নূরে মুজসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মহান আল্লাহ পাক উনার সমতুল্য হিসেবে সাব্যস্ত করার বেয়াদবীমূলক বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

নূরে মুজসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মহান আল্লাহ পাক উনার সমতুল্য হিসেবে সাব্যস্ত করার বেয়াদবীমূলক বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

নাস্তিকদের আপত্তি ১১ : মহান আল্লাহ পাক তিনিই কি একমাত্র শাসক এবং নির্দেশদাতা (Quran 18:86, 17:111, 3:79-80, 6:71)? নাকি মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও (Quran 4:59, 4:80, 24:56, 26:108, 26:110, 4:64)?নাস্তিকদের আপত্তি ১২ : পবিত্র কুরান শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে একজন মুসলিমকে অবশ্যই মহান আল্লাহ পাক উনার এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের উভয়ের আদেশ মুবারকই মান্য করে চলতে হবে (Quran 8:1, 8:20-21, 3:132, 33:31, 4:13, 4:80, 33:36, 4:14, 4:42, 58:20)!  এতে কি মহান আল্লাহ পাক উনাকে এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সমতুল্য হিসেবে বুঝানো হচ্ছে? নাঊযুবিল্লাহ!

খণ্ডণ : মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে অনেক আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মুসলমানদেরকে মহান আল্লাহ পাক উনার এবং উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের উভয়েরই আনুগত্য করার নির্দেশ মুবারক প্রদান করেছেন।

মূলত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুগত্যতাই মহান আল্লাহ পাক উনার আনুগত্যতা। 

বিষয়টি বুঝার জন্য সামান্য একটি উদাহরণের অবতারণা করা হলো। সাধারণত কোন একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে বেগবান করার জন্য বিভিন্ন কাজের উপযোগী করে বিভিন্ন সেকশনে ভাগ করে নেয়া হয়। প্রতিটি সেকশনে বিভিন্ন কর্মচারী কাজ করে থাকে। প্রতিটি সেকশনের কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য এক একজন দায়িত্বশীল নিযুক্ত থাকে যারা উক্ত সেকশনের কর্মচারীদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্মচারীদের জন্য যখন কোন আদেশ-নির্দেশ প্রদান করে তখন প্রতিটি সেকশনের দায়িত্বশীলের মাধ্যমেই করে থাকে। প্রতিটি দায়িত্বশীল সেকশনের কর্মচারীদের উপর সে আদেশ-নির্দেশগুলো প্রয়োগ করে।

কর্মচারীদেরকে নির্দেশগুলো সেকশনের দায়িত্বশীলরাই প্রদান করে। কর্মচারীরা দায়িত্বশীলের সে আদেশ পালনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির প্রধানেরই আদেশ পালন করে।

এটি দুনিয়াবী একটি উদাহরণ। এ সমস্ত দায়িত্বশীলরা সবাই ভুল-ত্রুটিযুক্ত। তাই আদেশ-নির্দেশ প্রদানের মধ্যে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির বিষয় জড়িত থাকে। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ হতে ওহী মুবারক নাযিল হওয়া ব্যতীত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ থেকে কোন কথা বলেন না বা নিজ থেকে কোন কাজ করেন না।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْـهَوٰى ◌ اِنْ هُوَ اِلَّا وَحْيٌ يُوحٰى ◌

অর্থ : “নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজ থেকে কোন কথা বলেন না বা কোন কাজ করেন না, যে পর্যন্ত উনার প্রতি ওহী মুবারক প্রেরণ করা হয়।” (পবিত্র সূরা নজম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩-৪)

আর তাই, মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসরণ করার জন্য আদেশ মুবারক প্রদান করেছেন। যেমন, মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

قُلْ يَا اَيُّهَا النَّاسُ اِنّـي رَسُوْلُ اللهِ اِلَيْكُمْ جَـمِيْعًا الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِ ۖ لَا اِلٰهَ اِلَّا هُوَ يُـحْيِي وَيُـمِيْتُ ۖ فَاٰمِنُوا بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ النَّبِيّ الْاُمّيّ الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللهِ وَكَلِمَاتِهٖ وَاتَّبِعُوْهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ ◌

অর্থ : “(হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি বলে দিন। হে মানব সম্প্রদায়! আমি তোমাদের সবার প্রতি মহান আল্লাহ পাক উনার প্রেরিত রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সমগ্র আসমান ও যমীনে মহান আল্লাহ পাক উনারই রাজত্ব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা সবাই বিশ্বাস স্থাপন করো মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি, উনার প্রেরিত মূল নবী নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি, যিনি বিশ্বাস রাখেন মহান আল্লাহ পাক উনার উপর এবং উনার সমস্ত কালাম মুবারক উনাদের উপর। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসরণ করো যাতে তোমরা সরল পথপ্রাপ্ত হতে পারো।” (পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫৮)

সুতরাং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুগত্য করার অর্থ হলো মহান আল্লাহ পাক উনার আনুগত্য করা। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মহান আল্লাহ পাক উনার সমতুল্য বুঝানো হচ্ছে। নাঊযুবিল্লাহ! কেননা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হচ্ছেন মাখলূক বা সৃষ্টি। তিনি খালিক বা স্রষ্টা মহান আল্লাহ পাক উনার কাছ থেকে ওহী মুবারক উনার মাধ্যমে বিভিন্ন আদেশ-নিষেধ মানুষকে প্রদান করে থাকেন। তাই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মহান আল্লাহ পাক উনার সমতুল্য জ্ঞান করা কুফরী।


 মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্রতা মুবারক নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

 মহান আল্লাহ পাক উনার পবিত্রতা মুবারক নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

নাস্তিকদের আপত্তি ১০ : মহান আল্লাহ পাক উনার কি সন্তান হতে পারে? না (Quran 6:101এবং হ্যাঁ (Quran 39:4)!

খণ্ডণ: মহান আল্লাহ পাক উনার শান-মান মুবারক সম্পর্কে এ ধরণের আপত্তি চরম মূর্খতা ও বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।

কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি স্পষ্ট করে ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّـمَا اللهُ اِلٰهٌ وَاحِدٌ ۖ سُبْحَانَهُ اَنْ يَكُوْنَ لَهُ وَلَدٌ ۘ

অর্থ : “নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ পাক তিনি একক ইলাহ। সন্তান-সন্ততি হওয়াটা উনার যোগ্য বিষয় নয়।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৭১)

মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন- 

وَقَالَتِ الْيَهُوْدُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيْحُ ابْنُ اللهِ ۖ ذٰلِكَ قَوْلُـهُمْ بِاَفْوَاهِهِمْ ۖ يُضَاهِئُوْنَ قَوْلَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا مِنْ قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللهُ ۚ اَنّٰـى يُؤْفَكُوْنَ◌ 

অর্থ : “ইহুদীরা বলে হযরত উযাইর আলাইহিস সালাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার পুত্র নাঊযুবিল্লাহ! এবং নাছারারা বলে হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস  সালাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার পুত্র। নাঊযুবিল্লাহ! এ হচ্ছে তাদের মুখের কথা। এরা পূর্ববর্তী কাফিরদের মত কথা বলে। মহান আল্লাহ পাক তিনি এদের ধ্বংস করুন, এরা কোন উল্টা পথে চলে যাচ্ছে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩০)

মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-

اَمْ يَـحْسَبُوْنَ اَنَّا لَا نَسْمَعُ سِرَّهُمْ وَنَـجْوَاهُمْ ۚ بَلٰى وَرُسُلُنَا لَدَيْهِمْ يَكْتُبُوْنَ ◌ قُلْ اِنْ كَانَ لِلرَّحْـمٰنِ وَلَدٌ فَاَنَا اَوَّلُ الْعَابِدِيْنَ ◌ سُبْحَانَ رَبِّ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُوْنَ ◌ 

অর্থ : “তারা কি মনে করে যে, আমি তাদের গোপন বিষয় ও গোপন পরামর্শ শুনি না? হ্যাঁ, শুনি। আমার হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাদের নিকটে থেকে লিপিবদ্ধ করে। বলুন, দয়াময় আল্লাহ পাক উনার কোন সন্তান থাকলে আমি সর্বপ্রথম তার ইবাদত করবো। তারা যা বর্ণনা করে, তা থেকে আসমান ও যমীনের পালনকর্তা, আরশের পালনকর্তা পবিত্র।” (পবিত্র সূরা যুখরুফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮০-৮২)

মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

مَا اتَّـخَذَ اللهُ مِنْ وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ اِلٰهٍ ۚ اِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ اِلٰهٍ بِـمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلٰى بَعْضٍ ۚ سُبْحَانَ اللهِ عَمَّا يَصِفُوْنَ ◌

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেননি এবং উনার সাথে কোন মাবুদ নেই। থাকলে প্রত্যেক মাবুদ নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে চলে যেতো এবং একজন অন্যজনের উপর প্রবল হয়ে যেতো। তারা যা বলে, তা থেকে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র।” (পবিত্র সূরা মু’মিনূন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৯১)

মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

بَدِيْعُ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضِ ۖ اَنّٰـى يَكُوْنُ لَهُ وَلَدٌ وَلَـمْ تَكُنْ لَّهُ صَاحِبَةٌ ۖ وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ ۖ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ◌

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি আসমান ও যমীনের আদি স্রষ্টা। কিরূপে মহান আল্লাহ পাক উনার পুত্র হতে পারে, অথচ উনার কোন সঙ্গী নেই? তিনি যাবতীয় কিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি সব বস্তু সম্পর্কে সুবিজ্ঞ।” (পবিত্র সূরা আন‘আম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১০১)

উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার কোন সঙ্গী নেই। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি এক এবং একক। আর তাই এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি পূর্ণাঙ্গ একখানা সূরা শরীফ নাযিল করেন এবং উক্ত সূরা শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন-

قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ ◌ اَللهُ الصَّمَدُ ◌ لَـمْ يَلِدْ وَلَـمْ يُوْلَدْ ◌ وَلَـمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا اَحَدٌ◌

অর্থ : “হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি বলুন- মহান আল্লাহ পাক তিনি এক। মহান আল্লাহ পাক তিনি বেনিয়াজ বা অমুখাপেক্ষী। মহান আল্লাহ পাক উনার থেকে কেউ জন্ম নেয়নি এবং মহান আল্লাহ পাক উনাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। আর মহান আল্লাহ পাক উনার সমকক্ষ কেউ নেই।” (পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ)

 যেহেতু মহান আল্লাহ পাক উনার থেকে কেউ জন্ম নেয়নি এবং মহান আল্লাহ পাক উনাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। আর এজন্য মহান আল্লাহ পাক তিনি সুস্পষ্ট করেই বর্ণনা মুবারক করেন-

اَاِلٰهٌ مَّعَ اللهِ ۚ تَعَالَى اللهُ عَمَّا يُشْرِكُوْنَ ◌

অর্থ : “অতএব, মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে অন্য কোন ইলাহ আছে কি? তারা যাকে শরীক করে মহান আল্লাহ তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে।” (পবিত্র সূরা নামল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৩)

মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَىْءٌ.

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক উনার মিছাল বা অনুরূপ কোন কিছুই নেই।” (পবিত্র সূরা শুরা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১)

মহান আল্লাহ পাক উনার কোন মিছালই নেই। তাহলে এ কথা কি করে সম্ভব যে, মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তান হতে পারে। আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

لَوْ اَرَادَ اللهُ اَنْ يَتَّخِذَ وَلَدًا لَّاصْطَفٰى مِـمَّا يَـخْلُقُ مَا يَشَاءُ ۚ سُبْحَانَهُ ۖ هُوَ اللهُ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ ◌

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি যদি সন্তান গ্রহণ করার ইচ্ছা করতেন, তবে উনার সৃষ্টির মধ্য থেকে যা কিছু ইচ্ছা মনোনীত করতেন, তিনি পবিত্র। তিনি মহান আল্লাহ পাক, এক পরাক্রমশালী।” (পবিত্র সূরা যুমার শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪)

এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দ্বারা স্পষ্ট যে, মহান আল্লাহ পাক উনার কোন সন্তান হতে পারে না। তাই তিনি ইরশাদ মুবারক করেন- سُبْحَانَهُ তিনি পবিত্র। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি সন্তানের বিষয়টি সহ সমস্ত অপবিত্রতা থেকে পবিত্র। তিনি হচ্ছেন সারা জাহানের স্রষ্টা।


মহান আল্লাহ পাক উনার ছূরত মুবারক নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

মহান আল্লাহ পাক উনার ছূরত মুবারক নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

নাস্তিকদের আপত্তি ৫ : মহান আল্লাহ পাক উনার অবস্থান প্রকৃতপক্ষে কোথায়? উনার জন্যে নির্ধারিত আরশে (Quran 57:4, 11:7)? পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র (Quran 2:115)? কা’বা ঘরে (Quran 14:37)?  আমাদের খুব নিকটে (Quran 50:16)?

নাস্তিকদের আপত্তি ৬ : মহান আল্লাহ পাক উনার কতগুলো cardinal point রয়েছে? এক (Quran 2:115) নাকি দুই (Quran 55:17)?

নাস্তিকদের আপত্তি ৭ : মহান আল্লাহ পাক উনার কি মানুষের মত কোন আকার আছে? না (Quran 112:4)  এবং হ্যাঁ (Quran 42:51, 38:75, 39:67, 69:17, 53:1-18)!

নাস্তিকদের আপত্তি ৮ : মহান আল্লাহ তিনি উনার তৈরি আরশ পাকে সমাসীন হয়ে লাওহে মাহফুজে সবকিছু লিখে রাখেন, যিনি হযরত আদম ছফিউল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে তৈরি করেছেন নিজের হাতে এবং নিজের আদলে (Sahih Bukhari 9:93:607, 8:74:246 Sahih Muslim 1:378, 32:6325, 40:6809), কিয়ামতের দিন যাঁর হাতের মুঠোয় থাকবে গোটা পৃথিবী (Sahih Bukhari 9:93:607, 8:74:246 Sahih Muslim 1:378, 32:6325, 40:6809),  আপনি কি করে দাবি করেন আপনার মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন ব্যাক্তি বিশেষ নন?

নাস্তিকদের আপত্তি ৯ : কিয়ামতের সময় আটজন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার আরশ পাককে উনাদের উর্ধ্বে বহন করবেন (Quran 69:17)! এই পবিত্র আয়াত শরীফ পড়েও কি আপনার মনে হয় মহান আল্লাহ পাক তিনি আসলেই নিরাকার এবং সর্বশক্তিমান?

খণ্ডণ: মহান আল্লাহ পাক উনার সম্পর্কে নিতান্তই মূর্খ হওয়ার কারণে এবং মহান আল্লাহ পাক উনাকে তাদের মতো চিন্তা করার কারণেই নাস্তিকরা এ ধরণের প্রশ্নের অবতারণা করেছে।

অথচ মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ اَيْدِيْهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُـحِيْطُوْنَ بِهِ عِلْمًا ◌

অর্থ : “তিনি জানেন যা কিছু তাদের সামনে ও পশ্চাতে আছে এবং উনাকে তারা তাদের জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ত করতে পারে না।” (পবিত্র সূরা ত্বহা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১০)

মূলত মহান আল্লাহ পাক তিনি যাত বা সত্ত্বাগতভাবে সম্মানিত আরশ পাকে অবস্থান করছেন। আর তাই তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُـمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ◌

অর্থ : “তিনি আসমানসমূহ ও যমীনসমূহ সৃষ্টি করেছেন ছয় ধাপে, অতঃপর সম্মানিত আরশ পাকের উপর সমাসীন হয়েছেন।” (পবিত্র সূরা হাদীদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪)

وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ 

অর্থ : “তিনিই আসমান ও যমীন ছয় ধাপে সৃষ্টি করেছেন, উনার সম্মানিত আরশ পাক ছিল পানির উপরে।” (পবিত্র সূরা হূদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)

الرَّحْمَـٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى ◌

অর্থ : “তিনি পরম দয়াময়, সম্মানিত আরশ পাকে সমাসীন রয়েছেন।” (পবিত্র সূরা ত্বহা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫)

اِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضَ فِي سِتَّةِ اَيَّامٍ ثُـمَّ اسْتَوٰى عَلَى الْعَرْشِ ◌

অর্থ : “নিশ্চয়ই তোমাদের মহান রব তায়ালা তিনি আল্লাহ। তিনি আসমান ও যমীনসমূহকে ছয় ধাপে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্টিত হয়েছেন।” (পবিত্র সূরা আরাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৪)

তবে তিনি সম্মানিত আরশ পাকে কিভাবে সমাসীন রয়েছেন তার পদ্ধতি কারো জানা নেই। কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি হচ্ছেন নিরাকার। উনার কোন ছূরত বা আকৃতিই নেই। মহান আল্লাহ পাক উনার মানুষের মতো আকার আকৃতি বা দেহ নেই। বরং মহান আল্লাহ পাক তিনি আকৃতি, প্রতিকৃতি, প্রতিচ্ছবি, অবয়ব বা দেহ বিশিষ্ট হওয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে পুতঃপবিত্র। উক্ত বৈশিষ্টগুলো মহান আল্লাহ পাক উনার সৃষ্টি।

আর তাই এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ ◌ اَللهُ الصَّمَدُ ◌ لَـمْ يَلِدْ وَلَـمْ يُوْلَدْ ◌ وَلَـمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا اَحَدٌ◌

অর্থ : “হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি বলুন- মহান আল্লাহ পাক তিনি এক। মহান আল্লাহ পাক তিনি বেনিয়াজ বা অমুখাপেক্ষী। মহান আল্লাহ পাক উনার থেকে কেউ জন্ম নেয়নি এবং মহান আল্লাহ পাক উনাকেও কেউ জন্ম দেয়নি। আর মহান আল্লাহ পাক উনার সমকক্ষ কেউ নেই।” (পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ)

মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَىْءٌ.

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক উনার মিছাল বা অনুরূপ কোন কিছুই নেই।” (পবিত্র সূরা শুরা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১)

এই আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় আক্বাইদের কিতাব ও অন্যান্য কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে যে, মহান আল্লাহ্ পাক তিনি দেহ বা আকার-আকৃতি বিশিষ্ট নন। মহান আল্লাহ্ পাক তিনি দেহ বা আকার-আকৃতি বিশিষ্ট একথা বিশ্বাস করা সুস্পষ্ট কুফরী। যেমন- এ প্রসঙ্গে হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম ফী ইল্মিল কালাম আল্লামা ইমাম গাযালী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার সুপ্রসিদ্ধ কিতাব “ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন”-এর ১ম খন্ড ৮১ পৃষ্ঠায় লিখেন-

مع كونه منزها عن الصورة والـمقدار مقدسا عن الـجهات والاقطار

অর্থ: “মহান আল্লাহ্ পাক তিনি “ছুরত” অর্থাৎ আকার-আকৃতি এমনকি সমস্ত “জিহাত” বা দিক হতেও পবিত্র।”

প্রসিদ্ধ, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ব বিখ্যাত কিতাব “শরহে আক্বায়িদে নাসাফীতে” উল্লেখ করা হয়েছে-

ولا جسم ولا جوهر ولا مصور اى ذى صورة وشكل مشكل مثل صورة الانسان او الفرس بان لـها بواسطة الكميات تلك من خواص الاجسام جص ذى حد ونـهاية.

অর্থ: “তিনি জিসিম বা দেহ বিশিষ্ট নন। (কারণ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে এবং দেহ স্থান দখলকারী)। মানুষ ও প্রাণীর ছুরত বা আকার-আকৃতি হলো- দেহের বৈশিষ্ট্য, যা দেহের প্রান্তসীমা ও পরিধি তথা দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বেধ দ্বারা অর্জিত অর্থাৎ আয়তন ও পরিমাণ হতে সৃষ্টি হয়ে থাকে। তিনি প্রান্ত, সীমা ও পরিধি বিশিষ্ট নন।”

এ উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ ও প্রখ্যাত হাদীছ বিশারদ ইমামুল মুহাদ্দিছীন, আল্লামা শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ মুহাদ্দিছে দেহলভী হানাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর নির্ভরযোগ্য কিতাব “আল ক্বাওলুল জামীল”-এর ৩১ পৃষ্ঠায় লিখেন-

منزه من جـميع سـمات النقص والزوال من الـجسمية والتجيز والعرضية والـهة والاالوان والاشكال.

অর্থ: মহান আল্লাহ্ পাক অপূর্ণতা ও নশ্বরতার যাবতীয় ছিফ্ত বা গুণ হতে সম্পূর্ণই মুক্ত। তিনি দেহ বিশিষ্ট, স্থান দখলকারী, কোন জিহাত বা দিকে অবস্থানকারী, বর্ণ ও আকৃতিধারী এবং দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যধারী নন।”

মহান আল্লাহ্ পাক-এর “জাতের পরিচয়” সম্পর্কিত উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, মহান আল্লাহ্ পাক-এর “জাত” ওয়াজিবুল ওয়াজূদ, উনার জাত হাদিছ বা সৃষ্ট নয়, মহান আল্লাহ্ পাক তিনি জিস্ম বা দেহ, ছূরত বা আকার-আকৃতি এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ভেদ ও তাশবীহ্ বা সাদৃশ্য ইত্যাদি হতে সম্পূর্ণরূপেই পবিত্র।

সুতরাং মহান আল্লাহ পাক তিনি সম্মানিত আরশ পাকে সমাসীন রয়েছেন, তবে কিভাবে সমাসীন আছেন তার পদ্ধতি কারো জানা নেই। কেননা যখন সম্মানিত আরশ পাক সৃষ্টি হয়নি, তখনও মহান আল্লাহ পাক তিনি ছিলেন।

মহান আল্লাহ পাক তিনি যেহেতু নিরাকার, তাই তিনি উনার ছিফত মুবারক বা গুণ-বৈশিষ্ট্য মুবারক দ্বারা সর্বত্র বিরাজমান।

আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وَلِلّٰهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ ۚ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللهِ ۚ اِنَّ اللهَ وَاسِعٌ عَلِيْمٌ ◌

অর্থ : “পূর্ব ও পশ্চিম মহান আল্লাহ পাক উনারই। অতএব, তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও, সেদিকেই মহান আল্লাহ পাক তিনি বিরাজমান। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৫)

اِنَّه بِكُلِّ شَىْءٍ مُحِيْطٌ.

অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।” (পবিত্র সূরা হা-মীম সিজদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৪)

মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্যত্র ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّ اللهَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيْرٌ.

অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্ববিষয়ে সমস্ত কিছুর উপর ক্ষমতাবান।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২০)

তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنَّ اللهَ عَلِيْمٌ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ.

অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি অন্তরের অন্তঃস্থলের খবরও জানেন।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৯)

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ ۖ وَنَـحْنُ اَقْرَبُ اِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيْدِ ◌

অর্থ : “আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।” (পবিত্র সূরা ক্বাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৬)

اَلَـمْ تَرَ اَنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْاَرْضِ ۖ مَا يَكُوْنُ مِن نَّـجْوٰى ثَلَاثَةٍ اِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَلَا خَـمْسَةٍ اِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَلَا اَدْنٰـى مِن ذٰلِكَ وَلَا اَكْثَرَ اِلَّا هُوَ مَعَهُمْ اَيْنَ مَا كَانُوا ۖ ثُـمَّ يُنَبِّئُهُم بِـمَا عَمِلُوْا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۚ اِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ ◌

অর্থ : “হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি কি দেখেননি যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি আসমান ও যমীনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে তা সবই অবগত রয়েছেন। এমনকি কোন স্থানে তিনজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে কোন গোপন পরামর্শ করলে মহান আল্লাহ পাক তিনি হন সেখানে চতুর্থজন, পাঁচজন হলে মহান আল্লাহ পাক তিনি হন তাদের ষষ্ঠ জন। এর চেয়ে কমবেশি যতজনই তারা হোক না কেন মহান আল্লাহ পাক তিনি তাদের সাথেই থাকেন তারা যেখানেই থাকুক। তারা যে কোন আমলই করুক মহান আল্লাহ পাক ক্বিয়ামতের দিন তাদের সমস্ত আমলের সংবাদ দিবেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণরূপে অবগত রয়েছেন।” (পবিত্র সূরা মুজাদালা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)

হযরত তাবেয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের সময়ে একদিন রোমের রাজা একজন দূতকে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে তিনটি প্রশ্নসহ বাগদাদে পাঠালো।

দূত শহরে এসে খলীফাকে জানালো যে, সে রোমের রাজার কাছ থেকে তিনটি প্রশ্ন এনেছে এবং মুসলিমদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তার উত্তর দেওয়ার জন্য।

খলীফা সকল আলিমদের একত্র হতে বললেন। রোমান দূত একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে বললো, আমি এসেছি তিনটি প্রশ্ন নিয়ে যদি আপনারা এর উত্তর দিতে পারেন আমি এ স্থান ত্যাগ করবো প্রচুর সম্পদ রেখে যা আমাকে রোমের রাজা সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে।

প্রশ্নগুলো হলো-

১) মহান আল্লাহ পাক উনার আগে কি ছিলো?

২) মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন দিকে মুখ করে আছেন?

৩) মহান আল্লাহ পাক তিনি এই মুহুর্তে কোন কাজে নিয়োজিত আছেন?

সবাই চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন; এর মধ্যে একটি ছোট বালক খলীফার কাছে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার জন্য অনুমতি চাইলেন; খলীফা উনাকে অনুমতি দিলো।

প্রশ্নোত্তর শুরু হলো :

বালক : তুমি কি গুনতে জানো?

দূত : হ্যাঁ।

বালক : তাহলে ১০ থেকে উল্টো দিকে গণনা করো।

দূত : (দূতটি গণনা শুরু করলো) ১০, ৯, ৮, ...... ১।

বালক : ১- এর আগে কি?

দূত : ১- এর আগে কিছুই নেই।

বালক : ঠিক আছে, গাণিতিক একের আগে যদি কিছুই না থাকে তাহলে তুমি কিভাবে আশা করো কি থাকবে এই ‘এক’-এর আগে যা নিশ্চিত সত্য, শাশ্বত, চিরস্থায়ী, সুস্পষ্ট।

বালকটির স্পষ্ট উত্তরে দূতটি হতবিহ্বল হয়ে গেল, কিছু অস্বীকার করতে পারল না।

দূত : তাহলে এখন বলুন, মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন দিকে মুখ করে আছেন?

বালক : একটি মোমবাতি আনো এবং তাতে আগুন জ্বালাও।

(মোমবাতি জ্বালানো হলো)

বালক : এখন বলো আগুনের শিখা কোন দিকে মুখ করে আছে?

দূত : এটাতো চতুর্দিকেই আলো ছড়াচ্ছে; এটা কোন এক দিকে নির্দিষ্ট নেই।

বালক : যদি এই বস্তু চতুর্দিকেই আলো ছড়াতে পারে; তাহলে তুমি কিভাবে এরকম অনুমান করতে পারো মহান আল্লাহ উনার সম্পর্কে যে তিনি নির্দিষ্ট কোন একটি দিকে মুখ করে থাকবেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর অধিপতি; সকল আলোর আলো।

(রোমান দূত বোকা বনে গেল। সে অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হলো। এতটুকু একটি বালক তার সব প্রশ্নের এত সাবলীলভাবে উত্তর দিচ্ছেন যে, উনার যুক্তি-প্রমাণের কাছে কোনরূপ দ্বিমত পোষণ করা যাচ্ছে না। অবশেষে সে তার শেষ প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতে গেল।)

বালক : থামুন। এখানে প্রশ্ন করছো তুমি আর জবাব দিচ্ছি আমি। আর যেহেতু উত্তরদাতা প্রশ্নকর্তা থেকে বড়। তাই তুমি নিচে নেমে আসো আর আমাকে উপরে আসন গ্রহণ করতে দাও ।

এরপর দূত নিচে নেমে এল এবং বালকটি উচু স্থানে আসন গ্রহন করার পর দূত তার শেষ প্রশ্নটি করল।

দূত : বল এখন আল্লাহ কি করছেন?

বালক : এই মুহুর্তে আল্লাহ তোমাকে উচু স্থান থেকে নিচে নামিয়ে অপমান করেছেন এবং আমাকে নিচু স্থান থেকে উচু স্থানে উঠিয়ে সম্মানিত করেছেন। আর এভাবেই যে মহান আল্লাহ উনার একত্ব বিশ্বাস করে তিনি তাকে উপরে উঠিয়ে সম্মানিত করেন এবং মহান আল্লাহ পাক উনার একত্বে অবিশ্বাসীদেরকে অপদস্থ করেন।

অতঃপর রোমান দূতের আর কিছু বলার থাকল না, সেই স্থান ত্যাগ করা ছাড়া।

এই ছেলেটি পরবর্তীতে বড় হয়ে ইসলামের এক মহান জ্ঞানী পন্ডিত হিসেবে আবির্ভূত হন এবং তিনিই হলেন ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, নিরাকার মহান আল্লাহ পাক তিনি জাত বা সত্ত্বাগতভাবে সম্মানিত আরশ পাকে সমাসীন। আর উনার ছিফত মুবারক বা গুণ-বৈশিষ্ট্য মুবারক দ্বারা তিনি সর্বত্র বিরাজমান।

আদর তাই ছিফত মুবারক বা গুণ-বৈশিষ্ট্য মুবারক দ্বারা সর্বত্র বিরাজমান মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে কখনো বলেছেন তিনি পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র আছে, কখনো বলেছেন তিনি পবিত্র কা’বা শরীফ উনার মধ্যে আছে কিংবা কখনো বলেছেন আমাদের খুব নিকটে আছেন। আবার তিনি কখনো বলেছেন তিনি দুই উদায়াচল ও দুই অন্তাচল উভয়ের মালিক। প্রত্যেকটি বিষয়ই উনার ছিফত মুবারক বা গুণ-বৈশিষ্ট্য মুবারক দ্বারা সর্বত্র বিরাজমানের বহিঃপ্রকাশ।

 

 মহান আল্লাহ পাক উনার একত্বতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

মহান আল্লাহ পাক উনার একত্বতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের দালীলিক জাওয়াব

নাস্তিকদের আপত্তি ১ : মহান আল্লাহ পাক প্রকৃতপক্ষে কতজন? একজন (Quran 40:62) নাকি অনেক (Quran 21:7, 23:14)!

নাস্তিকদের আপত্তি ২ : সৃষ্টিকর্তা কতজন? অনেক (Quran 23:14, 37:125 l-khāliqīna means the Creators)  নাকি এক (Quran 39:62, 40:62, 6:102, 13:16)!

নাস্তিকদের আপত্তি ৩ : সৃষ্টিকর্তা আসলে কতজন যে মহান আল্লাহ পাক তিনি তাদের মাঝে অন্যতম (Quran 23:14, 37:125 l-khāliqīna means the Creators)?

নাস্তিকদের আপত্তি ৪ : মহান আল্লাহ পাক তিনিই কি মানব সভ্যতার জন্যে একমাত্র রক্ষাকর্তা (Quran 32:4, 18:86, 18:102, 9:116) নাকি তিনি একাই নন (Quran 41:30-31, 5:55, 9:71)?

খণ্ডণ : মহান আল্লাহ পাক তিনি এক এবং একক। এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবেই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। 

বস্তুত নাস্তিকদের অবস্থা হচ্ছে আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেয়ার মতো। তাদের আপত্তির প্রেক্ষিতেই তাদের ইলমের দৌড় সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়। 

মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার একত্বতা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বিভিন্ন আয়াত শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশ করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

ذٰلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ لَّا اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۖ فَاَنّٰـى تُؤْفَكُوْنَ ◌

অর্থ : “তিনি মহান আল্লাহ পাক, তোমাদের রব তায়ালা, সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছো?” (পবিত্র সূরা মু’মিন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬২)

মহান আল্লাহ পাক তিনি তো বিভ্রান্তি থেকে উদ্ধারের জন্য স্পষ্ট করেই বর্ণনা করেছেন যে, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত যদি আরো সৃষ্টিকর্তা কিংবা ইলাহ থাকতো তাহলে তাদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়ে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যেত।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

لَوْ كَانَ فِيْهِمَا اٰلِـهَةٌ اِلَّا اللهُ لَفَسَدَتَا ۚ فَسُبْحَانَ اللهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُوْنَ ◌

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত আসমান ও যমীনে যদি অন্য কোন ইলাহ থাকতো, তবে উভয়ে ধ্বংস হয়ে যেতো। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে সম্মানিত আরশ উনার অধিপতি মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র।” (পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২২)

আর মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার একত্বতা প্রকাশের জন্য একখানা পূর্ণ সূরা শরীফও নাযিল করেছেন-

قُلْ هُوَ اللهُ اَحَدٌ ◌ اَللهُ الصَّمَدُ ◌ لَـمْ يَلِدْ وَلَـمْ يُوْلَدْ ◌ وَلَـمْ يَكُن لَّه كُفُوًا اَحَدٌ ◌

অর্থ : “(হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম!) আপনি বলুন, খালিক্ব, মালিক, রব, মহান আল্লাহ পাক তিনি এক। মহান আল্লাহ পাক তিনি বেনিয়াজ অর্থাৎ তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। উনার থেকে কেউ জন্মগ্রহণ করেননি এবং তিনিও কারও থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। উনার সমকক্ষ কেউ নেই।” (পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ) 

সুতরাং সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত যে, মহান আল্লাহ তিনি এক ও একক। এরপরেও পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি নিজের ব্যাপারে কোথাও একবচন ব্যবহার করেছেন আবার কোথাও বহুবচন ব্যবহার করেছেন। আবার কোথাও একই আয়াত শরীফ উনার মধ্যে একবচন ও বহুবচন উভয়টি ব্যবহার করেছেন। এই বহুবচন ব্যবহারের কারণ নিয়েই নি¤েœ আলোচনা করা হলো-

১) মহান আল্লাহ পাক উনার শান মুবারক এবং সব বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করা : মহান আল্লাহ পাক উনার সম্মানিত কালাম পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ভাষা হচ্ছে খাঁটি ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষা।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وَهٰذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُّبِيْنٌ

অর্থ : “আর পবিত্র কুরআন শরীফ সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।” (পবিত্র সূরা নাহল্ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১০৩)

সুতরাং অনন্য ও অসাধারণ বাকরীতি এবং অনুপম অলংকার ও সাহিত্য গুণসম্পন্ন আরবী ভাষাই হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ভাষা। আর তাই পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার শান মুবারক-এ যে, উত্তম পুরুষ বা বক্তাপক্ষের কোথাও একবচনের সর্বনাম, কোথাও বহুবচনের সর্বনাম এবং কোথাও একবচন ও বহুবচনের সর্বনাম পাশাপাশি ব্যবহার হয়েছে, তা আরবী বাকরীতি ও অলংকারসম্মত বৈকি।

মহান আল্লাহ পাক তিনি সবদিক থেকে এক অদ্বিতীয় ও ‘লা-শারীক’-এই বিবেচনায় উনার ব্যাপারে একবচনের সর্বনাম ব্যবহৃত হয়েছে। আবার মহান আল্লাহ পাক তিনি হলেন সর্বময় গুণের অধিকারী অর্থাৎ একের ভেতর অনেকগুলো বিশেষ গুণ এবং এক-একটি গুণের এক-এক রকম রূপ আছে। তাই তিনি কখনো واحد ওয়াহিদ, আবার কখনো احد আহাদ। অর্থাৎ তিনি একের মধ্যে বহু তথা একক। তাই তিনি কখনো নিজেকে اَنَا ‘আমি’ বলেছেন, আবার কখনো نَـحْنُ ‘আমরা’ বলেছেন।

সাধারণত আরবী ভাষায় সম্মানিত ব্যক্তিত্ব উনার মর্যাদা প্রকাশার্থে উনার সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় বুঝাতে বহুবচনের ব্যবহার সুপরিচিত। তাই এটিকে আরবী ভাষাবিদগণ ‘বহুবচন’ না বলে ‘সম্মানজ্ঞাপক একবচনের সর্বনাম’ বলেছেন। উনাদের ভাষায় এর নাম হলো : ضمير العظمة، نون العظمة، ضمير الـمتكلم الـمعظم نفسه، ضمير الـمتكلم الواحد الـمطاع، لفظ الـمتكلم الـمطاع ইত্যাদি।

মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যাপারে ব্যবহৃত এই সর্বনাম ব্যবহারের একটি উদ্দেশ্য হলো উনার শান মুবারক এবং সব বিষয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অভিব্যক্তি প্রকাশ করা। 

যেমন- আদেশ মুবারক ও নিষেধাজ্ঞা মুবারক বিষয়ক পবিত্র আয়াত শরীফ-

وَاِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْا اِلَّا اِبْلِيْسَ اَبٰـى) سورة طه: ١١٦(When We said to the angels, "Prostrate yourselves to Adam", they prostrated themselves, but not Iblis: he refused. (20: 116)

وَاِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْا اِلَّا اِبْلِيْسَ قَالَ اَاَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِيْنًا )سورة الاسراء: ٦١(

وَاِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْا اِلَّا اِبْلِيْسَ اَبٰـى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِيْنَ )سورة البقرة: ٣٤(

And behold, We said to the angels: "Bow down to Adam" and they bowed down. Not so Iblis: he refused and was haughty: He was of those who reject Faith. (2: 34)

وَاِذْ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْا اِلَّا اِبْلِيْسَ كَانَ مِنَ الْـجِنِّ فَفَسَقَ عَنْ اَمْرِ رَبِّهِ اَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِن دُوْنِـي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِيْنَ بَدَلًا ) سورة الكهف: ٥٠(

وَقُلْنَا يَا اٰدَمُ اسْكُنْ أَنتَ وَزَوْجُكَ الْـجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّالِمِيْنَ) سورة البقرة: ٣٥(

قُلْنَا اهْبِطُوْا مِنْهَا جَـمِيْعًا فَاِمَّا يَاْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَن تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَـحْزَنُوْنَ )سورة البقرة: ٣٨(

قُلْنَا يَا نَارُ كُوْنِـي بَرْدًا وَسَلَامًا عَلٰى اِبْرَاهِيْمَ) سورة الانبياء: ٦٩(

وَقُلْنَا مِن بَعْدِهِ لِبَنِي اِسْرَائِيْلَ اسْكُنُوا الْاَرْضَ فَاِذَا جَاءَ وَعْدُ الْاٰخِرَةِ جِئْنَا بِكُمْ لَفِيْفًا )سورة الاسراء: ١٠٤(

وَرَفَعْنَا فَوْقَهُمُ الطُّوْرَ بِـمِيْثَاقِهِمْ وَقُلْنَا لَـهُمُ ادْخُلُوا الْبَابَ سُجَّدًا وَقُلْنَا لَـهُمْ لَا تَعْدُوْا فِي السَّبْتِ وَاَخَذْنَا مِنْهُم مِّيْثَاقًا غَلِيْظًا) سورة النساء: ١٥٤(

মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার এ সৃষ্টিজগতের পরিচালনার জন্য কারো মুখাপেক্ষী নন বরং সবাই উনার মুখাপেক্ষী। আর এ জন্যই তিনি পৃথিবীর রাজা-বাদশাহদের মতো নন, যাদের প্রয়োজন হয় উযীর বা মন্ত্রীর এবং বিভিন্ন বাহিনীর। মহান আল্লাহ পাক তিনি হলেন কুল কায়িনাতের খ¦ালিক্ব বা সৃষ্টিকর্তা ও রব বা প্রতিপালনকারী। উনার শান মুবারক সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

اِنَّـمَا اَمْرُهُ اِذَا اَرَادَ شَيْئًا اَنْ يَّقُوْلَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ ◌

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছা মুবারক করেন, তখন কেবল বলেন, ‘হও’ তখনই তা হয়ে যায়।” (পবিত্র সূরা ইয়াসীন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮২)

মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন একটি কার্য সম্পাদনের ইচ্ছা মুবারক পোষণ করলে كُنْ ‘হও’ বললেই তা হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তারপরও মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার তাকউয়ীনী হুকুম মুবারক কার্যকর করার জন্য কর্মনির্বাহকারী ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের নিযুক্ত রেখেছেন। বস্তুত মহান আল্লাহ পাক তিনি বিভিন্ন হিকমত ও উদ্দেশ্যে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের সৃষ্টি করেছেন এবং উনাদেরকে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত রেখেছেন। উনাদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা ইখতিয়ার নেই। উনারা কেবল মহান আল্লাহ পাক উনার হুকুম মুবারক তামীল করেন। উনাদেরকে যে কাজেরই নির্দেশ মুবারক প্রদান করা হয় সেটাকেই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আঞ্জাম দেন। সুতরাং মহান আল্লাহ পাক উনার সৃষ্ট এবং উনার পূর্ণ আজ্ঞাবহ ও নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়ার কারণে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের কথা মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে বহুবচনে সর্বনামের ব্যবহার মহান আল্লাহ পাক উনার নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অভিব্যক্তিই প্রকাশ করে এবং এতে উনার গৌরব ও মহিমাই ফুটে উঠে।

মহান আল্লাহ পাক উনার যাঁরা বান্দা উনাদেরকে নিয়েই তিনি ‘আমরা’। এখানে হয়তো অনেকের মনে প্রশ্ন হতে পারে আমরা কি মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা নই? হ্যাঁ, মৌখিক স্বীকৃতিতে মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা। কিন্তু কার্য্যগতভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা হওয়া সহজ বিষয় নয়। কার্য্যগতভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা হলে তখনই মহান আল্লাহ পাক উনার ‘আমরা’ দলের সদস্য হওয়া যায়।

একটি মোমবাতির আলো দিয়ে হাজার বাতি আলোকিত করা যায়, তাতে প্রথম মোমবাতিটির আলো একটুও কমবেও না, বাড়বেও না। হাজার বাতির আলোর নাম ‘আমরা’ আলো - কিন্তু বহুবচন ব্যবহার হলেও আলো আসলে এক এবং অদ্বিতীয়। হাজারের মধ্যেও তিনি, অগণিতের মধ্যেও তিনি, আবার একের মধ্যেও তিনি। এই অসীম ও অপরিমেয় গুণাবলীর জন্য বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহার হতে পারে। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক তিনি কখনোই দ্বৈত বা দ্বিবচন ব্যবহার করেননি। কারণ বহুবচন যেখানে মহান আল্লাহ পাক উনার মর্যাদা ও গুণসমূহের মাহাত্ম্যকে প্রকাশ করে, দ্বিবচনাত্মক শব্দ সেখানে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সংখ্যাকেই (দুই) নির্দেশ করে, যা থেকে তিনি সম্পূর্ণ পবিত্র।

এছাড়াও পবিত্র হাদীছে কুদসী শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

كُنْتُ كَنْزَا مُـخْفِيًّا فَاَحْبَبْتُ اَنْ اُعْرَفَ فَخَلَقْتُ الْـخَلْقَ لاُعْرَفَ.

অর্থ : “আমি গুপ্ত ছিলাম। যখন আমার মুহব্বত হলো যে, আমি প্রকাশিত হই, তখনই আমি সৃষ্টি করলাম সৃষ্টির যিনি মূল (আমার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উনাকে।” (সিররুল আসরার, আল মাকাসিদুল হাসানা ৮৩৮, কাশফূল খিফা/২০১৩, আসনাল মুত্বালিব/১১১০, তমীযুত তীব/১০৪৫, আসরারুল মারফুআ/৩৩৫, তানযিয়াতুশ শরীয়াহ ১/১৪৮, আদ দুরারুল মুন্তাছিরা/৩৩০, আত্ তায্কিরা ফি আহাদীসিল মুশতাহিরা/১৩৬)

সুতরাং মহান আল্লাহ পাক তিনি যেহেতু গুপ্ত ছিলেন। তাই তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সৃষ্টির মাধ্যমে “আমরা” রূপে প্রকাশিত হয়ে সৃষ্টির মধ্যে উনার তাওহীদ বা একত্বতা প্রকাশ করেছেন।

২) উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বচনভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটানো : মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যাপারে ব্যবহৃত বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহারের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বচনভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। কেননা বহুবচন ব্যবহারের ফলে বালাগাতের পরিভাষায় الالتفات ‘ইলতিফাত’ এবং التفنن ‘তাফান্নুুন’ নামক দুটি সৌন্দর্য তৈরি হয়। ইলতিফাত হলো বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে বক্তব্যের যমীর বা সর্বনামের ধারা পরিবর্তন করা। এর বিভিন্ন ধরণ ও প্রকার রয়েছে।

পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে যেখানেই মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যাপারে বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেই এর পূর্বে বা পরে মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যাপারে ইসমে যাহির কিংবা যমীরে ওয়াহিদ গায়িব তথা অন্যপক্ষের একবচনের সর্বনাম কিংবা ওয়াহিদ মুতাকাল্লিম তথা বক্তাপক্ষের একবচনের সর্বনাম ব্যবহার হয়েছে। এতে যেমন ইলতিফাত-এর সৌন্দর্য এসেছে তেমনি গৌরব ও সম্মানার্থে একবচনের জায়গায় বহুবচনের রূপ ব্যবহারের বিষয়টিও সুস্পষ্ট হয়েছে।

প্রতিটি ইলতিফাত-এর স্থানগত সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি নিজস্ব সৌন্দর্যও রয়েছে। যেমন আকস্মিক ধারা পরিবর্তন দ্বারা ‘তাফান্নুন’ ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়, ফলে শ্রোতা সচকিত হয়ে বিষয়বস্তুর প্রতি অধিকতর মনোযোগী হয়। সেই সাথে কালাম ইজাযপূর্ণ ও সুসংক্ষিপ্ত হয়। তাছাড়া ইলতিফাত দ্বারা উদ্দিষ্ট ভাব ও মর্মটি ইঙ্গিতে প্রকাশ করা হয়। আর ইঙ্গিতময়তা প্রত্যক্ষ ভাষণের চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে থাকে।

৩) মুসনাদের প্রতি বা সম্বন্ধকৃত বিষয়ের প্রতি শ্রোতার অন্তরে সমীহবোধ জাগ্রত করা : মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যাপারে ব্যবহৃত বহুবচনের সর্বনাম ব্যবহারের আরেকটি হিকমত হলো মুতাকাল্লিম বা বক্তাপক্ষের বহুবচন ব্যবহারের একাধিক অভিব্যক্তি রয়েছে। যেমন, ইসনাদ কিংবা ইযাফাতের মাধ্যমে বহুবচনের সর্বনামের দিকে সম্বন্ধকৃত বিষয়ের প্রতি শ্রোতার অন্তরে সমীহবোধ জাগ্রত করা। মুসনাদের প্রতি ইহতিমাম ও যতœ প্রদর্শন করা। মুসনাদের বিশেষত্ব প্রকাশ করা। আদিষ্ট বিষয়ের প্রতি সম্বোধিত ব্যক্তির অন্তরে অধিকতর গুরুত্ববোধ সৃষ্টি করা এবং কোনো কিছুর ভয়াবহতা তুলে ধরা। অথবা কোনো কিছু শুধু মহান আল্লাহ পাক তিনিই করতে পারেন, এই ইখতিছাছ ও বিশেষায়ণ ইত্যাদি ভাব ও মর্মের উপস্থাপন করা। যেমন -

وَاِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِّـمَّا نَزَّلْنَا عَلٰى عَبْدِنَا فَاْتُوْا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُوْنِ اللهِ اِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ) سورة البقرة: ٢٣(

وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا) سورة الأعراف: ٧)

وَمَنْ رَزَقْنَاهُ مِنَّا رِزْقًا حَسَنًا) سورة النحل: ١٦)

إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا) سورة الكهف: ١٨)

فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآَنَهُ) سورة القيامة: ١٨)

وَاللَّهُ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيَاحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَسُقْنَاهُ إِلَى بَلَدٍ مَيِّتٍ) سورة الفاطر:٩)

وَلَقَدْ كُذِّبَتْ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ فَصَبَرُوا عَلَى مَا كُذِّبُوا وَأُوذُوا حَتَّى أَتَاهُمْ نَصْرُنَا) سورة الأنعام: ٦)

অর্থাৎ এখানে এমন একটি আবহ বা অবস্থা তৈরি হয় যেন মহান আল্লাহ পাক উনার ‘সম্মানজ্ঞাপক একবচনের সর্বনাম’-এর মাধ্যমে আপন মহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছেন। ফলে শ্রোতাগণের উপর মহিমা ও গৌরবের এমন তাজাল্লীর বিচ্ছুরণ হয় যা পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ভাব ও গুঢ়রহস্যকে তাদের অন্তরের গভীর অনুভূতির সাথে পূর্ণ একাত্ম করে দেয়।

উপরোক্ত কারণসমূহ ছাড়াও শব্দগত, অর্থগত এবং প্রসঙ্গের পারিপার্শ্বিকতার সূক্ষ্ম বিচারেও বহুবচনরূপী সর্বনাম ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন-

وَلَوْ شِئْنَا لَآَتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (سورة السجدة: ٣٢)

وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا سَنَسْتَدْرِجُهُمْ مِنْ حَيْثُ لَا يَعْلَمُونَ وَأُمْلِي لَهُمْ إِنَّ كَيْدِي مَتِينٌ (سورة الأعراف:٧)

সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যাপারে ব্যবহৃত বহুবচনের সর্বনাম সম্মানার্থে বহুবচন, সংখ্যাবাচক বহুবচন নয়।

‘সম্মানজ্ঞাপক একবচনের সর্বনাম’-এর তরজমা বা অনুবাদ :

পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যাপারে ব্যবহৃত বহুবচনবাচক সর্বনামের অনুবাদ যদি বাংলায় বহুবচনের ‘আমরা’ ‘আমাদের’ দ্বারা করা হয় তা হবে শাব্দিক অনুবাদ। এতে আরবীর শব্দ-গৌরব, অলংকার ও ব্যঞ্জনা উঠে আসবে না। অধিকন্তু এতে বাংলাভাষী সাধারণ পাঠকের অন্তরে ঈমান-আক্বীদাগত ত্রুটি তো তৈরি হবেই পাশাপাশি প্রকাশরীতি অস্বাভাবিক হওয়ায় পাঠকের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু বাংলা তরজমায় যদি ‘আমি’ (যাতে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে কিছুটা হলেও সম্মানার্থ রয়েছে) প্রয়োগ করা হয়, তবে মূল আরবীর পূর্ণ ভাব ও আবেদন প্রকাশ না পেলেও ঈমান-আক্বীদাগত ত্রুটি ও পাঠকের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। এসব কারণে সাধারণ পাঠকদের উদ্দেশ্যে রচিত তরজমাতুল কুরআনে আলোচিত বহুবচনবাচক শব্দ মুবারক উনার বাংলা অনুবাদ ‘আমি’ করাই উত্তম।

তদুপরি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার অনুবাদের ক্ষেত্রে যে বহুবাচক We বা “আমরা” ব্যবহার করা হয় সেটাকে বলা হয় Royal বা রাজকীয় We (আমরা)। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো রাজা বা কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বলে- “আমরা এই অধ্যাদেশ জারি করছি যে” অথবা “আমরা এই বিষয়টিতে সন্তুষ্ট নই”, তখন সেটা রাজকীয় সর্বনাম “আমরা” ব্যবহৃত হয়। এখানে রাজা একজন মাত্র ব্যক্তি যে নিজেই অধ্যাদেশ জারি করছে বা সে নিজেই সন্তুষ্ট নয়। অথচ নিজের জন্য সে “আমি” ব্যবহার করার পরিবর্তে “আমরা” সর্বনাম ব্যবহার করছে। এই আমরা দিয়ে বহুবচন বুঝায় না; বরং বক্তার সম্মান এবং মর্যাদাগত অবস্থান তুলে ধরার জন্য এই সর্বনাম ব্যবহার করা হয়।

বাংলাসহ ইংরেজি, ফার্সি, হিব্রু, আরবী ইত্যাদি অনেক ভাষাতেই এই রাজকীয় “আমরা” সর্বনামের ব্যবহার রয়েছে। এটি ভাষার একটি মর্যাদাগত দিক। ইংরেজি ব্যাকরণের নিয়মানুযায়ী, কর্তা একবচন হলে ক্রিয়াও একবচন হবে। অতএব, He is  বা She is  এর মতো You is  হওয়ার কথা যখন  You দিয়ে কেবল তুমি বা আপনি অর্থাৎ একজন মাত্র ব্যক্তিকে বুঝায়। কিন্তু You দিয়ে যখন তোমরা বা আপনারা বুঝায়, তখনই কেবল ব্যাকরণ অনুযায়ী, You are  হওয়ার কথা। অথচ are  ক্রিয়াটি বহুবাচক তোমরা এর জন্য হলেও তুমি বা আপনি অর্থে You  সর্বনামের সাথেও আমরা বহুবাচক are ব্যবহার করি।

একই কথা প্রযোজ্য I এর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ব্যাকরণের নিয়মে I am না হয়ে I is হওয়ার কথা। কিন্তু প্রচলিত ইংরেজিতে  I এর সাথে am  ব্যবহার করা হয়। মোটকথা, তুমি বা আপনি অর্থে, You এর সাথে are এবং  I  এর সাথে am এর ব্যবহার হলো Royal Plural  বা রাজকীয় বহুবচনের উদাহরণ।

অধিকিন্তু শুধুমাত্র আলোচিত বহুবচনবাচক শব্দ মুবারক নয় বরং আরবী ভাষার সাথে অন্যান্য ভাষার সাদৃশ্য অপেক্ষা পার্থক্যই অধিক। কারণ একেকটি ভাষা সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা-গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তাই আরবী ভাষার গঠন-প্রণালী ও ব্যাকরণ নানা দিক দিয়ে অন্যান্য ভাষার গঠন-প্রণালী ও ব্যাকরণ হতে ভিন্ন। যেমন-

* অনেক আরবী বর্ণের বিশুদ্ধ আরবী উচ্চারণ অনুসারে প্রতিবর্ণীকরণ সম্ভব নয়।

* আরবীতে ও সংস্কৃতে ক্রিয়ার তিনটি বচন আছে, যথা- একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন। কিন্তু বাংলায় ক্রিয়ার বচনভেদ নেই। একবচন ও বহুবচনে ক্রিয়ার রূপ অভিন্ন।

* আরবী ও ইংরেজিতে সর্বনামের লিঙ্গভেদ রয়েছে, কিন্তু বাংলা ভাষায় সর্বনাম শব্দে নারী-পুরুষবাচক পার্থক্য করা হয় না। আমি, তুমি, সে, তারা, এটা, ওটা ইত্যাদি সর্বনাম স্ত্রী-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রে একই রূপে ব্যবহৃত হয়।

* আরবী ও সংস্কৃত ভাষায় সংখ্যা অনুযায়ী বিশেষ্যপদের বচন পাল্টে যায়। তাই আরবীতে বলা হয় রজুলুন, রজুলানি, রিজালুন। সংস্কৃতে বলা হয়, নর:, নরৌ, নরা:। কিন্তু বাংলায় সংখ্যা যা-ই হোক, সেই অনুযায়ী বিশেষ্যপদের বচন পাল্টানোর দরকার হয় না। তাই বাংলা ভাষায় ১-এর ক্ষেত্রে যা ‘মানুষ’, সংখ্যাটা ১-এর বেশি হলেও তা মানুষই থেকে যায়, ‘দুজন মানুষেরা’ বা ‘তিনজন মানুষেরা’ লেখার দরকার হয় না। ইংরেজিতে দ্বিবচনের বিশেষ রূপ নেই, আছে শুধুই Singular বা একবচন Plural বা বহুবচন। সংখ্যাটা ১ হলে Man ১-এর বেশি হলেই Men এ ধরনের আরো অনেক পার্থক্যই রয়েছে, যা বাংলা ভাষায় অবিকল নকল করা সম্ভব নয়।

* আরবী বাকরীতি বাংলায় অপ্রচলিত হওয়ার কারণে তরজমার ক্ষেত্রে তা পরিবর্তন করে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বাকরীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তরজমা করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন-

১. বক্তা ও শ্রোতার অন্তরে ভবিষ্যতে ঘটিতব্য কোনো ঘটনার সুনিশ্চয়তার বিশ্বাস বদ্ধমূল করার উদ্দেশ্যে ‘ছিগায়ে মুসতাকবিল’ বা ভবিষ্যত কালের পরিবর্তে ‘ছিগায়ে মাদ্বী’ বা অতীত কাল ব্যবহার হয়। এ ধরনের ‘ছিগায়ে মাদ্বী’-র বাংলা তরজমা কোথাও কোথাও ‘মাদ্বী’ বা অতীত কালের ক্রিয়া দিয়ে করা সম্ভব। কিন্তু সব জায়গায় তা খাটবে না। উদাহরণস্বরূপ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ উনার ৪৩ ও ৪৪ নং আয়াত শরীফ।

وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ تَـجْرِي مِن تَـحْتِهِمُ الْاَنْهَارُ ۖوَقَالُوا الْـحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي هَدَانَا لِـهٰذَا وَمَا كُنَّا لِنَهْتَدِيَ لَوْلَا اَنْ هَدَانَا اللهُ ۖ لَقَدْ جَاءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْـحَقِّ ۖ وَنُوْدُوا اَن تِلْكُمُ الْـجَنَّةُ اُورِثْتُمُوهَا بِـمَا كُنتُمْ تَعْمَلُوْنَ ◌ نَادٰى اَصْحَابُ الْـجَنَّةِ اَصْحَابَ النَّارِ اَن قَدْ وَجَدْنَا مَا وَعَدَنَا رَبُّنَا حَقًّا فَهَلْ وَجَدتُّـم مَّا وَعَدَ رَبُّكُمْ حَقًّا ۖ قَالُوا نَعَمْ ۚ فَاَذَّنَ مُؤَذِّنٌ بَيْنَهُمْ اَن لَّعْنَةُ اللّٰـهِ عَلَى الظَّالِمِيْنَ ◌

উপরোক্ত আয়াত শরীফদ্বয় উনাদের মধ্যে জান্নাতী ও জাহান্নামীদের কিছু অবস্থা ও সংলাপ তুলে ধরা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ঘটবে। কিন্তু ঘটনার সুনিশ্চয়তা বোঝানোর জন্য ‘ছিগায়ে মাদ্বী’ ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য ভাষায় এই ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যবহারের প্রচলন নেই বলেই সকল নির্ভরযোগ্য তরজমায় ভবিষ্যতের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে।

এছাড়াও পবিত্র সূরা নামল শরীফ উনার ৮৭ নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যেও একই পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

وَيَوْمَ يُنفَخُ فِي الصُّورِ فَفَزِعَ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَمَن فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَن شَاءَ اللهُ ۚ وَكُلٌّ أَتَوْهُ دَاخِرِينَ ◌

২. আরবী ভাষায় অনেক সময় মর্যাদাগত দূরত্ব ও সুউচ্চতার প্রতি ইঙ্গিত করার উদ্দেশ্যে নিকটবর্তী জিনিসের জন্য দূরবর্তী ‘ইসমুল ইশারাহ’ ذلك، أولئك ব্যবহার হয়ে থাকে। এই প্রকাশরীতি অন্য ভাষায় অপ্রচলিত। তাই এই দূরবর্তী ‘ইসমুল ইশারাহ’-র তরজমা নিকট-নির্দেশক সর্বনাম দ্বারাই করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ২য় ও ৫ম আয়াত শরীফ উল্লেখ করা যেতে পারে - 

ذٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ

اُولٰئِكَ عَلٰى هُدًى مِّن رَّبِّـهِمْ ۖ وَاُولٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ◌

সুতরাং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার শান মুবারকে বর্র্ণিত প্রত্যেকটি বহুবচনের সর্বনাম হচ্ছে উনার শান-মান মুবারক, ইজ্জত-জালালিয়ত মুবারক উনাদের বহিঃপ্রকাশ। এই বহুবচনের সর্বনাম কখনোই সংখ্যাবাচক বহুবচন নয় বরং সম্মানার্থক বা গুণবাচক বহুবচন।