সুওয়াল :
মাসিক আল জামিয়া ডিসেম্বর/৯৫ সংখ্যায় নিম্নোক্ত প্রশ্নোত্তর ছাপানো হয়-
প্রশ্ন :
ধুমপান হালাল না হারাম?
হারাম হলে দলীল কি? যারা ধুমপানকে হালাল বলে থাকেন, তারা কি
গুণাহগার হবেন? বিস্তারিত জানতে আগ্রহী।
উত্তর :
এ সম্পর্কে চার মাযহাবে উলামা মাশায়েখদের মধ্যে অত্যন্ত মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়।
শামীতে বলা হয়েছে,
اضطرات
اراء العلماء فيه فبعضهم قال بكراهيته وبعضهم قال مباحته وقد افتى بالمنع صفه ৪৫৯ وظاهر الكلام انه مكروه تحرمما صفه ৩৬০.
উপরোক্ত
এবারতের দ্বারা এ ব্যাপারে ফুকাহাদের মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু
দুর্গন্ধ এবং শারীরিক ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে ধুমপানের অঞ্জাম মাকরূহ পর্যায়ে আসে।
তাই ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে- অন্যথায় নয়। না করাই উত্তম। বিশেষতঃ এ
অবস্থায় মসজিদে যাওয়া অন্যান্য মুসল্লীদের জন্য কষ্টের কারণ। ভাল করে মুখ ধুয়ে
মসজিদে যাবে।
এখন আমার
প্রশ্ন হচ্ছে- প্রদত্ত উত্তরটি একেবারেই অস্পষ্ট, যা পরোক্ষভাবে ধুমপানের প্রতি
প্রেরণা যোগায়। স্পষ্ট ও সঠিক জাওয়াব কি হবে, তা জানায়ে সন্দেহমুক্ত করবেন।
জাওয়াব :
মাসিক আল জামিয়ার উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরে যে দলীল ও বক্তব্য পেশ করা হয়েছে, তা
অস্পষ্ট ও অশুদ্ধ হয়েছে। কারণ স্পষ্ট, ছহীহ ও গ্রহণযোগ্য ফতওয়া মুতাবিক
ধুমপান যেখানে মাকরূহ তাহরীমী, সেখানে মনগড়া মত পেশ করে তারা যেমন নিজেদের গুমরাহী প্রকাশ
করেছে, তেমনি সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার ব্যর্থ কোশেশ করেছে।
মূলত :
ধুমপানের মাসয়ালাটি ক্বিয়াসী মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত। যার বর্ণনা সরাসরি পবিত্র
কুরআন শরীফ এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে উল্লেখ নেই। আর না থাকাটাই
স্বাভাবিক, কেননা বিড়ি, সিগারেট হুক্কা ইত্যাদি যা তামাক দ্বারা তৈরী হয়। যার ব্যবহার মহান আল্লাহ পাক
উনার রসূল নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
যামানার অনেক পরে শুরু হয়েছে।
আমেরিকার
পাশে কিউবা নামক একটি দেশে তামাকের চাষ হতো, সেখান থেকে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের
শাসনামলে জনৈক রাষ্ট্রদূত ভারত উপমহাদেশে সর্ব প্রথম তামাক নিয়ে আসে। পরবর্তীতে এ
উপমহাদেশে ধুমপানের ব্যবহার শুরু হয়। তামাক সম্পর্কে সর্ব প্রথম ফতওয়া প্রদান করেন, হযরত শাহ
ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘দুররে
ছামীন’ কিতাবে। তাতে তিনি ধুমপান মাকরূহ তাহরীমী বলে ফতওয়া প্রদান করেন এবং তিনিই
ধুমপানের সর্ব প্রথম ফতওয়া প্রদানকারী। উনার পরে ফতওয়া দেন, হযরত শাহ
আব্দুল আজিজ রহমতুল্লাহি আলাইহি। যা সহীহ হাদীছ শরীফ থেকে ক্বিয়াস করে প্রদান করা
হয়েছে। এবং এটাই ছহীহ ও নির্ভরযোগ্য ফতওয়া, যার উপর ওলামায়ে হক্কানী, রব্বানীগণ
একমত।
পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
من
اكل هذه الشجرة المنتنة فلا يقربن مسجدنا فان الملائكة تتأذى مما يتأذى منه الانس.
অর্থ : “যে
ব্যক্তি এমন দুর্গন্ধযুক্ত বৃক্ষের (কাঁচা পিঁয়াজ বা রসূনের) কিছু খায়, সে যেন
আমাদের মসজিদের নিকটেও না আসে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ ও মিশকাত শরীফ)
পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে,
نهى
عن هاتين الشجر تين يعنى البصل والثوم وقال من اكلهما فلا يقرين مسجدنا وقال ان
كنتم لا بد اكلهما فا ميتو هما طبخا.
অর্থ :
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এ দু’টি বস্তু
খেতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ পিঁয়াজ ও রসূন এবং বলেছেন, “যে
ব্যক্তি ওটা খায়,
সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটেও না আসে।” তিনি আরো
বলেছেন, “তোমাদের যদি খেতেই হয়,
তাহলে তা রান্না করে দুর্গন্ধ বিনষ্ট করে খাবে।” (আবূ দাউদ
শরীফ ও মিশকাত শরীফ)
উল্লেখিত
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা কুতুবুদ্দীন খান
দেহলভী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “যে সকল দুর্গন্ধযুক্ত বস্তুর
দ্বারা মানুষের কষ্ট হয়,
তার দ্বারা ফেরেশতাদেরও কষ্ট হয়।” (মুযাহেরে
হক্ব)
সুতরাং
কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসূন এবং এ জাতীয় যে সমস্ত কাঁচা দ্রব্য খেলে মুখে দুর্গন্ধ হয়, সেটা
খাওয়া মাকরূহ তানযিহী এবং সেটা খেয়ে মসজিদে যাওয়া মাকরূহ তাহরীমী।
এ
মাসয়ালার উপর ক্বিয়াস করে ধুমপান করা মাকরূহ তাহরীমী এবং ধুমপান করে মসজিদে যাওয়া
হারাম ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে। কেননা কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসুন খাওয়া অপেক্ষা ধুমপানে
মুখ অনেক বেশী দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে।
এ ছাড়াও
ফিক্বাহের কিতাবসমূহে ধুমপান মাকরূহ তাহরীমী হওয়ার ব্যাপারে নিম্নোক্ত কারণসমূহ
উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) বিড়ি, সিগারেটে
‘নিকোটিন’ রয়েছে। যেটা পান করা বিষ পানের নামান্তর।
(২)
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে ধুমপান স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর।
(৩)
ধুমপানে আর্থিক অপচয় হয়। কুরআন শরীফে এরশাদ হয়েছে,
ان المبذرين كانوا اخوانا الشياطين.
অর্থ : “নিশ্চয়ই
অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।”
(৪)
ধুমপানে আগুনের ধোঁয়া মুখের ভিতর প্রবেশ করানো হয়, যা জাহান্নামীদের সাথে সদৃশ হয়ে
যায়।
পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আছে,
كل دخان حوام.
অর্থ : “প্রত্যেক
ধোঁয়াই (পান করা) হারাম।”
(৫)
ধুমপান বিধর্মীদের প্রচলিত অভ্যাস। ধুমপানে তাদের মুশাবেহাত হয়। হাদীছ শরীফে
বর্ণিত হয়েছে,
من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ : “যে
ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখবে, তাদের সাথেই তার হাশর-নশর হবে।”
(৬)
ধুমপানে মানুষ ও হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস
সালাম উনাদের কষ্ট হয়। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
ايذاء المسلم كفر.
অর্থ : “মুসলমানদেরকে
কষ্ট দেয়া কুফরী।”
(৭)
ধুমপানে নেশার সৃষ্টি হয়। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
كل مسكر حرام.
অর্থ : “সমস্ত
নেশাজাতীয় দ্রব্যই হারাম।”
এছাড়াও
আরো শত সহস্র কারণ রয়েছে। কাজেই যারা ধুমপান মুবাহ ফতওয়া দিয়েছে, তাদের
ফতওয়া কখনোই গ্রহণয্যো নয়। কারণ কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসুন বা এ জাতীয় সাধারণ
গন্ধযুক্ত খাদ্য খাওয়া যেখানে মাকরূহ তানযিহী, সেখানে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা
ইত্যাদি মারাত্মক দুর্গন্ধযুক্ত দ্রব্য কি করে মুবাহ হতে পারে?
অতএব
ধুমপান সম্পর্কে শরীয়তের মূল ফতওয়া হচ্ছে- মাকরূহ তাহরীমী। কেউ কেউ হারাম ফতওয়াও
দিয়েছেন।
তাছাড়া
নিন্মোক্ত কিতাবসমূহেও ‘ধুমপান’ করা ‘মাকরূহ তাহরীমী’
লেখা হয়েছে- শরহে ওহবানিয়া, গায়াতুল আওতার, সুয়ালাতে
আসরার, হাদিয়া, তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া উসিলায়ে আহমদীয়া, নাসিহাতু ইবাদিল্লাহ ওয়া উম্মতে
রসূলিল্লাহ, ক্বাওলুস সাবিত,
দুররে ছামীন, তারাবিহুল কেনান, সুলুহুল
ইখওয়ান বি ইযাতে নারিদ্দুখান, তোহফাতুল ইখওয়ান ফি শরবিদ্দুখান, তোহফাতুল
মাকাসেদে ওয়ার রাসায়েল,
ইমামুল ইখওয়ান ফি তাহরীমুদ্দুখান, আল
বুরহান ফি তাহরীমুদ্দুখান,
তাফসীরে রুহুল মা’য়ানী, তিবইয়ান, বুখারী
শরীফ, মুসলিম শরীফ,
মিশকাত শরীফ, মুযাহেরে হক্ব, ফতওয়ায়ে
আজিজীয়া, ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই লক্ষ্মৌবী, ফতওয়ায়ে আমিনীয়া, ফতওয়ায়ে
আশরাফিয়া, ইমদাদুল ফতওয়া,
নেহায়া, আইনী, দায়লামী শরীফ, দুররে মুখতার, আল আশবা
ওয়ান নাজায়ের, ফতওয়ায়ে আলমগিরী,
ফতওয়ায়ে হাম্মাদীয়া, শরহে মাওয়াহেবুর রহমান, মাজালেসুল
আবরার, কেফায়েতুল মুফতী,
আল হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম ইত্যাদি।
[ধুমপান
সম্পর্কে বিস্তারিত ফতওয়া অচিরেই আমরা আমাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায় প্রকাশ
করবো ইনশাআল্লাহ। ]
আবা-৩২