১০০টি চমৎকার ঘটনা - পর্ব-২০ (পিতার হক্ব আদায় করে সন্তান কামিয়াব)


পিতার হক্ব আদায় করে সন্তান কামিয়াব-পর্ব-২০

বনী ইসরাঈলের এক লোক নেককার পরহেযগার হিসেবে খুব মশহুর ছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে যান। উনার মাত্র একটা ছেলে ছিল। ছেলেটাও ছিল আল্লাহওয়ালা। এই ছেলেটা ছাড়া তার কোনো আল আওলাদ ছিল না। তখন উনার বয়সও অনেক হয়ে গিয়েছিল, মৃত্যুর সময় প্রায় নিকটবর্তী। সেই নেককার ব্যক্তি তখন উনার সন্তানকে ডেকে বললেন, ‘দেখ বাবা আমার তো অনেক সম্পদ রয়েছে সত্যিই, তবে ঋণও অনেক রয়েছে। তুমি যেহেতু আমার ছেলে, আমি তোমাকে দুটি বিষয়ে শপথ করিয়ে যাচ্ছি। তুমি এগুলো স্মরণ রাখবে। প্রথমত, তুমি ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, সত্য-মিথ্যা যেটাই হোক না কেন কখনোই মহান আল্লাহ পাক উনার নামে কসম করবে না।

আর দ্বিতীয়ত, যেহেতু তুমি ছাড়া আমার আর কোনো আওলাদ নেই। আমার যে পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে তা তুমি বসে খেলেও খেতে পারবে কিন্তু আমার অনেক ঋণও রয়েছে। আমার ঋণ পরিশোধ করতে গেলে হয়তো এত সম্পদ নাও থাকতে পারে। তুমি আমার পক্ষ থেকে আমার সন্তান হিসেবে আমার ঋণগুলো পরিশোধ করে দিও। হয়তো তোমার অসুবিধা হবে কিন্তু আমি তোমার জন্য দোয়া করছি যেন মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাকে হিফাযত করেন এবং ইহকাল ও পরকালে সুখ-শান্তি দান করেন।' তখন সে সন্তান রাজী হলো। এদিকে তার পিতা ইন্তেকাল করলেন। সারা এলাকার লোক জেনে গেলো যে, সেই লোক ইন্তেকাল করেছেন। উনার ঋণের জিম্মাদার হয়েছে উনার সন্তান। তখন পর্যায়ক্রমে লোক আসতে লাগলো। সে ঋণ পরিশোধ করতে লাগলো। তার যা সম্পত্তি ছিল ধন-দৌলত টাকা পয়সা সব দেয়া হয়ে গেলো, জায়গা-জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করলো। শেষ পর্যন্ত, যে বাড়িতে সে বসবাস করতো সেটাও বিক্রি করে তার ঋণ পরিশোধ করতে হলো। এ বাড়িটা ছাড়া বসবাস করার মতো তার আর কোনো জায়গা সেখানে অবশিষ্ট ছিল না। কাজকর্ম করে খাওয়ার মতো তার তেমন কোনো যোগ্যতাও ছিল না।

সে মনে মনে চিন্তা করলো তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। তাদের নিয়ে সে এখন কি করবে? পরিশ্রম করেনি কোনো সময়, কোনো কাজ সে জানে না, সে কি করে এখন কাজ করবে! সে তখন তার স্ত্রীর সাথে পরামর্শ

করলো যে, আমরা এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাই, যেখানে আমাদেরকে কেউ চিনবে না। সেখানে গিয়ে আমরা যেটা ইচ্ছা সেটা করতে পারবো। এখানে কোনো কাজ করতে গেলে মানুষ হয়তো অনেক কিছু মনে করবে, নানান কিছু বলবে । সে তার স্ত্রীকে বললো, আমার পিতাকে মানুষ খারাপ বলবে, সন্তানকে তিনি রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে গিয়েছেন ইত্যাদি ইত্যাদি নানান অশ্লীল, অশালীন কথা-বার্তা বলবে। সেটা আমার পক্ষে বরদাশত করা সম্ভব হবে না। কাজেই আমি এখান থেকে চলে যাবো। সে পিতার সম্মানের খাতিরে এ জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করলো। তারপর একদিন অনেক দূর চলে যাওয়ার জন্য পরিবারের সবাইকে নিয়ে রওয়ানা হলো। তারা কিছুদূর যাওয়ার পর একটা নদী পড়লো। বড় এক নদী। তারা নৌকায় চড়লো। নৌকায় চড়ে কিছুদূর যাওয়ার পর মধ্য নদীতে হঠাৎ তুফান শুরু হলো। তখন ছিল রাত্রিবেলা, তুফান সমস্ত নৌকা ছিন্নভিন্ন করে দিলো, তছনছ করে দিলো। তারা কোথায় কে চলে গেলো কোনো চিহ্ন রইলো না। প্রত্যেকেই জুদা হয়ে গেলো। কারো খবর কারো কাছে পৌঁছলো না যে, কোথায় কে অবস্থান করছে!

সেই লোকটার যখন হুঁশ ফিরে আসলো ; সে নিজেকে নিরিবিলি এক নদীর পাড়ে জঙ্গলের পাশে আবিষ্কার করলো। তারপর তার মনে একটা চিন্তা আসলো, এখন সে কি করবে? নির্জন জায়গা, লোকজন নেই, ভয়ও করছে! স্মরণ হলো তার স্ত্রীর কথা, তার ছেলেদের কথা। কিন্তু স্মরণ হলেও তো করার কিছু নেই। কেউই নেই সেখানে। সে রওয়ানা হলো যাওয়ার জন্য। কিন্তু কোথায় যাবে? রাস্তা নেই, ঘাট নেই, ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল। হঠাৎ একটা গায়েবী আওয়াজ হলো, “হে নেক সন্তান! পিতা-মাতার অনুগত সন্তান, তুমি সামনে অগ্রসর হও। তোমার জন্য মহান আল্লাহ পাক এখানে কিছু ধন ভান্ডার রেখেছেন। তুমি সেটা গ্রহণ করো।” মহান আল্লাহ পাক উনার নির্দেশে সে সামনে অগ্রসর হলো। এরপর সত্যিই একটা ধন ভান্ডার পেলো। পাওয়ার পর ভাবতে লাগলো, এটা দিয়ে সে এখন কি করবে? মহান আল্লাহ পাক উনার ইচ্ছা, কিছু লোক কোথা থেকে যেন সেখানে এসে পৌঁছলো। সে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করলো এবং এই লোকদের মাধ্যমে আরো কিছু লোক যোগাড় করলো। যেহেতু তার টাকা-পয়সা ছিল, তাই সে কিছু লোক দিয়ে ঘর-বাড়ী তৈরী করালো এবং অনেক দান-খয়রাতও করলো। আস্তে আস্তে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো সারা এলাকাতে। নদীর এপার-ওপার সবখানে এ সংবাদ পৌঁছে গেলো। দানশীলতার কারণে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য লোকজন দলে দলে আসতে থাকলো। কাউকে সে ফিরিয়ে দিত না। কম

বেশী দান করতো, মেহমানদারী করতো, অবস্থা বিশেষে লোকদেরকে থাকার ব্যবস্থাও করে দিত। এভাবে তার দিন কাটতে লাগলো। কয়েক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো।

হঠাৎ একদিন একটা ছেলে আসলো তার এখানে থাকার জন্য। সে তাকে কাজ দিলো। মূলতঃ সেটা ছিল তারই বড় ছেলে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানের কারণে সন্তান পিতাকে চিনতে পারেনি, পিতাও সন্তানকে চিনতে পারেনি। তাকে একটা কাজে নিয়োগ দিয়ে রেখে দিলো। যেহেতু তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারা এলাকায় তাই দেখা গেলো; তার দ্বিতীয় ছেলে যেখানে ছিল। সে জায়গায় এক লোকের অধীনে থাকা অবস্থায়ই সে এই লোকের সম্পর্কে শুনতে পায় যে, সে খুব দানশীল এবং মানুষের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করে। একথা শুনে সেও পর্যায়ক্রমে এখানে চলে আসলো এবং চাকরি নিলো এখানে এসে। বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হলো।

সেই লোকের যে স্ত্রী ছিল সেও নৌকাডুবির পর ভাসতে ভাসতে এক এলাকায় গিয়ে পৌঁছেছিল। সে এমন এক লোকের বাড়ীর পাশে গিয়ে পৌঁছলো, যে ব্যক্তি ছিলেন দ্বীনদার, পরহেযগার, আল্লাহওয়ালা। তিনি সকালে যখন সেই মহিলাকে দেখলেন তখন চিন্তা করলেন, কোথা থেকে এই বেগানা মহিলা এখানে আসলো? পরে বুঝতে পারলেন, নৌকা ভেঙ্গে এখানে এসেছে। তাই সেই মহিলাকে আশ্রয় দিলেন এবং কয়েক বছর ওখানে রাখলেন। যখন নেককার লোকটি সংবাদ পেলেন যে, একজন লোক খুব দানশীল। গরীব-অসহায়দেরকে সাহায্য করে থাকে। তখন সেই নেককার লোকটা যার আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ছিল, তিনি মহিলাটিকে বললেন: “আমি আর কতদিন তোমাকে লালন-পালন করবো? তুমি এক কাজ করো, আমার সাথে চলো, সেই দানশীল নেককার লোকের কাছে তোমাকে পৌঁছে দেই, সে তোমার একটা ব্যবস্থা করে দিবে। অথবা তার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে আসি, তোমার চলাচলের জন্য যেন সুবিধা হয়।”

তারপর একদিন সেই মহিলাকে একটি নৌকায় করে তিনি নিয়ে আসলেন সেই দানশীল ব্যক্তির এলাকায়। এনে নৌকাটি ঘাটে বেঁধে সেই দানশীল লোকের কাছে পরামর্শ করতে গেলেন যে মহিলাটির জন্য কি ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেই দানশীল ব্যক্তি তাকে কিছু অর্থ কড়ি দান করলো। রাত অনেক হয়ে গেলো। সে দানশীল ব্যক্তি বললো, আপনি এত রাত্রে যাবেন কোথায়? আপনি থাকুন, আপনার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আমি করবো। তখন তিনি বললেন যে, 'আমি তো একা নই, আমার সাথে আমার নৌকাতে

একজন মহিলা রয়েছেন। যার জন্য আমি আপনার এই দান খয়রাতগুলো গ্রহণ করেছি। সে অভাবগ্রস্ত। তখন সেই দানশীল লোকটি বললো, তাহলে এক কাজ করুন। তাকে পাহারা দেয়ার জন্য আমি লোক দিচ্ছি। আপনি চিন্তা করবেন না। সে পাহারা দেয়ার জন্য সেই ছেলে দু'টাকে দিলো। সেই ছেলে দু'টা এখানে এসে তাদের সততা, সৎ চরিত্রের কারণে দ্বীনদার, নেককার-পরহেযগার হিসেবে মোটামুটি পরিচিতি লাভ করেছিল। যেহেতু তারা সৎচরিত্রবান ছিল তাই তাদেরকে পাহারা দেয়ার জন্য পাঠানো হলো। সেই নৌকার পাশে যখন তারা গিয়ে পৌঁছলো, তখন তারা পরস্পর বললো যে, “আজকে রাত্রে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কি করবো সারা রাত? করার তো কিছু নেই। এক কাজ করো তুমি কোথা থেকে এখানে আসলে... আর আমিই বা কোথা থেকে আসলাম.... আমরা পরস্পর আমাদের পিছনের জীবনের কথা আলোচনা করি, তাতে রাত শেষ হয়ে যাবে।” তখন প্রথম যে ছেলেটা এখানে এসেছে, সে তার ইতিহাস বর্ণনা করলো যে, “আমরা এরকম ছিলাম, খুব সুখে ছিলাম, শান্তিতে ছিলাম। আমার পিতা, আমার এক ভাই, আমার মা ছিলেন কিন্তু হঠাৎ আমরা, আমার দাদার ঋণ পরিশোধ করে শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব হয়ে যাই, সম্বলহীন হয়ে যাই। তখন আমরা অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য নৌকায় চড়েছিলাম, কিন্তু ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা ভেঙ্গে আমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। কে যে কোথায় গিয়েছে! তার সংবাদ আমার জানা নেই! আমি শুধু আমারটা জানি। কথাগুলো বলে সে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

যখন প্রথম ছেলে একথা বললো, তখন দ্বিতীয় ছেলেটা বললো, তোমার পিতার নাম কি? সে জবাব দিলো। তখন সেই ছেলেটা বললো যে, দেখ তুমি তোমার যে ভাইকে তালাশ করছিলে আমি মনে হয় তোমার সেই ভাই। আমার জীবনের ঠিক একই ঘটনা। আমরা দুই ভাই ছিলাম এবং হারিয়ে গিয়েছিলাম। । তখন তাদের পরিচয় হয়ে গেলো। সেই মহিলা নৌকায় বসে বসে সেই ঘটনা শুনলো, শুনে সে চুপ করে রইলো, সে কোনো কথা বললো না। সকালে যখন সে নেককার লোকটি আসলেন, যিনি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তিনি এসে সে মহিলাকে দেখলেন বিমর্ষ, চিন্তিত। জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? সেই মহিলা বললো, এখানে কথা বলা যাবে না। এই এলাকার যিনি মালিক, উনার কাছে যেতে হবে। উনার সাথে আমার কিছু কথা আছে, আমি বললে হয়তো তারা (ছেলেরা) শুনবে না। সেই লোক বললেন, আচ্ছা। ঠিক আছে। অপারগ হয়ে সেই মহিলাকে নিয়ে গেলেন সেই লোকের কাছে। সেই জায়গার মালিক দানশীল ব্যক্তি বললেন, কি হয়েছে?

উনাকে কেন নিয়ে এসেছেন? সেই ব্যক্তি জবাব দিলেন, আপনার সাথে এই মহিলার কিছু কথা আছে। লোকটা প্রথমে একটু উত্তেজিত হয়ে গেলো। কি ব্যাপার? কোনো অঘটন কি ঘটিয়েছে তারা? মহিলার চেহারা আবৃত করা ছিল। তার চেহারা দেখা যাচ্ছিলো না। মহিলাটি বললো, না, তেমন কিছু ঘটেনি। তবে গত রাত্রে তারা একটা গল্প বলেছিল, সে গল্পটা আমি আবার শুনতে চাই। তারা যেন আবার বলে। ছেলে দু'টোকে ডাকানো হলো। ডেকে বলা হলো যে, তারা গত রাত্রে যে ঘটনা বলেছে, সেটা আবার বলতে। পুনরায় সেই কাহিনী যখন সেই ছেলে দু'টা বললো, তখন সেই লোকটা তার আসন থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললো যে, সত্যিই যদি এই ঘটনা সত্য হয়ে থাকে তাহলে তো তোমরাই আমার সন্তান। আমি তোমাদের পিতা। যখন সে পরিচয় দিলো, তখন সেই মহিলা বললো যে, ‘মহান আল্লাহ পাক উনার কসম! আমিই তাদের মা। এই ঘটনা বাস্তব সত্য, সেটা তাদের মুখ দিয়ে আবার শুনার জন্য আমি বলেছি তাদেরকে বলার জন্য। অন্য কোনো কারণে নয়।' তখন পরিচয় হয়ে গেলো। তারা আবার পরস্পর সেখানে সুখে শান্তিতে থাকতে লাগলো। যে ছেলে তার পিতার ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল তার প্রতি আবারো গায়েবী নেদা হলো যে, “তুমি তোমার পিতার ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছিলে, কষ্ট করেছো। মহান আল্লাহ পাক তোমাকে তার বদলা, জাযা-খায়ের দিয়েছেন। তোমাকে ইহকালে সুখ দেয়া হলো এবং পরকালেও তোমার জন্য সুখ-শান্তি অপেক্ষা করছে।” সুবহানাল্লাহ!

সম্মানিত পাঠক, সেই সন্তান পিতার আদেশ শিরোধার্য করে নিয়েছিল, দুনিয়াবী সম্পত্তির লোভ করেনি। আগে তার পিতার সমস্ত ঋণ শোধ করে স্বীয় পিতার প্রতি ইহসান করেছিল যার ফলশ্রুতিতে মহান আল্লাহ পাক তিনিও তার প্রতি কত বেমেছালভাবে ইহসান মুবারক করেছেন! সুবহানাল্লাহ!

0 Comments: