হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -১০

 
হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -১০

হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের কিবলা ছিলেন স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
হাদীছ শরীফে বর্ণিত আছে,
أَخْبَرَنِي أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ الأَنْصَارِيُّ ـ وَكَانَ تَبِعَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَخَدَمَهُ وَصَحِبَهُ أَنَّ أَبَا بَكْرٍ كَانَ يُصَلِّي لَهُمْ فِي وَجَعِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم الَّذِي تُوُفِّيَ فِيهِ، حَتَّى إِذَا كَانَ يَوْمُ الاِثْنَيْنِ وَهُمْ صُفُوفٌ فِي الصَّلاَةِ، فَكَشَفَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم سِتْرَ الْحُجْرَةِ يَنْظُرُ إِلَيْنَا، وَهْوَ قَائِمٌ كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ، ثُمَّ تَبَسَّمَ يَضْحَكُ، فَهَمَمْنَا أَنْ نَفْتَتِنَ مِنَ الْفَرَحِ بِرُؤْيَةِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم، فَنَكَصَ أَبُو بَكْرٍ عَلَى عَقِبَيْهِ لِيَصِلَ الصَّفَّ، وَظَنَّ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم خَارِجٌ إِلَى الصَّلاَةِ، فَأَشَارَ إِلَيْنَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَتِمُّوا صَلاَتَكُمْ، وَأَرْخَى السِّتْرَ،
“হযরত আনাস ইবনে মালিক আনসারী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু যিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাদিম এবং সাহাবী ছিলেন উনার থেকে বর্ণিত, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারিদ্বী শানে অবস্থান করা অবস্থায় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম ছাহাবীগণকে নিয়ে নামায আদায় করতেন। অবশেষে যখন সোমবার এল এবং লোকেরা নামাযের জন্য কাতারে দাঁড়ালেন, তখন হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা শরীফের পর্দা উঠিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, উনার চেহারা মুবারক যেন কুরআন শরীফের পৃষ্ঠার ন্যায় ঝলমল করছিল। তিনি মুচকি হাসলেন। আমরা হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখতে পেয়ে খুশীতে প্রায় আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম এবং হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম ইমামতি থেকে কাতারে দাঁড়ানোর জন্য পিছন দিকে সরে আসছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হয়তো নামাযের বেরিয়ে আসবেন। হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে ইশারায় জানালেন যে, তোমরা তোমাদের নামায পূর্ণ করে নাও। অতঃপর তিনি পর্দা ছেড়ে দিলেন।” (বুখারী শরীফ- কিতবুল আযান- হাদীছ শরীফ ৬৮০, মুসলিম শরীফ ৪১৯)
পোষ্টে সংযুক্ত ছবিটি খুবই ভালো করে লক্ষ্য করুন, অন্তরে গেঁথে নিন। তাহলে সেসময় পরিস্থিতিটা ভালো বুঝতে পারবেন।
১) হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমগন ক্বাবা শরীফের দিকে মুখ করে মসজিদে নববীতে নামায আদায় করছিলেন।
২) হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হুজরা শরীফ ছিলো মসজিদের সাথে সংযুক্ত ঠিক বাম দিকে।
৩) নামায তখন চলছিলো।
৪) এমতাবস্থায় হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হুজরা শরীফ থেকে পর্দা উঠিয়ে তাকালেন। উনার চেহারা মুবারক এসময় ছিলো অত্যান্ত উজ্জল।
৫) ছাহাবায়ে কিরাম নামাযরত অবস্থায় বিষয়টা কিভাবে বুঝলেন? ছবির দিকে তাকান , উনাদের নামাযের মধ্যেই মিনিমাম ৯০ ডিগ্রী ঘুরে তাকাতে হয়েছে।
৫) হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাসি মুবারক দেখে যেভাবে আন্দন্দে আত্মহারা হলেন, সেভাবে দেখতে গেলে কি কাতারবদ্ধ থাকা যায়?
৬) কাতারের সামনে ছিলেন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম তিনি। উনি কি করলেন? নামাযের ইমামতি ছেড়ে দিয়ে পিছনের কাতারে চলে আসতে লাগলেন, হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সেটা না করার জন্য ইশারা করলেন। কি বুঝা গেলো এ ইশারা দেখতে হলে স্বয়ং ইমাম সাহেবকেও কিবলা থেকে মুখ ঘুরিয়ে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে তাকাতে হয়েছিলো।
৭) হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নামায চালিয়ে যেতে বললেন।
তারমানে এতক্ষণ যা কিছু হলো নামায কিন্তু চলমান। সকল কিবলার কিবলা যখন উনার নূরানী চেহারা মুবারক দেখালেন তখন ছাহাবায়ে কিরাম উনারা ক্বাবা শরীফের দিক থেকে মুখ সরিয়ে মিনিমাম ৯০ ডিগ্রী ঘুরে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে কিবলা স্থির করে নিলেন। সম্ভবত ঐসময় ইমাম হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম সূরা কিরয়াতও পাঠ করাও বন্ধ রেখেছিলেন।
নবীজী কি বলেছিলেন আপনাদের নামায হয়নি। আপনারা নামায দোহরিয়ে পড়ুন। আপনারা নামায বাদ দিয়ে তাকাচ্ছেন কেন? বরং তিনি হাসি মুবারক দিয়েছিলেন, ইশকে রসূলের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং সে চলমান নামাযও শেষ করতে বলেছিলেন। সুবহানাল্লাহ!
ঘটনাটা ফিকির করেন অনেক কিছু বুঝবেন।
 হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -৯

 হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -৯

হযরত ইমাম কাজী আয়ায রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘আশ শিফা বিতারিফে হুকুকীল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’ কিতাবে বর্ণনা করেন,
وَمِنْ إِعْظَامِهِ وَإِكْبَارِهِ إِعْظَامُ جَمِيعِ أَسْبَابِهِ، وَإِكْرَامُ مَشَاهِدِهِ وَأَمْكِنَتِهِ مِنْ مَكَّةَ وَالْمَدِينَةِ، وَمَعَاهِدِهِ. وَمَا لَمَسَهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْ عُرِفَ به. عَنْ صَفِيَّةَ بِنْتِ نَجْدَةَ قَالَتْ: كَانَ لِأَبِي مَحْذُورَةَ قُصَّةٌ فِي مُقَدَّمِ رَأْسِهِ إِذَا قَعَدَ وأرسلها أصابت الأرض.. فقيل له: أَلَا تَحْلِقُهَا؟! فَقَالَ: لَمْ أَكُنْ بِالَّذِي أَحْلِقُهَا وَقَدْ مَسَّهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِيَدِهِ.
হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি গভীর সম্মান ও আদব প্রদর্শনের অন্যতম দিক হলো উনার সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছুর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা। উনার কদম মুবারক স্পর্শীত স্থানসমূহকে মর্যাদা দেওয়া। উনার অবস্থানস্থল যেমন মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ, উনার অবস্থান ও ইবাদতের স্থান গুলোকে সম্মান করা। এবং যেসব জিনিস হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পর্শ করেছেন বা যেগুলো উনার সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে পরিচিত সেসবেরও ।
হযরত সাফিয়্যা বিনতে নাজদাহ রহমতুল্লাহি আলাইহিহা থেকে বর্ণিত,
হযরত আবূ মাহযূরাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কপালের সামনের দিকে একটি লম্বা চুলের গোছা ছিল। যখন তিনি বসতেন, সেই চুলের আগা মাটিতে লেগে যেত। কেউ উনাকে বললেন, ‘আপনি এটা ছেটে ফেলেন না কেন?’
তখন তিনি বললেন, ‘আমি কখনোই এটা ছাটবো না। কারণ হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিজের হাতে এই স্থানটি স্পর্শ করেছিলেন। সুবহানাল্লাহ!
وَكَانَتْ فِي قَلَنْسُوَةِ خَالِدِ بْنِ الْوَلِيدِ شَعَرَاتٌ مِنْ شَعَرِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.. فَسَقَطَتْ قَلَنْسُوَتُهُ فِي بَعْضِ حُرُوبِهِ فَشَدَّ عَلَيْهَا شَدَّةً أَنْكَرَ عَلَيْهِ أَصْحَابُ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَثْرَةَ مَنْ قُتِلَ فِيهَا.. فَقَالَ: ‌لَمْ ‌أَفْعَلْهَا ‌بِسَبَبِ ‌الْقَلَنْسُوَةِ، ‌بَلْ ‌لِمَا ‌تَضَمَّنَتْهُ ‌مِنْ ‌شَعَرِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِئَلَّا أُسْلَبَ «٥» بَرَكَتَهَا وَتَقَعَ فِي أَيْدِي الْمُشْرِكِينَ.
হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর টুপিতে হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চুলের কয়েকটি কেশরাশি রাখা ছিল।
এক যুদ্ধে উনার সেই টুপিটি পড়ে গেল। তখন হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেটি উদ্ধার করার জন্য এমন প্রবলভাবে শত্রুর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন যে, এতে অনেক মানুষ শহীদ হলো।
হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অন্যান্য ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগন এই ঘটনায় উনার প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করলেন। অন্যান্য ছাহাবায়ে কিরাম অবাক হলেন যে, এত বিপদ মাথায় নিয়ে তিনি কেন টুপিটির জন্য এত লড়লেন?
তখন হযরত খালিদ ইবনু ওয়ালিদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি টুপির জন্য এমন করিনি; বরং টুপির ভেতরে ছিল হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চুল মুবারক। আমি ভয় পেয়েছিলাম যেন উনার বরকত থেকে বঞ্চিত না হই, এবং যেন তা মুশরিকদের হাতে না পরে। (আশ শিফা বিতারিফে হুকুকীল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২য় খন্ড ১২৭ পৃষ্ঠা)
সুবহানাল্লাহ! এই হচ্ছে হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নমুনা। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগন সব কিছুর উপর হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে প্রাধান্য দিতেন।
 হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - ৮

 হুব্বে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - ৮

ইন্তেকাল পথযাত্রী হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাক্ষাত লাভের সুযোগ হচ্ছে মর্মে আনন্দ প্রকাশ-
হযরত বিলাল ইবন রাবাহ রদ্বিয়াল্লাহ তা'আলা 'আনহু যখন ইন্তেকাল পথযাত্রী, তখন উনার স্ত্রী দুঃখ ও বেদনায় ভরাক্রান্ত হয়ে কাঁদছেন আর বলছেন, হায় কষ্ট! হায় দুশ্চিন্তা! তখন বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু স্ত্রীর দুঃখ-বেদনা প্রকাশের প্রেক্ষিতে নিজের মনের কথা তুলে ধরে বলেন,
بَلْ وَا طَرَبَاهُ غَدًا نَلْقَى الأَحِبَّةَ مُحَمَّدًا وَصَحِبَه
'বরং খুশী ও আনন্দের কথা যে, কালকেই আমি আমার সর্বাধিক প্রিয় নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং উনার সাথীদের সাথে মিলিত হব' (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪/১৩২৫)
অর্থাৎ তিনি স্ত্রীকে শান্ত্বনা দিচ্ছেন যে, উনার ইন্তেকাল স্ত্রীর জন্য দুঃখ ও বেদনার বিষয় হলেও এই ইন্তোকালের মাধ্যমেই তিনি হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাক্ষাত লাভে ধন্য হবেন। এটা উনার জন্য পরম আনন্দের বিষয়। কতটা হুব্বে রসূল প্রকাশ করতেন ছাহাবীগন সেটা চিন্তা করে দেখেন।