প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ
২১নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : “তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব” নামক কিতাবের (লেখক- মাওঃ ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী) ১০৯ পৃষ্ঠায় ও “তাবলীগে দাওয়াত কি এবং কেন?” নামক কিতাবের (লেখক- ওবায়দুল হক) ৭৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে জ্বিহাদ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান বা ছয় উছূলী তাবলীগই হচ্ছে- জিহাদুল আকবর। অনুরূপ তাবলীগ জামায়াতের সমালোচনা ও তার জবাব নামক কিতাবের যার মূল হযরত জাকারিয়া কর্তৃক লিখিত ৮৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়তসম্মত? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ অশুদ্ধ, কারণ তাবলীগের শাব্দিক অর্থ- পৌঁছানো, প্রচার করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় তাবলীগের অর্থ হলো- আল্লাহ পাক-এর হুকুম-আহকামকে পৌঁছিয়ে দেয়া বা তার প্রচার করা। অর্থাৎ ইসলামী পরিভাষায় সামগ্রিকভাবে মহান আল্লাহর দ্বীন ও দ্বীনের বিধি-বিধান বা শিক্ষা-দ্বীক্ষাকে আল্লাহর বান্দাগণের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার নাম হলো- তাবলীগ, যার পরিধি ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ হতে অনেক ব্যাপক।
আর জ্বিহাদের শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ হলো- কোশেশ করা, চেষ্টা করা ইত্যাদি। আর শরীয়তের পরিভাষায় জ্বিহাদের অর্থ হলো- মহান আল্লাহ পাক উনার কালিমাকে বুলন্দ করা ও দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য যে যুদ্ধ করা।
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার দ্বীনকে পূর্ণমাত্রায় বিজয়ী করার জন্য তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের নাম হলো জ্বিহাদ।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, জ্বিহাদ দু’প্রকার- (১) জ্বিহাদুল আছগর, (২) জ্বিহাদুল আকবর।
“জ্বিহাদুল আছগরের” দুটি অর্থ। শাব্দিক অর্থ হলো- ছোট জ্বিহাদ। আর শরীয়তের পরিভাষায় (তাসাউফের পরিভাষায়) “জ্বিহাদুল আছগর” হচ্ছে- তরবারীর জ্বিহাদ। যেটা কাফেরের বিরূদ্ধে করা হয়। (যা দীন ইসলামের বিজয়ের জন্য করা হয়)
আর “জ্বিহাদুল আকবরের” অর্থ হচ্ছে- বড় জ্বিহাদ। শরীয়তের পরিভাষায় (তাসাউফের পরিভাষায়) “জ্বিহাদুল আকবরের” অর্থ হলো- নফসের সাথে বা নফসের বিরূদ্ধে জ্বিহাদ করা। (আল কামুস আল মুহীত্ব, লিসানুল আরব, তাজুল উরুস, আসাসুল বালাগা, আল মুনযিদ, মিসবাহুল লুগাত, ফিরুজুল লুগাত, লুগাতে হীরা, গিয়াসুল লুগাত)
অর্থাৎ নফসকে ইছলাহ করার জন্য কোশেশ করা। আর নফসকে ইছলাহ করার জন্য যে ইলম রয়েছে, সে ইলমকে বলে ইলমে তাসাউফ। যা তাযকিয়ায়ে নফস বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার একমাত্র মাধ্যম।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাবূকের যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তন করার সময় বললেন যে,
رجعنا من الجهاد الاصغر الى جهاد الاكبر.
অর্থাৎ “আমরা ছোট জ্বিহাদ থেকে বড় জ্বিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম।” (সমূহ সীরাত গ্রন্থ)
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, জ্বিহাদ (জ্বিহাদুল আছগর), “জ্বিহাদুল আকবর” ও তাবলীগ এ তিনটির প্রত্যেকটিরই বিষয় ভিন্ন। বিষয়গত দিক থেকে একটির সাথে অপরটির কোন মিল নেই।
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যে বলে থাকে, তাদের মধ্যে জ্বিহাদ পুর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান, এ কথা সম্পূর্ণই অশুদ্ধ। কারণ “জ্বিহাদুল আছগর” অর্থাৎ তরবারীর জ্বিহাদ আর “জ্বিহাদুল আকবর” যা নফসের জ্বিহাদ, অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ উভয়টার কোনটাই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অর্ন্তভুক্ত নয়। বরং “জ্বিহাদুল আকবর” আহলে তাসাউফগণের মধ্যেই পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান রয়েছে। আর জ্বিহাদ অর্থ যদি শুধু কোশেশ করা হয়, তাহলে তো সকল কাজেই জ্বিহাদ বা কোশেশ রয়েছে।
২২নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা গাশতের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলে থাকে যে, গাশত ক্বাজা করা, নামায ক্বাজা করার চেয়েও কঠিন গুণাহের কারণ।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়তসম্মত ও গ্রহণযোগ্য জানতে বাসনা রাখি।
জাওয়াব : এরূপ আক্বীদা পোষণ করাও কুফরী, কারণ শরীয়তে এর কোন দলীল নেই। এ কথা দ্বারা দলীয় রীতি-নীতি কায়েম রাখা ও দল ভারী করার মানসিকতাই ফুটে উঠে। অথচ হক্ব পথে না থেকে ধর্মোম্মদনা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে বিদায় হজ্বের পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে এসেছে, “সাবধান! ধর্মোম্মদনা অতীতের বহু জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। (ইবনে মাজা শরীফ, নাসায়ী শরীফ)
উল্লেখ্য, নামায ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। কুরআন শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
(১) “তৎপরে তাদের পশ্চাতে একদল লোক আগমন করলো, যারা নামাজ নষ্ট করলো এবং রিপুর বশবর্তী হলো, অচিরে তারা গাই কুপের সাক্ষাত পাবে।” অর্থাৎ গোমরাহ হবে এবং আযাবে গ্রেফতার হবে। (সূরা মরিয়ম/৫৯)
(২) “যে ঈমানদারেরা নিজেদের নামাযে মনোনিবেশকারী, তারাই সফলতার অধিকারী হয়েছে।” (পবিত্র সূরা মু’মিনুন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১-২)
(৩)
اقم الصلوة لذكرى.
“এবং তুমি আমার স্মরণ করার জন্য নামায সম্পাদন কর।” (পবিত্র সূরা ত্বোহা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৪)
(৪) “তোমরা নামাযসমূহ এবং মধ্যম নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ কর, নিস্তব্ধভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা উনার জন্য দয়মান থাক।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৩৮)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
من حافظ عليها كائت له نوراوبرهانا ونجاة يوم القيامة ومن لم يحافظ عليها لم تكن له نوراولابر ها ناولانجاة يوم القيامة وكان يوم القيامة مع فارون وفرعون وها مان وابى بن خلف.
অর্থ : “যে ব্যক্তি নামাযের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তা তার ক্বিয়ামতের দিনে জ্যোতি, দলীল ও মুক্তির কারণ হবে। আর যে ব্যক্তি তার রক্ষণাবেক্ষণ না করে, তার পক্ষে তা জ্যোতি, দলীল ও মুক্তির কারণ হবে না এবং সে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিবস কারূন, ফেরাউন, হামান ও ওবাই ইবনে খালফের সাথে থাকবে।” (আহমদ শরীফ, দারেমী শরীফ, বায়হাক্বী শরীফ, মিশকাত , মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মুজাহেরে হক্ব)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে,
الصلوة عمادالدين من اقامها فقد اقام الدين ومن تر كها فقد هدم الدين.
অর্থ : “নামায দ্বীনের খুটি বা স্তম্ভ। যে নামায কায়িম রাখলো, সে দ্বীন ইসলাম কায়িম রাখলো। আর যে নামায তরক করলো, সে দ্বীন ইসলাম ধ্বংস করলো।”
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দ্বারা স্পষ্টতঃ বুঝা যায় যে, নামায দ্বীন ইসলাম উনার মূখ্য একটি স্তম্ভ, যার সাথে আর কারো তুলনা হয়না। এমনকি অন্যান্য রোকনী ফরযসমূহও পর্যন্ত। তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়,
بين العبد وبين الكفر ترك الصلواة.
অর্থ : “কাফির ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্যকারী আমল হলো- নামায।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীক) পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে যে,
من ترك الصلوة حتى مضى وقتها ثم قضى عذاب فى النار حقيا والحقبة ثمانون سنة والسنة ثلث مائة وستون بوما كل يوم كان مقداره الف سنة. (مجالس الابرار(
অর্থ : “যে ব্যক্তি এক ওয়াক্ত নামায কাজ্বা করবে, তাকে জাহান্নামে এক হোক্ববা শাস্তি দেয়া হবে। আর এক হোক্ববা হলো ৮০ মাস, প্রত্যেক মাস ১৬০ দিনের সমান। আর প্রত্যেক দিন এক হাজার মাসের সমান।” (মাজালেসুল আবরার)
আর প্রচলিত তাবলীগের গাশতকে সেই নামাযের চেয়েও প্রাধান্য দেয়া সম্পূর্ণ কুফরী, চরম জেহালত ও বিশেষ বিভ্রান্তিমূলক।
২৩নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : হযরতজীর মালফুযাত নামক কিতাবের ১২৮ পৃষ্ঠার ২০১নং মালফুয এবং (মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী লিখিত) “তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরুদায়িত্ব” নামক কিতাবের ১০১ পৃষ্ঠায় একথা লেখা আছে যে, ফাযায়েলের মর্যাদা মাসায়েলের চেয়ে বেশী।
উল্লিখিত কিতাবদ্বয়ের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পর্কে শরীয়তের ফায়সালা কি কুরআন, সুন্নাহ ইজমা, ক্বিয়াস-এর দৃষ্টিতে জাওয়াবদানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই অশুদ্ধ ও অজ্ঞতামূলক। কারণ ফাযায়িল হচ্ছে- ফযীলাতুন-এর বহুবচন। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- উচ্চ মর্যাদা, বৃদ্ধি, বাতেনী নি’য়ামত ইত্যাদি। আর এখানে ফাযায়েল অর্থ হলো- কোন আমলের ফল। অর্থাৎ কোন আমল করলে সে আমলের পরিবর্তে যে বদলা বা বিণিময় পাওয়া যায় বা যা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা হচ্ছে- ঐ আমলের ফাযায়েল বা ফল।
মাসায়েল হচ্ছে- মাসয়ালাতুন-এর বহুবচন। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- প্রশ্ন করা, জিজ্ঞাসা করা ইত্যাদি। আর এখানে মাসায়িল অর্থ হলো- যে আমল করলে ফযীলত বা ফাযায়িল হাছিল হয়, শরীয়ত মুতাবিক সে আমল করার পদ্ধতি সম্পর্কিত ইলম।
ফাযায়িলের বর্ণনা শুনে আমলের জন্য উৎসাহিত হয়ে কেউ যদি আমল করে, তাহলে সে আবেদ হয়।
আর মাসায়েল (ইলম) শিক্ষা করে কেউ যদি সে অনুযায়ী আমল করে, তবে সে আলিম হয়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
فضل العالم على العابد كفضلى على ادناكم.
অর্থ : “আলিমের ফযীলত আবেদের উপর এমন, যেমন তোমাদের মধ্যে সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার ফযীলত।” (তিরমিযী শরীফ, দারেমী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মা’য়ারিফুস সুনান, মিরকাত শরীফ, মুজাহিরে হক্ব, উরফুশ শাজী, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত)
অতএব, আবেদের উপর আলিমের যেরূপ ফযীলত, তদ্রুপ ফাযায়িলের উপর মাসায়িলের ফযীলত।
এখানে উল্লেখ্য যে, শুধু ফযীলত শুনে আমল করা কখনই সম্ভব নয়। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
العلم امام العمل.
অর্থ : “আমলের জন্য ইলম হলো- পথ প্রদর্শক বা ইমাম, আর আমল হলো- ইলমের অনুগামী।”
মাসায়িলের ফযীলত সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
(১)
تدارس العلم ساعة من الليل خير من احيائها.
অর্থ : “রাত্রের কিছু অংশ (সময়) ইলম শিক্ষা করা সারা রাত্রি জেগে ইবাদত করা থেকে উত্তম। (দারেমী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, মুজাহিরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, তালীক)
(২)
ان الملائكة لتضع اجنحتها لطالب، العلم رضاء بما يصنع.
অর্থ : “নিশ্চয়ই হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা ইলম শিক্ষার্থীদের জন্য সন্তুষ্টচিত্তে উনাদের পাখা বিস্তার করে দেন।” (আহমদ শরীফ, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন, ইবনে হাব্বান, হাকিম)
(৩)
لان تغدو فتتعلم بابا من العلم خير من ان تصلى مائة ركعة.
অর্থ : “সকালে বের হয়ে ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করা একশত রাকায়াত নামায পড়া হতে উত্তম।” (ইবনে আব্দুল বার, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন) শব্দের কিছু তারতম্যে অনুরূপ হাদীছ ইবনে মাযাহতেও বর্ণিত হয়েছে।
(৪)
باب من العلم يتعلمه الرجل خيرله من الدنيا وما فيها.
অর্থ : “কোন ব্যক্তির জন্য ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করা দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তা হতে উত্তম।” (ইবনে হাব্বান, ইবনে আব্দুল বার, ইহইয়াউল উলুম)
(৫)
باب من العلم يتعلمه الرجل خير له من مائة ركعة.
অর্থ : “কোন ব্যক্তির জন্য ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করা একশত রাকায়াত নফল নামায হতে উত্তম।” (তিবরানী, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন)
(৬)
اطلبوا العلم ولو بالصين
অর্থ : “তোমরা ইলম তলব কর, যদিও চীন দেশে হয়।” (ইবনে আদী, বায়হাক্বী, মাদখাল, শো’বুল ঈমান, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন)
(৭)
حضور مجلس عالم افضل من صلوة الف ركعة عيادة الف مريض ار شهود الف جنازة. فقيل يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ومن قرأة القران؟ فقال صلى الله عليه وسلم وهل ينفع القرأن الا بالعلم؟
অর্থ : “আলিমের মজলিসে হাজির হওয়া এক হাজার রাকায়াত নামায, এক হাজার রোগীর সেবা-শুশ্রুষা, এক হাজার মৃতের জানাযায় উপস্থিত হওয়া অপেক্ষা উত্তম। জিজ্ঞাসা করা হলো, হে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত হতেও উত্তম? তিনি বললেন, ইলম ব্যতীত কি পবিত্র কুরআন শরীফ উপকার করতে পারে? (ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন, ইবনে জাওযী)
(৮)
العلم خزائن مفاتيحها السوال الافاسئلوا فانه يؤجرفيه اربعة- السائل- والعالم والمستمع والمحب لهم.
অর্থ : “ইলম হলো রতœাগার, সুওয়াল হলো তার চাবি। অতএব তোমরা প্রশ্ন করো, তাতে চার ব্যক্তির পুরস্কার রয়েছে- প্রশ্নকারীর, আলেমের, শ্রোতার এবং তাদেরকে যারা ভালবাসে।” (আবূ নাঈম, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন)
(৯)
من تعلم بابامن العلم ليعلم الناس اعطى ئراب سبعين صديقا.
অর্থ : “যে ব্যক্তি ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করে, মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তাকে সত্তর জন ছিদ্দীকের সওয়াব দেয়া হবে।” (দায়লামী শরীফ, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বোঝা যায় যে, ফাযায়িলের মর্যাদা মাসায়িলের চেয়ে বেশী নয়। বরং মাসায়িলের মর্যাদা ফাযায়িলের চেয়ে বেশী।
কাজেই ফাযায়িলর মর্যাদা মাসায়িলের চেয়ে বেশী, এ কথা শুদ্ধ নয়। বরং শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মত হলো- মাসায়িলের মর্যাদা ফাযায়িলের চেয়ে বেশী।
আরো উল্লেখ্য যে, তারা কেবল তাদের ছয় উছূল ভিত্তিক আমলের ফযীলত বর্ণনা করে। অন্যান্য আমলের ফাযায়িল বর্ণনা করেনা।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মাসায়েল শিক্ষার ব্যাপারে বলে থাকে, তা লোকেরা আলিমদের কাছে শিক্ষা করে নিবে।
তাদের একথা দ্বারাও বোঝা যায় যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত একটি মক্তবী কোর্স মাত্র। অতএব, এই মক্তবী শিক্ষার মধ্যেই সারা জীবন ব্যয় করলে চলবেনা। কারণ এরপরেও অনেক শিক্ষা রয়ে গেছে। যেমন মাসয়ালা-মাসায়িলসহ ইলমে ফিক্বাহর বিভিন্ন বিষয়াদি শিক্ষা ও ইলমে তাসাউফ শিক্ষা ইত্যাদি।
ফাযায়িলের মর্যাদা মাসায়িলের চেয়ে বেশী, একথা বলার অর্থ হলো- মানুষকে ইলম থেকে ফিরিয়ে রাখা, আর ইলম থেকে ফিরিয়ে রাখা ইবলিসী খাছলতের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয় যে, “ইবলিস তার মজলিসে বসে তার শিষ্যদের ডেকে জিজ্ঞাসা করে, তোমরা কে কি করেছ? একজন বলে যে, আমি হত্যা করিয়েছি, আর একজন বলে, আমি তালাক দেয়ায়েছি। অন্যজন বলে আমি জেনা (ব্যভিচার) করিয়েছি এবং অন্যান্য শিষ্যরা প্রত্যেকেই কে কি কাজ করেছে, তার বর্ণনা দিতে থাকে। ইবলিসের এক শিষ্য এক কোণায় চুপ করে বসে থাকে। তাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ইবলিস জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি কিছু করোনি? তখন সে বললো, আমি তেমন কোন উল্লেখযোগ্য কাজ করিনি। শুধুমাত্র একটি ছেলেকে ইলমের দর্স গাহে যাওয়া থেকে ফিরিয়ে দিয়েছি। একথা শুনামাত্র ইবলিস তার আসন থেকে উঠে একলাফ দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিল এবং বললো, তুমিই সবচেয়ে উত্তম কাজ করেছ। কারণ এ ছেলে ইলম অর্জন করে আমারই বিরোধিতা করতো।”
অতএব, কারো জন্য একথা বলা শরীয়তসম্মত হবেনা যে, ফাযায়িলের মর্যাদা মাসায়িলের চেয়ে বেশী। যেসব বক্তব্যের কারণে মানুষ ইলমে দ্বীন হতে বঞ্ছিত হয়, সেসব বক্তব্য পরিহার করা প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব।
২৪নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : আপনাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাতের” ২৬তম সংখ্যায় লিখেছেন যে, ভোট গণতন্ত্রের একটি অংশ আর গণতন্ত্র ইসলামে হারাম। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা লিখিত, “তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব” নামক কিতাবের ৭৫ ও ১২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ভোট দান প্রচলিত তাবলীগের ৬নং উছূলের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ ভোট দেয়াও তাবলীগের অন্তর্ভূক্ত।
এখন আমাদের প্রশ্ন হলো- সত্যিই কি ভোটদান তাবলীগের আওতায় পড়ে? আর অন্ততঃপক্ষে তাবলীগের স্বার্থে বা কাজে ভোট দেয়া জায়েয হবে কি? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্যটি সম্পূর্ণই অশুদ্ধ ও মারাত্মক আপত্তিকর। কারণ ভোটদান কখনো তাবলীগের; আওতায় পড়েনা, বরং ভোটদান থেকে বিরত থাকার জন্য বলাই মূলতঃ তাবলীগের অন্তর্ভুক্ত। কেননা পূর্বেই বলা হয়েছে যে, তাবলীগের শাব্দিক অর্থ- পৌঁছানো, প্রচার করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় তাবলীগের অর্থ হলো- আল্লাহ পাক-এর হুকুম-আহকামকে পৌঁছিয়ে দেয়া বা তার প্রচার করা। অর্থাৎ ইসলামী পরিভাষায় সামগ্রিকভাবে আল্লাহর দ্বীন ও দ্বীনের বিধি-বিধান বা শিক্ষা-দীক্ষাকে আল্লাহর বান্দাগণের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার নাম হলো- তাবলীগ। যার পরিধি ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ হতে অনেক ব্যাপক।
আর ভোট প্রথা হলো- গণতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ। বাংলায় গণ অর্থ- জনগণ এবং তন্ত্র অর্থ- নিয়ম-নীতি বা পদ্ধতি। অর্থাৎ জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করার যে নিয়ম-কানুন বা পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে, তাই গণতন্ত্র। যার প্রবর্তক হচ্ছে- ইহুদী-নাছারা। এর সাথে মহান আল্লাহ পাক, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তথা দ্বীন ইসলাম উনাদের কোনই সম্পর্ক নেই।
উপরোক্ত সুওয়ালে উল্লেখ করা হয়েছে, তাবলীগের কাজ হিসেবে গণতন্ত্র ও ভোট প্রথা জায়েয হবে কিনা।
মুলত : এ কথার মধ্যে কুফরী রয়েছে। কারণ দ্বীন ইসলাম হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাক উনার মনোনীত দ্বীন, যা ওহীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি নাযিল হয়েছে। আর এ দ্বীন ইসলাম কারো অনুমোদনের মুখাপেক্ষী নয়। দ্বীন ইসলামকে জনগণের অনুমোদনের মুখাপেক্ষী করার অর্থ হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদেশ ও নিষেধসমূহ সরাসরি গ্রহণযোগ্য নয় জনগণের সমর্থন ব্যতীত। অথচ ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
اتبعوا ماانزل اليكم من ربكم ولا تتبعوا من دونه اولياء.
অর্থ : “তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের রবের তরফ হতে তোমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং তোমরা উনাকে (মহান আল্লাহ পাক উনাকে) ব্যতীত আর কাউকে অনুসরণ করোনা।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩)
মহান আল্লাহ পাক তিনি আরো বলেন,
اتبعوا المرسلين.
অর্থ : “তোমরা হযরত রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের অনুসরণ কর।” (পবিত্র সূরা ইয়াসীন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফসমূহ দ্বারা এটাই সাবেত হয় যে, মহান আল্লাহ পাক উনার নাযিলকৃত কিতাবকে এবং উনার প্রেরিত রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে। কারণ বান্দার জন্য কোনটি ভাল এবং কোনটি মন্দ, বান্দা জানেনা। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
عسى ان تكرهوا شيأ وهو خير لكم وعسى ان تحبوا شيأ وهو شر لكم والله يعلم وانتم لا تعلمون.
অর্থ : “সম্ভবতঃ তোমরা যা খারাপ মনে করে থাক, সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম। আর তোমরা যেটা ভাল মনে করে থাক, সেটাই তোমাদের জন্য খারাপ, মূলতঃ আল্লাহ পাকই জানেন কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ, তোমরা জাননা।” (পবিত্র সূরা বাক্বারাহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২১৬)
কাজেই মহান আল্লাহ পাক উনার প্রেরিত ও প্রদর্শিত পথের নির্দেশিকা পবিত্র কুরআন শরীফ এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনার অনুসরণ-অনুকরণই হচ্ছে একমাত্র কল্যাণের ও নাযাতের পথ।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে,
وعن ابى موسى قال دخلت على النبى صلى الله عليه وسلم
انا ورجلان من بنى عمى فقال احد هما يارسول الله امرنا على بعض ما ولاك الله وقال الاخر مثل ذلك فقال انا والله لا نولى على هذا العمل احدا ساله ولا احدا حرص عليه وفى رواية قال لا نستعمل على عملنا من اراده.
অর্থ : হযরত আবূ মুসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, একদা আমি ও আমার দু’জন চাচাত ভাই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট গেলাম। সে দু’জনের একজন বললো, হে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনাকে যে সকল কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন, আপনি আমাদেরকে তার মধ্য হতে কোন একটির শাসক নিযুক্ত করুন এবং দ্বিতীয়জন ও অনুরূপই বললো। উত্তরে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার কছম! আমরা এ কাজে (শাসক পদে) এমন কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করিনা, যে ওটার প্রার্থী হয় এবং ঐ ব্যক্তিকেও নিয়োগ করিনা, যে ওটার লোভ বা আকাঙ্খা করে।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
وعن عبد الرحمن اين سمرة قال- قال لى رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تسال الامارة فائك ان اعطيتها عن مسئلة وكلت اليها وان اعطيتها عن غير مسئلة اعنن عليها.
অর্থ : হযরত আব্দুর রহমান বিন সামুরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে বললেন, “(হে হযরত সামুরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু!) আপনি নেতৃত্ব বা পদ চাবেননা। কেননা, যদি আপনাকে তা চাওয়ার কারণে দেয়া হয়, তবে তা আপনার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আর যদি তা আপনাকে চাওয়া ব্যতীত দেয়া হয়, তাহলে এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করা হবে।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
وعن ابى هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تجدون من خير الناس اشد هم كراهية لهذا الامر حتى يقع فيه.
অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, “এই শাসনভারকে যারা কঠোরভাবে ঘৃণা করে, তাদেরকে তোমরা উত্তম লোক হিসেবে পাবে, যে পর্যন্ত তারা তাতে লিপ্ত না হয়।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
মূলতঃ নির্বাচন বা ভোট হচ্ছে- গণতন্ত্রেরই একটি অংশ। কারণ মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, “যারা কোন পদপ্রার্থী হয়, তাদেরকে পদ দিওনা।”
আর আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয় যে, এটা গণতন্ত্রেরই একটা নতুন রূপ। কারণ গণতন্ত্র জনগণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর আপনারাও ইসলামকে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ জনগণ যে আইন পছন্দ করবে, গণভোটের মাধ্যমে সেটাই সমর্থন দিবে এবং আপনারা সে আইনই জারি করবেন। গণভোট বলতে এটাই বুঝানো হয় যে, দেশের যত প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক তথা জনগণ রয়েছে, তাদের থেকে ভোট নেয়া। চাই তারা মুসলমান হোক বা অমুসলমান (হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদী, মুজুসী, মোশরেক, কাদিয়ানী, শিখ ইত্যাদি) হোক।
এখন ভোটে জনগণ যদি ইসলামের পক্ষে রায় দেয়, তবে ইসলাম থাকবে অন্যথায় নয়। আর যদি বিপরীতে রায় দেয়, তবে যে বিষয়ে রায় দেবে সেটাই বহাল থাকবে, হোক তা বেদ্বীনী ও বদদ্বীনী।
অথচ ইসলামের কোন আইন কোথায় প্রয়োগ করতে হবে, তা মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিই উল্লেখ্য করে দিয়েছেন।
এরপরও জন সমর্থন, গণ অনুমোদন ও ভোট করার অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ইহানত করা এবং এটাই প্রমাণ করা যে, মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা বলেছেন, তা সঠিক নয়, তা গণ অনুমোদন দিয়ে সঠিক করে নিতে হবে। এক কথায় মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারা যত আদেশ নিষেধই করুন না কেন, তা কখনই গ্রহণযোগ্য হবে না জনগণের অনুমোদন ব্যতীত। অর্থাৎ ইসলামী আইন ও তার প্রয়োগ জনগণের অনুমোদনের উপর নির্ভরশীল। (নাউযুবিল্লাহ)
বর্তমানে কেউ যদি দ্বীনের হাক্বীকী তাবলীগ ও ইসলামী আন্দোলন করতে চায়, তবে তাকে “খিলাফত আলা মিন হাযিন নুবুওওয়াহ” অর্থাৎ নুবুওওয়াতের দৃষ্টিতে খিলাফতের জন্য কোশেশ করতে হবে। আর খিলাফত কায়িমের জন্য মজলিসে শুরা করতে হবে।
মজলিসে শুরার প্রধান তিনিই হবেন, যিনি সবচেয়ে বেশী তাকওয়াধারী হবেন। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ان اكرمكم عندالله اتقاكم
অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট ঐ ব্যক্তি সব চাইতে সম্মানিত, যিনি তোমাদের মধ্যে তাকওয়াধারী বা পরহেযগার।” (পবিত্র সূরা হুজরাত শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৩)
আর যিনি ইলম, আমল, ইখলাস অর্থাৎ প্রতিটি বিষয়ে তাকমীলে (পূর্ণতায়) পৌঁছেছেন, তিনিই হাক্বীক্বী তাকওয়াধারী।
খিলাফত প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
وعد الله الذين امنوا منكم وعملوا الصالحات ليستخلفتهم فى الارض كما استخلف الذين من قبلهم وليمكنن لهم دينهم الذى ارتض لهم وليبد لنهم من بعد خوفهم امنا- يعبدوننى ولا يشركون بى شيأ ومن كفربعد ذالك فاولئك هم الفاسقون- واقيموا الصلوة واتوا الزكوة واطيعوا الرسول لعكم ترحمون لا تحبين الذين كفروا معجزين فى الارض ومأواهم النار رلبئس المصير.
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি ওয়াদা দিয়েছেন যে, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছেন এবং আমলে সলেহ করেছেন, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে খিলাফত (শাসন কর্তৃত্ব) দান করবেন। যেমন- তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে খিলাফত দিয়েছিলেন এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে, যে দ্বীন তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং নিশ্চয়ই তিনি তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে আসান (নিরাপত্তা) দান করবেন এ শর্তে যে, তারা আমার ইবাদত বন্দেগী করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর এরপর যারা কুফুরী করবে, তারাই ফাসিক। তোমরা নামায কায়িম কর এবং যাকাত আদায় কর এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুগত্যতা প্রকাশ কর। আশা করা যায়, তোমরা (পূর্ণ) রহমত প্রাপ্ত হবে। তোমরা কাফিরদের সম্পর্কে এটা ধারণা করোনা যে, তারা যমীনে পরাক্রমশীল, তাদের জায়গা/ঠিকানা হবে জাহান্নাম, আর নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যাবর্তন স্থল অত্যান্ত নিকৃষ্ট।” (পবিত্র সূরা নূর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৫৫-৫৭)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ওয়াদা দিয়েছেন, যারা খালিছভাবে ঈমান আনবে এবং খালেছ আমলে সলেহ করবে, অর্থাৎ ইলমে জাহির ও ইলমে তাসাউফ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করতঃ ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হবে, তাদেরকে মহান আল্লাহ পাক খিলাফত দান করবেন। যেমন- তিনি পূর্ববর্তীগণকে দান করেছেন। আর শুধু তাই নয়, সাথে সাথে দ্বীনে মজবুতী দান করবেন, ভয়ভীতি দূর করে নিরাপত্তা দান করবেন। আর এ খিলাফত কায়িম থাকবে পরিশুদ্ধ দিল বা তাযকিয়ায়ে নফসের সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত-বন্দেগীতে দায়িম-কায়িম থাকা পর্যন্ত এবং কোন বিষযে মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে কাউকে শরীক না করা পর্যন্ত।
বিশেষ করে শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ পাক উনার প্রদত্ত আইনের সাথে অন্য কারো প্রণীত আইন-কানুন, নিয়ম-নীতি (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, মাওবাদ, লেলিনবাদ, মার্কসবাদ ইত্যাদি), মিশ্রিত করে শরীক করলে, তথন আর খিলাফতের নিয়ামত কায়িম থাকেনা। আর যারা এরূপ করবে, তারা গোমরাহ হয়ে যাবে।
কাজেই প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ নামায কায়িম, যাকাত আদায় এবং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের ইত্তেবার দ্বারা খিলাফত কায়িমের কোশেশের মাধ্যমে রহমত হাছিল করা।
আর এটা যেন কোন মুসলমানই কখনো ঘুর্নাক্ষরেও চিন্তা না করে যে, কাফির, ফাসিক, জালিমরা পৃথিবীতে প্রতাপশালী, ক্ষমতাশালী, আধিপত্য বিস্তারকারী হয়ে গিয়েছে, তাই তাদের নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা ব্যতীত খিলাফত কায়িম করা সম্ভব নয়। অবশ্যই সম্ভব, কারণ তারা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট মনোনীত, পছন্দনীয় বা প্রিয় নয়, তাই তাদের অবস্থানস্থল করা হয়েছে জাহান্নাম।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র ও তার সাহায্য-সহযোগীতা করা এবং তার জন্য দল, মত-পথ গঠন করা নির্বাচন করা এবং ভোট দেয়া বা চাওয়া ইত্যাদি সবই নাযায়িয ও হারাম, যা হালাল মনে করা কুফরী।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
تعاونوا علىالبرو التقوى ولا تعاونوا على الاثم والعدولن.
অর্থ : “তোমরা পরস্পর পরস্পরকে নেকী ও পরহেজগারীতে সাহায্য কর, নাফরমানী ও শত্রুতার মধ্যে সাহায্য করোনা।” (পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২)
আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যদি বলে- গণতন্ত্র বা তার অঙ্গ নির্বাচন তথা ভোট প্রথা তাদের ৬নং উছূলের অর্ন্তভুক্ত, তবে তা হবে শক্ত হারাম ও জঘন্য কুফরী। কারণ এমনিতেই হারামকে হালাল বললে তা কুফরী হয়। আর সেখানে হারাম দিয়ে ইসলামের কাজ বা তাবলীগের কাজ হয়, এ কথা বললে তা আরও শক্ত কুফরী হয় এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রকাশ্য ঈমানহারার দল হিসেবে অভিহিত হয়।
অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের জন্য ওয়াজিব- গণতন্ত্র ও তার অঙ্গ নির্বাচন তথা ভোট প্রথাকে তাদের উছূল থেকে বাদ দেয়া এবং সমর্থন ও সহযোগীতা থেকে বিরত থাকা।
উল্লেখ্য এ সম্পর্কে আরো ভাল মত বুঝতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ২৬তম সংখ্যা ও পড়ৃন।
২৫নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা সাধারণ লোকদের তাবলীগের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে গাশতের ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলে থাকে যে, গাশতকারীরা যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, সে রাস্তায় যে ঘাস হয়, সে ঘাস যে গরু খায়, সে গরুর দুধ বা গোশত যারা পান করবে বা খাবে, তারাও বেহেশতে যাবে।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথাও আছে কি? জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : একথা সম্পূর্ণই বাতিল, ফুজুল এবং ডাহা মিথ্যা, যা কুফরীর অর্ন্তভুক্ত।
মূলত : এরূপ কোন কথা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা-ক্বিয়াস উনাদের কোথাও উল্লেখ নেই। এমনকি তার ইঙ্গিতও নেই। আর এ ধরণের মিথ্যা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা নহল শরীফ ১০৫নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
انما يفترى الكذب الذين لا يؤمنون.
অর্থ : “নিশ্চয় যাদের ঈমান নেই, কেবল তারাই মিথ্যা বলে থাকে।”
এবং সূরা হজ্বের ৩০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
واجتنبوا قول الزور.
অর্থ : “তোমরা মিথ্যা কথা থেকে বিরত থাক।
মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ১০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে আরো বলেন,
ولهم عذاب اليم بما كانوا يكذبون
অর্থ : “তাদের মিথ্যারোপের কারণে তাদের জন্য কঠিন, যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি রয়েছে।”
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
انما الكذب لكل الذنوب ام.
অর্থ : “নিশ্চয়ই মিথ্যা সমস্ত গুণাহের মূল।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, “মু’মিনের মধ্যে অন্য সকল দোষই অল্প-বিস্তর থাকা সম্ভবপর। কিন্তু গচ্ছিত সম্পদ আত্মসাত করা এবং মিথ্যা কথা বলার দোষ কিছুতেই থাকতে পারেনা।” (আহমদ শরীফ, বায়হাক্বী শরীফ)
সুতরাং উপরোক্ত মিথ্যাসমূহ থেকে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের পরহেজ করা ওয়াজিব।
২৬নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট প্রায় কিতাবেই একথা লেখা আছে যে, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল করেছিলেন। যেমন- হযরত আদম আলাইহিস সালাম গন্দম খেয়ে ভুল করেছিলেন ও হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম দাওয়াত না দিয়ে ভুল করেছিলেন ইত্যাদি। (মালফুযাতে শায়খুল হাদীছ পৃঃ ২৩১, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, লেখক- মাওলানা ইসমাইল হোসেন, দেওবন্দী পৃঃ৬১)
নবী-রাসূল আলাইহিস সালামগণের প্রতি এরূপ আক্বীদা পোষণ করা জায়েয কি? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : এরূপ আক্বীদা পোষণ করা গোমরাহী ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ সকল হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ছিলেন আল্লাহ পাক উনার খাছ ও মনোনীত বান্দাহগণের অন্তর্ভূক্ত। উনারা প্রত্যেকেই ছিলেন ওহীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পবিত্র কুরআন শরীফ উনার একাধিক স্থানে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-
نوحى اليهم.
অর্থ : “আমি উনাদের (হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের) প্রতি ওহী পাঠাতাম।” (পবিত্র সূরা ইউসূফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১০৯, পবিত্র সূরা নহল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৪৩, পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ, ৭)
অর্থাৎ হযতর নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের যাবতীয় কার্যাবলীই ওহীর দ্বারা (মহান আল্লাহ পাক কর্তৃক) পরিচালিত হতো। যার পরিপ্রেক্ষিতে আক্বায়েদের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে-
الانبياء عليهم السلام كلهم معصوم.
অর্থ : “সকল হযরত আম্বিয়া আলাইহিস সালাম উনারা মাছূম বা নিস্পাপ।”
আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে,
الانبياء عليهم السلام كلهم منزحون عن الصغائر والكبائر والكفر والقبائح.
অর্থ : “সকল আম্বিয়া হযরত আলাইহিমুস সালাম উনারা ছগীরা, কবীরা, কুফরী এবং অপছন্দনীয় কাজ হতেও পবিত্র।”
এ উছূলের ভিত্তিতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা হলো- কোন নবী-রাসূল আলাইহিস সালামগণ কখনও ভুল করেননি। ইচ্ছাকৃত তো নয়ই, অনিচ্ছাকৃতও নয়। অর্থাৎ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা কোন ভুলই করেননি। (শরহে আক্বাইদে নসফী, ফিক্বহে আকবর, তাকমীলুল ঈমান, আক্বাইদে হাক্কাহ)
অতএব, যারা হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ভুল সম্পর্কে বলে থাকে, আক্বাইদ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই তারা তা বলে থাকে। যেমন তারা বলে থাকে যে, হযরত আদম আলাইহিস সালাম গন্দম খেয়ে ভুল করেছিলেন। (নাউযুবিল্লাহ)
মূলত : তাদের একথা সঠিক নয়। প্রকৃত ঘটনা হলো- যখন মহান আল্লাহ পাক হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হযরত হাওয়া আলাইহিস সালাম উনাদেরকে আদেশ করেছিলেন যে
لاتقربا هذه الشجرة.
অর্থ : “আপনারা এই (গন্দমের) গাছের নিকটবর্তী হবেন না।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩৫)
তখন উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার এ আদেশ মুবারক অনুযায়ী সে গাছের নিকটবর্তী হননি। বরং উক্ত গাছের অনুরূপ বিপরীত দিকের অন্য একটি গাছ দেখিয়ে, ইবলিস শয়তান এসে হযরত হাওয়া আলাইহিস সালাম উনাকে মিথ্যা কছম খেয়ে বলেছিল যে, যদি আপনারা এ গাছের ফল খান, তবে আপনারা ফেরেস্তা হয়ে যাবেন অথবা স্থায়ীভাবে বেহেশতে বসবাস করতে পারবেন। কোন কোন বর্ণনা মোতাবেক তখন হযরত হাওয়া আলাইহিস সালাম তিনি সে গাছ হতে ফল এনে শরবত বানিয়ে হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে খাইয়েছিলেন। অপর বর্ণনায় ফল কেটে খাইয়েছিলেন। এ ঘটনা হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার অজান্তেই সংঘটিত হয়েছিল। সুতরাং যা অজান্তে সংঘটিত হয়, তা কি করে ভুল বা অপরাধ হতে পারে? বাস্তবিক তা কখনই ভুল হতে পারেনা। (সমূহ তাফসীরের কিতাব) এর মেছালস্বরূপ উল্লেখ করা যায়- হযরত ইমাম হাসান আলাইহিস সালাম উনার শাহাদতের ঘটনা। তিনি যে শাহাদত বরণ করেছিলেন, এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। উনাকে ইসলামের শত্রুরা শহীদ করার জন্য একে একে পাঁচবার বিষ পান করায়। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতে তিনি প্রত্যেক বারই বেঁচে যান। ষষ্ঠবার উনাকে শহীদ করার জন্য উনার পানির কলসিতে, যে কলসির মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখতেন, যেন তার ভিতর কিছু ফেলা না যায়, সেই কাপড়ের উপর শত্রুরা হিরক চূর্ণ বিষ উনার অজান্তে মিশিয়ে দিয়েছিল। তিনি গভীর রাত্রে হিরক চূর্ণ বিষ মিশ্রিত পানি কলসি থেকে ঢেলে পান করেন, যার ফলশ্রুতিতে তিনি শাহাদত বরণ করেন। যা উনার অজান্তেই সংঘটিত হয়েছিল। (সিররুশ শাহাদাতাঈন, শুহাদায়ে কারবালা, সীরতে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) এখন প্রশ্ন উঠে, শরীয়তের দৃষ্টিতে উনার শাহাদাতকে আত্মহত্যা বলতে হবে, না ভুল করার কারণে ইন্তেকাল করেছেন, তা বলতে হবে? মূলতঃ উপরোক্ত দু’টির কোনটিই বলা যাবেনা। যদি কেউ কোন একটিও বলে, তবে সে মিথ্যা তোহমত দেয়ার গুণাহে গুণাহগার হবে, যা কুফরীর শামিল হবে। তদ্রুপ হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনার ঘটনাও। যা উনার অজান্তে সংঘটিত হয়েছিল। অনুরূপ অন্যান্য হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ঘটনাও। মানুষ সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার সঠিক ব্যাখ্যা না বুঝার কারণে, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের শানে বেয়াদবী মূলক কুফরী কথাবার্তা বলে থাকে। হযরত হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের সাথে কতটুকু আদব রক্ষা করতে হবে, সে প্রসঙ্গে কিতাবে, হযরত ইমাম সাররী সাকতী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ঘটনা উল্লেখ করা হয়, যিনি উনার যামানায় মহান আল্লাহ পাক উনার লক্ষস্থল ছিলেন। যিনি ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত ছিলেন। তিনি একবার স্বপ্নে দেখেন মহান আল্লাহ পাক উনার নবী হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনাকে দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, হে মহান আল্লাহ পাক উনার নবী হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম! আপনার অন্তরে যদি মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত সত্যিকার ভাবেই প্রবল হতো, তাহলে আপনি কি করে আপনার ছেলে হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম উনার জুদাইয়ের (বিচ্ছেদের) কারণে উনার মুহব্বতে চল্লিশ বছর যাবত কেঁদে কেঁদে আপনার চক্ষু মুবারক নষ্ট করেছিলেন? একথা বলার সাথে সাথে গায়েব থেকে নেদা (আওয়াজ) হলো, “হে সাররী সাকতী রহমতুল্লাহি আলাইহি! মুখ শামলিয়ে নবীদের শানে কথা বল।” এরপর হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম উনাকে উনার সামনে পেশ করা হলে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যান এবং এভাবে একাধারা তের দিন, তের রাত্র বেহুশ থাকার পর হুঁশ ফিরে পান। তখন গায়েব থেকে নেদা হয়, “মহান আল্লাহ পাক উনার হযরত নবী আলাইহিস সালাম উনাদের শানে আদবের খেলাফ কথা বললে এরূপই শাস্তি হয়ে থাকে।” (তাজকেরাতুল আওলিয়া) উপরোক্ত ওয়াকিয়ার আলোকে প্রতিভাত হয় যে, আদব কত সুক্ষ্ম জিনিস এবং হযরত নবী আলাইহিস সালাম উনাদের ক্ষেত্রে কত আদবের সাথে কথা বলতে হবে এবং উনাদের সাথে বেয়াদবির কি পরিণতি? বেয়াদব সম্পর্কে হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
بے ادب محروم گشت از لطف رب-
অর্থঃ- “বেয়াদব মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত থেকে বঞ্চিত।” (মসনবী শরীফ) অতএব, প্রতীয়মান হয় যে, হযরত নবী-রাসূল আলাইহিস সালাম উনাদের প্রতি কতটুক আদব রক্ষা করা দরকার। উল্লেখ্য যে, হযরত সাররী সাকতী রহমতুল্লাহি আলাইহি ইমামুজ্জামান, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত ও মহান আল্লাহ পাক উনার লক্ষ্যস্থল হওয়া সত্বেও উনার প্রতি সতর্কবাণী ও সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে। মূলতঃ হরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ভুল করা তো দূরের কথা, কোন প্রকার অপছন্দনীয় কাজও উনারা করতেন না। বরং সর্ব প্রকার অপছন্দনীয় কাজ থেকেও বেঁচে থাকতেন বা পবিত্র থাকতেন, সে প্রসঙ্গে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র সীরত মুবারক উনার থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়-
“একবার মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুজরা শরীফ উনার মধ্যে বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি এসে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি চাইলেন। এ সংবাদ উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট পৌঁছালেন। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, সে ব্যক্তিকে অপেক্ষা করতে বল। একথা বলে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পাগড়ী মুবারক, জামা বা কোর্তা মুবারক ইত্যাদি গুছগাছ করে নিলেন। এমন কি হুজরা শরীফ থেকে বের হওয়ার মূহুর্তে পানির গামলাতে নিজের চেহারা মুবারক দেখে গুছিয়ে নিচ্ছিলেন। তা দেখে সে সময় হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনিও কি এরূপ করেন? তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “কিরূপ করি?” তখন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি বললেন, “এরূপ পরিপাটি।” এর জবাবে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আমরা মহান আল্লাহ পাক উনার নবী। আমাদের কোন কাজ কারো অপছন্দ হলে, সে ঈমান হারা হয়ে যাবে।” (আল মুরশিদুল আমীন) অতএব, হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা যে কতটুকু অপছন্দনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকতেন, এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত ঘটনা তারই প্রমাণ। তাহলে কি করে এ কথা বলা যেতে পারে বা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে, হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ভুল-ত্রুটি করেছিলেন? বস্তুতঃ এরূপ আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী। তদ্রুপ হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের সম্পর্কে ও উনাদের শানের খিলাফ কোন অর্থ গ্রহণ করা যাবেনা বরং এমন অর্থ ব্যবহার বা গ্রহণ করতে হবে, যাতে উনাদের শান সমুন্নত থাকে। উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা কারীদেরকে রাবী বলা হয়। এই রাবী উনাদের মধ্যে যাঁরা প্রথম শ্রেণীর, উনাদেরকে বলা হয় ছেক্বাহ রাবী। হাদীছ বিশারদগণ, ছেক্বাহ রাবী হওয়ার জন্য যে মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন, তার মধ্যে মূল বিষয় হচ্ছে- (১) আদালত ও (২) জবত।
জবত হচ্ছে- প্রখর স্মরণশক্তি। তা এমন যে, একবার শুনলে আর ভুলেনা। আর আদালত-এর মধ্যে চারটি শর্ত রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান হলো- দু’টি। যথা- (ক) তাক্বওয়া, (খ) মুরুওওয়াত। (ক) তাক্বওয়া হচ্ছে- কুফরী, শেরেকী, বিদয়াতী, ফাসেকী কাজ থেকে বেঁচে থাকার সাথে সাথে কবীরাহ গুণাহ থেকে, এমনকি ছগীরাহ গুণাহও বার বার করা থেকে বেঁচে থাকা। (খ) আর মুরুওওয়াত হচ্ছে- অশালীন, অশোভনীয়, অপছন্দনীয়, এমনকি দৃষ্টিকটু কাজ থেকে বিরত থাকা। যেমন- রাস্তায় হেঁটে হেঁটে খাদ্য খাওয়া, রাস্তায় অট্টহাস্য করা, চিৎকার করা ইত্যাদি। (তাদরীবুর রাবী, মুকাদ্দামাতুশ শায়খ, মীযানুল আখবার) এখন ফিকিরের বিষয় এই যে, পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনাকারী ছেক্বাহ রাবী যদি এত গুণ ও যোগ্যতাসম্পন্ন এবং তাক্বওয়াধারী হন অর্থাৎ পবিত্র হাদীছ বিশারদ উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের নিকট যদি ছেক্বাহ রাবী হিসেবে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনাকারী হওয়ার জন্য ছগীরাহ গুণাহ বার বার না করা ও দৃষ্টিকটু সাধারণ অপছন্দনীয় কাজও না করা শর্ত হয়, তাহলে যাঁরা মহান আল্লাহ পাক উনার নবী হবেন এবং মহান আল্লাহ পাক উনার কালাম বর্ণনা করবেন, উনাদের জন্য মহান আল্লাহ পাক তিনি কি মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন বা উানদের ক্ষেত্রে কতটুকু মা’ছূম ও মাহফুজ হওয়া নির্দিষ্ট করছেন তা অনুধাবনীয়।
অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত এবং অন্যান্য যে কোন লোকের জন্যই হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের শানের বিন্দুমাত্র খেলাফ কথাবার্তা বলা সম্পূর্ণ নাজায়েয, হারাম ও কুফরী। এ ধরণের কুফরী আক্বীদা থেকে বেঁচে থাকা সমস্ত মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ ।
২৭নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : মৌলভী মুহম্মদ ইব্রাহীম কর্তৃক লিখিত- “তাবলীগ জামায়তের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত” নামক কিতাবের ১ম খন্ড ৩৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, খৃীষ্টান মিশনারীদের ন্যায় প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত কৃতিত্বের দাবীদার। এ ব্যাপারে আমাদের প্রশ্ন হলো খৃীষ্টানদের সাথে মিল রেখে এরূপ দাবী করা জায়েয হবে কি? এবং তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়ত সম্মত? জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : উপরোক্ত কথাটি নেহায়েত মূর্খতা সুচক ও জেহালতপূর্ণ। খৃীষ্টান মিশনারীরা কখনই প্রকৃতপক্ষে কৃতিত্বের দাবীদার নয়। যদিও তারা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে মানুষকে তাদের ধর্মীয় মত-পথের প্রতি আকৃষ্ট করে। কিন্তু মূলতঃ তারা মুসলমানের ঈমান হরন করে তাদেরকে গোমরাহী ও কুফরীতে নিমজ্জিত করে। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে এই বেদ্বীন, গজব প্রাপ্ত খৃীষ্টান মিশনারীর সাথে মিল রেখে, তাদের অনুসরণ করে গর্ব করা সম্পূর্ণই নাজায়েয। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ উনার মধ্যে ৫-৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে বলেন, (তোমরা আমার কাছে দোয়া চাও, হে মহান আল্লাহ পাক)
اهدنا الصراط المستقيم- صراط الذين انعمت عليهم.
অর্থ : “আপনি আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করুন। উনাদের পথ, যাঁদেরকে আপনি নিয়ামত দিয়েছেন।”
আর মহান আল্লাহ পাক তিনি যাদেরকে নিয়ামত দিয়েছেন, তাদের প্রসঙ্গে পবিত্র সূরা নিসা শরীফ উনার ৬৯নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
انعم الله عليهم من النبيين والصديقين والشهداء والصالحين.
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি নি’য়ামত দান করেছেন, যাঁরা নবী, ছিদ্দীক, শহীদ, সলেহ উনাদেরকে।”
এরপর পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ উনার ৭নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
غير المغضوب عليهم ولا الضالين.
অর্থ : “(তোমরা দোয়া চাও) হে মহান আল্লাহ পাক তাদের পথ দান করবেন না, যারা গযব প্রাপ্ত (খৃীষ্টান) এবং যারা পথভ্রষ্ট (ইহুদী)।” আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে যে,
من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ : “যে যেই সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে সেই সম্প্রদায়ের অর্ন্তভূক্ত।” (মসনদে আহমদ শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, বজলুল মাজহুদ) উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দ্বারা একথাই প্রতীয়মান হয় যে, তাদের (বেদ্বীনদের) পথ চাওয়া, তাদের সাথে মিল রেখে তাদেরকে অনুসরণ করে গর্ব করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী। এরপরেও, যদি আমরা দুনিয়াবী দৃষ্টিতে খৃীষ্টান মিশনারী ও প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করি, তাহলেও দেখা যাবে যে, খৃীষ্টান মিশনারীরা নিজেদের গৃহের, অন্ন, বস্ত্রের সংস্থান তো করেই, শুধু এতটুকু নয় বরং সাথে সাথে যাদেরকে তাদের মত-পথের প্রতি আকৃষ্ট করতে চায়, তাদেরও অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দেয়। আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পূর্ণই তার বিপরীত। অতএব খৃীষ্টান মিশনারীর সাথে মিল রেখে এবং তাদেরকে অনুসরণ করে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত যে নিজেদেরকে কৃতিত্বের দাবীদার মনে করে, তা সম্পূর্ণই অবৈধ, যা শরীয়তের খেলাফ ও কুফরী। তাই একথা তাদের পরহেজ করা ওয়াজিব।
২৮নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, বিদায় হজ্বের(খূৎবা) ভাষণ শ্রবণকালে হযরত ছাহাবা ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের, যাঁর ঘোড়ার মুখ যেদিকে ছিল, ভাষণ (খূৎবা) শেষ হওয়া মাত্র উনারা সেদিকেই প্রচলিত তাবলীগের কাজে ছুটেছেন।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়ত সম্মত ও সত্য পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য দলীলের দ্বারা জাওয়াব দানে উপকৃত করবেন বলে আশাবাদী।
জাওয়াব : এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যার নামান্তর, যার মধ্যে সত্যের লেশমাত্র নেই। যা অবাস্তব, উদ্ভট ও দলীল বিহীন, যা ইতিহাসকে বিকৃত করেছে। কারণ উপরোক্ত কথা মেনে নিলে সাধারণ দৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় যে, বিদায় হজ্বে খূৎবা প্রদান কালে হযরত ছহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারর দিকে উনাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে উনাদের দৃষ্টি নিবব্ধ করে রেখেছিলেন? অর্থাৎ উনারা ঘোড়ার উপর বসে ও উনাদের ঘোড়ার মুখগুলো অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছিলেন এই খেয়ালে যে, তারা কখন রওয়ানা দিবেন?
উপরোক্ত বক্তব্যের আলোকে আরো কয়েকটি নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, (১) তাহলে কি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি খুৎবা প্রদানের পুর্বেই হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে বলেছিলেন যে, “আপনারা খুৎবা শেষ হওয়া মাত্রই যার ঘোড়া যেদিকে মুখ করে থাকবে, সেদিকেই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে বের হবেন?” (২) হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা সকলেই কি তাহলে ঘোড়ায় করে এসেছিলেন? উটে করে, গাধায় করে, খচ্চরে করে বা পায়ে হেঁটে আসেননি? (৩) আর খুৎবা শ্রবণের সময় কি তাহলে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের কেউ পিছ দিয়ে, কেউ পার্শ্বদেশ দিয়ে শুনেছিলেন? আর যাঁরা সামনে মুখ দিয়ে শুনেছেন, উনারা কি তাহলে সরাসরি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আরাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অতিক্রম করে চলে গেছেন? (৪) আর খূৎবার মধ্যে কি মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এ কথা বলেছেন যে, “খুৎবা শেষ হওয়া মাত্রই আপনারা যার ঘোড়ার মুখ যেদিকে রয়েছে, সেদিকেই দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে বের হয়ে যান? (৫) আবার খূৎবা শোনার শেষে যদি উনারা দাওয়াতের কাজে বের হয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে কি উনারা হজ্বের বাকী ফরয কাজ, যেমন- তাওয়াফে যিয়ারত, আর ওয়াজিব যেমন- রমি বা কঙ্কর নিক্ষেপ, মুজদালিফায় অবস্থান, কুরবানী, চুল কাটা, বিদায়ী তাওয়াফ ইত্যাদি আদায় না করেই অর্থাৎ হজ্ব সমাপন না করেই তাবলীগের কাজে বের হয়েছিলেন?
মূলত, উপরের কথাগুলি আদৌ শুদ্ধ নয়, বরং সম্পূর্ণই ভুল ও অশুদ্ধ। কারণ- (১) একথা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কখনো বলেননি। আর যদি বলে নাই থাকেন, তাহলে কেন উনারা উনাদের ঘোড়ার মুখ বিভিন্ন দিকে করে রাখবেন? মূলতঃ কথাটা ডাহা মিথ্যা। আসলে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা কেউই অন্যদিকে মুখ করে রাখেননি। সকলেই একমাত্র নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লালল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে রুজু হয়েছিলেন। (২) বিদায় হজ্বের ভাষণে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা হেঁটে, ঘোড়ায় চড়ে, গাধায় করে, খচ্চরে করেও এসেছেন, আবার উটে করেও এসেছেন। (৩) হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বিভিন্ন দিকে মুখ দিয়ে খুৎবা শুনেছিলেন, একথা কেবল মিথ্যাই নয় বরং উনাদের প্রতি মিথ্যা তোহমতও বটে
যা কুফরীর নামান্তর। কারণ হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা সকলেই বাআদব (আদব ওয়ালা) ছিলেন, আর খূৎবা আদবের সাথেই শুনেছিলেন। কেননা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি আদব রক্ষা করা ফরয, তার খেলাফ করা কুফরী। আর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের পক্ষে আদবের খেলাফ কাজ করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। (৪) নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেননি যে, “খুৎবা শেষ হওয়া মাত্রই আপনারা যার ঘোড়া যেদিকে আছেন, সেদিকে বের হয়ে যান।” বরং বলেছেন, “আপনারা যারা উপস্থিত রয়েছন, যারা অনুপস্থিত, তাদের কাছে আমার কথাগুলো পৌঁছে দিবেন।” প্রশ্ন উঠে যে, বিদায় হজ্বের খুৎবার পরেই যদি সকল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম তাবলীগের কাজে বের হয়ে থাকেন, তাহলে কাদেরকে নিয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রত্যাবর্তন করলেন, কাদেরকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বিভিন্ন দায়িত্বে ও জ্বিহাদের জন্য মনোনীত করলেন। কাদেরকে নিয়ে দুনিয়াবী জিন্দেগীর অবশিষ্ট সময় কাটালেন। আর কারাই বা উনার বাকী জীবন উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ ও নাযিলকৃত ওহী মুবারক সংরক্ষিত করলেন?
উল্লেখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লম তিনি যাঁদেরকে নিয়ে হজ্বে গিয়েছেন, উনাদের প্রায় সকলকে নিয়েই পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে প্রত্যাবর্তন করেছেন। এবং পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে পৌঁছানোর পর কাউকে জ্বিহাদে, কাউকে দাওয়াত ও তাবলীগ, কাউকে তা’লীম ও তালক্বীনে এবং কাউকে অন্য কোন দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। বিশেষ করে হযরত উসামা বিন জায়েদ বিন হারেস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে সেনাপতি করে জ্বিহাদে পাঠানোর ব্যবস্থা প্রায় সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অসুস্থতার কারণে উনারা যেতে পারেননি। পরবর্তীতে হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম উনাকে পাঠিয়েছিলেন। (৫) মূলতঃ এ কথা কস্মিন কালেও চিন্তা করা যায়না যে, হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনার মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে হজ্ব করতে গিয়ে, হজ্ব সমাপন না করেই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে বের হয়ে যাবেন। কারণ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেদিন বিদায় হজ্বের খুৎবা দেন, সেদিন ছিল আরাফার দিন। আর আরাফার পরও হজ্বের অনেক আহকাম বাদ থাকে। যারা এ ধরণের কথা বলে থাকে, তারা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের নামে মিথ্যা তোহমত দিয়ে থাকে। (সিহাহ সিত্তাহ ও অন্যান্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার কিতাবসমূহ এবং মাদারেজুন নুবুওওয়াত, সীরাতুন্নবী, সীরাতে হালবীয়া, ইবনে হিশাম, যাদুল মায়াদ ইত্যাদি সীরাতসমূহ)
সুতরাং উপরোক্ত আলোনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, প্রলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মিথ্যা, মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তোহমত দেয়ার শামিল, যা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত আক্বীদা ও কথা পরহেজ করা ওয়াজিব।
২৯নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : হযরত মাওলানা জাকারিয়া প্রণীত- তাবলীগ জামায়াতের সমালোচনা ও জবাব ৪৪ পৃষ্ঠায় হযরতজীর মালফূযাত ২২ পৃষ্ঠা মলফূয ২৯ পৃষ্ঠা, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, (লেখক- মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী) ১১৫ পৃষ্ঠার বক্তব্য সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, “প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মাদ্রাসা কিতাবের প্রচার-প্রসার পছন্দ করেনা, খানকা শরীফ সম্পর্কেও ভাল ধারণা রাখেনা এবং মনে করে যে, সেগুলোর দ্বারা কমই ইসলামের খেদমত হয়ে থাকে।” তাদের উপরোক্ত ধারণা বা বক্তব্য কতটুকু কুরআন-সুন্নাহ, ইজমা-ক্বিয়াস সমর্থিত? নির্ভরযোগ্য দলীলের দ্বারা জাওয়াব দানে উপকৃত করবেন।
জাওয়াব : তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত ধারণা বা মন্তব্য ও বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলক ও শরীয়তের খেলাফ। কারণ শরীয়তের মূল বিষয় হচ্ছে- দ্বীনী ইলম। যে ইলম অর্জন করার জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
طلب العلم فريضة على كل مسلم ومسلمة.
অর্থ : “প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ইলম অর্জন করা ফরয।” (বায়হাক্বী শরীফ, মেশকাত, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মোজাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, তা’লীকুছ ছবীহ, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন, আরবাঈন) আর এ ইলম হলো দু’প্রকার। যেটা অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে।
العلم علمان علم فى القلب فذاك علم النافع وعلم على اللسان فذالك حجة الله عزو جل على ابن ادم.
অর্থ : “ইলম দু’প্রকার- (১) ক্বালবী ইলম অর্থাৎ ইলমে তাসাউফ যা উপকারী ইলম। (২) লিসানী ইলম অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ, যা বণী আদম উনাদের জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ হতে দলীল স্বরূপ।” (দারেমী, তারগীব, তারীখ, মিশকাত শরীফ, মেরকাত, আব্দুল বার, দায়লামী, শরহুত ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ) এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মিশকাত শরীফ উনার বিখ্যাত শরাহ “মিরকাত শরীফ” উনার মধ্যে উল্লেখ করেন যে, মালেকী মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
من تفقه ولم يتصوف فقد تفسق ومن تصوف ولم يتفقه فقد تزندق- ومن جمع بينهما فقد تحقق.
অর্থ : “যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো, কিন্তু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ফাসেক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করলো কিন্তু ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করলো না, সে যিন্দিক (কাফের)। আর যে ব্যক্তি উভয়টি শিক্ষা করলো, সে মুহাক্কিক তথা হক্কানী আলিম।”
অর্থাৎ যে ইলমে ফিক্বাহ শিখলো, কিন্তু ইলমে তাসাউফ শিখলোনা, সে হচ্ছে ফাসেক। আর যে বলে আমি মা’রিফাত করি বা ইলমে তাসাউফ করি কিন্তু শরীয়ত বা ফিক্বাহ স্বীকার করেনা, সে হচ্ছে যিন্দীক। আর যিনি উভয়টাই শিক্ষা করলেন, তিনি হচ্ছেন মুহাক্কিক অর্থাৎ হাক্বীক্বী আলেম। কাজেই উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এ কথাই সাবেত হয় যে, সকল মুসলমান পুরুষ ও মহিলার জন্য জরুরত আন্দাজ ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করা ফরজ। শুধু এ ফরজ পরিমাণ ইলম শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবেনা। কেননা ফতওয়া দেয়া হয়েছে যে, ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফে দক্ষতা অর্জন করা ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। এ ফরজে কেফায়াহ যদি আদায় না করা হয়, তাহলে সকলেই ফরজ তরকের গুণাহে গুণাহগার হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قرمهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থ : “কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরকা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে। (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২২)
অতএব, কিছু লোককে অবশ্যই দ্বীনী ইলমে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে হবে, নচেৎ সকলেই ফরজে কেফায়া তরকের গুণাহে গুণাহগার হতে হবে। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফতহুল ক্বাদীর, হাশিয়ায়ে সাবী, খাযেন, বাগবী, কবীর, ইবনে কাছীর, যা’দুল মাছীর, বয়ানুল কুরআন) তাই এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীরে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
كن عالما او متعلما اومستمعا او محبا ولا تكن الخامس فتهلك.
অর্থ : “তুমি আলেম হও অথবা ইলম শিক্ষার্থী হও অথবা শ্রবণকারী হও অথবা মহব্বতকারী হও, পঞ্চম হয়োনা, তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে।” (মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মোজাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, শরহুত ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ) এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা দ্বারা আলেম ও ইলম অন্বেষণকারীদের বিশেষ ফযীলত দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আলেম না হতে পারলে, ইলম অন্বেষণকারী হতে হবে, তা হতে না পারলে আলেমদের কাছে ইলমের কথা শুনতে হবে, আর তাও না পারলে আলেমগণকে মুহব্বত করতে হবে। অন্যথায় হালাকী বা ধ্বংস ছাড়া গত্যন্তর নেই।
প্রকাশ থাকে যে, ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়া হয়- মাদ্রাসা তথা দ্বীনী প্র্রতিষ্ঠানে কিতাবাদীর মাধ্যমে। আর ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করতে হয়- পীর ছাহেবগণের খানকা শরীফে গিয়ে, উনাদের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে, ছোহবত ইখতিয়ারের মাধ্যমে। তবে পীর সাহেবগণ শুধু ইলমে তাসাউফ শিক্ষা দেননা, বরং ইলমে তাসাউফের সাথে সাথে ইলমে ফিক্বাহও শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, যদি মাদ্রাসা না থাকে ও কিতাবাদি প্রচার-প্রসার না করা হয় অথবা খানকা শরীফ না থাকে, যেখানে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ শিক্ষা দেয়া হয় অর্থাৎ পূর্ণ ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষার একশত ভাগই শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে ইলমে দ্বীন কি করে থাকবে? আর ইলমে দ্বীন যদি না থাকে, তাহলে ইসলাম কি করে থাকবে? আর ইসলাম যদি না থাকে, তাহলে কি করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের রেজামন্দী হাছিল করা সম্ভব?
মূলত : রেজামন্দী হাছিল করা তো যাবেই না বরং মুসলমান হওয়াও যাবেনা। আর মাদ্রাসা, কিতাবাদি ও খানকা শরীফ ইত্যাদি দ্বারা (যেখানে পূর্ণ ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষার একশত ভাগই শিক্ষা দেয়া হয়) দ্বীনের খেদমত কম হয়, এ কথাই বা কি করে শুদ্ধ হতে পারে?
কারণ দ্বীন ইসলাম উনার শুরু থেকেই উলামায়ে হাক্কানী-রাব্বানীগণ ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে আসছেন। এই ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতিই পরবর্তীতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে মাদ্রাসায় পরিণত হয়, যার ধারাবাহিকতা তখন থেকে এ পর্যন্ত চলে আসছে। ইলমে তাসাউফ শুরু থেকেই আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা উনাদের খানকা শরীফ উনার মধ্যে শিক্ষা দিয়ে আসছেন, যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে। আর এ যাবত যত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম-মুজতাহিদ হয়েছেন। উনারা সকলেই মাদ্রাসার ওস্তাদ ও খানকা শরীফ থেকে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করে ইমাম-মুজতাহিদ, আওলিয়া, বুজুর্গ এবং মুহাক্কিক ও মুদাক্কিক আলেম হয়েছেন। তাহলে একথা কি করে শুদ্ধ হতে পারে যে, মাদ্রাসা, কিতাবাদি ও খানকা শরীফের মাধ্যমে দ্বীনের খেদমত কমই হয়ে থাকে? অতএব, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উল্লেখিত মন্তব্য ও বক্তব্য দ্বীনী শিক্ষার প্রতি তোহমত ও ইহানতের শামিল, যা সম্পূর্ণরূপে কুফুরীর অন্তর্ভূক্ত।
উল্লেখ্য যে, তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যে ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ করাটাকে ইসলামের ব্যাপক খেদমত বলে ধারণা করে, তা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত। মূলতঃ তা তো সেই মাদ্রাসা ও খানকা শরীফেরই ফল। কেননা উক্ত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের যিনি বাণী বা প্রতিষ্ঠাতা- মাওলানা ইলিয়াস সাহেব, তিনি তো মাদ্রাসাই লেখা পড়া করেছেন এবং মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী সাহেবের হাতে বাইয়াত হয়ে, তাঁর খানকা শরীফে যাতায়াতের মাধ্যমে, ইলমে তাসাউফ চর্চা করে খিলাফত হাছিল করেছিলেন। তদ্রুপ মাওলানা জাকারিয়া সাহেব, যিনি তাবলীগী নেছাব ও অন্যান্য তাবলীগী কিতাবাদি প্রনয়ণ করেছেন, তিনিও মাদ্রাসায় লেখা পড়া শিক্ষা করেছেন এবং মাওলানা খলীল আহমদ সাহরানপুরী সাহেবের হাতে বাইয়াত হয়ে ইলমে তাসাউফ চর্চা করে খেলাফত লাভ করে নিজেই পীর সাহেব হয়েছিলেন এবং লোকদের বাইয়াতও করেছিলেন।
আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত, যার কার্যক্রম মাত্র ৭১ বছর যাবত চলে আসছে। যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত, যদি আক্বীদা শুদ্ধ থাকে। তাহলে এই মক্তবী শিক্ষা দ্বারা ইসলামের কতটুকু খেদমত করা সম্ভব? আর বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের সকল লোকদের জন্যে ওয়াজিব- আক্বীদা শুদ্ধ রেখে মক্তবী শিক্ষা সমাপন করে মাদ্রাসার ওস্তাদের নিকট কিতাবাদি পাঠ করে ও পীর সাহেবগণের খানকা শরীফে গিয়ে কমপক্ষে ইলমে ফিক্বাহ, ইলমে তাসাউফের ফরয পরিমাণ ইলম অর্জন করা ও খালিছ মুসলমান অর্থাৎ মু’মিনে কামিল হওয়া। যেহেতু মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
يا ايها الذين امنوا امنوا.
অর্থ : “হে ঈমানদারগণ ঈমান আন, অর্থাৎ মু’মিনে কামিল হয়ে যাও।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৬)
অন্যথায় ক্বিয়ামত পর্যন্ত প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের মক্তবী শিক্ষায় রত থাকলেও কখনই পরিপূর্ণ মুসলমান বা মুমিনে কামেল হওয়া সম্ভব নয়। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, “মাদ্রাসা ও খানকা শরীফ দ্বারা দ্বীনের খেদমত কমই হয়” প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্য বা ধারণা সম্পূর্ণই মিথ্যা, যা বিভ্রান্তিকর, অবান্তর ও অজ্ঞতামূলক, শরীয়তের খেলাফ। এ ধরণের বক্তব্য বা ধারণা ত্যাগ করা সকলের জন্যই অবশ্য কর্তব্য।
৩০নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী লিখিত “তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব” নামক কিতাবের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, লক্ষাধিক সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণের মধ্যে অধিকাংশই মূর্খ ছিলেন। (অনুরূপ শরীয়তের দৃষ্টিতে তাবলীগী নেছাব, যার মূল হযরত জাকারিয়া প্রণীত- ১৩ পৃষ্ঠা, তাবলীগী জামায়াতের প্রধানের তর্ক ও ইচ্ছা নামক কিতাবের ৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে)
এখন আমাদের সুওয়াল হলো, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সম্পর্কে উপরোক্ত কিতাবের উক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে এর ফায়সালা কামনা করি।
জাওয়াব : হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে মূর্খ বলা শক্ত হারাম ও কুফরী। মূর্খ শব্দটি হচ্ছে- একটি অশালীন শব্দ ও গালি, যা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের শান মুবারক উনার সম্পূর্ণই খিলাফ। মূলতঃ এরূপ শব্দ উনাদের শান মুবারকে ব্যবহার করা, উনাদেরকে ইহানত করার শামিল। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ولا تلمزوا انفسكم ولا تنابزوا بالالقاب. بئس الاسم الفسوق بعد الايمان ومن لم يتب فاولئك هم الظالمون.
অর্থ : “তোমরা পরষ্পর পরষ্পরকে দোষারোপ করোনা এবং পরষ্পর পরষ্পরকে অশোভনীয় লক্বব (উপাধি) দ্বারা সম্বোধন করোনা। (কেননা) ঈমান আনার পর অশ্লীল নাম দ্বারা ডাকা গুণাহ এবং যারা এটা হতে তওবা করলো না তারা জালিমের অন্তর্ভূক্ত।” (পবিত্র সুরা হুজরাত শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১১) উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাদের একে অপরকে দোষারোপ করতে এবং অশ্লীল, খারাপ শব্দ দ্বারা সম্বোধন করতে নিষেধ করেছেন। আর এও বলেছেন যে, ঈমান গ্রহণের পর খারাপ নামে সম্বোধন করা গুণাহের কাজ। (খাযেন, বাগবী, ইবনে কাছীর, ইবনে আব্বাস, কাদেরী, হুসায়নী, মাজহারী, কামালাইন, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান ইত্যাদি সকল তাফসীর সমূহ)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
لا تسبوا اصحابى فلو ان احدكم انفق مثل احد ذهبا ما بلغ مد احدهم ولا نصيفه.
অর্থ : “আমার হযরত সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে তোমরা গালী দিওনা, আমার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা এক মুদ বা অর্ধ মুদ গম মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় দান করে যে ফযীলত অর্জন করেছেন, তোমরা উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করেও তার সমান ফযীলত হাছিল করতে পারবে না।” (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মোজাহেরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, ইত্যাদি)
এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে গালী দেয়াকে সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করে দিয়েছেন। উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, হযরত ছাহাবোয়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে কোন অবস্থাতে গালী দেয়া তো যাবেইনা বরং কোন প্রকার অশোভণীয়, অপছন্দনীয় শব্দ দ্বারাও সম্বোধন করা যাবেনা। এরূপ করলে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কষ্টের কারণ হবে। আর যে তা করবে, সে লা’নতের উপযুক্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ان الذين يؤذون الله ورسوله لعنه الله فى الدنيا والاخرة واعد لهم عذابا مهينا.
অর্থ : “নিশ্চয় যারা মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদেরকে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ থেকে অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৭)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
الله الله فى اصحابى لا تتخذوا هم غرضا من بعدى فمن احبهم فبحبى احبهم ومن ابغض هم فببغضى ابغضهم من اذى هم فقد اذا نى ومن اذانى فقد اذى الله ومن اذى الله يوشك ان ياخذه.
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর, মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর, আমার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সম্পর্কে। আমার পরে উনাদেরকে তিরস্কারের লক্ষ্যস্থল করোনা। উনাদেরকে যারা মুহব্বত করলো, তা আমাকে মুহব্বত করার কারণেই। এবং উনাদের প্রতি যারা বিদ্বেষ পোষণ করলো, তা আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার কারণেই। উনাদেরকে যারা কষ্ট দিল, তারা আমাকেই কষ্ট দিল। আর আমাকে যারা কষ্ট দিল, তারা মহান আল্লাহ পাক উনাকেই কষ্ট দিল। আর যারা মহান আল্লাহ পাক উনাকে কষ্ট দিল, তাদেরকে মহান আল্লাহ পাক তিনি অতি শিঘ্রই পাকড়াও করবেন।” (বোখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, মেশকাত, মেরকাত, মোজাহেরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহে তিবী, মিরয়াতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে গালী-গালাজ করা, তিরষ্কারের লক্ষ্যস্থল করা ইত্যাদি সবকিছুই নাজায়েয, হারাম, কুফরী ও লা’নতের কারণ। কাজেই প্রত্যেক হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রতি সুধারণা ও সঠিক আক্বীদা পোষণ করা এবং উনাদেরকে মুহব্বত করা ঈমানের অঙ্গ। কারণ মহান আল্লাহ পাক স্বয়ং হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার একাধিক স্থানে বলেন,
رضى الله عنهم ورضوا عنه.
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের উপর সন্তুষ্ট, উনারাও মহান আল্লাহ পাক উনার উপর সন্তুষ্ট।” (পবিত্র সূরা মাযিদা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৯, পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১০০, পবিত্র সূরা ফাতাহ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১৮, পবিত্র সূরা বাইয়্যিনাহ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮)
আর তাই হযরত ইমামে আযম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি, উনার বিশ্ব বিখ্যাত আক্বাইদের কিতাবে উল্লেখ করেন,
لا نذكر احدا من اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم الابخير.
অর্থ : “আমরা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রত্যেক হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে সুধারণার সাথে স্মরণ করি।” (ফিক্বহুল আকবর)
মূলত : সকল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমই দ্বীন সম্পর্কে গভীর ইলমের অধিকারী ছিলেন। তাই পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অসংখ্য স্থানে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনুসরণ করাকে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের পূর্ব শর্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা সর্বজন স্বীকৃত যে, মূর্খ লোক কখনো অনুসরণীয় ও মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম হতে পারেনা। এখানে উল্লেখ্য যে, পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রত্যেকেই গভীর ইলমের অধিকারী ছিলেন, যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে,
عن عبدا لله بن مسعود قال- من كان مستنا فليستن بمن قدمات فان الحى لا تؤمن عليه الفتنة اولئك احاب محمد صلى الله عليه وسلم كانوا افضل هذه الامة- ابرها قلوبا واعمقها علما راقلها تكلفا- اختارهم الله لصحبة بيه ولا قامة دينه- فاعرفوالهم فضلهم واتبعوا على اثرهم وتمسكوا بما استطعتم من اخلاقهم وسيرهم فانهم كانوا على الهدى المستقيم.
অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, “যে ব্যক্তি শরীয়তের সঠিক তরীকা অনুসরণ করতে চায়, তার উচিত যাঁরা অতীত হয়েছেন, অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রিয় হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনুসরণ করা। কেননা জীবিত লোকেরা ফিৎনা হতে নিরাপদ নয়। আর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারাই উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম, উনারা আত্মার দিক দিয়ে অধিক পবিত্র, ইলমের দিক দিয়ে গভীর ইলমের অধিকারী, উনারা লোক দেখানো কোন আমল করতে জানেন না। মহান আল্লাহ পাক উনাদেরকে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথী হিসাবে মনোনীত করেছেন।
সুতরাং উনাদের মর্যাদা-মর্তবা, ফাযায়িল-ফযীলত, শান-শওকত সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং উনাদের কথা ও কাজের অনুসরণ করা এবং যথাসম্ভব উনাদের সীরত-ছূরতকে গ্রহণ করা, কারণ উনারা হিদায়েত ও “সিরাতুম মুস্তাক্বীম” উনার উপর দৃঢ় ছিলেন।” (রযীন, মেশকাত, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত্ব ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, তা’লীকুছ, ছবীহ)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, “হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা গভীর ইলমের অধিকারী।” আর তাবলীগ ওয়ালারা বলছে, উনাদের মধ্যে অনেকেই মূর্খ ছিলেন। তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বিপরিত, যা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের পক্ষে কি করে মুর্খ থাকা সম্ভব হতে পারে? যেখানে সাধারণ মানুষ যখন মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী হন, তখন উনার পক্ষে মূর্খ থাকা সম্ভব হয়না। কারণ তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে খোদায়ী ইলম বা ইলমে লাদুন্নী প্রাপ্ত হয়ে আলেম হন। এর হাজারো উদাহারণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হযরত আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি। যিনি প্রথম জীবনে কোথাও তেমন লেখাপড়া করেননি এবং ক্ষেত-খামারে কাজ করে দিন যাপন করতেন। কিন্তু উনার ভিতরে মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত থাকার কারণে তিনি প্রতিদিন ইশার ওয়াক্তে সুলতানুল আরেফীন, হযরত বায়েযীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাজার শরীফে গিয়ে সারা রাত্র অবস্থান করে যিকির-আযকার, মোরাকাবা-মোশাহাদা ইত্যাদিতে সময় কাটাতেন। আর দোয়া করতেন, “আয় মহান আল্লাহ পাক! আপনার ওলী, সুলতানুল আরেফীন, হযরত বায়েযীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার খাঞ্চা থেকে আমাকে উনার উসীলায় কিছু নিয়ামত দান করুন। এভাবে প্রায় বিশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। যেদিন বিশ বছর পুরো হলো, সেদিন যখন তিনি বাড়ী ফিরছিলেন, তখন মাজার শরীফে বিকট এক আওয়াজ হলো। তিনি মাজার শরীফের দিকে লক্ষ্য করলেন যে, মাজার শরীফ দু’ভাগ হয়ে তার মাঝে একজন নূরানী ছূরতের লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তাকে নিজের দিকে ডাকলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কি?” তিনি বললেন, “আবুল হাসান।” “থাক কোথায়?” “খারকান শহরে।” “কি কর?” “ক্ষেত-খামারে কাজ করি।” “এখানে কি কর?” “এখানে প্রতিদিন ইশার পরে আসি, মাজার শরীফ যিয়ারত করি, কিছু যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল ও দোয়া পাঠ করি, অতঃপর ফযর নামায পড়ে চলে যাই।” “কি বল এখানে তুমি?” আমি এখানে বলি, “মহান আল্লাহ পাক! আপনার ওলী সুলতানুল আরেফীন, হযরত বায়েযীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি এখানে শায়িত আছেন, উনার উসীলায় আমাকে কিছু নিয়ামত দান করুন।” “এভাবে কতদিন হলো?” “আজকে প্রায় ২০ বৎসর।” শুনে নূরানী ছূরতধারী ব্যক্তি আশ্চার্যাম্বিত হয়ে বললেন, “বিশ বছর!” অতঃপর নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “আমিই হযরত বায়েযীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি।” এরপর তিনি নিজের হাত মুবারক দিয়ে উনার পিঠের মধ্যে আস্তে করে থাপ্পর দিয়ে বললেন- “যাও, আমিও সুলতানুল আরেফীন, আর আজ থেকে তুমিও সুলতানুল আরেফীন।” (সুবহানাল্লাহ) (তাজকেরাতুল আওলিয়া)
এ ঘটনার পর হযরত আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বাড়ী ফিরে আসলেন এবং এরপরে আস্তে আস্তে করে উনার ভেতরে ইলমে লাদুন্নীর মাধ্যমে উনার ইলম বৃদ্ধি পেতে লাগলো। এভাবে আস্তে আস্তে তিনি আল্লাহর খালেছ ওলী হয়ে গেলেন এবং পরবর্তীতে লোকজনকে বাইয়াত করাতে লাগলেন। এদিকে সে এলাকায় ছিল একটা বড় মাদ্রাসা। সেখানে কিছু ওলামায়ে হক্ব ছিলেন। উনারা মনে মনে চিন্তা করলেন- আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তো কোন লেখাপড়া জানতেন না, তিনি লোক বাইয়াত করান, উনাকে একটু পরীক্ষা করতে হবে। এজন্য উনারা একশটা মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করার জন্য রওনা হলেন। তখন আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ঘরের বারান্দায় পায়চারী করতে ছিলেন। ঘরের সামনে ছিল একটা বাগান, আর বাগানের মধ্যে একজন মালি কাজ করছিল। যখন সেই সমস্ত আলেম সম্প্রদায় মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করার জন্য আসছিলেন, হযরত আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি সেই মালীর প্রতি একটা দৃষ্টি দিলেন। দৃষ্টি দেয়ার সাথে সাথে মালি মস্তান হয়ে গেল, মজ্জুব হয়ে গেল। সে লাফাতে লাগলো। লাফাতে লাফাতে বলতে লাগলো, হুযূর বেয়াদবী মাফ করবেন। এই যে আলেম সম্প্রদায় আসছেন, উনারা আপনাকে মাসয়ালা জিজ্ঞাসা করবেন। আপনি কি জবাব দিবেন, আমিই জবাব দিয়ে দেই। সেই মালি এক এক করে সেই একশ’জন আলেমের নাম বলে উনাদের মাসয়ালার জবাব বলে দিলেন। (সুবহানাল্লাহ) তখন সেই সমস্ত আলেম তাঁর কাছে গিয়ে বাইয়াত হয়ে গেলেন। (সুবহানাল্লাহ) (তাজকেরাতুল আওলিয়া)
বর্ণিত ঘটনা সাপেক্ষে দু’টি বিষয় বিশেষভাবে ফিকিরযোগ্য যে, আবুল হাসান খারকানী রহমতুল্লাহি আলাইহি যেমন ওলী আল্লাহ উনার ছোহবতের কারণে ইলমে লাদুন্নী প্রাপ্ত হয়ে ছিলেন, তেমনি উনার নেক দৃষ্টির কারণে বা ছোহবতের কারণে উনার বাগানের মালীও ইলমে লাদুন্নী প্রাপ্ত হয়ে, গভীর ইলমের অধিকারী হয়ে, আলেম সম্প্রদায়ের একশত মাসয়ালার সঠিক, সম্পূর্ণ ও উত্তম জবাব দিয়েছিলেন। সুতরাং এখানে প্রশ্ন দাড়ায়, ওলী আল্লাহ উনার ছোহবতের কারণেই যদি ইলমে লাদুন্নী প্রাপ্ত হয়ে আলিম হওয়া যায়, তবে হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা কি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ছোহবত পেয়ে ইলমে লাদুন্নী প্রাপ্ত হননি? অবশ্যই হয়েছেন, বরং উনারা দ্বীনের গভীর ইলম অর্জন করে উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ও অশেষ ফযীলত অর্জন করেছেন। বস্তুতঃ উনাদের হাক্বীক্বী ফযীলত না জানার কারণেই উনাদের শানে এরূপ কথা বলে থাকে। হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে যে মহান আল্লাহ পাক কত ফযীলত দান করেছেন, তা নিন্মোক্ত বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
আমীরুল মু’মিনীন ফিল হাদীছ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে,
ايما افضل معاوية او عمربن عبدالعزيز فقال والله لغبارالذى دخل انف فرس معاويه مع رسول الله صلى الله عليه وسلم- خير من مأة واحد مثل عمربن عبدالعزيز (فتاوى حديثية(
অর্থ : হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শ্রেষ্ঠ, না হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি শ্রেষ্ঠ? তিনি বলেন, খোদার কছম! হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু যখন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে ঘোড়ায় চড়ে জ্বিহাদে যেতেন, তখন ঘোড়ার নাকে যে ধুলাবালিগুলো প্রবেশ করতো, সে ধুলাবালিগুলোও শত শত হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। (ফতওয়ায়ে হাদীসিয়াহ)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সকলেই অশেষ ও গভীর ইলমের অধিকারী ছিলেন। অর্থাৎ প্রত্যেকেই দ্বীনের প্রকৃত আলেম ছিলেন। উনাদের কোন একজনকেও মূর্খ বলা, পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বিরোধিতারই শামিল, যা সম্পূর্ণই হারাম, নাজায়েয ও কুফরী।
অতএব, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের জন্য ওয়াজিব হবে- হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের প্রতি অশালীন শব্দ প্রয়োগ করা ও কুফরী ধারণা পোষণ করা থেকে বিরত থাকা।
৩১নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা আরো বলে থাকে যে, টঙ্গীর ইজতেমায় অনেক বেশী লোক হয়, তাই নামাজে বড় জামায়াত হয়। আর বড় জামায়াতের ফযীলত বেশী এবং সেই উদ্দেশ্যও টঙ্গীর ইজতেমায় হাজির হওয়া উচিৎ।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শুদ্ধ? আর বড় জামায়াতের উদ্দেশ্যে নামাজের জন্যে যাওয়া শরীয়ত সম্মত কিনা নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লা দ্বারা জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা সম্পূর্ণই শরীয়তের খিলাফ। কারণ কোথায় নেকী বেশী হবে বা কোথায় ফযীলত বেশী হবে, সে বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিই বেশী অবগত। যার কারণে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
وما التاكم الرسول فخذوه ونهاكم عنه فانتهوا واتقوا اله ان الله شديد العقاب.
অর্থ : “আমার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা এনেছেন বা বলেছেন, তা আঁকড়িয়ে ধর, আর যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তা থেকে বিরত থাক, অন্যথায় নিশ্চয়ই আল্লাহ পাক কঠিন শাস্তিদাতা।” (পবিত্র সুরা হাশর শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)
আর কোন মসজিদে বা কোন স্থানে যাওয়া যাবে বা যাবেনা কোথায় গেলে ফযীলত বেশী পাওয়া যাবে, সে প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে হযরত আবু সাঈদ খুদরী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
لا تشد الرحال الا الى ثلاثة مساجد مسجد الحرام ومسجد الاقصى ومسجدى هذا.
অর্থঃ- “তিন মসজিদ ছাড়া সফর করোনা, মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আক্বসা ও আমার এই মসজিদ।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুলকারী, এরশাদুস সারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মেরকাত, লুমআত, আশয়াতুল লুময়াত, তালীকুছ ছবীহ, শরহুত ত্বীবী ইত্যাদি)
আর এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে যে, “ক্বাবা শরীফ উনার মধ্যে নামায পড়লে এক রাকায়াতে এক লক্ষ রাকায়াতের সওয়াব, মসজিদে নববী শরীফ ও মসজিদে আক্বসা শরীফ উনাদের মধ্যে ৫০ হাজার রাকায়াতের সওয়াব পাওয়া যায়।” (ইবনে মাজাহ, মেশকাত মেরকাত, মোজাহেরে হক্ব, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, মিরআতুল মানাজীহ)
উল্লেখ্য এই তিন মসজিদ ছাড়া পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো একটি মসজিদের বিশেষ ফযীলতের কথা বলা হয়েছে, তাহলো মসজিদে ক্বোবা। জমহুর ওলামাদের মতে তাক্বওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ হিসেবে ক্বোবাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সর্বপ্রথম যে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন, তাহলো মসজিদে ক্বোবা। এই মসজিদের ফযীলত সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে- “মসজিদে ক্বোবায় নামায পড়লে উমরার ফযীলত পাওয়া যায়।” এই মসজিদের ফযীলত সম্পর্কে হযরত ছায়াদ ইবনে আক্কাছ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “বায়তুল মুকাদ্দাসে দু’বার যাওয়ার চেয়ে ক্বোবার মসজিদে দু’রাকায়াত নামায পড়া আমার নিকট অতি প্রিয়।”
আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে, “লোকজন যদি জানত যে, ক্বোবাতে কি ফযীলত রয়েছে, তবে তারা অবশ্যই সেখানে যেত।” (ফতহুল মুলহিম) আর তাই সওয়াবের নিয়তে উপরোক্ত তিন মসজিদ এবং মসজিদে ক্বোবা সফর করার আদেশ আছে। এছাড়া পৃথিবীর সকল জামে মসজিদে পাঁচশত রাকায়াত, পাঞ্জেগানা মসজিদে পঁচিশ বা সাতাশ রাকায়াত, এছাড়া দুনিয়ার সমস্ত স্থানে এক রাকায়াতে এক রাকায়াত ফযীলত। তাহলে উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, অধিক সওয়াব বা ফযীলত হাছিলের উদ্দেশ্যে বর্ণিত মসজিদসমূহ ছাড়া অন্য কোন স্থানে বড় জামায়াতে শামিল হওয়ার জন্য যাওয়া বা সফর করা জায়েয নেই। আর এরূপ সফরে গেলে তা স্পষ্টতঃ মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদেশকে অমান্য করা হবে এবং গুণাহের কারণ হবে। উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, “ফযীলতের জন্য তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও সফর করা যাবেনা।” আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলছে, টঙ্গীতে ফযীলতের জন্য সফর করা যাবে। তাহলে এখন কার কথা মান্য করা উচিৎ?
অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত কথা পরহেজ করা ওয়াজিব। কারণ তা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুকুমের খিলাফ। যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে শাস্তির কারণও বটে।
৩২নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : হযরতজীর মলফূজাত, পৃষ্ঠা-৪৭, ৫০নং মলফুয, শরীয়তের দৃষ্টিতে তাবলীগী নেছাব পৃষ্ঠা ১৫, হযরতজী ইনয়ামের তর্ক ও বাহাছ পৃষ্ঠা ১২, তাবলীগ পরিচয় পৃষ্ঠা ১৭, তাবলীগ দর্পণ পৃষ্ঠা ৬২ ইত্যাদি কিতাব সমূহের বর্ণনা অনুযায়ী ইলিয়াস সাহেব বিশেষ স্বপে¦র মাধ্যমে এ তাবলীগের নির্দেশ পেয়েছেন। আবার কারো কারো মতে হিন্দু জমিদারদের কারণে মুসলমানগণ প্রায় হিন্দু হয়ে পড়লে, ইলিয়াস সাহেব এ তাবলীগের উদ্যোগ নেন। তাবলীগের কাজ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর ইলিয়াস সাহেবই পূনরুজ্জীবিত করেন।
উপরোক্ত বক্তব্য বা বিবৃতি কতটুকু শরীয়ত সম্মত ও বিশুদ্ধ?
জাওয়াব : উল্লেখ্য ইলিয়াস সাহেব যদি স্বপ্নের মাধ্যমে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কাজের নির্দেশ পেয়ে থাকেন, তবে তা তার জন্য নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার হিসেবে গণ্য হবে, যা অপরের জন্য আদৌ দলীল নয়। কারণ স্বপ্ন আরেকজনের জন্য দলীল নয়, এর উপরই ফতওয়া। আর ইলিয়াস সাহেব যদি তার এলাকার মুসলমানের দুরাবস্থার কারণে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কাজের ব্যবস্থা করে থাকেন, তবে তাও তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ মাত্র। কিন্তু যখনই বলা হবে যে, তাবলীগের কাজ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর ইলিয়াস সাহেবই পূনরুজ্জীবিত করেছে, তবে তা হবে সম্পূর্ণই অশুদ্ধ, নাজায়েয ও কুফরী। কারণ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানায় প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের কোন অস্তিত্বই ছিলনা। বরং তা মাওলানা ইলিয়াস সাহেব কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি বিদয়াত বা নতুন উদ্ভাবিত পন্থা। সুতরাং তার পুনরুজ্জীবনের কোন প্রশ্নই আসেনা।
উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি করেছেন পরিপুর্ণ দ্বীন ইসলাম উনার তাবলীগ। যার অর্ন্তভূক্ত ছিল সম্পূর্ণ শরীয়ত তথা ইলমে ফিক্বাহ, ইলমে তাসাউফ, দাওয়াত, তাবলীগ, জ্বিহাদ, হুকুমাত ইত্যাদি সব কিছুই। অতএব ইলিয়াস সাহেব যে তাবলীগ করেছেন, তা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যে তাবলীগ করেছেন তার পূনরুজ্জীবন তো নয়ই, এমনকি তার পূর্ণ অনুসরণ পর্যন্ত নয়। আরো উল্লেখ্য যে, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তাবলীগ করেছেন, তার অনুসরণ পূর্ণভাবে করেছেন- হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম থেকে শুরু করে তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমাম-মুজতাহিদ ও প্রত্যেক যামানার আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা।
মূলতঃ তাবলীগের কাজ কোনদিনই থেমে থাকেনি। হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম থেকে শুরু করে আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের ধারাবাহিকতায় অতীতেও চলেছে এবং এখনও চলছে, এর বিরতি কোনদিনই হয়নি। অতএব যে কাজের গতিধারা সবসময়েই প্রবাহমান বা বিরাজমান, তার আবার পূনরুজ্জীবন কি করে হতে পারে? তাই কেউ যদি বলে যে, ইলিয়াস সাহেব নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরে তাবলীগের পূনরুজ্জীবন দান করেছেন, তাহলে সে কথা কুফরী হবে। কারণ এ কথার অর্থ তাহলে এই দাঁড়ায় যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিও প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ করেছেন। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের তর্জ-তরীক্বা মাত্র ৭১ বছর পূর্বে উদ্ভাবন করা হয়েছে। কাজেই তাদের এ বক্তব্য নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নামে মিথ্যারোপ করার শামিল, যা স্পষ্টতঃ কুফরী। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
من كذب على متعمدا فاليتبؤا مقعده من النار.
অর্থ : “যে স্বেচ্ছায় আমার নামে মিথ্যা কথা বলে, সে যেন দুনিয়ায় থাকতেই তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মেশকাত, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, উরফূশ শাজী, তুহফাতুল আহওয়াজী, মা’য়ারেফুস সুনান)
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরে ইলিয়াস সাহেব তাবলীগ পূনরুজ্জীবিত করেছে, এই কথা যদি বলা হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে যে, হযরত খোলাফায়ে রাশেদীন আলাইহিমুস সালাম, হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমাম-মুজতাহিদ, মুজাদ্দিদ, আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের কি দ্বীনের প্রচার-প্রসার, তা’লীম-তালক্বীন, দাওয়াত- তাবলীগ, দর্স-তাদরীস, ইজতিহাদ-তাজদীদ, জ্বিহাদ, হুকুমত পরিচালনা ইত্যাদি করেননি? অথচ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
ان الله يبعث لهذه الامة على رأس كل مائة سنة من يجدد لها دينها.
অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি প্রত্যেক হিজরী শতকের শুরুতে এই উম্মতের (ইসলাহর) জন্য একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন, যিনি দ্বীনের তাজদীদ করবেন।” (আবূ দাউদ, বজলুল মাজহুদ, মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তা’লীকুছ ছবীহ, আশয়াতুল লুময়াত)
প্রদত্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার প্রেক্ষিতে তাহলে এ যাবত যাঁরা মুজাদ্দিদ হিসেবে এসেছেন, উনারা কি তাজদীদ-ইজতিহাদ, তাবলীগ ও দাওয়াতের কাজ করেননি? মূলতঃ উনারা সকলেই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুতাবেক বর্ণিত দ্বীনের দাওয়াত বা কার্যাবলী যথাযথভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন।
অতএব, কি করে এটা বলা যেতে পারে যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরে ইলিয়াস সাহেব তাবলীগ পুনরুজ্জীবিত করেছেন। বস্তুতঃ তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর, কল্পনাপ্রসূত ও কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত আক্বীদা পোষণ করা হতে বিরত থাকা ওয়াজিব।
৩৩নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : “দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন” (লেখক- ওবায়দুল হক) নামক কিতাবের ৪৮ ও ৪৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, তাবলীগের কাজ করার কারণেই মাত্র দশ হাজার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মাজার শরীফ পবিত্রু মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ উনার মধ্যে আছে। উল্লেখ্য প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকও এই কথা বলে থাকে।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বিশুদ্ধ দলীলের দ্বারা জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : তাদের এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এর দ্বারা ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য দ্বীনের খেদমত করতে হবে সততার সহিত। ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে দ্বীনের খেদমত করলে, প্রকৃতপক্ষেই তা দ্বীনের খেদমত হবেনা বরং তা মিথ্যার মত হারাম কাজ প্রচার-প্রসারেই সাহায্য করা হয়। তাদের পরিণতি সম্পর্কে পবিত্র মি’রাজ শরীফ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে- হযরত জীব্রাইল আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আপনি যে ব্যক্তিকে দেখেছেন যে, তার গাল কর্তন করা হচ্ছে, সে মিথ্যাবাদী। যে এমন অমূলক কথা প্রচার করতো যে, তা তার দ্বারা প্রচারিত হয়ে পৃথিবীর প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছতো। (বোখারী, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস সারী, তাইসীরুল ক্বারী) কারণ নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী মদীনা শরীফের জান্নাতুল বাক্বীতেই কেবল দশ হাজার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মাজার শরীফ রয়েছে। (তারীখে মদীনাতুল মুনাওওয়ারা) এরপর পবিত্র মক্কা শরীফ উনার জান্নাতুল মুয়াল্লাতে বেশ কয়েক হাজার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মাজার শরীফ রয়েছে। (তারীখে মক্কাতুল মোকাররমাহ)
উল্লেখ্য, নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত মোতাবেক মোট হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সংখ্যা ছিল প্রায় সোয়া লক্ষ। আর ৮ম হিজরীতে পবিত্র মক্কা শরীফ বিজয়ের সময় হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। তবে উনারা কেবল পবিত্র মদীনা শরীফ উনার অধিবাসীই ছিলেন না, আশে-পাশের বহু এলাকারও অনেক হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম ছিলেন। বিশেষ করে বিদায় হজ্বের সময় প্রায় সোয়া লক্ষ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উপস্থিত ছিলেন এবং উনারা আবিসিনিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, মিশর, ইরাক ও পৃথিবীর অন্যান্য বহু স্থান থেকে এসে বিদায় হজ্বে শরীক হন। এবং হজ্ব সমাপনের পর প্রত্যেকেই তাঁদের গন্তব্য স্থলের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। (সীরাত কিতাব সমূহ)
হ্যাঁ একথা ঠিক যে, হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও তাবলীগ করেছেন। তবে উনাদের তাবলীগ আর বর্তমানে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের মধ্যে আসমান-যমীন ফারাক (পার্থক্য) বিদ্যমান। কারণ উনাদের তাবলীগের অন্তর্ভূক্ত ছিল সম্পূর্ণ ইসলাম। সে হিসেব মতে বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগের লোকেরা যৎসামান্য মাত্র শিক্ষা দিয়ে থাকে, যা কেবল মক্তবী শিক্ষার সাথেই তুলনীয়।
উল্লেখ্য যে, ৬ষ্ঠ হিজরী থেকে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বা দেশে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে প্রতিনিধি বা দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে এবং সেখানে শর্তারোপ করেছিলেন তিনটি। যথা-(ক) ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ, (খ) আনুগত্যতা স্বীকার করে জিযিয়া কর প্রদান, (গ) অন্যথায় জ্বিহাদের মোকাবেলা। অর্থাৎ হয় ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করে মুসলমান হওয়া অথবা জিজিয়া কর দিয়ে ইসলামী খেলাফতের নিরাপত্তালাভী বাসিন্দা হওয়া। আর এ দু’টো শর্তের কোনটি গ্রহণ বা করলে জ্বিহাদের জন্য প্রস্তুত হওয়া।
বর্ণিত ক্ষেত্রে যাঁরা ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন, তাঁদের তা’লীম-তালক্বীনের জন্য নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে প্রেরণ করেছেন।
আবার যারা আনুগত্যতা স্বীকার করে জিযিয়া কর প্রদান করেছে, তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্যও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে পাঠিয়েছেন। আর জ্বিহাদের ফলে বিজিত অঞ্চলে হুকুমত বা প্রশাসন পরিচালনার জন্য নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে প্রেরণ করেছেন। এবং পরবর্তীতে তাদের তা’লীম-তালক্বীনের জন্যও হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে প্রেরণ করেছেন।
এর পরবর্তীতে হযরত খোলাফায়ে রাশেদীন আলাইহিমুস সালাম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এই সুন্নত জারী রেখেছিলেন এবং সেই সুন্নত মোতাবেক পরবর্তীতে তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, ইমাম-মুজতাহিদ, আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা দ্বীনের খেদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও দিবেন। যার নজীর আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের মাজার শরীফ দেখতে পাই। যাঁরা দ্বীনের খেদমতের আঞ্জাম দিতে গিয়ে সেখানে ইন্তেকাল করেছেন এবং তাঁদের মাজার শরীফও সেখানে রয়ে গেছে।
উদাহারণ স্বরূপ পাক ভারত উপমহাদেশের কথাও যদি আমরা ধরি, তাহলে দেখতে পাই, এদেশে অসংখ্য আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের মাজার শরীফ প্রায় প্রত্যেক এলাকাতেই রয়েছে।
যেমন- (১) পাকিস্তানের লাহোরে রয়েছে, দাতা গঞ্জে বখশ রহমতুল্লাহি আলাইহি। (২) ভারতের আজমীরে রয়েছে, হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী সানজীরি রহমতুল্লাহি আলাইহি। (৩) রাজশাহীর হযরত শাহ মখদুম রহমতুল্লাহি আলাইহি। (৪) সাভারে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ছেলে হযরত হুসসামুদ্দীন রহমতুল্লাহি আলাইহি। (৫) ঢাকায় হযরত শরফুদ্দীন চিশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি। (৬) খুলনার হযরত খানজাহান আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি। (৭) সিলেটের হযরত শাহ জালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি। (৮) পীর ইয়ামেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি। (৯) বগুড়ায় হযরত ইব্রাহীম বলখী রহমতুল্লাহি আলাইহি। (১০) হযরত শাহ আলী বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি। (১১) চট্টগ্রামের নূর মুহম্মদ নিজামপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও বারো আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি। (১২) বাংলাদেশের রংপুরে হযরত কারামত আলী জৌনপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পবিত্র মাজার শরীফ। উনারা প্রত্যেকেই দ্বীনের পূর্ণ আঞ্জাম দিয়েছেন, জ্বিহাদ করেছেন, মানুষকে তা’লীম-তালক্বীন দিয়েছেন, ইলমে ফিক্বাহ-তাসাউফ উভয়টিই শিক্ষা দিয়েছেন। এমনকি ইসলামী আইন প্রনয়ন তথা প্রশাসনও চালিয়েছেন।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেভাবে দ্বীনের আঞ্জাম দিয়েছেন বা তাবলীগ করেছেন, প্রকৃতপক্ষে আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারাও সেভাবে দ্বীনের আঞ্জাম দিয়েছেন বা তাবলীগ করেছেন। এবং বর্তমানেও যাঁরা রয়েছেন, উনারাও একইভাবে দ্বীনের আঞ্জাম দিচ্ছেন বা তাবলীগ করছেন।
আর এভাবে করলেই হাক্বীক্বী তাবলীগের হক্ব আদায় হবে। পক্ষান্তরে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ করলে কস্মিনকালেও হাক্বীক্বী তাবলীগের হক্ব আদায় হবেনা।
অতএব, প্রমাণিত হয় যে, পবিত্র মক্কা শরীফ ও পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে দশ হাজারের চেয়ে অনেক অনেক বেশী হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের পবিত্র মাজার শরীফ রয়েছে। আর হযরত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম জ্বিহাদ বা তাবলীগের জন্য অন্যত্র গিয়েছেন এবং অন্য স্থানেও উনাদের মাজার শরীফ রয়েছে। কিন্তু উনারা যে তাবলীগী কাজের জন্য বেরিয়েছিলেন, তা প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের জন্য নয় বরং যা ছিল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত অনুযায়ী দ্বীনের পূর্ণ তাবলীগ। যা পরিপূর্ণ ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফের গুণে গুণান্বিত হয়ে উনারা করতেন। আর সে ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত হাক্বীক্বীভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ অর্থাৎ হক্ব ওলী আল্লাহগণ।
সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও ইতিহাস বিকৃতির অন্তর্ভুক্ত। এ ধরণের লেখা বা বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা সকলের জন্যেই অপরিহার্য্য।
৩৪নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মনে করে যে, তাদের প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের অনুসরণ করা উচিৎ, কেননা তারা বড় জামায়াত। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে যে, “তোমরা বড় জামায়াতের অনুসরণ কর।”
তাদের এ বক্তব্য কতটুকু বিশুদ্ধ ও শরীয়ত সম্মত? আর অনুসরণীয় কারা? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা-ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : উল্লিখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দোহাই দিয়ে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা প্রচার করা সম্পূর্ণই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অপব্যাখ্যা। কারণ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন এই পবিত্র হাদীছ শরীফ বলেছেন, তখন থেকে শুরু করে মাত্র ৭১ বছর পুর্ব পর্যন্ত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কোন অস্তিত্বই ছিলনা। তাহলে কি মধ্যবর্তী প্রায় ১৩০০ বছর যাবত কোন বড় জামায়াত ছিলনা? আর যদি থেকেও থাকে, তবে কি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রবর্তনের পর সেই বড় জামায়াতের সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্তি ঘটেছে? (নাউযুবিল্লাহ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
اتبعوا سواد الاعظم.
অর্থ : “তোমরা বড় দলের অনুসরণ করো।” (মেশকাত, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, তা’লীকুছ ছবীহ)
উল্লেখ্য, উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা বর্ণিত আছে ইবনে মাজাহ শরীফ উনার মধ্যে। এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লোমায়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, মোজাহেরে হক্ব ইত্যাদি কিতাবে বলা হয়েছে যে, বড় জামায়াত হলো- আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
ما انا عليه واصحابى.
অর্থ : “যার মধ্যে আমি এবং আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রয়েছি।” (তিরমিযী, আহমদ, আবু দাউদ শরীফ, মিশকাত, বজলুল মাজহুদ, তুহফাতুল আহওয়াজী, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, উরফুশ শাজী, তালীক ইত্যাদি)
কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা সম্পূর্ণই মিথ্যা, বানোয়াট ও গোমরাহী যে, হাদীসে বর্ণিত বড় জামায়াত বলতে তাদের জামায়াতকেই বোঝায়।
৩৫নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : “হযরতজীর কয়েকটি স্মরণীয় বয়ান (লেখক, মাওলানা নোমান আহমদ)” নামক কিতাবের ১৩ পৃষ্ঠার বর্ণনা দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, সারা বছর প্রতি মাসে তিন দিন করে সময় লাগালে পুরা বছর আল্লাহর রাস্তায় কাটানো হয়েছে বলে গণ্য হবে। কারণস্বরূপ বলা হয়েছে, প্রতিটি নেক কাজের দশ গুণ সওয়াব হিসেবে এক দিনের কাজে ত্রিশ দিনের সওয়াব পাওয়া যাবে।
উপরোক্ত বক্তব্য পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনার দৃষ্টিতে কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা শরীয়ত সম্মত? জানার বাসনা রাখি।
জাওয়াব : তাদের একথাও সম্পূর্ণ মনগড়া, দলীল বিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ। কুরআন-হাদীসের কোথাও নেই যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে মাসে তিনদিন সময় দিলে সারা বছর আল্লাহর রাস্তায় থাকা যায়। যারা একথা বলে, তারা দলীল হিসাবে এ পবিত্র আয়াত শরীফখানা পেশ করে থাকে-
من جاء بالحسنة فله عشر بامثالها.
অর্থ : “যে একটি নেক কাজ করবে, তাকে দশটি নেক কাজের ফযীলত দেয়া হবে।” (পবিত্র সূরা আনআম শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৬০)
কাজেই “মাসে তিন দিন আল্লাহর রাস্তায় থাকলে ত্রিশ দিন আল্লাহর রাস্তায় থাকার ফযীলত পাওয়া যায়।”
মূলত : তাদের এ বক্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ নেক কাজের ফযীলত একে দশগুণ সত্য কথাই, তবে সেটা ফযীলতের ক্ষেত্রে, হক্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নয়। যেমন- কেউ যদি সূরা ইয়াসীন একবার পড়ে, তবে তাকে ১০ খতমের ফযীলত দেয়া হয়। আবার কেউ যদি পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ তিনবার পড়ে, তবে তাকে এক খতমের ফযীলত দেয়া হয়। তাই বলে একবার পবিত্র সূরা ইয়াসীন শরীফ বা তিনবার পবিত্র সূরা ইখলাছ শরীফ পাঠ করলে পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করার হক্ব আদায় হবেনা। আরো প্রশ্ন উঠে যে, তাহলে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে মাসে তিন দিন গিয়ে নামায আদায় করলে কি সারা মাসের নামাজ আদায় হয়ে যাবে? রমজান মাসে তিন দিনের জন্য গিয়ে রোযা রাখলে সারা মাস রোযা রাখার হক্ব আদায় হবে কি? কস্মিন কালেও নয়। এ ধরণের আক্বীদা রাখা শরীয়তের খেলাফ, অবৈধ। হ্যাঁ, তিন দিন নামাজ পড়লে, তিনদিন রোযা রাখলে ত্রিশ দিন নামায ও ত্রিশ দিন রোযার ফযীলত পাওয়া যেতে পারে কিন্তু হক্ব আদায় হবেনা। অর্থাৎ বাকি সাতাশ দিন নামাজ-রোজা না করলে কবীরা গুণাহে গুণাহগার হবে, যা হালাল মনে করা কুফরী। কাজেই মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় মাসে তিনদিন সময় ব্যায় করলেই যে মুসলমান হিসেবে সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য বা হক্ব আদায় হয়ে যায়, তা নয়। কারণ এর ফলে প্রশ্ন উঠে যে, মাসে তিনদিন কেবল আল্লাহর রাস্তায় থাকা হলে বাকী সাতাশ দিন কার রাস্তায় থাকা হবে? তা কি মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তার বরখেলাফ বেদ্বীন-বদ্বদীনের রাস্তায় হলেও চলবে? কিন্তু একথা কখনো শরীয়তসম্মত হতে পারেনা যে, তিনদিন মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায়, বাকী মাস গায়রুল্লাহর রাস্তায় থাকবে।
তাই মুসলমান হিসেবে মাত্র তিন দিন মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় থাকাই কাম্য নয়। বরং সারা মাস, বছর তথা জীবনই মহান আল্লাহ পাক উনার বন্দেগীতে কাটানো বা মহান আল্লাহ পাক উনার মতে-পথে থেকে, উনার মুহব্বত-মা’রিফাত হাছিল করা মুসলমান বা মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
وما خلقت الجن والانس الاليعبدون.
অর্থ : “নিশ্চয়ই আমি জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের উদ্দেশ্যে।” (পবিত্র সূরা জারিয়াত শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৬)
তাফসীরে লিয়াবুদুন (ليعبدون) শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে লিয়ারিফুন (ليعرفون), অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত-মা’রিফত হাছিলের জন্য। মূলতঃ মানুষ সৃষ্টি হয়েছে মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত-মা’রিফত হাছিলের জন্য। আর শুধু ইবাদত-বন্দেগী তথা তাসবীহ-তাহলীল যদি মানুষের কর্তব্য হতো, তাহলে মানুষ সৃষ্টির দরকার ছিলনা। কারণ শুধু ইবাদত-বন্দেগী, তাসবীহ-তাহলীলের জন্য তো ফেরেস্তারাই যথেষ্ট ছিল। এ কারণে হযরত ফেরেস্তা আলাইহিমুস সালাম উনারা মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে যে প্রশ্ন রেখেছিলেন পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে তা বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
قالوا اتجعل فيها من يفسد فيها وبسفك الدماء ونحن نسبح بحمدك ونقدس لك.
অর্থ : “আপনি কি এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন? যারা মারামারি করবে, কাটাকাটি করবে, রক্ত প্রবাহিত করবে অথচ আমরাই তো রয়েছি আপনার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করার জন্য।” (পবিত্র সূরা আল বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৩০)
অতএব, দেখা যায় শুধু ইবাদত-বন্দেগী তথা তাসবীহ-তাহলীলই মানুষের কর্তব্য নয়। ইবাদত-বন্দেগীর সাথে আল্লাহ তায়ালার মহব্বত-মা’রিফাত বা নিয়ামত হাছিলই হচ্ছে মানুষের মূল কতর্ব্য। আর যে পথে চলে মানুষ আল্লাহ পাক-এর মহব্বত-মা’রিফাত বা নিয়ামত হাছিল করতে পারে, তাই মহান আল্লাহ পাক উনার পথ বা সরল পথ।
এজন্য মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন,
اهدنا الصراط المستقيم صراط الذين انعمت عليهم.
অর্থ : “আমাদেরকে সরল পথ দান করুন তাদের পথ, যাদেরকে নিয়ামত দেয়া হয়েছে।” (পবিত্র সূরা ফাতিহা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ, ৫ ও ৬)
আর কাদেরকে নিয়ামত দেয়া হয়েছে, সে প্রসঙ্গে অন্যত্র মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ ফরমান,
انعم الله عليهم من النبين والصديعين والشهداء والصالحين.
অর্থ : “নিয়ামত দেয়া হয়েছে- নবী, ছিদ্দীক, শহীদ, ছালেহগণকে।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৯)
উল্লেখ্য, এখানে ছিদ্দীক শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকেও ছিদ্দীক বলা হয়। যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে। আর ছালেহগণের চুড়ান্ত স্তর হলো ছিদ্দীক। আর হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনাদের পরে আহলে তাসাউফগণই হলেন ছিদ্দীকগণের অন্তর্ভূক্ত। যাঁদের ছোহবত হাছিল করা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
كونوا مع الصادقين.
অর্থ : “তোমরা ছদেক্বীনদের ছোহবত এখতিয়ার কর।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১৯)
মূলত, ছদেক্বীনদের ছোহবত ইখতিয়ার করে, উনাদের মাধ্যমে ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করে ছদেক্বীন হওয়ার কোশেশ করাই হলো হাক্বীক্বীভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় থাকা, যার দলীল পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে রয়ে গেছে। কিন্তু প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগে গেলে মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় থাকা যায়, শরীয়তে কোথাও একথা উল্লেখ নেই। আর শরীয়তে যে তাবলীগের কথা বলা হয়েছে, তার তুলনায় প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত অতি সামান্য অংশবিশেষ। যা কেবল মক্তবী শিক্ষার সাথেই তুলনীয় যদি আক্বীদা শুদ্ধ থাকে। আর এই মক্তবী শিক্ষার জন্যও প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতেই যেতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা শরীয়ত করেনি অর্থাৎ এই মক্তবী শিক্ষা শুধুমাত্র তাবলীগ জামায়াতে গিয়েই শিখতে হবে তা নয়, বরং তা যেকোন মক্তব থেকে শিক্ষা করলেই চলে । আবার যাদের এই মক্তবী মানের শিক্ষা হয়ে গেছে তাদের উচিৎ, এর পরবর্তী ফরজ পরিমাণ ইলমে তাসাউফ ও ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা করা। তাই কেবলমাত্র মক্তবী শিক্ষার জন্য সারা জীবন, প্রতিমাসে তিনদিন ব্যয় করা কখনো শরীয়ত সম্মত হতে পারে না। আবার সাধারণভাবে ইহুদী-নাছারার খেলাফ বা বিধর্মীদের মতে না চললে বা শরীয়তসম্মত জীবন যাপন করলে, হালাল রিযিকের জন্য কোশেশ করলে এবং সেজন্য যে কোন জায়েয বিদ্যা শিখলেও আল্লাহর রাস্তায় থাকা হিসাবেই গণ্য হবে।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টরূপে বোঝা যায় যে, আল্লাহর রাস্তায় মাসে তিনদিন থাকলেই মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায়, এ কথা যেমন শুদ্ধ নয়, তেমনি এজন্য প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে সময় দিলেই মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় থাকা হয়, সে কথাও শুদ্ধ নয়। অর্থাৎ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে মাসে তিনদিন সময় দিলে যে মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় থাকা যায়, এ কথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের দলীল যুক্ত নয়।
অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উচিৎ তাদের এ ধরণের মনগড়া কথা পরহেজ করা।
৩৬নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাদের ফাযায়েল-ফযীলত সম্পর্কে নানা রকম কথা বলে থাকে। সে সমস্ত ফাযায়েল-ফযীলতের দলীল- আদিল্লা তলব করলে তারা তাদের মুরুব্বীদের দলীল দিয়ে থাকে। কোন অবস্থায়ই তারা পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের দলীল পেশ করেনা। যা দাওয়াতে তাবলীগ, (আম্বর আলী লিখিত) ৮২ পৃষ্ঠা সুন্নী পরিচয় ও তাবলীগ পরিচয় কিতাব যা রেদওয়ানুল হক ইসলামাবাদী প্রণীত সে কিতাবের ৫৬ পৃষ্ঠার বর্ণনা দ্বারাও প্রতীয়মান হয়।
এখন আমাদের জিজ্ঞাস্য যে, পবিত্র কুরআন শরীফ- পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের দলীল ব্যতীত কোন মুরুব্বীদের দলীল গ্রহণযোগ্য হবে কি? আর এভাবে দলীল পেশ করা কতটুকু শরীয়ত সম্মত?
জাওয়াব : মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার একাধিক স্থানে ইরশাদ মুবারক করেছেন-
هاتوا برهانكم ان كنتم صادقين.
অর্থ : “তোমরা সত্যবাদী হলে দলীলসমুহ পেশ কর।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১১১, পবিত্র সূরা নমল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৬৪)
অর্থাৎ কোন বিষয়কে সত্য বা মিথ্যা, হালাল বা হারাম প্রমাণিত করতে চাইলে দলীল পেশ করতে হবে। আর দলীল পেশ করতে হবে একমাত্র পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস হতে। এর খেলাফ দলীল পেশ করা কখনও শরীয়ত সম্মত হবেনা। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদগ মুবারক করেন
واذا قيل لهم اتبعوا ما انزل الله قالوا بل نتبع ما الفينا عليه ابا ئنا. اولو كان اباؤهم لا يعقلون شيئا ولا يهتدون.
অর্থ : “যখন তাদেরকে বলা হয় যে, ইত্তেবা (অনুসরণ) কর মহান আল্লাহ পাক তিনি যা নাযিল করেছেন । তারা বলে- বরং আমরা ঐ বিষয়ের (হুকুমের) উপর আমল করবো, যার উপর আমাদর বাপ-দাদা (মুরুব্বীদের)কে পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদা তথা মুরুব্বীরা জ্ঞানী ও হিদায়েত প্রাপ্ত ছিলনা। (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১৭০)
অন্যত্র ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
واذا قيل لهم اتبعواما انزل الله قالوابل نتبع ماوجدنا عليه ابائناء اولو كان الشيطان يدعوهم الى عذاب السعير.
অর্থ : “তাদেরকে যখন বলা হয়- মহান আল্লাহ পাক তিনি যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর। তখন তারা বলে- বরং আমরা আমাদের পুর্ব পুরুষদের (মুরুব্বীদের) যার উপর পেয়েছি, তাই অনুসরণ করবো। যদিও শয়তান তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে আহ্বান করে।” (পবিত্র সূরা লোকমান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২১)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন,
عن ابن مسعود قال- ان الشيطان ليتمثل فى صورة الرجل فياتى القوم فيحدثهم بالحديث من الكذب فيتفرقون فيقول الرجل منهم سمعت رجلا اعرف وجهه ولا ادرى مااسمه يحدث.
অর্থ : “শয়তান কোন মানুষের আকৃতি ধারণ করে কোন জামায়াতের কাছে আসে এবং তাদেরকে মিথ্যা কথা বলে। অতঃপর যখন সে জামায়াতটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, তখন তাদের মধ্য হতে কোন এক লোককে বলে- আমি এক ব্যক্তির নিকট হতে এই কথা শুনেছি কিন্তু তাকে দেখলে চিনি, তবে তার নাম জানিনা।” (মুসলিম, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
এই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, শয়তান যেমন জ্বিন জাত হতে সৃষ্ট হয়, তেমনি মানুষের মধ্যেও যে সকল লোক কোন কথাকে কুরআন-হাদীসের আলোকে যাচাই-বাছাই না করে প্রচার করে বেড়ায়, তাদেরকে মানুষরূপী শয়তান বলা হয়। তারা কুরআন-হাদীসের সাথে নিজেদেরও মনগড়া কিছূ কথা এমনভাবে যোগ করে যে, সাধারণ মানুষ বা শ্রোতারা মনে করে যে, ঐগুলো বুঝি পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদেরই কথা। কিন্তু পরে শ্রোতারা যখন তা প্রচার করে, তখন যদি তাদের বলা হয় যে, সেগুলো পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথায় আছে? তখন তারা বলে যে, আমরা জানিনা, তবে আমরা এগুলো অমুক লোক বা অমুক মুরুব্বীদের কাছ থেকে শুনেছি। অথচ যা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের খেলাফ।
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ ও তার ব্যাখ্যা দ্বারা এই প্রমাণিত হয় যে, ইত্তেবা অনুসরণ করতে হবে, মহান আল্লাহ পাক যা নাযিল করেছেন তার। বাপ-দাদা আর পূর্বপুরুষ তথা মুরুব্বীদের অনুকরণ এবং কথাকে দলীল হিসাবে পেশ করা কখনোই জায়েয নেই, যা সম্পূর্ণরূপে নাজায়িয, হারাম ও কুফরী, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কথা বা আমল পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সম্মত না হবে।
কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উচিৎ হবেনা, তাদের কোন বিষয়ে মুরুব্বীদের কথা বা কাজকে দলীল হিসেবে পেশ করা। কারণ আল্লাহ পাক তা নিষেধ করেছেন। অতএব এর থেকে বিরত থাকা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের এবং অন্যান্য যারা নিজেদের পুর্ব পুরুষদেরকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে, তাদের প্রত্যেকের জন্য ওয়াজিব।
৩৭নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের স্ত্রী লোকেরা মাহরাম পুরুষ ব্যতীত এক এলাকা বা শহর থেকে অন্য এলাকায় বা শহরে সফর করে থাকে, প্রচলিত তাবলীগের তা’লীম দেয়ার জন্য। তাদের এ কাজ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু জায়িয? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জানতে বাসনা রাখি।
জাওয়াব : উপরোক্ত বক্তব্যের জবাবে এই বলতে হয় যে, কোন স্ত্রী লোকের জন্যই মাহরাম পুরুষ ব্যতীত কোথাও সফর করা জায়িয নেই । কারণ মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মাহরাম পুরুষ ব্যতীত স্ত্রী লোকদের সফর করতে নিষেধ করেছেন। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
لا تسافرن امراة الا ومعها محرم.
অর্থ : “কোন মহিলা যেন কখনো মাহরাম পুরুষ ব্যতীত সফর না করে।” (মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মুজাহেরে হক্ব)
এজন্য স্বামী বা মাহরাম পুরুষ ব্যতীত মহিলাদের উপর হজ্বও ফরজ হয়না। যদিও প্রত্যেক পুরুষ ও মহিলার জন্য হজ্ব পালনে সক্ষম হলে তা আদায় করা ফরযে আইন। অথচ স্বামী বা মাহরাম ব্যতীত স্ত্রী লোকের উপর হজ্ব তো ফরয হয়ইনা বরং মাহরাম ব্যতীত তা পালন করা গুণাহর কারণ। তাই মহিলাদেরকে মাহরাম ব্যতীত হজ্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে-
لا تحدن امرأة الا ومعها ذو محرم.
অর্থ : “কোন মহিলা যেন কখনও মাহরাম ব্যতীত হজ্ব না করে।” (দারে কুতনী)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত আছে,
لا يخلون رجل بامرأة ولا تسافرن امرأة الا ومعها محرم فقال رجل يا رسول الله اكتبت فى غزوة كذا وكذا وخرجت امرأتى حاجة قال اذهب فا حجج مع امرأتك.
অর্থ : “কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে কখনও নিরিবিলিতে একাকী না বসে এবং কোন মহিলাও যেন কখনও মাহরাম পুরুষ ব্যতীত সফর না করে। অতঃপর এক ব্যক্তি আরজ করলো, হে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আমি অমুক অমুক জ্বিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য নাম লিখিয়েছি এবং আমার স্ত্রী হজ্বের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন বা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “তুমি যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্ব আদায় কর।” (বোখারী, মুসলিম, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, এরশাদুস সারী)
হজ্ব দ্বীনের একটি অন্যতম রোকন এবং ফরজ ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত। মহিলাদের এ ফরয আদায় করার জন্য সকল শর্ত মওজুদ থাকা সত্বেও মাহরাম পুরুষের অভাবে তাদের উপর হতে উক্ত ফরজ রহিত হয়ে যায়। তাহলে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ, যা মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যা ফরজ ওয়াজিব ইত্যাদি কোনটারই অন্তর্ভূক্ত নয়। তার তা’লীম দেয়ার জন্য মাহরাম ব্যতীত সফর করা কি করে জায়েয হতে পারে? উল্লেখ্য যে, হযরত নবী রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা ছিলেন দ্বীনের মূল প্রচারকারী অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ। তাঁরা তাবলীগে আম করেছেন। আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : “আলেমগণ হলেন হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারর ওয়ারিশ।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা, ইবনে হাব্বান, মিশকাত, উরফুশ শাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মা’য়ারেফুস সুনান, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, তালীক ইত্যাদি)
অর্থাৎ দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগের ওয়ারিশ হচ্ছেন আলেমগণ। অতএব পুরুষ সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা ওলামায়ে হক্ব, উনারাই হলেন মুবাল্লিগে খাছ। উনারা আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীনের দাওয়াত বা তা’লীম দিবেন।
আর এছাড়া যারা মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ মুবাল্লিগ, তারা তাবলীগে খাছ করবেন। বিশেষ করে মহিলারা কষ্মিন কালেও মুবাল্লিগে খাছ হতে পারবেন না। কারণ তাদের পর্দা করা শর্ত রয়েছে। মহিলাদের মধ্যে যারা বিশেষ যোগ্যতার অধিকারিনী হয়ে মুবাল্লিগ হবেন, তারা মুবাল্লিগে আম হবেন। মুবাল্লিগে আমের দায়িত্ব হচ্ছে- তাবলীগে খাছ করা। অর্থাৎ মহিলা মুবাল্লিগদের দায়িত্ব হচ্ছে- তাদের অধীনস্থ মহিলাদের তা’লীম দেয়া। হ্যাঁ যদি বিশেষ তা’লীমের জন্য মহিলাদের সফর করতে হয়, তবে অবশ্যই মাহরামের সাথে পর্দা করে যেতে হবে। এছাড়াও মহিলাদেরকে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তরফ থেকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাও পূর্ণভাবে আদায় করতে হবে। যেমন- পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে,
المرأة راعية على اهل بيت زوجها وهى مشئولة عنهم.
অর্থ : “মেয়েরা হচ্ছে তাদের স্বামীর বাড়ীর অধীনস্থদের অভিভাবিকা এবং এ ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিতা হবে।” (বোখারী শরীফ, মেশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস সারী, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, মোজাহেরে হক্ব)
সুতরাং মেয়েদের জন্য তার স্বামীর বাড়ীর অধীনস্থদের দ্বীনী তা’লীম ও দেখা-শোনা করাই হচ্ছে অপরিহার্য কাজ। কেননা এর জন্য তাকে পরকালে জবাবদিহী করতে হবে। কিন্তু এলাকা বা শহর ঘুরে ঘুরে তাবলীগ না করলে তাকে জবাবদিহী করতে হবেনা। কারণ ওটা তার জন্য অপরিহার্য তো নয়ই বরং মাহরাম ব্যতীত সফর করে দ্বীনের দাওয়াত ও তা’লীম দিলে তার কবীরা গুণাহ হবে। আর এটাই তার জন্য জাহান্নামী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৩৮নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : “মহান আল্লাহ পাক উনার রাস্তায় বের হলে ঘর সংসার মহান আল্লাহ পাক তিনিই দেখবেন।” একথা বলে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা অন্য লোকদেরকে প্ররোচিত করে। যার কারণে অনেক লোকই ঘর-সংসারের যথাযথ ব্যবস্থা না করে প্রচলিত তাবলীগে বের হয়ে যায়। অথচ এর ফলে তাদের বাড়ীর লোকজন প্রায়ই বিভিন্ন বর্ণনাতীত অসুবিধায় ভোগে। উল্লেখ্য আত তুরাগ, সম্পাদক হামীদ রশীদ মে/১৯৯৩ পৃষ্ঠা, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন নামক কিতাব, (লেখক- ওবায়দুল হক) ১৭ থেকে ২৬ পৃষ্ঠার বর্ণনা দ্বারাও এই বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য ও আমল কতটুকু শরীয়ত সম্মত বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত কথা বা কাজ শুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত নয়। কারণ ঘর-সংসারের অভিভাবকের জন্যে তার অধীনস্থ লোকজনের যাবতীয় প্রয়োজনাদী মেটানো ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته فالامام الذى على الناس راع وهو مسئول عن رعيته والرجل راع على اهل بيته وهو مسئول عن رعيته والمرأة راعية على اهل بين زوجها وهى مسئوله عنهم وعبد الرحل راع على مال سيده وهو مسئول عنه الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته.
অর্থ : “প্রত্যেকেই রক্ষক, তাকে তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। ইমাম বা আমীর হলেন উনার অধীনস্থ লোকদের রক্ষক, তিনি উনার রক্ষিত বিষয় সর্ম্পকে জিজ্ঞাসিত হবেন। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার আহলে বাইত বা পরিবারের রক্ষক এবং তিনি তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। একজন স্ত্রী তার স্বামীর বাড়ীর রক্ষক। তিনি তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর গোলাম তার মনিবের মালের রক্ষক। সে তার রক্ষিত বিষয় সর্ম্পকে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বোখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস সারী, মুসলিম, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী ইত্যাদি)
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, স্বামী তার স্ত্রীর রক্ষক বা তার যাবতীয় প্রয়োজনাদি মেটানোর ব্যাপারে জিম্মাদার। তাই সে যদি তার পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি না করেই প্রচলিত তাবলীগে বের হয়ে যায়, তবে উপরোক্ত হাদীছ শরীফের খেলাফ কাজ করে কঠিন গুণাহে গুণাহগার হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, কোন স্বামী যখন বিয়ে করে, তখন তার স্ত্রীর যাবতীয় প্রয়োজনাদি বা তার সংসারের যাবতীয় ব্যবস্থাদি মিটানোর ওয়াদা দিয়েই বিয়ে করে থাকে।
এ প্রসঙ্গে বিদায় হজ্বের ভাষণে আল্লাহর রাসূল, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের ব্যাপারে সতর্ক থাক। কারণ আল্লাহ পাককে সাক্ষী রেখেই তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছ।” (সিহাহ সিত্তাহ ও সীরাত কিতাব সমূহ)
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো বলেন,
الصلوة وما ملكت ايمانكم.
অর্থ : “তোমরা নামাজ এবং তোমাদের দক্ষিন হস্তের অধিকারীনী অর্থাৎ তোমাদের স্ত্রী-দাসী ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক থাক।” (সিহাহ সিত্তাহ ও সীরাত কিতাব সমূহ)
আবার পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
ولهن مثل الذى عليهن بالمعروف.
অর্থ : “নারীদের তেমনি ন্যায় সঙ্গত অধিকার আছে, যেমনি আছে তাদের উপর পুরুষদের।” (পবিত্র সুরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২২৮)
আবার পবিত্র সূরা তালাক উনার ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
اسكنوهن من حيث سكنتم من وجدكم ولا تضارو هن لتضيقوا عليهن.
অর্থঃ- “তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেমন বাড়ীতে বাস কর, তাদেরও তেমনি বাড়ীতে বাস করতে দাও। তাদের উত্যক্ত করে বিপদে ফেলোনা।” তাই আমরা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে দেখতে পাই যে, স্বয়ং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কখনো কখনো হযরত উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের জন্য বছরের চেয়েও বেশী সময়ের জন্য খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করে দিতেন। (সীরাত কিতাব সমূহ)
আরো উল্লেখ্য যে, এ ক্ষেত্রে পরিবার- পরিজনের মধ্যে যদি মা-বাবা বিদ্যমান থাকে, তবে সেক্ষেত্রে মা-বাবাকে অন্তর্ভূক্ত রেখে বা তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি সম্পন্ন না করে প্রচলিত তাবলীগে যাওয়া হবে কঠিন গুণাহের কাজ। কারণ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
ان اشكرلى ولوالديك.
অর্থ : “তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার শোকর গোজারী কর এবং পিতা-মাতার শোকর গোজারী কর।” (পবিত্র সূরা লোকমান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪)
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, অধীনস্থ পিতা-মাতা বা স্ত্রী-পুত্র পরিবার-পরিজনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি সম্পন্ন না করে তাবলীগে যাওয়াই হারাম। (কুরতুবী, মায়ারেফুল কুরআন) তাই পবিত্র শরীয়ত উনার ফায়সালা হলো- ঘর-সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদির যোগান দেয়া বা তার জন্য কোশেশ করা ফরয। যে প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
فاذا قضيت الصلوة فانتشروا فى الارض وابتغوا من فضل الله.
অর্থ : “যখন নামায শেষ হয়ে যায়, তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং মহান আল্লাহ পাক উনার ফজল-করম তালাশ কর। (রিযিকের সন্ধান কর।)” (পবিত্র সূরা জুমুয়া শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১০)
আবার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
طلب كسب الحلال فريضة بعض الغريضة.
অর্থ : “অন্যান্য ফরজ আদায়ের পর হালাল রিযিকের জন্য কোশেশ করা ফরজের অন্তর্ভূক্ত।” (বায়হাক্বী শো’বুল ঈমান, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহে তিবী, আশয়্যাতুল লুময়াত ইত্যাদি)
কাজেই সে হালাল রিযিকের কোশেশ না করে বা ঘর-সংসারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাদি সম্পন্ন না করে- সে ব্যবস্থা আল্লাহ পাক করবেন, এ কথার উপর থেকে প্রচলিত তাবলীগে যাওয়া শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ শরীয়তের ফায়সালা হলো- হক্কুল ইবাদ যথাযথভাবে আদায় করে হক্কুল্লাহ বা ফরজে আইন আদায়ের পর, ফরজে কেফায়া বা ইসলামের তাবলীগের কাজ যা প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ হতে অনেক ব্যাপক, তার জন্য সামর্থ অনুযায়ী কাজ করা। কারণ আল্লাহ পাক কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে পাকড়াও করেন না। আবার হাক্বীক্বত ইসলাম বান্দার খেদমতের মুখাপেক্ষী নয়। ইসলামের হিফাযতকারী হলেন, স্বয়ং আল্লাহ পাক। বান্দা তাতে খেদমতগার হিসেবে শরীক থাকতে পারে।
অতএব, যারা ঘর-সংসারের জিম্মাদারী মহান আল্লাহ পাক উনার উপর দিয়ে প্রচলিত তাবলীগ জামাতে তাদের ধারণা মোতাবেক দ্বীনের খেদমত করতে যায় বা তাদের ধারণা মোতাবেক তাদের প্রতি দ্বীনের যে জিম্মাদারী দেয়া হয়েছে তা আদায় করতে যায় তাদেরকে বলতে হয়ে যে, প্রত্যেকেরই ঘর-সংসারের দায়িত্ব যার যার নিজের উপরই দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন-
نحن قسمنا بينهم معيشة فى الحيوة الدنيا.
অর্থ : “আমি (মহান আল্লাহ পাক) তাদের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী জিন্দেগীর যা জরুরত, তা বন্টন বা নির্ধারণ করে দিয়েছি।” (পবিত্র সূরা যুখরুফ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৩২)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রসঙ্গে বলেন-
الاكلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته فالامام الذى على الناس راع وهو مسئول عن رعيته والرجل راع على اهل بيته وهو مسئول عن رعيته والمرأة راعية على اهل بيت زوجها وهى مسئولة عنهم وعبد الرجل راع على مال سيده وهو مسئول عنه الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته.
অর্থ : “সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই রক্ষক (তোমাদেরকে যে বিষয়ে জিম্মাদারী দেয়া হয়েছে, সে বিষয়ে) এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত (জিম্মাদারী) বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। ইমাম বা আমীর হলেন তাঁর অধীনস্থ লোকদের রক্ষক বা জিম্মাদার, তিনি তাঁর রক্ষিত (জিম্মাদারী) বিষয় সর্ম্পকে জিজ্ঞাসিত হবেন। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার আহলে বাইত বা পরিবারের রক্ষক বা জিম্মাদার এবং তিনি তার রক্ষিত (জিম্মাদারী) বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। একজন স্ত্রী তার স্বামীর বাড়ীর রক্ষক বা জিম্মাদার, তিনি তার রক্ষিত (জিম্মাদারী) বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। আর গোলাম তার মনিবের মালের রক্ষক বা জিম্মাদার, সে তার রক্ষিত (জিম্মাদারী) বিষয় সর্ম্পকে জিজ্ঞাসিত হবে।” (পবিত্র বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, মুসলিম, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ ইত্যাদি))
আর দ্বীনের জিম্মাদারী তো স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন যেটা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করেন-
والله متم نوره ولو كره الكافرون.
অর্থ : “আর মহান আল্লাহ পাক উনার নূর বা দ্বীনকে পূর্ণ করবেন যদিও কাফিরা পছন্দ করেনা।” (পবিত্র সূরা ছফ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮) অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক তিনি প্রত্যেকেরই ঘর-সংসারের জিম্মাদারী তার নিজের উপর দিয়েছেন আর দ্বীনের জিম্মাদার স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনি নিজেই। এখন কেউ হয়ত প্রশ্ন করতে পারে যে, তাহলে প্রত্যেকেই তার ঘর-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে আর মহান আল্লাহ পাক তিনি স্বয়ং নিজেই দ্বীনের খেদমতের আঞ্জাম দিবেন? মূলতঃ ব্যাপারটি তদ্রুপ নয়। প্রত্যেকেই তার ঘর-সংসারের দায়িত্ব, হক্ব বা জিম্মাদারী পরিপূর্ণভাবে আদায় করার সাথে সাথে যোগ্যতানুযায়ী দ্বীনের খেদমতের আজ্ঞাম দিবে। অর্থাৎ ঘর-সংসারের হক্ব আদায় করতে গিয়ে দ্বীনের খেদমতের ত্রুটি করতে পারবেনা আর দ্বীনের খেদমত করার নাম দিয়ে ঘর-সংসারের হক্ব বা জিম্মাদারীতে ত্রুটি বা গাফলতী করতে পারবেনা। করলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে আদৌ গ্রহণযোগ্য হবেনা। উপরন্ত গুণাহর কারণ হবে। কারণ যারা মনে করে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে গেলে তাদের ঘর-সংসার আল্লাহ পাক দেখবেন, তাদের সে কথা অনুযায়ী বলতে হয় যে, দ্বীনের তাবলীগ যা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের থেকে অনেক উর্ধ্বে, তাও তো তাহলে মহান আল্লাহ পাক তিনিই দেখবেন। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি যেহেতু নিজেই দ্বীনের জিম্মাদারী নিয়েছেন। এবং ঘর-সংসার দুনিয়াবী কাজের চেয়ে দ্বীনের কাজকেই আল্লাহ পাক বেশী পছন্দ করেন। উল্লেখ্য ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দ্বীন। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আছে,
لا رهبانية فى الاسلام.
অর্থ : “বৈরাগ্য ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়।” তাই পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন না মিটিয়ে প্রচলিত তাবলীগে যাওয়াও ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়। এজন্য পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
ويسئلونك ماذا ينفقون قل العفو.
অর্থ : “তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, কি দান করবো? আপনি বলেন, যা উদ্বৃত্ত।” (পবিত্র সূরা বাক্বারাহ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২১৯)
উল্লেখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে যে, “একবার একজন ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উটের রশি না বেঁধেই বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক উনার উপর তাওয়াক্কুল করলাম।” তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আগে উটের রশি বাঁধ, পরে তাওয়াক্কুল কর।” মূলতঃ বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাধারণভাবে একটি নছীহত পেশ করা হয়েছে যে, সাধারণ জীবন-যাপন বা প্রয়োজনীয় কার্যাদি সমাপনের পরই তাওয়াক্কুল করা উচিৎ। এক্ষেত্রে প্রশ্ন হতে পারে যে, যিনি ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ক্ষেত্রে রশি বাধার পর তাওয়াক্কুলের প্রসঙ্গ আসল অথচ অনেক অলীআল্লাহ উনাদের জীবনীতেই দেখা যায় যে তারা কোন চেষ্টা বা উপকরণ ও কাজ ছাড়াই তাওয়াক্কুল করেছেন এবং উনাদের সেই তাওয়াক্কুল বাস্তবে রূপায়িত হয়েছে। এর ফায়সালা হচ্ছে- হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম হলেন চরম স্তরের ছিদ্দীক বা পরিপূর্ণ সুস্থ হালতের লোক। উনারা এ উম্মতের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। পক্ষান্তরে অনেক অলীআল্লাহ নিজ নিজ হাল অনুযায়ী তাওয়াক্কুল করেছেন। যা উনার বাতেনী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু এই হাল শরীয়তে অনুসরণযোগ্য নয়। কারণ শরীয়তের ফতওয়া হলো- জাহেরের উপর, বাতেনের উপর নয়। অর্থাৎ সুন্নত মোতাবেক জীবন যাপন করতে হবে এবং তার সাথে সাথে তাওয়াক্কুলও করতে হবে। এক্ষেত্রে আরো উল্লেখযোগ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের যে ৬ (ছয়) উছূল রয়েছে, তা নিতান্ত মক্তবী মানের শিক্ষা, এ মক্তবী মানের শিক্ষা হাছিল করে কখনও ওলীআল্লাহ হওয়া সম্ভব নয় এবং উঁচুস্তরের তাওয়াক্কুলও হাছিল করা সম্ভব নয়। তবে যাঁরা ওলীআল্লাহ, উনারা হক্কুল ইবাদ পূর্ণ করেই তাওয়াক্কুল করে থাকেন। অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যদি নিজেদের ঘর-সংসারের ব্যবস্থাদি না করে সময় ব্যয় করে এবং অন্যকেও তার জন্য প্ররোচিত করে, তবে তা হবে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের খেলাফ ও হক্কুল ইবাদ নষ্ট করার শামিল। যে হক্কুল ইবাদ নষ্ট করা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, অন্য সব গুণাহ মাফ হবে কিন্তু হক্কুল ইবাদ মাফ করা হবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত তা বান্দার পক্ষ থেকে মাফ না করা হয়। (মেশকাত, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, লুময়াত) অতএব প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উচিৎ কুরআন-সুন্নাহর খিলাফ বান্দার হক্ব নষ্টকারী এসব কথাবার্তা ও কাজ পরহেজ করা।
৩৯নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, রাসুলের চেয়ে দ্বীনের মর্যাদা বেশী এবং মহান আল্লাহ পাক নবী রসুল উনাদের দ্বীনের জন্য কষ্ট দিয়েছেন, আর নবী রসুল উনারাও দ্বীনের জন্য কষ্ট করেছেন।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়তসম্মত? নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লার ভিত্তিতে জাওয়াবদানে উপকৃত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত কথা সম্পূর্ণই অশুদ্ধ, যা বেয়াদবী ও বিভ্রান্তিমুলক। কারণ মহান আল্লাহ পাক দ্বীনের চেয়ে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা বেশী দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
رضوان من الله اكبر.
অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তূষ্টিই সবচেয়ে বড়। (পবিত্র সুরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৭২)
মুলতঃ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির জন্য যা কিছু করেছেন, তাই দ্বীন। অর্থাৎ দ্বীন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অধীন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি দ্বীনের অধীন নন। নানাভাবে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রথমতঃ ঈমান গ্রহণের ক্ষেত্রেই বলা যায়। কেউ যদি সারা জীবন লা-ই-লাহা ইল্লাল্লাহু পড়ে, তবে সে ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ না সে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) না বলে। এমনকি সে যদি আমৃত্যু সর্বক্ষণ যিকির-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল, সালাত- সাওম, হজ্ব ইত্যাদিতে মশগুলও থাকে, তথাপিও তার এসব কোন দ্বীনী আমলই গ্রহণযোগ্য হবেনা, যদি সে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ স্বীকার না করে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত সর্বক্ষণ সকল দ্বীনী আমলের সমষ্টিও রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদার তুলনায় কিছুই নয়। আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ঈমান আনার পরও সমস্ত দ্বীনী আমলসমূহ কবুল হওয়ার ক্ষেত্রে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুপারিশের মুখাপেক্ষী। যে প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে, সমস্ত নেক আমলসমূহই আকাশে ঝুলন্ত থাকে, যতক্ষণ সে আমলের আগে এবং পরে দরুদ শরীফ পড়া না হয়। অতএব এখানেও দ্বীনের চেয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা বা প্রাধান্যই স্বীকৃত হয়। দ্বিতীয়তঃ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা দ্বীনের চেয়ে যে কত বেশী, তা যত ফিকির করা যায় ততই উপলদ্ধি করা যায়। তিনি ইচ্ছে করলে দ্বীনের যে কোন হুকুমকে রদ বা পরিবর্তন-পরিবর্ধন বা সংযুক্ত করতে পারতেন।। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আবু তালিবের মৃত্যুকালীন ঘটনা। যে সময়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছিলেন, “আপনি কেবল “লা-ই-লাহা-ইল্লাল্লাহু” পড়েন, তাতেই হবে।” (সমূহ সীরাতের কিতাব)
অর্থাৎ কালেমার ব্যাপারেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইচ্ছাধীন ক্ষমতা ছিল। আবার নামাজ কোন ওয়াক্তে কত রাকায়াত পড়তে হবে এবং কিভাবে পড়তে হবে, তাও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনিই নির্ধারণ করেছেন। আবার রোজার কাফফারার ক্ষেত্রেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ হুকুম জারী করেছিলেন। যেমন তিনি জনৈক কাফফারা আদায়কারীকে বলেছিলেন, নিজের কাফফারা নিজেই খেয়ে ফেলার জন্য।
যেমন ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
ثم قال اطعمه اهلك.
অর্থ : অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “তুমি তোমার পরিবারকে তা ভক্ষণ করাও।” (পবিত্র বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মুজাহেরে হত্ব, শরহুত ত্বীবী) বর্ণিত আছে যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় জামায়াতে তারাবীহ নামায পড়েননি এবং এজন্য তা পড়েননি যে, তিনি আশঙ্কা করেছেন- প্রতিদিন তারাবীহ পড়লে তা উম্মতের প্রতি ফরয হয়ে যায় কিনা। অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি প্রত্যহ তারাবীহ নামাজ জামায়াতে পড়তেন, তাহলে তা ফরয হয়ে যেত, আর পড়েননি দেখে তা ফরয হয়ে যায়নি। যেমন ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
انى خشيت ان يفرض عليكم.
অর্থ : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন যে, “আমি আশঙ্কা করলাম, তোমাদের প্রতি (তারাবীহর নামাজ) ফরয হয়ে যাবে।” (পবিত্র বুখারী শরীফ, পবিত্র মুসলিম শরীফ, পবিত্র মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, পবিত্র মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মুজাহেরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী) তাহলে দেখা যাচ্ছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইচ্ছা অনুযায়ীই দ্বীন পরিচালিত হতো। আবার যাকাতের ক্ষেত্রে বলতে হয় যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার তো অবশ্যই যাকাত ছিলনা, বরং কোন নবী আলাইহিস সালাম উনাদেরই যাকাত ছিলনা। (সমূহ ফিক্বাহ ও আক্বায়েদের কিতাব) এর দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনের চেয়ে রসূল উনাদের মর্যাদা বেশী। এরপরে হজ্বের ক্ষেত্রেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উছিলায় অনেক হুকুম রদ হয়েছে। যেমন- সামর্থ্যবানদের জন্য প্রত্যেকবারই হজ্ব ফরয হওয়ার কথা ছিল কিন্তু উম্মতের কষ্ট হবে ভেবে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কেবলমাত্র একবারই হজ্ব ফরয করে দিয়েছেন। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আছে,
قال لو قلتها نعم لو جبت
অর্থ : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “আমি যদি বলতাম হ্যাঁ, তবে তা (হজ্ব আদায় করা প্রতি বছরই) ফরয হয়ে যেত।” (আহমদ, নাসাঈ, মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, আশয়াতুল লুময়াত, তালীক ইত্যাদি)
আবার পবিত্র কুরআন শরীফ উনার হুকুম অনুযায়ী হেরেম শরীফ উনার সকল প্রকার গাছ ইত্যাদি কাটা নাজায়েয হলেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের জরূরতের দিকে লক্ষ্য করে উনাদের অনুরোধের কারণে ইজখার নামক এক প্রকার গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছিলেন। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
فقال الا الاذخر.
অর্থ : অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “ইজখার ব্যতীত (সবই কাটা হারাম)।” (বোখারী, মুসলিম, মেশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, মুজাহেরে হক্ব ইত্যাদি) অতএব উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা দেখা যায় যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের যে মূল পাঁচটি ভিত্তি রয়েছে, তাতেও উনার হুকুম জারী করেছেন। অর্থাৎ সেখানে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিশেষ ইচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ হয়েছিলো। আর এর দ্বারাও খুবই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুখাপেক্ষী ছিল। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের জন্য ছিলেন না। তৃতীয়তঃ উল্লেখ করা যায় যে, দ্বীন হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সম্মিলিত রূপ। আর ইজমা ও ক্বিয়াস হচ্ছে- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরে মুহাক্কিক-মুদাক্কিক উলামায়ে উম্মতে মুহম্মদীগণ, যা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে ইজতিহাদ করতঃ ধার্য্য করেছেন। অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের ক্ষেত্রে উম্মতের প্রতিনিধিত্বও অনুমোদন করেছেন। (এতকান, ফাওজুল কবীর, নুরুল আনওয়ার, উসুলে শাশী, কুরতুবী, জাসসাস, আহমদী, খাযেন, বাগাবী, মাজহারী ইত্যাদি) উল্লেখ্য, এ ক্ষেত্রে উনারা নিজেরা মনগড়া কোন বক্তব্য দেননি। বরং উনারা পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দৃষ্টিতে ইজতিহাদের মাধ্যমে ফায়সালা দিয়েছেন, যা ইজমা ও ক্বিয়াস নামে অভিহিত। যা পালন করা মহান আল্লাহ পাক ও মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুকুম হিসেবেই গণ্য। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
اطيعو الله واطيعوا الرسول واولى الامرمنكم.
অর্থ : “তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ও তোমাদের মধ্যে যাঁরা উলুল আমর, উনাদের আদেশ পালন করা।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৯)
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
العلماء امتى كانبياء بنى اسرائيل.
অর্থ : “আমার উম্মতের আলেম সম্প্রদায়, বণী ইস্রাঈলের নবীদের ন্যায়।” উল্লেখ্য, এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এক এক ইমাম বা মুজতাহিদ একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মাসয়ালা প্রদান করেছেন। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে এক মাযহাবে যা জায়িয অন্য মাযহাবে তা নাযায়েয বা এক মাযহাবে যা হালাল, অন্য মাযহাবে তা হারাম। এক মাযহাবে ফরয অন্য মাযহাবে ফরয-ওয়াজিব কোনটাই নয়। যেমন- কচ্ছপ খাওয়া হানাফী মাযহাবে হারাম কিন্তু শাফেয়ী মাযহাবে জায়িয। আবার হানাফী মাযহাবে ঘোড়া, কাঁকড়া খাওয়া মাকরূহ তাহরীমী কিন্তু শাফেয়ী মাযহাবে জায়িয। আবার শাফেয়ী মাযহাবে রক্তঝরা অবস্থায় নামায জায়িয কিন্তু অন্য সব মাযহাবে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকলে ওজুই ভঙ্গ হয়ে যায়। হানাফী মাযহাবে ওজুর চার ফরয কিন্তু হাম্বলী মাযহাবে দশ ফরয, নিয়ত এবং তরতীব উভয় ফরয। ঈদের নামায হানাফী মাযহাবে ওয়াজিব, অন্য মাযহাবে সুন্নত। আবার ঈদের নামাজে হানাফী মাযহাবে ছয় তাকবীর, অন্য মাযহাবে বার তাকবীর। হানাফী মাযহাবে ঈমামের পিছনে সূরা-ক্বিরাআত পড়তে হয়না, কিন্তু অন্য মাযহাবে তা পড়া ফরয। আবার হানাফী মাযহাবে বিতর নামায তিন রাকায়াত কিন্তু অন্য মাযহাবে তা এক রাকায়াত। আবার হক্ব ওলামাদের মতভেদ যেমন- মাযহাব প্রণয়নকারী ইমাম উনাদের মতভেদও গ্রহণযোগ্য ও বরকতের কারণ। যে প্রসঙ্গে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
اختلاف العلماء رحمة.
অর্থ : “উলামাদের (হক্ব পন্থীদের) মাঝে মতবিরোধ রহমত স্বরূপ।” (আলমগীরী, শামী, দুররুল মুখতার, বাহরুর রায়েক, হেদায়া, আইনুল হেদায়া, শরহে হেদায়া, এনায়া, নেহায়া, ফতহুল কাদীর, গায়াতুল আওতার, কিতাবুল ফিক্বহ আলা মাজাহিবিল আরবায়া, মা’রেফুল কুরআন ইত্যাদি) অতএব মাযহাব সমূহের মধ্যে বিভিন্ন রকমের মতভেদ থাকলেও নিজ নিজ মাযহাবের অনুসরণ করা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে কবীর, মুছাল্লাম, তাফসীরে আহমদিয়াত, তাফসীরে ফতহুল আজীজ, তাফসীরে খাজেন, তাফসীরে মাদারেক, জরীর তাবারী, তাফসীরে বাগবী, তাফসীরে ইবনে কাসীর, রুহুল মায়ানী জামউল জাওয়াম, ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন, ইকদুল জিদ, সফরুস সায়াদাত, ফয়জুল হারামাইন, ইয়াম্বু, হাশিয়ায়ে তাহতাবী, হাদায়েকে হানাফিয়া, দুররুল মুখতার, শামী।)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীনের ফায়সালা নির্ধারণ করেছেন- মাযহাব প্রনয়নকারী ইমামগণও। অর্থাৎ দ্বীন কিভাবে পরিচালিত হবে, সে সম্পর্কে তাঁরাও মন্তব্য পেশ করেছেন। যদ্বারা দ্বীনের উপর বা দ্বীনের নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁদের মর্যাদা প্রকাশ পায় এবং তাহলে তাঁদের রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দ্বীনের থেকে অনেক বেশী সম্মানিত, তা অতি সহজেই অনুমেয়। উল্লেখ্য, দ্বীনের বিধি-বিধান শুধু সীমিত সময়ের জন্য। অর্থাৎ মানুষ পৃথিবীতে এসে বালেগ হওয়ার পর থেকে হুশ থাকা অবস্থায় মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের উপর দ্বীনের হুকুম বলবৎ থাকে। অপরদিকে আলমে আরওয়াহতেও মানুষ, বহুকাল থেকে এসেছে এবং মুসলমানগণ অনন্তকাল থাকবে। কিন্তু এ কোন ক্ষেত্রেই তার প্রতি দ্বীনের হুকুম প্রযোজ্য হয়নি বা হবেও না। এর দ্বারাও বোঝা যায় যে, দ্বীনের চেয়ে মানুষের এবং তার চেয়েও রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা অনেক বেশী। (সমূহ ফিক্বাহের কিতাব) চতুর্থতঃ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা যে দ্বীনের চেয়ে বেশী, সে সম্পর্কে অনেক বর্ণনা দ্বারা তা এমনিতেই বোঝা যায়। যেমন- বণী ইস্রাঈল আমলের একটি ঘটণা কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, লোকটি তাওরাত কিতাব খুলে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক দেখে মুহব্বতের সাথে তা চুম্বন করেছিল বলে মহান আল্লাহ পাক তার উপর এত বেশী খুশী হন যে, সে যখন মৃত্যুবরণ করে, মহান আল্লাহ পাক তিনি সে যামানার হযরত নবী আলাইহিস সালাম উনাকে ওহী করলেন- “সম্মানের সাথে সে লোকটির জানাযা পড়াতে ও দাফন করতে।”
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
الا انه كان كلما نشر التوراة ونظر الى اسم محمد صلى الله عليه وسلم قبله وضعه على عينيه وصلى عليه فشكرت ذالك له وغفرت ذنويه وزوجته سيعين حوراء.
অর্থ : “ঐ ব্যক্তির অভ্যাস ছিল যে, যখনই সে তাওরাত কিতাব খুলতো এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক দেখতে পেত, সে তা (নাম মুবারক) চুম্বন করে তার চোখে লাগাতো এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি দরুদ শরীফ পাঠ করতো। অতঃপর আমি (মহান আল্লাহ পাক) এ কাজে সন্তুষ্ট হয়ে, তার গুণাহসমূহ ক্ষমা করলাম এবং ৭০ জন হুর তার সঙ্গিনী করে দিলাম। অর্থাৎ তাকে জান্নাতী করে দিলাম।” (হিলইয়াতুল আউলিয়া আবু নাঈম, সীরাতে হালবী, হুজ্জাতুল্লাহিআলাল আলামীন)
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা দ্বীনের চেয়ে বেশী হওয়ার কারণে, সে ব্যক্তি খালিছভাবে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি মুহব্বত প্রকাশ করায়, মহান আল্লাহ পাক তাকে নাযাত দিয়েছেন, তার সম্মান বৃদ্ধি করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এমনিতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা দ্বীনের চেয়ে তো বেশীই, তার পরে আবার মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা অনেক গুণ বেশী।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
قال اأقرر تم واخذتم على ذالكم اصرى- قالوا اقررنا.
অর্থ : “তিনি (মহান আল্লাহ পাক) বললেন, তোমরা কি স্বীকার করে নিলে? এবং এ শর্তে আমার ওয়াদা গ্রহণ করলে কি? উনারা বললেন, আমরা স্বীকার করে নিলাম।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮১)
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এ কথাই ছাবেত হয় যে, কোন হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে নুবুওওয়াত দেয়া হয়নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না উনারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উানকে রসূল হিসেবে মেনে নিয়েছেন। যার কারণে তিনি হচ্ছেন- রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের রসূল, নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের নবী। অর্থাৎ তিনি হচ্ছেন- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। (তাফসীরে মাজহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, কবীর, তাবারী, ইবনে কাছীর, কুরতুবী, আহকামুল কুরআন, জাসসাস, খাযেন, বাগবী ইত্যাদি) যাঁর সর্ম্পকে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
لولك لما خلقت الافلاك.
অর্থ : “ওগো হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম, তবে কোন কিছুই বা কোন মাখলুকাতই আমি সৃষ্টি করতাম না।” (পবিত্র হাদীছে কুদসী শরীফ, মওজুয়াতে কবীর) কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, দ্বীনের জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসেননি বরং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম উনার জন্য মাখলুকাত, দ্বীন তথা সবকিছু এসেছে। উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা এত বেশী যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আদেশ, মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশের মধ্যেই গণ্য। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
مااتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا.
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা এনেছেন, তা আঁকড়িয়ে ধর। আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তা থেকে বিরত থাক।” (পবিত্র সূরা হাশর শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আমলের মর্যাদা যে কতবেশী, তা এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যেও ফুটে উঠেছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
قل ان كنتم تحبون الله فاتبعونى.
অর্থ : “(হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলুন)! তোমরা যদি মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি পেতে চাও, তবে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইত্তেবা (অনুসরণ) কর।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৩১) কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইত্তেবা করলেই মহান আল্লাহ পাক উনাকে পাওয়া যায়।
মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
من يطع الرسول فقد اطاع الله.
অর্থ : “যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অনুসরণ করলো, সে মূলত, মহান আল্লাহ পাক উনার অনুসরণ করলো।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮০) আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইত্তেবা না করলে, দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত হওয়া যায়না, আর মহান আল্লাহ পাক উনাকেও পাওয়া যায়না। অর্থাৎ কেবল মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি দ্বারাই বান্দার হক্ব আদায় হয়না। মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি অর্জনও বান্দার জন্য অবধারিত বা আবশ্যিক কর্তব্য। যেজন্য মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
والله ورسوله احق ان يرضوه.
অর্থ : “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ এবং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনারাই সন্তুষ্টি পাওয়ার সমধিক উপযুক্ত।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৬২) তাই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, আগে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, পরে দ্বীন। দ্বীনের চেয়ে রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা অনেক বেশী। আবার প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যে বলে থাকে, হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে মহান আল্লাহ পাক দ্বীনের জন্য কষ্ট দিয়েছেন, আর হযরত নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম উনারাও দ্বীনের জন্য সে কষ্ট করেছেন, তাও বিভ্রান্তিমুলক কথা। কারণ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের যদি দ্বীনের জন্যই কষ্ট করতেন, তাহলে সে দ্বীন যথাযথভাবে প্রচার হয়ে না থাকলে উনাদের সারা জীবনের কষ্ট কেবল ব্যর্থতায়ই পর্যবসিত হতো। যেমন পবিত্র মি’রাজ শরীফ উনাদের হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেছেন যে, “এমন অনেক হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম ছিলেন, যাঁদের কোন উম্মতই ছিলনা।” (সিহাহ সিত্তাহ ও সীরাতের কিতাব সমূহ)
অতএব কেবল দ্বীনের প্রচারের জন্যই যদি হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা কষ্ট করতেন, তাহলে উনারা অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। (নাউযুবিল্লাহ) হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের শানে এ ধরণের কথা বলা সম্পূর্ণই ভুল ও কুফরী। তাই বলতে হয়, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা দ্বীনের জন্য কোন কষ্ট করেননি, গায়রূল্লাহর জন্য কোন কষ্ট করেননি, উনারা খালেছ মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যই কষ্ট করেছেন। আর মহান আল্লাহ পাক তিনিও দ্বীনের জন্য নয় বরং হাক্বীক্বতে উনাদের ভিতরে মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত কতটুকু রয়েছে বা মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বতে উনারা কতটুকু গরক্ব, তা প্রমাণ করার জন্যই মহান আল্লাহ পাক সুরতান উনাদের অনেক সময় অনেক কষ্ট দিয়েছেন। যেমন- হযরত আইয়ূব আলাইহিস সালাম উনার দীর্ঘ আঠারো বছর যাবত রোগ ভোগ ইত্যাদি।
অতএব উপরোক্ত বিভিন্ন প্রকার আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মর্যাদা দ্বীনের চেয়ে বেশী এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের জন্য কষ্ট বরন করেননি বরং একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির জন্যই সবকিছু করেছেন।
সুতরাং সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উল্লিখিত বক্তব্য সম্পূর্ণই অবান্তর, কল্পনাপ্রসূত ও অজ্ঞতামূলক, স্থান বিশেষে কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। (অসমাপ্ত)
0 Comments:
Post a Comment