৬৩৩ নং- সুওয়াল : মাওলানা ইলিয়াছ ছাহেবের “মালফূযাত” সহ আরো কিছু কিতাবে লেখা আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা, যা সকল দ্বীনী আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল তরীক্বা আর হতে পারেনা। এখন আমার জানার বা বুঝার বিষয় হচ্ছে- আসলেই কি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত শ্রেষ্ঠ ও উত্তম পথ? শরীয়তের দৃষ্টিতে তার ফায়সালা কামনা করি।


সুওয়াল : মাওলানা ইলিয়াছ ছাহেবের মালফূযাতসহ আরো কিছু কিতাবে লেখা আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা, যা সকল দ্বীনী আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল তরীক্বা আর হতে পারেনা। (হযরতজীর মলফুজাত-২৯ পৃষ্ঠা-২২, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব পৃষ্ঠা-৮৫, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন পৃষ্ঠা-৪৯ লেখক- ওবায়দুল হক, তাবলীগ জামায়াতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত ১ম খন্ড পৃষ্ঠা-৫৬, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা-২৯ লেখক- মৌলবী মুঃ ইব্রাহীম)
এখন আমার জানার বা বুঝার বিষয় হচ্ছে- আসলেই কি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত শ্রেষ্ঠ ও উত্তম পথ? শরীয়তের দৃষ্টিতে তার ফায়সালা কামনা করি।

জাওয়াব : তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা সম্পূর্ণই মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর, যা পূর্ববর্তী আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরো উল্লেখ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে যে দ্বীনী তালিম দেয়া হয়, তা পরিপূর্ণ দ্বীনী তালিম হতে নিতান্তই কম এবং সেটাকেই তারা পরিপূর্ণ ও যথেষ্ট মনে করে থাকে। অথচ দ্বীন ইসলাম ও তার শিক্ষা অত্যন্ত ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। যেমন পরিপূর্ণ দ্বীনী শিক্ষার বিষয় উল্লেখপূর্বক মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক ফরমান,
لقد من الله على المؤمنين اذبعث فيهم رسولا من اهفسهم يتلوا عليهم اياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة وان كانوا من قبل لفى ضلال مبن.             
অর্থ : মুমিনদের প্রতি মহান আল্লাহ পাক উনার ইহসান, তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি কিতাব শিক্ষা দিবেন, হিকমত শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে তাযকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন। যদিও তারা পূর্বে হিদায়েত প্রাপ্ত ছিলনা।  (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৬৪)
(তাফসীরে জালালাইন, কামালাইন, বায়যাবী, কুরতুবী, তাবারী, রুহুল মায়ানী, রহুল বয়ান, ইবনে কাছীর, আবী সউদ, মাযহারী, মাআরেফুল কুরআন, দুররে মানছুর)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে, পবিত্র আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করে শুনানো কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া হচ্ছে ইলমে জাহির বা ইলমে ফিক্বাহ ও হুনরের অন্তর্ভূক্ত। যা দ্বীনের যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজন। আর (তাযকিয়া) পরিশুদ্ধ ও সংশোধন করার দ্বারা ইলমে বাতিন বা ইলমে তাছাউফ উদ্দেশ্য। যার মাধ্যমে মানুষের ক্বালব বা আভ্যন্তরীণ দিক শুদ্ধ হয়। অনুরূপ পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ২৯ ও ১৫১নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে এবং পবিত্র সূরা জুমুয়া শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সমার্থবোধক আরো তিনখানা পবিত্র আয়াত শরীফ উল্লেখ রয়েছে। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, কবীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, দুররে মানছূর, আবী সউদ, রুহুল মায়ানী, তাবারী, মায়ারেফুল কুরআন ইত্যাদি)
মূলত : এ ক্বালব বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার শিক্ষাই হচ্ছে মূল শিক্ষা। কেননা ক্বালব শুদ্ধ না হলে মানুষের কোন ইবাদত-বন্দিগী, ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবুলযোগ্য নয়। ফলে সে পরকালে কোন ফায়দা বা উপকার ও হাছিল করতে পারবেনা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন-  
يوم لا ينفع مال ولا بنون الا من اتى الله بقلب مليم.
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন কেউ তার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা উপকার বা ফায়দা হাছিল করতে পারবেনা। একমাত্র ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে প্রশান্ত বা পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে।” (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮৮-৮৯)
আর অন্তর বা ক্বালব প্রশান্ত ও পরিশুদ্ধ হয় একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
الابذكر الله تطمئن القلوب.
অর্থ : সাবধান! মহান আল্লাহ তায়ালা উনার যিকিরের দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।” (পবিত্র সূরা রাদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৮)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে-
ان فى الجسد مضغة اذا صلحت صلح الجسد كله واذا فسدت فسد الجسد كله الا وهى القلب.
অর্থ : নিশ্চয়ই (মানুষের) শরীরে এক টুকরা গোশত রয়েছে। সেটা যদি পরিশুদ্ধ হয়, তবে গোটা শরীরই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর সেটা যদি বরবাদ হয়ে যায়, তবে গোটা শরীরই বরবাদ হয়ে যায়। সাবধান! সেই গোশতের টুকরাটির নাম হচ্ছে ক্বালব বা অন্তর।” (বোখারী শরীফ)
অর্থাৎ ক্বালব শুদ্ধ হলে মানুষের ঈমান-আক্বীদা, আমল-আখলাক্ব, সীরত-ছূরত সবকিছু শুদ্ধ হয়ে যায়। আর ক্বালব অশুদ্ধ বা বরবাদ হলে সবকিছুই বরবাদ হয়ে যায়। মূলতঃ তখন বান্দার কোন কিছুই মহান আল্লাহ পাক কবুল করেননা।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, অনন্য, শ্রেষ্ঠ, সম্মানিত ও প্রকৃত কামিয়াব তারাই, যাঁরা ইলমে ফিক্বাহের সাথে সাথে ইলমে তাসাউফ চর্চা করার মাধ্যমে নিজেদের ক্বালব বা অন্তর ইছলাহ বা পরিশুদ্ধ করেছে।
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে ক্বালব শুদ্ধকরণ ইলম বা ইলমে তাসাউফ ব্যতীত শুধুমাত্র যৎসামান্য ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কিভাবে দাবী করতে পারে যে, “প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা, যা সকল দ্বীনী আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মাণিত, যার থেকে ভাল তরীক্বা আর হতে পারেনা।মূলতঃ তাদের উপরোক্ত দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কল্পনা প্রসূত ও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ খিলাফ।
অপর পক্ষে শুদ্ধ ও সঠিক দাবী হলো তাদের, যারা উপরোল্লিখিত দুপ্রকার ইলম তথা ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফের যথার্থ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন পূর্বক দ্বীনের তালীম-তালক্বীন ও তাবলীগের কাজে নিয়োজিত। এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
العلم علمان علم فى القلب فذالك علم النافع علم على السان فذالك حجة الله عزوجل على ابن ادم.
অর্থ : ইলম দুপ্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইলম (ইলমে তাসাউফ) -যা উপকারী ইলম। অপরটি হচ্ছে- জবানী ইলম (ইলমে ফিক্বাহ) -যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার প্রতি  দলীল স্বরূপ।” (দারিমী, মেশকাত উেনারকাত আশায়াতুল লোময়াত, লোমায়াত)
এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় মালিকী মাযহাবের ইমাম, ইমামুদ দাহর, ফখরুদদ্দীন, শায়খুল মাশায়িখ, রাহনুমায়ে শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত, ইমামুল আইম্মা, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
من تفقه ولمك يتصوف فقد تفست ومن تصوف ولم يتفقه فقد تضدت ومن جمع بينهما فقد تحقق. 
অর্থ : যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত। আর যে তাসাউফ করে অর্থাৎ মারিফাত চর্চা করে অথচ ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করেনা অর্থাৎ শরীয়ত মানেনা বা অস্বীকার করে, সে কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সেই হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ বা হাক্বীক্বী আলেম।
সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পূর্ণ তাসাউফ শুন্য হয়ে শুধুমাত্র যৎসামান্য ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কি করে দাবী করতে পারে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই শ্রেষ্ঠ, সম্মাণিত ও অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা? মূলতঃ তাদের এ দাবী সম্পূর্ণই অবান্তর ও কল্পনা প্রসূত।
প্রকৃতপক্ষে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ সমন্বিত শিক্ষাই হচ্ছে- অনন্য, শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা, যা হক্কানী-রব্বানী আলিমগণ শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
কাজেই একমাত্র হক্কানী-রাব্বানী পীরানে তরীক্বত, হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম উনাদের দরবার শরীফেই পূর্ণ ইসলাম বা ইসলামী শিক্ষা হাছিল করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে অবিস্মরণীয় আলিম, মহা দার্শনিক ও প্রখ্যাত ইমাম, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর ইলমের তীব্রতা এত বেশী ছিল যে, সে তেজোচ্ছাটায় সবাই তটস্থ থাকতো। যাঁর সমঝের ব্যাপকতা ও ক্ষুরধার যুক্তি উপস্থাপনার এত দক্ষতা ছিল, যে কারণে সারা জীবনে সকলেই উনার কাছে বাহাসে পরাজিত হয়েছে। অপরদিকে যিনি এত অল্প সময়ে তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত ও সমাদৃত বাগদাদের ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদ অলংকৃত করেছিলেন। তার পূর্বে ও পরে কেউ এত অল্প বয়সে উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি এবং এক কথায় এতসব গুণের অধিকারী হওয়ার  উছিলায় যাঁর দ্বারা তৎকালে ইসলাম ছেড়ে প্রায় সর্বোতভাবে গ্রীক দর্শণের দিকে ঝুঁকে পড়া মুসলমানদেরকে যিনি সারগর্ভ হিদায়েতের বাণী শুনিয়ে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়ে হুজ্জাতুল ইসলামলক্বব দ্বারা অদ্যাবধি সমগ্র বিশ্বে বিশেষভাবে সম্মাণিত। সে মহান পুরুষের ইলমে তাসাউফের তাৎপর্য উপলব্ধি ও তার গুরুত্ব অনুধাবনের ঘটনাটি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। যা তিনি নিজেই যথার্থভাবে প্রকাশ করেছেন উনার প্রখ্যাত আল মুনকেযু মিনাদ্দালালবা ভ্রান্তির অপনোদনকিতাবে।
উল্লেখ রয়েছে, তিনি প্রথমে ইলমে কালাম বা মুতাকাল্লিমদের বিষয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সে বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনার দ্বারা তার গুঢ়মর্ম উপলব্ধিতে সক্ষম হন এবং তাকে তিনি অপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন।
অতঃপর তিনি দর্শণের দিকে মনযোগী হন এবং অল্প সময়েই (দুবছরে) পরিপূর্ণভাবে দর্শণ শাস্ত্র আয়ত্ত করেন। আর উনারপরেও এক বছর ধরে তিনি অর্জিত জ্ঞানের বিশেষ উপলব্ধি দ্বারা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, দর্শণের অনেকটাই প্রবঞ্চনাপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। তাই দর্শণও তাকে আশ্বস্ত করলোনা।
আর উনারপরে তিনি তালিমী শিয়া সম্প্রদায়ের বাতেনী মতবাদ নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু এ সম্প্রদায়ের স্থানে অস্থানে বাতেনী ইমামের বরাত তাঁকে এ সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ করে তোলে। এমনিতর অবস্থায় তিনি এক সময় হাজির হন- উনার ভাই হযরত আহমদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এক মাহফিলে এবং সেখানে হযরত  আহমদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি পরিবেশিত একটি কাছীদা শুনে উনার ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। কাছীদাটির ভাবার্থ ছিল নিম্নরূপ -
আর কতকাল জাহিরী ইলমের ফখর ধরে রাখবে? অন্তরের কলুষতা হিংসা, রিয়া, ফখর থেকে কবে আর মুক্ত হবে।
অন্তরের অস্থিরতার এ সময়ে ইমাম ছাহেবের মানসপটে ভেসে উঠে দুটি স্মৃতি, যা সংঘটিত হতো বাদশাহর দরবারে। একটি হলো- যখন ইমামুল হারামাইন, যিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেম এবং তৎকালীন সকল উলামাদের শ্রদ্ধেয় ইমাম, যিনি হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ওস্তাদ, তিনি যখন বাদশাহর দরবারে যেতেন তখনকার স্ম্রতি। অপরটি হলো- বাদশাহর দরবারে অপর একজন সূফী ও শায়খ,  আবূ আলী  ফরমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি,  যিনি ছিলেন তৎকালে আল্লাহ পাক উনার লক্ষ্যস্থল, তিনি যখন হাজির হতেন তখনকার স্মৃতি। প্রথম ক্ষেত্রে ইমাম সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন উনার ওস্তাদের সাথে বাদশাহর দরবারে তাশরীফ রাখতেন, তখন বাদশাহ ইমামুল হারামাইন রহমতুল্লাহি আলাইহিকে তাযীম করে স্বীয় সিংহাসনের পাশে অন্য আসনে বসাতেন। অন্যদিকে যখন শায়খ আবূ আলী ফরমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি ছিলেন বিশিষ্ট সূফী, তিনি যখন বাদশাহর দরবারে তাশরীফ রাখতেন, তখন বাদশাহ তাঁকে অধিকতর তাযীম-তাকরীম করে নিজ সিংহাসনে বসাতেন এবং বাদশাহ স্বয়ং নীচে বসতেন।
এ ঘটনার স্মৃতি ইমাম ছাহেবের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং তাঁকে সূফী সম্প্রদায়ের প্রতি অনুপ্রাণিত করে তোলে। সূফী তত্ত্ব বা ইলমে তাসাউফের দিকে মনযোগ দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন যে, পূর্ণাঙ্গ সূফী তরীক্বার মধ্যেই রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির (ইলমী আক্বীদা) এবং ব্যবহারিক কার্যক্রম (আমল ও রিয়াযত)-উনার সমন্বয়। তিনি বলেন, “আমলের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির আক্বীদা ও বিশ্বাস আমার কাছে অনেক সহজ মনে হয়েছে।তবে তিনি উল্লেখ করেন, “সূফীবাদের যে দিকটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা কেবল পড়াশোনা বা অন্যকিছু দ্বারা সম্ভব নয় বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা (জওক বা স্বাদ) তন্ময় সাধনা এবং নৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব।তিনি উদাহরণ পেশ করেন, “স্বাস্থ্য ও স্বস্তির সংজ্ঞা জানা এবং এগুলোর কারণ ও শর্তাবলী নির্ধারণ করা, আর স্বাস্থ্য ও স্বস্তিলাভের মধ্যে বড় প্রভেদ।
তিনি উল্লেখ করেন, “আমি পরিস্কারভাবে বুঝতে পারলাম, সূফীগণ কথায় মানুষ নন, উনাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং পড়াশোনার মাধ্যমে যতটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব তা আমি করেছি। এখন আমার বাকী রয়েছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা আস্বাদন এবং তাসাউফ সাধনার পথ প্রত্যক্ষভাবে অতিক্রমের দ্বারাই তা লাভ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, এরপরে তাসাউফ শিক্ষার পেছনে বা সূফী হওয়ার বাসনায় তিনি দীর্ঘ দশ বছর কাটিয়ে দেন। এবং ইলমে তাসাউফ বা সূফীদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, সে সম্পর্কে বলেন, “আমি  নিশ্চতভাবে বুঝতে পেরেছি যে, কেবল সূফীরাই আল্লাহর পথের যথার্থ পথিক। উনাদের জীবনই হলো সর্বোত্তম জীবন, উনাদের তরীক্বাই নিখুঁত তরীক্বা, উনাদের চরিত্রই সুন্দরতম চরিত্র।
বুদ্ধিজীবিদের সকল বুদ্ধি, জ্ঞানীদের সকল জ্ঞান এবং পন্ডিতদের সকল পান্ডিত্য, যাঁরা খোদায়ী সত্যের প্রগাঢ়তা সম্পর্কে দক্ষ, তাদের সকলের জ্ঞান-বুদ্ধি একত্র করলেও তা দিয়ে ছুফীদের জীবন এবং চরিত্র উন্তততর করা যাবেনা বা সম্ভব নয়।
ছুফীদের অন্তরের বা বাইরের সকল গতি এবং স্থৈর্য নুবুওওয়তের (প্রত্যাদেশ) নূরের জ্যোতি দ্বারা উদ্ভাসিত, নুবুওওয়তের জ্যোতি ছাড়া ধরার বুকে অন্য কোন আলো নেই, যা থেকে জ্যোতির ধারা পাওয়া যেতে পারে।
তিনি লিখেন, “ছুফী তরীক্বার প্রথম স্তর থেকেই শুরু হয় ইলহাম ও দীদার (দর্শন)। ছুফীগণ এ সময়ে জাগ্রত অবস্থায় হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম এবং হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের রূহের দর্শন লাভ করেন। শুনতে পান উনাদের বাণী এবং নির্দেশ। অতঃপর উনারা আরো উচ্চ স্তরে উপনীত হন। আকার ও প্রতীকের উর্দ্ধে এমন এক পরিম-লে উনারা পৌঁছে যান, ভাষায় যার বর্ণনা দান সম্ভব নয়।
তিনি লিখেন, “যারা ছুফীদের মাহফিলে বসে, তারা উনাদের নিকট থেকে বিশেষ ধরণের রূহানিয়াত হাছিল করে।
তিনি সূফীদের এই বিশেষ মর্তবা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র আয়াত শরীফ পেশ করেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম (ইলমে তাসাউফ) দেয়া হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন।” (পবিত্র সূরা মুজাদালাহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১)
আর যারা সূফীদের বিরোধিতা করে অথবা তা থেকে গাফিল থাকে, তাদেরকে তিনি নেহায়েত অজ্ঞ বলে মন্তব্য করেন এবং তাদের প্রতি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার নিম্নোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ প্রযোজ্য বলে মন্তব্য করেন, “তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপনার কথা শুনতে আসে, অতঃপর আপনার নিকট থেকে বের হবার পর যারা জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়েছে, তাদের জিজ্ঞেস করে এই ব্যক্তি এখন কি বললো? ওরা ঐসব লোক, যাদের হৃদয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সীলমোহর মেরে দিয়েছেন। উনারা তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা মুক, বধির এবং অন্ধ হয়ে গেছে।” (পবিত্র সূরা মুহম্মদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৬)
হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই মন্তব্য করেন যে, “দ্বীনের সকল পথের পথিকদের মধ্যে একমাত্র সূফী সাহেবরাই পরিপূর্ণ।
তিনি উদাহরণ দেন, “জাহিরী ইলম হলো- খোসা মাত্র। আর সূফীতত্ত্ব অথবা ইলমে তাসাউফ হলো তার অভ্যন্তরীস্থিত শাস বা মূল বস্তুর ন্যায়।তাই তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, “যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সূফী ছাহেবগণের কাছেই তা রয়েছে।
উল্লেখ্য, তাই তিনি সূফী ছাহেবগণের ছোহবত ইখতিয়ার করা বা উনাদের কাছে বাইয়াত হওয়া ফরযের অন্তর্ভূক্ত বলে উনার রচিত কিমিয়ায়ে সায়াদাত কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং নিজেও হযরত আবূ আলী ফরমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বাইয়াত হয়ে তাকমীলে পৌঁছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ইলমে তাসাউফের পথই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত পথ এবং উনার মধ্যেই পূর্ণতা রয়েছে।
আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে কস্মিনকালেও ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা হাছিল করে তাকমিলে পৌঁছা সম্ভব নয়। ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ياايها الذين امنوا ادخلو فى السلم كافة.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হও।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২০৮)
অর্থাৎ প্রত্যেক বান্দাকে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হতে হবে তথা দ্বীন ইসলাম উনাকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে হবে।
তাহলে যারা প্রচলিত তাবলীগ করবে, তাদের পক্ষে কি করে সম্ভব দ্বীন ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া বা পরিপূর্ণভাবে দ্বীন ইসলাম উনাকে অনুসরণ করা?
আর এ প্রচলিত তাবলীগই কিভাবে সবচেয়ে উত্তম, শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত আন্দোলন এবং একমাত্র পথ হতে পারে?
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মনগড়া, বানোয়াট ও পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের খিলাফ। আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত কখনো সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আন্দোলন বা উত্তম তরীক্বা হতে পারেনা। যেহেতু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম উনার পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। (যা আমরা সামনে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ)
 আবা-৩৫

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ-  





0 Comments: