সুওয়াল : মাসিক মদীনা ডিসেম্বর/৯৬ইং
সংখ্যায় নিন্মলিখিত প্রশ্নোত্তর ছাপানো হয়-
প্রশ্ন : কোন কোন জায়গায় জানাযার নামায শেষ করার পর মৃত ব্যক্তির জন্য হাত তুলে দোয়া
করা হয়। এটা শরীয়ত অনুযায়ী জায়েয কি না?
উত্তর : জানাযার সবটুকুই মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া।
দোয়ার এই পদ্ধতিই নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী
দোয়া করার পর সঙ্গে সঙ্গেই পুনরায় হাত তুলে দোয়া করণে মনে হয় যেন হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলিইহি ওয়া সাল্লাম দেয়া
দোয়ার পদ্ধতিটুকু পরিপূর্ণ ছিল না। তার সাথে কিছু সংযুক্ত করা প্রয়োজনীয়তা রয়ে
গিয়েছিল। আর যেহেতু হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবীগণের দ্বারা জানাযার পর হাত তুলে
দোয়া করার কোন প্রমাণ নাই, সে কারণে ফেকাহ্বিদগণ এই দোয়াকে
মকরুহ এমনকি বেদাত এবং নাজায়েয পর্যন্ত বলেছেন। হিজরী ৩য় শতাব্দীর বিখ্যাত
ফেকাহ্বিদ ইমাম আবু বকর ইবনে হামেদ রহমতুল্লাহি
আলাইহি-এর মতে জানাযার পরপরই হাত তুলে দোয়া করা মকরুহ্।
(ফাওয়ায়েদে-বাহীয়্যাহ ১ম খন্ড) শামসুল আয়েম্মাহ্ হালওয়ানীর (রাহঃ মৃঃ ৪৫৪হিঃ)
অভিমত হচ্ছে,
জানাযার পর দোয়ার জন্য হাত তোলা অনুচিত। (ক্বানিয়্যাহ)-
জানাযার পর হাত তুলে দোয়া করা যাবে না।-(ফাতাওয়ায়ে ছেরাজিয়্যাহ)।
মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন- জানাযার পর
পুনরায় মৃতের জন্য হাত তুলে দোয়া করা যাবে না। -(মেরক্কাতঃ শরহে মেশকাত)
এখন আমার
সুওয়াল হচ্ছে- মাসিক মদীনার উপরোক্ত উত্তর শুদ্ধ হয়েছে কি? নির্ভরযোগ্য
দলীল-আদিল্লার মাধ্যমে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : না, মাসিক মদীনার প্রদত্ত উত্তর
সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়নি। কারণ জানাযার নামাজের পর হাত তুলে মুনাজাত করা জায়েয, তথা মোস্তাহাব। স্বয়ং আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
জানাযার নামাজের পর মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া ও মুনাজাত করেছেন। আবার জানাযা নামাযের
পর মুনাজাত করা মাকরূহ ও বিদয়াত। অর্থাৎ শর্ত সাপেক্ষে জায়েয ও মোস্তাহাব আর শর্ত
সাপেক্ষে মাকরূহ ও বিদয়াত।
মূলত
মাসিক মদীনার সম্পাদক উক্ত কিতাবগুলোর ইবারতের সঠিক ব্যাখ্যা বুঝতে সক্ষম হয়নি।
বরং যা বুঝেছে,
তা সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছে। কেননা উক্ত কিতাব সমূহের বক্তব্য
সমূহ ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। যেমন হানাফী মাযহাবের সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য ফতওয়ার কিতাব মূহীত্বে সারাখছীতে উল্লেখ আছে যে,
ان الدعاء بعد الصلوة الجنازة مكروه.
অর্থ : “নিশ্চয়
জানাযার নামাযের পর
মুনাজাত করা মাকরূহ।”
ফিক্বাহের
বিশ্ববিখ্যাত কিতাব খোলাছাতুল ফতওয়া সিরীজিয়া, বাজ্জাজিয়াহ
এবং বাহরুর রায়েকে
উল্লেখ আছে যে,
لايدعوا
بعد التسليم كما فى الخلاصة وعن الفصلى لا بأس به.
অর্থ : “(জানাযার
নামাজের) সালামের পর মুনাজাত করবেনা।
অনুরূপ
খোলাসা কিতাবে বর্ণিত আছে, আর ফাজলীহ্তে বর্ণিত আছে যে, (জানাযার নামাজের পর) মুনাজাত করাতে কোন ক্ষতি নেই।”
আর
বিখ্যাত মুহাদ্দিস মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কিতাব
মিশকাত শরীফের শরাহ মিরকাত শরীফে উল্লেখ করেন যে,
ولا
يدعوا للميت بعد صلوة الجنازة لانه يشبه الزيادة فى صلوة الجنازة.
অর্থ : “জানাযার
নামাজের পর মৃত ব্যক্তির জন্যে মুনাজাত করবে না, কেননা
এরূপ মুনাজাত করা জানাযার নামাজে বৃদ্ধি করার নামান্তর।”
উল্লেখিত
ইবারত বা বক্তব্যসমূহ অবশ্যই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত, তবে তা
অবশ্যই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। মূলত উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা এটাই বুঝানো হয়েছে যে, জানাযার নামাজের পর পর অর্থাৎ সালাম ফিরানোর সাথে সাথে অন্যন্য নামাজের ন্যায়
কাতারে থেকেই মুনাজাত করা মাকরূহ, কেননা তাতে মুনাজাতও জানাযার
নামাজের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়।
অতএব, জানাযার নামাজের পর কাতার ভঙ্গ করে এবং মৃত ব্যক্তির নিকট হতে সরে গিয়ে সকলে
একত্রিত হয়ে মুনাজাত করবে, এরূপভাবে মুনাজাত করা মাকরূহ্ নয়।
যদি সাধারণভাবে (مطلقا)জানাযার নামাজের পর মুনাজাত করা মাকরূহ্ বা নাজায়েয হতো, তবে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাযার নামাজের পর মৃত ব্যক্তির জন্যে দোয়া
করতেন না। অথচ হাদীছ শরীফ ও ফিক্বাহের কিতাবে স্পষ্ট বর্ণিত রয়েছে যে, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাযার নামাজের পর মৃত ব্যক্তির জন্যে মুনাজাত
বা দোয়া করেছেন। তবে কি তিনি নাজায়েয ও মাকরূহ কাজ করেছেন? (নাউজুবিল্লাহ)
মূলত
জানাযার নামাজের পর মৃত ব্যক্তির জন্যে মুনাজাত করা সুন্নত। তবে শর্ত হলো-
(১) উক্ত মুনাজাতকে ফরয-ওয়াজিবের
ন্যায় জরুরী মনে করা যাবেনা অর্থাৎ সুন্নত মনে করেই করতে হবে।
(২) জানাযার নামাজের সালাম ফিরানোর সাথে সাথে মুনাজাত করা যাবেনা।
(৩) সালাম ফিরানোর পর কাতার ভঙ্গ করে মৃত ব্যক্তি থেকে সরে গিয়ে মুনাজাত করবে।
এরূপভাবে মুনাজাত করা জায়েয বরং সুন্নত, অর্থাৎ সুন্নাতে যায়েদাহ্।
এখানে
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে- ফতহুল ক্বাদীর, সিফরুস সায়াদাত এবং যাদুল আখিরাত
কিতাবে উল্লেখ আছে যে, আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানাযার নামায পড়ে এ দোয়া পাঠ করতেন-
اللهم
انت ربها وانت خلقتها وانت رزقتها وانت هديتها الى الاسلام- وانت قبضت روحها وانت
اعلم يسرها وعلايتها جئنا شفعاء فا غفر لها وارحمها انك انت الغفور الرحيم.
অর্থ : “হে মহান আল্লাহ পাক! আপনিই তার রব, আর আপনিই তাকে সৃষ্টি করেছেন ও রিযিক দান করেছেন। আর তাকে ইসলামের দ্বারা
হিদায়েত দান করেছেন। আপনি তার রূহ্ কবয করেছেন ও আপনিই তার জাহের-বাতেন সম্পর্কে
অধিক জ্ঞাত। আমি সুপারিশ করছি- তাকে ক্ষমা করে দিন, তার
প্রতি দয়া করুন। নিশ্চয়ই আপনি অতি ক্ষমাশীল ও অতিশয় দয়ালু।”
তবে উক্ত
মুনাজাতে নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
হাত তুলেছেন কি না, সে সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে স্পষ্ট
কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে দাফনের পর হাত তুলে মুনাজাত করেছেন, তার স্পষ্ট দলীল রয়েছে। আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
জানাযার নামাজের পর হাত তুলে মুনাজাত করতে যেহেতু নিষেধ করেননি, সেহেতু কোন উম্মতের পক্ষে সেটা নিষেধ করা জায়েয হবেনা। কারণ অনুসরণীয় ইমাম ও
মুজতাহিদগণের রায় হাত তুলে মুনাজাত
করার পক্ষে। যেমন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
رفع
اليدين عند الدعاء على ما عليه عمل الامة انماهو من الاداب والاسحباب والاتباع
الاثر لا على سنة الهدى.
অর্থ : “উম্মতের
মধ্যে মুনাজাতে হাত উঠানোর যে আমল বিদ্যমান রয়েছে, নিশ্চয়ই
তা আদব,
মুস্তাহাব ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাদের অনুসরণের অন্তর্ভূক্ত। তবে
সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ্ নয়।” (ফতহুল ক্বাদীর)
অতএব, জানাযার নামাজের পর হাত তুলে মুনাজাত করাও মোস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত।
কিতাবে
আরো উল্লেখ করা হয়েছে,
وضع
عمر على سريره فتكفنه الناس يدعون وسشنون وسصلون عليه قبل ان يرفع.
অর্থ : “হযরত উমর ফারূক
আলাইহিস সালাম উনার খাটের উপর রাখা হয়েছিল। অতঃপর লোকেরা উনাকে কাফন পরাচ্ছিল এবং উনাকে উঠিয়ে নেয়ার পূর্বে উনার জন্য লোকেরা দোয়া-দরূদ পড়ছিলেন।” (মিরকাত শরীফ)
روى
ان رجلا فقل هكذا بعدا الصلوة فراه رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال ادع يستجب
لك.
অর্থ : বর্ণিত আছে, এক ব্যক্তি জানাযার নামাজের পর অনুরূপ দোয়া-দরূদ পড়ছিলেন। নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখে বললেন, “দোয়া কর,
তোমার দোয়া অবশ্যই কবুল হবে।” (কেফায়া, এনায়া)
وفى
نافع المسلمين رجل رفع يديه بدعاء الفاتحة للميت قبل الدفن جاز.
অর্থ : “নাফেউল
মুসলিমীন কিতাবে উল্লেখ আছে- মৃতের জন্য দাফনের পূর্বে (জানাযার নামাজের পর) উভয়
হাত উঠিয়ে মুনাজাত করা জায়েয।” (জাওয়াহিরুল নাফীস, শরহে দুররুল ক্বাইস-১৩২)
সুতরাং
প্রমাণিত হলো যে, জানাযার নামাজের পর হাত তুলে মুনাজাত করা জায়েয, তথা সুন্নত। এছাড়া নিম্নলিখিত কিতাবসমূহে জানাযার নামাজের পর হাত তুলে মুনাজাত
করাকে জায়েয বলা হয়েছে- জামিউর রুমুয, তাতারখানিয়া, হাদীয়াতুল মুসাল্লিন, শরহে বরযখ, ফতওয়ায়ে দেওবন্দ, ফতওয়ায়ে মাহমুদীয়া, ফতহুল
বারী শরহে বোখারী ইত্যাদি।
[বিঃদ্রঃ- বিস্তারিত জানার জন্য মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ২০তম ও ৩৬তম
সংখ্যা পড়ুন।]
আবা-৪১
জানাযা নামাযের পর হাত তুলে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করার
শরয়ী ফায়সালা ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া -
১. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_13.html
২. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_30.html
৩. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_59.html
৪. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_14.html
৫ক. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_99.html
৫খ. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_22.html
৬. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_42.html
৭. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_93.html
৮. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_0.html
৯. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_86.html
১০. https://khawajarazi.blogspot.com/2019/02/blog-post_35.html