মহাসম্মানিত হিজরত মুবারক উনার শুরু থেকে পবিত্র মদীনা শরীফ পৌঁছা পর্যন্ত ঘটনাসমূহের বর্ণনা আকাবা উনার ১ম বায়াত শরীফ

মহাসম্মানিত হিজরত মুবারক উনার শুরু থেকে পবিত্র মদীনা শরীফ পৌঁছা পর্যন্ত ঘটনাসমূহের বর্ণনা আকাবা উনার ১ম বায়াত শরীফ:

মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র হিজরত মুবারক উনার সূচনা হয় পবিত্র আকাবা উনার বাইয়াত শরীফ থেকে। পবিত্র মদীনা শরীফ উনার অধিকাংশ অধিবাসী ছিলেন আওস ও খাযরাজ সম্প্রদায়ভুক্ত। আর উনাদের সাথে কিছু ইহুদীও বাস করতো; যারা ছিলো আহলে কিতাব। পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে যেহেতু ইহুদীরা সংখ্যালঘু তাই যখনই তাদের সাথে আওস ও খাযরাজ সম্প্রদায়ের ঝগড়া-বিবাদ লেগে যেতো, তখনই ইহুদীরা বলতো, শিগগিরই যিনি শাহীদুন নবী, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যিনি হাযির-নাযীর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যিনি হায়াতুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, যিনি মুত্তালাল গায়িব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যমীনে তাশরীফ আনছেন, আমরা উনার আনুগত্য করবো এবং উনাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা তোমাদেরকে আদ ও ইরাম জাতির মতো ধ্বংস ও পর্যুদস্ত করবো। দেখো গেলো, যখন পবিত্র হজ্জ উনার মওসুম এলো, খাযরাজ সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন উনারা পবিত্র মক্কা শরীফ আগমন করলেন। এটা ছিলো আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত শরীফ প্রকাশের ১১তম বর্ষ। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদের নিকট তাশরীফ মুবারক গ্রহণ করলেন এবং পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি আহ্বান করলেন, তাদের সামনে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করলেন। ওই সমস্ত ব্যক্তি উনাকে দেখে চিনে ফেললেন এবং পরস্পর উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! ইহুদীরা যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে উল্লেখ করতো, উনি সেই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। সুবহানাল্লাহ! উনারা পরামর্শ করলেন, দেখুন! এমনটি যেনো না হয় যে, উনার খিদমত মুবারক আঞ্জাম দেয়ার ব্যাপারে ইহুদীরা আমাদের অগ্রগামী না হয়। আর ওই মজলিস থেকে উঠার পূর্বেই উনারা পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা তো আপনার প্রতি ঈমান আনলাম আর ইহুদীদের সাথে আমাদের প্রায় ঝগড়া হয়। যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে আমরা ফিরে গিয়ে তাদেরকে পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি আহ্বান করবো। যদি ওরা পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনাকে গ্রহণ করে আর এ অবস্থায় তারা ও আমরা ঐক্যবদ্ধ হই তা হলে সবাই মিলে আমরা আপনার খিদমতের আঞ্জাম দিবো ইনশাআল্লাহ। এই মজলিসে ঈমান আনয়নকারী হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সংখ্যা ছিলেন ৬/৭ জন। যা ছিলো মহাসম্মানিত আকাবা উনার ১ম বাইয়াত মুবারক। সুবহানাল্লাহ!

আহলু বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মুত্বহ্হার, মুত্বহহির, আছ ছমাদ, মুজাদিদ্দে আ’যম মামদূহ মুর্শিদ ক্বিবলা সাইয়্যিদুনা ইমাম খলীফাতুল্লাহ হযরত আস সাফফাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র বাই‘আতে আক্বাবাহ্ শরীফ তিন বার অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম বার নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনি দুনিয়াবী দৃষ্টিতে ৫১তম বছর বয়স মুবারক-এ, দ্বিতীয় বার ৫২তম বছর বয়স মুবারক-এ এবং তৃতীয় বার ৫৩তম বছর বয়স মুবারক-এ। প্রথম বার ৬/৭ জন, দ্বিতীয় বার ১২ জন এবং তৃতীয় তথা শেষ বার ৭৩ জন পুরুষ এবং ২ জন মহিলা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহুম উনারা বাই‘আত মুবারক গ্রহণ করেন।” সুবহানা মুর্শিদ ক্বিবলা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! 

আকাবা উনার ২য় বায়াত শরীফ:

অতঃপর যখন পরবর্তী বৎসর এলো যা ছিলো আনুষ্ঠানিক পবিত্র নুবুওওয়াত শরীফ উনার দ্বাদশতম বর্ষ। বারোজন ব্যক্তি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ মুবারকের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা শরীফ আগমন করেন। পাঁচজন পূর্বের আর বাকি সাতজন ছিলেন নতুন। সর্বমোট ১২ জন।

উনারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক খিদমতে উপস্থিত হন এবং মিনা প্রান্তরে আকাবার সন্নিকটে এই মর্মে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাত মুবারকে বাইয়াত হন। যাকে পবিত্র আকাবা উনার প্রথম বাইয়াত শরীফ বলা হয়। উনারা যখন বাইয়াত হয়ে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রত্যাবর্তন করতে উদ্যত হন, তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাদেরকে পবিত্র কুরআন শরীফ এবং পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বিধি-বিধান তা’লীম বা শিক্ষা দানের জন্যে উনাদের সঙ্গে প্রেরণ করা হয় এবং উনারা পবিত্র মদীনা শরীফ পৌঁছে হযরত আসয়াদ ইবনে যুরারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হুযরা শরীফ-এ অবস্থান মুবারক করেন। হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি লোকদের পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি দাওয়াত দিতেন এবং পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে অবস্থিত মুসলমানগণ উনাদের নামাযের ইমামতি করতেন।

 একদিন হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি লোকদের পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার প্রতি আহ্বান করছিলেন। অনেক লোকজন একত্রিত হয়েছিলেন। উসায়ীদ ইবনে হুযাইর যখন এ খবর পেলেন, তখন তিনি খোলা তরবারী হাতে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমাদের নারী ও শিশুদের কেনো বিভ্রান্ত করেছেন? আপনার এখান থেকে চলে যাওয়া উত্তম। হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, যদি সম্ভব হয়, তবে দয়া করে সামান্য সময় আমাদের মজলিসে বসুন, আমি যা বলি মেহেরবানী করে শুনুন। যদি পছন্দ হয় গ্রহণ করবেন আর না হলে চলে যাবেন। হযরত উসায়ীদ ইবনে হুযাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, এটা অবশ্যই আপনি ইনসাফপূর্ণ কথাই বলেছেন। এ বলে তিনি মাজলিসে বসে পড়লেন। হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার সৌন্দর্য বর্ননা করলেন এবং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার থেকে তিলাওয়াত করলেন যা শুনে হযরত উসায়ীদ ইবনে হুযায়র রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন,

مَا أَحْسَنَ هَذَا الْكَلَامَ وَأَجْمَلَهُ

“কতই উত্তম, কতই না চমৎকার কালাম পাক।” সুবহানাল্লাহ! এবং জিজ্ঞেসা করলেন এ পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে প্রবেশ করতে হলে কি করতে হয়? হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, প্রথমে শরীর এবং পোশাক পবিত্র করুন এবং গোসল করুন। এরপর পবিত্র কালিমা-ই শাহাদাত শরীফ পাঠ করুন এবং পবিত্র নামায আদায় করুন। কালিমায়ে শাহাদাত পাঠ করে মুসলমান হলেন। সুবহানাল্লাহ!

আকাবা উনার ৩য় বাইয়াত শরীফ:

আনুষ্ঠানিক নুবুওয়াত মুবারক প্রকাশের ত্রয়োদশ বৎসর পবিত্র আকাবা উনার দ্বিতীয় বাইয়াত বা শপথ অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে হযরত মুসআব ইবনে উমায়র রদ্বিয়াল্লাহু তায়লা আনহু উনাকে পবিত্র মদীনাবাসী উনাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্যে প্রেরণ করা হয়েছিলো। উক্ত বৎসর তিনি হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম এবং পবিত্র মদীনা শরীফ উনার অনেক সম্প্রদায়ের লোকজন উনাদেরকে নিয়ে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে উপস্থিত হলেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সঙ্গে উনাদের কথাবার্তা হলো যে, আইয়ামে তাশরীক উনার দিবসে অর্থাৎ ১২ই যিলহজ্জ শরীফ তারিখে উনারা পবিত্র আকাবা নামক স্থান মুবারকে একত্রিত হবেন। উনাদের মহাসম্মানিত ও মহিমান্বিত করার জন্যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতের আঞ্জাম দেয়ার লক্ষ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি এই সময়টিকে উনাদের জন্যে নির্ধারণ করে দিলেন। সুবহানাল্লাহ!

আমরা পবিত্র মসজিদুল হারাম শরীফ উনার মধ্যে প্রবেশ করেই দেখলাম সাইয়্যিদুনা খতিমুল মুহাজিরীনা হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম তিনি বসে রয়েছেন এবং উনার সঙ্গে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও তাশরিফ মুবারক গ্রহণ করেছেন।

হযরত কা’ব ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, এরপর আমরা পবিত্র হজ্জ আদায়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি এবং ১২ই যিলহজ্জ শরীফ আকাবা উনাতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাক্ষাৎ মুবারক করি। যথা সময়ে একজন দু’জন করে আমরা উনার নিকট উপস্থিত হলাম। শেষ পর্যন্ত আমরা সকলে সেখানে সমবেত হলাম। আমরা বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কোন বিষয়ে আমরা আপনার হাত মুবারকে বাইয়াত করবো? তিনি বললেন, আপনারা আমার হাত মুবারকে বাইয়াত করবেন যে, সুখে, দুঃখে সর্বাবস্থায় আপনারা আমার কথা মুবারক শুনবেন, আমার আদেশ-নির্দেশ মুবারক পালন করবেন। অভাবের সময় স্বচ্ছলতার সময় সর্বসময়ে তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার পথে দান-সদকা করবেন। আপনারা মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির পক্ষে কথা বলবেন, মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে, কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রকার ভৎসনাকারীর ভর্ৎসনার তোয়াক্কা করবেন না। আপনারা এ বিষয়েও বাইয়াত করবেন যে, আপনারা আমার খিদমত করবে এবং আপনাদের নিকট যখন আমি যাই তখনই আপনারা আমার খিদমতের ভার গ্রহণ করবেন। যেমনটি নিরাপত্তা দিয়েছেন আপনাদের নিজেদেরকে এবং আপনাদের আহলিয়া ও পুত্রগণদের। বিনিময়ে আপনারা জান্নাত লাভ ও আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু উনার সন্তুষ্টি লাভ করতে পাবেন। উনার হাত মুবারক ধরে বাইয়াত হওয়ার জন্যে আমরা উঠে দাঁড়ালাম।

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

اِنَّا بَايَعْنَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فى النَّشَاطِ والْكَسَلِ، والنَّفَقَةِ فِى الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ، وَعَلٰى الاَمْرِ بِالْـمَعْرُوْفِ والْنَهْىِ عَنِ الْـمُنْكَرِ، وَعَلٰى أن نَقُوْلَ فِى اللهِ لَا تَـاْخُذُنَا فِيْهِ لَوْمَةُ لَائِمٍ.

অর্থ: নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট নিশ্চয়ই আমরা এই শর্তে বায়াত গ্রহণ করেছি যে, উনার প্রত্যেকটি আদেশ-নিষেধ অবশ্যই শুনব এবং অবশ্যই মানব- ইছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক। অবশ্যই প্রত্যেকটি নেক কাজে আর্থিক শরীক থাকবো- স্বচ্ছল হই বা অস্বচ্ছল হই। প্রত্যেক সৎকাজে আদেশ করব, অসৎ কাজে নিষেধ করব। আমরা মহান আল্লাহ পাক উনার এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের সন্তুষ্টির জন্য এই কাজগুলি করব। এ কাজগুলি করতে গিয়ে আমরা কোন নিন্দাকারীর নিন্দাকে পরোয়া করবো না।

আরও বর্ণিত আছে,

وَعَلٰى اَنْ نَنْصُرَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا قَدِمَ عَلَيْنَا الْـمَدِيْنَةَ مِـمَّا نَـمْنَعُ بِهٖ اَنْفُسَنَا وَ اَرْوَاحَنَا وَأَبْنَاءَنَا وَلَنَا الْجَنَّةُ فَبِهٰذِهٖ بَيْعَةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم الَّتِـيْ بَايَعْنَاهُ عَلَيْهِ:

অর্থ: নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন পবিত্র মদীনা শরীফ তাশরীফ মুবারক রাখবেন তখন উনার সম্মানিত গোলামী মুবারক আমরা সেইভাবে করব যেমন আমরা নিজেদের জান ও প্রাণ এবং আমাদের আল-আওলাদদের হিফাযত করি বরং তার চেয়ে বেশি করব। এর প্রতিদানে আমাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদেরকে এ বিষয়গুলোর শর্তে বায়াত করিয়েছেন এবং আমরা উনার কাছে বায়াত হয়েছি।

আরও বর্ণিত হয়েছে,

اُبَايِعُكُمْ عَلٰى اَنْ تَـمْنَعُوْنِـيْ مِـمَّا تَـمْنَعُوْنَ بِهٖ نِسَائَكُمْ وَاَبْنَائَكُمْ:

অর্থ: আমি এই শর্তে আপনাদের বায়াত করেছি যে, আপনারা আমার গোলামীর আঞ্জাম দিবেন যেমন আপনাদের আহলিয়া এবং সন্তানদের যেভাবে নিরাপত্তা দিয়ে থাকেন তার চেয়ে বেশি । (মুসনাদে আহমদ ২২/৩৪৬)

বর্ণনাকারী জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, হে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার অধিবাসীগণ! থামুন, আমরা উটের পিঠে আরোহন করে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছি এজন্যে যে, আমরা ঈমান এনেছি তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তবে কথা হলো, আজ যদি আপনারা উনাকে এখান থেকে নিয়ে যান, তবে আরবের সকলেই আপনাদের শত্রু হয়ে যায়। আপনাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের শহীদ করে। তীক্ষ্ম তরবারী আপনাদের গরদানে উড়ায়।

এ পরিস্থিতিতে আপনারা যদি এই অঙ্গীকারে অবিচল থাকতে পারেন, অটল থাকতে পারেন, তবে উনাকে নিয়ে যান, ফলশ্রুতিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি খুশি হবেন। আর যদি আপনারা নিজেদের ব্যাপারে শংকিত হয়ে থাকেন, উনার পূর্ণ খিদমতের আঞ্জামে অক্ষমতার ভয় করেন, তবে উনাকে রেখে যান। মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট ওযর পেশ করার জন্যে এটিই হবে সহজতর। উপস্থিত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বলে উঠলেন, হে হযরত আসয়াদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আমরা এই পবিত্র বাইয়াত শরীফ কখনও ত্যাগ করবো না এবং কস্মিনকালেও এর বরখেলাফ করবো না। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মুখে দাঁড়ালাম এবং উনার হাত মুবারকে বাইয়াত হলাম। তিনি আমাদের থেকে কিছু শর্ত ও অঙ্গীকার আদায় করলেন আর বিনিময়ে আমাদেরকে জান্নাত লাভের প্রতিশ্রুতি দিলেন।” সুবহানাল্লাহ! 

আমরা সকলে পবিত্র আকাবায় গিয়ে একত্রিত হলাম। আমরা ছিলাম ৭৩ জন পুরুষ। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ২ জন মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা।

 উনাদের কথা শুনে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মুচকি হাসলেন এবং বললেন, 

 بَلِ الدَّمُ الدَّمُ، وَالْهَدْمُ الْهَدْمُ، أَنَا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مِنِّي، أُحَارِبُ مَنْ حَارَبْتُمْ أُسَالِمُ مَنْ سَالَمْتُمْ-

 অর্থ: “আমার জীবন আপনাদের জীবন, আমার বিদায় আপনাদের বিদায়। আমি আপনাদের, আপনারা আমার। আপনারা যার বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন, আমি তার বিরুদ্ধে জিহাদ করবো আর আপনারা যার সাথে সন্ধি করবেন আমি তার সাথে সন্ধি করবো।” 

 উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমাকে দেখানো হয়েছে হিজরত মুবারক উনার ভূমি বা স্থান মুবারক। জনবহুল এলাকা এবং খর্জুর বৃক্ষ পরিবেষ্টিত কৃষ্ণ প্রস্তরময় দু’টি অঞ্চলের মধ্যেখানে তা অবস্থিত। (বুখারী শরীফ)

দারুন নাদওয়া’য় কাফির মুশরিকদের বৈঠক:

কুরাইশ কাফির মুশরিকরা যখন দেখলো যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুমতি মুবারক নিয়ে ধীরে ধীরে হিজরত করে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে চলে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রায় সমস্ত হযরত সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা হিজরত করেছেন। আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হয়তো অতিসত্বর হিজরত করবেন ভেবে কাফির মুশরিক তথা বিধর্মীরা পরামর্শের জন্য ‘দারুন নাদওয়া’য় সমবেত হয়। 

কুরাইশ কাফির মুশরিকরা যখন দেখলো যে, পবিত্র মক্কা শরীফ উনার বাহিরে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের একটি দল সৃষ্টি হয়ে গেছে এবং হযরত মুহাজির ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা হিজরত করে মদীনা শরীফ উনার মধ্যে হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের নিকট গমন করেছেন। উনারা এমন এক স্থান মুবারকে হিজরত করেছেন যেখানে উনারা নিরাপদ স্থান করে নিয়েছেন, তখন কাফির মুশরিকদের আশঙ্কা জাগলো যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হয়তো তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। তখন তারা উনার প্রসঙ্গ (আলোচনা করার জন্য) ‘দারুন নাদওয়া’য় সমবেত হয়। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ব্যাপারে তারা শঙ্কিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার নিমিত্তে ‘দারুন নাদওয়া’য় সমবেত হওয়া ঠিক করে।

কুরাইশ কাফিররা যখন এ বিষয়ে একমত হয় যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শের দিনক্ষণ নির্ধারণ করে এবং ‘দারুন নাদওয়ায়’ একত্রিত হওয়া সাব্যস্ত হয় এবং তারা এ দিনটার নামকরণ করে ‘ইয়াওমুয যাহমা’ তথা ভিড়ের দিন।

হিজরত মুবারক উনার প্রস্তুতি ও রওয়ানা মুবারক:

ইতোমধ্যে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আগমন করেন এবং উনাকে বিনীতভাবে বলেন, যে শয্যায় আপনি ঘুমাতেন আজ রাতে সে শয্যায় আপনি ঘুমাবেন না। তাদের উপস্থিতি জানতে পেরে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ইবনে আবূ ত্বালীব আলাইহিস সালাম উনাকে বললেন, আমার এই সবুজ হাযরামী চাদর মুবারক গায়ে দিয়ে আপনি আমার শয্যায় শুয়ে পড়েন। এ চাদর মুবারক গায়ে দিয়ে ঘুমালে তাদের পক্ষ থেকে আপনাকে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাধারণত এ চাদর মুবারক গায়ে দিয়েই ঘুমাতেন। সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র কুরআন শরীফ উনার নিম্নোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করতে করতে তাদের দিকে ধুলো ছিটাতে ছিটাতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বের হয়ে যান। 

 يس -وَالْقُرْآنِ الْحَكِيمِ- إِنَّكَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ- عَلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ -تَنزِيلَ الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ- لِتُنذِرَ قَوْمًا مَّا أُنذِرَ آبَاؤُهُمْ فَهُمْ غَافِلُونَ- لَقَدْ حَقَّ الْقَوْلُ عَلَى أَكْثَرِهِمْ فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ - إِنَّا جَعَلْنَا فِي أَعْنَاقِهِمْ أَغْلاَلاً فَهِيَ إِلَى الأَذْقَانِ فَهُم مُّقْمَحُونَ- وَجَعَلْنَا مِن بَيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَمِنْ خَلْفِهِمْ سَدًّا فَأَغْشَيْنَاهُمْ فَهُمْ لاَ يُبْصِرُونَ- 

 উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ সমূহ পাঠ করে মাটির উপর ফু দিয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেখানে যাওয়ার ইচ্ছা মুবারক করেছিলেন সেখানে তিনি চলে গেলেন। তাদের মধ্যে একজন লোকও ছিলো না- যার মাথায় ধুলো লাগেনি। এরপর তাদের সঙ্গে ছিলো এমন এক আগন্তুক সে আগমন করে জিজ্ঞাসা করলো, তোমরা এখানে কিসের জন্যে অপেক্ষা করছো? তারা বললো: আমরা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্যে অপেক্ষা করছি। লোকটি বললো, মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদেরকে ব্যর্থ করেছেন। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! তিনি তো তোমাদের প্রত্যেকের মাথায় মাটি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেছেন। তিনি তো বেরিয়ে গেছেন উনার প্রয়োজনে। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না তোমাদের উপর কি আছে। 

 মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

 وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُواْ لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللّهُ وَاللّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ

 “আপনি স্মরণ করুন, কাফিরেরা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দী করার জন্যে, আপনাকে শহীদ করার জন্যে অথবা আপনাকে নির্বাসিত করার জন্যে এবং তারা ষড়যন্ত্র করে আর মহান আল্লাহ পাক তিনি হিকমত করেন। আর মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বোত্তম হিকমতওয়ালা।” সুবহানাল্লাহ! (পবিত্র সূরা আনফাল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ- ৩০)

 আনুষ্ঠানিকভাবে পবিত্র নুবুওওয়াত শরীফ প্রকাশের ত্রয়োদশ বর্ষে পবিত্র রবীউল আউওয়াল শরীফ মাস উনার মধ্যে ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম শরীফ সুমহান পবিত্র হিজরত মুবারক সংঘটিত হয়। 

 قَالَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اللَّهُمَّ إِنَّكَ أَخْرَجْتَنِي مِنْ أَحَبِّ الْبِلاَدِ إِلَيَّ ، فَأَسْكِنِّي أَحَبَّ الْبِلاَدِ إِلَيْكَ ، فَأَسْكَنَهُ اللَّهُ الْمَدِينَةَ.

অর্থ: “মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! মহান আল্লাহ পাক উনার শ্রেষ্ঠতম জনপদ ও মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট মহান আল্লাহ পাক উনার মাটিসমূহের মধ্যে প্রিয় মাটি। যদি আমাকে আপনার থেকে হিজরত মুবারক করতে নাহতো তাহলে আর বেরিয়ে যেতাম না।”

 নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূত-পবিত্র জবান মুবারক থেকে এ কথা মুবারক শুনে তিনি আশা পোষণ করেন যে, নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বয়ং উনার সঙ্গী হবেন। তিনি দুটি সাওয়ারী মুবারক ক্রয় করেন। সেগুলো নিজ গৃহে রেখে হিজরত মুবারক-এর জন্য প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে সেগুলোকে সযতেœ লালন-পালন করেন।

সাইয়্যিদুনা হযরত মুজাদ্দিদে আ’যম, হযরত মূর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম উনার পূতঃপবিত্র জবান মুবারক-এ বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে রাত্রি মুবারক-এ পবিত্র হিজরত মুবারক করলেন ওই রাত্রি মুবারক-এ যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বীয় হুজরা শরীফ উনার থেকে বের হয়ে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার বাড়িতে গিয়ে উনার ঘরের দরজায় খটখটি দিলেন। খটখটি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা মুবারক খুলে গেলো। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম! আপনি কি ঘুমাননি? তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি যে দিন হিজরত মুবারক উনার কথা বলেছেন সেদিন থেকে আমি বিছানায় ঘুমাই না। কারণ আমি যদি বিছানায় ঘুমিয়ে যাই আর আপনি এসে যদি ডাকেন আপনার ডাকে সাড়া দিতে হয়তো দেরি হয়ে যেতে পারে তাই আমি ওই দিন থেকে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেই। যাতে করে আপনি আমার দরজায় শব্দ করার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিতে পারি এবং আপনি কষ্ট না পান। সুবহানাল্লাহ! 

উল্লেখ্য যে, সাইয়্যিদুনা মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, কাফির মুশরিকরা যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হুজরা শরীফ উনার মধ্যে প্রবেশ করে দেখতে পেলো, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূতঃপবিত্র কম্বল মুবারক গায়ে দিয়ে একজন শুয়ে রয়েছেন। এ দিকে তারা কম্বল মুবারক ধরে টানাটানি করতে লাগলো। আর হযরত আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম তিনি কম্বল মুবারক খুবই শক্তি করে ধরে রেখেছেন যাতে করে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারেন। সুবহানাল্লাহ! কাফির মুশরিকরা কম্বল মুবারক টানাটানি করতে করতে সকাল হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ পর তারা কম্বল মুবারক টেনে নিয়ে দেখতে পেলো নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নন, বরং কম্বল মুবারক-এর ভিতরে যিনি শুয়ে ছিলেন তিনি হচ্ছেন সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম। কাট্টা কাফির আবূ জাহিল উনার গাল মুবারক-এ একটা আঘাত করে পবিত্র হুজরা শরীফ থেকে বের হলো নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে খোঁজার জন্য। নাঊযুবিল্লাহ!

পথ চলাকালীন সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী:

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ও খলীফাতু রসূলিল্লাহ হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনারা দু’জন পবিত্র মক্কা শরীফ উনার নি¤œভূমিতে অবস্থিত ছাওর পাহাড়ের একটি গুহায় তাশরিফ গ্রহণের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। দু’জনেই উনারা গুহায় প্রবেশ করলেন। আর হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে নির্দেশ মুবারক দিয়ে যান তাদের সম্পর্কে লোকজন কি বলাবলি করছে দিনের বেলা তা মনোযোগ সহকারে শুনে এবং সন্ধ্যায় সারাদিনের খবরাখবর নিয়ে যেন উনাদের নিকট আসেন। আর উনারা আযাদকৃত গোলাম হযরত আমীর ইবনে ফুহাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে নির্দেশ দান করেন দিনের বেলা উনার মেষ চরাবার জন্য। আর সন্ধ্যায় যেন তিনি মেষ উনাদের নিকট গুহায় নিয়ে আসেন। সুতরাং হযরত আব্দুল্লাহ ইবেন আবূ বকর ছিদ্দীক্ব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি দিনের বেলা কুরাইশের কাফির, মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করে তারা কি পরামর্শ করছে তা শুনতেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাদের সম্পর্কে তারা কি বলছে তিনি তাও শুনতেন এবং রাত্রিবেলা উনাদের নিকট এসে সেসব উনাদেরকে অবহিত করতেন। আর হযরত আমীর ইবনে ফুহায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি দিনের বেলা পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে রাখালদের সাথে মেষ চরাতেন। আর রাতের বেলা উনাদের নিকট মেষ নিয়ে আগমন করতেন। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি দুধ মুবারক দোহন করতেন এবং মেষ যবেহ করে আহারের ব্যবস্থা করতেন। ভোরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ছিদ্দীক্বে আকবর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনাদের নিকট থেকে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে আগমন করলে হযরত আমীর ইবনে ফুহায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনার মেষ নিয়ে উনাকে অনুসরণ করতেন এবং উনার পদচিহ্ন মুবারক মুছে ফেলতেন। সুবহানাল্লাহ!

উল্লেখ্য যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনারা রাত্রিবেলা গুহার মুখে আসেন। প্রথমে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি গুহার ভিতর প্রবেশ করেন- সেখানে সাপ বিচ্ছু অন্য কিছু আছে কিনা তা দেখার জন্য। আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একাকি গুহার বাইরে অবস্থান করছিলেন।” সুবহানাল্লাহ! এছাড়া হিজরত মুবারকের পথে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি কখনও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সামনে আবার কখনো পিছনে থাকতেন। এ সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যখন পিছনে থাকি, তখন আশঙ্কা জাগে না জানি সম্মুখ থেকে কোনো শত্রু আসে, আবার আমি যখন সামনে থাকি, তখন আশঙ্কা হয় না জানি পিছন থেকে কোনো শত্রু আসে কি না। গুহায় প্রবেশ করে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আপনি দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন, আমি ছিদ্রপথে হাত রেখে দেখি, যদি কোনো সাপ-বিচ্ছু থেকে থাকে, তাহলে আগে আমাকে দংশন করুক। গর্তে একটি ছিদ্র ছিলো। ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে কোনো সাপ-বিচ্ছু বা অন্য কিছু বের হয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কষ্ট দেয় কিনা সে আশঙ্কায় হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি ছিদ্রের মুখে উনার পা মুবারক রেখে তা বন্ধ করে দেন। 

 “হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, গুহার রজনীতে মহান আল্লাহ পাক তিনি বৃক্ষকে নির্দেশ দান করলে বৃক্ষ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মুখে বের হয়ে উনাকে আচ্ছন্ন করে নেয় আর মহান আল্লাহ পাক তিনি মাকড়সাকে নির্দেশ দিলেন মাকড়সা উভয়ের মধ্যস্থলে জাল বিস্তার করে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চেহারা মুবারক আচ্ছাদিত করে নেয় এবং দুটি বুনো কবুতরকে মহান আল্লাহ পাক তিনি নির্দেশ দান করলেন কবুতর দুটি পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মাকড়সার জাল এবং বৃক্ষের মধ্যস্থলে এসে বসে। আর কুরাইশের প্রতিটি গোত্রের যুবক কাফির মুশরিকরা এগিয়ে আসে। তাদের হাতে লাঠি, ধনুক আর ডা-া। তারা যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে দুইশ হাত পরিমাণ দূরে তখন তাদের পথপ্রদর্শক সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জু’শাম মুদলিজী বললো, এ পাথর পর্যন্ত তো বুঝা যাচ্ছে (যার উপর পদচিহ্ন মুবারক রয়েছেন) তবে এরপর কোথায় উনার পা মুবারক পড়েছেন আমি জানি না।

 তখন কুরাইশি কাফির যুবকরা বলে, তুমি রাত্রি বলে ভুল করনি তো? ভোর হলে তাদের পথপ্রদর্শক বলে গুহায় দৃষ্টি দিয়ে দেখি। লোকেরা গুহা দেখার জন্যে ছুটে আসে। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মধ্যখানে আনুমানিক ৫০ হাত দূরত্ব বাকী, তখন কবুতর দুটি ডাক দিয়ে উঠে। তখন তারা বললো, কিসে তোমাকে বারণ করছে? সে বললো, আমি গুহার মুখে দুটি বুনো কবুতর দেখতে পাচ্ছি। তাই আমি বুঝতে পারি যে, গুহার ভিতরে কেউ নেই। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একথা শুনতে পান এবং দেখতে পান যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাদের দু’জনকে হিফাযত করেছেন। কবুতর দুটিকে মহান আল্লাহ পাক তিনি বরকত দান করেন এবং হেরেম শরীফ উনার মধ্যে উনাদেরকে স্থান দান করেন আর সেখানে উনারা বাচ্চা দেন, যেমন আপনি দেখতে পাচ্ছেন।” 

 এ সময় হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বললেন, আপনার স্বজাতির লোকজন, আমাদেরকে খুঁজছে। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আমার নিজের ব্যপারে আমার কোনো চিন্তা নেই তবে আপনার কোনো কষ্ট হোক তা আমি বরদাশত করতে পারবো না। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন-

يا حضرت ابا بكر عليه السلام لاتخف ان الله معنا

“হে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম! আপনার কোনো ভয় নেই। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।” সুবহানাল্লাহ! 

 মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,

 ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لاَ تَحْزَنْ إِنَّ اللّهَ مَعَنَا 

 অর্থ: তিনি ছিলেন দু’জনের দ্বিতীয়জন। যখন উনারা গুহার মধ্যে অবস্থান করেছিলেন, তিনি তখন উনার সঙ্গীকে বলেছিলেন, চিন্তিত হবেন না। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। (পবিত্র সূরা তাওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪০)

 হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি উক্ত কথা মুবারক বললেন তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, তারা এদিক থেকে আসলে আমরা অবশ্যই ঐদিকে চলে যেতাম। তখন হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি পবিত্র গুহা উনার দিকে তাকিয়ে দেখেন যে, একদিক থেকে তা ফাঁক হয়ে গেছে। আর সমুদ্র তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আর অপর প্রান্তে কিস্তি বা নৌকা বাঁধা আছে। মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত আর বিশাল ক্ষমতার কাছে এটা অসম্ভব, অবাস্তব এবং অগ্রাহ্য নয়। সুবহানাল্লাহ! 

 কুরাইশ কাফির মুশরিকদের দূত এসে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকে শহীদ বা বন্দি করার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়। তিনি বলেন, আমার স্বগোত্র বনী মুদলিজের একটি মাজলিসে আমি উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় তাদের এক ব্যক্তি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। আমরা তখন উপবিষ্ট ছিলাম। লোকটি বললো, হে হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আমি সবেমাত্র উপকূলীয় পথে কিছু লোক দেখে এসেছি, আমার ধারণা উনারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উনার সঙ্গী হবেন। হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারলাম যে, উনারা আসলেই উনারা। কিন্তু আমি তাদেরকে বললাম যে, না উনারা নন। তুমি হয়তো অমুককে দেখে থাকবে যে আমাদের সম্মুখ দিয়ে একটু আগে চলে গেছে। এরপর আমি মজলিসে কিছু সময় অবস্থান করি, তারপর উঠে দাঁড়াই এবং গৃহে প্রবেশ করি। আমি আমার ঘোড়া বের করার জন্য আমার বাঁদীকে নির্দেশ দিলাম। আমি তাকে টিলার পেছনে ঘোড়া নিয়ে আমার অপেক্ষায় থাকতে বলি এবং আমি বর্শা নিয়ে ঘরের পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার ঘোড়ার নিকট আসি এবং তার উপর সাওয়ার হই। তাকে ছুটাই আর সে ছুটে যায়। আমাকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে ঘোড়াটি হোঁচট খায় এবং আমি তার পিঠ থেকে নিচে পড়ে যাই। আমি উঠে দাঁড়াই এবং তূনের প্রতি হাত বাড়াই এবং তা থেকে ভাগ্য গণনার তীর বের করে তার সাহায্যে ভাগ্য পরীক্ষা করি। উনাদের ক্ষতি করবো কিনা তা জানার চেষ্টা করি। যা আমি পছন্দ করি না তাই বের হলো। ভাগ্য পরীক্ষার তীরের বিরোধিতা করে আমি ঘোড়ায় সাওয়ার হই, ঘোড়া আমাকে কাছাকাছি নিয়ে যায়। এমনকি আমি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র জবান মুবারক থেকে পবিত্র তিলাওয়াত মুবারক উনার আওয়াজ মুবারক শুনতে পাই। কোনো দিকে উনার লক্ষ্য নেই। 

 আর হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি তখন এদিকে তাকাচ্ছিলেন। আমার ঘোড়ার দু’পা মাটিতে আটকে পড়ে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়। আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাই। আমি উঠে দাঁড়াই, ঘোড়াকে শাসাই। সেও উঠে কিন্তু সামনের পা দুটি মাটি থেকে বের করতে পারলো না। সে যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তখন তার সামনের দু’পায়ের নিচ থেকে ধুলা উড়ে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আবার আমি তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করলাম। এবারও তা-ই বের হলো, যা আমার অপছন্দ। হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি তা দেখেই আঁচ করতে পারলাম যে, উনাকে আমার কবল থেকে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে এটা একান্তই সত্য। উনারা দাঁড়ালেন আমি ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে উনাদের নিকট পৌঁছি। মাটিতে আটকা পড়ে আমার যে দশা হয় তাতে মনে এমন ভাবের উদয় হয় যে, অবিলম্বে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দ্বীন ইসলাম জয়যুক্ত হবে। তখন আমি উনাকে বললাম, আপনার জাতি আপনাকে দেখিয়ে দেয়ার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। উনাদেরকে নিয়ে লোকেরা যা করতে চায়, সে সম্পর্কে আমি উনাদেরকে অবহিত করলাম এবং আমি উনাদেরকে পথের সম্বল আর সামগ্রী দানের প্রস্তাব পেশ করলাম। উনারা আমাকে কোনো জবাব দিলেন না। কোনো কথা আমার নিকট জিজ্ঞাসাও করলেন না। কেবল এটুকুই বললেন যে, আমাদের বিষয়টি গোপন রাখবে। আমাকে নিরাপত্তা পত্র লিখে দেয়ার জন্য আমি আবেদন জানালে তিনি হযরত আমির ইবনে ফুহায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেন। তিনি আমাকে চামড়ায় নিরাপত্তা পত্র লিখে দেন। এরপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সম্মুখে অগ্রসর হন।

 কুরাইশ কাফির মুশরিকরা তখনো আমাদেরকে খুঁজছিলো। কিন্তু হযরত সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জুশাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ছাড়া কেউ আমাদের সন্ধান পায়নি।

পবিত্র মদীনা শরীফে প্রবেশ এবং মদীনা শরীফবাসীর খুশি প্রকাশ:

পবিত্র মক্কা শরীফ উনার নিম্নঞ্চল দিয়ে পথ চলেন। এরপর উনাদেরকে নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে আড়াআড়িভাবে কুবায় পৌঁছে। সেখান থেকে বনূ আমর ইবনে আওফ উনার পল্লীতে তিনি অবস্থান করেন। সেই তারিখটি ছিলো ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীমি উনার ১২ তারিখ। সূর্য তখন প্রখর কিরণ দিচ্ছিলো এবং তখন ছিলো প্রায় দুপুরের কাছাকাছি সময়।

নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ উনার থেকে ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম হিজরতের জন্যে বের হন এবং পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রবেশ করেন ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীমি। বলাবাহুল্য, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে বের হয়ে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রবেশ করার মধ্যখানে ১৫ দিন অতিবাহিত হয়েছিলো। 

 হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পবিত্র ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে বলা হয়, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার দিকে কিছুটা সামনে অগ্রসর হলে হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মতো হযরত বুরাইদা আসলাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ৭০ জন অশ্বারোহীসহ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্ধানে বের হন, যাতে করে কুরাইশ কাফিরদের নিকট থেকে একশত উট পুরস্কার পাওয়া যায়। যখন হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকটবর্তী হলেন তখন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আমি বুরাইদা। 

 হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আপনি কে? তিনি বললেন, 

انا حضرت محمد بن عبد الله رسول الله صلى الله عليه و سلم

“আমি হযরত আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পুত্র নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, 

اشهد ان لا اله الا الله وان محمدا عبده و رسوله صلى الله عليه و سلم

“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পুরনূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনাকে গ্রহণ করলেন এবং ওই ৭০ জন ব্যক্তি যাঁরা হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার উনার সঙ্গী ছিলেন সবাই মুসলমান হলেন। সুবহানাল্লাহ!

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রবেশকালে আপনার সামনে একটি পতাকা রাখতে ইচ্ছা করছি। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বয়ং পাগড়ী মুবারক খুললেন এবং বর্শার মাথায় বেঁধে হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে দিলেন। যে সময় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে তাশরীফ নিলেন তখন হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পতাকা মুবারক হাতে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে ছিলেন।

জনৈক ইহুদী ব্যক্তি উনাকে সকলের আগে দেখতে পায়। সে উচ্চকণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বলে, হে বনূ কারলা (হযরত আনছার ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ!) ওই যে, আপনাদের কাঙ্খিত ব্যক্তি তিনি আগমন করেছেন। আমরা আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে ছুটে গেলাম। তিনি তখন খেজুর গাছের ছায়ায় উপবিষ্ট ছিলেন। উনার সঙ্গে ছিলেন হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম। দু’জনের বয়স মুবারক প্রায় সমান ছিলো। আমাদের অধিকাংশ লোকজন ইতঃপূর্বে আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখেননি। উনার আশেপাশে লোকজনের ভীড় হয়ে যায়। হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মধ্যে লোকজন ফারাক বা পার্থক্য করতে পারছিলেন না। আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে ছায়া সরে গেলে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি উনার চাদর মুবারক দিয়ে আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ছায়া মুবারক দান করেন। এ সময় আমরা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে চিনতে পারি। 

হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই আমি বালকদের মধ্যে ছুটাছুটি করছিলাম। তারা বলছিলেন, আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এসেছেন। আমি ছুটে গেলাম কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আগমন করলেন এবং উনার সঙ্গে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম। উনারা দু’জনে অনাবাদ এলাকায় থেমে যান। এরপর দু’জনে জনৈক বেদুঈনকে প্রেরণ করলেন। হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে উনার আগমনের সংবাদ দেয়ার জন্য। পাঁচ শতাধিক হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা ছুটে এসে উনাদের দু’জনকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বললেন, আপনারা নিরাপদে আমাদের বরণীয় রূপে চলুন। আর আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এবং উনার সঙ্গী হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাদের সাথে লোকজন এগিয়ে আসেন। পবিত্র মদীনাবাসীগণ নিজ নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এমনকি কুলশীলা মহিলাগণও ঘরের ছাদে আরোহন করেন, উনাকে দেখে উনারা বলে উঠেন-

ايهم هو ايهم هو

 “তিনি কোনজন? তিনি কোনজন?” এমন দৃশ্য মুবারক আমরা (ইতপূর্বে) কখনো দেখিনি। হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি উনাকে যেদিন দেখি তিনি আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেন (অর্থাৎ হিজরত মুবারকের দিন) এবং উনার বিছাল শরীফ উনার দিনও দেখেছি। এ দু’দিনের অনুরূপ দিন আমি আর কখনো দেখিনি। সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র বুখরী শরীফ ও পবিত্র মুসলিম শরীফ উনার মধ্যে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম উনার থেকে হিজরত প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন- আমরা পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে আগমন করলে লোকেরা ঘর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন, গৃহের ছাদের উপরে উঠেন। শিশুগণ আর খাদিমগণ বলে উঠেন- 

الله أكبر جاء رسول الله صلى الله عليه وسلم،

الله أكبر جاء حضرت محمد صلى الله عليه وسلم،

الله أكبر جاء حضرت محمد صلى الله عليه وسلم،

الله أكبر جاء رسول الله صلى الله عليه وسلم.

فلما أصبح انطلق وذهب حيث أمر.

যখন সকাল হলো তিনি রওয়ানা করেন, যেমনটি উনাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। 

 হযরত ইবনে আয়িশা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে আগমন করলেন তখন নারী এবং শিশুগণ বলে উঠলেন-

طلع البدر علينا – من ثنيات الوداع

وجب الشكر علينا – ما دعا لله داع

 “উদিত হয়েছে আমাদের উপর পূর্ণ চাঁদ ওদা পাহাড়ের ঘাঁটি থেকে, শোকর আদায় করা আমাদের কর্তব্য, যতদিন আহবানকারী আহবান করবেন (মহান আল্লাহ পাক উনার দিকে)।”

হযরত আবূ আইউব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার গৃহ মুবারকে গমন:

এরপর বনূ সালিমের একদল লোকের সঙ্গে হযরত উতবান ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদ্বলা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র খিদমত শরীফে হাযির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি আমাদের মধ্যে অবস্থান করুন। আমরা সংখ্যায় অধিক, আমাদের প্রস্তুতি অনেক এবং আমরা প্রতিরোধ আর প্রতিরক্ষায়ও সক্ষম। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

خلوا سبيلها فانها ما مورة

 “তোমরা উটটির পথকে ছেড়ে দাও। কারণ সে (মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে) আদেশ মুবারকপ্রাপ্ত।” ফলে উনারা উটটির পথ মুবারক ছেড়ে দেন। উটটি চলতে থাকে।

 শেষ পর্যন্ত বনূ বিয়াদ্বার মহল্লায় পৌঁছলে হযরত যিয়াদ ইবনে লবীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত ফারওয়া ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা একদল লোকজন নিয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দীদার মুবারক লাভ করার আবেদন জানান। উনারা বলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! দয়া করে আমাদের এখানে অবস্থান করুন, আমরা জনবল এবং অস্ত্র বলে অধিক এবং প্রতিরোধ আর প্রতিরক্ষায় সক্ষম।” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আপনারা তার পথ ছেড়ে দিন, উটনীটি মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে আদিষ্ট।” উনারা তার পথ ছেড়ে দেন এবং উটনীটি চলতে থাকে। বনূ সায়িদা মহল্লা দিয়ে গমনকালে বনূ সাইদের একদল লোকসহ হযরত সা’দ ইবনে উবাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত মুনযির ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারক-এ হাযির হয়ে আবেদন জানান, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাদের মধ্যে দয়া করে অবস্থান করুন! সংখ্যায় আমরা অধিক এবং প্রতিরোধে আমরা সক্ষম।” আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আপনারা তার রাস্তা ছেড়ে দিন। কারণ সে (মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে) আদেশপ্রাপ্ত। অতঃপর উটনীটি চলতে থাকেন।

অতঃপর বনূ হারিছ ইবনে খাযরাজ-এর মহল্লা বরাবর পৌঁছলে হযরত সা’দ ইবনে রাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত খারিজাহ ইবনে যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, বনূ হারিছ ইবনে খাযরাজ-এর একদল লোক নিয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র খিদমত শরীফ-এ উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! দয়া করে আমাদের মধ্যে তাশরীফ মুবারক আনুন। জনবল আর অস্ত্রবলে আমরা বেশি এবং প্রতিরোধ আর প্রতিরক্ষায়ও আমরা সক্ষম।” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আপনারা তার পথ ছেড়ে দিন। উটনী মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে আদিষ্ট।” উনার পথ ছেড়ে দিলে উটনীটি চলতে থাকেন। 

 বনী আদী ইবনে নাজ্জারের মহল্লা দিয়ে অতিক্রমকালে হযরত উম্মু আব্দুল মুত্তালিব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বংশ মুবারক-এর অন্যতম নারী হযরত সালমা বিনতে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনারা দু’জন নিকটে আসেন। উনারা হযরত সালীত ইবনে কাইস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত আবূ সালীত আসীরা ইবনে খারিজা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বনী আদী ইবনে নাজ্জারের একদল লোক নিয়ে আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র খিদমত শরীফ-এ উপস্থিত হয়ে আরজ করেন, “ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার মাতুলকুলে দয়া করে অবস্থান গ্রহণ করুন। জনসংখ্যা আর অস্ত্রবলে উনারা বেশি এবং প্রতিরোধেও উনারা সক্ষম।” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আপনারা তার পথ ছেড়ে দিন। কারণ উটনীটি তো আদিষ্ট আছে।” পথ ছেড়ে দিলে উটনীটি আপন মনে চলতে থাকেন। শেষপর্যন্ত বনূ মালিক ইবনে নাজ্জারের মহল্লার দরজায় এসে বর্তমান যেখানে পবিত্র মসজিদুন নববী শরীফ অবস্থিত। হযরত আবূ আইউব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার গৃহ মুবারকের কাছে গিয়ে উটনীটি উনার গৃহ মুবারক উনার দরজা মুবারকে বসে পড়ে। আখিরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেখানে অবতরণ করেন। হযরত আবূ আইউব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার গৃহ মুবারকে প্রবেশ করেন।

 আর হযরত আবু আইউব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং হযরত খালিদ বিন যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা (এগিয়ে আসেন) উটের পালানাট বহন করে ঘরে নিয়ে রাখেন। আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুজরা শরীফ মুবারক-এ তাশরীফ নেন। পূর্বোক্ত খুজুর খলা সম্পর্কে জানতে চান যে, এটা কার? হযরত মু’আয ইবনে আফরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনাকে বলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এটি আমর উনার দু’পুত্র হযরত সাহল এবং হযরত সুহাইল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা এবং উনারা দু’জন ইয়াতীম অবস্থায় আমার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। আমি উনাদের দু’জনকে রাজি করতে পারবো। আপনি সেখানে মসজিদ বানিয়ে নিন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেখানে পবিত্র মসজিদুন নববী শরীফ নির্মাণের নির্দেশ দেন। তিনি হযরত আবু আইউব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার গৃহ মুবারক-এ অবস্থান করেন। পবিত্র মসজিদুন নববী শরীফ ও পবিত্র হুজরা শরীফ মুবারক নির্মাণ না করা পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন। পবিত্র মসজিদুন নববী শরীফ উনার নির্মাণের কাজে আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত মুহাজির ছাহবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ও হযরত আনছার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সঙ্গে নিজেও অংশগ্রহণ করেন।

 হযরত আবু আইয়ুব আনছারী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, তিনি বলেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নুরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন আমার হুজরা শরীফ-এ তাশরীফ মুবারক নিলেন তখন তিনি নিচ তলা মুবারক-এ অবস্থান করতেন। আমি এবং হযরত উম্মে আইয়ুব রদি¦য়াল্লাহু তায়ালা আনহা (অর্থাৎ আমার আহলিয়া) আমরা অবস্থান করি উপর তলা মুবারক-এ। তখন আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক! আমি উপর তলায় থাকবো আর আপনি থাকবেন নিচতলায়, এটা আমার নিকট অসহ্য এবং জঘন্য বেয়াদবী। তাই আমি চাই যে, দয়া করে আপনি উপরে অবস্থান করুন আর আমি নীচে অবস্থান করি। অতঃপর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হযরত আবূ আইয়ূব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আমি হুজরা শরীফ-এর নিচতলায় অবস্থান করলে তা হবে আমি এবং যারা আমার নিকট আসা যাওয়া করছেন উনাদের জন্য সুবিধাজনক। তাই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র হুজরা শরীফ উনার নিচতলা মুবারক-এ অবস্থান করলেন, আর আমরা অবস্থান করতে থাকি উপর তলায়। একদিন একটা বড় পানির পাত্র ভেঙ্গে গেলো যাতে পানি ছিলো । তখন আমি এবং হযরত উম্মু আইযূব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আমরা একটা চাদর বা কম্বল নিয়ে দাঁড়াই। আর আমাদের ঘরে কেবল একটা চাদর ছিলো যাতে চাদর পানি চুষে নেয়, যেনো নিচ তলায় পানি যেয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে পতিত হয়ে উনাকে কষ্ট না দেয়।

হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার চিঠি মুবারক:

 সাইয়্যিদুল আনাম, আঁক্বায়ে নামদার, ছাহিবে কলম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি বাদশাহ হযরত আসআদ বিন কারব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ১৪০০ বৎসর আগের চিঠি

 هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ ، وَكَفى بِاللَّهِ شَهِيداً

অর্থ: “সেই মহান আল্লাহ্ পাক যিনি পূর্ববর্তী ওহী মুবারক দ্বারা নাযিলকৃত সমস্ত দ্বীন এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে মানবরচিত সমস্ত মতবাদ রদ করে এবং তাদের উপর প্রাধান্য দিয়ে উনার রাসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সত্য দ্বীন ও হেদায়েতসহ পাঠিয়েছেন, উনার স্বাক্ষী হিসেবে মহান আল্লাহ্ পাক তিনিই যথেষ্ট।” (সূরা তওবা শরীফ : আয়াত শরীফ- ৩৩)

“তাফরিহুল আজকিয়া ফি আহ্ওয়ালিল আম্বিয়া” নামক কিতাব উনার ২য় খণ্ড- ১১০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে যে, ইয়েমেনের বাদশাহ্ হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ইরাক ও সিরিয়া জয় করার উদ্দেশ্যে বের হলে পথিমধ্যে তিনি আমিয়া শহরে (যা বর্তমানে পবিত্র মদিনা শরীফ নামে পরিচিত) সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সেটি দখল করে নেন এবং উনার পুত্রকে সেখানকার অধিকর্তা নিয়োগ করে দেশে ফিরে যান, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পুত্রকে কে বা কারা হত্য করে। পুত্র হত্যার সংবাদে তিনি এতোই প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠেন যে, আমিয়া নগরী উনাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সমূলে উচ্ছেদ তথা ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে পুনরায় আমিয়াতে (পবিত্র মদীনা শরীফ) আসেন এবং উনার নিদের্শ মুতাবিক সেনাবাহিনী ধ্বংসলীলা শুরু করে, কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো উনার সেনাবাহিনী প্রত্যহ যেটুকু ধ্বংস করে, পরবর্তী দিন দেখা যায় তা পূনরায় পুর্বাবস্থায় ফিরে আসে।

ফলশ্রুতিতে হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ঘটনার মর্ম জানার জন্য উনার বন্দীকৃত লোকজনের মধ্যে যে সমস্ত তাওরাতপন্থী ইহুদী আলিম ছিলেন তাদের নিকট এই অত্যাশ্চর্য ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করায় তারা বাদশাহ্ হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বলেন যে, আপনি আপনার ইচ্ছানুযায়ী সবকিছু করতে পারলেও এই শহরের বিন্দুমাত্র ক্ষতি সাধন করতে পারবেন না। কেননা আখিরী যামানার প্রতিশ্রুত নবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ভবিষ্যতে এ শহরের আতিথ্য গ্রহণ করবেন। তখন হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ইহুদীদের এ কথার সত্যতার প্রমাণ কোথায় রয়েছে তা জানতে চাইলে তারা তাদের প্রতি নাযিলকৃত পবিত্র তাওরাত কিতাবের কথা বলেন, এবং সত্যতা যাচাইয়ের প্রেক্ষিতে পবিত্র তাওরাত কিতাবসহ দু’জন পবিত্র তাওরাতপন্থীকে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয়া হলে দেখা গেল যে, তাওরাতপন্থী দু’ব্যক্তি কিতাবসহ সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে আসেন। সুবহানাল্লাহ! অথচ হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি যখন উনার দুই অগ্নিপূজক অনুচরকে তাদের অগ্নিদেবের মূর্তিসহ অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে বললেন তখন দেখা গেলো যে, তারা অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করার পূর্বেই তাদের সমস্ত শরীর ঝলসে গেল। নাঊযুবিল্লাহ!

এসব ঘটনা অবলোকন করে হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষে পরিণত হন এবং পবিত্র মদীনা শরীফ ধ্বংসের ব্যর্থ কোশেশের জন্যে তীব্র অনুশোচনায় পাপ খ-ানোর নিমিত্তে উনার বন্দিকৃতদের মধ্যে থেকে পবিত্র তাওরাত কিতাবের উপর পান্ডিত্যের অধিকারী চারশত ইহুদি আলিমকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে আমিয়া নগরী (পবিত্র মদীনা শরীফ)-এ স্থায়ীভাবে বসবাস করার বন্দোবস্ত করে দেন।

তাদের মধ্যকার প্রধান ব্যক্তিত্ব হযরত শাহাউল নামক আলেম উনার কাছে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারক-এ লেখা একটি চিঠি দেন এবং বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যদি উনার হায়াত মোবারকে এ শহরে আগমন করেন তবে তিনিই যেনো এই চিঠি উনার হাত মুবারক-এ দেন। যদি উনার হায়াত মুবারক-এ না আসেন তবে যেন চিঠিটি ইন্তেকালের পূর্বে উনার পুত্রের নিকট দিয়ে যান, এভাবে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আগমন না ঘটা পর্যন্ত যেন বংশ পরম্পরায় চলতে থাকে। বাদশাহ্ হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আরো বলে দেন যে, তিনি যে বাড়িটি নির্মাণ করেছেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য, সে বাড়িতে আপাততঃ হযরত শাহাউল তিনি অবস্থান করবেন। পরবর্তীতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন এ শহরে তাশরীফ আনবেন তখন যেন তিনি ওই বাড়িতেই অবস্থান করেন এবং এজন্য তিনি যেন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অনুরোধ করেন।

৬২২ ঈসায়ী সনে হজ্জ মৌসূমে পবিত্র মদীনা শরীফ থেকে ৭৩ জন মুসলমানদের একটি কাফিলা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পবিত্র মদীনা শরীফ তাশরীফ মুবারক নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পবিত্র মদীনাবাসী উনাদের একটি আমন্ত্রণনামা পেশ করেন।

উক্ত প্রতিনিধি দলে হযরত আবু লাইল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নামে এক যুবক ছিলেন, যিনি ছিলেন সেই হযরত শাহাউল যার নিকট সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে লিখিত বাদশাহ্ হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার চিঠিও অর্পিত ছিলো, উনার বংশধর হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পুত্র হযরত আবু লাইল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি যখন উক্ত প্রতিনিধি দলের সাথে যাচ্ছিলেন তখন হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি অত্যন্ত গোপনে উনার পুত্র উনার হাত মুবারক-এ চিঠিখানা দিয়ে বললেন যে, তিনি যেনো চিঠিখানার কথা গোপন রাখেন এবং যদি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি চিঠিখানার কথা জিজ্ঞেস না করেন তবে যেন এ ব্যাপারে কিছু বলা না হয় এবং চিঠিখানা ফেরত নিয়ে আসেন। অথচ দেখা গেলো উক্ত প্রতিনিধি দলটি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে আসলে তিনি হযরত আবু লাইল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার দিকে আঙ্গুল মুবারক দিয়ে নিদের্শ করে বললেন, আপনার নামতো হযরত আবু লাইল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, আপনার কাছে বাদশাহ্ হযরত আসআদ বিন র্কাব তুব্বা রহমতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক আমার জন্য লিখিত পত্রখানি লুকায়িত আছে। উহা বের করুন। এ কথায় উপস্থিত সকলেই আশ্চর্যান্বিত হলেন। অতঃপর হযরত আবু লাইল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি চিঠিখানা বের করে নিজেই উচ্চস্বরে জনসম্মুখে পড়ে শুনালেন। চিঠিখানা পড়ে সকলেই অবহিত হলেন যে, এটি প্রায় ১৪০০ বৎসর পূর্বে লেখা। সুবহানাল্লাহ! সুবহানা রসূলিল্লাহি ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! সুবহানা মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!







আজ পবিত্র ১লা রবিউল আউয়াল শরীফ,  সম্মানিত হিজরত মুবারক উনার পথে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম গ্রহণকারী হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম

 সম্মানিত হিজরত মুবারক উনার পথে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম গ্রহণকারী হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম 

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পবিত্র ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে বলা হয়, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার দিকে কিছুটা সামনে অগ্রসর হলে হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মতো হযরত বুরাইদা আসলামী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ৭০ জন অশ্বারোহীসহ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্ধানে বের হন, যাতে করে কুরাইশ কাফিরদের নিকট থেকে একশত উট পুরস্কার পাওয়া যায়। যখন হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকটবর্তী হলেন তখন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আমি বুরাইদা। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, “হে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম আমার কাজ শীতল ও সঠিক হয়েছে।” 

এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কোন গোত্রের? হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আমি আসলাম গোত্রের। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার দিকে তাকিয়ে বললেন, سلمنا অর্থাৎ আমরা নিরাপদ।” এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আসলাম গোত্রের কোন শাখার? হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, বনী সাহমের। তিনি বললেন, خرج سهمك অর্থাৎ ‘আপনার অংশ বেরিয়ে এসেছে’ অর্থাৎ পবিত্র ইসলাম উনার মধ্যে আপনার অংশ রয়েছে।

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, আপনি কে? তিনি বললেন, 

انا حضرت محمد بن عبد الله رسول الله صلى الله عليه و سلم

“আমি হযরত আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার আওলাদ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, 

اشهد ان لا اله الا الله وان محمدا عبده و رسوله صلى الله عليه و سلم

অর্থ: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পুরনূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনাকে গ্রহণ করলেন এবং উনার সঙ্গী ৭০ জন ব্যক্তি উনারা সবাই মুসলমান হলেন। সুবহানাল্লাহ!

হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আরয করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রবেশকালে আপনার সামনে একটি পতাকা রাখতে ইচ্ছা করছি। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বয়ং পাগড়ী মুবারক খুললেন এবং বর্শার মাথায় বেঁধে হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে দিলেন। যে সময় সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে তাশরীফ মুবারক নিলেন তখন হযরত বুরাইদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পতাকা মুবারক হাতে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে ছিলেন। (দালাইল, আল ইস্তিয়াব, সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১ম খণ্ড ৩৬৪ ও ৩৬৫ পৃষ্ঠা)

 পবিত্র হিজরত মুবারক ও হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার বেমেছাল মুহব্বত ও খিদমত মুবারক

 আফযালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম উনার বুযুর্গী ও ফযীলত মুবারক বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনি একাধিক স্থানে উনার পবিত্র ছানা-ছিফত মুবারক করেছেন। উনার প্রশংসায় অসংখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে। হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের পরে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী তিনিই হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম। তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে সন্তুষ্ট মুবারক করার লক্ষ্যে উনার মাল ও জান সব মহান আল্লাহ পাক উনার পথে ব্যয় করেছেন। অর্থাৎ উনি মাল ও জানের চেয়েও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অধিক মুহব্বত করতেন। সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিনে কামিল হতে পারবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং অন্যান্য সকল মানুষ অপেক্ষা আমাকে বেশি মুহব্বত করবে।” 

অপর এক পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “তার মাল ও জান হতেও যতক্ষণ পর্যন্ত বেশি মুহব্বত না করবে।”

এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পবিত্র হিজরত মুবারক উনার কথা জানালেন, তখন মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সবচেয়ে প্রিয় ছাহাবী খলীফাতু রসূলিল্লাহ সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম উনাকে ডেকে বললেন, “হে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম! আমাকে পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে হিজরত করে পবিত্র মদীনা শরীফ যেতে হবে। আর সেই পবিত্র হিজরত বরকতময় মুবারকের সময় আপনিই হবেন আমার একমাত্র সঙ্গী। কাজেই আপনি বরকতময় হিজরতের জন্য প্রস্তুত থাকুন। পবিত্র হিজরত মুবারক করার নির্দেশ মুবারক এলে আমি আপনাকে জানাবো।

এদিকে এ ঘটনার প্রায় ছয় মাস পর মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পবিত্র হিজরত মুবারক করার নির্দেশ মুবারক দিলেন। পবিত্র হিজরত মুবারক উনার পথে বিশ্রাম নেয়ার উদ্দেশ্যে গারে ছুর বা ছাওর পর্বতের গুহায় প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করে দেখলেন সেখানে অনেক ছিদ্র রয়েছে। সে ছিদ্রতে বিষাক্ত সাপ-বিচ্ছু থাকতে পারে এ আশঙ্কায় হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি নিজ পাগড়ী মুবারক ও চাদর মুবারক টুকরো টুকরো করে ছিদ্রের মুখগুলো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু একটি ছিদ্র বন্ধ করার মতো কোনো কাপড় অবশিষ্ট রইলো না। তাই সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি নিজ পা মুবারক উনার গোড়ালি মুবারক দ্বারা উক্ত ছিদ্রের মুখে চাপ দিয়ে রাখলেন।

আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম উনার উক্ত জানু মুবারক উনার উপর মাথা মুবারক রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। 

উল্লিখিত ছিদ্রের ভিতর অবস্থান করছিল হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার যুগের একটি সাপ। সাপটি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক যিয়ারত লাভ করার উদ্দেশ্যই এখানে অবস্থান করছিল। সাপটি শত চেষ্টা করেও বের হতে না পেরে অপারগ হয়ে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার পা মুবারকে আঘাত করলো। আঘাতের সাথে সাথে বিষের ক্রিয়ায় এবং বিষের যন্ত্রণায় উনার চোখ মুবারক দিয়ে দর দর করে পানি মুবারক পড়তে লাগলো। তবুও তিনি নিজ পা মুবারক একটুও নড়াচড়া করলেন না যেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ঘুম মুবারক উনার কোনো ব্যাঘাত না হয়। হঠাৎ করে উনার চোখ মুবারক উনার এক ফোঁটা পানি মুবারক আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র চেহারা মুবারক উনার উপর পড়লো। সাথে সাথে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ঘুম মুবারক ভেঙে গেলো। দেখলেন সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বিষের যন্ত্রণায় কাঁদছেন।

এ অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজ মুখ মুবারক থেকে একটু নূরুল বারাকাত মুবারক (থু থু) মুবারক সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। সুবহানাল্লাহ! সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “হে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম! আপনার এ অবস্থা হওয়ার সাথে সাথে কেন আমাকে ঘুম মুবারক থেকে জাগ্রত করলেন না?” জবাবে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার ঘুম মুবারক উনার ব্যাঘাত ঘটবে এবং আপনার সাথে বেয়াদবী হবে ভেবে আমি কোনো নড়াচড়া করিনি এবং আপনাকে ঘুম মুবারক থেকে জাগ্রত করিনি। সুবহানাল্লাহ!

ফিকিরের বিষয় যে, আখিরী রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার কত গাঢ় মুহব্বত ছিলো। মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি এত গাঢ় মুহব্বত উনার পরিপ্রেক্ষিতে উনার সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন, “যেকোনো ব্যক্তি আমাদের প্রতি যে কোনো প্রকারের ইহসান করেছে আমরা তার প্রতিদান দিয়েছি, কিন্তু সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম উনার ইহসান ব্যতীত। অর্থাৎ উনারটাও দেয়া হয়েছে- তবে তিনি যেহেতু অনেক বেশি খিদমত মুবারক করেছেন তাই- স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনিও ক্বিয়ামতের দিন উনাকে বিশেষ প্রতিদান প্রদান করবেন। আর কারো ধন-সম্পদ আমাকে ততখানি উপকৃত করেনি যতখানি উপকৃত করেছে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার ধন-সম্পদ। আর আমি যদি মহান আল্লাহ পাক উনাকে ছাড়া অন্য কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। জেনে রেখ! নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ তায়ালা উনার বন্ধু।” সুবহানাল্লাহ! (তিরমিযী শরীফ)

সম্মানিত হিজরত মুবারক উনার সংক্ষিপ্ত সঠিক ইতিহাস

‘হিজরত’ শব্দটি হিজরান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণভাবে দেশত্যাগ করাকে ‘হিজরত’ বলা হয়। সম্মানিত ইসলামী শরীয়ত উনার পরিভাষায় হিজরত বলা হয়, ফিতনা-ফাসাদের আশঙ্কায় অথবা সম্মানিত দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশত্যাগ করে অন্য কোনো দেশে গমন করা। মূলত, ‘সম্মানিত দ্বীন উনার কারণে কোনো দেশত্যাগ করাও হিজরতের অন্তর্ভুক্ত।’

সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার দুশমন কাফির-মুশরিকরা গোপনে বৈঠক করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, আগামীকাল ভোরবেলা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার পবিত্র হুজরা শরীফ থেকে যখন বাইরে তাশরীফ মুবারক রাখবেন তখন হঠাৎ হামলা করে উনাকে শহীদ করা হবে। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! কাফির-মুশরিকদের এসব গোপন সিদ্ধান্তের কথা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জানতে পারেন। কারণ তিনি তো মুত্তালা আলাল গইব। অতঃপর সেই প্রতিক্ষিত সময়টি এলো যখন তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে পবিত্র মদীনা শরীফ পবিত্র হিজরত করার বিষয়ে পবিত্র ওহী মুবারক উনার মাধ্যমে নির্দেশ মুবারক পেলেন। এদিকে পবিত্র হিজরত উনার ছয় মাস পূর্ব থেকেই তিনি আফযালুন নাস বা’দাল আম্বিয়া সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকে জানিয়ে রাখেন যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকেও হিজরত করতে হবে। তাই তিনি পূর্ব থেকেই হিজরত করার জন্যে দুটি উষ্ট্রী এবং কিছু পাথেয় তৈরি করে রাখেন। সুবহানাল্লাহ!

নির্দিষ্ট রাতে কাফিররা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হুজরা শরীফ ঘেরাও করলো। রাত যখন গভীর হলো, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র হুজরা শরীফ থেকে বের হলেন। সে সময় তিনি ‘পবিত্র সূরা ইয়াসীন শরীফ’ উনার একটি পবিত্র আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করছিলেন। তিনি এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে ‘শাহাতিল ওয়াজুহ’ (মুখম-ল আচ্ছন্ন হয়ে যাক) এটা পাঠ করে কাফির-মুশরিকদের দিকে ছুঁড়ে মারলেন এবং তাদের ব্যুহ ভেদ করে নির্বিঘেœ বেরিয়ে গেলেন। সে সময় মহান আল্লাহ পাক উনার মুবারক কুদরতে অবরোধকারীরা যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো; ফলে তারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বেরিয়ে যেতে দেখতে পেলো না। প্রথমে তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার গৃহে গমন করলেন এবং সেখান থেকে উনাকে নিয়ে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার বাইরে গিয়ে পবিত্র ছাওর পর্বত গুহায় তাশরীফ মুবারক গ্রহণ করলেন।

ভোরবেলা কাফির-মুশরিকরা জানতে পেলো- নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ ছেড়ে চলে গেছেন। তারা উনার সন্ধানে চারদিকে ছুটাছুটি শুরু করলো। তারা খুঁজতে খুঁজতে ‘পবিত্র ছাওর’ পর্বতের কাছে গেলো। তাদের পদধ্বনি শুনে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, ‘ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কাফির-মুশরিকরা যদি আমাদেরকে দেখে ফেলে?’ নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন- “চিন্তার কোনো কারণ নেই। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সঙ্গে রয়েছেন।” মহান আল্লাহ পাক উনার মুবারক কুদরতে গুহামুখে এমন কতকগুলো নিদর্শন মুবারক ফুটে উঠলো যে, তা দেখে কাফির-মুশরিকরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। তাদের মনে ধারণা জন্মালো যে, এ গুহার ভেতরে কেউ প্রবেশ করেননি। তাই তারা ফিরে গেলো। সুবহানাল্লাহ! তিন দিন তিন রাত নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনারা সেখানে অবস্থান মুবারক করেন। চতুর্থ দিন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ছওর পর্বত গুহা থেকে বের হয়ে এক রাত এক দিন পথ চললেন। পরদিন দুপুর বেলা রোদের তেজ প্রখর হয়ে উঠলে বিশ্রামের জন্যে একটি বৃহদাকার পাথরের ছায়ায় উনারা কিছুক্ষণ অবস্থান মুবারক করলেন। অদূরেই একটি গোয়ালা ছিল; তার বকরী থেকে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দুধ পান করলেন। সুবহানাল্লাহ!

অতঃপর সেখান থেকে তিনি আবার রওয়ানা হলেন। তিনি সামনে নূরুদ দারাজাত পা মুবারক বাড়াতেই সোরাকা বিন জাশিম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হঠাৎ উনাকে দেখে ফেললেন (তিনি তখনও ঈমান মুবারক প্রকাশ করেননি)। তিনি কুরাঈশদের পক্ষ থেকে পুরস্কারের লোভে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখতে পেয়েই ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। কিন্তু ঘোড়াটি হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তিনি আবার নিজেকে সামলে নিলেন এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর হামলা করার জন্যে তৈরি হলেন। নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! কিন্তু এবারও সামনে এগুতেই উনার ঘোড়া হাঁটু পর্যন্ত মাটিতে বসে গেল। এবার তিনি শঙ্কিত হয়ে উঠলেন এবং বুঝতে পারলেন। ব্যাপারটা মোটেই সুবিধাজনক নয়। উনার পক্ষে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর হামলা করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। তিনি অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়লেন এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে আত্মসমর্পণ করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে ক্ষমা করে দিলেন। সুবহানাল্লাহ!

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক আগমন বার্তা পূর্বেই পবিত্র মদীনা শরীফ পৌঁছেছিল। তাই গোটা পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মুবারক শুভাগমনের জন্যে প্রতীক্ষমান ছিলেন। ছোট-বড় সবাই প্রতিদিন সকালে শহরের বাইরে গিয়ে জমায়েত হতেন এবং দুপুর পর্যন্ত ইন্তেজার করে ফিরে আসতেন। অবশেষে একদিন উনাদের সেই প্রতীক্ষিত বরকতময় মুহূর্তটি এসেই পড়লো। দূর থেকে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তাশরীফ মুবারক নেয়ার আলামত দেখে গোটা শহরটি তাকবীর ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। প্রত্যেক প্রতীক্ষাকারী হৃদয় উজাড় করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে স্বাগত জানালেন এই বলে যে, “ত্বলায়াল বাদরু আলাইনা, মিন ছানিয়াতিল বিদায়ি। ওয়াজাবাত শুকরু আলাইনা, মাদায়া লিল্লাহি দাঈ।” সুবহানাল্লাহ!

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত মুবারক করার সৌভাগ্য কে লাভ করবেন? এর সমাধান মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মুবারক সমাধান দিয়ে বললেন যে, আমার সম্মানিত উষ্ট্রী যে সৌভাগ্যবান ব্যক্তির গৃহের সামনে দাঁড়াবে, খিদমত মুবারক করার সৌভাগ্য তিনিই লাভ করবেন।’ ঘটনাক্রমে এ সৌভাগ্যটুকু লাভ করলেন হযরত আবু আইয়ুব আনছারী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। সুবহানাল্লাহ! বর্তমানে যেখানে মসজিদে নববী শরীফ অবস্থিত, উনার নিকটেই ছিল উনার মুবারক গৃহ। গৃহ মুবারকটি ছিল দ্বিতল বিশিষ্ট। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশ্রাম মুবারকের জন্যে তিনি উপরের তলাটি পেশ করেন। কিন্তু যিয়ারতপ্রার্থীদের আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিচের তলায় থাকা পছন্দ করলেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি প্রায় সাত মাস এখানে মুবারক অবস্থান করেন। সুবহানাল্লাহ! এটাই হচ্ছেন- পবিত্র হিজরত মুবারক উনার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত হিজরত ও সম্মানিত তাবুক জিহাদকে কথিত লংমার্চের সাথে তুলনা করে উলামায়ে সূ’রা কুফরী করেছে

 নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতিটি আমল মুবারকই হচ্ছে পবিত্র ওহী মুবারক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

قل .....ان اتبع الا ما يوحى الى

অর্থ: বলুন আমি তো কেবল ওই ওহী মুবারক উনার অনুসরণ করি, যা আমার প্রতি অবতীর্ণ হয়। (পবিত্র সূরা আনআম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫০)

কাজেই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হিজরত মুবারক এবং তাবুক জিহাদ মহান আল্লাহ পাক উনার ওহী মুবারক দ্বারা ফায়ছালাকৃত ও সংঘটিত হয়েছে। যেমন- হিজরত মুবারক সম্পর্কে পবিত্র সূরা আনফাল শরীফ ৩০নং পবিত্র আয়াতে কারীমা উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّـهُ وَاللَّـهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ

অর্থ: “স্মরণ করুন, (আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) কাফিরেরা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দি করার জন্য, শহীদ করার জন্য অথবা নির্বাসিত করার জন্য এবং তারা (বিভিন্ন) ষড়যন্ত্র করে। মহান আল্লাহ পাক তিনিও হিকমত (কৌশল) করেন। আর মহান আল্লাহ পাক তিনি শ্রেষ্ঠ হিকমতওয়ালা।” 

অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কাফির মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের সমুদয় ঘটনা অবহিত করেন এবং উনাকে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেন এবং সেইসাথে হিজরতকালীন উনাকে এই দু’আ পাঠ করতে বলা হয়-

وقل رب ادخلنى مدخل صدق واخرجنى مخرج صدق واجعل لى من لدنك سلطانا نصيرا

অর্থ: “বলুন, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে উত্তমরূপে পৌঁছিয়ে দিন এবং আমাকে উত্তমরূপে নিয়ে যান এবং আমার জন্য আপনার তরফ থেকে সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বউত্তম বিজয় ও সাহায্য দান করুন।” (পবিত্র সূরা বণী ইসরাইল শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৮০)

একইভাবে তাবুক জিহাদের আদেশ প্রদান সম্পর্কে পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ৭৩নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

يا ايها النبى جاهد الكفار والـمنافقين

অর্থ: “আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি কাফির ও মুনাফিকদের বিরূদ্ধে জিহাদ করুন।”

কাজেই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হিজরত মুবারক এবং তাবুক জিহাদ ইত্যাদি প্রতিটি বিষয়ই ওহী মুবারক অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছিল। 

কিন্তু লংমার্চের বিষয়টি কি ওহী মুবারক দ্বারা ফায়ছালাকৃত? কস্মিকালেও নয়। তাহলে তা কী করে ওহী মুবারক উনার ফায়ছালাকৃত বিষয়ের সাথে তুলনা দেয়া যেতে পারে। কাজেই, লংমার্চকে ওহী মুবারক দ্বারা ফায়ছালাকৃত কোনো বিষয়ের সাথে তুলনা দেয়ার অর্থ হচ্ছে কুফরী করা। কোনো মুসলমান কুফরী করলে সে মুসলমান থেকে খারিজ হয়ে কাফির ও মুরতাদে পরিণত হয়।

আর শরীয়তে মুরতাদের শাস্তি বা ফায়সালা হলো, তার স্ত্রী তালাক হবে যদি বিয়ে করে থাকে এবং এক্ষেত্রে পুনরায় তওবা না করে, বিয়ে না দোহরানো ব্যতীত তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করা বৈধ হবে না। আর এ অবৈধ অবস্থায় সন্তান হলে সে সন্তানও অবৈধ হবে। হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে যদি হজ্জ করে থাকে, সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে, তার ওয়ারিছস্বত্ব বাতিল হবে। তাকে তিন দিন সময় দেয়া হবে তওবা করার জন্য এবং যদি তওবা করে, তবে ক্ষমা করা হবে। অন্যথায় তার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদ-। কেননা হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে, তিন কারণে মৃত্যুদ- দেয়া জায়িয। যথা- ১. ঈমান আনার পর কুফরী করলে অর্থাৎ মুরতাদ হলে। ২. ওই ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিণী, যারা বিবাহিত বা বিবাহিতা। ৩. যে অন্যায়ভাবে কাউকে ক্বতল করে, তাকে। 

আর মুরতাদ মারা যাবার পর যারা জানাযার নামায পড়ে বা পড়ায় বা জানাযার নামাযে সাহায্য-সহযোগিতা করে, তাদের সকলের উপরই মুরতাদের হুকুম বর্তাবে এবং এ সকল মুরতাদ মরলে বা নিহত হলে তাকে মুসলমানগণ উনাদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না। এমনকি মুসলমানের ন্যায়ও দাফন করা যাবেনা। বরং তাকে মৃত শুকরও কুকুরের ন্যায় গর্তের মধ্যে পূঁতে রাখতে হবে।

মূলত, লংমার্চ হচ্ছে কাফিরদের দ্বারা প্রবর্তিত বা উদ্ভাবিত পদ্ধতি বা বিষয়ের নাম। যা আদৌ শরীয়তসম্মত নয়। 

যেমন লংমার্চ সম্পর্কে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে, ১৯৩০-৩৪ সালের মধ্যবর্তী সময় তৎকালীন চীনের প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেক কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালালে পালানোর কৌশল হিসেবে কম্যুনিস্টরা চীনের দক্ষিণ-পূর্ব কিয়াংসি থেকে পশ্চিম দিক দিয়ে ঘুরে প্রায় ৬-৮ হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে চীনের উত্তর-পশ্চিম সেনসি প্রদেশে পৌঁছে। পথে তাদের ১৮টি পাহাড়ের সারি ও ২৪টি নদী অতিক্রম করতে হয়। ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী কাট্টা নাস্তিক মাওসেতুংয়ের নেতৃত্বে কম্যুনিস্টদের এই দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রমের কাহিনীই ইতিহাসে লংমার্চ নামে পরিচিত।

কাজেই, লংমার্চ সর্বপ্রথম ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদের ধারক ও বাহক কট্টর নাস্তিক, কাফির মাওসেতুং কর্তৃক উদ্ভাবিত।

সুতরাং কোনো মুসলমানের পক্ষে কাফির, মুশরিক, মুনাফিকদের কোনো নিয়ম-নীতি, তর্য-তরীক্বা গ্রহণ বা অনুসরণ করা জায়িয নেই।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

ولا تطع الكافرين والـمنافقين

অর্থ: “কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য বা অনুসরণ করো না।” (পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৮)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عن حضرت عبد الله بن عمر رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من تشبه بقوم فهو منهم

অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে।” (মুসনাদে আহমদ শরীফ, আবু দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ)

পক্ষান্তরে হিজরত ও জিহাদ এ বিষয় দুটি হচ্ছে পবিত্র ওহী মুবারক উনার দ্বারা ফায়ছালাকৃত, যা পবিত্র দ্বীন ইসলাম বা পবিত্র শরীয়ত উনার অন্তর্ভুক্ত বিষয়।

হিজরতের অর্থ: হিজরত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- ত্যাগ করা, পরিবর্তন করা, বর্জন করা ইত্যাদি। হিজরতের পারিভাষিক অর্থ হলো- ফিতনার আশঙ্কায় এবং ঈমান হিফাজত কিংবা দ্বীন পালনের নিমিত্তে দারুল কুফর হতে দারুল ইসলাম- এ গমন করাকে হিজরত বলে। আরেক বর্ণনা মতে, কাফির-মুশরিকদের অত্যাচারে জীবন নাশ হওয়ার আশঙ্কা থাকলে কিংবা পবিত্র দ্বীন ইসলাম পালনে বাধাগ্রস্ত হলে তখন এক ভূমি থেকে অন্য ভূমির প্রতি স্থানান্তরিত হওয়াকে হিজরত বলে।

হিজরতের হুকুম: কোনো জনপদের মুসলমান অধিবাসী যদি দ্বীন পালনে বাধাগ্রস্ত হন, ইসলামী তাহযীব-তামাদ্দুন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপ উনাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন ওই মুসলমান অধিবাসীদের জন্য ওই জনপদ থেকে অনুকূল পরিবেশে হিজরত করা ফরয।

এ মর্মে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

قالوا الـم تكن ارض الله واسعة فتهاجروا فيها

অর্থ: “হযরত ফেরেশ্তা আলাইহিমুস সালাম উনারা (হিসাব গ্রহণকালে) বলবেন, মহান আল্লাহ পাক উনার যমীন কি প্রশস্ত ছিল না? তোমাদের উচিত ছিল স্বদেশ পরিত্যাগ করে (নিরাপদ স্থানে) চলে যাওয়া।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৯৭)

অর্থাৎ হিজরত করা পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে। তবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত হিজরতের দ্বার উন্মুক্ত থাকবে। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে-

لا تنقطع الـهجرة حتى تنقطع التوبة

অর্থ: “তওবার অবকাশ থাকা পর্যন্ত হিজরতের ধারাও বলবৎ থাকবে।”

জিহাদের অর্থ: জিহাদ শব্দের আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ হলো- চেষ্টা করা, কষ্ট স্বীকার করা, শক্তি ব্যয় করা, জিহাদ করা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থ হলো- মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম মুবারক বুলন্দ বা সমুন্নত করার লক্ষ্যে তথা পবিত্র দ্বীন ইসলাম উনার বোল-বালা, প্রচার-প্রসারের নিমিত্তে কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বাহন, মাল, জান সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রকাশ্যে লড়াই করাকে জিহাদ বলে।

অতএব, পবিত্র ওহী মুবারক দ্বারা ফায়ছালাকৃত নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক বিষয় হিজরত ও তাবুক জিহাদের সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার মনোনীত হযরত নবী-রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চরম বিদ্বেষী কট্টর নাস্তিক, কাফির মাওসেতুং-এর উদ্ভাবিত লংমার্চকে তুলনা করে উলামায়ে সূ’রা ঈমান ও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে কাট্টা কাফির ও মুরতাদে পরিণত হয়েছে। তাদের উচিত অতিসত্বর উক্ত কুফরী বক্তব্য ও আমল পরিহার করতঃ প্রকাশ্যে খালিছ তওবা করা।

মহাপবিত্র ১লা রবীউল আউওয়াল শরীফ একটি ঐতিহাসিক দিবস

সম্মানিত ইসলাম উনার ইতিহাস ও বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে উল্লেখ আছে ইসলামের ব্যাপক আলোচিত হিজরত হলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ও উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনাদের পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে পবিত্র মদীনা শরীফে হিজরত। 

হিজরতের পটভূমি তৈরি হয়েছিল ঐতিহাসিক আকাবা নামক স্থানের শপথের মাধ্যমে। সম্মানিত নবুওওয়াত উনার ১১তম বছর মদীনা শরীফের ছয়জন ঈমানদার আর ১২তম বছর ১২ জন পবিত্র আকাবা নামক স্থানে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার কাজে সাহায্য করার জন্য নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে শপথ নেন। আর ১৩তম বছরে ৭৩ জন পুরুষ ও দুজন নারী উনারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাত মুবারকে বাইয়াত গ্রহণ করেন। উনারা পবিত্র মক্কা শরীফের মুসলমানদের আশ্রয় দেয়ার অঙ্গীকার করেন। 

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উনাদের নিয়ে পবিত্র মুহররমুল হারাম শরীফ মাস থেকে পবিত্র মদীনা শরীফে হিজরত করার অনুমতি দিলেন। পবিত্র মদীনা শরীফে সর্বপ্রথম হিজরত করেন হযরত মুসআব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহ আনহু তিনি। 

আফদ্বালুন নাস, বা’দাল আম্বিয়া হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। যাতে করে তিনি উনার সঙ্গে পবিত্র হিজরত মুবারক করতে পারেন। উক্ত হিজরত মুবারক উনার ছয় মাস পর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাইয়্যিদুল আসইয়াদ, সাইয়্যিদুশ শুহুর, শাহরুল আ’যম পবিত্র রবীউল আউওয়াল শরীফ মাসের ইছনাইনিল আযীম শরীফ (সোমবারে) হিজরত মুবারক করেন। 

তিনি বাইয়াতে আকাবার তিন মাস পর পহেলা রবীউল আউওয়াল শরীফ আবার রওনা দেন। পবিত্র ১২ রবীউল আউওয়াল শরীফ ইয়াওমুল ইছনাইনিল আযীম শরীফে তিনি পবিত্র মদীনা শরীফ তাশরিফ মুবারক নেন।

সুতরাং উক্ত বরকতময় পবিত্র দিবস যথাযথভাবে পালন করে সমস্ত নিয়ামত বরকত সাকীনা মাগফিরাত নাজাত লাভ করার মাধ্যম দিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের হাক্বীকী সন্তুষ্টি মুবারক অর্জন করা সকলের জন্যই আবশ্যক। 

হিজরতের সময় ইমামুল আউওয়াল সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনার আত্মত্যাগ মুবারক 

 কিতাবে বর্ণিত রয়েছে, “হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ উনার উদ্দেশ্যে বের হন, তখন এ সম্পর্কে হযরত সাইয়্যিদুনা হযরত আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম, সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম এবং উনার পরিবারের লোকজন ছাড়া আর কেউ তা জানতেন না। আর সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহি সালাম উনাকে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার নায়িব বা স্থলাভিষিক্ত করে যান এবং উনার নিকট লোকজনের যেসব আমানত ছিলো তা ফেরত দেয়ার নির্দেশ মুবারক দেন। পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মধ্যে কারো নিকট কোনো দুর্মূল্য ও পছন্দনীয় বস্তু থাকলে তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আমানত রাখা হতো। কারণ তারা উনার সত্যবাদিতা ও আমানতদারী সম্পর্কে অবগত ছিলো।” সুবহানাল্লাহ!

 উল্লেখ্য যে, কাফির-মুশরিকরা যখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হুজরা শরীফ উনার মধ্যে প্রবেশ করে দেখতে পেলো, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূত-পবিত্র কম্বল মুবারক গায়ে দিয়ে একজন শুয়ে রয়েছেন। এদিকে তারা কম্বল মুবারক ধরে টানাটানি করতে লাগলো। আর সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি কম্বল মুবারক খুবই শক্ত করে ধরে রেখেছেন যাতে করে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারেন। সুবহানাল্লাহ! কাফির-মুশরিকরা কম্বল মুবারক টানাটানি করতে করতে সকাল হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ পর তারা কম্বল মুবারক টেনে নিয়ে দেখতে পেলো সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নন, কম্বল মুবারক উনার ভিতরে যিনি শুয়ে ছিলেন তিনি হচ্ছেন সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম তিনি। সুবহানাল্লাহ! কাট্টা কাফির আবূ জাহিল সে উনার গাল মুবারক-এ একটা আঘাত করে পবিত্র হুজরা শরীফ থেকে বের হলো সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে খোঁজার জন্য। নাঊযুবিল্লাহ! 

পবিত্র হিজরত উনার সময় নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পিছনে হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অগ্রসর

  নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন ছাওর গুহা মুবারক থেকে রওয়ানা দিয়ে পবিত্র মদীনা শরীফ উনার পথ ধরে চলতে লাগলেন। এদিকে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্ধান না পেয়ে মক্কার কাফির-মুশরিক নেতারা ঘোষণা করলো, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবার আলাইহিস সালাম উনাকে অর্থাৎ উনাদের দু’জন বা একজনকে যে এনে দিতে পারবে তাকে একশ উট পুরস্কৃত করা হবে। নাঊযুবিল্লাহ! নাঊযুবিল্লাহ! নাঊযুবিল্লাহ! এই ঘোষণা শুনে উনাদের ক্বদম মুবারক উনার চিহ্ন মুবারক অনুসন্ধানে লোকজন বেরিয়ে পড়লো। কিন্তু তারা তা মিলাতে সক্ষম হলো না বরং বিষয়টি তাদের নিকট সন্দেহজনক হয়ে উঠলো। 

 হযরত শিহাব যুহরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন। হযরত সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জু’শাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, কুরাইশ কাফির-মুশরিকদের দূত এসে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এবং সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনাকে শহীদ বা বন্দি করার পুরস্কারের ঘোষণা দেয়। নাঊযুবিল্লাহ! নাঊযুবিল্লাহ! নাঊযুবিল্লাহ! হযরত সুরাকা ইবনে মালিক ইবনে জু’শাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন আমার স্বগোত্র বনী মুদলিজের একটি মাজলিসে আমি উপবিষ্ট ছিলাম। এমন সময় তাদের এক ব্যক্তি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে সম্মুখে দাঁড়ায়। আমরা তখন উপবিষ্ট ছিলাম। লোকটি বললো, হে হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আমি সবেমাত্র উপকূলীয় পথে কিছু লোক দেখে এসেছি, আমার ধারণা উনারা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এবং উনার সঙ্গী হবেন। হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু (হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি তখনো মুসলমান হননি) তিনি বললেন, আমি বুঝতে পারলাম যে, উনারা আসলেই উনারা। কিন্তু আমি তাদেরকে বললাম- না, উনারা নন। তুমি হয়তো অমুককে দেখেছ যে, আমাদের সম্মুখ দিয়ে একটু আগে চলে গেছে। এরপর আমি মজলিসে কিছু সময় অবস্থান করি, তারপর উঠে দাঁড়াই এবং গৃহে প্রবেশ করি। আমি আমার ঘোড়া বের করার জন্য আমার বাঁদীকে নির্দেশ দেই। আমি তাকে টিলার পেছনে ঘোড়া নিয়ে আমার অপেক্ষায় থাকতে বলি এবং আমি বর্শা নিয়ে ঘরের পিছন দিক দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার ঘোড়ার নিকট আসি এবং তার উপর সাওয়ার হই। তাকে ছুটাই আর সে ছুটে যায়। আমাকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে ঘোড়াটি হোঁচট খায় এবং আমি তার পিঠ থেকে নিচে পড়ে যাই। আমি উঠে দাঁড়াই এবং তূনের প্রতি হাত বাড়াই এবং তা থেকে ভাগ্য গণনার তীর বের করে তার সাহায্যে ভাগ্য পরীক্ষা করি। উনাদের ক্ষতি করবো কিনা তা জানার চেষ্টা করি। যা আমি পছন্দ করি না তাই বের হলো। ভাগ্য পরীক্ষা তীরের বিরোধিতা করে আমি ঘোড়ায় সাওয়ার হই, ঘোড়া আমাকে কাছাকাছি নিয়ে যায়। এমনকি আমি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র জবান মুবারক থেকে পবিত্র তিলাওয়াত মুবারক উনার আওয়াজ মুবারক শুনতে পাই। কোনো দিকে উনার লক্ষ্য নেই। আর সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি তখন আমার এদিকে তাকাচ্ছিলেন। আমার ঘোড়ার দু’পা মাটিতে আটকে পড়ে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়। আমি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাই। আমি উঠে দাঁড়াই, ঘোড়াকে শাসাই। সেও উঠে কিন্তু সামনের পা দুটি মাটি থেকে বের করতে পারলো না। সে যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তখন তার সামনের দু’পায়ের নিচ থেকে ধুলা উড়ে আচ্ছন্ন করে ফেললো। আবার আমি তীর দ্বারা ভাগ্য পরীক্ষা করলাম। এবারো তাই বের হলো যা আমার অপছন্দ। হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি তা দেখেই আঁচ করতে পারলাম যে, উনাকে আমার কবল থেকে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে- এটা একান্তই সত্য। উনারা দাঁড়ালেন আমি ঘোড়ায় সাওয়ার হয়ে উনাদের নিকট পৌঁছি। মাটিতে আটকা পড়ে আমার যে দশা হয় তাতে মনে এমন ভাবের উদয় হয় অবিলম্বে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দ্বীন ইসলাম জয়যুক্ত হবে। সুবহানাল্লাহ! তখন আমি উনাকে বললাম- আপনার জাতি আপনাকে পাকড়াও করার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। উনাদেরকে নিয়ে লোকেরা যা করতে চায়, সে সম্পর্কে আমি উনাদেরকে অবহিত করলাম এবং আমি উনাদেরকে পথের সম্বল আর সামগ্রী দানের প্রস্তাব পেশ করলাম। উনারা আমাকে কোনো জবাব দিলেন না। কোনো কথা আমার নিকট জিজ্ঞাসাও করলেন না। কেবল এটুকুই বললেন যে, আমাদের বিষয়টি গোপন রাখবে। আমাকে নিরাপত্তা পত্র লিখে দেয়ার জন্য আমি আবেদন জানালে তিনি হযরত আমির ইবনে ফুহায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেন। তিনি আমাকে চামড়ায় নিরাপত্তা পত্র লিখে দেন। এরপর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সম্মুখে অগ্রসর হন। 

 আরো বর্ণিত রয়েছে, “হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি যখন ফিরে আসেন (এ অনুসন্ধানী অভিযান থেকে) তখন সন্ধানকারী দলের কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে বলতেন, এদিকে এ পর্যন্ত থেমে যাও। অর্থাৎ এদিকে গিয়ে লাভ হবে না, কেউ নেই। যখন প্রকাশ পেলো যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিশ্চিত পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে পৌঁছেছেন। তখন তিনি লোকদের নিকট সেসব ঘটনা প্রকাশ করতে শুরু করলেন যা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং উনার মাধ্যমে যেসব ঘটনা মুবারক ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে কুরাইশ কাফির সরদাররা উনার পক্ষ থেকে অনিষ্টের আশঙ্কা করতে থাকে। তারা এ আশঙ্কা করে যে, এটা তাদের অনেকের ইসলাম গ্রহণের কারণ হয়ে যেতে পারে। আর হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ছিলেন মুদলিজ গোত্রের সরদার। তখন অভিশপ্ত আবূ জাহল বনূ মুদলিজ গোত্রের নিকট নিম্নোক্ত কবিতাটি লিখে পাঠায়।

 بنى مدلج انى اخاف سفيهكم- سراقة مستغو لنصر حضرت محمد صلى الله عليه وسلم عليكم به الا يفرق جمعكم- فيصبح شتى بعد عزو سودد

 অর্থ: “বনী মুদলিজ গোত্রের লোকজন! তোমাদের নির্বোধ হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সম্পর্কে আমার ভয় হয়, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সাহায্য বা উনার খিদমত করে তিনি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন। নাঊযুবিল্লাহ! তোমাদের উচিত উনাকে প্রতিহত করা, যাতে করে তিনি কোনো ফাটল ধরাতে না পারেন তোমাদের ঐক্যে। ফলে মর্যাদা আর কর্তৃত্বের পর তোমরা হয়ে পড়বে শত বিভক্ত।”

 কাট্টা কাফির আবু জাহিলের জবাবে হযরত সুরাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি নিচের কবিতাটি লিখে পাঠান। 

ابا حكم و الله لوكنت شاهدا- لامر جوادى اذ تسوخ قوائمه-

হে আবুল হাকাম (আবূ জাহিল)! তুমি যদি দেখতে আমার ঘোড়ার পা যখন দেবে যায় মাটিতে

عجبت و لم تشكك بان حضرت محمدا صلى الله عليه وسلم - رسول و برهان فمن ذا يقاو مه-

 তবে তুমি অবাক হতে। সন্দেহ করতে না যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন নাবিইয়ীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সুস্পষ্ট প্রমাণ- কে আছে উনার মুকাবিলা করতে পারে?

عليك فكف القوم عنه فاننى اخال لنا يوما ستبدو معالمه

 তোমাদের কর্তব্য হলো- লোকদেরকে উনার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া। আমার আকাঙ্খা একদিন উনার পবিত্র দ্বীনের নিদর্শনসমূহ প্রকাশ পাবে। 

بامر تود النصر فيه فانهم- و ان جميع الناس طرا مسالمه

 যাতে তুমিও উনার খিদমত বা গোলামী করতে আকাঙ্খী হবে, কারণ তারা এবং সকল মানুষ উনার সঙ্গে সন্ধি করতে উদগ্রীব হবে। সুবহানাল্লাহ!