নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শুধুমাত্র আরব অঞ্চলের প্রাণীর বিষয়ে বর্ণনা করেনি বরং সমস্ত আলমের সমস্ত প্রাণীর বর্ণনাই প্রদান করেছেন
নাস্তিকদের আপত্তি ৭ : আরব অঞ্চলে সচরাচর যে সকল জীব দেখা যায় অর্থাৎ - যেগুলো বুকে হেটে চলে (সাপ), দুই পায়ে (মানুষ) এবং চার পায়ে (অন্যান্য জন্তু, গিরগিটি) চলে সেগুলোর কথাই উঠে এসেছে কুরানে (Quran 24:45)! অথচ হাজার পা যুক্ত প্রানীও পৃথিবিতে বিদ্যমান (Millipedes)! এসব কি মুহম্মদের অজ্ঞতার ফসল নয়?
খন্ডন : মহান আল্লাহ পাক তিনি চলন্ত সকল জীব সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেন-
وَاللهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِّن مَّاءٍ ۖ فَمِنْهُم مَّن يَـمْشِي عَلٰى بَطْنِهِ وَمِنْهُم مَّن يـَمْشِي عَلٰى رِجْلَيْنِ وَمِنْهُم مَّن يَـمْشِي عَلٰى اَرْبَعٍ ۚ يَـخْلُقُ اللهُ مَا يَشَاءُ ۚ اِنَّ اللهَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ◌
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে কিছু পেটে ভর দিয়ে চলে, কিছু দুই পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কিছু চার পায়ে ভর দিয়ে চলে; মহান আল্লাহ পাক তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সবকিছু করতে সক্ষম।” (পবিত্র সূরা নূর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৫)
এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দ্বারা মহান আল্লাহ পাক উনার সর্বশক্তিময় ক্ষমতার শান মুবারক প্রকাশ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ পাক তিনি যে, কোন প্রাণীকে দুই বা ততোধিক পা দিয়ে হাঁটাতে পারেন এবং কোন কোন প্রাণীকে পা ছাড়াই হাঁটাতে পারেন- সে ক্ষমতার বিষয় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তাই এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত كُلَّ دَابَّةٍ বাক্যাংশ মুবারক দ্বারা যেহেতু স্থলে, পানিতে এমনকি আকাশে উড়ন্ত সমস্ত জীবকে বুঝানো হয়েছে। তাই-
১. مِنْهُم مَّن يَـمْشِي عَلٰى بَطْنِهِ অর্থাৎ পেটে ভর দিয়ে চলাফেরাকারী প্রাণী বলতে শুধু সাপকে বুঝানো হয়নি। এই বাক্যাংশ মুবারক দ্বারা স্থলের সাপ, কেঁচো, গুইসাপ, গিরিগিটি, টিকটিকি, বিছা, কেন্নো, কাঁকড়া, মাকড়সাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ যদিও তারা আকাশে উড়ে বেড়াক না কেন (যেমন ফড়িং) তাদেরকেও বুঝানো হয়েছে। আর পানিতে বসবাসকারী সাপ, মাছ, পানিতে বসবাসকারী অন্যান্য পোকা-মাকড়ও এই শ্রেণীভুক্ত।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, পেটে বা বুকে ভর দিয়ে চলাফেরা করে এমন সকল প্রাণী সেটা পানিতে থাকুক বা স্থলে থাকুক কিংবা আকাশে উড়ে বেড়াক যেখানেই থাকুক না কেন তা অবশ্যই এই দলভুক্ত হবে। এমনকি তাদের যদি পা না থাকে কিংবা দু পা থাকে কিংবা চার পা থাকে কিংবা আরো অধিক পা থাকে কিন্তু পেটে বা বুকে ভর দিয়ে চলাচল করে তারা অবশ্যই এই শ্রেণীভুক্ত হবে।
২. مِنْهُم مَّن يـَمْشِي عَلٰى رِجْلَيْنِ অর্থাৎ দু পায়ে ভর দিয়ে চলাফেরাকারী প্রাণী বলতে শুধু মানুষকে বুঝানো হয়নি বরং দু পা বিশিষ্ট সকল প্রাণীই যারা পেটে বা বুকে ভর দিয়ে চলে না তারাই এই শ্রেণীভুক্ত।
৩. مِنْهُم مَّن يَـمْشِي عَلٰى اَرْبَعٍ অর্থাৎ চার পায়ে ভর দিয়ে চলাফেরাকারী প্রাণী বলতে গিরগিটিকে বুঝানো হয়নি বরং চার পা বিশিষ্ট সকল প্রাণীই যারা পেটে বা বুকে ভর দিয়ে চলে না তারাই এই শ্রেণীভুক্ত। গিরগটি যেহেতু পেটে বা বুকে ভর দিয়ে চলে তাই এর চার পা থাকলেও এটি প্রথম শ্রেণীভুক্ত প্রাণী।
সর্বোপরি يَـخْلُقُ اللهُ مَا يَشَاءُ এই আয়াতাংশ মুবারক দ্বারা এই ইঙ্গিত প্রদান করেছেন যে, মহান আল্লাহ পাক উনার কর্তৃক সৃষ্ট প্রাণী চারের অধিক পা বিশিষ্টও হওয়া সম্ভব। যেমন বিভিন্ন মাকড়সা, বিভিন্ন বহুপদী পোকা-মাকড় ইত্যাদি। এমনকি চার পা বিশিষ্ট প্রাণী হওয়ার পরও চলাচলের জন্য শুধুমাত্র দুই পা ব্যবহার করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা প্রাণীও প্রাণীজগতে রয়েছে। এমন বিস্ময়কর একটি প্রাণী হচ্ছে ক্যাঙ্গারু। প্রাণীটি স্তন্যপায়ী। এরা চার পা বিশিষ্ট হলেও পিছনের দুই পায়ের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। এরা অপরিণত বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাগুলো মায়ের পেটের কাছে এক বিশেষ থলিতে থেকে টানা ২৩৫ দিন লালিত-পালিত হয়ে বড় হয়। ক্যাঙ্গারুর মূল বসতি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখ-, নিউ গিনি এবং আশেপাশের দ্বীপ যেমন তাসমানিয়া। তবে কিছু কিছু প্রজাতির ক্যাঙ্গারু অন্যান্য দেশেও স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
আবার আপাত দৃষ্টিতে পা হীন প্রাণীরও সূক্ষ্ম পা বিদ্যমান থাকতে পারে। যেমন কেঁচো। কেঁচোর প্রথম ও শেষ খণ্ড (segment) ব্যতীত প্রত্যেক খণ্ডে ৪ জোড়া ক্ষুদ্র পা (setae) আছে। এই অতি ক্ষুদ্র লোমশ শক্ত পাগুলো কেঁচোকে পেশীসহ নড়াচড়া করতে সহায়তা করে। প্রত্যেক জোড়া পা পরিবেশের প্রতিবেদক হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শরীরের পিছনের অংশের setae-র সাহায্যে মাটিকে আঁকড়ে ধরে বর্তুলাকার পেশীকে ধাক্কা দেয়ার মাধ্যমে শরীরের সামনের অংশকে প্রলম্বিত করে।
সামনের অংশের setae মাটিকে আঁকড়ে ধরে অনুদৈর্ঘ্য পেশীকে সংকুচিত করার মাধ্যমে শরীরের পিছনের অংশকে টেনে আনে। গন্তব্যে পৌঁছানো পর্যন্ত কেঁচো এই চক্র ঘটাতে থাকে।
এছাড়াও এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার শেষাংশের দ্বারা মহান আল্লাহ পাক তিনি যে মানুষের দৃষ্টিতে যা স্বাভাবিক বলে মনে হয় তার ব্যতিক্রম সবকিছুই করতে পারেন তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সুতরাং পৃথিবীতে বিভিন্ন ব্যতিক্রমী প্রাণীর উদাহরণও এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে।
যেমন প্রাণীজগতের এক বিস্ময়কর প্রাণী হলো প্লাটিপাস বা হংসচঞ্চু। প্লাটিপাসের ঠোঁট ও পায়ের পাতা দেখতে হাঁসের মতো এবং এদের শরীর অনেকটা ভোঁদড়ের মতো। এদের দেহের রঙ বাদামী, লোমশ এবং প্রশস্ত ও সমান্তরাল লেজ আছে। অদ্ভুদ এই প্রাণীটি ডিম পাড়ে কিন্তু বাচ্চারা মায়ের দুধ খায়। প্লাটিপাসের পাকস্থলী নেই। তাসমানিয়া, দক্ষিু ও পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার নদী ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলে এদের বাস।
কানাডার উপকূলে ‘ওয়েস্টার্ন গ্রেব’ নামক এক ধরনের পাখি আছে তারা পানির উপর চপচপ করে হাঁটে, অন্য কোনো প্রাণী পানির উপর হাঁটতে পারে না; কিন্তু সাঁতার কাটতে পারে। টিকটিকি, মাকড়সা হাত-পা উপর দিকে রেখে ছাদের নিচে দিয়ে দৌড়াতে পারে। মশার চোখ নেই, কিন্তু হাত উঠাতেই দৌঁড়ে পালায়। সাপের ‘পা’ নেই অথচ মানুষের চেয়েও দ্রুত দৌড়ায়। আবার কানও নেই জিহ্বা দিয়ে শোনে।
এমনকি পৃথিবীতে অনেক রহস্যময় স্থান আছে যার রহস্য আজও বিজ্ঞানীরা উদঘাটন করতে পারেনি, সেখানেও এমন অনেক রহস্যময় প্রাণীর আবাস রয়েছে।
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, পবিত্র কুরআন শরীফ আরব অঞ্চলে সচরাচর গোচরীভূত কিছু সরিসৃপ, দু পা বিশিষ্ট বা চা বিশিষ্ট নির্দিষ্ট প্রাণীর বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং হাজার পা যুক্ত প্রাণীসহ পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল প্রাণী তা আবিষ্কৃত হোক বা অনাবিষ্কৃত থাকুক তার বর্ণনা পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে এসেছে, যা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একটি মুজিযা শরীফ।
পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে-
عن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اعطيت جوامع الكلم.
অর্থ : “হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমাকে সমস্ত ইলম মুবারক হাদিয়া করা হয়েছে।” (এরওয়াউল গলীল, দায়লামী/১৬২০)
অপর এক হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে-
عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم بعثت بـجوامع الكلم.
অর্থ : “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমি সমস্ত ইল্ম মুবারকসহ প্রেরিত হয়েছি।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত/৫১২)
উপরোক্ত পবিত্র হাদীছ শরীফ উনাদের আলোকে এ বিষয় সুস্পষ্ট যে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সৃষ্টির শুরু থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত সমস্ত বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ ইলম রয়েছে। আর তাই তিনি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে-
يَـخْلُقُ اللهُ مَا يَشَاءُ ۚ اِنَّ اللهَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ◌
অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সবকিছু করতে সক্ষম।” (পবিত্র সূরা নূর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৫)
সুতরাং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শুধুমাত্র আরব অঞ্চলের প্রাণীর বিষয়ে বর্ণনা করেনি বরং সমস্ত আলমের সমস্ত প্রাণীর বর্ণনাই প্রদান করেছেন।
0 Comments:
Post a Comment