শবে বরাতের আমল সম্পর্কে ইবনে মাজাহ
শরীফের হাদীস নিয়ে সালাফীদের আপত্তির
জবাব
শবে বরাত বা লাইলাতুন নিছফী মিন শাবান এর বিরোধীতা করতে আহলে হদস বা লা’মাযহাবীরা যে হাদীস শরীফের বিরোধীতা করে সেটা নিয়ে আজ আলোকপাত করবো। অকাট্য দলীল দ্বারা শবে বরাতের ফযীলত উপস্থাপিত হবে ইনশা আল্লাহ।
“মিশকাত শরীফ”-এর ১১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
عن حضرت على رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا يومها فان الله تعالى ينزل فيها لغروب الشمس الى السماء الدنيا فيقول الا من مستغفر فاغفرله الا من مسترزق فارزقه الا مبتلى فاعافيه الا كذا الا كذا حتى يطلع الفجر. رواه ابن ماجه.
অর্থ: “হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, যখন অর্ধ শা’বান তথা শবে বরাতের আগমন ঘটে তখন ওই রাতে তোমরা ইবাদত-বন্দেগী করে জাগ্রত থাকবে এবং দিবাভাগে রোযা রাখবে। কেননা, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক ওই শবে বরাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই নিকটবর্তী আকাশে নাযিল হন এবং বলতে থাকেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছ কি? যাকে আমি ক্ষমা করে দিব। কোন রিযিক প্রার্থনাকারী আছ কি? যাকে আমি অপরিমিত রিযিক দিয়ে দিব এবং কোন বিপদে বিপন্ন ব্যক্তি আছ কি? যাকে আমি বিপদ থেকে মুক্ত করে দিব। সাবধান! সাবধান! এভাবেই মহান আল্লাহ পাক ফজর পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ ১/১৪৪: হাদীস ১৩৮৮, ইবনে হিব্বান: হাদীস ১৩৮৮, বায়হাকী শুয়াবুল ঈমনি ৫/৪৫৪: হাদীস ৩৮২২, মিশকাতুল মাসাবীহ ২/২৪৫ : হাদীস ১২৩৩, দায়লামী শরীফ ১/২৫৯: হাদীস ১০০৭, তারগীভ ওয়াত তারহীব ২/৭৫: হাদীস ১৫৫, বায়হাক্বী – ফযায়েলে ওয়াক্ত ১/১২২ : হাদীস ২৪, জামেউস সগীল লি সুয়ুতী : হাদীষ ১৬৬৫, মিসবাহুল জুজাহ : হাদীস ৪৯১, কানযুল উম্মাল ১২/৩১৪ : ৩৫১৭৭, উমদাতুল ক্বারী শরহে বুখারী ১১/৮২, মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়াহ ৩/৩০০, মিরকাত ৩য় খ-, ১৯৫-১৯৬, মিরয়াতুল মানাজিহ ৩য় খ- ২৯৩-২৯৪-২৯৫, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত ৪/২১২)
উক্ত হাদীস শরীফের রাবীগন হচ্ছেন:
১) খলীফাতুল মুসলিমিন হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু আনহু: জলীল ক্বদর সাহাবী।
২) হযরত মুয়াবিয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন জাফর রহমতুল্লাহি আলাইহি- ইবনে হাজর আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহ বলেন, তিনি বিশ্বস্ত রাবীদের অর্ন্তভুক্ত ছিলেন, এবং নির্ভরযোগ্য ছিলেন। (তাহযীবুত তাহযীব ২/১৯৬)
৩) হযরত ইব্রাহিম বিন মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি: তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন। (মিযানুল এতেদাল)
৪) হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি- ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে দ্বয়ীফ বলেছেন। ইমাম নাসায়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে মাতরুক বলেছেন। কিন্তু ইমাম যাহাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে বড় ফক্বীহ ও ইরাকের কাজী বলে উল্লেখ করেছেন। (মিযানুল এতেদাল ৪/৫০৩) সিয়া সিত্তার অন্যতম ইমাম হযরত আবু দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি মদীনা শরীফের মুফতী ছিলেন। (তাহযীবুত যাহযীব ১২/২৭, মিযানুল এতেদাল ৪/৪৬১)
৫) আব্দুর রাজ্জাক ইবনু হাম্মাম ইবনে নাফে রহমতুল্লাহি আলাইহি- ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে হাদীস শরীফের বড় নির্ভরযোগ্য রাবী বলেছেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ ১/৩৬৪)
৬) হযরত হাসান বিল আলী আল খালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি- হযরত খতীব বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য এবং হাফিজে হাদীস ছিলেন। (তারীখে বাগদাদ ৭/৪২৫) হযরত ইবনে হাজর আসকালানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য এবং হাফিজে হাদীস ছিলেন। (তাহজীবুত তাহজীব ২/৩০২)
উক্ত হাদীস শরীফে সালাফীদের আপত্তি হচ্ছে চতুর্থ রাবী হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে নিয়ে। হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কিন্তু য্যথাক্রমে কাজী, ফকীহ এবং মুফতী ছিলেন। সালাফীদের আপত্তির প্রেক্ষিতে বিষয়গুলো পর্যালোচনা না করলেই নয়। মুসলমান শাষন আমলে একজন ক্বাজী হওয়ার যোগ্যতা সে বিষয়ে না বললেই না। একজন ক্বাজীর প্রধান বৈশিষ্ঠই হচ্ছে সর্বোচ্চ তাক্বওয়া। সেই সাথে কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজমা কিয়াস সর্ম্পকে অগাধ জ্ঞান। যিনি কাজী তিনি অবশ্যই আদীল বা চরম ন্যায়পরায়ন হবেন। শুধু তাই না একজন কাজীর কুরআন শরীফের ৬৬৬৬ টি আয়াত শরীফের আদেশ সূচক ১০০০ আয়াত শরীফ , নিষেধ সূচক ১০০০ আয়াত শরীফ, ওয়াদা সূচক ১০০০ আয়াত শরীফ, ভীতি সূচক ১০০০ আয়াত শরীফ, ঘটনা সূচক ১০০০ আয়াত শরীফ, উপদেশ মূলক ১০০০ আয়াত শরীফ, হালাল সূচক ২৫০ টা আয়াত শরীফ, হারাম বিষয়ে ২৫০ টা আয়াত শরীফ, তাজবীহ সংক্রান্ত ১০০ টি আয়াত শরীফ, বিবিধ বিষয়ে ৬৬ টি আয়াত শরীফ এর প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা হুকুম সর্ম্পকে পূর্ণরূপে অবহিত থাকতে হবে। এবং কয়েক হাজার হাদীস শরীফের হাফিজ হবেন। এবং প্রতিটা বিষয়ে অত্যান্ত সত্যবাদী হবেন। যেহেতু তিনি বিচারক সেহেতু উনার যোগ্যতার মাপকাঠি সহজেই অনুমেয়। (দলীলঃ সমূহ ফিক্বহের কিতাব) সহজেই বোঝা যাচ্ছে একজন কাজী মাতরূক বা পরিত্যজ্য ব্যাক্তি হতে পারেন না। তাহলে ৭০ হাজার হাদীসের হাফিজ ( মিযানুল এতেদাল ৪/৪৬১) এবং একজন ক্বাজী হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি যে রাবী হিসাবে সিকাহ সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি শুধু ক্বাজীই ছিলেন না তিনি ছিলেন ফকীহ। (মিযানুল এতেদাল ৪/৫০৩)
একজন ফক্বীহর যোগ্যতা সর্ম্পকে ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীকত হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বক্তব্যটাই যথেষ্ঠ,
একজন ফক্বীহর যোগ্যতা সর্ম্পকে ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত তরীকত হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বক্তব্যটাই যথেষ্ঠ,
*انما الفقيه الزاهد فى الد نيا الراغب فى الا خرة البصير بذنبه المدائم على عبادة ربه الورع الكف عن اعراض المسلمين العفيف عن اموالهم النا صح لجماعتهم.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই ফক্বীহ (হাক্বীক্বী আলিম) ঐ ব্যক্তি যিনি দুনিয়া থেকে বিরাগ, আখিরাতের দিকে ঝুকে রয়েছেন, গুণাহ থেকে সতর্ক, সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল, পরহিযগার, মুসলমানদের মান-সম্ভ্রম নষ্ট করেন না, তাদের সম্পদের প্রতি লোভ করেন না এবং অধীনস্থ লোকদেরকে নছীহত করেন। (তাফসীরে কবীর)
সূতরাং ফক্বীহ হিসাবে হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি কেমন ব্যাক্তিত্ব ছিলেন নতুন করে বলার অবকাশই রাখে না।
এছাড়ও হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সর্ম্পকে বিখ্যাত ইমাম হযরত আবু দাউদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি মদীনা শরীফের মুফতী ছিলেন। (তাহযীবুত যাহযীব ১২/২৭, মিযানুল এতেদাল ৪/৪৬১)
আর একজন মুফতী বা ফতোয়াদান কারীর বৈশিষ্ঠ সর্ম্পকে হাফিজে হাদীস হযরত জালালুদ্দীন সূয়ুতী রহমতুল্লাহি আলাইহ , ফতোয়াদানকারী বা মুফতীকে অবশ্যই ইলমে লাদুন্নী বা খোদায়ী প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। (আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন)
সূতরাং সহজেই বলা যায় হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এ বিশেষ গুনাবলীর অধিকারী ছিলেন। আর মদীনা শরীফের একজন মুফতীর কি পরিমান যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন সেটা আক্বল সম্পন্ন ব্যাক্তি মাত্রই বুঝতে পারার কথা।
তাই রাবী হিসাবে উনাকে মাতরূক বলার আগে অবশ্যই হুশিয়ার হতে হবে। হযরত ইবনু আবি সাবরা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি মোটেও মাতরূক ছিলেন না। তিনি একজন যোগ্য হাদীস বিশারদ ও সেইসাথে ক্বাজী, ফক্বীহ ও মুফতী ছিলেন। সুবহানাল্লাহ।
ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি হল ঃ
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: ينزل ربنا تبارك وتعالى في كل ليلة إلى سماء الدنيا حين يبقى ثلث الليل الآخر فيقول من يدعوني فأستجيب له ومن يسألني فأعطيه ومن يستغفرني فأغفرله. (أخرجه البخاري ومسلم)
অর্থ ঃ আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , আমাদের রব তা‘আলা প্রতি রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন ও বলতে থাকেন, কে আছ আমার কাছে দু‘আ করবে আমি কবুল করব। কে আছ আমার কাছে চাইবে আমি দান করব। কে আছ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব। (বুখারী শরীফ: হাদীস ১০৯৪, মুসলিম শরীফ : হাদীস ১৮০৮)
সূতরাং বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের হাদীস শরীফ দ্বারা হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত শবে বরাতের হাদীস শরীফখানাও সমর্থন পেলো। অতএব বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফের হাদীস শরীফ দ্বারা শবে বরাতের হাদীস শরীফ শক্তিশালী হলো।
এ ছাড়া মাওয়াহেবুল্লাদুন্নিয়া ৭/৪১২ এ উল্লেখ আছে , “এ হাদীস শরীফের সমর্থনে শাহেদ হাদীস বিদ্যমান। ফলে হাদীস শরীফটির মৌলিকত¦ স্বীকৃত। ”
এছাড়াও এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফ উনার অন্যতম বিশুদ্ধ হাদীছ গ্রন্থ সিয়া সিত্তার অন্যতম কিতাব “ইবনে মাজাহ শরীফ” শরীফ উনার মধ্যে অর্ধ শা’বানের তথা শবে বরাত সম্পর্কে একটি বাবও আনা হয়েছে। যেমন, “ইবনে মাজাহ শরীফ”-এর ১০০ পৃষ্ঠায় বাবের নাম উল্লেখ করা হয়েছে,
باب ماجاء فى ليلة النصف من شعبان
এখন কথা হচ্ছে পবিত্র লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান বা শবে বরাতের যদি অস্তিত্বই না থাকতো তবে হযরত ইমাম ইবনে মাজাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি এ প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র একটি অধ্যায় রচনা করলেন কেন ? এবং সে বাবে এই হাদীস শরীফ বর্ণনা করলেন কেন? হাফিজে হাদীস ইমাম হযরত ইবনে মাজাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি কি সালাফীদের চাইতে হাদীস কম বুঝতেন ? নাউযুবিল্লাহ।
ইবনে মাজাহ শরীফ বিশ্লেষনে অনেক ইমাম অনেক মতামত ও চুচেরা বিশ্লেষন করেছেন। কিন্তু কেউই উক্ত হাদীস শরীফ এর ব্যাপারে জাল বা মওজু বলেন নাই। সূতারাং অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমান হলো শবে বরাত সম্পর্কে হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত হাদীস শরীফ খানা সহীহ। এবং সালাফীদের সকল আপত্তির উপশমও হবে আশাকরি।