২৩৭ নং- প্রশ্নঃ- খুৎবার সময় যে আযান দেয়া হয়, সে আযানের জবাব কি শুধু ইমাম সাহেবই দিবেন, নাকি মুসল্লিগণকেও দিতে হবে? জবাব দেয়া কি জরুরী নয়”


সুওয়াল: মাসিক মদিনা নভেম্বর-১৯৯৪ সংখ্যায় নিম্নলিখিত প্রশ্নোত্তর ছাপা হয়-
প্রশ্নঃ- খুৎবার সময় যে আযান দেয়া হয়, সে আযানের জবাব কি শুধু ইমাম সাহেবই দিবেন, নাকি মুসল্লিগণকেও দিতে হবে? জবাব দেয়া কি জরুরী নয়  
উত্তর (মদীনা পত্রিকা): ইমাম যখন খুৎবার জন্য মিম্বরে আরোহন করেন, তখন থেকে খুৎবা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন কথাবার্তা বলা এমনকি  নামায পড়াও জায়েয নয়। একই কারণে আযানের জবাব দেয়া, খুৎবার মধ্যে হযরত নবী করীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক উচ্চারিত হতে শুনলে শব্দ করে দরূদ শরীফ পড়া ইত্যাদি কিছুই জায়েয নয়।         
মাসিক মদীনা পত্রিকার এ উত্তর শুদ্ধ হয়েছে কি?
জাওয়াব: মাসিক মদীনা পত্রিকার উল্লিখিত উত্তর শুদ্ধ হয়নি। জুমুয়ার দিন ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া জায়েয, যার স্বপক্ষে বহু নির্ভরযোগ্য দলীলসমূহ রয়েছে। নিম্নে তার অকাট্য ও নির্ভরযোগ্য দলীলসমূহ পেশ করা হলো-      এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن ابى امامة قال سمعت معاوية بن ابى سفيان رضى الله عنهما- وهو جالس على المنبر اذن المؤذن فقال الله اكبر، الله الكبر- الخ- فلما ان قضى التأذين- قال يا ايها الناس انى سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم على هذا المجلس حين اذن المؤذن بقول ماسمعتم منى من مقالتى. (بخارى شريف، نسائ شريف)
অর্থঃ- হযরত আবূ উমামাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আমি শুনেছি ছাহাবী হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি জুমুয়ার দিন মিম্বরের উপর বসে মুয়াজ্জিনের আযানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আযানের শব্দসমূহকে উচ্চারণ করেন এবং আযান শেষে বলেন, হে লোক সকল! আমি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জুমুয়ার দিন মিম্বরে বসা অবস্থায় মুয়াজ্জিনের  আযান শ্রবণে এরূপ বলতে শুনেছি, যেরূপ তোমরা আমার থেকে শুনতে পেলে।(বুখারী শরীফ, নাসাঈ শরীফ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে-
قال النبيى صلى الله عليه وسلم- من قال مين يسمع الاذان والاقامة اللهم ربهذه الدعة الخ. حلت له شفاعتى يوم القيامة. (بخارى شريف)
অর্থঃ- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আযান ও ইক্বামত শ্রবণ করে, আল্লাহুম্মা রব্বা হাজিহিদ্ দাওয়্যাতি ..... এ দোয়া পাঠ করবে, তার জন্য ক্বিয়ামতের দিন আমি শুপারিশ করবো।(বুখারী শরীফ)          ওমদাতুর রিওয়াইয়্যাহ কিতাবে উল্লেখ আছে, ছানী আযানের পর দোয়া করা যাবে কিন্তু ইমাম সাহেব খুৎবা শুরু করার পূর্বে দোয়া করতে হবে।          কেউ কেউ নিম্নোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা ছানী আযানের পর দোয়া করা নাজায়েয বলে থাকেন।     পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
  اذاخرج الامام ضلا صلوة ولا كلام. (طبرانى شريف)
অর্থঃ- ইমাম ছাহেব যখন (খুৎবার জন্য) বের হয়, তখন নামায পড়া ও কথা বলা নিষেধ। (তিবরানী শরীফ)     অথচ উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় ছাহেবাইন অর্থাৎ হযরত ইমাম আবূ ইউসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন- ইমাম ছাহেব হুজরা (রুম) হতে বের হলে  নামায পড়া নিষেধ, কিন্তু খুৎবা শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত (দ্বীনি) কথা বলা জায়েয।(আলমগীরী, কাফী, সিরাজুল ওয়াহহাজ্, তাহতাবী)
এ প্রসঙ্গে হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুয়াত্তা শরীফ কিতাব উনার মধ্যে উল্লেখ করেন, হযরত ইবনে শিহাব জুহুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন-
  خروج الامام يقطع الصلوة وخطبته يقطع الكلام.
অর্থঃ- ইমাম ছাহেবে উনার আগমন নামাযকে বন্ধ করে দেয়, আর উনার খুৎবা কথা-বার্তাকে বন্ধ করে দেয়।অর্থাৎ ইমাম ছাহেব যখন খুৎবার জন্য হুজরা (রুম) হতে বের হবেন, তখন নামায (সুন্নত বা নফল) পড়া নিষেধ। আর যখন খুৎবা শুরু করে দিবেন, তখন নামাযের সাথে সাথে কথা-বার্তা বলাও নিষেধ। কাজেই খুৎবা শুরু করার পূর্বে দোয়া-দুরূদ, তাসবীহ্-তাহ্লীল ও দ্বীনী কথা-বার্তা বলা জায়েয।
মূলতঃ জুমুয়ার ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া এবং ছানী আযানের পর দোয়া করা বা পড়া সম্পর্কে আইম্মায়ে মুজতাহিদগণ উনাদের মধ্যে ইখতিলাফ (মত বিরোধ) রয়েছে। হযরত ইমামে আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে মাকরূহ্ তানযীহী। কিন্তু সাহেবাইন রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে মুস্তাহাব। (হেদায়া, নূরুদ্ দেরায়া, নুরুল হিদায়া, ইনায়া, নিহায়া, ইমদাদুল মুফতীন, মায়ারেফে মাদানিয়া) তবে         সহীহ্ ক্বওল মতে হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকটও ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও দোয়া পড়া মাকরূহ্ নয়।
যেমন এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয়-
  واما قبل الشروع بعد صعوده على المنبر قيكره الكلام الدنيوى اتفاقا- واما الكلام الدينى كا لتسبيح والتهليل فلا يكره عندهما- وروى بعض المشائخ عنه انه بكره والاصح انه لا يكره عنده ايضاسرحيه فى النهاية وغيره- فعلى هذا لا يكره اجابة اذان الثانى ودعاء الوسيلة بعده مالم يشرغ الامام فى الخطبة وقد ثبت ذلك من فعل معاوية رضى الله عنه فى الصحيح البخارى- حاشيهء هذاية، وهكذا فى النهايه، وحاشيهء شرح وقايه)
অর্থঃ- ইমাম ছাহেব মিম্বরে উঠে খুৎবা পাঠ শুরু করার পূর্বে দুনিয়াবী (পার্থিব) কথা-বার্তা বলা সর্ব সম্মতিক্রমে মাকরূহ্। আর হযরত ইমাম আবূ ইউসূফ  রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইমাম মুহম্মদ  রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে দ্বীনী কথা-বার্তা যেমন, তাসবীহ-তাহ্লীল, দোয়া-দুরূদ পাঠ করা মাকরূহ্ নয়। কোন কোন মাশায়েখ বর্ণনা করেন যে, ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট জুমুয়ার ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া মাকরূহ্। তবে অধিক সহীহ্ মত হলো- ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকটও ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া মাকরূহ্ নয়।এ ব্যাপারে নেহায়া ও অন্যান্য কিতাবে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া ও খুৎবা শুরু করার পূর্বে আযানের দোয়া পড়া মাকরূহ্ নয়। (বরং জায়েয) আর এটা সহীহ্ বুখারী শরীফ উনার মধ্যে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আমল দ্বারাও প্রমাণিত হয়। এরূপ শরহে বেকায়ার হাশীয়াতেও উল্লেখ আছে। (হাশিয়ায়ে হেদায়া, নেহায়া, শরহে বেকায়া) এবং বুখারী শরীফ উনার মধ্যে হযরত আবূ উমামাহ্  রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ হতে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আমল দ্বারা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, ছানী আযানের পর দ্বীনী কথা-বার্তা যেমন : দোয়া-দুরূদ, তাসবীহ্-তাহ্লীল, মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়া জায়েয, তবে তা খুৎবা শুরু করার পূর্বে হতে হবে। সুতরাং ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া  জায়েয প্রমাণিত হয়। আর ছানী আযানের পর খুৎবা শুরু করার পূর্বে যদি দ্বীনী কথা-বার্তা বলা নিষেধ বা নাজায়েয হতো, তবে হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি আযানের পর কথা বলতেন না। আর তাই বুখারী শরীফ উনার শরাহ্ আইনী কিতাবে উল্লেখ করা হয়-
  مما يستفاد، منه تعلم العلم وتعليمه من الامام وهو على المنبر وفيه اجابة الخطيب للمؤذن وهو على المنبر وفيه قول المجيب وانا كذالك وظاهره ان هذا المقداريكفى لكن الا ولى ان يقول مثل قول المؤذن. (عينى شرح بخارى)
অর্থঃ- উল্লেখিত (হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার আযানের পর কথা বলা সংক্রান্ত) পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা (নিম্নলিখিত) বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যায় যে, (১) খতীব ছাহেব মিম্বরে থাকা অবস্থায় মুক্তাদীগণ উনাদেরকে কোন মাসয়ালা-মাসায়েল শিক্ষা দেয়া, (২) মুক্তাদীগণ কোন মাসয়ালা শিক্ষা করা, (৩) মুয়াজ্জিনের আযানে (আমি এরূপ বলছি) শ্রোতাদের জবাব দেয়া জায়েয। প্রকাশ থাকে যে, ঐভাবে সংক্ষেপে জবাব দিলেও চলবে, তবে পরিপূর্ণ জবাব দেয়াই উত্তম। (আইনী শরহে বুখারী)
          উপরোক্ত কিতাবের ইবারত দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, ছানী আযানের জবাব দেওয়া ও দোয়া পড়া জায়েয। সুতরাং জুমুয়ার দিন ছানী আযানের জাওয়াব দেয়া এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক শুনে দরূদ শরীফ পড়া জায়েয। শুধু তাই নয়, ছানী  আযানের জাওয়াব দেয়ার সাথে সাথে আযানের পর খুৎবা শুরু করার পূর্বে হাত উঠায়ে মুনাজাত করাও জায়েয। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ১৮তম সংখ্যা পড়ে দেখুন। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাব হতে মোট ২৮টি দলীল দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, ছানী  আযানের জাওয়াব দেয়া ও হাত উঠায়ে মুনাজাত করা জায়েয।
 আবা-১৯

0 Comments: