প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ ( ১ নং )


Image result for তাবলীগ জামাতপ্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ

[সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফে”-উনার ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামায ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরজ নামাজের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইনজেকশন নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ-উনার নামাজে বা অন্যান্য সময় কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়  সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর চতুর্দশ (১৪তম) ফতওয়া হিসাবে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ  করতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]

মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও রহস্য

সমস্ত প্রশংসা ও শোকর সেই মহান রাব্বুল আলামীন উনার জন্যে, যিনি বিশেষ করে মানব জাতিকে উনার ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছেন।
মহান আল্লাহ পাক যখন মানুষ সৃষ্টি করার কথা হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে জানালেন, হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা বললেন,
اتجعل فيها من يفسد فيها ويسفك الدماء ونحن نسبح بحمدك ونقدس لك.
অর্থ : আপনি কি এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যারা মারামারি করবে, কাটাকাটি ও রক্ত প্রবাহিত করবে? অথচ আউনারা সবসময় আপনার প্রশংসার সাথে তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করছি ও পবিত্রতা বর্ণনা করছি।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩০)
অর্থাৎ যদি তাসবীহ-তাহলীল ও যিকির-আযকারের জন্যে হয় তবে তো আমরাই রয়েছি, তাহলে বণী আদম সৃষ্টি করার কি কারণ রয়েছে?
এ কথার জবাবে মহান আল্লাহ পাক তিনি বললেন,
انى اعلم مالا تعلمون.
অর্থ : নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তোমরা তা জাননা।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩০)
অর্থাৎ আমি জমিনে খলীফা কেন পাঠাবো, তা তোমাদের জানা নেই। উক্ত গুপ্তভেদ জানানোর উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহ পাক সূরা জারিয়াত শরীফ উনার ৫৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
وما خلقت الجن والانس الا ليعبدون.
অর্থ : আমি জ্বিন ও মানব জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।
উল্লেখ্য, ইবাদত হলো দুপ্রকার। (১) ইবাদতে জাহেরাহ (২) ইবাদতে বাতেনাহ।
ইবাদতে জাহেরাহ হচ্ছে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, মুয়ামেলাত, মুয়াশেরাত ইত্যাদি।
আর ইবাদতে বাতেনাহ হচ্ছে ইরফানে খোদাওয়ান্দী বা মহান আল্লাহ পাক উনার মারিফত, মুহব্বত। শুধু ইবাদতে জাহেরাহ করার জন্যে হলে তো ফেরেস্তারাই ছিল।
মূলতঃ মহান আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ইবাদতে জাহিরার সাথে সাথে ইবাদতে বাতেনাহ অর্থাৎ ইরফানে খোদাওয়ান্দী বা মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত, মারিফত হাছিল করার জন্যে। এ প্রসঙ্গে তাফসীরে ليعبدون  শব্দের ব্যাখ্যায় মুহাক্কিক-মুদাক্কিক ও অনুসরণীয় মুফাসসিরীনে কিরামগণ বলেন, ليعرفون অর্থাৎ   ইরফানে খোদাওন্দী বা মহান আল্লাহ পাক উনার মারিফাত ও মুহব্বত হাছিল করার জন্য জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন।
সেই মুহব্বত-মারিফাত হাছিল করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
قل انكنتم تحبون الله فا تبعونى يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفور رحيم.
অর্থ : হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আপনি বলে দিন, যদি তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে মুহব্বত কর বা মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত হাছিল করতে চাও, তবে তোমরা আমার অনুসরণ কর। মহান আল্লাহ পাক তোমাদের মুহব্বত করবেন এবং তোমাদের গুণাহখাতা ক্ষমা করবেন। আর মহান আল্লাহ পাক অত্যাধিক ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩১)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত হাছিল করতে হলে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অনুসরণ করতে হবে।
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে কতটুকু এবং কিভাবে অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে সে সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে,
 وعن انس قال جاء ثلاثة رهط الى ازواج النبى صلى الله عليه السلام. يسئلون عن عبادة النبى صلى الله عليه وسلم. قلما اخبروا بها كانهم تقالوها. فقالوا اين نحن من النبى صلى الله عليه وسلم وقد غفرا الله له ما تقدم من دنبه وما تأخر فقال احدهم اما انا فا صلى الليل ابدا وقال الاخر انا اصوم الدهر ولا انطر وقال الاخر انا اعتزل النساء قلا اتزح ايدا فجاء النبى صلى الله عليه وسلم اليهم فقال انتم الذين قلتم كذا وكذا؟ اما والله انى لا خشا كم لله واتقاكم له لكنى اصوم رافطر واصلى وارقد واتزوج النساء فقال النبى صلى الله عليه وسلم فمن رغب عن سنتى فليس منى.
অর্থ : হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, একদিন তিনজন হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা আসলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার স্ত্রী অর্থাৎ উম্মুল মুমিনীন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের কাছে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইবাদত বা আমল সম্পর্কে জানার জন্যে।
যখন উনাদের মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইবাদত বা আমল সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হলো, তখন উনারা ইবাদতগুলোকে (নিজেদের জন্য) কম মনে করলেন এবং উনারা বললেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তুলনায় আমরা কোথায়? কারণ মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পূর্বের এবং পরের সমস্ত কিছু ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। (সে কারণে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য কম ইবাদত করলেও চলবে কিন্তু আমাদেরকে উনার চাইতে বেশী ইবাদত করতে হবে এরূপ চিন্তা করে) উনাদের মধ্যে একজন বললেন, আমি সারা রাত্রি নামায পড়বো, কখনো ঘুমাবো না।
আরেকজন বললেন, আমি সারা জীবন রোযা রাখবো, কখনো রোযা ভঙ্গ করবো না।
আরেকজন বললেন, আমি সারা জীবন স্ত্রীর থেকে দূরে থাকবো। কখনো বিয়ে-শাদী করবো না।
এমন সময় মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের কাছে এসে বললেন,  তোমরা কি সেই লোক, যারা একথা বলেছ যে, সারা রাত্র নামায পড়বো, সারা জীবন রোযা রাখবো, আর স্ত্রীর কাছে যাবনা, বিয়ে-শাদী করবো না।
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “সাবধান! তোমরা সতর্ক হয়ে যাও। আমি আল্লাহ পাককে তোমাদের চেয়ে বেশী ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে বেশী মোত্তাকী, তথাপি আমি নামায পড়ি, ঘুমাই, রোযা রাখি, রোযা ভঙ্গ করি, স্ত্রীর কাছে যাই। (বিয়ে-শাদী করেছি)
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “যে আমার সুন্নতের খিলাফ করবে, সে আমার উম্মত থেকে খারিজ হয়ে যাবে।” (বোখারী, মুসলিম শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে প্রতিক্ষেত্রে অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ইত্যাদি সকল অবস্থাতেই হুবহু অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। কোন প্রকার ইফরাত ও তাফরীত (কম-বেশী) করা যাবে না।      উল্লেখ্য যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ করতে হলে, যিনি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ করেন, উনার সোহবত ইখতিয়ার করতে হবে।
আর ছোহবত ইখতিয়ার প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
يا ايها الذين امنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর এবং সত্যবাদীগণের ছোহবত ইখতিয়ার কর।” (পবিত্র সূরা তাওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১৯)
ছদেক্বীন বা সত্যবাদী হলেন উনারাই যারা মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত ও মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হয়েছেন। উনার ছোহবত ইখতিয়ার করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক আরো বলেন,
واصبر نفسك مع الذين يدعون ربهم والغداوة والعشى يريدون وجهه ولا تعد عينك عنهم. تريد زينة الحيوة الدنيا ولا تطع من اغفلنا قلبه عن ذكرن واتبع هواه وكان امره فرطا.
অর্থ :আপনি নিজেকে উনাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যাঁরা সকাল-সন্ধ্যায় উনাদের রবকে ডাকে উনার সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য এবং আপনি দুনিয়াবী জিন্দেগীর সৌন্দর্য্য (হাছিল)-উনার উদ্দেশ্যে তঁাঁদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবেন না। আর সে ব্যক্তির অনুসরণ করবেন না, যার ক্বালবকে আমি আমার যিকির থেকে গাফেল করেছি। অর্থাৎ যার ক্বালব আমার যিকির থেকে গাফেল হয়েছে। আর যে নিজের নফসের অনুসরণ করে এবং যার কাজ সীমালংঘন করা।” (পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৮)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ মূহ দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, ছদেক্বীন বা আল্লাহওয়ালা উনাদের সোহবত ইখতিয়ার করতে হবে।
উল্লেখ্য, ছদেক্বীন উনারাই যারা নফসের পায়রবী করেন না, যারা দুনিয়া থেকে বিরাগ, যাদের দিল বা অন্তর ইখলাছে পরিপূর্ণ, যাদের ক্বলব বা অন্তর সর্বদা মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরে মশগুল। অর্থাৎ যারা আহলে তাসাউফ বা পীরানে তরীক্বত। সুতরাং ইখলাস বা মহান আল্লাহ পাক উনার মারিফত-মুহব্বত হাছিল করতে হলে তাদের ছোহবতই ইখতিয়ার করতে হবে।  

আহলে তাসাউফ উনারা কামিয়াব এবং তাসাউফের পথেই কামিয়াবী

ইখলাছ ব্যতীত আমলের কোন মূল্যই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট নেই। তাই বলা হয়ে থাকে যে, ইলম বা ইসলাম হলো একটি পাখি, আমল হলো তার পাখা, আর ইখলাছ হলো তার রূহ। এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
فالناس كلهم هلكى الا العالمون والعالمون كلهم هلكى الا العاملون والعاملون كلهم هلكى الا المخلصون والمخلصون على خطر عظيم.
অর্থ : সকল মানুষ ধ্বংস প্রাপ্ত, একমাত্র আালমগণ ব্যতীত। আলিমগণও ধ্বংস প্রাপ্ত, একমাত্র আমলকারীগণ ব্যতীত। আমলকারীগণও ধ্বংস প্রাপ্ত, একমাত্র ইখলাছের সাথে আমলকারীগণ ব্যতীত। আর মুখলিছ বান্দাগণও মহা চিন্তার মধ্যে রয়েছেন।
কিতাবের উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ঈমানদারদের জন্যে ইখলাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার কারণে মহান আল্লাহ পাক, রাব্বুল আলামীন কুরআন শরীফ-উনার অসংখ্য স্থানে এবং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসংখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইখলাছ অর্জনের ব্যাপারে তাকীদ করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
وما امروا الا ليعدوا الله مخلصين له الدين.
অর্থ : আমি তাদেরকে শুধুমাত্র ইখলাছের সাথে ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছি।” (পবিত্র সূরা আল বাইয়্যিনাহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৫)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
يامعاذ اخلص دينك يكفيك العمل القليل.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “হে মুয়াজ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, আপনার দ্বীন বা আমলের মধ্যে ইখলাছ পয়দা করুন, তবে আপনার জন্যে অল্প আমলই যথেষ্ট।” (তারগীব)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইখলাছ ছাড়া আমলের কোন মূল্যই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট নেই। আর ইখলাছের সাথে অল্প আমলই মহান আল্লাহ পাক উনার রেযামন্দী বা সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। অপরদিকে ইখলাছ বিহীন পাহাড় পরিমাণ আমলের দ্বারাও মহান আল্লাহ পাক উনার হাক্বীক্বী রেযামন্দী হাছিল করা সম্ভব নয়।
ইখলাছের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
عن ابى هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان اول الناس يقض عليه يوم القيامة رجل استشهد فاتى به فعرفه نعمته فعرفها فقال فماعملت فيها؟ قال قاتلت فيك حتى استشهدت، قال كذبت- ولكنك قاتلت لان يقال جرىء فقد قيل ثم امربه فسحب على وجهه حتى القىفى النار- ورجل تعلم العلم وعلمه وقرأ القران فاتىبه فعرفه نعمه- فعرفها قال فما عملت فيها؟ قال تعلمت العلم وعلمته وقرأت فيك القران- قال كذبت ولكنك تعلمت العلم ليقال انك عالم-
وقرأت القران ليقال انك قارىء- فقد قيل- ثم امربه فسحب على وجهه حتى القى فى النار- ورجل وسح الله عليه- واعطاه من اصناف المال كله- فاتى به فعرفه نعمه فعر فها- قال فما عملت فيها؟ قال ماتر كت من سببل تحب ان ينفق فيها الاانفقت فيها لك- قال كذبت ولكنك فعلت ليقال هوجواد فقد فيل ثم امربه فسحب على وجهه ثم القى فى النار. (رواه مسلم(
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন তিনজন লোককে প্রথমে বিচারের জন্য আনা হবে। প্রথম যে ব্যক্তিকে আনা হবে, সে হলো একজন শহীদ। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে ব্যক্তি তোমাকে আমি এত শক্তি-সামর্থ্য দিলাম, তা দিয়ে তুমি কি করেছ? সে বলবে, মহান আল্লাহ পাক আমি জ্বিহাদ করতে করতে আপনার জন্য শহীদ হয়েছি। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, মিথ্যা কথা, তুমি আমার জন্য জ্বিহাদ করনি। মানুষ তোমাকে বড় পালোয়ান বা শক্তিশালী বলবে, সেজন্য তুমি জ্বিহাদ করেছ, যুদ্ধ করেছ। মানুষ তোমাকে শহীদ বলেছে। তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের বলবেন, হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম, এ লোকটাকে চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করুন, তাই করা হবে।
দ্বিতীয় আরেকজন লোককে আনা হবে, যাকে ইলম দান করা হয়েছে এবং সে তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। এবং পবিত্র কুরআন শরীফ সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে শিখেছে। মহান আল্লাহ পাক তাকে বলবেন, হে আলিম বা ক্বারী ছাহেব, তোমাকে এত ইলম দেয়া হয়েছিল, শুদ্ধ করে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করতে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, তুমি কি করলে? সে ব্যক্তি বলবে, মহান আল্লাহ পাক, আমি আপনার জন্য ইলম শিক্ষা করেছি এবং তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি, আর আপনার জন্যই আমি পবিত্র কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে পাঠ করেছি। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, মিথ্যা কথা। বরং মানুষ তোমাকে বড় আলিম বা বড় ক্বারী ছাহেব বলবে, সে জন্যেই তুমি ইলম অর্জন করেছ, পবিত্র কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে শিখেছ। কাজেই মানুষ তোমাকে বড় আলেম, বড় ক্বারী সাহেব বলেছে (তোমার বদলা তুমি পেয়েছ)। তখন মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে বলবেন, হে হযরত ফেরেশত আলাইহিমুস সালাম, আপনারা এ লোকটাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করুন। তখন তার চুল ধরে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এরপর তৃতীয় আরেক জনকে আনা হবে, যাকে অনেক সম্পদ দান করা হয়েছে। তাকে মহান আল্লাহ পাক বলবেন, হে ব্যক্তি, তোমাকে আমি দুনিয়াতে অনেক সম্পদের মালিক করেছিলাম, তার বিণিময়ে তুমি কি আমল করলে? সে ব্যক্তি বলবে, হে আল্লাহ পাক, আমি আপনার পছন্দণীয় এমন কোন পথ নেই, যে পথে দান-খয়রাত করিনি। অর্থাৎ আপনি যতগুলো রাস্তা পছন্দ করতেন- মসজিদ, মাদ্রাসা, লঙ্গরখানা, এতিমখানা, গরীব-মিসকিন, রাস্তা-ঘাট, পুল ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই আমি কম-বেশী দান করেছি। কোন প্রার্থীকে আমি খালিহাতে ফিরিয়ে দেইনি। সবাইকে কম-বেশী দান করেছি, একমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, মিথ্যা কথা। তুমি এ জন্য করেছ যে, লোকে তোমাকে দানশীল বলবে, তোমাকে তা বলা  হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তখন বলবেন, হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম, এ দানশীল ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দিন। তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাকে চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” (মুসলিম শরীফ)
স্মরণীয় যে দ্বীন ইসলাম উনার কাজ বিশেষভাবে যাদের দ্বারা হয় তারা এই তিন শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত।
কারণ জ্বিহাদকারী না হলে ইসলাম জারি রাখা, ইসলামে উনার প্রচার-প্রসার করা এবং দ্বীন ইসলাম উনার শত্রুদের থেকে মুসলমানদের মান-ইজ্জত, আবরু-সম্মান ও সম্পদ ইত্যাদির হিফাযত করা দুরূহ হবে, আলিম না হলে ইলম উনার প্রচার-প্রসার হওয়া, মানুষের মাদ্রাসা, মক্তবে ও সাধারণভাবে দ্বীনের তালীম পাওয়া, মসজিদ পরিচালনা করা কঠিন হবে এবং দানশীল না থাকলে দ্বীন ইসলাম উনার বহু কাজ যেমন, মসজিদ, মাদ্রাসা, লঙ্গরখানা ইয়াতীমখানা ইত্যাদি হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। অর্থাৎ ইসলামের প্রচার-প্রসারে উপরোক্ত তিন ব্যক্তির অবদান বিশেষভাবে কাম্য। কিন্তু অবদান থাকা সত্ত্বেও উপরোক্ত তিন ব্যক্তি যে কারণে নাযাত পেতে ব্যর্থ হবে তা হলো ইখলাছ।
অতএব প্রমাণিত হলো যে, ইখলাছ ব্যতীত দ্বীনের দাওয়াত, জ্বিহাদ, দান-খয়রাত ইত্যাদিসহ কোন ইবাদত বা আমলই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট গৃহীত নয়। যদি গ্রহণযোগ্যই হতো, তাহলে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত তিন প্রকার লোক জাহান্নামী হতোনা।
এখানে উল্লেখ্য যে, উক্ত ইখলাছ অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে- ইলমে তাসাউফ। ইলমে তাসাউফ চর্চা বা হাছিল করা ব্যতীত ইখলাছ হাছিল করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। তাই শরীয়ত, ইলমে তাসাউফ অর্জন করা ফরযে আইন করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
طلب العلم فريضة على كل مسلم وسلمة.
অর্থ : প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্যে ইলম অর্জন করা ফরয।” (ইবনে মাজা, বায়হাক্বী)
এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় আরো একখানা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
العلم علمان علم فى القلب فذاك علم النافح وعلم على للسان فذا لك حجة الله عزوجل على ابن ادم.
অর্থ : ইলম দুপ্রকার। একটি হলো- ক্বালবী ইলম, যা উপকারী ইলম অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ। আর দ্বিতীয়টি হলো- জবানী ইলম, যা মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে বান্দার জন্যে দলীলস্বরূপ অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ।” (দারেমী, মিশকাত)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ইলমে ফিক্বাহের সাথে সাথে ইলমে তাসাউফ অর্জন করাও ফরযে আইনের অন্তর্ভুক্ত। মুলতঃ ইলমে ফিক্বাহের দ্বারা বাহ্যিক আমল পরিশুদ্ধ হবে, আর ইলমে তাসাউফের দ্বারা আভ্যন্তরীণ অর্থাৎ ক্বালব বা অন্তর পরিশুদ্ধ হবে অর্থাৎ ইখলাছ পয়দা হবে।
বস্তুতঃ আহলে তাসাউফ বা অন্তর পরিশুদ্ধকারীগণ অর্থাৎ ইখলাছ অর্জনকারীগণই প্রকৃত পক্ষে কামিয়াব বা সফল। আর একমাত্র তাসাউফ চর্চা বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমেই প্রকৃত সফলতা অর্জন করা সম্ভব। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
قد افلح من تزكى
অর্থ : সে ব্যক্তিই কামিয়াবী বা সফলতা অর্জন করেছে, যে ব্যক্তি তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধতা অর্জন করেছে।” (পবিত্র সূরা আলা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৪)
মহান আল্লাহ পাক অন্যত্র আরো ইরশাদ মুবারক ফরমান,
قد الفح من زكها وقد خاب من دسها.
অর্থ : সে ব্যক্তিই সফলতা অর্জন করেছে, যে ব্যক্তি তার অন্তরকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর যে ব্যক্তি তার অন্তরকে কুলষিত করেছে, সে বিফল হয়েছে।” (পবিত্র সূরা শামছ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৯-১০)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ক্বালব বা অন্তর পরিশুদ্ধ করা বা ইলমে তাসাউফ অর্জন করার মধ্যেই পূর্ণ কামিয়াবী বা সফলতা নিহিত রয়েছে, যা অন্য কোনভাবেই অর্জন করা সম্ভব নয়। শুধুমাত্র ক্বালব বা অন্তর পরিশুদ্ধ করেই সে কামিয়াবী বা সফলতা অর্জন করা সম্ভব। এ ব্যাপারটি আরো সুস্পষ্টভাবে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে এভাবে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
يوم لا يئفح مال ولا بنون الا من اتى الله بقلب سليم.
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবে না, তবে যে ব্যক্তি ক্বালবে সালীম অর্থাৎ পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট আসবে, সে ব্যতীত।” (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮৮-৮৯)
অর্থাৎ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি বা অন্য কোন কিছুর দ্বারাই ফায়দা বা সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং ইলমে তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করার দ্বারাই হাক্বীক্বী কামিয়াবী বা সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আহলে তাসাউফগণই কামিয়াব এবং তাসাউফের পথেই পূর্ণ কামিয়াবী। যার নিদর্শন পূর্ববর্তী হযরত ইমাম-মুজতাহিদ ও আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের মধ্যে সুস্পষ্টভাবেই বিদ্যমান। অর্থাৎ পূর্ববর্তী সকলেই ইলমে তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করার কারণেই পূর্ণ সফলতা অর্জন করেছেন।
তাই ইমামকুল শিরমনি, ফখরুল উলামা ওয়াল মাশায়িখ, ইমামুল মুজতাহিদীন, শায়খুল মুতাকাদ্দিমীন ওয়াল মুতাআখখিরীন, ইমামুল আইম্মা, ইমামুল আযম, হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
لولا سنتان لهلك ابو نعمان.
অর্থ : যদি আমি আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি দুটি বৎসর না পেতাম, তবে ধ্বংস হয়ে যেতাম।
আর বিখ্যাত কবি, জগতখ্যাত দার্শনিক ও আলিম, বিশিষ্ট সূফীসাধক, হযরত মাওলানা জালালুদ্দীন রূমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
مولوی خود بخود نشد مولائے روم- تا غلام شمس تبریج نشد-      
অর্থ : আমি মাওলানা রূমী রহমতুল্লাহি আলাইহি  ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহওয়ালা হতে পারিনি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার পীর হযরত শামছে তাবরীজী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাসাউফ চর্চা করে ইখলাছ হাছিল না করেছি। অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার পরই হাক্বীক্বী কামিয়াবী বা সফলতা অর্জন করতে পেরেছি।
অপরদিকে হুজ্জাতুল ইসলাম, মুজাহিদে আকবর, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি একে একে সকল মত-পথ ও তর্জ-তরীক্বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর রায় পেশ করেন যে, পৃথিবীতে যত মত-পথ বা তর্জ-তরীক্বা রয়েছে, সবই অপূর্ণ। একমাত্র তাসাউফ উনার পথই পূর্ণ অর্থাৎ এ পথেই পূর্ণ সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
অনুরূপভাবে পূর্ববর্তী সকলেই ইলমে তাসাউফ উনার পথেই কামিয়াবী হাছিল করেছেন অর্থাৎ ইখলাছ হাছিল করে হাক্বীক্বী আল্লাহওয়ালা হয়েছেন।
অতএব, বর্তমানেও যদি কেউ কামিয়াবী হাছিল করতে চায়, তবে অবশ্যই তাকে ইলমে তাসাউফ চর্চার মাধ্যমে অন্তর পরিশুদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ ইখলাছ পয়দা করতে হবে।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, আহলে তাসাউফগণই কামিয়াব এবং তাসাউফের পথেই কামিয়াবী। সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, পূর্ববর্তী হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা যেভাবে বা যে পদ্ধতিতে দ্বীনের কাজ করেছেন, তার মধ্যেই কামিয়াবী। তার খেলাফ যে কোন পথ বা পদ্ধতি অপূর্ণ ও ফিৎনার কারণ। আর এটা বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, পূর্ববর্তী সকলেই ইলমে ফিক্বাহের সাথে সাথে ইলমে তাসাউফে পূর্ণতা লাভ করার পরই দ্বীনের কাজে বা তাবলীগে আম-এ নিজেদেরকে নিয়োজিত করতেন। এটাই মূলতঃ সঠিক ও বিশুদ্ধ পথ, যা বর্তমানে হাক্কানী আল্লাহওয়ালা বা পীরানে তরীক্বতগণের মধ্যে বিরাজমান।
 আমলের জন্যে প্রধানতম শর্ত
স্মর্তব্য যে, এ দ্বীনের তাবলীগ বা প্রচার বিভিন্নজন বিভিন্ন পদ্ধতিতে করবেন। যেমন কেউ ইমামতী করে, কেউ মুয়াজ্জিনী করে, কেউ মাদরাসায় দর্স দিয়ে, কেউ কিতাবাদি লিখে, কেউ ওয়াজ-নছীহত করে, আবার কেউ খানকায় তালীম দিয়ে ইত্যাদি অসংখ্য পদ্ধতিতে দ্বীনের প্রচার হতে পারে।
কারণ মহান আল্লাহ পাক ও উনার প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পক্ষ হতে-দ্বীনের তাবলীগের জন্যে নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি বা পন্থা নির্ধারিত করে দেয়া হয়নি। তবে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে এতটুকু বলে দেয়া হয়েছে,
ادع الى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة.
অর্থাৎ- মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় (লোকদেরকে) ডাক (দাওয়াত দাও) হিকমতের সহিত সুন্দর সুন্দর কথা দ্বারা।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১২৫)
অর্থাৎ আক্বীদা শুদ্ধ রেখে, শরীয়ত সম্মত যে কোন পদ্ধতি বা পন্থায় মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় ডাকা যাবে বা দাওয়াত দেয়া যাবে অর্থাৎ তাবলীগ করা যাবে।
তবে তার জন্যে প্রধানতম শর্ত হচ্ছে- আক্বীদা শুদ্ধ থাকা অর্থাৎ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার ন্যায় আক্বীদা পোষণ করা। কারণ বিশুদ্ধ আক্বীদা আমল কবুল হওয়ার পূর্ব শর্ত। তাই মহান আল্লাহ পাক, পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন
والعصر- ان الانسان لفى خسر الا الذين امنوا وعملوا الصالحات.
অর্থ : আছরের সময়ের কসম, সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্থের মধ্যে, একমাত্র তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে।” (পবিত্র সূরা আছর শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক মানব জাতির ধ্বংস হতে নাযাত পাওয়ার প্রথম উপায় হিসাবে ঈমান (আক্বীদা)কে আখ্যায়িত করেছেন। অতঃপর আমলের প্রশ্ন। কারণ ঈমানহীন ব্যক্তির নেক আমলের কোন মূল্যই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট নেই। কাজেই বান্দার জন্যে প্রধানতম ফরয এই যে, সে সর্ব প্রথম তার ঈমান বা আক্বীদাকে বিশুদ্ধ করবে অর্থাৎ ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে, আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ন্যায় আক্বীদা  পোষণ করবে।
কেননা আক্বীদাগত কারণেই ইসলামে ৭২টি বাতিল ফিরকার আবির্ভাব হয়েছে। যদিও তাদের কথাবার্তা, চাল-চলন, ছূরত-সীরত ইত্যাদি বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমানের ন্যায় বা ইসলামসম্মত, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা দ্বীন ইসলাম উনার মৌলিক বিষয়ে ইসলাম তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস অর্থাৎ আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার সম্পূর্ণ বিপরীত আক্বীদা পোষণ করে থাকে, যা সুস্পষ্ট কুফরী। যেমন : ক্বদরিয়া সম্প্রদায়- তারা তক্বদীরকে অবিশ্বাস করে, অথচ তক্বদীরের উপর ঈমান আনা ফরজ। খারেজী সম্প্রদায়- তাদের আক্বীদা হলো- হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা কাফির (নাউযুবিল্লাহ), অথচ হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রতি সুধারণা পোষণ করা ঈমানের অঙ্গ বা ফরয।
রাফেজী বা শিয়া সম্প্রদায়- তাদের আক্বীদা মতে শিয়াদের ইমামদের মর্যাদা হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের চেয়েও বেশী, বর্তমান পবিত্র কুরআন শরীফ পরিবর্তীত, হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম ব্যতীত হযরত খোলাফায়ে রাশেদীন আলাইহিমুস সালাম উনারা সকলেই মুরতাদ। (নাউযুবিল্লাহ)
অনুরূপ বর্তমান যামানার ভয়ঙ্কর ফিৎনা- কাদিয়ানী সম্প্রদায়, তাদের আক্বীদা হলো- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শেষ নবী নন, উনার পর আরো নবী পৃথিবীতে আসবে, তাই তারা গোলাম কাদিয়ানীকে নবী বলে বিশ্বাস করে, যা অকাট্য কুফরী।
অথচ তারা প্রত্যেকেই বাহ্যিক দৃষ্টিতে দ্বীন ইসলাম উনার তাবলীগ (প্রচার) করে, নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের কথা বলে, টুপি, কোর্তা, পাগড়ী পরিধান করে। এতকিছুর পরও তারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া মোতাবেক কাফের বা অমুসলিম। কারণ তাদের উপরোক্ত আক্বীদাসমূহ সম্পূর্ণই কুফরী।
আর এদের প্রসঙ্গেই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
ستفترق امتى ثلاث وسبعين فرقة كلهم فى النار الاملة واحدة قيل من هى يا رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما انا عليه واصحابى.
অর্থ : অতি শীঘ্রই আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, একটি দল ব্যতীত সকল দল জাহান্নামে যাবে। জিজ্ঞাসা করা হলো- যে দলটি (নাযাত পাবে) সেটা কোন দল? ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, যে (মত-পথের) উপর আমি আমার হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম রয়েছি, তার উপর যারা থাকবে, তারাই সেই নাযাতপ্রাপ্ত দল।” (আহমদ, আবু দাউদ, মেশকাত, মিরকাত শরীফ)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, দ্বীন ইসলাম উনার খেদমত বা প্রচার যে কোন পদ্ধতিতেই করা হোক না কেন এবং যে কেউই করুক না কেন, তা যদি আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করা হয়, তবে তা গ্রহণযোগ্য। আর যদি আক্বীদার মধ্যে কোন ত্রুটি থাকে, তবে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন- খারেজী, রাফেজী, কাদিয়ানী ইত্যাদি সম্প্রদায় পরিত্যাজ্য ও বাতিল।
সহীহ সমঝ
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
من ير دالله به خيرا يفقهه فى الدين.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক যার ভালাই চান, তাকে দ্বীনের সহীহ সমঝ দান করেন।” (বোখারী, মুসলিম শরীফ)
অর্থাৎ দ্বীনের বুঝ অনেক প্রকারেরই হতে পারে কিন্তু সহীহ বুঝ বা সমঝ সম্পূর্ণই আলাদা। যার কারণে সহীহ বুঝের দ্বারা দ্বীনের বিষয়াদি যেরূপ ভালভাবে বোঝা যায়, সহীহ বুঝের অভাবে তদ্রুপ বোঝা যায় না। যেমন সহীহ বুঝের কারণে অনেকে নিম্নোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার প্রয়োগ হাক্বীক্বীভাবে বুঝতে ব্যর্থ হন। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
من دل على خير فله مثل اجر فاعله.
অর্থ : যে ব্যক্তি কোন নেক কাজের প্রবর্তন করলো অতঃপর যতজন লোক সে কাজ করবে প্রত্যেকের সাওয়াব তার আমলনামায় (প্রথমে) দেয়া হবে।” (মুসলিম, মিশকাত ও মিরকাত)
এখানে উল্লেখ্য যে, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নেক কাজের পথ দেখানোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা সত্যি। কিন্তু তাই বলে নেক কাজের নামে যেকোন কাজের প্রবর্তন করলেই চলবে না। অথবা ছোট নেক কাজ প্রবর্তন করে বড় নেক কাজ থেকে মাহরূম করা বা বড় নেক কাজের অন্তরায় সৃষ্টি করা চলবে না। ওলামায়ে মুহাক্কিক-মুদাক্কিকগণ এ বিষয়ে সাবধান করেছেন যে, এমন কোন নতুন নেক কাজের পথ প্রবর্তন বা গ্রহণ করা যাবে না, যার কারণে উলামায়ে মুহাক্কিক ও মুদাক্কিকগণ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার ভিত্তিতে ফরযে আইন হিসেবে নেক কাজের যে পথ সাব্যস্ত করেছেন, তার গুরুত্ব অনুধাবন ও পালন থেকে মানুষ বঞ্চিত হয়।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করা হলো ফরযে আইন, যার সিলসিলা স্বয়ং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে চলে আসছে এবং যা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জরুরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরযে আইন হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
অপরদিকে তাবলীগ হচ্ছে দুপ্রকার। যথা- (১) তাবলীগে আম ও (২) তাবলীগে খাছ। আবার তাবলীগের প্রকার অনুযায়ী মুবাল্লিগও দুপ্রকার। যথা- মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ। তাবলীগে খাছ করা ফরযে আইন যা মুবাল্লিগে আম, খাছ সকলের জন্যই ফরযে আইন। আর তাবলীগে আম করা হচ্ছে- ফরযে কেফায়া, যা কেবল মুবাল্লিগে খাছ উনার জন্যই করণীয়।
উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে প্রচলিত ৬(ছয়) উছুল ভিত্তিক তাবলীগ যাকে তাবলীগ জামাতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে (যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত। যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে। আর যদি তাদের কথা মোতাবেক সেটাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই সেটা মুবাল্লিগে খাছ উনার জন্য করা উচিৎ ছিল। যদি কোন মুবাল্লিগে খাছ  প্রচলিত তাবলীগ করে আক্বীদা বিশুদ্ধ রেখে, তবে সে দ্বীন ইসলামের তাবলীগের তুলনায় খুব সামান্য অংশমাত্র করে।
অথচ তা এরূপ লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লিগে আমেরও উপযুক্ত নয়। যদিও কারো কারো মধ্যে মুবাল্লিগে আমের যোগ্যতা রয়েছে। অর্থাৎ মুবাল্লিগে আম রয়েছে। যার কারণে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের দ্বারা মানুষ দ্বীনের ফায়দা পাওয়ার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্তই হয়ে থাকে বেশী। অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ হচ্ছে ফরযে আইন আর প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ হচ্ছে মক্তবী শিক্ষা।
কাজেই এ মক্তবী শিক্ষা- যা ইলমে ফিক্বাহর অংশবিশেষ তাতে নিয়োজিত থেকে ইলমে তাসাউফ যা জরুরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরযে আইন তা থেকে মাহরূম থাকা কখনই শরীয়ত সম্মত হবেনা।
অতএব প্রতীয়মান হয় যে, বিগত ৭১ (একাত্তর) বৎসর যাবত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের যে কার্যক্রম চলছে, তা দ্বীনী সহীহ সমঝের ভিত্তিতে চলছেনা, বরং তাদের মধ্যে দ্বীনী সহীহ সমঝের যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে।
 প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ 
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
كنتم خير امة اخرجت للناس تامرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتومنون بالله.
অর্থ : তোমরা (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তাবলীগ তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সাথে সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। সেটা হলো-
نومنون
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন ইসলাম সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা। অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। তবেই সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ফায়দা বা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব হবে।
স্বরণযোগ্য যে, বর্তমান প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের বেশকিছু লেখনী, বক্তব্য, বিবৃতি, আমল ও আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের মনে নানাবিধ সংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারপাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ হতে মাসিক আল বাইয়্যিনাতেরআকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য বিভাগ সুওয়াল-জাওয়াববিভাগে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারিত কতিপয় আপত্তিজনক আক্বীদাসমূহ উল্লেখ করে অসংখ্য চিঠি প্রেরণ করে। কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : যদি তোমরা না জান, তবে আহলে যিকির বা হক্কানী আলিম উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করো।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৪৩ ও পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৭)
অর্থাৎ তোমরা যারা জাননা বা দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান রাখনা, তারা যাঁরা জানেন, উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।
অতএব, যাঁরা জানেন, উনাদের পবিত্র দায়িত্ব হলো- প্রশ্নকারীর প্রশ্নের শরীয়তসম্মত জাওয়াব প্রদান করা। কারণ যারা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাব প্রদান হতে বিরত থাকবে, তার জন্যে কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে। যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة باجام من النار.
অর্থ : যাকে দ্বীন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়,  জানা থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা গোপন করে অর্থাৎ জবাব না দেয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযা, আহমদ, মেশকাত শরীফ)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে, “তার জ্বিহ¡া আগুনের কেঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হবে।
কাজেই উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে যে ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার থেকে বাঁচার জন্যে অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করার লক্ষ্যে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারঅগণিত পাঠক, গ্রাহক ও সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের প্রেরিত সুওয়ালসমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদাসমূহের শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব বা ফতওয়া দেয়া হলো।

প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়

এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় এই যে, মূলতঃ আমাদের সাথে কারো যেরূপ বন্ধুত্ব নেই, তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খেলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যেই হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
من احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মুহব্বত বা বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী)
বস্তুতঃ মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি সবই উপরোক্ত হাদীছ শরীফ-উনার মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
কাজেই মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায়প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতসম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো- প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কেউল্লেখকৃত আক্বীদাসমূহের সঠিক, বিশুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত ফায়সালা প্রদান এবং প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতের কাজে যারা মশগুল রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা উক্ত আক্বীদাসমূহ জেনে হোক বা না জেনেই হোক বিশ্বাস করে এবং তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করে, নিজেদের ও জনসাধারণের ঈমান ও আমলের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের সে ঈমান ও আমলের হিফাযত করা ও সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণের নিকট সত্য বা হক্ব বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক এতমিনান ও নাযাত লাভ করতে পারে।
মূলত : মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তাই এক মুমিন অপর মুমিনের ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমানী আলামত। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
المؤمن مرأة ملمومن
অর্থ : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে আয়না স্বরূপ।
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি স্বীয় খিলাফতকালে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রীতিনীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত হযরত আনছার এবং মুহাজির ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যদি আমি দ্বীনের হুকুম-আহকামকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে শরীয়ত উনার বিরোধী কোন আদেশ প্রকাশ করি, তবে আপনারা কি করবেন?” উপস্থিত লোকেরা নীরব রইল। হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই কথার পূণরাবৃত্তি করলেন। তখন হযরত বশীর ইবনে সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন, “যদি আপনি উনারূপ করেন, তবে আমরা আপনাকে এরূপ সোজা করবো, যেরূপ তীরকে সোজা করা হয়।তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, “আপনারাই আমার প্রকৃত বন্ধু, দ্বীনের কাজে সাহায্যকারী।” (আওয়ারেফুল মাআরেফ)
সুতরাং উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আলোকে অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃ পূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল হিফাযতের লক্ষে বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো। যাতে করে সত্যান্বেষী, সমঝদার মুসলমান ও প্রচলিত তাবলীগ কারীগণ সে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী ফায়সালা অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিজেদের ঈমান ও আমলের হিফাযত করে সঠিকভাবে দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খেদমত করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বীনের তাবলীগ যা খাছ ও আম তা শত-সহস্র লোক করবে এবং অবশ্যই করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করতে হবে। কারণ আক্বীদা শুদ্ধ না হলে দ্বীনী কোন খিদমতই আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্য নয়। উপরন্ত কুফরী আক্বীদা থাকার কারণে তাকে হতে হবে চির জাহান্নামী।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে দ্বীনী তাবলীগ (যা আম ও খাছ) করার তৌফিক দান করুন। (আমীন)

সুওয়ালকারীদের নাম-ঠিকানা
(১)  মুহম্মদ হাবীবুর রহমান, ব্লক-বি, হালিশহর, চট্টগ্রাম। (২) অধ্যক্ষ, মুহম্মদ আলী হায়দার, দিনাজপুর। (৩) মুহম্মদ ইমদাদুর রহমান (মাষ্টার), সহ-সভাপতি,  প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, সুনামগঞ্জ। (৪) এম, , সালেহ, জালালিয়া মসজিদ, শ্রীমঙ্গল। (৫) মুহম্মদ নুরুল হক খান, কোর্ট মসজিদ, রাজশাহী। (৬) এ, কে, এম রোকনুজ্জামান, ক্যাডেট কলেজ মোড়, রংপুর। (৭) মুহম্মদ মামুনুর রশীদ (মামুন),এইচ, এস, সি পরীক্ষার্থী/৯৬, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর। (৮) মুহম্মদ নাজিম উদ্দিন, মুনিরীয়া বই ঘর, রাউজান হাই স্কুল গেইট, পোষ্ট ও থানা- রাউজান, চট্টগ্রাম।
(৯) কে, জে, এম, উমর ফারুক, প্রিন্সিপাল অফিসার, আইন বিভাগ-১, সোনালী ব্যাংক,  প্রধান কার্যালয়, ঢাকা।
(১০) মুহম্মদ মুনিষ মোর্শেদ, উিনারপুর, ঢাকা। (১১) মুহম্মদ নুরুল আফসার চৌধুরী, বাশখালী, চট্টগ্রাম। (১২) ডাঃ মুহম্মদ মফিজ আহমদ, পোরশা, নওগাঁ। (১৩) মুহম্মদ আব্দুর রহীম, ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া। (১৪) সাইয়্যিদ মুহম্মদ আলমগীর হুসাইন,  ভুরঘাটা, মাদারীপুর। (১৫) মুহম্মদ আব্দুল কাদের খন্দকার, কুড়িগ্রাম।  (১৬) শেখর আহমদ, জাতীয় আইন কলেজ,  প্রথম বর্ষ,  খিলগাঁও বিশ্বরোড, ঢাকা।  (১৭) মুহম্মদ সেলিম, আশরতপুর মডার্ন মসজিদ, রংপুর। (১৮) মুহম্মদ মিজানুর রহমান, কালিপুর, মতলব, চাঁদপুর। (১৯) মুহম্মদ রুহুল আমীন ভুইয়া, লগ্নসার, বরুড়া, কুমিল্লা। (২০) মুহম্মদ আব্দুর রহমান, নড়াইল। (২১) মুহম্মদ হাসীবুল হাসান, মাগুড়া। (২২মুহম্মদ আব্দুল হাকীম, শাহজাহানপুর,ঢাকা। (২৩) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সদরঘাট, ঢাকা। (২৪) মুহম্মদ শফিকুল আলম, মান্দারীখিল, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর। (২৫) মুহম্মদ আলী হায়দার, পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম। (২৬) মুহম্মদ আজহারুল ইসলাম,  জয়মনির হাট, ভুরঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম। (২৭) মুহম্মদ ইসমাঈল হোসেন, মুক্তাগাছা, মোমেনশাহী। (২৮) মুহম্মদ আব্দুল কাদের, আহমদবাগ, ঢাকা। (২৯) মুহম্মদ তোফাজ্জল হুসাইন, টাঙ্গাইল। (৩০) মুহম্মদ আবুল হাসেম জেহাদী, সিলেট সদর।  (৩১) মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, গাইবান্ধা। (৩২) গোলাম মুহীউদ্দীন, লালমনির হাট। (৩৩) মাওলানা মুহম্মদ আখলাকুর রহমান, রাজারহাট, কুড়িগ্রাম। (৩৪) মুহম্মদ আবূ বকর সিদ্দীক, নূর কলোনী, খাগড়াছড়ি। (৩৫) মুহম্মদ মুনসুর আলম, কোর্ট রোড, ঠাকুর গাঁও। (৩৬) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা বান্ধা, পঞ্চগড়। (৩৭) মুহম্মদ মুহিউদ্দীন, পাটগ্রাম, লালমনিরহাট। (৩৮) মুহম্মদ মনু মিয়া, সদর রোড, কক্সবাজার। (৩৯) মুহম্মদ জয়নাল আবেদীন, চিরিঙ্গা, কক্সবাজার। (৪০) মুহম্মদ মুকুল, ডিসি বাংলা রোড, ঝিনাইদাহ। (৪১) মুহম্মদ আবদুস সাত্তার, বয়রা, খুলনা। (৪২) মুহম্মদ আবু বকর সিদ্দীক, বরগুনা। (৪৩) মুহম্মদ ইসহাক, ঝালকাঠী। (৪৪) মুহম্মদ ফারুক, প্রধান সড়ক, হবিগঞ্জ। (৪৪) মুহম্মদ নূরুল হক, কসবা, বিঃবাড়ীয়া। (৪৫) মুহম্মদ ইব্রাহীম খলিল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। (৪৬) মুহম্মদ আলী, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা। (৪৭) মুহম্মদ আলম, ট্টাঙ্ক রোড, ফেনী। (৪৮) মুহম্মদ ফজলুল হক, জয়পুরহাট। (৪৯) মুহম্মদ আযীযুল হক বিলাল, ডিসি অফিস, চাঁপাই নবাবগঞ্জ। (৫০) মুহম্মদ আবুল কাশেম, রেলষ্টেশন,জামালপুর। (৫১) মুহম্মদ আবুল খায়ের, মদীনা ওয়াচ, রায়পুর বাজার, লক্ষীপুর।
সুওয়াল : আমরা শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। কারণ আউনারা অনেকদিন যাবত তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলাম এবং এখনো তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকের সাথে আমাদের মেলামেশা আছে। তাতে তাদের বেশ কিছু বক্তব্য বা আক্বীদা, যা আউনারা অতীতেও জেনেছি এবং এখনো তা অবহিত হচ্ছি। তার মধ্যে অনেকগুলো তাদের লেখা কিতাবেও উল্লেখ আছে। সে সমস্ত আক্বীদাসমূহ আমাদের মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। সেগুলো আউনারা নিম্নে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম –
(১) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লিখিত কিতাবে একথা উল্লেখ আছে যে, মূর্খ হোক, আলেম হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, সকল পেশার সকল মুসলমানের জন্য তাবলীগ করা ফরজে আইন। (হযরতজীর মালফূযাত-৪ পৃষ্ঠা-৭, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব পৃষ্ঠা-৫৩, তাবলীগে ইসলাম পৃষ্ঠা-৩, পস্তী কা ওয়াহেদ এলাজ পৃষ্ঠা-২২)
(২) মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের মালফূযাতসহ আরো কিছু কিতাবে লেখা আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা, যা সকল দ্বীনী আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল তরীক্বা আর হতে পারেনা। (হযরতজীর মালফূযাত-২৯ পৃষ্ঠা-২২, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব পৃষ্ঠা-৮৫, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন পৃষ্ঠা-৪৯, তাবলীগ জামায়াতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত ১ম; খন্ড, পৃষ্ঠা-৫৬)
(৩) প্রচলিত তাবলীগের কেউ কেউ বলে থাকে যে, প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগে অংশ গ্রহণ না করলে ও চিল্লা না দিলে ঈমান ও এক্বীন সহীহ হয়না। তাই সাধারণ লোক ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লার দরকার।
(৪) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কেউ কেউ অনেক সময় বলে থাকে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা ছাড়া আর সকলেই গোউনারাহ। অর্থাৎ একমাত্র তারাই হিদায়েতের উপর রয়েছে।
(৫) মুহম্মদ মুযাম্মিলুল হক লিখিত- তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে ১০ দফানামক কিতাবের ১৪নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে যে, “প্রচলিত তাবলীগ হচ্ছে নবীওয়ালা কাজ।
(৬) প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালারা বলে থাকে যে, পীর সাহেবগণের যেখানে শেষ, তাবলীগ ওয়ালাদের সেখানে শুরু। অতএব পীর সাহেবদের ইছলাহর জন্য দশ চিল্লার দরকার।
(৭) তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের মালফূযাতের ৫৩নং পৃষ্ঠার ৮০নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, প্রচলিত তাবলীগের বা অতরীক্বত পন্থীদের, তাসাউফের বা সূফীদের বই পড়া উচিৎ নয়।
এখন আমরা জানতে চাই, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু ঠিক? এবং তা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু প্রয়োজনীয় ও কোন স্তরের আমলের অন্তর্ভূক্ত? কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে ঈমান ও আমল হিফাযত করনে সাহায্য করবেন।
জাওয়াব : আপনাদের তরফ থেকে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন সুওয়ালসহ প্রায় শতাধিক চিঠি এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে যেসব সুওয়ালগুলি মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলির জবাব না দিলেই নয়, সেরূপ প্রায় অর্ধ শতাধিক সুওয়ালের জাওয়াব দিব ইনশাআল্লাহ। তারমধ্যে বর্তমান সংখ্যায় উপরে বর্ণিত আটটি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হলো। বাকীগুলো পর্যায়ক্রমে জাওয়াব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
আপনাদের বর্ণিত সুওয়াল মুতাবেক যদি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হয়ে থাকে, তাহলে তা শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে অবশ্যই আপত্তিজনক, যা বিভ্রান্তিকর ও জিহালতপূর্ণ এবং তারমধ্যে কোন কোনটি কুফরীমূলক বক্তব্যও রয়েছে।
তবে আপনারা যেহেতু দলীল ভিত্তিক জাওয়াব চেয়েছেন, তাই আউনারা উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের ভিত্তিতে জাওয়াব দিব। (ইনশাআল্লাহ)
কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে বলেন,
فاسئلوا اهل الذكر انكنتم لا تعلمون.
অর্থ : তোমরা যারা জাননা, যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৪৩)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجم من النار.          
অর্থ : যাকে ইলমের বিষয় সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করা হয়, আর সে জানা থাকা সত্ত্বেও তা চুপিয়ে রাখে, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী দেয়া হবে।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, আহমদ, মিশকাত, মিরকাত)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, “তার জিব কেটে দেয়া হবে ইত্যাদি।
তাই নিম্নে পর্যায়ক্রমে আপনাদের প্রেরিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহের পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য দলীলসমূহের ভিত্তিতে শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো-

তাবলীগের অর্থ ও প্রকার

তাবলীগ সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ কি, তা জানতে হবে। ত্মণ্ডব্দৈঙ্খত্রঞ্জ তাবলীগ অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দুপ্রকার অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দুভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১) তাবলীগে ত্মম্লব্জহৃত্রঞ্জ  আম  বা    সাধারণভাবে, (২) তাবলীগে ত্মম্পব্জম্বত্রঞ্জ খাছ বা বিশেষভাবে। আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দুপ্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক)।

মুবাল্লিগে আম ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র

মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারকারী)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে সূরা তাহরীম শরীফ উনার ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا قرا انفسكم واهليكم نارا
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।” (বোখারী শরীফ)
আর বোখারী শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسول عن رعيته.
অর্থ : সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো বলেন, 
بلغوا عنى ولو اية.
অর্থ : তোমরা আমার থেকে একটি পবিত্র আয়াত শরীফ (পবিত্র হাদীছ শরীফ) হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বোখারী শরীফ)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- তখন হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে না পার। (তিবরানী শরীফ)
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো বলেন,
الدين نضيحة
অর্থ : দ্বীন হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং মহান আল্লাহ পাক প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ উনার হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।
কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করবেন।
অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-উনার জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তালীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম-উনার জন্য ফরযে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, কাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, কবীর)

মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র

মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-উনার মত নয়। অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন।
আর যাঁরা খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট প্রচারক, উনাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ولنكن منكم امة يدتمون الى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر واولئك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম উনার) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১০৪)
অর্থাৎ তাকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعله يحذرون.
অর্থ : কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১২২)
(তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : তোমরা দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর এবং  মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুতনী, মিশকাত)
মূলতঃ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনাদের অবশ্যই ওলামায়ে হাক্কানী-রাব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী, রব্বানী আলেম উনাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.
অর্থ : নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলিমরাই মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করেন।” (পবিত্র সূরা ফাতির শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৮)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর হযরত ইমাম আহম্মদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী মহান আল্লাহ পাক উনার ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলিম।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
من ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟ قال الطمع.
অর্থ : “(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলিম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আলিমের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।  (দারিমী, মিশকাত)
অর্থাৎ যিনি ইলম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হাক্কানী-রাব্বানী আলিম।
কাজেই যিনি ইলম, আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হাক্কানী আলিম, আর তিনিই হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলিমগণ হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত)
অর্থাৎ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনারা নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে উনাদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তালীম ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ তাছাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদরাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদিভাবে দাওয়াত ও তালীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-উনার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আমের (ফরযে কিফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-উনার (ফরযে আইনের) খিদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

মুবাল্লিগে আমের জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ উনার যোগ্যতা ও তাবলীগে আমের শর্ত

স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরযে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কশ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়িয নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক উনার সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল করেছ?” যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) পবিত্র সূরা সফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
يا ايها الذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?”
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(২) তিনি আবার বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন,
اتأمرون الناس بالبر وبنسون انفسكم وانتم تتلون الكتاب.
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انهاكم عنه.
অর্থ : আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খিলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮৮)
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না।
তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ পবিত্র আয়াত শরীফসমূহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।অর্থাৎ উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়িয নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যেই ফরযে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলিম উনাদের জন্যেই প্রযোজ্য, যা উনাদের জন্যে ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। অতএব, মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাযায়িয ও হারাম হবে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ যাকে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে, (যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে) যদি তাদের কথা মোতাবেক সেটাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই সেটা মুবাল্লিগে খাছ-উনার জন্য করা উচিৎ ছিল। অথচ তা এমন সব লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লীগে খাছ তো নয়ই, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই মুবাল্লীগে আম-উনারও উপযুক্ত নয়। যদিও কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগে আম রয়েছে।
অতএব তাবলীগে আম মুবাল্লিগে খাছ উনার জন্যই করা ফরযে কিফায়া। যা মুবাল্লিগে আমের জন্য করা সম্পূর্ণ নাযায়িয ও হারাম। আর সাধারণ লোকেরতো প্রশ্নই উঠেনা।
এখন হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় এমন কতক লোক, যারা মুবাল্লিগে খাছ ও আম কোনটাই নয়, তারা অনেকেই নামাযের জামায়াতে যাওয়ার সময় বা নামায পড়ার সময় অন্যকে নামাযে ডেকে নিয়ে যায়, রোযার মাসে রোযা রাখার কথা বলে, ইত্যাদি অনেক নেক কাজের কথাই বলে থাকে, যা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা তবে সেটার ফায়সালা কি?
এর ফায়সালা হলো, ঐ সকল লোক মুসলিম শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ-
الدين نصيحة
অর্থাৎ দ্বীন হচ্ছে অপরের ভাল কামনা করা।”) এর মিছদাক বা নমুনা। অর্থাৎ এদেরকে কেউ হিদায়েতের দায়িত্ব দেয়নি বা উনারা হিদায়েতের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। উনারা হচ্ছে মানুষের খয়েরখাঁ বা হিতাকাঙ্খী।
এখানে উল্লেখ্য যে, তিবরানী শরীফ উনার উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে, সৎকাজ না করলেও অপরকে সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, “তোমরা ঐ কথা বল কেন, যা তোমরা নিজেরা করোনা।
তাহলে এই পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বক্তব্যের মধ্যে ফায়সালা কি?
মূলতঃ উনার ফায়সালা উলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ দিয়েছেন। উনাদের মতে তিবরানী শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সৎ কাজ না করলেও সৎ কাজের দাওয়াত দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা মুবাল্লিগে আমের জন্য। যেমন কোন বাবা নিজে নামায বা অন্যান্য নেক কাজ না করা সত্বেও তার সন্তান ও অধিনস্তদের নামায বা অন্যান্য নেক কাজের জন্য বলতে পারেন।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা বলার জন্য যে নিষেধবাণী করা হয়েছে, তা হলো- মুবাল্লিগে খাছ-উনার জন্য। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ-উনার জন্য নিজে কোন সৎ কাজ না করে অপরকে তা করতে বলা জায়িয নেই।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন মিরাজ শরীফ যান, তখন দেখলেন কিছু লোকের জিহ¡া আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছে। তখন জিজ্ঞাসা করা হলো- উনারা কারা? হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, এরা ঐসকল লোক, যারা অন্যকে নেক কাজের উপদেশ দিতো কিন্তু নিজেরা তা করতো না।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তিবরানী শরীফ উনার বর্ণনা মোতাবেক সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারা কুরআন শরীফ-উনার উক্ত আয়াত শরীফ মোতাবেক নিজে সৎকাজ না করে অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন না। কারণ যদি সকলের জন্যে আমভাবে একথা বলা হয় যে, সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজের কথা বলা জায়িয, তবে মিরাজ শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত লোকদের জিহ¡া কাটা হলো কেন? এতে বুঝা গেল যে, তিবরানী শরীফ উনার উক্ত হুকুম সকলের জন্যে প্রযোজ্য নয়। বরং যারা মুবাল্লিগে আম, তাদের জন্যেই প্রযোজ্য। আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উক্ত আয়াত শরীফ ও মিরাজ শরীফ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা যারা মুবাল্লিগে খাছ, তাদের জন্যে প্রযোজ্য।
সুতরাং হাক্বীক্বতে উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ ও আয়াত শরীফ উনার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। অনেকে ব্যাখ্যা না জানার কারণে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। মূলতঃ উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়।
সুওয়াল সমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের জাওয়াব -

১নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লিখিত কিতাবে একথা উল্লেখ আছে যে, মূর্খ হোক, আলিম হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, সকল পেশার সকল মুসলমানের জন্য তাবলীগ করা ফরযে আইন। (হযরতজীর মালফুজাত-৪ পৃষ্ঠা-৭, অনুবাদক মাওলানা ছাখাওয়াত উল্লাহ, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব পৃষ্ঠা-৫৬ অনুবাদক- ইসমাইল হোসেন, তাবলীগে ইসলাম পৃষ্ঠা-৩, লেখক- মাওলানা আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী, পস্তী কা ওয়াহেদ এলাজ, লেখক- মাওলানা এহতেশামুল হাসান কান্দলবী, পৃষ্ঠা-২২)
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুক সত্য? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : তাদের এ বক্তব্যের জবাবে বলতে হয়, তাবলীগ করা কি? তা ফরযে আইন না ফরযে কিফায়া?
ফরযে আইন হলো এমন ইবাদত, যা প্রত্যেককেই আলাদাভাবে ফরয হিসেবে পালন করতে হয়। যেমন- নামায, রোযা ইত্যাদি।
আর ফরযে কিফায়া হলো এমন ইবাদত, যা সমষ্টিগত লোকের প্রতি পালন করা ফরয। এ ফরয দেশবাসী, শহরবাসী, এলাকাবাসী বা কোন সম্প্রদায় থেকে একজন আদায় করলেই সকলের তরফ থেকে ফরযের হক্ব আদায় হয়ে যায়। যেমন- হাফিয বা আলিম হওয়া, জানাযার নামায পড়া ইত্যাদি।
উপরোক্ত বক্তব্যের জবাবে আরো বলতে হয়- যদি তাবলীগ করা ফরযে আইন হয়, তবে কার জন্য ফরযে আইন? এবং যদি ফরযে কিফায়া হয়, তবে কার জন্য ফরযে কিফায়া? আর যদি উভয়টাই হয়, তবে সেটাই বা কাদের জন্য।
মূলত : তাবলীগ করা ফরযে আইন ও ফরযে  কিফায়া উভয়টাই। যারা মুবাল্লিগে খাছ উনাদের জন্য তাবলীগে আম করা ফরজে কেফায়া। আর যারা মুবাল্লিগে আম তাদের জন্য তাবলীগে আম করা জায়িয নেই। তাদের করতে হবে তাবলীগে খাছ, যা মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যই করা ফরযে আইন।
মুবাল্লিগে আম বা খাছ ব্যতীত আওয়ামুন্নাছ বা সাধারণ জনগণের জন্য তাবলীগে আম বা খাছ কোনটাই করা ফরযে আইন বা ফরযে কিফায়া নয়।
আর তাবলীগে আম করা কারো জন্যই ফরযে আইন নয়, যদিও সে মুবাল্লিগে খাছ হোক না কেন। আর তাবলীগে আম করা শুধু মুবাল্লিগে খাছ উনার জন্য ফরযে কিফায়া, যা মুবাল্লিগে আমের জন্য করা জায়িয নেই।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ১২২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
ما كان لمؤمنين لينفروا كا فة.
অর্থ : সকল মুমিনদের জন্য একসাথে কোন কাজে বের হওয়া উচিৎ নয়।
ইমাম, মুজতাহিদগণ এই আয়াত শরীফ থেকে উছূল বের করেছেন যে, মুমিনদের জন্য সমষ্টিগতভাবে কোন কাজ করা ফরযে আইন নয় বরং তা ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য যেসব কাজ সমষ্টিগতভাবে করতে হয়, সেটা ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। তা কখনো ফরযে আইন নয়, যা উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
অতএব যদি কেউ বলে- মূর্খ হোক, আলিম হোক, ধনী হোক, দরিদ্র হোক, সকল পেশার সকল মুসলমানের জন্য তাবলীগ করা ফরযে আইন। তবে তা সম্পূর্ণই পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ ও ইজমা-ক্বিয়াস উনাদের খিলাফ বা পরিপন্থী হবে। আর ফরযে কিফায়াকে ফরযে আইন বলাও হারাম ও কুফরীর নামান্তর, যা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই ওয়াজিব।

২নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : মাওলানা ইলিয়াছ ছাহেবের মালফূযাতসহ আরো কিছু কিতাবে লেখা আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা, যা সকল দ্বীনী আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত, যার থেকে ভাল তরীক্বা আর হতে পারেনা। (হযরতজীর মলফুজাত-২৯ পৃষ্ঠা-২২, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব পৃষ্ঠা-৮৫, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন পৃষ্ঠা-৪৯ লেখক- ওবায়দুল হক, তাবলীগ জামায়াতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত ১ম খন্ড পৃষ্ঠা-৫৬, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা-২৯ লেখক- মৌলবী মুঃ ইব্রাহীম)
এখন আমার জানার বা বুঝার বিষয় হচ্ছে- আসলেই কি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত শ্রেষ্ঠ ও উত্তম পথ? শরীয়তের দৃষ্টিতে তার ফায়সালা কামনা করি।
জাওয়াব : তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা সম্পূর্ণই মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর, যা পূর্ববর্তী আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরো উল্লেখ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে যে দ্বীনী তালিম দেয়া হয়, তা পরিপূর্ণ দ্বীনী তালিম হতে নিতান্তই কম এবং সেটাকেই তারা পরিপূর্ণ ও যথেষ্ট মনে করে থাকে। অথচ দ্বীন ইসলাম ও তার শিক্ষা অত্যন্ত ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। যেমন পরিপূর্ণ দ্বীনী শিক্ষার বিষয় উল্লেখপূর্বক মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক ফরমান,
لقد من الله على المؤمنين اذبعث فيهم رسولا من اهفسهم يتلوا عليهم اياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة وان كانوا من قبل لفى ضلال مبن.             
অর্থ : মুমিনদের প্রতি মহান আল্লাহ পাক উনার ইহসান, তাদের মধ্য থেকে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, তিনি কিতাব শিক্ষা দিবেন, হিকমত শিক্ষা দিবেন ও তাদেরকে তাযকিয়া (পরিশুদ্ধ) করবেন। যদিও তারা পূর্বে হিদায়েত প্রাপ্ত ছিলনা।  (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৬৪)
(তাফসীরে জালালাইন, কামালাইন, বায়যাবী, কুরতুবী, তাবারী, রুহুল মায়ানী, রহুল বয়ান, ইবনে কাছীর, আবী সউদ, মাযহারী, মাআরেফুল কুরআন, দুররে মানছুর)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে, পবিত্র আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করে শুনানো কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়া হচ্ছে ইলমে জাহির বা ইলমে ফিক্বাহ ও হুনরের অন্তর্ভূক্ত। যা দ্বীনের যাবতীয় হুকুম-আহকাম পালন করার জন্য ও দৈনন্দিন জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজন। আর (তাযকিয়া) পরিশুদ্ধ ও সংশোধন করার দ্বারা ইলমে বাতিন বা ইলমে তাছাউফ উদ্দেশ্য। যার মাধ্যমে মানুষের ক্বালব বা আভ্যন্তরীণ দিক শুদ্ধ হয়। অনুরূপ পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ২৯ ও ১৫১নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে এবং পবিত্র সূরা জুমুয়া শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সমার্থবোধক আরো তিনখানা পবিত্র আয়াত শরীফ উল্লেখ রয়েছে। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, কবীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, দুররে মানছূর, আবী সউদ, রুহুল মায়ানী, তাবারী, মায়ারেফুল কুরআন ইত্যাদি)
মূলত : এ ক্বালব বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার শিক্ষাই হচ্ছে মূল শিক্ষা। কেননা ক্বালব শুদ্ধ না হলে মানুষের কোন ইবাদত-বন্দিগী, ধন-সম্পদ, প্রতিপত্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবুলযোগ্য নয়। ফলে সে পরকালে কোন ফায়দা বা উপকার ও হাছিল করতে পারবেনা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন-  
يوم لا ينفع مال ولا بنون الا من اتى الله بقلب مليم.
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন কেউ তার ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা উপকার বা ফায়দা হাছিল করতে পারবেনা। একমাত্র ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে প্রশান্ত বা পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে উপস্থিত হবে।” (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮৮-৮৯)
আর অন্তর বা ক্বালব প্রশান্ত ও পরিশুদ্ধ হয় একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
الابذكر الله تطمئن القلوب.
অর্থ : সাবধান! মহান আল্লাহ তায়ালা উনার যিকিরের দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।” (পবিত্র সূরা রাদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৮)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে-
ان فى الجسد مضغة اذا صلحت صلح الجسد كله واذا فسدت فسد الجسد كله الا وهى القلب.
অর্থ : নিশ্চয়ই (মানুষের) শরীরে এক টুকরা গোশত রয়েছে। সেটা যদি পরিশুদ্ধ হয়, তবে গোটা শরীরই পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর সেটা যদি বরবাদ হয়ে যায়, তবে গোটা শরীরই বরবাদ হয়ে যায়। সাবধান! সেই গোশতের টুকরাটির নাম হচ্ছে ক্বালব বা অন্তর।” (বোখারী শরীফ)
অর্থাৎ ক্বালব শুদ্ধ হলে মানুষের ঈমান-আক্বীদা, আমল-আখলাক্ব, সীরত-ছূরত সবকিছু শুদ্ধ হয়ে যায়। আর ক্বালব অশুদ্ধ বা বরবাদ হলে সবকিছুই বরবাদ হয়ে যায়। মূলতঃ তখন বান্দার কোন কিছুই মহান আল্লাহ পাক কবুল করেননা।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, অনন্য, শ্রেষ্ঠ, সম্মানিত ও প্রকৃত কামিয়াব তারাই, যাঁরা ইলমে ফিক্বাহের সাথে সাথে ইলমে তাসাউফ চর্চা করার মাধ্যমে নিজেদের ক্বালব বা অন্তর ইছলাহ বা পরিশুদ্ধ করেছে।
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে ক্বালব শুদ্ধকরণ ইলম বা ইলমে তাসাউফ ব্যতীত শুধুমাত্র যৎসামান্য ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কিভাবে দাবী করতে পারে যে, “প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা, যা সকল দ্বীনী আন্দোলনের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সম্মাণিত, যার থেকে ভাল তরীক্বা আর হতে পারেনা।মূলতঃ তাদের উপরোক্ত দাবী সম্পূর্ণ মিথ্যা ও কল্পনা প্রসূত ও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ খিলাফ।
অপর পক্ষে শুদ্ধ ও সঠিক দাবী হলো তাদের, যারা উপরোল্লিখিত দুপ্রকার ইলম তথা ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফের যথার্থ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন পূর্বক দ্বীনের তালীম-তালক্বীন ও তাবলীগের কাজে নিয়োজিত। এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফে বর্ণিত রয়েছে,
العلم علمان علم فى القلب فذالك علم النافع علم على السان فذالك حجة الله عزوجل على ابن ادم.
অর্থ : ইলম দুপ্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইলম (ইলমে তাসাউফ) -যা উপকারী ইলম। অপরটি হচ্ছে- জবানী ইলম (ইলমে ফিক্বাহ) -যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার প্রতি  দলীল স্বরূপ।” (দারিমী, মেশকাত উেনারকাত আশায়াতুল লোময়াত, লোমায়াত)
এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় মালিকী মাযহাবের ইমাম, ইমামুদ দাহর, ফখরুদদ্দীন, শায়খুল মাশায়িখ, রাহনুমায়ে শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত, ইমামুল আইম্মা, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
من تفقه ولمك يتصوف فقد تفست ومن تصوف ولم يتفقه فقد تضدت ومن جمع بينهما فقد تحقق. 
অর্থ : যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত। আর যে তাসাউফ করে অর্থাৎ মারিফাত চর্চা করে অথচ ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করেনা অর্থাৎ শরীয়ত মানেনা বা অস্বীকার করে, সে কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সেই হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ বা হাক্বীক্বী আলেম।
সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পূর্ণ তাসাউফ শুন্য হয়ে শুধুমাত্র যৎসামান্য ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করে কি করে দাবী করতে পারে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতই শ্রেষ্ঠ, সম্মাণিত ও অনন্য ধর্মীয় তরীক্বা? মূলতঃ তাদের এ দাবী সম্পূর্ণই অবান্তর ও কল্পনা প্রসূত।
প্রকৃতপক্ষে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ সমন্বিত শিক্ষাই হচ্ছে- অনন্য, শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ শিক্ষা, যা হক্কানী-রব্বানী আলিমগণ শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
কাজেই একমাত্র হক্কানী-রাব্বানী পীরানে তরীক্বত, হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম উনাদের দরবার শরীফেই পূর্ণ ইসলাম বা ইসলামী শিক্ষা হাছিল করা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে অবিস্মরণীয় আলিম, মহা দার্শনিক ও প্রখ্যাত ইমাম, হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর ইলমের তীব্রতা এত বেশী ছিল যে, সে তেজোচ্ছাটায় সবাই তটস্থ থাকতো। যাঁর সমঝের ব্যাপকতা ও ক্ষুরধার যুক্তি উপস্থাপনার এত দক্ষতা ছিল, যে কারণে সারা জীবনে সকলেই উনার কাছে বাহাসে পরাজিত হয়েছে। অপরদিকে যিনি এত অল্প সময়ে তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত ও সমাদৃত বাগদাদের ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদ অলংকৃত করেছিলেন। তার পূর্বে ও পরে কেউ এত অল্প বয়সে উক্ত পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেননি এবং এক কথায় এতসব গুণের অধিকারী হওয়ার  উছিলায় যাঁর দ্বারা তৎকালে ইসলাম ছেড়ে প্রায় সর্বোতভাবে গ্রীক দর্শণের দিকে ঝুঁকে পড়া মুসলমানদেরকে যিনি সারগর্ভ হিদায়েতের বাণী শুনিয়ে ইসলামের দিকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়ে হুজ্জাতুল ইসলামলক্বব দ্বারা অদ্যাবধি সমগ্র বিশ্বে বিশেষভাবে সম্মাণিত। সে মহান পুরুষের ইলমে তাসাউফের তাৎপর্য উপলব্ধি ও তার গুরুত্ব অনুধাবনের ঘটনাটি বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। যা তিনি নিজেই যথার্থভাবে প্রকাশ করেছেন উনার প্রখ্যাত আল মুনকেযু মিনাদ্দালালবা ভ্রান্তির অপনোদনকিতাবে।
উল্লেখ রয়েছে, তিনি প্রথমে ইলমে কালাম বা মুতাকাল্লিমদের বিষয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সে বিষয়ে ব্যাপক পর্যালোচনার দ্বারা তার গুঢ়মর্ম উপলব্ধিতে সক্ষম হন এবং তাকে তিনি অপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন।
অতঃপর তিনি দর্শণের দিকে মনযোগী হন এবং অল্প সময়েই (দুবছরে) পরিপূর্ণভাবে দর্শণ শাস্ত্র আয়ত্ত করেন। আর উনারপরেও এক বছর ধরে তিনি অর্জিত জ্ঞানের বিশেষ উপলব্ধি দ্বারা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে পান যে, দর্শণের অনেকটাই প্রবঞ্চনাপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। তাই দর্শণও তাকে আশ্বস্ত করলোনা।
আর উনারপরে তিনি তালিমী শিয়া সম্প্রদায়ের বাতেনী মতবাদ নিয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু এ সম্প্রদায়ের স্থানে অস্থানে বাতেনী ইমামের বরাত তাঁকে এ সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ করে তোলে। এমনিতর অবস্থায় তিনি এক সময় হাজির হন- উনার ভাই হযরত আহমদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার এক মাহফিলে এবং সেখানে হযরত  আহমদ গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি পরিবেশিত একটি কাছীদা শুনে উনার ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। কাছীদাটির ভাবার্থ ছিল নিম্নরূপ -
আর কতকাল জাহিরী ইলমের ফখর ধরে রাখবে? অন্তরের কলুষতা হিংসা, রিয়া, ফখর থেকে কবে আর মুক্ত হবে।
অন্তরের অস্থিরতার এ সময়ে ইমাম ছাহেবের মানসপটে ভেসে উঠে দুটি স্মৃতি, যা সংঘটিত হতো বাদশাহর দরবারে। একটি হলো- যখন ইমামুল হারামাইন, যিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেম এবং তৎকালীন সকল উলামাদের শ্রদ্ধেয় ইমাম, যিনি হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ওস্তাদ, তিনি যখন বাদশাহর দরবারে যেতেন তখনকার স্ম্রতি। অপরটি হলো- বাদশাহর দরবারে অপর একজন সূফী ও শায়খ,  আবূ আলী  ফরমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি,  যিনি ছিলেন তৎকালে আল্লাহ পাক উনার লক্ষ্যস্থল, তিনি যখন হাজির হতেন তখনকার স্মৃতি। প্রথম ক্ষেত্রে ইমাম সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহি যখন উনার ওস্তাদের সাথে বাদশাহর দরবারে তাশরীফ রাখতেন, তখন বাদশাহ ইমামুল হারামাইন রহমতুল্লাহি আলাইহিকে তাযীম করে স্বীয় সিংহাসনের পাশে অন্য আসনে বসাতেন। অন্যদিকে যখন শায়খ আবূ আলী ফরমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি ছিলেন বিশিষ্ট সূফী, তিনি যখন বাদশাহর দরবারে তাশরীফ রাখতেন, তখন বাদশাহ তাঁকে অধিকতর তাযীম-তাকরীম করে নিজ সিংহাসনে বসাতেন এবং বাদশাহ স্বয়ং নীচে বসতেন।
এ ঘটনার স্মৃতি ইমাম ছাহেবের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং তাঁকে সূফী সম্প্রদায়ের প্রতি অনুপ্রাণিত করে তোলে। সূফী তত্ত্ব বা ইলমে তাসাউফের দিকে মনযোগ দিয়েই তিনি বুঝতে পারেন যে, পূর্ণাঙ্গ সূফী তরীক্বার মধ্যেই রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির (ইলমী আক্বীদা) এবং ব্যবহারিক কার্যক্রম (আমল ও রিয়াযত)-উনার সমন্বয়। তিনি বলেন, “আমলের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির আক্বীদা ও বিশ্বাস আমার কাছে অনেক সহজ মনে হয়েছে।তবে তিনি উল্লেখ করেন, “সূফীবাদের যে দিকটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা কেবল পড়াশোনা বা অন্যকিছু দ্বারা সম্ভব নয় বরং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা (জওক বা স্বাদ) তন্ময় সাধনা এবং নৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা অর্জন করা সম্ভব।তিনি উদাহরণ পেশ করেন, “স্বাস্থ্য ও স্বস্তির সংজ্ঞা জানা এবং এগুলোর কারণ ও শর্তাবলী নির্ধারণ করা, আর স্বাস্থ্য ও স্বস্তিলাভের মধ্যে বড় প্রভেদ।
তিনি উল্লেখ করেন, “আমি পরিস্কারভাবে বুঝতে পারলাম, সূফীগণ কথায় মানুষ নন, উনাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং পড়াশোনার মাধ্যমে যতটা অগ্রসর হওয়া সম্ভব তা আমি করেছি। এখন আমার বাকী রয়েছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা আস্বাদন এবং তাসাউফ সাধনার পথ প্রত্যক্ষভাবে অতিক্রমের দ্বারাই তা লাভ করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, এরপরে তাসাউফ শিক্ষার পেছনে বা সূফী হওয়ার বাসনায় তিনি দীর্ঘ দশ বছর কাটিয়ে দেন। এবং ইলমে তাসাউফ বা সূফীদের সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, সে সম্পর্কে বলেন, “আমি  নিশ্চতভাবে বুঝতে পেরেছি যে, কেবল সূফীরাই আল্লাহর পথের যথার্থ পথিক। উনাদের জীবনই হলো সর্বোত্তম জীবন, উনাদের তরীক্বাই নিখুঁত তরীক্বা, উনাদের চরিত্রই সুন্দরতম চরিত্র।
বুদ্ধিজীবিদের সকল বুদ্ধি, জ্ঞানীদের সকল জ্ঞান এবং পন্ডিতদের সকল পান্ডিত্য, যাঁরা খোদায়ী সত্যের প্রগাঢ়তা সম্পর্কে দক্ষ, তাদের সকলের জ্ঞান-বুদ্ধি একত্র করলেও তা দিয়ে ছুফীদের জীবন এবং চরিত্র উন্তততর করা যাবেনা বা সম্ভব নয়।
ছুফীদের অন্তরের বা বাইরের সকল গতি এবং স্থৈর্য নুবুওওয়তের (প্রত্যাদেশ) নূরের জ্যোতি দ্বারা উদ্ভাসিত, নুবুওওয়তের জ্যোতি ছাড়া ধরার বুকে অন্য কোন আলো নেই, যা থেকে জ্যোতির ধারা পাওয়া যেতে পারে।
তিনি লিখেন, “ছুফী তরীক্বার প্রথম স্তর থেকেই শুরু হয় ইলহাম ও দীদার (দর্শন)। ছুফীগণ এ সময়ে জাগ্রত অবস্থায় হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম এবং হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের রূহের দর্শন লাভ করেন। শুনতে পান উনাদের বাণী এবং নির্দেশ। অতঃপর উনারা আরো উচ্চ স্তরে উপনীত হন। আকার ও প্রতীকের উর্দ্ধে এমন এক পরিম-লে উনারা পৌঁছে যান, ভাষায় যার বর্ণনা দান সম্ভব নয়।
তিনি লিখেন, “যারা ছুফীদের মাহফিলে বসে, তারা উনাদের নিকট থেকে বিশেষ ধরণের রূহানিয়াত হাছিল করে।
তিনি সূফীদের এই বিশেষ মর্তবা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র আয়াত শরীফ পেশ করেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম (ইলমে তাসাউফ) দেয়া হয়েছে, মহান আল্লাহ পাক তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিবেন।” (পবিত্র সূরা মুজাদালাহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১)
আর যারা সূফীদের বিরোধিতা করে অথবা তা থেকে গাফিল থাকে, তাদেরকে তিনি নেহায়েত অজ্ঞ বলে মন্তব্য করেন এবং তাদের প্রতি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার নিম্নোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ প্রযোজ্য বলে মন্তব্য করেন, “তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপনার কথা শুনতে আসে, অতঃপর আপনার নিকট থেকে বের হবার পর যারা জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়েছে, তাদের জিজ্ঞেস করে এই ব্যক্তি এখন কি বললো? ওরা ঐসব লোক, যাদের হৃদয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা সীলমোহর মেরে দিয়েছেন। উনারা তাদের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে যাচ্ছে। অর্থাৎ তারা মুক, বধির এবং অন্ধ হয়ে গেছে।” (পবিত্র সূরা মুহম্মদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৬)
হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই মন্তব্য করেন যে, “দ্বীনের সকল পথের পথিকদের মধ্যে একমাত্র সূফী সাহেবরাই পরিপূর্ণ।
তিনি উদাহরণ দেন, “জাহিরী ইলম হলো- খোসা মাত্র। আর সূফীতত্ত্ব অথবা ইলমে তাসাউফ হলো তার অভ্যন্তরীস্থিত শাস বা মূল বস্তুর ন্যায়।তাই তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, “যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সূফী ছাহেবগণের কাছেই তা রয়েছে।
উল্লেখ্য, তাই তিনি সূফী ছাহেবগণের ছোহবত ইখতিয়ার করা বা উনাদের কাছে বাইয়াত হওয়া ফরযের অন্তর্ভূক্ত বলে উনার রচিত কিমিয়ায়ে সায়াদাত কিতাবে উল্লেখ করেছেন এবং নিজেও হযরত আবূ আলী ফরমুদী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বাইয়াত হয়ে তাকমীলে পৌঁছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, ইলমে তাসাউফের পথই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত পথ এবং উনার মধ্যেই পূর্ণতা রয়েছে।
আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে কস্মিনকালেও ইসলামের পূর্ণ শিক্ষা হাছিল করে তাকমিলে পৌঁছা সম্ভব নয়। ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ياايها الذين امنوا ادخلو فى السلم كافة.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হও।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২০৮)
অর্থাৎ প্রত্যেক বান্দাকে ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হতে হবে তথা দ্বীন ইসলাম উনাকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে হবে।
তাহলে যারা প্রচলিত তাবলীগ করবে, তাদের পক্ষে কি করে সম্ভব দ্বীন ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হওয়া বা পরিপূর্ণভাবে দ্বীন ইসলাম উনাকে অনুসরণ করা?
আর এ প্রচলিত তাবলীগই কিভাবে সবচেয়ে উত্তম, শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত আন্দোলন এবং একমাত্র পথ হতে পারে?
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মনগড়া, বানোয়াট ও পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের খিলাফ। আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত কখনো সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আন্দোলন বা উত্তম তরীক্বা হতে পারেনা। যেহেতু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম উনার পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। (যা আমরা সামনে বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ)


৩নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগের কেউ কেউ বলে থাকে যে, প্রচলিত ছয় উছূলী তাবলীগে অংশ গ্রহণ না করলে ও চিল্লা না দিলে ঈমান ও এক্বীন সহীহ হয়না। তাই সাধারণ লোক ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লার দরকার।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়ত সম্মত বা গ্রহণযোগ্য, নির্ভরযোগ্য দলীলের দ্বারা জাওয়াব দিয়ে উপকৃত করবেন।
জাওয়াব : সুওয়ালে উল্লেখকৃত তাদের উক্ত বক্তব্য বা আক্বীদাটিও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সম্পূর্ণ খিলাফ এবং সমাজে ফিৎনা সৃষ্টির কারণ।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে,
عن ابى هريرة- قال- قال النبى صلى الله عليه وسلم- يكون فى اخرالزمان دجالون الكذابون ياتوئكم من الاحاديث بما لم تسمعوا انتم ولا ابائكم اياكم واياهم لا يضلونكم ولا يفتنون كم.
অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, “শেষ যামানায় এমন অনেক মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বের হবে, যারা এমন সব হাদীছসমূহ বয়ান করবে (মতবাদ বা কথা ছড়াবে), যা তোমরা শোননি, তোমাদের বাপ-দাদা কেউ শোনেনি। তোমরা তাদের নিকট গমন করোনা এবং তাদেরকে তোমাদের নিকট স্থান দিওনা, তাহলে তারা তোমাদেরকে ভ্রান্ত করতে ও ফিৎনায় ফেলতে পারবে না।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)
উল্লেখ্য, প্রচলিত তাবলীগ শুরু হয়েছে, ১৩৪৫ হিজরীতে। অর্থাৎ প্রায় ৭১ বছর ধরে এই প্রচলিত তাবলীগ চলে আসছে। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, উনার পূর্বে যারা ছিলেন অর্থাৎ হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের থেকে শুরু করে তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমাম মুজতাহিদীন, হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম যাঁরাই এসেছেন ১৩৪৫ হিজরীর পূর্ব পর্যন্ত, তাহলে কি তাদের ঈমান ও এক্বীন সহীহ বা শুদ্ধ ছিলনা? এরূপ আক্বীদা পোষণ করা কুফরী। যে ব্যক্তি এই আক্বীদা পোষণ করবে, সে ব্যক্তিই ঈমান হারা হবে। কেননা উপরোক্ত কথাগুলো পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনার কোথাও নেই। যা সম্পূর্ণই ভিত্তীহীন, বানোয়াট ও মনগড়া।
আরো উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ঞ্জম্প॥ঞ্জব্জহৃণ্ডঞ্জল্ফ॥শুঞ্জরুহৃঞ্জব্জৈৈশুঞ্জèৈশুশ্চহৃঞ্জরুহৃঞ্জব্জৈৈশুঞ্জèৈশুশ্চহৃ
অর্থ : আমার যামানা সর্বোত্তম, অতঃপর পরবর্তী যামানা, অতঃপর তৎপরবর্তী যামানা।” (বুখারী শরীফ)         
অথচ উল্লেখিত তিন যামানায় বা খাইরুল কুরুনে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত ও তাদের প্রবর্তিত চিল্লার কোন অস্তিত্বই ছিলনা।
এমনকি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা, ইলিয়াস ছাহেবের পীর ছাহেব রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী ছাহেবও চিল্লা দেননি, তাহলে কি উনার ঈমান ও এক্বীন সহীহ ছিলনা?
অথচ ঈমান এক্বীন সহীহ ও পূর্ণ হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা নিসা শরীফ উনার ৬৫নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
فلا وربك لا يومنون حتى يحكموك فيما شجر بينهم ثم لا يجدوا فى انفسهم حرجا مما قضيت وسلموا تسليما.
অর্থ : আপনার রবের কছম! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নিবে। অতঃপর আপনার ফায়সালা সম্পর্কে তাদের মনে কোন সঙ্কীর্ণতা থাকবেনা এবং তারা সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণ করবে।
এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার শানে নুযুল সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ করা হয়- এক ব্যক্তি ছিল মুনাফিক, তার নাম ছিল বিশর। সে মুসলমান দাবী করতো, হাক্বীক্বতে সে মুনাফিক ছিল। এই মুনাফিক বিশরের সাথে এক ইহুদীর কোন বিষয় নিয়ে গ-গোল হয়। তখন মুনাফিক বিশরকে ইহুদী বললো, হে বিশর এটার বিচার করতে হবে। মুনাফিক বললো, কে বিচার করবেন? ইহুদী বললো- আল্লাহ পাক উনার রসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করবেন। মুনাফিক বিশর মনে মনে চিন্তা করলো, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যদি বিচার করেন, তবে রায় চলে যাবে ইহুদীর পক্ষে। কারণ তিনি হক্ব বিচার করবেন। তখন মুনাফিক বিশর বললো- না, তুমি এক কাজ কর, তোমাদের যে বিচারক, ইহুদী কাব ইবনে আশরাফ, সে বিচার করবে। কিন্তু ইহুদী ব্যক্তি জানতো যে, কাব ইবনে আশরাফ যদি বিচার করে, তাহলে সে মুনাফিকী করবে। অর্থাৎ ঘুষ খেয়ে বিচারে হেরফের করবে। তখন সেই ইহুদী বললো না, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করবেন। এই কথা বলে মুনাফিক বিশরকে বুঝিয়ে নিয়ে গেল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দরবার শরীফে। মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করলেন। রায় গেল মুনাফিক বিশরের বিরুদ্ধে, ইহুদীর পক্ষে।
যখন ইহুদী জিতে গেল, তখন মুনাফিক বিশর মনে করলো যে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনার খুব জালালী তবিয়ত। কারণ উনার প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
اشداء على الكفار.
অর্থাৎ হযরত উমর উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম কাফিরদের প্রতি কঠোর।” (পবিত্র সূরা ফাতহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৯)
তিনি হয়তো আমার পক্ষেই রায় দিবেন। তাই মুনাফিক বিশর পূণরায় বিচারের জন্য ইহুদীকে নিয়ে গেল, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনার দরবার শরীফ। কারণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হায়াত মুবারকে, উনার নির্দেশেই হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম বিচার করতেন।
ইহুদী খুব চালাক ছিল, সে প্রথমেই বললো, হে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম, এই বিশর আমাকে বিচারের জন্য আপনার নিকট নিয়ে এসেছে। অথচ মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিচার করে দিয়েছেন। যার রায় আমার পক্ষে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশর তা মানতে রাজী নয়। তাই আপনার নিকট বিচারের প্রার্থী হয়েছে।
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি বিচার করবো, তোমরা বস। তিনি ঘরে প্রবেশ করে একটি তরবারী এনে মুনাফিক বিশরকে এক কোপে দুভাগ করে দিলেন এবং বললেন, এটাই তোমার বিচার। কারণ, তুমি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে বিচার করেছেন, তা তুমি মাননি। তাই তোমার শাস্তি ও বিচার একমাত্র মৃত্যুদ-। যখন তিনি বিশরকে হত্যা করে ফেললেন, তখন মুনাফিক বিশরের আত্মীয়-স্বজন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দরবার শরীফে গিয়ে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ! হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনাকে আপনি বিচারের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আমাদের একজন আত্মীয়কে হত্যা করেছেন। মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন যে দেখ, এটা উনার পক্ষে কি করে সম্ভব? কারণ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তো খাছ লোক-
لوكان بعدى نبى لكان عمربن الخطاب رضى الله تعالى عنه.
আমার পরে যদি কেউ নবী হতো, তাহলে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম নবী হতেন।” (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ)
কাজেই উনার পক্ষে একাজ করা কখনো সম্ভব নয়। ঠিক আছে উনাকে ডাকা হোক। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনাকে ডেকে আনা হলো। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “হে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম! তুমি নাকি একজনকে হত্যা করেছ?” হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! মূলতঃ আমি তাকে হত্যা করার কারণ হচ্ছে- সে মুনাফিক। কেননা আপনি যে বিচার করেছেন, সে তা মানেনি, সেজন্য আমি তাকে হত্যা করেছি।
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “হে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম! সে যে মুনাফিক, তার প্রমাণ কি ও তার সাক্ষী কোথায়?” কারণ ইসলামে সাক্ষী ছাড়া কোন কথা গ্রহণযোগ্য নয়। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি চুপ করে রইলেন। সাথে সাথে মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং নিজে সাক্ষী হয়ে এই পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করেন,
فلاوربك لا يومنون حتى يحكموك فيما شجر بينهم ثم لا يجدوا فى انفسهم حرجا مما قضيت وسلموا سليما.   
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করে জানিয়ে দিলেন, “(ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ! ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমিই সাক্ষী) মহান আল্লাহ পাক উনার কছম, কোন ব্যক্তি মুমিনে কামিল হতে পারবে না ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যক্তি আপনাকে সীরতান-ছুরতান, জাহিরী-বাতিনী, (বাহ্যিক-আভ্যন্তরীন) প্রত্যেক বিষয়ে আপনাকে ক্বাজী বা ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নিবে। অর্থাৎ আপনার হুকুম-আহকাম না মেনে নিবে।
আর ঈমান পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
قال النبى صلى الله عليه وسلم- لا يؤمن احدكم حتى اكون احب الله من والده وولده والناس- اجمعين.
অর্থ : তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিনে কামিল হতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তোমাদের বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি, সকল মানুষ থেকে, অর্থাৎ সবকিছু থেকে আমাকে বেশী মুহব্বত না করবে।” (বোখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো রয়েছে,       
من احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : যে মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য মুহব্বত করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে ও নিষেধ করে, সে ঈমানে পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ঈমান ও এক্বীন সহীহ বা পূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত ও উনার রাসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহব্বত ও আনুগত্যতা শর্ত, অন্য কিছু নয়। কাজেই প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ না করলে ও চিল্লা না দিলে ঈমান ও এক্বীন সহীহ হবেনা, এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা, যা কুফরীর পর্যায়ে পড়ে। বরং অতীতের মুহাক্কিক-মুদাক্কিক, ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি বুযূর্গানে দ্বীনের মতে মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত ও উনার রাসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহব্বত ও আনুগত্যতা অর্জনের সর্বোত্তম ও অত্যাবশ্যকীয় উপায় হচ্ছে- তাছাউফ শিক্ষা করা। যার কারণে উনারা ফতওয়া দিয়েছেন, ইলমে তাছাউফ শিক্ষা করা ফরয। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে (ইনশাআল্লাহ)।

৪নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কেউ কেউ অনেক সময় বলে থাকে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা ছাড়া আর সকলেই গোউনারাহ। অর্থাৎ একমাত্র তারাই হিদায়েতের উপর রয়েছে। শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে উপরোক্ত বক্তব্যের জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : এই কথাটিও সম্পূর্ণই বানানো, মনগড়া, উদ্ভট ও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ পরিপন্থী হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের কোথাও উল্লেখ নেই যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ছাড়া সকলেই গুমরাহ।
কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আছে, “কাউকে যখন কাফির ফতওয়া দেয়া হয়, সে কথাটা আকাশে উঠে। তখন আকাশের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর তা জমিনে নামে, তখন জমিনের দরজাও বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর সে কথাটা যাকে বলা হয়েছে, তার উপর পড়তে চায়। যদি সে যোগ্য হয়, তবে তার উপরই পড়ে। আর যদি যোগ্য না হয়, তবে যে বলেছে, তার উপর পড়ে এবং সে মৃত্যুর সময় ঈমানহারা হয়ে মারা যায়। (আলমগীরী)
কাজেই যারা বলবে, প্রচলিত তাবলীগ ছাড়া আর সকলেই গুমরাহ, একথা বলার কারণে তারাই সেই গোউনারাহদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে, কারণ গোউনারাহ বলতে বুঝায় পথভ্রষ্ট। আর গুমরাহর বিপরীত হলো- হিদায়েত প্রাপ্ত। আর হিদায়েত প্রাপ্তগণের সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যায় মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
الذين يؤمنون بالغيب ويقيمون الصلوة ومما وزقناهم ينفقون والذين يؤمنوبما انزل اليك وما انزل من قبلك وبالاخرة هم يوقنون- اولئك على هدى من ربهم واولئك هم المفلحون.
অর্থ : যারা অদৃশ্যের উপর ঈমান আনে, নামায কায়িম করে এবং আমার তরফ থেকে তাদের প্রতি দানকৃত রিযিক থেকে দান করে, যারা ঈমান আনে আপনার প্রতি যা নাযিল করেছি ও আপনার পূর্বে যা নাযিল করেছি তার উপর এবং যারা পরকালের প্রতি এক্বীন রাখে। তারাই তাদের রবের হিদায়েতের উপর রয়েছে এবং তারাই কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও তার সমপর্যায়ের আরো অনেক পবিত্র আয়াত শরীফ রয়েছে, যাতে হিদায়েত প্রাপ্তদের আলামত বর্ণনা করা হয়েছে।
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ما انا عليه واصحابى.
অর্থ : আমি এবং আমার ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম যে পথে কায়িম আছি।” (সেটাই হক্ব মত, হক্ব পথ) (আহমদ, আবূ দাউদ, মেশকাত, উেনারকাত)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা মুতাবিক যারা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রাসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান এনেছেন, কিম্বা উনাদের মতে মত ও পথে পথ হয়েছে, তারাই হিদায়েত প্রাপ্ত।
আবারো উল্লেখ্য যে, ইলমে তাসাউফ ব্যতীত মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত এবং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হওয়া কখনই সম্ভব নয়, যা প্রদত্ত ফতওয়ায় সামনে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে।
অতএব, তাবলীগ জামায়াতের বক্তব্য- ছয় উছূলের বাইরে যারা রয়েছেন, তারা হক্বের মধ্যে নয় বা তারা গুমরাহ। তাদের একথা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের প্রকাশ্য বর্ণানার খিলাফ হওয়ার দরুণ এবং ফিক্বাহর প্রনিধানযোগ্য ফতওয়া ঈমানদার উনাদেরকে কাফিরের গণ্ডিভূত করা কুফরীউনার ভিত্তিতে প্রকাশ্য কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।

৫নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : মুহম্মদ মুযাম্মিলুল হক লিখিত- তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে ১৩ দফানামক কিতাবের ১৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে যে, “প্রচলিত তাবলীগ হচ্ছে নবীওয়ালা কাজ।
এ ব্যাপারে আমার প্রশ্ন হলো, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বাইরে যারা দ্বীনের কাজ করছেন, তাদেরগুলো কি নবীওয়ালা কাজ নয়? কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীল সাপেক্ষে ইহার ফায়সালা কামনা করি
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগকে তারা যেজন্য নবীওয়ালা কাজ বলতে চায়, সেটা হলো- তারা মনে করে যে, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা যেভাবে দ্বীন ইসলাম উনার দাওয়াত দিয়েছেন, তারাও বুঝি সেভাবেই দ্বীন ইসলাম উনার দাওয়াত দেয়। কিন্তু হাক্বীক্বতে এ দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক (প্রার্থক্য)। কারণ নবী আলাইহিস সালামগণ সকলেই মারিফাতে পূর্ণ হয়ে দ্বীন ইসলাম উনার দাওয়াত দিয়েছেন এবং তা দেয়া হয়েছে কাফিরদেকে। সে কারণে বলা হয় যে, সকল হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের তাসাউফ এক, কিন্তু শরীয়ত আলাদা। কিন্তু প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রায় সবাই একেবারেই তাসাউফ শুন্য হয়ে তাদের ছয় উছূল ভিত্তিক দাওয়াত দেয়। যে দাওয়াতটা কিনা মুসলমানদেরই মুখ্যতঃ দেয়া হয়।
কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত যা করে, তা মুসলমানকে সাধারণ তালীম-তালক্বীন দেয়া ব্যতীত কিছুই নয়।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে আরো কথা এসে যায়, সেটা হচ্ছে এই যে, মাদ্রাসা-মক্তবে কিতাবী দর্স ও তালীম দেয়া, মসজিদে, জনসমাবেশে ওয়াজ-নছীহত করা, দ্বীনী ইলমের জন্য কিতাব প্রনয়ণ করা, সর্বোপরি, পীরানে তরীক্বত, হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের খানকা শরীফে ও দরগায় এই ইলমে তাসাউফ ও ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়া কি তাহলে নবীওয়ালা কাজ নয়? তবে কি ইহা শয়তানওয়ালা কাজ? (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক)
যদি কোন ব্যক্তি উপরোক্ত আক্বীদা পোষণ করে, তাহলে সে ঈমান হারা হয়ে কুফরীতে নিপতিত হবে।
উল্লেখ্য যে, যদিও প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা সুরতান নবীওয়ালা কাজ করে বলে দাবী করে, কিন্তু হাক্বীক্বতান তারা নবীওয়ালা কাজ করেনা। কারণ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
وان العلماء ورثة الانبياء وان الانبياء لم يورثوا دينارا ولا درهما وانما ورئراالعلم فمن اخذه اخذ بحظ وافر.
অর্থ : নিশ্চয়ই আলিমগণ নবী আলাইহিস সালামগণের ওয়ারিছ এবং নিশ্চয়ই নবী আলাইহিস সালামগণ কোন দিনার-দিরহাম রেখে যাননি বরং উনারা ইলমে দ্বীন রেখে গিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করলো, সে পূর্ণ অংশ (বিরাট সফলতা) লাভ করলো। (আহমদ, তিরমীযী)
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো বলেন,
العلم علمان علم فى القلب فذاك علم النافع وعلم على اللسان فذالك حجة الله عزوجل على ابن ادم.
অর্থ : ইলম দুপ্রকার, একটি হচ্ছে- ক্বালবী ইলম (ইলমে তাসাউফ) -যা উপকারী ইলম। অপরটি হচ্ছে- জবানী ইলম (ইলমে ফিক্বাহ) -যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার প্রতি  দলীল স্বরূপ।” (দারেমী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লোমায়াত, লোময়াত)
মিশকাত শরীফ উনার শারেহ, হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার মিরকাত শরীফে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, মালিকী মাযহাবের ইমাম, হযরত ইমাম মালিক রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,     
من تفقه ولم يتصوف فقد تفسق ومن تصوف ولم يتفقه فقد تزندق ومن جمع بيتهما فقد تحقق.
অর্থ : যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ব্যক্তি ফাসিকের অন্তর্ভূক্ত। আর যে ব্যক্তি তাসাউফ করে অর্থাৎ মারিফাত চর্চা করে অথচ ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করেনা অর্থাৎ শরীয়ত মানেনা বা অস্বীকার করে, সে কাফিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে উভয়টাই শিক্ষা করলো, সেই মুহাক্কিক অর্থাৎ সে ব্যক্তিই নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ বা হাক্বীক্বী আলিম।
উল্লেখ্য যে, যিনি ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ হাছিল করেছেন, তিনিই হচ্ছেন- নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ বা নায়েবে নবী। যাঁরা নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ বা নায়িবে নবী, উনাদের পক্ষেই একমাত্র নবীওয়ালা কাজ পুর্ণভাবে করা সম্ভব। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উছূলের মধ্যে তাসাউফের কোন শিক্ষাই নেই। শুধু ইলমে ফিক্বাহর শিক্ষা যতসামান্যই রয়েছে, তাহলে কি করে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের পক্ষে হাক্বীক্বতান নবীওয়ালা কাজ করে বলে দাবী করা সম্ভব?
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, তাদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর, যার থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্যেই দায়িত্ব ও কর্তব্য।

৬নং সুওয়াল ও তার জাওয়া
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালারা বলে থাকে যে, পীর ছাহেবগণের যেখানে শেষ, তাবলীগ ওয়ালাদের সেখানে শুরু। অতএব পীর সাহেবদের ইছলাহর জন্য দশ চিল্লার দরকার।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়তসম্মত বা সত্য, বিস্তারিতভাবে জানার বাসনা রাখি।
জাওয়াব :  একথা সম্পূর্ণ শরীয়ত উনার খিলাফ, যা বলা নিহায়েত অজ্ঞতা, ধৃষ্ঠতাপূর্ণ, বেয়াদবীমূলক, অমার্জনীয় অপরাধ ও কুফরীর শামিল।
যদি কোন ব্যক্তি উপরোক্ত আক্বীদা পোষণ করে, তাহলে সে ঈমান হারা হয়ে কুফরীতে নিপতিত হবে।
কারণ যাঁরা হক্কানী-রব্বানী পীর ছাহেব, উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ ওলীর অন্তর্ভূক্ত। আর ইছলাহ প্রাপ্ত তারা তাদের শায়খ বা পীর ছাহেব-উনার ছোহবত ইখতিয়ার করে অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাছাউফ উভয়টিতেই পারদর্শীতা লাভ করে বা পূর্ণ ইছলাহ প্রাপ্ত হয়ে স্বীয় পীর ছাহেব উনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছ থেকে খিলাফত প্রাপ্ত হন। অতঃপর তারা তাদের শায়খ বা পীর সাহেবের নির্দেশে আম মানুষকে ইছলাহ করার কাজে তথা দ্বীন প্রচারের কাজে নিয়োজিত হন। অতএব তাদের ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য চিল্লার কোনই জরুরত নেই।
মূলতঃ চিল্লার দ্বারা কোন মানুষের পক্ষেই ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়া সম্ভব নয়। যাঁরা খাছ, উনাদের তো প্রশ্নই উঠে না। আর যারা আম বা সাধারণ লোক, তারাও চিল্লার মাধ্যমে ইছলাহ প্রাপ্ত হবে, এ কথাটিও সম্পূর্ণই অবান্তর।
সুতরাং যারা বলে যে, পীর সাহেবদের ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য দশ চিল্লার দরকার, সেটা পীর সাহেবগণ বা পীরানে তরীক্বত তথা হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের শানে নিহায়েত অবমাননাকর উক্তি। যার দ্বারা উনাদের প্রতি ইহানত করা হয়, যা কুফরীর শামিল।
কেননা উনাদের শানে, উনাদের মর্যাদা সম্পর্কে অনেক পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ রয়েছে। যা থেকে বোঝা যায়, উনারা সর্বোচ্চ স্তরের মর্যাদা ও মর্তবার অধিকারী। যার তুলনায় প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকগণ তিফলে মক্তব বা মক্তবের শিশু ব্যতীত নয়। যেমন হক্কানী আলিম বা আল্লাহ ওয়ালা উনাদের মর্যাদা-মর্তবা সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
(ক)
الاان اولياء الله لا خوف عليهم ولا هم يحزنون.
অর্থ : সাবধান! যাঁরা মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী বা বন্ধু, উনাদের কোন ভয় ও চিন্তা নেই।” (পবিত্র সূরা ইউনুস শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৬২)
(খ)
من عاد لو ليا فقد اذنته بالحرب
অর্থ : যে আমার ওলীর সাথে বেয়াদবী করে, আমি তার বিরুদ্ধে জ্বিহাদ ঘোষণা করি।” (পবিত্র হাদীসে কুদসী শরীফ, বোখারী শরীফ)
(গ)
ان اوليائى تحت قبائى لا يعرفو نهم الا غيرى.
অর্থ : ওলীআল্লাহ উনারা আমার কুদরতের নীচে অবস্থিত, আমি ছাড়া উনাদের কেউ চিনেনা।” (পবিত্র হাদীসে কুদসী শরীফ)
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, পৃথিবীর প্রায় সকল মুহাক্কিক-মুদাক্কিক, মুজতাহিদ ঈমামগণই পীর ছাহেব ছিলেন বা পীর ছাহেবের কাছে বাইয়াত ছিলেন এবং উনারা তাসাউফকেই চুড়ান্ত স্তর বা শেষ স্তর বলে নির্ধারণ করেছেন। যেমন- ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি,  যাঁর শানে শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম, হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেছেন যে,
الفقهاء كل عيال ابى حنيفة (رح) فى الفقه.
অর্থ : সকল ফক্বীহগণ, ইলমের দিক দিয়ে (ফিক্বাহ শাস্ত্রে) ইমাম আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সন্তান তুল্য।” (লাউস সুনান)
সেই ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি পর্যায়ক্রমে ইমাম বাকির আলাইহিস সালাম ও ইমাম জাফর সাদিক আলাইহিস সালাম উনার কাছে বাইয়াত হন। আর বাইয়াত হয়ে ইমাম জাফর সাদিক আলাইহিস সালাম উনার দরবার শরীফে দুবছর থেকে ইলমে তাছাউফের তাকমীলে পৌঁছেন।
এ প্রসঙ্গে ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
لولا سنتان لهلك ابو نعمان.
অর্থ : যদি দুবছর না পেতাম, তবে আমি ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি (ইলমে তাছাউফ অর্জন না করার কারণে) ধ্বংস হয়ে যেতাম।” (যদিও তিনি ইলমে ফিক্বাহে পূর্ণ পারদর্শী ছিলেন।) (সাইফুল মুকাল্লেদীন, ইছনা আশারিয়াহ, দুররুল মোখতার, সীরাতে ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ইত্যাদি)
উল্লেখ্য যে, ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি, এতবড় ইমাম হওয়া সত্ত্বেও ইলমে তাছাউফ ব্যতীত খালিছ মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী হতে পারতেন না বলে নিজেই স্বীকার করেছেন।
অতএব ইমামে আযম হওয়া সত্ত্বেও যদি উনার পক্ষে ইলমে তাসাউফ ব্যতীত ধ্বংস হওয়া থেকে বেঁঁচে থাকা সম্ভব না হয়, তবে সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে কি করে ইলমে তাসাউফ ব্যতিরেকে ধ্বংস হতে বেঁঁচে থাকা সম্ভব?
আরো উল্লেখ্য যে, হযরত মাওলানা রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বিশ্ব বিখ্যাত আলেম হওয়া সত্ত্বেও পীর সাহেবগণের ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন, “আমি মাওলানা রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি অসংখ্য কিতাবাদি পাঠ করে বিশ্ববিখ্যাত আলিম হওয়া সত্ত্বেও, আমি আমার পীর সাহেব হযরত শামস তাবরীজী রহমতুল্লাহি আলাইহি-উনার কাছে বাইয়াত হওয়া তথা ইলমে তাসাউফ অর্জন করা ব্যতীত তাকমীলে পৌঁছতে পারিনি বা আল্লাহ ওয়ালা হতে পারিনি।” (মসনবী শরীফ)
সুতরাং পীর সাহেবগণের ফযীলত উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সহজেই অনুধাবন করা যায়। আরো অনুধাবনীয় যে, সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম হওয়া সত্ত্বেও ধ্বংস থেকে বেঁচে থাকা বা তাকমীলে পৌঁছা  বা মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী হওয়া আদৌ সম্ভব নয়, পীর সাহেবের কাছে বাইয়াত হওয়া ব্যতীত অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ অর্জন করা ব্যতীত।
তাহলে প্রচলিত তাবলীগকারীগণ, এক কথায় ইলমে ফিক্বাহ, ইলমে তাসাউফ শুন্য হওয়া সত্ত্বেও অর্থাৎ যতসামান্য শিক্ষা অর্জন করে এ কথা কি করে বলতে পারে যে, পীর সাহেবগণের যেখানে শেষ, তাবলীগ ওয়ালাদের সেখানে শুরু!
হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার আল-মুনকেযু মিনাদ্দালাল কিতাবে বলেছেন, “সবই অপূর্ণ, একমাত্র পীরানে তরীক্বত তথা আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারাই পূর্ণ।
কুতুবুল আলম, কুতুবুল আক্বতাব, হযরত খাজা বখতিয়ার কাকী আউসী, ছুম্মা দেহলভী, কুদ্দিসা সেররুহুল বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর অনুরূপ বুযুর্গ মহান আল্লাহ পাক উনার যমিনে খুব কমই পয়দা হয়েছেন। যাঁর উছিলায় উনার যামানায় সারা বিশ্বের অসংখ্য জ্বীন-ইনসান মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত-মারিফতের সুধা লাভ করেছেন এবং পৃথিবীর ইতিহাসে যে দুজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়, যাঁরা মায়ের পেট থেকে ত্রিশ পারা পবিত্র কুরআনে হাফিয অবস্থায় যমিনে তাশরীফ এনেছেন, উনাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি স্বীয় প্রনীত দলীলুল আরেফীনকিতাবের নবম মজলিসে সূফী সাহেবদের যে কত বড় ফযীলত রয়েছে, সে সম্পর্কে শায়খ মুহম্মদ আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার একটি ঘটনা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন যে, আমার শায়েখ সুলতানুল হিন্দ, খাজা গরীবে নেয়াজ, হাবীবুল্লাহ, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী, সানজিরী, সুম্মা আজমিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যাঁর উছিলায় আল্লাহ পাক এক কোটিরও বেশী লোককে ঈমান দিয়েছেন। এবং আরো উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর ইতিহাসে যে দুজন বিশিষ্ট ওলীআল্লাহ বিছাল শরীফ গ্রহণ করার পর উনাদের কপাল মুবারকে সোনালী অক্ষরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, “হাজা হাবীবুল্লাহ, মাতা ফী হুব্বিল্লাহ।অর্থাৎ ইনি আল্লাহ পাক উনার হাবীব, যিনি আল্লাহ পাক উনার মুহব্বতে বিছালা শরীফ গ্রহণ করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, একবার আমার শায়খ হযরত খাজায়ে খাজেগাঁ হযরত ওসমান হারুনী রহমতুল্লাহি আলাইহি, খাজা আওহাদুদ্দীন কিরমানী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আমি যিয়ারত ও সফরে বের হয়ে সফর করতে করতে পর্যায়ক্রমে মদীনা শরীফ ও তার আশ-পাশ এলাকা যিয়ারত করে দামেশকে গিয়ে পৌঁছি। সেখানে বার হাজার হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের রওযা শরীফ যিয়ারতের জন্য কয়েকদিন অবস্থান করি।
একদিন দামেশকের এক মসজিদ যেখানে হযরত খাজা আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি নামে একজন বিশিষ্ট কামিল বুযুর্গ ব্যক্তি অবস্থান করতেন, সেখানে উনার মজলিশে হাজির হলাম এমতাবস্থায় যে, তিনি নছীহত করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন যে, ক্বিয়ামতের দিন সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বতগণ হতে বুযুর্গগণও পর্যন্ত অর্থাৎ আলিম, দরবেশ ও বুযুর্গগণ সকলেই ফায়দা হাছিল করবেন। এককথায় হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ব্যতীত অন্য সকলেই সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বতগণ থেকে ফায়দা হাছিল করবেন।
একথা বলার পর হযরত খাজা আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সাথে এক ব্যক্তি বিতর্কে লিপ্ত হলো। সে বললো, আপনার বক্তব্যের পিছনে কোন দলীল আছে কি? অর্থাৎ এটা কোন কিতাবে আছে? উত্তরে খাজা আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, কিতাবের নামটা স্মরণ করতে পারছিনা। লোকটি বললো, কিতাবে লিখা না দেখানো পর্যন্ত বিশ্বাস করবোনা। খাজা আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি যিনি মুস্তাজাবু দ্দাওয়াত (যার দোয়া কবুল করা হয়) ছিলেন। তিনি স্বীয় মস্তক আকাশের দিকে উত্তোলন করে বললেন, কিতাবের নাম আমার মনে নেই, ‘ইয়া বারে ইলাহি, ভুলে যাওয়া কিতাবটি দেখিয়ে দিন।তৎক্ষণাৎ হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতি মহান আল্লাহ পাক তিনি হুকুম দিলেন, যে কিতাবে ঐ কথা লিখা আছে, সেটা নিয়ে দেখাও। হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা ঐ কিতাব খুলে যেখানে ঐ কথা লিখা ছিল বের করে ঐ লোককে দেখিয়ে দিলেন, যে লোকটি খাজা আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিল। তখন সে ব্যক্তি লজ্জিত হয়ে খাজা আরিফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কদম মুবারকে পড়ে গেল এবং উনার নিকট মুরীদ হলো।
উপরোক্ত ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ পাক উনার যমিনের উপর যাঁরা সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বত, উনাদের কি বর্ণনাতীত ফযীলত রয়েছে। আবার কেবল যমিনের উপরই নয় বরং কবরে, হাশরে এবং ক্বিয়ামতের ময়দানেও সূফীয়ানে কিরামগণের ফযীলত বহাল থাকবে।
এ প্রসঙ্গে সুলতানুল হিন্দ, খাজা গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি নিজে বর্ণনা করেন, “আমার এক প্রতিবেশী পীর ভাই, তরীক্বার আইন-কানুন মেনে চলতো না, হঠাৎ মারা গেল। নিয়ম অনুযায়ী তাকে কাফন-দাফন করে প্রত্যেকে যে যার কাজে চলে গেল। কিন্তু কৌতুহল বশতঃ আমি কবরের পাশেই দুনিয়া হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইলাম। এমন সময় দুজন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সলাম উনারা এসে কবরে অবতরণ করলো, দেখেই বুঝতে পারলাম উনারা আযাবের হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম। কবরে নেমেই উনারা আমার পীর ভাইকে শাস্তি প্রদানে উদ্যত হলো। এমন সময় আমার পীর ও মুর্শিদ খাঁজা উসমান হারুনী কুদ্দেসু সিররুহুল আজীজ হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন, “এ লোককে শাস্তি প্রদান করতে পারবে না, কারণ এ আমার মুরীদ।হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার বন্ধুর সম্মানার্থে চলে গেলেন, কিন্তু একটু পরেই ফিরে এসে বললো, “হুযূর এ লোক আপনার মুরীদ, একথা সত্য কিন্তু সে আপনার তরীক্বার কাজ হতে বিরত ছিলো।হযরত উসমান হারুনী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, “তার কাজ যাই হোক, সে তার জাতকে (অস্তিত্ব) আমার নিকট সমর্পণ করায় তার কাজ আমার কাজের সংগে সংযুক্ত হয়ে গেছে। অতএব, তার রক্ষণাবেক্ষণ আমার কর্তব্য।হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে উনার বক্তব্য পেশ করার সাথে সাথেই হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালা উনার হুকুম হলো, “আপনারা চলে আসুন, তাকে শাস্তি দিবেননা। আমি আমার বন্ধুর সম্মানে তাকে ক্ষমা করে দিলাম।” (আনিসুল আরওয়াহ)
ক্বিয়ামতের দিন সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বতগণকে মহান আল্লাহ পাক যে বর্ণনাতীত ফযীলত দান করবেন, সে প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, কুতুবুল আলম, কুতুবুল আক্বতাব, হযরত বখতিয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দলীলুল আরেফীনকিতাবে তদীয় পীর সাহেব, সুলতানুল হিন্দ, খাজা গরীবে নেওয়াজ, হাবীবুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে বর্ণনা করেন। আর ইসরারুল আওলিয়া নামক কিতাবে বর্ণনা করা হয়েছে, শাইখুল ইসলাম, ইমামুল আইম্মা, হযরত ফরীদ উদ্দীন মসউদ গঞ্জে শকর রহমতুল্লাহি আলাইহি তদীয় শায়খ, কুতুবুল আলম, কুতুবুল আফতাব, হযরত বখতিয়ার কাকী রহমতুল্লাহি আলাইহি থেকে উল্লেখ করেন, “ক্বিয়ামতের দিন সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বতগণকে কবর থেকে উঠানো হবে। এরপর আল্লাহ পাক সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বতগণকে আহবান করবেন। তখন উনাদের প্রত্যেকেই কম্বল কাঁধে নিয়ে উপস্থিত হবেন এবং প্রত্যেক কম্বলে কম-বেশী একলাখ সুতা বা তার লাগানো থাকবে। প্রত্যেক সুতা বা তারে কম-বেশী একলাখ গিঁট থাকবে। তখন উনাদের মুরীদগণ, পুত্র-কন্যা, শিশু-বাচ্চা সমস্ত বংশধর সেই সুতা বা তার ধরে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না হাশরের কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি না পাবে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালা উনাদের পুলছিরাতে পৌঁছাবেন। অতঃপর সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বতগণের সুতা বা তার ধরে থাকার বরকতে শায়েখের সাথে পুলছিরাতের ত্রিশ হাজার বছরের পথ চোখের পলকে পার হয়ে বেহেশতে পৌঁছে তাতে বিনা দ্বিধায় প্রবেশ করবে। কোথাও কোন বাঁধার সম্মুখীন হবেনা।” (সুবহানাল্লাহ)
আরো উল্লেখ্য যে, সূফীয়ানে কিরাম বা পীরানে তরীক্বতগণের মুরীদ-মুতাক্বিদ, মুহিব্বীনগণ সকলেই পুলছিরাত পার হয়ে বেহেশতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত তাদের শায়খ বা পীর সাহেব পর্যায়ক্রমে হাশরের ময়দানে এসে উচ্চস্বরে বলতে থাকবেন, “আমার মুহেব্বীনগণ কোথায়? তোমরা আমার কম্বলের তার বা সুতা ধরে বেহেশতে মহান আল্লাহ পাক উনার রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট চলে যাও।” (সুবহানাল্লাহ)
কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত ধৃষ্টতাপূর্ণ, কুফরী মূলক কথা, যা সকল সূফীয়ানে কিরাম, ইমাম-মুজতাহিদ, হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং উলামায়ে মুহাক্কিক ও মুদাক্কিকগণের কথার সম্পূর্ণ খিলাফ, তথা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার খিলাফ, যা থেকে পরহেজ করা বা বিরত থাকা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের ও অন্য সকলের জন্যই ওয়াজিব ও ফরজের অন্তর্ভূক্ত।
আবার পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে কেবল যৎসামান্য ইসলামী শিক্ষা দেয়া হয়। অথচ যাঁরা পীরানে তরীক্বত, উনারা ইসলামের প্রায় পূর্ণ শিক্ষাই গ্রহণ করে তাকমীল বা পুর্ণতায় পৌঁছে থাকেন।

৭নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ ছাহেবের মালফূযাতের ৫৩নং পৃষ্ঠার ৮০নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, প্রচলিত তাবলীগের বা অতরীক্বত পন্থীদের, তাসাউফের বা সূফীদের বই পড়া উচিৎ নয়।
উল্লেখিত কিতাবের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য? কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতে তার সমাধান কামনা করি।
জাওয়াব : উপরোক্ত বক্তব্যের জবাবে বলতে হয় যে, তাসাউফের বা ছুফীদের কিতাবে তাসাউফ সম্পর্কে যে সুক্ষ্ম বর্ণনা রয়েছে, তা প্রচলিত তাবলীগওয়ালা বা অতরীক্বত পন্থীদের পক্ষে বোঝা সত্যিই খুব দুরূহ ব্যাপার। সেজন্য তাদেরকে ইলমে তাসাউফ থেকে ফিরিয়ে রাখা কখনই জায়েয হবেনা। কারণ প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জরুরত আন্দাজ ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করা ফরয।
কাজেই অতরীক্বত পন্থীদের তাসাউফ বা সূফীদের বই পড়া উচিৎ নয়একথা বলার অর্থ হলো- পূর্ণ ইসলামী শিক্ষা থেকে মাহরুম করা ও অন্তর পরিশুদ্ধ করে ইখলাছ অর্জনে বাধা সৃষ্টি করা, যা সম্পূর্ণই শরীয়ত বিরোধী কাজ। কারণ কোন লোক যখন ইলমে তাসাউফ অর্জন বা ক্বালবী যিকির থেকে বিরত থাকে, তখন শয়তান তার সঙ্গী হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ومن يعش عن ذكر الوحمن نقيض له شيطانا فهوله قرين.
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার যিকির থেকে বিরত থাকে, তার জন্যে একটি শয়তান নির্দিষ্ট হয়ে যায়, সে তাকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে গোউনারাহ করে দেয়।” (পবিত্র সূরা যুখরূফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩৬)
(তাফসীরে জালালাইন, আবি সউদ, মাদারেক, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, মাযহারী )
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে,
الشيطان جائم على قلب بنى ادم فاذا ذكر الله خنش واذا غغل وسوس.
অর্থ : শয়তান মানুষের অন্তরে বসে, যখন সে যিকির করে, তখন পালিয়ে যায়। আর যখন যিকির থেকে গাফেল থাকে, তখন ওয়াসওয়াসা দেয়।” (বোখারী)
কাজেই প্রমাণিত হলো যে, ইলমে তাসউফ চর্চা থেকে বিরত রাখার অর্থ হলো- লোকদেরকে শয়তানের সঙ্গী করে দেয়া বা গুমরাহীতে নিপতিত করা।
আরো উল্লেখ্য যে, সূফীদের বই পড়া বা ইলমে তাসাউফ থেকে বিরত রাখার মানে হচ্ছে, দ্বীন ইসলামের অর্ধ শিক্ষা ও অর্ধ আমল থেকে বিরত রাখা। অথচ মহান আল্লাহ পাক পরিপূর্ণভাবে দ্বীন ইসলাম উনার মধ্যে দাখিল হতে বলেছেন। ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
يا ايها الذين امنوا ادخلوا فى السلم كافة.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে দ্বীন ইসলামে দাখিল হও।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২০৮)
অন্যত্র মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন
اليوم الكملت لكم دينكم.
অর্থ : আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” (পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩)
তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য মহান আল্লাহ পাক উনার বিধানের বিপরীত, যা দ্বীনের মধ্যে তাহরীফের শামিল ও কুফুরীর অন্তর্ভূক্ত।
মূলতঃ তারা চায়, একথা বলে ইলমে তাসাউফকে নিশ্চিহ্ন করতে বা ইলমে তাসাউফের শিক্ষা থেকে সাধারণ লোকদেরকে দূরে রেখে নিজেদের দল ভারী করতে। মূলতঃ এটা কস্মিন কালেও সম্ভব নয। কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
يريدون ليطفؤا نورالله يافوائهم والله متم نووه ولو كره الكافرون.
অর্থ : তারা চায়, মহান আল্লাহ পাক উনার নূরকে ফূ দিয়ে নিভিয়ে দিতে। মহান আল্লাহ পাক উনার নূরকে পরিপূর্ণ করবেন, যদিও কাফিররা তা পছন্দ করেনা।” (পবিত্র সূরা ছফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নূরের ব্যাখ্যায় মুহাক্কিক, মুদাক্কিক ও অনুসরণীয় মুফাসসিরীন-ই-কিরামগণ বলেন, “নূর হচ্ছে- দ্বীন ইসলাম। আর ইসলাম হচ্ছে- ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফের সমন্বয়। (তাফসীরে মাযহারী, ইবণে কাছীর, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, কবীর, ফতহুল ক্বাদীর, তাবারী, আবী সউদ ইত্যাদি)
অতএব, ইলমে তাসাউফ থেকে ফিরিয়ে রাখা অর্ধ দ্বীন থেকে ফিরিয়ে রাখার নামান্তর, যা কুফরীর শামিল।
সুতরাং ইলমে তাসাউফ, যা দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করার মূল ও একমাত্র মাধ্যম, তা কারো পক্ষেই নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয় বরং তা ক্বিয়ামত পর্যন্তই বহাল থাকবে।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই শরীয়ত বিরোধী। কাজেই একথা বলা তাদের উচিৎ হয়নি। বরং তাদের উচিৎ হবে একথা বলা যে, যারা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক বা অতরীক্বতপন্থী, তারা যেন কোন হক্কানী পীরানে তরীক্বত, আওলিয়া-ই-কিরাউেনার কাছে বাইয়াত হয়ে তাসাউফ শিক্ষা ও কিতাবাদি পাঠের মাধ্যমে ফরজ পরিমাণ ইলম অর্জন করে। (দুররুল মুখতার, শামী, তাফসীরে মাজহারী, তাফসীরে কবীর, তাফসীরে রুহুল মায়ানী, মকতুবাত শরীফ, এহইয়াউলুমুদ্দীন, কিমিয়ায়ে সায়াদাত, ফতহুর রব্বানী, আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ ইত্যাদি) (অসমাপ্ত)

0 Comments: