বাদশা আকবর প্রবর্তিত কুফরী "দ্বীনে এলাহী" উৎপত্তির প্রসংঙ্গিক কথা এবং একজন মুজাদ্দিদের আগমনের প্রেক্ষাপটে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উনার আগমন এবং সুমহান তাজদীদ-
মুঘল সম্রাট বাদশা আকবরের কথা আমরা সকলেই জানি। মুঘলদের মধ্যে সুদীর্ঘ সময় রাজত্ব করেছে এই আকবর। ধর্মীয় আবহে বেড়ে ওঠার পরও কিছু ক্ষমতালোভী, ধর্মব্যবসায়ী, সার্থপর আলেমদের সংসর্গে আকবর চুড়ান্ত ভাবে অধপতেন চরমসীমায় নিমজ্জিত হয়।
আকবরের পিতা মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর সময় আকবরের বয়স ছিলো মাত্র তের বছর। হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তার বিশ্বস্ত সহযোগী বৈরাম খান ১৫৫৬ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি তের বছরের আকবরকে মুঘল সম্রাট বলে ঘোষণা করে। নামে সম্রাট থাকলেও দেশ পরিচালনা ও অন্যান্য কাজ বৈরাম খানই করতো। ১৫৬০ সালে আকবরের বয়স আঠারো হলে, সে বৈরাম খানকে হজ্জ করতে পাঠিয়ে দিয়ে ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেয়।
প্রথমিক জীবনে আকবরের ধর্মীয় বিশ্বাস :
(১) উলামা ও শাইখদের মহত সংস্পর্শে উদ্ভুদ্ধ হয়ে আকবর দৈনিক পাঁচবার যথারীতি সালাত আদায় করতো এবং শরীয়তের অন্যান্য হুকুম আহকাম মেনে চলতো। আকবর নিজেই আজান দিতো এবং মাঝে মাঝে নামাজের ইমামতি করতো। এছাড়াও ছাওয়াবের আশায় কখনো কখনো সে মসজিদ ঝাড়ু দিতো। (ماثر الامراء جلد ٣،ص ٢٥٢)
(২) প্রথম জীবনে আকবর রীতিমত পাঁচ ওয়াক্ত জামায়াতে নামাজ পড়তো এবং এজন্য সে সপ্তাহের সাত দিন সাতজন ইমাম নিয়োগ করতো।" ( মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ দ্বিতীয় খন্ড ১৮১ পৃষ্ঠা)
(৩) প্রতি বছর হজ্জের মৌসুমে আকবর একজনকে আমীরে হজ্জ নিযুক্ত করতো এবং বলতো যে কেউই তার সাথে গমন করবে সমুদয় খরচ আকবরই বহন করবে। এছাড়াও প্রতিবছর সে ক্বাবা শরীফ এবং এর প্রতিবেশীদের জন্য মূল্যবান উপহার প্রেরন করতো। হাজীদের বিদায় মুহূর্তে সে এহরামের কাপড় পরে মাথা মুন্ডন করে তাকবীর পাঠ করতে করতে হাজীদের সাথে খালি মাথায় নগ্নপদে বহুদূর পর্যন্ত গমন করতো। (ঐ)
(৪) প্রথম জীবনে আকবর হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি যে গভীর শ্রদ্ধাবোধ জ্ঞাপন করতো তা একটা ঘটনা শুনলে জানা যায়, শাহ আবু তুরাব নামক একজন হজ্জ সম্পন্ন করে ফিরলে সে একটি পাথর খন্ড নিয়ে আসে। সেই পাথর খন্ডে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কদম মুবারকের চিহৃ ছিলো। এই সংবাদ শুনে আকবর তার সংবর্ধনা প্রদান করতে দীর্ঘ আট মাইল পথ অতিক্রম করে এবং আমীর উমারা ও আলেমদের সাথে করে নিয়ে যায়।" ( মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ ২য় খন্ড ২৩৯ পৃষ্ঠা)
(৫) ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য আকবর খুবই আগ্রহী ছিলো। প্রতি রাতে শয়নের প্রককালে ধর্মীয় গ্রন্থাদীর কিছু অংশ শ্রবন করতো।" ( ঐ)
আকবরকে একবার পবিত্র আয়তাল কুরসীর তাফসীর উপহার দিলে সে খুবই সম্মানের সাথে তা গ্রহন করে এবং সসম্মানে রাজ গ্রন্থাগারে রেখে দেয়।
এই হলো আকবরের প্রথমিক জীবনে ধর্মভীরুতার কিছু নমুনা। প্রথমিক জীবনে যথেষ্ট ধার্মীক থাকলেও পরবর্তীতে সে বিভিন্ন মহলের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে ইসলাম বিদ্বেষী এমন সব কাজ এবং আইন করে যে গুলা ভাবলেও একজন মুসলমানের শরীর শিউরিয়ে ওঠে। তাকে পথভ্রষ্ট হতে সাহায্য করে সে যামানার কিছু দরবারী আলেম, এবং বাতিল বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা।
তার শাষনামলে তারই দরবারী আলেম আবদ উন নবী মুসলমানদের জন্য ফরজ ইবাদত জাকাত না দেয়ার একটি বুদ্ধি আবিষ্কার করে। নাউযুবিল্লাহ । যেহেতু জাকাতের জন্য মালের একবছর পূর্ন হওয়া শর্ত তাই সে এক বছর হওয়ার পুর্বেই সকল সম্পদ স্ত্রীর নিকট অর্পন করতো এবং বছর শেষ হলে আবার গ্রহণ করতো। এর মাধ্যমে সে জাকাত না দেয়ার রাস্তা আবিস্কার করে।
মোল্লা শীরি নামক জনৈক দরবারী আলেম আকবরকে সূর্য পুজায় উৎসাহিত করে সূর্যের প্রশস্তি সূচক এক হাজার লাইনের একটি কবিতা লিখে উপহার দেয়।
আকবরের উপর ভন্ড ফকিরদের প্রভাব বিস্তার:
আমানউল্লাহ নামক এমন এক ভন্ড বললো, যুগের সুলতানই পরিপূর্ণ মানুষ, তাই যুগের সুলতানের সম্মুখে সিজদা করা বৈধ। এজন্য সে যখনই আকবরকে দেখতো তখনই সিজদা দিতো। (ঐ)
তারা বলতো সকল সৃষ্টিতে আল্লাহ বিরাজমান সূতরাং তারকার পূজা করাও আল্লাহর ইবাদত।" নাউযুবিল্লাহ । (the influence of Islam on Indian culture. p.57)
আকবরের উপর হিন্দুদের প্রভাব :
আকবরের উপর সবচাইতে ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করে হিন্দুরা। যৌবনে রানী যোধবাই ও অন্যান্য হিন্দু রাজপুত মহিলাদের পনি গ্রহণ করে যার ফলে হিন্দুদের সাথে অবাধ মেলামেশা করে হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরে। এবং হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ ফারসীতে অনুবাদ করার নির্দেশ দেয়।" এরফলে মুসলমানদের মধ্যেও হিন্দু মনোভাবাপন্ন একটি দল সৃষ্টি হয়।
আকবর এ সময় গরু কে শক্তির উৎস মনে করতো। সে গরু কুরবানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং গরুর গোশত খাওয়ার উপরও বিধি নিষেধ আরোপ করে। কেননা হিন্দুরা গরু পুজা করতো এবং গোমুত্র পবিত্র মনে করতো।" ( মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ দ্বিতীয় খন্ড ৩২৬ পৃষ্ঠা)
আকবরের প্রতি জৈন দের প্রভাব :
ষোড়শ শতাব্দীতে আগ্রায় জৈনদের একটি বড় কেন্দ্র ছিলো। আকবর সর্বপ্রথম সেখানে তাদের সহচর্যে আসে। হিরনা বিজয়া শুরী ও জয়চন্দ্র শূরী নামক দুইজন জৈনের সহচর্যের প্রভাবে আকবরের নতুন ধর্মচিন্তা বিশেষভাবে প্রভান্বিত হয়। প্রকৃতপক্ষে আকবরের গোশত খাওয়া পরিত্যাগ করা এবং কোন প্রানী হত্যা করার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ মূলত জৈনদের প্রভাবেই হয়েছিলো। ( a short history of Muslim rule in India. p.292)
পারসিকদের প্রভাব :
পারসিক ধর্মগুরুরাও আকবরের ইবাদত খানায় আগমন করতো। তাদের মাধ্যমে আকবর আগুন পুজা, শিখা অনির্বাণ প্রজ্বলিত করার নির্দেশ দেয়। এবং সূর্য পুজা শুরু করে" ( মুন্তাখাবুত তাওয়ারিখ)
আকবরের উপর খ্রিষ্টানদের প্রভাব :
নাস্তিকদের দ্বারা প্রভাবিত :
মুক্ত বুদ্ধীজীবী সম্প্রদায় আকবরের মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করার বিরাট ভুমিকা পালন করে। আবুল ফজল ছিলো একজন নাস্তিক। এর প্রভাবে আকবর সৃষ্টি জগত সব প্রকৃতির দান মনে করে। আল্লাহ , রসূল , শরীয়ত এসব আলেমদের আবিস্কার বলে ধারনা করা শুরু করে। এভাবে নামাজ, রোজা, হজ্জ নিয়েও তারা বিভিন্ন কটুক্তি করতো এবং উপহাস করতো।
দ্বীনে এলাহী প্রবর্তন :
এসকল বিষয়ের প্রভাবে আকবর এক নতুন ধর্ম প্রবর্তনের দিকে আগ্রহী হয়। ১৫৮২-১৬০৫ সালের মধ্যে আকবর ইসলাম ধর্মকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে দ্বীনে এলাহী নামক ধর্ম প্রচার শুরু করে। ( Akbar the great mughal p.348)
সে জাকাত এবং হজ্জের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এসময় হজ্জে গমনের অনুমতি চাওয়া আর মৃত্যু প্রার্থনা করা সমান ছিলো।
এক কথায় সকল ইসলামী শরীয়তের বিরুদ্ধে নিজের মনগড়া নীতি চালু করে। এবং অস্বীকার কারীদের হত্যা করে।
এই হলো আকবরের সময়কার ইতিহাস। কতটা কঠিন অবস্থা ছিলো একটু চিন্তা করুন। সেই ভয়াবহ ঘুনে ধরা পরিবেশকে ইসলামের আলোয় আলোকিত করতে আগমন করেন এক বিখ্যাত ওলী। যার আগমন সম্পর্কে সরাসরি হাদীস শরীফ বর্নিত আছে।
এ মহান ব্যক্তি সম্পর্কে যে কথাগুলো সবার জানা একান্ত জরুরী-
১) মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি এমন বিশেষ শ্রেনীর ওলী আল্লাহ, যার সম্পর্কে হাদীস শরীফে পর্যন্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। হাদীস শরীফগুলো নিম্নরূপ:
يَكُوْنُ فِـىْ اُمَّتِـىْ رَجُلٌ يُقَالُ لَه صِلَةُ يَدْخُلُ الْـجَنَّةَ بِشَفَاعَتِهٖ كَذَا وَكَذَا مِنَ النَّاسِ.
“আমার উম্মতের মাঝে একজন মহান ব্যক্তিত্ব’র আবির্ভাব ঘটবে। উনাকে ‘ছিলাহ’ বলা হবে। উনার মুবারক শাফায়াতে (সুপারিশে) অসংখ্য মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (জামউল জাওয়াম, জামিউদ দুরার, জামিউল আহাদীছ, যুহুদ, ইবনে সা’দ, বাইহাক্বী)
অর্থাৎ মুযাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি’র নাম ছিলো ‘আহমদ’ এবং উনার আগমণ ঘটেছে বাদশাহ আকবর ও বাদশাহ জাহাঙ্গীরের মধ্যবর্তী সময়ে।
২) হাদীস শরীফে আছে, নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মহান আল্লাহ প্রতি হিজরী শতকের শুরুতে এমন একজন ব্যক্তিত্ব পাঠান, যিনি উম্মতের স্বার্থে পবিত্র দ্বীন ইসলামের সংস্কার সাধন করেন।” (আবু দাউদ শরীফ)
অর্থাৎ প্রতি হিজরী শতকের শুরুতে একজন করে মুজাদ্দিদ শ্রেণীর ওলী আল্লাহ’র আগমণ ঘটবে, যাদের উছিলায় আল্লাহ তায়ালা পবিত্র দ্বীন ইসলামকে হিফাজত করবেন। আর মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি ছিলেন ঐ শ্রেণীর ওলী আল্লাহগণের মধ্যে অন্যতম।