মহাসম্মানিত সুন্নতী খাদ্যসমূহ- কালোজিরা,দুধ ও মাঠা


 
মহাসম্মানিত সুন্নতী খাদ্যসমূহ- কালোজিরা,দুধ ও মাঠা

২২. কালোজিরা (الْـحَبَّةُ السَّوْدَاء) হাব্বাতুস সাওদা

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে কালোজিরার অনেক উপকারিতা বর্ণিত রয়েছে।

عَنْ حَضْرَتْ اَبِـيْ هُرَيْـرَةَ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ اَنَّ رَسُوْلَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا مِنْ دَاءٍ اِلَّا فِي الْـحَبَّةِ السَّوْدَاءِ مِنْهُ شِفَاءٌ اِلَّا السَّامَ‏

অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রাহ্‌ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, মৃত্যু ছাড়া এমন কোন রোগ নেই কালোজিরায় যার আরোগ্যতা নেই।” (মুসলিম শরীফ: কিতাবুস সালাম: হাদীছ শরীফ নং ৫৬৬১)

অন্য বর্ণনায় বর্ণিত রয়েছে- “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, যখন রোগ-যন্ত্রণা খুব বেশী কষ্টদায়ক হয় তখন এক চিমটি পরিমাণ কালোজিরা নিয়ে খাবে তারপর পানি ও মধু সেবন করবে।” (মু’জামুল আওসাত লিত ত্ববারানী)

অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে- “হযরত কাতাদাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত আছে, প্রতিদিন ২১টি কালোজিরার ১টি পুটলি তৈরী করে পানিতে ভিজাবে এবং পুটলির পানির ফোঁটা এ নিয়মে নাসারন্দ্রে (নাসিকা, নাক) ব্যবহার করবে- প্রথমবার ডান নাকের ছিদ্রে ২ ফোঁটা এবং বাম নাকের ছিদ্রে ১ ফোঁটা। দ্বিতীয়বার বাম নাকের ছিদ্রে ২ ফোঁটা এবং ডান নাকের ছিদ্রে ১ ফোঁটা। তৃতীয়বার ডান নাকের ছিদ্রে ২ ফোঁটা ও বাম নাকের ছিদ্রে ১ ফোঁটা।”

কালোজিরার গুণাগুণ:

হজমের সমস্যায় এক-দুই চা-চামচ কালোজিরা বেটে পানির সঙ্গে প্রতিদিন দু-তিনবার খেলে এক মাসের মধ্যে হজম শক্তি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি পেট ফাঁপাভাবও দূর হবে।

জ্বর, ব্যাথা, সর্দি-কাশিতে এক চা-চামচ কালোজিরার সঙ্গে তিন চা-চামচ মধু ও দুই চা-চামচ তুলসী পাতার রস মিশিয়ে প্রতিদিন একবার সেবন করুন। কালোজিরা বেটে কপালে প্রলেপ দিন যদি সর্দি বসে যায়। একই সঙ্গে পাতলা পরিষ্কার কাপড়ে কালোজিরা বেঁধে শুকতে থাকুন, শ্লেষ্মা তরল হয়ে ঝরে যাবে।

• মায়েদের বুকের দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে প্রতিদিন রাত্রে শোবার আগে ৫-১০ গ্রাম কালোজিরা মিহি করে গরুর দুধের সঙ্গে খেতে হবে। ইনশাআল্লাহ্ মাত্র ১০-১৫ দিনে দুধের প্রবাহ বেড়ে যাবে। এছাড়া কালোজিরা ভর্তা করে ভাতের সঙ্গে খেলেও এ সমস্যা সমাধান হতে পারে।

• নিয়মিত কালোজিরা খেলে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয়। ফলে স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি প্রাণশক্তি বাড়ায় ও ক্লান্তি দূর করে।

• কালোজিরা লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী আলফা টক্সিন নামক বিষ ধ্বংস করে। তাই যারা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য এটি মহৌষধ।

• ডায়বেটিকস্ রোগীরা এক চিমটি পরিমাণ কালো জিরা এক গ্লাস পানির সঙ্গে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে; একসময় ডায়বেটিকস্ কমে যাবে ইনশাআল্লাহ।

• কালোজিরা যৌন ব্যাধি ও স্নায়ুবিক দুর্বলতায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতি উৎকৃষ্ট ঔষধ।

• শুলবেদনা ও প্রসূতি রোগে কালোজিরা অত্যধিক উপকারী। ব্রণের জন্যও এটি উত্তম ঔষধ।

• মূত্রথলির পাথর ও জন্ডিস থেকে আরোগ্য লাভ করতে কালোজিরা খান নিয়মিত যতবার পারেন।

• অধিক ঋতুস্রাব, মাত্রাতিরিক্ত ছোট ইস্তিঞ্জা প্রতিরোধ করতে কালোজিরার উপকারিতা অপরিসীম। এটি কৃমিনাশক।

• কালোজিরা রিউমেটিক এবং পিঠে ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।

• নিয়মিত কালোজিরা সেবন শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সতেজ করে ও সার্বিকভাবে স্বস্থ্যের উন্নতি সাধন করে।

• ভাত, তরকারী ইত্যাদির সাথে কালোজিরা মিশিয়ে খান, রোগ-শোক থেকে দূরে থাকুন।

বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কালোজিরার আরো কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা:

কালোজিরাকে সব রোগের ওষুধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অন্যান্য সব ভেষজের মতো কালোজিরা নিয়েও গবেষণা কম হয়নি। ১৯৬০ সালে মিসরের গবেষকরা নিশ্চিত হন যে, কালো জিরায় বিদ্যমান নাইজেল-এর কারণে হাঁপানী উপশম হয়। জার্মানী গবেষকরা বলেছে, কালো জিরার অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-মাইকোটিক প্রভাব রয়েছে। এটি বোনম্যারো ও প্রতিরক্ষা কোষগুলোকে উত্তেজিত করে এবং ইন্টারফেরন তৈরী বাড়িয়ে দেয়।

আমেরিকার গবেষকরা কালোজিরার টিউমারবিরোধী প্রভাব সম্পর্কে মতামত দেয়। শরীরে ক্যান্সার উত্পাদনকারী ফ্রি-রেডিক্যাল অপসারিত করতে পারে কালোজিরা। মোটকথা, কালোজিরা সব ধরণের রোগের বিরুদ্ধে তুলনাহীন। কালোজিরা পিষে তেল বের করে নিলে কার্যকারীতা অনেকগুণে বৃদ্ধি পায়। আসুন জেনে নিই কালোজিরার এমন কিছু ব্যবহার, যেগুলো একেবারেই অপ্রচলিত।

১. স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে: কালোজিরা মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি করে স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রতিদিন নিয়ম করে আধা চা চামচ কাঁচা কালোজিরা অথবা ১ চা চামচ কালোজিরার তেল খাওয়া যায়।

২. ব্যাথা কমাতে: যেকোনো ধরণের ব্যাথা কমাতে কালোজিরার জুড়ি নেই। কালোজিরার তেল হালকা গরম করে নিয়ে ব্যাথার জায়গায় মালিশ করলে ব্যাথা সেরে যায়। বিশেষ করে বাতের ব্যাথায় বেশ ভালো উপকার পাওয়া যায়।

৩. ফোঁড়া সারাতে: ব্যাথাযুক্ত ফোঁড়া সারাতে কালোজিরা সাহায্য করে। তিলের তেলের সাথে কালোজিরা বাটা বা কালোজিরার তেল মিশিয়ে ফোঁড়াতে লাগালে ব্যাথা উপশম হয় ও ফোঁড়া সেরে যায়।

৪. মেদ কমাতে: চায়ের সাথে কালোজিরা মিশিয়ে পান করলে তা বাড়তি মেদ ঝরে যেতে সাহায্য করে। চুলার উপরে একটি পাত্রে পানি নিয়ে, পানি ফুটলে চা পাতা ও সমপরিমাণ কালোজিরা পানিতে দিতে হবে। চায়ের রং হয়ে এলে নামিয়ে ছেঁকে নিয়ে সাধারণ চায়ের মতোই পান করা যায়।

৫. দাঁতের ব্যাথায়: দাঁত ব্যাথা হলে, মাড়ী ফুলে গেলে বা রক্ত পড়লে কালোজিরা তা উপশমে সহায়ক। পানিতে কালোজিরা দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে, পানির তাপমাত্রা কমে স্বাভাবিক গরম অবস্থায় এলে তা দিয়ে কুলি করতে হয়। এতে দাঁত ব্যাথা কমে যায়, মাড়ীর ফোলা বা রক্ত পড়া বন্ধ হয়। এছাড়া জিহ্বা, তালু ও মুখের জীবাণু ধ্বংস হয়।

৬. মাথা ব্যাথায়: ঠাণ্ডাজনিত মাথাব্যাথা দূর করতে একটি সুতি কাপড়ের টুকরায় খানিকটা কালোজিরা নিয়ে পুঁটুলি তৈরী করে নাকের কাছে নিয়ে শ্বাস টানতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাথা সেরে যায়।

কালোজিরার তেল: কালোজিরা পিষে তেল বের করে নিলে কার্যকারীতা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায়। যেমন-

* কপালের দুই পাশে এবং কানের পাশে দিনে তিন-চারবার কালোজিরার তেল মালিশ করুন মাথাব্যাথা ভালো হয়ে যায়।

* চুল পড়া রোধে কালোজিরার তেল চুলের গোড়ায় নিয়মিতভাবে মালিশ করতে হয়। ২ টেবিল চামচ যয়তুন তেল ও ১ চা চামচ কালোজিরার তেল একসাথে মিশিয়ে হালকা গরম করে চুলের গোড়ায় ভালো করে লাগিয়ে ১০-১৫ মিনিট ম্যাসাজ করে, ১ ঘণ্টা পর চুল ধুয়ে ফেলতে হয়।

* উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কালোজিরার তেল ব্যবহার করা হয়। শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানী দূর করে। হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করে।

* পক্ষাঘাত (প্যারালাইসিস) ও কম্পন রোগে কালোজিরার তৈল মালিশ করলে আশ্চর্যজনক ফল পাওয়া যায়।

* জ্বর, ব্যাথা, সর্দি-কাশিতে তাড়াতাড়ি ভালো ফল পেতে বুকে ও পিঠে কালোজিরার তেল মালিশ করা যায়।

* সকালে খালি পেটে ১২/১৩ ফোঁটা কালোজিরার তেল ও ১৫/১৬ ফোঁটা মধু খেলে ডায়াবেটিসের উপকার হয়।

* ১০/১২ ফোঁটা কালোজিরার তেল গরম পানিতে মিশিয়ে খেলে বাত রোগের উপকার হয়।

২৩. দুধ (حَلِيْبٌ) হালীব

দুধ শব্দের আরবী حَلِيْبٌ ‘হালীব। তবে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে দুধ বুঝাতে لَبَنٌ লাবান শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে।

যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اِبْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ قَالَ دَخَلْتُ مَعَ رَسُوْلِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَا وَخَالِدُ بْنُ الْوَلِيْدِ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ عَلٰى اُمِّ الْمُؤْمِنِيْنَ الثَّالِثَةِ عَشَرَ حَضْرَتْ مَيْمُوْنَةَ عَلَيْهَا السَّلَامُ فَجَاءَتْـنَا بِاِنَاءٍ مِنْ لَبَنٍ فَشَرِبَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاَنَا عَلٰى يـَمِيْنِهٖ وَخَالِدٌ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ عَلٰى شِـمَالِهٖ فَـقَالَ لِي الشَّرْبَةُ لَكَ فَإِنْ شِئْتَ اٰثَـرْتَ بِـهَا خَالِدًا‏‏ فَـقُلْتُ مَا كُنْتُ اُوْثِرُ عَلٰى سُؤْرِكَ اَحَدًا‏ ثُـمَّ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ‏ مَنْ اَطْعَمَهُ اللهُ الطَّعَامَ فَـلْيَـقُلِ اللّٰهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْهِ وَاَطْعِمْنَا خَيْـرًا مِنْهُ‏ وَمَنْ سَقَاهُ اللهُ لَبَـنًا فَـلْيَـقُلِ اللّٰهُمَّ بَارِكْ لَـنَا فِيْهِ وَزِدْنَا مِنْهُ‏ وَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ شَيْءٌ يَـجْزِيْ مَكَانَ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ غَيْـرُ اللَّبَنِ‏.

অর্থ: “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে আমি এবং হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হযরত উম্মুল মুমিনীন আছ ছালিছাহ ‘আশার আলাইহাস সালাম উনার হুজরা শরীফ উনার মধ্যে তাশরীফ মুবারক নিলাম। হযরত উম্মুল মুমিনীন আছ ছালিছাহ ‘আশার আলাইহাস সালাম তিনি এক পাত্র দুধ আমাদের নিকট পাঠালেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি (তা হতে) পান করলেন। উনার ডান পাশে আমি ছিলাম এবং উনার বাম পাশে ছিলেন হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাকে বললেন, এখন আপনার পান করার পালা। তবে আপনি চাইলে আপনার উপর হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে অগ্রাধিকার দিতে পারেন। আমি বললাম, আপনার মুবারক ঝুটাতে আমি উনার উপর অন্য কাউকে অগ্রাধিকার দিবো না। তারপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি যাকে আহার করান তিনি যেন বলেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফীহি ওয়া আত্ব‘য়িমনা খ্বইরাম মিনহু’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ পাক! আমাদেরকে এ খাদ্যে বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে এর চাইতে উত্তম খাবার আহার করান)। আর মহান আল্লাহ পাক তিনি যাকে দুধ পান করান তিনি যেন বলেন, আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফীহি ওয়া যিদনা মিনহু’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ পাক! আমাদেরকে এ দুধে বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে এর চাইতেও বেশি দান করুন)। এরপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, একই সঙ্গে পান ও আহারের জন্য যথেষ্ট হওয়ার মত দুধের বিকল্প কোন খাবার নেই।” (তিরমিযী শরীফ: কিতাবুদ দাওয়াত: হাদীছ শরীফ নং ২৪৫৫, ইবনে মাজাহ শরীফ: হাদীছ শরীফ নং ৩৩২২)

২৩(১) গরুর দুধ খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান: এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ اَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَـمْ يَضَعْ دَاءً اِلَّا وَضَعَ لَهٗ شِفَاءً فَـعَلَيْكُمْ بِأَلْبَانِ الْبَـقَرِ فَاِنَّـهَا تَـرُمُّ مِنْ كُلِّ الشَّجَرِ

অর্থ: “হযরত ত্বরিক্ব ইবনে শিহাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি এমন কোন অসুস্থতা রাখেননি যার কোন প্রতিকার বা চিকিৎসাও রাখেননি। তাই আপনাদের জন্য রয়েছে গরুর দুধ (আপনাদের গরুর দুধ পান করা উচিত), কারণ তারা সব ধরণের তৃণলতা খেয়ে পুষ্টি লাভ করে থাকে।” (মুসনাদে আহমাদ শরীফ ৪র্থ খণ্ড ৩১৫ পৃষ্ঠা : হাদীছ শরীফ নং ১৮৮৫১, মিশরের ছাপা)

২৩(২) ছাগলের দুধ: এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-

عَنْ حَضْرَتْ اَنَسٍ رَضِىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ يَـقُوْلُ اٰتَانَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ دَارِنَا هٰذِه فَاسْتَسْقٰى فَحَلَبْنَا لَهٗ شَاةً لَنَا ثُـمَّ شُبْتُهٗ مِنْ مَاءِ بِئْرِنَا هٰذِه فَأَعْطَيْـتُهٗ وَحَضْرَتْ اَبُـوْ بَكْرٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ عَنْ يَسَارِهٖ وَحَضْرَتْ عُمَرُ عَلَيْهِ السَّلَامُ تُـجَاهَهٗ وَاَعْرَابِيٌّ عَنْ يَـمِيْنِه فَـلَمَّا فَـرَغَ قَالَ حَضْرَتْ عُمَرُ عَلَيْهِ السَّلَامُ هٰذَا حَضْرَتْ اَبُـوْ بَكْرٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ.‏ فَأَعْطٰى الأَعْرَابِيَّ ثُـمَّ قَالَ‏ الأَيْـمَنُـوْنَ الأَيْـمَنُـوْنَ اَلَا فَـيَمِّنُوْا‏.‏ قَالَ حَضْرَتْ اَنَسٌ رَضْىَ اللهُ تَـعَالٰى عَنْهُ فَهِىَ سُنَّةٌ فَهِىَ سُنَّةٌ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ‏.‏

অর্থ: “হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদের এই ঘরে আগমন করেন এবং কিছু পান করতে চাইলেন। আমরা উনার জন্য আমাদের একটা বকরীর দুধ দহন করে তাতে আমাদের এই কুয়ার পানি মিশালাম। অতঃপর তা মুবারক খিদমতে পেশ করলাম। এ সময় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বাম পাশে ছিলেন হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি, হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি ছিলেন সম্মুখে, আর এক বেদুঈন ছিলেন ডান পাশে। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন পান শেষ করলেন, তখন হযরত ফারূক্বে আ’যম আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, ইনি হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি, কিন্তু নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার অবশিষ্ট পান দান করলেন বেদুঈনকে। অতঃপর তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, ডান দিকের ব্যক্তিরাই/ব্যক্তিগণ (অগ্রাধিকার প্রাপ্ত), ডান দিকের ব্যক্তিরাই/ব্যক্তিগণ (অগ্রাধিকার প্রাপ্ত) শোন! ডান দিক থেকেই শুরু করবে। হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, এটাই সুন্নত, এটাই সুন্নত, এটাই সুন্নত।” (বুখারী শরীফ: কিতাবুল হিবাহ ওয়া ফাদ্বলুহা ওয়া তাহরীদ্বা আলাইহ্: হাদীছ শরীফ নং ২৫৭১)

হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার হিজরতের সময় একজন মেষ পালক রাখালের কাছ থেকে ছাগলের দুধ সংগ্রহ করে পরিবেশন মুবারক করেছিলেন। এছাড়াও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উটের দুধ পানের ব্যাপারে তা’কীদ রয়েছে।

উপকারিতা: নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন- “দুধ হৃদপিণ্ডের উত্তপ্ততা দূর করে, যেভাবে তোমরা ভ্রু থেকে ঘাম মুছে ফেল। এটি মস্তিস্কে নতুন শক্তি যোগায় এবং স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি ঘটায়।”

এছাড়াও দুধের আরো কিছু উপকারিতা নিচে দেয়া হলো-

১. দুধের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি শোষিত হয়ে দাঁত ও হাড়ের গঠন মজবুত করে।

২. প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ পানে অন্যান্য খাবারের চাহিদা অনেকাংশে মিটে যায়।

৩. দুধে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল কর্মদক্ষতা বাড়ায় ও মানসিক চাপ দূর করতে সহায়তা করে।

৪. ডিহাইড্রেশনের সমস্যায় ভুগলে দুধ শরীর রি-হাইড্রেট করতে সাহায্য করে।

৫. দুধ পাকস্থলী ঠাণ্ডা রাখে এবং বুক জ্বালাপোড়ার সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা দূর করে।

৬. দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন যা গোশত পেশীর গঠনে সহায়তা করে ও গোশত পেশীর আড়ষ্টতা দূর করে।

৭. দুধে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল রয়েছে, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

৮. প্রতিদিন দুধ পানে ত্বক নরম, কোমল ও মসৃণ হয়।

৯. দুধ কোলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখে ও রক্ত পরিষ্কারের পাশাপাশি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।

১০. নিয়মিত দুধ পান ওজন কমাতে সহায়তা করে।

গরু, ছাগল ও ভেড়ার দুধের তুলনামূলক আলোচনা

১. প্রোটিন/আমিষের পরিমাণ: ছাগলের দুধ > ভেড়ার দুধ > গরুর দুধ

২. ফ্যাট/চর্বির পরিমাণ: ভেড়ার দুধ > গরুর দুধ > ছাগলের দুধ

৩. ক্যালসিয়ামের পরিমাণ: ছাগলের দুধ > ভেড়ার দুধ > গরুর দুধ

২৪. মাঠা (لَبَنٌ) লাবান

পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে জান্নাতে দুধের নহরের বর্ণনায় ‘লাবান’ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে-

مَثَلُ الْـجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّـقُوْنَ ۖ فِيْـهَا أَنْـهَارٌ مِّنْ مَّاءٍ غَيْرِ اٰسِنٍ وَأَنْـهَارٌ مِّنْ لَّبَنٍ لَّـمْ يَـتَـغَيَّـرْ

অর্থ: “পরহেযগারদেরকে যে জান্নাতের ওয়াদা দেয়া হয়েছে, তার অবস্থা নিম্নরূপঃ তাতে আছে পানির নহর, নির্মল দুধের নহর যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়।” (পবিত্র সূরা মুহম্মদ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ নং ১৫)

 

পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

وَاِنَّ لَكُمْ فِي الْاَنْـعَامِ لَعِبْـرَةً نُسْقِيْكُمْ مِّـمَّا فِيْ بُطُوْنِه مِنْ بَۢيْنِ فَـرْثٍ وَّدَمٍ لَّبَـنًا خَالِصًا سَائِغًا لِّلشَّارِبِيْنَ

অর্থ : “নিশ্চয়ই চতুস্পদ জন্তুর মধ্যেও তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আমি তোমাদেরকে পান করাই এদের শরীর থেকে তাদের পাচিত খাদ্যবস্তু ও রক্তের মধ্যবর্তী বস্তু থেকে নিঃসৃত দুধ যা পানকারীদের জন্য উপাদেয়।” (পবিত্র সূরা নাহল শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৬)

লাবান হচ্ছে দুধ থেকে তৈরী একটি পানীয়। লাবান দ্বারা দুধ ও দুগ্ধজাত পানীয় উভয়টিই বুঝায়। দুধের আলোচনা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে। তাই দুগ্ধজাত পানীয় বিষয়ে আলোচনা করা হলো। এটি উষ্ণ আবহাওয়ায় শরীরের প্রয়োজনীয় লবণ ও পানির ঘাটতি পূরণ করে। ঠান্ডা আবহাওয়াতে এর কার্যক্রম আরো বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়। একে আরবীতে “লাবান” বলা হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে নামকরণ করা হয়। যেমন- বাংলাদেশে “মাঠা”, ভারতবর্ষে “লাচ্ছি”, ইরানে “ডূঘ” এবং তুরস্কে “আইরান” নামেও অভিহিত করা হয়।

প্রস্তুত প্রণালী: ঐতিহ্যগতভাবে “লাবান” দুধ থেকে তৈরী করা হয়। তবে দুধকে ২৪ ঘন্টা রেখে তার খামীর তৈরী করা হয়। তারপর সেখান থেকে মাখন তুলে ফেলা হয়। বাকী দুধ (মাঠা) টুকু স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বেশ কয়েকদিন রাখা হয়। বর্তমান সময়ে এটি বানিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। দুটি মূল উপাদান “লাবান” হিসেবে পরিচিত। পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতে এটি দই হিসেবে আর পশ্চিম দিকে বিশেষ করে আরব এবং উত্তর আফ্রিকায় মাঠা হিসেবে পরিচিত।

উপকারিতা:

১. গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদানে ভরপুর

২. অনেক প্রোটিন রয়েছে

৩. পরিপাক তন্ত্রের জন্য উপকারী

৪. রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

৫. হাড়ের ক্ষয়রোগ (Osteoporosis) প্রতিরোধ করে

৬. হার্টের (হৃৎপিন্ডের) জন্য উপকারী

৭. ওজন ঠিক রাখে।

৮. গরমকালে লবণ ও পানির ঘাটতি পূরণ করে।



0 Comments: