গবেষণা
কেন্দ্র মুহম্মদীয়া
জামিয়া শরীফ
[সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আ’লামীন উনার এবং
অসংখ্য দুরূদ ও
সালাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ” উনার ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের
আতঙ্ক ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার
নামায ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে
ফতওয়া,
মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ
নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে
সাইয়্যিয়াহ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরয নামাজের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়
সম্পর্কে ফতওয়া,
ইনজেকশন
নেওয়া রোজা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ উনার নামাজে
বা অন্যান্য সময় পবিত্র কুরআন শরীফ
খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ নামায বিশ
রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে
ফতওয়া প্রকাশ করার পর চতুর্দশ (১৪তম) ফতওয়া হিসেবে (৩৫তম সংখ্যা থেকে) প্রচলিত
তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ
পাক উনার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]
[বিঃদ্রঃ পাঠকগণের সুবিধার্থে ফতওয়ার ভুমিকার কিছু অংশ পুণরায় প্রকাশ করা হলো]
“প্রচলিত
তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ”
মহান আল্লাহ
পাক রাব্বুল আ’লামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
كنتم
خير امة اخرجت اللناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله.
অর্থ : “তোমরা (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার
কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের
আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১১০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান
আল্লাহ পাক তাবলীগ তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের
সাথে সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। সেটা হলো- تؤمنون অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা।
অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। তবেই সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে
নিষেধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ফায়দা বা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি
লাভ করা সম্ভব হবে।
স্মরণযোগ্য
যে, বর্তমান প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের বেশকিছু লেখনী, বক্তব্য,
বিবৃতি, আমল ও আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে
সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের মনে নানাবিধ সংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যার
ফলশ্রুতিতে “মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার” পাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ হতে “মাসিক আল
বাইয়্যিনাতের”
আকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য বিভাগ “সুওয়াল-জাওয়াব” বিভাগে,
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে
প্রচারিত বেশকিছু আপত্তিজনক আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ উল্লেখ করে অসংখ্য চিঠি আসে।
কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আ’লামীন কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক করেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : “যদি
তোমরা না জান,
তবে আহলে যিকির বা হক্কানী আলেমগণের নিকট জিজ্ঞাসা করো।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩ ও পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)
অর্থাৎ তোমরা যারা জাননা
বা দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান রাখনা, তারা যাঁরা জানেন, উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।
অতএব, যাঁরা জানেন, তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব হলো- প্রশ্নকারীর প্রশ্নের
শরীয়তসম্মত জাওয়াব প্রদান করা। কারণ যারা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নকারীর প্রশ্নের
জবাব প্রদান হতে বিরত থাকবে, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে। যেমন সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন,
من
سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : “যাকে
দ্বীন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়, জানা থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা গোপন করে অর্থাৎ জবাব না দেয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।” (আবু দাউদ,
তিরমিযী, ইবনে মাযা, আহমদ
শরীফ,
মিশকাত শরীফ, বযলুল মাজহুদ, উরফুশশাজী,
তোহফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক,
আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে, “তার জ্বিহ্বা আগুনের
কেঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হবে।”
কাজেই
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে, যে ভয়াবহ
শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার থেকে বাঁচার জন্যে অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করার
লক্ষ্যে “মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার” অগণিত পাঠক, গ্রাহক ও সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের প্রেরিত সুওয়ালসমূহে উল্লেখকৃত
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ,
ইজমা ও
ক্বিয়াস উনাদের
দৃষ্টিতে জাওয়াব বা ফতওয়া দেয়া হলো।
প্রকৃত
বন্ধুর পরিচয়
এখানে
বিশেষভাবে স্মরণীয় এই যে, মূলতঃ আমাদের সাথে কারো যেরূপ
বন্ধুত্ব নেই,
তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের
খেলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ বন্ধুত্ব
বা বিদ্বেষ একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যেই হতে হবে।
এ
প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
من
احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : “যে
ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মুহব্বত বা বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী, বজলুল
মাজহুদ,
উরফুশশাজী,
তোহফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস সুনান, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত
ত্বীবী,
তালীক, মোজাহেরে হক্ব, লুময়াত,
মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
বস্তুতঃ
মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি সবই উপরোক্ত হাদীছ শরীফের মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
কাজেই “মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায়” প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক ‘তাবলীগ জামায়াত’ সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো- “প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে” উল্লেখকৃত
আক্বীদাসমূহের সঠিক, বিশুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত ফায়সালা প্রদান এবং প্রচলিত ৬ (ছয়)
উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতের কাজে যারা মশগুল রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা উক্ত আক্বীদাসমূহ জেনে হোক বা না জেনেই হোক বিশ্বাস করে এবং
তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করে, নিজেদের ও জনসাধারণের ঈমান ও
আমলের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের সে ঈমান ও আমলের হিফাযত করা
ও সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণের নিকট সত্য বা হক্ব বিষয়টি ফুটিয়ে
তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ইহ্লৌকিক ও পারলৌকিক এত্মিনান ও নাযাত লাভ
করতে পারে।
মূলত
মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তাই এক মু’মিন অপর মু’মিনের ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমানী আলামত। কারণ পবত্রি হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক হয়েছে যে,
المؤمن مرأة المؤمن.
অর্থ : “এক মু’মিন অপর মু’মিনের জন্যে আয়না স্বরূপ।” (আবূ দাউদ শরীফ, বযলুল মাজহুদ)
এ
প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, আমীরুল মু’মিনীন,
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম স্বীয় খিলাফতকালে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার রীতিনীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত আনছার এবং মুহাজির হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি আমি দ্বীনের হুকুম-আহকামকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে শরীয়ত বিরোধী কোন আদেশ
দান করি,
তবে তোমরা কি করবে?” উপস্থিত
লোকেরা নীরব রইল। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই কথার
পূণরাবৃত্তি করলেন। তখন হযরত বশীর ইবনে সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “যদি আপনি
এরূপ করেন,
তবে আমরা আপনাকে এরূপ সোজা করবো, যেরূপ
তীরকে সোজা করা হয়।” এ কথা শুনে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম বললেন,
“তোমরাই আমার প্রকৃত বন্ধু, দ্বীনের
কাজে সাহায্যকারী।” (আওয়ারেফুল মা’আরেফ)
সুতরাং
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার আলোকে অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃ পূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল
হিফাযতের লক্ষে বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও
বক্তব্যসমূহের শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো। যাতে করে সত্যান্বেষী, সমঝদার মুসলমান ও প্রচলিত তাবলীগকারীগণ সে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী
ফায়সালা অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ
থেকে নিজেদের ঈমান ও আমলের হিফাযত করে সঠিকভাবে দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খেদমত করে
মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারেন।
এখানে
উল্লেখ্য যে,
দ্বীনের তাবলীগ যা খাছ ও আম তা শত-সহস্র লোক করবে এবং
অবশ্যই করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করতে হবে।
কারণ আক্বীদা শুদ্ধ না হলে দ্বীনী কোন খিদমতই মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে
কবুলযোগ্য নয়। উপরন্ত কুফরী আক্বীদা থাকার কারণে তাকে হতে হবে চির জাহান্নামী।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে দ্বীনী
তাবলীগ (যা আম ও খাছ) করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)
সুওয়াল : আমরা শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল
ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। কারণ আমরা অনেকদিন
যাবত তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলাম এবং এখনো তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকের সাথে
আমাদের মেলামেশা আছে। তাতে তাদের বেশ কিছু বক্তব্য বা আক্বীদা, যা আমরা অতীতেও জেনেছি এবং এখনো তা অবহিত হচ্ছি। তার মধ্যে অনেকগুলো তাদের
লেখা কিতাবেও উল্লেখ আছে। সে সমস্ত আক্বীদাসমূহ আমাদের মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে
আপত্তিকর। সেগুলো আমরা নিম্নে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম –
(৫৪) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই ধারণা করে থাকে যে, দ্বীন ইসলামের বাইরেও বিধর্মীদের মাঝে, এমন অনেক
শিক্ষণীয়,
নছীহতপূর্ণ ও অনুসরণীয় বিষয় রয়েছে, যদ্বারা
ইছলাহ্ বা পরিশুদ্ধতা লাভ করা যায়।। এ কথার প্রমাণ তাদের লেখা কিতাবেও রয়েছে।
যেমন- “তাবলীগ-ই-উত্তম জিহাদ” নামক কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ
আছে যে,
“হিন্দু যোগীরা ইবাদতে আলস্য দূর করার জন্যে সারা রাত একই অবস্থায়
দাঁড়িয়ে থাকে,
এসব দৃষ্টান্ত থেকে অন্তরের চিকিৎসার পদ্ধতি জানা জায়।” অর্থাৎ হিন্দু যোগীদের মধ্যেও শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় অনেক কিছু রয়েছে। আর
মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের “মলফুযাতের” ৯৫ পৃষ্ঠায় ১৩৬নং মলফূযে একথা লেখা আছে যে, আমাদের
এই কাজ (প্রচলিত তাবলীগ) এক প্রকার যাদুমন্ত্রের মত।
(৫৫) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বেশ কিছু মুরুব্বী ও আমীর এবং তাদের অনুসারীরা
মনে করে থাকে যে, তাদের প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য বা
তাবলীগ জামায়াতের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য পবিত্র
কুরআন শরীফ-পবিত্র হাদীছ শরীফ বহির্ভূত বিষয়ে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত পরিমাণের বাইরে বহু বহু ফযীলতের বর্ণনা করা জায়েয।
(৫৬) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, “মসজিদে
নববী ছাড়া বিশ্বের যে তিনটি দেশে, তিনটি মসজিদে প্রচলিত তাবলীগের
বিশেষ মারকায,
সেখানেই চব্বিশ ঘন্টা আমল জারী থাকে। যেমন- প্রচলিত তাবলীগ
জামায়াতের লোক দ্বারা লিখিত “এক মুবাল্লিগের পয়লা নোট বই” নামক কিতাবের (সংকলক- এঞ্জিনীয়ার মু.জু.আ. মজুমদার) ৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “সারা বিশ্বে মাত্র ৪টি মসজিদে ২৪ঘন্টা আমল চালু থাকে। যথা- (১) কাকরাইল, ঢাকা (২) নিজামুদ্দীন বস্তী, দিল্লী (৩) রায়বন্ড, লাহোর। (৪) মসজিদে নববী, মদীনা শরীফ।”
(৫৭) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত-এর লোকেরা বলে থাকে যে, তারা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র
সূরা ইমরান শরীফ
উনার ১০৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ
ولتكن
منكم امة يدعون الى الخير- يامرون بالمعروف وينهون عن المنكر واولتك هم المفلحون.
অর্থ : “তোমাদের
মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে
ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে ও বদ্ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।” এর আমল করে থাকে যা তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক কাজের দ্বারাই সাধিত হয়।
(৫৮) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই মনে করে থাকে যে, তাদের ৬
(ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের দাওয়াত মোতাবেক যাদের জীবন পরিবর্তিত হবে, শুধুমাত্র তাদের দ্বারাই আল্লাহ পাক হিদায়েত বা দ্বীনের কাজ নিবেন। যেমন- “হযরতজীর কয়েকটি স্বরণীয় বয়ান” নামক কিতাবের (সংকলক- মাওলানা
নোমান আহ্মদ) ২য় খন্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যাদের
জীবন দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন অর্জিত হবে, তাদের
দ্বারা আল্লাহ পাক হিদায়েত ছড়াবেন, .....। যাদের জীবনে দাওয়াত মোতাবেক
পরিবর্তন আসবেনা, তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের প্রকৃত কাজ নিবেন না।”
(৫৯) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক দোয়া ও তাসবীহ পড়াই সুন্নত। যা করলেই যিকির-এর হক্ব আদায়
হয়ে যায়। এবং তার দ্বারাই অনেক অনেক ফযীলত, রহমত ও
বরকত পাওয়া যায়। আর এর দ্বারাই দিল ইসলাহ্ হয়। অর্থাৎ তাসাউফ ভিত্তিক ক্বলবী
যিকিরের আর দরকার হয়না। অপরদিকে তাদের কথানুযায়ী তাসাউফী বা ক্বলবী যিকির হল নফল
এবং যার ফযীলত নগণ্য। আর এসব কথা নাকি তাদের ‘হযরতজীর
মলফুজাত’
এবং মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দীর “তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব” নামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
(৬০) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, মুর্শিদদের দ্বারা দ্বীনের ব্যাপক খেদমত কখনোই সম্ভব নয়। তাই তারা পীর সাহেবের
নিকট বাইয়াত হওয়া বা ইলমে তাছাউফ চর্চা করাকে মোটেও গুরুত্ব দেয় না। একথার সত্যতা
তাদেরই লোক দ্বারা লিখিত “আয়নায়ে তাবলীগ” নামক কিতাবের (লেখক- মুহম্মদ দাউদ আলী) ৮৮ পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত বক্তব্য দ্বারা
প্রমাণিত হয়। ইক্ত কিতাবে লিখা হয়েছে- “তাবলীগের মধ্যে পীর-মুরীদীর
প্রচলন সম্ভব নহে, কেননা পীরী-মুরীদীর দ্বারা সাধারণতঃ গন্ডিবদ্ধ একটা দলের
সৃষ্টি হইয়া থাকে। ..... এইরূপ একটা দলের দ্বারা ব্যাপক কোন কাজ করা সম্ভব নহে।
.... তাই বাধ্য হইয়া তাবলীগ এই পথ এড়াইয়া চলিয়া থাকে।”
উপরোক্ত
সুওয়ালসমূহের আলোকে এখন আমরা জানতে চাই, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত
বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু ঠিক? এবং তা
শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু প্রয়োজনীয় ও কোন স্তরের আমলের অন্তর্ভূক্ত? পবিত্র কুরআন শরীফ,
পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের
দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে ঈমান ও আমল হিফাযত করণে সাহায্য করবেন।
জাওয়াব : (আপনাদের তরফ থেকে মাসিক আল বাইয়্যিনাত
পত্রিকার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে
বিভিন্ন সুওয়ালসহ প্রায় শতাধিক (শত শত) চিঠি এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে যেসব
সুওয়ালগুলি মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলির জবাব না
দিলেই নয়,
সেরূপ অর্ধ শতাধিক সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে এবং এরূপ
প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সুওয়ালেরই জাওয়াব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। তার মধ্যে গত (৩৫, ৩৬, ৩৭ ও
৩৮তম) সংখ্যা চারটিতে যথাক্রমে (৭+৩২+৬+৮) মোট = ৫৩টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে।
বর্তমান (৩৯তম) সংখ্যায় ৭টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হলো। বাকীগুলোর জাওয়াব
পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।)
আপনাদের
বর্ণিত সুওয়াল মোতাবেক যদি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হয়ে থাকে, তাহলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই আপত্তিজনক, যা
গোমরাহীমূলক,
বিভ্রান্তিকর ও জেহালতপূর্ণ এবং তারমধ্যে কোন কোনটিতে
কুফরীমূলক বক্তব্যও রয়েছে।
তবে
আপনারা যেহেতু দলীল ভিত্তিক জাওয়াব চেয়েছেন, তাই আমরা
উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র
কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের ভিত্তিতে জাওয়াব দিব। (ইনশাআল্লাহ)
কারণ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে বলেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : “তোমরা
যারা জাননা,
যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من
سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : “যাকে ইলমের
বিষয় সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করা হয়, আর সে জানা থাকা সত্ত্বেও তা
চুপিয়ে রাখে,
তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পড়িয়ে দেয়া হবে।” (আবূ দাউদ,
তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, আহমদ,
মিশকাত, বজলুল
মাজহুদ,
তোহফাতুল আহওয়াযী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, উরফুশশাজী, তালীক, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, “তার জিব কেটে দেয়া হবে ইত্যাদি।”
তাই
নিম্নে পর্যায়ক্রমে আপনাদের প্রেরিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্য বা
আক্বীদাসমূহের পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ,
ইজমা ও
ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য
দলীলসমূহের ভিত্তিতে শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো-
তাবলীগের
অর্থ ও প্রকারভেদ
[সুওয়াল সমূহের জাওয়াব দেয়ার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করা অতি
জরুরী। কারণ তাবলীগ সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ
কি, তা জানতে হবে।
তাবলীগত্ম
(تبليغ) অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দু’প্রকার
অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দু’ভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১)
তাবলীগে আম (عام) বা সাধারণভাবে, (২) তাবলীগে খাছ (خاص) বা বিশেষভাবে। আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দু’প্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক) ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ
(বিশেষ দ্বীন প্রচারক)।
মুবাল্লিগে
আম ও তার
হিদায়েতের
ক্ষেত্র
মুবাল্লিগে
আম অর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারক)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই।
শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী,
ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার
অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত
করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ
পাক পবত্রি কুরআন শরীফ উনার
মধ্যে সূরা তাহরীমের ৬নং পবিত্র আয়াত
শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا قوا انفسكم واهليكم نارا.
অর্থ : “হে
ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে
বাঁচাও।”
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسؤل عن رعيته.
অর্থ : “সাবধান!
তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত
বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল
বারী ,
ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, শরহে নববী, মিরকাত,
লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
মহান
আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
بلغوا عنى ولو اية.
অর্থ : “তোমরা
আমার থেকে একটি পবিত্র আয়াত (পবিত্র হাদীছ শরীফ)
শরীফ হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বুখারী শরীফ,
ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস
সারী)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- তখন হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল
করবো,
ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- “না, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে
আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা
নিজেরা পুরোপুরিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে না পার। (তিবরানী শরীফ)
সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
الدين نصيحة.
অর্থ : “দ্বীন
হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।”
হযরত ছাহাবায়ে
কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের
জন্য?
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন,
“মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রিয়
রসূল,
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ
মুসলমানদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও
মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে
দেয়া হয়নি।
কাজেই
যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে
খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করবেন।
অতএব
প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার
তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তা’লীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও
কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম-এর জন্য ফরজে আইনের
অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী,
ইবনে কাছীর, কবীর)
মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র
মুবাল্লিগে
খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-এর মত নয়। অর্থাৎ
তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল
তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন।
আর যাঁরা
খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট দ্বীন প্রচারক, তাঁদের
প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,
ولتكن
منكم امة يدعون الى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون ن المنكر وارلئك هم المفلحون.
অর্থ : “তোমাদের
মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র
সুন্নাহ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম উনার) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ
করবে এবং বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলত কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১০৪)
অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ
যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন
فلولا
نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم
لعلهم يحذرون.
অর্থ : “কেন
তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা
বাঁচতে পারবে।”
(পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত
শরীফ ১২২)
(তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মা’য়ানী, রুহুল
বয়ান,
ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে
সাবী,
যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী,
কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
আর মহান
আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : “তোমরা
দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর এবং মানুষকে তা
শিক্ষা দাও।”
(দারেমী, দারে কুত্নী, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত
ত্বীবী,
তালীকুছ ছবীহ, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত ইত্যাদি)
মূলতঃ
যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁদেরকে অবশ্যই ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর
হক্কানী,
রব্বানী আলেমগণের প্রসঙ্গে মহান
আল্লাহ পাক পবিত্র
কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.
অর্থ : “নিশ্চয়ই
বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই মহান আল্লাহ
পাক উনাকে ভয় করেন।” (পবিত্র সূরা ফাতির শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলেম।”
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
من
ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟
قال الظمع.
অর্থ : “(জিজ্ঞাসা
করা হলো) আলেম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন।
পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আলেমের অন্তর থেকে ইলমকে
বের করে দেয়?
তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।” (দারেমী,
মিশকাত, মিরকাত, মোযাহেরে
হক্ব,
শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল
লুময়াত,
মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত ইত্যাদি)
অর্থাৎ
যিনি ইলম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলেম।
কাজেই
যিনি ইলম,
আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলেম, আর তিনিই
নবী আলাইহিস সালামগণের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : “আলেমগণ
হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (আহমদ,
তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে
মাযাহ,
মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্
ত্বীবী,
বজলুল মাজহুদ, তোহ্ফাতুল আহওয়াযী, মায়ারেফুস সুনান, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, উরফুশশাজী, তা’লীক)
অর্থাৎ হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের দাওয়াত ও তাবলীগ, তা’লীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি
প্রযোজ্য,
তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনারা হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে উনদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তা’লীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি
প্রযোজ্য। আর এ আম তা’লীম বা তাবলীগ ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও
বর্তমানে ওলামায়ে হক্কানী- রব্বানীগণ তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায়
পড়িয়ে,
মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি
লিখে,
ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানানভাবে দাওয়াত ও তা’লীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের
মাধ্যমে,
তাবলীগে আম-এর (ফরজে কেফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-এর (ফরজে
আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম
এবং মুবাল্লিগে খাছ-এর যোগ্যতা ও তাবলীগে আম-এর শর্ত
স্মরণীয়
যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার
করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েয নেই।
এ
প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক উনার সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে
জিজ্ঞাসা করলেন,
“তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি
ঐ সকল পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল করেছ?” যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) পবিত্র সূরা সফ শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান
আল্লাহ পাক বলেন,
يا ايها الذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থ : “হে
ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?”
“তুমি কি এ পবিত্র আয়াত
শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(২) তিনি আবার বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন,
اتأمرون
الناس بالبر وتنسون انفسكم وانتم تنلون الكتاب.
অর্থ : “তোমরা কি
মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।”
“তুমি কি এ পবিত্র আয়াত
শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انهاكم عنه.
অর্থ : “আমি এটা
চাইনা যে,
তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার
খেলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।”
(পবিত্র সূরা হুদ শরীফ, পবিত্র আয়াত
শরীফ ৮৮)
তুমি কি
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না।
তখন হযরত
ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ পবিত্র আয়াত শরীফসমূহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে
নিজেকে নিয়োজিত কর।” অর্থাৎ উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল
ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়েয নেই।
উপরোক্ত
আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ
উভয়ের জন্যেই ফরজে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী
আলেমগণের জন্যেই প্রযোজ্য, যা উনাদের জন্যে ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত।
অতএব,
মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো
শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হবে।
বিশেষভাবে
উল্লেখযোগ্য যে,
“বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ” যাকে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে, (যা আমাদের
নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে) যদি তাদের কথা
মোতাবেক তাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই তা মুবাল্লিগে
খাছ-এর জন্য করা উচিৎ ছিল। অথচ তা এমন সব লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লিগে খাছ তো
নয়ই, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই মুবাল্লিগে আম-এরও উপযুক্ত নয়। যদিও কিছু সংখ্যক
মুবাল্লিগে আম রয়েছে।
অতএব
তাবলীগে আম মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্যই করা ফরজে কেফায়া। যা মুবাল্লিগে আম-এর জন্য
করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। আর সাধারণ লোকেরতো প্রশ্নই উঠেনা।
এখন হয়তো
কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় এমন কতক লোক, যারা মুবাল্লিগে খাছ ও আম কোনটাই নয়, তারা অনেকেই নামাজের জামায়াতে
যাওয়ার সময় বা নামায পড়ার সময় অন্যকে নামাজে ডেকে নিয়ে যায়, রোজার মাসে রোজা রাখার কথা বলে, ইত্যাদি অনেক নেক কাজের কথাই বলে
থাকে,
যা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা তবে তার ফায়সালা কি? এটাও কি নাজায়েয ও হারাম?
এর
ফায়সালা হলো,
ঐ সকল লোক মুসলিম শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ-
الدين نصيحة.
অর্থাৎ “দ্বীন হচ্ছে অপরের ভাল কামনা করা।” এর মেছদাক বা নমুনা। অর্থাৎ
এদেরকে কেউ হিদায়েতের দায়িত্ব দেয়নি বা এরা হিদায়েতের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ
করেনি। এরা হচ্ছে মানুষের খয়েরখাঁ বা হিতাকাঙ্খী।
এখানে
আরো উল্লেখ্য যে, তিবরানী শরীফের উপরোক্ত হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, সৎকাজ না করলেও অপরকে সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান
আল্লাহ পাক বলেন, “তোমরা ঐ কথা বল কেন, যা তোমরা নিজেরা করোনা।”
তাহলে এই
পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বক্তব্যের মধ্যে ফায়সালা কি?
মূলত এর
ফায়সালা ওলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ দিয়েছেন। উনাদের মতে তিবরানী শরীফ উনার হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সৎ কাজ না করলেও সৎ কাজের দাওয়াত
দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন
প্রচারক)-এর জন্য। যেমন কোন বাবা নিজে নামায বা অন্যান্য নেক কাজ না করা সত্বেও
তার সন্তান ও অধীনস্থদের নামায বা অন্যান্য নেক কাজের জন্য বলতে পারেন।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা
বলার জন্য যে নিষেধবাণী করা হয়েছে, তা হলো- মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য।
অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা করতে বলা জায়েয নেই।
এ
প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
عن
انس قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مررت ليلة اسرى بى بقوم تقرض شفاههم
بمقاريض من النار- فقلت يا جبريل من هؤلاء- قال هؤلاء خظباء امتك الذين يقولون
مالا يفعلون.
অর্থ : হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেন,
“মি’রাজ শরীফ উনার রাত্রে এমন একটি ক্বওমের নিকট
দিয়ে যাচ্ছিলাম,
যাদের ঠোঁটগুলো আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। আমি হযরত
জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জবাবে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বলেন, এরা আপনার উম্মতদের মধ্যে ঐ সকল ওয়ায়েজ বা বক্তা, যারা এমন
কথা বলতো,
যেটা তারা নিজেরা আমল করতোনা।” (তিরমিযী, মিশকাত, তোহফাতুল আহওয়াজী, উরফুশ শাজী,
মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ্)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যারা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক), তারা তিবরানী শরীফের বর্ণনা মোতাবেক সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে
পারবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), তারা কুরআন
শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ মোতাবেক নিজে সৎকাজ না করে অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে
পারবেন না। কারণ যদি সকলের জন্যে আমভাবে একথা বলা হয় যে, সৎকাজ না
করেও অপরকে সৎকাজের কথা বলা জায়েয, তবে মি’রাজ শরীফ উনার পবিত্র
হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত লোকদের জিহ্বা কাটা
হলো কেন?
এতে বুঝা গেল যে, তিবরানী শরীফ উনার উক্ত হুকুম সকলের জন্যে প্রযোজ্য
নয়। বরং যারা মুবাল্লিগে আম, তাদের জন্যেই প্রযোজ্য। আর কুরআন
শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ ও মি’রাজ শরীফ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা যারা মুবাল্লিগে
খাছ, তাদের জন্যে প্রযোজ্য।
সুতরাং
হাক্বীক্বতে উক্ত পবিত্র হাদীছ
শরীফ ও পবিত্র আয়াত
শরীফ উনাদের মধ্যে কোনই দ্বন্দ্ব নেই। অনেকে
এর সঠিক ব্যাখ্যা না জানার ও না বুঝার কারণে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা
বলে থাকে। মূলত উক্ত পবিত্র আয়াত
শরীফ ও পবিত্র হাদীছ
শরীফ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়।]
সুওয়ালে উল্লেখকৃত প্রচলিত
তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্যের জাওয়াব -
৬৪নং
সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা
ইলমে তাসাউফ শিক্ষা বা ইখলাছ অর্জন করাকে মোটেও গুরুত্ব দেয়না। যে কারণে তাদের
বয়ানে ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করতঃ বা ইখলাছ হাছিল সম্পর্কে কোন আলোচনাই করতে দেখা
যায়না। পক্ষান্তরে ইলমে তাসাউফ শিক্ষার মাধ্যমে ইখলাছ হাছিল করতঃ “তাযকিয়ায়ে ক্বালব” বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হলো- “ইলমে
তাসাউফ শিক্ষা ব্যতীত কেবল চিন্তা দ্বারা ও প্রচলিত তাবলীগ করার মাধ্যমেই ইখালছ
হাছিল করা,
অন্তর পরিশুদ্ধ করা ও হুজুরী ক্বলব-এর সাথে নামায আদায় করা সম্ভব। এর জন্যে ক্বলবী যিকিরের
কোনই প্রয়োজন নেই, বরং বিভিন্ন প্রকার দোয়া-দরূদ ও তাছবীহ-তাহলীলের মাধ্যমেই তা অর্জিত হয়।”
এখন
আমাদের সুওয়াল হলো- দ্বীন ইসলাম উনার দৃষ্টিতে ইলমে তাসাউফ শিক্ষার
মাধ্যমে ইখলাছ অর্জনের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? আর তা
অর্জন করার শরয়ী পদ্ধতি কি? প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বক্তব্য
মোতাবেক সত্যিই কি চিন্তা ও খেয়ালের দ্বারা এবং তাবলীগ করার মাধ্যমে ইখলাছ হাছিল
করতঃ তাযকিয়ায়ে ক্বলব
অথবা অন্তর পরিশুদ্ধ হওয়া বা ক্বলবী যিকির ব্যতীত হুজুরী ক্বলব হাছিল করা সম্ভব? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য
দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বিশেষভাবে উপকৃত করবেন।
জাওয়াব : ইলমে তাসাউফ বা অন্তর পরিশুদ্ধ করা ও ক্বলবী
যিকির সম্পর্কিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই
অশুদ্ধ,
বিভ্রান্তিকর ও জিহালতপূর্ণ।
শুধুমাত্র
চিন্তা বা তাবলীগ করার মাধ্যমেই অন্তর পরিশুদ্ধ হয় বা ইখলাছ অর্জিত হয়, এজন্য ইলমে তাসাউফের কোন প্রয়োজন নেই, প্রচলিত
তাবলীগ জামায়াতের লোকদের এ বক্তব্য মূলত ইসলামী শিক্ষা বা ইলমে তাসাউফ সম্পর্কে
তাদের বিশেষ অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
কেননা ইলমে
তাসাউফই অন্তর পরিশুদ্ধ করে ইখলাছ হাছিল করার একমাত্র মাধ্যম, যা জরুরত আন্দাজ শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্যে ফরজে আইন। কারণ ইলমে
তাসাউফ ব্যতীত ইখলাছ অর্জন করা বা অন্তর পরিশুদ্ধ করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয় এবং
এটা ক্বলবী যিকিরের দ্বারাই হাছিল করতে হয়।
এখানে
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ পাক যখন মানুষ সৃষ্টি
করার কথা হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে জানালেন, হযরত
ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা বললেন,
اتجعل
فيها من يفسد فيها وسفك الدماء ونحن نسبح يحمدك ونقدس لك.
অর্থ : “আপনি কি
এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যারা মারামারি, কাটাকাটি ও রক্ত প্রবাহিত করবে? অথচ আমরা সব সময় আপনার প্রশংসার
সাথে তাছবীহ-তাহ্লীল পাঠ করছি ও পবিত্রতা বর্ণনা করছি।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩০)
অর্থাৎ
যদি তাছবীহ-তাহ্লীল ও যিকির- আযকারের জন্যে হয়, তবে তো
আমরাই রয়েছি,
তাহলে বণী আদম সৃষ্টি করার কি কারণ রয়েছে?
হযরত
ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের এ কথার জবাবে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
انى اعلم مالا تعلمون.
অর্থ : “নিশ্চয়ই
আমি যা জানি,
তোমরা তা জাননা।” (পবিত্র সূরা
বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩০)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, আমি
যমিনে কেন খলীফা পাঠাবো, তার হাক্বীক্বী রহস্য তোমাদের
জানা নেই। আর উক্ত গুপ্তভেদ বা হাক্বীক্বী রহস্য জানানোর উদ্দেশ্যেই মহান আল্লাহ
পাক পবিত্র সূরা জারিয়াত শরীফ উনার ৫৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
وما خلقت الجن والانس الا ليعبدون.
অর্থ : “আমি জিন ও মানব জাতিকে একমাত্র আমার
ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।”
স্মরণীয়
যে, ইবাদত হলো দু’প্রকার- ১) ইবাদতে জাহেরাহ, ২।
ইবাদতে বাতেনাহ।
ইবাদতে
জাহেরাহ হচ্ছে- নামায, রোজা, হজ্ব,
যাকাত, মুয়ামেলাত, মুয়াশেরাত ইত্যাদি।
আর
ইবাদতে বাতেনাহ হচ্ছে- ইরফানে খোদাওয়ান্দী বা মহান আল্লাহ পাক উনার মা’রিফত ও মুহব্বত। শুধু ইবাদতে
জাহেরাহ করার জন্যে হলে তো হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারাই যথেষ্ট ছিল।
মূলত মহান আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, ইবাদতে জাহেরার সাথে সাথে ইবাদতে বাতেনাহ তথা ইরফানে খোদাওয়ান্দী বা মহান আল্লাহ পাক উনার মা’রিফত মুহব্বত হাছিল করার জন্য। আর তাই উল্লেখিত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ليعبدون শব্দের তাফসীরে বা ব্যাখ্যায় মুহাক্কিক-মুদাক্কিক ও
অনুসরণীয় মুফাসসিরীনে
কিরামগণ বলেন,
ليعرفون অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক জিন ও মানব
জাতিকে সৃষ্টি করেছেন, শুধুমাত্র ইরফানে খোদাওয়ান্দী বা মহান আল্লাহ পাক উনার মা’রিফত-মুহব্বত হাছিল করার জন্য।
এক কথায়
জাহির ও বাতিন উভয় দিক দিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার হাক্বীক্বী আব্দ
বা গোলাম হওয়াই বান্দার একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই তাসাউফ উনার পরিভাষায় আবদিয়্যাতের মাক্বাম
হচ্ছে- সর্বশ্রেষ্ঠ মাক্বাম।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার মতে পরিপূর্ণ মত
ও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পরিপূর্ণ পথ হওয়াই
হাক্বীক্বী আবদিয়্যাত বা গোলামী। আর যে ব্যক্তি তা হতে পারবে, সে ব্যক্তই হাক্বীক্বী আব্দ বা গোলাম।
এ
প্রসঙ্গে কিতাবে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে যে, অনেক দিন
পূর্বে এক মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী বাজার থেকে একজন গোলাম (দাস) খরীদ করে আনেন।
খরীদ করে বাড়ীতে আনার কিছুক্ষণ পর, মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী উনার খরীদকৃত গোলামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে গোলাম,
তুমি কি খাবে? গোলাম জবাব দেয়, হুযূর আপনি আমার মনিব, আপনি আমাকে যা খাওয়াবেন, আমি তাই খাব। মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি পরিধান করবে? গোলাম জবাব দেয়, আপনি যা পরিধান করতে দিবেন, তাই পরিধান করবো। পুণরায় জিজ্ঞাসা
করলেন,
তুমি কোথায় থাকবে? গোলাম জবাব দেয়, আপনি যেখানে রাখবেন, সেখানেই থাকবো। মহান আল্লাহ পাক
উনার ওলী আবার জিজ্ঞাসা করলেন, হে গোলাম! তুমি কি কাজ করবে? গোলাম জবাব দেয়, হুযূর আপনি আমাকে যে কাজ দিবেন, আমি সে
কাজই করবো।
যখন মহান
আল্লাহ পাক উনার ওলীর খরীদকৃত গোলাম উল্লেখিত প্রশ্নসমূহের জবাব প্রদান করলো, তখন মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী কাঁদতে লাগলেন। উপস্থিত মুরীদ-মু’তাক্বেদ ও ভক্তবৃন্দ প্রশ্ন করলেন, হুযূর! আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার গোলাম তো অন্যায় কিছুই বলেনি বরং সে সন্তুষ্টিমূলক ও সঠিক জবাব দিয়েছে। মহান
আল্লাহ পাক উনার ওলী বলেন, দেখ, এ গোলাম
সন্তুষ্টিমূলক ও সঠিক জবাব দেয়ার ফলেই আমি কাঁদছি। কারণ অল্প কিছুক্ষণ হয় এ
গোলামকে আমি খরীদ করে এনেছি, আর এরই মধ্যে সে তার মতকে আমার
মতের সাথে সম্পূর্ণ মিলিয়ে দিয়েছে, এটাই তো হাক্বীক্বী গোলামীর
নিদর্শণ। আর মহান আল্লাহ
পাক আমাকে গোলামীর জন্য সৃষ্টি করেছেন, অথচ আমি এখনো সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত হতে
পারিনি।
অতএব, সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহ
পাক উনার মতে মত ও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হওয়াই হাক্বীক্বী ইবাদত
বা গোলামী। আর এ আবদিয়্যাত বা গোলামীর ব্যাপারে আমরা সকলেই মহান রাব্বুল আ’লামীন,
মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট ওয়াদাবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে উল্লেখ
করা হয় যে,
মহান আল্লাহ পাক যখন সকল মানুষের রূহ বা আত্মা সৃষ্টি করলেন, তখন সকল রূহ বা আত্মাকে একত্রিত করে বললেন,
الست بر بكم؟
অর্থাৎ “আমি কি তোমাদের রব বা মা’বূদ নই? জবাবে
রূহ সম্প্রদায় বললো- بلى হ্যাঁ,
আপনি আমাদের রব বা মা’বূদ।”
পরক্ষণে মহান আল্লাহ পাক রূহ সম্প্রদায়কে
লক্ষ্য করে বললেন, “হে রূহ সম্প্রদায়! তোমরা আজ থেকে অনেকদিন পর যমিনে যাবে, যমিনে
গিয়ে এ প্রতিজ্ঞা বা ওয়াদার কথা ভুলে যেওনা।” একথা
শুনে রূহ সম্প্রদায় বললো, হে আমাদের রব! আমরা তো অনেক বৎসর
পর যমিনে যাব,
তখন আমাদের এ ওয়াদার কথা মনে নাও থাকতে পারে। জবাবে মহান আল্লাহ পাক বলেন, “এ ব্যাপারে তোমাদের চিন্তার কোন কারণ নেই। মূলত তোমাদেরকে এ ওয়াদার কথা স্মরণ
করিয়ে দেয়ার জন্য আমি যুগে যুগে হযরত হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম
আলাইহিমুস সালামগণ উনাদেরকে যমিনে
পাঠাবো,
হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম যখন আসা শেষ হয়ে যাবে, তখন নায়েবে রসূলগণ উনাদেরকে
ক্বিয়ামত পর্যন্ত পাঠাবো।
উপরোক্ত
আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, মানবজাতি
মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত তথা হুকুম-আহ্কাম মেনে চলার ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে ওয়াদাবদ্ধ।
আর মহান আল্লাহ পাক তিনিও ওয়াদা মোতাবেক মানব জাতির নিকট
ইবাদতের পদ্ধতি বা বিধি-বিধান পৌঁছে দেয়ার জন্য এক লক্ষ বা দু’লক্ষ চব্বিশ হাজার হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম আলাইহিস সালামগণ উনাদেরকে যমিনে পাঠিয়েছেন। আর এর মধ্যে
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল হিসেবে, পূর্ণাঙ্গ দ্বীনসহ আখেরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে পাঠিয়েছেন।
এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ
পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
هوالذى
ارسل رسوله بالهدى ودين الحق ليظهرة على الدين كله وكفى با لله شهيدا.
অর্থ : “সেই মহান আল্লাহ পাক, যিনি উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে হিদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ পাঠিয়েছেন সকল দ্বীনের উপর প্রাধান্য দিয়ে (অন্য
সমস্ত দ্বীন বাতিল ঘোষণা করে)। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক উনার সাক্ষ্যিই যথেষ্ট।” (পবিত্র সূরা আল
ফাতহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
মূলকথা
হলো- মহান আল্লাহ পাক উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে ইবাদতের পদ্ধতি ও ইরফানে
খোদাওয়ান্দী বা মহান আল্লাহ
পাক উনার মা’রিফত-মুহব্বত হাছিল করার নিয়মনীতি, তর্জ-তরীক্বা বাতলিয়ে দেয়ার জন্য, আখেরী রসূল,
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার
মাধ্যমে পরিপূর্ণ দ্বীন ইসলাম দান করেন। আর তাই মহান
আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফ
উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
اليوم
اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الاسلام دينا.
অর্থ : “আজ আমি
তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন ইসলাম উনাকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সমাপ্ত করলাম এবং ইসলামকেই
তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোণীত করলাম।” (পবিত্র সূরা
মায়েদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩)
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো বলেন,
كل فى كتاب مبين.
অর্থ : “সুস্পষ্ট
কিতাবে (অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে) সব কিছুই রয়েছে।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬)
অন্যত্র ইরশাদ
মুবারক হয়েছে,
ما فر طنا فى الكتب من شئ.
অর্থ : “আমি এ
কিতাবে কোন কিছুই বর্ণনা করতে ছেড়ে দেইনি।” (পবিত্র সূরা আনয়াম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৮)
মূলত জিন ও মানব জাতির জন্যে মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুকুম মুতাবেক
চলতে হলে যা কিছুর দরকার অর্থাৎ তার ব্যক্তিগত পর্যায় হতে শুরু করে, রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এবং তার পায়ের তলা হতে মাথার তালু পর্যন্ত, তার হায়াত হতে মৃত্যু পর্যন্ত, এক কথায় ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত
সমস্যারই উদ্ভব হোক না কেন, সকল বিষয়েরই ফায়সালা বা সমাধান
দ্বীন-ইসলামের মধ্যে অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ,
পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের মধ্যে রয়েছে।
আর দ্বীন
ইসলাম পরিপূর্ণ বিধায় মহান আল্লাহ
পাক কালামে পাক উনার মধ্যে
বান্দাকে নির্দেশ দিয়েছেন,
يا ايها الذين امنوا ادخلوا فى السلم كافة.
অর্থ : “হে
ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর।”
মূলত
ইবাদতে জাহেরাহ ও ইবাদতে বাতেনাহ পরিপূর্ণ পালন করার মাধ্যমেই মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত ও
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হওয়া এবং দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে পরিপূর্ণ প্রবেশ করা সম্ভব।
ইলমে
ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ উনার
গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
ইবাদতে
জাহেরাহ ও ইবাদতে বাতেনাহ সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে পালন করার জন্য উভয় বিষয় সম্পর্কে
অন্ততঃ জরুরত আন্দাজ ইলম অর্জন করা ফরয। কারণ পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
العلم امام العمل.
অর্থ : “ইলম
হচ্ছে আমলের ইমাম।”
বিখ্যাত
কবি, জগদ্বরেণ্য সূফী সাধক, হযরত শায়খ সা’দী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মশহুর কিতাব “কারীমাতে” উল্লেখ করেন যে,
کہ سے علم نتوان خدا راشنا خت-
অর্থ : ইলমহীন ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনাকে পরিপূর্ণ চিনতে পারেনা। অর্থাৎ পূর্ণ
মা’রিফত মুহব্বত অর্জন করতে পারেনা।
যার
কারণে আখেরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তিনি পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
طلب العلم
فريضة على كل مسلم ومسلمة.
অর্থ : “প্রত্যেক
মুসলমান নর-নারীর জন্য (জরুরত আন্দাজ) ইলম অর্জন করা ফরয।” (বায়হাক্বী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, তা’লীকুছ ছবীহ,
শরহুত ত্বীবী, মুযাহেরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক হয়েছে,
كن
عا لما او متعلما او مستمعا او محبا ولا تكن المخامس فتهلك.
অর্থ : “তুমি
আলেম হও অথবা তালেবে ইলম (ছাত্র) হও অথবা (ইলমের মজলিসে) শ্রোতা হও অথবা (ইলম ও
আলেমকে) মুহব্বতকারী হও, পঞ্চম হয়োনা, তবে হালাক বা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এ প্রসঙ্গে
আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
“তোমরা ইলম শিক্ষা কর এবং তা মানুষকে শিক্ষা দাও।” (দারেমী,
দারে কুৎনী, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, আশয়াতুল
লুময়াত,
মোযাহেরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ)
শুধু তাই
নয়, এছাড়াও অসংখ্য, অগণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইলম অর্জন করার জন্য তাকীদ দেয়া হয়েছে এবং ইলম ও আলেমের
অশেষ ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। যদ্বারা ইলম অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
এখানে
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইবাদত যেহেতু দু’প্রকার অর্থাৎ ইবাদতে জাহেরাহ ও ইবাদতে
বাতেনাহ সেহেতু তৎসম্পর্কিত ইলমও
দু’প্রকার- ইলমে জাহের ও ইলমে বাতেন, তথা ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ।
ইলমে
ফিক্বাহ হাছিল করার মাধ্যমে বান্দা সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে ইবাদতে জাহেরাহ অর্থাৎ
নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত,
মোয়ামেলাত, মোয়াশেরাত ও আক্বাইদ ইত্যাদি
বাহ্যিক ইবাদতসমূহ পালন করতে পারবে।
আর ইলমে
তাসাউফ হাছিল করার মাধ্যমে বান্দা ইবাদতে বাতেনাহ অর্থাৎ নিজ অন্তর সমূহকে ইবাদতে
জাহেরাহ বিনষ্টকারী কুস্বভাব বা বদ খাছলত থেকে হিফাযত করে ইখলাছের সহিত ইবাদতে
জাহেরাহ সমূহ পালন করে মহান আল্লাহ পাক উনার হাক্বীক্বী মা’রিফত ও মুহব্বত হাছিল করতে পারবে।
এ
প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন,
العلم
علمان علم فى القلب فذاك علم النافح وعلم على اللسان فذالك حجة الله عزوجل على ابن
ادم.
অর্থ : “ইলম দু’প্রকার- (১) ক্বলবী ইলম অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ, আর এটাই
মূলতঃ উপকারী ইলম। (২) যবানী ইলম অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ্, যা আল্লাহ
পাক উনার পক্ষ হতে বান্দার জন্য দলীল। (দারেমী, তারগীব
ওয়াত তারহীব,
তারীখ, আব্দুল বার, দায়লমী,
বায়হাক্বী, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ,
আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মোযাহেরে
হক্ব)
আর এ হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যের ব্যাখ্যায় মালেকী মাযহাবেবের ইমাম,
ইমামুল আইম্মা, তাজুল মুজতাহিদীন, রঈসুল মুহাদ্দিসীন, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি
আলাইহি বলেন,
من
تفقه ولم يصوف فقد تفسق ومن توف ولم يتفقه فقد تزئدق ومن جمع بينها فقد تحقق.
অর্থ : “যে
ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ্ অর্জন করলো কিন্তু ইলমে তাসাউফ অর্জন করলোনা, সে ব্যক্তি ফাসেক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাসাউফের দাবী করে অথচ ইলমে ফিক্বাহ বা
শরীয়ত স্বীকার করেনা, সে ব্যক্তি যিন্দীক। আর যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ উভয়টাই অর্জন করলো, সে ব্যক্তিই মুহাক্কিক্ক অর্থাৎ মু’মিনে কামেল।” (মিরকাত শরহে মিশকাত)
ইলমে
তাসাউফ উনার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র হাদীছে জিব্রীল উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক হয়েছে,
عن
عمرين الخطابرضى الله عنه قال- بينما نحن عند رسول الله صلى اللهعليه وسلم ذات يوم
اذ طلح علينا رجل شديد بياض الشياب شديد شوادالشعرلا يرى عليه اثرا السفر ولا
يعرفه منا احد حتى جلس الى النبى صلى الله عليه وسلم فاشئد ركبتيه الى ركبتيه ورضع
كفيه على فخذيه وقال يا محمد اخبرنى عن الاسلام؟
قال
الاسلامان تشهد ان لا اله الا الله وان محمدا رسول الله وتقيم الصلوة وتؤتى الزكوة
وتصوم رمضان وتحج البيت ان استطعت اليه سبيلا- قال صدقت فعجبناله يسأله ويصدقه-
قال
فا خبرنى عن الايمان قال ان تؤمن با لله وملئكته ةكتبه ورسله واليوم الاخر وتؤمن
بالقدر خيره وشره قال صدقت فا خبرنى عن الاحسان قال ان تعبدا الله كانك تراه فان
لم تكن تراه فانه يراك.
অর্থ : “হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আমরা একদিন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট
বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি আসলেন, যাঁর পোশাক অত্যন্ত সাদা ও চুলগুলো
অত্যন্ত কালো। উনার মধ্যে
সফরের কোন লক্ষণ নেই, আর আমাদের মধ্যে কেউ তাঁকে চিনেওনা। তিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাঁটু মুবারক উনার সাথে তাঁর
হাঁটু লাগিয়ে এবং তাঁর হাতদ্বয় রানের উপর রেখে বসলেন। অতঃপর বললেন, হে হাবীব ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে বলুন, ইসলাম কি? বা ইসলাম
কাকে বলে?
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, এ কথার সাক্ষ্য দেয়া, নামায আদায় করা, যাকাত
প্রদান করা,
রমজান মাসের রোজা রাখা, সামর্থবানদের
জন্য হজ্ব করা।
তিনি
(হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম) বলেন, আপনি সত্য বলেছেন। (হযরত উমর ফারূক
আলাইহিস সালাম বলেন) আমরা উনার অবস্থা দেখে আশ্চর্যবোধ করি এজন্য যে, তিনিই
প্রশ্ন করছেন আবার তিনিই সত্যায়িত করছেন।
তিনি
(হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম) পুণরায় বললেন, আমাকে
ঈমান সম্পর্কে বলুন, অর্থাৎ ঈমান কি বা কাকে বলে? সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন, মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম, কিতাবসমূহ, হযরত রসূল আলাইহিমুস সালামগণ, পরকাল এবং তক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস রাখার নামই হচ্ছে- ঈমান। তিনি
(হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম) বলেন, আপনি সত্যই বলেছেন।
তিনি
পুণরায় বললেন,
আমাকে ইহ্সান সম্পর্কে বলুন, অর্থাৎ
ইহ্সান কি বা কাকে বলে? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ইহ্সান
হচ্ছে “তুমি
এরূপভাবে মহান আল্লাহ
পাক উনার ইবাদত কর, যেন মহান আল্লাহ পাক উনাকে তুমি
দেখছ। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে এ ধারণা কর যে, মহান আল্লাহ পাক তোমাকে দেখছেন।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহে
নববী,
মিরকাত শরীফ, লুময়াত, আশয়াতুল
লুময়াত,
তা’লীকুছ ছবীহ, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব)
উল্লিখিত
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় মিশকাত শরীফ উনার বিখ্যাত শরাহ বা ব্যাখ্যা
গ্রন্থ মোযাহেরে হক্ব-এ উল্লেখ আছে যে,
جاننا چاھئے کہ مداردین کا اور اسکے کمال کا فقہ اور عقائد اور تصوف پرھے- اس حدیث مین تینون چیزین بیان ھوئین ھین- کہ اسلام اشارہ ھے فقہ پرکہ اس مین سب احکام و اعمال شرعی بیان ھوتے ھین اور ایمان اشارہ ھے عقائد پر اور احسان اشارہ ھے اصل تصوف پر-
অর্থ : “জেনে
রাখ! দ্বীনের ভিত্তি ও পূর্ণতা ফিক্বাহ, আক্বাইদ ও তাসাউফের উপর
নির্ভরশীল। পবিত্র হাদীছে জিবরীঈল
আলাইহিস সালাম উনার মধ্যে উক্ত তিন প্রকার ইলমের কথাই বলা হয়েছে। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত “ইসলাম”
শব্দ দ্বারা “ইলমে ফিক্বাহকে” বুঝানো হয়েছে। যাতে শরীয়তের
বাহ্যিক সকল হুকুম-আহ্কাম বর্ণিত হয়েছে। আর “ঈমান” শব্দ দ্বারা “ইলমুল আক্বাইদকে” বুঝানো হয়েছে। আর “ইহ্সান”
শব্দ দ্বারা “ইলমুত তাসাউফ” বা ইখলাছকে বুঝানো হয়েছে।”
বাংলার
মুলুকে প্রায় ৫৫ বৎসর দ্বীনের প্রচার-প্রসারকারী হাদিয়ে বাঙ্গাল, মুজাহিদে আ’যম,
হযরতুল আল্লামা শাহ সূফী, কারামাত
আলী জৈনপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মশহুর কিতাব “জাদুত তাক্বওয়া” নামক কিতাব মুবারক পবিত্র
হাদীছে জিবরীঈল আলাইহিস সালাম উনার
ব্যাখ্যায় লিখেন,
کہ دین بو لتے ھین- اسلام و ایمان و احسان سب کو ملاکے اور شریعت نام اس مجموعہ کا ھے اور بھی فرما یا ھے کہ فقہ اور تصوف اور کلام آپس مین ایک کو ایک لازم ھے ایک سے دوسرا الگ نھین انمین سے ایںک بے دوسرا کے پورا نھین ھوتا ھے-
অর্থ : “ইসলাম
(ফিক্বাহ),
ঈমান (আক্বাইদ), ইহ্সান (তাসাউফ) এ তিনটির সমষ্টিই
হচ্ছে দ্বীন বা শরীয়ত। তাসাউফ, আক্বাইদ, ফিক্বাহ
এ তিনটি যথাযথভাবে পালনের ক্ষেত্রে একটি অপরটির প্রতি মুখাপেক্ষী। এদের একটি হতে
অপরটি আলাদা নয়,
বরং একটি ব্যতীত অপরটি পূর্ণ হতে পারেনা।”
উপরোক্ত
আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে পরিপূর্ণ প্রবেশ করে মু’মিনে কামিল হওয়ার
জন্য দ্বীন ইসলাম সম্পর্কিত দু’প্রকার ইলম অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ্
ও ইলমে তাসাউফ জরুরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরজে আইন।
ইলমে
তাসাউফ অর্জন করা ফরয হওয়ার কারণ
স্মরণযোগ্য
যে, ইলমে ফিক্বাহ্ যেমন- আক্বাইদ, ইবাদত, মোয়ামেলাত, মোয়াশেরাত ইত্যাদি সম্পর্কিত ইলম অর্জন করা ফরয (এ প্রসঙ্গে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ৪১তম সংখ্যায় ছক সহ বিস্তারিত
আলোচনা করা হয়েছে।)।
তদ্রুপ “তাযকিয়ায়ে ক্বলব” অন্তর থেকে বদ খাছলত বা কুস্বভাবসমূহ বের করে নেক খাছলত বা সুস্বভাব সমূহ
হাছিল করে অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্যও জরুরত আন্দাজ ইলমে তাসাউফ অর্জন করা ফরজ। যা পবিত্র
কুরআন শরীফ হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা ও ক্বিয়াস দ্বারা
অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ
পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক করেন,
لقد
من الله على المؤمنين اذبعث فيهم رسولا من انفسهم يتلواعليهم اياته ويز كيهم ويعلم
هم الكتاب والحكمة وان كانوا من قبل لفى ضلال منين.
অর্থ : “মু’মিনদের প্রতি মহান আল্লাহ
পাক উনার ইহ্সান যে, তাদের মধ্য হতে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি মহান আল্লাহ
পাক উনার আয়াতগুলো তিলাওয়াত করে শুনাবেন, তাদেরকে তাযকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন এবং কিতাব ও
হিকমত শিক্ষা দিবেন। যদিও তারা পূর্বে হিদায়েত প্রাপ্ত ছিলনা।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৬৪)
অনুরূপ পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ২৯ ও ১৫১নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার এবং সূরা জুমুযার ২নং আয়াত শরীফে
উপরোক্ত আয়াত শরীফের সমার্থবোধক আয়াত শরীফ উল্লেখ আছে।
মূলত
উল্লিখিত পবিত্র আয়াত
শরীফসমূহে বিশেষভাবে চারটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। তন্মধ্যে আয়াত শরীফ
তিলাওয়াত করে শুনানো এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া। এ তিনটি বিষয় হচ্ছে- ইলমে
জাহের বা ইলমে ফিক্বাহ এবং ইলমে হুনরের অন্তর্ভূক্ত। যা ইবাদতে জাহেরা বা দ্বীনের
যাবতীয় বাহ্যিক হুকুম-আহ্কাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অর্থাৎ হালাল
কামাই করার জন্য প্রয়োজন। আর চতুর্থ হচ্ছে- (يزكيهم) তাযকিয়ায়ে ক্বলব
অর্থাৎ অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা।
মুফাসরিরীনে কিরামগণ "يزكيهم"-এর ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ তাফসীরের কিতাব যেমন- তাফসীরে জালালাইন, কামালাইন, বায়হাক্বী, কুরতুবী,
তাবারী, কবীর, খাযেন, বাগবী,
ইবনে কাছীর, দুররে মানছুর, আবী সউদ, মাজহারী,
রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, মায়ারেফুল কুরআনসহ আরো অনেক তাফসীর গ্রন্থে “তাযকিয়ায়ে ক্বলব” বা অন্তর পরিশুদ্ধ করাকে ফরয বলেছেন এবং তজ্জন্য ইলমে তাসাউফ অর্জন করাকেও ফরয বলেছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ইলমে তাসাউফ অর্জন করার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করে অর্থাৎ
অন্তর থেকে বদ খাছলতসমূহ দূর করে দিয়ে নেক খাছলত সমূহ পয়দা করা ফরয।
এ
প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুফাস্সির, ফক্বীহুল উম্মত, হযরত মাওলানা ছানাউল্লাহ পানি পথি রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে
মাযহারীতে উল্লেখ করেন,
واما
العلم الدنى الذى يسمون اهلها بالصوفية الكرام فهو فرض عين لان من ثمراتها تصفية
القلب عن الاشتغال بغير الله تعالى واتصافه بدوامالحضور وتز كية النفس عن ذائل
الاخلاق- .......... وتحبليتها بكرام الاخلاق
............
অর্থ : “যে সকল
লোক ইলমে লাদুন্নী বা ইলমে তাসাউফ হাছিল করে, তাদেরকে “সূফী”
বলে। ইলমে তাসাউফ অর্জন করা ফরজে আইন। কেননা (ইলমে তাসাউফ)
মনকে গায়রুল্লাহ হতে ফিরিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার দিকে রুজু করে দেয়। সর্বদা মহান
আল্লাহ পাক উনার হুজুরী পয়দা করে দেয় এবং অন্তর থেকে বদ
খাছলত সমূহ দূর করে নেক খাছলতসমূহ পয়দা করে অন্তর পরিশুদ্ধ করে দেয়।”
ইলমে
তাসাউফ অর্জন করা ফরয হওয়া
সম্পর্কে “জামিউল উসূল” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
واعلم
ان العلم الباطن الذى هو من اعظم المنجيات والسوك ولريا ضات والمجاهدت فرض عين.
অর্থ : “ইলমে
তাসাউফ,
যা (বদ্ খাছলতসমূহ হতে) নাযাত বা মুক্তি পাওয়ার একমাত্র
মাধ্যম। পক্ষান্তরে আল্লাহ প্রাপ্তি, রিপু বিনাশন ও সংযম শিক্ষার
একমাত্র পথ। এটা (ইলমে তাসাউফ) শিক্ষা করা ফরজে আইন।”
আর
হাশিয়ায়ে তাহ্তাবী কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
فان
البخل والجبن والكبر والتقتير حرام ولا يمكن التحرز عنها الا يعلمها وعلم والحاصل
ان التحرز عن المحرم فرض كما استفيد عن ذالك. لا مند وبا ما يضادها.
অর্থ : “নিশ্চয়ই কৃপণতা, অহংকার,
পরিবার পরিজনকে খাওয়া পরায় কষ্ট দেয়া ইত্যাদি হারাম।
উল্লিখিত বদ খাছলত সমূহ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা ব্যতীত তা হতে বেঁচে
থাকা অসম্ভব। অথচ হারাম কাজ হতে বেঁচে থাকা ফরয। যেহেতু হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকা ফরয, সেহেতু উক্ত বদ খাছলত সমূহকে অন্তর থেকে দূর করার জন্য ইলমে তাসাউফ অর্জন করাও
ফরয। মুস্তাহাব মোটেও নয়।
আর “ফতওয়ায়ে শামী” কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
(علم
القلب) اى علم الاخلاق وهو علم يعرف به انواع الفضائل وكيفية اكتسابها وانواع
الرأئل وكفية ادتنابها.
অর্থ : “যে ইলমের
মাধ্যমে নেক খাছলত বা সদ্ গুণাবলীর প্রকারভেদ এবং তা হাছিল করার পদ্ধতি জানা যায়
এবং বদ খাছলত বা অসৎ গুণাবলীর শ্রেণী বিভাগ এবং সেগুলি হতে নাযাত বা মুক্তি পাবার পদ্ধতি জানা যায়, তাকে ইলমে ক্বলব বা ইলমে তাসাউফ বলে।
উপরোক্ত
দলীলভিত্তিক আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, তাযকিয়ায়ে ক্বলব বা অন্তর পরিশুদ্ধ
করার জন্য অর্থাৎ অন্তর থেকে বদ খাছলতসমূহ দূর করে নেক খাছলত সমূহ অন্তরে হাছিল
করা ফরজে আইন। আর এটাই মূলত ইলমে তাসাউফ হাছিল করার মূল উদ্দেশ্য বা কারণ।
নেক
খাছলত ও বদ খাছলতসমূহ
অনুসরণীয়
ইমাম,
মুজ্তাহিদ ও ওলীআল্লাহ্গণ ইলমে তাসাউফকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। (১) মুহলিকাত, (২) মুনজিয়াত। এ প্রসঙ্গে “মুছাল্লামুছ ছুবূত” নামক কিতাবের মুকাদ্দামায় উল্লেখ
আছে যে,
وعلم
الطر يقة وهى ميا حث المهلكات والمنديات.
অর্থ : “মুহলিকাত” অর্থাৎ ক্বলব বা আত্মার ধ্বংস সাধনকারী বদ্ খাছলত সমূহ এবং “মুনজিয়াত”
অর্থাৎ অন্তরকে মুক্তিদানকারী নেক খাছলত সম্পর্কিত ইলমকেই ইলমে
তরীক্বত বা ইলমে তাসাউফ বলে।”
হুজ্জাতুল
ইসলাম,
শায়খুল মুহাদ্দিসীন ওয়াল মুফাস্সিরীন, বিখ্যাত দার্শনিক হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জগদ্বিখ্যাত কিতাব ইহ্ইয়াউল
উলুমিদ্দীন কিতাবে লিখেন,
اعلم
.................... والباطنة ايضا قسمان ما يجب تحلية القلب به من الصفات
المحمودة- فقال الامام الغزالى فى ختبته ولقد اسسته على اربعة ارباع- ربع العبادات
وربع المعملات وربح المهلكات وربع المنجيات.
অর্থ : “জেনে
রাখ! ............ ইলমে তাসাউফ দু’ভাগে বিভক্ত। (১) “মুহলিকাত”
ঐ সকল বদ্ খাছলত সমূহ, যা অন্তর
থেকে দূর করা ওয়াজিব। (২) “মুনজিয়াত” ঐ সকল
নেক খাছলতসমূহ,
যা অন্তরে পয়দা করা ওয়াজিব। ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি ইহ্ইয়াউল উলুমিদ্দীন কিতাবকে চার ভাগে বিভক্ত করেছি। প্রথমাংশ ইবাদত, দ্বিতীয়াংশ মুয়ামেলাত, তৃতীয়াংশ মুহলিকাত ও চতুর্থংশ
মুনজিয়াত।”
মূলত
অন্তর থেকে বদ খাছলত সমূহ দূর করে দিয়ে নেক খাছলত সমূহ পয়দা করার মাধ্যমেই
হাক্বীক্বী ইছলাহ বা পরিশুদ্ধতা লাভ সম্ভব।
আর তাই
বোখারী শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত
হয়েছে,
ان
فى الجسد مضغة اذا صلعت صلح الجسد كله واذا فسدت فسد الجسد كله الا ههى القلب.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
“মানব শরীরে এক টুকরা গোশত রয়েছে, তা
পরিশুদ্ধ হলে গোটা শরীরটাই পরিশুদ্ধ হবে এবং তা বিনষ্ট বা ধ্বংস হলে গোটা শরীরটাই
ধ্বংস হবে। সাবধান! উক্ত গোশতের টুকরাটি হলো- ক্বলব বা অন্তর।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদ মুবারকস্সারী, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, আশয়াতুল
লুময়াত,
শরহুত ত্বীবী, তা’লীকুছ
ছবীহ,
মোযাহেরে হক্ব)
আর
পূর্বেই প্রমাণিত হয়েছে যে, মুহলিকাতের (বদ খাছলতের) কারণে ক্বলব বিনষ্ট হয়। আর মুনজিয়াতের (নেক খাছলতের) কারণে ক্বলব
পরিশুদ্ধ হয়। অতএব, মুহলিকাত ও মুনজিয়াত সম্পর্কিত ফরয পরিমাণ ইলম অর্জন করাও প্রত্যেক মুসলমান
নর-নারীর জন্য ফরয। তাই
নিম্মে মুহলিকাত ও মুনজিয়াত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো-
এখানে
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তাসাউফ সংক্রান্ত বিষয়সমূহ
সাধারণতঃ দু’ভাগে বিভক্ত। ১। ইলমী অর্থাৎ তাসাউফ বা মুহলিকাত ও মুনজিয়াত সম্পর্কিত ইলম। ২।
আ’মালী অর্থাৎ তরীক্বা বা সবকসমূহ আদায় করা বা যিকির-ফিকির, মুরাক্বাবা-মুশাহাদাহ ইত্যাদি। এখানে প্রথমতঃ তাসাউফ বা মুহলিকাত-মুনজিয়াত
সংশ্লিষ্ট ইলম সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। আর আ’মালী
বিষয় সম্পর্কে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হবে ইন্শাআল্লাহ।
মুহলিকাতের
বিবরণ
মুহলিকাত
(مهلكات) ঐ সকল বদ খাছলত বা কুস্বভাব সমূহকে বলে, যে সকল
বদ খাছলতসমূহ মানুষকে বা মানুষের অন্তরকে ধ্বংস বা হালাক করে দেয়।
এ সকল বদ
খাছলত অনেক,
তবে তন্মধ্যে দশটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও পরিত্যজ্য।
যেমন- ১। কিবর (অহংকার), ২। হাসাদ (হিংসা), ৩। বোগ্য (শত্রূতা), ৪। গযব (রাগ), ৫। গীবত (পরনিন্দা), ৬। হেরছ (লোভ), ৭। কিয্ব
(মিথ্যা),
৮। বোখল (কৃপনতা), ৯। রিয়া (লোক দেখানো), ১০। গুরুর (ধোকাবাজী) ইত্যাদি।
কিব্র
(অহংকার)-এর বর্ণনা
কিব্র বা
অহংকার সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক
উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ولا تمش فى الارض مرحا.
অর্থ : “তুমি
যমিনের উপরে সগর্বে চলিওনা।” (পবিত্র সূরা লোকমান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮)
আর
হাদীসে কুদসীতে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
الكبرياء
ردائ والعظمة اذارى فمن نزع شيئا منهما فقد ادخلته فى النار ولا ابالى.
অর্থ : “কিব্র
(অহংকার) আমার চাদর, আর আযমত (বড়ত্ব) আমার লুঙ্গি (অর্থাৎ খাছ ছিফত)। যে ব্যক্তি
দু’প্রকার ছিফতের কোন একটি নিয়ে টানাটানি করবে অর্থাৎ অহংকার বা বড়ত্ব প্রকাশ
করবে,
আমি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবো, আমি কারো
পরওয়া করিনা।”
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ
মুবারক হয়েছে যে,
من
كان فى قلبه مثقال ذرة من كير- لا يدخل الجنة.
অর্থ : “যার
অন্তরে একবিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।”
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, কিব্র বা
অহংকার করা হারাম ও কবীরা গুণাহ, আর এর থেকে বেঁচে থাকা ফরজ।
হাসাদ
(হিংসা)-এর বর্ণনা
হাসাদ বা
হিংসা বলে পরশ্রীকাতরতাকে অর্থাৎ কারো উন্নতি বা ভাল দেখে অসহ্য করা এবং তার ধ্বংস
কামনা করা। হাসাদ বা হিংসা কবীরা গুণাহের অন্তর্ভূক্ত।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র
কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক করেন,
ومن شر حاشد اذا حسد.
অর্থ : “হিংসুক
যখন হিংসা করে,
তখন তার হিংসার
ক্ষতি থেকে মহান আল্লাহ
পাক উনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।” (পবিত্র সূরা ফালাক্ব শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল
মরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন,
اياكم
والحسد فان الحسد يا كل الحسنات كما تأكل النار الحطب.
অর্থ : “তোমরা
হিংসা থেকে বেঁচে থাক, নিশ্চয়ই হিংসা নেকী সমূহকে এরূপভাবে খেয়ে ফেলে, যেরূপ আগুণ লাড়কীকে খেয়ে ফেলে। অর্থাৎ জ্বালিয়ে দেয়।”
অতএব, হিংসা বা হাসাদ থেকে বেঁচে থাকা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয। কাজেই হিংসা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন
করাও ফরয।
বোগ্য
(শত্রুতা)-এর বর্ণন
কারো
সাথে অন্তরে শত্রূতাভাব পোষণ করাকে বোগ্য বলে।
মূলত
শরয়ী ওজর ব্যতিত কারো সাথে বোগ্য বা শত্রুতা পোষণ করা হারাম ও কবীরা গুণাহ।
এ প্রসঙ্গে
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার
মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما
يريد الشيطان ان يوقع بينكم العداوة والبغضاء.
অর্থ : “নিশ্চয়ই
শয়তান চায় তোমাদের পরস্পরকে বিদ্বেষ ও শত্রুতার মধ্যে জড়িয়ে দিতে।” (পবিত্র সূরা মায়েদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৯১)
তাই সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন
ولاتباغضوا.
অর্থ : “তোমরা পরস্পর অন্তরে শত্রূতা পোষণ
করোনা।”
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ
মুবারক হয়েছে,
من
احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : “যে
ব্যক্তি মুহব্বত করে মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যে, শত্রুতা
পোষণ করে মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যে, আদেশ করে মহান আল্লাহ পাক উনার
জন্যে এবং নিষেধ করে মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যে, তার ঈমান
পরিপূর্ণ।”
(আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, অন্তরে বোগ্য বা শত্রুতা পোষণ করা সম্পূর্ণ হারাম ও
নাজায়েয। তবে মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করা জাযেয। কাজেই
বোগ্য সম্পর্কিত যাবতীয় ইলম অর্জন করাও সকলের জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্য।
গয্ব
(রাগ)-এর বর্ণনা
রাগ বা
গোস্সা হওয়াকে গযব বলে। ব্যক্তিগত কারণে অন্তরে যে গোস্সা পয়দা হয়, সেটাই দোষণীয় ও পরিত্যাজ্য। আর দ্বীনের ক্ষতি দেখে অন্তরে যে গোস্সা বা রাগ
পয়দা হয়,
তা দোষণীয় নয় বরং প্রশংসনীয়।
এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক কালামে পাক উনার
মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
والكا ظمين الغيض والعافين عن الناس.
অর্থ : “যারা
গোস্সাকে হজম করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে, তারা আল্লাহ পাক উনার প্রিয়পাত্র।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৪)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
ليس
الشديد با لضر ع انما الشديد الذى يملك نفسه عند الغضب.
অর্থ : “কুস্তিতে বিপক্ষকে পরাভূত করলেই
শক্তিশালী হওয়া যায়না। বরং গোস্সার সময় নিজ প্রবৃত্তিকে যে দমন করতে পারে সেই
শক্তিশালী।”
(ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন)
কাজেই
গযব বা গোস্সা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাও সকলের জন্য ফরজ।
গীবত
(পরনিন্দা)-এর বর্ণনা
কারো
অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি অপরের নিকট বর্ণনা করাকে গীবত বলে। এরূপ গীবত শরীয়তের
দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই হারাম ও নাজায়েয।
এরূপ
গীবত সম্পর্কে মহান আল্লাহ
পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ولا
يغتب بعشكم بعضكم بعضا ايحب احد كم ان يا كل لحم اخيه ميتا فكر هتموه.
অর্থ : “তোমরা
একে অপরের গীবত করোনা। তোমাদের কেউ কি আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? কখনো তোমরা তা পছন্দ করবে না।” (পবিত্র সূরা হুজরাত শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১২)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন,
الغيبة اشد من الزناء
অর্থ : “গীবত
ব্যভিচার হতেও কঠিন পাপ।”
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন,
ما
النار فى اليبس با سرع من الغيبة فى حسنات العبد.
অর্থ : “পরনিন্দা
বা গীবত কোন লোকের নেকীকে যত দ্রুত জ্বালিয়ে দেয়, তত দ্রুত
আগুণও লাকড়ীকে জ্বালাতে পারেনা।” (ইহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন)
সুতরাং
গীবত থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীকে গীবত সম্পর্কিত ফরজ
পরিমাণ ইলম অর্জন করতে হবে, যা অর্জন করা সকলের জন্যই ফরজ।
হের্ছ (লোভ)-এর বর্ণনা
লোভ-লালসাকেই হের্ছ বলে। হের্ছ
বা লোভের বশবর্তী হয়েই মানুষ হারাম রিযিক ভক্ষণ করে বা হারামের দিকে ধাবিত হয়। এ
প্রসঙ্গে পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হচ্ছে,
ولا
تمدن عينيك الى ما متعنا به ازواجا منهم زهرة الحيوة الدنيأ.
অর্থ : “নিজ
চক্ষুকে এরূপ জিনিসের প্রতি নিবদ্ধ করবে (অর্থাৎ এরূপ জিনিসের প্রতি লোভ করবেনা), যদ্বারা আমি কাফেরদের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্রে উপকৃত
করেছি।”
(পবিত্র সূরা ত্বয়াহা শরীফ :
পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩১)
তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক হয়েছে,
نهى
رسول الله صلى الله عليه وسلم عن شدة الحرص.
অর্থ : “সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবৈধ লোভ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ
দিয়েছেন।”
কারণ লোভ
মানুষকে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত করে তোলে অথচ দুনিয়ার মুহব্বতই হচ্ছে সকল অনিষ্টের
মূল। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
حب الدنياء رأس كل خظيئة.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
“দুনিয়ার মুহব্বত সমস্ত গুণাহের মূল।”
অতএব, দুনিয়ার মুহব্বত বা অবৈধ লোভ-লালসা অন্তর থেকে সম্পূর্ণরূপে দূর করে দেয়া
সকলের জন্য ফরয।
তজ্জন্য সে সম্পর্কিত ফরয পরিমাণ ইলম
অর্জন করাও ফরয।
কিয্ব
(মিথ্যা)-এর বর্ণনা
মিথ্যা
কথা বলাকে কিয্ব বলে। মিথ্যা কথা বলা কবীরা গুণাহের অন্তর্ভূক্ত ও হারাম। তাই পবিত্র
কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে মিথ্যা বলার পরিণাম সম্পর্কে অসংখ্য স্থানে বিশেষ সতর্কবাণী
উচ্চারিত হয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ উনার
মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لعنة الله على الكاذبين.
অর্থ : “মিথ্যাবাদীদের
উপর আল্লাহ পাক উনার লা’নত।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬১)
পবিত্র
কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে মিথ্যা বলার ভয়াবহ পরিণাম বর্ণনা করে মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকার
কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
انما الكذب لكل الذنوب ام.
অর্থ : “নিশ্চয়ই
মিথ্যা সমস্ত গুণাহর মূল।”
মিথ্যাবাদীর
মিথ্যার কারণে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারাও পর্যন্ত দূরে সরে যান। যেমন হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে,
اذا
كذب العبد تبا عد عنه الملك ميلا من نتن ما جاء به.
অর্থ : “যখন
বান্দা মিথ্যা বলে, তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উক্ত মিথ্যা কথার
দুর্গন্ধের জন্য তার নিকট হতে এক মাইল দূরে সরে যান।” (তিরমিযী
শরীফ,
মায়ারেফুস সুনান, তোহ্ফাতুল আহওয়াযী, উরফুশ শাজী)
মিথ্যা
বলা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ
পাক তিনি সূরা নহল শরীফ উনার ১০৫নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
انما يفترى الكذب الذب الذين لا يؤمنون.
অর্থ : “নিশ্চয়ই
যাদের ঈমান নেই,
কেবল তারাই মিথ্যা কথা বলে।”
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, মিথ্যা কথা বলা কবীরা গুণাহের অন্তর্ভূক্ত এবং সকল গুণাহের
মূল।
তবে
শরীয়তে কয়েক স্থানে অবস্থা বিশেষে মিথ্যা কথা বলার এযাজত রয়েছে। যেমন- হাদীছ শরীফ
উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, তিন ব্যক্তি তিন অবস্থায় মিথ্যা
বলতে পারবে। (১) দুই দলের ঝগড়া মীমাংসার জন্য। (২) জ্বিহাদের ময়দানে মুজাহিদদের
জন্য। (৩) স্ত্রীর মন সন্তুষ্ট রাখার জন্য।
সুতরাং
মিথ্যা কথা ত্যাগ করা বা মিথ্যা বলা হতে বিরত থাকা সকলের জন্য ফরজ। আর সেজন্য
তৎসম্পর্কিত ইলম অর্জন করাও ফরজ।
বোখল
(কৃপণতা)-এর বর্ণনা
শরীয়ত উনার নির্দেশিত পথে ধন-সম্পদ ব্যয়
করতে অন্তরের না চাওয়াকেই বোখল বা কৃপণতা বলে। বখল বা কৃপণতা করা কবীরাহ্ গুণাহের
অন্তর্ভূক্ত। কৃপণতা অন্তরের যাবতীয় বদ্ খাছলতসমূহের মধ্যে অন্যতম।
বোখল বা
কৃপণতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক
উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ولا
تحسبن الذين يبخلون بما اتا هم الله من فضله هو خيرا لهم بل هو شر لهم- سيطو قون
ما بخلوابه يوم القيامة.
অর্থ : “যারা মহান আল্লাহ পাক উনার দেয়া সম্পদ মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় খরচ করতে
বোখল বা কৃপণতা করে, তারা যেন ধারণা না করে যে, সেটা
তাদের জন্য মঙ্গলজনক। বরং তা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ। কৃপণতার কারণে যে সম্পদ মহান
আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় দান করা হয়নি, তা ক্বিয়ামতে দিন তার গলার বেড়ী
হবে।”
(পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ :
পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮০)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুর মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন,
السخنى
حبيب الله ولو كان فاسقا والبخيل عدو الله ولو كان عابدا.
অর্থ : “দানশীল মহান আল্লাহ পাক উনার বন্ধু, যদিও সে ফাসেক হোক না কেন। আর বখীল বা কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ পাক
উনার দুশমন, যদিও সে আবেদ হোক না কেন।”
তাই
বিশিষ্ট বুযুর্গ, বিখ্যাত কবি, হযরত শায়খ সাদী রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার “কারীমা”
কিতাবে বলেন,
يخيل
اربود زاهد وبحر وبربهشتى نبا شد بحكم خبر.
অর্থ : “বখীল যদি
সারা পৃথিবীতে যাহেদ হিসাবে মশহুরও হয়, তবুও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যের ভাষ্য মতে
সে জান্নাতে যেতে পারবে না।”
অতএব, সকলের উচিৎ কৃপণতা পরিত্যাগ করে আল্লাহ পাক উনার দেয়া সম্পদ মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় বা
প্রয়োজনীয় স্থানে যথাযথ ব্যয় করা। আর তজ্জন্য প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাও ফরয।
রিয়া
(লোক দেখানো)-এর বর্ণনা
মহান আল্লাহ পাক ব্যতীত অন্য কোন
উদ্দেশ্যে ইবাদত বা আমল করাই হচ্ছে রিয়া। রিয়াকারীর কোন আমল মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্য
নয়। তাই রিয়া সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা সকলের জন্য ফরয।
এ
প্রসঙ্গে ফতওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে যে,
وعلم
الرياء لان العابد محروم من ثواب عمله بالرياء.
অর্থ : “রিয়া
সম্পর্কিত ইলম অর্জন করা ফরজ। কারণ ইবাদতকারী রিয়ার কারণে ইবাদতের সওয়াব থেকে
বঞ্চিত হয়।”
মহান আল্লাহ
পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ
মুবারক করেন,
فويل
للمصلين الدين هم عن صلانهم ساهون الذين هم يرائون.
অর্থ : “ওই মুছল্লী বা নামাজীর জন্য
জাহান্নাম,
যে মুছল্লী অলসতার সাথে এবং লোক দেখানোর জন্য নামাজ আদায়
করে।”
(পবিত্র সূরা মাউন শরীফ)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বলেন,
الرياء شرك الخفى.
অর্থ : “রিয়া হলো
গোপন শিরক।”
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ
মুবারক হয়েছে,
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তিনি বলেন,
ان يشير الرياء شرك.
অর্থ : “যৎকিঞ্চিত
রিয়াও শেরেকের অন্তর্ভূক্ত।” (ইবনে মাযাহ্)
উপরোক্ত
আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, রিয়াকারী ব্যক্তির কোন
ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্য নয়। তাই অন্তর থেকে রিয়া সম্পূর্ণরূপে দূর করে দেয়া ফরজ।
কাজেই
রিয়া দূর করার জন্য রিয়া সম্পর্কিত ফরজ পরিমাণ ইলম অর্জন করাও ফরজ।
গুরুর
(ধোকাবাজি)-এর বর্ণনা
সাধারণতঃ
গুরুর বা ধোকা দু’ধরণের হতে পারে। প্রথমতঃ নিজে দুনিয়ার শান-শওক্বত বা
বিলাসিতা দেখে ধোকায় পতিত হওয়া অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে দুনিয়ায় মশগুল হয়ে যাওয়া। আর
দ্বিতীয়তঃ অন্য কাউকে ধোকা দেয়া বা প্রতারণা করা। মূলত উভয়টাই শরীয়তের দৃষ্টিতে
নাজায়েয ও হারাম।
বস্তুতঃ
দুনিয়া হচ্ছে- ধোকার জায়গা। দুনিয়া তাঁর চাকচিক্য বা বিলাসিতার মাধ্যমে, মানুষদেরকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করে এবং দুনিয়ার মধ্যে গরক করে দেয়। যার ফলে সে মহান আল্লাহ পাক ও পরকাল হতে সম্পূর্ণ
গাফেল হয়ে যায়।
তাই মহান
আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
لا
يغرنك تقلب الذين كفروا فى البلاد متاع قليل ثم مأوهم جهنم وبئس المهاد.
অর্থ : “হে হাবীব, কাফেরদের শহরে শান-শওকত ও বিলাসিতার সাথে বিচরণ যেন আপনাকে (উম্মতদেরকে) ধোকায়
না ফেলে। দুনিয়াবী সম্পদ তো সামান্য সম্পদ। এরপর তাদের (কাফেরদের) আবাসস্থল হবে
জাহান্নাম,
যা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৯৫-১৯৭)
পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ উনার ১৮৫নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
وما الحيوة الدنيا الا متاع الغرور.
অর্থ : “এবং
পার্থিব জীবন তো কিছুই নয়, একমাত্র প্রতারনার সামগ্রী ছাড়া।
অর্থাৎ দুনিয়াবী (জিন্দেগী) জীবন ধোকার সামগ্রী মাত্র।”)
অতএব, দুনিয়ার চাকচিক্য ও বিলাসিতা দেখে ধোকায় পড়া যাবেনা। যে ব্যক্তি দুনিয়ার ধোকায়
পতিত হবে,
তার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বরবাদ হবে। সুতরাং দুনিয়ার ধোকা
থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরয।
তাছাড়া
দুনিয়ার ধোকা থেকে নিজেকে বাঁচানো যেরূপ ফরজ তদ্রুপ অন্যকে ধোকা দেয়া থেকে বেঁচে
থাকাও ফরজ। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে অপরকে ধোকা দেয়া বা প্রতারণা করা হারাম ও
নাজায়েয।
এ
প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তিনি বলেন,
من غش فليس منا.
অর্থ : “যে
ব্যক্তি অপরকে ধোকা দেয়, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভূক্ত নয়।”
এছাড়াও
গুরুরের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে- নেক আমল না করে নাযাত বা জান্নাত লাভের আশা করা বা
নিজেকে নেক্কার মনে করা অথবা পাপ কাজসমূহকে নেক্ কাজ মনে করে করা। যেমন- আজকাল
অনেকেই জ্বিহাদ বা আন্দোলনের নামে হারাম গণতন্ত্র চর্চা করছে। ইসলাম প্রচারের নামে
ছবি বা ভিডিও,
ভিসিআর ও টিভিকে জায়েয বলছে ইত্যাদি। অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে
ধোকা দিয়ে ইসলামের নামে হারাম কাজগুলো করাচ্ছে এবং তাদেরকে গোমরাহ্ বা পথভ্রষ্ট
করে দিচ্ছে,
যা সম্পূর্ণরূপেই শয়তানী ওয়াসওয়াসা বা ধোকা। অর্থাৎ শয়তান এ
ওয়াসওয়াসা বা ধোকার মাধ্যমে তাদেরকে নেক্ কাজ থেকে বিরত রাখে ও নেক্ কাজের নামে
পাপ কাজে মশগুল রাখে। এ ধোকায় যারা পতিত হবে, তাদের
হালাকী বা ধ্বংস ব্যতীত কোন গত্যান্তর নেই।
উপরোক্ত
আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, গুরুর বা ধোকাবাজী সম্পূর্ণ হারাম
ও কবীরা গুণাহ্রে অন্তর্ভূক্ত। তাই সর্বপ্রকার গুরুর হতে বেঁচে থাকা সকলের জন্যই
ফরজ। আর তজ্জন্য গুরুর সম্পর্কিত ইলম অর্জন করাও ফরজ।
এছাড়া ‘মুহলিকাত’
বা ধ্বংসকারী অনেক বদ্ খাছলত রয়েছে, যেমন- ১।
কিনা (দুশমনী),
২। ত্বমা (হালাল-হারাম না দেখে ভবিষ্যতে পাওয়ার আশা করা), ৩। কাছীরুল কালাম (অতিরিক্ত কথা বলা), ৪। শরফ
(সম্মান কামনা করা), ৫। হুব্বেজাহ্ (প্রভুত্ত্ব প্রিয়তা), ৬। হুব্বুদদুনইয়া (দুনিয়ার মুহব্বত), ৭। খোদপছন্দী (আত্ম গৌরব), ৮। কুওওয়াতে শাহ্ওয়াত (কাম শক্তি), ৯। খতা (ভুল, মোহ্ বা ভ্রম), ১০। হুব্বুল মাল (মালের মুহব্বত), ১১।
নেফাক্ব (কপটতা), ১২। গাফলতী (অলসতা), ১৩।
শাব্য়ান (অধিক আহার করা), ১৪। খোছম (ঝগড়া), ১৫। নাম্মাম (চোগলখোরী), ১৬। ফুহুশ (অশ্লিলতা), ১৭। মোনাজেরাহ (তর্ক), ১৮। বদ দোয়া (অভিশাপ), ১৯। তোহ্মত (অপবাদ), ২০। মোকর (ধোকাবাজী), ২১। শেকায়েত (খারাপ বলা, দোষ বর্ণনা করা), ২২। বদ্ গোমান (কুধারণা), ২৩। আফাতুল লিসান (জবানের খারাবী), ২৪। জুব্ন (ভীতু), ২৫। আয্ল (তাড়াহুড়া করা) ২৬। কুফ্র (অস্বীকার করা), ২৭। আমল (অবৈধ আকাংখা), ২৮। জিহালত (অজ্ঞতা) ইত্যাদি।
পবিত্র
কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ উনার মধ্যের উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত
হলো যে,
মুহলিকাত বা উল্লিখিত বদ্ খাছলত সমূহ যার মধ্যে বিদ্যমান
থাকবে,
তার পক্ষে “ইবাদতে জাহেরার” দ্বারা মহান আল্লাহ
পাক উনার হাক্বীক্বী রেজামন্দী কস্মিনকালেও অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ উল্লিখিত বদ্
খাছলত সমূহ বান্দার ইবাদত সমূহকে হালাক বা ধ্বংস করে দেয়। নিন্মোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যেও এ কথার
জাজ্বল্য ও উৎকৃষ্ট প্রমাণ রয়েছে। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
হযরত মু’আজ ইবনে জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত- এক তাবেয়ী এসে হযরত মু’আজ ইবনে জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু কে বললেন “হে মু’আজ ইবনে জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, আমি আজকে
আপনার কাছে এসেছি একখানা হাদীছ শরীফ শোনার জন্য, এমন
একখানা পবিত্র হাদীছ
শরীফ আপনি পেশ করবেন, যে পবিত্র হাদীছ
শরীফখানা স্বয়ং আপনি নিজের কানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন,
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার যবান মুবারক থেকে শুনেছেন। প্রথমে এটি শুনে
হযরত মু’আজ ইবনে রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু খুব কাঁদলেন। কাঁদাকাটি করার পর তিনি
বললেন- হ্যাঁ,
আপনানার কাছে এমন একখানা হাদীছ শরীফ
বর্ণনা করব যে হাদীছ শরীফ স্বয়ং আমি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব সাইয়্যিদুল
মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম॥এর জবান মুবারক থেকে শুনেছি। মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন,
“সাত আসমান তৈরী করার পূর্বে আল্লাহ পাক প্রথম সাতজন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস
সালাম তৈরী করলেন, যাদেরকে হাফাজা নাম দেয়া হয়েছে। যখন আল্লাহ পাক সাত আসমান
তৈরী করলেন,
তখন সেই সাতজন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামকে সাত আসমানের
দায়িত্বে দিয়ে দিলেন। আল্লাহ পাক বললেন, “হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম
উনারা তোমাদের জিম্মাদারী হলো- তোমাদের সামনে দিয়ে বান্দাদের আমলগুলি যাবে, তোমরা আমলগুলি পরীক্ষা করবে।
যে হযরত
ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম প্রথম আকাশে থাকে তার জিম্মাদারী হলো- গীবতের। যারা গীবত
করে, তাদের আমলনামা প্রথম আকাশ উত্তীর্ণ হবেনা। হযরত
মু’আজ ইবনে জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, যখন তার
আমলনামাগুলি হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা নিয়ে প্রথম আকাশে পৌঁছে, তখন সেই হাফাজা হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলেন, “আমলনামাগুলি
রাখ, আমাকে যাচাই-বাচাই করতে দাও।” তখন আমলবাহী হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম উনারা বলেন, আপনি কি যাচাই-বাছাই করবেন? সেইপরীক্ষক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলেন, আমি
যাচাই-বাছাই করবো, সে গীবত করেছে কিনা? সে
গীবতকারী ব্যক্তি কিনা? যদি কোন গীবতকারী ব্যক্তির
আমলনামা এখানে এসে থাকে, তাহলে সেটা আমার এ দরজা দিয়ে
উত্তীর্ণ হবেনা।”
কাজেই
যারা গীবতকারী,
গীবতকারীর আমলনামা প্রথম আকাশ থেকে উত্তীর্ণ হবে না।
এরপর
দ্বিতীয় আকাশে গিয়ে যখন পৌঁছবে, তখন দ্বিতীয় আকাশের হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম বলবেন, “রাখ আমলনামাগুলি আমাকে
যাচাই-বাছাই করতে দাও। আমাকে পরীক্ষা করতে দাও।” তখন
আমলবাহী হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলবেন, “হে ভাই হযরত
ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম, আপনি কি যাচাই-বাছাই করবেন?” পরীক্ষক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলবেন, যে
ব্যক্তি হুব্বেজাহ্ অর্থাৎ মান॥সম্মান হাছিল করার জন্য ইবাদত করেছে, তার আমলনামাগুলি আমার এ আকাশ দিয়ে উত্তীর্ণ হবে না।
পরীক্ষক হযরত
ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলবেন, যারা হুব্বেজাহ্ অর্থাৎ মান-সম্মানের
জন্য আমল করেছে। মূলত তাদের আমল আমি এই রাস্তা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে দেব না।
কাজেই
যারা হুব্বেজাহ্ অর্থাৎ মান-সম্মানের জন্য, ইবাদত-বন্দেগী
করবে,
তাদের আমলনামা দ্বিতীয় আকাশ দিয়ে যাবে না।
এরপর যখন
বাকী আমলনামাগুলো নিয়ে তৃতীয় আকাশে পৌঁছানো হবে, তখন
তৃতীয় আকাশের হাফাজা হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলবেন, “রাখ
আমলনামাগুলি আমাকে যাচাই-বাছাই করতে দাও। আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দাও।” তখন সেই তৃতীয় আকাশের হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে ভাই হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম! আপনি কি যাচাই-বাছাই করবেন? তখন সেই হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলবেন, দেখ আমি
হলাম অহংকারের হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম। যারা অহংকারী, তাদের
আমলনামা তৃতীয় আকাশ উত্তীর্ণ হবে না।
এরপর
বাকী আমলনামাগুলি নিয়ে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা চতুর্থ আকাশে গিয়ে
পৌঁছবেন,
তখন ঐ চতুর্থ আকাশের হাফাজা হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম
বলবেন,
ব্যক্তিগত কোন আমলের উপর যদি কেউ ফখর করে, তাহলে সে আমলটা চতুর্থ আকাশ দিয়ে উত্তীর্ণ হবে না।
কাজেই
যারা ফখর করবে ঐ ব্যক্তির আমলনামা চতুর্থ আকাশ অতিক্রম করবে না কখনও।
এরপর
বাকী আমলনামাগুলো নিয়ে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা পঞ্চম আকাশের দিকে
রওয়ানা হবেন। যখন পঞ্চম আকাশে গিয়ে পৌঁছবেন, তখন সেই
হাফাজা হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলবেন, “রাখ
আমলনামাগুলি,
আমাকে যাচাই-বাছাই করতে দাও, আমাকে
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দাও।” তখন আমলবাহী হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম উনারা বলবেন, “হে ভাই পঞ্চম আকাশের হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম! আপনি কি যাচাই-বাছাই করবেন, কি
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন?” পরীক্ষক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস
সালাম বলবেন,
আমি হলাম হিংসার হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম। যারা হিংসুক, হাসাদকারী তাদের আমলনামা আমার এই পঞ্চম আকাশ দিয়ে উত্তীর্ণ হবে না।
কাজেই
যারা হিংসা করে,
তাদের আমলনামা পঞ্চম আকাশ দিয়ে উত্তীর্ণ হবে না।
এরপর
ষষ্ঠ আকাশে গিয়ে যখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা পৌঁছবেন, কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে- তখন আমলগুলি গুণগুণ করতে থাকে, খুব জ্বলজ্বল করতে থাকে, আলোক বিকিরণ করতে থাকে। তখন ষষ্ঠ
আকাশের হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলেন, “হে
আমলবাহী হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা! তোমরা আমলনামাগুলি রাখ, আমাকে যাচাই-বাছাই করতে দাও, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দাও।
আমলবাহী হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা বলবেন, আপনি কি
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন? তখন পরীক্ষক হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম উনারা বলেন, আমি হলাম রহমতের হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম।
যারা
নির্দয়,
তাদের আমলনামাগুলি ষষ্ঠ আকাশ দিয়ে উত্তীর্ণ হবে না। পরীক্ষক
হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম ঐ আমলনামাগুলি যাচাই-বাছাই করে আবার ছেড়ে দেবেন।
বলবেন,
তোমরা বাকী আমলনামাগুলো নিয়ে যাও। আমলবাহী হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম উনারা সপ্তম আকাশের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।
যখন
সপ্তম আকাশে গিয়ে পৌঁছাবেন, তখন সেই পরীক্ষক হযরত ফেরেশতা
আলাইহিমুস সালাম বলবেন, “দাড়াও, আমলনামাগুলো
আমাকে পরীক্ষা করতে দাও”। তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস
সালাম উনারা বলবেন, “আপনি কি পরীক্ষা করবেন?” তখন সেই
হাফাজা হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম বলবেন, আমি রিয়ার হযরত
ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম।
মূলত লোক
প্রদর্শনের জন্য যারা আমল করে, তাদের আমল সপ্তম আকাশ উত্তীর্ণ
হবে না। যখন সপ্তম আকাশ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়ে আল্লাহ পাক উনার কাছে যাবে, বলা হয়- তখন ঐ আমলগুলো গুণগুণ করতে থাকবে। তখন আল্লাহ পাক বলবেন, “হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা! আমাকে যাচাই-বাছাই করতে দাও।”
আলাহ পাক
বলবেন,
“আমি যাচাই-বাছাই করবো, বান্দা
ইখলাছের সহিত আমল করেছে কিনা? কেননা আল্লাহ পাক বলেন,
وما امروا الاليعبدوا الله مخلصين له الدين.
অর্থ : “আমি
তাদেরকে শুধুমাত্র খালেছভাবে আমার জন্যই ইবাদত করার নির্দেশ দিচ্ছি।
অতএব, যে ইবাদতগুলো ইখলাছের সহিত অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য করা হবে, সেটাই মহান আল্লাহ পাক কবুল করবেন। আর যে
ইবাদত গায়রুল্লাহর জন্য
করা হবে,
তা কবুল করবেন না। বরং তা আমলকারীর চেহারার উপর নিক্ষেপ
করবেন।
অতএব
প্রমাণিত হলো যে, ইবাদতে জাহেরাহ সঠিকভাবে পালন করতে হলে বা তা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবুলযোগ্য
হতে হলে,
ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করার মাধ্যমে অন্তর থেকে উল্লিখিত বদ খাছলত সমূহ দূরীভূত করতে হবে
এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। আর ইলমে তাছাউফ ব্যতীত ইখলাছ হাছিল সম্ভব নয় বিধায় তা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর
জন্যই ফরজে আইন।
0 Comments:
Post a Comment