প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ ( ৯ নং )


প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া

গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ

[সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন উনার এবং অসংখ্য দুরূদ ও সালাম মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি। মহান আল্লাহ পাক উনার অশেষ রহমতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদীয়া জামিয়া শরীফ” উনার ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, বাতিলের আতঙ্ক ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র মাসিক আল বাইয়্যিনাতপত্রিকায় যথাক্রমে টুপির ফতওয়া, অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ জিয়ারত করা, ছবি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামা ফরজে আইন ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া, মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামা পড়া মাকরূহ তাহরীমী সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামা জামায়াতে পড়া মাকরূহ তাহরীমী ও বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফর নামাজের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, নজেকশন নেওয়া রোজা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ উনার নামাজে বা অন্যান্য সময় পবিত্র কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ নামা বিশ রাকায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহকাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করার পর চতুর্দশ (১৪তম) ফতওয়া হিসেবে (৩৫তম সংখ্যা থেকে) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া প্রকাশ করে আসতে পারায় মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে অসংখ্য শুকরিয়া।]
[বিঃদ্রঃ পাঠকগণের সুবিধার্থে ফতওয়ার ভুমিকার কিছু অংশ পুণরায় প্রকাশ করা হলো]

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
كنتم خير امة اخرجت اللناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله.
অর্থ : তোমরা (নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণে) শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।” (পবিত্র সূরা আল ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১১০)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তাবলীগ তথা সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের সাথে সাথে আরো একটি শর্ত যুক্ত করে দিয়েছেন। সেটা হলো- تؤمنون অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে সঠিক ও পরিশুদ্ধ ঈমান আনা। অর্থাৎ তৎসম্পর্কে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণ করা। তবেই সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মাধ্যমে পরিপূর্ণ ফায়দা বা মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি লাভ করা সম্ভব হবে।
স্মরণযোগ্য যে, বর্তমান প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের লোকদের বেশকিছু লেখনী, বক্তব্য, বিবৃতি, আমল ও আক্বীদা ইত্যাদি সম্পর্কে সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের মনে নানাবিধ সংশয় ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারপাঠক, গ্রাহক, শুভাকাঙ্খী ও শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ হতে মাসিক আল বাইয়্যিনাতেরআকর্ষণীয় ও নির্ভরযোগ্য বিভাগ সুওয়াল-জাওয়াববিভাগে, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচারিত বেশকিছু আপত্তিজনক আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ উল্লেখ করে অসংখ্য চিঠি আসে। কারণ মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : যদি তোমরা না জান, তবে আহলে যিকির বা হক্কানী আলেমগণের নিকট জিজ্ঞাসা করো।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩ ও পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)
      অর্থাৎ তোমরা যারা জাননা বা দ্বীনের ব্যাপারে জ্ঞান রাখনা, তারা যাঁরা জানেন, উনাদের নিকট জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও।
অতএব, যাঁরা জানেন, তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব হলো- প্রশ্নকারীর প্রশ্নের শরীয়তসম্মত জাওয়াব প্রদান করা। কারণ যারা জানা থাকা সত্ত্বেও প্রশ্নকারীর প্রশ্নের জবাব প্রদান হতে বিরত থাকবে, তাদের জন্যে কঠিন শাস্তির কথা পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে। যেমন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে দ্বীন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা হয়,  জানা থাকা সত্ত্বেও যদি সে তা গোপন করে অর্থাৎ জবাব না দেয়, তবে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযা, হম শরীফ, মিশকাত শরীফ, বযলুল মাজহুদ, উরফুশশাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বলা হয়েছে, “তার জ্বিহ্বা আগুনের কেঁচি দ্বারা কেটে দেয়া হবে।
কাজেই উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে, যে ভয়াবহ শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তার থেকে বাঁচার জন্যে অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করার লক্ষ্যে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকারঅগণিত পাঠক, গ্রাহক ও সত্যান্বেষী সমঝদার মুসলমানগণের প্রেরিত সুওয়ালসমূহে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব বা ফতওয়া দেয়া হলো।

প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়

এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় এই যে, মূলতঃ আমাদের সাথে কারো যেরূপ বন্ধুত্ব নেই, তদ্রুপ নেই বিদ্বেষ। অর্থাৎ যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তসম্মত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বিদ্বেষ নেই। আর যাদের আক্বীদা ও আমল শরীয়তের খেলাফ বা বিপরীত, তাদের সাথে আমাদের কোন প্রকার বন্ধুত্ব নেই। কারণ বন্ধুত্ব বা বিদ্বেষ একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার জন্যেই হতে হবে।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,
من احب لله وابغض لله واعطى لله ومنع لله فقد استكمل الايمان.
অর্থ : যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার (সন্তুষ্টি লাভের) জন্যে মুহব্বত বা বন্ধুত্ব করে, বিদ্বেষ পোষণ করে, আদেশ করে, নিষেধ করে, তার ঈমান পরিপূর্ণ।” (আবূ দাউদ শরীফ, তিরমিযী, বজলুল মাজহুদ, উরফুশশাজী, তোহফাতুল আহওয়াজী, মায়ারেফুস সুনান, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, শরহুত ত্বীবী, তালীক, মোজাহেরে হক্ব, লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
বস্তুতঃ মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার প্রতিটি লেখা, বক্তব্য, সুওয়াল-জাওয়াব, ফতওয়া, প্রতিবাদ, প্রতিবেদন, মতামত ইত্যাদি সবই উপরোক্ত হাদীছ শরীফের মূলনীতির ভিত্তিতেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।
কাজেই মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকায়প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতসম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হলো- প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কেউল্লেখকৃত আক্বীদাসমূহের সঠিক, বিশুদ্ধ ও শরীয়তসম্মত ফায়সালা প্রদান এবং প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াতের দাওয়াতের কাজে যারা মশগুল রয়েছে, তাদের মধ্যে যারা উক্ত আক্বীদাসমূহ জেনে হোক বা না জেনেই হোক বিশ্বাস করে এবং তা জনসাধারণের নিকট প্রচার করে, নিজেদের ও জনসাধারণের ঈমান ও আমলের বিরাট ক্ষতি করছে, তাদের সে ঈমান ও আমলের হিফাযত করা ও সত্যান্বেষী বা হক্ব তালাশী সমঝদার মুসলমানগণের নিকট সত্য বা হক্ব বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা। যার মাধ্যমে প্রত্যেকেই তাদের ইহ্লৌকিক ও পারলৌকিক এত্মিনান ও নাযাত লাভ করতে পারে।
মূলত মানুষ মাত্রই ভুল হওয়া স্বাভাবিক, তাই এক মুমিন অপর মুমিনের ভুল ধরিয়ে দেয়া ঈমানী আলামত। কারণ পবত্রি হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে,      
المؤمن مرأة المؤمن.
অর্থ : এক মুমিন অপর মুমিনের জন্যে আয়না স্বরূপ।” (আবূ দাউদ শরীফ, বযলুল মাজহুদ)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে যে, আমীরুল মুমিনীন, হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম স্বীয় খিলাফতকালে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার রীতিনীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সমবেত আনছার এবং মুহাজির হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ উনাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি আমি দ্বীনের হুকুম-আহকামকে সহজতর করার উদ্দেশ্যে শরীয়ত বিরোধী কোন আদেশ দান করি, তবে তোমরা কি করবে?” উপস্থিত লোকেরা নীরব রইল। হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার একই কথার পূণরাবৃত্তি করলেন। তখন হযরত বশীর ইবনে সাঈদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, “যদি আপনি এরূপ করেন, তবে আমরা আপনাকে এরূপ সোজা করবো, যেরূপ তীরকে সোজা করা হয়।এ কথা শুনে হযরত মর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম বললেন, “তোমরাই আমার প্রকৃত বন্ধু, দ্বীনের কাজে সাহায্যকারী।” (আওয়ারেফুল মাআরেফ)
সুতরাং উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আলোকে অসংখ্য, অগণিত পাঠকগণের পূণঃ পূণঃ অনুরোধের প্রেক্ষিতে মুসলমানদের আক্বীদা ও আমল হিফাযতের লক্ষে বর্তমানে প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহের শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো। যাতে করে সত্যান্বেষী, সমঝদার মুসলমান ও প্রচলিত তাবলীগকারীগণ সে আপত্তিকর বক্তব্যসমূহের সঠিক শরয়ী ফায়সালা অবগত হন, যার ফলশ্রুতিতে সকলেই উক্ত আপত্তিকর আক্বীদা ও বক্তব্যসমূহ থেকে নিজেদের ঈমান ও আমলের হিফাযত করে সঠিকভাবে দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও খেদমত করে মহান আল্লাহ পাক ও উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খাছ সন্তুষ্টি হাছিল করতে পারেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বীনের তাবলীগ যা খাছ ও আম তা শত-সহস্র লোক করবে এবং অবশ্যই করতে হবে। তবে শর্ত হচ্ছে আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করতে হবে। কারণ আক্বীদা শুদ্ধ না হলে দ্বীনী কোন খিদমতই মহান আল্লাহ পাক উনার দরবারে কবুলযোগ্য নয়। উপরন্ত কুফরী আক্বীদা থাকার কারণে তাকে হতে হবে চির জাহান্নামী।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে দ্বীনী তাবলীগ (যা আম ও খাছ) করার তাওফীক দান করুন। (আমীন)

সুওয়াল : আমরা শরীয়তের দৃষ্টিতে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত সম্পর্কে সঠিক তত্ত্ব জানতে আগ্রহী। কারণ আমরা অনেকদিন যাবত তাবলীগ জামায়াতের সাথে জড়িত ছিলাম এবং এখনো তাবলীগ জামায়াতের অনেক লোকের সাথে আমাদের মেলামেশা আছে। তাতে তাদের বেশ কিছু বক্তব্য বা আক্বীদা, যা আমরা অতীতেও জেনেছি এবং এখনো তা অবহিত হচ্ছি। তার মধ্যে অনেকগুলো তাদের লেখা কিতাবেও উল্লেখ আছে। সে সমস্ত আক্বীদাসমূহ আমাদের মনে হয় ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। সেগুলো আমরা নিম্নে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করলাম –
(৫৪) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই ধারণা করে থাকে যে, দ্বীন ইসলামের বাইরেও বিধর্মীদের মাঝে, এমন অনেক শিক্ষণীয়, নছীহতপূর্ণ ও অনুসরণীয় বিষয় রয়েছে, যদ্বারা ইছলাহ্ বা পরিশুদ্ধতা লাভ করা যায়।। এ কথার প্রমাণ তাদের লেখা কিতাবেও রয়েছে। যেমন- তাবলীগ-ই-উত্তম জিহাদনামক কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “হিন্দু যোগীরা ইবাদতে আলস্য দূর করার জন্যে সারা রাত একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে, এসব দৃষ্টান্ত থেকে অন্তরের চিকিৎসার পদ্ধতি জানা জায়।অর্থাৎ হিন্দু যোগীদের মধ্যেও শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় অনেক কিছু রয়েছে। আর মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের মলফুযাতের৯৫ পৃষ্ঠায় ১৩৬নং মলফূযে একথা লেখা আছে যে, আমাদের এই কাজ (প্রচলিত তাবলীগ) এক প্রকার যাদুমন্ত্রের মত।
(৫৫) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বেশ কিছু মুরুব্বী ও আমীর এবং তাদের অনুসারীরা মনে করে থাকে যে, তাদের প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য বা তাবলীগ জামায়াতের প্রতি উৎসাহিত করার জন্য পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র হাদীছ শরীফ বহির্ভূত বিষয়ে এবং পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত পরিমাণের বাইরে বহু বহু ফযীলতের বর্ণনা করা জায়েয।
(৫৬) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা বলে থাকে যে, “মসজিদে নববী ছাড়া বিশ্বের যে তিনটি দেশে, তিনটি মসজিদে প্রচলিত তাবলীগের বিশেষ মারকায, সেখানেই চব্বিশ ঘন্টা আমল জারী থাকে। যেমন- প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোক দ্বারা লিখিত এক মুবাল্লিগের পয়লা নোট বইনামক কিতাবের (সংকলক- এঞ্জিনীয়ার মু.জু.আ. মজুমদার) ৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, “সারা বিশ্বে মাত্র ৪টি মসজিদে ২৪ঘন্টা আমল চালু থাকে। যথা- (১) কাকরাইল, ঢাকা (২) নিজামুদ্দীন বস্তী, দিল্লী (৩) রায়বন্ড, লাহোর। (৪) মসজিদে নববী, মদীনা শরীফ।
(৫৭) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত-এর লোকেরা বলে থাকে যে, তারা পবিত্র কুরআন শরীফ উনাপবিত্র সূরা ইমরান শরীফ উনার  ১০৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ
ولتكن منكم امة يدعون الى الخير- يامرون بالمعروف وينهون عن المنكر واولتك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে ও বদ্ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই মূলতঃ কামিয়াব।এর আমল করে থাকে যা তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক কাজের দ্বারাই সাধিত হয়।
(৫৮) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অনেকেই মনে করে থাকে যে, তাদের ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগের দাওয়াত মোতাবেক যাদের জীবন পরিবর্তিত হবে, শুধুমাত্র তাদের দ্বারাই আল্লাহ পাক হিদায়েত বা দ্বীনের কাজ নিবেন। যেমন- হযরতজীর কয়েকটি স্বরণীয় বয়াননামক কিতাবের (সংকলক- মাওলানা নোমান আহ্মদ) ২য় খন্ড ২০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যাদের জীবন দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন অর্জিত হবে, তাদের দ্বারা আল্লাহ পাক হিদায়েত ছড়াবেন, .....। যাদের জীবনে দাওয়াত মোতাবেক পরিবর্তন আসবেনা, তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের প্রকৃত কাজ নিবেন না।
(৫৯) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, তাদের ৬ উছুল ভিত্তিক দোয়া ও তাসবীহ পড়াই সুন্নত। যা করলেই যিকির-এর হক্ব আদায় হয়ে যায়। এবং তার দ্বারাই অনেক অনেক ফযীলত, রহমত ও বরকত পাওয়া যায়। আর এর দ্বারাই দিল ইসলাহ্ হয়। অর্থাৎ তাসাউফ ভিত্তিক ক্বলবী যিকিরের আর দরকার হয়না। অপরদিকে তাদের কথানুযায়ী তাসাউফী বা ক্বলবী যিকির হল নফল এবং যার ফযীলত নগণ্য। আর এসব কথা নাকি তাদের হযরতজীর মলফুজাতএবং মাওলানা ইসমাইল হোসেন দেওবন্দীর তাবলীগ গোটা উম্মতের গুরু দায়িত্বনামক কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
(৬০) প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা প্রচার করে থাকে যে, মুর্শিদদের দ্বারা দ্বীনের ব্যাপক খেদমত কখনোই সম্ভব নয়। তাই তারা পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হওয়া বা ইলমে তাছাউফ চর্চা করাকে মোটেও গুরুত্ব দেয় না। একথার সত্যতা তাদেরই লোক দ্বারা লিখিত আয়নায়ে তাবলীগনামক কিতাবের (লেখক- মুহম্মদ দাউদ আলী) ৮৮ পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয়। ইক্ত কিতাবে লিখা হয়েছে- তাবলীগের মধ্যে পীর-মুরীদীর প্রচলন সম্ভব নহে, কেননা পীরী-মুরীদীর দ্বারা সাধারণতঃ গন্ডিবদ্ধ একটা দলের সৃষ্টি হইয়া থাকে। ..... এইরূপ একটা দলের দ্বারা ব্যাপক কোন কাজ করা সম্ভব নহে। .... তাই বাধ্য হইয়া তাবলীগ এই পথ এড়াইয়া চলিয়া থাকে।
উপরোক্ত সুওয়ালসমূহের আলোকে এখন আমরা জানতে চাই, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের উপরোক্ত বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহ শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু ঠিক? এবং তা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটুকু প্রয়োজনীয় ও কোন স্তরের আমলের অন্তর্ভূক্ত? পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের দৃষ্টিতে জাওয়াব দিয়ে ঈমান ও আমল হিফাযত করণে সাহায্য করবেন।
জাওয়াব : (আপনাদের তরফ থেকে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সুওয়াল-জাওয়াব বিভাগে প্রচলিত ৬ (ছয়) উছূল ভিত্তিক তাবলীগ জামায়াত প্রসঙ্গে বিভিন্ন সুওয়ালসহ প্রায় শতাধিক (শত শত) চিঠি এসে পৌঁছেছে। তার মধ্যে যেসব সুওয়ালগুলি মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত এবং যেগুলির জবাব না দিলেই নয়, সেরূপ অর্ধ শতাধিক সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে এবং এরূপ প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সুওয়ালেরই জাওয়াব দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ। তার মধ্যে গত (৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮তম) সংখ্যা চারটিতে যথাক্রমে (৭+৩২+৬+৮) মোট = ৫৩টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হয়েছে। বর্তমান (৩৯তম) সংখ্যায় ৭টি সুওয়ালের জাওয়াব দেয়া হলো। বাকীগুলোর জাওয়াব পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।)
আপনাদের বর্ণিত সুওয়াল মোতাবেক যদি প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকদের আক্বীদা হয়ে থাকে, তাহলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই আপত্তিজনক, যা গোমরাহীমূলক, বিভ্রান্তিকর ও জেহালতপূর্ণ এবং তারমধ্যে কোন কোনটিতে কুফরীমূলক বক্তব্যও রয়েছে।
তবে আপনারা যেহেতু দলীল ভিত্তিক জাওয়াব চেয়েছেন, তাই আমরা উপরোক্ত প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই শরীয়তসম্মত তথা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের ভিত্তিতে জাওয়াব দিব। (ইনশাআল্লাহ)
কারণ মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে বলেন,
فاسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون.
অর্থ : তোমরা যারা জাননা, যারা জানেন, তাদের কাছ থেকে জেনে নাও।” (পবিত্র সূরা নহল শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৩)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من سئل عن علم علمه ثم كتمه الجم يوم القيامة بلجام من النار.
অর্থ : যাকে ইলমের বিষয় সর্ম্পকে কোন প্রশ্ন করা হয়, আর সে জানা থাকা সত্ত্বেও তা চুপিয়ে রাখে, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী পড়িয়ে দেয়া হবে।” (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ, আহমদ, মিশকাত, বজলুল মাজহুদ, তোহফাতুল আহওয়াযী, মায়ারেফুস্ সুনান, মেরকাত, উরফুশশাজী, তালীক, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, “তার জিব কেটে দেয়া  হবে ইত্যাদি।
তাই নিম্নে পর্যায়ক্রমে আপনাদের প্রেরিত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের আপত্তিকর বক্তব্য বা আক্বীদাসমূহের পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, জমা ও ক্বিয়াস উনাদের অকাট্য দলীলসমূহের ভিত্তিতে শরয়ী ফায়সালা প্রদান করা হলো-

তাবলীগের অর্থ ও প্রকারভেদ
[সুওয়াল সমূহের জাওয়াব দেয়ার পূর্বে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোচনা করা অতি জরুরী। কারণ তাবলীগ সম্পর্কে বুঝতে হলে প্রথমে তা কত প্রকার ও কি কি এবং তার অর্থ কি, তা জানতে হবে।
তাবলীগত্ম (تبليغ) অর্থ হলো- প্রচার করা। তাবলীগ দুপ্রকার অর্থাৎ সাধারণতঃ ইসলাম দুভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে- (১) তাবলীগে আম (عام) বা  সাধারণভাবে,  (২) তাবলীগে খাছ (خاص) বা বিশেষভাবে। আবার দ্বীন প্রচারকারী (মুবাল্লিগ) ও দুপ্রকার- (১) মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক) ও (২) মুবাল্লিাগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক)।

মুবাল্লিগে আম ও তার
হিদায়েতের ক্ষেত্র

মুবাল্লিগে আম অর্থাৎ সাধারণ মুবাল্লিগ (দ্বীন প্রচারক)- তার বিশেষ কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। শুধু দ্বীনী সমঝ বা বুঝ থাকলেই চলবে। সে খাছ বা বিশেষভাবে যেমন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাতিজী ও কর্মচারী তথা তার অধীনস্থ সকলকে দ্বীনী আমলের জন্য তথা দ্বীনদারী হাছিলের জন্য তাকীদ বা উৎসাহিত করবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবত্রি কুরআন শরীফ উনা মধ্যে সূরা তাহরীমের ৬নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেন,
يا ايها الذين امنوا قوا انفسكم واهليكم نارا.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে আগুন (জাহান্নাম) থেকে বাঁচাও।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
الا كلكم راع وكلكم مسؤل عن رعيته.
অর্থ : সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই (নিজের অধীনস্থদের ব্যাপারে) রক্ষক এবং প্রত্যেকেই তার রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, ফতহুল বারী , ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, শরহে নববী, মিরকাত, লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মিরআতুল মানাজীহ ইত্যাদি)
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
بلغوا عنى ولو اية.
অর্থ : তোমরা আমার থেকে একটি পবিত্র আয়াত (পবিত্র হাদীছ শরীফ) শরীফ হলেও তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দাও।” (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, তাইসীরুল ক্বারী, রশাদুস সারী)
অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত আছে- তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আমরা সৎ কাজের আদেশ দিব না? অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা সমস্ত খারাবী হতে ক্ষান্ত হবো, ততক্ষণ পর্যন্ত কি অসৎ কাজে নিষেধ করবো না? সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- না, বরং তোমরা সৎকাজের আদেশ দান করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে আমল করতে না পার। তদ্রুপ মন্দ কাজে নিষেধ করবে, যদিও তোমরা নিজেরা পুরোপুরিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকতে না পার। (তিবরানী শরীফ)
সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
الدين نصيحة.
অর্থ : দ্বীন হচ্ছে নছীহত স্বরূপ।
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুগণ জিজ্ঞাসা করলেন, কাদের জন্য? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার জন্য এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রিয় রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার জন্য এবং মুসলমানের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এবং সাধারণ মুসলমানদের জন্য।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, ফতহুল মুলহিম)
উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফসমূহ মুবাল্লিগে আম ও মুবাল্লিগে খাছ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। অর্থাৎ এর হুকুম কারো জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।
কাজেই যারা মুবাল্লিগে আম, তারা তাদের দায়িত্ব ও ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার আমল করবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ, তারাও তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার উপর আমল করবেন।
অতএব প্রত্যেক মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তার ক্ষেত্র হচ্ছে- তার অধীনস্থগণ। যাদেরকে তার তরফ থেকে দ্বীনের জন্য তালীম দেয়া ও তাকীদ করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। অর্থাৎ এটা হচ্ছে তাবলীগে খাছ যা করা- মুবাল্লিগে আম-এর জন্য ফরজে আইনের অন্তর্ভূক্ত। (তাফসীরে মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, ফতহুল ক্বাদীর, খাযেন, বাগবী, কুরতুবী, ইবনে কাছীর, কবীর)

মুবাল্লিগে খাছ ও তার হিদায়েতের ক্ষেত্র
           
মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), মুবাল্লিগে আম-এর মত নয়। অর্থাৎ তিনি কেবল তার অধীনস্থদেরই নয় বরং তিনি আমভাবে সকল উম্মতকেই হিদায়েত করার উপযুক্ত। পক্ষান্তরে মুবাল্লিগে আম কেবল তার অধীনস্থদেরই বলার যোগ্যতা রাখেন।
আর যাঁরা খাছ মুবাল্লিগ অর্থাৎ বিশিষ্ট দ্বীন প্রচারক, তাঁদের প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন,
ولتكن منكم امة يدعون الى الخير ويأمرون بالمعروف وينهون ن المنكر وارلئك هم المفلحون.
অর্থ : তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় হওয়া জরুরী, যারা (মানুষকে) কল্যাণের (পবিত্র কুরআন শরীফ-পবিত্র সুন্নাহ শরীফ তথা দ্বীন ইসলাম উনার) দিকে ডাকবে এবং সৎ কাজের আদেশ করবে এবং বদ কাজ থেকে নিষেধ করবে, আর তারাই মূলত কামিয়াব।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১০৪)
 অর্থাৎ তাঁকে অবশ্যই দ্বীনী বিষয়ে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে এবং ইলমে ফিক্বাহ্ ও ইলমে তাসাউফে বিশেষ দক্ষতা তথা ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত পরিমাণ ইলম, আমল এবং ইখলাছ হাছিল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক বলেন 
فلولا نفر من كل فرقة منهم طائفة ليتفقهوا فى الدين ولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم لعلهم يحذرون.
অর্থ : কেন তাদের প্রত্যেক ক্বওম বা ফেরক্বা থেকে একটি দল বের হয়না এজন্য যে, তারা দ্বীনী ইলমে দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের ক্বওমকে ভয় প্রদর্শন করবে, যখন তারা তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। আশা করা যায়, তারা বাঁচতে পারবে।” (পবিত্র সূরা তওবা শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ১২২)
(তাফসীরে মাজহারী, রুহুল মায়ানী, রুহুল বয়ান, ফাতহুল ক্বাদীর, কাশশাফ, হাশিয়ায়ে সাবী, যাদুল মাসীর, খাজেন, বাগবী, কুরতুবী, কবীর, ইবনে কাছীর ইত্যাদি)
আর মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تعلموا العلم وعلموه الناس.
অর্থ : তোমরা দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর এবং  মানুষকে তা শিক্ষা দাও।” (দারেমী, দারে কুত্নী, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত ইত্যাদি)
মূলতঃ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, তাঁদেরকে অবশ্যই ওলামায়ে হক্কানী-রব্বানী হতে হবে। আর হক্কানী, রব্বানী আলেমগণের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
انما يخشى الله من عباده العلماء.
অর্থ : নিশ্চয়ই বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করেন।” (পবিত্র সূরা ফাতির শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীর হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “যার মধ্যে যতবেশী আল্লাহ ভীতি রয়েছে, তিনি তত বড় আলেম।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ  উনার মধ্যে রয়েছে,
من ارباب العلم؟ قال الذين يعملون بما يعلمون قال فما اخرج العلم من قلوب العلماء؟ قال الظمع.
অর্থ : “(জিজ্ঞাসা করা হলো) আলেম কে? উত্তরে বললেন, যাঁরা ইলম অনুযায়ী আমল করেন। পুণরায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোন জিনিস আলেমের অন্তর থেকে ইলমকে বের করে দেয়? তিনি বললেন, লোভ (দুনিয়ার সম্পদ, সম্মান ইত্যাদি হাছিলের আকাঙ্খা)।  (দারেমী, মিশকাত, মিরকাত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত ত্বীবী, তালীক, আশয়াতুল লুময়াত, মিরআতুল মানাজীহ, লুময়াত ইত্যাদি)
অর্থাৎ যিনি ইলম অনুযায়ী আমল করেন, তিনিই হক্কানী-রব্বানী আলেম।
কাজেই যিনি ইলম, আমল ও ইখলাছ হাছিল করেছেন, তিনিই হক্কানী আলেম, আর তিনিই নবী আলাইহিস সালামগণের ওয়ারিছ। যাঁদের শানে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
العلماء ورثة الانبياء.
অর্থ : আলেমগণ হলেন- নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী।” (হম, তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাযাহ, মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, বজলুল মাজহুদ, তোহ্ফাতুল আহওয়াযী, মায়ারেফুস সুনান, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ, উরফুশশাজী, তালীক)
অর্থাৎ হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র যেমন আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য, তদ্রুপ যাঁরা মুবাল্লিগে খাছ, উনারা হযরত নবী আলাইহিমুস সালামগণ উনাদের ওয়ারিছ হওয়ার কারণে উনদেরও দাওয়াত ও তাবলীগ, তালীম ও তালক্বীন এবং হিদায়েতের ক্ষেত্র আম বা ব্যাপকভাবে উম্মতদের প্রতি প্রযোজ্য। আর এ আম তালীম বা তাবলীগ ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। যা অতীতে ও বর্তমানে ওলামায়ে হক্কানী- রব্বানীগণ তাসাউফ শিক্ষা দিয়ে, মাদ্রাসায় পড়িয়ে, মসজিদে ইমামতি করে, কিতাবাদি লিখে, ওয়াজ-নছীহত করে ইত্যাদি নানানভাবে দাওয়াত ও তালীম-তালক্বীন দিয়ে হিদায়েতের কাজ করে মুবাল্লিগে খাছ-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, তাবলীগে আম-এর (ফরজে কেফায়ার) ও তাবলীগে খাছ-এর (ফরজে আইনের) খেদমতের আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

মুবাল্লিগে আম-এর জন্য তাবলীগে আম করার হুকুম এবং মুবাল্লিগে খাছ-এর যোগ্যতা ও তাবলীগে আম-এর শর্ত

স্মরণীয় যে, যারা মুবাল্লিগে আম এবং যাদের জন্য শুধু তাবলীগে খাছ করা ফরজে আইন, তাদের জন্য কোন ক্রমেই এবং কষ্মিনকালেও তাবলীগে আম বা ব্যাপকভাবে দ্বীন প্রচার করা (যা মুবাল্লিগে খাছ তথা লামায়ে হক্কানী-রব্বানীগণের জন্য নির্দিষ্ট তা) জায়েয নেই।
এ প্রসঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত রয়েছে যে, একদিন এক লোক উনার সাক্ষাতে আসলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি কর?” সে জাওয়াব দিল, দ্বীন প্রচার করি। তখন তিনি তাকে বললেন, “তুমি কি ঐ সকল পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল করেছ?” যা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-
(১) পবিত্র সূরা সফ শরীফ উনার ২নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক বলেন,
يا ايها الذين امنوا لم تقولون مالا تفعلون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা করনা, তা কেন বল?”
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(২) তিনি আবার বললেন যে, মহান আল্লাহ পাক পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ উনার ৪৪নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বলেছেন,
اتأمرون الناس بالبر وتنسون انفسكم وانتم تنلون الكتاب.
অর্থ : তোমরা কি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ কর, আর নিজেদের ব্যাপারে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কিতাব তিলাওয়াত করে থাক।
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ?” সে জাওয়াব দিল, না।
(৩) পুণরায় তিনি বললেন, “তুমি কি ঐ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? যা হযরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম উনার ক্বওমকে বলেছিলেন,
وما اريد ان اخالفكم الى ما انهاكم عنه.
অর্থ : আমি এটা চাইনা যে, তোমাদেরকে যে কাজ থেকে নিষেধ করি, আমি তার খেলাফ করি। অর্থাৎ আমি যা বলি, তা করি আর যা বলিনা, তা করিনা।” (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ, পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৮)
তুমি কি এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার আমল করেছ? সে জাওয়াব দিল, না।
তখন হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাকে বললেন, “তুমি প্রথমে এ পবিত্র আয়াত শরীফসমূহের আমল কর, অতঃপর তুমি দ্বীন প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত কর।অর্থাৎ উপরোক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের আমল ব্যতিরেকে তাবলীগে আম করা জায়েয নেই।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে, তাবলীগে খাছ মুবাল্লিগে আম ও খাছ উভয়ের জন্যেই ফরজে আইন। আর তাবলীগে আম শুধুমাত্র মুবাল্লিগে খাছ তথা হক্কানী আলেমগণের জন্যেই প্রযোজ্য, যা উনাদের জন্যে ফরজে কেফায়ার অন্তর্ভূক্ত। অতএব, মুবাল্লিগে আম বা সাধারণ লোকদের জন্যে তাবলীগে আম করা কখনো শুদ্ধ হবেনা বরং তাদের জন্যে তা করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হবে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, “বর্তমানে প্রচলিত ছয় উছূল ভিত্তিক তাবলীগযাকে তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা তাবলীগে আম বলে থাকে, (যা আমাদের নিকট মক্তবী শিক্ষার অন্তর্ভূক্ত যদি আক্বীদা শুদ্ধ হয়ে থাকে) যদি তাদের কথা মোতাবেক তাকে তাবলীগে আম ধরা হয়, তাহলে তো অবশ্যই তা মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য করা উচিৎ ছিল। অথচ তা এমন সব লোকেরা করে থাকে যারা মুবাল্লিগে খাছ তো নয়ই, বরং তাদের মধ্যে অনেকেই মুবাল্লিগে আম-এরও উপযুক্ত নয়। যদিও কিছু সংখ্যক মুবাল্লিগে আম রয়েছে।
অতএব তাবলীগে আম মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্যই করা ফরজে কেফায়া। যা মুবাল্লিগে আম-এর জন্য করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম। আর সাধারণ লোকেরতো প্রশ্নই উঠেনা।
এখন হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, অনেক সময় দেখা যায় এমন কতক লোক, যারা মুবাল্লিগে খাছ ও আম কোনটাই নয়, তারা অনেকেই নামাজের জামায়াতে যাওয়ার সময় বা নামায পড়ার সময় অন্যকে নামাজে ডেকে নিয়ে যায়, রোজার মাসে রোজা রাখার কথা বলে, ইত্যাদি অনেক নেক কাজের কথাই বলে থাকে, যা তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলনা তবে তার ফায়সালা কি? এটাও কি নাজায়েয ও হারাম?
এর ফায়সালা হলো, ঐ সকল লোক মুসলিম শরীফ উনা মধ্যে বর্ণিত পবিত্র হাদীছ শরীফ- 
الدين نصيحة.
অর্থাৎ দ্বীন হচ্ছে অপরের ভাল কামনা করা।এর মেছদাক বা নমুনা। অর্থাৎ এদেরকে কেউ হিদায়েতের দায়িত্ব দেয়নি বা এরা হিদায়েতের ব্যাপারে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করেনি। এরা হচ্ছে মানুষের খয়েরখাঁ বা হিতাকাঙ্খী।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, তিবরানী শরীফের উপরোক্ত হাদীসে দেখা যাচ্ছে যে, সৎকাজ না করলেও অপরকে সৎ কাজ করতে বলা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক বলেন, “তোমরা ঐ কথা বল কেন, যা তোমরা নিজেরা করোনা।
তাহলে এই পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার বক্তব্যের মধ্যে ফায়সালা কি?
মূলত এর ফায়সালা ওলামায়ে মুহাক্কিক, মুদাক্কিকগণ দিয়েছেন। উনাদের মতে তিবরানী শরীফ উনার হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সৎ কাজ না করলেও সৎ কাজের দাওয়াত দেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, তা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক)-এর জন্য। যেমন কোন বাবা নিজে নামায বা অন্যান্য নেক কাজ না করা সত্বেও তার সন্তান ও অধীনস্থদের নামায বা অন্যান্য নেক কাজের জন্য বলতে পারেন।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা বলার জন্য যে নিষেধবাণী করা হয়েছে, তা হলো- মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য। অর্থাৎ মুবাল্লিগে খাছ-এর জন্য নিজে সৎ কাজ না করে অপরকে তা করতে বলা জায়েয নেই।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ আছে যে,
عن انس قال- قال رسول الله صلى الله عليه وسلم مررت ليلة اسرى بى بقوم تقرض شفاههم بمقاريض من النار- فقلت يا جبريل من هؤلاء- قال هؤلاء خظباء امتك الذين يقولون مالا يفعلون.
অর্থ : হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মিরাজ শরীফ উনার রাত্রে এমন একটি ক্বওমের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের ঠোঁটগুলো আগুনের কেঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। আমি হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? জবাবে হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম বলেন, এরা আপনার উম্মতদের মধ্যে ঐ সকল ওয়ায়েজ বা বক্তা, যারা এমন কথা বলতো, যেটা তারা নিজেরা আমল করতোনা।” (তিরমিযী, মিশকাত, তোহফাতুল আহওয়াজী, উরফুশ শাজী, মায়ারেফুস সুনান, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, মোযাহেরে হক্ব, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ্)
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, যারা মুবাল্লিগে আম (সাধারণ দ্বীন প্রচারক), তারা তিবরানী শরীফের বর্ণনা মোতাবেক সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন। আর যারা মুবাল্লিগে খাছ (বিশেষ দ্বীন প্রচারক), তারা কুরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ মোতাবেক নিজে সৎকাজ না করে অপরকে সৎকাজ করার কথা বলতে পারবেন না। কারণ যদি সকলের জন্যে আমভাবে একথা বলা হয় যে, সৎকাজ না করেও অপরকে সৎকাজের কথা বলা জায়েয, তবে মিরাজ শরীফ উনাপবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত লোকদের জিহ্বা কাটা হলো কেন? এতে বুঝা গেল যে, তিবরানী শরীফ উনার উক্ত হুকুম সকলের জন্যে প্রযোজ্য নয়। বরং যারা মুবাল্লিগে আম, তাদের জন্যেই প্রযোজ্য। আর কুরআন শরীফের উক্ত আয়াত শরীফ ও মিরাজ শরীফ সম্পর্কিত পবিত্র হাদীছ শরীফখানা যারা মুবাল্লিগে খাছ, তাদের জন্যে প্রযোজ্য।
সুতরাং হাক্বীক্বতে উক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ ও পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে কোনই দ্বন্দ্ব নেই। অনেকে এর সঠিক ব্যাখ্যা না জানার ও না বুঝার কারণে এ ব্যাপারে বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলে থাকে। মূলত উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ যার যার ক্ষেত্র অনুযায়ী প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়।]
সুওয়ালে উল্লেখকৃত প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের  আপত্তিকর বক্তব্যের  জাওয়াব –

৬৪নং সুওয়ালের জাওয়াবের পরবর্তী অংশ

সুওয়াল : প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের লোকেরা ইলমে তাসাউফ শিক্ষা বা ইখলাছ অর্জন করাকে মোটেও গুরুত্ব দেয়না। যে কারণে তাদের বয়ানে ইলমে তাসাউফ বা ইখলাছ সম্পর্কে কোন আলোচনাই করতে দেখা যায়না। পক্ষান্তরে ইলমে তাসাউফ শিক্ষার মাধ্যমে ইখলাছ হাছিল করতঃ তাযকিয়ায়ে ক্বালববা অন্তর পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হলো- ইলমে তাসাউফ শিক্ষা ব্যতীত কেবল চিন্তা দ্বারা ও প্রচলিত তাবলীগ করার মাধ্যমেই ইখালছ হাছিল করা, অন্তর পরিশুদ্ধ করা ও হুজুরী ক্বলব-এর সাথে নামাজ আদায় করা সম্ভব। এর জন্যে ক্বল্বী যিকিরের কোনই প্রয়োজন নেই, বরং বিভিন্ন প্রকার দোয়া-দরূদ ও তাস্বীহ্-তাহ্লীলের মাধ্যমেই তা অর্জিত হয়।এ ধরণের বক্তব্য তাদের দ্বারা লিখিত বিভিন্ন কিতাবের নানা স্থানে বিবৃত রয়েছে। এখন আমাদের সুওয়াল হলো- ইসলামের দৃষ্টিতে ইলমে তাসাউফ শিক্ষার মাধ্যমে ইখলাছ অর্জনের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? আর তা অর্জন করার শরয়ী পদ্ধতি কি? প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের বক্তব্য মোতাবেক সত্যিই কি চিন্তা ও খেয়ালের দ্বারা এবং তাবলীগ করার মাধ্যমে ইখলাছ হাছিল করতঃ তাযকিয়ায়ে ক্বলব অথবা অন্তর পরিশুদ্ধ হওয়া ও ক্বলবী যিকির ব্যতীত হুজুরী ক্বলব হাছিল করা সম্ভব? এর জন্য কি ক্বলবী যিকিরের মাধ্যমে ইলমে তাসাউফ শিক্ষার জরুরত নেই? পবিত্র কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের অকাট্য দলীলের ভিত্তিতে জাওয়াব দানে বিশেষভাবে উপকৃত করবেন।

জাওয়াব : (পূর্ববর্তী অংশের পর) মুনজিয়াতের বিবরণ           মুনজিয়াত  (منجيات) হলো-  ঐ সকল নেক খাছলত বা সৎস্বভাবসমূহ, যে সকল নেক খাছলত বা সৎ স্বভাবসমূহ নাযাত বা মুক্তি দেয়। অর্থাৎ তায়াল্লুক মায়াল্লাহ্বা মহান আল্লাহ পাক উনার সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে দেয়। ঐ সকল নেক খাছলত অনেক, তবে তন্মধ্যে দশটি উল্লেখযোগ্য। যেমন- (১) তওবা (গুণাহ থেকে প্রত্যাবর্তন), (২) ছবর (ধৈর্য্য), (৩) শোকর (কৃতজ্ঞতা), (৪) তায়াক্কুল (ভরসা), (৫) ইখলাছ (একনিষ্ঠতা), (৬) খওফ (ভয়), (৭) রেজা (সন্তুষ্টি), (৮) মুহব্বত (ভালবাসা), (৯) মুরাক্বাবা (চিন্তা-ভাবনা) ও (১০) মুহাসাবা (আমলের হিসাব) ইত্যাদি। তওবার বর্ণনা
যাহেরী-বাতেনী, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ছগীরা-কবীরা সর্বপ্রকার গুণাহ হতে প্রত্যাবর্তন/অনুশোচনা ও অনুতাপ করাই হচ্ছে- তওবা। তওবা করা সকলের মতেই ওয়াজিব। তওবা সম্পর্কে মহান মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
يا ايها الذين امنوا توبوا الى الله توبة نصوحا.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট খালেছ তওবা কর।” (পবিত্র সূরা তাহরীম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
التائب من الذنب كمن لا ذنب له.
অর্থ : তওবাকারীর যেন কোন গুণাই নেই। অর্থাৎ তওবাকারী তওবা করার সাথে সাথে মাছূম বা নিষ্পাপ হয়ে যায়।” (ইবনে মাজাহ্, বায়হাক্বী, শরহুস্ সুন্নাহ্, মেশকাত, মেরকাত, লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ, মিরআতুল মানাজীহ) অতএব, প্রত্যেকের জন্যই দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে- সর্বদা তওবার উপর কায়েম থাকা। আর তজ্জন্য তওবা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা সকলের জন্যই ফরজ। ছবর (ধৈর্য্য)-এর বর্ণনা সাধারণতঃ বাংলা ভাষায় বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট দৃঢ়ভাবে সহ্য করাকে ছবর বলে। কিন্তু আরবী ভাষায় ছবরের অর্থ অনেক ব্যাপক। যেমন- ভোগের আকাংখা, প্রাপ্তির লোভ, কামের উত্তেজনা, প্রবৃত্তির তাড়নায় সম্পূর্ণ অবিচল থাকা এবং আনন্দের উচ্ছাসে ও সুখের আতিসয্যে পথহারা না হয়ে শরীয়তের মাঝে অটল ও দৃঢ়ভাবে স্থির থাকাকে ছবর বলে। 
স্মরণীয় যে, ছবর ব্যতীত তওবা হাছিল হয়না। শুধু তাই নয়, ছবর ব্যতীত কোন নেক কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা এবং পাপ কাজ থেকে পরিপূর্ণ বিরত থাকাও সম্ভব নয়। মহান মহান আল্লাহ পাক, পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে অসংখ্য স্থানে ছবরের গুরুত্ব ও মাহাত্ম সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,           
يا ايها الذين امنوا اصبروا وسابروا ورابطوا واتقوالله لعلكم تفلحون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর, ধৈর্য্যশীল হয়ে যাও এবং মহান আল্লাহ পাককে ভয় করে নেক কাজে লেগে থাক। আশা করা যায়, তোমরা সফলতা অর্জন করবে।” (পবিত্র সূরা ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২০০)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
الصبر نصف الايمان.
অর্থঃ- ধৈর্য্য হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ছবর বা ধৈর্য্য নামক গুণ বা নেক খাছলত হাছিল করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। অতএব, ছবর বা ধৈর্য্য সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাও সকলের জন্য ফরজ। শোকর (কৃতজ্ঞতা)-এর বিবরণ  মহান মহান আল্লাহ পাক প্রদত্ত নিয়ামত সমূহের যথাযথ কৃতজ্ঞতা আদায় বা প্রশংসা করার নামই হচ্ছে- শোকর।
মূলত মহান আল্লাহ পাক উনার দেয়া নিয়ামতের শোকরিয়া তখনই পরিপূর্ণ আদায় হবে, যখন নিয়ামতসমূহ যবানে ও অন্তরে বিশ্বাস করার সাথে সাথে শরীয়তসম্মত পন্থায় ব্যয় বা ব্যবহার করা হবে।            শোকর বা কৃতজ্ঞতা একটি অতি উত্তম ও উন্নত স্তরের গুণ। যার ফলে মহান মহান আল্লাহ পাক স্বীয় যিকিরের সাথেই শোকরের কথা বলেছেন। যেমন মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
فاذكرونى اذ كر كم واشكروالى ولا تكفرون.
অর্থ : সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে (রহমতের দ্বারা) স্মরণ করবো। আর আমার শোকর গুজারী বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, আমার প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়োনা।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫২) শোকরের ফযীলত সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
الطاعم الشاكر بمنزلة الصائم الصابر.
অর্থ : যে ব্যক্তি আহারের পর মহান মহান আল্লাহ পাক উনার শোকর গুজারী বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তার মর্যাদা রোজাদার ও ছবরকারীর মর্যাদার ন্যায়।” (ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত) আর বিশিষ্ট ছাহাবী, ফক্বীহুল আযম, হযরত ইবনে মাসউদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “শোকর ঈমানের অর্ধাংশ।সুতরাং প্রত্যেক বান্দার জন্য মহান মহান আল্লাহ পাক উনার নিয়ামতের  যথাযথ শোকর গুজারী করা ফরয। আর তজ্জন্য তৎসম্পর্কিত জরুরী ইলম অর্জন করাও ফরজ। তাওয়াক্কুল (ভরসা)-এর বর্ণনা সর্বাবস্থায় ও সর্বক্ষেত্রে মহান মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি নির্ভরশীল হওয়া বা ভরসা করার নামই তাওয়াক্কুল। যে সকল উন্নত হাল বা অবস্থার অধিকারী হলে মানুষ মহান আল্লাহ পাক উনার সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হাছিল করে, ‘তাওয়াক্কুলসে সকল অবস্থার মধ্যে একটি উচ্চতর হাল বা অবস্থা।          এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,                                  
وعلى الله فتو كلوا ان كنتم مؤمنين.
অর্থ : যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক, তবে একমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার উপর (তাওয়াক্কুল) ভরসা কর।” (পবিত্র সূরা মায়েদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীপ ২৩)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “মহান মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি যেরূপ দ্বিধাহীনচিত্তে তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা উচিৎ, তোমরা যদি উনার প্রতি তদ্রুপ তাওয়াক্কুল বা ভরসা করতে পার, তবে তিনি পশু-পাখীর ন্যায় অপরিচিত স্থান হতে তোমাদেরকে রিযিক দান করবেন।তবে তাই বলে মহান আল্লাহ পাক উনার উপর তাওয়াক্কুল করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা বা রিযিকের জন্য কোশেশ না করা শরীয়তের নির্দেশ নয়। বরং হালাল রুজী কামাই করার জন্য কোশেশ করার সাথে সাথে মহান মহান আল্লাহ পাক উনার উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করাই শরীয়তের নির্দেশ বা সুন্নতে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, তাওয়াক্কুল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অতএব তাওয়াক্কুল সম্পর্কিত যাবতীয় ইলম অর্জন করা সকলের জন্য ফরজ।  ইখলাছ (একনিষ্ঠতা)-এর বর্ণনা একনিষ্ঠভাবে শুধুমাত্র মহান মহান আল্লাহ পাক উনার রেজামন্দি বা সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য ইবাদত বা আমল করার নাম হচ্ছে ইখলাছ। ইখলাছ অর্জন করা বা ইখলাছের সাথে আমল করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
وما امروا الا ليعبدوالله مخلصين له الدين.
অর্থ : তাদেরকে (ঈমানদারদেরকে) শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন খালেছভাবে অর্থাৎ ইখলাছের সহিত মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করে।” (পবিত্র সূরা বাইয়্যিনাহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হযরত আবু উমামাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন,
ان الله لا يقبل من العمل الا ما كان له خالصا وابتغى به وجهه.
অর্থ : নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক ঐ সকল আমল কবুল করবেন না, যা ইখলাছের সাথে মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা না হয়।” (নাসাঈ শরীফ)
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
ان الله لا ينظر الى صوركم واموا لكم ولكن ينظر الى قلوبكم.
অর্থ : নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তোমাদের আকৃতি বা ধন-সম্পদের প্রতি লক্ষ্য করেন না, বরং তোমাদের অন্তরের (ইখলাছের) দিকে লক্ষ্য করেন।” (মুসলিম, শরহে নববী) ইখলাছ সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
فالناس كلهم هلكى الا العالمون والعالمون كلهم هلكى الا العا ملون والعا ملون كلهم هلكى الا المخلصون والمخلصون على خطر عظيم.
অর্থ : সকল মানুষ ধ্বংসের মধ্যে আলেমগণ ব্যতীত, আলেমগণও ধ্বংসের মধ্যে আমলকারীগণ ব্যতীত, আমলকারীগণও ধ্বংসের মধ্যে ইখলাছের সহিত আমলকারীগণ ব্যতীত,  ‍মুখলিছ বান্দাগণও চিন্তার উপর রয়েছে।” (ইহয়াউ উলূমিদ্দীন) আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন,
يا معاذ اخهلص دينك يكفيك العمل القليل.
অর্থ : হে মুয়াজ বিন জাবাল! ইখলাছের সাথে ইবাদত কর। অল্প আমলই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।” (ইহ্ইয়াউ উলুমিদ্দীন, ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত) সুতরাং ইখলাছবিহীন কোন ইবাদত-বন্দেগীই মহান মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবুলযোগ্য নয়। তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইখলাছের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন,
عن ابى هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان اول الناس يقضى عليه يوم القيامة رجل استشهد فاتى به فعرفه نعمته فعر فها فقال فما عملت فيها؟ قال قاتلت فيك حتى استشهدت، قال كذبت- ولكنك قاتلت لا ن يقال جرىء فقد قيل ثم امربه فسحب على وجهه حتى القى فى النار- ورجل تعلم العلم وعلمه وقرأ القرأن فاتى به فعر فه نعمه- فعرفها قال فما عملت فيها؟ قال تعلمت العلم وعلمته وقرأت فيك القران- قال كذبت ولكنك تعلمت العلم ليقال انك عالم- وقرأت القران ليقال هوقارىء- فقد قيل- ثم امربه فسحب على وجهه حتى القرى فى النار- ورجل وسع الله عليه- واعطاه من اصناف المال كله- فاتى به فعرفه نعمه فعر فها- قال فما عملت فيها؟ قال ماتر كت من سبيل تحب ان ينفق فيها الا انفقت فيها لك- قال كذبت ولكنك فعلت ليقال هو جواد فقد قيل ثم امربه فسحب على وجهه ثم القى فى النار. (رواه مسلم(
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন তিনজন লোককে প্রথমে বিচারের জন্য আনা হবে। প্রথম যে ব্যক্তিকে আনা হবে, সে হলো একজন শহীদ। তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, হে ব্যক্তি তোমাকে আমি এত শক্তি-সামর্থ্য দিলাম, তা দিয়ে তুমি কি করেছ? সে বলবে, মহান আল্লাহ পাক আমি জ্বিহাদ করতে করতে আপনার জন্য শহীদ হয়েছি। মহান আল্লাহ পাক বলবেন, মিথ্যা কথা, তুমি আমার জন্য জ্বিহাদ করনি। মানুষ তোমাকে বড় পালোয়ান বা শক্তিশালী বলবে, সেজন্য তুমি জ্বিহাদ করেছ, যুদ্ধ করেছ। মানুষ তোমাকে শহীদ বলেছে। (তোমার বদলা তুমি পেয়েছ) তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিস সালামদের বলবেন, হে ফেরেস্তারা, এ লোকটাকে চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর, তাই করা হবে। দ্বিতীয় আরেকজন লোককে আনা হবে, যাকে ইলম দান করা হয়েছে এবং সে তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে। এবং পবিত্র কুরআন শরীফ সহীহ্-শুদ্ধভাবে পড়তে শিখেছে। মহান আল্লাহ পাক তাকে বলবেন, হে আলেম বা ক্বারী সাহেব, তোমাকে এত ইলম দেয়া হয়েছিল, শুদ্ধ করে পবিত্র কুরআন শরীফ পাঠ করতে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল, তুমি কি করলে? সে ব্যক্তি বলবে, মহান আল্লাহ পাক, আমি আপনার জন্য ইলম শিক্ষা করেছি এবং তা অন্যকে শিক্ষা দিয়েছি, আর আপনার জন্যই আমি পবিত্র কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে পাঠ করেছি। মহান আল্লাহ পাক বলবেন, মিথ্যা কথা। বরং মানুষ তোমাকে বড় আলেম বা বড় ক্বারী সাহেব বলবে, সে জন্যেই তুমি ইলম অর্জন করেছ, পবিত্র কুরআন শরীফ শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে শিখেছ। কাজেই মানুষ তোমাকে বড় আলেম, বড় ক্বারী সাহেব বলেছে (তোমার বদলা তুমি পেয়েছ)। তখন মহান আল্লাহ পাক হযরত ফেরেশতা আলাইহিস সালামদেরকে বলবেন, হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা, তোমরা এ লোকটাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর। তখন তার চুল ধরে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
এরপর তৃতীয় আরেক জনকে আনা হবে, যাকে অনেক সম্পদ দান করা হয়েছে। তাকে মহান আল্লাহ পাক বলবেন, হে ব্যক্তি, তোমাকে আমি দুনিয়াতে অনেক সম্পদের মালিক করেছিলাম, তার বিণিময়ে তুমি কি আমল করলে? সে ব্যক্তি বলবে, হে মহান আল্লাহ পাক, আমি আপনার পছন্দণীয় এমন কোন পথ নেই, যে পথে দান॥খয়রাত করিনি। অর্থাৎ আপনি যতগুলো রাস্তা পছন্দ করতেন॥ মস্জিদ, মাদ্রাসা, লঙ্গরখানা, এতিমখানা, গরীব-মিস্কিন, রাস্তা-ঘাট, পুল ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই আমি কম-বেশী দান করেছি। কোন প্রার্থীকে আমি খালিহাতে ফিরিয়ে দেইনি। সবাইকে কম-বেশী দান করেছি, একমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য। মহান আল্লাহ পাক বলবেন, মিথ্যা কথা। তুমি এ জন্য করেছ যে, লোকে তোমাকে দানশীল বলবে, তোমাকে তা  বলা  হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তখন বলবেন, হে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা, এ দানশীল ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দাও। তখন হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা তাকে চুলে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।” (মুসলিম শরীফ, শরহে নববী, মেশকাত, মেরকত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথাই প্রমাণিত হলো যে, ইখলাছ ব্যতীত পাহাড়সম আমলও কোন উপকারে আসবেনা। তাই মহান মহান আল্লাহ পাক উনার রেজামন্দী হাছিল করতে হলে অবশ্যই অন্তরে ইখলাছ পয়দা করতে হবে। কেননা ইখলাছ অর্জন করা ফরয। আর সেজন্য জরুরত আন্দাজ ইলম অর্জন করাও ফরয। এ প্রসঙ্গে ফতওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ আছে যে,
وعلم الاخلاص لان صحة المل موقوفة عليه.
অর্থ : ইখলাছ সম্পর্কিত ইলম অর্জন করা ফরজ, কেননা ইখলাছ ব্যতীত আমল কবুলযোগ্য নয়।অতএব, ইখলাছ অর্জন করতে হবে, তবেই মহান মহান আল্লাহ পাক উনার রেজামন্দি বা সন্তুষ্টি হাছিল করা সম্ভব।  খওফ (ভয়)-এর বর্ণনা       মহান মহান আল্লাহ পাক উনার ভয়ে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা ও নেক কাজে মশগুল থাকার নামই খওফ।    মূলত খওফবা খোদাভীতি ব্যতীত নেক কাজে মশগুল থাকা সম্ভব নয়। তাই মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যের অসংখ্য স্থানে মহান আল্লাহ পাককে ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ মুবারক করেন,
 يا ايها الذين امنوا اتقوا الله حق تعاته ولا تموتن الا وانتم مسلمون.
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! মহান আল্লাহ পাককে ভয় করার মত ভয় কর, খাঁটি মুসলমান না হওয়া পর্যন্ত তোমরা মারা যেওনা।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১০২)
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে যে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
من هب الله هبه كل شئ.
অর্থ : যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাককে ভয় করে সমস্ত মাখলুকাত তাকে ভয় করবে।” (আনীসুল আরওয়াহ) এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, খওফ বা ভয়ের সাথে রেজা অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত ও মাগফেরাতের আশা থাকাও বাঞ্ছনীয়। উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, খোদাভীতি অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। কারণ খোদাভীতি ব্যতীত মহান আল্লাহ পাক উনার মতে ও রাসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে ক্বায়েম-দায়েম থাকা আদৌ সম্ভব নয়। অতএব, মহান আল্লাহ পাক ভীতি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাও ফরজ। রেজা (সন্তুষ্টি)-এর বর্ণনা মহান আল্লাহ পাক উনার ব্যবস্থা ও বিধানের উপর পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকার নামই হচ্ছে রেজা। মূলত মহান আল্লাহ পাক উনার বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি মুহব্বতেরই নমুনা। অবশ্য মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত অন্তরে ভরপুর থাকলেই কেবল মহান আল্লাহ পাক উনার বিধানে পূর্ণ সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব। তাই সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
الرضاء با لقضاء باب الله الا عظم.
অর্থ : মহান মহান আল্লাহ পাক উনার বিধানের উপর সন্তুষ্ট থাকা, মহান আল্লাহ পাক উনার অভিমুখে শ্রেষ্ঠ দ্বার।” (ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত) আর            রেজা বা সন্তুষ্টি সম্পর্কে মহান মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
رضوان من الله اكبر.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক উনার সন্তুষ্টিই হচ্ছে সবচেয়ে বড়।” (পবিত্র সুরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৭২)
মূলত ঈমানদারদের দায়িত্ব একটাই যে, তারা মহান আল্লাহ পাক উনার বিধানে সন্তুষ্ট থাকবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনাকে সন্তুষ্ট করবে। যে প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন ইরশাদ মুবারক করেন
والله ورسوله احق ان يرضوه ان كانوا مؤمنين.
অর্থ : তারা যদি মুমিন হয়ে থাকে, তবে তাদের উচিৎ মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসূলকে সন্তুষ্ট করা, কেননা ওনারাই সন্তুষ্টি পাওয়ার সমধিক উপযুক্ত। (পবিত্র সুরা তওবা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৬২)
অতএব, রেজা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করাও সকলের জন্য অবশ্য কর্তব্য।  মুহব্বত (ভালবাসা)-এর বর্ণনামহান মহান আল্লাহ পাককে মুহব্বত করা সকল মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ। এ ব্যাপারে সকলেই একমত। এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক বলেন,
يحبهم ويحبونه.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে ভালবাসেন, তারাও মহান আল্লাহ পাককে ভালবাসে।” (পবিত্র সূরা মায়েদা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৪)
মূলত মহান মহান আল্লাহ পাককে ভালবাসতে হলে বা উনার ভালবাসা লাভ করতে হলে, আখেরী রাসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে ভালবাসতে হবে। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন,
 قل ان كنتم تحبون الله فا تبعونى يحببكم الله ويغفر لكم ذنوبكم والله غفوررحيم.
অর্থ : হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি! আপনি বলুন- যদি তোমরা মহান আল্লাহ পাককে মুহব্বত কর, তবে আমাকে অনুসরণ কর। তবে মহান আল্লাহ পাক তোমাদেরকে মুহব্বত করবেন এবং তোমাদের সকল গুণাহ্ ক্ষমা করবেন। মহান আল্লাহ পাক ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীপ ৩১)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لا يؤمن احدكم حتى يكون الله ورسوله احب اليه من نفسه وماله وولده ووالده والناس اجمعين.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিনে কামেল হতে পারবেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তার জীবন, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা এবং সকল মানুষ থেকে মহান আল্লাহ পাক ও তাঁর রাসূলকে অধিক মুহব্বত না করবে।আর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মুহব্বত করতে হলে, তাঁর সুন্নতের পায়রবী করতে হবে। তাই পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
من احب سنتى فقد احبنى.
অর্থ : যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে মুহব্বত (অনসরণ) করলো, সে ব্যক্তি আমাকে মুহব্বত করলো।” (তিরমিযী, মেশকাত, মায়ারেফুস সুনান, উরফুশ্ শাজী, মেরকাত, লুময়াত, আশ্য়াতুল  লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ্ ছবীহ্, মিরআতুল মানাজীহ্, মোযাহেরে হক্ব) অতএব, প্রমাণিত হলো যে, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নতের সুক্ষাতিসুক্ষ্ম ও পূঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ অনুকরণ করার মধ্যেই মহান আল্লাহ পাক ও উনার রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মুহব্বত নিহিত। কাজেই মুহব্বত সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা সকলের জন্যই দায়িত্ব ও কর্তব্য। মুরাকাবা (চিন্তা- নিমগ্নতা)-এর বর্ণনামহান মহান আল্লাহ পাক আমার যাবতীয় আমলসমূহ দেখছেন এবং তিনি আমার অন্তরের সকল জল্পনা-কল্পনা সম্পর্কে সুস্পষ্ট অবগত আছেন, এ খেয়াল বা ধ্যান অন্তরে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হওয়ার নামই মুরাকাবা।
এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ মুবারক করেন,
الم يعلم بان الله يرى.
অর্থ : সে কি জানেনা যে, মহান আল্লাহ পাক তায়ালা দেখছেন।” (পবিত্র সূরা আলাক্ব শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪) মূলত যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের অন্তরে এ খেয়াল সৃষ্টি না হবে যে, মহান মহান আল্লাহ পাক সদা-সর্বদা তার সাথে রয়েছেন এবং তার যাবতীয় আমল সম্পর্কে জানেন ও দেখেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তার পক্ষে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা ও নেক কাজে মশগুল থাকা যথাযথভাবে সম্ভব নয়।
আর এটার নামই মূলত ইহ্সান। যে সম্পর্কে হাদীসে জিব্রীলের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে,
ان تعبد الله كانك تراه فان لم تكن تراه فانه يراك.
অর্থ : তুমি এরূপভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত কর, যেন তুমি মহান আল্লাহ পাককে দেখছো, আর যদি তা সম্ভব না হয়, তবে এ ধারণা কর যে, মহান আল্লাহ পাক তোমাকে দেখছেন।মুসলিম, মেশকাত, মেরকাম, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, তালীকুছ্ ছবীহ্, শরহুত ত্বীবী, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্)
এ প্রসঙ্গে কিতাবে একটি ঘটনা উল্লেখ আছে যে, একজন মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী, তাঁর অনেক মুরীদান ছিল। তন্মধ্যে একজনকে তিনি সর্বাপেক্ষা অধিক মুহব্বত করতেন এবং তার কাজ-কর্মের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। এতে অন্যন্য মুরীদানরা কিছুটা চু-চেরা, কিল ও কাল করতে লাগলো। মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী মুরীদানদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে একদিন সকল মুরীদানকে ডেকে আনলেন এবং সকলের হাতে একটি পাখি ও একটি ছুরি দিয়ে বললেন, তোমরা প্রত্যেকেই এ পাখিটি এমন স্থান হতে জবেহ্ করে আনবে যেন কেউ না দেখে। সকলেই বিভিন্ন স্থান হতে যেমন- কেউ ঘরের দরজা বন্ধ করে, কেউ গহীন জঙ্গলে, কেউ পানির নীচে ডুব দিয়ে পাখিটি জবেহ্ করে নিয়ে আসলো এবং তাদের জবেহ্ করার বর্ণনা প্রদান করলো। কিন্তু যে মুরীদটিকে মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী, অত্যাধিক মুহব্বত করতেন, সে পাখিটি জবেহ্ না করেই পীর সাহেবের দরবারে ফিরে আসলেন। এসে বললেন! হুযূর, আমি এরূপ কোন স্থান পেলামনা, যেখানে কেউ দেখেনা। যেখানেই যাই সেখানেই অন্তরে খেয়াল হয় যে, কেউ যদিও দেখছেনা কিন্তু মহান আল্লাহ পাক তো আমার কার্যকলাপ দেখছেন। তখন মহান আল্লাহ পাক উনার ওলী সকল মুরীদানকে লক্ষ্য করে বললেন, এ কারণেই আমি এ মুরীদকে অত্যাধিক মুহব্বত করি। যেহেতু সে এরূপ স্তরে পোঁছেছে যে, সে সর্বদা মহান আল্লাহ পাক উনার মহিমা দর্শনে মশগুল এবং মহান আল্লাহ পাক উনার স্মরণ ব্যতীত অন্য কিছুই তার অন্তরে নেই।
সুতরাং প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর অন্তরে এ খেয়াল পয়দা করা ফরজ যে, মহান মহান আল্লাহ পাক আমাদের সব বিষয়ে সুস্পষ্ট অবগত। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক সর্বস্থানে সর্বদা হাজির ও নাযির। আর এ খাছলত বা গুণ অর্জন করতে হলে অবশ্যই জরুরত আন্দাজ ইলমে তাসাউফ অর্জন করতে হবে।  মুহাসাবা (হিসাব-নিকাশ)-এর বর্ণনানিজের প্রতিদিন ও রাত্রির ইবাদত বা আমল সমূহের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ করার নামই মুহাসাবা।
মূলত মহান মহান আল্লাহ পাক বান্দার প্রতিটি আমলের হিসাব নিবেন সুচারুভাবে, যাতে একবিন্দুও কম-বেশী করা হবেনা। তাই মহান আল্লাহ পাক কালামে পাকে ইরশাদ মুবারক করেন,
ونضع الموازين القسط ليوم القيامة فلا تظلم نفس شيئا.
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন আমি ইন্ছাফের পাল্লা স্থাপন করবো। অতএব, এতে কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার করা হবেনা।” (পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৭)
তাই আমীরুল মুমিনীন, হযরত আলী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,
حاسبوا قبل ان تحاسبوا.
অর্থ : মহান মহান আল্লাহ পাক কর্তৃক আমলের হিসাব-নিকাশের পূর্বেই তোমরা নিজেরা নিজেদের আমলের হিসাব করে নাও।” (ক্বিমিয়ায়ে সায়াদাত)
মূল কথা হলো- আমলের হিসাব বা মুহাসাবা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা সকলের জন্যই ফরজ। কারণ ইলমে তাসাউফ চর্চা ব্যতীত মুহাসাবার যোগ্যতা অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়। এছাড়াও মুনজিয়াত বা নাযাত (মুক্তি) দানকারী অনেক নেক খাছলত রয়েছে, যেমন- ১। এনাবত (রুজু হওয়া), ২। জোহ্দ (বিরাগী হওয়া), ৩। অরা (পরহেজগারী), ৪। কানায়াত (অল্পে তুষ্ট), ৫। তাস্লীম (আত্মসমর্পণ করা), ৬। তাফাক্কুর (সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করা), ৭। শওক্ব (আগ্রহ), ৮। তাওহীদ (একাত্ববাদ), ৯। নিয়ত (সংকল্প), ১০। ছিদ্ক (সত্যবাদীতা), ১১। ফক্বর (স্বেচ্ছায় দারিদ্রতা গ্রহণ করা), ১২। জিক্রুল মওত (মৃত্যুর  স্মরণ), ১৩। আহ্ওয়ালে আখেরাত (পরকালের অবস্থা), ১৪। সাখাওয়াত (দানশীলতা), ১৫। তাওয়াজু (বিনয় বা নম্রতা), ১৬। রেজা (আশা), ১৭। মুজাহাদাহ্ (চেষ্টা বা কোশেশ) ১৮। মুশাহাদাহ্ (দেখা), ১৯। ইলম (জ্ঞান), ২০। ইস্তেক্বামাত (দৃঢ়তা), ২৩। হায়া (লজ্জা), ২৪। কিল্লাতুত্ তোয়াম (কম খাওয়া), ২৫। আদব (শিষ্টাচার), ২৬। ইছার বা হুররিয়্যাত (স্বাধীনতা বা অপরের লাভকে প্রাধান্য দেয়া), ২৭। হুজুরী ক্বলব (সর্বদা অন্তরে যিকির করা), ২৮। খেদ্মাতুল ফোক্বারা (ওলীগণের খেদমত), ২৯। উজ্লত (নির্জনতা) ৩০। তাফবীজ (ভার অর্পন বা দায়িত্ব দেয়া), ৩১। ইহ্সান (পরোপকার), ৩২। শুজায়াত (বাহাদুরী), ৩৩। আহাদ (ওয়াদা), ৩৪। কিল্লাতুল কালাম (কম কথা বলা), ৩৫। কিল্লাতুল মানাম (কম ঘুমানো), ৩৬। কিল্লাতুল্ ইখ্লাত মায়াল আনাম (মানুষের সাথে কম মেলামেশা করা) ইত্যাদি।দশ লতীফার বিবরণ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, তরীক্বা সমূহের ইমামগণ বলেন, “প্রতিটি মানুষের শরীরে দশটি লতীফা রয়েছে। যেমন- ক্বলব, রূহ্, সির, খফি, আখ্ফা, নফস, আব (পানি), আতেশ (আগুণ), খাক (মাটি) ও বাদ (বাতাস)।
উল্লেখিত লতীফা সমূহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত এবং প্রত্যেকটি লতীফাই এক একটি নেক খাছলতের মাক্বাম। যেমন- (১) ক্বলব : বাম স্তনের দুআঙ্গুল নীচে অবস্থিত। আর ক্বলব হচ্ছে- তওবার মাক্বাম। অর্থাৎ সালেক যখন ক্বলবের সবক আদায় করে, তখন সে পাপ বা নাফরমানী থেকে ফিরে আসে। তওবার বিপরীত হচ্ছে- পাপ বা নাফরমানীর মধ্যে মশগুল থাকা। অর্থাৎ যার তওবার মাক্বাম হাছিল না হবে, সে পাপ বা নাফরমানীতে মশগুল থাকবে। (২) রূহ : ডান স্তনের দুআঙ্গুল নীচে অবস্থিত। রূহ্ হচ্ছে- এনাবতের মাক্বাম। অর্থাৎ নেক কাজের দিকে রুজু হওয়া, আর এর বিপরীত হচ্ছে- পাপ বা নাফরমানীর দিকে রুজু হওয়া। অর্থাৎ যার এনাবতের মাক্বাম হাছিল না হরে সে পাপের দিকে রুজু হবে। (৩) সির : কড়ার উপর বুকের মধ্যখানে অবস্থিত। সির লতীফা যোহ্দের মাক্বাম। অর্থাৎ দুনিয়া বিরাগী হওয়া আর এর বিপরীত হচ্ছে- দুনিয়ার মোহে মোহগ্রস্থ থাকা। অর্থাৎ যে ব্যক্তির যুহদের মাক্বাম হাছিল না হবে, সে দুনিয়াদারীর মধ্যে গরক্ব থাকবে। (৪) খফী : কপালে অবস্থিত। খফী- ওয়ারা বা পরহেযগারীর মাক্বাম। অর্থাৎ সন্দেহজনক বস্তু হতে বিরত থাকা। ওয়ারা বা পরহেযগারীর বিপরীত দিক হচ্ছে- সন্দেহজনক বস্তুর মধ্যে মশগুল থাকা। অর্থাৎ এ মাক্বাম হাছিল না হওয়া পর্যন্ত সে সন্দেহজনক বস্তুর মধ্যে মশগুল থাকবে। (৫) আখফা : মাথার তালুতে অবস্থিত। শোকরের মাক্বাম হচ্ছে- আখফা। অর্থাৎ এ মাক্বাম হাছিল হওয়ার কারণে পূর্ণরূপে বা যথাযথভাবে নিয়ামত সমূহের শোকরিয়া আদায় করা সম্ভব। এছাড়া যথাযথ শোকরিয়া আদায় করা সম্ভব নয় বরং নাশোকরী করবে। অর্থাৎ শোকরের মাক্বাম হাছিল না হলে, সে সর্বদাই নাশোকরী করবে। (৬) নফস : নাভীমূলে অবস্থিত। নফস হলো- তাওয়াক্কুলের মাক্বাম। অর্থাৎ পরিপূর্ণরূপে মহান আল্লাহ পাক উনার উপর ভরসা করা। আর এর বিপরীত হলো- গায়রুল্লাহ্র উপর ভরসা করা। অর্থাৎ তাওয়াক্কুলের মাক্বাম হাছিল না হওয়া পর্যন্ত সে গায়রুল্লাহ্র উপর ভরসা করবে। (৭) আব (পানি) : সমস্ত শরীরেই অবস্থিত। আব লতীফা কানায়াতের মাক্বাম। অর্থাৎ অল্পে তুষ্ট থাকা, কানায়াতের বিপরীত দিক হলো- অতি লোভী ও অলস হওয়া। অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ মাক্বাম হাছিল না করবে, সে অতি লোভী ও অলস হবে। (৮) আতেশ (আগুণ) : সমস্ত শরীরে অবস্থিত। আতেশ লতীফা তাসলীমের মাক্বাম। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার আহ্কাম সমূহকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়া বা পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। আর এর বিপরীত হচ্ছে- বিদ্রোহী বা বাগী হওয়া ও বদ মেজাজী হওয়া। অর্থাৎ তাসলীমের মাক্বাম হাছিল না হওয়া পর্যন্ত সে বিদ্রহী ও বদ্ মেজাজী হবে। (৯) খাক (মাটি) : সমস্ত শরীরে অবস্থিত। ইহা রেজার মাক্বাম। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাক উনার কাজের উপর বা তক্বদীরের উপর সন্তুষ্ট থাকা বা বিনয়ী হওয়া। আর এর বিপরীত দিক হচ্ছে- তক্বদীরের ফায়সালা অমান্য করা ও খারাপ উদ্দেশ্যে বিনয়ী ভাব প্রকাশ প্রকাশ করা। অর্থাৎ যে ব্যক্তির এ মাক্বাম হাছিল না হবে, সে তক্বদীর অমান্যকারী হবে। (১০) বাদ (বাতাস) : সমস্ত শরীরের মধ্যে অবস্থিত। বাদ লতীফা সবরের মাক্বাম। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় ধৈর্য্যধারণ করা। আর এর বিপরীত হচ্ছে- সর্বক্ষেত্রে অধৈর্য্য হওয়া ও ভোগ বিলাসিতায় মশগুল থাকা। অর্থাৎ এ মাক্বাম হাছিল না হলে, সে অধৈর্য্য হবে ও ভোগ বিলাসিতায় মশগুল থাকবে।         উল্লেখ্য, শেষ চারটি লতীফাকে আরবায়ে আনাছেরবলে, যদ্বারা মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
অতএব, মুহ্লিকাত ও মুনজিয়াত এবং দশ লতীফা সংক্রান্ত ফরজ পরিমাণ ইলম অর্জন করা ফরজে আইন। অর্থাৎ অন্তর পরিশুদ্ধ করতে হলে উল্লিখিত বদ্ খাছলতসমূহ অন্তর থেকে দূর করে নেক খাছলত সমূহ অন্তরে পয়দা করতে হবে।  তাই শুধুমাত্র মুহ্লিকাত ও মুনজিয়াতের তারীফ, সবব, আলামত ও এলাজ মুখস্ত করলেই বা তার পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করলেই অন্তরের ব্যধি থেকে মুক্তি পাওয়া বা ইলমে তাসাউফ অর্জন করা সম্ভব নয়। বরং সাথে সাথে ক্বালবী যিকির করা বা তরীক্বার সবক সমূহ আদায় করা একান্ত কর্তব্য। তবেই ইছলাহ্ বা পরিশুদ্ধতা লাভ করা সম্ভব, যেমন- কোন রোগী যদি ডাক্তারের দেয়া ব্যবস্থাপত্রের শুধু নিয়ম-কানুনই মুখস্ত করে কিন্তু সে অনুযায়ী ওষুধ না খায়, তবে সুস্থতা লাভ করতে পারবে না।
বিশেষ করে ক্বলবী যিকির ব্যতীত অন্তর পরিশুদ্ধ করা অর্থাৎ মুহ্লিকাত বর্জন ও মুনজিয়াত অর্জনসহ হুজুরী অর্জন করা সম্পূর্ণই অসম্ভব। অথচ নামাজসহ সকল ইবাদত যথাযথ আদায় করতে হলে এবং মহান মহান আল্লাহ পাক উনার খাছ রেজামন্দী হাছিল করতে হলে অন্তর পরিশুদ্ধ করা ও হুজুরী ক্বলব হাছিল অর্থাৎ ক্বলবে দায়েমীভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির জারী করা একান্তই অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ মুবারক করেন,            
يوم لا ينفع مال ولا بنون الا من اتى الله بقلب سليم.
অর্থ : ক্বিয়ামতের দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুষ্টি কোন কাজে আসবেনা, একমাত্র ক্বলবে সালীম বা পরিশুদ্ধ অন্তর ব্যতীত। (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৮-৮৯) আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ মুবারক করেন,
ان فى الجسد مضغة اذا صلحت صلح الجسد كله واذا فسدت فسد الجسد كله الا وهى القلب. 
অর্থ : মানুষের শরীরে এক টুকরো গোশ্ত রয়েছে, যা সংশোধিত হলে গোটা শরীর সংশোধিত হয়। আর যদি তা দূষিত হয়, তবে গোটা শরীরই দূষিত হয়। সাবধান! উক্ত গোশ্তের টুকরাটি হলো- ক্বলব। (বোখারী, মুসলিম, মেশকাত, শরহে নববী, মেরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত, ত্বীবী তালীকুছ্ ছবীহ্, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ্, ফতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, এরশাদুস সারী, তাইসীরুল ক্বারী) আর হুজুরী ক্বলব সম্পর্কে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ্ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
قد افلح المؤمنون الذين هم فى صلا تهم خاشعون.
অর্থ : ঐ মুমিনগণ কামিয়াবী হাছিল করেছে, যারা তাদের নামাজ খুশু খুজু বা হুজুরী ক্বলবের সহিত আদায় করেছে।” (পবিত্র সূরা মুমিনুন শরীফ : পবিত্র আয়ত শরীফ ১-২)
এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
لا صلاة الا بحضور القلب.
অর্থ : হুজুরী ক্বলব বা খুশু খুজু ব্যতীত নামাজ (পূর্ণ) হয়না।  পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যের উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য অন্তর পরিশুদ্ধকরা এবং হুজুরী ক্বলবহাছিল করা অবশ্য কর্তব্য অর্থাৎ ফরজ। আর তজ্জন্য ক্বলবী যিকির বা তরীক্বার সবক সমূহ আদায় করাও ফরয।

পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের দৃষ্টিতে ক্বলবী যিকিরের গুরুত্ব

মূলত অন্তর পরিশুদ্ধ করা ও হুজুরী ক্বলব হাছিল করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে- ক্বলবী যিকিরঅর্থাৎ তাসাউফ তথা মুহ্লিকাত ও মুনজিয়াত সম্পর্কিত ইলম অর্জন করার সাথে সাথে ক্বলবী যিকির করতে হবে। তবেই অন্তর পরিশুদ্ধ হবে এবং হুজুরী ক্বলব অর্জিত হবে এবং নামাজসহ সকল ইবাদত শুদ্ধভাবে বা ইখলাছের সহিত আদায় করা সম্ভব হবে। যার ফলে সকলেই ক্বলবী যিকির করাকে ফরজ বলেছেন। এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
الا بذ كر الله تطمئن القلوب.
অর্থ : সাবধান! মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরের দ্বারাই ক্বলব (অন্তর) ইতমিনান বা পরিশুদ্ধ হয়।” (পবিত্র সূরা রাদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
لكل شئ صقالة وصقالة القلوب ذكر الله.
অর্থ : সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, “প্রত্যেক জিনিস পরিস্কার করার যন্ত্র রয়েছে, আর ক্বলব বা অন্তর পরিস্কার (পরিশুদ্ধ) করার যন্ত্র (মাধ্যম) হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির (ক্বলবী যিকির)।” (বায়হাক্বী শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক্ব) উক্ত আয়াত শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যের দ্বারা বুঝা গেল যে, অন্তর পরিশুদ্ধ করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে- যিকির অর্থাৎ ক্বলবী যিকির।ইমাম-মুজতাহিদ ও হযরত আউলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিমগণ কোরআন- হাদীসের দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করতঃ যিকিরকে দুভাগে ভাগ করেছেন- (১ লিসানী যিকির অর্থাৎ মৌখিক যিকির। (২) ক্বলবী যিকির অর্থাৎ অন্তরের যিকির। লিসানী যিকির হচ্ছে, বিভিন্ন প্রকার তাস্বীহ-তাহ্লীল, দোয়া-দরূদ, কোরআন তিলাওয়াত, ওয়াজ-নছীহত ইত্যাদি। মূলত লিসানী যিকিরের দ্বারা সার্বক্ষণিকভাবে অর্থাৎ দায়েমীভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরে মশগুল থাকা সম্ভব নয়। কারণ উল্লিখিত যিকিরসমূহ সময় ও স্থান বিশেষে করা সম্পূর্ণই অসম্ভব। যেমন- ওযু-এস্তেঞ্জা, খাওয়া-দাওয়া, কথা-বার্তা ও ঘুম ইত্যাদি। অথচ শরীয়তের নির্দেশ হচ্ছে- সার্বক্ষণিক বা দায়েমীভাবে যিকিরে মশগুল থাকার। কারণ বান্দা যে মুহুর্তে বা সময়ে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির থেকে গাফেল বা অমনোযোগী হয়, তখনই শয়তান তাকে ওয়াসওয়াসা দিয়ে পাপ বা নাফরমানীতে লিপ্ত করে দেয়।
যেমন এ প্রসঙ্গে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ومن يعش عن ذكر الر حمن نقيض له شيطانا فهو له قرين وانهم ليصدونهم عن السبيل ويحسبون انهم مهتدون.
অর্থ : যে বা যারা মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির থেকে বিরত (গাফেল) থাকে, আমি (মহান আল্লাহ পাক) তার জন্য একটি শয়তান নিযুক্ত করে দেই। অতঃপর সেই শয়তান তার সঙ্গি হয় এবং তাকে সৎপথ থেকে ফিরায়ে রাখে, অর্থাৎ পাপ কাজে লিপ্ত করে দেয়। অথচ তারা মনে করে, তারা সৎপথেই রয়েছে।” (পবিত্র সূরা যুখরূফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৬)
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন,
الشيطان جاثم على قلب بنى ادم فاذا ذكر الله خنس واذا غفل وسوس.
অর্থ : শয়তান আদম সন্তানের ক্বলবের উপর বসে, যখন সে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির করে, তখন শয়তান পালিয়ে যায়। আর যখন সে যিকির থেকে গাফেল বা অমনোযোগী হয়, তখন শয়তান তাকে ওয়াসওয়াসা দেয়।” (বুখারী শরীফ, মিশকাত শরীফ, ফাতহুল বারী, ওমদাতুল ক্বারী, ইরশাদুস সারী, তাইসীরুল ক্বারী, মিরকাত শরীফ, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, তালীকুছ ছবীহ, মোযাহেরে হক্ব, মিরআতুল মানাজীহ) উক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে বা ব্যাখ্যায় তাফসীরে রুহুল বয়ানে উল্লেখ আছে যে,
فيه اشارة الى ان من دوام على ذكراالرحمن لم يقربه الشيطان بحالقال بعضهم من نسى الله وترك مرا قبته ولم يسخى منه او اقبل على شئ من حظوظ نفسه قيض الله له شطانا يوسوس له فى جميع انفاسه ويغرى نفسه الى طلب هولها حتى يسلط على عقله وعلمه وبيانه.
অর্থ : উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা ইহাই বুঝানো হয়েছে যে, যে ব্যক্তি সর্বদা বা দায়েমীভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকিরে মশগুল থাকে, শয়তান কস্মিনকালেও তার নিকটবর্তী হতে পারেনা। মুফাস্সিরীনে কিরামগণ বলেন, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভুলে যায় বা মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির থেকে গাফেল থাকে এবং নফসের তাড়নায় কোন কিছুর আকাঙ্খা করে, তখন মহান আল্লাহ পাক শয়তানকে তার উপর গালেব করে দেন। শয়তান প্রতি মুহুর্তে তাকে পাপের দিকে ধাবিত করে এবং তার বিবেক ও ইলমের উপর তার রিপুগুলো গালেব (জয়ী) হয়।উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, শুধুমাত্র লেসানী বা মৌখিক যিকিরের দ্বারা অন্তর পরিশুদ্ধ করা ও শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে বেঁচে থাকা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে অন্তর পরিশুদ্ধ করতে হলে বা শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচতে হলে ক্বলবী যিকির করতে হবে। কারণ ক্বলবী যিকিরেই সার্বক্ষনিক বা দায়েমী যিকিরের একমাত্র মাধ্যম। তাই মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে অসংখ্য স্থানে সদা সর্বদা বা দায়েমীভাবে যিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন।
যেমন দায়েমী বা ক্বলবী যিকির সম্পর্কে মহান মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালাম পাক উনার মধ্যে সূরা আরাফ শরীফ উনার ২০৫ নং পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
واذكر ربك فى نفسك تضرعا وخيفة ودون الجهر من القول بالغدو والاصال ولا تكن من الغافلين.
অর্থ : সকাল-সন্ধা স্বীয় অন্তরে সবিণয়ে, সভয়ে, অনুচ্চ আওয়াজে তোমার রবের যিকির (স্মরণ) কর। আর (এ ব্যাপারে) তুমি গাফেলদের অন্তর্ভূক্ত হয়োনা।পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীরে বা ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে খোলাছায়উল্লেখ আছে যে,
کہ مراد ذکر قلبی اور پاس انفاس دوامی ھے-
অর্থ : (উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার) যিকির দ্বারা ক্বলবী যিকির ও সার্বক্ষণিক পাছ-আন ফাস বা শ্বাস-প্রশ্বাস যিকিরকে বুঝানো হয়েছে। উক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুফাস্সির, ইমামুল মুফাস্সিরীন, ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর জগদ্বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে কবীরেউল্লেখ করেন,
 ومن الناس من قال ذكر هذين الوقتين- والمراد مداومة الذكر والمواظبة عليه بقدر الامكان.
অর্থ : কেউ কেউ বলে, শুধুমাত্র সকাল-সন্ধা যিকির করার কথা উক্ত আয়াত শরীফে বলা হয়েছে। মূলতঃ উক্ত আয়াত শরীফের সকাল-সন্ধা যিকির করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- দায়েমী বা সার্বক্ষণিক যিকির এবং সাধ্যানুযায়ী যিকিরে মশগুল থাকা। অনুরূপ তাফসীরে রুহুল বয়ানেও উল্লেখ আছে। দায়েমী বা ক্বলবী যিকির সম্পর্কে পবিত্র পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যের অন্যত্র আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
 يا ايها الذين امنوا اذكرو الله ذكراكثيرا وسبحوه بكرة واصيلا
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক মাত্রায় মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির কর। আর সকাল-সন্ধা উনার তাসবীহ পাঠ কর।” (পবিত্র সূরা আহযাব শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪১-৪২)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় তাফসীরে খোলাছায়উল্লেখ আছে যে,
کھا حضرت ابن عباس رضی ا للہ عنہ نے کہ ھر عبادت محدود ھے اور مجبوری مین عذر مسسوع مگر ذکر نہ اسمین حدھے نہ عذر ھر حال ھر وقت ھر عنوان سے ھر زبان مطلوب و محمود ھے-
অর্থ : যরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, “প্রত্যেক ইবাদতের সীমা নির্ধারিত রয়েছে, তদুপরি তা সম্পন্ন করতে অপারগ হওয়ার ওজর গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যিকিরের জন্য কোন নির্ধারিত সীমা নেই এবং যিকিরের ব্যাপারে অপারগতার কোন ওজরও গ্রহণযোগ্য নয়। যিকির সর্বাবস্থায়, সর্বসময়, সর্ব প্রকারে, যেকোন ভাষায় সমর্থনযোগ্য ও প্রশংসিত।
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় তাফসীরে রুহুল বয়ানেউল্লেখ আছে যে,
 قوله ذكراكشيرا- فى جميع الاوقات ليلا ونهارا صيفا وشتاء وفى عموم الامكنة براوبحرا وسهلا وجبلا وفى كل الاحوال حضرا وسفرا صحة سقما سرا وعلانية قياما وقعوذا وعلى الجنوب.
অর্থ : পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যের এ পবিত্র আয়াত শরীফ অধিক পরিমাণে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির কর।এর দ্বারা দিবা-রাত্রি, সর্বসময়, সর্বঋতুতে, পানি ও স্থলে, মাঠে-পর্বতে, স্বদেশে-প্রবাসে, সুস্থতায়, অসুস্থতায়, প্রকাশ্যে, গোপনে, দন্ডায়মান-উপবেশনে ও শয়নে অর্থাৎ প্রতি অবস্থায় বা দায়েমীভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।          
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় তাফসীরে কবীরেআরো উল্লেখ আছে যে
قوله تعالى بكرة واصيلا- اشارة الى المداومة وذالك لان مريد العموم قد يذكر الطرفين ويفهم منهما الوسط.
অর্থ : পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে পবিত্র আয়াত শরীফ দিবা-রাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির করএর দ্বারা সর্বদা বা দায়েমীভাবে যিকির করার কথা বলা হয়েছে। যদিও সকাল-সন্ধা দিবসের দুই প্রান্তের নাম। কিন্তু এর দ্বারা সমস্ত দিবা-রাত্রকে বুঝা যায়।ক্বলবী বা দায়েমী যিকিরের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কালামুল্লাহ শরীফ উনার আরো ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
الذين يذكرون الله قياما وقعودا وعلى جنو بهم.
অর্থ : যাঁরা দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায় মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির করে (তারাই প্রকৃত জ্ঞানী)।” (পবিত্র সূরা আলে ইমরান শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৯১)
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার তাফসীরে বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে কবীরেউল্লেখ আছে যে,
 عن ابن عباس رضى الله عنه انه قال فى قوله تعالى- الذين يذكرون الله قياما وقعودا وعلى جنوبهم لو حصل لا بن ادم حالة رابعة سوى هذه الاحوال لا مر الله بالذكر عندها- والمراد منه انه تعالى امر بالذكر على الدوام.
অর্থ : হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত দাঁড়ানো, বসা ও শয়ন এ তিন অবস্থা ব্যতীত মানুষের যদি চতুর্থ কোন অবস্থা থাকতো, তবে সে অবস্থায়ও মহান আল্লাহ পাক তাকে যিকির করার নির্দেশ দিতেন। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, উক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা মহান আল্লাহ পাক দায়েমী বা সার্বক্ষণিকভাবে যিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। উক্ত তাফসীরে কবীরে আরো উল্লেখ আছে যে,
 ان يكون المراد كون الانسان دائم الذكر فالاحوال ليست الاهذه الثلاثه.
অর্থ : উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এই যে, মানুষ সর্বদা বা দায়েমীভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির করবে। কেননা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত তিন অবস্থা ব্যতীত মানুষের অন্য কোন অবস্থা নেই।সুতরাং পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যের উল্লিখিত আয়াত শরীফসমূহ ও তার তাফসীর বা ব্যাখ্যার ভিত্তিতে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলো যে, অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও দায়েমী হুজুরী অর্জন করতে হলে অবশ্যই ক্বলবী যিকির করতে হবে। কারণ ক্বলবী যিকির ব্যতীত যেরূপ অন্তরের পরিশুদ্ধতা লাভ করা সম্ভব নয়, তদ্রুপ দায়েমী বা সার্বক্ষণিক হুজুরীও হাছিল করা অসম্ভব। তাই তাফসীরে মাযহারীতে উল্লেখ করা হয়েছে,
دوام الحضور بالقلب اذ لا يتصور دوام الذكر باللسان.
অর্থ : দায়েমী হুযূরী বা যিকির কেবলমাত্র ক্বলবের দ্বারাই সম্ভব। কেননা লেসান বা মুখ দ্বারা দায়েমী বা সার্বক্ষণিকভাবে যিকির করা অসম্ভব।তাই সকলেই তাসাউফের কিতাবসমূহে ক্বলবী যিকিরকরাকে ফরজ বলেছেন। উল্লেখ্য যে, যাদের ক্বলবে যিকির জারী নেই বা যাদের ক্বলব বা অন্তর মহান মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির থেকে গাফেল, তারা মহান মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত থেকে সম্পূর্ণই বঞ্চিত। আর রহমত থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই তারা হয় গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট। অর্থাৎ শয়তানের অনুসারী। যেমন বর্তমানে অনেকেই তথাকথিত পীর সাহেব, শায়খুল হাদীছ, ওয়ায়েজ ও হাদী হওয়া সত্বেও ছবি তোলা, হরতাল-লংমার্চ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ নানাবিধ হারাম ও নাজায়েয কাজে মশগুল। তার একমাত্র কারণ হলো- তাদের অন্তরে যিকির জারি নেই, যার ফলে শয়তান তাদের সঙ্গি হয়ে, ওয়াসওয়াসা দিয়ে এ সকল হারাম কাজগুলো করাচ্ছে। তাই মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে পাক উনার মধ্যে এ ধরণের লোক অর্থাৎ যাদের ক্বলব মহান আল্লাহ পাক উনার যিকির থেকে গাফেল বা যাদের ক্বলবে যিকির জারি নেই, তাদেরকে অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ তাদের অনুসরণ করার অর্থই হচ্ছে- শয়তানকে অনুসরণ করা।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক করেন,
ولا تطع من اغفلنا قلبه عن ذكرنا واتبع هواه وكان امره فرطا
অর্থ : সেই ব্যক্তিকে অনুসরণ করোনা, যার ক্বলবকে আমার যিকির থেকে গাফেল করেছি অর্থাৎ যার ক্বলবে আমার যিকির নেই। সে নফস (শয়তান)কে অনুসরণ করে। তাই তার কাজগুলো (আমলগুলো) শরীয়তের খেলাফ।” (পবিত্র সূরা কাহাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)
অতএব, বুঝা গেল যে, ক্বলবী যিকির ব্যতীত পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা ও শয়তানী ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচা আদৌ সম্ভব নয়। কাজেই মহান আল্লাহ পাক উনার রহমত প্রাপ্তির মাধ্যমে হক্ব মত-পথে ক্বায়েম থেকে মহান আল্লাহ পাক উনার  সন্তুষ্টি বা নৈকট্য লাভ করার ক্বলবী যিকিরই একমাত্র মাধ্যম। এ প্রসঙ্গে জামিউল উছূলনামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে,
 اعلم ان الذكر هو العمدة فى هذا الطريق فلايصل احد الى الل الا بدوام ذكره وهو ما موربه وثابة بالا دلة الكشيرة.
অর্থ : জেনে রাখ, মহান আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে (ক্বলবী) যিকিরই হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতী বা মাধ্যম। দায়েমী বা ক্বলবী যিকির ব্যতীত মহান মহান আল্লাহ পাক উনার নৈকট্য বা সন্তুষ্টি অর্জন করা মোটেও সম্ভব নয়। আর দায়েমী বা ক্বলবী যিকির করা মহান আল্লাহ পাক উনারই নির্দেশ, যা অসংখ্য, অগণিত দলীল দ্বারা প্রমাণিত। উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা দ্বারা অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য অন্তর পরিশুদ্ধ করা ফরজ। আর তজ্জন্য অন্ততঃ ফরয পরিমাণ ইলমে তাসাউফ অর্জন করা ও হুজুরী ক্বলব হাছিল করার জন্য ক্বলবী যিকির করা ফরয।
[বি : দ্র : ৬৪নং সুওয়ালের অবশিষ্ট জাওয়াব পরবর্তী সংখ্যায় আসবে ইনশাআল্লাহ।] (অসমাপ্ত)

0 Comments: