তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহ্মানে” ছানী আযান সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণই দলীলবিহীন ও মনগড়া। কারণ উক্ত তাফসীরের
লেখক তার উক্ত বক্তব্যের সমর্থনে কোন দলীলই পেশ করতে পারেনি।
পক্ষান্তরে মাসিক
আল বাইয়্যিনাতে বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাবের বরাত দিয়ে লিখা হয়েছে যে, ছানী আযানের ব্যাপারে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের
মধ্যে ইজ্মা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে বোখারী শরীফের বিখ্যাত শরাহ্ আইনীতে
ও সহীহ্ আবু দাউদের হাশিয়াতে উল্লেখ আছে,
الاذان
الثالث هو الاول وجودا اذا كانت مسر وعيته با جتهاد عثمان وموا فقه سائر الصحابة
له يالسكوت وعدم الانكار فصار اجماعا.
অর্থঃ- “তৃতীয় আযান, এটাই মূলতঃ প্রথম আযান, (তৃতীয় এজন্য বলা হয় যে, ইক্বামতকেও আযান বলা হয়) যা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ইজ্তিহাদের দ্বারা সাব্যস্ত করা
হয়। (যখন হযরত ওসমান (রাঃ) দ্বিতীয় আরেকটি আযানের প্রচলন করেন) তখন প্রায় সমস্ত সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণই এটা জ্ঞাত ছিলেন এবং সকলেই এ ব্যাপারে নিশ্চুপ ছিলেন। কেউ এটার প্রতিবাদ না
করার কারণে এর উপর ইজ্মা তথা ইজ্মায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।”
অনুরূপ তাফসীরে
ওসমানী, তাফসীরে কামালাইন, তাফসীরে মায়ারেফুল কোরআনে উল্লেখ আছে যে, ছানী আযানের ব্যাপারে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের
মধ্যে ইজ্মা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অতএব, উল্লিখিত বিশ্ববিখ্যাত, নির্ভরযোগ্য, সর্বজন স্বীকৃত
কিতাব ও একাধিক কিতাবের বর্ণনার বিপরীতে “তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহ্মানের” দলীলবিহীন ও মনগড়া বা স্বরচিত বক্তব্য কিরূপে গ্রহণীয় হতে পারে?
এখানে বিশেষভাবে
উল্লেখ্য যে, হযরত আলী (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সাথে
ছিলেন। শাহাদাতের পূর্বে যখন বিদ্রোহীরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর বাড়ী ঘেরাও করেছিল, তখন হযরত আলী (রাঃ) তাঁর দু’ছেলে- হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এবং হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ)দ্বয়কে পাঠিয়েছিলেন, যাতে বিদ্রোহীরা হযরত ওসমান (রাঃ)-এর কোন ক্ষতি করতে
না পারে, সে বিষয়ে দেখাশোনার জন্য। অর্থাৎ
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর পুরো খিলাফতকালেই হযরত আলী (রাঃ), হযরত ওসমান (রাঃ)-এর সাথে ছিলেন। শুধু সাথেই ছিলেন না,
তিনি তাঁর বিশিষ্ট পরামর্শদাতাও ছিলেন। এমনকি তিনি হযরত
ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শদাতারূপেও কাজ করেছিলেন। আর ছানী আযান মসজিদের ভিতরে, মিম্বরের নিকটে দেয়ার ব্যাপারে হযরত ওসমান (রাঃ) যখন
ইজ্তিহাদ করলেন, তখন হযরত সাহাবা-ই-কিরাম
(রাঃ)গণ সে বিষয়ে একমত পোষণ করেন এবং এটাই পরবর্তীতে ইজ্মায়ে আযীমত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
হয়। এবং হযরত আলী (রাঃ)ও উপরোক্ত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। কিন্তু
হযরত আলী (রাঃ) উক্ত ছানী আযানের ব্যাপারে কোনরূপ মতদ্বৈততা পেশ করেছেন, ভিন্নমত পোষণ করেছেন বা বিপরীত বক্তব্য পেশ করেছেন অথবা
তা গ্রহণ করেননি, এরূপ কোন দলীল
কি কেউ কস্মিনকালেও পেশ করতে পারবে? মূলতঃ এরূপ কোন দলীল কেউ কস্মিনকালেও পেশ করতে পারবেনা।
অথচ হযরত আলী
(রাঃ) যে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণকে অনেক মাসয়ালা সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছার
ক্ষেত্রে সহযোগীতা করেছেন, তার বহু প্রমাণ বা দৃষ্টান্ত কিতাবে উল্লেখ রয়েছে। যেমন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা
হয়, আমীরুল মু’মিনীন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর খিলাফতকালে এরূপ একজন মহিলার ব্যাপারে মামলা দায়ের
করা হয়, যে মহিলা ব্যাভিচারের কারণে গর্ভবতী
হয়েছিল। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) সে মহিলাকে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদন্ড কার্যকর
করার নির্দেশ দেন। হযরত আলী (রাঃ) এ নির্দেশ শুনে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! “শরীয়তের নির্দেশ হলো- গর্ভবতী মহিলার সন্তান খালাস না
হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা যাবেনা।” আমীরুল মু’মিনীন, হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তা মেনে নিলেন এবং বললেন,
لولا على
لهلك عمر.
অর্থঃ- হযরত
আলী (রাঃ) না হলে আমি হযরত ওমর (রাঃ) হালাক হয়ে যেতাম।”
এ প্রসঙ্গে কিতাবে
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ আছে- আমীরুল মু’মিনীন, হযরত ওমর ইবনুল
খাত্তাব (রাঃ) একদিন হাজ্রে আস্ওয়াদকে চুম্বন করলেন এবং বললেন, হে হাজরে আস্ওয়াদ! তোমাকে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুম্বন করেছেন বিধায় আমি তোমাকে চুম্বন
করলাম। প্রকৃতপক্ষে তোমার ভালমন্দ করার কোন ক্ষমতা নেই। এ কথা শুনে হযরত আলী (রাঃ)
বলে উঠলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! হাদীস শরীফে রয়েছে,
“এ পাথরটি বেহেশ্ত থেকে এসেছে, তাকে যে চুম্বন করবে, তার গুণাহ্খাতা সমূহ্ সে চুষে নিবে এবং ক্বিয়ামতের ময়দানে তার জন্য সুপারিশ করবে।” একথা শুনে হযরত ওমর (রাঃ) ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) তা বিনা
দ্বিধায় মেনে নিলেন।
সুতরাং উপরোক্ত
ঘটনার আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত ওসমান (রাঃ)-এর ছানী আযান সম্পর্কিত ইজ্তিহাদ যদি হযরত আলী (রাঃ) মেনে না
নিতেন বা সমর্থন না করতেন, তবে তিনি অবশ্যই তাঁর প্রতিবাদ করতেন। অথচ এরূপ একখানা দলীলও কেউ পেশ করতে পারবেনা
যে, তিনি এ ব্যাপারে কোন প্রকার মতভেদ
করেছেন। কাজেই হযরত আলী (রাঃ) ছানী আযানের ব্যাপারে ইজ্মা বা ঐক্যমত পোষণ করেননি, একথা সম্পূর্ণই মনগড়া ও মিথ্যা। বস্তুতঃ তাফসীরে “মাওয়াহিবুর রহ্মানে” ছানী আযান প্রসঙ্গে ও হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে যে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, তা নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বসমাদৃত কোন তাফসীর, হাদীস শরীফ, ফিক্বাহ্, ফতওয়া ও ইতিহাসের
কিতাবে উল্লেখ নেই।
সুতরাং এরূপ
মনগড়া কিতাবের কোন মূল্যই নেই। কারণ এরূপ যে কেউ তার ইচ্ছামত অনেক কিছুই লিখতে পারে
এবং সেটা কিতাব আকারে প্রকাশ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে মসজিদে মহিলা জামায়াত পাঠকারীদের
কথা বলা যায়। মসজিদে মহিলা জামায়াত ইজ্মা দ্বারা মাকরূহ্ তাহ্রীমী সাব্যস্ত হওয়ার পরও
অনেকে মহিলা জামায়াত পাঠের পক্ষে কিতাব লিখছে অথচ যা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
আরো বিবেচ্য
যে, কোরআন-হাদীস সম্মত এবং নির্ভরযোগ্য
ও গ্রহণযোগ্য কিতাবের বর্ণনার সাথে সদৃশপূর্ণ হওয়ার পরও যদি আরফুশ্ শাযী, ফয়জুল বারী এবং আযীযুল ফতওয়া কিতাব-এর বর্ণনা গ্রহণযোগ্য
নয় বলে মন্তব্য করা হয়, তবে দলীলবিহীন ও ভুল বক্তব্যযুক্ত মাওয়াহিবুর রহ্মান ইত্যাদির দলীল গ্রহণের কথা
কি করে বলা যেতে পারে? এবং “মাওয়াহিবুর রহ্মানের” বক্তব্য দ্বারা মাসিক আল বাইয়্যিনাতে বর্ণিত “ছানী আযান” সম্পর্কিত হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের ইজ্মা কি করে রদ্ বা ভুল প্রমাণ করার
কথা চিন্তা করা যেতে পারে?
মূলতঃ ছানী আযানের
ব্যাপারে হযরত সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ)গণের মধ্যে ইজ্মায়ে আযীমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মাসিক আল বাইয়্যিনাতের এ বক্তব্যই বিশুদ্ধ, নির্ভরযোগ্য, দলীল ভিত্তিক ও গ্রহণযোগ্য। আর তাফসীরে মাওয়াহিবুর রহ্মানের বক্তব্য দলীলবিহীন, মনগড়া ও সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।
( অসমাপ্ত )
0 Comments:
Post a Comment