প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ ( ৫ নং )

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া

গবেষণা কেন্দ্র
মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ

[সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন উনার এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ” উনার ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামায ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া মাকরূহ্ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরয নামাজের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইন্জেকশন নেওয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ-এর নামাজে বা অন্যান্য সময় পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ নামায বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং দাড়ি ও গোঁফের শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়  সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর চতুর্দশ (১৪তম) ফতওয়া হিসেবে (৩৫তম সংখ্যা থেকে) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ  করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]
[বিঃদ্রঃ পাঠকগণের সুবিধার্থে ফতওয়ার ভুমিকার কিছু অংশ পুণরায় প্রকাশ করা হলো]

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
كنتم خير امة اخرجت اللناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله.
অর্থ : তোমরা (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১১০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তাবলীগ তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সাথে সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। সেটা হলো- تؤمنون অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা। অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। তবেই সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ফায়দা বা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব হবে।
স্মরণযোগ্য যে, বর্তমান প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের বেশকিছু লেখনী, বক্তব্য, বিবৃতি, আমল ও আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের মনে নানাবিধ সংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারপাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ হতে মাসিক আল বাইয়্যিনাতেরআকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য বিভাগ সুওয়াল-জাওয়াববিভাগে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারিত বেশকিছু আপত্তিজনক আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ উল্লেখ করে অসংখ্য চিঠি আসে। কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : যদি তোমরা না জান, তবে আহলে যিকির বা হক্কানী আলেমগণের নিকট জিজ্ঞাসা করো।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩ ও পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)
      অর্থাৎ তোমরা যারা জাননা বা দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান রাখনা, তারা যাঁরা জানেন, উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।
অতএব, যাঁরা জানেন, তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব হলো- প্রশ্নকারীর প্রশ্নের শরীয়তসম্মত জাওয়াব প্রদান করা। কারণ যারা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাব প্রদান হতে বিরত থাকবে, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে। যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে দ্বীন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়জানা থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা গোপন করে অর্থাৎ জবাব না দেয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযা, হম শরীফ, মিশকাত শরীফ, বযলুল মাজহুদ, উরফুশশাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে, “তার জ্বিহ্বা আগুনের কেঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হবে।
কাজেই উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে, যে ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার থেকে বাঁচার জন্যে অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করার লক্ষ্যে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারঅগণিত পাঠক, গ্রাহক ও সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের প্রেরিত সুওয়ালসমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব বা ফতওয়া দেয়া হলো।

প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়

এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় এই যে, মূলতঃ আমাদের সাথে কারো যেরূপ বন্ধুত্ব নেই, তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খেলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যেই হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
من احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মুহব্বত বা বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী, বজলুল মাজহুদ, উরফুশশাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস সুনান, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, তালীক, মোজাহেরে হক্ব, লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
বস্তুতঃ মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি সবই উপরোক্ত হাদীছ শরীফের মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
কাজেই মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায়প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতসম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো- প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কেউল্লেখকৃত আক্বীদাসমূহের সঠিক, বিশুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত ফায়সালা প্রদান এবং প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতের কাজে যারা মশগুল রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা উক্ত আক্বীদাসমূহ জেনে হোক বা না জেনেই হোক বিশ্বাস করে এবং তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করে, নিজেদের ও জনসাধারণের ঈমান ও আমলের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের সে ঈমান ও আমলের হিফাযত করা ও সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণের নিকট সত্য বা হক্ব বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ইহ্লৌকিক ও পারলৌকিক এত্মিনান ও নাযাত লাভ করতে পারে।
মূলত মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তাই এক মুমিন অপর মুমিনের ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমানী আলামত। কারণ পবত্রি হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,      
المؤمن مرأة المؤمن.
অর্থ : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে আয়না স্বরূপ।” (আবূ দাউদ শরীফ, বযলুল মাজহুদ)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, আমীরুল মুমিনীন, হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম স্বীয় খিলাফতকালে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রীতিনীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত আনছার এবং মুহাজির হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি আমি দ্বীনের হুকুম-আহকামকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে শরীয়ত বিরোধী কোন আদেশ দান করি, তবে তোমরা কি করবে?” উপস্থিত লোকেরা নীরব রইল। হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই কথার পূণরাবৃত্তি করলেন। তখন হযরত বশীর ইবনে সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “যদি আপনি এরূপ করেন, তবে আমরা আপনাকে এরূপ সোজা করবো, যেরূপ তীরকে সোজা করা হয়।এ কথা শুনে হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম বললেন, “তোমরাই আমার প্রকৃত বন্ধু, দ্বীনের কাজে সাহায্যকারী।” (আওয়ারেফুল মাআরেফ)
সুতরাং উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আলোকে অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃ পূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল হিফাযতের লক্ষে বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো। যাতে করে সত্যান্বেষী, সমঝদার মুসলমান ও প্রচলিত তাবলীগকারীগণ সে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী ফায়সালা অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিজেদের ঈমান ও আমলের হিফাযত করে সঠিকভাবে দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খেদমত করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বীনের তাবলীগ যা খাছ ও আম তা শত-সহস্র লোক করবে এবং অবশ্যই করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করতে হবে। কারণ আক্বীদা শুদ্ধ না হলে দ্বীনী কোন খিদমতই মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্য নয়। উপরন্ত কুফরী আক্বীদা থাকার কারণে তাকে হতে হবে চির জাহান্নামী।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে দ্বীনী তাবলীগ (যা আম ও খাছ) করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

সুওয়াল : আমরা শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। কারণ আমরা অনেকদিন যাবত তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলাম এবং এখনো তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকের সাথে আমাদের মেলামেশা আছে। তাতে তাদের বেশ কিছু বক্তব্য বা আক্বীদা, যা আমরা অতীতেও জেনেছি এবং এখনো তা অবহিত হচ্ছি। তার মধ্যে অনেকগুলো তাদের লেখা কিতাবেও উল্লেখ আছে। সে সমস্ত আক্বীদাসমূহ আমাদের মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। সেগুলো আমরা নিম্নে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম –
(৫৪) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই ধারণা করে থাকে যে, দ্বীন ইসলামের বাইরেও বিধর্মীদের মাঝে, এমন অনেক শিক্ষণীয়, নছীহতপূর্ণ ও অনুসরণীয় বিষয় রয়েছে, যদ্বারা ইছলাহ্ বা পরিশুদ্ধতা লাভ করা যায়।। এ কথার প্রমাণ তাদের লেখা কিতাবেও রয়েছে। যেমন- তাবলীগ-ই-উত্তম জিহাদনামক কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “হিন্দু যোগীরা ইবাদতে আলস্য দূর করার জন্যে সারা রাত একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে, এসব দৃষ্টান্ত থেকে অন্তরের চিকিৎসার পদ্ধতি জানা জায়।অর্থাৎ হিন্দু যোগীদের মধ্যেও শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় অনেক কিছু রয়েছে। আর মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের মলফুযাতের৯৫ পৃষ্ঠায় ১৩৬নং মলফূযে একথা লেখা আছে যে, আমাদের এই কাজ (প্রচলিত তাবলীগ) এক প্রকার যাদুমন্ত্রের মত।
(৫৫) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বেশ কিছু মুরুব্বী ও আমীর এবং তাদের অনুসারীরা মনে করে থাকে যে, তাদের প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য বা তাবলীগ জামায়াতের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র হাদীছ শরীফ বহির্ভূত বিষয়ে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত পরিমাণের বাইরে বহু বহু ফযীলতের বর্ণনা করা জায়েয।
(৫৬) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, “মসজিদে নববী ছাড়া বিশ্বের যে তিনটি দেশে, তিনটি মসজিদে প্রচলিত তাবলীগের বিশেষ মারকায, সেখানেই চব্বিশ ঘন্টা আমল জারী থাকে। যেমন- প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা লিখিত এক মুবাল্লিগের পয়লা নোট বইনামক কিতাবের (সংকলক- এঞ্জিনীয়ার মু.জু.আ. মজুমদার) ৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “সারা বিশ্বে মাত্র ৪টি মসজিদে ২৪ঘন্টা আমল চালু থাকে। যথা- (১) কাকরাইল, ঢাকা (২) নিজামুদ্দীন বস্তী, দিল্লী (৩) রায়বন্ড, লাহোর। (৪) মসজিদে নববী, মদীনা শরীফ।
(৫৭) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত-এর লোকেরা বলে থাকে যে, তারা পবিত্র কুরআন শরীফ উনাপবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার  ১০৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ
ولتكن منكم امة يدعون الى الخير- يامرون بالمعروف وينهون عن المنكر واولتك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে ও বদ্ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।এর আমল করে থাকে যা তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক কাজের দ্বারাই সাধিত হয়।
(৫৮) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই মনে করে থাকে যে, তাদের ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের দাওয়াত মোতাবেক যাদের জীবন পরিবর্তিত হবে, শুধুমাত্র তাদের দ্বারাই আল্লাহ পাক হিদায়েত বা দ্বীনের কাজ নিবেন। যেমন- হযরতজীর কয়েকটি স্বরণীয় বয়াননামক কিতাবের (সংকলক- মাওলানা নোমান আহ্মদ) ২য় খন্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যাদের জীবন দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন অর্জিত হবে, তাদের দ্বারা আল্লাহ পাক হিদায়েত ছড়াবেন, .....। যাদের জীবনে দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন আসবেনা, তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের প্রকৃত কাজ নিবেন না।
(৫৯) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক দোয়া ও তাসবীহ পড়াই সুন্নত। যা করলেই যিকির-এর হক্ব আদায় হয়ে যায়। এবং তার দ্বারাই অনেক অনেক ফযীলত, রহ্মত ও বরকত পাওয়া যায়। আর এর দ্বারাই দিল ইসলাহ্ হয়। অর্থাৎ তাসাউফ ভিত্তিক ক্বলবী যিকিরের আর দরকার হয়না। অপরদিকে তাদের কথানুযায়ী তাসাউফী বা ক্বলবী যিকির হল নফল এবং যার ফযীলত নগণ্য। আর এসব কথা নাকি তাদের হযরতজীর মলফুজাতএবং মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দীর তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্বনামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
(৬০) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, পীর সাহেবদের দ্বারা দ্বীনের ব্যাপক খেদমত কখনোই সম্ভব নয়। তাই তারা পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়া বা ইলমে তাছাউফ চর্চা করাকে মোটেও গুরুত্ব দেয় না। একথার সত্যতা তাদেরই লোক দ্বারা লিখিত আয়নায়ে তাবলীগনামক কিতাবের (লেখক- মুহম্মদ দাউদ আলী) ৮৮ পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয়। ইক্ত কিতাবে লিখা হয়েছে- তাবলীগের মধ্যে পীর-মুরীদীর প্রচলন সম্ভব নহে, কেননা পীরী-মুরীদীর দ্বারা সাধারণতঃ গন্ডিবদ্ধ একটা দলের সৃষ্টি হইয়া থাকে। ..... এইরূপ একটা দলের দ্বারা ব্যাপক কোন কাজ করা সম্ভব নহে। .... তাই বাধ্য হইয়া তাবলীগ এই পথ এড়াইয়া চলিয়া থাকে।
উপরোক্ত সুওয়ালসমূহের আলোকে এখন আমরা জানতে চাই, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু ঠিক? এবং তা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু প্রয়োজনীয় ও কোন স্তরের আমলের অন্তর্ভূক্ত? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে ঈমান ও আমল হিফাযত করণে সাহায্য করবেন।
জাওয়াব : (আপনাদের তরফ থেকে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন সুওয়ালসহ প্রায় শতাধিক (শত শত) চিঠি এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে যেসব সুওয়ালগুলি মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলির জবাব না দিলেই নয়, সেরূপ অর্ধ শতাধিক সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে এবং এরূপ প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সুওয়ালেরই জাওয়াব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। তার মধ্যে গত (৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮তম) সংখ্যা চারটিতে যথাক্রমে (৭+৩২+৬+৮) মোট = ৫৩টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে। বর্তমান (৩৯তম) সংখ্যায় ৭টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হলো। বাকীগুলোর জাওয়াব পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।)
আপনাদের বর্ণিত সুওয়াল মোতাবেক যদি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হয়ে থাকে, তাহলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই আপত্তিজনক, যা গোমরাহীমূলক, বিভ্রান্তিকর ও জেহালতপূর্ণ এবং তারমধ্যে কোন কোনটিতে কুফরীমূলক বক্তব্যও রয়েছে।
তবে আপনারা যেহেতু দলীল ভিত্তিক জাওয়াব চেয়েছেন, তাই আমরা উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের ভিত্তিতে জাওয়াব দিব। (ইনশাআল্লাহ)
কারণ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে বলেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : তোমরা যারা জাননা, যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে ইলমের বিষয় সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করা হয়, আর সে জানা থাকা সত্ত্বেও তা চুপিয়ে রাখে, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পড়িয়ে দেয়া হবে।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, আহমদ, মিশকাত, বজলুল মাজহুদ, তোহফাতুল আহওয়াযী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, উরফুশশাজী, তালীক, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, “তার জিব কেটে দেয়া  হবে ইত্যাদি।
তাই নিম্নে পর্যায়ক্রমে আপনাদের প্রেরিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহের পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য দলীলসমূহের ভিত্তিতে শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো-

তাবলীগের অর্থ ও প্রকারভেদ
[সুওয়াল সমূহের জাওয়াব দেয়ার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করা অতি জরুরী। কারণ তাবলীগ সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ কি, তা জানতে হবে।
তাবলীগত্ম (تبليغ) অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দুপ্রকার অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দুভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১) তাবলীগে আম (عام) বা  সাধারণভাবে,  (২) তাবলীগে খাছ (خاص) বা বিশেষভাবে। আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দুপ্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক) ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক)।

মুবাল্লিগে আম ও তার
হিদায়েতের ক্ষেত্র

মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারক)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবত্রি কুরআন শরীফ উনা মধ্যে সূরা তাহরীমের ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا قوا انفسكم واهليكم نارا.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسؤل عن رعيته.
অর্থ : সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী , ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, শরহে নববী, মিরকাত, লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
بلغوا عنى ولو اية.
অর্থ : তোমরা আমার থেকে একটি পবিত্র আয়াত (পবিত্র হাদীছ শরীফ) শরীফ হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, রশাদুস সারী)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে না পার। (তিবরানী শরীফ)
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
الدين نصيحة.
অর্থ : দ্বীন হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।
কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করবেন।
অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তালীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম-এর জন্য ফরজে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইব্নে কাছীর, কবীর)

মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র
           
মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-এর মত নয়। অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন।
আর যাঁরা খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট দ্বীন প্রচারক, তাঁদের প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,
ولتكن منكم امة يدعون الى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون ن المنكر وارلئك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম উনার) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলত কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১০৪)
 অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন 
فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থ : কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২২)
(তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : তোমরা দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর এবং  মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুত্নী, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত ইত্যাদি)
মূলতঃ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁদেরকে অবশ্যই ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী, রব্বানী আলেমগণের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.
অর্থ : নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করেন।” (পবিত্র সূরা ফাতির শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলেম।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ  উনার মধ্যে রয়েছে,
من ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟ قال الظمع.
অর্থ : “(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলেম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আলেমের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।”  (দারেমী, মিশকাত, মিরকাত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত ইত্যাদি)
অর্থাৎ যিনি ইলম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলেম।
কাজেই যিনি ইলম, আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলেম, আর তিনিই নবী আলাইহিস সালামগণের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলেমগণ হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (হম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, তোহ্ফাতুল আহওয়াযী, মায়ারেফুস সুনান, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, উরফুশশাজী, তালীক)
অর্থাৎ হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনারা হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে উনদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তালীম বা তাবলীগ ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে ওলামায়ে হক্কানী- রব্বানীগণ তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানানভাবে দাওয়াত ও তালীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আম-এর (ফরজে কেফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-এর (ফরজে আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ-এর যোগ্যতা ও তাবলীগে আম-এর শর্ত

স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা লামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েয নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক উনার সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল করেছ?” যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) পবিত্র সূরা সফ শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
يا ايها الذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?”
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(২) তিনি আবার বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন,
اتأمرون الناس بالبر وتنسون انفسكم وانتم تنلون الكتاب.
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انهاكم عنه.
অর্থ : আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খেলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৮)
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না।
তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ পবিত্র আয়াত শরীফসমূহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।অর্থাৎ উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়েয নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যেই ফরজে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলেমগণের জন্যেই প্রযোজ্য, যা উনাদের জন্যে ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। অতএব, মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হবে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, “বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগযাকে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে, (যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে) যদি তাদের কথা মোতাবেক তাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই তা মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য করা উচিৎ ছিল। অথচ তা এমন সব লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লিগে খাছ তো নয়ই, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই মুবাল্লিগে আম-এরও উপযুক্ত নয়। যদিও কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগে আম রয়েছে।
অতএব তাবলীগে আম মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্যই করা ফরজে কেফায়া। যা মুবাল্লিগে আম-এর জন্য করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। আর সাধারণ লোকেরতো প্রশ্নই উঠেনা।
এখন হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় এমন কতক লোক, যারা মুবাল্লিগে খাছ ও আম কোনটাই নয়, তারা অনেকেই নামাজের জামায়াতে যাওয়ার সময় বা নামায পড়ার সময় অন্যকে নামাজে ডেকে নিয়ে যায়, রোজার মাসে রোজা রাখার কথা বলে, ইত্যাদি অনেক নেক কাজের কথাই বলে থাকে, যা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা তবে তার ফায়সালা কি? এটাও কি নাজায়েয ও হারাম?
এর ফায়সালা হলো, ঐ সকল লোক মুসলিম শরীফ উনা মধ্যে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ- 
الدين نصيحة.
অর্থাৎ দ্বীন হচ্ছে অপরের ভাল কামনা করা।এর মেছদাক বা নমুনা। অর্থাৎ এদেরকে কেউ হিদায়েতের দায়িত্ব দেয়নি বা এরা হিদায়েতের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। এরা হচ্ছে মানুষের খয়েরখাঁ বা হিতাকাঙ্খী।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, তিবরানী শরীফের উপরোক্ত হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, সৎকাজ না করলেও অপরকে সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক বলেন, “তোমরা ঐ কথা বল কেন, যা তোমরা নিজেরা করোনা।
তাহলে এই পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বক্তব্যের মধ্যে ফায়সালা কি?
মূলত এর ফায়সালা ওলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ দিয়েছেন। উনাদের মতে তিবরানী শরীফ উনার হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সৎ কাজ না করলেও সৎ কাজের দাওয়াত দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক)-এর জন্য। যেমন কোন বাবা নিজে নামায বা অন্যান্য নেক কাজ না করা সত্বেও তার সন্তান ও অধীনস্থদের নামায বা অন্যান্য নেক কাজের জন্য বলতে পারেন।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা বলার জন্য যে নিষেধবাণী করা হয়েছে, তা হলো- মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা করতে বলা জায়েয নেই।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
عن انس قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مررت ليلة اسرى بى بقوم تقرض شفاههم بمقاريض من النار- فقلت يا جبريل من هؤلاء- قال هؤلاء خظباء امتك الذين يقولون مالا يفعلون.
অর্থ : হযরত আনাস ইব্নে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মিরাজ শরীফ উনার রাত্রে এমন একটি ক্বওমের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের ঠোঁটগুলো আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। আমি হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জবাবে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বলেন, এরা আপনার উম্মতদের মধ্যে ঐ সকল ওয়ায়েজ বা বক্তা, যারা এমন কথা বলতো, যেটা তারা নিজেরা আমল করতোনা।” (তিরমিযী, মিশকাত, তোহফাতুল আহওয়াজী, উরফুশ শাজী, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যারা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক), তারা তিবরানী শরীফের বর্ণনা মোতাবেক সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), তারা কোরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ মোতাবেক নিজে সৎকাজ না করে অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন না। কারণ যদি সকলের জন্যে আমভাবে একথা বলা হয় যে, সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজের কথা বলা জায়েয, তবে মিরাজ শরীফ উনাপবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত লোকদের জিহ্বা কাটা হলো কেন? এতে বুঝা গেল যে, তিবরানী শরীফ উনার উক্ত হুকুম সকলের জন্যে প্রযোজ্য নয়। বরং যারা মুবাল্লিগে আম, তাদের জন্যেই প্রযোজ্য। আর কোরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ ও মিরাজ শরীফ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা যারা মুবাল্লিগে খাছ, তাদের জন্যে প্রযোজ্য।
সুতরাং হাক্বীক্বতে উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ ও পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে কোনই দ্বন্দ্ব নেই। অনেকে এর সঠিক ব্যাখ্যা না জানার ও না বুঝার কারণে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। মূলত উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়।]
সুওয়াল সমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের জাওয়াব-

৫৪নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই মনে করে থাকে যে, দ্বীন ইসলামের বাইরেও বিধর্মীদের মাঝে এমন অনেক শিক্ষণীয়, নছীহতপূর্ণ ও অনুসরণীয় বিষয় রয়েছে, যদ্বারা ইছলাহ্ বা পরিশুদ্ধতা লাভ করা যায়। এ কথার প্রমাণ তাদের লেখা কিতাবেও রয়েছে। যেমন- তাবলীগ-ই-উত্তম জিহাদনামক কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “হিন্দু যোগীরা ইবাদতে আলস্য দূর করার জন্যে সারা রাত একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে, এসব দৃষ্টান্ত থেকে অন্তরের চিকিৎসার পদ্ধতি জানা জায়।অর্থাৎ হিন্দু যোগীদের মধ্যেও শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় অনেক কিছু রয়েছে। আর মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের মলফুযাতের ৯৫ পৃষ্ঠায় ১৩৬নং মলফূযে একথা লেখা আছে যে, আমাদের এই কাজ (প্রচলিত তাবলীগ) এক প্রকার যাদুমন্ত্রের মত।
এখন আমাদের জানার বিষয় হলো- অন্তরের চিকিৎসা পদ্ধতি ও যাদুমন্ত্র সম্পর্কিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উক্ত বক্তব্য কতটুকু সঠিক ও শরীয়তসম্মত? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য নেহায়েতই অজ্ঞতামূলক, বিভ্রান্তিকর ও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ বিরোধী। 
প্রথমতঃ তাদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা এটিই বুঝা যায় যে, দ্বীন ইসলাম নাক্বেছ বা অপূর্ণ, তাই অন্তর চিকিৎসা করার পদ্ধতি হিন্দু যোগীদের থেকে কর্জ নিতে হবে। অর্থাৎ তাদের বক্তব্য মোতাবেক দ্বীন ইসলামে অন্তরের চিকিৎসা বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার কোন পদ্ধতি বা তর্জ-তরীক্বা বর্ণিত হয়নি আর বর্ণিত হয়ে থাকলেও তা ইছ্লাহ্ লাভের জন্য যথেষ্ট নয় বিধায় হিন্দুদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে।
মূলত মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট একমাত্র মনোনীত বা গ্রহণযোগ্য দ্বীন হচ্ছে ইসলাম”! তাই মহান আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ان الدين عند الله الاسلام.
অর্থ : নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট একমাত্র মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১৯)
আর তাই দ্বীন ইসলামে বর্ণিত নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা বান্দার জন্য যেরূপ অনুকরণ-অনুসরণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তদ্রুপ তা মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্যও নয়, আর তার প্রশংসা করাও জায়েয নয়। যেমন- এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
ومن يبتغ غير الاسلام دينا فلن  يقبل منه وهو فى الاخرة من الخسرين.
অর্থ : যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (নিয়ম-নীতি, অন্য ধর্ম) তালাশ করে, তা কখনই তার থেকে গ্রহণ করা হবে না এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৫)
আর এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার পরিপ্রেক্ষিতে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
وعن جابر عن النبى صلى الله عليه وسلم حين اتاه عمر فقال: انا نسمع احاديت من يهود تعجبنا افترى ان نكتب بعضها- فقال امتهوكون انم كما تهو كت اليهود والنصارى؟ لقد جنتكم بها بيضاء نقيه ولو كان موسى حيا ماوسعه الا اتباعى.
অর্থ : হযরত জাবের রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে বর্ণনা করেন যে, একদিন হযরতমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম যখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট এসে বললেন, আমরা ইহুদীদের অনেক ধর্মীয় কাহিনী, কথাবার্তা, নিয়ম-কানুন ইত্যাদি শ্রবণ করে থাকি যা আমাদের নিকট ভাল লাগে। আমরা সেগুলি থেকে কিছু লিখে রাখতে পারবো কি? তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “তোমরাও কি তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্থ বা বিভ্রান্ত রয়েছো? যেভাবে ইহুদী-নাছারারা বিভ্রান্ত রয়েছে। মহান আল্লাহ পাক উনার কসম আমি তোমাদের নিকট সম্পূর্ণ পরিস্কার ও পরিপূর্ণ দ্বীন এনেছি। হযরত মুসা আলাইহিস সালাম যদি এখন থাকতেন, তাহলে উনাকেও আমার অনুসরণ করতে হতো।” (হম, বায়হাক্বী, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকছবীহ, মুযাহেরে হক্ব)
তাই আমরা দেখতে পাই, ইহুদী-খ্রীষ্টান তথা বিধর্মীরা যে সকল আমল করতো, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে সকল জিনিস স্বয়ং নিজেও অনুসরণ করতেন না এবং আমাদেরকেও কঠোরভাবে অনুসরণ না করার জন্য তাগীদ দিয়েছেন। যেমন ইহুদী-নাছারারা আশুরার একদিন রোজা রাখতো, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতে মুহম্মদীকে দুদিন রোজা রাখতে বললেন। ইহুদী-নাছারারা দেরী করে ইফতার করতো, এর পরিপ্রেক্ষিতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদের তাড়াতাড়ি ইফতার করতে বলেন। আবার ইহুদীরা শুধুমাত্র পাগড়ী ব্যবহার করতো, এর পরিপ্রেক্ষিতে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম টুপি ছাড়া পাগড়ী পরতে নিষেধ করেছেন এবং টুপীসহ পাগড়ী ব্যবহার করতে বলেছেন। দাড়ি ও মোঁছের ব্যাপারে মজুছী (অগ্নি উপাসক) ও মুশরেকদের বিরোধীতা করতে বলেছেন। যেমন- তারা দাড়ি কাটতো ও মোঁছ বড় করতে। তাই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা দাড়ি বড় কর ও মোঁছ ছোট কর।এরূপ প্রত্যেক বিষয়ে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদেরকে- নাস্তিক, ইহুদী-নাছারা, মজুসী-মোশরেক তথা বিজাতীয় বিধর্মীদের অনুসরণ না করে খেলাফ বা বিপরীত করতে বলেছেন। আর তাই মহান আল্লাহ পাক কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ولن ترضى عنك اليهود ولا النصرى حتى تتبع ملتهم قل ان هدى الله هوالهدى ولئن اتبعت اهواء هم بعد الذى جاء ك من العلم مالك من الله من ولى ولا نصير.
অর্থ : ইহুদী ও নাছারারা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, আপনি তাদের ধর্মের (নিয়ম-নীতির) যতক্ষণ পর্যন্ত অনুসরণ না করবেন। বলে দেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার হেদায়েতই প্রকৃত হেদায়েত। আপনার কাছে সত্য ইলম (অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম) আসার পরও যদি আপনি তাদের নফ্সের বা মনগড়া নিয়ম-নীতির অনুসরণ করেন, তবে আপনার জন্য মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী নাই বা পাবেন না।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ অনুযায়ী বুঝা যাচ্ছে যে, আমাদের কোন আমল করতে হলে বিধর্মী, বিজাতীয় বা নফসের কোন অনুসরণ করা যাবে না বা তাদের থেকে কোন নিয়ম-নীতি গ্রহণ করা যাবে না বরং শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস অনুযায়ীই আমল করতে হবে, নচেৎ বিধর্মীদের সাথে তাশাব্বুহ বা মিল হয়ে যাওয়ার কারনে জাহান্নাম অবধারিত। কেননা মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ : যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের অন্তর্ভূক্ত অর্থাৎ তার হাশর-নশর তাদের সাথে হবে।” (আবূ দাউদ, হমদ)
এ প্রসঙ্গে হিন্দুস্থানেরই একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- হিন্দুস্থানে একজন জবরদস্ত মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী ছিলেন। যিনি ইন্তেকালের পর অন্য একজন বুজুর্গ ব্যক্তি উনাকে স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করেন, “হে মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী, আপনি কেমন আছেন?” তখন সেই মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী জাওয়াবে বলেন, “আপাতত আমি ভালই আছি কিন্তু আমার উপর দিয়ে এক কঠিন সময় অতিবাহিত হয়েছে। যা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার ইন্তেকালের পর আমাকে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা সরাসরি মহান আল্লাহ পাক উনার সম্মুখে পেশ করেন। আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনাদের বলেন, “হে হযরত ফেরেশত আলাইহিমুস সালামগণ তোমরা কেন তাকে এখানে নিয়ে এসেছ”? হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালামগণ বলেন, হে মহান আল্লাহ পাক আমরা তাকে খাছ বান্দা হিসেবে আপনার সাথে সাক্ষাত করার জন্য নিয়ে এসেছি। একথা শুনে মহান আল্লাহ পাক বললেন, “তাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, তার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হবে কেননা সে পূঁজা করেছে। সেকথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম এবং আমার সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপতে লাগল। তখন আমি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট আরজু করলাম, “হে মহান আল্লাহ পাক! আমার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হবে কেন? আমি তো সব সময় আপনার এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ফরমাবরদার ছিলাম। কখনও ইচ্ছাকৃত নাফরমানি করিনি এবং কখনো পুঁজা করিনি আর মন্দিরেও যাইনি।
তখন মহান আল্লাহ পাক বললেন, “তুমি সেদিনের কথা স্মরণ কর, যেদিন হিন্দুস্থানে হোলি পূঁজা হচ্ছিল। তোমার সামনে-পিছনে, ডানে-বামে, উপরে-নীচে সমস্ত গাছ-পালা, তরুলতা, পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ সবকিছুকে রঙ দেয়া হয়েছিল। এমতাবস্থায় তোমার সামনে দিয়ে একটি গর্দভ যাচ্ছিল যাকে রঙ দেয়া হয়নি। তখন তুমি পান চিবাচ্ছিলে, তুমি সেই গর্দভের গায়ে এক চিপটি পানের রঙীন রস নিক্ষেপ করে বলেছিলে- হে গর্দভ তোমাকে তো কেউ রঙ দেয়নি, এই হোলি পূঁজার দিনে আমি তোমাকে রঙ দিয়ে দিলাম। এটি কি তোমার পূঁজা করা হয়নি?” তুমি কি জান না?
من تشبه بقوم فهو منهم.
অর্থ : যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল রাখে, সে তাদের অন্তর্ভূক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথে হবে।
সুতরাং তোমার হাশর-নশর হিন্দুদের সাথে হবে।
যখন মহান আল্লাহ পাক এই কথা বললেন, তখন আমি লা জওয়াব হয়ে গেলাম এবং ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে বললাম, “হে মহান আল্লাহ পাক আমি তা বুঝতে পারিনি, আর আমাকে কেউ বুঝিয়েও দেয়নি। হে মহান আল্লাহ পাক আমাকে আপনি ক্ষমা করুন।কিছুক্ষণ পর মহান আল্লাহ পাক বললেন, “হ্যাঁ তোমাকে অন্যান্য আমলের কারণে ক্ষমা করা হলো।
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ ও ঘটনাসমূহের দ্বারা একথাই প্রমাণিত হলো যে, মুসলমানদের জন্য বে-দ্বীন, বদ-দ্বীনদের অর্থাৎ হিন্দু-বৌদ্ধ, ইহুদী-খৃষ্টানদের নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা অনুসরণ করা সম্পূর্ণই নাজায়েয ও হারাম। কারণ বে-দ্বীন, বদ্দ্বীন অর্থাৎ হিন্দু-বৌদ্ধ, ইহুদী-খৃষ্টানদের নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা অনুসরণ-অনুকরণ করার অর্থই হলো, দ্বীন ইসলামকে নাক্বেছ বা অপূর্ণ মনে করা, অথচ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন
اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الاسلام دينا.
অর্থ : আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিয়ামত সমাপ্ত করলাম এবং ইসলামকেই তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোণীত করলাম।” (পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৩)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, “দ্বীন ইসলামপরিপূর্ণ অর্থাৎ দ্বীনী ও দুনিয়াবী সকল বিষয়ের ফায়সালা বা সব সমস্যার সমাধান দ্বীন ইসলামে রয়েছে। নিন্মোক্ত ঘটনা দ্বারা বিষয়টি আরো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে।
একবার কিছু ইহুদী সম্প্রদায়ের লোক খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মুমিনীন হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনার দরবার শরীফ আসলো, এসে বললো- হে আমীরুল মুমিনীন! মহান আল্লাহ পাক আপনাদের দ্বীন-ইসলামে তথা আসমানী কিতাব, পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে একখানা পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল করেছেন, সে পবিত্র আয়াত শরীফখানা যদি আমাদের ইহুদী ধর্মে বা আমাদের কোন আসমানী কিতাবে নাযিল হতো, তবে আমরা যেদিন এ পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে, সেদিনকে ঈদের দিন বা খুশির দিন হিসাবে ঘোষণা করতাম।
তখন হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন- হে ইহুদী সম্প্রদায়, সেটি কোন পবিত্র আয়াত শরীফ? যে পবিত্র আয়াত শরীফখানা তোমাদের ধর্মে নাযিল হলে তোমরা সেদিনকে ঈদের দিন হিসাবে ঘোষণা করতে? ইহুদী সম্প্রদায় বললো- তা পবিত্র সূরা মায়িদা শরীফ উনার ৩নং পবিত্র আয়াত শরীফ, যেখানে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ মুবারক করেন,
اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الاسلام دينا.
অর্থ : আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে সমাপ্ত করলাম, তোমাদের জন্যে ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।
পবিত্র আয়াত শরীফ শুনে আমীরুল মুমিনীন হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম বললেন- হে ইহুদী সম্প্রদায় তোমাদের কি জানা আছে? পবিত্র আয়াত শরীফখানা কোথায়, কবে, কখন নাযিল হয়েছে?
তারা বললো- না, আমাদের তা জানা নেই। তখন হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম বললেন, দেখ এ পবিত্র আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে, বিদায় হজ্বের সময়, আরাফার ময়দানে, শুক্রবার দিন, আসরের ওয়াক্তে। সুতরাং হজ্বের দিন আমাদের জন্যে খুশির দিন, শুক্রবার দিনও আমাদের জন্যে খুশির দিন, কাজেই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার শুকরিয়া আদায় করতে গিয়ে আমাদের (মুসলমানদেরকে) আলাদাভাবে কোন খুশির দিনের ব্যবস্থা করতে হবেনা (সুবহানাল্লাহ্)।
উপরোক্ত ঘটনা বা ওয়াকেয়া হতে আমরা এ কথাই বুঝতে পারলাম যে, মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের জন্যে দ্বীন ইসলাম উানকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। দ্বীন ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন বা ধর্মই পরিপূর্ণ নয়। অর্থাৎ সবই অপূর্ণ ছিল এবং বর্তমানেও অপূর্ণ রয়েছে। একমাত্র দ্বীন ইসলামই পরিপূর্ণ। আর তাই মহান আল্লাহ পাক বলেন,
كل فى كتاب مبين.
অর্থ : সুস্পষ্ট কিতাবে (অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে) সব কিছুই রয়েছে।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৬)
অন্যত্র ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
مافرطنا فى الكتب من شئ.
অর্থ : আমি এ কিতাবে কোন কিছুই বর্ণনা করতে ছেড়ে দেইনি।” (পবিত্র সূরা আনয়াম শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৮)
অর্থাৎ জিন ও মানব জাতির জন্যে মহান আল্লাহ পাক ও উনারসূল সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুকুম মোতাবেক চলতে হলে যা কিছুর দরকার অর্থাৎ তার ব্যক্তিগত পর্যায় হতে শুরু করে, রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এবং তার পায়ের তলা হতে মাথার তালু পর্যন্ত, তার হায়াত হতে মৃত্যু পর্যন্ত, এক কথায় ক্বিয়ামত পর্যন্ত যত সমস্যারই উদ্ভব হোক না কেন, সকল বিষয়েরই ফায়সালা বা সমাধান দ্বীন-ইসলামের মধ্যে অর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের মধ্যে রয়েছে।
এতক্ষণের আলোচনা দ্বারা তাই সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, “দ্বীন ইসলামেসব কিছুই বর্ণিত হয়েছে। কাজেই কোন ব্যাপারেই হিন্দু যোগী বা বির্ধমীদের থেকে কোন কিছু গ্রহণ করার বিন্দুমাত্রও প্রয়োজন নেই। বরং তাদের থেকে কিছু গ্রহণ করা বা সামান্য বিষয়েও তাদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করা বা তাদের কোন কিছুর প্রশংসা করা অর্থ বা তাকে শিক্ষণীয় বলা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয। পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অসংখ্য স্থানে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
আর অন্তরের চিকিৎসা বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য হিন্দু যোগীদের পদ্ধতি অনুসরণ করাও নাজায়েয ও হারাম, আর তাকে হালাল বা শিক্ষণীয় মনে করা কুফরী।
মূলত অন্তরের চিকিৎসা বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার পদ্ধতি, নিয়ম-নীতি, তর্জ-তরীক্বা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ পাক বলেন,
الا بذكر الله تطمئن القلرب.
অর্থ : সাবধান, একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরের দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে, (রোগ মুক্ত বা পরিশুদ্ধ হয়)।” (পবিত্র সূরা রাআ শরীফ, পবিত্র আয়ত শরীফ ২৮)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لكل شئ صقالة رصقالة القلوب ذكرالله.
অর্থঃ- প্রতিটি জিনিস পরিস্কার করার যন্ত্র রয়েছে, আর অন্তর পরিস্কার বা রোগ মুক্ত করার যন্ত্র হলো- মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির।” (বায়হাক্বী, মেশকাত, মেরকাত, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ)
অতএব, বুঝা গেল যে, অন্তরের রোগ ভাল করার ও অন্তর পরিস্কার বা পরিশুদ্ধ করার একমাত্র পদ্ধতি হলো ক্বলবী যিকির। যার কারণে যিকিরকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে-
(১) লেসানী যিকির, (২) ক্বলবী যিকির।
লেসানী যিকির হচ্ছে- নামায পড়া, পবিত্র কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করা, ওয়াজ নছীহত করা, কিতাবাদী পাঠ করা, মুখে মুখে আল্লাহ-আল্লাহ, লা-ইলাহা-ইল্লাহ ইত্যাদি যিকির করা।
আর ক্বলবী যিকির হচ্ছে- কামিল মুর্শিদ উনার হাতে বাইয়াত হয়ে তরীক্বা মোতাবেক ক্বলবের মধ্যে জরব দিয়ে যিকির করা। বস্তুতঃ ক্বলবী যিকিরের মাধ্যমেই ক্বলবের বা অন্তরের রোগ, ময়লা ইত্যাদি দূর হয়।
আর এই অন্তরের চিকিৎসা-পদ্ধতি জানার জন্য অর্থাৎ ক্বলবী যিকির হাছিল করার জন্য ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে পূর্ণতা প্রাপ্ত একজন কামেল পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়াকে ফরয বলে উলামায়ে মুহাক্কিক ও মুদাক্কিকগণ মত ব্যক্ত করেছেন। যেমন- হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত ও ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন কিতাবে, গাউসুল আযম, বড় পীর, আব্দুল ক্বাদির জ্বিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতহুর রাব্বানী কিতাবে, কাইউমে আওয়াল, মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মাকতুবাত শরীফে অনুরূপ অসংখ্য নির্ভরযোগ্য ও মশহুর কিতাবে অন্তরের চিকিৎসা বা অন্তর পরিশুদ্ধ করার জন্য একজন হক্কানী-রব্বানী, কামেল মুর্শিদের নিকট বাইয়াত হওয়াকে ফরয বলা হয়েছে।
কাজেই অন্তরের চিকিৎসা করতে হলে কামেল মুর্শিদের হাতে বাইয়াত হয়ে ইলমে তাসাউফ চর্চা বা ক্বলবী যিকির করতে হবে। তবেই অন্তরের চিকিৎসা লাভ করা সম্ভব। পক্ষান্তরে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বক্তব্য মোতাবেক হিন্দু যোগীদের ন্যায় যদি ক্বিয়ামত পর্যন্তও দন্ডায়মান হয়ে থাকে, তবুও অন্তরের চিকিৎসা পদ্ধতি জেনে অন্তর পরিশুদ্ধ করা সম্ভব নয়। উপরন্ত হিন্দু যোগীদের সাথে তাশাব্বুহ্ বা মিল হয়ে যাওয়ার কারণে তার হাশর-নশর সব হিন্দু যোগীদের সাথেই হবে। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক)
দ্বিতীয়তঃ মাওলানা ইলিয়াস সাহেব বলেছে, “প্রচলিত তাবলীগ যাদুমন্ত্রের মত।
তার সে কথাটিও অশুদ্ধ ও শরীয়তের খেলাফ। কারণ তার এ বক্তব্য দ্বারা এ কথাই বুঝা যায় যে, যাদুমন্ত্র শরীয়তসম্মত বা ইসলামের অন্তর্ভূক্ত। অথচ যাদুমন্ত্র শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয। শরীয়তের দৃষ্টিতে যাদুমন্ত্র করা কুফরী।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে, “শবে বরাতের রাত্রে সাত প্রকার লোকের দোয়া মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুল হয়না, খালেছ তওবা না করা পর্যন্ত। তার মধ্যে এক প্রকার হলো- (الساحر) অর্থাৎ যাদুমন্ত্র শিক্ষাকারী বা প্রদর্শণকারী।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- من تعلم صرف الكلم ليسبى به قلوب الرجال او الناس- لم يقبل الله منه يوم القيامة صرفا ولا عدلا.
অর্থ : হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসারীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি এরূপ বাক্য (মন্ত্র) শিক্ষা করলো, যদ্বারা লোকদের অন্তরকে আকৃষ্ট বা ঘুরানো যায়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার ফরয-নফল কোন ইবাদত আল্লাহ পাক কবুল করবেন না।” (আবূ দাউদ, মেশকাত, বযলুল মাজহুদ, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, তালীকুছ ছবীহ, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব)
অতএব, প্রমাণিত হয় যে, যাদুমন্ত্র শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই নাজায়েয ও হারাম। কাজেই দ্বীনী দাওয়াত বা তাবলীগের কাজ কখনোই যাদুমন্ত্র হতে পারেনা, বরং একে যাদুমন্ত্র বলা স্পষ্টতঃ কুফরী।
তাছাড়া মন্ত্রসম্পূর্ণই হিন্দুদের নিয়ম-নীতির অন্তর্ভূক্ত। অতএব, যাদুমন্ত্র করার অর্থই হলো- হিন্দুদেরকে অনুসরণ- অনুকরণ করা, যা সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয। আর হিন্দু বা বেদ্বীনদের অনুসরণ করার আহকাম ও ভয়াবহ পরিণাম ইতঃপূর্বে পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
সুতরাং বলার আর অপেক্ষাই রাখেনা যে, যাদুমন্ত্র সম্পর্কিত মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের উক্ত বক্তব্য মারাত্মক আপত্তিকর জেহালতপূর্ণ ও শরীয়ত বিরোধী। আর হিন্দুদের সাথে তাশাব্বুহ বা মিল হওয়ার কারণে হারাম ও নাজায়েয।
সুতরাং স্পষ্টতঃ প্রমাণিত হলো যে, অন্তরের চিকিৎসা পদ্ধতি ও যাদুমন্ত্র সম্পর্কিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই মনগড়া, বানোয়াট বিভ্রান্তিকর ও জেহালতপূর্ণ। পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের বিপরীত তো অবশ্যই। এ ধরণের বক্তব্য বা আমল থেকে তওবা করা তাদেরসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই ফরয-ওয়াজিব।

৫৫নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বেশ কিছু মুরুব্বী ও আমীররা এবং তাদের অনুসারীরা মনে করে থাকে যে, তাদের প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য বা তাবলীগ জামায়াতের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ বহির্ভূত বিষয়ে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত পরিমাণের বাইরে বহু বহু ফযীলতের বর্ণনা করা জায়েয।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মুরুব্বী ও আমীরদের এবং তাদের অনুসারীদের উপরোক্ত আমল বা বক্তব্য কতটুকু শরীয়ত সম্মত? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মুরুব্বী ও আমীরদের উপরোক্ত বক্তব্য বা আমল সম্পূর্ণই শরীয়তের খেলাফ। কারণ শরীয়তের কোথাও উল্লেখ নেই যে, দ্বীনের প্রতি তারগীব বা উৎসাহ প্রদানের জন্যে ফযীলতে কম-বেশী করা বা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ বহির্ভূত ফযীলত বর্ণনা করা জায়েয। বরং মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা হজ্ব শরীফ উনার ৩০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
واجتنبوا قول الزور-
অর্থ : তোমরা মিথ্যা কথা থেকে বিরত থাক।
আর ফযীলতের ক্ষেত্রে কম-বেশী করা অথবা যেসব বিষয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ফযীলতের কথা নেই, সেসব বিষয়ে ফযীলতের কথা বলার অর্থই হলো, পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ আমলের যে ফযীলতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে تغريط-افراط  (কমানো বা বাড়ানো)  এবং দ্বীনের মধ্যে تحريف (বদল বা পরিবর্তন) করা। এক কথায় পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ উনাদের প্রতি মিথ্যারোপ করা বা পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা, যা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কুফরী।
কারণ পবিত্র কুরআন শরীফ সম্পর্কে মিথ্যা বলা প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে,
من قال فى القران برأيه فليتبزا مقعده من النار وفى رواية من قال فى القران بغير علم فليتبؤا مقعده من النار.
অর্থ : যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন শরীফ সম্পর্কে মনগড়া কথা বলে, সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়। অন্য এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত রয়েছে, যে ব্যক্তি বিনা ইলমে বা না জেনে পবিত্র কুরআন শরীফ সম্পর্কে কথা বলে, সেও যেন তার স্থান দুনিয়ায় থাকতেই জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়। (তিরমিযী, মেশকাত, মেরকাত, মোযাহেরে হক্ব, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, উরফুশ শাজী, মায়ারেফুস সুনান)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ সম্পর্কে মিথ্যা বলা প্রসঙ্গে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
قال النبى صلى الله عليه وسلم من كذب على متعمدا فليتبوأ مقعده من النار.
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার নামে স্বেচ্ছায় মিথ্যা কথা বলবে, সে যেন তার স্থান (দুনিয়াতে থাকতেই) জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, তালীকুছ ছবীহ)
শুধু এতটুকুই নয় বরং মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কেও সঠিকভাবে না জেনে কোন কিছু বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
اتقوا الحديث عنى الا ما علمتم فمن كذب على متعمدا قليتبوأ مقعده من النار.
অর্থ : তোমরা যা জান, তা ব্যতীত আমার থেকে হাদীছ বর্ণনা করা হতে বিরত থাক বা ভয় কর। কেননা যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার প্রতি মিথ্যারোপ করে, সে যেন দুনিয়ায় থাকতেই নিজের বাসস্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, ইবনে মাজা, উরফুশ শাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস সুনান, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, তালীকুছ্ ছবীহ্)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ করা হয়েছে,
من حدث عنى يحديث يرى انه كذب فهو احد الكاذبين.
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার থেকে এরূপ একটি পবিত্র হাদীছ শরীফ বর্ণনা করে, যা সে মিথ্যা বলে ধারণা করে, সে মিথ্যাবদী ব্যক্তিদের একজন।” (মুসলিম, শরহে নববী, ফতহুল মুলহি, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, তালীকুছ ছবীহ)
অতএব দ্বীনের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয, হারাম ও কুফরী।
তাই তাবলীগ জামায়াতের মুরুব্বী, আমীর, তাদের অনুসারী এবং সংশ্লিষ্ট সকল মুসলমানের জন্যই এ ধরণের মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকা ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।
এছাড়া সাধারণভাবেও সকলের জন্যই মিথ্যা থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব।
কেননা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
انما الكذب لكل الذنوب ام.
অর্থ : নিশ্চয়ই মিথ্যা সমস্ত গুণাহের মূল।
শুধু তাই নয়, মিথ্যাবাদীর মিথ্যার কারণে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারাও পর্যন্ত দূরে সরে যান। যেমন পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে,
اذا كذب العبد تباعد عنه الملك ميلا من نتن ما جاءبه.
অর্থ : যখন বান্দা মিথ্যা বলে, তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা উক্ত মিথ্যা কথার দুর্গন্ধের জন্য তার নিকট হতে এক মাইল দূরে সরে যান।” (তিরমিযী শরীফ, মায়ারেফুস্ সুনান, তোহ্ফাতুল আহওয়াযী, উরফুশ শাজী)
মিথ্যা বলা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক সূরা নহল শরীফ উনার ১০৫নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
انما يفترى الكذب الذين لا يؤمنون.
অর্থ : নিশ্চয়ই যাদের ঈমান নেই কেবল তারাই মিথ্যা কথা বলে।
আর এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীরে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে
قبل لرسول الله صلى الله عليه وسلم ايكون المؤمن جبانا قال نعم- فقيل له ايكون المؤمن بخيلا قال نعم فقيل له ايكون المؤمن كذابا قال لا.
অর্থ : নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ঈমানদার ব্যক্তি কি ভীরু হয়। তিনি বললেন, হ্যাঁ হতে পারে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হলো যে, ঈমানদার ব্যক্তি কি বখীল বা কৃপণ হতে পারে? তিনি বললেন হ্যাঁ হতে পারে। পুণরায় নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ঈমানদার ব্যক্তি কি মিথ্যাবাদী হতে পারে? তিনি বললেন, না।” (মুওয়াত্তায়ে মালি, বায়হাক্বী, আওযাযুল মাসালিক)
উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা একথাই বুঝানো হয়েছে যে, মুমিন ব্যক্তি কখনো মিথ্যা বলতে পারেনা অর্থাৎ যে ব্যক্তি মিথ্যা বলে তার পক্ষে মুমিন থাকা সম্ভব নয়।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মুমিন ব্যক্তির মধ্যে অন্য সকল দোষই অলপ বিস্তর থাকা সম্ভবপর কিন্তু গচ্ছিত সম্পদ আত্মসাত করা এবং মিথ্যা কথা বলার দোষ কিছুতেই থাকতে পারে না।” (হম, বায়হাক্বী)
মিথ্যা কথা বলা শুধু কবীরা গুণাহই নয় বরং কঠিন শাস্তির কারণ। যেমন মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ১০নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
ولهم عذاب اليم بما كانوا يكذبون.
অর্থ : তাদের মিথ্যারোপের কারণে তাদের জন্য কঠিন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।
এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
اماالرجل الذى رأيته يشق شدته فكذاب يحدث بالكذبة فتحمل عنه حتى تبلغ الا فاق فيصنع به ما ترى الى يوم القيمة.
অর্থ : হযরত জীব্রাঈল আলাইহিস সালাম বলেন, আপনি যে ব্যক্তিকে দেখছেন যে, তার গাল কর্তন করা হচ্ছে সে একজন মিথ্যাবাদী। সে অমূলক ও মিথ্যা কথা প্রচার করত। যা প্রচারিত হয়ে (দুনিয়ার) সমস্ত প্রান্তে পৌঁছত। আপনি যে শাস্তি দেখছেন ক্বিয়ামত অবধি তার প্রতি তা অব্যাহত থাকবে।” (সহীহ বুখারী, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, রশাদুস সারী, তাইসীরুল ক্বারী)
তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মিথ্যার বুরায়ী সম্পর্কে  বিশেষ সতর্ক বাণী উল্লেখ করা হয়েছে,
عليكم بالصدق فان الصدق يهدى الى البر وان البر يهدى الى الجنة وما يزال الرجل يصدق ويتحرى الصدق حتى يكتب عند الله صديقا واياكم والكذب فان الكذب يهدى الى الفجور وان الفجور يهدى الى النار وما يزال الرجل يكذب ويتحرى الكذب حتى يكتب عند الله كذابا.
অর্থ : তোমরা সত্য বলাকে ওয়াজিব করে নিও। নিশ্চয়ই সত্যবাদিতা সৎকাজের পথ প্রদর্শন করে এবং নিশ্চয়ই সৎকাজ বেহেশতের পথ প্রদর্শন করে। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্য বলার চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত সে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট ছিদ্দীক (মহা সত্যবাদী) বলে লিখিত হয়। তোমরা মিথ্যা থেকে সতর্ক থাক এবং মিথ্যা থেকে বাঁচ। নিশ্চয়ই মিথ্যা কথা গুণাহ দিকে ধাবিত করে। গুণাহ জাহান্নামের দিকে পথ প্রদর্শন করে। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত সে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কাজ্জাব বা মিথ্যাবাদী বলে লিখিত হয়।” (বুখারী শরীফ, মুসলিম, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস সারী, তাইসীরুল ক্বারী, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
আর মিথ্যাবাদীরা সর্বদাই মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত থেকে বঞ্চিত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
لعنة الله على الكاذبين.
অর্থ : মিথ্যাবাদীদের প্রতি মহান আল্লাহ পাক উনার লানত।
এখানে উল্লেখ্য যে, যেখানে সাধারণ লোকদের জন্যেও মিথ্যা বলা হারাম ও কবীরা গুণাহ্, সেখানে যারা নিজেদেরকে দ্বীনের হাদী বা দাঈ মনে করে থাকে, তাদের পক্ষে ফযীলত বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা কি করে জায়েয হতে পারে?
মূলত যারা হাদী দাবী করে অথচ মিথ্যা কথা বলে তারা যেরূপ হাদী হওয়ার যোগ্য নয়, তদ্রুপ তাদেরকে অনুসরণ অনুকরণ করা, তাদের থেকে দ্বীন গ্রহণ করাও শরীয়ত সম্মত নয়।
কারণ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
انظروا عمن تأخذون دينكم.
অর্থ : তোমরা কার নিকট থেকে তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করছ, তা লক্ষ্য কর।” (মুসলিম, মিশকাত, শরহে নববী, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, লুময়াত, তালীকুছ ছবীহ্)
অর্থাৎ তোমরা যার নিকট থেকে দ্বীনের বিষয় সম্পর্কে জানবে বা যাকে অনুসরণ-অনুকরণ করবে তার আক্বীদা, আমল-আখলাক্ব, সীরত-ছূরত, কথা-বার্তা ইত্যাদি শরীয়ত সম্মত কিনা তা যাচাই-বাছাই করবে।
কাজেই যারা হাদী হবেন, তাদের আমল-আখলাক্ব, সাধারণ লোকদের চেয়ে অনেক নিখুঁত, বিশুদ্ধ ও শরীয়ত সম্মত হতে হবে। কেননা কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
حسنة الابرار سيئة المقربين.
অর্থ : সাধারণ লোকদের জন্য যা নেকের কারণ, নৈকট্য প্রাপ্তদের জন্যে তা গুণাহের কারণ।
অর্থাৎ এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা সাধারণ লোকদের জন্য আমল করার নির্দেশ থাকলেও, খাছ নৈকট্যপ্রাপ্ত বা হাদীগণের জন্য তা আমল করা থেকে বিরত থাকাই নেকী বা মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি লাভের কারণ।
            যেমন এ প্রসঙ্গে হাদীছ শরীফে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
خذوا نصف الدينكم من هذه الحميره.
অর্থ : আমার পর তোমরা অর্ধেক দ্বীন শিক্ষা লাভ করবে, হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার থেকে।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর যেহেতু হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম হাদী হবেন, তাই হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনাকে হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম বলেন, “হে আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম! মহিলাদের জন্য কয়েকটি জিনিস ব্যবহার করা জায়েয হলেও তোমার  জন্য সেগুলো ব্যবহার করা জায়েয নয়। (১) রেশমী কাপড় পরিধান করা। (২) লাল রং-এর কাপড়  পরিধান করা। (৩) স্বর্ণের অলংকার ব্যবহার করা। কারণ তুমি আমার পরে হাদী হবে।তখন হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম বললেন- ইয়া রাসুলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমি রেশমী ও লাল রং-এর কাপড় পরিধান নাই বা করলাম, কিন্তু আমি যেহেতু মহিলা আমার তো অলংকার ব্যবহার করতে হবে।তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি অলংকার ব্যবহার করতেই হয়, তবে রূপার অলংকার ব্যবহার করবেহযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম বললেন, “আমি কি সে রূপার অলংকারগুলো স্বর্ণের পানিতে রং করে নিব?” নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যদি রং করতেই হয়, তবে জাফরানের পানিতে রং করে নিবে।
উল্লিখিত ঘটনা দ্বারা বুঝা গেল যে, যিনি হাদী, আলেম, মুহাদ্দিস, মুফতী ও আমীর হন বা হবেন, তাঁদেরকে হারাম ও নাজায়েয কাজ থেকে তো বেঁচে থাকতে হবেই বরং স্থানবিশেষে মোবাহ কাজও তরক করতে হবে। যেমন- হযরত আয়িশা ছিদ্দীকা আলাইহাস সালাম উনার জন্য রেশমী ও লাল রং-এর কাপড় পরিধান করা এবং স্বর্ণের অলংকার ব্যবহার করা জায়েয থাকা সত্ত্বেও, হাদী হওয়ার কারণে তা পরিধান ও ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। কাজেই যারা সব সময় হারাম ও নাজায়েয কাজে মশগুল থাকে, আর অপরকে করতে উৎসাহিত করে, তারা হাদী হওয়ার উপযুক্ত নয় এবং তাদের অনুসরণ করাও জায়েয নয়। 
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে ফযীলত বর্ণনায় কম-বেশী করা এবং ফযীলতবিহীন বিষয়গুলিতে ফযীলতের কথা বর্ণনা করা, মিথ্যা কথা বলার শামিল, যা সম্পূণই হারাম, নাজায়েয ও কবীরাহ গুণাহের অন্তর্ভূক্ত। আর মিথ্যা বলাকে জায়েয মনে করা কুফরী।
সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মুরুব্বী-আমীর বা তার অনুসারীরা তাদের প্রবর্তিত তাবলীগের প্রতি তারগীব বা উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে যে, ফযীলত বর্ণনার ক্ষেত্রে কম-বেশী করে ও মিথ্যা ফযীলত বর্ণনা করে বা মিথ্যা কথা বলে, আর এরূপ ক্ষেত্রে মিথ্যা বলাকে জায়েয বলে, তা সম্পূর্ণই হারাম, নাজায়েয ও কুফরী। এ ধরণের বক্তব্য বা আমল থেকে বিরত থাকা বা পরহেজ করা, তাদেরসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

৫৬নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, মসজিদে নববী ছাড়া বিশ্বের যে তিনটি দেশে, তিনটি মসজিদে প্রচলিত তাবলীগের বিশেষ মারকায, সেখানেই চব্বিশ ঘন্টা আমল জারী থাকে। যেমন- প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা লিখিত এক মুবাল্লিগের পয়লা নোট বই” (সংকলক- এঞ্জিনীয়ার মু.জা.আ. মজুমদার) নামক কিতাবের ৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “সারা বিশ্বে মাত্র ৪টি মসজিদে ২৪ঘন্টা আমল চালু থাকে। যথা- (১) কাকরাইল, ঢাকা (২) নিজামুদ্দীন বস্তী, দিল্লী (৩) রায়বন্দ, লাহোর। (৪) মসজিদে নববী, মদীনা শরীফ।
এখন আমাদের সুওয়াল হলো, তাদের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু সত্য? আর মসজিদে নববীকে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উল্লিখিত মসজিদগুলোর সর্বশেষে উল্লেখ করা কতটুকু সঠিক হয়েছে? শরীয়তের দৃষ্টিতে এর সঠিক সমাধান কামনা করি।

জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণ মনগড়া বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও বেয়াদবীমূলক। আর তা মিথ্যা হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কারণ তাদের উল্লিখিত তিন মসজিদ ছাড়াও পৃথিবীতে অসংখ্য অগণিত মসজিদ রয়েছে, যেখানে সর্বদাই দ্বীনের আমল হচ্ছে। তম্মধ্যে প্রথমেই বলতে হয়, বাইতুল্লাহ শরীফ উনার হেরেম শরীফ উনার কথা। যেখানে সর্বদাই নামায-কালাম, যিকির-ফিকির, দোয়া-দরূদ, তাওয়াফ ইত্যাদি নেক আমলসমূহ চালু রয়েছে। অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাদের কিতাবে বাইতুল্লাহ্ শরীফের কথা উল্লেখ করেনি। শুধু তাই নয়, আমাদের বাংলাদেশ ও পাক-ভারতেও এমন অনেক মসজিদ রয়েছে যেখানে ২৪ঘন্টাই আমল চালু রয়েছে। যেমন- সিলেটের হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ, হযরত শাহ মখদুম রূপোশ রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ, বগুড়ার হযরত মাহী সাওয়ার বল্খী রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ, চিটাগাং-এর হযরত শাহ আমানত রহমতুল্লাহি আলাইহি, শাহ গরীবুল্লাহ রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত বায়েজীদ বোস্তামীহযরত মোহসেন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদসমূহ।
ঢাকার হাইকোর্ট মসজিদ, মীরপুরে শাহ আলী বোগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ। তাছাড়া ভারতের আজমীর শরীফে, ইরাকের বাগদাদ শরীফে, পাকিস্তানের ফরীদুদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শোকর রহমতুল্লাহি আলাইহি মসজিদসহ পৃথিবীতে আরো অসংখ্য-অগণিত মসজিদ রয়েছে, যেখানে ২৪ ঘন্টাই নামায-কালাম, যিকির-ফিকির, দোয়া-দরুদ, ওয়াজ-নছীহত ও যিয়ারত ইত্যাদি নেক আমল সমূহ চালু রয়েছে।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উল্লিখিত মসজিদসমূহে অন্যান্য নেক আমল সমূহের সাথে সাথে আরো একটি বিশেষ সুন্নত চালু রয়েছে, যা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উক্ত তিন মসজিদে চিন্তাও করা যায়না। তাহলো- মাজার শরীফ যিয়ারত করা। অর্থাৎ মসজিদে নববীতে যেরূপ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র রওজা শরীফ রয়েছে এবং আশেক্বে রাসূলগণ সর্বদা সেখানে যিয়ারত করছেন ও অশেষ ফয়েজ, বরকত ও রহ্মত হাছিল করছেন। তদ্রুপ উল্লিখিত মসজিদ সমূহেও সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত, বিশ্ব সমাদৃত, নায়েবে রাসূল বা ওলী আল্লাহ্গণের মাজার শরীফ রয়েছে, সেখানে আশেক্বে ওলী আল্লাহ্গণ, সর্বদাই যিয়ারত করছেন এবং লাভ করছেন অশেষ রহমত-বরকত ও ফয়েজ-তাওয়াজ্জুহ্। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, উল্লিখিত মসজিদ সমূহে মসজিদে নববীর সুন্নাত অনুসরণে যেরূপ সর্বদা আমল চালু রয়েছে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উক্ত তিন মসজিদে তদ্রুপ নেই।
কাজেই শুধুমাত্র প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উক্ত তিন মসজিদেই ২৪ঘন্টা আমল চালু থাকে, অন্য কোন মসজিদে থাকেনা, তাদের একথা ডাহা মিথ্যা, মনগড়া, বিভ্রান্তিমূলক ও অন্যান্য মসজিদ সমূহের প্রতি অবজ্ঞা স্বরূপ।
দ্বিতীয়তঃ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাদের মসজিদ সমূহের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে, তাদের মসজিদগুলোর নাম প্রথমে উল্লেখ করেছে আর মসজিদে নববীর নাম সর্বশেষে উল্লেখ করেছে। এটি অত্যন্ত বেয়াদবীমূলক ও চরম ধৃষ্টতার শামিল।
এ ধরণের বেয়াদবী যারা করে, তাদের সম্পর্কে মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
بے ادب محروم گشت از لطف رب-
অর্থ : বেয়াদব মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত থেকে বঞ্চিত।” (মছনবী শরীফ)
কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উচিৎ ছিল, তাদের উল্লিখিত মসজিদসমূহের মধ্যে, মসজিদে নববীর নাম সর্ব প্রথমে উল্লেখ করা।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হলো যে, মসজিদে আমল চালু থাকা সম্পর্কিত, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই ডাহা মিথ্যা। আর মিথ্যা বলার পরিণাম সম্পর্কে ইতিপূর্বে পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস থেকে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
কাজেই এ ধরণের মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা তাদের সহ সকলের জন্যেই ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

৫৭নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত-এর লোকেরা বলে থাকে যে তারা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার সূরা ইমরান শরীফ ‍উনার ১০৪নং আয়াত শরীফ
ولتكن منكم امة يبدعون الى الخير يامرون بالمعروف وبنهون عن المنكر واولئك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে ও বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই মূলত কামিয়াব।এর আমল করে থাকে যা তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক কাজের দ্বারাই সাধিত হয়।
তাদের একথা কতটুকু সঠিক? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জানতে চাই।

জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের উপরোক্ত কথা সঠিক নয়। কারণ এ আয়াত শরীফ যাঁদের প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে তাঁরা হলেন, মুবাল্লিগে খাছ।
অথচ প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অধিকাংশ লোক মুবাল্লিগে খাছ তো নয়ই, এমনকি তারা মুবাল্লিগে আম-এর উপযুক্তও নয়। কাজেই তারা এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল যেমন করেনা তেমনি এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার অন্তর্ভূক্তও আদৌ তারা নয়। আবার তাদের ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক কাজ দ্বারা এই আয়াত শরীফের আমল হয়ে যায়, তাও সম্পূর্ণ ভুল কথা। কারণ এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সব ধরণের সৎ কাজের আদেশের কথা বলা হয়েছে এবং সব ধরণের অসৎ কাজের নিষেধের কথা বলা হয়েছে।
তাই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যদি বলে যে, তাদের ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক কাজের দ্বারাই সৎ কাজের আদেশ হয়ে যায় এবং অসৎ কাজের নিষেধ হয়ে যায়, তবে তা সম্পূর্ণই তাফসীর বির রায়ের অন্তর্ভূক্ত, যা কুফরীর শামিল। যে প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
من فسر القران برائه فقد كفر.
অর্থ : যে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মনগড়া তাফসীর করলো, সে কুফরী করলো।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো উল্লেখ আছে,
من قال فى القران برائه فاليتببؤا مقعده من النار. وفى رواية من قال فى القران بغير علم فليتبوأ مقعده من النار.
অর্থ : যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মনগড়া ব্যাখ্যা করে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।
অন্য রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি বিনা ইলমে বা না জেনে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ব্যাখ্যা করে সেও যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” (তিরমিযী, মিশকাত শরীফ, মায়ারেফুস সুনান, মায়ারেফে মাদানীয়া, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, উরফুশশাজী, তালীকুছ ছবীহ)
অপরদিকে যারা মুবাল্লিগে খাছ তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে বিশেষভাবে বর্ণিত রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে তাঁদেরকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন,          
فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفه ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থ : কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২২)
(তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : তোমরা দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর এবং  মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুত্নী, মেশকাত, মেরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, লুময়াত ইত্যাদি)
মূলত যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁদেরকে অবশ্যই ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী, রব্বানী আলেমগণের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.
অর্থ : নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করেন।” (পবিত্র সূরা ফাতির শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহিকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলেম।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে,
من ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟ قال الطمع.
অর্থ : “(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলেম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আলেমের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।” (দারেমী, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত ইত্যাদি)      অর্থাৎ যিনি ইলম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলেম।
কাজেই যিনি ইলম, আমল ও ইখ্লাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলেম, আর তিনিই নবী আলাইহিস সালামগণের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলেমগণ হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (হম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ্, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, তোহফাতুল আহওয়াযী, মায়ারেফুস সুনান, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, উরফুশশাজী, তালীক)
অর্থাৎ নবী আলাইহিস সালামগণের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁরা নবী আলাইহিস সালামগণের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে তাঁদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তালীম বা তাবলীগ ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে ওলামায়ে হক্কানী- রব্বানীগণ তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানাভাবে দাওয়াত ও তালীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আম-এর (ফরজে কেফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-এর (ফরজে আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
অতএব, প্রতীয়মান হল যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের ৬ (ছয়) উছুল ভিত্তিক কাজ করলেই সকল নেক কাজের কথা বলা হয়ে যায় এবং সকল অসৎ কাজের নিষেধ হয়ে যায়, তা সম্পূর্ণই বিভ্রান্তিমূলক কথা এবং তারা পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার ১০৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ অনুযায়ী আমল করে থাকে, তাও সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অশুদ্ধ কথা এবং তাফসীর বির রায়ের অন্তভূক্ত। যা বলা থেকে তাদের পরহেজ করা ফরয-ওয়াজিব।

৫৮নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই মনে করে থাকে যে, তাদের ৬ (ছয়)উছূল ভিত্তিক তাবলীগের দাওয়াত মোতাবেক যাদের জীবন পরিবর্তিত হবে। শুধুমাত্র তাদের দ্বারাই আল্লাহ পাক হিদায়েত বা দ্বীনের কাজ নিবেন। যেমন- হযরতজীর কয়েকটি স্বরণীয় বয়াননামক কিতাবের ২য় খন্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যাদের জীবন দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন অর্জিত হবে, তাদের দ্বারা আল্লাহ পাক হিদায়েত ছড়াবেন, .....। যাদের জীবনে দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন আসবেনা, তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের প্রকৃত কাজ নিবেন না।
এখন আমাদের প্রশ্ন হলো- প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য কতটুকু সঠিক ও দলীল ভিত্তিক? জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।

জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই অশুদ্ধ, মনগড়া, বিভ্রান্তিকর ও দলীল বিহীন। কারণ প্রথমতঃ বলতে হয় যে, দাওয়াত ছাড়াও আরো অনেক কিছুর মাধ্যমে মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার শুরুতে ইরশাদ মুবারক করেন,
ذالك الكتاب لا ريب فيه هذى للمتقين.
অর্থ : “পবিত্র কুকোরআন শরীফ এমন একখানা কিতাব, যার মধ্যে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ্ নেই। আর কোরআন শরীফ মুত্তাক্বীদের জন্য পথ প্রদর্শক বা মানুষের জীবনে ব্যপক পরিবর্তন আনয়নকারী।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২)
আর তাই খলীফাতুল মুসলিমীন, আমীরুল মুমিনীন, হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম বলেন,
ان الله يرفع بهذا الكتاب اقراما ويضع به اخرين.
অর্থ : নিশ্চয় মহান আল্লাহ পাক এ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার দ্বারা অনেক ক্বওমকে হিদায়েত বা পরিবর্তন দান করেছেন। আর অনেক ক্বওম কোরআন শরীফকে অস্বীকার করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।” (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, শুধুমাত্র দাওয়াতের মাধ্যমেই মানুষের জীবনে হিদায়েত বা পরিবর্তন আসেনা বরং পবিত্র কুরআন শরীফ বা আরো বহু কিছুর মাধ্যমেও মানুষের জীবনে বিরাট ও ব্যাপক হিদায়েত বা পরিবর্তন আসতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত বুযুর্গ, হযরত ফরীদুদ্দীন আত্তার রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বিশ্বখ্যাত, নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ আলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিগণ উনার অনুপম জীবনী গ্রন্থ তাযকেরাতুল আওলিয়ারএকটি মশহুর ওয়াক্বেয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখ্য, বিখ্যাত ওলী আল্লাহ, তৎকালীন যামানায় মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ লক্ষ্যস্থল, হযরত ফুযায়েল ইবনে আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি, জীবনের প্রথমভাগে তিনি একজন বিখ্যাত ডাকাত সর্দার ছিলেন। তার ভয়ে সকলেই সর্বদা ভীত থাকতো, কোন বণীক কাফেলাই তার হাত থেকে রেহাই পেতনা। তিনি সকলেরই সর্বস্ব লুক্তন করে নিতেন। একবার এক বণীক তার অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাবে, কিন্তু ফুযায়েল ইবনে আয়াজ-এর আস্তানার সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া তার বিকল্প কোন পথ ছিলনা।
উক্ত বণীক ফুযায়েল ইবনে আয়াজের হাত থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য একজন হাফেজ সাহেবকে তার বাহনের পিছনে বসিয়ে তাকে কোরআন তিলাওয়াত করার নির্দেশ দেয়। বণীকের ধারণা হয়তোবা কোরআন তিলাওয়াতের সম্মানার্থে ফুযায়েল তাকে আক্রমণ করবেনা।
এদিকে বণীক যখন তার ধন-সম্পদ নিয়ে ফুযায়েল ইবনে আয়াজ উনার আস্তানার নিকটবর্তী হলো, তখন হাফেজ সাহেব তিলাওয়াত করছিলেন,
الم يان للذين امنوا ان تخشع قلو بهم لذكر الله.
অর্থাৎ- এখনো কি মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরের দ্বারা ঈমানদারগণের অন্তর সমূহকে ভীত ও জাগ্রত করার সময় আসে নাই।” (পবিত্র সূরা হাদীদ, পবত্রি আয়াত শরীফ ১৬)
উল্লেখ্য, ফুযায়েল ইবনে আয়াজ যেহেতু আরবী ভাষী ছিলেন, তাই তিনি উক্ত আয়াত শরীফ শুনা মাত্র তাঁর অন্তর ভীত হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই এখন তওবা করার সময় এসেছে। তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ফুযায়েল আজ থেকে তওবা করছে, সে আর কোন দিন ডাকাতি করবেনা। এই বলে সে বাদশাহর দরবারে চলে গেল, গিয়ে বললো, হে বাদশাহ! আমাকে শাস্তি দিন, আমি জীবনে বহু অন্যায় ও অবিচার করেছি। বাদশাহ যখন বুঝলেন, ফুযায়েল ইবনে আয়াজ তার ভুলের জন্য অনুশোচনা বা খালেছ তওবা করেছে, তখন বাদশাহও তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
অতঃপর ফুযায়েল ইবনে আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বাইয়াত হয়ে উনার ছোহবতে থেকে কঠোর রিয়াজত-মোশাক্বাত ও মোরাকাবা-মোশাহাদার মাধ্যমে ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে পূর্ণতা লাভ করেন।
এখন ফিকিরের বিষয় এই যে, কোরআন শরীফের একখানা আয়াত শরীফ, মশহুর ডাকাত সর্দার ফুযায়েল ইবনে আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জীবনে এমন বিরাট ও ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিল যে, তিনি সে যামানার ওলী আল্লাহগণ উনার মধ্যে বিশেষভাবে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেন এবং দ্বীনের একজন শ্রেষ্ঠ হাদী বা খাদেম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। শুধু তাই নয়, উনার উসীলায় পরবর্তীতে অসংখ্য-অগণিত লোকের জীবনেও ব্যাপক হিদায়েত ও পরিবর্তন আসে। সাথে সাথে তাঁর মাধ্যমে পৃথিবীতে জারী হয়- চীশতীয়া, চীশতীয়া নিযামিয়া ও চীশ্তীয়া ছাবেরিয়া তরীক্বা সমূহের বরকতপূর্ণ সিলসিলা। যে সিলসিলার মাধ্যমে অসংখ্য লোক নিজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে লাভ করছে, হিদায়েত তথা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি। 
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, শুধুমাত্র দাওয়াতই জীবনে পরিবর্তন আনার মাধ্যম নয়। এছাড়াও বহুভাবে জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন এসেছে হযরত ফুযায়েল ইবনে আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ আরো অনেকের জীবনে।
দ্বিতীয়তঃ বলতে হয় যে, শুধুমাত্র দাওয়াত মোতাবেক জীবনে পরিবর্তন আসলেই যে, তার দ্বারা হিদায়েত ছড়াবে বা দ্বীনের হাক্বীক্বী কাজ হবে, অন্যথায় হবেনা।
এ কথাটিও সম্পূর্ণ অশুদ্ধ, কল্পনা প্রসুত ও অবান্তর এবং বিভ্রান্তিকর। কেননা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এমন অনেকেই অতীত হয়েছেন, যাদের জীবন দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন হয়নি বরং অন্য কোনভাবে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তাদের দ্বারা দ্বীনের হাক্বীক্বী কাজ হয়েছে বা ব্যাপকভাবে হিদায়েত ছড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট বুযুর্গ ও ওলী মহান আল্লাহ অন্যতম তাবেয়ী, ইমামুশ শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত, হযরত ইমাম হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসার ঘটনাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
কিতাবে উল্লেখ করা হয়, হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রথম জীবনে একজন মনি-মুক্তার ব্যবসায়ী ছিলেন, রোম থেকে মণিমুক্তা এনে বছরাতে বিক্রী করতেন। রোমের এক উজিরের সাথে উনার সম্পর্ক ছিল। সেই রোমের মন্ত্রী বললো, হে হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি! আপনি এসেছেন ব্যবসার মাল নেয়ার জন্য, আজকে আমি আপনাকে একটা নতুন জায়গায় নিয়ে যাব এবং একটা নূতন জিনিস দেখাব। হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, ঠিক আছে, নিয়ে চলেন। উনাকে নিয়ে যাওয়া হলো, অনেক দূরে একটা মাঠের মধ্যে। সেই মাঠে ছিল একটা বড় তাঁবু টাঙ্গানো, যে তাঁবুর ভিতরে কিছু একটা রাখা ছিল। তিনি দূরের থেকে লক্ষ্য করলেন যে, সেই রোমবাসীদের বাদশাহ্ সেখানে গিয়েছে, তার উজির-নাজির সকলেই হাজির হয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে প্রথমতঃ কিছু সৈন্য-সামন্ত তাদের ঢাল-তলোয়ার নিয়ে সেই তাঁবুটার চারপাশ ঘুরলো এবং তৎপর তারা কি যেন বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
দ্বিতীয়তঃ কিছু সংখ্যক আলেম বা জ্ঞানীলোকও কিছু কিতাবসহ সেই তাঁবুটার চারপাশ ঘুরে, কিছু বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
তৃতীয়তঃ এরপর কিছু বৃদ্ধলোক, তারাও সেই তাঁবুটার চারপাশ ঘুরলো।  তারাও কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলে চলে গেল।
চতুর্থতঃ কিছু খুবছূরত মহিলা। তাদের মাথায় স্বর্ণ মণি-মুক্তার ডালা রয়েছে। সেগুলি নিয়ে তারা সে তাবুটার চারপাশ ঘুরে কিছু বলে, কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
এরপরে যখন স্বয়ং বাদশাহ্ও তার চারপাশ ঘুরলো এবং সে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে কিছু বলে, সেখান থেকে বের হয়ে আসল।
তখন হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, হে ভাই মন্ত্রী, আমি তো তোমাদের ভাষা বুঝি না। তোমরা কি বললে, কি করলে? আমি তো কিছুই বুঝলাম না। জবাবে সে মন্ত্রী বললো- হে হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি, মূলত বাদশাহ একটা ছেলে ছিল, সে খুব উপযুক্ত ছিল। বাদশাহ্ মনে করেছিল, বাদশাহ পরে তাকেই গদীনশীন করা হবে। কিন্তু হঠাৎ এক অসুখে সে মারা যায়। তখন তাকে এখানে দাফন করা হয়, এজন্য প্রত্যেক বৎসর তার মৃত্যুর দিন বাদশাহ এখানে আসে।
আর আপনি যে সৈন্য-সামন্তদের দেখলেন- তারা কি বললো, জানেন? সৈন্য-সামন্তরা তাদের ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তার কবরের চারপাশ ঘুরলো এবং তারা কাঁদতে কাঁদতে বললো, হে শাহ্জাদা যদি ঢাল দিয়ে, তলোয়ার দিয়ে তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব হতো, তাহলে আজকে তোমাকে আমরা অবশ্যই, তার দ্বারা সেই মৃত্যু থেকে রক্ষা করতাম  কিন্তু তোমাকে এমন এক অস্তিত্ব অর্থাৎ খালিক, মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মৃত্যু দিয়েছেন, যাঁর কাছে আমাদের ঢাল-তলোয়ারের কোন মূল্যই নেই। কাজেই তোমাকে রেখে যাওয়া ছাড়া আমাদের কোন পথ নেই। এই কথা বলে তারা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
এরপরে জ্ঞানী ব্যক্তিরা আসল। এসে বললো- হে শাহজাদা, যদি জ্ঞান দিয়ে, আক্বল দিয়ে, সমঝ দিয়ে তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব হতো, তবে আমরা সে উপায়ে তোমাকে রক্ষা করতাম। কিন্তু যিনি তোমাকে নিয়ে গেছেন, উনার কাছে আমাদের জ্ঞান, আমাদের আক্বল তুচ্ছতাচ্ছিল্য। এই কথা বলে কাঁদতে কাঁদতে তারাও চলে গেল। এরপর আসলো বৃদ্ধলোকেরা। তারা এসে বললো- হে শাহজাদা যদি কান্নাকাটি করে, রোনাজারি করে, আহাজারি করে, মায়া-মুহব্বত দিয়ে, তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব হতো, আমরা তোমাকে সেভাবে রক্ষা করতাম। কিন্তু যিনি নিয়ে গেছেন, আমাদের রোনাজারি, আহাজারি, কান্নাকাটির কারণে তিনি তোমাকে আবার আমাদের মাঝে জীবিত করে দিবেন না। একথা বলে তারাও কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
এরপরে আসলো সেই মহিলারা। তারা বললো যে, হে শাহজাদা, যদি ছূরত দিয়ে, মাল দিয়ে তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব হতো, আমরা তার দ্বারা তোমাকে রক্ষা করতাম। কিন্তু যিনি নিয়ে গেছেন, উনার কাছে এগুলো তুচ্ছ, এগুলোর কোন মূল্যই নেই। কাজেই আমাদেরকেও চলে যেতে হলো।
শেষ পর্যন্ত বাদশাহ্ বললো, হে শাহজাদা! যদি আমার সমস্ত রাজত্বের বিণিময়ে, সমস্ত ধন-সম্পদের বিণিময়ে তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব হতো, তবে আমি তা করতাম। কিন্তু আমার এই সমস্ত ধন-সম্পদ ও রাজত্বের, যিনি তোমাকে নিয়ে গেছেন, তাঁর কাছে কোন মূল্যই নেই। কাজেই তোমাকে রেখে যাওয়া ছাড়া আমারও অন্য কোন পথ নেই। একথা বলে বাদশাহ্ নিজে ও উজির-নাজিরসহ কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।
হযরত ইমাম হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহি এই ঘটনা দেখে খুব ফিকিরে পড়ে গেলেন এবং এর থেকে নছীহত গ্রহণ করেই খালেছ তওবা করলেন আর হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহিস সালাম উনার নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফে পূর্ণতা লাভ করে ইমামুশ্ শরীয়ত ওয়াত্ব তরীক্বত হিসেবে সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেন।
এখানে ফিকিরের বিষয় এই যে, হযরত হাসান বছরী রহমতুল্লাহি আলাইহিকেও কেউ হিদায়েতের জন্য দাওয়াত দেয়নি বা তওবা করার উপদেশ দেয়নি। কিন্তু বর্ণিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ পাক উনাকে হিদায়েত দান করেন অর্থাৎ উনার জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। এবং উনার দ্বারা আল্লাহ পাক ব্যাপকভাবে পৃথিবীতে হিদায়েত ছড়িয়েছেন বা হাক্বীক্বী দ্বীনের খেদমত নিয়েছেন এবং উনার হিদায়েতের সিলসিলা যেমন- চীশতীয়া, চীশতীয়া নিযামিয়া ও চীশতীয়া ছাবেরিয়া তরীক্বা এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে জারী রেখেছেন।
উল্লেখ্য, এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ও প্রসিদ্ধ সাহাবী, হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার হিদায়েত লাভ করার বা জীবনে পরিবর্তন আসার ঘটনাটিও বিশেষভাবে স্মরণীয়।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম বা ঐতিহাসিকগণের মতে, হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৫০০ বৎসর হায়াত পেয়েছেন। অবশ্য কেউ কেউ কমও বলেছেন। তবে ঐক্যমতে কমপক্ষে দুশত বছর বলা হয়েছে। হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন মজুসী বা অগ্নি উপাসকের সন্তান। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি মজুসী ধর্ম পরিত্যাগ করে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুসেল, নসিবাইন ইত্যাদি নানা স্থান সফর করে পর্যায়ক্রমে এক পাদ্রী থেকে অপর পাদ্রীর নিকটে গিয়ে হক্ব তালাশ করতে লাগলেন। তিনি সর্বশেষ যে পাদ্রীর নিকট যান, সে পাদ্রী উনাকে বললো- হে সালমান! তুমি আমার পর আর কোন হক্ব পাদ্রী পাবেনা, এরপর তুমি আখেরী নবী, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আগমনের জন্য অপেক্ষা করবে। পাদ্রী আরো বললো- তিনি আগমন করবেন মক্কা শরীফে, ওয়াদিউল কোরায়, আর হিজরত করবেন, মদীনা শরীফে। সে স্থান হবে কঙ্করময় ও খেজুর বৃক্ষে পরিপূর্ণ। উনার পীঠ মোবারকে থাকবে, “মহরে নুবুওওয়াত।তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, কিন্তু যাকাত-ফিৎরা খাবেন না।
উক্ত পাদ্রী ইন্তেকাল করার পর হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আখেরী নবীর সন্ধানে, হক্ব তালাশের উদ্দেশ্যে আরবীয় এক কাফেলার সাথে মক্কা-মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কিন্তু কাফেলার লোকেরা চক্রান্ত করে পথিমধ্যে উনাকে এক ইহুদীর নিকট গোলাম হিসেবে বিক্রী করে দেয়। ইহুদী উনাকে নিয়ে মদীনায় চলে যায়। তিনি মদীনায় গিয়েই বুঝতে পারলেন, এখানেই আখেরী নবী হিজরত করবেন। কারণ তিনি দেখলেন যে, এ স্থানটির বর্ণনা পাদ্রীর কথার সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। তাই তিনি সেখানে আখেরী নবী নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হিজরতের অপেক্ষায় রইলেন।
একদিন তিনি উনার মনীবের উপস্থিতিতে মনীবের খেজুর গাছ পরিস্কার করছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে ইহুদী মনীবকে সংবাদ দিল যে, যিনি আখেরী নবী দাবী করেছেন, তিনি ইয়াসরেব অর্থাৎ মদীনা শরীফে এসেছেন। একথা হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুও শুনলেন। তাই তিনি একদিন গোপনে, কিছু খেজুর নিয়ে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দরবার শরীফ আসলেন এবং খেজুরগুলো দিয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এগুলো ছদকা হিসেবে এনেছি। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেজুরগুলো হাতে নিয়ে গরীব ছাহাবী উনাদের দিয়ে বললেন, “এগুলো তোমরা খেয়ে ফেলুন, আমার জন্য ছদকা খাওয়া জায়েয নেই।
অতঃপর আরেক দিন কিছু খেজুর নিয়ে দরবার শরীফ আসলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এগুলো হাদিয়া স্বরূপ এনেছি। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা গ্রহণ করলেন, নিজে খেলেন এবং সকলকে খাওয়ালেন।
পূর্বোক্ত পাদ্রির ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার জন্য এখন শুধু বাকী রইলো মোহরে নুবুওওয়াত দেখা। তিনি মোহরে নুবুওওয়াত দেখার জন্য সর্বদা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পিছনে হাঁটতেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে পিছন দিক থেকে চাদর মুবারক ফেলে দেন, এ সুযোগে হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মোহরে নুবুওওয়াত দেখার পরম সৌভাগ্য লাভ করেন এবং তাতে তিনি চুমু খান। অতঃপর তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, ইনিই হচ্ছেন আখেরী নবী, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। অতঃপর সাথে সাথে তিনি বাইয়াত গ্রহণ করে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করেন। (সুবহানাল্লাহ্)
স্মরণযোগ্য যে, হযরত সালমান ফার্সী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার জীবনে যে বিরাট ও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তা কখনোই দাওয়াতের কারণে হয়নি। অর্থাৎ সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সরাসরি দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে উনার নিকট যাননি। কিন্তু তথাপিও তিনি একজন বিশিষ্ট সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন এবং উনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক ব্যাপকভাবে হিদায়েত ছড়ান এবং হাক্বীক্বী দ্বীনের কাজ নেন। উনার হিদায়েতের সিলসিলা যেমন- নকশবন্দীয়া ও মুজাদ্দেদিয়া তরীক্বা এখনো পৃথিবীতে রয়েছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত ইনশাআল্লাহ থাকবে। যার মাধ্যমে অসংখ্য অগণিত লোক হিদায়েত লাভ করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ রেজামন্দী হাছিল করছে এবং করবে।
এছাড়াও অনুরূপ আরো অসংখ্য মেছাল রয়েছে যে, যাঁদের জীবনে দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু উনাদের দ্বারাও পৃথিবীতে হাক্বীক্বী দ্বীনের কাজ হয়েছে।
অতএব, উপরোক্ত বিস্তারিত এবং দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, শুধুমাত্র দাওয়াতই জীবনে পরিবর্তন বা হিদায়েত আসার মাধ্যম নয়, এছাড়াও বহু মাধ্যম রয়েছে। আর দাওয়াত ছাড়া অন্য কোনভাবে জীবনে পরিবর্তন আসলে বা হিদায়েত লাভ করলেও তাঁদের দ্বারা ব্যাপকভাবে হিদায়েত ছড়ানো বা দ্বীনের হাক্বীক্বী খেদমত হওয়া সম্ভব।
সুতরাং প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যে বলে থাকে, “যাদের জীবনে দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন আসবে, তাদের মাধ্যমে হিদায়েত ছড়াবে বা হাক্বীক্বী দ্বীনের কাজ হবে অন্যথায় নয়। তাদের এ বক্তব্য সম্পূর্ণই অশুদ্ধ, বিভ্রান্তিকর, অজ্ঞতাপ্রসূত ও পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ বিরোধী। এ ধরণের বক্তব্য থেকে পরহেজ হওয়া তাদেরসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ফরয-ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত।

৫৯নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক দোয়া ও তাসবীহ পড়াই সুন্নত। যা করলেই যিকির-এর হক্ব আদায় হয়ে যায়। এবং তার দ্বারাই অনেক অনেক ফজীলত, রহমত ও বরকত পাওয়া যায়। আর এর দ্বারাই অন্তর ইসলাহ্ হয়। অর্থাৎ তাছাউফ ভিত্তিক ক্বলবী যিকিরের আর দরকার হয়না। অপরদিকে তাদের কথানুযায়ী তাছাউফী বা ক্বলবী যিকির হল নফল এবং যার ফজীলত নগণ্য। আর এসব কথা নাকি তাদের হযরতজীর মলফুজাত এবং মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দীর তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্বনামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
তাদের একথা কতটুকু সঠিক? নির্ভরযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য ও মন্তব্য আদৌ সঠিক নয়। এ ধরণের কথা বিশেষভাবে বিভ্রান্তিকর এবং ইলমে তাসাউফকে অবজ্ঞা ও এহানত করার কারণে হক্ব মত, হক্ব পথের খেলাফ।
আর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা, যে পরিমাণে ও যেভাবে তিন তাসবীহ ও দোয়া সমূহ পাঠ করে, তা সুন্নত উনার পর্যায়ে পড়েনা। বরং তা নফল হিসেবে গণ্য হয়। যেমন এ প্রসঙ্গে তাদের ছে বাঁতেছয় উছুল নামক কিতাবের (মূল- মাওঃ আশেকে ইলাহী, অনুবাদ- মোঃ মাসউদ আহম, মুতায়াল্লিম, দারুল উলুম দেওবন্দ) চৌদ্দ পৃষ্ঠায় লিখিত রয়েছে- “...... তবে প্রত্যেকে অন্ততঃ সকালে ও বিকালে কলেমা তৌহিদ, দরূদ শরীফ ও ইস্তেগফার প্রত্যেকটা এক এক তাসবীহ পড়ার অভ্যাস করবে।
আর এক মোবাল্লেগের পয়লা নোট বইতে, নয় পৃষ্ঠায় লিখিত রয়েছে- তিন তাসবীহ হইল কলেমা ছওম অর্থাৎ ছোবহানাল্লাহে ওয়াল হামদুলিল্লাহে ওয়া লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার (ইহার সাথে ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আযিম- মিলাইয়া পড়িলে উত্তম হয়) সকালে একশত বার ও বিকালে একশত বার আস্তাগফেরুল্লাহা রাব্বি মিন কুল্লে জাম্বিও ওয়া আতুবু ইলাইহি অথবা আস্তাগফেরুল্লা হিল্লাজি লা-ইলাহা- ইল্লাহুয়াল হাইয়্যূল কাইয়্যূম ওয়া আতুবু ইলাইহি- সকালে একশতবার, বিকালে একশত বার। (৩) যে কোন দরূদ শরীফ সকালে একশত বার বিকালে একশত বার।
আবার পূর্বোক্ত ছে বাঁতেকিতাবে আরো উল্লেখ রয়েছে, “হাদীছ শরীফে সময় সময় যে সমস্ত দোয়া পড়ার নির্দেশ এসেছে, যেমন- শোওয়ার জায়গায়, মজলিসের শেষে, খাওয়ার আগে ও পড়ে, ঘরে ঢুকতে, ঘর থেকে বের হতে, ছফরের প্রারম্ভে ও ছফর হতে ফিরে আসার পর, সওয়ারীর পিঠে বা গাড়ীর সিটে বসবার, নতুন শহর বা বস্তিতে প্রবেশ করবার, এবং আরও অন্যান্য দোয়া সমূহ মুখস্থ করে যদি ধ্যানের সাথে প্রতিটা ক্ষেত্রে পড়ার অভ্যাস করা যায় তবে সব সময় মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরের অনুশীলন হতে পারে।
অর্থাৎ তাদের এই বক্তব্য দ্বারা বোঝা যায় যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের মতে উপরোক্ত তিন প্রকার তাসবীহ ও দোয়া দ্বারাই যিকিরের হক্ব আদায় হয়ে যায়। যার দ্বারাই তাদের মতে অন্তর ইলাহ হয়।
উল্লেখ্য উপরোক্ত কাজ সমূহ লোগাতী অর্থে ঠিকই যিকিরের পর্যায়ে পড়ে কিন্তু হাক্বীক্বী অর্থে যিকিরের ফায়দা তার দ্বারা আদৌ অর্জিত হয়না। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে সালাত শব্দটি বহু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো তা ব্যবহৃত হয়েছে রহমত অর্থে, কখনো শান্তি অর্থে কখনো ইস্তেগফার, তাসবীহ-তাহলীল অর্থে কখনো দরূদ অর্থে আবার কখনো নামায অর্থে। আর শুধু দরূদ পাঠ করে যেমন নামাজের হক্ব আদায় হয়না যদিও নামাজের মধ্যেই দরূদ রয়েছে, তেমনি তাসবীহ ও দোয়া এক প্রকার যিকির হলেও সে যিকির দ্বারা মূলত ক্বলবী যিকিরের হক্ব কিছুই আদায় হয়না।
কারণ ক্বলবী যিকির সম্পূর্ণই ভিন্ন জিনিস। যা অর্জন করা ফরয। যে প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
واصبر نفسك مع الذين يدعون ربهم والغداوة والعشى يريدون وجهه ولا تعد عينك عنهم تريد زينة الحيوة الدنيا ولا تطع من اغفلنا قلبه عن ذكرنا راتبع هواه وكان امره فرطا.
অর্থ : আপনি নিজেকে তাঁদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যাঁরা সকাল-সন্ধ্যায় তাঁদের রবকে ডাকে উনার সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য এবং আপনি দুনিয়াবী জিন্দেগীর সৌন্দর্য্য (হাছিল)-এর উদ্দেশ্যে তাঁদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবেন না এবং তার অনুসরণ করবেন না, যার ক্বলবকে আমি আমার যিকির থেকে গাফেল করেছি। অর্থাৎ যার ক্বলব আমার যিকির থেকে গাফেল হয়েছে। আর যে নিজের নফসের অনুসরণ করে এবং যার কাজ সীমালংঘন করা।” (পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি হাছিলের জন্য ক্বলবী যিকির করেনা, তার অনুসরণ ও ছোহ্বত এখতিয়ার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত হয়েছে,
ومن يعش عن ذكر الرحمن نقيض له شيطانا.
অর্থ : যার ক্বলব মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির থেকে গাফেল থাকে, তার জন্য একটি শয়তান মোকররার করে দেয়া হয়, সে শয়তান তাকে খারাপ পথে ওসওয়াসা দিতে থাকে।” (পবিত্র সূরা যুখরূ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৬)
এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীরে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে,
الشيطان جاثم على قلب ادم اذا دكر الله خنس راذا غفل وسوس.
অর্থ : শয়তান আদম সন্তানের ক্বলবের উপর বসে থাকে। আদম সন্তান যখন যিকির করে, তখন শয়তান পালিয়ে যায়, আর যখন যিকির থেকে গাফেল থাকে, তখন এসে ওসওয়াসা দেয়।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, রশাদুস সারী, শরহে কেরমানী, মিরকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ)
পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত আছে যে,
يوم لا ينفع مال ولا بنون الا من اتى الله بقلب سليم.
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন কেউ কামিয়াবি হাছিল করতে পারবেনা, তার পরিশুদ্ধ অন্তর বা ক্বাল্বে সলিম ব্যতীত।” (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৮)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে,
فى ان الحسد مضغة اذا صلحت صلح الجسد كله واذا فسدت قسدت فسد الجسد كله الا وهى القلب.
অর্থ : মানুষের শরীরে এক টুকরা গোশ পিণ্ড আছে, তা সংশোধন হয়ে গেলে সমস্ত শরীর সংশোধন হয়ে যায়, আর তা বরবাদ হলে সমস্ত শরীর বরবাদ হয়ে যায়। সাবধান! সে গোশতের টুকরা হলো ক্বলব।” (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, রশাদুস সারী, শরহে কেরমানী, তাইসীরুল ক্বারী)
ইলম অর্জন করা ফরয। আর ইলমকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। (ক) ইলমে জাহির (খ) ইলমে বাতিন। আর বাতেনী ইলম অর্জন করার উপায় হলো ক্বলবী যিকির।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো বর্ণিত রয়েছে,
لكل شى صقالة وصقالة القلوب ذكر الله.
অর্থ : প্রত্যেক জিনিস পরিস্কার করার যন্ত্র রয়েছে ক্বলব পরিস্কার করার যন্ত্র হলো- ক্বলবী যিকির।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ)
উপরোক্ত পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে সকল ইমাম, মুজতাহিদ, মুহাক্কিক, মুদাক্কিক এবং ওলামায়ে মুতাআখখেরীন ও মুতাকাদ্দেমীনগণ ক্বলবী যিকির করাকে ফরয বলে সাব্যস্ত করেছেন। আর কেবলমাত্র পীর সাহেব উনার কাছে বাইয়াত হয়ে তা হাছিল করা সম্ভব বিধায়, উনারা পীর সাহেব উনার কাছে বাইয়াত হওয়াও ফরয বলেছেন। কারণ পীর সাহেব উনার কাছে বাইয়াত হওয়া ব্যতীত কখনো ক্বলবী যিকির হাছিল করা সম্ভব নয়। আর এই ক্বলবী যিকির করেই মানুষ ওলীআল্লাহ হতে পারে। যাঁদের শান সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন,
الا ان اولياء الله لا خوف عليهم ولاهم يحزنون.
অর্থ : সাবধান! যারা ওলী আল্লাহ, তাদের কোন ভয় নেই, চিন্তা নেই, পেরেশানী নেই।” (পবিত্র সূরা ইউনুস শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৬২)
অর্থাৎ ক্বলবী যিকির যেমন অত্যাবশ্যক তেমনি তার ফযীলতও অনেক এবং ব্যাপক।
অতএব, প্রকৃষ্টরূপে প্রতীয়মান হলো যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের তাস্বীহ-তাহলীল ও ক্বলবী যিকির সম্পর্কিত উপরোক্ত বক্তব্য ও মন্তব্য সম্পূর্ণই ভুল। এ ধরণের বক্তব্য ও মন্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা তাদেরসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ফরয-ওয়াজিব।

৬০নং সুওয়াল ও তার জাওয়াব

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, পীর সাহেবদের দ্বারা দ্বীনের ব্যাপক খেদমত কখনোই সম্ভব নয়। তাই তারা পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়া বা ইলমে তাছাউফ চর্চা করাকে মোটেও গুরুত্ব দেয় না। একথার সত্যতা তাদেরই লোক দ্বারা লিখিত আয়নায়ে তাবলীগনামক কিতাবের (লেখক- মুহম্মদ দাউদ আলী) নিম্নোক্ত বক্তব্য দ্বারাও প্রমাণিত হয়। তারা লিখেছে- তাবলীগের মধ্যে পীর-মুরীদীর প্রচলন সম্ভব নহে, কেননা পীরী-মুরীদীর দ্বারা সাধারণতঃ গন্ডিবদ্ধ একটা দলের সৃষ্টি হইয়া থাকে। ..... এইরূপ একটা দলের দ্বারা ব্যাপক কোন কাজ করা সম্ভব নহে। .... তাই বাধ্য হইয়া তাবলীগ এই পথ এড়াইয়া চলিয়া থাকে।
এখন আমাদের জানা ও বুঝার বিষয় হলো, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের পীর-মুরীদীর পথ এড়িয়ে চলা কতটুকু শরীয়ত সম্মত ও গ্রহণযোগ্য? আর সত্যিই কি পীর-মুরীদীর দ্বারা ব্যাপকভাবে দ্বীনের খেদমত করা সম্ভব নয়? পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে বিস্তারিত জানিয়ে উপকৃত করবেন বলে আমরা আশা রাখি।

জাওয়াব : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য ও প্রচারণা, মারাত্মক আপত্তিকর, জেহালতপূর্ণ ও সম্পূর্ণ অবান্তর।
প্রথমতঃ বলতে হয় যে, পীর-মুরীদীর পথকে বা ইলমে তাসাউফকে এড়িয়ে চলার অর্থই হচ্ছে- পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদেরকে এড়িয়ে চলা। কারণ পীর-মুরীদীর কথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অসংখ্য স্থানে বর্ণিত হয়েছে, যেমন- মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র সূরা তওবা শরীফ উনার ১১৯ নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا اتقو الله وكونوا مع الصادقين.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় কর এবং সদেক্বীন অর্থাৎ ওলীআল্লাহগণ উনাদের সঙ্গী হও।
আর এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, সদেক্বীন হলেন উনারাই, যাঁরা ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে পূর্ণতাপ্রাপ্ত, যাঁদের অন্তর সর্বদা মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরে মশগুল ও যাঁদের আমলগুলো সম্পূর্ণ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ সম্মত। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হক্কানী পীর সাহেবগণই একমাত্র ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে পূর্ণতাপ্রাপ্ত এবং উনাদের অন্তরই সর্বদা মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরে মশগুল।
উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ পাক পীর-মুরীদী সম্পর্কে পবিত্র কালামে পাক উনামধ্যে পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ উনার ১৭নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে আরো বলেন,
من يهد الله فهوا المهتد ومن يضلل فلن تجد له وليا مرشدا.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক যাকে হিদায়েত দান করেন, সেই হিদায়েত প্রাপ্ত হয়। আর যাকে গোমরাহ করেন (যে ব্যক্তি গোমরাহীতে দৃঢ় থাকে), তার জন্য আপনি কোন ওলীয়ে মুর্শিদ (কামেল পীর) পাবেন না।
পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা বুঝা গেল যে, যারা পীর বা ওলীয়ে মুর্শিদ এড়িয়ে চলে, তারা গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে পীর-মুরীদী প্রসঙ্গে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
الشيخ لقومه كالنبى فى امته.
অর্থ : শায়খ (পীর সাহেব) উনার ক্বওমের মধ্যে তদ্রুপ, যেরূপ নবী উনার উম্মতের মধ্যে।” (দায়লামী শরীফ)
অর্থাৎ নবী আলাইহিস সালাম উনার দ্বারা যেরূপ উম্মতের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সবক্ষেত্রে ইছলাহ লাভ হয়, সেরূপ শায়খ বা পীর সাহেব উনার দ্বারাও সকলের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সবক্ষেত্রে ইছলাহ লাভ হয়।
অতএব, উম্মত যেরূপ নবী আলাইহিস সালাম উনাকে এড়িয়ে চললে হিদায়েত লাভ করা সম্ভব নয়। তদ্রুপ শায়খ বা পীর সাহেব উনাকে এড়িয়ে চললেও কোন ব্যক্তির পক্ষে ইছলাহ লাভ করা সম্ভব নয়। বরং শয়তানী প্রবঞ্চনায় পড়ে গোমরাহীতে নিপতিত হওয়াই তার জন্য স্বাভাবিক।
আর তাই সুলতানুল আরেফীন, হযরত বায়েজীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি, সাইয়্যিদুত ত্বাইফা, হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ আরো অনেকেই বলেন যে,
من ليس له شيخ فشيخه شيطان.
অর্থ : যার কোন পীর নেই, তার পীর বা ওস্তাদ হলো শয়তান।” (ক্বওলুল জামীল, নূরুন আলা নূর, তাসাউফ তত্ত্ব)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন কামেল পীরের নিকট বাইয়াত না হবে, তাকে শয়তান ওয়াস ওয়াসা দিয়ে বিভ্রান্ত করে দিবে।
এ কারণে শ্রেষ্ঠতম মাযহা, হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা, ইমামুল আইম্মা, ইমামুল আযম, হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
لولا سنتان لهلك ابو نعمان.
অর্থ : আমার জীবনে যদি দুটি বৎসর না হতো, তবে আবূ নোমান (আবু হানীফা) ধ্বংস হয়ে যেত।
অর্থাৎ আমি ইমামে আযম, যদি দুবৎসর আমার দ্বিতীয় পীর সাহেব, ইমাম জাফর ছাদিক্ব আলাইহিস সালাম উনার ছোহবত লাভ না করতাম, তবে (শয়তানী প্রবঞ্চনায়) ধ্বংস বা বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম।
এ আলোচনা দ্বারা এ কথাই প্রমাণিত হলো যে, যারা পীর-মুরীদীকে এড়িয়ে চলে বা পীরের নিকট বাইয়াত হওয়াকে মোটেও গুরুত্ব দেয়না, তারা মুলত পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদেরকেই এড়াইয়া চলে বা গুরুত্ব দেয়না।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদেরকে এড়িয়ে চলা বা গুরুত্ব না দেয়া স্পষ্টতঃ গোমরাহী। তাছাড়া শয়তান তাদের পথ প্রদর্শক হওয়ার কারণে তারা চরম বিভ্রান্ত।
দ্বিতীয়তঃ বলতে হয় যে, পীর-মুরীদীকে এড়িয়ে চলা বা ইলমে তাসাউফ থেকে দূরে থাকার অর্থ হলো মুমিনে ফাসেক থেকে যাওয়া।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইলমে তাসাউফ অর্জন করবেনা বা পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হবেনা, সে কস্মিনকালেও মুমিনে কামেল হতে পারবেনা বরং মুমিনে ফাসেকই থেকে যাবে।
যেমন এ প্রসঙ্গে মালেকী মাযহাবের ইমাম, ইমামুল আইম্মা, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন,
من تفقه ولم يتصوف فقد تفسق ومن تصوف ولم يتفقه فقد تزندق- ومن جمع بينهما فقد تحقق.
অর্থ : যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বাহ অর্জন করলো, কিন্তু ইলমে তাসাউফ অর্জন করলোনা, সে ব্যক্তি ফাসেক। আর যে ব্যক্তি ইলমে তাসাউফ বা মারিফাতের দাবি করে কিন্তু ইলমে ফিক্বাহ বা শরীয়ত স্বীকার করেনা সে যিন্দিক। আর যে উভয়টা অর্জন করলো, সে মুহাক্কিক। অর্থাৎ মুমিনে কামেল।” (মিরকাত শরীফ)
মূলত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার উপরোক্ত বক্তব্য দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, ইলমে তাসাউফহীন ব্যক্তি ফাসেকের অন্তর্ভূক্ত। তাই যারা পীর-মুরীদী বা ইলমে তাসাউফকে এড়িয়ে চলে, তারাও নিঃসন্দেহে ফাসেকের অন্তর্ভূক্ত।
অথচ মহান আল্লাহ পাক কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ياايها الذين امنوا امنوا.
অর্থ : হে ইমানদার বান্দাগণ, তোমরা ঈমান আন। অর্থাৎ হে মুমিনে ফাসেকরা তোমরা মুমিনে কামেল হয়ে যাও।” (পবিত্র সূরা নিসা ১৩৬)
উল্লেখ্যপ্রচলিত  তাবলীগ  জামায়াতের  লোকদের  পক্ষে যৎসামান্য ইলমে ফিক্বাহ্ শিক্ষা দিয়ে এবং পীর-মুরীদী বা ইলমে তাসাউফকে পরিহার করে আজীবন কোশেশের দ্বারাও মুমিনে কামেল হওয়া সম্ভব নয়। কারণ মুমিনে ফাসেক থেকে মুমিনে কামেল হওয়ার একটিই পথ, তাহলো ইলমে তাসাউফ অর্জন করা। যা পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়া ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব নয়।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, পীর-মুরীদীকে এড়িয়ে চলা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের ফাসেক হওয়ার পথকেই সুগম করবে নিঃসন্দেহে।
তৃতীয়তঃ বলতে হয় যে, পীর-মুরীদীকে এড়িয়ে চলা বা পরিহার করার মানেই হলো, ইমাম-মুজতাহিদ ও আউলিয়ায়ে কিরামগণ উনা, পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে ইজতিহাদকৃত রায়কে এড়িয়ে চলা বা পরিহার করা।
কারণ অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ, তথা আলিয়ায়ে কিরামগণ পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা, ক্বিয়াস উনার দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করতঃ রায় দেন যে, ইলমে তাসাউফ হাছিলের মাধ্যমে অন্তঃকরণ পরিশুদ্ধ করার জন্য একজন কামেল পীরের নিকট বাইয়াত হওয়া ফরয। (ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত, ফতহুর রাব্বানী, মাকতুবাত শরীফ, আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যাদ)
তাই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের পীর-মুরীদীর পথকে এড়িয়ে চলা বা পরিহার করার অর্থই হচ্ছে অনুসরণীয়, ইমাম-মুজতাহিদ বা আলিয়ায়ে কিরামগণ উনাদের রায়কে এড়িয়ে চলা বা পরিহার করা, তাদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করা থেকে বিরত থাকা এবং তাদের প্রবর্তিত মত-পথের বিরোধীতা করা। যা প্রকৃত পক্ষে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদেরই বিরোধীতার শামিল।
আর মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
اطيعوا الله ولطيعوا الرسول واولى الامرمنكم.
অর্থ : তোমরা মহান আল্লাহ পাক এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অনুসরণ কর এবং তোমাদের মধ্যে যাঁরা উলিল আমরঅর্থাৎ পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ মোতাবেক নির্দেশ প্রদানকারী, তাদেরকেও অনুসরণ কর।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৮)
পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা বুঝা গেল যে, মহান আল্লাহ পাক ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ন্যায় উলিল আমরবা অনুসরণীয় ইমাম-মুজতাহিদ বা আলিয়ায়ে কিরামগণ উনাদেরকে অনুসরণ-অনুরকণ করা অবশ্য কর্তব্য।
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে অন্যত্র আরো ইরশাদ মুবারক ফরমান,
ومن يشاقق الرسول من يعد ما تبين له الهدى وبتبع غير سبيل المؤمنين نوله ماتولى ونصليهم جهنم.
অর্থ : হিদায়েত প্রকাশিত হওয়ার পর, যে ব্যক্তি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার বিরোধীতা করবে এবং মুমিনদের পথ রেখে ভিন্ন পথের অনুসরণ করে, আমি তাদের সেদিকেই ফিরাবো, যেদিকে তারা ফিরেছে এবং তাদেরকে জাহান্নামে পৌঁছাবো।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ, পবিত্র আয়াত ১১৫)
পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম-মুজতাহিদ বা আলিয়য়ে কিরামগণ উনাদের পথ রেখে ভিন্ন পথের অনুসরণ করা ও উনাদের পথকে এড়িয়ে চলা বা পরিহার করা জাহান্নামী হওয়ার কারণ। কাজেই প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা যে, পীর-মুরীদীকে এড়িয়ে চলে বা পরিহার করে, তা অনুসণীয় ইমাম-মুজতাহিদ বা আউলিয়ায়ে কিরামগণ উনাদের মত-পথের খেলাফ হওয়ার কারণেও স্পষ্ট গোমরাহী ও জাহান্নামী হওয়ার কারণ।
চতুর্থতঃ বলতে হয়- তারা যে লিখেছে, “পীর-মুরীদীর দ্বারা গন্ডিবদ্ধ দলের সৃষ্টি হয় যা দ্বারা ব্যাপকভাবে দ্বীনের কাজ করা সম্ভব নয়।
প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্যটিও সম্পূর্ণ অবান্তর, জেহালতপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। সাথে সাথে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাহাবায়ে কিরাম ও পীর-মাশায়েখগণের প্রতি অপবাদ স্বরূপ।
কারণ পীর-মুরীদী বা তাসাউফ নতুন উদ্ভূত কোন বিষয় বা আমল নয়। বরং তা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আমল দ্বারাই অকাট্যভাবে প্রমাণিত। যেমন তিনি হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ উনাদেরকে বাইয়াত করায়েছেন এবং ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফের তালীম দিয়েছেন। তদ্রুপ পীর-মাশায়েখগণ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সেই ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে অর্থাৎ হাক্বীক্বী নায়েবে রাসূল হওয়ার কারণে ও নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত অনুকরণে বাইয়াত করান এবং ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফের তালীম দেন। শুধু তাই নয়, সাইয়্যিদুল মুরাসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণও নববী সুন্নতের ধারায় বাইয়াত করেছেন। যেমন হযরত আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম উনার নিকট সকল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ বাইয়াত গ্রহণ করেন। অনুরূপ তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন অর্থাৎ খায়রুল কুরুনের সকলেই বাইয়াত হওয়ার সে নববী তরীক্বাহ অব্যাহত রাখেন। বর্তমান পীর-মাশায়েখগণও সে নববী তরীক্বার পূর্ণ অনুসারী।
অতএব, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের এ বক্তব্য- পীর-মুরীদীর দ্বারা একটি গন্ডিবদ্ধ দলের সৃষ্টি হয়সরাসরি, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ছাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীনগণের প্রতি অপবাদ স্বরূপ।
কেননা তাদের বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, উল্লিখিত সকলেই বাইয়াত করার কারণে বা ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফের তালীম, দেয়ার কারণে একটি গন্ডিবদ্ধ দলের সৃষ্টি করেছেন। (নাউযুবিল্লাহ মিন যালিক)
মূলত এটি সম্পূর্ণই কুফরীমূলক বা ঈমান হানীকর বক্তব্য বা আক্বীদা।
অতঃপর প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বত্তব্য হলো, পীর-মুরীদীর দ্বারা ব্যাপক কাজ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ পীর-মাশায়েখগণের দ্বারা ব্যাপকভাবে দ্বীনের খেদমত করা সম্ভব নয়।
তাদের এ বক্তব্যটিও পীর-মাশায়েখগণের প্রতি মিথ্যা অপবাদের শামিল হওয়ার সাথে সাথে ইতিহাসকে অস্বীকার করার শামিল।
কারণ দ্বীনের খেদমত বা দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে পীর-মাশায়েখগণের অবর্ণণীয় অবদানের ইতিহাস কারো পক্ষে কস্মিনকালেও অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
আর ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীতে পীর-মাশায়েখগণের উছীলাতেই দ্বীন টিকে রয়েছিল এবং সব সময় টিকে থাকবে। কারণ যখনই মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে, হিদায়েত থেকে দূরে সরে গেছে এবং বিদ্য়াত-বেশরা ও লামায়ে সূবা দুনিয়ালোভী আলেমদের কারণে যখন দ্বীনের ভিতর নানান বিদয়াত-বেশরা ও কুফরী মতবাদ প্রবেশ করেছে, তখনই আবির্ভাব ঘটেছে, মহান মুজাদ্দিদ, পীর-মাশায়েখগণের। যাঁরা অক্লান্ত কোশেশ অবর্ণনীয় রিয়াজত-মুশাক্কাত বা ব্যাপক তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীণের মাধ্যমে মানুষদেরকে করেছেন হিদায়েত, দেখিয়েছেন হক্ব মত-পথ এবং দ্বীনকে করেছেন সম্পূর্ণ বিদয়াত-বেশরা ও কুফরীমুক্ত।
যেমন এ প্রসঙ্গে অসংখ্য অগণিত পীর-মাশায়েখগণের মধ্যে কয়েকজনের অবদানের ইতিহাস আলোচনার অপেক্ষা রাখে।
প্রথমেই বলতে হয় মায্হাবের ইমামগণের কথা।
যাঁরা ইলমে ফিক্বাহ্রে ভিত্তি স্থাপনকারী, অর্থাৎ যাঁদের অক্লান্ত কোশেশের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি ইলমে ফিক্বাহ্ ভিত্তিক চারটি মায্হাব। যার ফলে সকলেই অতি সহজেই পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদেরকে পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে পারছি। অথচ তাঁদের প্রত্যেকেই পীর-মুরীদী করেছেন। যেমন ইমামে আযম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পীর সাহেব ছিলেন, হযরত ইমাম বাকের রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক আলাইহিস সালাম। হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পীর সাহেব ছিলেন, হযরত ইমাম নাফেরহমতুল্লাহি আলাইহি। হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পীর সাহেব ছিলেন, হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি। হযরত ইমাম আহ্মদ ইবনে হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পীর সাহেব ছিলেন, হযরত আবু হামযাহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি।
অনুরূপ ছাহেবাইন  অর্থাৎ হযরত ইমাম আবু ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি, আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীছ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক রহমতুল্লাহি আলাইহি এবং বিখ্যাত সূফী, হযরত ইমাম দাউদ ত্বাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহিগণের সকলেই ইমামে আযম, হযরত আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ ও খলীফার অন্তর্ভূক্ত।
অতঃপর বলতে হয় তরীক্বার ইমামগণের কথা।
যাঁদের উসীলায় ইলমে তাসাউফের ভিত মজবুত হয়েছে। যা প্রচারিত ও প্রসারিত হয়ে ব্যাপকভাবে আম জনগণের নিকট পৌঁছেছে। যেমন পবিত্র কুরআন শরীফ নাযিল হয়েছে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর। অথচ তা জমা করেন আফজালুন নাস, হযরত আবু বকর ছিদ্দীক আলাইহিস সালাম। অতঃপর কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করে হযরত সমান জিন নূরাইন আলাইহিস সালাম আম জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়ার কারণে তিনি জামিউল কুরআনহিসেবে মশহুর হন। তদ্রুপ প্রতিটি তরী`ক্বাই নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার থেকে শুরু হয়ে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদের মাধ্যমে তরীক্বার ইমাম-মুজতাহিদগণ উনাদের নিকট পৌঁছে। অতঃপর তরীক্বার ইমাম-মুজতাহিদগণ তরীক্বার সবকগুলোকে সুবিন্যাস্তভাবে কিতাব বা অযীফা আকারে লিপিবদ্ধ করেন।
তাসাউফের বিষয় সমূহকে সর্বপ্রথম সুবিন্যস্তভাবে কিতাব আকারে লিপিবদ্ধ করেন, ইমাম আবুল কাসেম কুশাইরী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিখ্যাত রেসালা, “রেসালায়ে কুশাইরিয়াতে।অতঃপর গাউসুল আযম, বড় পীর আব্দুল ক্বাদির জ্বিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, হযরত শায়খ আহমদ রেফাঈ রহমতুল্লাহি আলাইহি, সুলতানুল হিন্দ, খাজা মুঈনুদ্দীন চীশতী রহমতুল্লাহি আলাইহি, খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দ বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও আফজালুল আলিয়া, শায়খ আহমদ ফারুকী মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহিসহ প্রত্যেক তরীক্বার ইমামগণই নিজ নিজ তরীক্বার সবকগুলোকে আরো সুবিন্যাস্ত ও সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করে কিতাব বা অযীফা আকারে সাধারণ জনগণের নিকট ব্যাপকভাবে পৌঁছে দিয়ে তরীক্বার ইমাম হিসেবে মশহুর হন।
অতএব, যাঁদের দ্বারা ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফের ভিত স্থাপিত বা মজবুত হয়েছে, উনারা প্রত্যেকেই পীর সাহেব উনার নিকট বাইয়াত হয়েছেন এবং খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে মুরীদ করায়েছেন। উনাদের মাধ্যমেও দ্বীনের ব্যাপক ও অবর্ণনীয় খেদমত হয়েছে, যা কারোই অজানা নয়।
যেমন হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে চিনেনা বা উনার নাম জানেনা এমন মুসলমান খুব কম হবে। এ মহান মুজাদ্দিদও ছিলেন, একজন জগৎ বিখ্যাত ওলী আল্লাহ বা পীর। কিতাবে লেখা হয়, সে যামানায় যদি এ মহান মুজাদ্দিদের আবির্ভাব না হতো, তবে দ্বীন ইসলাম গ্রীক দর্শনের দিকে ধাবিত হতো।
হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালী রহমতুল্লাহি আলাইহি শরীয়তের অকাট্য দলীলের মাধ্যমে এবং অক্লান্ত পরিশ্রম বা কলমী ও যবানী তাবলীগ, তালীম- তালক্বীনের ফলশ্রুতিতে ইসলাম পুণরায় ইসলামের দিকে ফিরে আসে। মানুষ বিদ্য়াত-বেশরা ও কুফরী থেকে মুক্ত হয়ে লাভ করে সত্যিকারের হিদায়েত। যার ফলে মানুষ আজো উনাকে স্মরণ করে হুজ্জাতুল ইসলামবা ইসলামের অকাট্য দলীল হিসেবে।
অনুরূপ গাউসুল আযম, বড় পীর আব্দুল ক্বাদির জ্বিলানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর সুমহান তাজ্দীদের উসীলায় মৃতপ্রায় দ্বীন যিন্দা হয়। যার ফলশ্রুতিতে তিনি মুহিউদ্দীন”  বা দ্বীন যিনন্দাকারী লক্ববে ভুষিত হন।         
তদ্রুপ সুলতানুল হিন্দ, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর দাওয়াত ও তাবলীগের উসীলায় হিন্দুস্থানের প্রায় এক কোটিরও বেশী বিধর্মী ঈমান লাভ করে এবং হিন্দুস্থানে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি আজো মুঈনুদ্দীনবা দ্বীনের সাহায্যকারী নামে মশহুর হয়ে আছেন।
আফজালুল আলিয়া, শায়খ আহমদ ফারুক্বী সেরহিন্দী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, যিনি বাদশাহ আকবরের দ্বীনে লাহীর ন্যায় কুফরী মতবাদকে সমূলে উৎপাটন করে সঠিক দ্বীন মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানীহিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
অনুরূপ আরো অসংখ্য, অগণিত মহান মুজাদ্দিদগণ, উনাদের নিজ-নিজ যামানায় মহান মুজাদ্দিদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং উনাদের প্রত্যেকেই পীর-মুরীদী করেছেন। উনাদের দ্বারা পৃথিবীতে দ্বীনের যে খেদমত হয়েছে, তা ভাষায় বর্ণনা করে শেষ করার মত নয়।
এখন প্রশ্ন জাগে উনারা পীর-মুরীদী করার পরও যদি উনাদের দ্বারা দ্বীনের এত ব্যাপক খেদমত হতে পারে! তবে বর্তমানেও পীর-মুরীদীর মাধ্যমে ব্যাপক কাজ করা কেন সম্ভব হবেনা? তাহলে কি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা মনে করে যে, উল্লিখিত মহান মুজাদ্দিদগণের দ্বারা দ্বীনের ব্যাপক খেদমত হয়নি। যদি তারা তা মনে করে থাকে, তবে তা স্পষ্ট ভ্রান্তি ও ঘৃণ্য মিথ্যাচারিতা। আর যদি তারা স্বীকার করে থাকে যে, উনাদের দ্বারা ব্যাপক দ্বীনের খেদমত হয়েছে, তবে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের কথিত বক্তব্য- পীর-মুরীদীর দ্বারা ব্যাপক কাজ সম্ভব নয়তা সম্পূর্ণই বিভ্রান্তিকর প্রমাণিত হয়।
      বস্তুতঃ উল্লিখিত ওলীআল্লাহ বা পীর সাহেবগণ উনাদের মাধ্যমে দ্বীনের যে খেদমত হয়েছে, তা প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের দ্বারা কল্পনাও করা যায়না বরং সত্য কথা বলতে গেলে এ কথাই বলতে হয় যে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের মাধ্যমে দ্বীনের হাক্বীক্বী খেদমত তো হচ্ছেইনা উপরন্ত শরীয়ত বিরোধী আক্বীদা ও আমলের কারণে মানুষ ঈমান আমল শুন্য হয়ে গোমরাহীতে নিপতিত হচ্ছে। আর তারাই মূলত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদা ও আমল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি গন্ডিবদ্ধ দলের সৃষ্টি করেছে।
মূলত পীর-মুরীদী এড়িয়ে বা পরিহার করে দ্বীনের ব্যাপক খেদমত করার আশা করা, দুরাশা বৈ কিছুই নয়।
সুতরাং এতক্ষণের বিস্তারিত, দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা এটিই সাব্যস্ত হলো যে, পীর-মুরীদী সম্পর্কে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য মারাত্মক আপত্তিকর, মনগড়া, বিভ্রান্তিমূলক ও পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ্ বিরোধী হওয়ার কারণে কুফরীর অন্তর্ভূক্ত। সাথে সাথে লোকদেরকে দ্বীন ইসলামের অর্ধেক ইলম, ইলমে তাসাউফের প্রতি নিরুৎসাহিত করার শামিল। এ ধরণের আপত্তিকর ও শরীয়ত বিরোধী আক্বীদা পোষণ ও বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকা, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই ফরয-ওয়াজিব।  
(অসমাপ্ত)

0 Comments: