প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ ( ২ নং ক )

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া
গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ


[সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উনার এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফউনার ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাযার শরীফ যিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামাজ ফরযে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরয নামাযের পর মুনাযাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইনজেকশন নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ-এর নামাযে বা অন্যান্য সময় পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়িয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং দাড়ি ও গোঁফের শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর চতুর্দশ (১৪তম) ফতওয়া হিসেবে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার দরবার শরীফ এ অসংখ্য শুকরিয়া।]

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ

মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তিনি পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
كنتم خير امة اخرجت للناس تامرون بالمعروف ةتنهون عن المنكر وتومنون بالله.

অর্থ : তোমরা (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি তাবলীগ তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সাথে সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। সেটা হলো- تو منون
অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা। অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। তবেই সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ফায়দা বা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব হবে।
স্মরণযোগ্য যে, বর্তমান প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের বেশকিছু লেখনী, বক্তব্য, বিবৃতি, আমল ও আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের মনে নানাবিধ সংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারপাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ হতে মাসিক আল বাইয়্যিনাতেরআকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য বিভাগ সুওয়াল-জাওয়াববিভাগে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারিত কতিপয় আপত্তিজনক আক্বীদাসমূহ উল্লেখ করে অসংখ্য চিঠি আসে। কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : যদি তোমরা না জান, তবে আহলে যিকির বা হক্কানী আলিম উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করো।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৪৩ ও পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ, ৭)
অর্থাৎ তোমরা যারা জাননা বা দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান রাখনা, তারা যাঁরা জানেন, উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।
অতএব, যাঁরা জানেন, উনাদের পবিত্র দায়িত্ব হলো- প্রশ্নকারীর প্রশ্নের শরীয়তসম্মত জাওয়াব প্রদান করা। কারণ যারা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাব প্রদান হতে বিরত থাকবে, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে। যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে দ্বীন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়জানা থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা গোপন করে অর্থাৎ জবাব না দেয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযা, আহমদ, মেশকাত শরীফ, বজলুল মাজহুদ, উরফুশশাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত ইত্যাদি)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে, “তার জ্বিহ¡া আগুনের কেঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হবে।
কাজেই উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে যে ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার থেকে বাঁচার জন্যে অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করার লক্ষ্যে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারঅগণিত পাঠক, গ্রাহক ও সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের প্রেরিত সুওয়ালসমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদাসমূহের শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব বা ফতওয়া দেয়া হলো।

প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়

এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় এই যে, মূলত : আমাদের সাথে কারো যেরূপ বন্ধুত্ব নেই, তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়ত উনার খিলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যেই হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
من احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মুহব্বত বা বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, বজলুল মাজহুদ, উরফুশশাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, মোজাহেরে হক্ব ইত্যাদি)
বস্তুত : মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি সবই উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
কাজেই মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায়প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতসম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো- প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কেউল্লেখকৃত আক্বীদাসমূহের সঠিক, বিশুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত ফায়সালা প্রদান এবং প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতের কাজে যারা মশগুল রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা উক্ত আক্বীদাসমূহ জেনে হোক বা না জেনেই হোক বিশ্বাস করে এবং তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করে, নিজেদের ও জনসাধারণের ঈমান ও আমলের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের সে ঈমান ও আমলের হিফাযত করা ও সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণের নিকট সত্য বা হক্ব বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক এতমিনান ও নাযাত লাভ করতে পারে।
মূলত : মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তাই এক মুমিন অপর মুমিনের ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমানী আলামত। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
المؤمن مرأة المؤمن.
অর্থ : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে আয়না স্বরূপ।” (আবূ দাউদ শরীফ, বজলুল মাজহুদ)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি স্বীয় খিলাফতকালে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রীতিনীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত হযরত আনছার এবং মোহাজির ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যদি আমি দ্বীনের হুকুম-আহকামকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে শরীয়তের বিরোধী কোন আদেশ প্রকাশ করি, তবে আপনরা কি করবেন?” উপস্থিত লোকেরা নীরব রইল। হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই কথার পূণরাবৃত্তি করলেন। তখন হযরত বশীর ইবনে সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “যদি আপনি এরূপ করেন, তবে আমরা আপনাকে এরূপ সোজা করবো, যেরূপ তীরকে সোজা করা হয়।এ কথা শুনে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, “আপনারাই আমার প্রকৃত বন্ধু, দ্বীনের কাজে সাহায্যকারী।” (আওয়ারেফুল মাআরেফ)
সুতরাং উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আলোকে অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃ পূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল হিফাযতের লক্ষে বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো। যাতে করে সত্যান্বেষী, সমঝদার মুসলমান ও প্রচলিত তাবলীগ কারীগণ সে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী ফায়সালা অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিজেদের ঈমান ও আমলের হিফাযত করে সঠিকভাবে দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খিদমত করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বীনের তাবলীগ যা খাছ ও আম তা শত-সহস্র লোক করবে এবং অবশ্যই করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করতে হবে। কারণ আক্বীদা শুদ্ধ না হলে দ্বীনী কোন খিদমতই মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্য নয়। উপরন্ত কুফরী আক্বীদা থাকার কারণে তাকে হতে হবে চির জাহান্নামী।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে দ্বীনী তাবলীগ (যা আম ও খাছ) করার তাওফিক দান করুন। (আমীন)

সুওয়াল : আমরা শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। কারণ আমরা অনেকদিন যাবত তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলাম এবং এখনো তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকের সাথে আমাদের মিলামিশা আছে। তাতে তাদের বেশ কিছু বক্তব্য বা আক্বীদা, যা আমরা অতীতেও জেনেছি এবং এখনো তা অবহিত হচ্ছি। তার মধ্যে অনেকগুলো তাদের লেখা কিতাবেও উল্লেখ আছে। সে সমস্ত আক্বীদাসমূহ আমাদের মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। সেগুলো আমরা নিম্নে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম -
(৮) হযরতজীর মলফুযাত নামক কিতাবের ১৫ পৃষ্ঠার ৩নং মলফূযে ও তাবলীগ জামাতের হাক্বীক্বত নামক কিতাবের ৭২ পৃষ্ঠায় একথা উল্লেখ আছে যে, “তরীক্বত পন্থায় কিছু কিছু বিদয়াত রয়েছে।
(৯) দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন (মুহম্মদ ওবায়দুল হক রচিত) ১১৬ পৃষ্ঠা, পস্তী কা ওয়াহেদ এলাজ ৯ পৃষ্ঠা, মূলঃ- মাওঃ এহতেশামুল হাসান কান্দলভী, অনুবাদক- ছাখাওয়াত উল্লাহ। তাবলীগী নেছাব ১১ পৃষ্ঠা, ফাজায়েলে তাবলীগ (মূলঃ- হযরত মাওলানা জাকারিয়া, অনুবাদক- আম্বর আলী) ৯ পৃষ্ঠা, তাবলীগে ইসলাম, লেখক- আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী ৯ পৃষ্ঠা ও মাওলানা শাহ মনিরুজ্জামান লিখিত- আমি কেন তাবলীগ করি ১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “তাবলীগ তথা দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, অন্য কোন কারণে নয়।দলীল স্বরূপ তারা পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার ১১০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে
كنتم خيرامة اخرجت للناس- الخ
পেশ করে থাকে।
(১০) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বেশ কিছু লোককে বলতে শুনেছি যে, তিন তাসবীহ পাঠ করলেই বেহেশতে যাওয়া যাবে, অন্যথায় নয়।
(১১) মলফূযাতের ৪৩ পৃষ্ঠার ৪২নং মলফূযে এবং নবুওয়ত ও মাওঃ ইলিয়াছ নামক কিতাবের ৩০-৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “মুসলমান দুপ্রকার- একদল প্রচলিত তাবলীগের জন্য হিজরত করবে, দ্বিতীয় দল নুছরত বা সাহায্য করবে, এ দুদলই মুসলমান। অর্থাৎ যারা প্রচলিত তাবলীগও করবেনা আর তাবলীগ কারীদেরকে সাহায্যও করবেনা, তারা মুসলমান নয়।” (অনুরূপ তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, লেখক- মোঃ ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী ১৭৪ পৃষ্ঠা, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন? (লেখক- ওবায়দুল হক) ২১ পৃষ্ঠ, হযরতজীর কয়েকটি স্বরণীয় বয়ান, ২য় খন্ড ১১ পষ্ঠায় উল্লেখ আছে।)
(১২) ফাযায়েলে তাবলীগ-এর ৪নং পৃষ্ঠায়, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন, (লেখক- ওবায়দুল হক) ১১৮ পৃষ্ঠা ও তাবলীগে ইসলাম (লেখক- আব্দুল সাত্তার ত্রিশাল) নামক কিতাবের ৯ পৃষ্ঠার বক্তব্য দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, “পবিত্র সূরা হামীম সিজদা শরীফ উনার ৩৩নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে
)ومن احسن قولامحن دعا الى الله- الخ(
প্রচলিত তাবলীগের জন্য খাছ। অর্থাৎ একমাত্র প্রচলিত তাবলীগ কারীরাই এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার পূর্ণ মিছদাক্ব বা নমুনা।
(১৩) টঙ্গীর ইজতেমা এলে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রায় লোক সাধারণ লোকদের মাঝে একথা প্রচার করে থাকে যে, “বিশ্ব ইজতেমাই হচ্ছে- গরীবের হজ্ব। কেননা টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় গেলে হজ্বের সওয়াব পাওয়া যায়।
(১৪) মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের মলফূযাতের ১৮ পৃষ্ঠার ২৯নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, নামাজ-রোজা উচ্চাঙ্গের ইবাদত কিন্তু দ্বীনের সাহায্যকারী নয়।
(১৫) দাওয়াতে তাবলীগ” (আম্বর আলী কর্তৃক প্রণীত) নামক কিতাবের প্রথম খন্ড ৩৯ পৃষ্ঠার বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকজন ইজতেমায়ী আমল করে, যার জন্য তারা আহলে তাসাউফগণ যারা ইনফেরাদী আমল করেন, তাদের থেকে অনেক বেশী সওয়াবের ভাগীদার হয়।
(১৬) আমাদের এলাকার তাবলীগ জামায়াতের এক আমীর আমাদের বললো যে, “টঙ্গীতে যে কয়দিন ইজতেমা সংঘটিত হয়, সে কয়দিন স্বয়ং হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেখানে উপস্থিত থাকেন।
(১৭) প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের মলফূযাতের৪৯ পৃষ্ঠার, ৭৪নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, শুধুমাত্র জিহ¡ার দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, যা প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালাদের মাঝেই বিদ্যমান।
(১৮) তাবলীগ জামাতের লোকেরা বলে- মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলেমের চেয়ে বেশী ফযীলত প্রাপ্ত হয়, আর মূর্খ লোক ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লা দরকার এবং তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে তেরো দফানামক কিতাবে ৭ পৃষ্ঠায় যা মুযাম্মিলুল হক উল্লেখ করেছেন, “মূর্খ লোক আমীর হওয়ার জন্য তিন চিল্লাহ যথেষ্ট, আর আলেমের জন্য প্রয়োজন সাত চিল্লার।
(১৯) প্রচালিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, প্রচলিত তাবলীগে গেলে পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ১১৯নং পবিত্র আয়াত শরীফ-  
كونوا مع الصادقين.
অর্থ : তোমরা ছদেক্বীনদের ছোহবত বা সংসর্গ লাভ কর।
এ আয়াত শরীফের আমল করা হয়। অর্থাৎ তাবলেিগ যাওয়ার অর্থ হচ্ছে- ছদেক্বীনদের সোহবত লাভ করা।
(২০) মলফুযাতে ইলিয়াছনামক কিতাবের ৪৮ পৃষ্ঠার বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালারাই যাকাত পাবার প্রকৃত হক্বদার।
(২১) তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্বনামক কিতাবের (লেখক- মাওঃ ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী) ১০৯ পৃষ্ঠায় ও তাবলীগে দাওয়াত কি এবং কেন?” নামক কিতাবের (লেখক- ওবায়দুল হক) ৭৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে জ্বিহাদ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান বা ছয় উছূলী তাবলীগই হচ্ছে- জিহাদুল আকবর। অনুরূপ তাবলীগ জামায়াতের সমালোচনা ও তার জবাব নামক কিতাবের যার মূল হযরত জাকারিয়া কর্তৃক লিখিত ৮৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে।
(২২) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা গাশতের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলে থাকে যে, গাশত ক্বাজা করা, নামাজ ক্বাজা করার চেয়েও কঠিন গুণাহের কারণ।
(২৩) হযরতজীর মালফুযাত নামক কিতাবের ১২৮ পৃষ্ঠার ২০১নং মালফুয এবং (মাওলানা ইসমাইল হোসেন, দেওবন্দী লিখিত) তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরুদায়িত্বনামক কিতাবের ১০১ পৃষ্ঠায় একথা লেখা আছে যে, ফাযায়েলের মর্যাদা মাসায়েলের চেয়ে বেশী।
(২৪) আপনাদের মাসিক আল বাইয়্যিনাতের২৬তম সংখ্যায় লিখেছেন যে, ভোট গণতন্ত্রের একটি অংশ আর গণতন্ত্র ইসলামে হারাম। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা লিখিত, “তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্বনামক কিতাবের ৭৫ ও ১২৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ভোট দান প্রচলিত তাবলীগের ৬নং উছূলের মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ ভোট দেয়াও তাবলীগের অন্তর্ভূক্ত।
(২৫) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা সাধারণ লোকদের তাবলীগের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্যে গাশতের ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলে থাকে যে, গাশতকারীরা যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, সে রাস্তায় যে ঘাস হয়, সে ঘাস যে গরু খায়, সে গরুর দুধ বা গোশত যারা পান করবে বা খাবে, তারাও বেহেশতে যাবে।
(২৬) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট প্রায় কিতাবেই একথা লেখা আছে যে, নবী আলাইহিস সালামগণ কোন কোন ক্ষেত্রে ভুল করেছিলেন। যেমন- হযরত আদম আলাইহিস সালাম গন্দম খেয়ে  ভুল করেছিলেন ও হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম দাওয়াত না দিয়ে ভুল করেছিলেন ইত্যাদি। (মালফুযাতে শায়খুল হাদীছ পৃষ্ঠা ২৩১, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, লেখক- মাওলানা ইসমাইল হোসেন, দেওবন্দী পৃষ্ঠা ৬১)
(২৭) মৌলভী মুহম্মদ ইব্রাহীম কর্তৃক লিখিত- তাবলীগ জামায়তের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতনামক কিতাবের ১ম খন্ড ৩৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, খৃীষ্টান মিশনারীদের ন্যায় প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত কৃতিত্বের দাবীদার।
(২৮) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, বিদায় হজ্বের(খূৎবা) ভাষণ শ্রবণকালে হযরত সাহাবা ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর, যাঁর ঘোড়ার মুখ যেদিকে ছিল, ভাষণ (খূৎবা) শেষ হওয়া মাত্র উনারা সেদিকেই প্রচলিত তাবলীগের কাজে ছুটেছেন।
(২৯) হযরত জাকারিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রণীত- তাবলীগ জামায়াতের সমালোচনা ও জবাব ৪৪ পৃষ্ঠায়, হযরতজীর মালফূযাত ২২ পৃষ্ঠা, মলফূয ২৯ পৃষ্ঠা, তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, (লেখক- মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী) ১১৫ পৃষ্ঠার বক্তব্য সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, “প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মাদ্রাসা কিতাবের প্রচার-প্রসার পছন্দ করেনা, খানকা শরীফ সম্পর্কেও ভাল ধারণা রাখেনা এবং মনে করে যে, সেগুলোর দ্বারা কমই ইসলামের খেদমত হয়ে থাকে।
(৩০) মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী লিখিত তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্বনামক কিতাবের ৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, লক্ষাধিক সাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণের মধ্যে অধিকাংশই মূর্খ ছিলেন। (অনুরূপ শরীয়তের দৃষ্টিতে তাবলীগী নেছাব, যার মূল হযরত জাকারিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রণীত- ১৩ পৃষ্ঠা, তাবলীগী জামায়াতের প্রধানের তর্ক ও ইচ্ছা নামক কিতাবের ৮ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে)
(৩১) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা আরো বলে থাকে যে, টঙ্গীর ইজতেমায় অনেক বেশী লোক হয়, তাই নামাজে বড় জামায়াত হয়। আর বড় জামায়াতের ফযীলত বেশী এবং সেই উদ্দেশ্যও টঙ্গীর ইজতেমায় হাজির হওয়া উচিৎ।
(৩২) হযরতজীর মলফূজাত, পৃষ্ঠা-৪৭, ৫০নং মলফুয, শরীয়তের দৃষ্টিতে তাবলীগী নেছাব পৃষ্ঠা ১৫, হযরতজী ইনয়ামের তর্ক ও বাহাছ পৃষ্ঠা ১২, তাবলীগ পরিচয় পৃষ্ঠা ১৭, তাবলীগ দর্পণ পৃষ্ঠা ৬২ ইত্যাদি কিতাব সমূহের বর্ণনা অনুযায়ী ইলিয়াস সাহেব বিশেষ স্বপে¦র মাধ্যমে এ তাবলীগের নির্দেশ পেয়েছেন। আবার কারো কারো মতে হিন্দু জমিদারদের কারণে মুসলমানগণ প্রায় হিন্দু হয়ে পড়লে, ইলিয়াস সাহেব এ তাবলীগের উদ্যোগ নেন। তাবলীগের কাজ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর ইলিয়াস সাহেবই পূনরুজ্জীবিত করেন।  
(৩৩) দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন” (লেখক- ওবায়দুল হক) নামক কিতাবের ৪৮ ও ৪৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, তাবলীগের কাজ করার কারণেই মাত্র দশ হাজার সাহাবা কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর মাজার মক্কা ও মদীনা শরীফে আছে। উল্লেখ্য প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকও এই কথা বলে থাকে।
(৩৪) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মনে করে যে, তাদের প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের অনুসরণ করা উচিৎ, কেননা তারা বড় জামায়াত। কারণ হাদীছ শরীফে রয়েছে যে, “তোমরা বড় জামায়াতের অনুসরণ কর।
(৩৫) হযরতজীর কয়েকটি স্মরণীয় বয়ান লেখক, মাওলানা নোমান আহমদনামক কিতাবের ১৩ পৃষ্ঠার বর্ণনা দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, সারা বছর প্রতি মাসে তিন দিন করে সময় লাগালে পুরা বছর আল্লাহর রাস্তায় কাটানো হয়েছে বলে গণ্য হবে। কারণস্বরূপ বলা হয়েছে, প্রতিটি নেক কাজের দশ গুণ সওয়াব হিসেবে এক দিনের কাজে ত্রিশ দিনের সওয়াব পাওয়া যাবে।
(৩৬) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাদের ফাযায়েল-ফযীলত সম্পর্কে নানা রকম কথা বলে থাকে। সে সমস্ত ফাযায়েল-ফযীলতের দলীল- আদিল্লা তলব করলে তারা তাদের মুরুব্বীদের দলীল দিয়ে থাকে। কোন অবস্থায়ই তারা কুরআন-সুন্নাহর দলীল পেশ করেনা। যা দাওয়াতে তাবলীগ, (আম্বর আলী লিখিত) ৮২ পৃষ্ঠা সুন্নী পরিচয় ও তাবলীগ পরিচয় কিতাব যা রেদওয়ানুল হক ইসলামাবাদী প্রণীত সে কিতাবের ৫৬ পৃষ্ঠার বর্ণনা দ্বারাও প্রতীয়মান হয়।
(৩৭) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের স্ত্রী লোকেরা মাহরাম পুরুষ ব্যতীত এক এলাকা বা শহর থেকে অন্য এলাকায় বা শহরে সফর করে থাকে, প্রচলিত তাবলীগের তালীম দেয়ার জন্য।
(৩৮) আল্লাহর রাস্তায় বের হলে ঘর সংসার আল্লাহ পাকই দেখবেন।একথা বলে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা অন্য লোকদেরকে প্ররোচিত করে। যার কারণে অনেক লোকই ঘর-সংসারের যথাযথ ব্যবস্থা না করে প্রচলিত তাবলীগে বের হয়ে যায়। অথচ এর ফলে তাদের বাড়ীর লোকজন প্রায়ই বিভিন্ন বর্ণনাতীত অসুবিধায় ভোগে। উল্লেখ্য আত তুরাগ, সম্পাদক হামীদ রশীদ মে/১৯৯৩ পৃষ্ঠা, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন নামক কিতাব, (লেখক- ওবায়দুল হক) ১৭ থেকে ২৬ পৃষ্ঠার  বর্ণনা দ্বারাও এই বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।
(৩৯) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, রাসুলের চেয়ে দ্বীনের মর্যাদা বেশী এবং আলাহ পাক নবী-রাসূলদের দ্বীনের জন্য কষ্ট দিয়েছেন, আর নবী-রাসূলগণও দ্বীনের জন্য কষ্ট করেছেন।
উপরোক্ত সুওয়ালের আলোকে এখন আমরা জানতে চাই, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু ঠিক? এবং তা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু প্রয়োজনীয় ও কোন স্তরের আমলের অন্তর্ভূক্ত? কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনার দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে ঈমান ও আমল হিফাযত করনে সাহায্য করবেন।

জাওয়াব : (আপনাদের তরফ থেকে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন সুওয়ালসহ প্রায় শতাধিক চিঠি এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে যেসব সুওয়ালগুলি মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলির জবাব না দিলেই নয়, সেরূপ প্রায় অর্ধ শতাধিক সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। তারমধ্যে গত (৩৫তম) সংখ্যায় ৭টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছিল। বর্তমান (৩৬তম) সংখ্যায় ৩২টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হলো। বাকীগুলোর জাওয়াব পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।)
আপনাদের বর্ণিত সুওয়াল মোতাবেক যদি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হয়ে থাকে, তাহলে তা শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে অবশ্যই আপত্তিজনক, যা গোমরাহীমূলক, বিভ্রান্তিকর ও জিহালতপূর্ণ এবং তারমধ্যে কোন কোনটি কুফরীমূলক বক্তব্যও রয়েছে।
তবে আপনারা যেহেতু দলীল ভিত্তিক জাওয়াব চেয়েছেন, তাই আমরা উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই শরীয়তসম্মত তথা কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসের ভিত্তিতে জাওয়াব দিব। (ইনশাআল্লাহ)
কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে বলেন,
فاسئلوا اهل الذكر انكنتم لا تعلمون.
অর্থ : তোমরা যারা জাননা, যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৪৩)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
من سئل عن علم علمه ئم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে ইলমের বিষয় সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করা হয়, আর সে জানা থাকা সত্ত্বেও তা চুপিয়ে রাখে, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী দেয়া হবে।” (আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী শরীফ, ইবনে মাযাহ শরীফ, আহমদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, বজলুল মাজহুদ, মিরকাত শরীফ, উরফুশশাজী, তালীক, শরহুত ত্বীবী)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, “তার জিব কেটে দেয়া  হবে ইত্যাদি।
তাই নিম্নে পর্যায়ক্রমে আপনাদের প্রেরিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহের পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য দলীলসমূহের ভিত্তিতে শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো-

তাবলীগের অর্থ ও প্রকার

তাবলীগ সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ কি, তা জানতে হবে।
)تبليغ(
তাবলীগ অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দুপ্রকার অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দুভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১) তাবলীগে (عام) আম বা সাধারণভাবে, (২) তাবলীগে (خاص) খাছ বা বিশেষভাবে। আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দুপ্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক)।

মুবাল্লিগে আম ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র

মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারকারী)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে সূরা তাহরীম উনার ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا قوا انفسكم واهليكم نارا.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।
আর পবিত্র বুখারী শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাসম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته.
অর্থ : সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, মিরকাত শরীফ, লুময়াত ইত্যাদি)
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো বলেন,
بلغوا عنى ولو اية.
অর্থ : তোমরা আমার থেকে একটি পবিত্র আয়াত শরীফ (পবিত্র হাদীছ শরীফ) হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বোখারী শরীফ)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- তখন হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে না পার। (তিবরানী শরীফ)
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আরো বলেন,
الدين نضيحة
অর্থ : দ্বীন হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।হযরত ছাহাবায়ে ক্বিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং মহান আল্লাহ পাক প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ উনার হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।
কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করবেন।
অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-উনার জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তালীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম-উনার জন্য ফরযে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, কাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, কবীর)

মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র

মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-উনার মত নয়। অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন।
আর যাঁরা খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট প্রচারক, উনাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ولنكن منكم امة يدتمون الى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون عن المنكر واولئك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম উনার) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১০৪)
অর্থাৎ তাকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعله يحذرون.
অর্থ : কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১২২)
(তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : তোমরা দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর এবং  মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুতনী, মিশকাত)
মূলতঃ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনাদের অবশ্যই ওলামায়ে হাক্কানী-রাব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী, রব্বানী আলেম উনাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.
অর্থ : নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলিমরাই মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করেন।” (পবিত্র সূরা ফাতির শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৮)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর হযরত ইমাম আহম্মদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী মহান আল্লাহ পাক উনার ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলিম।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
من ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟ قال الطمع.
অর্থ : “(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলিম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আলিমের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।”  (দারিমী, মিশকাত)
অর্থাৎ যিনি ইলম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হাক্কানী-রাব্বানী আলিম।
কাজেই যিনি ইলম, আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হাক্কানী আলিম, আর তিনিই হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলিমগণ হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (আহমদ, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত)
অর্থাৎ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনারা নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে উনাদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তালীম ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ তাছাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদরাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদিভাবে দাওয়াত ও তালীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-উনার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আমের (ফরযে কিফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-উনার (ফরযে আইনের) খিদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

মুবাল্লিগে আমের জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ উনার যোগ্যতা ও তাবলীগে আমের শর্ত

স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরযে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কশ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়িয নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক উনার সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল করেছ?” যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) পবিত্র সূরা সফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
يا ايها الذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?”
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(২) তিনি আবার বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন,
اتأمرون الناس بالبر وبنسون انفسكم وانتم تتلون الكتاب.
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انهاكم عنه.
অর্থ : আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খিলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮৮)
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না।
তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ পবিত্র আয়াত শরীফসমূহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।অর্থাৎ উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়িয নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যেই ফরযে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলিম উনাদের জন্যেই প্রযোজ্য, যা উনাদের জন্যে ফরযে কিফায়ার অন্তর্ভূক্ত। অতএব, মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাযায়িয ও হারাম হবে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ যাকে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে, (যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে) যদি তাদের কথা মোতাবেক সেটাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই সেটা মুবাল্লিগে খাছ-উনার জন্য করা উচিৎ ছিল। অথচ তা এমন সব লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লীগে খাছ তো নয়ই, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই মুবাল্লীগে আম-উনারও উপযুক্ত নয়। যদিও কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগে আম রয়েছে।
অতএব তাবলীগে আম মুবাল্লিগে খাছ উনার জন্যই করা ফরযে কিফায়া। যা মুবাল্লিগে আমের জন্য করা সম্পূর্ণ নাযায়িয ও হারাম। আর সাধারণ লোকেরতো প্রশ্নই উঠেনা।
এখন হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় এমন কতক লোক, যারা মুবাল্লিগে খাছ ও আম কোনটাই নয়, তারা অনেকেই নামাযের জামায়াতে যাওয়ার সময় বা নামায পড়ার সময় অন্যকে নামাযে ডেকে নিয়ে যায়, রোযার মাসে রোযা রাখার কথা বলে, ইত্যাদি অনেক নেক কাজের কথাই বলে থাকে, যা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা তবে সেটার ফায়সালা কি?
এর ফায়সালা হলো, ঐ সকল লোক মুসলিম শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ-
الدين نصيحة
অর্থাৎ দ্বীন হচ্ছে অপরের ভাল কামনা করা।”) এর মিছদাক বা নমুনা। অর্থাৎ এদেরকে কেউ হিদায়েতের দায়িত্ব দেয়নি বা উনারা হিদায়েতের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। উনারা হচ্ছে মানুষের খয়েরখাঁ বা হিতাকাঙ্খী।
এখানে উল্লেখ্য যে, তিবরানী শরীফ উনার উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে, সৎকাজ না করলেও অপরকে সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, “তোমরা ঐ কথা বল কেন, যা তোমরা নিজেরা করোনা।
তাহলে এই পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বক্তব্যের মধ্যে ফায়সালা কি?
মূলতঃ উনার ফায়সালা উলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ দিয়েছেন। উনাদের মতে তিবরানী শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সৎ কাজ না করলেও সৎ কাজের দাওয়াত দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা মুবাল্লিগে আমের জন্য। যেমন কোন বাবা নিজে নামায বা অন্যান্য নেক কাজ না করা সত্বেও তার সন্তান ও অধিনস্তদের নামায বা অন্যান্য নেক কাজের জন্য বলতে পারেন।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা বলার জন্য যে নিষেধবাণী করা হয়েছে, তা হলো- মুবাল্লিগে খাছ-উনার জন্য। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ-উনার জন্য নিজে কোন সৎ কাজ না করে অপরকে তা করতে বলা জায়িয নেই।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, “সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যখন মিরাজ শরীফ যান, তখন দেখলেন কিছু লোকের জিহ্বা আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছে। তখন জিজ্ঞাসা করা হলো- উনারা কারা? হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, এরা ওই সকল লোক, যারা অন্যকে নেক কাজের উপদেশ দিতো কিন্তু নিজেরা তা করতো না।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তিবরানী শরীফ উনার বর্ণনা মোতাবেক সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারা কুরআন শরীফ-উনার উক্ত আয়াত শরীফ মোতাবেক নিজে সৎকাজ না করে অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন না। কারণ যদি সকলের জন্যে আমভাবে একথা বলা হয় যে, সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজের কথা বলা জায়িয, তবে মিরাজ শরীফ উনার পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণিত লোকদের জিহ¡া কাটা হলো কেন? এতে বুঝা গেল যে, তিবরানী শরীফ উনার উক্ত হুকুম সকলের জন্যে প্রযোজ্য নয়। বরং যারা মুবাল্লিগে আম, তাদের জন্যেই প্রযোজ্য। আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উক্ত আয়াত শরীফ ও মিরাজ শরীফ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা যারা মুবাল্লিগে খাছ, তাদের জন্যে প্রযোজ্য।
সুতরাং হাক্বীক্বতে উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ ও আয়াত শরীফ উনার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। অনেকে ব্যাখ্যা না জানার কারণে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। মূলতঃ উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও হাদীছ শরীফ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়।
সুওয়াল সমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের জাওয়াব

৮নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : হযরতজীর মলফুযাত নামক কিতাবের ১৫ পৃষ্ঠার ৩নং মলফূযে ও তাবলীগ জামাতের হাক্বীক্বত নামক কিতাবের ৭২ পৃষ্ঠায় একথা উল্লেখ আছে যে, “তরীক্বত পন্থায় কিছু কিছু বিদয়াত রয়েছে।
এখানে আমাদের সুওয়াল হচ্ছে- তরীক্বত পন্থায় সত্যিই কি বিদয়াত রয়েছে? আর যদি থেকেই থাকে, তবে তা বিদয়াতে হাসানাহ না বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ? আর তরীক্বত সম্পর্কিত উপরোক্ত মন্তব্য কতটুকু সঠিক, তা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের নির্ভরযোগ্য দলীল দ্বারা বিস্তারিতভাবে জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : হ্যাঁ। একথা ঠিক যে, তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস সাহেবের মলফুজাতে তার বাণী হিসেবে একথা লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু তার উপরোক্ত বক্তব্য আদৌ সঠিক বা শুদ্ধ হয়নি। কারণ সাধারণভাবে বিদয়াত বলতে বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহকেই বুঝায়। এ প্রসঙ্গে উছূলের কিতাবে একটি উছূল উল্লেখ আছে যে,
المطلق يطلق على الفرد الكامل.
অর্থাৎ কোন বিষয়ের মূলটা বললে তার পূর্ণটা বুঝায়। যেমন ফরয বলতে ফরযে আইন, সুন্নত বলতে সুন্নতে মুয়াক্বাদাহ, অনুরূপ বিদয়াত বলতে বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহকেই বুঝায়।
কাজেই তরীক্বত পন্থায় কিছু কিছু বিদয়াত রয়েছে।সরাসরিভাবে একথা বলা জায়িয নেই। কারণ এ কথার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, তরীক্বতে যে সকল বিদয়াতসমূহ রয়েছে, তা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। অথচ তরীক্বত পন্থায় বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহর বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই। অবশ্য বিদয়াতে হাসানাহ রয়েছে। তবে বিদয়াতে হাসানাহ অবশ্যই শরীয়তে গ্রহণযোগ্য এবং দ্বীনের জন্য সহায়ক আর ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাবশ্যাকীয়ও বটে। নিম্মে বিদয়াত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
বিদয়াতের পরিচয়
আমাদের প্রথমে জানতে হবে বিদয়াত শব্দের অর্থ কি? বিদয়াত কাকে বলে? এবং কত প্রকার ও কি কি?
বিদয়াত (يدعة) শব্দটি (اسم مشتقق) একবচন (واحد) স্ত্রীলিঙ্গ (مؤنث) এবং তার বহুবচন (جمع) হলো  بدع
বিদয়াতের লোগাতী (আভিধানিক) অর্থসমূহ নিম্নরূপ-
বিদয়াতের লোগাতী অর্থ
বিদয়াতের লোগাতী অর্থ হচ্ছে- (১)
البدعة:- احدث فى الدين بعد الاكمال، اومالستحدث بعد النبى صلى الله عليه وسلم من الاهراء والاعمال. (لغات القاموس المحيط ج صفه ، بيان للسان، صفه ১১৫، لسان العرب ج صفه ২২৯، تاح العروس جه صفه ২৭১، لغات هيرا صفه ১৭৫، غياث للغات صفه ৭১)
অর্থ : বিদয়াত হলো- দ্বীনের পূর্ণতার পর নতুন কোন বিষয় উদ্ভব হওয়া অথবা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর আমল ও খাহেশাত সম্পর্কিত কোন কিছুর নতুন উৎপত্তি।” (লোগাতুল কামূস আল মুহীত্ব ৩য় জিঃ পৃঃ৩, বয়ানুল লিসান, পৃঃ১১৫, লিসানুল আরব ১ম জিঃ পৃঃ২২৯, তাজুল উরুস ৫ম জিঃ পৃঃ২৭১, লোগাতে হীরা পৃঃ১৭৫, গিয়াসুল লোগাত পৃঃ৭১) (২)           
بغیرنمونہ کے بنائی ھئی چیز، (مصباح للغات صفہ ২৭ لغات سعیدی صفہ ৯৬
অর্থ : বিদয়াত হলো- নমুনা ব্যতীত সৃষ্ট জিনিস।” (মিছবাহুল লোগাত, পৃঃ২৭) (৩)
والبدعة، اصلها مااحدث على غبر مثال سابق فتح البارىج صفه ২১৯، مرقاة شرح مشكوة(
অর্থ : বিদয়াত মূলতঃ তাকেই বলা হয়, যা পূর্ব নমুনা ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়েছে।” (ফাতহুল বারী শরহে বুখারী ৪র্থ জিঃ পৃঃ২১৯, মিরকাত শরীফ) (৪)         
بدانکہ ھر چیز پیدا شدہ بعد از پیغمبر علیہ السلام بدعت است- (اشعۃ للمعات(
অর্থ : জেনে রাখ, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পরে উদ্ভব ঘটেছে এমন প্রত্যেক কাজই বিদয়াত।” (আশয়াতুল লুময়াত) (৫)
بدعة- نئ بات، نئ رسم (عربى فيروز اللغات صفه ৫৩)
অর্থ : বিদয়াত হলো- নতুন কথা, নতুন প্রথা।” (আরবী ফিরোজুল লোগাত পৃঃ৫৩) ৬)
وہ چیز جو بغیر کسی سابق بثال کے بنائی جائے- (لغات المنجد صفہ ৭৬)
অর্থ : বিদয়াত তাকে বলা হয়, যা পূর্ব নমুনা ব্যতীত সৃষ্টি করা হয়।” (লোগাত আল মুনজিদ পৃঃ৭৬) (৭)
البدعة- نئ بات. (لغات سعيدى صفه ৯৬)
অর্থ : বিদয়াত হলো- নতুন কথা।” (লোগাতে সাঈদী পৃঃ ৯৬)
সুতরাং বিদয়াত শব্দের লোগাতী বা আভিধানিক মূল অর্থ হলো- নতুন উৎপত্তি, নতুন উদ্ভব, নতুন সৃষ্টি। পূর্বে যার কোন অস্তিত্ব ছিলনা।

বিদয়াতের শরীয়তী অর্থ
(১) বিদয়াতের শরীয়তী অর্থ সম্পর্কে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী হানাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
والبدعة فى الاصل احداث امر لم يكن فى زمان رسول الله صلى الله عليه وسلم. ( عمدة القارى، ج صفه ৩৫৬، الا عتصام ج صفه ২০)
অর্থ : প্রকৃতপক্ষে বিদয়াত হলো- এমন জিনিসের আবির্ভাব, যার নমুনা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা।” (ওমদাতুল ক্বারী শরহে বোখারী ৫ম জিঃ পৃঃ৩৫৬, আল ইতেছাম জিঃ১ পৃঃ২০)
(২) আল্লামা ইসমাঈল নাবিহানী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
قال العز دالدين ابن السلام- البدعة فعل مالم يعهد فى عهد النبى صلى الله عليه وسلم. (حواهر البحار صفه ২৮০)
অর্থ : (শায়খুল ইসলাম) ইজদুদ্দীন ইবনে সালাম বলেন, “বিদয়াত এমন একটি কাজ, যা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানায় সম্পন্ন হয়নি।” (জাওয়াহিরুল বিহার পৃ: ২৮০)
(৩) ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
وفى الشرع احداث مالم يكن فى عهد رسول الله  صلى الله عليه وسلم. (شرح مسلم)
অর্থ : শরীয়ত মুতাবিক বিদয়াত হচ্ছে- এমনসব নব আবিস্কৃত জিনিসের নাম, যা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা।” (শরহে মুসলিম লিন নববী)
(৪)  হাফিয ইবনে রজব রহমতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন,
المراد بالبدعة ما احدث مما لا اصل له فى الشريعة يدل عليه واما ماكان له اصل من الشرغ يدل عليه فليس ببدعة شرعا وان كان بدعة لغة. (جامع العلوم والحكم، صفه ১৯৩، ارشادالعنود صفه ১৬১)
অর্থ : বিদয়াত ঐ বিষয়কে বলা হয়, যার ভিত্তি শরীয়তে নেই। সুতরাং শরীয়তে যে বিষয়ের ভিত্তি রয়েছে, শরীয়ত মোতাবেক তা বিদয়াত নয়, যদিও আভিধানিক অর্থে বিদয়াত বলা হয়।” (জামিউল উলূম ওয়াল হাকাম পৃঃ১৯৩, ইরশাদুল উনূদ পৃঃ১৬১)
(৫) ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি লিখেছেন,
البدعة فى الشرع هى احداث مالم يكن فى عهد النبى صلى الله عليه وسلم. (تهذيب الا سماء وللغات(
অর্থ : ইমাম নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “বিদয়াতের শরীয়তী অর্থ হচ্ছে- এমন একটি  নতুন কর্ম, যা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার যামানায় ছিলনা।” (তাহযীবুল আসমা ওয়াল লোগাত)
অতএব, শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে বিদয়াত শব্দের মূল অর্থ হলো- ঐসব নতুন উদ্ভুত বিষয়, যার ভিত্তি কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের মধ্যে নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, বিদয়াত হলো- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর হতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভাবিত প্রত্যেক নতুন বিষয়। এখন তা খায়রুল কুরুনেও হতে পারে অথবা তার পরেও হতে পারে।
 বিদয়াতের ব্যাখ্যা
উপরোক্ত লোগাতী ও শরীয়তী অর্থের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিদয়াত হলো নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর হতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভাবিত প্রত্যেক নতুন বিষয়। অতএব, নতুন উদ্ভাবিত বিষয়ের কোনটি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য ও কোনটি পরিত্যাজ্য, তা অবশ্যই ব্যাখ্যা সাপেক্ষ।
এ বিদয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্ব বিখ্যাত হাদীছ শরীফ উনার কিতাব মিশকাত শরীফ উনার শরাহ মিরকাত শরীফউনার মধ্যে উল্লেখ করেন,
قال الشافعى رحمة الله مااحث مما يخالف الكتاب اوالسنة او الاثر اوالاجماع فهو ضلالة- وما احدث مما لا يخالف شيأ مما ذكر فليس بمذمموم- (مرقات شرح مشكوة ج صفه ১৮৯)
অর্থ : ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, যে নব উদ্ভাবিত কাজ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, আসার (অর্থাৎ হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের আমল বা ক্বওল) অথবা ইজমার বিরুদ্ধ বলে প্রমাণিত, তাই গোমরাহী ও নিকৃষ্ট। আর যে নব উদ্ভাবিত কাজ উল্লেখিত কোনটির বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়, তা মন্দ বা নাজায়িয নয়।” (মিরকাত শরহে মিশকাত, ১ম জিঃ পৃঃ ১৮৯)
ইমাম শারানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতিই যে নিকৃষ্ট বা নিষিদ্ধ হবে, তার কোন যুক্তি নেই।” (আনওয়ারে কুদসিয়্যাহ)
অথচ আজকাল কিছু জাহিল লোক সকল বিদয়াতকেই (নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতি) গোমরাহী বলে থাকে এবং দলীল হিসাবে তারা নিম্মোক্ত হাদীছ শরীফখানা পেশ করে থাকে। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
كل بدعة ضلالة.
অর্থ : প্রত্যেক বিদয়াতই গোমরাহী।” (মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ব ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, তালীকুছ ছবীহ, মিরআতুল মানাজীহ)
অথচ তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে তারা নেহায়েতই অজ্ঞ। এ হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় মিশকাত শরীফ উনার শরাহ মিরকাত শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়,
قوله كل بدعة ضلالة قال فى الازهار اى كل بدعة سيئة ضلالة.
অর্থ : সাহেবে মিরকাত হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “আল আজহারনামক কিতাবে
كل بدعة ضلالة
(প্রত্যেক বিদয়াতই নিকৃষ্ট)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এ অংশটুকুর ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়েছে,
"اى كل بدعة سيئة ضلالة"
অর্থাৎ  সকল  বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহই গোমরাহী।
আর তাই শায়খ ইব্রাহীম হালবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
وعدم النقل عن النبى صلى الله عليه وسلم وعن الصحابة والتابعين ورضى الله عنهم وكونه بدعة لا ينفى كونه حسنا. (كبيرى شرح منية المصلى صفه ২৫১)
অর্থ : নতুন উদ্ভাবিত কোন কাজ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, হযরত তাবেয়ীন রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের নিকট হতে প্রমাণিত না থাকলে অথবা উক্ত কাজের প্রতি বিদয়াত শব্দ আরোপিত হলেই যে তা মন্দ বা গোমরাহী, একথা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং তা ভালও হতে পারে।” (কবীরী শরহে মুনিয়াতুল মুসল্লী পৃঃ২৫১)
হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিও উনার ইহইয়াউল উলুম কিতাবের ২য় খ- ২৬ পৃষ্ঠায় অনুরূপ মন্তব্য করেন।
কেউ কেউ আবার উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত নিন্মোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা পেশ করে বলেন যে, সকল বিদয়াতই পরিত্যাজ্য। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করা হয়,
من احدث فى امرنا هذا ماليس منه فهورد.
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের ভিতরে কোন নতুন জিনিস উদ্ভাবন করবে, যার ভিত্তি এ দ্বীনে নেই, সেটা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুছছারী, মিশকাত শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত শরীফ, তালীকুছ ছবীহ, শরহুত ত্বীবী মুজাহের মিরয়াতুল মানাজিহ)
এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
قوله ماليس منه يدل على ان الامور التى لها اصل من الكتاب او من سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم اومن الخلفاء الراشدين اوتعامل عامة السلف او الاجتهاد المعتبر بشروط، المستند الى النصوص لا تسمى بدعة شرعية لا ى. (بدعة سيتة) فان هذه الاصول كلها من الدين- (فتح الملهم شرح المسلم ج صفه ৪০৭)
অর্থ : ماليس منه পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উক্ত শব্দ দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হয়, যে সকল দ্বীনী কাজের সনদ পবিত্র কুরআন শরীফ অথবা পবিত্র হাদীছ শরীফ বা হযরত খুলাফায়ে রাশিদীন আলাইহিমুস সালাম উনাদের সুন্নত অথবা বুযুর্গানে দ্বীনের পারস্পরিক কার্যকলাপ অথবা গ্রহণযোগ্য শর্তাদীসহ শরীয়ত উনার স্পষ্ট দলীলসমূহের ভিত্তিতে যে ইজতিহাদ করা হয়েছে, তার মধ্যে পাওয়া যায়, তবে সেগুলোকে নিকৃষ্ট বিদয়াত (বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ) বলা যাবেনা। কারণ সে ভিত্তিসমূহ দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত।” (ফতহুল মুলহিম শরহে মুসলিম, ২য় জিঃ পৃঃ ৪০৭)
অতএব, যে সকল কাজ উল্লেখিত ভিত্তিসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা দ্বীন অর্থাৎ শরীয়ত উনার অন্তর্ভূক্ত বলেই বিবেচিত হবে। অনুরূপ মুযাহেরে হক্ব ১ম খন্ড ৭০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ  রয়েছেপবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ماليس منه শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে- উদ্দেশ্য এই যে, যে সকল কাজ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের বিরুদ্ধ নয়, সেগুলোকে বিদয়াতের গণ্ডী বহির্ভূত করে রাখা। কারণ এ সকল কাজ নতুন উদ্ভুত হলেও গোমরাহী বা নিকৃষ্ট নয়।
কেউ কেউ আবার মাহবুবে সুবহানী, কুতুবে রব্বানী, কাইয়্যুমে আউয়াল হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার একটি ক্বাওল উনার ভুল ব্যাখ্যা করে বলে থাকে যে, বিদয়াত বলতেই গোমরাহী। কেননা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “আমি কোন বিদয়াতের মধ্যেই নূর দেখিনা, তা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহই হোক বা বিদয়াতে হাসানাই হোক।অথচ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার উক্ত ক্বাওলটি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আমল অর্থাৎ সুন্নত উনার মধ্যে যে নূর রয়েছে, তা অন্য কারো আমলের মধ্যে নেই আর তাই তো স্বাভাবিক। কেননা সুন্নত উনার মধ্যে যে নূর রয়েছে, তা বিদয়াতের মধ্যে কখনো পাওয়া সম্ভব নয়। আর তাই তিনি বলেছেন, “আমি কোন বিদয়াতের মধ্যেই নূর দেখিনা।অর্থাৎ সুন্নত উনার ন্যায় নূর দেখিনা। অবশ্য হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উপরোক্ত কথার দ্বারা বিদয়াতে হাসানাহ যে পরিত্যাজ্য তা বুঝায় না। কেননা তিনি নিজেও অনেক বিদয়াতে হাসানাহ আমল করেছেন ও তা আমলে উৎসাহিত করেছেন, যেমন তাসাউফ উনার সমস্ত তরীক্বাগুলো। যেহেতু খাইরুল কুরুনেতাসাউফ উনার মাকামাতগুলো বর্তমান তরীক্বাগুলোর ন্যায় সুবিন্যস্ত আকারে সন্নিবেশিত ছিল না। অথচ হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাসাউফ উনার বেশীরভাগ তরীক্বার সংস্কার সাধন করেন। বিশেষভাবে নকশবন্দীয়া তরীক্বাকে আরো বিস্তারিত ও ব্যাপক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে নকশবন্দীয়ায়ে মুজাদ্দিদিয়া নামক তরীক্বার প্রবর্তন করেন এবং নিজে এই সকল তরীক্বার মাকামের বিন্যাস, হাল-অবস্থা বর্ণনা করে মুরীদ-মুতাকিদগণকে তালীম-তালক্বীন দিয়ে গেছেন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জীবনে এরকম আরো অনেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তিনি বিদয়াতে হাসানাহ কাজকে কখনও পরিত্যাগ করেননি বা করতে বলেননি। কাজেই যারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ক্বাওল শরীফ উনার ভুল ব্যাখ্যা প্রচারে লিপ্ত, তারাই আবার উনার অন্যান্য বিদয়াতে হাসানাহ আমলগুলো সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। অতএব তাদের কথা বা কাজ গ্রহণযোগ্য নয়। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিদয়াতে হাসানাহ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য, আর বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, বিদয়াত মাত্রই পরিত্যাজ্য নয় এবং সকল বিদয়াতই গোমরাহী নয়। যদি তাই হতো, তবে তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়া জায়িয হতো না। কেননা একেও বিদয়াত বলা হয়েছে, অর্থাৎ উত্তম বিদয়াত।
এখন মূল বিষয় হলো- বিদয়াত কত প্রকার ও কি কি এবং তার মধ্যে কোনটি শরীয়তে গ্রহণযোগ্য আর কোনটি শরীয়তে পরিত্যাজ্য, তা নির্ণয় করা।
বিদয়াতের শ্রেণী বিভাগ
হযরত ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি আলাইহিম শরীয়ত উনার বিধান অনুযায়ী বিদয়াতকে প্রথমতঃ দুভাগে বিভক্ত করেছেন-
১। বিদয়াতে ইতেক্বাদী, অর্থাৎ আক্বীদা বা বিশ্বাসগত বিদয়াত।
২। বিদয়াতে আমালী, অর্থাৎ কর্মগত বিদয়াত।
(১) বিদয়াতে ইতেক্বাদী বা আক্বীদাগত বিদয়াত হলো- যে সমস্ত আক্বীদা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের মূলনীতির বহির্ভূত। মূলতঃ এ আক্বীদাগত বিদয়াতের সবই হারামের পর্যায়ভূক্ত এবং অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন- খারিজী, মুতাজিলা, জাবারিয়া, ক্বদরিয়া, শিয়া ইত্যাদি বাতিল ফিরকার আবির্ভাব। এই নব আবির্ভূত ফিরকার ন্যায় আক্বীদা পোষণ করা সম্পূর্ণই হারাম ও কুফরী।
(২) বিদয়াতে আমালী বা কর্মগত বিদয়াত প্রথমতঃ দুভাগে বিভক্ত- (ক) বিদয়াতে হাসানাহ, (খ) বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ।
(ক) বিদয়াতে হাসানাহ আবার তিন প্রকার- (১) বিদয়াতে ওয়াজিব, (২) বিদয়াতে মোস্তাহাব ও (৩) বিদয়াতে মোবাহ।
আর এ বিদয়াতে হাসানাহ সম্পর্কেই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,          
من سن فى الاسلام سنة حسنة فله اجرها واجر من عمل بها من بعده.
অর্থ : যে কেউ দ্বীন ইসলামে উত্তম কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করবে (যা শরীয়ত সম্মত), তার জন্য সে সওয়াব পাবে এবং তারপরে যারা এ পদ্ধতির অনুসরণ করবে, তার সওয়াবও সে পাবে।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী)
উল্লিখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দৃষ্টিতে বিদয়াতে হাসানাহকে বিদয়াত লিদদ্বীন বলা হয়। কেউ কেউ আবার উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দৃষ্টিতে বিদয়াতে হাসানাহকে
(بدعت لغوى)
বিদয়াতে লোগবীও বলে থাকেন। অর্থাৎ যদিও শাব্দিক অর্থে বিদয়াত বলা হয়েছে, মূলতঃ এগুলো সুন্নাত উনারই অন্তর্ভূক্ত। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে (سنة) সুন্নাত শব্দ উল্লেখ রয়েছে।
(খ) আর বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ দুপ্রকার- (১) বিদয়াতে হারাম, (২) বিদয়াতে মাকরূহ।
এই বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ সম্পর্কেই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
من احدث فى امرنا هذا ماليس منه فهورد.
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার এ দ্বীনের ভিতরে কোন নতুন জিনিসের প্রবর্তন করবে, যার ভিত্তি এ দ্বীনে নেই, তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুসসারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, মুজাহিরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, তালীক)
আর এ বিদয়াত সম্পর্কেই ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
كل بدعة ضلالة.
অর্থ : প্রত্যেক বিদয়াতই (সাইয়্যিয়াহ) গুমরাহী।” (মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী)
উল্লেখিত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার দৃষ্টিতে বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহকে বিদয়াত ফিদদ্বীন বলা হয়। আর এ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহকেই শরয়ী (شرعى) বিদয়াত বলা হয়।
মূলকথা হলো- যা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর নতুন উদ্ভব হয় এবং তা দ্বীনের সাহায্য করে থাকে অথবা সাহায্যকারী না হলেও দ্বীনের কোন ক্ষতি করে না, তাই বিদয়াত লিদদ্বীন বা লোগবী বিদয়াত অর্থাৎ বিদয়াতে হাসানাহ। আর যে নতুন বিষয় উদ্ভব হওয়ার কারণে দ্বীনের কিছুমাত্রও ক্ষতি হয়, তবে তাই হবে বিদয়াত ফিদদ্বীন বা শরয়ী বিদয়াত অর্থাৎ বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ।
উল্লিখিত আলোচনা দ্বারা এই প্রমাণিত হয় যে, বিদয়াত বলতেই তা পরিত্যাজ্য নয়। অর্থাৎ যেই বিদয়াত  বা নতুন উদ্ভাবিত কাজ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের বিপরীত তা অবশ্যই বর্জনীয়। আর তাই বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ বা হারামের অন্তর্ভূক্ত, যদিও তা কুরুনে সালাসারমধ্যে উদ্ভাবিত হোক না কেন। আর যেই নতুন উদ্ভাবিত কাজ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের অনুকুলে তা অবশ্যই জায়িয এবং উত্তম, আর একেই বিদয়াতে হাসানাহ বলা হয়। যদিও তা কুরুনে সালাসারপরে উদ্ভাবিত হোক না কেন।

বিদয়াতে হাসানাহ ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ-এর বিশ্লেষণ
নিম্নে বিদয়াতে হাসানা ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহর উদাহরণভিত্তিক ব্যাখ্যা দেয়া হলো-
১। বিদয়াতে ওয়াজিব : যা পালন না করলে দ্বীন ইসলাম উনার ক্ষতি বা সংকট হবে, যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ কাগজে কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করা, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার জের, জবর, পেশ দেওয়া, মাদ্রাসা নির্মাণ করা, নাহু সরফ, উসুল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিতাব লেখা ও পড়া।
২। বিদয়াতে মুস্তাহাব : যা শরীয়তে নিষেধ নেই এবং তা সমস্ত মুসলমানগণ ভাল মনে করে সাওয়াবের নিয়তে করে থাকেন, যেমন- তারাবীহ নামায জামায়াতে পড়া, মুছাফিরখানা, ইবাদতখানা, লঙ্গরখানা, খানকা শরীফ ইত্যাদি জনহিতকর কাজ করা। খতিবের সম্মুখে আযান দেয়া, রমযান মাসে বিতর নামায জামায়াতে আদায় করা ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত- নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
ما راه الناس حسنا فهو عند الله حسن- لاتحبتمع امتى على الضلالة.
অর্থ : লোকে যা ভাল মনে করে তা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকটও ভাল। আমার উম্মতগণ কখনো গুমরাহীর মধ্যে একমত হবে না।” (মিশকাত শরীফ)
৩। বিদয়াতে মুবাহ : ঐ সমস্ত নতুন কাজ যা শরীয়তে নিষেধ নেই, যেমন- পোলাও, বিরিয়ানী, বুট, মুড়ী, পিয়াঁজো ইত্যাদি খাদ্য খাওয়া। ট্রেন, মোটরগাড়ী, প্লেন ইত্যাদি যান-বাহনে চড়া।
৪। বিদয়াতে হারাম : যা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের পরিপন্থী বা ওয়াজিব আমলগুলি ধ্বংসের কারণ। যেমন- ইয়াহুদী, নাছারা ও ভ- ফকিরদের কু-প্রথা বা আক্বীদাসমূহ।
৫। বিদয়াতে মাকরূহ : যার দ্বারা কোন সুন্নত কাজ বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন- বিধর্মীদের পোশাক পরিধান করা, টাই পরিধান করা এবং বিধর্মীদের অনুসরণ করা ইত্যাদি। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- ما احدث قوم بدعة الارفع مثلها من السنة فتمسك بسنة خير من احداث بدعة. (رواه احمد)
অর্থ : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যখনই কোন ক্বাওম একটি বিদয়াতের উদ্ভব ঘটিায়ছে, তখনই একটি সুন্নত লোপ পেয়েছে। সুতরাং একটি সুন্নতের আমল করা (যদিও তা ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হয়) একটি বিদয়াত উদ্ভব করা হতে উত্তম (যদিও তা বিদয়াতে হাসানাহ হয়)।” (মসনদে আহমদ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, মুজাহেরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ))
বিদয়াতের অনুরূপ ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা নিন্মোক্ত কিতাবসমূহেও রয়েছে। যেমন- বুখারী শরীফ উনার শরাহ ফাতহুল মুবীন, হাশিয়ায়ে মিশকাত, আশআতুল লোমআত, ফতওয়ায়ে শামী, ইশবাউল কালাম, আসমাওয়াল লোগাত, হুসনুল মাকাছেদ ইত্যাদি আরো অনেক কিতাবসমূহে।
উল্লেখ্য আমাদের সমাজে নতুন এমন অনেক জিনিসই প্রচলিত রয়েছে, যা না হলে দ্বীনের মোটেও ক্ষতি হবেনা। যেমন- মসজিদে মিহরাব ব্যবহার করা, মিনারা ব্যবহার করা, ট্রেন, মোটরগাড়ী, প্লেনে চড়া ইত্যাদি। কাজেই দ্বীনের সাহায্যকারী না হলেই যে বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ হবে তা নয়। বরং এমন বিদয়াত যা দ্বীনের সাহায্যও করে না এবং কোন প্রকার ক্ষতিও করেনা, তা বিদয়াতে মুবাহ। তবে সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, বিদয়াতে মোবাহও অনেক ক্ষেত্রে দ্বীনের সাহায্য করে থাকে। যেমন- প্লেনের কারণে আমরা অল্প সময়ের মধ্যে হজ্বব্রত পালন করতে পারি। পোলাও-বিরানী ইত্যাদি খাদ্য খেলে স্বাস্থ্য ভাল থাকে, আর স্বাস্থ্য ভাল থাকলে ইবাদত--বন্দেগী সঠিকভাবে করা যায়। সে দৃষ্টিতে এগুলো কি দ্বীনের সাহায্যকারী নয়?
কেউ কেউ আবার বলে থাকে, খাইরুল কুরুনের পর আবিস্কৃত প্রত্যেক নতুন জিনিসই বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ। অথচ এটা মোটেও শুদ্ধ নয়। কেননা যদি তাই হতো, তবে আমাদের সমাজে প্রচলিত এমন অনেক নতুন বিষয় রয়েছে, যা অবশ্যই পরিত্যাগ করা জরুরী হয়ে পড়তো। যেমন-
(ক) বর্তমানে যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসায় ইলম শিক্ষা দেয়া হয়, সেই পদ্ধতি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে শুরু করে খাইরুল ক্বুরুনপর্যন্ত কারো সময়ই ছিলনা।
(খ) বর্তমানে আমরা যে নাহু সরফ শিক্ষা করে থাকি, তাও খাইরুল ক্বুরুনেছিল না।
(গ) বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে তারাবীহর নামায পড়ে থাকি, এ পদ্ধতিও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা।
(ঘ) বর্তমানে আমরা মসজিদে জামায়াতের জন্য যে সময় নির্ধারণ করে থাকি, তাও সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা।
(ঙ) বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে জুমুয়ার সানী আজান দিয়ে থাকি, এ পদ্ধতি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা।
(চ) বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে ওয়াজ মাহফিল করে থাকি, ঐরূপ পদ্ধতিতে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ওয়াজ মাহফিল করেননি।
(ছ) বর্তমানে আমরা যে পোলাও, বিরিয়ানী কোর্মা, বুট, মূড়ী, পিয়াঁজো খেয়ে থাকি, তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি খাননি।
(জ) বর্তমানে আমরা যে সকল যান-বাহনে চড়ে থাকি, যেমন- মোটরগাড়ী, ট্রেন, প্লেন, রকেট, রিক্সা, জাহাজ ইত্যাদি এবং পবিত্র হজ্বব্রত পালন করি ও বিদেশ ভ্রমনে যাই, তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা, তিনি ঐগুলোতে কখনো চড়েননি।
(ঝ) বর্তমানে মানুষ যে সকল খাট-পালঙ্ক, শোকেস-আলমারী ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে, তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ব্যবহার করেননি।
(ঞ) বর্তমানে বিয়ে-শাদীতে যে কাবিননামা করা হয়, তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা।
(ত) বর্তমানে যে সকল আধুনিক যন্ত্রপাতি মানুষ ব্যবহার করছে, যেমন- ফ্যান, ঘড়ি, চশমা, মাইক ইত্যাদি, এগুলো সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা।
(থ) বর্তমানে যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসার জন্য চাঁদা আদায় করা হয়, যেমন সদকা, ফিৎরা, যাকাত, কুরবানীর চামড়া, মান্নতের টাকা ইত্যাদি এবং যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসা তৈরী করা হয়, তা যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সময় ছিলনা। তদ্রুপ খায়রুল কুরুনেওছিলনা। এমনিভাবে আরো অনেক বিষয়ই রয়েছে, যা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা খায়রুল কুরুনেছিল না কিন্তু আমরা তা দায়েমীভাবে করছি।
(এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, বর্তমান প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের যে তর্জ-তরীক্বা, নিয়ম-কানুন রয়েছে, যেমন- ৬ (ছয়) উছূল নির্ধারণ, গাশত, চিল্লা, ইজতেমা ইত্যাদিসহ আরো অনেক কিছুই রয়েছে, খাইরুল কুরুনে যার কোন অস্তিস্তই ছিলনা যা মাত্র কিছু দিন পূর্বে উদ্ভাবন করা হয়েছে আর এগুলো অবশ্যই নতুন উৎপত্তি এবং বিদয়াতের অন্তর্ভূক্ত, তবে কি তা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ বা বিদয়াতে হাসানাহ?)
বিদয়াতের উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, বিদয়াত বলতেই পরিত্যাজ্য বা বাতিল নয়। বরং বিদয়াতে হাসানাহ, যা দ্বীনের সাহায্যকারী, তা শরীয়তে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং অনুসরণীয়।
অতএব, “তরীক্বত পন্থায় কিছু কিছু বিদয়াত রয়েছে।এ কথাটি সতর্কতার সাথে বিচার করতে হবে। কারণ তরীক্বতপন্থী নাম দিয়ে কেউ কেউ বেশরা-বিদয়াত কাজ করতে পারে। তাই বলে কেউ যদি তাদেরকে দোষারোপ করতে গিয়ে সমষ্টিগতভাবে সমস্ত তরীক্বত পন্থীদের খারাপ বা বিদয়াতী বলে, তবে তা মারাত্মক কুফরী হবে। আক্বাইদের কিতাবে উল্লেখ আছে, “ওলীআল্লাহ বা আলিম সমাজকে ইহানত করা কুফরী।
যেমন পবিত্র হাদীছে কুদসী শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
من عاد لو ليا فقد اذ نته الحرب.
অর্থ : যে আমার ওলী উনার বিরোধীতা করে, আমি তার বিরুদ্ধে জ্বিহাদ ঘোষণা করি।” - (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী)
আবার উপরোক্ত কথাটি যদি পীরানে তরীক্বতদের, তরীক্বত শিক্ষা করার সাথে সংযুক্ত করে বিদয়াত বলা হয়, তবে তাও হবে মারাত্মক কুফরী। কারণ এই তরীক্বত শিক্ষা বা তাযকিয়ায়ে ক্বলব ও তাযকিয়ায়ে নফস অর্থাৎ অন্তর পরিশুদ্ধকরণ ইলম, স্বয়ং সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। যা মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার মধ্যে ১৬৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করেন,
لقد من الله على المؤمنين اذ بعث فيهم رسولا من انفسهم يتلوا عليهم اياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة وان كانوا من قبل لفى ضلال مبين.     
অর্থ : নিশয়ই মহান আল্লাহ পাক মুমিনদের প্রতি ইহসান বা দয়া করেছেন যে, তাদের মধ্যে থেকে তাদের জন্য একজন রসূল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদেরকে কিতাব তিলওয়াত করে শুনাবেন, অন্তর পরিশুদ্ধ করবেন, কিতাব শিক্ষা দিবেন এবং হিকমত শিক্ষা দিবেন যদিও তারা পূর্বে হিদায়েতপ্রাপ্ত ছিল না।
এছাড়াও পবিত্র সূরা বাকারা শরীফ উনার মধ্যে ১২৯, ১৫১ ও পবিত্র সূরা জুমুয়া শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যেও তাযকিয়ায়ে ক্বালব ও তাযকিয়ায়ে নফসের কথা উল্লেখ করেন।
এই শিক্ষা শুধু হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল তা নয় বরং  হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন ও সকল ইমাম, মুজতাহিদ, উলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ সকলেই এই ইলম শিক্ষা করেছেন ও শিক্ষা দিয়েছেন এবং তা আবশ্যক বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যা পরবর্তীতে উম্মতের ইজমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যা মান্য করা সকলের জন্যই ফরজ-ওয়াজিব। (তাফসীরে জালালাইন, কামালাইন, বায়জাবী, কুরতুবী, তাবারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ইবনে কাছীর, আবী সউদ, মাযহারী, মাআরেফুল কুরআন, দুররে মানসুর)
যে প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ماتولى.
অর্থ : হিদায়েত প্রকাশিত হওয়ার পর যারা রসূল, ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিরোধীতা করবে এবং মুমিনদের প্রচলিত পথ রেখে অন্য পথের অনুসরণ করবে, আমি তাদেরকে সেদিকেই ফিরাবো- যেদিকে সে ফিরছে।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১৮) (নুরুল আনোয়ার ও অন্যান্য উছূলের কিতাব দ্রষ্টব্য)
অতএব সে তরীক্বত শিক্ষার পন্থাকে যারা খারাপ বা বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ বলবে, তারা গোমরাহদের অন্তর্ভূক্ত হবে। কারণ তরীক্বত পন্থায় কিছু কিছু বিদয়াতে হাসানাহ থাকলেও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহর অস্তিত্ব বিন্দুমাত্র নেই।
এখানে উল্লেখ্য যে, তরীক্বতের নাম দিয়ে কিচু লোক বিদয়াত-বেশরা কাজ করলেই যে, তরীক্বত ছেড়ে দিতে হবে তা নয়, যদি তাই হতো, তবে ইসলাম ছেড়ে দেয়াও অপরিহার্য হয়ে পড়তো, কারণ অনেক লোক রয়েছে, যারা ইসলাম নাম দিয়ে ইসলামের খেলাফ শত-সহস্র কাজ করে থাকে। কাজেই ইসলামের নামে ইসলামের খেলাফ কার করলেও যেমন ইসলাম ছাড়া যাবেনা, তদ্রুপ তরীক্বতের নাম দিয়ে বিদয়াত-বেশরা কাজ করলেও তরীক্বত ছাড়া যাবেনা। বরং যারা বিদয়াত-বেশরা কাজ করে, তাদের হিদায়েতের কোশেশ করাই বাঞ্ছনীয়।

৯নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন (মুহম্মদ ওবায়দুল হক রচিত) ১১৬ পৃষ্ঠা, পস্তী কা ওয়াহেদ এলাজ ৯ পৃষ্ঠা, মূলঃ- মাওঃ এহতেশামুল হাসান কান্দলভী, অনুবাদক- ছাখাওয়াত উল্লাহ। তাবলীগী নেছাব ১১ পৃষ্ঠা, ফাজায়েলে তাবলীগ (মূলঃ- হযরত মাওলানা জাকারিয়া, অনুবাদক- আম্বর আলী) ৯ পৃষ্ঠা, তাবলীগে ইসলাম, লেখক- আব্দুস সাত্তার ত্রিশালী ৯ পৃষ্ঠা ও মাওলানা শাহ মনিরুজ্জামান লিখিত- আমি কেন তাবলীগ করি ১৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “তাবলীগ তথা দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, অন্য কোন কারণে নয়।দলীল স্বরূপ তারা পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার ১১০নং পবিত্র আয়াত শরীফ
كنتم خيرامة اخرجت للناس- الخ
পেশ  করে থাকে।
এখন আমাদের প্রশ্ন হলো- উম্মতে হাবীবী শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার কারণ কি? উম্মতে হাবীবী উনাদের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কিত প্রচলিত তাবলীগ; জামায়াতের উপরোক্ত কথা ঠিক আছে কিনা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার ১১০নং পবিত্র আয়াত শরীফ প্রসঙ্গে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর এবং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ভুল ও মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যার শামিল, যাকে তাফসীর বিররায়বলে। শরীয়তের দৃষ্টিতে তাফসীর বিররায়অর্থাৎ মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যা করা স্পষ্ট কুফরী। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
من فسر القران برائه فقد كفر.
অর্থ : যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মনগড়া তাফসীর করলো, সে কুফরী করলো।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে,
من قال فى القران برأيه فليتبؤا مقعده من النار وفى رواية من قال فى القران بغير علم فلبتبؤا مقعده من النار.
অর্থ : যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মনগড়া ব্যাখ্যা করে, সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নিরর্ধারণ করে নেয়। অন্য রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি বিনা ইলমে বা না জেনে কুরআন শরীফ উনার ব্যাখ্যা করে, সেও যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, উরফুশশাজী, তালীক)
মূলতঃ পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার মধ্যে এ পবিত্র আয়াত শরীফ-
كنتم خير امة اخرجت للناس تامرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله.
অর্থ : তোমরা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছ। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ কাজের নিষেধ করবে ও মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।এর দ্বারা কখনোই প্রমাণিত হয়না যে, তাবলীগ তথা দাওয়াত দেয়ার কারণে উম্মতে মুহম্মদী শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। বস্তুতঃ উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সঠিক তাফসীর বা ব্যাখ্যা না জানার কারণেই এরূপ বিভ্রান্তিমূলক কথা বলা হয়েছে বা পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সঠিক  তাফসীর নিম্নে বর্ণিত হলো -
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সঠিক  তাফসীরে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বলেন,
لوشاء الله تعالى لقال انتم فكنا كلنا ولكن قال كنتم خاصة فى اصحاب محمد صلى الله عليه وسلم.
অর্থ : মহান আল্লাহ তায়ালা তিনি যদি انتم (জমীর বা সর্বনাম) বলতেন, তাহলে সমস্ত উম্মতগণকে বুঝানো হতো। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা كنتم (ফেল) ব্যবহার করেছেন, সেহেতু খাছ করে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে বুঝানো হয়েছে। (হায়াতুস ছাহাবা)
অর্থাৎ যদিও এ পবিত্র আয়াত শরীফখানা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের শানে নাযিল হয়েছে, তথাপিও যাঁরা উনাদের ওয়ারিছ বা নায়িব হবেন, উনাদের উপরও এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার হুকুম বর্তাবে। যেমন মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ১০০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
والسا بقون الاولون من المها جرين والانصار والذين اتبعوهم با حسان رضى الله عنه ورضوا عنه.
অর্থ : মুহাজির এবং আনসার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মধ্যে (ঈমান গ্রহণের ব্যাপারে) যাঁরা পূর্ববর্তী ও অগ্রগামী এবং উনাদেরকে যারা উত্তম বা যথাযথভাবে অনুসরণকারী, উনাদের প্রতি মহান আল্লাহ পাক তিনি সন্তুষ্ট এবং উনারাও মহান আল্লাহ পাক উনার উপর সন্তুষ্ট।
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দ্বারা এই প্রমাণিত হচ্ছে যে, যাঁরা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের অনুসরণ করবে, উনারাই শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে পরিগণিত হবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিল করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের ন্যায় আরো অনেকেই পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার উপরোল্লিখিত পবিত্র আয়াত শরীফ উল্লেখ করে বলে থাকে যে, আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে। কারণ আমরা সৎ কাজের আদেশ করি এবং অসৎ কাজের নিষেধ করি। মূলতঃ তাদের কৃত এ অর্থ ও ব্যাখ্যা কোনটাই সঠিক নয়। কেননা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়াটাই হলো আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠত্ব। আর এ ছাড়া আমাদের যতগুলো গুণ দেয়া হয়েছে, তাও একমাত্র নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কারণেই। তাবলীগ তথা শুধু দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার কারণেই শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়নি। শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, একমাত্র সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণেই।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, “সমস্ত হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট আরজু করেছেন।” (তাফসীর সমূহ)
সমস্ত হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের দুয়াই মহান আল্লাহ পাক তিনি কবুল করেছেন, তবে সরাসরি কবুল করেছেন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনার দুয়া। অনেকে মনে করে থাকে বা বলে থাকে, একমাত্র হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম ব্যতীত আর কোন হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের দোয়াই কবুল হয়নি, এ কথাই সঠিক নয়। কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে, দুয়া কবুল হয় তিন প্রকারে-
(১) বান্দা যা চায়, মহান আল্লাহ পাক তিনি সরাসরি তা দিয়ে দেন।
(২) বান্দা যা চায়, তার চেয়ে যা বেশী জরুরী, তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি দিয়ে থাকেন, যে জরুরত সম্বন্ধে বান্দা নিজেই জানে না।
(৩) বান্দা যা চায়, মহান আল্লাহ পাক তা তাকে না দিয়ে তার দোয়া কবুল করে তার সওয়াবটুকু পরকালের জন্য জমা করে রাখেন। কিছু বান্দারা যখন হাশরের ময়দানে উপস্থিত হয়ে তাদের নেকী কম দেখবে, তখন তারা অস্থির হয়ে যাবে যে, তাদের জন্য জাহান্নাম ওয়াজিব হয়ে যায় কিনা। তখন মহান আল্লাহ পাক বান্দাদেরকে ডেকে বলবেন, “হে বান্দারা! তোমরা অস্থির হয়োনা, তোমাদের জন্য অমুক স্থানে নেকী রাখা হয়েছে।তখন সেই বান্দারা গিয়ে দেখবে যে, তাদের জন্য পাহাড় পাহাড় নেকী রাখা হয়েছে। তারা বলবে, মহান আল্লাহ পাক! আমরা তো এত নেক কাজ করিনি, আমাদের এত পরিমাণ নেকী আসলো কোথা থেকে? তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, “তোমরা দুনিয়াতে যে সকল দুয়া করেছিলে, যার বদলা দুনিয়াতে দেয়া হয়নি। তোমরা বুঝতে পারনি, দুয়া কবুল হলো বা হলোনা, অথচ আমি তা কবুল করেছিলাম এবং সেগুলিই পাহাড় পাহাড় পরিমাণ নেকী আকারে জমা হয়েছে।তখন বান্দারা বলবে, মহান আল্লাহ পাক! দুনিয়াতে আমাদের সমস্ত দোয়াগুলিরই বদলা না দিয়ে যদি পরকালের জন্য জমা রাখা হতো, তাহলে তা আমাদের জন্য আরো ফায়দার কারণ হতো। (বোখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল বারী, এরশাদুস সারী)
উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র দাওয়াতের কারণেই যদি উম্মতে হাবীবী উনাদে শ্রেষ্ঠত্ব হতো, তাহলে অন্যান্য হযরত নবী আলাইহিস সালাম দাওয়াতের দায়িত্ব পাওয়া সত্ত্বেও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হবার জন্য দুয়া করতেন না। বরং উম্মতে হাবীবী উনাদের শ্রেষ্ঠত্ব, দাওয়াতের কারণে নয় বরং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণেই।
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ করা হয়েছে,
وكذالك جعلناكم امة وسطا لتكونوا شهداء على الناس ويكون الرسول عليكم شهيدا.
অর্থ : এরূপেই আমি তোমাদেরকে উম্মতে ওয়াসাত (শ্রেষ্ঠ উম্মত) করেছি। যেন তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও, সমস্ত মানুষের জন্য এবং যাতে হযরত রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের সাক্ষ্যদাতা হন, তোমাদের জন্য।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৪৩)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়, হাশরের ময়দানে যখন সমস্ত হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের গুণাহগার উম্মতদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, “তোমরা কেন নেক কাজ করনি?” তখন তারা বলবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী কিতাবও আসেনি এবং কোন হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারাও আগমন করেননি। তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, “আপনারা কি তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাননি?” তাঁরা বলবেন, “হ্যাঁ, পৌঁছিয়েছি।তখন অন্য হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনার উম্মতগণ তা অস্বীকার করবে। তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, “হে হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম আপনাদের সাক্ষী কোথায়?” তখন উনারা বলবেন, “উম্মতে হাবীবী উনারাই আমাদের সাক্ষী।তখন উম্মতে হাবীবী উনাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হলে উনারা বলবেন, “হ্যাঁ, সমস্ত হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের দাওয়াত উনারা পৌঁছিয়েছেন এবং দায়িত্ব পালন করেছেন।একথা শুনে অন্যান্য হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের উম্মতগণ বলবেন, উম্মতে হাবীবী উনারা তো আমাদের থেকে অনেক পরে এসেছেন, উনারা কিভাবে আমাদের সাক্ষী হয়? তখন মহান আল্লাহ পাক উম্মতে হাবীবী উনাদেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উনারা বলবেন, “হ্যাঁ, আমরা তাদের থেকে অনেক পরে এসেছি, তবে আমাদের নিকট এসেছিলেন- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তিনি আমাদেরকে এ বিষয়ে জানিয়েছেন। আমরা উনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং উনাকে সত্য বলে জেনেছি, তাই আমাদের সাক্ষ্য সত্য।অতঃপর মহান আল্লাহ পাক তিনি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন এবং  তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি, উম্মতে হাবীবী উনাদেরকে সমর্থন করে সাক্ষী দেবেন, “হ্যাঁ, উনারা যা বলেছে, সবই সত্য এবং আমিই উনাদেরকে এ তথ্য জানিয়েছি, যা আমি মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে জেনেছি।” (সিহাহ সিত্তাহ ও সমূহ তাফসীর)
সুতরাং পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার মধ্যে উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে আমাদেরকে যে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে, তা দাওয়াতী কাজ করার জন্য নয় বরং তা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রকৃত উম্মত হওয়ার কারণে। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, মাযহারী, কুরতুবী, খাযেন, বাগবী, কবিরী, ইবনে আব্বাস, আবিস সউদ, দুররে মনসুর ইত্যাদি)
এখানে স্মরণীয় যে, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার পবিত্র আয়াত শরীফ এবং সহীহ পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, আগেকার উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিল। যেমন সূরা ইয়াসীনে উল্লেখ করা হয়েছে, “কোন এক জনপদে হযরত রসূল আলাইহিমুস সালাম উনারা আগমন করলে সেখানকার অধিবাসীরা উনাদের (হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের) রিসালতকে অস্বীকার করে, হত্যা করার জন্য উদ্যত হলো। তখন শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি, যিনি ঈমান গ্রহণ করেছিলেন, তিনি দৌড়ে এলেন এবং তার সম্প্রদায়কে হযরত রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন এবং উনাদের অনুসরণ করার উপদেশ দিলেন।
এছাড়া পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, “মহান আল্লাহ পাক হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম উনার নিকট ওহী পাঠালেন, অমুক শহরের সমগ্র বাসিন্দাসহ উল্টিয়ে দিন।তখন হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম তিনি আরজ করলেন, “হে পরওয়ারদিগার, এ শহরে আপনার অমুক বান্দা রয়েছে, যে মুহূর্তকালও আপনার নাফরমানীতে লিপ্ত হয়নি।তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করলেন, “শহরটিকে ঐ ব্যক্তি এবং সমগ্র বাসিন্দাসহ তাদের উপর উল্টিয়ে দাও। কারণ আমার জন্য ঐ ব্যক্তির চেহারায় এক মুহূর্তের জন্য পরিবর্তন আসেনি, অর্থাৎ সে লোকদের নাফরমানী থেকে নিষেধ করা তো দূরের কথা, আফসোসও করেনি।” (বায়হাক্বী শরীফ)
বণী ইসরাঈল আমলের অনুরূপ আরো একটি ওয়াক্বিয়া তাফসীরে উল্লেখ করা হয়- মহান আল্লাহ পাক হযরত ইউশা বিন নুন আলাইহিস সালাম উনার উপর ওহী নাযিল করলেন, “হে আমার নবী আলাইহিস সালাম! আপনার উম্মতের মধ্যে এক লক্ষ লোককে ধ্বংস করে দেয়া হবে। যার মধ্যে ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুণাহে লিপ্ত (গুমরাহ)।তখন হযরত ইউশা বিন নুন আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, “হে মহান আল্লাহ পাক! ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুণাহে লিপ্ত, তাই তাদের ধ্বংস করে দেয়া হবে। কিন্তু বাকী ৪০ হাজার লোককে ধ্বংস করা হবে কেন?” তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি বললেন, “যেহেতু তারা তাদের সাথে মিলা-মিশা, ওঠা-বসা করে এবং সম্পর্ক রাখে। আর গুণাহের কাজে বাধা প্রদান করেনা, তাই তাদেরকে সহ ধ্বংস করে দেয়া হবে।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিল, কেননা দায়িত্ব থাকার কারণেই তা পালন না করায় বনী ইস্রাঈলেরউল্লেখিত ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে শাস্তি পেতে হয়েছে।
অতএব উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ এবং তার আনুষাঙ্গিক ঘটনা ব্যতীত আরও অনেক পবিত্র আয়াত শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ এবং ঘটনার মাধ্যমে জানা যায় যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণও দাওয়াতের কাজ করেছেন, যা তাফসীরে রূহুল মায়ানী, তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে আমিনিয়া, তাফসীরে খাযেন, তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন ইত্যাদি তাফসীরের কিতাব সমূহ এবং বিশুদ্ধ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার কিতাব দ্বারাও প্রমাণিত।
এখানে উল্লেখ্য যে, অন্যান্য হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার জন্য আরজু করেছেন, তাই বলে কেউ যেন একথা মনে না করে যে, উম্মতে হাবীবী উনাদের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের হতে বেশী। বরং শুধুমাত্র নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কারণে যে উম্মতে হাবীবী উনাদের শ্রেষ্ঠত্ব, তা বুঝানোর জন্যই সমস্ত হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার জন্য আরজু করেছেন।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, উম্মতে হাবীবী সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণেই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তাবলীগ তথা দাওয়াতের কারনে নয়। কাজেই যারা বলে তাবলীগ তথা দাওয়াতের কারণে উম্মতে হাবীবী শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তাদের কথা সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর এবং তাফসীর বির রায় হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তুর্ভূক্ত। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে এ ধরণের অবান্তর ও কুফরীমূলক কথাবার্তা বলা থেকে হিফাযত করুন।

১০নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বেশ কিছু লোককে বলতে শুনেছি যে, তিন তাছবীহ পাঠ করলেই বেহেশতে যাওয়া যাবে, অন্যথায় নয়।
তাদের উপরোক্ত বক্তব্য শরীয়তসম্মত কি? অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে ঈমান হিফাযত করণে সাহায্য করবেন।
জাওয়াব : মূলতঃ সরাসরি এরূপ কথা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের কোথাও নেই।
এরূপ কথা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। তিন তাছবীহ পড়লে ফযীলত পাওয়া যেতে পারে। বেহেশতে, দোযখে যাওয়া বা নাযাত পাওয়া, না পাওয়া আমলের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয় বরং মহান আল্লাহ পাক উনার রহমতের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এ প্রসঙ্গে হযরত উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার থেকে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জিজ্ঞাসিত হয়ে বললেন,
ما من احديد خل الجنة الا بر حمة الله تعالى قالها ثلاثا- قالت عائشة وما انت قال وما انا الا ان يتغمدى الله يرحمته.
অর্থ : কোন ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত ব্যতীত বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবেনা, এরূপ তিনবার বললেন।এরপর হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, আপনিও নন? জবাবে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের হাত মুবারক স্বীয় মাথা মুবারক উনার উপর রেখে বললেন, “আমিও নই, যতক্ষণ পর্যন্ত মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত আমাকে বেষ্টন না করবেন।” (বায়হাক্বী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, মুজাহেরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত, লুমআত)
এখানে উল্লেখ্য যে, আমল দ্বারা বেহেশতে যাওয়া যাবেনা। এ প্রসঙ্গে এক ব্যক্তির কথা হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয় যে, এক ব্যক্তি ক্রমাগতভাবে আশি বছর ইবাদত করে মারা যাবে। এত দীর্ঘ বছর ইবাদত করার ফলে সে ব্যক্তির মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাবে যে, বহু বছরের ইবাদতের বিণিময়ে সে নিশ্চিত জান্নাতে যাবে।
কিন্তু তার নছীহতের জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাকে জাহান্নামের কিনারা দিয়ে ঘুরিয়ে আনবেন। এতে সে ব্যক্তি পিপাসায় খুবই কাতর হয়ে বার বার পানির জন্য আরজু করতে থাকবে। হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তখন পানি দিতে রাজী হবেন কিন্তু বিণিময় চাবেন। সে ব্যক্তি তাতে রাজী হবে। তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাকে বলবেন, তুমি কি বিণিময় দিতে পারবে? সে ব্যক্তি তখন বলবে, আমার সমস্ত জীবনের ইবাদতের বিণিময়ে হলেও আমাকে এক গ্লাস পানি দিন। অতঃপর এই শর্তে তাকে পানি দেয়া হবে এবং সে তা পান করবে। তখন মহান আল্লাহ পাক তাকে বলবেন, “এক গ্লাস পানির মূল্য যদি আশি বছরের ইবাদত হয়, তাহলে আমি তোমাকে জমিনে কত পানি পান করিয়েছি, তার বদলা কোথায়? তখন বান্দা তার ভুল বুঝতে পারবে যে, ইবাদতের দ্বারা নাযাত পাওয়া সম্ভব নয়, একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত ব্যতীত।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা আরাফ উনার ৫৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে
ان رحمة الله قريب من المحسنين.
অর্থ : নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত, যারা মুহসীনীন বা সূফী, তাদের নিকটবর্তী।
অতএব সূফী হওয়া ব্যতীত রহমত পাওয়া যাবেনা, রহমত ব্যতীত নাযাত পাওয়া যাবেনা। আর পীরানে তরীক্বতের নিকট বাইয়াত হওয়া ব্যতীত সূফী হওয়া যাবেনা।
সতরাং প্রমাণিত হলো যে, যারা বলে তিন তাছবীহ পাঠ করলেই বেহেশতে যাওয়া যাবে। তাদের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ শরীয়তের খেলাফ ও বিভ্রান্তিকর।

১১নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : মলফূযাতের ৪৩ পৃষ্ঠার ৪২নং মলফূযে এবং নবুওয়ত ও মাওঃ ইলিয়াছ নামক কিতাবের ৩০-৩২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “মুসলমান দুপ্রকার- একদল প্রচলিত তাবলীগের জন্য হিজরত করবে, দ্বিতীয় দল নুছরত বা সাহায্য করবে, এ দুদলই মুসলমান। অর্থাৎ যারা প্রচলিত তাবলীগও করবেনা আর তাবলীগকারীদেরকে সাহায্যও করবেনা, তারা মুসলমান নয়।” (অনুরূপ তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্ব, লেখক- মোঃ ইসমাইল হোসেন দেওবন্দী ১৭৪ পৃষ্ঠা, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন? লেখক- ওবায়দুল হক ২১ পৃষ্ঠ, হযরতজীর কয়েকটি স্বরণীয় বয়ান, ২য় খন্ড ১১ পষ্ঠায় উল্লেখ আছে।)
উল্লিখিত কিতাব সমূহের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু শরীয়তসম্মত? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে এর ফায়সালা কামনা করি।
জাওয়াব : উল্লিখিত কিতাবের উপরোক্ত বক্তব্যটি  দলীল-আদিল্লা বিহীন, মনগড়া, যা সম্পূর্ণ শরীয়ত উনার খিলাফ। মুসলমান হওয়ার জন্য ঈমানের যে শর্ত দেয়া হয়েছে, তাতে হিজরত বা নুছরতের কোন শর্ত দেয়া হয়নি। অর্থাৎ মুসলমান হতে হলে হিজরত করতেই হবে, এমন কোন শর্ত নেই। মূলতঃ তারা হিজরত ও নুছরতের সঠিক অর্থ না জানা ও না বুঝার কারণেই এরূপ লিখেছে।
হিজরতশব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- পরিত্যাগ করা, ছেড়ে যাওয়া, বিরত থাকা।
আর শরীয়তের পরিভাষায় হিজরতের অর্থ হলো- দ্বীন ও ঈমান হিফাযতের উদ্দেশ্যে স্বীয় মাতৃভুমি স্থায়ীভাবে পরিত্যাগ করে দূরে কোথাও দ্বীন ও ঈমানের সাথে নিরাপদে বসবাসের ব্যবস্থা করা।
শরীয়তের পরিভাষায় মুহাজির হচ্ছেন ঐসকল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, যাঁরা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নির্দেশে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তূষ্টির উদ্দেশ্যে বাড়ী-ঘর ছেড়ে মদীনা শরীফ বা অন্যান্য স্থান যেমন- আবিসিনিয়াহ ইত্যাদিতে হিজরত করে সেখানে বসবাস করেছিলেন। 
নুছরতশব্দের অর্থ হলো- সাহায্য করা। আর নুছরতের জন্য মুছাফির, মুক্বীম বা মুহাজির হওয়া শর্ত নয়। বরং এক মুসলমান অপর মুসলমানকে সাহায্য  করাটাই হচ্ছে নুছরত করা।
আনছারশব্দের শাব্দিক অর্থ হলো- সাহায্যকারীগণ।শরীয়তের পরিভাষায় আনছারহলেন, ঐসকল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম, যাঁরা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মদীনা শরীফ হিজরত করার পর সাহায্য সহযোগীতা করেছিলেন। (আল কামুস আল মুহীত্ব, লিসানুল আরব, তাজুল উরুস, আসাসুল বালাগাহ, আল মনযিদ, মিসবাহুল লোগাত, আল কামুস আল জাদীদ, আল কামুস আল ইসতিলাহী, আল মুজামুল ওয়াসীত, বয়ানুল লিসান)
মূলতঃ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যা করে থাকে, তা হচ্ছে- সফর। আর সফরকারীকে বলা হয় মুছাফির।
মুছাফির হচ্ছে- দুপ্রকার। (১) উরফী, (২) শরয়ী। (সমূহ ফিক্বাহের কিতাব)
উরফী  মুছাফির হচ্ছে- যারা ৪৮ মাইলের কম দুরত্বের স্থান সফর করে। আর শরয়ী মুছাফির হচ্ছে তারা- যারা ৪৮ মাইল বা তার চেয়ে বেশী দুরবর্তী স্থান সফর করে।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বোঝা যায়, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যা করে থাকে, তা প্রকৃতপক্ষে হিজরত নয়। তারা যা করেমূলতঃ তা হলো- সফর। অর্থাৎ তারা  মুহাজির নয় বরং মুছাফির। আর যেহেতু তারা শরঈ মুহাজির নয়, সেহেতু তাদেরকে যারা সাহায্য করে থাকে তারাও শরয়ী আনসার নয়। অর্থাৎ আনসারদের ন্যায় নুছরতকারী নয়। বরং তারা মুসলমান হিসেবে অপর মুসলমানকে সাহায্য করার ন্যায় সাধারণ নুছরত বা সাহায্য করে থাকে।
আর তাদের একথা যদি ধরেও নেয়া হয় যে, মুসলমান দুপ্রকার, একদল হিজরত করবে এবং অপর দল তারা যারা হিজরতকারীদেরকে নুছরত বা সাহায্য করবে। তবে এ কথা অনুযায়ী প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরাও মুসলমানের আওতায় পড়েনা। কারণ শরীয়তের দৃষ্টিতে তারাও মুহাজির বা আনছার উভয়টার কোনটাই নয়।
অতএব, এ ব্যাপারে তাদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বিভ্রান্তিকর, আপত্তিকর ও কুফরী। এরূপ বক্তব্য থেকে বিরত থাকা সকলের জন্যেই ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভুক্ত।

১২নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : ফাযায়েলে তাবলীগ-এর ৪নং পৃষ্ঠায়, দাওয়াতে তাবলীগ কি ও কেন? (লেখক- ওবায়দুল হক) ১১৮ পৃষ্ঠা ও তাবলীগে ইসলাম লেখক- আব্দুল সাত্তার ত্রিশাল, নামক কিতাবের ৯ পৃষ্ঠার বক্তব্য দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, “পবিত্র সূরা হামীম সিজদার ৩৩ আয়াত শরীফ
)ومن احسن قولا ممن دعا الى الله- الخ(
প্রচলিত তাবলীগের জন্য খাছ। অর্থাৎ একমাত্র প্রচলিত তাবলীগ কারীরাই এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার পূর্ণ মিছদাক্ব বা নমুনা।
এখন আমাদের সুওয়াল হলো- আসলে উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের কাদেরকে বুঝানো হয়েছে, আর এ ব্যাপারে তাদের দাবী কতটুকু সত্য ও ন্যায়সঙ্গত, অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : মূলত উল্লেখিত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক,   
ومن احسن قولا ممن دعا الى الله وعمل صالحا وقال اننى من المسلمين.
অর্থ : সেই ব্যক্তি অপেক্ষা কার কথা অধিক উত্তম হতে পারে? যিনি মহান আল্লাহ পাক উনার দিকে মানুষকে ডাকেন এবং নেক কাজ করেন এবং বলেন, নিশ্চয়ই আমি মুসলমানের অন্তর্ভূক্ত।” (পবিত্র সূরা হামীম সিজদাহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৩৩)
এ পবিত্র আয়াত শরীফখানা সম্পর্কে হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম তিনি বলেন, “এটা মুয়াজ্জিনদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।” (তাফসীরে মাযহারী)
এখানে উল্লেখ্য যে, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা বা আয়াতসমূহের নুযুল খাছ অর্থাৎ বিশেষ কারণে নাযিল হয়েছে। কিন্তু হুকুম আম অর্থাৎ ঐ আয়াত শরীফ উনার মেছদাক বা নমুনা যারাই হবে, তাদেরই উপর সে হুকুম বর্তাবে।
অতএব, উপরোক্ত আয়াত শরীফ যদিও মুয়াজ্জিনের জন্য খাছ করে নাযিল হয়েছে, তথাপিও যাঁরা ঈমান-আক্বীদা শুদ্ধ রেখে মহান আল্লাহ পাক উনার দিকে মানুষকে ডাকবে, তা যেভাবেই হোক, যেমন- কিতাব লিখে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, ওয়াজ করে, তালীম দিয়ে, দাওয়াত দিয়ে, জ্বিহাদ করে ইত্যাদি, তাদের সকলের উপরই এ আয়াত শরীফ উনার হুকুম বর্তাবে। (খাজেন, বাগবী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, বায়ানুল কুরআন, মাজহারী, ইবনে কাছীর, কবিরী, কানযুল ঈমান, তাবলীগী নেছাব- মাওঃ জাকারীয়া সাহেব)
কাজেই এ আয়াত শরীফ উনাকে কখনোই প্রচলিত তাবলীগের জন্য খাছ করে নেয়া শরীয়তসম্মত হবেনা। বরং তাফসীর বিররায়হবে, যা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত।  এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে,
من فسر القران برائه فقد كفر.
অর্থ : যে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মনগড়া তাফসীর করলো, সে কুফরী করলো।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে,
من قال فى القران برأيه فليقبؤا مقعده من النار وفى رواية- .. قال فى القران بغير علم فليتبؤا مقعده من النار.
অর্থ : যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মনগড়া ব্যাখ্যা করে, সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নিরর্ধারণ করে নেয়। অন্য রেওয়াতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি বিনা ইলমে বা না জেনে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ব্যাখ্যা করে, সেও যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মায়ারেফস সুনান, মায়ারেফে মাদানীয়া, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, উরফুশশাজী, তালীক)
সুতরাং এরূপ মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণ হারাম। কারণ এরূপ মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যার কারণে যেমন নিজে গোমরাহ হয়, তেমন অপরকেও গোমরাহ করে। যার ফলে সমাজে ফিৎনা বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, আর হওয়াটাই স্বাভাবিক। অথচ ফিৎনা সৃষ্টি করা কবীরা গুণাহর অন্তর্ভূক্ত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
لا تفسدوا فىالارض.
অর্থ : তোমরা যমীনে ফিৎনা সৃষ্টি করোনা।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১২)
অন্য পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
الفتنة اشد من القتل وفى ايات اخرى الفتنة اكبر من القتل.
অর্থ : ফিৎনা হত্যার চেয়ে অধিক শক্ত গুণাহ।অন্য পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে, “ফিৎনা হত্যার চেয়েও অধিক বড় গুণাহ।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৯১ ও ২১৭) কাজেই সমাজে ফিৎনা সৃষ্টি হয়, এ ধরণের শরীয়ত বিরোধী কথা বলা থেকে প্রত্যেক মুসলমানের বিরত থাকা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

১৩নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : টঙ্গীর ইজতেমা এলে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের প্রায় লোক সাধারণ লোকদের মাঝে একথা প্রচার করে থাকে যে, “বিশ্ব ইজতেমাই হচ্ছে- গরীবের হজ্ব। কেননা টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় গেলে হজ্বের সওয়াব পাওয়া যায়।
তাদের উপরোক্ত প্রচারণা কতটুকু শরীয়তসম্মত? আর এরূপ আক্বীদা যারা প্রচার করবে, তাদের সম্পর্কে শরীয়তের ফায়সালা কি? নির্ভরযোগ্য দলীললের ভিত্তিতে সঠিক ফায়সালা কামনা করি।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বার্ষিক সমাবেশ বা ইজতেমাকে গরীবের হজ্ব বলা ও হজ্বের সাওয়াবের সাথে তুলনা করা নিতান্তই অজ্ঞতাসূচক, বিভ্রান্তিমূলক ও কুফরীর শামিল। যে ব্যক্তি এরূপ আক্বীদা পোষণ করবে এবং এ আক্বীদা পোষণ করা অবস্থায় মারা যাবে, সে ঈমান হারা হয়ে চির জাহান্নামী হবে। কারণ হজ্ব হলো ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ বা ভিত্তির মধ্যে একটি বিশেষ ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن ابن عمر رضى الله عنه قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- بنى الاسلام على خمس شهادة ان لا اله الا الله وان محمدا عبده ورسوله ايقام الصلوة وايتاء الزكاة والحج وصوم رمضان.
অর্থ : হযরত ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত- (১) স্বাক্ষ্য দেয়া মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বান্দা ও রসূল। (২) নামায কায়িম করা, (৩) যাকাত দেয়া, (৪) হজ্ব করা, (৫) রমযান মাসে রোযা রাখা।” ( বোখারী, মুসলিম, মেশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, মোজাহেরে হক্ব, তাইসীরুল ক্বারী)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, হজ্ব ইসলামের একটি বিশেষ ভিত্তি। শুধু তাই নয়, হজ্বকে জামিউল ইবাদতও বলা হয়। এ হজ্ব মালেকে নেছাবদের জন্যে জীবনে একবার আদায় করা ফরযে আইন। যে ব্যক্তি হজ্ব ফরয হওয়া সত্বেও বিনা শরয়ী ওজরে হজ্ব করা থেকে বিরত থাকে, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বর্ণনা মোতাবিক সে ইহুদী-নাছারা অর্থাৎ বেদ্বীন হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কাজেই যেখানে হজ্ব একটি ফরজ ইবাদত, অশেষ ফযীলত লাভের মাধ্যম ও ইসলামের একটি গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ আমল, সেখানে একটি বাৎসরিক সমাবেশ বা ইজতেমাকে কি করে হজ্বের সাথে তুলনা করা যেতে পারে? যেখানে শরীক হওয়া ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্বাদাহ, সুন্নতে যায়েদাহ, মোস্তাহাব, নফল কোনটাই নয়। মূলতঃ হজ্বের সাথে ইজতেমাকে তুলনা করা বা ইজতেমাকে গরীবের হজ্ব বলা, ইসলামের ভিতর প্রকাশ্য তাফরীত ও ইফরাতের অর্থাৎ কমানো, বাড়ানোর শামিল, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে সুস্পষ্ট কুফরী। যেমন কাদিয়ানী সম্প্রদায় ও ৭২টি বাতিল ফেরকার লোকেরা ইসলামের ভিতর তাফরীত ও ইফরাত অর্থাৎ কমানো, বাড়ানোর কারণে কুফরীতে নিপতিত হয়ে কাফের বা অমুসলিম হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, হাদীছ শরীফে এমন অনেক আমলের কথাই বলা হয়েছে, যা পালন করলে হজ্ব ও ওমরার সওয়াব পাওয়া যায়। যেমন- ফজর নামাযের পর যিকির-আযকার করে এশরাক্ব নামাজ আদায় করলে এক হজ্ব ও ওমরার সওয়াব পাওয়া যায়।” (মালা-বুদ্দা মিনহু)
রমজান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করলে দুই হজ্ব ও দুই ওমরার ফযীলত পাওয়া যায়।” (বায়হাক্বী)
অনুরূপ পিতা-মাতার চেহারার দিকে নেক দৃষ্টিতে তাকালেও হজ্বের সওয়াব পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- ما من ولدبار ينظر الى والديه نطروحمة الاكتب الله له كل نظرة حجة مبرورة- قالوا وان نظر كل يومأة مرة قال الله اكبر اطيب. (شعب الايمان)
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “কোন নেক সন্তান যখন পিতা-মাতার দিকে রহমতের দৃষ্টি দেয়, তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি তার প্রত্যেক দৃষ্টির বিণিময়ে একটি করে কবুল হজ্বের সওয়াব তার আমলনামায় লিখে দেন।হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বললেন, যদি প্রতিদিন একশতবার দৃষ্টি দেয়, তবে? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “মহান আল্লাহ পাক তিনি মহান ও পবিত্র। (মহান আল্লাহ পাক একশতটি হজ্বের সওয়াবও দিতে পারেন।” (শোবুল ঈমান, মেশকাত, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মোজাহেরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত)
কাজেই প্রমাণিত হলো যে, যে সকল আমল করলে হজ্ব বা ওমরার ফযীলত পাওয়া যায়, তা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, ক্বিয়াস উনাদের কোথাও উল্লেখ নেই যে, টঙ্গীর ইজতেমা গরীবের হজ্ব বা ইজতেমায় গেলে হজ্বের সওয়াব পাওয়া যায়।
মূলতঃ এরূপ বক্তব্যের কারণে সাধারণ মানুষ, ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বুনিয়াদী ফরজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবনে চরমভাবে ব্যর্থ হবে। যার কারণে যে কেউ যেকোন স্থানকে হজ্বের জন্যে নির্ধারন করে নিবে। যেমন সুরেশ্বর ভন্ডদের আস্তানায় কৃত্রিম কাবা শরীফ নির্মাণ করা হয়েছে এবং তাতে হাজরে আসওয়াদও স্থাপন করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য হলো- হজ্ব করার জন্যে মক্কা শরীফে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই বরং যেখানে হজ্ব করলেই হজ্বের সওয়াব পাওয়া যাবে। (নাউযুবিল্লাহ)
আরো উল্লেখ্য যে, লিবিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীর বক্তব্য হলো- মাটির দ্বারা নির্মিত কাবা শরীফকে তাওয়াফ করার কি সার্থকতা রয়েছে? অর্থাৎ মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্জ্ব করার কোন জরুরত নেই। (নাউযুবিল্লাহ)
কাজেই নতুন করে কোন আমলকে হজ্ব হিসাবে সাব্যস্ত করা বা কোন আমলের জন্যে হজ্বের সওয়াব নির্ধারণ করা অথবা নফলকে ফরয বলা হারাম, নাজাযেয় ও কুফরী। (সমূহ আক্বায়েদের কিতাব)
অতএব, ইসলামের জন্যে ক্ষতিকর এরূপ কোন বক্তব্য পেশ করা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয।

১৪নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের মলফূযাতের ১৮ পৃষ্ঠার ২৯নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, নামায-রোযা উচ্চাঙ্গের ইবাদত কিন্তু দ্বীনের সাহায্যকারী নয়। উল্লেখ্য এ ধরণের কথা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতেরও অনেক লোকদের মুখে শোনা যায়।
এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- উল্লিখিত কিতাবের উপরোক্ত মন্তব্য এবং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের এ ধরণের কথা কতটুকু শুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত? পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে বিভ্রান্তি দূর করবেন।
জাওয়াব : বর্ণিত মন্তব্যটি জিহালতপূর্ণ ও গোমরাহীমূলক, যা বিভ্রান্তির কারণও বটে। মূলতঃ সব ইবাদতই দ্বীনের সাহায্যকারী। যার কারণে হাদীছ শরীফে এসেছে, “কোন ইবাদতকেই ছোট মনে করোনা, তা যদি তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাতও হয়।
আবার দ্বীনের সাহায্যকারী সব কাজই ইবাদত।
বর্ণিত আছে, হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম যখন উনার জাতিকে তাওহীদের আহ¡ানসহ সকল পাপাচার থেকে বিরত হওয়ার দাওয়াত দিলেন, তখন তারা বিস্ময়ে ভাবতো, কোন জিনিস তাকে এভাবে উৎসাহিত করলো। তারা দেখলো যে, তিনি সালাত আদায় করেন। অতঃপর তাদের প্রশ্নটা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ভাষায় বর্ণিত হয়েছে এভাবে-      
قالوا ياشعيب اصلوتك تأمرك ان نترك مايعبد اباتنا اوان نفعل فى اموالنا ما نشائرا- انك لانت الحليم الرشيد.
অর্থ : আপনার ছালাত কি আমাদের এ নির্দেশই দেয় যে, আমরা আমাদের পুর্ব পুরুষদের পুজনীয় বিষয়গুলো ত্যাগ করবো? কিম্বা আমরা বিরত থাকবো আমাদের ধন-সম্পদ নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা থেকে? আপনি তো বেশ বুদ্ধিমান, ধার্মিক হে?” (পবিত্র সুরা হুদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৮৭)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে। দ্বীন ইসলাম উনার পাঁচটি ভিত্তি বা খুঁটি।
(১) স্বাক্ষ্য দেয়া- মহান আল্লাহ তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদুর রসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দা ও রসূল। (২) নামায কায়িম করা। (৩) যাকাত দেয়া। (৪) রমযান মাসের রোযা রাখা। (৫) হজ্ব করা। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল  বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ফতহুল মুলহিম, মিরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী ইত্যাদি।)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত আছে, “নামায দ্বীনের খুঁটি। যে নামায কায়িম রাখলো, সে দ্বীন কায়িম রাখলো এবং যে নামায তরক করলো, সে দ্বীন ধ্বংস করলো।
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ দ্বারা এ কথাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, নামাজ ও রোযা দ্বীনের স্তম্ভ বা খুঁটি। খুঁটি বা স্তম্ভই হচ্ছে দ্বীনের মূল সাহায্যকারী।
অতএব নামায, রোযা উচ্চাঙ্গের ইবাদত, কিন্তু দ্বীনের সাহায্যকারী নয়, একথাটি সম্পূর্ণ ভুল। মূলতঃ নামায, রোযা উচ্চাঙ্গের ইবাদতের সাথে সাথে দ্বীনের মূল সাহায্যকারীও বটে।
যে প্রসঙ্গে পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ১৫৩ নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
يا ايها الدين امنوا استعينوا بالصبر والصلواة.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ। তোমরা ধৈর্য্য ও ছালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।
এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে তাফসীরে আমরা দেখতে পাই স্বয়ং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, বদরের জ্বিহাদে এবং অন্যান্য জ্বিহাদে দ্বীনকে বিজিত করার জন্য এবং দ্বীনের সাহায্য কারীদেরকে (হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদেরকে) হিফাযতের জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে নামাযের ও সবরের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। (সিরাতুন্নবী, মাদারেজুন নুবুওওয়াত, সিরাতে হালবীয়া, যাদুল মায়াদ, ইবনে হিশাম ইত্যাদি)
তাহলে একথা কি করে শরীয়তসম্মত হতে পারে যে, “নামায রোযা দ্বীনের সাহায্যকারী নয়?”
পবিত্র সূরা আনকাবুত শরীফ উনার ৪৫নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ان الصلوة تنهى عن الغحشاء والمنكر.
অর্থ : নিশ্চয়ই সালাত, অশ্লীল এবং অশোভনীয় কাজ থেকে মানুষকে বিরত রাখে।
এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে- একজন ছাহাবী এসে একদিন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কাছে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, “অমুক ব্যক্তি সারা রাত নামায পড়ে কিন্তু সকাল হলেই চুরি করে।তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “নিশ্চয়ই নামায অতি শীঘ্রই তাকে ফিরিয়ে রাখবে তুমি যা বলতেছ তা থেকে অর্থাৎ চুরি থেকে।” (আহমদ শরীফ, বায়হাক্বী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, মিরআতুল মানাজীহ, মোজাহেরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত।)
আর রোযা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বলেন,   
كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون.
অর্থ : তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হলো যেমন পূর্ববর্তীদের উপর করা হয়েছিল। আশা করা যায় (রোযা দ্বারা), তোমরা তাক্বওয়া হাছিল করতে পারবে। (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১৮৭)
অর্থাৎ রোযার দ্বারা তাক্বওয়া হাছিল হয়। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে, “তাক্বওয়া হচ্ছে- সমস্ত ইবাদতের মূল।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা হুজরাত শরীফ ১৩নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ان اكر مكم عند الله اتقى كم.
অর্থ : নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মানিত, যে সবচেয়ে বেশী পরহেজগার অর্থাৎ তাক্বওয়াধারী।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
الصيام جنة.
অর্থ : রোযা হচ্ছে মুমিনের জন্য (পাপাচার) থেকে বেঁচে থাকার ঢাল স্বরূপ।” (বোখারী, মুসলিম, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
পবিত্র হাদীছ শরীফে আরো বর্ণিত আছে,
من لم يدع قول الزور والعمل به فليس لله حاجة فى ان يدع طعامه وشرايه.
অর্থ : যে মিথ্যা কথা ত্যাগ করলো না এবং অনুরূপ আমল (অশ্লীল, অশালীন, খিলাফে শরা) থেকে বিরত থাকলনা, এ প্রকার লোকের খাদ্য, পানীয় থেকে বিরত থাকার কোন জরুরতই মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে নেই। অর্থাৎ যারা রোযা রেখে তাক্বওয়া হাছিল করতে পারেনা তাদের রোযার, মহান আল্লাহ পাক উনার কোন দরকার নেই। (বোখারী শরীফ, মেশকাত, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস সারী, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মেরকাত)
অর্থাৎ রোযা, রোযাদারকে সমস্ত পাপাচার থেকে বিরত রাখবে। অর্থাৎ ছালাত বা রোজা সকল প্রকার পাপাচার বা অশ্লীল, অশোভনীয় কাজ থেকে বিরত রেখে মানুষের চরিত্রকে সুন্দর করে তোলে এবং তাঁর চারিত্রিক সৌন্দর্য্য দ্বারা মুগ্ধ হয়ে মুসলমান, অমুসলমান সকলেই তার মাধ্যমে ইসলামের পরিচয় পেয়েও ইসলাম বা দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এবং তারাও পাপাচার থেকে বিরত হয়ে নেক কাজে লিপ্ত হয়। এভাবে তার দ্বারা প্রকারান্তরে দ্বীনের প্রচার-প্রসারের কাজ হয় বা দ্বীনের বড় ধরণের সাহায্য হয়। অর্থাৎ দ্বীনের কাজের সাহায্য করার তৌফিক সে প্রাপ্ত হয় এবং তার দ্বারা দ্বীনের সাহায্য হয়।
তাহলে কেন একথা বলা শরীয়ত উনার খিলাফ হবেনা যে, নামায রোযা দ্বীনের সাহায্যকারী নয়। মূলতঃ তাদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে জিহালতপূর্ণ, বিভ্রান্তিকর ও শরীয়ত বিরোধী, যার থেকে বিরত থাকা সকলের জন্যেই ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

১৫নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : দাওয়াতে তাবলীগ” (আম্বর আলী কর্তৃক প্রণীত) নামক কিতাবের প্রথম খন্ড ৩৯ পৃষ্ঠার বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকজন ইজতেমায়ী আমল করে, যার জন্য তারা আহলে তাসাউফগণ যারা ইনফেরাদী আমল করেন, তাদের থেকে অনেক বেশী সওয়াবের ভাগীদার হয়।
তাদের উল্লিখিত বক্তব্য কতটুকু শুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : তাদের একথা মোটেও শুদ্ধ নয়। বরং আহলে তাসাউফদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ স্বরূপ। কারণ আহলে তাসাউফগণ ইজতেমায়ী ও ইনফেরাদী উভয় প্রকার আমলের উপরই সমান গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন। আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকজন শুধুমাত্র ইজতেমায়ী আমলের উপর গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।
আহলে তাসাউফগণ নিজেদের ইসলাহ বা সংশোধন করার জন্য যেরূপ ইনফেরাদী বা একাকী আমল করে থাকেন। যেমন- যিকির-ফিকির, মোরাক্বাবা-মোশাহেদা, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ও ইলমে ফিক্বাহ ইত্যাদি চর্চার মাধ্যমে। তেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা শরীফ, এতিমখানা, লঙ্গরখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, কিতাবাদি প্রনয়নের মাধ্যমে দরস-তাদরীস, তালীম-তালক্বীন, হালকায়ে যিকির, মোরাকাবা- মোশাহাদা, ওয়াজ-মাহফিলে ইত্যাদির মাধ্যমেই ইজতেমায়ী আমল করে থাকেন।
উল্লেখ্য ইনফেরাদী বা ইজতেমায়ী যে কোন প্রকারের আমলই হোক না কেন, সে আমল করার পেছনে উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ- মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিল করা, সওয়াব হাছিল করা নয়। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা কেবলমাত্র মক্তবী শিক্ষার মাঝে মশগুল থাকার কারণে, তাদের সকল প্রকার আমলের লক্ষ্যস্থল হচ্ছে- নেকী বা সওয়াব হাছিল করা। আর আহলে তাসাউফগণ সুক্ষ্ম সমঝের অধিকারী ও ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার কারণে তাদের প্রত্যেক আমলের লক্ষ্যস্থল থাকে- মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিল। যে প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
رضوان من الله اكبر.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টিই সবচেয়ে বড়।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৭২)
অর্থাৎ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের লক্ষ্য হলো- সওয়াব বা নিয়ামত হাছিল করা। পক্ষান্তরে আহলে তাসাউফগণের লক্ষ্য হলো- ছাহেবে নিয়ামত বা মহান আল্লাহ পাক উনাকে হাছিল করা। যা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সুন্নত উনার অন্তর্ভূক্ত। কেননা হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা সব সময় সকল প্রকার আমল করতেন মহান আল্লাহ পাক উনার রেজামন্দী হাছিলের জন্য এবং তা হাছিলও করেছেন। যে প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
رضى الله عنهم ورضوا عنه.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক উনাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং উনারাও মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি সন্তুষ্ট।” (পবিত্র সূরা বাইয়্যিনাহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, , পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১৯, পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১০০, পবিত্র সূরা মুজাদালা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২২)
অতএব গভীর বা সুক্ষ্মভাবে ফিকির করলে দেখা যাবে, আহলে তাসাউফগণই ইজতেমায়ী আমল তুলনামূলক যেমন বেশী করেন, তেমনিভাবে উনাদের ইখলাছ থাকার কারণে উনারা অধিক নেকীর বা সওয়াবের ভাগীদার হন।
সুতরাং তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য শুদ্ধ বা গ্রহণযোগ্য নয় বরং সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। এ ধরণের কথা বলা সম্পূর্ণ শরীয়ত বিরোধী কাজ।

১৬নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : আমাদের এলাকার তাবলীগ জামায়াতের এক আমীর আমাদের বললো যে, “টঙ্গীতে যে কয়দিন ইজতেমা সংঘটিত হয়, সে কয়দিন স্বয়ং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেখানে উপস্থিত থাকেন।
একথা কতটুকু সত্য ও গ্রহণযোগ্য, দলীল সহকারে জানতে চাই।
জাওয়াব : উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত, মনগড়া, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর। সাথে সাথে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি মিথ্যারোপ করার শামিল, যা কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,  
قال النبى لى الله عليه وسلم من كذب على متعمد فليتبوا مقعده من النار.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আমার নামে স্বেচ্ছায় মিথ্যা কথা বলবে, সে যেন তার স্থান (দুনিয়াতে থাকতেই) জাহান্নামে নির্ধারণ করে নিলো।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মুজাহেরে হক্ব)
সুতরাং এ ধরণের বানানো, মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও কুফরীমূলক কথা থেকে বেঁচে থাকা সকলের জন্যেই ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। আর কোন কথা শুনে বিনা তাহক্বীক্বে তা বিশ্বাস করা ও প্রচার করাও মারাত্মক অন্যায়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- كفى بالمرء كذب ان يحدث بكل ماسمع.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “কোন ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্যে এই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে।” (সত্য-মিথ্যা তাহক্বীক্ব করেনা) (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, মুজাহেরে হক্ব, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য, মনগড়া, বানানো, কল্পনাপ্রসূত ও মিথ্যা প্রচারনার অন্তর্ভূক্ত, যা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সম্পূর্ণ বহির্ভূত। এ ধরণের কথা বলা, প্রচার করা ও বিশ্বাস করা সবই হারাম, নাযায়িয ও কুফরী।

১৭নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ সাহেবের মলফূযাতের৪৯ পৃষ্ঠার, ৭৪নং মলফূযে একথা উল্লেখ আছে যে, শুধুমাত্র জিহ¡ার দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, যা প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালাদের মাঝেই বিদ্যমান।
উল্লিখিত কিতাবের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু সঠিক ও শরীয়তসম্মত? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : উল্লিখিত কিতাবের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ শরীয়ত উনার খিলাফ। পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ খিলাফ বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। এ প্রকার বক্তব্যের কারণে মানুষ নেক কাজে উৎসাহিত তো হবেইনা বরং নেক কাজ থেকে গাফেল হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক ফরমান,
ان الذين امنوا وعملوا الصا لحات كانت لهم حنت الفردوس نزلا- خالين فيها لا يبغون عنها حولا.
অর্থ : নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও আমলে সালেহ বা নেক কাজ করেছে, তাদের জন্যে জান্নাতুল ফিরদাউসে মেহমানদারীর ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, তারা সেখান থেকে কখনো বের হতে চাবেনা।” (পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১০৭)
এই পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারাও বোঝা যায় যে, কেবল ঈমান আনলেই বা জিহ্বা দ্বারা ইসলামের বাণী উচ্চারণ করলেই চলবেনা। তার সাথে আমলে সালেহ করতে হবে বা নেক কাজ করতে হবে, তাহলেই নাযাত পাওয়া যাবে।
আমাদের হানাফী মাযহাব মোতাবেক মুমিনে কামেল হওয়ার শর্ত হচ্ছে তিনটি-
(১) তাছদীক্ব বিল জিনান- অর্থাৎ অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন করা।
(২) ইক্বরার বিল লিসান- অর্থাৎ মুখে স্বীকার করা।
(৩) আমল বিল আরকান- অর্থাৎ আমলে পরিণত করা।
এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে, কোন বিধর্মী যদি অন্তরে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের পর মুখে স্বীকার করে, তবে সে মুমিন মুসলমান হবে। আমল না করা পর্যন্ত মুমিনে ফাসেক থাকবে, যখন আমল করবে, তখন মুমিনে কামেল হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু জিহ্বার দ্বারাই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গের মাধ্যমে সেটা আমলে বাস্তবায়ন না করবে। শাফেয়ী মাযহাবে ঈমানদার হওয়ার জন্য আমল শর্ত। অর্থাৎ শুধু জবানে স্বীকার করলেই ঈমানদার হওয়া যাবেনা। (শরহে আক্বায়েদে নসফী, তাকমীলুল ঈমান, ফিক্বহে আকবর ইত্যাদি)
অপরদিকে আমল না করে অপরকে বলার বা জিহ্বার ব্যবহারের মধ্যে কোনই ফায়দা নেই, বরং তা বিপদের কারণ।
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা সফ উনার ৩নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,
يا ايها لذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون كبر مقتا عندا لله ان تقولوا مالا تفعلون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল? তোমরা যা করনা, তা বলা মহান আল্লাহ পাক উনার কাছে খুবই অসন্তোষজনক।
পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪ নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মাহন আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
اتأمرون الناس بالبر وتنسون انفسكم وانتم تتلون الكباب افلا تعقلون.
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও?” অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক। তবে কি তোমরা চিন্তা করোনা, বুঝনা?”
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “আমি মিরাজ শরীফ উনার রাতে এরূপ কিছু লোককে দেখেছিলাম, যাদের ঠোঁটগুলি আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। আমি বললাম, হে হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম! এই লোকগুলো কারা?” তিনি বললেন, “এরা আপনার উম্মতের আলিম শ্রেণী, যারা লোককে নেক আমলের হুকুম করতো এবং নিজেরা তা ভুলে থাকতো।” (সিহাহ সিত্তাহ ও সমূহ সীরাতের কিতাব)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে, “আখেরী যামানায় এমন অনেক লোক বের হবে, যাদের কথাগুলো হবে হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের মত, আমলগুলো হবে ফেরাউনের মত এবং অন্তরটা হবে নেকড়ে বাঘের মত।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো রয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “যে জিহ¡া ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার বেহেশতের জিম্মাদার হবো।” (বোখারী, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারাী, ইরশাদুস সারী)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা বোঝা যায় যে, কেবল মুখে মুখে দ্বীন ইসলাম উনার কথা বললে বা প্রচলিত তাবলীগের দাওয়াত দিলে কোনরূপ শ্রেষ্ঠত্বই অর্জন করা যায় না বরং তা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার অসন্তুষ্টির কারণ হবে। যদি না যা বলা হয়, সে অনুযায়ী আমল না থাকে এবং সে আমলগুলি ইখলাছের সাথে করা না হয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা পবিত্র সূরা নিছা শরীফ উনার ১১নং পবিত্র আয়াত শরীফ উল্লেখ করে বলেন,
لاخير فى كثير من نجوا هم الامن امر بصدقة اومعروف او اصلاه بين الناس.
অর্থ : যারা পরামর্শ দেয় দান খয়রাত করতে অথবা সৎকাজ করতে অথবা মানুষের মধ্যে সন্ধি স্থাপন বা মীমাংসা করতে, তা উত্তম।
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ উনার অংশবিশেষ তার বাকী অংশে বলা হয়েছে,
ومن يفعل ذالك ابتغاء مرضات الله فسوف نؤتيه اجرا عظيما.
অর্থ : যে এই কাজ মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টির জন্য করবে, আমি অতি শীঘ্রই তাকে বিরাট সওয়াব দান করবো।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১৪)
অর্থাৎ নেক কাজ করা বা বলার মধ্যে ফযীলত নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা মহান আল্লাহ পাক উনার রেজামন্দী হাছিলের উদ্দেশ্যে, ইখলাছের সহিত আমল না করবে।
আরো উল্লেখ্য, এ ধরণের নেক কাজ যে কেবল প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালাদের মাঝেই বিদ্যমান তা সম্পূর্ণই ভুল কথা। সত্যিকার অর্থে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বহু পূর্ব থেকেই সেগুলি যেমন অন্যান্যদের মাঝে বিশেষ করে, আহলে তাসাউফদের মাঝে অধিক মাত্রায় বিদ্যমান ছিল, তার ধারাবাহিকতা এখনো তেমনি বিদ্যমান আছে।
আবার অপরদিকে ক্ষেত্র বিশেষে জিহ¡ার চেয়ে বা মৌখিক কথার চেয়ে, লেখনীর মর্যাদা অধিক। যার জন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে এসেছে, “আলিমের কলমের কালি, শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র।
আরো পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আছে, ক্বিয়ামতের দিন আলিমদের কালী শহীদগণের রক্তের বিণিময়ে ওজন করা হবে। (আব্দুল বার, এহইয়াউল উলুমুদ্দীন)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, শুধুমাত্র জিহ¡ার দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নয় বরং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব, আর এ শ্রেষ্টত্ব শুধু আহলে তাসাউফ বা তরীক্বত পন্থীগণের মধ্যেই অধিক মাত্রায় বিদ্যমান।

১৮নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে- মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলেমের চেয়ে বেশী ফযীলত প্রাপ্ত হয়, আর মূর্খ লোক ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লা দরকার এবং তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে তেরো দফানামক কিতাবে ৭ পৃষ্ঠায় যা মুযাম্মিলুল হক উল্লেখ করেছেন, “মূর্খ লোক আমীর হওয়ার জন্য তিন চিল্লাহ যথেষ্ট, আর আলিমের জন্য প্রয়োজন সাত চিল্লার।
এখন আমাদের প্রশ্ন সত্যিই কি মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলিমের চেয়ে বেশী ফযীলত প্রাপ্ত হয়? আর শরীয়ত কি ইসলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের চিল্লাকে শর্ত করেছে?
জাওয়াব : মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলিমের চেয়ে মর্যাদা বেশী, একথা সম্পূর্ণ শরীয়ত উনার খিলাফ, যা কুফরীর শামিল। কারণ আক্বাইদের কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
اهانة العلماء كفر.
অর্থ : আলিমগণকে ইহানত (তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল্য বা অবজ্ঞা) করা কুফরী।” (আক্বায়েদের কিতাব)
আলিমের ফযীলত সম্পর্কে কুরআন শরীফ উনার মধ্যে অনেক পবিত্র আয়াত শরীফ এবং অসংখ্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। আলিমদের ফযীলত সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
هل يستوى الذين يعلمون والذين لا يعمون.
অর্থ : যারা জানে আর যারা জানেনা, উভয়ে কি সমান হতে পারে?” (পবিত্র সূরা যুমার শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ৯)
মহান আল্লাহ পাক আলিমদের মর্যাদা ও ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা মুজাদালা শরীফ উনার ১১নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
والذين اوتوا العلم درجات.
অর্থ : যারা আলিম, তাদেরকে অনেক মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলিমগণ হলেন নবীগণের ওয়ারিছ।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, দারিমী শরীফ, আহমদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, মায়ারেফুস সুনান, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হকাব, উরফুশ শাজী, বজলুল মাজহুদ ইত্যাদি)
আলিমের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
عن ابى اما مة البا هلى قال- ذكر لرسول الله صلى الله عليه وسلم رجلان احدهما عابد والاخر عالم فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم فضل العالم على العابد كفضلى على ادناكم. هم قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله وملئكته واهل السموات والارض حتى النملة فى جحرها وحتى الحوت ليصلون على معلم الناس الخير.
অর্থ : হযরত আবূ উমামাতুল বাহেলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট দুজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম জন আবেদ, আর দ্বিতীয় জন আলিম। (এ কথা শুনে) সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেনআলিমের মর্যাদা আবেদের উপরে তদ্রুপ, যেমন তোমাদের মধ্যে সাধারণ ব্যক্তির উপর আমার ফযীলত। অতঃপর আরো বলেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক ও উনার হযরত ফেরেস্তা আলাইহিমুস সালাম উনারা এবং আসমান ও যমীনবাসী, এমনকি গর্তের ভিতর পিপীলিকা ও মাছ পর্যন্ত আলেমের প্রতি ছালাত পাঠ করেন।” (তিরমিযী ও দারেমী, মেশকাত, মায়ারেফুস সুনান, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, উরফুশ শাজী, তালীক)
আলিমের ফযীলত সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে যে,
عن ابى درداء قال سعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول ......... وان العالم يستغفر له من فى السموات ومن فى الارض والحيتان فى جوف الماء وان فضل العالم على العابد كفضل القمر ليلة البدر على سائر الكواكب.
অর্থ : হযরত আবূ দারদা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, “নিশ্চয় আলিমের জন্যে আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, এমন কি পানির মাছ পর্যন্ত ইস্তিগফার (ক্ষমা) প্রার্থনা করে। আর নিশ্চয় আলিমের মর্যাদা আবেদের উপর এরূপ, যেরূপ পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকারাজীর উপর।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, দারেমী, আহমদ, মেশকাত, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, উরফুশ শাজী, বজলুল মাজহুদ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আলিমের মর্যাদা সম্পর্কে আরো উল্লেখ আছে যে,
عن ابن عباس قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- فقيه واحد اشد على الشيطان من الف عابد.
অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, একজন ফক্বীহ (হাক্কানী আলিম) শয়তানের নিকট এক হাজার আবেদের চেয়েও বেশী ভয়ঙ্কর।” (তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, দারেমী, আহমদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, মায়ারেফুস সুনান, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, উরফশ শাজী)
অতএব, উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের পর মহান আল্লাহ পাক উনার যমীনে শ্রেষ্ঠ মানুষ। যার কারণে উনাদের নিদ্রাকে জাহিল বা মূর্খ ব্যক্তির ইবাদতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,            
نوم العالم خير من عبادة الجاهل.
অর্থ : আলিমের নিদ্রা মূর্খ লোকের ইবাদত হতে উত্তম।
স্মরণীয় যে, উপরে আলিমদের যে মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, তা শুধুমাত্র ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ অর্জনকারী, ইলম অনুযায়ী আমলকারী অর্থাৎ উলামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্যেই প্রযোজ্য।
অতএব, মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেখানে আলিমদেরকে মূর্খ লোকের উপর এত ফযীলত দিয়েছেন, সেখানে বিনা দলীল-আদীল্লায় একথা বলা কি করে জায়েয ও শরীয়তসম্মত হতে পারে যে, মূর্খ লোক চিল্লা দিলে আলিমের চেয়ে বেশী ফযীলত প্রাপ্ত হবে। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে মাত্র মক্তবী শিক্ষা দেয়া হয়। যে মক্তবী শিক্ষার মাধ্যমে কখনো হাক্বীক্বী আলিম হওয়া সম্ভব নয়। আর যেখানে আলিম হওয়াই সম্ভব নয়। সেখানে চিল্লা দিলে কি করে আলিমের চেয়ে বেশী ফযীলত প্রাপ্ত হবে?
আরো উল্লেখ্য যে, মূর্খ লোক ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য তিন চিল্লা দিতে হয়, কিন্তু আলিমের ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য সাত চিল্লার প্রয়োজন।
তাদের এ কথাটাও জেহালতপূর্ণ ও কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। কারণ একথাও আলিম সম্প্রদায়কে ইহানত করার শামিল।
তবে এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, শুধু মাদ্রাসা হতে ফারেগ হলে অর্থাৎ টাইটেল বা দাওরা পাশ করলে মাওলানা হওয়া যায়, হাক্বীক্বী আলেম হওয়া যায়না। কারণ মাদ্রাসায় শধুমাত্র ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষা দেয়া হয়, ইলমে তাসাউফ শিক্ষা দেয়া হয়না। অথচ ইলমে ফিক্বাহের সাথে সাথে ইলমে তাসাউফ অর্জন করাও ফরজে আইন। অতএব যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ উভয়টি অর্জন করলো, সে ব্যক্তিই হাক্বীক্বী আলেম বা নায়েবে রাসূল। এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
العلماء ورثة الانبياء وان الانبياء لم يورثوا دينا را ولا درهما وانما ورثوالعلم فمن اخذه اخذ بحظ وافر.
অর্থ : নিশ্চয় আলিমগণ হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনাদের ওয়ারিছ এবং নিশ্চয় হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা কোন দীনার-দিরহাম রেখে যাননি। বরং ইলম (ইলমে জাহির ও বাতিন) রেখে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা গ্রহণ বা অর্জন করলো, সে পূর্ণ অংশ লাভ করলো।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, আহমদ, মেশকাত, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোজাহেরে হক্ব, উরফশ শাজী, বজলুল মাজহুদ)
অর্থাৎ সে ব্যক্তিই হাক্বীক্বী আলেম বা নায়েবে রসূল।
উপরোক্ত হাদীছ শরীফ দ্বারা বুঝা গেল যে, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা ওয়ারিছ স্বত্ব হিসাবে শুধুমাত্র ইলম রেখে গেছেন। আর এই ইলম সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
العلم علمان علم فى القلب فذاك علم النافع وعلم على اللسان فذلك حجة الله عزوجل على ابن ادم.
অর্থ : ইলম দুপ্রকার। (১) ক্বালবী ইলম (ইলমে তাসাউফ), যা উপকারী ইলম, (২) জবানী ইলম (ইলমে ফিক্বাহ), যা আল্লাহ পাক-এর তরফ থেকে বান্দার জন্য দলীল স্বরূপ।” (দারেমী, মেশকাত, মেরকাত, মোজাহেরে হক্ব, তারগীব ওয়াত্ব তারহীব, তারিখ, আব্দুল বার, দায়লামী, বায়হাক্বী, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী,)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, হযরত নবী আলাইহিমুস সালাম উনারা ওয়ারিছ স্বত্ব হিসেবে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ উভয়টিই রেখে গেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি উভয়টিই শিক্ষা করলো, সে ব্যক্তিই নায়িবে রাসূল বা হাক্বীক্বী আলিম।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যারা ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করে মাওলানা হয়েছে, তাদের উচিৎ হবে, পীরানে তরীক্বত বা আল্লাহওয়ালা উনাদের ছোহবত ইখতিয়ার করে, ইলমে তাসাউফ অর্জন করার মাধ্যমে ইছলাহ প্রাপ্ত হয়ে হাক্বীক্বী আলেম বা নায়েবে রাসূল হওয়া। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
يا يها الذين امنةا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর এবং সত্যবাদী বা আল্লাহওয়ালা উনাদের ছোহবত ইখতিয়ার কর।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ১১৯)
অতএব উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, যারা ইলমে তাসাউফ অর্জন করেনি, তারা হাক্বীক্বী আলিম নয়। কারণ তাদের অন্তর ইছলাহ প্রাপ্ত নয়। কাজেই তাদের তো ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্যে পীরানে তরীক্বত বা আল্লাহ ওয়ালাগণের নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাসাউফ অর্জন করতে হবেই। সাথে সাথে যারা মূর্খ বা জাহেল, তাদেরকেও ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য আল্লাহ ওয়ালাগণের নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাসাউফ চর্চা করতে হবে। আর          যাঁরা হাক্বীক্বী আলেম, তাঁরা তো অবশ্যই ইছলাহ প্রাপ্ত। স্মরণীয় যে, তিন চিল্লা, সাত চিল্লা, দশ চিল্লা কেন, শত-সহস্র চিল্লা দিলেও কেউ ইছলাহ প্রাপ্ত হবেনা। কারণ কুরআন-সুন্নাহর কোথাও চিল্লাকে ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য শর্ত করা হয়নি। আর এটাও বলা হয়নি যে, চিল্লা দিলে মানুষ ইছলাহ প্রাপ্ত হবে। বরং শর্ত করা হয়েছে, ইছলাহ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করাকে।
মূর্খ লোক ৩ চিল্লা দিলে আমীর হতে পারে, আর আলিম আমীর হওয়ার জন্য ৩ চিল্লার প্রয়োজন, তাদের এ কথাও আলেম ও ইলমকে এহানত করার শামিল। কারণ ইতিপূর্বে কুরআন-হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আলিমের মর্যাদা মূর্খ লোকের উপর অনেক বেশী।
অতএব যে সমস্ত কথাবার্তা শরীয়তের খেলাফ ও যার কোন শরয়ী দলীল নেই, এ ধরণের কথাবার্তা থেকে বেঁচে থাকা বা বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ওয়াজিব।

১৯নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : প্রচালিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, প্রচলিত তাবলীগে গেলে সূরা তওবার ১১৯নং আয়াত শরীফ-
كرنوا مع الصادقين.
অর্থ : তোমরা ছদেক্বীনদের ছোহবত বা সংসর্গ লাভ কর।
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করা হয়। অর্থাৎ তাবলীগে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে- ছদেক্বীনদের ছোহবত লাভ করা।
এক্ষেত্রে আমরা চানতে চাই যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা ছদেক্বীনের অন্তর্ভূক্ত কিনা? আর সত্যিকার অর্থ ছদেক্বীন কারা? নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লার মাধ্যমে জাওয়াব দানে উপকৃত করবেন বলে আশা রাখি।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত দাবি সম্পূর্ণই অবান্তর ও কল্পনাপ্রসূত। মূলতঃ প্রচলিত তাবলীগে গেলে কখনোই উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল হবেনা। কারণ তারা ছদেক্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়। যার দলীল  মাওলানা জাকারিয়া সাহেব রচিত- তাবলীগী নেছাবনামক কিতাবেও পাওয়া যায়। ছদেক্বীনের হাক্বীক্বী পরিচয় বা ব্যাখ্যা না জানার কারণে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের  অনেকেই এরূপ অবান্তর দাবি করে থাকে। বস্তুতঃ ছদেক্বীন হতে হলে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফে পূর্ণ পারদর্শী হতে হবে। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ৬ (ছয়) উছূলের মধ্যে ইলমে তাসাউফের কোন অস্তিত্ব তো নেই, ইলমে ফিক্বাহও যৎসামান্য শিক্ষা দেয়া হয়।
কাজেই যৎসামান্য ইসলামী শিক্ষা লাভ করে এবং সম্পূর্ণ ইলমে তাসাউফ শুন্য হয়ে কি করে দাবি করতে পারে যে, “তারা ছদেক্বীন?”
মূলতঃ প্রচলিত তাবলীগে গেলে ছদেক্বীনদের ছোহবতে থাকা হয় না। তাই তাদের ছোহবত থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। কারণ তাদের মধ্যে ইলমে তাসাউফ চর্চা বা ক্বালবী যিকির, যা ইলমে তাসাউফের মূল তা নেই।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ উনার মধ্যে ২৮নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
ولا تطع من اغفلنا قلبه عن ذكرنا.
অর্থ : যারা তাদের ক্বালবকে আমার যিকির থেকে গাফেল রেখেছে, আপনি তাদের অনুসরণ-অনুকরণ তথা ছোহবত ইখতিয়ার করবেন না।
আর মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ১১৯নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর এবং ছদেক্বীন বা সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও।
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ছদেক্বীন দ্বারা উনাদেরকেই বুঝানো হয়েছে, যাঁরা জাহির-বাতিন, ভীতর-বাহির আমল-আখলাক, সীরত-ছূরত, ক্বওল-ফেল সর্বাবস্থায় সত্যের উপর কায়িম রয়েছেন। অর্থাৎ যাঁরা ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফে তাকমীলে (পূর্ণতায়) পৌঁছেছেন। এক কথায় যাঁরা মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত এবং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হয়েছেন, উনাদেরকে বুঝানো হয়েছে।
মূলতঃ যারা তাকমীলে (পূর্ণতায়) পৌঁছেনি তথা মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত এবং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক  ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হয়নি, তাদেরকে অনুসরণ করতে ও তাদের ছোহবত ইখতিয়ার করতে নিষেধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
واصبر نفسك مع الذين يدعون ربهم بالغداوة والعشى يريدون وجهه ولا تعد عينك عنهم- تريد زينة الحيوة الدنيا ولا تطع من اغفلنا قلببه عن ذكرنا واتبع هواه وكان امره فرطا.
অর্থ : আপনি নিজেকে তাঁদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যাঁরা সকাল-সন্ধায় তাঁদের রবকে ডাকে উনার সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য এবং আপনি দুনিয়াবী জিন্দেগীর সৌন্দর্য্য (হাছিল)-এর উদ্দেশ্যে তাঁদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবেন না এবং তার অনুসরণ করবেন না, যার ক্বালবকে আমি আমার যিকির থেকে গাফিল করেছি। অর্থাৎ যার ক্বালব আমার যিকির থেকে গাফিল হয়েছে। আর যে নিজের নফসের অনুসরণ করে এবং যার কাজ সীমালংঘন করা।” (পত্রি সূরা কাহাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ, ২৮)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য ক্বালবী যিকির করেনা, তার অনুসরণ ও ছোহবত এখতিয়ার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে, হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞেস করলেন,
اى جلسائنا خير قال من ذكر كم الله رؤيته ومن زاد فى علم كم منطقه ومن ذكركم بالاخرة اعماله.
অর্থ : কোন সঙ্গী উত্তম বা আমরা কার ছোহবত ইখতিয়ার করবো? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “যাকে দেখলে মহান আল্লাহ পাক উনার কথা স্মরণ হয়, যার কথা শুনলে দ্বীনী ইলম বৃদ্ধি হয় এবং যার আমল দেখলে পরকালের আমল করতে ইচ্ছা জাগে।” (তারগীব)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে,
انظروا عمن تأخذون دينكم.
অর্থ : তোমরা লক্ষ্য করো, কার নিকট থেকে দ্বীন গ্রহণ করছো।” (মুসলিম, তিরমিযী, মেশকাত, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, মিরআতুল মানাজীহ))
অর্থাৎ যার ছোহবত এখতিয়ার করবে এবং যার থেকে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করবে, সে উপরোক্ত গুণে গুণাম্বিত কিনা, তার ঈমান-আক্বীদা, আমল-আখলাক, সীরত-ছূরত পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা মহান আল্লাহ পাক উনার মতে মত ও মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হয়েছে কিনা, তা তাহক্বীক্ব করতে হবে।
অতএব, যে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায় থেকে যেমন দ্বীন গ্রহণ করা যাবেনা, তেমনি তাদের ছোহবতও ইখতিয়ার করা যাবেনা।
এ প্রসঙ্গে হযরত জালালুদ্দীন রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন,
صحبت صالح ترا صالح كند صحبت طالح ترا طالح كند.
অর্থ : সৎ সংগ তোমাকে নেককার করে দিবে, অসৎ সংগ তোমাকে বদকার করে দিবে।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এই প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে গেলে পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ১১৯নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করা কখনো সম্ভব নয়। কারণ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে ইলমে তাসাউফ বা ক্বালবী যিকিরের কোন অস্তিত্বই নেই। বরং উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার পূর্ণ আমল করতে হলে, যাঁরা পীরানে তরীক্বত ও সূফীয়ানে কিরাম অর্থাৎ হক্কানী এহান মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী, উনাদের নিকট বাইয়াত হয়ে উনাদের ছোহবত ইখতিয়ার করতে হবে। কারণ তরীক্বত পন্থী ওলী আল্লাহগণই হলেন হাক্বীক্বী ছদেক্বীন। (তাফসীরে খাজেন, বাগবী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, কবিরী, আবী সউদ, দুররে মানসুর, মাযহারী, তাবলিগী নেছাব- মাওলানা জাকারিয়া সাহেব)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর এবং কল্পনা প্রসূত।

২০নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব
সুওয়াল : মালফুযাতে ইলিয়াছনামক কিতাবের ৪৮ পৃষ্ঠার বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রচলিত তাবলীগ ওয়ালারাই যাকাত পাবার প্রকৃত হক্বদার।
এখন আমাদের প্রশ্ন হলো- প্রকৃত পক্ষে যাকাত পাওয়ার হক্বদার কারা? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : একথা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের সম্পূর্ণ খিলাফ। কারণ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের কোথাও যাকাত পাওয়ার হক্বদার হিসাবে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বরং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ৬০নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক যাকাত পাওয়ার প্রকৃত হক্বদারদের সম্পর্কে বলেন,
انما الصدقات للفقراء والمساكين والعاملين عليها والمؤلفة قلوبهم وفى الرقاب والغارمين وفى سبيل الله وابن السبيل فريضة من الله والله عليم حكيم.
অর্থ : যাকাত হলো কেবল- ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী ও নওমুসলিম এবং গোলাম আজাদের জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, মহান আল্লাহ পাক উনার পথে জ্বিহাদকারীদের জন্যে এবং মুসাফিরের জন্য, মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ হতে এটাই ফরয। মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।
উল্লেখ্য, শাফেয়ী মাযহাবের মাসয়ালা মতে উপরোক্ত ৮ প্রকার লোক প্রত্যেককেই আংশিক যাকাত দিতে হবে।
আর আমাদের হানাফী মাযহাব মোতাবেক উপরোক্ত প্রত্যেক প্রকার ব্যক্তিকেই দেয়া শর্ত নয়। এদের মধ্যে যাদেরকে পাওয়া যাবে তাদেরকে দিতে হবে। (মাযহারী, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, আহকামুল কুরআন জাসসাস, ইবনে কাছীর, ইবনে আব্বাস, দুররে মনসুর, ইহইয়াউল উলুম, কিমইয়ায়ে সায়াদাত ও সমূহ ফিক্বাহের কিতাব)
উল্লেখিত ৮ (আট) প্রকার লোকের মধ্যে যাকাত পাওয়ার ব্যাপারে কে বেশী হক্বদার, সে ব্যাপারে ওলামায়ে মুহাক্কিক্ব ও মুদাক্কিক্বগণ বিভিন্নজন বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেনে, যেমন- হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি, এ ক্ষেত্রে ৫ প্রকার ব্যক্তির অনুসন্ধান করতে বলেছেন-
প্রথমতঃ তাক্বওয়াধারী, কারণ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহহুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেছেন, “মুত্তাক্বীন লোকদিগকে তোমাদের খাদ্য খাওয়াবে।
দ্বিতীয়তঃ তালেবে ইলম।
তৃতীয়তঃ যারা অভাব গোপন রাখে।
চতুর্থতঃ বহু পোষ্য থাকা ও উপার্জনে অক্ষম।
পঞ্চমতঃ আত্মীয়।
তবে উল্লেখ্য যে, যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রতিবেশী হিসেবে তার এক হক্ব। আর প্রতিবেশী আত্মীয় হলে তার দুই হক্ব।
সুতরাং দেখা যায়, যাকাত পাবার ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর বিশেষ হক্ব আছে।
আবার মাহবুবে সোবহানী, কুতুবে রাব্বানী, কাইউমুয যামান, হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে, তালেবে ইলমকে যাকাত প্রদানের ফযীলত অন্যান্যদের তুলনায় লক্ষগুণ বেশী। সুতরাং দেখা যায় যে, তালেবে ইলমদের ক্ষেত্রে অপরাপর ব্যক্তির তুলনায় যাকাত প্রদানের ফযীলত অনেক অনেক বেশী।
তবে স্মরণীয় যে, যাকাত প্রদানের যতগুলো শ্রেণীই থাকুক না কেন এবং যে শ্রেণীই অগ্রাধিকার পাক না কেন, তার মধ্যে আবার তাক্বওয়াকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তাই শরীয়তে বলা হয়েছে।
অতএব, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকগণ যদি উল্লিখিত শ্রেণীর অর্ন্তভূক্ত হয়, তবেই তারা যাকাত পেতে পারে। অন্যথায় তাদের যাকাত পাবার ব্যাপারে শরীয়ত বিশেষ কোন ব্যবস্থা প্রদান করেনি।

0 Comments: