অভিশপ্ত মৃত সাগর কি ?

অভিশপ্ত মৃত সাগর
মুহম্মদ রুহুল হাসান
কয়েক বছর আগেও বৃটিশ বিমানগুলো রীতিমত মৃত সাগরের (DEAD SEA) ওপর দিয়ে উড়ে যেতো। বিমানটি মৃত সাগরের ঠিক উপরে এলেই পাইলট একটি ঘোষণা দিয়ে যাত্রীদের ভড়কে দিতেন। ঘোষণাটি ছিল এ রকম- “যাত্রী মহোদয়, আমরা এখন উড়ে যাচ্ছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ ফিট নীচ উচ্চতা দিয়ে।” সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ ফিট নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়া এও সম্ভব? সত্যি তাই। মৃত সাগর বা উঊঅউ ঝঊঅ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর সবচাইতে নীচু স্থান, প্রায় ১৮০০ ফিট। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর এ স্থানটুকু ধ্বসে গেছে অনেক গভীরে, আর সৃষ্টি হয়েছে এক বিশাল হৃদের। জর্দান এবং ইসরাঈলের কাছেই মৃত সাগরের গভীরতা বেশী, সেখানে মৃত সাগরের তলদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৬০০ ফিট নীচে। ডেডসির অবস্থান হচ্ছে জর্দানের পশ্চিম সীমানার সন্নিকটে এবং ইসরাঈলের পূর্ব-উত্তরদিকে লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত। অর্থাৎ পশ্চিম তীর (ডবংঃ নধহফ)-এর দক্ষিণাংশের দৈর্ঘ্য ৭৭ কিঃমিঃ (৪৮ মাইল) এবং প্রস্থ ৫-১৮ কিঃমিঃ (৩-১১ মাইল) জর্দান এবং ইসরাঈল উভয়েই এই মৃত সাগর ভাগ করে নিয়েছে এবং উভয়েরই দাবী পৃথিবীর সর্বপেক্ষা নীচু স্থান তাদের দিকে। ইসরাঈলের অংশে একটি পোষ্ট অফিস বানিয়ে ওদের দাবী পৃথিবীর সবচাইতে নীচু অংশে ওদের পোষ্ট অফিস সার্ভিস। আর পাশাপাশি জর্দান তাদের অংশে একটি হোটেল বানিয়ে সার্ভিসে ঘোষণা দিচ্ছে, পৃথিবীর সবচাইতে নীচু স্থানে আপ্যায়ন। 
ডেডসি পৃথিবীর সর্বাধিক লবনাক্ত হৃদগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমুদ্র পানির লবণাক্ততা প্রতি হাজার গ্রামে ৩৫ ভাগ, সেখানে ডেডসির লবণাক্ততা হচ্ছে ২৩৮ ভাগ। তাই একে হাইপার স্যালাইন ওয়াটার সি-এর তালিকাভূক্ত করা হয়ে থাকে। ইউটায় অবস্থিত গ্রেট সল্ট লেকের চেয়েও এর লবণাক্ততা বেশী। ডেডসির ভৌগলিক অবস্থান এবং জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্যের কারণে একে মরু সাগর বলে অভিহিত করেছেন বিভিন্ন ভূ-বিজ্ঞানীগণ। উষ্ণ মন্ডলে; অবস্থিত এ ডেডসির চারদিকে শুষ্ক মরু অঞ্চল থাকায় এর বাস্পীয়ভবন (ঊঠঅচঙজঅঞওঙঘ) বেশী। পক্ষান্তরে বৃষ্টিপাত কম এবং নদীদ্বারা সরবরাহকৃত পানির পরিমাণও তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় এর লবণাক্ততার পরিমাণ বেশী। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বহু বছর ধরে জর্দান নদীর পানি এবং অনেক ছোট-বড় ঝর্ণার পানি গড়িয়েছে ডেডসি বা মৃত সাগরের বুকে কিন্তু এ পানির স্রোত ডেডসির মধ্যেই থেমে গেছে। ধারণা করা হয়, প্রতিদিন গড়ে সাত মিলিয়ন টন পানি বাষ্পাকারে উড়ে যাচ্ছে এবং রেখে যাচ্ছে ডেডসির বুকে লবন, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি। এভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ পানি হয়েছে ক্রমশ ঘন, ভারী এবং লবণাক্ত। যদি নদীর পানির সঙ্গে ঘটনাক্রমে কোন জলজ জীব এ সাগরের পানিতে এসে পড়ে, তবে রক্ষে নেই, মৃত্যু অবধারিত। সম্ভবত এই ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের জন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে, মৃত সাগর বা উঊঅউ ঝঊঅ.। তবে আরবদের কাছে ঐতিহাসিক লুত সাগর নামে অধিক পরিচিত।
ডেডসির পানির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ক্লোরাইড (ডিফ), ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড (কপষ), সোডিয়াম ক্লোরাইড গমপষ২), ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (ঘধপষ) এবং সোডিয়াম সালফেট ঈফপষ২) রয়েছে। ম্যাগনেসিয়াম ব্রোমাইড মিশে পানিকে দিয়েছে তিক্ত স্বাদ। এক গ্লাস পানি পানে আপনি হবেন ভয়ানক অসুস্থ, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। মরু সাগর এক সময় বর্তমানের প্রায় ৪ গুণ বড় ছিল এবং পানির তল ছিল আরো উঁচূতে। এখনো পাহাড়ের উপরে রেখা দেখা যায়। ধারণা করা হয়, যা বহুসময় পূর্বের। প্রতি বছর ১০ ইঞ্চি পরিমাণ সমুদ্রতল নীচে নেমে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে খুব শীঘ্রই দক্ষিণের দিকে সমুদ্র একসময় শুকিয়ে যাবে এবং কয়েক শতকের মধ্যে উত্তরের গভীর দিকটাও শুকিয়ে যাবে এবং ১০০ ফিট পুরু সাদা রাসায়নিক দ্রব্যের স্তর বেরিয়ে পড়বে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্রমতে হযরত লুত আলাহিস সালাম -এর হাতির বসতি যেখানে ছিল, তা এখন বিলুপ্ত এবং তার ধ্বংসাবশেষ ডেডসির দক্ষিণাংশের অগভীর পানির নীচে অবস্থিত। এই এলাকার সমৃদ্ধশালী নগরের নাম ছিল সাভোম বা শাদুম (ঐযধফড়ড়স) সুস্পষ্ট পথ প্রদর্শক থাকার পরও লুত জাতির মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ এবং নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন ঘটেছিল। তারা নিজেদের স্ত্রী পরিত্যাগ করে প্রকাশ্য দিবালোকে, জনসমাবেশে সমকামিতার মত জঘণ্য পাপাচারে লিপ্ত হতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করতোনা। এই এলাকা দিয়ে কোন বানিজ্য কাফেলা, পথিক নিরাপদে যাতায়াত করতে পারতো না। সুযোগ পেলেই ধন-সম্পদ সব লুটপাট করে নিয়ে যেত। রাতে কোন বাড়িতে মেহ্মান অবস্থান করছে, এ খবর শুনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ঐ বাড়িতে গিয়ে হাজির হতো এবং গৃহকর্তার কথা উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে জোরপূর্বক পাপাচারে লিপ্ত হতো। হযরত লুত আলাহিস সালাম -এর স্ত্রীও ছিল ঐ পাপীদের সহযোগী। এই অধঃপতিত জাতিকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে লুত জাতির ধ্বংসের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে, সূরা আ’রাফে এবং সূরা হুদে। আরবদের কাছে এটা লুত সাগর নামে অধিক পরিচিত।
হযরত লুত আলাহিস সালাম ছিলেন হযরত ইব্রাহীম আলাহিস সালাম উনার ভ্রাতুস্পুত্র। উভয়ের মাতৃভূমি ছিল, পশ্চিম ইরাকে বসরার নিকটবর্তী প্রসিদ্ধ বাবেল শহরে। এখানে মূর্তি পুঁজার ব্যাপক প্রচলন ছিল। নিজ পরিবারের মধ্যে শুধু সহধর্মিনী হযরত সারা আলাহাস সালাম ও ভ্রাতুস্পুত্র হযরত লুত আলাহিস সালাম মুসলমান হন। এক সময় উনাদেরকে সঙ্গে নিয়ে হযরত ইব্রাহীম আলাহিস সালাম তিনি দেশ ছেড়ে সিরিয়ায় হিজরত করেন। জর্দান নদীর তীরে পৌঁছার পর মহান আল্লাহ্ পাক উনার নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম আলাহিস সালাম তিনি কেনানে গিয়ে অবস্থান করেন, যা বায়তুল মুকাদ্দাসের অদুরেই অবস্থিত।
হযরত লুত আলাহিস সালাম উনাকেও মহান আল্লাহ্ পাক তিনি নুবুওওয়াত দান করে জর্দান ও বায়তুল মুকাদ্দাসের মধ্যবর্তী সাদুমের অধিবাসীদের পথ প্রদর্শনের জন্যে প্রেরণ করেন। এ এলাকায় সাদুম, আমুরা, উমা, ছাবুবিম, বালে অথবা সুগর নামক পাঁচটি বড় বড় শহর ছিল।  কুরআন পাক-এ আল্লাহ্ তায়ালা তিনি বিভিন্ন স্থানে এদের সমষ্টিকে ‘ম’ তাফেকা ও ‘মু’ তাফেকাত শব্দে বর্ণনা করেছেন। এসব শহরের মধ্যে সাদুমকেই রাজধানী মনে করা হতো। এ এলাকার ভূমি ছিল উর্বর ও শস্য শ্যামলা। এখানে সর্বপ্রকার শস্য ও ফলের প্রাচুর্য ছিল। (এসব ঐতিহাসিক তথ্য বাহরে মুহীত, মাযহারী, ইবনে কাছীর, আলমানার প্রভৃতি গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে)
কুরআন পাক-এর ভাষায় মানুষের সাধারণ অভ্যাস হচ্ছে- মানুষ যখন দেখে, সে কারো মুখাপেক্ষী নয়, তখন অবাধ্যতা শুরু করে। তাদের সামনেও আল্লাহ্ তায়ালা তিনি স্বীয় নিয়ামতের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। তারা এমন প্রকৃতি বিরুদ্ধ নির্লজ্জতায় লিপ্ত হয়, যা হারাম ও গুণাহ্ তো বটেই, সুস্থ স্বভাবের কাছে ঘৃণ্য হওয়ার কারণে সাধারণ জন্তু-জানোয়ারও এর নিকটবর্তী হয়না।
মহান আল্লাহ্ তায়ালা তিনি হযরত লুত আলাহিস সালাম উনাকে তাদের হিদায়েতের জন্য নিযুক্ত করেন। তিনি স্বজাতিকে সম্বোধন করে বলেন, “তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করো, যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ করেনি।” মহান আল্লাহ্ পাক তিনি এ জাতিকে ভয়ানক আযাবে গ্রেফতার করেন। সূরা আ’রাফের তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াত শরীফে সাদুম সম্প্রদায়ের বক্রতা ও বেহায়াপনার আসমানী শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, গোটা জাতিই মহান আল্লাহ পাক উনার আযাবে পতিত হলো। শুধু হযরত লুত আলাহিস সালাম এবং উনার কয়েকজন সঙ্গী আযাব থেকে বেঁচে রইলেন। ৮৪নং আয়াত শরীফে আযাব সম্পর্কে এটুকুই বলা হয়েছে যে, তাদের উপর এক অভিনব বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়। সূরা হুদে এ আযাব বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- “যখন আমার আযাব এসে গেল, তখন আমি বস্তিটিকে উল্টে দিলাম এবং তাদের উপর স্তরে স্তরে প্রস্তর বর্ষণ করলাম, যা আপনার প্রতিপালকের নিকট চিহ্নযুক্ত ছিল। সে বস্তিটি এ কাফেরদের থেকে বেশী দূরে নয়।”
এতে বুঝা যাচ্ছে যে, উপর থেকে প্রস্তর বর্ষিত হয়েছে এবং নীচে থেকে হযরত জীবরাঈল আলাহিস সালাম গোটা ভূ-খন্ডকে ওপরে তুলে উল্টে দিয়েছিলেন। বর্ষিত প্রস্তরসমূহ স্তরে স্তরে একত্রিত ছিল। অর্থাৎ এমন অবিরাম ধারায় বর্ষিত হয়েছিল যে, স্তরে স্তরে জমা হয়ে গিয়েছিল। এসব প্রস্তর চিহ্নযুক্ত ছিল। কোন কোন তফসীরবিদ বলেন- প্রত্যেক পাথরে ঐ ব্যক্তির নাম লিখিত ছিল, যাকে খতম করার জন্য পাথরটি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।
বাহ্যত বুঝা যায় যে, চিৎকার ধ্বনির পর প্রথমে ভূখন্ড উল্টে দেয়া হয়। অতঃপর তাদেরকে অধিকতর লাঞ্চিত করার জন্যে উপর থেকে প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণ করা হয়। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, প্রথমে প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণ করা হয় এবং পরে ভূখন্ড উল্টিয়ে দেয়া হয। কারণ,  কুরআন শরীফের বর্ণনা পদ্ধতিতে যে বিষয়টি আগে উল্লেখ করা হয়, তা বাস্তবেও আগেই সংঘটিত হবে, তা অপরিহার্য নয়।
সূরা হুদে বর্ণিত আয়াতসমূহের শেষে  কুরআনপাকে আরবদের হুশিয়ার করে এ কথাও বলা হয়েছে যে, “উল্টে দেয়া বস্তিগুলো জালেমদের কাছ থেকে বেশী দূরে নয়। সিরিয়া গমনের পথে সব সময়ই সেগুলো তাদের চোখের সামনে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তারা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।”
সেই এলাকাটাই ডেডসি বা মৃত সাগর নামে পরিচিত। ১৯৩৯-৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ এলাকার আশেপাশে বিভিন্ন ধরণের অনুসন্ধানী দল পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা তেমন কিছু আবিস্কার করতে পারেনি। তবে ১৯৪৬-৪৭ সালে ডেডসির পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে হিব্রু (ঐবনৎব)ি ও আরাকানা (অৎধশধহধ) ভাষার শিলালিপি এবং বাইবেলের কিছু পান্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক কালের জরিপ কাজ চালাতে গিয়ে ডেডসির দক্ষিণাংশের অগভীর পানির নীচে বিভিন্ন ধরণের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পেয়েছেন। তবে কিছুদিন আগে একজন আমেরিকান প্রত¦তাত্ত্বিকবিদ পল লোপ বিস্ময়কর তথ্য দিয়েছেন। ডেডসির গভীর অংশে অসংখ্য সিমের্ট্রি (ঈবসবঃৎু) এবং ২০,০০০ বা তার উর্ধ্বে ঞড়সন পাওয়া গেছে এবং সাদুম গোত্র সময়কালীন অনেক চড়ঃঃবৎু (মৃৎ শিল্পের যন্ত্র) দেখা গেছে। এত পরিমাণ ঈবসবঃৎু অবশ্যই মনে করিয়ে দেয়, এখানে একটি বৃহৎ শহর সভ্যতার অস্তিত্বের কথা এবং সেটা কেন হবে না সাদুম গোত্র? ঈবসবঃৎু তে মৃত ব্যক্তির নাম উল্লেখিত থাকে, আর কুরআন পাক-এ মহান আল্লাহ্ পাক তিনি তো ঘোষণাই দিয়েছেন, “তাদের উপর স্তরে স্তরে প্রস্তর বর্ষণ করলাম, যা আপনার প্রতিপালকের নিকট চিহ্নযুক্ত ছিল।”
আবা-২৪

0 Comments: