প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ ( ৪ নং )


প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া
গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ

[সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন উনার এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামায ফরযে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরয নামাযের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইনজেকশন নেয়া রোজা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ-এর নামাযে বা অন্যান্য সময় পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর চতুর্দশ (১৪তম) ফতওয়া হিসেবে (৩৫তম সংখ্যা থেকে) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]
[বিঃদ্রঃ পাঠকগণের সুবিধার্থে ফতওয়ার ভুমিকার কিছু অংশ পুণরায় প্রকাশ করা হলো]

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ

মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
كنتم خير امة اخر حت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله.
অর্থ : তোমরা (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১১০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তাবলীগ তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সাথে সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। সেটা হলো- تؤمنون অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা। অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। তবেই সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ফায়দা বা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব হবে।        
স্মরণযোগ্য যে, বর্তমান প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের বেশকিছু লেখনী, বক্তব্য, বিবৃতি, আমল ও আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের মনে নানাবিধ সংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারপাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ হতে মাসিক আল বাইয়্যিনাতেরআকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য বিভাগ সুওয়াল-জাওয়াববিভাগে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারিত বেশকিছু আপত্তিজনক আক্বীদাসমূহ উল্লেখ করে অসংখ্য চিঠি আসে। কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
فاسئلوا اهل الذ كر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : যদি তোমরা না জান, তবে আহ্লে যিকির বা হক্কানী আলেমগণের নিকট জিজ্ঞাসা করো।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩ ও পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)
অর্থাৎ তোমরা যারা জাননা বা দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান রাখনা, তারা যাঁরা জানেন, উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও। অতএব, যাঁরা জানেন, উনাদের পবিত্র দায়িত্ব হলো- প্রশ্নকারীর প্রশ্নের শরীয়তসম্মত জাওয়াব প্রদান করা। কারণ যারা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাব প্রদান হতে বিরত থাকবে, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে। যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে দ্বীন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়,  জানা থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা গোপন করে অর্থাৎ জবাব না দেয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযা, আহমদ, মিশকাত, বজলুল মাজহুদ, উরফুশ্শাজী, তোহ্ফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মোজাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে, “তার জ্বিহ্বা আগুনের কেঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হবে।কাজেই উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে, যে ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার থেকে বাঁচার জন্যে অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করার লক্ষ্যে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারঅগণিত পাঠক, গ্রাহক ও সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের প্রেরিত সুওয়ালসমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদাসমূহের শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব বা ফতওয়া দেয়া হলো।

প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়
এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় এই যে, মূলত আমাদের সাথে কারো যেরূপ বন্ধুত্ব নেই, তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খেলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যেই হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
من احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মুহব্বত বা বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, বজলুল মাজহুদ, উরফুশ্শাজী, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াজী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীক, মোজাহেরে হক্ব, লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ্ ইত্যাদি)
বস্তুতঃ মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি সবই উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
কাজেই মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায়প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতসম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো- প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কেউল্লেখকৃত আক্বীদাসমূহের সঠিক, বিশুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত ফায়সালা প্রদান এবং প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতের কাজে যারা মশগুল রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা উক্ত আক্বীদাসমূহ জেনে হোক বা না জেনেই হোক বিশ্বাস করে এবং তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করে, নিজেদের ও জনসাধারণের ঈমান ও আমলের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের সে ঈমান ও আমলের হিফাযত করা ও সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণের নিকট সত্য বা হক্ব বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ইহলৌকিক ও পরলৌকিকি ইতমিনান ও নাযাত লাভ করতে পারে।
মূলত মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তাই এক মুমিন অপর মুমিনের ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমানী আলামত। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
المؤمن مرأة المؤمن.
অর্থ : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে আয়না স্বরূপ।” (আবূ দাউদ শরীফ, বজলুল মাজহুদ)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, আমীরুল মুমিনীন, হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম স্বীয় খিলাফতকালে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রীতিনীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত আনছার এবং মোহাজিরগণকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি আমি দ্বীনের হুকুম-আহকামকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে শরীয়ত বিরোধী কোন আদেশ দান করি, তবে তোমরা কি করবে?” উপস্থিত লোকেরা নীরব রইল। হযরত ওমর ইব্নুল খত্তাব আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই কথার পূণরাবৃত্তি করলেন। তখন হযরত বশীর ইব্নে সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “যদি আপনি এরূপ করেন, তবে আমরা আপনাকে এরূপ সোজা করবো, যেরূপ তীরকে সোজা করা হয়।এ কথা শুনে হযরত ওমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম বললেন, “তোমরাই আমার প্রকৃত বন্ধু, দ্বীনের কাজে সাহায্যকারী।” (আওয়ারেফুল মাআরেফ)    
সুতরাং উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আলোকে অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃ পূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল হিফাযতের লক্ষে বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো। যাতে করে সত্যান্বেষী, সমঝদার মুসলমান ও প্রচলিত তাবলীগকারীগণ সে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী ফায়সালা অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিজেদের ঈমান ও আমলের হিফাযত করে সঠিকভাবে দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খেদমত করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারেন।  
এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বীনের তাবলীগ যা খাছ ও আম তা শত-সহস্র লোক করবে এবং অবশ্যই করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করতে হবে। কারণ আক্বীদা শুদ্ধ না হলে দ্বীনী কোন খিদমতই মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্য নয়। উপরন্ত কুফরী আক্বীদা থাকার কারণে তাকে হতে হবে চির জাহান্নামী।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে দ্বীনী তাবলীগ (যা আম ও খাছ) করার তৌফিক দান করুন। (আমীন)

সুওয়াল : আমরা শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। কারণ আমরা অনেকদিন যাবত তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলাম এবং এখনো তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকের সাথে আমাদের মেলামেশা আছে। তাতে তাদের বেশ কিছু বক্তব্য বা আক্বীদা, যা আমরা অতীতেও জেনেছি এবং এখনো তা অবহিত হচ্ছি। তার মধ্যে অনেকগুলো তাদের লেখা কিতাবেও উল্লেখ আছে। সে সমস্ত আক্বীদাসমূহ আমাদের মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। সেগুলো আমরা নিম্নে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম - (৪৬) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, হিদায়েতের ক্ষেত্রে মূর্খরাই সমধিক উপযুক্ত। যেক্ষেত্রে নবীগণ এবং আলেমরা ফেল করে, সেখানেও মূর্খরা কৃতিত্ব দেখায়। এ প্রসঙ্গে ইসমাঈল হোসেন দেওবন্দী লিখিত তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্বনামক কিতাবের ১১৬ পৃষ্ঠায় একথা লেখা আছে যে, “..... অনেক স্থলে নবীগণ পর্যন্ত হিদায়েতে বিরাট সংকটে ও বিপদে পড়িয়াছিলেন, তাই অনেক স্থলে বিরাট আলেমও ফেল পড়িতেছে। কিন্তু মূর্খগণ তথায় দ্বীন জয় করিতেছে।” (৪৭) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রায়ই বলে থাকে যে, “ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগের তরতীব মোতাবেক সকল স্থানের সকল লোককে দাওয়াত দেয়া ফরজ বা জরুরী এবং এ দাওয়াত না দেয়ার কারণে যারা ঈমান হারা হয়ে মারা যাবে, তাদের জন্য যারা দাওয়াতের কাজ করবেনা অথবা জড়িত থাকবেনা, তাদেরকে মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং তারা পাকড়াও হবে।উল্লেখ্য আম্বর আলী প্রণীত- দাওয়াতে তাবলীগ কিতাবের ৪৯ পৃষ্ঠায় এরূপ সমার্থবোধক বর্ণনা রয়েছে। (৪৮) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের অনেকের আক্বীদা হলো যে, ধুমপান করা মোবাহ্। যার কারণে তাদের অনেককেই ধূমপান করতে দেখা না গেলেও তাদের মধ্যে যারা ধুমপান করে, তাদের প্রতি বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দেখা যায়না। তাদের সাপ্তাহিক বয়ান এবং বার্ষিক ইজ্তেমায়ও নয়। তদুপরি তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা- ইলিয়াস সাহেবের বক্তব্যে ধুমপান দ্বারা বা হুক্কা-পানি দ্বারা যাতে দাওয়াতীদিগকে আপ্যায়ন করা হয়, সে পরামর্শ রয়েছে। যা হজরতজী মাওঃমুহম্মদ ইলিয়াছনামক কিতাবের ১৪৪ পৃষ্ঠায় (মূল- সৈয়দ আবুল হাসান নদভী, সংকলক- মুহীউদ্দীন খান, সম্পাদক- মাসিক মদীনা) লিপিবদ্ধ রয়েছে। (৪৯) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, দাওয়াতের কাজে মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। যদিও সে মূর্খ হয়ে থাকুক না কেন? আর শুধুমাত্র ইবাদতের কাজে মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেন না, যদিও তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রাসূল হয়ে থাকেন না কেন। এর উদাহারণ স্বরূপ তারা বলে থাকে যে, যেমন পবিত্র মক্কা শরীফ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায পড়ছিলেন, তখন কাফিররা এসে উনার পিঠ মুবারকের উপর উটের নাড়ি-ভূড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ফেরেশতারা এসে তাকে সাহায্য করেননি। তখন হযরত ফাতেমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এসে সেই নাড়ি-ভুড়ি সরিয়ে ছিলেন। অপরদিকে তিনি যখন তায়েফে গিয়েছিলেন দাওয়াতের কাজে, তখন ফেরেশতারা এসে তাকে সাহায্য করেছিল। অর্থাৎ প্রথম ক্ষেত্রে পবিত্র মক্কা শরীফ শরীফে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন শুধু নামায বা ইবাদতে রত ছিলেন, তখন ফেরেশতারা সাহায্য করতে আসেননি কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তায়েফের ময়দানে দাওয়াতের কাজ হওয়ায় তখন মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে ফেরেশতারা উনাকে সাহায্য করেছিলেন। (৫০) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেরই আক্বীদা হলো যে, সূরা ফাতিহার মধ্যে দোয়াল্লীন-এর স্থলে যোয়াল্লীন পড়াই শুদ্ধ মত এবং এ বিষয়ে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বিশিষ্ট লোকদের লিখিত কিতাবের বর্ণনাও রয়ে গেছে। যেমন- আঃ সাত্তার ত্রিশালী লিখিত তাবলীগে ইসলাম বা দ্বীনের দাওয়াত নামক কিতাবের ৩৫ পৃষ্ঠায় এরূপ বক্তব্য রয়েছে। (৫১) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, ক্বিয়ামতের দিন স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক দাঈকে (যে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে) হিসাব দিবেন। আর যারা দাঈ নয় (যারা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেনা), তারা মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে হিসাব দিবেন। (৫২) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, আলেম-জাহেল সকলেই দ্বীন প্রচার করবে এবং দ্বীনের তাবলীগের জন্য আলেম হওয়ার কোনই জরুরত নাই। কারণ তারা মনে করে যে, দ্বীন প্রচার শুধু আলেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত এবং এখনো যাবে। অর্থাৎ জাহেল লোক তাবলীগ করার কারণে দ্বীন টিকে ছিল এবং ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।যা তাদেরই লেখা কিতাব তাবলীগ জামায়াতের সমালোচনা  ও উহার সদুত্তর, নামক কিতাবের ৯৫ পৃষ্ঠার (লেখক- মূল শাঃহাঃ জাকারিয়া সাহেব, অনুবাদক- মাওলানা মুহিব্বুর রহ্মান আহমদ) এবং তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, নামক কিতাবের ৯৪ পৃষ্ঠার (লেখক- মাওলানা ইসমাঈল হোসেন দেওবন্দী) বর্ণনা দ্বারাও প্রমাণিত হয়।  (৫৩) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অধিকাংশ লোকদের আক্বীদা হলো যে, মাগরিব ও বিত্রের উমরী ক্বাজা, ক্বাজায়ে আদা-এর ন্যায় আদায় করতে হবে। এ কথার প্রমাণ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা প্রকাশিত মাসিক আত্ তুরাগ পত্রিকা, সম্পাদক- হামীদ রশীদ, ১১তম খন্ড ১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে।
উপরোক্ত সুওয়ালসমূহের আলোকে এখন আমরা জানতে চাই, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু ঠিক? এবং তা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু প্রয়োজনীয় ও কোন স্তরের আমলের অন্তর্ভূক্ত? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনার দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে ঈমান ও আমল হিফাযত করণে সাহায্য করবেন।
জাওয়াব : (আপনাদের তরফ থেকে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন সুওয়ালসহ প্রায় শতাধিক (শত শত) চিঠি এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে যেসব সুওয়ালগুলি মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলির জবাব না দিলেই নয়, সেরূপ অর্ধ শতাধিক সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ্। তার মধ্যে গত (৩৫, ৩৬ ও ৩৭তম) সংখ্যা তিনটিতে যথাক্রমে (৭+৩২+৬) মোট = ৪৫টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছিল। বর্তমান (৩৮তম) সংখ্যায় ৮টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হলো। বাকীগুলোর জাওয়াব পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।)
আপনাদের বর্ণিত সুওয়াল মোতাবেক যদি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হয়ে থাকে, তাহলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই আপত্তিজনক, যা গোমরাহীমূলক, বিভ্রান্তিকর ও জেহালতপূর্ণ এবং তারমধ্যে কোন কোনটিতে কুফরীমূলক বক্তব্যও রয়েছে। তবে আপনারা যেহেতু দলীল ভিত্তিক জাওয়াব চেয়েছেন, তাই আমরা উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের ভিত্তিতে জাওয়াব দিব। (ইনশাআল্লাহ)
কারণ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে বলেন,         
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : তোমরা যারা জাননা, যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লহ হুযূর পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে ইলমের বিষয় সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করা হয়, আর সে জানা থাকা সত্ত্বেও তা চুপিয়ে রাখে, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পড়িয়ে দেয়া হবে।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্, আহমদ, মেশকাত, বজলুল মাজহুদ, তোহফাতুল আহ্ওয়াযী, মায়ারেফুস্ সুনান, মিরকাত, উরফুশ্শাজী, তালীক, শরহুত্ ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, লুময়াত)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, “তার জিব কেটে দেয়া হবে ইত্যাদি।
তাই নিম্নে পর্যায়ক্রমে আপনাদের প্রেরিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহের পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য দলীলসমূহের ভিত্তিতে শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো- তাবলীগের অর্থ ও প্রকারভেদ [সুওয়াল সমূহের জাওয়াব দেয়ার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করা অতি জরুরী। কারণ তাবলীগ সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ কি, তা জানতে হবে। তাবলীগ (تبليغ) অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দুপ্রকার অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দুভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১) তাবলীগে আম (عام) বা সাধারণভাবে, (২) তাবলীগে খাছ (خاص) বা বিশেষভাবে। আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দুপ্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক) ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক)। মুবাল্লিগে আম ও তার  হিদায়েতের ক্ষেত্র  মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারক)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সূরা তাহরীম শরীফ উনার ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا قوا انفسكم واهليكم نارا.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته.
অর্থ : সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
بلغوا عنى ولو اية.
অর্থ : তোমরা আমার থেকে একটি পবিত্র আয়াত শরীফ (পবিত্র হাদীছ শরীফ) হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বোখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী) অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে না পার। (তিবরানী শরীফ) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
الدين نصيحة.
অর্থ : দ্বীন হচ্ছে নসীহত স্বরূপ।হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীছ শরীফের আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীছ শরীফের উপর আমল করবেন। অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তালীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম-এর জন্য ফরজে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইব্নে কাছীর, কবীর) মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র
মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-এর মত নয়। অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন। আর যাঁরা খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট দ্বীন প্রচারক, উনাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ولتكن منكم امة يدعون الى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر و اولئك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম উনার) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলত কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১০৪)
অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
فلولا نفر من كل فر قة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থ : কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২২)
(তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : তোমরা দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর এবং  মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুত্নী, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, লুময়াত ইত্যাদি))
মূলত যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনাদেরকে অবশ্যই উলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী, রব্বানী আলেমগণের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.
অর্থ : নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করেন।” (পবিত্র সূরা ফাতির শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলেম।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
من ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟ قال الطمع.
অর্থ : “(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলেম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ জিনিস আলেমের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।” (দারেমী, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, মোজাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ্, লুময়াত ইত্যাদি) অর্থাৎ যিনি ইলম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলেম।
কাজেই যিনি ইলম, আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলেম, আর তিনিই নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,                             
العلماء ورئة اانبياء.
অর্থ : আলেমগণ হলেন- নবীগণ উনাদের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াযী, মায়ারেফুস্ সুনান, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, উরফুশশাজী, তালীক)
অর্থাৎ হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনারা হযতর নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে উনাদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তালীম বা তাবলীগ ফরজে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে উলামায়ে হক্কানী- রব্বানীগণ তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানানভাবে দাওয়াত ও তালীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আম-এর (ফরজে কেফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-এর (ফরজে আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ-এর যোগ্যতা ও তাবলীগে আম-এর শর্ত
স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েয নেই। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক উনার সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-  (১) পবিত্র সূরা সফে শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
يا ايها الذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?” “তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফের আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না। (২) তিনি আবার বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন,
اتأمرن الناس بالبر وتيسون انفسكم وانتم تتلون الكتاب.
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।” “তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না। (৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انها كم عنه.
অর্থ : আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খেলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৮)
তুমি কি এ আয়াত শরীফের আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না।  তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ পবিত্র আয়াত শরীফসমূহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।অর্থাৎ উপরোক্ত আয়াত শরীফের আমল ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়েয নেই। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যেই ফরজে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলেমগণের জন্যেই প্রযোজ্য, যা উনাদের জন্যে ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। অতএব, মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হবে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, “বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগযাকে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে, (যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে) যদি তাদের কথা মোতাবেক তাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই তা মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য করা উচিৎ ছিল। অথচ তা এমন সব লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লিগে খাছ তো নয়ই, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই মুবাল্লিগে আম-এরও উপযুক্ত নয়। যদিও কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগে আম রয়েছে।           
অতএব তাবলীগে আম মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্যই করা ফরজে কেফায়া। যা মুবাল্লিগে আম-এর জন্য করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। আর সাধারণ লোকেরতো প্রশ্নই উঠেনা।    
এখন হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় এমন কতক লোক, যারা মুবাল্লিগে খাছ ও আম কোনটাই নয়, তারা অনেকেই নামাযের জামায়াতে যাওয়ার সময় বা নামায পড়ার সময় অন্যকে নামাযে ডেকে নিয়ে যায়, রোজার মাসে রোজা রাখার কথা বলে, ইত্যাদি অনেক নেক কাজের কথাই বলে থাকে, যা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা তবে তার ফায়সালা কি? এটাও কি নাজায়েয ও হারাম?
এর ফায়সালা হলো, ঐ সকল লোক মুসলিম শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ- 
الدين نصيحة.
অর্থাৎ দ্বীন হচ্ছে অপরের ভাল কামনা করা।এর মেছদাক বা নমুনা। অর্থাৎ এদেরকে কেউ হিদায়েতের দায়িত্ব দেয়নি বা এরা হিদায়েতের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। এরা হচ্ছে মানুষের খয়েরখাঁ বা হিতাকাঙ্খী।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, তিবরানী শরীফ উনার উপরোক্ত হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে, সৎকাজ না করলেও অপরকে সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, “তোমরা ঐ কথা বল কেন, যা তোমরা নিজেরা করোনা।           তাহলে এই পবিত্র আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ উনাদের বক্তব্যের মধ্যে ফায়সালা কি?
মূলত এর ফায়সালা ওলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ দিয়েছেন। উনাদের মতে তিবরানী শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সৎ কাজ না করলেও সৎ কাজের দাওয়াত দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক)-এর জন্য। যেমন কোন বাবা নিজে নামায বা অন্যান্য নেক কাজ না করা সত্বেও তার সন্তান ও অধীনস্থদের নামায বা অন্যান্য নেক কাজের জন্য বলতে পারেন।   
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা বলার জন্য যে নিষেধবাণী করা হয়েছে, তা হলো- মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা করতে বলা জায়েয নেই।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
عن انس قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مررت ليلة اسرى بى بقوم تقرض سفاههم بمقاريض من النار- فقلت يا جبريل من هؤلاء- قال هؤلاء خطاء امتك الذين يقولون مالا بفعلون.
অর্থ : হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মিরাজ শরীফ উনার রাত্রে এমন একটি ক্বওমের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের ঠোঁটগুলো আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। আমি হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জবাবে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বলেন, এরা আপনার উম্মতদের মধ্যে ঐ সকল ওয়ায়েজ বা বক্তা, যারা এমন কথা বলতো, যেটা তারা নিজেরা আমল করতোনা।” (তিরমিযী, মেশকাত, তোহ্ফাতুল আহ্ওয়াজী, উরফুশ শাজী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যারা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক), তারা তিবরানী শরীফের বর্ণনা মোতাবেক সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), তারা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ মোতাবেক নিজে সৎকাজ না করে অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন না। কারণ যদি সকলের জন্যে আমভাবে একথা বলা হয় যে, সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজের কথা বলা জায়েয, তবে মিরাজ শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত লোকদের জিহ্বা কাটা হলো কেন? এতে বুঝা গেল যে, তিবরানী শরীফের উক্ত হুকুম সকলের জন্যে প্রযোজ্য নয়। বরং যারা মুবাল্লিগে আম, তাদের জন্যেই প্রযোজ্য। আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও মিরাজ শরীফ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা যারা মুবাল্লিগে খাছ, তাদের জন্যে প্রযোজ্য।
সুতরাং হাক্বীক্বতে উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ ও পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে কোনই দ্বন্দ্ব নেই। অনেকে এর সঠিক ব্যাখ্যা না জানার ও না বুঝার কারণে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। মূলতঃ উক্ত আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়।] সুওয়াল সমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের জাওয়াব –

৪৬নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, হিদায়েতের ক্ষেত্রে মূর্খরাই সমধিক উপযুক্ত। যেক্ষেত্রে নবীগণ এবং আলেমরা ফেল করে, সেখানেও মূর্খরা কৃতিত্ব দেখায়। এ প্রসঙ্গে তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব নামক কিতাবের ১১৬ পৃষ্ঠায় একথা লেখা আছে যে, “..... অনেক স্থলে নবীগণ পর্যন্ত হিদায়েতে বিরাট সংকটে ও বিপদে পড়িয়াছিলেন, তাই অনেক স্থলে বিরাট আলেমও ফেল পড়িতেছে। কিন্তু মূর্খগণ তথায় দ্বীন জয় করিতেছে।এখন আমাদের সুওয়াল হলো শরীয়তের দৃষ্টিতে উক্ত বক্তব্য ও আক্বীদা কতটুকু সঠিক? দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য মারাত্মক আপত্তিকর ও কুফরীমূলক। কারণ তাদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মূর্খদের মর্যাদা ও যোগ্যতা হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম ও নায়েবে রসূল অর্থাৎ আলেমগণের চেয়েও বেশী। (নাউযুবিল্লাহ)
কেননা হিদায়েতের ক্ষেত্রে হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা পর্যন্ত সংকটে পড়েছেন, আর আলেমরা হিদায়েতের ক্ষেত্রে অকৃতকার্য হয়েছেন। কিন্তু মূর্খ লোকেরা দ্বীন জয় করছে অর্থাৎ হিদায়েতের ক্ষেত্রে বিরাট সফলতা অর্জন করছে। মূলত এরূপ আক্বীদা পোষণ করা ও এ ধরণের বক্তব্য পেশ করা সম্পূর্ণ নাজায়েয, হারাম ও কুফরী।         বস্তুত হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ হলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ হতে মনোণীত ও ওহীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সাথে সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ গায়েবী মদদের দ্বারা সাহায্য প্রাপ্ত। উনাদের পক্ষে হিদায়েতের ক্ষেত্রে সংকটে পড়ার প্রশ্নই উঠেনা। বরং হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের শানে এরূপ আক্বীদা পোষণ করা স্পষ্টতঃ কুফরী। হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের প্রতি কিরূপ আক্বীদা পোষণ করতে হবে, আর হযরত নবী-রসূল আলাইহিস সালামগণ উনাদের মর্যাদা-মর্তবা যে কতটুকু তা ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আর আলেমগণ হিদায়েতের ক্ষেত্রে অকৃতকার্য হয়েছেন কিন্তু মূর্খরা কৃতকার্য হয়েছে। তাদের এ মন্তব্যও নেহায়েতই আপত্তিকর, বিভ্রান্তিমূলক ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত এবং উলামায়ে কিরামগণ উনোদের প্রতি সুস্পষ্ট ইহানত। যা কিনা আলেমগণের মর্যাদাকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। কারণ তাদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা একথাই বুঝা যাচ্ছে যে, মূর্খ লোকের যোগ্যতা ও মর্যাদা আলেমের চেয়ে বেশী।
অথচ একথা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলেমগণের যে মর্যাদা ও মর্তবা বর্ণনা করেছেন, তাতে এই প্রমাণিত হয় যে, আলেমের মর্যাদা মূর্খ লোকের চেয়ে শত-কোটি গুণ বেশী এবং বে-মেছাল। যেমন আলেমের মর্যাদা-মর্তবা, শান-শওক্বত ও তাযীম-তাকরীম সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে- মহান আল্লাহ পাক বলেন,
هل يستوى الذين يعلمون والذين لا يعلمون.
অর্থ : যারা জানে আর যারা জানেনা, উভয়ে কি সমান হতে পারে?” (পবিত্র সূরা যুমার শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৯)
মহান আল্লাহ পাক আলেমদের মর্যাদা ও ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা মুজাদালা শরীফ উনার ১১নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
والذين اوتوا العلم درجات.
অর্থ : যারা আলেম, তাদেরকে অনেক মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
العاماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলেমগণ হলেন নবীগণের ওয়ারিছ।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, দারেমী, আহমদ, মিশকাত, মায়ারেফুস্ সুনান, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, উরফুশ শাজী, বজলুল মাজহুদ ইত্যাদি)
আলেমের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
عن ابى امامة الباهلى قال- ذكر لرسول الله صلى الله عليه وسلم رجلان احدهما عابد والاخر عالم فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فضل العالم على العابد كفضلى على ادناكم. ثم قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله وملئكته واهل السموات والارض حتى النملة فى جخرها وحتى الحوت ليصلون على مهلم الناس الخير.
অর্থ : হযরত আবূ উমামাতুল বাহেলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট দুজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হলো- প্রথম জন আবেদ, আর দ্বিতীয় জন আলেম। (এ কথা শুনে) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,  আলেমের মর্যাদা আবেদের উপরে তদ্রুপ, যেমন তোমাদের মধ্যে সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার ফযীলত। অতঃপর আরো বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক ও উনার হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামগণ উনারা এবং আসমান ও যমীনবাসী, এমনকি গর্তের ভিতর পিপীলিকা ও মাছ পর্যন্ত আলেমের প্রতি ছালাত পাঠ করেন।” (তিরমিযী, দারেমী, মেশকাত, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, উরফুশ্ শাজী, তালীকুছ্ ছবীহ্)
আলেমের ফযীলত সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে যে,
عن ابى درداء قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول .............. وان العالم يستغفر له من فى السموات ومن فى الارض والحيتان فى جوف الماء وان فضل العالم على العايد كفضل القمر ليلة البدر على سائر الكواكب.
অর্থ : হযরত আবূ দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আমি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, ......... “নিশ্চয় আলেমের জন্যে আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, এমন কি পানির মাছ পর্যন্ত ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থণা) করে। আর নিশ্চয় আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর এরূপ, যেরূপ পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকারাজীর উপর।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, দারেমী, আহমদ, মিশকাত, মায়ারেফুস সুনান, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, উরফুশ শাজী, বজলুল মাজহুদ)         পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আলেমের মর্যাদা সম্পর্কে আরো উল্লেখ আছে যে,
عن ابن عباس قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- فقيه واحد اشد على الشيطان من الف عابد.
অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একজন ফক্বীহ্ (হক্কানী আলেম) শয়তানের নিকট এক হাজার আবেদের চেয়েও বেশী ভয়ঙ্কর।” (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্, দারেমী, আহমদ, মিশকাত শরীফ, মায়ারেফুস্ সুনান, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, উরফুশ্ শাজী)
হক্কানী-রব্বানী আলেমগণের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
نوم العالم خير من عبادة الجاهل.
অর্থ : আলেমের নিদ্রা মূর্খ লোকের ইবাদত হতে উত্তম।উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, আলেমের মর্যাদা অসংখ্য, অগণিত, বে-মেছাল। এক কথায় হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের পর মহান আল্লাহ পাক উনার যমীনে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদা-মর্তবার অধিকারী হলেন আলেমগণ। যেহেতু উনারা নায়েবে রসূল, অর্থাৎ দ্বীনের ধারক ও বাহক। মূলত মহান আল্লাহ পাক হক্কানী আলেম বা ওলী আল্লাহগণ উনাদের মাধ্যমেই পৃথিবীতে দ্বীন জিন্দা রেখেছেন এবং রাখবেন। মূর্খদের পক্ষে কখনো দ্বীন জয় করা বা দ্বীনের খেদমত করা সম্ভব নয়।          
কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
ان الله يبعث لهذه الامة على راس كل مأة سنة من يجدد لها دينها.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক প্রত্যেক হিজরী শতকের মাথায় একজন সংস্কারক পাঠাবেন, যিনি উম্মতের দ্বীনকে সংস্কার করবেন।” (আবূ দাউদ, বযলুল মাজহুদ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মিরআতুল মানাজীহ্)          
আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যুগ যুগ ধরে যাঁরাই মুজাদ্দিদ হিসেবে দ্বীনের তাবলীগ করেছেন বা দ্বীন জয় করেছেন, উনারা প্রত্যেকেই দ্বীনের হাক্বীক্বী আলেম ছিলেন। মূর্খ লোকের দ্বারা দ্বীনের হাক্বীক্বী তাবলীগ হয়েছে বা মূর্খ লোক মহান আল্লাহ পাক ওলী ছিল, এরূপ একটি নযীরও কেউ পেশ করতে পারবে না। তাই কিতাবে লেখা হয়েছে,
بے علم نتوان خدا را شناخت-
অর্থ : মূর্খ লোক মহান আল্লাহ পাক উনাকে চিনতে পারেনা। অর্থাৎ মূর্খ লোক আল্লাহওয়ালা হতে পারেনা।
অতএব, মূর্খলোক যদি মহান আল্লাহ পাক উনাকেই চিনতে না পারে, তবে তার দ্বারা হাক্বীক্বী দ্বীনের খেদমত কি করে হওয়া সম্ভব? মূলত দ্বীনের খেদমত তো হবেই না বরং তাদের দ্বারা দ্বীনের ক্ষতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বেশ কিছু মূর্খ লোকের কারণে দ্বীনের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। অর্থাৎ তাদের অজ্ঞতাসূচক ও কুফরীমূলক বক্তব্যের কারনে অসংখ্য লোকের ঈমান-আমল বিনষ্ট হচ্ছে। তাই এ ধরণের মূর্খদের সম্পর্কে হযরত শায়খ সাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি কঠিন হুশিয়ার বাণী উচ্চারণ করে বলেন,
دلاگر خرد مند و ھو شیار-
مکن صحبت جاھلا اختیار-
অর্থ : তুমি যদি জ্ঞানী হয়ে থাক, তবে মূর্খদের সোহ্বত ইখতিয়ার করোনা।
অন্যত্র বলেন,
زجاھل حذر کردن اولی بود
کزو ننگ دنیا و عقبی بود-
অর্থ : মূর্খ লোকদের থেকে দূরে থাকাই উত্তম, কেননা মূর্খ লোকের দ্বারা দ্বীন-দুনিয়া উভয়টিই ক্ষতিগ্রস্থ হয়।তাই মূর্খ লোকের শেষ পরিণাম ফল সম্পর্কে তিনি আরো বলেন,
سر انجام جاھل  جھنم بود
کہ جاھل نکو عاقبت کم بود-
অর্থ : মূর্খ লোকের শেষ পরিণাম হলো- জাহান্নাম। কেননা মূর্খ লোকের শেষ পরিণাম ভাল খুব কমই হয়ে থাকে।        আর এ ধ্বংস হতে নাযাত পাওয়ার দিক নির্দেশনা দিয়ে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
كن عالما او متعلما او مستمعا او مستمعا او محبا ولا تكن الخامس فتهلك.
অর্থ : তুমি আলেম হও অথবা ইলম অন্বেষণকারী হও অথবা ইলমের শ্রোতা হও (আর যদি তুমি এ ব্যাপারে মাজূর হও), তবে আলেমদেরকে মুহব্বত কর, পঞ্চম হয়োনা, তবে ধ্বংস হয়ে যাবে।” (মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, ত্বীবী, তালীক)
অন্যত্র ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
فالناس كلهم هلكى الا العالمون.
অর্থ : সকল লোক ধ্বংস প্রাপ্ত, আলেমগণ ব্যতীত।শুধু তাই নয়, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে যে,
الدنيا ملعون وما فيها ملعون الا ذكر الله وما والاه ار عالم او متعلم.
অর্থ : দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যস্থ সব কিছুই লানত প্রাপ্ত বা অভিশপ্ত। তবে যিকির ও যিকিরকারী এবং আলেম ও তালেবে ইলম ব্যতীত। অর্থাৎ মূর্খরা লানত প্রাপ্ত।
তাই বুঝা যাচ্ছে যে, যারা মূর্খ, তারা নিজেরাই ধ্বংসের সম্মুখীন বা লানতপ্রাপ্ত বা অভিশপ্ত। কাজেই যারা নিজেরাই ধ্বংসের পথে, তাদের পক্ষে দ্বীন জয় করা কি করে সম্ভব? মূলত এটি ডাহা মিথ্যা ও কল্পনা প্রসূত কথা। বস্তুতঃ মূর্খ লোকদের, তাদের নিজেদেরই ধ্বংস হতে নাযাত পাওয়ার জন্যে অথবা নিজেদের দ্বীন তথা ঈমান-আমল হিফাযতের লক্ষ্যে আলেম হতে হবে অথবা আলেম-এর কাছে যেতে হবে। আর শরয়ী ওজরের কারণে  যারা মূর্খ রয়েছে, অর্থাৎ আলেম হতে পারেনি বা তাঁদের কাছে যেতে পারেনি, তাদেরকে নাযাত পেতে হলে অন্ততঃ আলেমকে মুহব্বত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, ক্বিয়ামতের ময়দানে যখন কিছু লোক জাহান্নামী হবে, তখন মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে বলবেন, “হে হযরত ফেরেশতারা আলাইহিমুস সালাম! দেখতো এ লোকগুলো আলেম কিনা?” হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা বলবেন, না, তারা আলেম নয়। মহান আল্লাহ পাক পুণরায় বলবেন, “কোন আলেমের সাথে তাদের বন্ধুত্ব ছিল কি? অথবা আলেমগণের মজলিসে বসেছিল কি? অথবা এমন কোন লোকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল কি? যার সাথে কোন আলেমের সাথে বন্ধুত্ব ছিল।তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের কথার জবাবে জাহান্নামী ব্যক্তিরা বলবে, হ্যাঁ, আমাদের অমুক ব্যক্তির সাথে মুহব্বত ছিল, যার সাথে অমুক আলেমের সাথে মুহব্বত ছিল। তখন মহান আল্লাহ পাক বলবেন, যাও! আমার সে আলেমের উসীলায় আমি তোমাদেরকে জান্নাতী করে দিলাম।” (সুবহানাল্লাহ্)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে,
يشغع يوم القيامة ثلثة الا نبياء ثم العلماء ثم الشهداء.
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন তিন প্রকার লোক সুপারিশ করবেন। প্রথম- নবী আলাইহিস সালামগণ, দ্বিতীয়- আলেমগণ, তৃতীয়- শহীদগণ।উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হলো যে, আলেমগণের সুপারিশের কারণে অসংখ্য, অগণিত লোক জান্নাতে যাবে। এবং আলেমগণের মুহব্বতের কারণেই মূর্খ লোকেরা ধ্বংস হতে নাযাত পাবে। আর পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথাও নাই যে, মূর্খ লোকেরা সুপারিশ করবে। অথবা মুর্খ লোকের উসীলায় মানুষ নাযাত পাবে।
সুতরাং এই যদি হয়, তবে কি করে মূর্খদের পক্ষে দ্বীন জয় করা সম্ভব? আর আলেমের পক্ষে হিদায়েতের ক্ষেত্রে অকৃতকার্য হওয়া সম্ভব? মূলত এটি সম্পূর্ণই কুফরীমূলক কথা। অতএব উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হলো যে, “নবী এবং আলেমরা যেখানে ব্যর্থ হয়, মূর্খরা সেখানে জয়ী হয়প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, অজ্ঞতামূলক ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। যা থেকে তাদের সকলের পরহেজ হওয়া ফরয ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

৪৭নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রায়ই বলে থাকে যে, “ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগের তরতীব মোতাবেক সকল স্থানের সকল লোককে দাওয়াত দেয়া ফরজ বা জরুরী এবং এ দাওয়াত না দেয়ার কারণে যারা ঈমান হারা হয়ে মারা যাবে, তাদের জন্য যারা দাওয়াতের কাজ করবেনা অথবা জড়িত থাকবেনা, তাদেরকে মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে জবাবদিহি করতে হবে এবং তারা পাকড়াও হবে।উল্লেখ্য আম্বর আলী প্রণীত- দাওয়াতে তাবলীগ কিতাবের ৪৯ পৃষ্ঠায় এরূপ সমার্থবোধক বর্ণনা রয়েছে।           
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস সম্মত? দলীল-আদিল্লাসহ সঠিক ফায়সালা জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা সম্পূর্ণই অশুদ্ধ ও শরীয়তের খেলাফ।  
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ একাত্তর বছর ধরে শুরু হয়েছে, তাহলে বিগত প্রায় ১৩০০ বছর যাবত যাঁরা অতীত হয়েছেন অথবা এই ৭১ বছর ধরে যারা প্রচলিত তাবলীগ করেননি বা তাবলীগের তরতীব মোতাবেক সরাসরি দাওয়াত দেননি অথবা যারা দাওয়াতের কাজ করেছে, তাদের সাথে জড়িত ছিলেন না,  তাঁরা কি পাকড়াও হবেন?    
উল্লেখ্য, যিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, যিনি সমস্ত আলমের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরিত হয়েছিলেন, যাঁর অঙ্গুলির ইশারায় চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়েছিল, যাঁকে সৃষ্টি না করলে সারা জাহানের কিছুই সৃষ্টি হতোনা, যিনি মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত প্রকাশের মূল মাধ্যম বা লক্ষ্যস্থল, সর্বোপরি মহান আল্লাহ পাক উনার পরেই যাঁর স্থান, তিনি ও  উনার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ তো করেননি বা ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের তরতীব মোতাবেক দাওয়াতও দেননি, তাহলে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কথা অনুযায়ী উনারাও কি পাকড়াও হবেন? (নাউযুবিল্লাহ্) - সে কথা বললে চরম পর্যায়ের কুফরী হবে।
আবার প্রচলিত তাবলীগ  জামায়াতের উপরোক্ত কথা দ্বারা বোঝা যায় যে, একজনের গুণাহের জন্য অপরজনকে দায়ী করা হবে। অথচ এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র সূরা আনআম শরীফ উনার ১৬৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ولا تزر وازرة وزراخرى.
অর্থ : একজনের গুণাহের বোঝা আরেকজন বহন করবেনা।
অর্থাৎ একজনের জন্য আরেকজন দায়ী হবেনা। আর যদি একজনের গুণাহের জন্য আরেকজনকে দোষারোপ করতে হয় এবং যাদেরকে দাওয়াত না দেয়ার কারণে ঈমানহারা হয়ে মারা গেল, তাদের জন্য যারা দাওয়াত দেয়নি বা দিলনা, তাদেরকে দায়ী করা হয়, তাহলে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এই কথা অনুযায়ী সর্ব প্রথমে দায়ী করতে হয়- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে, অথচ যা মারাত্মক  কুফরী।
কারণ ঐতিহাসিকদের বিবরণ অনুযায়ী নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানায় পৃথিবীর লোক সংখ্যা ছিল- ১৫-২০ কোটি এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাদের সংখ্যা ছিল, প্রায় সোয়া লক্ষ, আর সব মিলিয়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লক্ষের মত। তাই সে সময় সমগ্র পৃথিবীর লোকসংখ্যা যদি ১৫ কোটিও ধরা হয়, তাহলেও মুসলমানদের সংখ্যা দাড়ায় মাত্র ০.২% বা শতকরা  এক ভাগের পাঁচ ভাগের এক অংশ।
অতএব এক্ষেত্রে কেউ যদি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানায় অবশিষ্ট যে ৯৯.৮% লোক ঈমান হারা হয়ে থাকলো বা মারা  গেল, তাদের জন্য নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দায়ী মনে করে, তবে সে খাছ কাফির হবে।
মূলত প্রত্যেক যামানায়ই এমন কিছু স্থান ও এমন জনসমষ্টি থাকবে, যেখানে দাওয়াত পৌঁছবেনা। তাদের প্রসঙ্গে ফিক্বাহর কিতাবে রয়েছে, ইমাম, মুজ্তাহিদগণ উল্লেখ করেছেন, “পৃথিবীর সর্বত্র দাওয়াত পৌঁছবেনা। যেমন- গুহাবাসী, পর্বতবাসী, জঙ্গলবাসী, ইত্যাদি। যার কারণে তাদের শরয়ী ফায়সালা উনারা উল্লেখ করেছেন, যা নিম্নরূপ-
যেমন : এ ধরণের লোক সম্পর্কে হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতওয়া হচ্ছে যে, “তারা জান্নাতী।  আর ইমাম আযম, আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতওয়া হচ্ছে- ঈমান গ্রহণের জন্য সাধারণ আক্বলই যথেষ্ট হবে।অর্থাৎ এ ধরণের লোক যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছেনি, তারা যদি কোন প্রকার কুফরী-শেরেকী করে, তবে তারা জাহান্নামী হবে। (নুরুল আনোয়ার)
আবার কাইয়্যূমুয্ যামান, গাউসে সামদানী, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে, “এ ধরণের লোককে মিটিয়ে দেয়া হবে।” (মকতুবাত শরীফ)
মুলত উপরোক্ত তিনটি ইজতিহাদই শুদ্ধ। অর্থাৎ যাদের সাধারণ আক্বল রয়েছে, কিন্তু কুফরী করেনি, শরীয়তের হুকুম-আহকামও পালন করেনি, তা সত্ত্বেও তারা জান্নাতবাসী হবে। তবে যাদের আক্বল থাকা সত্তেও তারা কুফরী করেছে, তারা জাহান্নামের উপযোগী হবে। আর যাদের মোটেও আক্বল নেই, তাদেরকে মিটিয়ে দেয়া হবে। মুলত তাবলীগে আম হচ্ছে- ফরজে কেফায়ার অর্ন্তভুক্ত। যা মুবাল্লিগে খাছ, তার দায়িত্ব অনুযায়ী পালন  করবে। যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছবেনা, তাদের ক্ষেত্রে  উপরোক্ত তিনটি হুকুমের একটি প্রযোজ্য হবে। তবে এক্ষেত্রে ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে সাধারণ আক্বলই যথেষ্ট, একথাটি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য।
সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা সম্পূর্ণই ভুল, বিভ্রান্তিমূলক ও জেহালতপূর্ণ, যা থেকে তাদের পরহেজ করা জরুরী।

৪৮নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের অনেকের আক্বীদা হলো যে, ধুমপান করা মোবাহ। যার কারণে তাদের অনেককেই ধূমপান করতে দেখা না গেলেও তাদের মধ্যে যারা ধুমপান করে, তাদের প্রতি বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দেখা যায়না। তাদের সাপ্তাহিক বয়ান এবং বার্ষিক ইজ্তেমায়ও নয়। তদুপরি তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা- ইলিয়াস সাহেবের বক্তব্যে ধুমপান দ্বারা বা হুক্কা-পানি দ্বারা যাতে দাওয়াতীদিগকে আপ্যায়ন করা হয়, সে পরামর্শ রয়েছে। যা হজরতজী মাওঃমুহম্মদ ইলিয়াছনামক কিতাবের ১৪৪ পৃষ্ঠায় (মূল- সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী, সংকলক- মুহীউদ্দীন খান, সম্পাদক- মাসিক মদীনা) লিপিবদ্ধ রয়েছে।          এখানে আমাদের সুওয়াল হলো- আমরা জানি ধুম পান করা মাকরূহ তাহরীমী, অথচ মাওলানা ইলিয়াস সাহেব তাবলীগের স্বার্থে ধুম পানের নির্দেশ দিয়েছেন, তা কতটুকু শরীয়তসম্মত হয়েছে?

জাওয়াব : হুক্কা-পানি সম্পর্কে মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য খুবই আপত্তিকর। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে ধুমপান করা মাকরূহ্ তাহরীমী। আর তাবলীগের স্বার্থে ধুমপান দ্বারা খাতির করার নির্দেশ দেয়ার অর্থ হচ্ছে- মাকরূহ্ তাহরীমীর জন্য উৎসাহিত করা এবং মাকরূহ তাহরীমী কাজকে দ্বীনের কাজে সংশ্লিষ্ট করা।। অথচ শরীয়ত, মাকরূহ্ তাহরীমীর জন্য উৎসাহিত করা তো দূরের কথা বরং তা বিশেষ গুণাহ্র কাজরূপে ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য যে, ধুমপান সম্পর্কে মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের উল্লিখিত বক্তব্য প্রদান শুদ্ধ হয়নি।
মূলত ধুমপানের মাসয়ালাটি ক্বিয়াসী মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত। যার বর্ণনা পবিত্র কুরআন শরীফ এবং পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সরাসরি উল্লেখ নেই। (আর না থাকাটাই স্বাভাবিক, কেননা বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি, যা তামাক দ্বারা তৈরী হয়। তার ব্যবহার মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানার অনেক পরে শুরু হয়েছে।) ঐতিহাসিক সূত্র মতে আমেরিকার পাশে কিউবা নামক একটি দেশে তামাকের চাষ হতো, সেখান থেকে বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে জনৈক রাষ্ট্রদুত ভারত উপমহাদেশে সর্ব প্রথম তামাক নিয়ে আসে। পরবর্তীতে এ উপমহাদেশে ধুমপানের ব্যবহার শুরু হয়। তামাক সম্পর্কে সর্ব প্রথম ফতওয়া প্রদান করেন, হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দুররে ছামীনকিতাবে। তাতে তিনি ধুমপান মাকরূহ তাহরীমী বলে ফতওয়া প্রদান করেন এবং তিনিই ধুমপানের সর্ব প্রথম ফতওয়া প্রদানকারী। তারপরে ফতওয়া দেন, হযরত শাহ আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি। যা সহীহ হাদীছ শরীফ থেকে ক্বিয়াস করে প্রদান করা হয়েছে। এবং এটিই সহীহ ও নির্ভরযোগ্য ফতওয়া, যার উপর ওলামায়ে হক্কানী, রব্বানীগণ একমত।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন,
 من اكل هذه الشجرة المنتنة فلا يقربن مسجدنا فان الملائكة تتأذى مما يتأذى منه الانس.
অর্থ : যে ব্যক্তি এমন দুর্গন্ধযুক্ত বৃক্ষের (কাঁচা পিঁয়াজ বা রসূনের) কিছু খায়, সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটেও না আসে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফাতহুল বারী ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, শরহে নববী, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মিরআতুল মানাজীহ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে,
نهى عن ها تين الشجر تين يعنى البصل والشوم وقال من اكلهما فلا يقربن مسجدنا وقال ان كنتم لا يد اكلهما فا ميتوهما طبخا.
অর্থ : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দুটি বস্তু খেতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ পিঁয়াজ ও রসূন এবং বলেছেন, “যে ব্যক্তি তা খায়, সে যেন আমাদের মসজিদের নিকটেও না আসে।তিনি আরো বলেছেন, “তোমাদের যদি খেতেই হয়, তাহলে তা রান্না করে দুর্গন্ধ বিনষ্ট করে খাবে।” (আবূ দাউদ, মিশকাত শরীফ, বজলুল মাজহুদ, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ)
উল্লিখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুহাদ্দিস, হযরত মাওলানা কুতুবুদ্দীন খান দেহ্লভী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “যে সকল দুর্গন্ধযুক্ত বস্তুর দ্বারা মানুষের কষ্ট হয়, তার দ্বারা ফেরেশতাদেরও কষ্ট হয়।” (মোযাহেরে হক্ব) সুতরাং কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসূন এবং এ জাতীয় যে সমস্ত কাঁচা দ্রব্য খেলে মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়, তা খাওয়া মাকরূহ্ তান্যিহী এবং তা খেয়ে মসজিদে যাওয়া মাকরূহ্ তাহরীমী। উল্লেখ্য এ মাসয়ালার উপর ক্বিয়াস করে ধুমপান করা মাকরূহ তাহরীমী এবং ধুমপান করে মসজিদে যাওয়া হারাম ফতওয়া প্রদান করা হয়েছে। কেননা কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসুন খাওয়া অপেক্ষা ধুমপানে মুখ অনেক বেশী দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে থাকে। 
এ ছাড়াও ফিক্বাহের কিতাবসমূহে ধুমপান মাকরূহ্ তাহরীমী হওয়ার ব্যাপারে নিম্নোক্ত কারণসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে, সংক্ষেপে তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে : (১) বিড়ি, সিগারেটে নিকোটিনরয়েছে। যা পান করা বিষ পানের নামান্তর। (২) চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। (৩) ধুমপানে আর্থিক অপচয় হয়। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
ان المبذرين كانوا اخوانا الشياطين.
অর্থ : নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (পবিত্র সূরা বনি ঈসরাইল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭) (৪) ধুমপানে আগুনের ধোঁয়া মুখের ভিতর প্রবেশ করানো হয়, যা জাহান্নামীদের সাথে সদৃশ হয়ে যায়। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আছে,
كل دخان حرام.
অর্থ : প্রত্যেক ধোঁয়াই (পান করা) হারাম।” (৫) ধুমপান বিধর্মীদের প্রচলিত অভ্যাস। ধুমপানে তাদের মুশাবেহাত বা সদৃশ হয়। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ : যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখবে, তাদের সাথেই তার হাশর-নশর হবে।” (আহমদ, আবূ দাউদ, বযলুল মাজহুদ) (৬) ধুমপানে মানুষ ও হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের কষ্ট হয়। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
ايذاء المسلم كفر.
অর্থ : মুসলমানদেরকে কষ্ট দেয়া কুফরী।
এছাড়াও আরো শত সহস্র কারণ রয়েছে। কাজেই যারা ধুমপান মুবাহ ফতওয়া দিয়েছে, তাদের ফতওয়া কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কাঁচা পিঁয়াজ, কাঁচা রসুন বা এ জাতীয় সাধারণ গন্ধযুক্ত খাদ্য খাওয়া যেখানে মাকরূহ্ তান্যিহী, সেখানে বিড়ি, সিগারেট, হুক্কা ইত্যাদি মারাত্মক দুর্গন্ধযুক্ত দ্রব্য কি করে মুবাহ হতে পারে?
অতএব ধুমপান সম্পর্কে শরীয়তের মূল ফতওয়া হচ্ছে- মাকরূহ্ তাহরীমী। কেউ কেউ হারামও ফতওয়া দিয়েছেন। তাছাড়া নিন্মোক্ত কিতাবসমূহেও ধুমপানকরা মাকরূহ তাহরীমীলেখা হয়েছে- শরহে ওহ্বানিয়া, গায়াতুল আওতার, সুয়ালাতে আসরার, হাদিয়া, তরীকায়ে মুহাম্মদীয়া উসিলায়ে আহমদীয়া, নাসিহাতু ইবাদিল্লাহ্ ওয়া উম্মতে রসূলিল্লাহ্, ক্বাওলুস সাবিত, দুররে ছামীন, তারবিহুল জেনান, সুলুহুল ইখওয়ান বি ইযাতে নারিদ্দুখান, তোহ্ফাতুল ইখওয়ান ফি শরবিদ্দুখান, তোহ্ফাতুল মাকাসেদ ওয়ার রাসায়েল, ইমামুল ইখওয়ান ফি তাহরীমীদ্দুখান, আল বুরহান ফি তাহরীমুদ্দুখান, তাফসীরে রুহুল মায়ানী, তিবইয়ান, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, মুজাহেরে হক্ব, ফতওয়ায়ে আজিজীয়া, ফতওয়ায়ে আব্দুল হাই লক্ষ্মৌবী, ফতওয়ায়ে আমিনীয়া, ফতওয়ায়ে আশরাফিয়া, ইমদাদুল ফতওয়া, নেহায়া, আইনী, দায়লামী শরীফ, দুররে মোখতার, আল আশবা ওয়ান নাজায়ের, ফতওয়ায়ে আলমগিরী, ফতওয়ায়ে হাম্মাদীয়া, শরহে মাওয়াহেবুর রহ্মান, মাজালেসুল আবরার, কেফায়েতুল মুফতী, আল হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম ইত্যাদি। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে হুক্কা-বিড়ি তথা ধুমপান সম্পূর্ণ মাকরূহ্ তাহরীমী।           
কাজেই ধুমপান সম্পর্কে ইলিয়াস সাহেবের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিমূলক ও অত্যন্ত আপত্তিকর। আর তাবলীগ জামায়াতের লোকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে, তারা যেন অন্যদেরকে হুক্কা-পানি, সিগারেট বা ধূমপান দ্বারা খাতির না করে এবং নিজেরাও যাতে তা পান না করে। কেননা সহীহ ফতওয়া মোতাবেক ধুমপান করা গুণাহ ও আযাবের কারণ।

৪৯নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, দাওয়াতের কাজে মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। যদিও সে মূর্খ হয়ে থাকুক না কেন? আর শুধুমাত্র ইবাদতের কাজে মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেন না, যদিও তিনি মহান আল্লাহ পাক রাসূল হয়ে থাকেন না কেন। এর উদাহারণ স্বরূপ তারা বলে থাকে যে, যেমন পবিত্র মক্কা শরীফ শরীফে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নামায পড়ছিলেন, তখন কাফিররা এসে উনার পিঠ মুবারকের উপর উটের নাড়ি-ভূড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ফেরেশতারা এসে উনাকে সাহায্য করেননি। তখন হযরত ফাতেমা আলাইহাস সালাম এসে সেই নাড়ি-ভুড়ি সরিয়ে ছিলেন। অপরদিকে তিনি যখন তায়েফে গিয়েছিলেন দাওয়াতের কাজে, তখন ফেরেশতারা এসে তাকে সাহায্য করেছিল। অর্থাৎ প্রথম ক্ষেত্রে পবিত্র মক্কা শরীফ শরীফে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন শুধু নামায বা ইবাদতে রত ছিলেন, তখন ফেরেশতারা সাহায্য করতে আসেননি কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তায়েফের ময়দানে দাওয়াতের কাজ হওয়ায় তখন মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে ফেরেশতারা উনাকে সাহায্য করেছিলেন।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত আক্বীদা ও বক্তব্য কতটুকু সঠিক? জানিয়ে বাধিত করবেন।
জওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য নেহায়েত অশুদ্ধ, যা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের খেলাফ, কারণ আমরা তাফসীর, হাদীছ শরীফ, সীরাত ইত্যাদি কিতাবসমূহে এর বিপরীত দেখতে পাই। দ্বিতীয়তঃ তারা বলেছে যে, পবিত্র মক্কা শরীফ শরীফে নামায পরাকালীন পৃষ্ঠ মুবারকে যে নাড়ি-ভূড়ি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তা সরানোর জন্য হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের পাঠানো হয়নি। এ বক্তব্য দ্বারা তারা প্রমাণ করতে চায় যে, ইবাদতের মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার সাহায্য- আসেনা, কিন্তু তাদের একথা শুদ্ধ নয়। কারণ এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ আশরাফুল মখলুকাত মানুষ, তাদের মধ্যে যিনি 
سيدة نساء اهل الجنة حضرت فاطمة رضى الله عنها.
বেহেশতে মেয়েদের মধ্যে সর্দার, হযরত ফাতেমা আলাইহাস সালাম, উনার দ্বারা মহান আল্লাহ পাক সাহায্য করিয়েছিলেন।  আর তায়েফে যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতের কাজে গিয়েছিলেন, তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা সাহায্য করেছিল, যা তারা বলে থাকে, তাও শুদ্ধ নয়। কারণ তায়েফের ময়দানে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহত হওয়ার পর, মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের পাঠিয়েছিলেন তায়েফবাসীদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার জন্য। যদি তখন মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সরাসরি সাহায্য করার জন্য হত, তবে তিনি আহত হওয়ার পূর্বেই মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের পাঠাতেন যাতে তায়েফবাসীরা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে আহত না করতে পারে। কিন্তু আহত হওয়ার পর মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের পাঠিয়েছেন। তাহলে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এ কথা কি করে বলা যেতে পারে যে, তায়েফের ময়দানে মহান আল্লাহ পাক, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সরাসরি হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। 
প্রকৃতপক্ষে মহান আল্লাহ পাক ইবাদত ও দাওয়াত উভয় কাজেই হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের দিয়ে সাহায্য করে থাকেন। যেমন দাওয়াতের কাজে সাহায্য এসেছে- বদরের যুদ্ধে, ওহুদের যুদ্ধে, হুনায়নের যুদ্ধে যা মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করেছেন। বদরের যুদ্ধের ক্ষেত্রে পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার মধ্যে ১২৩নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে,
ولقد نصر كم الله ببدر وانتم اذلة فاتقوا الله لعلكم تتفكرون.
অর্থ : নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তোমাদেরকে বদরের জ্বিহাদে সাহায্য করেছেন এবং তোমরা ছিলে সংখ্যায় নগণ্য ও সাজ-সরঞ্জামে অল্প। তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর, আশা করা যায় তোমরা শোকরগোজার বান্দা হতে পারবে।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২৩)
আবার বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে পবিত্র সূরা আনফাল শরীফ উনার ৯-১০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
اذ تستغيثون ربكم فاستجاب لكم انى ممد كم من بالف الملائكة مردفين وما جعله الله الا بشرى ولتطمئن به قلوبكم.
অর্থ : যখন তোমরা তোমাদের রবের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তা কবুল করে বলেন, আমি তোমাদিগকে সাহায্য করবো এক হাজার ফেরেশতা দিয়ে, যারা একের পর এক আসবে। আর মহান আল্লাহ পাক খোশ-খবর দান করেন, যাতে তোমাদের অন্তর এতমিনান লাভ করতে পারে।” (পবিত্র সূরা আনফাল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৯-১০)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যিনি তখনও ঈমানের কথা প্রকাশ করেননি অর্থাৎ তিনি ঈমান এনেছিলেন কিন্তু প্রকাশ করেননি, যিনি ছিলেন খুব শক্তিশালী, উঁচা-লম্বা এবং সুঠাম দেহের অধিকারী। উনাকে যখন একজন হালকা-পাতলা ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু গ্রেফতার করে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে নিয়ে আসলেন, তখন উনাকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি করে হযরত আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ন্যায় শক্তিশালী ও সবল লোককে গ্রেফতার করে নিয়ে আসলে? জবাবে সে ছাহাবী বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি উনাকে গ্রেফতার করিনি। বরং একজন খুব শক্তিশালী লোক উনাকে গ্রেফতার করে আমার কাছে দিয়েছেন, যাকে আমি ইতিপূর্বে ও পরে কখনো দেখিনি। একথা শুনে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “ঐ শক্তিশালী লোকটি হলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার প্রেরিত একজন ফেরেশতা, যে ফেরেশতা দিয়ে মহান আল্লাহ পাক সাহায্য করার কথা ঘোষণা করেছেন।” (সমূহ সীরতের কিতাব)
আর ওহুদ যুদ্ধে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের সাহায্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে,
اذتقول للمؤمنين الن يكفيكم ان ميد كمربكم بثلاثة الاف من الملائكة مزلين بلى ان تصبروا وتتقوا وياتوكم من فورهم هذا يمددكم ربكم بخمسة الاف من الملائكة مسو مين وما جعله الله الابشرى لكم ولتطمئن قلوبكم به.
অর্থ : যখন আপনি মুমিনদের বলেছিলেন- তোমাদের রব তোমাদেরকে নাযিলকৃত তিন হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেন, তবে কি তা তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবেনা? হ্যাঁ যদি তোমরা ধৈর্য্যধারণ কর এবং তাক্বওয়া অবলম্বন কর এবং তোমরা হঠাৎ আক্রান্ত হলে তোমাদের রব তোমাদের সাহায্য করবেন পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফেরেশতা দিয়ে। আর মহান আল্লাহ পাক খোশ খবর দান করেন, যাতে তোমাদের অন্তর এতমিনান লাভ করে।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২৪, ১২৫, ১২৬)
এরপরে হুনায়নের যুদ্ধে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের সাহায্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ২৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
ثم انزل الله سكينته على رسوله وعلى المؤمنين وانزل جنودا لم تروها وعذب الذب الذب الذين كفروا وذلك جزاء الكافرين.
অর্থ : অতঃপর মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে ছাকিনা (শান্তি) নাযিল করেন, উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুমিনদের উপর এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী নাযিল করেন, যাদেরকে তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফিরদেরকে। আর এই হলো কাফিরদের জাযা বা বদলা।আর এভাবে মহান আল্লাহ পাক, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রত্যেক জ্বিহাদে তো বটেই, এমনকি প্রতিটি কাজেও ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, যা তাফসীরে কুরতুবী, আহ্কামুল কোরআন, খাযেন, বাগবী, মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ইবনে আব্বাস, ইবনে কাছির ও কবীর ইত্যাদি। এছাড়া হাদীছ শরীফের কিতাব সমূহেও বর্ণিত রয়েছে।
উল্লেখ্য দাওয়াত এর কাজ ছাড়াও যে, মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেন, তার বহু বহু প্রমাণ রয়েছে। আর তা নবী-রাসূল ছাড়াও হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ মনোনীত ব্যক্তিগণকেও মহান আল্লাহ পাক সব সময়ই ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করিয়ে থাকেন।
এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়, সাইয়্যিদুল মুরাসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত পিতা, হযরত খাজা আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পবিত্র জীবন মুবারকের ঘটনা। উল্লেখ্য আহলে কিতাব বা ইহুদী-খ্রীষ্টান পাদরী ও তাদের প্রেরিত দূতগণ ছিল উনার শত্রু। কারণ তারা জানতো যে, হযরত খাজা আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার পৃষ্ঠ মুবারকে রয়েছে, “নুরে মুহম্মদী।যার কারণে উনাকে তারা শহীদ করে ফেলতে চেয়েছিল। 
এরূপ একটি ঘটনা হাদীয়ে বাঙ্গাল, হযরত কারামত আলী জৌনপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার লিখিত নুরে মুহাম্মদী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামনামক কিতাবে উল্লেখ করেছেন-          একদিন হযরত খাজা আব্দুল্লাহ্ আলাইহিস সালাম শিকারের উদ্দেশ্যে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন। যা অবগত হয়ে শত্রুদের একটি বিরাট দল হযরত খাজা আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে শহীদ করার জন্য তৈরী হয়ে তলোয়ার নিয়ে তিনি যেখানে ছিলেন, সেখানে উপস্থিত হয়ে উনাকে শহীদ করতে উদ্যত হলো। সেখানে হযরত ওহাব বিন মানাফ, যিনি হযরত আমিনা আলাইহাস সালাম উনার পিতা ছিলেন, তিনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন যে, তিনি দেখতে পেলেন হঠাৎ করে অতি দ্রুতগামী একদল অশ্বারোহী সৈন্য এসে হযরত খাজা আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে হেফাযত করলেন এবং উক্ত শত্রু দলকে পর্যুদস্ত করে দিলেন। হযরত ওহাব-বিন মানাফ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন যে, উনারা দেখতে ইহজগতের কোন মানুষের সদৃশ ছিলেননা। মূলত উনারা ছিলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে প্রেরিত ফেরেশতা।
এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, হযরত খাজা আব্দুল্লাহ আলাইহিস সালাম দাওয়াত বা ইবাদত কোন কাজেই মশগুল ছিলেননা। কিন্তু ফেরেশতারা উনাকে খাছভাবে সাহায্য করলেন।      আবার নুযহাতুল মাযালিশকিতাবে উল্লেখ রয়েছে, হযরত হোযায়ফা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, একদা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাযে দাঁড়ালেন। নামাজান্তে তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার দিকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম কোথায়? সাথে সাথে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ্ উপস্থিত আছি।
অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আপনি কি আমার সাথে প্রথম রাকায়াতে শরীক হয়েছিলেন?” তিনি জবাব দিলেন- জি! কিন্তু জামায়াতে শামিল হওয়ার পর আমার মনে নিজের ওযু সম্পর্কে সন্দেহ উপস্থিত হয়। কাজেই আমি নামায ছেড়ে দিয়ে পুণরায় ওযু করার জন্য মনস্থির করি। এরপর মসজিদের দরজায় পৌঁছে একটি আওয়াজ শুনতে পাই, কেউ যেন আমাকে বলছে- হে আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম আসুন, যেদিক থেকে আওয়াজটি শ্রুত হচ্ছিল, আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, একটি স্বর্ণের পিয়ালায় বরফ অপেক্ষা সাদা এবং মধু অপেক্ষা মিষ্টি পানি রয়েছে এবং সে পেয়ালাটিকে একটি চমৎকার রুমাল দ্বারা ঢেকে রাখা হয়েছে। রুমালটির গায়ে লিখা ছিল- লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ্। আমি সে পানি দ্বারা ওযু করে পুণরায় এসে জামায়াতে শামিল হয়েছি।
এ ঘটনা শুনে হযরত নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “আমি প্রথম রাকায়াতে সূরা কিরাআত শেষ করে রুকু করার উদ্দেশ্যে হাঁটুতে হাত রাখলাম, কিন্তু বাধা প্রাপ্ত হলাম। মনে হলো, কেউ যেন আমাকে সজোরে ঠেলে ধরে রেখেছে, যাতে আমি যথানিয়মে রুকু করতে না পারি। 
কিন্তু আপনি হযরত আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম যখন পুণরায় নামাযে শামিল হলেন, তখনই আমার সে বাঁধা কেটে গেল। তারপর আমি যথারীতি রুকু করলাম। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বললেন,    এবার শুনুন, যিনি ওযুর পানির ব্যবস্থা করেছিলেন, তিনি ছিলেন- হযরত মীকাঈল আলাইহিস সালাম, যিনি রুমাল দ্বারা ঢাকনা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন- হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম এবং যিনি আমার হাঁটুতে ধরে রেখেছিলেন, যার দ্বারা আমি বুঝতে পারি যে, রুকুতে পরে যেতে হবে, তিনি হলেন- হযরত ইস্রাফীল আলাইহিস সালাম। তিনি এরূপ করেছিলেন যেন আপনার জামায়াতের একটি রাকায়াতও বাদ যেতে না পারে।
এ ঘটনায় দেখা যায় যে, হযরত আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম উনার ক্ষেত্রে জামায়াতের প্রথম রাকায়াতের মত ইবাদতে শামিল হওয়ার কাজেও ফেরেশতারা বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। আবার সীরাতে ইমাম হাসান-হুসাইন আলাইহিমাস সালামএ বর্ণিত রয়েছে যে, “একদিন হযরত ফাতিমা আলাইহাস সালাম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে এসে কেঁদে কেঁদে জানালেন যে, সেদিন সকালে হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম এবং হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম কোথায় যেন চলে গেছেন এবং তখনও পর্যন্ত উনারা বাসায় পৌঁছেননি। একথা শুনে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিন্তিত হয়ে, হযরত ইমামদ্বয় আলাইহিমুস সালাম উনাকে খোঁজার জন্য প্রস্তুত হলেন। 
আর তখনি হাজির হলেন, হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম। তিনি বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি চিন্তিত হবেন না। হযরত ইমাম আলাইহিমাস সালাম উনারা বেড়াতে বেড়াতে বণী নজীর গোত্রের পল্লীতে গিয়ে সেখানে পথের উপরেই ধুলার মাঝে দুজনে নিদ্রিত হয়ে পড়েছেন। উনাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মহান আল্লাহ তায়ালা দুজন ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছেন। উনারা হযরত ইমামুল হুমাম আলাইহিমাস সালাম উনাদের শরীরে ছায়া করে দাঁড়িয়ে আছেন ও বাতাস করছেন।          একথা শুনে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালামসহ বনু নজীর পল্লীতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, ফেরেশতা দুজন তখনও সেখানে রয়েছেন। একজন তার পালক বিস্তার করে হযরত ইমামুল হুমাম আলাইহিমাস সালাম উনাদেরকে ছায়া দিয়ে আছেন এবং অপর ফেরেশতা অনবরত বাতাস করছেন। বর্ণিত ঘটনায় দেখা যায় যে হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম, হযরত ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ফেরেশতারা উনাদের খাছভাবে খেদমত করেছেন। অর্থাৎ এখানেও খাছভাবে কোন ইবাদত বা দাওয়াত-এর বিষয় ছিলনা।   আবার প্রখ্যাত আলেম ও বিশিষ্ট ওলীআল্লাহ হযরত ফরিদউদ্দীন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, হযরত শায়খ সাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শেখ নিযামী ও হযরত মোল্লা জামী রহমতুল্লাহি আলাইহি। সে মহান ব্যক্তিত্ব হযরত ফরীদ উদ্দীন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার লিখিত বিশ্বখ্যাত ও বহুল পরিচিত তাযকিরাতুল আওলিয়া কিতাবে। এছাড়াও আরো অনেকের দ্বারা প্রণিত তাযকিরাতুল আওলিয়া নামক কিতাবে বর্ণিত- হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি নামে বিশিষ্ট ওলী মহান আল্লাহ পাক কথা, যিনি মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে হাবীব নামে অভিহিত হয়েছিলেন। উনার জীবনীতেও রয়েছে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ইবাদতে ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য প্রাপ্ত হওয়ার ঘটনা।             তিনি প্রথম জীবনে সুদের ব্যবসায় জড়িত বিরাট ধনী ব্যক্তি ছিলেন। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে ঘটনাক্রমে তিনি তওবা করে সুদের ব্যবসা ছেড়ে দিলেন এবং প্রত্যেককে তার পাওনা ফিরিয়ে দিলেন, যার ফলে তিনি একরূপ নিঃস্ব হয়ে পড়লেন। কিন্তু সে অবস্থায়ও তিনি খাছভাবে ইবাদতে মনোযোগী হলেন এবং এজন্য তিনি ফোরাত নদীর তীরে একটি ইবাদতখানা তৈরী করলেন। দিনের শুরুতে তিনি হাজির হতেন হযরত ইমাম হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মজলিশে। সেখানে দর্স নিয়ে অতঃপর ইবাদতখানায় গিয়ে সারাদিন ইবাদত করে সন্ধ্যায় বাড়ীমুখী হতেন।       এভাবে কিছুদিন গত হলে, উনার স্ত্রী একদিন খাদ্যসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ইত্যাদি ফুরিয়ে যাওয়ার কথা উনাকে জানালেন। সেকথা শুনে হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি জবাব দিলেন যে, তিনি এক মহান মালিকের কাজ করছেন এবং তার মালিক সময়মত তাকে মজুরী দিবেন। এভাবে আরো কিছুদিন অতিবাহিত হলে, উনার স্ত্রী পুণরায় আরো ব্যাকুলভাবে উনার অতি জরুরী প্রয়োজনের কথা জানালেন। অবস্থার প্রেক্ষিতে হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল যে, উনার মালিক দশ দিন পর পর মজুরী দেন। আর একথা বলেই তিনি পুণরায় ইবাদতগাহে গিয়ে ইবাদতে লিপ্ত হলেন। এভাবে যেদিন দশদিন পুরো হবে। সেদিন সকাল উনার স্ত্রী বললেন, আজকে তো দশদিন হয়ে যাবে, আজকে মজুরী পাওয়ার কথা, আপনি এই ব্যাগ নিয়ে যান, আসার সময় বাজার করে নিয়ে আসবেন। স্ত্রীর কথা শুনে তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগটি হাতে তুলে নিলেন। কারণ তিনি নিজে ভালভাবে জানেন যে, তিনি কোন কাজ করেননা। অতঃপর তিনি অন্যান্য দিনের মতই স্বাভাবিক তালীম গ্রহণ করে ইবাদতখানায় গিয়ে যথারীতি ইবাদতে লিপ্ত হলেন। এরপর যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো, তিনি বাড়ীর দিকে রওনা করলেন এবং পথিমধ্যে চিন্তা করতে লাগলেন, স্ত্রীর নিকট কি জবাব দিবেন। বিশেষ করে দূর থেকে যদি উনার স্ত্রী দেখেন খালি ব্যাগ, তাহলে কেমন হবে। একথা ভেবে তিনি প্রথম অবস্থাটা কাটিয়ে নেয়ার জন্য ব্যাগের ভিতর কিছু বালি ভরে নিলেন। 
এদিকে মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে যুবকের ছুরতে একজন ফেরেশতা এক বস্তা আটা, অপর ফেরেশতা জবেহ করা ছাগল, তৃতীয় ফেরেশতা পাত্রভরা ঘি ও মধু এবং চতুর্থজন তিনশত দিরহাম ভরা থলে নিয়ে, উনারা হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দরজায় আঘাত করে উনার স্ত্রীকে বললেন, আপনার স্বামীর মালিক, আপনার স্বামীর মজুরী পাঠিয়েছেন। এবং তিনি আরো জানিয়েছেন, আপনার স্বামী সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে আসলে উনাকে বলতে যে, তিনি কাজে যতই উন্নতি করবেন, উনার পারিশ্রমিক ততই বাড়িয়ে দেয়া হবে।
অপরদিকে সন্ধ্যায় হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন ইতস্ততঃ মনে বালি ভর্তি ব্যাগ হাতে বাড়ী ফিরছিলেন। তখন দূর থেকে নানা প্রকার খাদ্য-দ্রব্যের সুগন্ধে তিনি আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন এবং এভাবে আশ্চর্যান্বিত হয়ে তিনি যখন ঘরে ঢুকলেন, তখন উনার স্ত্রী উনাকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন এবং ঘরে প্রবেশ করলে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাগে কি রয়েছে? স্ত্রীর কথা শুনে হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুখ থেকে আফসে আফ অর্থাৎ উনার অজান্তেই বের হয়ে গেল, ‘আটা। আর মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরতে দেখা গেল, ব্যাগের বালি সত্যিই আটা হয়ে গেছে। হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার স্ত্রী হাসিমুখে সে আটা নিলেন এবং তাকে বললেন, আপনি যার চাকুরী করছেন, তিনি বড়ই মেহেরবান। তিনি দয়া করে এসব খাদ্য দ্রব্যাদি এবং টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবং সে সাথে আরো জানিয়েছেন যে, আপনি কাজে যত ভাল করবেন, আপনার পারিশ্রমিক ততই বাড়িয়ে দেয়া হবে।
হযরত হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি একথা শুনে মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ শুকরিয়া আদায় করলেন এবং আরো অধিকভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরে মশগুল হলেন। আর তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের মাধ্যমে উনাকে কুদরতী রিযিক দ্বারা মদদ করেছেন।
উল্লেখ্য এ ঘটনার দ্বারাও বিশেষভাবে প্রতীয়মান হলো যে, মহান আল্লাহ পাক দাওয়াতের কাজ ছাড়াও শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রে তার খাছ বান্দাদের এমনভাবে সাহায্য করে থাকেন। যা দাওয়াতের কাজে লিপ্ত হয়েও হাজার হাজার আম বান্দারা তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। তবে হ্যাঁ, দাওয়াতের কাজে যদি খাছ লোক থাকেন, তবে মহান আল্লাহ পাক অবশ্যই ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা হামীম সিজদা শরীফ উনার ৩০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
ان الذين قالوا ربنا الله ثم استقاموا تتزل عليهم الملائكة.
অর্থ : নিশ্চয়ই যারা বলেন, মহান আল্লাহ পাক আমাদের রব, অতঃপর এতে এস্তেক্বামাত (দৃঢ়চিত্ত) থাকেন, (তাদেরকে সাহায্য করার জন্য) তাদের নিকট ফেরেশতা নাযিল হয়।আর উপরোক্ত আলোচনার পর প্রতীয়মান হয় যে, যাঁরা খাছ বান্দা উনাদেরকে মহান আল্লাহ পাক ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেন এবং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কথানুযায়ী দাওয়াত ও ইবাদতের ক্ষেত্রে ফেরেশতার সাহায্য করা এবং না করার কথা আদৌ সত্য নয়। 
অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের এবং সংশ্লিষ্ট সকলের উপরোক্ত আক্বীদা পরহেজ করা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

৫০নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেরই আক্বীদা হলো যে, সূরা ফাতিহার মধ্যে দোয়াল্লীন-এর স্থলে যোয়াল্লীন পড়াই শুদ্ধ মত এবং এ বিষয়ে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বিশিষ্ট লোকদের লিখিত কিতাবের বর্ণনাও রয়ে গেছে। যেমন আঃ সাত্তার ত্রিশালী লিখিত তাবলীগে ইসলাম বা দ্বীনের দাওয়াত নামক কিতাবের ৩৫ পৃষ্ঠায় এরূপ বক্তব্য রয়েছে।
এখন আমাদের সুওয়াল হলো প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকের দোয়াল্লীনকে যোয়াল্লীন পড়ার এরূপ আক্বীদা কতটুকু সহীহ। নির্ভরযোগ্য দলীল-আদীল্লার ভিত্তিতে জানালে বিশেষ উপকৃত হই।

জাওয়াব : দোয়াল্লীন-যোয়াল্লীনসম্পর্কে তাবলীগ জামায়াতের লোক মাওলানা আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী যে বক্তব্য পেশ করেছে, তা নির্ভরযোগ্য সকল ফতওয়া ও ফিক্বাহের কিতাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। উপরন্ত নামায ফাসেদ বা বিনষ্ট হওয়ার কারণ। কেননা দোয়াল্লীনকে জোয়াল্লীন, মাগদুবকে মাগজুব অর্থাৎ ض (দোয়াদ)কে د (দাল) ইত্যাদি অক্ষর পরিবর্তন করে পড়লে অর্থের পরিবর্তন হওয়ার কারণে লাহনে জলী হবে ও নামায বাতিল হয়ে যাবে। 
কেননা শামী কিতাবের ১/৬৫৯ পৃষ্ঠায় ও মারাকিউল ফালাহ্ কিতাবের টিকা তাহতাবীর ১৯৮নং পৃষ্ঠায় লিখিত রয়েছে- যদি কেউ এক অক্ষরের স্থলে অন্য অক্ষর পরিবর্তন করে, এক্ষেত্রে যদি উক্ত শব্দের মর্ম অতিরিক্ত বিকৃত হয়ে পড়ে কিম্বা উক্ত শব্দ অর্থশূণ্য হয়ে পড়ে, তবে উক্ত শব্দ কোরআন শরীফের অন্যস্থলে থাকুক আর না থাকুক তাতে নামায বাতিল হয়ে যাবে।
কাজেই ضالين-কে دالين পড়লে অর্থের পরিবর্তন হয়। যেমন-ولا الضالين  অর্থ- আর পথভ্রষ্টদের পথ  নয় এবং ولا الدالين অর্থ- পথ প্রদর্শনকারীদের পথ নয়, যা সম্পূর্ণ উল্টো অর্থ। আর এরূপ পড়লে কুফরী হবে। যেমন ফিক্বাহে আক্বরের টিকা ২০৫ পৃষ্ঠার মধ্যে লেখা রয়েছে,
فى المحيط سئل الامام الفضلى عمنن يقرأ الظاء المعجمة مكان الضاد المعجمة او يقرأ اصحاب الجنة مكان اصحاب النار او على العكس فقال لا يجور امامته ولو تعمد يكفر قلت اما كون تعمده كفرا فلا كلام فيه.
অর্থ : মুহীত কিতাবে আছে- ইমাম ফজলী রহমতুল্লাহি আলাইহি জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, কোন ব্যক্তি দোয়াদ-এর স্থলে জোয়া পড়ে কিম্বা আছহাবুলজান্নাহ্-এর স্থলে আছহাবুন্নারপড়ে অথবা তার বিপরীত (পড়ে) তার সম্পর্কে। তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন, তার ইমামতি করা জায়েয নেই। আর যদি সে স্বেচ্ছায় এরূপ করে, তবে সে কাফির হবে। আল্লামা মুল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, স্বেচ্ছায় এরূপ পড়লে সে কাফির হবে, এতে মতভেদ নেই। 
তাহজাব কিতাবে উল্লেখ আছে,
ولو قرأ الضاد مكان الظاء ار على العكس تفسد صلاته عند ابى حنيفة ومحمدرح.
অর্থ : যদি কেউ দোয়াদকে জোয়ার স্থলে অথবা জোয়াকে দোয়াদ-এর স্থলে পড়ে, তবে ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে তার নামায বাতিল হবে।
ফতোয়ায়ে সিরাজিয়ার ২১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে,
ولو قرأ ولا الضالين با لذال او بالظاء عند عامة المشانخ رح تفسد صلاته.
অর্থ : অধিকাংশ ফক্বীহ্গণের মতে যদি কেউ
ولاالضالين
-এর (দোয়াদকে) ذ (যাল) অথবা ظ (জোয়া)-এর দ্বারা পরিবর্তন করে পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।
মুনইয়াতুল মুছাল্লী কিতাবে বলা হয়েছে,
اما اذا قرأ مكان الذال ظاء او قرأ الظاء مكان الضاد او على القلب تفسد صلاته عليه اكشر الائمة.
অর্থ : অধিকাংশ ইমামগণের মতে যখন কেউ ذال (যাল)-এর স্থলে ظاء (জোয়া) অথবা ض (দোয়াদ)-এর স্থলে ظاء (জোয়া) অথবা তার বিপরীত পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে। খাজানাতুল আকমাল কিতাবে উল্লেখ আছে,
اذ قرأ كان الظاء ضادا او مكان الضاد ظاء فقال القاضيى المحسن الا حسن ان يقال ان يقال ان تعمد ذلك تبطل صلاته عالما كان او جاهلا.
অর্থ : যদি কেউ জোয়া’-এর স্থলে দোয়াদ কিম্বা দোয়াদ-এর স্থলে জোয়া পড়ে, তবে কাজী মুহ্সীন বলেছেন, (এ সম্বন্ধে) এরূপ মত প্রকাশ করা উত্তম যে, যদি স্বেচ্ছায় এরূপ করে, তবে আলেম হোক, আর বেইলম (নিরক্ষর) হোক, তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।)
কাজী খানের ৬৯ পৃষ্ঠায়, কবীরীর ৪৪৯ পৃষ্ঠায়, ছগীরীর ২৪৬/২৪৭ পৃষ্ঠায় ও কবীরীর হাশিয়া হুলইয়ার ৪৬০ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে,
ولو قرأ غير المغصوب عليهم بالظاء والذال تفسد صلاته الخ.
অর্থ : যদি কেউ জোয়া বা জাল দ্বারা মাগজুব পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হবে, কেননা তা অর্থহীন শব্দ হয়ে পড়ে।খোলাছাতুল ফাতাওয়া, ১/১০/১০৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে,
لو قرأء المغضوب بالظاء او بالذال يفسد والمغضوب بالزاء يفسد.
অর্থ : যদি জোয়া, জাল কিম্বা যা দ্বারা মাগজুব পড়ে, তবে নামায বাতিল হবে।অনুরূপ ফাতাওয়া বোরহানের ২৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে। কাজী খানের ৬৯ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে,
ولو قرأ الدالين بالدال تفسد صلوته.
অর্থ : যদি কেউ দাল দ্বারা দাল্লীন পড়ে, তবে তার নামায বাতিল হবে।শামী, ১/৬৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, 
وفى الخزانة الا كمل قال القاضيى ابو عاصم ان تعمد تفسد.
অর্থ : খাজানাতুল আকমালকিতাবে আছে, কাজী আবু আছেম বলেন, যদি স্বেচ্ছায় এরূপ অক্ষর পরিবর্তন করে, তবে নামায বাতিল হবে। ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে,
قال القاضيى الامام ابو الحسن والقاضيى الامام ابو عاصم ان تعمد فسدت وان جرى على لسانه او كان لا يعرف التعيز لا تفسد وهو اعدل الاقاويل والمختار.
অর্থ : কাজী ইমাম আবুল হাছান ও কাজী ইমাম আবু আছেম বলেছেন, যদি স্বেচ্ছায় এরূপ অক্ষর পরিবর্তন করে, তবে নামায বাতিল হবে। আর যদি (অনিচ্ছায়) তার মুখ হতে এরূপ বের হয়ে পড়ে, কিম্বা প্রভেদ করতে না জানে (অর্থাৎ অজানিতভাবে এক অক্ষরের স্থলে অন্য অক্ষর উচ্চারণ করে ফেলে), তবে তার নামায বাতিল হবেনা। এটাই সমস্ত মতের মধ্যে উৎকৃষ্ট ও মনোনীত মত (অর্থাৎ ফতওয়া গ্রাহ্য মত)।
উপরোক্ত কিতাবসমূহের বর্ণনা ছাড়াও নিম্নোক্ত সকল কিতাবসমূহে দোয়াল্লীন-এর পক্ষে মত পেশ করা হয়েছে, যেমন- (তাফসীরে আযীযী, জাজরী, গায়াতুল বায়ান, কাওয়ায়েদে ছামারকান্দ, তাহতাবী, ফতোয়ায়ে সিরাজিয়া, হুলইয়া, আলমগীরী, খাজানাতুল আহকাম, খাজানাতুল আকমাল, কাজীখান, খোলাছাতুল ফতওয়া, কবীরী, ছগীরী, ফতহুল ক্বাদীর, তাহতাবী, বায্যাযীয়া, ফতওয়ায়ে বোরহান, শাফিয়া, নিজামীয়া ইত্যাদি)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, নামাযের মধ্যে দোয়াল্লীন-এর স্থলে জোয়াল্লীন পড়লে লাহ্নে জলী হবে, নামায ফাসেদ হবে, ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ অক্ষর পরিবর্তন করে পড়লে কুফরী হবে এবং যে এরূপ পড়বে, তার ইমামতি করা জায়েয হবেনা, তার পিছনে নামায পড়লে নামায হবেনা। অর্থাৎ দোয়াল্লীনেরমতটিই সহীহ্ ও গ্রহণযোগ্য মত। এর বিপরীত মত পেশ করা সম্পূর্ণ হারাম। কাজেই এ ব্যাপারে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর, অজ্ঞতামূলক ও দলীল বিহীন এবং তা অনুসরণ করা নামায ফাসেদ হওয়া সহ খাছ কবীরা গুণাহের কারণ।

৫১নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, ক্বিয়ামতের দিন স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক দাঈকে (যারা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে) হিসাব দিবেন। আর যারা দাঈ নয় (যারা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করেনা), তারা মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে হিসাব দিবেন।              এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়তের উপরোক্ত কথা শুদ্ধ না অশুদ্ধ দয়া করে জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়তের উপরোক্ত কথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা-ক্বিয়াস উনাদের সম্পূর্ণ বিপরীত, মনগড়া, বানোয়াট ও মিথ্যা। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ১৪৩নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার প্রথমাংশে বলেন,
 وكذالك جعلناكم امة وسطا لتكونوا شهداء على الناس وبكون الرسول عليكم شهيدا.
অর্থ : আর এরূপে আমি তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত করেছি, যেন তোমরা সকল মানুষের উপর স্বাক্ষ্যদানকারী হও এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বাক্ষ্যদানকারী হবেন তোমাদের উপর।এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়, হাশরের ময়দানে যখন সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের গুণাহগার উম্মতদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, “তোমরা কেন নেক কাজ করনি?” তখন তারা বলবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী কিতাবও আসেনি এবং কোন নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামও আগমন করেননি। তখন মহান আল্লাহ পাক নবী-রসূল আলাইহিস সালামগণ উনাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, “আপনারা কি তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাননি?” উনারা বলবেন, “হ্যাঁ, পৌঁছিয়েছি।তখন অন্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনার উম্মতগণ তা অস্বীকার করবে। তখন মহান আল্লাহ পাক বলবেন, “হে নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ আপনাদের সাক্ষী কোথায়?” তখন উনারা বলবেন, “উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামগণই আমাদের সাক্ষী।তখন উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হলে উনারা বলবেন, “হ্যাঁ, সমস্ত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণই উনাদের দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন এবং দায়িত্ব পালন করেছেন।একথা শুনে অন্যান্য নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের উম্মতগণ বলবে, উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো আমাদের থেকে অনেক পরে এসেছেন, উনারা কিভাবে আমাদের সাক্ষী হয়? তখন মহান আল্লাহ পাক উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উনারা বলবেন, “হ্যাঁ, আমরা তাদের থেকে অনেক পরে এসেছি, তবে আমাদের নিকট এসেছিলেন- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তিনি আমাদেরকে এ বিষয়ে জানিয়েছেন। আমরা উনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং উনাকে সত্য বলে জেনেছি, তাই আমাদের সাক্ষ্য সত্য।অতঃপর মহান আল্লাহ পাক, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন এবং তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে সমর্থন করে সাক্ষী দেবেন, “হ্যাঁ, তারা যা বলেছে, সবই সত্য এবং আমিই তাদেরকে এ তথ্য জানিয়েছি, যা আমি মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে জেনেছি।” (সিহাহ সিত্তাহ্ ও সমূহ তাফসীর)         এ পবিত্র আয়াত শরীফ ও উনার ব্যাখ্যা থেকে একথাই সাবিত হয় যে, স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক উনার নবীগণ উনাদের কাছ থেকেও হিসাব নিবেন, যাঁরা সবচাইতে শ্রেষ্ঠ দাঈ। শুধু মহান আল্লাহ পাক উনার নিকটেই নয়, কবরে মুনকার-নকিরের সুওয়ালেরও জাওয়াব দিতে হবে সকলকে। 
সে সম্পর্কে ফতহুল ক্বাদীর, তাতারখানিয়া, নাহল ফায়েক, শরহে বরযখ, ইব্রাহীম শাহী, লালীয়ে ফাখেরা, খাজানাতুল মুফতান, কানযুল ইবাদ, মুখতারুল ফতওয়া, খোলাছাতুল ফতওয়া, জাদুল আখিরাত, মিনহুল গাফ্ফার ইত্যাদি কিতাবে বর্ণিত আছে। হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে মহান আল্লাহ পাক উনার একাত্বতা ও উনাদের উম্মতের অবস্থা ও দাওয়াত সম্পর্কে। ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, উনাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন কিনা সে সম্পর্কে এবং হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম উনাকে, তিনি ওহী যথাযথভাবে পৌঁছিয়েছিলেন কিনা সে সম্পর্কে। সাধারণ লোকদেরকে এমনকি শিশুদেরকেও জিজ্ঞাসা করা হবে উনাদের রব সম্পর্কে, নবী সম্পর্কে ও দ্বীন সম্পর্কে ইত্যাদি।
অতএব যেখানে স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক সকল নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের কাছ থেকে হিসাব নিবেন, সেখানে সাধারণ উম্মতের মধ্যে যারা দাঈ, উনাদের কাছ থেকে হিসাব-নিকাশ নেয়া হবেনা, একথা কি করে শুদ্ধ হতে পারে? অতএব মহান আল্লাহ পাক দাঈকে হিসাব দিবেন। আর যারা দাঈ নয় তারা হিসাব দিবে-প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের একথা সম্পূর্ণরূপে প্রতারণামূলক, মিথ্যা ও বানোয়াট যা নবী-রাসূল আলাইহিস সালামগণের শানের খেলাফ। এরূপ আক্বীদা ও বক্তব্য থেকে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতসহ সংশ্লিষ্ট সকল মুসলমানদের বেঁচে থাকা ফরয-ওয়াজিব।

৫২নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, আলেম-জাহেল সকলেই দ্বীন প্রচার করবে এবং দ্বীনের তাবলীগের জন্য আলেম হওয়ার কোনই জরুরত নাই। কারণ তারা মনে করে যে, দ্বীন প্রচার শুধু আলেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত এবং এখনো যাবে। অর্থাৎ জাহেল লোক তাবলীগ করার কারণে দ্বীন টিকে ছিল এবং ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।যা তাদেরই লেখা কিতাব তাবলীগ জামায়াতের সমালোচনা  ও উহার সদুত্তর নামক কিতাবের ৯৫ পৃষ্ঠা, মূল শাঃহাঃ জাকারিয়া সাহেব, অনুবাদক- মাওলানা মুহিব্বুর রহ্মান আহমদ এবং তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব নামক কিতাবের ৯৪ পৃষ্ঠার বর্ণনা (লেখক- মাওলানা ইসমাঈল হোসেন দেওবন্দী) দ্বারাও প্রমাণিত হয়। 
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বর্ণিত বক্তব্যসমূহ কতটুকু সঠিক ও শরীয়ত সম্মত জানিয়ে বাধিত করবেন। 

জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর, বিভ্রান্তিমূলক ও পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ক্বিয়াস উনাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। যা স্পষ্টতঃ কুফরী।
প্রথমতঃ তাদের কথা হলো আলেম-জাহেল সকলেই তাবলীগ করবে বা সকলের জন্যে তাবলীগ করা অপরিহার্য এবং তাবলীগ করার জন্য আলেম হওয়ার কোন জরুরত নেই। এটি নেহায়েতই অজ্ঞতামূলক কথা। মূলতঃ তারা তাবলীগ ও মুবাল্লিগের প্রকারভেদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের সঠিক ফায়সালা না জানার কারণেই এ ধরণের অজ্ঞতাসূচক কথা বলে থাকে।        
মূলত আলেম-জাহেল সকলেই তাবলীগ করবে অর্থাৎ তাবলীগের জন্য আলেম হওয়া জরুরী নয় সত্য কথাই, তবে তা অবশ্যই যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও গ্রহণযোগ্য হবে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলেম নয় তবে মোটামুটি দ্বীনী বুঝ রয়েছে সে ব্যক্তিও তাবলীগ করবে, তবে তাবলীগে আম নয় বরং তাবলীগে খাছ। অর্থাৎ সে যদি ঘরের মুরুব্বি হয়ে থাকে, তবে তার অধীনস্থদের মধ্যে তাবলীগ করবে। এ ধরণের মুবাল্লিগ যারা তাদের জন্যে বড় আলেম হওয়া জরুরী নয়। কিন্তু তাবলীগে আমের জন্য অবশ্যই আলেম হওয়া জরুরী। কারণ জাহেল লোকের জন্য তাবলীগে আম বা আমভাবে দ্বীন প্রচার করা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয। যা কোরআন হাদীছ, ইজমা, ক্বিয়াস দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত।
উল্লেখ্য তাবলীগে আম সম্পূর্ণরূপে আলেমের দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ শুধুমাত্র হাক্কানী-রাব্বানী আলেমদের জন্যেই তাবলীগে আম করা ফরজে কিফায়া। আর এটা বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ কি, তা জানতে হবে। (تبليغ) তাবলীগ অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দুপ্রকার অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দুভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১) তাবলীগে (عام)  আম বা সাধারণভাবে, (২) তাবলীগে (خاص) খাছ বা বিশেষভাবে। আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দুপ্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক)।
মুবাল্লিগে আমঅর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারক)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পাবিত্র সূরা তাহরীম শরীফ উনার ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا قوا انفسكم واهليكم نارا.
অর্থঃ- হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও। 
আর পবিত্র বুখারী শরীফ উনার হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته.
অর্থ : সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, মিরকাত, লুময়াত ইত্যাদি)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত হাদীছ শরীফ উনার আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করবেন।            
অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তালীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম ও খাছ সকলের জন্য ফরজে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইব্নে কাছীর, কবীর) আর মুবাল্লিগে খাছ” (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-এর মত নয়। অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন।
আর যাঁরা খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট দ্বীন প্রচারক, উনাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
ولتكن منكم امة يدعون الى الخير ويأمرون بالمعروف وبنهون عن المنكر راولئك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম উনার) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১০৪)
 অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখ্লাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
فلولا نفر من كل فر قة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থ : কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২২) (তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
মূলত যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনাদেরকে অবশ্যই ওলামায়ে হাক্কানী-রাব্বানী হতে হবে। কাজেই যিনি ইলম, আমল ও ইখ্লাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হাক্কানী আলেম, আর তিনিই হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলেমগণ হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, মিশকাত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মআজহুদ, উরফুশশাজী, তালীক)
অর্থাৎ নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনারা নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে উনাদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য।
স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েয নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইব্নে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক তাঁর সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল আয়াত শরীফের আমল করেছ?” যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-  (১) পবিত্র সূরা সফ শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
يا ايها الذين امنةا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?” “তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না। (২) তিনি আবার বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন,
اتأمرون الناس بالبر ةتنسون انفسكم واتم تتلون الكتاب.
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।” “তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না। (৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انها كم عنه.
অর্থ : আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খেলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৮)
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না। তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ পবিত্র আয়াত শরীফসমূহ উনাদের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।অর্থাৎ উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়েয নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এই প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যেই ফরজে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলেমগণের জন্যেই প্রযোজ্য, যা তাঁদের জন্যে ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। অতএব, মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হবে।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে আম যা ফরজে কিফায়া তা একান্তভাবেই হাক্কানী আলেম বা নায়েবে রাসূলগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্থাৎ তাবলীগে আম-এর জন্য আলেম হওয়া জরুরী। আর জাহেলদের জন্যে তাবলীগে আম করা অপরিহার্য তো নয়ই বরং জাহেলদের জন্যে তাবলীগে আম বা আমভাবে দ্বীন প্রচার করা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, জাহেলদের দ্বীন প্রচার সম্পর্কিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট, ও জিহালতপূর্ণ। পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের খেলাফ তো অবশ্যই।
দ্বিতীয়তঃ তারা লিখেছে যে, “শুধু আলেমদের মধ্যে দ্বীন প্রচার সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত আর জাহেলদের কারণে দ্বীন টিকে ছিল এবং টিকে থাকবে।তাদের এ বক্তব্যটি সরাসরি মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল উনার প্রতি দোষারোপ করার শামিল। কারণ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূলই তাবলীগে আমকে আলেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন। যা ইতিপূর্বের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। তবে কি মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ভুল করেছেন? (নাউযুবিল্লাহ্)।
মূলত কারো পক্ষেই প্রমাণ করা সম্ভব হবেনা যে, শরীয়ত সকল উম্মতের প্রতি তাবলীগে আমকে অপরিহার্য করেছে বা সকল উম্মতকেই দাওয়াতের কাজ করতে হবে সেকথা বলেছে। অবশ্য প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ উনার ১১ নং পবিত্র আয়াত শরীফ-
كنتم خير امة اخرجت للناس تأمرون بالمعروف ةتنهون عن المنكم.
অর্থ : তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমারদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে তোমরা সৎ কাজে আদেশ ও বদ কাজে নিষেধ করবে।এর ভিত্তিতে বলে থাকে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর দ্বীনের দাওয়াতের দায়িত্ব সকল উম্মতের প্রতি অর্পিত হয়েছে। 
বস্ততঃ তাদের এ বক্তব্য বা দলীল মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, উক্ত আয়াত শরীফখানা নাযিল হয়েছিল, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাদের শানে। অর্থাৎ হযরত ছাহাবাযে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাকে বলা হয়েছে তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত তোমরা সৎকাজে আদেশ ও বদ কাজে নিষেধ করবে।হযরত ছাহাবায়ে কিরাম যে, শ্রেষ্ঠ বা খায়রে উম্মত তার প্রমাণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যেও রয়েছে, যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
خير امتى قرنى.
অর্থ : শ্রেষ্ঠ বা খায়রে উম্মত হলো আমার যুগের উম্মতগণ।অর্থাৎ হযরত ছাহাবয়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ। (বোখারী শরীফ, মেশকাত, ফাতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, মিরকাত, লুময়াত, ত্বিবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মুজাহেরে হক্ব)
মূলকথা হলো উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার হযরত ছাহাবয়ে কিরামগণ উনাদেরকে আমভাবে তাবলীগ বা দাওয়াতের কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর এর মধ্যে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই যে, হযরত ছাহাবয়ে কিরামগণ প্রত্যেকেই দ্বীনের হাক্বীক্বী আলেম ছিলেন। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ ছিলেন।
অতএব, উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দ্বারা আসলে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, তাবলীগে আম আলেমদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আমভাবে সকল উম্মতের উপর তাবলীগে আমের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বত্তব্য- দ্বীন প্রচার আলেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত।সম্পূর্ণই পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের খেলাফ।             
মূলত মানুষের পক্ষে যেরূপ দ্বীন ধ্বংস করা সম্ভব নয়, তদ্রুপ দ্বীন হিফাজত বা টিকিয়ে রাখাও সম্ভব নয়। কাজেই আলেমের মধ্যে দ্বীন প্রচার সীমাবদ্ধ থাকলে দ্বীন ধ্বংস হয়ে যেত বা মূর্খ লোকেরা দ্বীন প্রচার করার কারণেই দ্বীন টিকে আছে।এ ধরণের বক্তব্য পেশ করা সম্পূর্ণ কুফরী-শেরেকীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ এ দ্বীন যমীনে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনারই, যে কারণে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انا نحن نزلنا الذ كر واناله الحافظون.
অর্থ : নিশ্চয় আমি কোরআন শরীফ (দ্বীন) নাযিল করেছি এবং আমিই তার হিফাযতকারী।” (পবিত্র সূরা হিজর শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৯)
অতএব, মানুষের পক্ষে দ্বীনের হিফাযত করা কখনোই সম্ভব নয়। এ দ্বীনের হিফাযতের দায়িত্ব যদি মানুষের উপর থাকতো তবে এ দ্বীন অনেক আগেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।
এ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী রহমতুল্লাহি আলাইহি একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, খলীফা মামুনুর রশীদের দরবারে, কোরআন হাদীছ, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে জ্ঞানমূলক আলোচনা হতো, যাতে সর্ব বিষয়ে যারা বিশেষ জ্ঞানে জ্ঞানী, এ ধরণের আলেম, ফাজেল, জ্ঞানী, বিজ্ঞানীগণ অংশ গ্রহণ করতো, এতে উপস্থিত থাকতো এক ইহুদী পন্ডিত, যে সর্ব বিষয়েই খুব জ্ঞানমূলক বক্তব্য রাখতো। তার জ্ঞানের পরিধি দেখে, মামুনুর রশীদ তাকে মুসলমান হওয়ার জন্য একথা বলেছিল যে, মুসলমান হলে তাকে সবদিক থেকে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু সে তার পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করে সেখান থেকে চলে গেল। 
এরপর সে পুণরায় এক বৎসর পরে মামুনুর রশীদের দরবারে আসলো, এসে যথারীতি আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে, ইসলামী ফিক্বাহ সম্পর্কে খুব জ্ঞানমূলক বক্তব্য রাখলো। এ বক্তব্য শুনে মামুনুর রশীদ তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি গত বৎসর এখানে এসেছিলে? সে বললো হ্যাঁ, তখন খলীফা বললো- তখন তুমি দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এখান থেকে চলে গিয়েছিলে, এখন তুমি কি কারণে মুসলমান হলে?            
সে বললো যে, এখান থেকে গিয়ে ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করতে ইচ্ছা করলাম। আর আমি হলাম একজন বিশিষ্ট হস্তলেখা বিশারদ। আমি নিজের হাতে কিতাব লিখে খুব উচ্চমূল্যে বিক্রয় করে থাকি। আমি পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তাওরাতের তিন কপি খুব সুন্দর করে লিখলাম এবং প্রত্যেকটির মধ্যেই নিজ থেকে কিছু কম-বেশী করলাম। এগুলো নিয়ে ইহুদীদের উপাসনালয়ে যখন গেলাম, তারা খুব সুন্দর দেখে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে কিনে নিল। এভাবে ইঞ্জিলের তিন কপি লিখলাম, তার প্রত্যেকটির মধ্যেও নিজ থেকে কিছু কম-বেশী করলাম এবং সেগুলো নিয়ে খ্রীষ্টানদের উপাসনালয়ে গেলাম। তারাও খুব সুন্দর দেখে কিনে নিল। এরপর কোরআন শরীফেরও খুব সুন্দর করে তিন কপি লিপিবদ্ধ করলাম। তার মধ্যে প্রত্যেকটিতে নিজ থেকে কিছু কম-বেশী করলাম। সেগুলি নিয়ে মুসলমানদের কাছে গেলাম। তখন মুসলমানেরা উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে যাচাই-বাছাই করে দেখলো, নির্ভুল কিনা? যখন সেগুলি তারা ভুল বা কম-বেশী দেখলো, তখন তারা তা ফেরত দিল।
এই ঘটনা থেকে আমি এই শিক্ষাই গ্রহণ করলাম যে, কোরআন শরীফ হুবহুই সংরক্ষিত আছে। মহান আল্লাহ পাক নিজেই এর সংরক্ষণ করছেন। এটি দেখেই আমি মুসলমান হলাম। এ ঘটনার বর্ণনাকারী কাজী ইয়াহিয়া বিন আকতাম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ঘটনাক্রমে সে বছরই আমার হজ্ব করার সৌভাগ্য হয়। সেখানে বিশিষ্ট আলেম ইমাম সুফিয়ান ইবনে ওয়াইনা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে সাক্ষাত হলে ঘটনাটি তার কাছে ব্যক্ত করলাম। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে এটাই স্বাভাবিক এবং কোরআন শরীফেও এর সমর্থন রয়েছে। কাজী ইয়াহিয়া বিন আকতাম জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ আয়াত শরীফে? ইমাম সুফিয়ান রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন যে, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে যেখানে তাওরাত, ইঞ্জিলের আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে,
بما استحفظوا من كباب الله.
অর্থ : ইহুদী খ্রীষ্টানদেরকে মহান আল্লাহ পাক উনার কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলের হিফাযতের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।” (পবিত্র সূরা মায়েদা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরফ ৪৪)
যখন ইহুদী খ্রীষ্টানরা হিফাজতের কর্তব্য পালন করেনি তখন এ কিতাবদ্বয় বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে।
পক্ষান্তরে পবিত্র কুরআন শরীফ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
وانا له لحا فظون.
অর্থ : নিশ্চয় আমিই এর সংরক্ষক।” (পবিত্র সূরা হিজর শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৯)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং এর হিফাযতকারী হওয়ার কারণে কেউ হাজারো কোশেশ করেও এর একটা জের, জবর বা নক্তা পর্যন্ত পরিবর্তন করতে পারেনি।
অতএব, এ দ্বীনের হিফাযতকারী যেহেতু মহান আল্লাহ পাক সেহেতু এ দ্বীন এখনো পৃথিবীতে বহাল অবস্থায় আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। তবে মুবাল্লিগগণ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী দ্বীনের দাওয়াত মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়ে দ্বীনের খাদেম হতে পারেন, এর বেশী কিছুই নয়।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, মূর্খ লোকের দ্বারা দ্বীনের খেদমত হওয়াতো দূরের কথা, দ্বীনের ক্ষতিই বেশী হয়ে থাকে। যার ফলে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “দুপ্রকার লোক আমার পিঠ বাঁকা করে দিয়েছে। (১) বে-আমল আলেম, (২) বে-ইলম অর্থাৎ মূর্খ আবেদ।
এখানে উল্লেখ্য যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মূর্খ লোকেরা আমার পিঠ বাঁকা করেছে বা আমার দ্বীনের ক্ষতি করেছে।আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলছে, মূর্খ লোকের কারণে দ্বীন টিকে আছে।
এখন প্রশ্ন হলো, কোনটা সত্য? যদি বলা হয় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে কথা সত্য, তবে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয়। আর যদি তাদেরটা সত্য বলা হয়, তবে পবিত্র হাদীছ শরীফ মিথ্যা সাব্যস্ত হয়। অথচ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা কাট্টা কুফরী।
কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য ডাহা মিথ্যা ও পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সম্পূর্ণই খেলাফ।
মূলত পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে একথাই প্রমাণিত হয় যে, মহান মহান আল্লাহ পাক হক্কানী-রব্বানী আলেমগণের মাধ্যমেই এ দ্বীনকে হিফাযত করবেন। মূর্খদের নিকট দ্বীনের সহীহ্ ও সঠিক দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্যই আলেমদেরকে পাঠিয়েছেন, পাঠাচ্ছেন এবং পাঠাবেন। তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
ان الله يبعث لهذه الامة على رأس كل مأة سنة من يجدد لها دينها.
অর্থ : নিশ্চয় মহান আল্লাহ পাক এ উম্মতের হিদায়েতের জন্যে প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে একজন করে মুজাদ্দিদ প্রেরণ করবেন, যিনি উম্মতের দ্বীনকে সংস্কার করবেন।” (আবু দাউদ, বযলুল মাজহুদ, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, তালীকুছ ছবীহ, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্)
অর্থাৎ যখন ওলামায়ে সূবা বিদয়াত-বেশরা ও মূর্খ লোকদের কারণে দ্বীনের ভিতর নানা রকম কুফরী, শেরেকী ও বিদয়াতের সংমিশ্রন ঘটবে, তখন দ্বীন থেকে সে সকল কুফরী, শেরেকী ও বিদ্য়াতী কথা-বার্তা বা আমল দূরীভূত করে দ্বীনকে সংস্কার করার জন্যে, এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যিনি হাক্বীক্বী নায়েবে রাসূল অর্থাৎ যিনি ইলমে শরীয়ত ও ইলমে তাসাউফে পূর্ণতা প্রাপ্ত হক্কানী-রব্বানী আলেম। যাঁর আক্বীদা ও আমল, সীরত-ছূরত সম্পূণই কোরআন, সুন্নাহ্, ইজ্মা-ক্বিয়াস সম্মত।            এখন প্রশ্ন উঠে, যদি মূর্খলোকের দ্বারাই দ্বীনের এ সকল কাজ হতে পারে, তবে মহান মহান আল্লাহ পাক উনার মুজাদ্দিদ প্রেরণ করার কি প্রয়োজন রয়েছে? মূলতঃ মূর্খলোকের দ্বারা দ্বীনের ক্ষতি হওয়া ব্যতীত উপকার হওয়া কখনোই সম্ভব নয়। আর এ মূর্খদেরকে হিদায়েতের পথ দেখানোর জন্যেই মুজাদ্দিদ বা আলেমগণের আবির্ভাব। যেমন- আবির্ভাব ঘটেছিল- ইমামে আযম, আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি, গাউসুল আযম, মুহীউদ্দীন, হযরত আব্দুল ক্বাদির জ্বিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, আফজালুল আওলিয়া, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সূলতানুল হিন্দ, হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি। অনুরূপ আরো অসংখ্য অগণিত নায়েবে রাসুল ও মুজাদ্দিদগণের। উনারা প্রত্যেকেই ছিলেন, দ্বীনের খাছ মুবাল্লিগ ও হাক্বীক্বী আলেম। উনাদের উসীলায়ই দ্বীন টিকে আছে এবং থাকবে। 
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উল্লেখিত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর, অজ্ঞতামূলক ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। এ ধরণের বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যেই ফরজ-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।


৫৩নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের অনেকের আক্বীদা হলো যে, মাগরিব ও বিত্রের উমরী ক্বাজা, ক্বাজায়ে আদা-এর ন্যায় আদায় করতে হবে। এ কথার প্রমাণ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা প্রকাশিত মাসিক আত তুরাগ পত্রিকা, সম্পাদক- হামীদ রশীদ, ১১তম খণ্ড ১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে। উমরী ক্বাজা সম্পর্কিত তাদের উপরোক্ত ফতওয়া কতটুকু শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য, নির্ভরযোগ্য দলীল দ্বারা জানিয়ে বাধিত করবেন।

জাওয়াব : উমরী ক্বাজা সম্পর্কে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মুখপত্র আত তুরাগপত্রিকার উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ ভুল ও অশুদ্ধ। কারণ সর্বজন স্বীকৃত ও নির্ভরযোগ্য ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবের বর্ণনার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ উমরী ক্বাজা সম্পর্কে ফিক্বাহ্ ও ফতওয়ার কিতাবের সঠিক ও বিশুদ্ধ মত হলো-   কাজ্বা নামায দুপ্রকার- (১) কাজ্বায়ে আদা ও (২) কাজ্বায়ে উমরী।
কাজ্বায়ে আদা আবার দুধরণের- প্রথমতঃ যে সমস্ত কাজ্বা নামাযের ক্ষেত্রে তরতীব রক্ষা করতে হয়। আর এর হুকুম হলো নামায যদি পাঁচ ওয়াক্ত বা তার চেয়ে কম কাজ্বা হয়, তাহলে তরতীব অনুযায়ী কাজ্বা আদায় করে তারপর ওয়াক্তিয়া নামায পড়তে হবে। যেমন কারো যদি ফজর, যোহর, আছর, মাগরীব, ইশার নামায কাজ্বা হয়, তাহলে পরবর্তী ফযরের নামায পড়ার পূর্বে উক্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পর্যায়ক্রমে কাজ্বা আদায় করে তারপর ফযর নামায পড়তে হবে, অন্যথায় ফযর নামায আদায় হবেনা।              আর যদি ফযর থেকে ফযর পর্যন্ত ৬(ছয়) ওয়াক্ত বা তদুর্ধ নামায কাজ্বা হয়, তাহলে পরবর্তী যোহর পড়ার সময় কাজ্বা নামাযের তরতীব রক্ষা না করলেও চলবে। বরং কাজ্বা নামায সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী হারাম ওয়াক্ত বাদে যেকোন সময় আদায় করলেই নামায শুদ্ধ হয়ে যাবে।
তবে তরতীবওয়ালা নামাযের ক্ষেত্রে কাজ্বা আদায় করতে গেলে যদি ওয়াক্তিয়া নামাযের সময় কম থাকার কারণে ওয়াক্তিয়া নামায ফওত হওয়ার আশঙ্কা হয়, তাহলে তরতীব রক্ষা না করে বরং ওয়াক্তিয়া নামায পড়ে নিতে হবে। যেমন কারো মাগরিব ও ইশার নামায কাজ্বা হয়ে গিয়েছে এবং ফযরের ওয়াক্তে এমন সময় ঘুম হতে উঠেছে- সুর্য উদয় হতে ৫/৭ মিনিট বাকী, এখন ওযু করে যদি কাজ্বা নামায আদায় করতে যায়, তাহলে আর ফযরের ফরয নামায পড়া যায়না, এমতাবস্থায় তরতীব রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। বরং ফযরের নামায পড়ে নিতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, তরতীব তিন কারণে ভঙ্গ হয়- (১) পাঁচ ওয়াক্তের বেশী কাজ্বা থাকলে, (২) নামাযের ওয়াক্ত কম থাকলে, (৩) তরতীবের কথা ভুলে গেলে। 
উল্লেখ্য উমরী কাজ্বা বলে এমন কাজ্বা নামাযকে, যে নামায ক্বাজা থাকা সম্বন্ধে নামাযী ব্যক্তি সন্দেহে রয়েছে, অর্থাৎ তার কাজ্বা নামায বাকী আছে কিনা? এ সন্দেহের কারণে যে কাজ্বা নামায পড়া হয়, তাকে উমরী কাজ্বা বলে। উমরী কাজ্বার ক্ষেত্রে মাগরিব ও বিত্র নামায তিন রাকায়াতের স্থলে চার রাকায়াত পড়তে হয়। যেমন- মাগরিব এবং বিত্র নামায নিয়ম মোতাবেক যথারীতি শেষ করে সালাম ফিরানোর পূর্বে দাঁড়িয়ে আর এক রাকায়াত (চতুর্থ রাকায়াত) নামায সুরা মিলায়ে পড়তে হবে। অতঃপর রুকু সিজদা করে তাশাহুদ, দরূদ শরীফ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করতে হবে। (আলমগীরী, দুররুল মুখতার, বাহ্রুর রায়েক, হিদায়া, ফতহুল ক্বাদীর ইত্যাদি) এ প্রসঙ্গে ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে যে,
 رجل يقض الفواثت فانه يقض الوتر وان لم استيقن انه هل بقى عليه وترا ولم يبق فانه يصلى ثلاث ركعات ويقنت ثم يقعد قدر التشهد ثم يصلى ركعات ويقنت ثم يقعد قدر التشهد ثم يصلى ركعة اخرى فان كان وترا فقد اداه وان لم يكن فقد صلى التطوع اربعا ولا يضره القنوت فى التطوع.
অর্থ : কোন ব্যক্তি যদি ফউত (অনাদায়ী নামাযের ক্বাজা আদায় করতে চায়, তবে তাকে বিতর নামাযেরও ক্বাজা আদায় করতে হবে। 
আর যদি সে বিত্র নামায ফউত হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়, তাহলে সে তিন রাকায়াত নামায আদায় করবে এবং দোয়ায়ে কুনুতও পড়ে নিবে। অতঃপর তাশাহুদ পরিমাণ বসার পর অতিরিক্ত এক রাকায়াত পড়বে। এক্ষেত্রে যদি বিত্র থাকে, তবে তা আদায় হয়ে যাবে। আর যদি বিত্র না থাকে, তবে চার রাকায়াতই নফল হিসেবে গণ্য হবে। নফল নামাযের ক্ষেত্রে দোয়ায়ে কুনুত কোন প্রকার ক্ষতি করবেনা।” (ফতওয়ায়ে আলমগিরী ১ম খন্ড ১২৫ পৃষ্ঠা) অনুরূপ মাগরিব নামাযের উমরী কাজ্বা সম্পর্কে দুররুল মুখতার কিতাবে বর্ণিত আছে।         
অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সমর্থিত আত্ তুরাগপত্রিকায় প্রকাশিত উমরী কাজ্বা সম্পর্কিত তাদের উক্ত ফতওয়া সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী। যা আমল করা থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয-ওয়াজিব। কারণ তা আমল করলে নামায শুদ্ধ হবেনা।         
অপরদিকে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদেরও উচিৎ অনুরূপ ফতওয়া প্রদান করা হতে বিরত থাকা। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে,
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من افتى بغير علم كان اثمه على من افتاه.
অর্থ : হযরত আবু হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তিকে ইলম ব্যতীত ফতওয়া দেয়া হয়েছে, অতঃপর সে তদানুযায়ী কাজ করেছে, তার গুণাহ যে তাকে ফতওয়া দিয়েছে, তার উপরই পড়বে।” (আবু দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, বজলুল মাজহুদ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, লুময়াত, তালীকুছ ছবীহ)
তাই বিনা তাহক্বীক্ব ও বিনা দলীল-আদিল্লায় কারো কোন ফতওয়া মোতাবেক আমল করা শরীয়তসম্মত নয়।
(অসমাপ্ত)

0 Comments: