৬৭২ নং- সুওয়াল :পীরের হাতে মুরীদ হওয়ার কারণ কি?


সুওয়াল : মাসিক আত-তাওহীদ জুলাই/আগষ্ট৯৬ইং সংখ্যায় নিম্নোক্ত সমস্যা ও তার সমাধান ছাপানো হয়।
সমস্যা : পীরের হাতে মুরীদ হওয়ার কারণ কি?
সমাধান : মানুষের মধ্যে কিছু পাশবিক চরিত্র আছে। যেমন- লোভ-লালসা, হিংসা-ক্রোধ, গৌরব-আত্মতুষ্টি, দুনিয়ার মোহ-পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি, যা মানুষকে মহান আল্লাহ পাক থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর কিছু ফেরেশতার গুণ আছে। যথা- আল্লাহ পাক-রসূলের প্রতি ভালবাসা, দয়া-নম্রতা, বিনয়-ধৈর্য্য ইত্যাদি। সাধারণতঃ মানুষ নিজেই তার অন্তরের রোগগুলো থেকে বেঁচে ফেরেশতার গুণ অর্জন করতে পারেনা। তাই অপর এক ব্যক্তির স্বরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন, যার নির্দেশনায় পাশবিক চরিত্র থেকে মুক্ত হয়ে ফেরেশতার গুণে গুণান্বিত হতে পারে। এটাই হলো পীরের হাতে মুরীদ হওয়ার তাৎপর্য। উল্লেখ্য, পীরের হাতে বায়আত গ্রহণ করা মুস্তাহাব।
প্রদত্ত সমাধানের প্রেক্ষিতে আমার জানবার বিষয় হলো- উপরিল্লিখিত এতসব বদগুণের ইছলাহের জন্য পীর সাহেব গ্রহণ করা মুস্তাহাব এ বক্তব্য কি সঠিক? না ভূল? বিস্তারিত জানালে উপকৃত হব।

জাওয়াব : মাসিক আত তাওহীদ পত্রিকায় প্রদত্ত উক্ত সমাধান সঠিক হয়নি। কেননা লোভ-লালসা, হিংসা, ক্রোধ, গৌরব-অহংকার, আত্মতুষ্টি, দুনিয়ার মোহ-পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি বদ খাছলত বা স্বভাব হতে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে হযরত ফেরেস্তা আলাইহিমুস সালাম উনাদের গুণে নয় বরং মহান আল্লাহ পাক উনার গুণে গুণান্বিত হওয়া হচ্ছে পীর সাহেব ক্বিবলা উনার হাতে বাইয়াত হওয়ার তাৎপর্য। যেমন- মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ মুবারক করেন,
صبغة الله ومن احسن من الله صبغة.
অর্থ : তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার গুণে গুণান্বিত বা রঙে রঞ্জিত হও, মহান আল্লাহ পাক উনার চেয়ে উত্তম রঞ্জনকারী আর কে হতে পারে?”
আর মহান আল্লাহ পাক রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
تخلقوا با خلاق الله.
অর্থ : তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার চরিত্রে চরিত্রবান বা গুণে গুণান্বিত হও।
উল্লেখ্য যে, উক্ত বদ খাছ্লত বা বদ্ স্বভাব অন্তর থেকে দূর করা ফরজ ওয়াজিবের অন্তর্ভূক্ত। কেননা উল্লেখিত বদ খাছলত সংশোধন করা সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ বিশেষভাবে বহুবার তাক্বীদ বা নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
যেমন- লোভ সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে,
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن شدة الحرص.
অর্থ : মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, অবৈধ লোভ-লালসা হতে নিষেধ করেছেন।
হিংসা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,          
اياكم والحسد فان الحسد يأكل الحسنات كما تأكل النار الحطب.
অর্থ : তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা নিশ্চয়ই হিংসা নেকীসমূহকে ধ্বংস করে দেয়। যেমন- আগুণ লাকড়ীকে ধ্বংস করে বা জ্বালিয়ে দেয়।
ক্রোধ ও পরশ্রীকাতরতা সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ولا تبا غضوا.
অর্থ : তোমরা পরস্পর অন্তরে শত্রুতা পোষণ করোনা।
গৌরব-অহংকার সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
من كان فى قلبه مثقال ذرة من كبر لا يدخل الجنة.
অর্থ : যার অন্তরে এক জাররা (বালু কণা) পরিমাণ অহংকার থাকবে, সে বেহেস্তে প্রবেশ করতে পারবেনা।
দুনিয়ার মোহ ও মুহব্বত সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
حب الدنيا رأس كل خطيئة.
অর্থ : দুনিয়ার মোহ বা মুহব্বত হচ্ছে সকল পাপের মূল।
মিথ্যা সম্পর্কে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেন,
انما الكذب لكل الذنوب ام.
অর্থ : নিশ্চয়ই মিথ্যা হলো সমস্ত পাপের মা।
আর পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে,
الالعنة الله على الكاذبين.
অর্থ : সাবধান! মিথ্যাবাদীদের উপর মহান আল্লাহ পাক উনার লানত।
উল্লিখিত বদ গুণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র সুন্নাহ শরীফ উনাদের এ সংক্ষিপ্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, যার অন্তরে উল্লিখিত বদ খাছলতগুলি থাকবে, সে কখনও খালেছ মুসলমান তো হতে পারবেইনা, উপরন্ত তার শেষ পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট আবাসস্থল তথা জাহান্নাম।
সুতরাং লোভ-লালসা, হিংসা, ক্রোধ, গৌরব, দুনিয়ার মোহ, মিথ্যা ইত্যাদি বদ খাছলতের কারণে যদি খালেছ মুসলমান হওয়া না যায় এবং তার জন্য জাহান্নামে যেতে হয়, তাহলে এ সকল বদ খাছ্লত হতে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার জন্য পীর সাহেব ক্বিবলা উনার হাতে বাইয়াত হওয়া কি অবশ্য, অবশ্যই ফরজের অন্তর্ভূক্ত হয় না? তাই সাধারণ আকলেই জিজ্ঞাস্য যে, দিল ইছলাহ ও জাহান্নাম থেকে বাঁচবার অবশ্য করণীয় আমল কি করে মুস্তাহাব হতে পারে? মূলত মাসিক আত-তাওহীদের এ সমাধান আদৌ শুদ্ধ হয়নি।
বরং শুদ্ধ ও সঠিক সমাধান বা জাওয়াব হলো- অন্তর পরিশুদ্ধ  করার জন্য যে ইলম অর্জন করতে হয়, তা যেমন ফরয, তদ্রুপ উক্ত ইলম অর্থাৎ ইলমে তাছাউফ যারা শিক্ষা দিয়ে থাকেন অর্থাৎ পীর সাহেবগণ, উনাদের সোহবত ইখতিয়ার করা বা উনাদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করাও ফরয।
ইলম অর্জন করা সম্পর্কে পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে
طلب العلم فريضة على كلم مسلم.
অর্থ : প্রত্যেক মুসলমানের (নর-নারীর) জন্য ইলম তলব বা শিক্ষা করা ফরয।
আর পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইলমকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে,
العلم علمان علم فى القلب فذاك علم النافع وعلم على اللسان فذا لك حجة الله غزو جل على ابنادم.
অর্থ : ইলম দুপ্রকার (১) ক্বালবী ইলম অর্থাৎ ইলমে তাছাউফ, এটিই উপকারী ইলম। (২) জবানী ইলম অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ যা মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ হতে বান্দার প্রতি দলীল স্বরূপ।
সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই এ দুপ্রকার ইলম অর্থাৎ ইলমে ফিক্বাহ ও ইলমে তাসাউফ জরুরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরয। আর এ ফরয পরিমাণ ইলম যেহেতু ওস্তাদ ছাড়া হাছিল করা সম্ভব নয়, সেহেতু এজন্য কোন ওস্তাদ গ্রহণ করাও ফরয।
কেননা উসুল রয়েছে,
مالا يتم به الفرض فهو فرض.
অর্থ : যে আমল ছাড়া কোন ফরয পূর্ণ হয়না, সে ফরযকে পূর্ণ করার জন্য ঐ আমল করাও ফরয।
যেমন- নামায আদায় করা ফরয। কিন্তু ওযু ব্যতীত নামায আদায় করলে, আদায় হবেনা। তাই নামাযের জন্য ওযু করা ফরয। অথচ সর্বদা ওযু করা ফরয নয়। তদ্রুপ ইলমে ফিক্বাহ শিক্ষার জন্য কোন ওস্তাদের নিকট যাওয়া এবং ইলমে তাসাউফ শিক্ষার জন্য কোন পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করাও ফরজের অন্তর্ভূক্ত।
এজন্য ইতিহাসে দেখা যায়, অতীতের সকল ইমাম, মুজতাহিদ, মুহাক্কিক, মুদাক্কিক, আউলিয়ায়ে কিরাম ও বুযুর্গাণে দ্বীন সকলেই ইলমে ফিক্বাহ্ শিক্ষার সাথে সাথে ইলমে তাসাউফ শিক্ষার জন্য একজন পীর সাহেবের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছে, তার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো- যিনি হানাফী মাযহাবের ইমাম, ইমামে আযম, হযরত আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি, যাঁর সম্পর্কে ইমাম শাফী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন,
الفقهاء كل عيال ابى حنيفة فى الفقه.
অর্থ : সকল ফক্বীহগণ বা আলেমগণ ইলমের তুলনায় ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার সন্তান তুল্য।
তিনি স্বয়ং বলেছেন,
لولا سنتان لهلك ابو نعمان.
অর্থ : যদি দুটি বছর না হতো, তাহলে অবশ্যই আবু নুমান (আবু হানীফা) ধ্বংস হয়ে যেত।
অর্থাৎ ইমাম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, আমি যদি দুটি বছর না পেতাম, তাহলে নিশ্চয়ই আমি ধ্বংস হয়ে যেতাম। সে বছর দুটির উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে দুবছর আমি আমার দ্বিতীয় পীর সাহেব, হযরত ইমাম জাফর সাদিক্ব আলাইহিস সালাম, উনার নিকট বাইয়াত হয়ে ইলমে তাসাউফ হাছিলের মাধ্যমে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করেছি।
অতএব সহজেই অনুভূত হয় যে, ইলমে তাসাউফ শিক্ষা করার আবশ্যকতা কত বেশী। হ্যাঁ, তবে মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু হাতে হাত দিয়ে বাইয়াত করিয়েছেন, সেহেতু সেই তরতীব অনুযায়ী পীর সাহেব ক্বিবলা উনার হাতে হাত রেখে বাইয়াত হওয়া সুন্নতের অন্তর্ভূক্ত। তাকেও মুস্তাহাব বলা যাবেনা।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা মাসিক আত তাওহীদের বক্তব্য, “পীরের হাতে বাইয়াত হওয়া মুস্তাহাবসম্পূর্ণই অশুদ্ধ, অসত্য ও ভুল প্রমাণিত হলো। যার সাথে শুদ্ধ ও সঠিক জাওয়াবও বিবৃত হলো যে, পীর সাহেব ক্বিবলা উনার হাতে বাইয়াত হওয়া ফরয। এর স্বপক্ষে অনেক অনেক কিতাবের মাঝে নিম্নলিখিত কিতাব সমূহেও দলীল রয়েছে।
(তাফসীরে কবীর, মাযহারী, রুহুল বয়ান, রুহুল মায়ানী, মাআরেফুল কোরআন, মাকতুবাত শরীফ, ইহ্ইয়াউল উলুমুদ্দীন, মাআরেফুল কুরআন, মাকতুবাত শরীফ, কিমিয়ায়ে সায়াদাত, ফতহুর রব্বানী, আল বুনইয়ানুল মুশাইয়্যাদ, সিররুল আসরার, দুররুল মোখতার, সাইফুল মুকাল্লেদীন ইত্যাদি।)
আবা-৩৮

1 Comments:

Unknown said...

Murid howa proyojon