হুযুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পবিত্র জীবনী মুবারক । (পর্ব- ৩৭৮-৪৮০) (জ)


হযরত আম্মার রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত সুহাইব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাদের ইসলাম গ্রহণ
হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমান হন। তিনি বনূ মাখযুম ইবনে ইয়াকাযার মিত্র ছিলেন। হযরত ইবনে হিশাম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু  তিনি মাযহাজ গোত্রভূক্ত।
হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, বনু তায়ম ইবনে মুররা গোত্রের মিত্র নামর ইবনে কাসিতের বংশধর হযরত সুহাইব ইবনে সানানা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু।
হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, হযরত আরকাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার গৃহ মুবারকের দরজা মুবারকে হযরত সুহাইল ইবনে সানানা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সাথে আমার সাক্ষাত হলো। আর আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেই হুজরা শরীফ-এর ভিতরে ছিলেন। আমি হযরত সুহাইব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার ইচ্ছা ও আকাঙ্খা কি? হযরত সুহাইব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনিও আমাকে একই প্রশ্ন করলেন, আপনার কি ইচ্ছা? আমি বললাম, আমার ইচ্ছা হলো নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত শরীফ-এ উপস্থিত হয়ে উনার কথা-বার্তা মুবারক শুনা। সুতরাং আমরা দু’জনই আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূল পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত শরীফ-এ হাযির হই। উনার কথা মুবারক শ্রবণ করি এবং তিনি আমাদেরকে ঈমান আনার জন্য দাওয়াত দেন। আমরা বিলম্ব না করে উনার নিকট ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়ে যাই। সুবহানাল্লাহ!
(সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১ম খ- ১৬১ পৃষ্ঠা, সীরাতুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত লেখায় হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সংক্ষিপ্তভাবে ইসলাম গ্রহণের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও আরো অসংখ্য হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম রয়েছেন যাদের আলোচনা আমরা এখানেই উল্লেখ করেনি। শুধু মাত্র ইসলামের প্রাথমিক যুগে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন উনাদের মধ্যে কয়েকজন বিশেষ বিশেষ ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের আলোচনা করেছি। মুজাদ্দিদে আ’যম, গাউছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আউলিয়া মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি ফয়েজ তায়াজ্জুহ দিয়ে ও দয়া ইহসান করলে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের জীবনী মুবারক পর্বে আমরা ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা করবো।
(সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১ম খ- ১৬১ পৃষ্ঠা, সীরাতুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
হযরত আমর ইবনে আবাসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার ইসলাম গ্রহণ :
হযরত আমর ইবনে আবাসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, শুরু থেকেই আমার মূর্তি পূজার প্রতি ঘৃণা ও অনীহা ছিলো। আর এটাও বুঝতাম যে, এ মূর্তি উপকার কিংবা অপকার করার প্রকৃতই অধিকারী নয়, এ কেবলই পাথর। একদা আমি আহলে কিতাবের আলিমদের মধ্যে এক আলিমের নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সর্বপ্রথম সর্বোন্নত ও সর্বোত্তম বা সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম কোনটি? ওই আলিম তিনি বললেন, পবিত্র মক্কা শরীফ-এ ওই ব্যক্তি প্রকাশিত হবেন, যিনি আগমন করে মানুষকে মূর্তিপূজা থেকে মহান আল্লাহ পাক উনার দিকে আহ্বান করবেন। সর্বাপেক্ষা উত্তম ও সর্বোন্নত দ্বীনই হচ্ছে উনার। সুবহানাল্লাহ! হযরত আমর ইবনে আবাসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, ওই সময় থেকে সদা-সর্বদা পবিত্র মক্কা শরীফকে খেয়াল করতাম। ছোট-বড় সবার কাছেই পবিত্র মক্কা শরীফ-এর খোঁজ-খবর নিতাম। শেষ পর্যন্ত আমি আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আগমনের সুসংবাদ পেলাম। এ বর্ণনা মু’জামে তিবরানী’ ও ‘দালাইলে আবূ নুয়াইম’-এ উল্লেখ রয়েছে।
হযরত আমর ইবনে আবাসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত শরীফ প্রকাশের খবর পাওয়ার পর আমি পবিত্র মক্কা শরীফ-এ গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং অত্যন্ত গোপনে উনার দীদার মুবারক অর্জন করলাম। আমি আদবের সাথে প্রশ্ন করলাম, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি মহান আল্লাহ পাক উনার নবী ও রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আমি বললাম, মহান আল্লাহ পাক তিনি কি আপনাকে পাঠিয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি প্রশ্ন করলাম, মহান আল্লাহ পাক আপনাকে কি পয়গাম দিয়ে প্রেরণ করেছেন? তিনি ইরশাদ করলেন, মহান আল্লাহ পাক উনাকে একক হিসেবে মানা হোক, উনার সাথে কোনো কিছুকে শরীক না করা হোক, মূর্তিগুলোকে ভাঙ্গা হোক আর আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা হোক। আমি বললাম, এ ব্যাপারে কে আপনার সাথে রয়েছেন? তিনি বললেন, এক আযাদ ও এক গোলাম অর্থাৎ সাইয়্যিদুনা হযরত আবু বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস সালাম ও হযরত বিলাল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনারা। আমি বললাম, আমি আপনার অনুগত, অনুসারী ও সাহায্যকারী হতে চাই। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, এখন আপনি নিজ দেশে ফিরে যান, যখন চতুর্দিকে বিজয়ের সংবাদ শুনতে পাবেন তখন আপনি আমার নিকট চলে আসবেন। হযরত আমর ইবনে আবাসা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি মুসলমান হয়ে নিজ দেশে ফিরে এলেন এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সংবাদাদি নিতে লাগলেন।
যখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হিজরত করে মদীনা শরীফ-এ তাশরীফ নিলেন, তখন আমি উনার খিদমত শরীফ-এ উপস্থিত হয়ে আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে চিনতে পেরেছেন কি? তিনি ইরশাদ করলেন, আপনিতো ওই ব্যক্তি যে মক্কা শরীফ-এ আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। আমি আরয করলাম, জ্বি হ্যাঁ! ইয়া হাবীবাল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আমাকে কিছু তা’লীম দিন ......।
(ছহীহ মুসলিম, মুছনাদে আহমদ, সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১ম খ- ১৬১ ও ১৬২ পৃষ্ঠা)


আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার প্রসার:
সাধারণ, অসাধারণ নির্বিশেষে সকল স্তরের জিন-ইনসানের প্রতি তাওহীদ ও রিসালতের অমীয় বাণী পৌঁছানো, ধৈর্য ধারণ ও স্থিরতা অবলম্বন। মূর্খ, সত্যদ্রোহী ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের নিকট সমস্ত সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণাদি পৌঁছার পরও তাদের অবাধ্যতার প্রবণতাকে উপেক্ষা করার জন্য নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি প্রেরিত হন। বিশেষ করে আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মা’রিফত ও মুহব্বত জিন-ইনসানকে শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি। সুবহানাল্লাহ!
মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ করেন-
وَأَنذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ - وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ - فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تَعْمَلُونَ - وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ - الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُومُ - وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ - إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
অর্থ: “আপনি আপনার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদেরকে সতর্ক করুন। আর যারা আপনার অনুসরণ করে সেই সমস্ত ঈমানদারদের প্রতি আপনি বিনয়ী হোন। তারা যদি আপনার অবাধ্যতা করে তবুও তাদেরকে বলুন যে, তোমরা যা কিছু করো তার জন্য আমি দায়ী নই। আপনি ভরসা করুন পরাক্রমশালী পরম দয়ালু মহান আল্লাহ পাক উনার উপর। যিনি আপনাকে দেখে থাকেন যখন আপনি দ-ায়মান থাকেন নামাযের মধ্যে এবং দেখেন আপনাকে সিজদাকারী রূপে উঠা বসা করতে। নিশ্চয়ই তিনি তো সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (সূরা শুআরা : আয়াত শরীফ ২১৪-২২০)
অর্থাৎ যখন واندز عشيرتك الاقربين (আপনি আপনার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদের সতর্ক করুন) এ আয়াত শরীফ নাযিল হলো তখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি স্বীয় আত্মীয়-স্বজন তথা কুরাইশগণদের সকলকে ভয় প্রদর্শন করতে লাগলেন।
এ সম্পর্কে হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ রয়েছে,
عن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنهما قال لما أنزل الله (وأنذر عشيرتك الأقربين) أتى النبى صلى الله عليه وسلم الصفا فصعد عليه ثم نادى ياصباحاه فاجتمع الناس اليه بين رجل يجئ اليه وبين رجل يبعث رسوله صلى الله عليه وسلم. فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم يابنى حضرت عبد المطلب عليه السلام يا بنى فهر، يابنى كعب أرأيتم لو أخبرتكم أن خيلا بسفح هذا الجبل تريد أن تغير عليكم صدقنمونى؟ قالوا نعم! قال فانى نذيرلكم بين يدى عذاب شديد فقال أبولهب- لعنه الله- تبالك سائر اليوم أما دعوتنا إلا لهذا؟ وأنزل الله عزوجل (تبت يدا أبى لهب وتب) سورة اللهب
অর্থ: “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা উনার থেকে বর্ণিত রয়েছে। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন واندز عشيرتك الاقربين ‘আপনার নিকটাত্মীয়-স্বজনদের সতর্ক করুন’ আয়াত শরীফ নাযিল করলেন, তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাফা পাহাড়ের উপরে আরোহণ করে উচ্চ কণ্ঠ মুবারক-এ ঘোষণা দিলেন, ইয়া ছাবাহা (প্রভাতকালীন বিপদ)! কুরাইশরা সবাই এই ডাক মুবারক শুনে সবাই উনার নিকট উপস্থিত হলেন। কেউ কেউ নিজেরা হাযির হলেন, আবার কেউ প্রতিনিধি পাঠালেন। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাদেরকে বললেন, হে আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম উনার বংশধরগণ! হে ফিহরের বংশধরগণ! হে কা’বা-এর বংশধরগণ! আমি যদি বলি এই পাহাড়ের অপরদিকে শত্রু পক্ষ রয়েছে; তারা তোমাদের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত। তোমরা কি আমার কথা মুবারক সত্য বলে বিশ্বাস করবে? সকলে বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই বিশ্বাস করবো। তখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি আসন্ন কঠিন (জাহান্নামের) শাস্তির ব্যাপারে।”
সব কিছু শুনে আবু লাহাব (মহান আল্লাহ পাক তার উপর লা’নত বর্ষণ করুন) বিকট চিৎকার করে বলে উঠলো সারা দিন ধরে আপনার জন্যে ধ্বংস আর দুর্ভোগ নেমে আসুক। নাঊযুবিল্লাহ! আমাদেরকে কি এজন্যে ডেকেছেন? এর পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি সূরা লাহাব নাযিল করলেন।
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩য় জিলদ ৩৮ পৃষ্ঠা, তাফসীরে মাযহারী, বাগবী, ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত ইমাম মুসলিম রহমতুল্লাহি আলাইহি উনারা হযরত আ’মাশ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সূত্রে অনুরূপ হাদীছ শরীফ বর্ণনা করেছেন।)

بسم الله الرحمن الرحيم
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ - مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ - سَيَصْلَى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ - وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ - فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ
অর্থ: মহান আল্লাহ পাক উনার নাম মুবারক নিয়ে শুরু করছি যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়।
 (১) আবূ লাহাবের দু’হাত ধ্বংস হলো এবং সে নিজেও ধ্বংস হলো। (২) কোনো কাজে আসবে না বা কোনো ফায়দা দিবে না তার আল-আওলাদ, মাল-সম্পদ; যা কিছু সে উপার্জন করেছে। (৩) অচিরেই বা অতিশীঘ্রই সে শিখাবিশিষ্ট আগুনে প্রবেশ করবে। (৪) এবং তার স্ত্রীও যে কাঠ বা লাকড়ি বহনকারিনী। (৫) তার গলায় রশি থাকবে, যা খেজুর গাছের ছাল বা বাকলের দ্বারা তৈরি। (সূরা লাহাব)
উল্লেখ্য যে, সূরা লাহাবের শানে নুযূল সম্পর্কে বলা হয়, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহন আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে তিন বৎসর অপ্রকাশ্যভাবে ইসলাম প্রচার করেন। এরপর মহান আল্লাহ পাক তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের কথা বলেন। তখন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট আরজ করলেন, কাদের কাছে প্রথম ইসলাম প্রচার করবো। এর জাওয়াবে মহান আল্লাহ পাক তিনি বললেন, আপনার যারা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন তাদের নিকট প্রচার করুন। সে নির্দেশ মুতাবিক মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কুরাইশবাসী বিশেষ করে হযরত আবদে মান্নাফ ও হযরত আবদে মুত্তালিব আলাইহিমুস্ সালাম উনাদের গোত্রদেরকে সাফা পাহাড়ের নিকট ডেকে ও জমা করে বললেন, আমি যদি আপনাদেরকে বলি, একদল শত্রু পাহাড়ের অপর পাশে অবস্থান করছে যারা সকাল বা সন্ধ্যায় যে কোনো সময় আপনাদেরকে আক্রমণ করতে পারে; এটা কি আপনারা বিশ্বাস করবেন?  তারা সকলেই বলে উঠলো, হ্যাঁ। আমরা অবশ্যই আপনাকে বিশ্বাস করি। কারণ আপনি হলেন চরম সত্যবাদী বা আল আমীন। আপনি জীবনে সত্যের খিলাফ বলেননি। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে দোযখের কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি। তোমরা এক মহান আল্লাহ পাক উনাকে মানো এবং সকল প্রকার মূর্তিপূজা, যা কুফরী-শিরকীর অন্তর্ভুক্ত, তা ছেড়ে দাও। তখন কুরাইশদের কেউ কেউ মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গেল, কেউ কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কেউ কেউ নানা রকম মন্তব্য করতে লাগলো। এর মধ্যে আবূ লাহাব বলে উঠল, আপনি কি এই জন্যে আমাদেরকে জমা করেছেন? আপনার ধ্বংস হোক। নঊযুবিল্লাহ। এটা বলে সে ইট-পাটকেল মারার জন্য উদ্যত হলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ পাক তিনি সূরা লাহাব নাযিল করেন।
          অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি রাত্রি বেলায় আবূ লাহাবের বাড়িতে গিয়ে বললেন, তুমি দিনের বেলায় প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করতে লজ্জাবোধ করো সে জন্য আমি বলছি, তুমি রাত্রি বেলায় চুপে চুপে ইসলাম গ্রহণ করো। তখন আবূ লাহাব তার সামনে একটি ছাগি সাবক ছিল সেটাকে উদ্দেশ্য করে বললো, এটা যদি ঈমানের কথা স্বীকার করে তাহলে সে ঈমান আনবে। তখন মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেই সাবকটাকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি কি আমাকে চেন, আমি কে? তখন সেই সাবকটির জবান খুলে গেলো। সে মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনর উপর ঈমান আনলো। তখন আবূ লাহাব গোস্বায় বলে উঠলো, এ সাবকটির প্রতি জাদু করা হয়েছে এবং সাথে সাথে সাবকটিকে সে হত্যা করল এবং বললো, এটা ধ্বংস হওয়ারই উপযুক্ত। তখন মৃত সাবকটি বলে উঠলো, তোমার ধ্বংস হোক। এর পরিপ্রেক্ষিতে সূরা লাহাব নাযিল হয়েছে।  (তরজমায়ে মুজাদ্দিদে আ’যম আলাইহিস সালাম)
হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত রয়েছে,
عن حضرت أبى هربرة رضى الله تعالى عنه. قال لما نزلت هذه الا ية (وأنذر عشيرتك الاقربين) دعا رسول الله صلى الله عليه وسلم قريشا فعم وخص. فقال يامعشر قريش أنقذوا أنفسكم من النار، يامعشر بنى كعب أنقذوا أنفسكم من النار، يامعشربنى هاشم أنقذوا أنفسكم من النار، يا معشر حضرت بنى عبد المطلب عليه السلام انقذوا انفسكم من النار،.... فانى والله لا أملك لكم من الله شيئا إلا أن لكم رحما سأبلها ببلائها.
অর্থ: “হযরত আবূ হুরাইরা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন এই আয়াত শরীফখানা নাযিল হলো
واندز عشيرتك الاقربين
(আপনি আপনার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদের সতর্ক করুন) তখন সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসারীন, খতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  তিনি কুরাইশ বংশের সাধারণ অসাধারণ নির্বিশেষে সকলকে ডাকলেন। তারপর বললেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আপনারা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন। হে কা’ব-এর বংশধরগণ! আপনারা জাহান্নাম থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করুন। হে বনী হাশিম-এর বংশধরগণ! আপনারা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন। হে আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম উনার বংশধরগণ! আপনারা নিজেদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন .........। মহান আল্লাহ পাক উনার পাকড়াও থেকে আপনাদেরকে রক্ষা করার কেউ নেই। তবে আপনাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। আমি ওই আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখবো।” ইনশাআল্লাহ!
(আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩য় জিলদ ৩৮ পৃষ্ঠা, তাফসীরে মাযহারী, ইবনে কাছীর, বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ, মুসনাদে আহমদ ইত্যাদি)
হাদীছ শরীফ-এ আরো বর্ণিত রয়েছে,
وقال حضرت الحافظ أبوبكر البيهقى رحمة الله عليه فى الدلائل عن حضرت على بن أبى طالب عليه السلام. قال لما نزلت هذه الا ية على رسول الله صلى الله عليه وسلم (وأنذر عشيرتك الاقربين، وأخفض جناحك لمن اتبعك من المؤمنين). قال رسول الله صلى الله عليه عرفت انى إن بادأت بها قومى رأيت منهم ما أكره، فصمت. فجاءنى حضرت جبريل عليه السلام فقال يامحمد صلى الله عليه وسلم إن لم تفعل ما أمرك به ربك عذبك بالنار.  
قال فدعانى فقال يا حضرت على عليه السلام إن الله قد أمرنى أن أنذر عشيرتى الاقربين فاصنع لنا يا حضرت على عليه السلام شاة على صاع من طعام، وأعد لنا عس لبن، ثم اجمع لى بنى عبد المطلب عليه السلام ففعلت فاجتمعوا له يومئذ وهم أربعون رجلا بزيدون رجلا أو ينقصون فيهم أعمامه أبو طالب، وحضرت حمزة عليه السلام وحضرت العباس عليه السلام، وأبولهب الكافر الخبيث. فقدمت اليهم تلك الجفنة، فاخذ رسول الله صلى الله عليه وسلم منها حذية فشقها باسنانه ثم رمى بها فى نواحيها وقال كلوا بسم الله. فاكل القوم حتى نهلوا عنه ما نرى إلا اثر أصابعهم،
অর্থ: হযরত হাফিয আবু বকর বাইহাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার দালাইল গ্রন্থে বলেন, হযরত আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
وأنذر عشيرتك الاقربين، وأخفض جناحك لمن اتبعك من المؤمنين
(আপনার নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদেরকে সতর্ক করুন। আর যাঁরা আপনার অনুসরণ করে তাঁদের প্রতি আপনি বিনয়ী হোন) উক্ত আয়াত শরীফখানা যখন নাযিল হয় তখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আমি তাদেরকে এই কথা বললে কি অপ্রীতিকর আচরণ আমি তাদের পক্ষ থেকে পাবো, তা আমার সবই জানা ছিলো। তাই আমি নীরব থাকি। অতঃপর হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি আমার নিকট আসলেন এবং আমাকে বললেন, ইয়া হাবীবাল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার রব মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন আপনি তা পালন করুন। অর্থাৎ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি অবশ্যই মহান আল্লাহ পাক তিনি যা বলেন তাই করেন যাতে বিন্দু মাত্র সন্দেহ নেই।
হযরত আলী আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, তখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাকে ডেকে বললেন, হে হযরত আলী আলাইহিস সালাম! মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমার নিকটাত্মীয়দেরকে আমি যেনো সতর্ক করি। সুতরাং হে হযরত আলী ইবনে আবু ত্বালিব আলাইহি সালাম! আপনি এক সা’ তথা সোয়া তিন কেজি পরিমাণ খাদ্যের সাথে একটি বকরী রান্না করে আর একটি পাত্র ভর্তি দুধের ব্যবস্থা করুন। তারপর হযরত আব্দুল মুত্তালিব আলাইহি সালাম উনার বংশধরগণকে আমার নিকট সমবেত করুন। আমি তাই করলাম। উনারা সবাই সেদিন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট উপস্থিত হলেন। উনারা সংখ্যায় ছিলেন নূন্যতম ৪০ জন। উপস্থিত লোকদের মধ্যে আখিরী নবী, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চাচাগণ আবু ত্বলিব, হযরত হামযা আলাইহিস সালাম, হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম এবং কাফির খবীছ আবু লাহাবও ছিলো। খাদ্যের গামলাটি আমি তাদের সামনে উপস্থিত করি। সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এক টুকরা গোশত নিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়িয়ে ছিড়ে তা পাত্রের চারিপার্শ্বে ছিটিয়ে দিলেন এবং সবাইকে বললেন, ‘বিসমিল্লাহ’ বলে সবাই খাওয়া শুরু করুন। সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিলেন এবং সেখান থেকে উঠলেন। তখন পাত্রে আমরা উনাদের আঙ্গুলের চিহ্নগুলো দেখতে পেলাম।
والله إن كان الرجل ليأكل مثلها. ثم قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اسقهم يا حضرت على عليه السلام فجئت بذلك القعب فشربوا منه حتى نهلوا جميعا وايم الله إن كان الرجل ليشرب مثله. فلما أراد رسول الله صلى الله عليه وسلم أن يكلمهم بدره أبو لهب لعنه الله فقال لهد ما سحركم صاحبكم، فتفرقوا ولم يكلمهم رسول الله صلى الله عليه وسلم فلما كان من الغد قال رسول الله صلى الله عليه وسلم عدلنا مثل الذى كنت صنعت لنا بالامس من الطعام والشراب، فان هذا الرجل قد بدر الى ما سمعت قبل أن أكلم القوم. ففعلت ثم جمعتهم له وصنع رسول الله صلى الله عليه وسلم كما صنع بالامس، فاكلوا حتى نهلوا عنه وايم الله إن كان الرجل ليأكل مثلها. ثم قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أسقهم يا حضرت على عليه السلام، فجئت بذلك القعب فشربوا منه حتى نهلوا جميعا وايم الله إن كان الرجل منهم ليشرب مثله فلما أراد رسول الله صلى الله عليه و سلم أن يكلمهم، بدره أبولهب امنه الله إلى الكلام فقال لهد ما سحركم صاحبكم؟ فتفرقوا ولم يكلمهم رسول الله صلى الله عليه وسلم.
মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! যে পরিমাণ খাদ্য প্রথমে পাত্রে ছিলো উনাদের একজনেই খেয়ে শেষ করতে পারতেন। মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হযরত আলী আলাইহি সালাম! সকলকে দুধ পান করান। আমি দুধের পাত্র উপস্থিত করলাম। সবাই তৃপ্তি সহকারে দুধপান করলেন। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! উনাদের একজনেই ওই পরিমাণ দুধ খেয়ে ফেলতে পারতেন। এবার আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাদের উদ্দেশ্যে উনার কথা মুবারক বলার ইচ্ছা করলেন। তার পূর্বেই আবু লাহাব কথা বলা শুরু করলো। সে বললো, আপনাদের মধ্যে এই ব্যক্তি তিনি যে জাদু দেখিয়েছেন তা অত্যন্ত শক্তিশালী বটে। নাঊযুবিল্লাহ! এ কথা বলার পর সবাই চলে গেলেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আর কথা বললেন না।
পরের দিন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হযরত আলী আলাইহিস সালাম! গতকাল যেরূপ খাদ্য পানীয় প্রস্তুত করেছিলেন আজও তেমন তৈরি করুন। আমি কথা বলার আগে ওই আবু লাহাব লোকটা কি বলে গেলো তা তো আপনি শুনেছেন। আমি খাদ্য পানীয় তৈরি করলাম এবং সবাইকে একত্র করলাম। পূর্বের দিন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা করলেন এ দিনও তাই করলেন। উনারা সবাই তৃপ্তি সহকারে খাওয়া শেষ করে হাসিমুখে উঠলেন। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! তাদের একজন লোকেই ওই পরিমাণ খাদ্য খেয়ে শেষ করতে পারতেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হযরত আলী আলাইহিস সালাম! তাদেরকে দুধপান করান। আমি দুধের পাত্র দিলাম। উনারা সবাই তৃপ্তি সহকারে দুধ পান করে হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! তাদের একজনেই এই পরিমাণ দুধ পান করে ফেলতে পারতেন। এরপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কথা মুবারক বলতে উদ্যত হলেন। তার পূর্বেই আবু লাহাব কথা বলে উঠলো। সে বললো, আপনাদেরকে এ ব্যক্তি তিনি যে জাদুর ব্যবস্থা করেছেন তা প্রচ- শক্তিশালী বটে। নাঊযুবিল্লাহ! এ কথা শুনে সবাই চলে যান। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি এদিনও উনাদের সাথে কথা বললেন না।
فلما كان من الغد قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا حضرت على عليه السلام عد لنا بمثل الذى كنت صنعت بالامس من الطعام والشراب فان هذا الرجل قد بدرنى إلى ما سمعت قبل أن أكلم القوم. ففعلت ثم جمعتهم له. فصنع رسول الله صلى الله عيله وسلم كاصنع بالامس فاكلوا حتى نهلوا عنه، ثم سقيتهم من ذلك القعب حتى نهلوا، وايم الله إن كان الرجل ليأ كل مثلها وليشرب مثلها. ثم قال رسؤل الله صلى الله عليه وسلم. يابنى عبد المطلب عليه السلام إنى والله ما أعلم شابا من العرب جاء قومه بافضل من ما جئتكم به إنى قد جئتكم بأمر الدنيا والا خرة.
পরের দিন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হযরত আলী আলাইহিস সালাম! পূর্বের দিনের ন্যায় খাদ্য পানীয় প্রস্তুত করুন। আমি কথা বলার পূর্বে কি বলেছে তাতো আপনি শুনেছেন। আমি অনুরূপ খাদ্য পানিও প্রস্তুত করে তাদের সবাইকে সমবেত করলাম। পূর্বের দিন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যা করেছিলেন এদিনও তা করলেন। তারা খাওয়া শেষে হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালেন। এরপর আমি উনাদের দুধ পান করালাম। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! উনাদের একজনেই ওই দুধ পান করে ফেলতে পারতেন।
এরপর সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন, খতামুন নাবিইয়ীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, হে হযরত আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম উনার বংশধরগণ! আমি আপনাদের নিকট যা নিয়ে এসেছি কোনো আরব যুবক তার সম্প্রদায়ের নিকট তার চাইতে বেশি কিছু নিয়ে এসেছে বলে আমার জানা নেই। দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণকর বিষয় নিয়ে আমি আপনাদের নিকট এসেছি।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩য় জিলদ ৩৯ পৃষ্ঠা)
অন্য হাদীছ শরীফ-এ হযরত ইমাম বায়হাক্বী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম উনার থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে এ বর্ণনায় আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
إنى قد جئتكم بخير الدنيا والا خرة، وقد أمرنى الله أن أدعوكم اليه، فايكم يؤازرنى على هذا الأمر على أن يكون أخى وكذا وكذا قال فاحجم القوم عنها جميعا، وقلت ولأنى لأحدثهم سنا وأرمشهم عينا، وأعظمهم بطنا، وأخمثهم ساقا، أنا يا نبى الله صلى الله عليه و سلم أكون وزيرك عليه فاخذ برقبتى فقال إن هذا أخى وكذا وكذا فاسمعوا له وأطيعوا. قال فقام القوم يضحكون ويقولون لابى طالب قد أمرك أن تسمع لابنك وتطيع.
আমি তোমাদের নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণ নিয়ে এসেছি।” এরপর এতটুকু অতিরিক্ত রয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেনো আপনাদেরকে উনার প্রতি আহ্বান করি। সুতরাং এ বিষয়ে আপনাদের মধ্যকার কে আমার খিদমত করবেন? তাহলে ওই ব্যক্তি আমার ছাহাবী হিসেবে গণ্য হবেন। তিনি এভাবে আরো কিছু কথা বললেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কথা মুবারক শুনে কেউই কোনো জবাব দিলেন না। হযরত আলী আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আমি সেখানে সবার চাইতে বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলাম। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তো। আমার পেট ছিলো একটু বড়ো এবং পায়ের গোছা ছিলো চিকন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমি হবো আপনার খাদিম। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমার ঘাড়ে হাত মুবারক রেখে বললেন, হে আমার ভাইয়েরা! আপনারা উনার কথা শুনবেন, উনার নির্দেশ মতো চলবেন। এরূপ শুনে লোকজন হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। আর আবূ ত্বলিব উনাকে ওই সব লোকজন বলতে লাগলো যে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তো আপনায় নির্দেশ দিলেন আপনার পুত্রের কথা শুনতে আর নির্দেশ পালন  করতে।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩য় জিলদ ৪০ পৃষ্ঠা)
হাদীছ শরীফ-এ এসেছে,
قال حضرت على عليه السلام لما نزلت هذه الا ية (وأنذر عشيرتك الاقربين). قال لى رسول الله صلى الله عليه وسلم. اصنع لى رجل شاة بصاع من طعام- واناء لبنا، وادع لى بنى هاشم فدعوتهم وانهم يومئذ لاربعون غير رجل أوأر بعون ورجل فذكر القصة نحو ما تقدم إلى أن قال وبدرهم رسول الله صلى الله عليه وسلم الكلام. فقال أيكم يقضى عنى دينى ويكون خليفتى فى أهلى؟ قال فكتوا وسكت حضرت العباس عليه السلام، فلما رأيت ذلك قلت أنا يارسول الله عليه و سلم، قال أنت؟ قال وإنى يومئذ لاسوأهم هيئة، وإنى لاعمش العينين، ضخم البطن. خمش الساقين. وهذه الطريق فيها شاهد
অর্থ: হযরত আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম তিনি বলেন,
أنذر عشيرتك الاقربين
(আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন) অত্র আয়াত শরীফখানা যখন নাযিল হলো, তখন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আমাকে বললেন, এক সা’ খাদ্যের মধ্যে একটি বকরীর রান রান্না করুন। আর এক পাত্র দুধের ব্যবস্থা করুন এবং হাশিম গোত্রের লোকজন সবাইকে আমার নিকট ডেকে নিয়ে আসুন। আমি সবাইকে ডেকে আনলাম। তাদের সংখ্যা ছিলো ৩৯ কিংবা ৪১ জন। অতঃপর পূর্বোক্ত হাদীছ শরীফ-এ বর্ণিত ঘটনার ন্যায় বর্ণনা করলেন। তবে শেষে এতটুকু অতিরিক্ত যোগ করলেন যে, অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তাদের সাথে আলাপ আলোচনার সূচনা করলেন এবং বললেন, আপনাদের মধ্যে কে আছেন যে, আমার ঋণগুলো পরিশোধ করবেন এবং আমার পরিবারের প্রতিনিধি হবেন? উপস্থিত কেউই কোনো কথা বললেন না। ঋণ পরিশোধে নিজের সব সম্পদ শেষ হয়ে যাবে এ আশঙ্কায় হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম তিনিও কিছু বললেন না। (ইহা উনার ইসলাম গ্রহাণের পূর্বের কথা) হযরত আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহি সালাম তিনি বলেন, হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম তিনি বয়সে প্রবীণ হওয়ার কারণে উনার সম্মানার্থে আমিও চুপ থাকলাম। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার সে আহ্বানের পুনরাবৃত্তি করলেন। এবারো হযরত আব্বাস আলাইহিস সালাম তিনি নীরব রইলেন। এ অবস্থা দেখে আমি বললাম, আমি আপনার এ দায়িত্ব নিবো ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তখন নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আপনিই হযরত আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম। তিনি বললেন, তখন আমার অবস্থা সবার চেয়ে শোচনীয় ছিলো। আমার দু’চক্ষু বেয়ে পানি পড়তো, পেট ছিলো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়, পায়ের গোছা ছিলো একটু চিকন।” এ হাদীছ শরীফখানা পূর্ববর্তী হাদীছ শরীফ-এর সমর্থক।
হযরত ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার মুসনাদ গ্রন্থে সাইয়্যিদুনা হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল্লাহ আসাদী ও রাবীয়া ইবনে নাজিয রহমতুল্লাহি আলাইহিমা উনাদের সূত্রে সাইয়্যিদুনা হযরত আলী আলাইহিস সালাম উনার থেকে উপরোক্ত হাদীছ শরীফ-এর সমার্থক হাদীছ শরীফ উল্লেখ করেছেন।
من يقضى عنى دينى ويكون خليفتى فى أهلى يعنى إذا مت، وكأنه صلى الله عليه وسلم خشى إذا قام با بلاغ الرسالة إلى مشركى العرب. أن يقتلوه، فاستوثق من يقوم بعده بما يصلح أهله، ويقضى عنه، وقد أمنه الله من ذلك فى قوله تعالى (ياأيها الرسول بلغ ما أنزل اليك من ربك، وإن لم تفعل فما بلغت رسالته والله يعصمك من الناس) الا ية
অর্থ: “আপনাদের মধ্যে কে আছেন, যে আমার ঋণগুলো পরিশোধ করবেন এবং আমার পরিবারে আমার প্রতিনিধিত্ব করবেন”-এ কথা মুবারক দ্বারা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বুঝিয়েছেন যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি যদি আমাকে নিয়ে নেন তখন এই দায়িত্ব পালন করবেন এমন কে আছেন? আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি জানেন যে, কাফির, মুশরিকদের নিকট রিসালতের বাণী পৌঁছাতে গেলে তারা উনাকে শহীদ করতে পারে। তাই তিনি উনার বিদায় অবস্থায় পূতঃপবিত্র আহাল ইয়াল আলাইহিমুস সালাম উনাদের দেখা-শোনা করার জন্যে এবং উনার ঋণ পরিশোধ বিষয় আস্থাভাজন লোকের খোঁজ করছিলেন। অবশ্যই মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সমস্ত প্রকার এরূপ অঘটন থেকে রক্ষা করেছেন।
মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন,
ياأيها الرسول بلغ ما أنزل اليك من ربك، وإن لم تفعل فما بلغت رسالته والله يعصمك من الناس
হে হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার সম্মানিত রব উনার নিকট থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা সর্বত্রই আপনি বর্ণনা করুন। তবে যদি তা না করেন তবে তো আপনি উনার কালাম প্রচার প্রসার করলেন না। মহান আল্লাহ পাক তিনি শত্রুদের থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন। (সূরা মায়িদা : আয়াত শরীফ ৬৭)
والمقصود أن رسول الله صلى الله عليه وسلم استمر يدعو إلى الله تعالى ليلاونهارا، وسرا وجهارا، لا يصرفه عن ذلك صارف ولا يرده عن ذلك راد، ولا يصده عنه ذلك صاد، يتبع الناس فى أنديتهم، ومجامعهم ومحافلهم وفى المواسم، ومواقف الحج. يدعو من لقيه من حر وعبد وضعيف وقوى، وغنى وفقير، جميع الخلق فى ذلك عنده شرع سواء. وتسلط عليه وعلى من اتبعه من احاد الناس من ضعفائهم الأشداء الاقوياء من مشركى قريش بالأذية القولية والفعلية، وكان من أشد الناس عليه عمه أبولهب- واسمه عبد العزى بن عبد المطلب- وامرأته أم جميل أروى بنت حرب بن أمية أخت حضرت أبى سفيان رضى الله تعالى عنه وخالفه فى ذلك عمه أبو طالب بن عبد المطلب، وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم أحب خلق الله اليه طبعا وكان يحنو عليه ويحسن اليه، ويدافع عنه ويحامى، ويخالف قومه فى ذلك مع أنه على دينهم وعلى خلتهم، إلا أن الله تعالى قد امتحن قلبه بحبه حبا طبعيا لا شرعيا.
মোদ্দা কথা, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি রাতে, দিনে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে সদা সর্বদাই সর্বশ্রেণীর মানুষকে মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কোনো বাধা প্রদানকারী উনাকে তা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি বিভিন্ন মাহফিলে, মাজলিসে, সমাবেশে, মেলার মৌসুমে এবং হজ্জের কার্যাদি সম্পাদনের স্থানসমূহে সমবেত লোকদের নিকট গিয়েছেন। মহান আল্লাহ পাক তথা তাওহীদ ও রিসালতের দাওয়াত দেয়ার জন্যে। ধনী-গরিব, স্বাধীন-পরাধীন এবং সবল-দুর্বল যার সাথে উনার সাক্ষাৎ হয়েছে তাকেই তিনি দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াতের ব্যাপারে তিনি কোনোরূপ ভেদাভেদ করেননি।
কুরাইশের সবল ও শক্তিশালী লোকেরা নানা প্রকারের অত্যাচার ও নির্যাতনসহকারে উনার উপর ও উনার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মধ্যে দুর্বল ব্যক্তিগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি সর্বাধিক কঠিন ও কঠোর আচরণকারী ছিলো উনার চাচা আবূ লাহাব ও তার স্ত্রী উম্মু জামীল আরওয়া বিনতে হারব ইবনে উমাইয়া। আবূ লাহাবের মূল নাম আব্দুল উযযা। তার স্ত্রী উম্মু জামীলা সে হলো হযরত আবূ সুফিয়ান আলাইহিস সালাম উনার বোন। চাচা আবূ ত্বলিব তিনি এই ব্যাপারে তার  বিরোধী ছিলেন। বস্তুত আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চাচা আবূ ত্বলিব উনার প্রিয়তম মানুষ ছিলেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ভরণ-পোষণ বা খিদমত শরীফ-এ তিনি অকাতরে অর্থ ব্যয় করতেন। আবূ ত্বলিব তিনি নিজে কুরাইশী ধর্ম মতের অনুসরণকারী হওয়া সত্ত্বেও আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি সহজাত মুহব্বত বা ভালোবাসা দিয়েছিলেন যা দ্বীনি ভালোবাসা নয়।
وكان استمراره على دين قومه من حكمة الله تعالى، ومما صنعه لرسوله صلى الله عليه و سلم من الحماية، إذ لو كان أسلم أبو طالب لما كان له عند مشركى قريش وجاهة ولا كلمة، ولا كانوا يهابونه ويحترمونه. ولا جترؤا عليه، ولمدوا أيديهم وألستهم بالسوء اليه، وربك يخلق ما يشاء ويختار. وقد قسم خلقه أنواعا وأجناسا، فهذان العمان كافران أبو طالب وأبو لهب. ولكن هذا يكون فى القيامة فى ضحضاح من نار، وذلك فى الدرك الأسفل من النار، وأنزل الله فيه سورة فى كتابه تتلى على المنابر، وتقرأ فى المواعظ والخطب. تتضمن أنه سيصلى نارا ذات لهب، وامرأته حمالة الحطب.
আবূ ত্বলিব তিনি একদিকে উনার পূর্বপুরুষের ধর্ম মতে অবিচল থেকেছেন আর অন্যদিকে জানপ্রাণ দিয়ে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন। এ দ্বিমুখী কর্মকা-ের মাঝে নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক উনার কোনো হিকমত নিহিত রয়েছে। কারণ আবূ ত্বলিব তিনি যদি ইসলাম গ্রহণ করতেন, তবে কুরাইশ বংশীয় মুশরিকদের নিকট উনার কোনো প্রকার গুরুত্ব থাকতো না, মহান আল্লাহ পাক তিনি ভালো জানেন। তখন তারা উনাকে ভয় পেতো না। উনাকে সমীহও করতো না। উপরন্তু উনার বিরুদ্ধাচরণের দুঃসাহস দেখাতো এবং মুখে ও কাজে উনার প্রতি অসদাচরনের চেষ্টা করতো। মহান আল্লাহ পাক তিনি তো বলেই দিয়েছেন যে, আপনার রব যা ইচ্ছা করেন এবং যা পছন্দ করেন তাই করে থাকেন।
বস্তুত, মহান আল্লাহ পাক উনার সৃষ্টি জগতকে বিভিন্ন শ্রেণী ও প্রজাতিতে বিভক্ত করেছেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার এই দু’চাচা আবূ ত্বলিব ও আবূ লাহাব। অথচ এই চাচা অর্থাৎ আবূ ত্বলিব তিনি আখিরাতে থাকবেন জাহান্নামের কূপের উপরের প্রান্তে আর ওই চাচা অর্থাৎ আবূ লাহাব থাকবে জাহান্নামের নি¤œতম স্তরে। তার দুর্ভোগের ঘোষণা দিয়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ-এ একটি সূরা নাযিল করেছেন। যে সূরাটি মিম্বরে মিম্বরে পাঠ করা হয়, ওয়াজ নছীহতে উল্লেখ করা হয়। এ সূরার মর্ম এই যে, ওই আবূ লাহাব প্রবেশ করবে শিখাময় অগ্নিতে। তার স্ত্রী কাঠ বহনকারিনীও সেখানে প্রবেশ করবে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩য় জিলদ ৪০ ও ৪১ পৃষ্ঠা)
হাদীছ শরীফ-এ এসেছে,
قال حضرت الامام احمد رحمة الله عليه حدثنا حضرت ابراهيم بن أبى العباس رحمة الله عليه حدثنا حضرت عبد الرحمن بن أبى الزناد رحمة الله عليه عن أبيه. قال أخبر رجل يقال له  حضرت ربيعة بن عباد رضى الله تعالى عنه من بنى الديل- وكان جاهليا فاسلم- قال رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم فى الجاهلية فى سوق ذى المجاز وهو يقول يا أيها الناس قولوا لا إله إلا الله تفلحوا. والناس مجتمعون عليه، ووراءه رجل وضئ الوجه أحول ذو غديرتين يقول إنه صابئ كاذب يتبعه حيث ذهب، فسألت عنه فقالوا هذا عمه أبو لهب
অর্থ : “হযরত ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, হযরত ইবরাহীম ইবনে আবুল আব্বাস রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট বর্ণনা করেন, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আবু যিনাদর রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি। তিনি উনার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমার নিকট বর্ণনা করেছেন এমন এক ব্যক্তি, বলা হয় যিনি বনূ দায়ল গোত্রের হযরত রবীয়া ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু নামক একজন ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেন। উক্ত বর্ণনাকারী যিনি জাহিলিয়াত যুগে অমুসলিম ছিলেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন যে, আমি জাহিলিয়া যুগে একদিন যুলমাজায বাজারে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে দেখতে পাই। তিনি বলেছেন,
يقول يا أيها الناس قولوا لا إله إلا الله تفلحوا.
হে লোকসকল! তোমরা বলো মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত কোনো মা’বুদ নাই। তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।”
আমি দেখেছি যে, লোকজন উনার নিকট সমবেত হয়ে উনার কথা মুবারক শুনলেন। নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পেছনে দেখতে পেলাম একজন লোক, লোকটির মুখম-ল ফ্যাকাশে গৌরবর্ণ, চক্ষু টেরা এবং তার দুটি ঝুঁটি ছিলো। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলো এই ব্যক্তি তিনি হচ্ছেন ধর্মত্যাগী। নাঊযুবিল্লাহ!
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি যেখানে যাচ্ছিলেন লোকটিও উনার পিছনে পিছনে সেখানে যাচ্ছিলো। আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে লোকজন বললো, সে তো উনার চাচা আবূ লাহাব।” (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩য় জিলদ ৪১ পৃষ্ঠা)

0 Comments: