১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৫৪( ঐশ্বর্যে লালিত আরাবী দুলাল )

ঐশ্বর্যে লালিত আরাবী দুলাল -পর্ব-৫৪

হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, পিতা-মাতার পরম আদর আর ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কা শরীফের অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। মা সম্পদশালী হওয়ার কারণে অত্যন্ত ভোগ বিলাসের মধ্যে উনাকে প্রতিপালন করে। তখনকার যুগে মক্কা শরীফের যত রকমের চমৎকার পোশাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সামনে কোনভাবে উনার প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন, "মক্কা শরীফে মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিল না।” ঐতিহাসিকরা বলেছেন, "তিনি ছিলেন মক্কা শরীফের সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারী।”

মক্কার অলিতে গলিতে কুরাইশগণের আড্ডায়, পরামর্শ সভায় তখন একই আলোচনা- আল আমীন মুহাম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উনার নতুন দ্বীন আল ইসলাম। কুরাইশগণের এই আদুরে দুলাল এসব আলোচনা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনতেন। অল্প বয়সী হওয়া সত্ত্বেও তিনি হতেন কুরাইশগণের সকল বৈঠক ও মজলিসের শোভা ও মধ্যমণি। তাদের প্রতিটি বৈঠকে সবার কাম্য হতো উনার উপস্থিতি। তীক্ষ্ম মেধা, প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যক্তিত্ব ছিল উনার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এ বৈশিষ্ট্য উনার হৃদয়ের সকল দ্বার, সকল অর্গল উন্মুক্ত করে দেয়।

তিনি শুনতে পেলেন, রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উনার প্রতি বিশ্বাসীরা কুরাইশদের সকল অর্থহীন কাজ ও তাদের যুলুম অত্যাচার থেকে দূরে থাকার উদ্দেশ্যে সেই সাফা পাহাড়ের পাদদেশে আল আরকাম ইবনে আবিল আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাড়িতে সমবেত হন। সব দ্বিধা, সব দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে একদিন সন্ধ্যায় তিনি হাযির হলেন দারুল আরকামে। রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই দিনগুলোতে সেখানে উনার সাথীদের সঙ্গে মিলিত হতেন, উনাদেরকে কুরআন শরীফ শিক্ষা দিতেন এবং উনাদের সাথে নামায আদায় করতেন।

মুসয়াব ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দারুল আরকামে বসতে না বসতেই আয়াত শরীফ নাযিল হলো। রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যবান মুবারক থেকে নিঃসৃত সেই আয়াত শরীফ যেন সকল শ্রোতার কর্ণকুহরে ও হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করতে লাগলো। সেই বরকতময় সন্ধ্যায় ইবনে উমাইর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও হয়ে গেলেন এক বিশ্বাসী অন্তঃকরণের অধিকারী। খুশি ও আনন্দে তিনি আত্মহারা হয়ে পড়লেন।

রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একটি পবিত্র হাত মুবারক বাড়িয়ে দিলেন মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বুকের ওপর। দারুণ এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়েন মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। মূহুর্তে তিনি উনার বয়সের তুলনায় বহুগুণ বেশি হিকমত ও জ্ঞান লাভ করলেন এবং এমন দৃঢ়তা অর্জন করলেন যে, হাজারো বিপদ মুছীবত উনাকে কোনদিন বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি।

হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আম্মা খুনাস বিনতু মালিক ছিল এক প্রচন্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। তিনি উনার আম্মাকে খুব ভয় করতেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর ধরাপৃষ্ঠে একমাত্র উনার মা ছাড়া আর কাউকে ভয় পেতেন না। কুরাইশ ও তাদের দেব-দেবী সহ সকল শক্তি উনার কাছে ছিল তুচ্ছ। কিন্তু মায়ের ভয় দূর হচ্ছিলো না। তাই মহান আল্লাহ পাক উনার চূড়ান্ত ফায়সালা না হওয়া পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণের সংবাদটি চেপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

দারুল আরকামে যাতায়াত চলতে লাগলো। তিনি রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মজলিসে বসতে লাগলেন। কিন্তু উনার মা কিছুই জানতে পারলো না।

একদিন গোপনে তিনি দারুল আরকামে প্রবেশ করছেন, সে সময় উসমান ইবনে তালহা তা দেখে ফেললো। আরেক দিন তিনি হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মতো নামায পড়ছেন। সেদিনও তা উসমানের চোখে পড়ে যায়। বাতাসের আগে খবরটি মক্কা শরীফের অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লো। উনার মায়ের কানেও খবরটি পৌঁছে গেল।

উনার মা, বংশের লোকজন ও মক্কা শরীফের নেতৃবৃন্দের সামনে উনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো। তিনি অত্যন্ত স্থির বিশ্বাস ও প্রশান্ত চিত্তে তাদেরকে পাঠ করে শুনাতে লাগলেন পবিত্র কুরআন শরীফের সেই মহাবাণী যার ওপর তিনি ঈমান এনেছেন। উনার মা উনাকে চপেটাঘাত করে চুপ করিয়ে দিতে চাইলো। বকাঝকা, মারপিট চললো। তারপর উনাকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হলো।

তিনি বন্দী অবস্থায় দিন কাটাতে লাগলেন। রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা উনাকে পাহারা দেয়া হতো। এর মধ্যে তিনি খবর পেলেন উনারই মত কিছু মযলুম মু'মিন মুসলমান হাবশায় হিজরত করছেন। তিনি মায়ের চোখে ধুলো দিয়ে সেই দলটির সাথে হাবশায় চলে গেলেন।

কিছুদিন হাবশায় থাকার পর তিনি পবিত্র মক্কা শরীফে ফিরে এলেন। তারপর রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশে আরেকটি দলকে সঙ্গে করে হাবশায় চলে যান। কিন্তু হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি পবিত্র মক্কা শরীফে কিংবা হাবশায় যেখানেই থাকুন না কেন জীবন উনার নতুন রূপ ধারণ করেছে। উনার একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ হচ্ছেন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং একমাত্র কাম্য মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি মুবারক।

একদিন মুসলমানদের একটি দল রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করতে উৎসাহিত করছেন, তিনি তাদের উপাস্য দেব দেবীকে গালাগালও করছেন। এসব ভেবে রেগে আগুন হয়ে উনাকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে আসলেন, উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার এ রণমূর্তি দেখে হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার পাশে বসা লোকেরা ভয় পেয়ে গেলেন।

কিন্তু না, হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি তো উনাকে ভয় পেলেনই না বরং সহাস্যে উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে স্বাগতম জানালেন। হাসতে হাসতে উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তখন উনাকে ও আসআদ ইবনে যারারা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে লক্ষ্য করে বললেন, আপনারা আমাদের গোত্রীয় এলাকায় এসে এভাবে আমাদের দুর্বল লোকদের বোকা বানাচ্ছেন কেন? যদি আপনাদের মারা যাওয়ার শখ না থাকে তাহলে আমাদের এলাকা থেকে বেরিয়ে যান।

একথা শুনে হাসতে হাসতে মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে বললেন, "আপনি কি একটু বসে আমার কথা শুনবেন না? আমার কথা শুনুন। ভালো লাগলে মানবেন, ভালো না লাগলে আমরা চলে যাবো।"

উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন একজন বুদ্ধিমান লোক। এই কথাটা উনার মনে লাগলো। এ তো বুদ্ধিমানের কথা! শুনতে আপত্তি কিসের! তিনি অস্ত্র ফেলে মাটিতে বসে কান লাগিয়ে হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কথা শুনতে লাগলেন।

হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পবিত্র কুরআন শরীফের আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে পবিত্র দ্বীন নিয়ে এসেছেন সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা করছেন, আর এদিকে উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মুখমন্ডল একটু একটু করে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠছে। হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বক্তব্য এখনও শেষ করতে পারেননি, এর মধ্যে উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও তার সঙ্গী লোকটি বলে বসলো, এ তো খুব চমৎকার ও সত্য কথা। আপনাদের দ্বীনে প্রবেশ করতে গেলে কি করতে হয়? হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, শরীর ও পোশাক পবিত্র করে "লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম" এই সাক্ষ্য দিতে হয়।

উসাইদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উঠে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে এলেন তখন উনার মাথার চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, "আশহাদু আল্লাহ ইলা-হা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রসূলুহু।"

এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো, সাদ ইবনে মুয়াজ ও সাদ ইবনে উবাদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা ছুটে এলেন হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে। উনারা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এসব নেতৃবৃন্দের ইসলাম গ্রহণের পর সাধারণ মদীনাবাসী বলাবলি করতে লাগলেন, আমরা পেছনে পড়ে থাকবো কেন! চলো, মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কাছে যাই, পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করি। এভাবেই হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি মহান আল্লাহ পাক প্রদত্ত বুদ্ধি, মেধা ও মহৎ চরিত্রের সাহায্যে মদীনাবাসীদের হৃদয়ের সাথে সংলাপ করেন। ফলে উনারা দলে দলে মহান আল্লাহ পাক উনার দ্বীনে প্রবেশ করেন।

হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পবিত্র মদীনা শরীফে আসার পূর্বে সেখান থেকে মাত্র বারো জন লোক আকাবায় এসে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি পবিত্র মদীনা শরীফে আসার পর কয়েক মাস যেতে না যেতেই বহু মানুষ উনার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে মদীনাবাসী মুসলমানদের বাহাত্তর জনের একটি প্রতিনিধি দল, উনাদের যিনি ধর্মীয় শিক্ষক ও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রেরিত দূত হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সাথে পবিত্র মক্কা শরীফে এসে আকাবায় রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে মিলিত হন।

যখন ওহুদ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। তখন হযরত মুসয়াব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হাত মুবারকে ছিল ইসলামের পতাকা। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর প্রচন্ড আঘাতে উনার ডান হাত কেটে যায়। এরপর তিনি বাম হাত দিয়ে ইসলামের পতাকা উড্ডীন রাখেন। একটু পরে বাম হাতও কাটা যায়। দু'হাত কাটা যাওয়ার পর দুই হাতের অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা বুকে ধরে রাখলেন তিনি। যতক্ষণ প্রাণ ছিল ইসলামের ঝান্ডা মাটিতে পড়তে দেননি। অবশেষে শত্রু পক্ষের তীরের আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। সুবহানাল্লাহ!

তিনি উনার দুনিয়াবী যিন্দেগীর আরাম, আয়েশ, সুখ, প্রভাব-প্রতিপত্তি সব অকাতরে ত্যাগ করেছেন শুধু মহান আল্লাহ পাক ও উনার প্রিয়তম হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহাব্বতে। দ্বীন ইসলাম উনার ঝান্ডা বুলন্দ করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত কুরবান করে দিয়ে গিয়েছেন। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা এভাবেই উনাদের শত সহস্র ত্যাগের বিনিময়ে, বুকের তাজা খুন ঝরিয়ে আমাদের জন্য দ্বীনের পথকে মসৃণ করে এক স্বর্ণালী যুগ রচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন।

১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৫৩( ওহুদের ময়দানে কে সেই বীর মুজাহিদা )

ওহুদের ময়দানে কে সেই বীর মুজাহিদা -পর্ব-৫৩

ওহুদের ময়দানে এক নারী পরাক্রমশালী বীর পুরুষের ন্যায় যুদ্ধ করেছিলেন। এই বীর মুজাহিদার নাম 'নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা'।

নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার স্বামী এবং পুত্রদ্বয় ওহুদের যুদ্ধে গমন করলে নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা নিশ্চেষ্টভাবে ঘরে বসে থাকা অপেক্ষা যুদ্ধে যাওয়াই শ্রেয় বলে স্থির করলেন এবং আহত মুসলমান সৈনিকদেরকে পানি প্রদান করার দায়িত্বে নিয়োজিত হলেন। কিন্তু যখন দেখলেন মুসলমানদের করুণ অবস্থা, তখন নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আর স্থির থাকতে পারলেন না। এক আহত সৈনিকের হাত থেকে তরবারি গ্রহণ করে শত্রু সৈন্যকে আক্রমণ করতে প্রবৃত্ত হলেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং দূর হতে এই বীর নারীর শৌর্য্য বীর্য দর্শন করছিলেন। রণক্ষেত্রে নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার পুত্রদ্বয়কে নিয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মুখেই যুদ্ধ করছিলেন। উনার হাতে ঢাল ছিল না। তাই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি একজন সৈনিককে বললেন, "নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাকে একখানি ঢাল দিয়ে আসুন।” সৈনিক উনার আদেশ মুবারকে একখানি ঢাল নিয়ে নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার নিকটে নিক্ষেপ করলে নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা সেই ঢাল তুলে নিয়ে ক্রুদ্ধ সিংহীর ন্যায় সদর্পে পরিভ্রমণ করে কুরাইশদের অস্ত্রাঘাত করতে লাগলেন। সেই সময় একজন কুরাইশ অশ্বারোহী নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার উপরে তরবারির আঘাত করলো, কিন্তু নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা স্বীয় হস্তস্থিত ঢাল দিয়ে আঘাত ব্যর্থ করে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ শত্রুর অশ্বের উপর তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন। এতে অশ্বটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। কুরাইশ সৈন্য পতনোন্মুখ অশ্ব হতে লাফ দিয়ে ভূমিতে দণ্ডায়মান হলো। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূর থেকে এই ব্যাপারটা দেখে নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার পুত্র আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে মায়ের সাহায্যার্থে যেতে আদেশ মুবারক করলেন। হযরত আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু দ্রুত পদে মায়ের নিকটে উপস্থিত হন। তখন নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা পুত্রের সহায়তায় সেই কাফিরকে আক্রমণ করে তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। একজন কাফিরের অস্ত্রের আঘাতে হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার অনেক রক্তপাত হওয়াতে তিনি দুর্বল হয়ে যমীনে পড়ে গেলেন। এ অবস্থা দেখে হযরত নাসিবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা পুত্রের নিকট গমন করে বললেন, 'বৎস! উঠো। শত্রুর সাথে যুদ্ধ করো। আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে ধূলির শয্যায় শয়ন করা কখনও তোমার পক্ষে সমীচীন নয়।" কথা শুনে আবদুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মহা উৎসাহ সহকারে দণ্ডায়মান হয়ে শত্রু সংহারে প্রবৃত্ত হলেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জিহাদের ময়দানে এই মহিলা ছাহাবীর নেক সাহস, পারদর্শীতা, তেজ আর বীরত্ব দেখে উনার জন্য প্রাণ উজাড় করে দোয়া করেছিলেন। সুবহানাল্লাহ!

১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৫২( কানের বদলে কান, আবার অতিরিক্ত মাথা )

কানের বদলে কান, আবার অতিরিক্ত মাথা-পর্ব-৫২

যখন সূরা "আর রহমান শরীফ" নাযিল হলো, তখন সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, 'হে আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম! আপনাদের মধ্যে কে আছেন, যে এই পবিত্র সূরা আর রহমান শরীফ পবিত্র কা'বা শরীফে গিয়ে তিলাওয়াত করে আসতে পারবেন?' হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, 'ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি যদি অনুমতি মুবারক দান করেন, তাহলে আমি তিলাওয়াত করতে পারবো।' তখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, 'ঠিক আছে, যান।'

অনুমতি পেয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিলাওয়াত করার জন্য পবিত্র কা'বা শরীফে গেলেন। যখন তিলাওয়াত করা শুরু করলেন, তখন আবু জাহেল কোথা থেকে এসে উনার কানের মধ্যে আঘাত করলো। এত জোরে সে আঘাত করলো যে, উনার কানটা নষ্ট হয়ে গেল। তিনি কাঁদতে কাঁদতে সরাসরি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুজরা শরীফে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বসা ছিলেন। একদিক থেকে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করলেন; আর ঠিক সাথে সাথে বিপরীত দিক থেকে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম তিনি হাসতে হাসতে প্রবেশ করলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, 'হে ভাই জিব্রাইল আলাইহিস সালাম! হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি কাঁদছেন আর আপনি হাসছেন, তার কি কারণ? 'হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, 'ইয়া রসূলাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কারণ আজকে বলবো না। বেয়াদবি মাফ করবেন, আমি অন্য একদিন বলবো।'

তারপর পবিত্র হিজরত মুবারক সংঘটিত হলো। হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে পবিত্র মদীনা শরীফ চলে গেলেন। প্রথম হিজরী পার হয়ে দ্বিতীয় হিজরীতে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। বদরের যুদ্ধে কাফিররা পরাস্ত হলো; সত্তর জন কাফির মারা গেল। কাফিরদের চৌদ্দজন নেতার মধ্যে এগারজন নেতা মারা গেল। যখন যুদ্ধ প্রায় শেষ, তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এসে বললেন, 'ইয়া রসূলাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমার একটা আরজু রয়েছে। আমি আজকের জিহাদে সরাসরি কোনো কাফিরকে হত্যা করতে পারিনি। আপনি যদি অনুমতি মুবারক দেন, তবে আমি জিহাদের ময়দানে একটু যেতে চাই। যদি কোনো কাফির অর্ধমৃত অবস্থায় পড়ে থাকে, তাহলে আমি তার গর্দানটা কেটে ফেলবো। এতে হয়তো মহান আল্লাহ পাক তিনি কাফির হত্যার সাওয়াবটা আমাকে দিয়ে দিবেন।' হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, 'বেশ, আপনি যান।'

অনুমতি পেয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ঘুরতে লাগলেন জিহাদের ময়দানে। ঘুরতে ঘুরতে দেখেন, এক কোনায় আবু জাহেল পড়ে আছে, মৃত্যুর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আবু জাহেল কিন্তু সেই অবস্থায়ও হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে চিনতে পারলো। সে বললো, 'হে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। আপনি কি আমার গর্দান কাটার জন্য এসেছেন?' হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, 'হ্যাঁ।' আবু জাহেল বললো, 'তাহলে আপনি আমার গর্দানটা একটু বড় করে কাটবেন; যেন মানুষ বুঝতে পারে যে, আপনাদের রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শত্রু আবু জাহেল খুব বড় পালোয়ান ছিল।' নাউযুবিল্লাহ! তখন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তার মাথাটা কেটে ফেললেন।

আবু জাহেল সত্যিই খুব বড় পালোয়ান, খুব শক্তিশালী ছিল। তার মাথাটা যেমন বড় ছিল, ঘাড়টাও তেমন মোটা ছিল। অন্যদিকে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খুব হালকা পাতলা ছিলেন। আবু জাহেলের মাথাটার অনেক ওজন হওয়ার কারণে বহন করে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। তাই তিনি মাথাটার এক কান দিয়ে রশি ঢুকিয়ে, কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে, অপর কানের ছিদ্র দিয়ে রশিটা বের করলেন। তারপর রশি ধরে মাথাটা ঝুলিয়ে নিয়ে চললেন; ঠিক যেভাবে মানুষ বাজার থেকে বড় মাছ আনার সময় কানকোর ভিতর রশি ঢুকিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যায় সেভাবে। আবু জাহেলের মাথা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দরবার শরীফে উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, 'ইয়া রসূলাল্লাহ ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি তো কোনো কাফির হত্যা করতে পারিনি। তবে সবচেয়ে বড় যে কাফির, আবু জাহেল, তার গর্দান কেটে নিয়ে এসেছি।

ঠিক সেই সময় আবার বিপরীত দিক থেকে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম হাসতে হাসতে এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, 'হে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! নিশ্চয়ই আপনার স্মরণ আছে, সেই মক্কা শরীফের ঘটনা। একদিন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলেন, আর আমি বিপরীত দিক থেকে হাসতে হাসতে এসে প্রবেশ করেছিলাম। আপনি আমাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি বলেছিলাম যে, পরে জওয়াব দিব। আজকে জওয়াব দেয়ার জন্য এসেছি, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করার কারণে আবু জাহেল হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার একটা কান নষ্ট করে দিয়েছিল। মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাকে কানের বদলে কান তো দিয়েছেনই, আবার অতিরিক্ত মাথাটাও দিয়ে দিয়েছেন।' সুবহানাল্লাহ!

কাফিররা মুসলমানদের উপর যত অত্যাচারই করুক না কেন, তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মুসলমানগণ যদি দ্বীন ইসলাম উনার উপর দৃঢ় থাকে, তাহলে স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনিই মুসলমানদের পক্ষ থেকে কাফিরদের উপর প্রতিশোধ নিবেন।

১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৫১( ইসলাম বিগত জীবনের সমস্ত পাপরাশিকে ক্ষমা করে দেয়)

 ইসলাম বিগত জীবনের সমস্ত পাপরাশিকে ক্ষমা করে দেয়-পর্ব-৫১

আরবে অন্ধকার যুগে তথা আইয়্যামে জাহিলিয়াহ বিরাজমান অবস্থায় মেয়ে সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয়ার প্রথা ছিল। সেই জীবন্ত মেয়ে সন্তানদের কবর দেয়া দলের প্রধান ছিলেন হযরত দাহিয়াতুল কালবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে আইয়্যামে জাহেলিয়ার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আসলেন এবং নিজ হাত দু'টি বাড়িয়ে দিলেন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে। মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাত মুবারক ধরবেন এমন সময় তিনি আবার হাত দু'টি গুটিয়ে নিলেন এবং বললেন, "হুযূর আমি আরবের বুকে মেয়ে সন্তানকে জীবিত কবর দেওয়া দলের প্রধান। আমার স্ত্রী আমার অজান্তে আমার একটি মেয়ে সন্তানকে লালন পালন করছিল। সে চলাচল করার মত বয়সে উপনীত হলে বিষয়টি আমার কাছে প্রকাশ পায়। মেয়েটির চেহারায়-কথাবার্তায় আমিও পিতৃস্নেহে অভিভূত হয়ে গেলাম। জাহেলিয়ার নীতি আমাকে বার বার তাড়া করতে লাগলো যে, তুমি আরবের বুকে মেয়ে সন্তান জীবন্ত কবর দেওয়া দলের সর্দার হয়ে পিতৃস্নেহের কাছে হেরে গেলে? পরিশেষে বাধ্য হয়ে মিথ্যে ছলনায় স্ত্রীকে বললাম, 'মেয়েকে সুন্দর ও পরিপাটি করে সাজিয়ে দাও। তাকে নিয়ে দাওয়াতে যাবো।' তারপর মেয়েটিকে নিয়ে মরুময় পথ ধরে চলতে আরম্ভ করলাম। মরুময় পথে আমি ও আমার সন্তানই যাত্রী। মেয়েটির প্রতি স্নেহ-মমতা আমাকে অত্যন্ত বিচলিত করে তুলছিল। কিন্তু আমি জাহিলিয়ার নীতির কাছে হেরে গেলাম।


মেয়েটি বললো, 'আব্বা আমাকে একটু পানি দেন।' আমি বললাম, 'মা! একটু অপেক্ষা করো।' এ সুযোগেই আমার কাপড়ের নিচে লুকানো কবর দেয়ার যন্ত্রপাতি বের করে মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম। অনেক গভীর করে উপরে উঠে এলাম। মেয়েটি তৃষ্ণার্ত নয়নে আমার পানে তাকিয়ে দেখছিল। মেয়েকে বললাম, 'দেখতো মা, পানি উঠছে কিনা?' মেয়েটি অধীর আগ্রহে তাকাতেই দু'চোখ বন্ধ করে মেয়েকে কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে মাটি দিতে শুরু করি। হুযূর! মেয়েটির সে কান্না আর আমাকে আব্বা! আব্বা! বলে আকুলভাবে ডাকার শব্দ আমার কানে আজও ভেসে উঠে। বলুন হুযূর! এমন পাপাত্মা

পিতা, মেয়ে সন্তানদের জীবিত কবর দেয়ার যে পাপ আমি করেছি, এমন পাপ নিয়ে ইসলাম কি আমাকে গ্রহণ করবে?"

হযরত দাহিয়াতুল কালবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কথা শুনে রহমাতুল্লিল আলামীন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দু'চোখ মুবারক অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু তিনি যেহেতু ওহী মুবারক ব্যতীত নিজ থেকে কোনো কথা বলেন না, কাজ করেন না, তাই চুপ করে থাকলেন। এমন সময় হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম আগমন করেন এবং বলেন, 'হে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করুন, আল ইসলামু ইয়াহদিমু মাকানা ক্বাবলাহু, অর্থাৎ ইসলাম বিগত জীবনের সমস্ত পাপরাশিকে ক্ষমা করে দেয়।' এ ঘোষণার পর হযরত দাহিয়াতুল কালবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ইসলামে দাখিল হলেন। তিনি এমন সুন্দর ও সুদর্শন ছিলেন যে, অধিকাংশ সময়ই হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম উনার সুরতে ওহী মুবারক নিয়ে আসতেন। সুবহানাল্লাহ!

১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৫০( শাহাদাত বরণের পূর্বেই যাকে শহীদা বলে ডাকা হতো)

শাহাদাত বরণের পূর্বেই যাকে শহীদা বলে ডাকা হতো-পর্ব-৫০

একজন আনছারী মহিলা ছাহাবী, উনার আসল নাম ইতিহাসে উল্লিখিত হয়নি তবে উনার কুনিয়াত ছিল উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। ইসাবাহ গ্রন্থে উনার পরিচয় সম্পর্কে উল্লেখ আছে উম্মে ওয়ারাকা বিনতে আবদুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে উয়াইমির ইবনে নওফেল। খুব সম্ভবত হিজরতের পর তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাত মুবারকে ইসলাম গ্রহণ করেন। বদর যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতে নিবেদন করেন, আমাকেও জিহাদে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হোক। আমি আহত এবং রোগাক্রান্তদের সেবা করবো। হতে পারে মহান আল্লাহ পাক আমাকে শাহাদাত নসীব করবেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আপনি গৃহেই থাকুন, মহান আল্লাহ পাক আপনাকে সেখানেই শাহাদাত দান করবেন। তিনি যেহেতু পবিত্র কুরআন শরীফ পড়তে জানতেন, তাই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে গৃহেই মহিলাদের ইমাম করেন। হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি উনার একজন গোলাম এবং একজন দাসীকে কথা দিয়েছিলেন যে, আমার ইন্তেকালের পর তোমরা আযাদ হয়ে যাবে। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট সময় আসার পূর্বেই উনার সেই প্রতিশ্রুতির সুযোগ নেয়ার ষড়যন্ত্র করে। তাই এক রাত্রে চাদর মুড়ি দিয়ে ছদ্মবেশে এসে তারা হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাকে নির্মমভাবে শহীদ করে। এ ঘটনার পর তারা দু'জনই পলায়ন করে। ভোরে হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম তিনি হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার গৃহে গিয়ে দেখেন তিনি ঘরের এক কোণে চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে রয়েছেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি আক্ষেপ করে বললেন, মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলেছেন। অতঃপর মসজিদে এসে মিনারে দাঁড়িয়ে এ খবর প্রচার করেন এবং অভিযুক্ত গোলাম ও দাসীকে গ্রেফতার করে আনার নির্দেশ দেন। তাদেরকে গ্রেফতার করে আনা হলে উভয়কে শুলীবিদ্ধ করা হয়। এরা হচ্ছে প্রথম মুনাফিক, যাদেরকে পবিত্র মদীনা শরীফে শুলীবিদ্ধ করা হয়। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাকে দেখতে উনার গৃহে গমন করতেন এবং উনাকে শহীদা বলে ডাকতেন। এজন্য হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম হযরত উম্মে ওয়ারাকা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার শাহাদাতের পর বললেন, রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিকই বলতেন, চলুন শহীদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার গৃহে যাই।

১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৪৯ ( বদনছীব আবু জাহেলের খোশনছীব সন্তান )

বদনছীব আবু জাহেলের খোশনছীব সন্তান-পর্ব-৪৯

কুরাইশরা দ্বীন ইসলাম উনার প্রচার প্রসার থামানোর জন্য একটা আইন করেছিল যে, কোনো ব্যক্তি যদি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে কোনরূপ সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। নাঊযুবিল্লাহ! তার কিছুদিন পর আবু জাহেলের সন্তান হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু (তিনি তখনও দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেননি) উনার সাথে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাক্ষাৎ মুবারক হলো। হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অত্যন্ত মুহাব্বতের সাথে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে মুসাফাহা-মুয়ানাকা করলেন।

কিছু কুরাইশ দূর থেকে এটা দেখে ফেললো। তারা হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে বললো, 'আপনি আমাদের সর্দারের ছেলে। আপনারাই আইন করেছেন, কেউ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে কোনরূপ সম্পর্ক স্থাপন করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। তাহলে এখন আপনি নিজেই যে উনার সাথে মুসাফাহা-মুয়ানাকা করলেন, আপনার কি শাস্তি হওয়া উচিত না?' তখন হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, 'ঠিক আছে। তোমরা আইন বাস্তবায়ন করো।' কুরাইশরা বললো, 'আপনি কিভাবে শাস্তি নিবেন?' তিনি বললেন, 'তোমরা যেভাবে পছন্দ করো।'

তারা তখন পরামর্শ করে উনাকে পাহাড়ের উপর থেকে নিচে ফেলে দিল। কিন্তু দেখা গেল যেভাবে উনার পড়ার কথা তিনি সেভাবে নিচে পড়ছিলেন না। বরং মনে হচ্ছিলো উনাকে যেন ধরে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে দেয়া হলো। সুবহানাল্লাহ! কুরাইশরা যখন দেখলো এভাবে কাজ হলো না, তখন তারা আবার পরামর্শ করে উনাকে হাত পা বেঁধে জঙ্গলে ফেলে আসলো, যাতে হিংস্র প্রাণীরা উনাকে খেয়ে ফেলে। কিন্তু দেখা গেল কিছুক্ষণ পরে হিংস্র প্রাণীরা অত্যন্ত তা'যীম তাকরীমের সাথে উনাকে পিঠে করে জঙ্গলের কিনারে পৌঁছে দিয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! কুরাইশরা এতে যারপরনাই অবাক হলো। তারা আবার পরামর্শ করে উনাকে হাত পা বেঁধে সাগরের মধ্যে ফেলে দিল। সাথে সাথেই হাজার হাজার মাছ এবং সামুদ্রিক প্রাণীরা উনাকে ঘিরে ফেললো এবং নিরাপদে তীরে পৌঁছে দিল। সুবহানাল্লাহ!

কুরাইশরা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললো, 'হে হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আমরা আপনাকে পরপর তিনবার মৃত্যুদণ্ড দেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রতিবারই আপনি নিরাপদে বেঁচে গেলেন। এর হাক্বীক্বত কি?' তখন তিনি বললেন, "হে কুরাইশগণ! তোমরা তো আসল বিষয় বুঝতে পারোনি। তোমরা যখন আমাকে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিলে সাথে সাথে অসংখ্য অগণিত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা আমাকে ঘিরে ধরলেন। উনারা ছলাত-সালাম পাঠ করছিলেন। আমাকে বললেন, 'হে হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আপনি চিন্তিত হবেন না। আপনি যিনি সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে তা'যীম-তাকরীম করেছেন, মুহাব্বতের সাথে মুসাফাহা-মুয়ানাকা করেছেন। আপনার শরীর থেকে উনার পূতপবিত্র জিসিম মুবারকের সুঘ্রাণ আসছে। এই সম্মানার্থে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না।' তারপর উনারা আমাকে সম্মানের সাথে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখলেন।” সুবহানাল্লাহ!

"তারপর যখন তোমরা আমাকে জঙ্গলে ফেলে আসলে, সেখানের হিংস্র প্রাণীরা আমাকে ঘিরে ফেললো। তারাও সকলে ছলাত-সালাম পাঠ করছিল। আমাকে বললো, 'হে হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আপনি পেরেশান হবেন না। আপনি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূতপবিত্র জিসিম মুবারক উনার সংস্পর্শে এসেছেন। আপনার শরীর থেকে উনার মুবারক সুঘ্রাণ আসছে। উনার সম্মানার্থে আপনার কোনো ক্ষতি করা হবে না।' তারপর তারা আমার বাঁধন খুলে তা'যীম-তাকরীমের সাথে জঙ্গলের কিনারে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে। সুবহানাল্লাহ! তারপর তোমরা আমাকে যখন সাগরে ফেলে দিলে, তখন সাগরের মাছগুলোও ছলাত-সালাম পাঠ করছিল। তারাও একইভাবে আমাকে সুসংবাদ শুনিয়ে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানার্থে আদবের সাথে নিরাপদে তীরে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে।” সুবহানাল্লাহ!

হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পরবর্তীতে দ্বীন ইসলাম কবুল করেন এবং হযরত ফারূকে আ'যম আলাইহিস সালাম উনার খিলাফতকালে জিহাদে শহীদ হন। সুবহানাল্লাহ! এখানে ফিকিরের বিষয় হলো, মাত্র একবার হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সংস্পর্শ মুবারকে আসার কারণে হযরত আকরামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি এতো সম্মানিত হয়ে গেলেন যে, বনের পশু, পানির মাছ এমনকি হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম সবাই উনার খিদমতের আঞ্জাম দিলেন। সুবহানাল্লাহ! এভাবে কায়িনাতের যত কিছুই উনার পূত পবিত্র সংস্পর্শ মুবারকে এসেছে সবকিছুই মর্যাদাবান বা সম্মানিত হয়ে গিয়েছে।

১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৪৮ ( মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় জানাজার ইতিহাস )

মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় জানাজার ইতিহাস-পর্ব-৪৮

মসজিদে নববী শরীফ ঝাড়ু দিতেন এক মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। তিনি এসেছিলেন আবিসিনিয়া থেকে। আবিসিনিয়া হচ্ছে আজকের ইথিওপিয়া। এর অধিবাসীদের বলা হতো হাবশী। সেখানে অনেক দুঃখ কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো হাবশী ক্রীতদাসদেরকে। দুর্বল মহিলা, শিশু, পুরুষদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হতো। কাফির বেদুইন মনিবরা তাদেরকে দাস-দাসী হিসেবে কিনে নিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করাতো, গোলামদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এই মহিলা ছাহাবী তিনি অনেক কষ্ট করে পবিত্র মদীনা শরীফে চলে আসেন। এখানে এসে দ্বীন ইসলাম উনার ছায়াতলে শান্তিময় পরিবেশে সম্মানের সাথে বসবাস করতে থাকেন।

উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি প্রতিদিনই উনাকে দেখতে পেতেন। প্রতিদিনই উনার পাশে বসতেন। আর শুনতে পেতেন ছড়ার মতন কয়েকটা লাইন তিনি নিয়মিত পড়ছেন - স্কার্ফের সেই দিনটি ছিল মাওলার এক বিস্ময়কর ইহসানের নমুনা, সেদিন আমায় তিনি বাঁচিয়েছিলেন অবিশ্বাসের আঁধার থেকে করেন আলোর সূচনা।

প্রতিদিন এই একই আবৃত্তি শুনতে পেয়ে উম্মুল মু'মিনীন হযরত ছিদ্দীক্বা আলাইহাস সালাম তিনি একদিন এর কারণ জানতে চাইলেন। তখন সেই মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বললেন:

"আমি ছিলাম একজন আবিসিনিয়ান ক্রীতদাসী, কুচকুচে কালো বর্ণের খুবই হালকা পাতলা গড়নের কৃষ্ণাঙ্গ একটা ছোট্ট মেয়ে। একটা বেদুইন আরব গোত্রে আমি ছিলাম এক আবদ্ধ দাসী। আমার কোনো সঙ্গী-সাথী ছিল না। ছিল না কোনো পারিবারিক বন্ধন। আমি শুধু মনিবের পরিবারের কাজ করতাম। আর তাদের সাথে সাথে ঘুরতাম এক জনপদ থেকে আরেক জনপদে। একদিন আমার মনিবের মেয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে এলো। তার গলায় একটা স্কার্ফ ছিল। এটাকে বলে 'উইশা'। উইশা হচ্ছে লাল রংয়ের চামড়ার একটা শাল যেটা গলায় বা কোমরে পেঁচিয়ে পরা যায়। সেটা ছিল

স্বর্ণ ও মূল্যবান পাথর খচিত। সে ঐ মূল্যবান স্কাফটা মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। তখন উপর থেকে এসে বড় একটা পাখি সেটা লাল বর্ণ হওয়ায় গোশত পিন্ড ভেবে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল।

ঘুম ভাঙার পর প্রিয় স্কার্ফটা না পেয়ে সে চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল এবং তার বাবার কাছে বিচার দিল ঘুমন্ত অবস্থায় কেউ এটা চুরি করেছে। স্বভাবতই দাসী হিসেবে সবার সন্দেহের চোখ আমার দিকে। আমি বললাম, গোশত পিন্ড ভেবে একটা পাখি ছোঁ মেরে ওটা নিয়ে গিয়েছে। তারা আমার কথা বিশ্বাস করলো না। তাদের ধারণা ছিল আমি ওটা চুরি করে লুকিয়ে রেখেছি।

আমার কোনো কথাই তারা বিশ্বাস করলো না। মারতে আরম্ভ করলো। চাবুকের আঘাতে আমার ছোট্ট পুরোটা দেহ রক্তাক্ত হয়ে গেল। আমি একটা শীর্ণকায় ছোট্ট মেয়ে ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদছি। কেউ একজন এগিয়ে এলো না আমার পাশে। শরীরের বিভিন্ন জায়গা চাবুকের আঘাতে কেটে রক্ত বেরিয়ে মরুভূমির বালি লাল হয়ে গিয়েছে। পুরোটা শরীর চাবুকের আঘাতে জখম। আমি তখন অসহ্য চিৎকারে আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদছি। ঠিক তখনি পাখিটা নেমে এলো। স্কার্ফটা ফেলে দিয়ে গেল আমার আর মনিবের মাঝখানে। চাবুক থেমে গেল। ভুল বুঝতে পেরে প্রচন্ড অনুশোচনায় মনিব আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দিল।

আমি তখন মুক্ত, স্বাধীন। শুনতে পেলাম মদীনাতে একজন মহান রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্যের দিকে মানুষকে ডাকছেন এবং উনার বেশীর ভাগ অনুসারী দরিদ্র, দূর্বল, ক্রীতদাস আর নির্যাতিত, পিছিয়ে থাকা সব সাধারণ মানুষ।

আমি ছুটলাম মদীনার পথে। অনেক লম্বা মরুভূমির পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম। চাবুকের আঘাত তখনও শুকায়নি। ছিন্ন বস্ত্র, শীর্ণ, ক্ষুধার্ত, কালো, সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত, এক খুব অসহায় ক্রীতদাসীকে চিনে নিতে কষ্ট হয়নি মহান রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার। আমি ঘোষণা দিলাম 'লা-ইলা-হা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।' আর মসজিদে নববী শরীফের ভিতরেই রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই অসহায়ের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।" সুবহানাল্লাহ!

এই মহিলা ছাহাবী উনার নাম উম্মে মাহজান রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। তিনি মসজিদে নববী শরীফ নিয়মিত ঝাড়ু দিতেন। রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিয়মিত সে মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার খোঁজ খবর রাখতেন। একদিন সারাদিনেও উনাকে দেখতে না পেয়ে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন উনার কথা জিজ্ঞাসা করলেন তখন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা জানালেন অসুস্থ হয়ে আগের রাতে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। রাত বেশী হওয়ায় রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ঘুম থেকে কেউ ডাকতে চায়নি। রাতেই দাফন করে দেয়া হয়েছে।

এটা জেনে রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুবই কষ্ট পেলেন। তখনই তিনি সে মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার কবরে গিয়ে বাকি ছাহাবীদের নিয়ে আবার জানাযা পড়লেন। সুবহানাল্লাহ! দ্বীন ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় জানাযা পড়ার ঘটনা এটাই প্রথম, যার সূচনা হয়েছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার জন্য। সুবহানাল্লাহ! এটাই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম, যা রসূলুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাদের জন্য নিয়ে এসেছেন।

১০০টি চমৎকার ঘটনা -পর্ব-৪৭ ( দীর্ঘ সাধনার ফসল )

দীর্ঘ সাধনার ফসল-পর্ব-৪৭

হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা উনার বয়স সম্পর্কে ইখতিলাফ ছিল। কেউ তিনশ, তিনশত পঞ্চাশ, আড়াইশ, দুইশ বছর পর্যন্ত বলেছেন। তিনি ছিলেন ইরানের এক মজুসীর সন্তান। কিন্তু তিনি সেই মজুসী ধর্ম ছেড়ে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসেল, নসিবাইন ইত্যাদি পর্যায়ক্রমে সফর করতে করতে, নানান পাদ্রীদের সাথে তিনি হক্ক তালাশে মশগুল ছিলেন। শেষ পাদ্রীর কাছে তিনি যখন ছিলেন, সেই পাদ্রী বললো, 'হে সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। আপনি এখন আর হক্ক পাত্রী পাবেন না, আপনি অপেক্ষা করুন। আখিরী নবী হুযুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আসবেন; উনার জন্য আপনি অপেক্ষা করতে থাকুন।' তিনি কোথায় আসবেন? সেই পাদ্রী কতগুলো লক্ষণ বলে দিল যে, উনার জন্ম হবে মক্কা শরীফের ওয়াদিউল কুরায়। আর তিনি হিজরত করবেন মদীনা শরীফ নামক এক জায়গায়, যেটা কঙ্করময় এবং খেজুর গাছে পরিপূর্ণ হবে। উনার পিঠ মুবারকে মোহরে নুবুওওয়াত থাকবে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন কিন্তু যাকাত, ছদকা, ফিতরা খাবেন না।

তারপর সেই পাদ্রী ইন্তেকাল করলো। হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফে আসার জন্য এক আরবীয় কাফেলার সাথে রওনা হলেন। রাস্তায় তারা চক্রান্ত করে উনাকে গোলাম হিসেবে বিক্রি করে ফেললো। তিনি এক ইহুদীর গোলাম হয়ে মদীনা শরীফ পৌঁছলেন। উনার বয়স তখন অনেক; তবুও তিনি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

একদিন তিনি খেজুর গাছের উপরে ছিলেন। গাছ পরিষ্কার করছিলেন। আর উনার ইহুদী মনিব ছিল সেই গাছের গোড়ায়। এমন সময় এক লোক এসে সংবাদ দিল যে, যিনি আখিরী নবী তিনি মদীনা শরীফে এসেছেন, উনার সাথে সাক্ষাৎ করা দরকার ইত্যাদি। এটা শুনে হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি খুব দ্রুত গাছের উপর থেকে নীচে নেমে আসলেন। উনার মনিবকে জিজ্ঞেস করলেন, 'লোকটা কি বললো?' মনিব উল্টো উনাকে আঘাত করলো এবং বললো, 'সেটা তোমার জানার বিষয় না। তুমি গোলাম, তুমি তোমার গোলামী করো।'

হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আর কিছু বললেন না। কিন্তু একদিন চুপি চুপি কিছু খেজুর নিয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দরবার শরীফে হাযির হলেন। বললেন, 'ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এটা আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।' মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নেয়ার জন্য হাত মুবারক বাড়ালেন। তখন হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, 'হুযূর! এটা ছদক্কা।' এটা শুনে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি

হাত মুবারক পিছিয়ে নিলেন। ছদক্কার হক্কদার ছাহাবী যাঁরা ছিলেন উনাদেরকে দিয়ে দিলেন এবং বললেন, 'আপনারা খেয়ে ফেলুন এটা আমার জন্য জায়েয নেই।'

হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আবার আরেকদিন কিছু খেজুর নিয়ে গেলেন। বললেন, 'হুযূর! এটা হাদিয়া। এটা আমার হালাল কামাই থেকে আপনার জন্য নিয়ে এসেছি।' মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেই খেজুর খেলেন এবং সবাইকে খাওয়ালেন।

দু'টি লক্ষণ মিলানো হলো, বাকি রইলো শুধু মোহরে নুবুওওয়াত মুবারক দেখা। দেখার সুযোগ পাওয়ার জন্য হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পিছনে পিছনে হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হটিতে লাগলেন। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শরীর মুবারকে ঐদিন একটি চাদর মুবারক ছিল। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জানতেন যে, হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মোহরে নুবুওওয়াত মুবারক দেখতে চান। তাই তিনি চাদর মুবারক সরিয়ে দিলেন। হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মোহরে নুবুওওয়াত মুবারক দেখলেন, চুম্বন করলেন। কোনো কোনো বর্ণনামতে আড়াইশ বছর অথবা তিনশ বছর, মতান্তরে পাঁচশো বছরের সাধনার পর, তিনি যে অবশেষে মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পেলেন, সেজন্য খুব কাঁদলেন। তারপরে বললেন, 'ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আজকে অনেকদিন হলো আমি আপনাকে পাওয়ার কোশেশ করছি। আমার সমস্ত আয়ু, ধন-সম্পদ, বাড়ী-ঘর, আত্মীয়-স্বজন সব আমি ত্যাগ করেছি, শুধুমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত হওয়ার জন্য, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হওয়ার জন্য। আজকে আমি আপনাকে পেয়েছি। আপনি দয়া করে আমাকে এখনই দ্বীন ইসলামে দাখিল করে নিন।'

মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে তওবা করালেন। তিনি মুসলমান হয়ে গেলেন। সুবহানাল্লাহ!

নছীহতে উম্মুল উমাম আলাইহাস সালাম -(১ম খণ্ড)১ম অংশ-সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের ফযীলত মুবারক-পর্ব-৬.১

সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের ফযীলত মুবারক-১ম অংশ-পর্ব-৬.১

১১ই ফিলরুদ শরীফ, ১৪৪১ হিজরী (ইয়াওমুল খমীস)

খলিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেন-

إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ٣٣) سورة الاحزاب

নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি চান হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সমস্ত প্রকার অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করার মতো পবিত্র করতে অর্থাৎ উনাদেরকে পবিত্র করার মতো পবিত্র করেই মহান আল্লাহ পাক তিনি সৃষ্টি করেছেন। সুবহানাল্লাহ! [সূরা আহযাব শরীফ: ৩৩]

এই আয়াত শরীফে মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের পবিত্রতার কথা ঘোষণা মুবারক করেছেন। আর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেছেন,

فَأَنَا وَأَهْلُ بَيْنِي مُطَهَّرُوْنَ مِنَ الذُّنُوبِ. (رواه ترمذی، طبرانی، بیهقی)

আমি এবং আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম, আমরা সকলেই যুনুব তথা সমস্ত প্রকার কবীরা-ছগীরা এবং যাবতীয় অপছন্দনীয় কাজ থেকে পূতপবিত্র। সুবহানাল্লাহ! [তিরমিযী, ত্ববারানী, বাইহাকী শরীফ]

উপরোক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীস শরীফ থেকে বুঝা যায় যে, হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা বেমেছাল পবিত্রতার অধিকারী। এখানে আরও ফিকিরের বিষয় হলো, হযরত নবী রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা হচ্ছেন মা'ছুম (নিষ্পাপ) ও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা হচ্ছেন মাহফুয (সংরক্ষিত) আর হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের শান মুবারক হলো মুত্বহহার-মুত্বহহির (পূতপবিত্র ও পবিত্রতা দানকারী)।

জানা আবশ্যক যে, সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা কারা? এ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

عَنْ حَضْرَتْ أُمِّ سَلَمَةَ عَلَيْهَا السَّلامُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَلَّلَ عَلَى الْحَسَنِ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَالْحُسَيْنِ عَلَيْهِ السَّلَامُ وَعَلِيّ عَلَيْهِ السَّلامُ وَفَاطِمَةَ عَلَيْهَا السَّلامُ كِسَاءٌ ، ثُمَّ قَالَ اللَّهُمَّ هُؤُلَاءِ أَهْلُ بَيْتِي وَخَاصَّتِيْ اِذْهَبْ عَنْهُمُ الرِّجْسَ وَطَهِّرْهُمْ تَطْهِيرًا ، فَقَالَتْ حَضْرَتْ أُمُّ سَلَمَةَ عَلَيْهَا السَّلَامُ وَأَنَا مَعَهُمْ يَا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَالَ : مَكَانُكِ إِنَّكِ إِلَيَّ خَيْرٌ. (رواه الترمذى، هذا حديث حسن صحيح)

হযরত উম্মুল মু'মিনীন আস সাদিসা আলাইহাস সালাম থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইমামুছ ছানী হযরত হাসান আলাইহিস সালাম উনাকে, ইমামুছ ছালিছ হযরত হুসাইন আলাইহিস সালাম উনাকে, ইমামুল আউওয়াল হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনাকে এবং হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম উনাকে একখানা চাদর মুবারকে আবৃত করে নিলেন। অতঃপর বললেন, আয় বারে ইলাহী! উনারা আমার সম্মানিত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম এবং আমার খাছ ব্যক্তিত্ব। উনাদের থেকে সব অপবিত্রতা দূর করুন এবং উনাদেরকে পবিত্র করার মত পবিত্র করুন। তখন উম্মুল মু'মিনীন হযরত আস সাদিসা আলাইহাস সালাম তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমিও উনাদের অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন, আপনার অবস্থান আমার নিকট আরও উত্তম। [তিরমিযী শরীফ]

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত রয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার সম্মানিত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা কারা? যে সমস্ত ব্যক্তিত্ব মুবারক উনাদের খিদমত মুবারক করা আমাদের জন্য আবশ্যক (ফরয-ওয়াজিব করা হয়েছে)। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম, হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম এবং উনার পূতপবিত্র সম্মানিত সন্তানদ্বয় আলাইহিমাস সালাম উনারা হলেন আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম। সুবহানাল্লাহ! [ত্ববারানী শরীফ]

বিশিষ্ট রাবী হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, হে যায়িদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিবার কারা? হযরত উম্মাহাতুল মু'মিনীন আলাইহিন্নাস সালামগণ কি উনার পরিবার নয়? তিনি বললেন, নিশ্চয়ই উনারা আহলু বাইত শরীফের অন্তর্ভুক্ত। উনার পরিবার হচ্ছেন, উনার বিছালী শান মুবারক প্রকাশের পর যাদের জন্য সদকা গ্রহণ করা হারাম। তিনি বললেন, উনারা কারা? তিনি বলেন, উনারা হচ্ছেন- হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম উনার বংশধর, হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম উনার বংশধর, হযরত জাফর আলাইহিস সালাম উনার বংশধর, হযরত আকীল আলাইহিস সালাম উনার বংশধর। তিনি বললেন, উনাদের সকলের জন্য কি সদকা গ্রহণ হারাম? তিনি বললেন, হ্যাঁ। [মুসনাদে আহমাদ, মুসলিম শরীফ]

উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম, হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম, হযরত জাফর আলাইহিস সালাম, হযরত আকীল আলাইহিস সালাম, হযরত হারিছ বিন আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম উনারাসহ উনাদের বংশধরগণও নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম তথা সম্মানিত পরিবার-পরিজন আলাইহিমুস সালাম। সুবহানাল্লাহ!

স্মর্তব্য যে, সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের স্তর হচ্ছে তিনটি।

১ম স্তরে রয়েছেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত হযরত ওয়ালিদাইন শরীফাইন তথা আব্বা ও আম্মা আলাইহিমাস সালাম।

২য় স্তরে রয়েছেন, সম্মানিতা হযরত উম্মাহাতুল মু'মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম।

৩য় স্তরে রয়েছেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত আবনা (পুত্র) আলাইহিমুস সালাম ও সম্মানিতা বানাত (কন্যা) আলাইহিন্নাস সালাম।

মূলত, এই তিন স্তরে যাঁরা রয়েছেন উনারা এবং উনাদের সম্মানিত আল-আওলাদ আলাইহিমুস সালাম সকলেই এবং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত পরিবারে যাঁরা ছিলেন প্রত্যেকেই সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের অন্তর্ভুক্ত।

উল্লেখ্য যে, শিয়াদের আক্বীদা হচ্ছে, সম্মানিত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা হচ্ছেন পাঁচ জন তথা পাক পাঞ্জাতন। উনারা হলেন- ১. নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ২. সাইয়্যিদাতু নিসায়ি আহলিল জান্নাহ আন নুরুর রবিয়া হযরত যাহরা আলাইহাস সালাম ৩. সাইয়্যিদুনা ইমামুল আউওয়াল হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম ৪. সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছানী আলাইহিস সালাম ৫. সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুছ ছালিছ আলাইহিস সালাম।

কিন্তু যারা সুন্নি দাবিদার উনারাও বছরের পর বছর ধরে এই সম্মানিত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র উপরোক্ত ৫ জন উনাদের ছানা-ছিফত মুবারক, সাওয়ানেহ উমরী মুবারকই আলোচনা করে আসছেন। আর অন্যান্য হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের বিষয়গুলো ছিল আলোচনার বাইরে। কিন্তু আমরা পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে দেখতে পাই মহান আল্লাহ পাক তিনি সূরা তওবা শরীফের ১২৮ নং আয়াত শরীফে ইরশাদ মুবারক করেন,

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوْفٌ رَّحِيمٌ (۱۲۸) سورة التوبة

তোমাদের কাছে তোমাদের জন্য একজন রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাশরীফ মুবারক এনেছেন। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট উনার জন্য বেদনাদায়ক। তিনি তোমাদের ভালাই চান। মু'মিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়ালু।

আর পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি রহমত মুবারক উনাকে একশত ভাগে বিভক্ত করেন। ৯৯ ভাগ রহমত মুবারক উনার নিকট রেখে বাকী ১ ভাগ রহমত মুবারককে আবার ১০০ ভাগে বিভক্ত করেন। আর সেখান থেকে ৯৯ ভাগ রহমত মুবারক নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হাদিয়া মুবারক করেন এবং ১ ভাগ রহমত মুবারক গোটা মাখলুকাতের মাঝে বন্টন করে দেন। [বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ]

ফিকিরের বিষয় হলো, একভাগ রহমত মুবারক সমস্ত মাখলুকাতের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে এক যাররা পরিমাণ রহমত মুবারক লাভ করার কারণে আমরা একে অপরকে মুহাব্বত করি। এমনকি এই মুহাব্বত মানুষ থেকে শুরু করে একটা ক্ষুদ্রতম প্রাণীর মাঝেও পরিলক্ষিত হয়। আমরা এই মুহাব্বতের কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একজন থেকে অপরজনকে আলাদা করতে পারিনা। তাহলে যিনি সমস্ত রহমত মুবারকের মালিক তিনি কিভাবে উনার পরিবারের একজন থেকে অপরজনকে আলাদা করে দেখতে পারেন! মূলত, এভাবে চিন্তা করাটাও উনার শান মুবারক উনার খিলাফ তথা কুফরী হবে। মূলত, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিবারের সকল সদস্যগণই সম্মানিত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফে অসংখ্যভাবে হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের ফাযায়িল ফযীলত গুরুত্ব তাৎপর্য সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (۵۶) سورة الاحزاب

নিশ্চয়ই খলিক মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি এবং সমস্ত হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করে থাকেন। কাজেই হে ঈমানদারগণ! তোমরাও উনার পবিত্রতম নূরানী শান মুবারকে দরূদ শরীফ পাঠ করো এবং সালাম দেয়ার যথার্থ নিয়মে সালাম দাও। [সূরা আহযাব শরীফ: ৫৬]

এই আয়াত শরীফের তাফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে-

বিশিষ্ট ছাহাবী হযরত কা'ব বিন উজরাতা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমরা কিভাবে আপনার মুবারক শানে দরূদ শরীফ পাঠ করবো? তখন সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সরাসরি উনাকে দরূদে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম পাঠ করে শুনিয়েছেন।

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى سَيِّدِنَا إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ سَيِّدِنَا إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى سَيِّدِنَا إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ سَيِّدِنَا إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ.

উল্লেখ্য যে, বর্ণিত 'দরূদে ইবরাহীম' শরীফ সাধারণভাবে পবিত্র নামাযের মধ্যেই পাঠ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাহলে এ থেকে বুঝা যায় যে, স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনিই পবিত্র নামাযের মধ্যে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাথে উনার সম্মানিত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস উনাদের শানেও দরূদ শরীফ পাঠ করার নির্দেশ মুবারক দিয়েছেন।

অর্থাৎ হযরত আহলু বাইত আলাইহিমুস সালাম উনাদের উপর দরূদ শরীফ পাঠ না করলে নামায পূর্ণরূপে আদায় হয় না। উনাদের প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করা ইবাদত এবং দোয়া পরিপূর্ণ ও কবুল হওয়ার প্রধান উসীলা। সুবহানাল্লাহ!

পবিত্র হাদীছ শরীফে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো ইরশাদ মুবারক করেন,

عَنْ حَضْرَتْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الْبَجَلِيِّ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَا وَأَهْلُ بَيْتِي شَجَرَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَأَغْصَانُهَا فِي الدِّيْنِ فَمَنْ تَمَسَّكَ دِيْنًا إِتَّخَذَ رَبَّهُ سَبِيلًا.

হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ আল বাযালী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি এবং আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম হলাম পবিত্র জান্নাত উনার একটি বৃক্ষ। পবিত্র দ্বীন ইসলাম হচ্ছে উহার শাখা। যে ব্যক্তি পবিত্র দ্বীনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরবে, সে ব্যক্তিই মহান আল্লাহ পাক উনাকে পাওয়ার সঠিক পথ পেয়ে যাবে। সুবহানাল্লাহ!

[তাফসীরে রুহুল বয়ান ৮/২৩৯, তাফসীরে হাক্কী ১৩/৭৯, তাফসীরে কবীর]

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ أَبِي ذَرٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ وَهُوَ أَخِذْ بِبَابِ الْكَعْبَةِ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ أَلَّا إِنَّ مَثَلَ أَهْلِ بَيْتِي فِيْكُمْ مَثَلُ سَفِينَةِ نُوحٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ مَنْ رَكِبَهَا نَجَا وَمَنْ تَخَلَّفَ عَنْهَا هَلَكَ رواه أحمد والحاكم والطبراني ومسند الشهاب وجامع الاحاديث وجمع الجوامع أو الجامع الكبير للسيوتي وكنز العمال)

হযরত আবু যর গিফারী রদ্বিয়াল্লাহ আনহু তিনি বর্ণনা করেন। আমি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বলতে শুনেছি, সাবধান! নিশ্চয়ই তোমাদের মাঝে আমার হযরত আহলু বাইত আলাইহিমুস সালাম উনাদের মেছাল হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনার কিশতী মুবারকের ন্যায়। যারা কিশতী মুবারকে আরোহণ করেছেন উনারা নাজাত লাভ করেছেন আর যারা আরোহণ করেনি তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। [আহমাদ শরীফ, তবারানী শরীফ]

অর্থাৎ যারা হযরত আহলু বাইত আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত করবে এবং উনাদের অনুসরণ করবে তারাই নাজাত লাভ করবে। সুবহানাল্লাহ! আর যারা হযরত আহলু বাইত আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত করবে না, উনাদের অনুসরণ করবে না তারা নাজাত লাভ করতে পারবে না। নাঊযুবিল্লাহ!

পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছেন, হযরত যায়িদ ইবনে আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, একবার নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফ উনাদের মধ্যবর্তী 'খোম' নামক পানির নালার নিকট দাঁড়িয়ে আমাদেরকে খুতবা মুবারক প্রদান করলেন। প্রথমে মহান আল্লাহ পাক উনার হামদ ও ছানা মুবারক বর্ণনা করলেন, এরপর নছীহত মুবারক করলেন। অতঃপর বললেন, "সাবধান! হে লোক সকল! নিশ্চয়ই আমি একজন নবী ও রসূল, অচিরেই আমার নিকট মহান আল্লাহ পাক উনার দূত (হযরত মালাকুল মউত আলাইহিস সালাম) আসবেন। তখন আমি আমার রব তায়ালা উনার পবিত্র আহবানে সাড়া দিব। আমি আপনাদের মাঝে দু'টি মূল্যবান নিয়ামত মুবারক রেখে যাচ্ছি। তন্মধ্যে প্রথম নিয়ামত মুবারক হলো- মহান আল্লাহ পাক উনার কিতাব। উনার মধ্যে রয়েছে পবিত্র হিদায়েত ও নূর। অতএব, আপনারা মহান আল্লাহ পাক উনার কিতাবকে খুব মজদ্ভুতভাবে আঁকড়ে ধরুন এবং দৃঢ়তার সাথে উনার বিধি-বিধান মেনে চলুন।" (বর্ণনাকারী বলেন,) মহান আল্লাহ পাক উনার কিতাব শরীফের নির্দেশনাবলী দৃঢ়ভাবে মেনে চলার জন্য তিনি খুব বেশি উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করলেন। অতঃপর বললেন, "দ্বিতীয় নিয়ামত মুবারক হলো- আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা। আমি আপনাদেরকে আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বিশেষভাবে সতর্ক তথা নছীহত করছি। আমি আপনাদেরকে আমার হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বিশেষভাবে সতর্ক তথা নছীহত করছি। [মুসলিম শরীফ]

অন্যত্র পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي حَجَّتِهِ يَوْمَ عَرَفَةَ وَهُوَ عَلَى نَاقَتِهِ الْقَصْوَاءِ يَخْطُبُ فَسَمِعْتُهُ يَقُوْلُ يَأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي تَرَكْتُ فِيْكُمْ مَا إِنْ أَخَذْتُمْ بِهِ لَنْ تَضِلُّوا كِتَابَ اللهِ وَعِتْرَتِي أَهْلَ بَيْتِي. (رواه ترمذى وابن ماجه والطبراني وجامع الاحاديث وجمع الجوامع أو الجامع الكبير للسيوتي وكنز العمال و الجامع الاصول من احاديث الرسول)

হযরত জাবির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হজ্জের সময় আরাফার দিন কাসওয়া নামক উষ্ট্রীর উপর আরোহণ করা অবস্থায় খুতবা দিতে দেখলাম। অতঃপর উনাকে বলতে শুনলাম, হে মানব জাতি। নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে এমন নিয়ামত রেখে যাচ্ছি; যা আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনো গোমরাহ হবে না। প্রথম হলো, মহান আল্লাহ পাক উনার কিতাব। আর দ্বিতীয় হলো, আমার সম্মানিত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম। সুবহানাল্লাহ! [তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, ত্ববারানী শরীফ ইত্যাদি]

অর্থাৎ আখেরী যামানার ফিতনা ফাসাদ থেকে নাজাত লাভের একমাত্র উপায় হলো হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা তথা অনুসরণ অনুকরণ করা, জীবনের সকল ক্ষেত্রে উনাদেরকে আদর্শ রূপে গ্রহণ করা। উনাদের অনুসরণ করতে হলে উনাদের সম্পর্কে জানতে হবে, আলোচনা করতে হবে। যে যাকে মুহাব্বত করে তার আলোচনাই অধিক করে। তাই উনাদের আলোচনা করলে, উনাদের আদর্শ মুবারক গ্রহণ করলেই উনাদের প্রতি মুহাব্বত বুঝা যাবে। অন্যথায় মুহাব্বত বুঝা যাবে না।

বলা হয়ে থাকে, মুহাব্বতে তিতাটাও মিষ্টি হয়ে যায়। কেউ যখন হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মুহাব্বত করবে তখন উনাদের আদর্শ মুবারকও পালন করতে ভালো লাগবে। আর উনাদের প্রতি মুহাব্বত না থাকলে অন্য দিকে রুজু হয়ে যাবে, ফলে উনাদের আদর্শ মুবারকও গ্রহণ করা হবে না। বর্তমান যামানায় দেখা যায়, মানুষ ফাসিক-ফুজ্জার, কাফির-মুশরিকদের আদর্শ নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত। মুসলমানগণ হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের আদর্শ মুবারক উনার অনুসরণ করা থেকে দূরে সরে গেছে। আসলে উনাদের মুহাব্বত ও অনুসরণের প্রতি গুরুত্ব বর্তমান যামানার নামসর্বস্ব মুসলমানদের অন্তরে নেই বলেই তাদের ঈমানী শক্তিও নেই। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ عَلِيَّ عَلَيْهِ السَّلَامُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أسَاسُ الْإِسْلَامِ حُبِّى وَحُبُّ أَهْلِ بَيْتِي. (رواه تاريخ دمشق وجامع الاحاديث وجمع الجوامع او الجامع الكبير للسيوتي وكنز العمال)

দ্বীন ইসলাম উনার মূল ভিত্তি-ই হলো নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারক। [তারীখে দামেশক, জামেউল আহাদীছ, জামিউল কাবীর লিস সুয়ূতী, কানযুল উম্মাল ইত্যাদি]

অন্যত্র ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ أَبِي لَيْلَى رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يُؤْمِنُ عَبْدٌ حَتَّى أَكُوْنَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ نَفْسِهِ وَأَهْلِي اَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَهْلِهِ وَ عِتْرَتِيْ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ عِتْرَتِهِ وَذَاتِي أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ ذَاتِهِ. (معجم الاوسط)

হযরত আবু লায়লা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত। কোনো বান্দা ততক্ষন পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষন পর্যন্ত না তার নফস থেকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ওয়া সাল্লাম উনাকে বেশি মুহাব্বত করতে পারবে এবং তার পরিবার থেকে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিবারকে অধিক মুহাব্বত করবে এবং তার বংশধর যারা আছে তাদের থেকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিবারকে অধিক মুহাব্বত করবে এবং উনার জাত বা সত্তা মুবারককে তার নিজের সত্তা থেকে থেকে বেশি মুহাব্বত করবে। [মু'জামুল আওসাত্ব]

এ থেকে প্রতিভাত হয় যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি মুবারক পেতে হলে এবং পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে হলে উনাকে আমাদের নিজ সত্তা, পরিবার, বংশধর থেকেও বেশি মুহাব্বত করার পাশাপাশি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকেও সর্বক্ষেত্রে অধিক মুহাব্বত করতে হবে। কেননা উনাদেরকে মুহাব্বত করা ব্যতীত নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাক্বীক্বী মুহাব্বত ও সন্তুষ্টি মুবারক হাছিল করা এবং মু'মিন হওয়া কখনোই সম্ভব হবে না। পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ عَلِي عَلَيْهِ السَّلَامُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَهْلُ بَيْتِي أَمَانٌ لِأَهْلِ الْأَرْضِ كَمَا أَنَّ النُّجُوْمَ أَمَانٌ لِأَهْلِ السَّمَاءِ فَوَيْلٌ لِمَنْ خَذَلَهُمْ وَعَانَدَهُمْ.

সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা হচ্ছেন সমস্ত যমীনবাসীর জন্য নিরাপত্তাদানকারী যেমন তারকারাজিরা আসমানবাসীর জন্য নিরাপত্তাদানকারী। সুবহানাল্লাহ! সুতরাং যারা আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের থেকে দূরে সরে যাবে, মানহানী করবে এবং উনাদের বিরোধিতা করবে, তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। নাউযুবিল্লাহ! [তারতীবুল আমালী ১/২০০, আল ঈমা ৫/১৭৮] অপর বর্ণনায় রয়েছে,

النُّجُومُ أَمَانٌ لِأَهْلِ السَّمَاءِ وَأَهْلُ بَيْتِيْ آمَانٌ لِأَهْلِ الْأَرْضِ فَإِذَا ذَهَبَ أَهْلُ بَيْتِي ذَهَبَ أَهْلُ الْأَرْضِ.

তারকারাজিরা আসমানবাসীর জন্য নিরাপত্তাদানকারী। আর আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা হচ্ছেন যমীনবাসীর জন্য নিরাপত্তাদানকারী। যখন আমার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা বিদায় নিবেন, তখন সমস্ত যমীনবাসী সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

[ফাদ্বায়িলুছ ছাহাবাহ ২/৬৭১, আছ ছওয়ায়িকুল মুহরিক্কহ ২/৬৭৫, আল মু'জাম ১/৪০৪, মিরক্কাত শরীফ ৯/৩৯৮৮, যাখায়িরুল 'উকবাহ ১/১৭, সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ ১১/৭]

প্রকৃতপক্ষে সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা হচ্ছেন তারকারাজিসহ আসমানবাসী-যমীনবাসী, সমস্ত কুল কায়িনাতের জন্য নিরাপত্তাদানকারী। সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের উসীলায় ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত কায়িনাতবাসী নিরাপত্তা লাভ করবে। সুবহানাল্লাহ! উক্ত হাদীছ শরীফ হতে আরো বুঝা যায় যে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত সবসময় দুনিয়ার যমীনে সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা অবস্থান মুবারক করবেন। আর উনাদের সম্মানার্থেই ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত কায়িনাত টিকে থাকবে। অতঃপর যখনই উনারা দুনিয়ার যমীন থেকে বিদায় নিবেন, তখনই সমস্ত কায়িনাত ধ্বংস হয়ে যাবে। পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

اجْعَلُوا أَهْلَ بَيْتِي مِنْكُمْ مَكَانَ الرَّأْسِ مِنَ الْجَسَدِ وَمَكَانَ الْعَيْنَيْنِ مِنَ الرَّأْسِ وَلَا يَهْتَدِى الرَّأْسِ إِلَّا بِالْعَيْنَيْنِ. (رواه البيهقي في شعب الايمان)

শরীর থেকে মাথার স্থান ও মাথা থেকে দুই চোখের স্থান যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন তোমরা আমার আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করো। যেমন দুই চোখ ব্যতীত মাথা সঠিক পথে চলতে পারে না। সুবহানাল্লাহ! [বাইহাক্বী শরীফ]

এভাবে আরো অসংখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ ও ক্বওল শরীফে হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুল খমিস মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,

إِنَّا أَهْلُ الْبَيْتِ لَا يُقَاسُ بِنَا أَحَدٌ مَنْ قَاسَ بِنَا أَحَدًا فَقَدْ كَفَرَ.

নিশ্চয়ই আমরা সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম। আমাদের সাথে অন্য কারো ক্বিয়াস বা তুলনা করা যাবে না। যে ব্যক্তি আমাদের সাথে অন্য কাউকে তুলনা করবে, সে কুফরী করবে।

অর্থাৎ উনারা হচ্ছেন আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ, উনাদের সাথে কারো তুলনা করা যায় না। সুবহানাল্লাহ! উনারাই হচ্ছেন মহান আল্লাহ পাক এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে হাছিল করার একমাত্র উসীলা বা মাধ্যম। উনারা ব্যতীত খলিব্ধ মালিক রব মহান আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে হাছিল করার দ্বিতীয় কোনো উসীলা বা মাধ্যম নেই। সুবহানাল্লাহ!

এ প্রসঙ্গে সাইয়্যিদুনা হযরত ইমামুস সাদিস মিন আহলি বাইতি রসূলিল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,

نَحْنُ أَلُ بَيْتِ رَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ (نَحْنُ أَهْلُ بَيْتِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) وَنَحْنُ الْوَسِيْلَةُ إِلَى اللَّهِ وَلَا وَسِيْلَةَ إِلَى اللَّهِ إِلَّا عَنْ غَيْرِ طَرِيْقِنَا أَوْ مِنْ سِوَانًا.

আমরা সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম। আমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে পাওয়ার একমাত্র উসীলা মুবারক। আমাদের পথ বা আমরা ব্যতীত মহান আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে পাওয়ার দ্বিতীয় কোনো উসীলা বা মাধ্যম নেই। সুবহানাল্লাহ! [শরহে আক্বাইদে ত্বহাবী]

মূলকথা হলো, হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত না করা পর্যন্ত কেউ হাক্বীক্বী মু'মিন হতে পারবে না। উনাদের মুহাব্বতই ঈমান। উনাদের মুহাব্বত ব্যতীত ঈমান পরিপূর্ণ হয় না। আর মুহাব্বত তখনই অন্তরে জাগ্রত হবে যখন সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সাওয়ানেহ উমরী বা জীবনী মুবারক সম্পর্কে জানা হবে, আলোচনা করা হবে। পবিত্র দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় উনাদের অসামান্য অবদান, অকল্পনীয় ত্যাগ তিতিক্ষার কথা স্মরণ হবে। ফিকির করলে দেখা যায়, কারো আলোচনা করতে করতে কিংবা শুনতে শুনতেও অন্তরে মুহাব্বত চলে আসে। আবার দেখা যায়, যে যাকে মুহাব্বত করে তার আলোচনাই সে বেশি করে। যত বেশি উনাদের আলোচনা করা হবে তত বেশি মুহাব্বত অন্তরে পয়দা হবে। তাই হাক্বীক্বী মু'মিন হতে হলে আমাদেরকে সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের জীবনী মুবারক সম্পর্কে বেশি বেশি আলোচনা করে, উনাদের সম্পর্কে জেনে সেই অনুযায়ী নিজেদের জীবনে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। উনাদের আদর্শ মুবারক নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে না পারলে কোনো কামিয়াবী থাকবে না। অত্যন্ত আফসোসের বিষয় হলো, মুসলমানদের গাফিলতির কারণে, দ্বীন থেকে সরে যাওয়ার কারণে, দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মহামূল্যবান ইতিহাস মুবারক গায়েব হয়ে গিয়েছে। কাফির মুশরিকরা হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের জীবন ইতিহাস গায়েব করে ফেলেছে কারণ তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম ও পবিত্র দ্বীন ইসলামের বিরোধীতা করা। কেননা মুসলমানগণ যদি উনাদের জীবন ইতিহাস জানে তাহলে উনাদের ঈমানী কুওওয়াত বৃদ্ধি পাবে। কোনোভাবেই যাতে মুসলমানদের ঈমানী কুওওয়াত বৃদ্ধি না পায় কাফির-মুশরিক, ইহুদীরা সুদূর অতীতকাল হতে সেই চেষ্টাই চালিয়ে এসেছে, এখনও তাদের এসব ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। তাদের ষড়যন্ত্র ও অনুসরণ থেকে মুসলিম উম্মাহকে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই পবিত্র হাদীছ শরীফ-এর কথা অনুযায়ী চলতে হবে।

পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ عَلَيْهِ السَّلَامُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَدِبُوا أَوْلَادَكُمْ عَلَى ثَلَاثِ خِصَالٍ حُبِّ نَبِيِّكُمْ وَحُبِّ أَهْلِ بَيْتِهِ وَقِرَاءَةِ الْقُرْآنَ.

সাইয়্যিদুনা হযরত কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু আলাইহিস সালাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে তিনটি বিষয়ে যথাযথ শিক্ষা প্রদান করো।

১. তোমাদের যিনি নবী নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত মুহাব্বত মুবারক,

২. উনার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহাব্বত মুবারক এবং

৩. পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত। সুবহানাল্লাহ!

[আল ফাতহুল কাবীর লিস সুয়ূত্বী ১/৫৭, জামিউল আহাদীছ লিস সুয়ূত্বী ২/৮৯, দায়লামী শরীফ ইত্যাদি]

এই পবিত্র হাদীছ শরীফে স্বয়ং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি প্রত্যেক পিতা-মাতার উপর স্বীয় সন্তানদেরকে তিনটি বিষয় শিক্ষা দেয়া ফরয করে দিয়েছেন। এখানে প্রথমেই নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত মুহাব্বত মুবারক শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তারপর উনার সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্মানিত মুহাব্বত মুবারক শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আর সর্বশেষ বলা হয়েছে পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়ার কথা। সুবহানাল্লাহ!

প্রথমোক্ত দুইটি বিষয় হচ্ছে সরাসরি সম্মানিত ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত। আর শেষোক্ত বিষয়টি আমলের সাথে সম্পৃক্ত। প্রথমোক্ত দুইটি বিষয় শিক্ষার মাধ্যমে ঈমান লাভ হবে। আর শেষোক্ত বিষয়টি শিক্ষার মাধ্যমে আমল সুন্দর হবে। সুবহানাল্লাহ!

সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কারো ঈমান পরিশুদ্ধ না থাকলে নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতসহ সমস্ত আমলই বরবাদ হয়ে যাবে। আর ঈমান ঠিক থাকলে, আমলে কিছু ত্রুটি থাকলেও সে এক সময় নাজাত পাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর যেহেতু সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনারা ঈমানের মূল; তাই কারো অন্তরে যদি উনাদের মুহাব্বত মুবারক থাকে, নিঃসন্দেহে সে নাজাত পাবে। যদিও তার আমলে কিছু ত্রুটি থাকুক না কেন। সুবহানাল্লাহ!

কাজেই উনাদের মুহাব্বত ও অনুসরণের জন্য উনাদের জীবনী মুবারক সম্পর্কে জানা জরুরী। অন্যথায় উনাদেরকে মুহাব্বত করা আদৌ সম্ভব নয়। সুতরাং প্রত্যেক পিতা-মাতার জন্য ফরয ওয়াজিব হচ্ছে সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সাওয়ানেহ উমরী মুবারক এবং বেমেছাল ফাযায়িল-ফযীলত, বুযুর্গী-সম্মান মুবারক সম্পর্কে নিজেরা শিক্ষা গ্রহণ করে স্বীয় সন্তানদেরকে শিক্ষা দেয়া এবং এর পাশাপাশি সম্মানিত হযরত আহলু বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের সাওয়ানেহ উমরী মুবারক পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দাবী জানানো।




















নছীহতে উম্মুল উমাম আলাইহাস সালাম -(১ম খণ্ড)নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান এনে উনার আনুগত্য করা ফরয-পর্ব-৫

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান এনে উনার আনুগত্য করা ফরয-পর্ব-৫

মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا ﴿۲۵﴾ وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا ﴿٢٦﴾ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ بِأَنَّ لَهُمْ مِّنَ اللَّهِ فَضْلًا كَبِيرًا (٢٧) سورة الاحزاب

হে নবী পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি আপনাকে উপস্থিত বা হাযির-নাযির, সুসংবাদ প্রদানকারী, সতর্ককারী এবং মহান আল্লাহ পাক উনার হুকুমে উনার দিকে আহবানকারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ রূপে প্রেরণ করেছি। আপনি মু'মিনদেরকে এ বিষয়ে সুসংবাদ প্রদান করুন যে, (আপনি) উনাদের জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে বিরাট অনুগ্রহ। [সূরা আহযাব শরীফ: ৪৫-৪৭]

আর পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ رَبِيعَةَ الْجُرَشِيِّ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقِيلَ لَهُ لِتَنَّمْ عَيْنُكَ وَلِتَسْمَعْ أُذُنُكَ وَلِيَعْقِلْ قَلْبُكَ قَالَ فَنَامَتْ عَيْنَى وَ سَمِعَتْ أَذْنَايَ وَعَقَلَ قَلْبِي قَالَ فَقِيْلَ لِي سَيِّدٌ بَنَى دَارًا فَصَنَعَ فِيْهَا مَأْدُبَةً وَأَرْسَلَ دَاعِيًا فَمَنْ أَجَابَ الدَّاعِيَ دَخَلَ الدَّارَ وَأَكَلَ

مِنَ الْمَأْدُبَةِ وَرَضِيَ عَنْهُ السَّيِّدُ وَمَنْ لَمْ يُجِبِ الدَّاعِيَ لَمْ يَدْخُلِ الدَّارَ وَلَمْ يَأْكُلْ مِنَ الْمَأْدُبَةِ وَسَخَطَ عَلَيْهِ السَّيِّدُ قَالَ فَاللَّهُ السَّيِّدُ وَ مُحَمَّدٌ النَّاعِي وَالدَّارُ الْإِسْلَامُ وَالْمَأْدُبَةُ الْجَنَّةُ. (رواه الدارمي)

হযরত রবিয়াতাল জুরাশি রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কতিপয় হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট আসলেন। অতঃপর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো, আপনার চোখ মুবারক যেন ঘুমিয়ে থাকেন, আপনার কান মুবারক যেন শুনতে থাকেন, আপনার অন্তর মুবারক যেন বুঝতে থাকেন। তিনি বললেন, অতঃপর আমার চক্ষু মুবারক ঘুমিয়ে রইলেন, আমার কর্ণদ্বয় মুবারক শুনতে থাকলেন এবং আমার অন্তর মুবারক উপলব্ধি করতে থাকলেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, আমাকে বলা হলো, একজন সাইয়্যিদ (বাড়ির মালিক) তিনি একটি বাড়ি তৈরী করলেন। সেখানে তিনি খাবারের আয়োজন করলেন এবং একজন আহবানকারী প্রেরণ করলেন। অতঃপর যে ব্যক্তি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিবে, সেই ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করবে এবং খাদ্য খাবে এবং যিনি সাইয়্যিদ (বাড়ির মালিক) তিনি তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন। আর যে ব্যক্তি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিবে না, সে ব্যক্তি ঘরে প্রবেশ করবে না এবং খাদ্যও খাবে না। সাইয়্যিদ তিনি তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন না। অতঃপর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি হচ্ছেন "সাইয়্যিদ", আর নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হচ্ছেন "আহবানকারী”, এবং ঘর হচ্ছে 'ইসলাম', আর খাবার হচ্ছে "জান্নাত”। সুবহানাল্লাহ! [দারিমী শরীফ]

উপরোক্ত আয়াত শরীফ এবং হাদীছ শরীফ দ্বারা যে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ মুবারকেই সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার দিকে আহবানকারী। যারা উনার সম্মানিত দাওয়াত মুবারক গ্রহণ করে পরিপূর্ণভাবে সম্মানিত দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে প্রবেশ করবেন, উনারাই জান্নাত উনার মধ্যে প্রবেশ করে জান্নাতী নিয়ামত মুবারক ভোগ করতে পারবেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুগত্য করাই হলো, মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন উনার আনুগত্য করা। সুবহানাল্লাহ! কেননা মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

مَنْ يُطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيْظًا (۸۰) سورة النساء

যে ব্যক্তি রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুগত্য করল, সে মূলতঃ মহান আল্লাহ পাক উনারই আনুগত্য করল। আর যারা (আনুগত্য করা থেকে) ফিরে যাবে, আমি আপনাকে তাদের হিফাযতকারী হিসেবে পাঠাইনি। [সূরা নিসা শরীফ: ৮০]

অর্থাৎ যারা আনুগত্য না করে ফিরে যাবে তাদের কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করা হবেনা। প্রসঙ্গত, পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে কয়েকজন লোক আসলেন, তিনি উনাদেরকে এক আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিলেন, (অতঃপর তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন)

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَتَدْرُوْنَ الْإِيْمَانُ بِاللَّهِ وَحْدَهُ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ شَهَادَةُ إِلَّا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. (متفق عليه)

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি জানেন, এক আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান কি? (হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম) উনারা বললেন, মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারাই সর্বাধিক জ্ঞাত। তখন নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, এক আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান হচ্ছে সাক্ষ্য দেয়া যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। [বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ]

অতএব, কেউ যদি শুধু "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ" বলে তাহলে এক আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনা শুদ্ধ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত "মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)" না বলবে। অনুরূপভাবে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুগত্য করা ব্যতীত মহান আল্লাহ পাক উনার প্রকৃত আনুগত্য করাও হবে না।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ تَعَالَى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِيَدِهِ لَا يَسْمَعُ بِيْ أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِي وَلَا نَصْرَانِي ثُمَّ يَمُوْتُ وَلَمْ يُؤْمِنُ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ. (رواه مسلم)

হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, কসম। ঐ মহান আল্লাহ পাক উনার, যার কুদরতি হাত মুবারকে আমার প্রাণ মুবারক রয়েছে। এই উম্মতের যে কেউ হোক অথবা ইহুদী অথবা নাছারা যেই আমার কথা শুনে অতঃপর আমি যা নিয়ে এসেছি সে বিষয়ের প্রতি ঈমান না এনে মারা যায়; সে অবশ্যই জাহান্নামী হবে। নাউযুবিল্লাহ! [মুসলিম শরীফ]

মূলত, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান আনা এবং উনাকে মুহাব্বত করে উনার আনুগত্য করা ব্যতীত কেউ মু'মিনে কামিল হতে পারবে না।

এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,

عَنْ حَضْرَتْ أَنَسٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ. (متفق عليه)

হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাকে তার নিজের পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এমনকি সমস্ত মানুষ হতে অধিক মুহাব্বত না করবে। [বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ]

অপরদিকে যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে রসূল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট থাকবে অর্থাৎ উনার আনীত দ্বীন ইসলাম উনার পরিপূর্ণ অনুসরণ করবে, সেই ব্যক্তিই ঈমান উনার স্বাদ লাভ করবে অর্থাৎ সে ব্যক্তিই মু'মিনে কামিল হতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,

عَنِ الْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ عَلَيْهِ السَّلَامُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاقَ طَعْمَ الْإِيْمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَسُوْلًا . (رواه مسلم)

হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, ঐ ব্যক্তিই ঈমান উনার স্বাদ পেয়েছে; যে ব্যক্তি মহান রব্বুল আলামীন উনাকে রব হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট রয়েছে, সম্মানিত ইসলাম উনাকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট রয়েছে এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে রসূল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট রয়েছে।

[মুসলিম শরীফ]

উল্লেখ্য, যখন বলা হবে, 'মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের প্রতি ঈমান আনলাম বা উনাদেরকে বিশ্বাস করলাম' তখন মহান আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের প্রতিটি বিষয় বিনা চু-চেরায় মেনে নিতে হবে এবং সে বিষয়গুলোর উপর আমল করতে হবে। কেননা, মানুষ যখন কাউকে বিশ্বাস করে তখন (যাকে বিশ্বাস করে) সে ব্যক্তি যা বলে, সেটাই সে বিশ্বাস করে মেনে নেয়। যে বিষয় থেকে নিষেধ করে, সে বিষয় থেকে বিরত থাকে। সুতরাং যারা মহান আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে বিশ্বাস করবেন, উনারা মহান আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের তর্জ-তরীক্বা মুবারক ব্যতীত অন্য কারো তর্জ-তরীক্কা গ্রহণ করবেন না।

সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের উভয়ের প্রতি ঈমান এনে উনাদের অনুসরণ করবে সে ইহকাল ও পরকালে ফায়দা লাভ করবে। আর যে উনাদের মধ্যে একজনকে অস্বীকার করবে, সে কুফরী করবে, ফলে তাকে জাহান্নামের আযাব ভোগ করতে হবে। নাউযুবিল্লাহ!

কুফরীর শাস্তি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি সূরা কাহাফ শরীফ-এর ২৯ নং আয়াত শরীফে ইরশাদ মুবারক করেন,

وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا ، وَإِنْ يَسْتَغِيْثُوْا يُغَاثُوْا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ ، بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا (٢٩) سورة الكهف

আপনি বলুন, সত্য তোমাদের রব মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে সুতরাং যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছা সে কুফরী করুক। নিশ্চয়ই আমি যালিমদের জন্য জাহান্নামের আগুন প্রস্তুত করে রেখেছি। তাদেরকে আগুনের তাবু বেষ্টন করে নিবে। যখন তারা পানি চাবে, তাদেরকে (শাস্তির কারণে তাদের শরীর থেকে নির্গত) গলিত পুঁজের ন্যায় পানি দেয়া হবে। যা তাদের চেহারাকে জ্বালিয়ে দিবে। কতইনা নিকৃষ্ট পানীয় এবং কতইনা নিকৃষ্ট আবাসস্থল!

অর্থাৎ যারা কুফরী করবে, তারাই যালিম সাব্যস্ত হবে। তাদের জন্য থাকবে জাহান্নামে আগুনের তাবু। যখন তারা পানি চাবে, তখন আযাবের কারণে তাদের শরীর থেকে নির্গত গলিত পুঁজের ন্যায় পানি তাদেরকে দেয়া হবে। যা তাদের চেহারাকে জ্বালিয়ে দিবে। নাঊযুবিল্লাহ!

আর মু'মিনদের প্রতিদান সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেন,

بَشِّرِ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ (۲۵) سورة البقرة

আপনি উনাদেরকে সুসংবাদ প্রদান করুন যারা ঈমান এনেছেন এবং আমলে ছলেহ করেছেন। নিশ্চয়ই তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত যার নিম্নদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হয়। [সূরা বাক্কারা শরীফ: ২৫]

কাজেই, সমস্ত উম্মাহর জন্য ফরয-ওয়াজিব হচ্ছে মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন এবং উনার রসূল নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা ব্যতীত যা কিছু রয়েছে সবকিছুর মুহাব্বত ত্যাগ করে একমাত্র মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের প্রতি হাক্বীক্বীভাবে ঈমান এনে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিপূর্ণ আনুগত্য করা। তাহলেই হাক্বীক্বী মু'মিন হওয়া এবং দুনিয়া ও আখিরাতে খায়ের-বরকত, সম্মান-ইজ্জত, মুহাব্বত-মা'রিফত, কুরবত, সন্তুষ্টি-রেযামন্দি মুবারক হাছিল করা সম্ভব হবে। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের সকলকে মু'মিনে কামিল হওয়ার তাওফীক দান করুন। (আমীন)