পবিত্র কুরআন শরীফ এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত ঈমানী কুওয়্যত বৃদ্ধিকারী মুবারক মু’জিযা ও নিদর্শনসমূহ-৭
-সাইয়্যিদুনা হযরত শাফিউল উমাম আলাইহিস সালাম
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
অর্থ: আমি পবিত্র এ কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মানুষের জন্যে সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি, যাতে তারা অনুধাবন করে। (পবিত্র সূরা যুমার শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭)
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে এমনকিছু ওয়াক্বিয়া এবং ঐতিহাসিক তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন যা মানুষের চিন্তা-কল্পনার ঊর্ধ্বে। উদাহরণস্বরূপ, মহান আল্লাহ পাক তিনি ‘পবিত্র সূরা রূম শরীফ’ উনার মধ্যে ২টি বিষয় একটি ভৌগোলিক এবং অপরটি অকল্পনীয় একটি ঐতিহাসিক ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
الـم
অর্থ: আলিফ-লাম-মীম।
غُلِبَتِ الرُّومُ
অর্থ: রোমকরা পরাজিত হয়েছে।
فِي أَدْنَى الْأَرْضِ وَهُم مِّن بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَঅর্থ: পৃথিবীর নিম্নতম এলাকায় এবং তারা তাদের পরাজয়ের পর অতিসত্বর বিজয়ী হবে।
فِي بِضْعِ سِنِينَ ۗ لِلَّهِ الْأَمْرُ مِن قَبْلُ وَمِن بَعْدُ ۚ وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُونَ
অর্থ: কয়েক বছরের মধ্যে। অগ্র-পশ্চাতের কাজ মহান আল্লাহ পাক উনার হাতেই। সেদিন মু’মিনগণ আনন্দিত হবে।
بِنَصْرِ اللَّهِ ۚ يَنصُرُ مَن يَشَاءُ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ
অর্থ: মহান আল্লাহ পাক উনার সাহায্যে, তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু। (পবিত্র সূরা রূম শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১-৫)
(১) পারস্যের বিরুদ্ধে রোমানদের বিজয়:
পবিত্র সূরা রূম শরীফ উনার উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মাঝে
وَهُم مِّن بَعْدِ غَلَبِهِمْ سَيَغْلِبُونَ فِي بِضْعِ سِنِينَ
“তারা তাদের পরাজয়ের পর অতিসত্বর বিজয়ী হবে কয়েক বছরের মধ্যে” -দ্বারা রোম কর্তৃক পারস্য সা¤্রাজ্য পরাজিত হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে।
অথচ যখন এই পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হয়, তখন পারস্যরা রোমানদেরকে পরাজিত করেছিলো এবং রোমানদের বিজয় লাভের কোনো সম্ভাবনাই ছিলো না, বরং রোমানদের বিজয়লাভ ছিলো একেবারেই অকল্পনীয়।
রোম-পারস্য যুদ্ধ:
ইসলামপূর্ব যুগে পারস্য (ইরান, সাসানিদ) ও রোম (বাইজেনটাইন) দুটি তথাকথিত বৃহৎ শক্তি ছিল।
তাদের উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ-বিবাদ লেগেই থাকতো। পারসিকরা ছিল অগ্নিপূজক মুশরিক এবং মক্কার মুশরিকদের সহানুভূতি ছিল পারসিকদের প্রতি; রোমানরা ছিল নাছারা বা খ্রিষ্টান যারা আহলে কিতাবদের অন্তর্ভূক্ত। তাই মুসলিমদের সহানুভূতি রোমের প্রতি ছিল।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নুবুওয়াত মুবারক প্রকাশের প্রায় ৭ বছর পূর্বে মরিশাস নামক রোমক শাসককে হত্যা করে তারই সেনাবাহিনী অফিসার ফোকাস। মরিশাসের সাথে পারস্য শাসক খসরুর (দ্বিতীয়) সুসম্পর্ক ছিলো। মরিশাসকে হত্যার পর পারস্য শাসক খসরু (দ্বিতীয়) রোমক রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এবং রোমানদের উপরে বিজয় লাভ করে। পরবর্তীতে পারস্যরা সিরিয়া, আর্মেনিয়া এবং জেরুজালেমসহ মিশর রাজ্য দখল করে নেয়। ঈসায়ী ৬১৪-৬১৫ সালের মধ্যে পারসিকরা খ্রিষ্টানদের উপরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তাদের তথাকথিত ক্রুশ দখল করে নেয় এবং তাদের তথাকথিত সমাধি গির্জা ধ্বংস করে দেয়। পারসিকরা খ্রিষ্টানদের উপর বিজয় লাভ করার ফলে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার মুশরিকরা আনন্দিত ছিলো। সে সময়ে রোমান শাসক হেরাক্লিয়াস এত হতাশ হয়েছিলো যে কন্সটান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) ত্যাগ করে তিউনিশিয়া চলে যায়। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক গীবন বলে, “এমনকি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার ভবিষদ্বানী নাযিল হওয়ার ৭-৮ বছর পরেও অবস্থা এমন ছিলো যে, বাইজেনটাইন বা রোমানরা পারস্য সা¤্রাজ্যের সাথে মোকাবেলা করবে তা কল্পনাও করা যাচ্ছিলনা। বিজয়ের তো প্রশ্নই উঠে না। এমনকী রোমান সা¤্রাজ্য টিকবে কিনা সে আশাও ছিলো না।”
৬১৭ ঈসায়ীতে রোমান শাসক হেরাক্লিয়াস পারস্য শাসক খসরু পারভেজের কাছে যেকোনো শর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। পারভেজ উত্তর দেয় “আমি বাদশাহকে কোনো নিরাপত্তা দিব না যতক্ষণ না তাকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে হাজির করা হয় এবং সে ক্রুসের ঈশ্বরকে ত্যাগ করে আগুনকে ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেয়।”
ঠিক তখনই পবিত্র সূরা রূম শরীফ নাযিল হয় এবং রোমানদের আসন্ন বিজয়ের ভবিষ্যদ্বানী করা হয়, যা ছিলো অকল্পনীয়।
বিদ্ব’য়ি সিনীন (بِضْعِ سِنِينَ)
এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, কয়েক বছরের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী হবে এবং বিজয়ী পারসিকরা পরাজিত ও পরাজিতরা বিজয়ী হয়ে যাবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী অসম্ভব মনে হলেও মহান আল্লাহ পাক উনার উক্ত বাণীর ফলে মুসলিমদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। এ ভবিষ্যদ্বানীর প্রেক্ষিতে সাইয়্যিদুনা হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি উবাই ইবনে খালাফকে বলেছিলেন যে, ৩ বৎসরের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী হবে (আল বাইযাবী) এবং অপর এক বর্ণনায় আছে, ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম তিনি আবু জাহলের সাথে চুক্তি করে ফেলেন যে, পাঁচ বছরের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী হবেই। কিন্তু নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত চুক্তির কথা জানতে পারলে তিনি আরো সঠিকভাবে জানিয়ে দিলেন যে, বিদ্ব’য়ি সিনীন (بِضْعِ سِنِينَ) শব্দের অর্থ ৩-৯ বছরের মধ্যে। অতএব পাঁচ বছর চুক্তির সময় কম করে ফেলেছেন, এতে আরো সময় বাড়িয়ে নিন। সুতরাং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশ মুবারক অনুসারে হযরত ছিদ্দীক্বে আকবর আলাইহিস সালাম উনার প্রস্তাবিত সময় আরো কিছু বাড়িয়ে দিলেন। উল্লেখ্য, بِضع (কয়েক) শব্দটি তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা বুঝাতে ব্যবহার হয়।
ফল এই দাঁড়ালো যে, পরবর্তীতে ৬২২ ঈসায়ী অর্থাৎ প্রথম বা দ্বিতীয় হিজরীতে কিসসাস এর যুদ্ধে দজলা নদীর ৫০ কিলোমিটার পূর্বে রোমানরা পারস্যদের পরাজিত করে অকল্পনীয় বিজয় লাভ করে অর্থাৎ পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হওয়ার ৭ বছরের মধ্যে তা সত্যে পরিণত হয়। রোমানরা তিন থেকে নয় বছর সময়ের মধ্যে অর্থাৎ পবিত্র সূরা অবতীর্ণ হওয়ার সপ্তম বছরেই অগ্নিউপাসক পারসিকদের উপর বিজয়ের স্বাদ লাভ করে এবং তাদের বিজয় অভিযান অব্যাহত থাকে। যাতে মুসলিমগণ আনন্দিত হয়েছিলেন। (তিরমিযী শরীফ, তাফসীর পবিত্র সূরা রূম শরীফ)
অনেকে বলেন যে, রোমানদের এই বিজয় ঠিক ঐ সময় হয়েছিল, যখন মুসলিমগণ সম্মানিত বদর উনার জিহাদে কাফিরদের উপর বিজয় লাভ করেছিলেন। মুসলিমগণ নিজেরা জয়ী হওয়ার ফলেও আনন্দিত ছিলেন। রোমানদের এই বিজয় পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সত্যতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে।
(২) পৃথিবীর নি¤œতম এলাকার অবস্থান: একটি আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে এ পবিত্র আয়াত শরীফে একটি ভৌগোলিক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। যা তৎকালীন সময় কারো পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব না। আর তা হচ্ছে রোমানরা পরাজিত হয়েছে পৃথিবীর নিম্নতম স্থানে। ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
فِي أَدْنَى الْأَرْضِ
”পৃথিবীর নিম্নতম এলাকায়”
শাব্দিক অর্থ: আরবীতে أَدْنَى (আদনা) শব্দ মুবারক দ্বারা “নিম্নতম” বুঝানো হয়েছে। যদিও অনেক অনুবাদক অর্থ করেছে পৃথিবীর নিকটবর্তী স্থান।
কিন্তু শব্দগতভাবে أَدْنَى (আদনা) এসেছে
(দানইউন) শব্দ থেকে যার অর্থ হচ্ছে নীচু, আর أَدْنَى (আদনা) হচ্ছে “ইসমে তাফদীল” যার অর্থ সর্ব নিম্নতম। অপর শব্দ الْأَرْضِ (আর্দ্ব) মানে পৃথিবী। তাহলে أَدْنَى الْأَرْضِ “আদনাল আর্দ্ব” মানে হচ্ছে ‘পৃথিবীর সর্ব নিম্নতম স্থান।’
অনেক ব্যাখ্যাকারক আরবদেশের কাছাকাছি বলে নিকটবর্তী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। রোমানরা ৬১৩ ঈসায়ীতে পারস্যদের নিকট পরাজিত হয়েছিল যে স্থানে তা অবস্থিত মৃতসাগরের (উবধফ ঝবধ) তীরে।
রোমান এবং পারস্যরা মৃতসাগরের উপকূলে পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিলো এবং রোমানরা মারাত্মকভাবে পরাজিত হয় আর এ যুদ্ধেই রোমানরা জেরুজালেমে তাদের তথাকথিত ক্রুশ হারিয়েছিলো, যা পারস্যরা নিয়ে যায়। বর্তমানে এ অঞ্চলটি সিরিয়া, প্যালেস্টাইন এবং জর্দানের অন্তর্ভুক্ত। ভূগোলবিদদের কাছে, এ অঞ্চলটি গ্রেট রিফট ভেলি (এৎবধঃ ৎরভঃ ঠধষষবু) নামে পরিচিত।
এটি ৬০০০ কিলোমিটার সুদীর্ঘ পৃথিবী পৃষ্ঠের একটি চ্যুতি (খাদ) যা উত্তর সিরিয়া থেকে সিনাই বদ্বীপ এবং লোহিত সাগরের এ্যাডেন উপসাগর হয়ে পূর্ব আফ্রিকার মোজাম্বিক পর্যন্ত বিস্তৃত।
গ্রেট রিফট ভেলির মৃতসাগর তীরবর্তী নীচু অঞ্চলটি হচ্ছে পৃথিবীর নিম্নতম স্থান।
এখানে উল্লেখযোগ্য, বরফ আচ্ছাদিত এন্টার্টিকা মহাদেশের “বেন্টলি সাবগ্লেসিয়াল ট্রেঞ্চ” (ইবহঃষবু ঝঁনমষধপরধষ ঃৎবহপয) পৃথিবীর নিম্নতম অংশ বলে ধারণা করে।
কিন্তু সেটা কোন জমিন নয় বরং তা বরফ স্তর। যমীন বা ভূমি হিসেবে সর্বনি¤œ স্থান হচ্ছে মৃত সাগরের উপকূল। মৃতসাগরের এ অঞ্চলটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ মিটার নীচে অবস্থিত। যা আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি ছাড়া বের করা অকল্পনীয়।
অথচ পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ১৪ শত বছর আগেই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। যা প্রমাণ করে পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত মুজিযা শরীফ।
-০-