মহাসম্মানিত সুন্নতী খাদ্যসমূহ- খেজুর চিপা রস ও কিশমিশের রস মিশ্রিত শরবত , শসা ও তরমুজ

 মহাসম্মানিত সুন্নতী খাদ্যসমূহ- খেজুর চিপা রস ও কিশমিশের রস মিশ্রিত শরবত , শসা ও তরমুজ

৩৪. খেজুর চিপা রস ও কিশমিশের রস মিশ্রিত শরবত

এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ صَفِيَّةَ بِنْتِ عَطِيَّةَ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهَا قَالَتْ دَخَلْتُ مَعَ نِسْوَةٍ مِنْ عَبْدِ الْقَيْسِ عَلٰى حَضْرَتْ اُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ الثَالِثَةِ الصِّدِّيْـقَةِ عَلَيْهَا السَّلَامُ فَسَأَلْنَاهَا عَنِ التَّمْرِ وَالزَّبِيْبِ فَـقَالَتْ كُنْتُ اٰخُذُ قَـبْضَةً مِنْ تَـمْرٍ وَقَـبْضَةً مِنْ زَبِيْبٍ فَاُلْقِيْهِ فِي اِنَاءٍ فَأَمْرُسُهُ ثُـمَّ اَسْقِيْهِ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‏‏.‏

অর্থ: “হযরত সাফিয়্যাহ বিনতু ‘আত্বিয়্যাহ রহমতুল্লাহি আলাইহা উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা ‘আবদুল ক্বায়িস গোত্রের মহিলাদের সঙ্গে আমি উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছা হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার মুবারক খিদমতে উপস্থিত হলাম। উনাকে খেজুর ও কিশমিশ মিশ্রিত শরবত সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি এক মুষ্টি খেজুর ও এক মুষ্টি কিশমিশ একটি পাত্রে ঢালতাম। তা আঙ্গুল দিয়ে চেপে রস বের করতাম, অতঃপর তা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পান করাতাম।” (আবূ দাঊদ শরীফ: কিতাবুশ শারাবাহ: হাদীছ শরীফ নং ৩৭০৮)

৩৫. শসা (قِثَّاءٌ) কিছ্ছা

শসার সাথে খেজুর একসাথে খাওয়াকে কিছ্ছা বলে। এটি গরম ও ঠান্ডার একটি সুষম মিশ্রণ। এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ عَبْدِ اللهِ بْنِ جَعْفَرٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ اَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَأْكُلُ الْقِثَّاءَ بِالرُّطَبِ

অর্থ: “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত, নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শসার সঙ্গে ‘রুত্বাব’ (পাঁকা খেজুর) খেতেন।” (আবূ দাঊদ শরীফ: কিতাবুত ত্বয়ামাহ: হাদীছ শরীফ নং ৩৮৩৫)

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে কিছ্ছার উপকারিতা সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ الثَّالِثَةِ الصِّدِّيْـقَةِ عَلَيْهَا السَّلَامُ قَالَتْ اَرَادَتْ اُمِّي اَنْ تُسَمِّنِّي لِدُخُوْلِيْ عَلٰى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمْ اَقْبَلْ عَلَيْهَا بِشَىْءٍ مِـمَّا تُرِيْدُ حَتّٰى اَطْعَمَتْنِي الْقِثَّاءَ بِالرُّطَبِ فَسَمِنْتُ عَلَيْهِ كَأَحْسَنِ السِّمَنِ‏

অর্থ: “উম্মুল মু’মিনীন আছ ছালিছা হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার সম্মানিতা আম্মাজান আলাইহাস সালাম উনার মুবারক ইচ্ছা ছিল আমাকে স্বাস্থ্যবতী বানিয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুবারক হুজরা শরীফ পাঠাবেন। এজন্য তিনি অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, কিন্তু কোন ফল হয়নি। শেষে তিনি আমাকে কিছ্ছার সাখে রুত্বাব (পাকা খেজুরের সাথে শসা) খাওয়াতে থাকলে আমি তাতে উত্তমরূপে স্বাস্থ্যের অধিকারী হই।” সুবহানাল্লাহ! (আবূ দাঊদ শরীফ: কিতাবুত ত্বিব: হাদীছ শরীফ নং ৩৯০৩)

শব্দগত কিছু পার্থক্যসহ অত্র হাদীছ শরীফখানা ইবনে মাজাহ শরীফ (কিতাবুত ত্বয়ামাহ্: হাদীছ শরীফ নং ৩৩২৪) উনার মধ্যেও বর্ণিত রয়েছে।

অর্থাৎ কিছ্ছা স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়ক।

প্রস্তুত প্রণালী: শসাকে টুকরা করে কেটে একটি প্লেটে রাখুন, প্রতি টুকরা শসার সাথে ১টি অথবা আংশিক খেজুরসহ খাওয়া যায়। আবার শসাকে সালাদের মত কুচি কুচি করে কেটে তার সাথে খেজুরের কুচি একত্র করেও খাওয়া যায়।

৩৫(১) শসা: قِثَّاءٌ বলতে শুধু শশাকেও বুঝায়। আরবী خِيار ব্দ দিয়েও শসা বুঝায়।

উপকারিতা:

১. ফাইবার ও ফ্লুইডসমৃদ্ধ শসা শরীরে ফাইবার এবং পানির পরিমাণ বাড়ায়। পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ফাইবার থাকার কারণে শসা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে থাকে।

২.  শসায় ও শসার খোসায় রয়েছে স্টেরল নামের এক ধরনের উপাদান, যা কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

৩. দেহের মেদ নিয়ন্ত্রণে শসা খুব উপকারী।

৪. কিডনি, ইউরিনারি, ব্লাডার, লিভার ও প্যানক্রিয়াসের সমস্যায় শসা বেশ সাহায্য করে থাকে।

৫. এরেপসিন নামক অ্যানজাইম থাকার কারণে শসা হজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা সমাধান করে থাকে।

৬. শসা বা শসার রস ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও বেশ উপকারী।

৭. শসার রস আলসার, গ্যাস্ট্রাইটিস, অ্যাসিডিটির ক্ষেত্রেও উপকারী।

৮. মিনারেলসমৃদ্ধ শসা নখ ভালো রাখতে, দাঁত ও মাড়ির সমস্যায় সাহায্য করে।

৯. ডাক্তারের পরামর্শনুযায়ী শসার রস খেলে আর্থ্রাইটিস, একজিমা, হার্ট ও ফুসফুসের সমস্যায় উপকার হতে পারে।

১০. গাজরের রসের সাথে শসার রস মিশিয়ে খেতে ইউরিক অ্যাসিড থেকে উদগত ব্যাথার সমস্যায় কাজ করে।

৩৬. তরমুজ (بِطِّيْخٌ) বিত্তীখ্ব

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ الثَّالِثَةِ الصِّدِّيْـقَةِ عَلَيْهَا السَّلَامُ قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَأْكُلُ الْبِطِّيْخَ بِالرُّطَبِ فَـيَـقُوْلُ ‏نَكْسِرُ حَرَّ هٰذَا بِبَـرْدِ هٰذَا وَبَـرْدَ هٰذَا بِـحَرِّ هٰذَا‏‏.

অর্থ: “উম্মুল মু’মিনীন হযরত ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাজা খেজুর দিয়ে তরমুজ খেতেন। তিনি বলতেন, এর ঠান্ডা ওটার গরম কমাবে, এবং এর গরম ওটির ঠান্ডা কমিয়ে দিবে।” (আবূ দাঊদ শরীফ: কিতাবুত ত্বয়াম: হাদীছ শরীফ নং ৩৮৩৬)

তরমুজের অসাধারণ গুণাগুণ সম্পর্কে একটি পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত হয়েছে- “তোমাদের মধ্যে এমন কোন মহিলা নেই যে গর্ভধারণ করা অবস্থায় তরমুজ খেয়েছে অথচ সন্তান প্রসবে ব্যর্থ হয়েছে, এটি নবজাতকের মুখ-অবয়ব ও চরিত্রের জন্য উত্তম।”

তরমুজের রাসায়নিক উপাদান:

তরমুজে প্রায় ৯২% পানি আছে। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা তরমুজে রয়েছে ৯২ থেকে ৯৫ গ্রাম পানি, আঁশ ০.২ গ্রাম, আমিষ ০.৫ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, ক্যালোরি ১৫ থেকে ১৬ মি.গ্রাম। এছাড়াও তরমুজে ক্যালসিয়াম রয়েছে ১০ মি.গ্রাম, আয়রন ৭.৯ মি.গ্রাম, কার্বহাইড্রেট ৩.৫ গ্রাম, খনিজ পদার্থ ০.২ গ্রাম, ফসফরাস ১২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন ০.২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ও ভিটামিন বি। তরমুজের বিশেষ কয়েক ধরনের অ্যামাইনো এসিডও পাওয়া যায়।

তরমুজের উপকারিতা:

১. পানি শূণ্যতা নিবারণ করে: তরমুজে যেহেতু প্রায় ৯২% পানি। তাই নিদারুণ গরমের মধ্যে তরমুজ খেলে সহজেই পানির তৃষ্ণা মিটানো যায়, ফলে পানি শূণ্যতা নিবারণ করা যায়।

২. মূত্রবর্ধক এবং কিডনি ও লিভার সুস্থ রাখে: তরমুজে রয়েছে প্রচুর জলীয় উপাদান যা প্রস্রাবের জ্বালা কমায়। এছাড়াও তরমুজ প্রস্রাবের প্রবাহ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, যা একটি প্রাকৃতিক মূত্রবর্ধক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তরমুজে রয়েছে এমন এন্টিবডি যা কিডনি ও লিভার সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর। তরমুজের Citrulline একটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা কিডনির জন্য অত্যন্ত উপকারী।

কিডনিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকিও কমায়। ডাবের পানির যে গুণাগুণ, তরমুজেও রয়েছে সেই গুণাগুণ। এটি কিডনি ও মুত্রথলিকে বর্জ্যমুক্ত করে।

৩. চোখ সুস্থ রাখে: তরমুজের লাল রঙ বিটা ক্যারোটিনের একটি চমৎকার উৎস যা চোখের রেটিনা সুরক্ষায় অত্যন্ত উপকারী। আর তাই নিয়মিত তরমুজ খেলে চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায় এবং চোখের ছানি পড়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিটা ক্যারোটিন রাতকানা প্রতিরোধেও কার্যকরী ভূমিকা রাখে।

৪. ত্বকের উপকার করে: তরমুজের সমৃদ্ধ ভিটামিন এ দেহের ত্বককে ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে। নিয়মিত তরমুজ খেলে ত্বকের হারিয়ে যাওয়া লাবণ্য ফিরে আসে। ত্বক উজ্জ্বল হয় ও সুস্থ থাকে। ত্বকের মেচতা দূর করতে সহায়ক। লাইকোপিনসহ বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ তরমুজ খাওয়ার অভ্যাসে বার্ধক্য দেরিতে আসে। ত্বকে সহজে ভাঁজ বা বলিরেখা পড়ে না।

৫. হৃদযন্ত্রে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে: তরমুজ ভাসডিলেশন (vasodilation)-এর মাধ্যমে রক্ত প্রবাহ উন্নত করে ও কার্ডিওভাসকুলার-এর সাথে সম্পর্কিত ফাংশনসমূহ উন্নত করে ফলে  হৃদযন্ত্রে সঠিকভাবে রক্তপ্রবাহ হতে সাহায্য করে। এতে হৃদযন্ত্রে ব্লক হওয়ার প্রবণতা অনেকটা হ্রাস পায়। তরমুজে আরও আছে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম যা রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও তরমুজের বিচিতে রয়েছে আর্গিনাইন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড। যার কাজ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ। করোনারি হার্ট ডিজিজের চিকিত্‍‌সার ক্ষেত্রেও এটা একটা জরুরী উপাদান। 

৬. ওজন কমাতে সহায়তা করে: তরমুজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এমাইনো এসিড যা শরীরের কোলেস্টরেল ও চর্বি কমাতে অত্যন্ত সহায়ক। এছাড়া তরমুজে রয়েছে এন্টি অক্সিডেন্ট যা শরীরের জমে থাকা কোলেস্টরেল কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও তরমুজে আছে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং খুব অল্প পরিমাণে ক্যালরি। আর তাই পেট ভরে তরমুজ খেলেও সেই অনুযায়ী ওজন বাড়ে না।

৭. হাড় মজবুত করে: তরমুজ লাইকোপিনো নামক লাল উপাদান যাতে রয়েছে প্রচুর ক্যালসিয়াম। তাই তরমুজ হাড় গঠন ও মজবুত করতে অত্যন্ত সহায়ক। তরমুজ পটাসিয়াম সমৃদ্ধ ফল তাই হাড়ের ক্যালসিয়াম ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং হাড়ের জোড়া/সন্ধি মজবুত করে।

৮. ব্যাথা/প্রদাহ নিরাময় করে: তরমুজ ফ্ল্যাভোনয়েড (flavonoids), ক্যারটিনয়েড (carotenoids), ট্রিটেপেনইডিস (triterpenoids) এবং ফেনোলিক (phenolic)এর মতো যৌগের সমৃদ্ধ ফল। ফলে শরীরের যে কোনো প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। তরমুজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিনি সি যা ত্বক, দাঁত এবং গোশতপেশীর সুরক্ষায় প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করে

৯. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে: তরমুজে লাইকোপেন নামের এক ধরনের খাদ্য উপাদান রয়েছে, যা অন্ত্রের ক্যান্সার ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও নিয়মিত তরমুজ খেলে ফুসফুসের ক্যান্সার ও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়।

১০. প্রজনন শক্তি বৃদ্ধি করে: টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা যৌনশক্তির দিক থেকে দুর্বল তাদের জন্য তরমুজ প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। একটি তরমুজে প্রচুর পরিমাণে সিট্রোলিন নামের অ্যামাইনো এসিড থাকে যা ভায়াগ্রার বিকল্প হিসেবে কাজ করে।



0 Comments: