পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ১টি আয়াত শরীফও কেউ দেখাতে পারবে না, যে আয়াত শরীফ বিবর্তনের সমর্থন করে। বরং পবিত্র কুরআন শরীফ প্রতিটি সৃষ্টি যে আলাদাভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তার বর্ণনা প্রদান করে।

পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ১টি আয়াত শরীফও কেউ দেখাতে পারবে না, যে আয়াত শরীফ বিবর্তনের সমর্থন করে। বরং পবিত্র কুরআন শরীফ প্রতিটি সৃষ্টি যে আলাদাভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তার বর্ণনা প্রদান করে।

নাস্তিকদের আপত্তি ৩ : কুরানের আয়াত 71:14, 76:28, 6:133, 71:17, 24:45, 2:35  দ্বারা আপনার ‘কুরান বিবর্তনের পক্ষে’ দাবি করার অর্থ কি হতে পারে যেখানে বিবর্তন মানতে গেলে আদম হাওয়া কাহিনি (Quran 2:29-36, 4:1, 7:10-27অস্বীকার করে ‘মানুষ সহ অন্যান্য প্রাইমেটদের পূর্বপুরুষ একই এবং সকল প্রানীর উৎপত্তি এককোষী জীব থেকে’ মেনে নিতে হয়? সেক্ষেত্রে আপনার ধর্মের কোন অস্তিত্ব থাকে কি?

নাস্তিকদের আপত্তি ৪ : "সৃষ্টিতত্ব মতে ‘আদম ও হাওয়া’ (Quran 2:29-36, 4:1, 7:10-27 Al-Tabari, Vol. 1, pp. 183-184, 187-193, 273-274, 277-281) থেকে সমগ্র মানব জাতির উদ্ভব! কিন্তু বিজ্ঞান বলে মানুষ সহ সকল প্রানি এসেছে বিবর্তনের মাধ্যমে। বিবর্তনের বাস্তব প্রমান থাকা সত্বেও কেন মুসলিমরা আদম-হাওয়ার কল্প কাহিনিকে বিশ্বাস করে যাচ্ছে?

http://atheistzoo.blogspot.com/2010/10/atavisms-blas :from-past.html"

খণ্ডণ : পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ১টি আয়াত শরীফও কেউ দেখাতে পারবে না, যে আয়াত শরীফ বিবর্তনের সমর্থন করে। বরং পবিত্র কুরআন শরীফ প্রতিটি সৃষ্টি যে আলাদাভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তার বর্ণনা প্রদান করে। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اَوَلَـمْ يَرَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا اَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْاَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُـمَا ۖ وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ ۖ اَفَلَا يُؤْمِنُوْنَ.

অর্থ : “কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আসমানসমূহ ও যমীনের মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?” (পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩০)

নাস্তিকরা নিরেট মূর্খ বলেই এক বিষয়ে বর্ণিত আয়াত শরীফ অন্য বিষয়ের সমর্থনে চালিয়ে দিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফ বিবর্তনের পক্ষে বলে দাবী তুলছে।

যেমন প্রথম আয়াত শরীফ (৭১:১৪) উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে- 

وَقَدْ خَلَقَكُمْ اَطْوَارًا

অর্থ : “অথচ তোমরা কি দেখ না তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ে?” (পবিত্র সূরা নূহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪)

এই পবিত্র আয়াত শরীফখানা উনার মধ্যে মায়ের রেহেমে মানুষের সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়ক্রম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই বিভিন্ন পর্যায়ক্রম সম্পর্কে অন্য আয়াত শরীফ উনার মধ্যে স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِيْنٍ. ثُـمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِيْنٍ. ثُـمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَـحْمًا ثُـمَّ اَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا اٰخَرَ فَتَبَارَكَ اللهُ اَحْسَنُ الْـخَالِقِيْنَ.

অর্থ : “আর আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির সারাংশ থেকে। অতঃপর আমি তাকে নুতফারূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি নুতফাকে ‘আলাক্বা’ বা জমাট রক্তে পরিণত করেছি, অতঃপর ‘আলাক্বা’ বা জমাট রক্তকে গোশতপি-ে পরিণত করেছি, এরপর সেই গোশতপি- থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে একটি নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা কতই না কল্যাণময়।” (পবিত্র সূরা মু’মিনুন শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১২-১৪)

পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে অন্যত্র ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

يَا اَيُّهَا النَّاسُ اِنْ كُنْتُمْ فِىْ رَيْبٍ مِّنَ الْبَعْثِ فَاِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُـمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُـمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُـمَّ مِنْ مُّضْغَةٍ مُّـخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُـخَلَّقَةٍ لِّنُبَيِّنَ لَكُمْ ۚ وَنُقِرُّ فِى الْاَرْحَامِ مَا نَشَاءُ اِلٰى اَجَلٍ مُّسَمًّى ثُـمَّ نُـخْرِجُكُمْ طِفْلً.

অর্থ : “হে মানব সম্প্রদায়! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছো, তবে (ভেবে দেখো-) আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর নুতফা থেকে, এরপর আলাক্ব বা জমাট রক্ত থেকে, এরপর আংশিক পূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট বা আংশিক গঠিত ও আংশিক অপূর্ণাকৃতিবিশিষ্ট বা আংশিক অগঠিত গোস্তপি- থেকে, তোমাদের কাছে ব্যক্ত করার জন্যে। আর আমি এক নির্দিষ্ট কালের জন্যে মায়ের রেহেমে যা ইচ্ছা রেখে দেই, এরপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় বের করি।” (পবিত্র সূরা হজ্জ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫)

সুতরাং অত্র আয়াত শরীফ (৭১:১৪) উনার মধ্যে বর্ণিত ‘বিভিন্ন পর্যায়’ বলতে- নুতফা > আলাক্ব > মুদগা > ইজমা > পূর্ণাঙ্গ আকৃতি এই ধারাক্রমকে বুঝানো হয়েছে। এখানে ‘বিভিন্ন পর্যায়’ বলতে কল্প কাহিনী নির্ভর ও বাস্তব প্রমাণবিহীন বিবর্তনবাদের প্রাইমেট পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন ধাপকে বুঝানো হয়নি।

এছাড়াও অত্র আয়াত শরীফ (৭১:১৪) উনার মধ্যে خَلَقَكُمْ ‘খালাক্বাকুম’ শব্দ মুবারক ব্যবহৃত হয়েছে, যা বহুবচন বাচক শব্দ মুবারক। সকল প্রাণীর উৎপত্তি যদি এককোষী জীব থেকেই হতো তাহলে خَلَقَكُمْ ‘খ¦লাক্বাকুম’ শব্দ মুবারক ব্যবহার না হয়ে বরং একবচন বাচক শব্দ خَلَقَ ব্যবহৃত হতো। কিন্তু তা হয়নি। তাই অত্র আয়াত শরীফ (৭১:১৪) উনার দ্বারা কল্প কাহিনী নির্ভর ও বাস্তবতা বিবর্জিত বিবর্তনবাদের দাবী করা নিতান্তই বাতুলতা বৈ কিছুই নয়। কোন মুসলমান এ আয়াত শরীফ তো নয়ই এমনকি অন্য কোন আয়াত শরীফ দ্বারাও বিবর্তনবাদের দাবী করতে পারে না। যদি কোথাও এ জাতীয় ভ্রান্ত দাবী করাও হয়ে থাকে তবে বুঝতে হবে যে, তা কোন মুসলিম নামধারী নাস্তিকই করেছে বা লিখেছে।

উপরন্তু কথিত বিবর্তনবাদ হচ্ছে বংশধারাক্রমে বাস্তবতা বিবর্জিতভাবে আরোপিত একটি কাল্পনিক প্রক্রিয়া। যদি অত্র আয়াত শরীফ (৭১:১৪) উনার দ্বারা এই কাল্পনিক প্রক্রিয়াকেই বুঝানো হতো তাহলে خَلَقَكُمْ ‘খালাক্বাকুম’ বা ‘সৃষ্টি করা হয়েছে’ শব্দ মুবারক ব্যবহৃত না হয়ে বরং جَعَلَكُمْ ‘যা‘য়ালাকুম’ বা ‘আরোপ করা হয়েছে’ ব্যবহৃত হতো, কিন্তু তা হয়নি।

সুতরাং এটা সুনিশ্চিত যে, অত্র আয়াত শরীফ (৭১:১৪) উনার দ্বারা কখনোই কাল্পনিক ও বাস্তবতা বিবর্জিত বিবর্তনবাদের দাবী করা সম্ভব নয়।

নাস্তিকরা নিম্নোক্ত আয়াত শরীফ ব্যবহার করেও পবিত্র কুরআন শরীফ বিবর্তনের পক্ষে বলে দাবী তুলেছে।

نَّـحْنُ خَلَقْنَاهُمْ وَشَدَدْنَا اَسْرَهُمْ ۖ وَاِذَا شِئْنَا بَدَّلْنَا اَمْثَالَـهُمْ تَبْدِيْلًا.

অর্থ : “আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি এবং মজবুত করেছি তাদের গঠন। আমি যখন ইচ্ছা করবো, তাদের সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে তাদের অনুরূপ অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।” (পবিত্র সূরা দাহর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৮)

অত্র আয়াত শরীফ (৭৬:২৮) উনার মধ্যে বর্ণিত بَدَّلْنَا ‘বাদ্দালনা’ (আমি পরিবর্তন করবো) পদটি সাধারণ কর্মপদ, যা বক্তব্যকে করেছে বেগবান। আর اِذَا شِئْنَا ‘ইযা শি’না’ (আমি যখন ইচ্ছা করবো) শর্তযুক্ত বাক্য, সংযোজিত হয়েছে شَدَدْنَا ‘শাদাদ্না’ (আমি সুদৃঢ় করেছি) কথাটির সঙ্গে। এভাবে এখানকার পুরো বাক্যটি হয়েছে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি এক কঠোর ভৎসনা। কেননা তারা মহান আল্লাহ পাক উনার অনুগ্রহরাজীর প্রতি প্রকাশ করেছে চরম অকৃতজ্ঞতা। আর সর্বোত্তম অনুগ্রহ হিসেবে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অস্তিত্ব সৃষ্টির। কারণ অস্তিত্ব প্রাপ্তিই সকল অনুগ্রহের মূল। এভাবে এখানে মহান আল্লাহ পাক তিনি উনার হাবীব ও মাহবূব, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ, হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এই মর্মে সাত্ত্বনা মুবারক প্রদান করেছেন যে, সেদিন তো বেশী দূরে নয়, যেদিন তাদেরকে অবনমিত করা হবে শোচনীয়ভাবে। অতএব হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি এ ব্যাপারে বিচলিত হবেন না মোটেও। বলাবাহুল্য, সেরকমই ঘটেছিলো। সম্মানিত বদর জিহাদে তারা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিলো যে, আর কখনো উত্থানের মুখ দেখেনি। আর এখানকার اِذَا ‘ইজা’ (যখন) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে اِنْ ‘ইন’ (যদি) অর্থে। এভাবে বক্তব্যটি দাঁড়ায়- যদি আমি ইচ্ছা করি, তবে তাদেরকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তদস্থলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি অন্য কোন জাতিগোষ্ঠিকে, যারা মহান আল্লাহ পাক উনার অনুগ্রহরাজী প্রাপ্তির পর অকৃতজ্ঞ না হয়ে বরং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।

উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ পাক তিনি এরকম ইচ্ছা আর করেননি। সুতরাং বুঝতে হবে, এখানে কেবল প্রকাশ করা হয়েছে উনার চির অপ্রতিরোধ্য ও সততস্বাধীন ‘অভিপ্রায়’ গুণের কথা।

এই চির অপ্রতিরোধ্য ও সততস্বাধীন ‘অভিপ্রায়’ গুণের ব্যাপারেই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

اِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ اَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِاٰخَرِيْنَ وَكَانَ اللهُ عَلٰى ذٰلِكَ قَدِيْرًا.

  অর্থ : “হে মানব সম্প্রদায়! যদি মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদেরকে সরিয়ে তোমাদের জায়গায় অন্য কাউকে প্রতিষ্ঠিত করেন? বস্তুতঃ মহান আল্লাহ পাক উনার সে ক্ষমতা রয়েছে।” (পবিত্র সূরা নিসা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৩)

আর তাই মহান আল্লাহ পাক উনার কাফির-মুশরিকদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অভিপ্রায়কে ‘বিবর্তনতত্ত্ব’ হিসেবে জুড়ে দেয়া মূলতঃ নাস্তিকদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।

নাস্তিকরা পবিত্র কুরআন শরীফ বিবর্তনের পক্ষে বলে দাবী তুলতে গিয়ে অন্য যে আয়াত শরীফ ব্যবহার করে তা হচ্ছে-

وَرَبُّكَ الْغَنِيُّ ذُو الرَّحْـمَةِ ۚ اِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَسْتَخْلِفْ مِنْ بَۢعْدِكُمْ مَّا يَشَاءُ كَمَا اَنْشَأَكُمْ مِّنْ ذُرِّيَّةِ قَوْمٍ اٰخَرِيْنَ.

অর্থ : “আপনার প্রতিপালক অমুখাপেক্ষী, করুণাময়। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে অপসারণ করতে এবং তোমাদের পরে যাকে ইচ্ছা তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন; যেমন তিনি তোমাদেরকে অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশধর থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (পবিত্র সূরা আন‘আম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৩৩)

অত্র আয়াত শরীফ (৬:১৩৩) উনার শুরুতেই বলা হয়েছে- وَرَبُّكَ الْغَنِيُّ ذُو الرَّحْـمَةِ (আপনার প্রতিপালক অমুখাপেক্ষী, করুণাময়)। এ কথার অর্থ হচ্ছে- মহান আল্লাহ পাক উনার বান্দাদের প্রতি আদেশ-নিষেধ অর্পণ করার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক উনার কোন অভাব মোচন বা উপকার প্রাপ্তির কোন উদ্দেশ্যই নেই। কারণ মহান আল্লাহ পাক তিনি সমস্ত মাখলুকাত হতে সমস্ত দিকে হতেই অমুখাপেক্ষী। তাছাড়া তিনি মহান ও দয়ালুও বটে। তাই তিনি দয়া করে পাপ করার সঙ্গে সঙ্গেই পাপিষ্ঠকে শাস্তিদান না করে বরং অবকাশ দান করেন। দেন তওবা ও সংশোধনের সুযোগ। যা উনার দয়াশীলতার একটি অনন্য নিদর্শন।

এরপরে বলা হয়েছে- اِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَسْتَخْلِفْ مِنْ بَۢعْدِكُمْ مَّا يَشَاءُ كَمَا اَنْشَأَكُمْ مِّنْ ذُرِّيَّةِ قَوْمٍ اٰخَرِيْنَ (তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে অপসারণ করতে এবং তোমাদের পরে যাকে ইচ্ছা তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন; যেমন তিনি তোমাদেরকে অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশধর থেকে সৃষ্টি করেছেন)। এ কথার অর্থ হচ্ছে- হে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার অধিবাসী! মহান আল্লাহ পাক তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের পাপাচারের কারণে তোমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। আর তোমরা ধ্বংস হয়ে গেলে মহান আল্লাহ পাক উনার কোন ক্ষতি হবে না। কারণ তিনি কারো মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ও মুক্ত। মহান আল্লাহ পাক তিনি কোন কোন সম্প্রদায়কে তাদের পাপাচারের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছেনও। যেমন অবকাশ ও তওবা করে সংশোধনের সুযোগ দেয়ার পরও পাপাচারের কারণে আদ ও সামুদ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। আবার ইচ্ছে করলে মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদেরকে সরিয়ে তদস্থলে অন্য কাউকেও প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। এখানে অন্য কাউকেও অর্থ হচ্ছে- যে বা যারা অনুগত, তাদেরকে। আর মহান আল্লাহ পাক তিনি এ রকম করেছেনও। যেমন ইতোপূর্বে তো তোমাদের অস্তিত্বই ছিলো না। অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশ থেকে তোমাদেরকে মহান আল্লাহ পাক তিনিই সৃষ্টি করেছেন। আর দেখো, এখনও তিনি তোমাদের সংশোধনের অবকাশ দিয়েই চলেছেন। দয়া করে এখনও টিকিয়ে রেখেছেন তোমাদের অস্তিত্ব।

সাধারণভাবে, ذُرِّيَّةِ বলতে মূলকেও বুঝায় আবার বংশকেও বুঝায়। আর এই মূল বা বংশ হচ্ছে মানবজাতি থেকে। কেননা এই ذُرِّيَّةِ শব্দ মুবারক শুধুমাত্র মানবজাতির দিকেই ইজাফত দিয়ে থাকে।

মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ উনার মধ্যে ৮টি সূরা শরীফ উনাদের মধ্যে ১১ খানা আয়াত শরীফ উনাদের মধ্যে ১২ বার ذُرِّيَّةِ শব্দ মুবারক ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-

পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১২৪ ও ১২৮        : ১ বার করে ২ বার

পবিত্র সূরা আন‘য়াম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৪ ও ১৩৩        : ১ বার করে ২ বার

পবিত্র সূরা ইবরাহীম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৭ ও ৪০         : ১ বার করে ২ বার

পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৮           : ২ বার

পবিত্র সূরা আনকাবুত শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭           : ১ বার

পবিত্র সূরা ছফফাত শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৩           : ১ বার

পবিত্র সূরা আহক্বাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫           : ১ বার

পবিত্র সূরা হাদীদ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ২৬                     : ১ বার

মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-

وَوَهَبْنَا لَهُ اِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ ۚ كُلًّا هَدَيْنَا ۚ وَنُوْحًا هَدَيْنَا مِنْ قَبْلُ ۖ وَمِن ذُرِّيَّتِهِ دَاوُوْدَ وَسُلَيْمَانَ وَاَيُّوْبَ وَيُوْسُفَ وَمُوْسٰى وَهَارُوْنَ ۚ وَكَذٰلِكَ نَـجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ.   

অর্থ : “আমি উনাকে দান করেছি হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম উনাকে এবং হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম উনাকে। প্রত্যেককেই আমি পথ প্রদর্শন করেছি এবং পূর্বে আমি হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনাকে পথ প্রদর্শন করেছি- উনার আওলাদ উনাদের মধ্যে হযরত দাঊদ আলাইহিস সালাম, হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম, হযরত আইউব আলাইহিস সালাম, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম, হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত হারুন আলাইহিস সালাম উনাদেরকে। এমনিভাবে আমি সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (পবিত্র সূরা আন‘য়াম শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৮৪)

অত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ব্যবহৃত ذُرِّيَّتِهِ শব্দ মুবারক দ্বারা যেমন মানব বংশধর বুঝানো হয়েছে ঠিক তেমনি পবিত্র সূরা আন‘য়াম শরীফ উনার ১৩৩ নং পবিত্র আয়াত শরীফ (৬:১৩৩) উনার মধ্যে ব্যবহৃত ذُرِّيَّتِهِ শব্দ মুবারক দ্বারাও মানব বংশধর বুঝানো হয়েছে। আর এই আয়াত শরীফ (৬:১৩৩) উনার ذُرِّيَّتِهِ শব্দ মুবারক উনার পরে “قَوْمٍ اٰخَرِيْنَ (অন্য সম্প্রদায়) শব্দ মুবারকদ্বয় দ্বারা হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনার বংশধরকে বুঝানো হয়েছে”। (তাফসীরে জালালাইন শরীফ)

এছাড়া قَوْمٍ اٰخَرِيْنَ (অন্য সম্প্রদায়) শব্দ মুবারকদ্বয় দ্বারা হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার বংশধরকে ইঙ্গিত করে। কেননা হযরত খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি যখন সিরিয়া থেকে হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে সহ হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনাকে পবিত্র মক্কা শরীফ উনার জনমানব ও পানিশূণ্য মরু উপতক্যায় রেখে যান। তখন উক্ত উপত্যকা থেকে দূরবর্তী এক অঞ্চলে বসবাস করত জুরহুম গোত্র। 

হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার ক্বদম মুবারক উনার আঘাতে যখন পানিশূণ্য মরু উপতক্যায় যমযম কূপের সৃষ্টি হলো তখন সে কূপের উপর পাখির আনাগোনা ও উড়ে বেড়ানো দেখে জুরহুম গোত্র নিশ্চিত হলো যে, উপত্যকার আশেপাশে কোথাও পানি পাওয়া গেছে। এরপর হযরত উম্মু যবীহুল্লাহ আলাইহাস সালাম উনার মুবারক অনুমতিক্রমে জুরহুম গোত্র দলে দলে রহমতের এ ঝরনাধারার চারপাশে গড়ে তুললো বসতি। পরবর্তীতে হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সাথে জুরহুম গোত্রের বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

সুতরাং অত্র আয়াত শরীফ (৬:১৩৩) উনার মধ্যে যাদেরকে উদ্দেশ্য করে আলোচনা করা হচ্ছে সেই পবিত্র মক্কা শরীফ উনার অধিবাসীরাই হযরত যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার বংশধর, যিনি সিরিয়া হতে পবিত্র মক্কা শরীফ তাশরীফ মুবারক আনেন।

আর তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন- كَمَا اَنْشَأَكُمْ مِّنْ ذُرِّيَّةِ قَوْمٍ اٰخَرِيْنَ “তিনি তোমাদেরকে অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশধর থেকে সৃষ্টি করেছেন”। 

সুতরাং অত্র আয়াত শরীফ (৬:১৩৩) উনার দ্বারাও মানববংশের ক্রমধারাই বর্ণিত হয়েছে। বিবর্তনের মতো কোন কল্প কাহিনী বর্ণনা করা হয়নি।

অতএব প্রথম আয়াত শরীফ (৭১:১৪) উনার মধ্যে “বিভিন্ন পর্যায়ে” বলতে মায়ের রেহেমে মানুষের সৃষ্টির বিভিন্ন পর্যায়ক্রম যেমন - নুতফা > আলাক্ব > মুদগা > ইজমা > পূর্ণাঙ্গ আকৃতি এই ধারাক্রমকে বুঝানো হয়েছে। 

দ্বিতীয় আয়াত শরীফ (৭৬:২৮) উনার মধ্যে বর্ণিত “অনুরূপ অন্য জাতিকে” বলতে সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তদস্থলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী জাতিগোষ্ঠিকে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়কে বর্ণনা করা হয়েছে।

তৃতীয় আয়াত শরীফ (৬:১৩৩) উনার মধ্যে বর্ণিত “অন্য এক সম্প্রদায়ের বংশধর থেকে” বলতে মানববংশ পরম্পরা বুঝানো হয়েছে।

অর্থাৎ অত্র আয়াত শরীফত্রয় দ্বারা কখনোই কল্প-কাহিনীবাদ তথা বিবর্তনবাদ, যা নাস্তিক্যবাদের অপর নাম, তা ব্যাখ্যা করা মূলত চরম মূর্খতার শামীল।

আর নাস্তিকরা বিবর্তনের পক্ষে বলে দাবী তুলতে গিয়ে অন্য যে ৩টি আয়াত শরীফ (৭১:১৭, ২৪:৪৫, ২:৩৫) ব্যবহার করে উক্ত আয়াত শরীফত্রয় উনাদের মধ্যেও বিবর্তনীয় আলোচনার লেশমাত্র নেই। যেমন-

وَاللَّـهُ أَنبَتَكُم مِّنَ الْأَرْضِ نَبَاتًا

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদেরকে মৃত্তিকা থেকে উদগত করেছেন।” (পবিত্র সূরা নূহ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৭)

وَاللهُ خَلَقَ كُلَّ دَابَّةٍ مِّن مَّاءٍ ۖ فَمِنْهُم مَّن يَـمْشِي عَلٰى بَطْنِهِ وَمِنْهُم مَّن يـَمْشِي عَلٰى رِجْلَيْنِ وَمِنْهُم مَّن يَـمْشِي عَلٰى اَرْبَعٍ ۚ يَـخْلُقُ اللهُ مَا يَشَاءُ ۚ اِنَّ اللهَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ ◌

অর্থ : “মহান আল্লাহ পাক তিনি প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে কিছু পেটে ভর দিয়ে চলে, কিছু দুই পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কিছু চার পায়ে ভর দিয়ে চলে; মহান আল্লাহ পাক তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি সবকিছু করতে সক্ষম।” (পবিত্র সূরা নূর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৫)

وَقُلْنَا يَا اٰدَمُ اسْكُنْ اَنْتَ وَزَوْجُكَ الْـجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هٰذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُوْنَا مِنَ الظَّالِمِيْنَ.

অর্থ : “এবং আমি হযরত আদম আলাইহিস সালাম উনাকে হুকুম করলাম যে, আপনি ও আপনার জাওযা আলাইহাস সালাম তিনি সহ জান্নাতে বসবাস করতে থাকুন এবং ওখানে যা চান, যেখান থেকে চান, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাকুন, কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হবেন না। অন্যথায় আপনারা যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বেন।” (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৫)

উপরোক্ত আয়াত শরীফত্রয় উনাদের দ্বারা একমাত্র মস্তিষ্ক বিকৃত নাস্তিকরাই তাদের কল্প-কাহিনীবাদের পক্ষে দলীল দিয়ে থাকে।

কাজেই, নাস্তিকদের উত্থাপিত পবিত্র কুরআন শরীফ উনার ৬ খানা আয়াত শরীফ (৭১:১৪, ৭৬:২৮, ৬:১৩৩, ৭১:১৭, ২৪:৪৫, ২:৩৫) দ্বারা তো পবিত্র কুরআন শরীফ বিবর্তনের পক্ষে দাবী করার প্রশ্নই আসে না, এমনকি অন্য কোন আয়াত শরীফ দ্বারাও কেউ বিবর্তনের পক্ষে প্রমাণ উপস্থান করতে পারবে না। কেননা মানুষ সহ প্রত্যেকটি জীব আলাদা আলাদা সৃষ্টি। যার প্রমাণ পৃথিবীতে সুস্পষ্ট।

বিবর্তনের কোন ধারা পৃথিবীতে কখনোই প্রকাশিত হয়নি, হচ্ছে না এবং কোন দিন হবেও না। আর তাই সৃষ্টিতত্ত্ব মুতাবিক প্রত্যেক সৃষ্ট জীব আদি পিতা-আদি মাতা থেকেই বিস্তৃত হয়েছে। যেমন মানুষের ব্যাপারে বর্ণিত আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও আদি মাতা হযরত হওওয়া আলাইহাস সালাম উনাদের থেকে মানবজাতির বংশক্রম কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে। এখানে বিবর্তনের কোন স্থানই নেই। এমন সুস্পষ্ট প্রমাণ বর্তমান থাকার পরও বাস্তবতাকে অস্বীকারকারী ও উদ্ভট কল্পনায় বিশ্বাসী নাস্তিকরা শুধুমাত্র তাদের নিজস্ব বিশ্বাসের দ্বারা বিবর্তন নামক এক উদ্ভট কল্প কাহিনীকে মেনে নিয়েছে এবং জোর করে কথিত বিবর্তনবাদকে বিজ্ঞানের বিবেচ্য বিষয় হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

কিন্তু কৌতুককর ব্যাপার হচ্ছে যে, প্রজননবিদ ও স্পষ্টভাষী বিবর্তনবাদী, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড সি. লিওনটিস নিজেকে “প্রথমে ও সর্বাত্মকভাবে একজন বস্তুবাদী ও তারপর একজন বিজ্ঞানী” বলে ঘোষণা করে বলে- “এমন নয় যে, বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানের কোন প্রকারে আমাদেরকে চাক্ষুষ বস্তু জগতের একটি বস্তুবাদী ব্যাখ্যা গ্রহণে বাধ্য করে; পরন্তু বস্তুবাদী কার্যকারণসূত্রের প্রতি আমাদের অপ্রমাণিত ধারণাপ্রসূত অসামঞ্জস্য হেতু আমরা অনুসন্ধানের এমন একটি ছক নির্মাণে ও কতিপয় অনুষঙ্গী ধারণা গ্রহণে বাধ্য হই, তা সে যত স্বজ্ঞানবিরোধীই হোক কিংবা বিজ্ঞজনের কাছে যত রহস্যজনক বলেই মনে হোক। অধিকিন্তু, যেহেতু বস্তু‘বাদ পরম, অবিকল্প, সেহেতু আমরা এর চৌকাঠে কোন ঐশ্বরিক পদচারণা অনুমোদন করতে পারি না।” (দি ডেমন হান্টেড ওয়াল্ড, দি নিউইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস, ৯ জানু: ১৯৭৭, পৃষ্ঠা-২৮)

এসব বক্তব্য থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, বিবর্তনবাদ হচ্ছে এমন একটি গোঁড়া মতবাদ যা শুধু বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি আনুগত্যের কারণেই জীইয়ে রাখা হয়েছে। এই মতবাদ দাবী করে যে, বস্তু ব্যতীত অপর কোন সত্তা নেই, অজান্তব অচেতন বস্তুই জীবন সৃষ্টি করেছে। লক্ষ লক্ষ প্রজাতির ও প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে বস্তুসমগ্রের মিথস্ক্রিয়ার ফলে যথা- বৃষ্টিপাত, বিদ্যুৎচমক, নিষ্প্রাণ পদার্থপুঞ্জের আকস্মিক সমাপতন। এইসব ধারণা যুক্তি ও বিজ্ঞান উভয়েরই পরিপন্থি। তবুও বিবর্তনবাদীরা এখনো এসব ধারণাই আঁকড়ে ধরে আছে শুধু ‘চৌকাঠে কোন ঐশ্বরিক পদচারণা অনুমোদন করতে’ না পারার জন্য। 

যে কেউ বস্তুবাদী সংস্কার বর্জন করে প্রাণের উৎপত্তির বিষয়ে চিন্তা করলেই এই স্পষ্ট সত্যটি উপলব্ধি করতে পারবে-সমস্ত প্রাণ সত্তাই হচ্ছে এক মহান আল্লাহ পাক উনার সৃষ্টি, যিনি কূণ্য থেকে নিখুঁতরূপে সৃষ্টি করেছেন সমস্ত কিছু।

কিন্তু নাস্তিকরা এই বিষয়গুলো চিন্তা করেই না। তাই মহান আল্লাহ পাক তিনি এদের সম্পর্কে ইরশাদ মুবারক করেন-

وَلَوْ فَتَحْنَا عَلَيْهِم بَابًا مِّنَ السَّمَاءِ فَظَلُّوا فِيْهِ يَعْرُجُوْنَ ◌ لَقَالُوا اِنَّـمَا سُكِّرَتْ اَبْصَارُنَا بَلْ نَـحْنُ قَوْمٌ مَّسْحُوْرُوْنَ ◌

অর্থ : “যদি আমি ওদের সামনে আকাশের কোন দরজাও খুলে দেই আর তাতে ওরা দিনভর আরোহণও করতে থাকে। তবুও ওরা একথাই বলবে যে, আমাদের দৃষ্টির বিভ্রাট ঘটানো হয়েছে নাকি আমাদের চোখের সামনে কোন মায়াজাল বিস্তার করা হয়েছে।” (পবিত্র সূরা হিজর শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১৪-১৫)

বস্তুত এই মায়াজালে আবদ্ধ থাকার কারণেই নির্বোধ নাস্তিকরা বলছে- নিষ্প্রাণ জড়বস্তু থেকে আকস্মিক যোগাযোগের ফলে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। এ রকম উদ্ভট সব ধারণায় বিশ্বাসের ব্যাখ্যা ‘যাদু’ ছাড়া আর কি হতে পারে?   

মূলত হযরত মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনার সাথে নাস্তিক্যবাদী ফেরাউনের যাদুকরদের যাদুর প্রবঞ্চনার সাথেই নাস্তিক্যবাদীদের বিবর্তনবাদ তুলনীয়। মহান আল্লাহ পাক তিনি পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফ উনার মধ্যে যাদুকরদের ব্যাপারে ইরশাদ মুবারক করেন- 

قَالَ اَلْقُوا ۖ فَلَمَّا اَلْقَوْا سَحَرُوا اَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ وَجَاءُوا بِسِحْرٍ عَظِيمٍ ◌ وَاَوْحَيْنَا اِلٰى مُوسٰى اَنْ اَلْقِ عَصَاكَ ۖ فَاِذَا هِيَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُوْنَ ◌ فَوَقَعَ الْـحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا يَعْمَلُوْنَ ◌ فَغُلِبُوا هُنَالِكَ وَانقَلَبُوا صَاغِرِيْنَ ◌

অর্থ : “হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, তোমরাই নিক্ষেপ করো। যখন যাদুকররা নিক্ষেপ করলো তখন লোকদের চোখগুলোকে ধাঁধিয়ে দিলো, ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুললো এবং মহাযাদু প্রদর্শন করলো। তারপর মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম উনাকে ওহী মুবারক করলেন, এবার আপনার লাঠি মুবারক নিক্ষেপ করুন। অতপর লাঠি মুবারক নিক্ষেপের পর যাদুকরদের সমস্ত জালিয়াতি বা ভেল্কি গ্রাস করে ফেললো। এভাবেই প্রকাশ হয়ে গেল সত্য বিষয় এবং ভুল প্রতিপন্ন হয়ে গেলো যা কিছু তারা করেছিলো। সুতরাং তারা সেখানেই পরাজিত হয়ে গেলো এবং অতীব লাঞ্ছিত হলো।” (পবিত্র সূরা আ’রাফ শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৬-১১৯)

এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনাদের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে, যাদুকরেরা প্রথম ভেল্কি দেখায়, ফলশ্র“তিতে হযরত কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি এবং উনার অনুসারীরা ছাড়া বাকি সবাইকে এই যাদু প্রতারিত করতে পেরেছিল। কিন্তু যখন যাদুকরদের মিথ্যা প্রমাণিত হয় তখন তারা তাদের সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। আজকের দিনেও যারা একই ধরণের যাদুর ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে বিজ্ঞানের ছদ্মবেশধারী এইসব হাস্যকর ও উদ্ভট মতবাদে বিশ্বাস স্থাপন করছে তারাও সৃষ্টতত্ত্ব তথা সত্যের সামনে পরাজিত, লাঞ্ছিত ও অপদস্থ। কিন্তু তারপরেও তাদের লজ্জা হয় না।

তাই সাধারণ মানুষ যাতে নাস্তিক্যবাদের ভেল্কিতে বিভ্রান্ত না হয় সেজন্য বিবর্তনবাদের অসারতা সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোকপাত করা হলো-

বিবর্তনবাদের দাবী হচ্ছে, অচেতন, নিষ্প্রাণ পরমাণুরা হঠাৎ একদিন সিদ্ধান্ত নিলো যে, তারা সম্মিলিত হয়ে এমন একটি বিশ্ব সৃষ্টি করবে যা সংগঠন, শৃঙ্খলা, যুক্তি ও সচেতনতাবদ্ধ একটি নিখুঁত পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে এবং তার মধ্যে একটি গ্রহ যা প্রাণের অস্তিত্বের জন্য উপযোগী, সেখানে অসংখ্য জটিল জীবতান্ত্রিক পদ্ধতিসম্পন্ন জীবন্ত প্রজাতিসমূহ বিচরণ করছে। অথচ জড়জগতের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, একটি সংবেদনশীল ভারসাম্যের উপর বস্তুনিচয়ের পরমাণুসমূহ বিন্যস্ত। অপরপক্ষে জীবজগতের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায়, কি জটিল নক্সার ভিত্তিতে এসব পরমাণুর সমাহার ঘটেছে এবং তাদের সহযোগে কি অসাধারণ বস্তুসমূহ যথা প্রোটিন, এনজাইম ও কোষ গঠন করা হয়েছে। প্রাণের এ অসাধারণ রূপবিন্যাস বিবর্তনবাদের কবর রচনা করেছে।

বিবর্তনবাদ অনুযায়ী সকল প্রাণীরই আদি উৎস এক ও অভিন্ন ছিল, সময়ে পরিক্রমায় প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। বিবর্তনবাদের এই মতবাদটি কোন বাস্তব বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এমনকি বিবর্তনবাদের প্রবক্তা ডারউইনও নিজে স্বীকার করেছে যে, এটি একটি ধারণা মাত্র। অধিকিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে ডারউইনের “তত্ত্বটির কতিপয় সমস্যা”র কোন সমাধান তো হয়ইনি বরং সমস্যার মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। ফলে বিবর্তনবাদ নিক্ষিপ্ত হয়ে আস্তাকুঁড়ে।  

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবর্তনবাদ ধিকৃত হওয়ার মূল কারণ তিনটি-

১. পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব কিভাবে ঘটলো তার কোন ব্যাখ্যা এই মতবাদ দিতে পারে না। যা এই ধিকৃত মতবাদের ১ম অনতিক্রম বাধা। এই ধিকৃত মতবাদ অনুযায়ী, পৃথিবীর বুকে ৩৮০ কোটি বছর আগে একটিমাত্র জীবিত কোষের উদ্ভব ঘটে আর তা থেকেই সমস্ত জীবন্ত প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। একটি মাত্র কোষ কি করে লক্ষ লক্ষ জটিল জীবন্ত প্রজাতির জন্ম দিতে পারে এবং সত্যিই যদি এরকম কোন বিবর্তনের মাধ্যমে পরবর্তী সমস্ত জীবন্ত প্রজাতির উদ্ভব ঘটতো তাহলে জীবাশ্মের ইতিহাসে এর কোন চিহ্ন মাত্র পাওয়া যাচ্ছে না কেন? এই প্রশ্নে কোন উত্তর বিবর্তনবাদীদের কাছে নেই। 

বিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ ‘প্রথম কোষ’-এর উৎপত্তি কিভাবে হলো এই বিষয়ে তাদেরকে প্রশ্ন করা তো জড়বস্তুকে প্রশ্ন করার নামান্তর। যে মতবাদ প্রথম কোষের উৎপত্তি কিভাবে তার কোন ধারণাই দিতে পারে না তাদের কাছ থেকে পরবর্তী বিষয়গুলোর কোন উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না।

সৃষ্টিতত্ত্বের কোন প্রকার অধিভৌতিক শক্তি অস্বীকার করে বিধায় দাবী করে যে, প্রথম কোষটি প্রকৃতির নিয়মাবলীর মধ্যেই যোগাযোগের কারণে উদ্ভুত হয়, এর পেছনে কোন নক্সা, বিন্যাস বা পরিকল্পনা ছিলো না। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মিশ্রণের কারণে জড় বা অজৈব বস্তু থেকে জৈব কোষের উদ্ভব ঘটে। জীববিদ্যার অলঙ্ঘনীয় নিয়মাবলীর সঙ্গে এ দাবী অসঙ্গতিপূর্ণ। 

বিবর্তনবাদের অজীবজনি বিশ্বাস এই যে, পোকা-মাকড়ের জন্ম হয় খাদ্যের উচ্ছিষ্ট থেকে এবং ইঁদুরের জন্ম হয় গম থেকে। এই ভ্রান্ত ও অবাস্তব বিশ্বাসকে প্রমাণ করার অনেক কৌতুককর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এক টুকরো নোংরা কাপড়ের উপর কিছু গম রেখে ভাবা হতো খানিক পরেই ওখান থেকে ইঁদুর লাফিয়ে ছুটবে। অনুরূপে গোশতে উৎপন্ন কীট মনে করা হতো অজীবজনি বিশ্বাসের অভ্রান্ত প্রমাণ। কিন্তু অল্পকাল পরেই জানা যায়, ওই কীট গোশতে স্বতঃজনিত হয়ে উদ্ভব হয়নি, বরং মাছিরা তাকে ওখানে বয়ে নিয়ে গেছে লার্ভা আকারে, খোলা চোখে যা দেখা যায়নি। এমনকি বিবর্তনবাদের প্রবক্তা ডারউইনের বই লেখার সময়েও বিজ্ঞানের জগতে রোগজীবাণু (ব্যাকটেরিয়া) অজীবজনি এ বিশ্বাসটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ছিল।

ডারউইনের মতবাদটি প্রকাশের ৫ বছর পর লুই পাস্তুর তার দীর্ঘ গবেষণালব্দ ফলাফল প্রকাশ করে ডারউইনের বিবর্তনবাদের অন্যতম স্তম্ভস্বরূপ বিবেচিত অজীবজনি মতটিকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে দেয়। ১৮৬৪ সালে লুই পাস্তুর তার ভাষণে প্রকাশ করে যে, “এ সরল গবেষণা যে মরণাঘাত হেনেছে তা সয়ে আর কোনদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না অজীবজনি তত্ত্ব।” (মলিকুলার ইভোলুশন এন্ড দি অরিজিন অফ লাইফ, ১৯৭৭ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-২)

বিবর্তনবাদের প্রবক্তারা বহুদিন পাস্তুরের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করলেও বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রাণীদেহের কোষের যে জটিল গঠন উদঘাটন করে তার ফলে প্রাণ যে নিছক সংমিশ্রণ থেকে উত্থিত হতে পারে- এ ধারণাকে আরো কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলে।

জড়জগতের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার আকস্মিক যোগাযোগ থেকে জীবকোষের উৎপত্তি- এই বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা প্রমাণ করতে গিয়ে অবধারিতভাবে ব্যর্থ হয়ে, বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিবর্তনবাদী রুশ প্রাণীবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন স্বীকারোক্তি প্রদান করে যে- “দুর্ভাগ্যক্রমে জীবকোষের উৎপত্তির সমস্যাটিই হচ্ছে জৈব বিবর্তনের অন্বেষার সবচেয়ে অস্পষ্ট বিষয়।” (অরিজিন অফ লাইফ, ডোভার পাবেিলকেশন, ১৯৫৩ ঈসায়ী (পুণঃমুদ্রণ), পৃষ্ঠা-১৯৬)  

প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ ওপারিনের পরবর্তীতে (১৯৫৩ সালে) সর্বাপেক্ষা সুবিদিত পরীক্ষা চালায় মার্কিন রসায়ণবিদ স্ট্যানলী মিলার। আদি পৃথিবীর আবহাওয়াম-লে যেসব গ্যাস বিরাজমান ছিলো বলে স্ট্যানলী মিলার দাবী করে, একটি পরীক্ষায় সেসব গ্যাস সম্মিলিত করে সে মিশ্রণের সাথে শক্তি যুক্ত করে, অতপর তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রোটিনের সংযুক্তিতে বিদ্যমান কতিপয় জৈব অণু (অ্যামাইনো এসিড) সংশ্লেষিত করে।

এই পরীক্ষায় ব্যবহৃত আবহাওয়াম-ল ছিলো পৃথিবীর পার্থিব পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে মাত্র কয়েক বছর পার হতে না হতেই স্পষ্ট বোঝা যায় বিবর্তনবাদ প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে উপস্থাপিত এই পরীক্ষা অসিদ্ধ। (নিউ এভিডেন্স অন ইভোলুশন অফ আর্লি এটমোস্ফিয়ার এন্ড লাইফ, বুলেটিন অফ দি আমেরিকান মেটেরোরোজিক্যাল সোসাইটি, ভলিউম ৬৩, নভে: ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১৩২৮-১৩৩০)  

দীর্ঘ নীরবতার পর মিলার স্বীকার করে যে, পরীক্ষায় যে আবহাওয়া মাধ্যম ব্যবহার করা হয়েছে তা ছিল অবাস্তব। (মলিকুলার ইভোলুশন অফ লাইফ : কারেন্ট স্ট্যাটাস অফ দি প্রিবায়োটিক সিনথেসিস অফ স্মল মলিকুলস, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা-৭)

সান ডিয়েগো স্ক্রিপ্স্ ইন্সটিটিউটের ভূ-রসায়নবিদ জেফ্রি বাডা এটা স্বীকার করেছে- আজ এই বিংশ শতাব্দীর বিদায় লগ্নে আমরা এখনো সেই বৃহত্তম অমীমাংসিত সমস্যাটির সম্মুখীন হয়ে আছি যার সম্মুখীন আমরা হয়েছিলাম বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল? (আর্থ : ফেব্রু: ১৯৯৮, পৃষ্ঠা-৪০)

যেহেতু সরলতম বলে বিবেচিত জীবের মধ্যেও রয়েছে অবিশ্বাস্য রকমের জটিল অবকাঠামো, আর এই কারণেই বিবর্তনবাদের এমন বৃহৎ অচলায়তনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একটি জীবকোষ মানুষের সমস্ত প্রযুক্তিগত উৎপাদের চেয়ে জটিল। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উন্নত গবেষণাগারেও অজৈব বস্তুর সমাহার ও সংশ্লেষে একটি জীবকোষ উৎপাদন করা যাবে না। একটি জীবকোষ গঠনের জন্য অনুকূল ও সহযোগী অবস্থা, পরিবেশ ও অনুষঙ্গের সংখ্যা এত বিপুল যে শুধু সংমিশ্রণের তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাবে না।

কোষ গঠনের মূল উপাদান প্রোটিনের সমাপতনিকভাবে সংশ্লেষিত হওয়ার সম্ভাবনা ৫০০ অ্যামাইনো এসিডযুক্ত সাধারণ প্রোটিনের ক্ষেত্রে ১০৯৫০-এ ১। স্মরণীয় যে, গণিতশাস্ত্রে ১০৫০-এ ১ অপেক্ষা কম সম্ভাবনাকে কার্যত অসম্ভব বলে বিবেচনা করা হয়।

কোষের পরমাণু কেন্দ্রে অবস্থিত ডিএনএ অণু হচ্ছে বংশানুগতি তথ্যের ভান্ডার এবং এটি একটি অবিশ্বাস্য তথ্য ভা-ার। হিসেব কষে দেখা গিয়েছে ডিএনএতে কোড করা তথ্য যদি কাগজে কলমে লেখা হয়, তাহলে তা দিয়ে প্রতিটি ৫০০ পৃষ্ঠা সম্বলিত ৯০০ খ-ের বিশ্বকোষের এক বিশাল গ্রন্থাগার গড়া যাবে।

কতিপয় বিশেষায়িত প্রোটিন (এনজাইম) সহযোগেই কেবল এসব ডিএনএর পুণর্সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এনজাইমগুলোর সংশ্লেষণ সম্ভব কেবল ডিএনএতে কোড করা তথ্য দ্বারা। যেহেতু তারা উভয়ে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং পুণর্সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় উভয়কে একই সময়ে বিদ্যমান থাকতে হবে। প্রাণ আপনা-আপনি উদ্ভুত হয়েছে এই মতবাদটি এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে। 

ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট বিবর্তনবাদী লেসলি ওর্গেল এই মতবাদের বিপর্যয় স্বীকার করেছে- প্রোটিন ও নিউক্লিক এসিড উভয়ের গঠনপ্রণালী অতি জটিল। এটা প্রায় অসম্ভব যে, উভয়ে একই স্থানে ও একই কালে স্বতঃ উদ্ভুত হয়েছিল। আবার, একটি ছাড়া অন্যটির অবস্থানও অসম্ভব মনে হয়। 

কাজেই প্রাথমিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তই করতে হয় যে, রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কস্মিনকালেও জীবনের উৎপত্তি হতে পারে না। (দি অরিজিন অফ লাইফ অন আর্থ, সাইন্টিফিক আমেরিকান, ভলিউম ২৭১, অক্টো: ১৯৯৪, পৃষ্ঠা-৭৮)

জীবন যদি প্রাকৃতিক উপায়ে উদ্ভূত না হয়ে থাকে তাহলে সন্দেহাতিতভাবে জীবন ‘সৃষ্টি করা হয়েছে’ অতিপ্রাকৃত উপায়ে। এই সত্য সুস্পষ্টভাবে বাতিল করে দেয় বিবর্তনবাদকে, যার মূল উদ্দেশ্য সৃষ্টিতত্ত্ব অস্বীকার করা।

২. মতবাদে প্রবক্ত বিবর্তনী প্রক্রিয়াগুলোর বিবর্তন করার আদৌ কোন ক্ষমতা আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করার যোগ্য কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত নেই। বিবর্তনবাদের ‘বিবর্তনী প্রক্রিয়া’র ধারণাই মূলত বাস্তবে বিবর্তনী ক্ষমতাহীন। অথচ ডারউইন তার তথাকথিত বিবর্তনবাদ সম্পূর্ণরূপে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ ধারণার উপর স্থাপন করেছে।

‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ ধারণা অনুযায়ী কেবল সেসব প্রাণীই জীবন সংগ্রামে টিকে থাকে যারা অধিকতর শক্তিশালী এবং তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অধিকতর উপযুক্ত। উদাহারণস্বরূপ, শিকারীর আক্রমণের হুমকির মুখে একটি হরিণের পালের মধ্যে যে হরিণগুলো দ্রুততর গতিতে দৌঁড়াতে সক্ষম সেগুলোই বেঁচে থাকবে। সুতরাং হরিণের পাল গড়ে উঠবে দ্রুততর ও বলবত্তর হরিণদের নিয়ে। তবে কোন সন্দেহেরই অবকাশ নেই যে, এই প্রক্রিয়া হরিণদের বিবর্তিত করে অন্য কোন প্রজাতিতে রূপান্তরিত করবে না।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার কোন বিবর্তনী ক্ষমতাই নেই। ডারউইনও এই বিষয়ে অবহিত ছিলো বলে তাকে বলতে হয়েছে- ঘটনাক্রমে অনুকূল বৈচিত্র্যের উদ্ভব না ঘটা পর্যন্ত প্রাকৃতিক নির্বাচনের কিছুই করার থাকে না। (দি অরিজিন অফ স্পিসিস এ ফেক্সিমাইল অফ দি ফার্স্ট এডিশন, হার্ভাট ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৪ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-১৮৯)

তাহলে এ ‘অনুকূল বৈচিত্র’ বা পরিবর্তনগুলো কিভাবে ঘটতে পারে? ডারউইন তার সমকালের বিজ্ঞানের পূর্বতন ধারণা থেকে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া চেষ্টা করেছে। ডারউইনের পূর্বসূরী ফরাসী জীববিজ্ঞানী ল্যামার্ক বলে যে, প্রাণীকূলের জীবনব্যাপী অর্জিত বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তর প্রজন্মে বর্তায়। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে সংবহিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সমাহারের ফলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে। ল্যামার্ক এ প্রসঙ্গে উদাহরণস্বরূপ দাবী করে যে, হরিণের বিবর্তনে জিরাফের উদ্ভব ঘটে। হরিণদের উঁচু ডালের পাতা খাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্মে তাদের গলা লম্বা হতে থাকে। পরিশেষে তাদের বিবর্তিত উত্তর প্রজন্ম জিরাফ আকারে নতুন প্রজাতিরূপে আবির্ভূত হয়েছে।

ডারউইনও অনুরূপ কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছে যে, কিছু ভাল্লুক খাদ্যের সন্ধানে পানিতে নেমে তিমি হয়ে যায় কালান্তরে। (দি অরিজিন অফ স্পিসিস এ ফেক্সিমাইল অফ দি ফার্স্ট এডিশন, হার্ভাট ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৪ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-১৮৪)

কিন্তু মে-েলের আবিষ্কৃত উত্তরাধিকারবিধি পুরোপুরি নস্যাৎ করে দেয় এ বিশ্বাস যে, প্রাণীকূলের অর্জিত বৈশিষ্ট্য উত্তর প্রজন্মে বর্তায়। এভাবেই একটি বিবর্তনবাদী প্রক্রিয়ারূপে প্রাকৃতিক নির্বাচন ধারণাটি অনাদৃত হয়ে পড়ে।

এছাড়াও হরিণ যখন উঁচু ডালের পাতা খাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় রত সেসময়ও যুগোপথভাবে পৃথিবীতে জিরাফ বিদ্যমান। এমনকি এখনো পৃথিবীতে হরিণও আছে জিরাফও আছে। আবার কিছু ভাল্লুক যদি খাদ্যের সন্ধানে পানিতে নেমে গিয়ে কালান্তরে তিমি হয়ে যেতে পারে তাহলে তিমি কেন তীরে উঠে এসে কালান্তরে ভাল্লুকে পরিণত হলো না। উপরন্তু যেসময় পৃথিবীতে ভাল্লুকের উপস্থিতি ছিলো একই সময়ে যুগোপথভাবে তিমিও বিরাজমান ছিলো, এমনকি উভয়েই আজো পৃথিবীতে বিরাজমান রয়েছে।

তাদের এ সমস্যা সমাধানে পৌঁছার আশায় বিবর্তনবাদীরা ১৯৩০ সালের শেষ দিকে উত্থাপন করে, ‘আধুনিক সংশ্লেষী মতবাদ’ যা নব্য ডারউইনীয় মতবাদ নামে সমধিক পরিচিতি।

নব্য ডারউইনীয় মতবাদ ‘অনুকূল বৈচিত্র্যের কারণ’ স্বরূপ প্রাকৃতিক পরিবর্তনে প্রাণীদেহে জীনের মিউটেশন বা পরিব্যক্তি ধারণার আমদানী করে। বাহ্যিক কারণ যথা বিকিরণ বা তেজস্ক্রিয়তা কিংবা পুণরুৎপাদন ভ্রমের ফলে জীনের এরূপ বিকৃতি ঘটে বলে তাদের ধারণা।

বর্তমান বিশ্বে নাস্তিকদের কাছে গ্রহণীয় এই নব্য ডারউইনীয় মতবাদ অনুযায়ী, পৃথিবীতে যে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী বিদ্যমান রয়েছে তাদের আবির্ভাব ঘটেছে এমন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাতে তাদের জটিল অঙ্গসংস্থানগুলো যথা - চোখ, কান, ফুসফুস, ডানা প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে জীনঘটিত বিকৃতির ফলে পরিব্যক্তি লাভ করে। কিন্তু পরিব্যক্তি প্রাণীদের বিকাশিত করে না বরং তাদের ক্ষতিসাধন করে থাকে- এই সোজা সাপ্টা বৈজ্ঞানিক সত্য নব্য ডারউইনীয় ধারণাকে নস্যাৎ করেছে। এর কারণ অতি সহজবোধ্য। ডিএনএর আছে অতি জটিল ও সুশৃঙ্খল বিন্যাস বা সংযুতি, এলোপাতাড়ি বিন্যাস ভঙ্গ কেবল তার ক্ষতিই করতে পারে।

মার্কিন প্রজনন বিজ্ঞানী বি. জি. রঙ্গনাথন এর ব্যাখ্যা দিয়েছে এভাবে- প্রথমত, প্রকৃতিতে প্রকৃত পরিব্যক্তি খুবই বিরল। দ্বিতীয়ত, পরিব্যক্তি যেহেতু জীনের সংযুতির সুশৃঙ্খল পরিবর্তন নয় বরং এলোপাতাড়ি, সেহেতু বেশিরভাগ পরিব্যক্তিই ক্ষতিকর। অতি সুশৃঙ্খল একটি সংযুতিতে এলোপাতাড়ি পরিব্যক্তির ফল মন্দই হবে, ভালো হবে না। উদাহরণস্বরূপ, কোন ভূমিকম্প যদি অতি সুশৃঙ্খল একটি সংযুতি, যেমন দালান কাঁপিয়ে দেয় তাহলে তার ফলে ওই সংযুতির কাঠামোতে যে পরিবর্তন সংঘটিত হবে তা কাঠামোর উন্নতিসূচক হবে না। (অরিজিন্স এন্ড পেনসেলভানিয়া : দি ব্যানার অফ ট্রাস্ট, ১৯৮৮ ঈসায়ী) 

কোন উপকারী পরিব্যক্তি অর্থাৎ যা জীন কোডকে উন্নত করে এমন কোন পরিব্যক্তি আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। সব পরিব্যক্তিই ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গিয়েছে- ‘বিবর্তন প্রক্রিয়া’ বলে যে পরিব্যক্তি হাজির করা হয়েছে তা আসলে জীন অভ্যন্তরের এমন একটি দূর্ঘটনা যা প্রাণীসত্ত্বাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং তাকে অক্ষম বা বিকলাঙ্গ করে। যেমন মানুষের ক্ষেত্রে পরিব্যক্তির সবচেয়ে সাধারণ পরিণাম হচ্ছে কর্কটরোগ বা ক্যান্সার। নিঃসন্দেহে একটি বিধ্বংসী প্রক্রিয়াকে ‘বিবর্তন প্রক্রিয়া’ বলা যায় না কোনভাবেই। অপরপক্ষে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন এককভাবে কিছুই করতে পারে না’ স্বয়ং ডারউইন-ই এ কথা স্বীকার করেছে। এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃতিতে ‘বিবর্তন প্রক্রিয়া’ বলে কিছুই নেই। যেহেতু বিবর্তন প্রক্রিয়ার কোন অস্তিত্ব নেই সুতরাং বিবর্তন নামে কোন কাল্পনিক ঘটনাও কদাপি সংঘটিত হয়নি।

৩. জীবাশ্মের ইতিহাস বিবর্তনবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করে।   বিবর্তনবাদে যেসব ঘটনা কথা বলা আছে তা যে কখনো ঘটেনি তার সুস্পষ্ট সাক্ষী হচ্ছে জীবাশ্মের ইতিহাস। বিবর্তনবাদ অনুযায়ী প্রতিটি প্রাণধারী প্রজাতি একটি পূর্বগামী প্রজাতি থেকে উদ্ভুত। একটি পূর্বতন প্রজাতি ক্রমাগত পরিব্যক্ত হয়ে কয়েক প্রজন্মান্তরে একটি ভিন্ন প্রজাতিরূপে আবির্ভূত হয়। এ বিবর্তন ক্রমাগত নিষ্পন্ন হয়েছে কোটি কোটি বছর ধরে, আর এভাবেই বিদ্যমান সমস্ত প্রজাতির উদ্ভবই ঘটেছে।

তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে এই দীর্ঘ বিবর্তনকরণ পর্বে বহু সংখ্যক মধ্যবর্তী প্রজাতির উদ্ভব ও অস্তিত্ব থাকার কথা। যেমন- বিবর্তনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কোন এক পর্যায়ে কিছু মাছ তাদের মাৎস্য বৈশিষ্টের অতিরিক্ত কিছু সরীসৃপ বৈশিষ্ট্য অর্জন করতো। ফলে সে পর্যায়ের কিছু অর্ধমৎস্য-অর্ধসরীসৃপ যমীনে বসবাস করতো। অথবা কিছু সরীসৃপ তাদের সারীসৃপের অতিরিক্ত কিছু পক্ষিত্ব অর্জন করে সরীসৃপ-পক্ষীতে পরিণত হতো। যেহেতু এসব প্রজাতির অবস্থা হতো পরিবৃত্তিকালীন বা অর্ধ-বিবর্তিত, এগুলো হতো ক্রটিপূর্ণ, ভঙ্গুর ও বিকলাঙ্গ। বিবর্তনবাদীরা এ ধরণের কাল্পনিক জীবের অস্তিত্বে বিশ্বাসী আর তারা এদের নাম দিয়েছে ‘পরিবৃত্তিকালীন জীব’।

এমন কিম্ভুতকিমাকার জীব যদি সত্যিই যমীনে থাকতো তাহলে তাদের সংখ্যা ও প্রজাতি বৈচিত্র হতো লক্ষ লক্ষ, এমনকি কোটি কোটি। তারচেয়ে অধিক প্রণিধানযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এসব কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীর দেহাবশেষ জীবাশ্মের ইতিহাসে পাওয়া যেতো।

এই বিষয়টি শিম্পাঞ্জী চেহারা সদৃশ ডারউইন তার বিবর্তনবাদে বলেছে- “আমার মতবাদ সত্য হলে, একই দলভুক্ত প্রজাতিগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ সৃষ্টিকারী অসংখ্য মধ্যবর্তী প্রজাতির অস্তিত্ব অবশ্যই ছিলো। ........................... সুতরাং তাদের সাবেকী অস্তিত্বের প্রমাণ কেবল জীবাশ্মের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে।” (দি অরিজিন অফ স্পিসিস এ ফেক্সিমাইল অফ দি ফার্স্ট এডিশন, হার্ভাট ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬৪ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-১৭৯)

অনুরূপ জীবাশ্ম আবিষ্কারের জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বিবর্তনবাদীরা সারাবিশ্বে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। কিন্তু অদ্যবধি কোন পরিবৃত্তিকালীন প্রজাতির হদিস মিলেনি। বিবর্তনবাদীদের আশার বিপরীতে আজ পর্যন্ত যত জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব অকস্মাৎ ও পরিপূর্ণরূপেই ঘটেছিল।

বৃটিশ পুরাতত্ত্ববিদ ডেরেক ভি. এইগার স্বয়ং একজন বিবর্তনবাদী হওয়া সত্ত্বেও এই সত্য স্বীকার করে উদ্ধৃতি দিয়েছে- “যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হচ্ছে এই যে, আমরা জীবাশ্মের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলে, জাতি কিংবা প্রজাতি যে পর্যায়েই হোক বারংবার আমরা দেখতে পাই- ক্রমাগত বিবর্তন নয়, বরং একটি দলের বিলুপ্তি পর আরেকটির আকস্মিক বিস্ফোরণ।” (দি ন্যাচার অফ দি ফসিল রেকর্ড, প্রোসিডিংস অফ দি ব্রিটিস জিওলোজিক্যাল এসোসিয়েশন, ভলিউম ৮৭, ১৯৭৬ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-১৩৩) 

সুতরাং জীবাশ্মের ইতিহাসে কোন পূর্ববর্তী-মধ্যবর্তী পরিব্যক্তি ব্যতীতই প্রতিটি প্রজাতি পূর্ণগঠিতরূপে আবির্ভুত হয়েছে, যা শিম্পাঞ্জী চেহারা সদৃশ ডারউইনের ধারণার বিপরীত। অধিকিন্তু এতে জোরালোভাবে প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীরা সৃষ্ট হয়। 

একটি প্রজাতি কোন পূর্বগামী প্রজাতির সংশ্রব ব্যতীত অকষ্মাৎ এবং পূর্ণরূপে গঠিত অবস্থায় আবির্ভূত হওয়ার অর্থ হচ্ছে প্রজাতিটি ওইভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে।

বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী ডগলাস ফুটুয়ামা এই সত্যটি স্বীকার করে নিচ্ছে এভাবে- “সৃষ্টি ও বিবর্তন, এ-দুয়ের মধ্যেই সমস্ত জীবন্ত সত্ত্বা উৎপত্তির সম্ভাব্য ব্যাখ্যা শেষ। জীবিত সত্ত্বা পৃথিবীতে পূর্ণগঠিতরূপে আবির্ভূত হয়েছে কিংবা তা হয়নি। যদি না হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সে পূর্বগামী প্রজাতি থেকে কোন প্রকার অভিযোজন বা রূপান্তরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছে। আর যদি সে পূর্ণগঠিতরূপে আবির্ভূত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই কোন সর্বজ্ঞ ধীশক্তি তাকে সৃষ্টি করেছেন।” (সাইন্স অন ট্রায়াল, নিউইয়র্ক, প্যান্থেয়ন বুকস, ১৯৮৩ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-১৯৭)

জীবাশ্ম সপ্রমাণ করে যে, পৃথিবীতে প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছে পূর্ণগঠিত ও নিখুঁত অবস্থায়। তার মানে ‘প্রজাতিসমূহের উৎপত্তি’র আদি কারণ কথিত বিবর্তন নয়, বরং সৃষ্টি।

এরপরও বিবর্তনবাদীরা বলে থাকে যে, আজকের আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হয়েছে এক প্রকারের আঙ্গুলহীন বানর সদৃশ প্রাণীর বিবর্তন থেকে। নাঊযুবিল্লাহ! ৪০-৫০ লক্ষ বছর আগে প্রালদ্ধ এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আধুনিক মানুষ ও তার আদি পূর্বগামী প্রজাতির মধ্যবর্তী সময়ে নর-বানরের কয়েকটি পরিবৃত্তিকালীন রূপ ছিল। পুরোপুরি মনগড়া এই দৃশ্যপটে ৪টি মূল শ্রেণী তালিকাভুক্ত করা হয়েছে- (১) অস্ট্রেইলো পিথিকাস, (২) হোমো হেবিলিস, (৩) হোমো ইরেক্টাস ও (৪) হোমো সেপিয়েন্স। 

বিবর্তনবাদীরা মানুষের তথাকথিত প্রথম বানর-সদৃশ পূর্বপুরুষদের নাম দিয়েছে ‘অস্ট্রেইলো পিথিকাস’, যার অর্থ হলো দক্ষিণ আফ্রিকার বানর। আসলে এরা বর্তমানে বিলুপ্ত প্রাচীন একটি বানর প্রজাতি বৈ কিছু নয়।

অস্ট্রেইলো পিথিকাস বানরের বিভিন্ন নমুনার উপর ইংল্যা- ও যুক্তরাষ্ট্রের ২জন শারীরতত্ত্ববিদ লর্ড সলি যাকারম্যান ও অধ্যাপক চার্লস অক্সনার্ডের ব্যাপক গবেষণাকর্মের ফলে দেখা গেছে, এগুলো ছিলো বিলুপ্ত একটি সাধারণ বানর প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত, মানুষের সঙ্গে এদের কোন সাদৃশ্য নেই। (বিয়ন্ড দি আইভরি টাওয়ার, নিউইয়র্ক, টপলিন্জার পাবলিকেশন, ১৯৭০ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-৭৫-৯৪; দি প্লেস অফ অস্ট্রেইলোপিথেসিনেস ইন হিউম্যান ইভোলুশন : গ্রান্ডস ফর ডাউট, ন্যাচার, ভলিউম ২৫৮, পৃষ্ঠা-৩৮৯)

বিবর্তনবাদীরা মানব বিবর্তনের দ্বিতীয় ধাপকে অভিহিত করেছে, হোমো অর্থাৎ মানবরূপে। তাদের দাবী, হোমো পর্যায়ের প্রাণীর অস্ট্রেইলো পিথিকাস থেকে অধিক বিকশিত, উন্নততর। বিবর্তনবাদীরা এই শ্রেণীর বিভিন্ন জীবাশ্ম একটি বিশেষ ক্রম অনুসারে বিন্যাস করে বিবর্তনের একটি কাল্পনিক ছক তৈরি করে। এই ছকটি কাল্পনিক কেননা এটি কখনো প্রমাণিত হয়নি যে, উক্ত শ্রেণীগুলোর মধ্যে কোনরূপ পারস্পারিক বিবর্তনীয় সম্পর্ক রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিবর্তনবাদী এর্নস্ট মাইর বলে- “............... বিশেষত প্রাণের কিংবা হোমো সেপিয়েন্সের মতো ঐতিহাসিক (ধাঁধাঁগুলো) খুবই কঠিন এবং তারা হয়ত একটি সন্তোষজনক চুড়ান্ত ব্যাখ্যাও প্রতিহত করবে।” (ডারউইন্স কারেন্ট বুল ডগ : এর্নস্ট মাইর, সাইন্টিফিক আমেরিকান, ডিসে: ১৯৯২)

অস্ট্রেইলো পিথিকাস > হোমো হেবিলিস > হোমো ইরেক্টাস > হোমো সেপিয়েন্স-এই সংযোগ-শৃঙ্খল ছক দিয়ে বিবর্তনবাদীরা বুঝাতে চায় যে, এই প্রজাতিগুলোর প্রত্যেকটি একে অপরের পূর্বপুরুষ। কিন্তু প্রতœতাত্ত্বিকবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন আবিষ্কারের মাধ্যমে জানা যায় যে, অস্ট্রেইলো পিথিকাস, হোমো হেবিলিস ও হোমো ইরেক্টাস একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিরাজমান ছিল। (এল্যান ওয়াকার, সাইন্স, ভলিউম ২০৭, ১৯৮০ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-১১০৩; এ জে কেলসো, ফিজিক্যাল এন্ট্রোপোলজি, ১ম সংস্করণ, নিউইয়র্ক, জেবি লিপিনকট কোং, ১৯৭০ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-২২১; এম ডি লিকে, ওল্ডুভাই জর্জ, ভলিউম ৩, ক্যাম্ব্রিজ, ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭১ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-২৭২)

অধিকিন্তু হোমো ইরেক্টাস শ্রেণীভুক্ত মানবগোষ্ঠির একটি অংশ অতি সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। হোমো সেপিয়েন্স নিয়ানডারথালেন্সিস ও হোমো সেপিয়েন্স (আধুনিক মানুষ) একই অঞ্চলে যুগপৎ বিদ্যমান ছিল। এই পরিস্থিতিতে এসব প্রজাতি একে অপরের পূর্বপুরুষ ছিল দাবী করা নিতান্তই মূর্খতা সূচক।

হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী স্টিফেন জে গৌল্ড নিজে বিবর্তনবাদী হওয়া সত্ত্বেও বিবর্তনবাদের অচলাবস্থার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলে- “এই ৩টি মানব প্রতীম বংশধারা (এ আফ্রিকানাস, নাসুদ-নুদুস অস্টেইলোপিথিসিস ও এইচ হেবিলিস), যারা পরিষ্কারভাবে একে অপর থেকে উদ্ভুত নয়, তারা যদি সহাবস্থানকারী অর্থাৎ একই সময়ে বিদ্যামান হয় তাহলে বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণাটির স্থান কি হবে? শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বুকে তারা যখন বিরাজমান ছিল তাদের মধ্যে কোন বিবর্তন প্রবণতা ছিল বলে প্রতীয়মাণ হয় না।” (ন্যাচারাল হিস্ট্রি, ভলিউম ৮৫, ১৯৭৬ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-৩০)

সংক্ষেপে বলতে গেলে, প্রচার মাধ্যম ও পাঠ্যপুস্তকে কয়েক প্রকারের অর্ধ-নর-বানরের চিত্র অঙ্কন করে অর্থাৎ প্রচারণার জোরে মানব বিবর্তনের যে দৃশ্যপট তুলে ধরার অপচেষ্টা করা হয়েছে তা বস্তুত কোনরূপ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছাড়া একটি কল্পকাহিনী মাত্র। 

যুক্তরাজ্যের বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানী সলি যাকারস্যান বিবর্তনবাদ নিয়ে বিশেষত অস্টেইলোপিথিকাস জীবাশ্ম নিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, বস্তুত এমন কোন বংশলতিকা নেই যেখানে বানর-প্রতীম জীব থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষের উৎপত্তি ঘটেছে।

যাকারম্যান একটি ‘বিজ্ঞান বর্ণালী’ কল্পনা করে, যেখানে যাকারম্যান নিজে যেসব বিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক বলে করে, সেগুলো থেকে যেগুলোকে অবৈজ্ঞানিক জ্ঞান করে সেগুলো পর্যন্ত তার এই বর্ণালী বিস্তৃত। যাকারম্যানের মতে, বিজ্ঞানে বাস্তব তথ্যক্ষেত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত সর্বাধিক বৈজ্ঞানিক বিজ্ঞান হচ্ছে রসায়ণ ও পদার্থবিদ্যা। এদের নিকট প্রতিবেশী হচ্ছে জীববিজ্ঞানসমূহ, তারপর সামাজিক বিজ্ঞানসমূহ। বর্ণালীর শেষ প্রান্তে আসে সর্বাধিক ‘অবৈজ্ঞানিক’ বিজ্ঞানসমূহ যথা- ‘অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি সঞ্জাত ধারণাবলী যথা টেলিপ্যাথি ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এবং পরিশেষে মানব বিবর্তন।’

যাকারম্যানের নিজের ভাষ্য- “এরপরেই আমরা বস্তুনিষ্ঠ সত্যের ক্ষেত্র থেকে অতীন্দ্রিয় উপলব্ধি কিংবা মানুষের জীবাশ্ম ইতিহাসের ন্যায় অনুমিত জীববিজ্ঞানের ভূমিতে গিয়ে পড়ি যেখানে বিশ্বাসী (বিবর্তনবাদী)দের জন্য সবকিছুই সম্ভব এবং যেখানে (বিবর্তনবাদে) বিশ্বাসীদের জন্য কোন কোন সময় একই সঙ্গে কয়েকটি পরস্পবিরোধী বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপনে কোন অসুবিধা হয় না।” (বিয়ন্ড দি আইভরি টাওয়ার, নিউইয়র্ক, টপলিন্জার পাবলিকেশন, ১৯৭০ ঈসায়ী, পৃষ্ঠা-১৯)

মানববির্তনের গরম খবরটি ঠান্ডা মাথায় বিচার করলে দেখা যায় যে, এটি আর কিছু নয় শুধু কয়েকজন অন্ধবিশ্বাসী বিবর্তনবাদীর কতিপয় জীবাশ্মের উদ্দেশ্যমূলক ও পক্ষপাতদুষ্ট ব্যাখ্যা।

আরেকটি বিষয় যা সম্পর্কে বিবর্তনবাদ কোন ব্যাখ্যা দিতে পারে না তা হচ্ছে, চোখ ও কানের উপলব্ধির চমৎকার গুণ। কোন বস্তু থেকে বিকরিত আলোর রশ্মি অক্ষিপটে উল্টোভাবে পতিত হয়। আলোক রশ্মিগুলো কোষসমূহ দ্বারা বৈদ্যুতিক সঙ্কেতে রূপান্তরিত হয়ে মস্তিষ্কের পিছন দিকে বিক্ষণ কেন্দ্রে (centre of vision) পৌঁছে। বৈদ্যুতিক সঙ্কেতগুলো কয়েকটি প্রক্রিয়ান্তে বিক্ষণ কেন্দ্রে একটি ছবি আকারে প্রতিভাত হয়।   

মস্তিষ্ক আলোক প্রতিরোধী, মস্তিষ্কের ভিতরটা ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন, মস্তিষ্ক যেখানে অবস্থিত আলো সেখানে পৌঁছে না। বিক্ষন কেন্দ্র বলে অভিহিত স্থানটি হচ্ছে নিরেট অন্ধকার একটি স্থান, যেখানে কখনো আলো পৌঁছে না। কিন্তু এই নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যেই দ্যুতিময় উজ্জ্বল বিশ্বের প্রতিবিম্ব দেখা যায়। চোখে যে ছবি ফুটে উঠে তা এতো তীক্ষ্ম ও স্পষ্ট যে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও প্রযুক্তি তা অর্জন করতে পারেনি।

বিবর্তনবাদীরা দারী করে যে, যে প্রক্রিয়ায় এই তীক্ষ্ম ও স্পষ্ট চিত্র প্রতিভাত হচ্ছে তা দৈবক্রমে নিষ্পন্ন। তাদের এহেন বক্তব্যের জবাবে একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়-

একবার ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুনাজিরা (বাহাছ) হয়েছিল মহান আল্লাহ পাক উনার অস্তিত্বে অস্বীকারকারী এক নাস্তিকের সাথে।

মুনাজিরার বিষয় ছিল, পৃথিবীর কোন সৃষ্টিকর্তা আছে কিনা। এতবড় ইমাম উনার সাথে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুনাজিরা দেখার জন্য শত্র“-মিত্র সবাই যথাসময়ে মুনাজিরার স্থানে সমবেত হয়ে গেল। নাস্তিক লোকটিও যথাসময়ে পৌঁছে গেল। কিন্তু হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি নির্ধারিত সময়ের অনেক দেরীতে সমাবেশে তাশরীফ মুবারক আনলেন।

নাস্তিকটি জিজ্ঞাসা করলো, আপনি এত দেরী করলেন কেন?

ইমামে আ’যম হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, জঙ্গল দিলে আসার সময় এক অদ্ভুত ঘটনা চোখে পড়লো, সেটা দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে ওখানে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

ঘটনা হলো, নদীর কিনারে একটি বৃক্ষ ছিলো। দেখতে দেখতে সেই বৃক্ষটি নিজেই কেটে গেলো। এরপর নিজেই তক্তায় পরিণত হলো। অতঃপর সেই তক্তাগুলো নিজেরাই একটি নৌকা হয়ে গেল এবং সে নৌকা নিজে নদীতে নেমে গেল এবং নিজেই নদীর এপাড় থেকে ওপাড়ে যাত্রী আনা নেয়া করতে লাগলো। নিজেই প্রত্যেক যাত্রী থেকে ভাড়া আদায় করতে ছিলো। এ দৃশ্যটি দেখতে গিয়ে আমার দেরী হয়ে গেলো।

নাস্তিকটি এটা শুনে অট্টহাসি দিলো এবং বললো, আপনার মতো একজন বুযূর্গ ইমাম উনার পক্ষে এ রকম বলা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। এ রকম কি নিজে নিজে কিছু হতে পারে? কোন কারিগর না থাকলে, এ রকম কাজ কিছুতেই হতে পারে না।

হযরত ইমামে আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, এটাতো কোন কাজই না। তোমার মতে তো এর থেকে অনেক বড় বড় কাজ এমনিতে হয়। এ পৃথিবী, এ আসমান, এ চাঁদ, সূর্য, তারকারাজি, বাগানসমূহ, রং-বেরংয়ের নানা রকম ফুল, সুমিষ্ট ফল, এ পাহাড় পর্বত, জীবজন্তু, মানব-দানব সব কিছু কোন সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত এমনিতেই হয়ে গেছে। যদি কোন একটি নৌকা কোন কারিগর ছাড়া এমনিতে তৈরি হয়ে যাওয়াটা মিথ্যা হয়, তাহলে সমস্ত পৃথিবীটা সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত নিজেই তৈরি হয়ে যাওয়াটা ডাহা মিথ্যা ছাড়া আর কি হতে পারে?

উনার বক্তব্য শুনে নাস্তিকটি বিমোহিত হয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় ভ্রান্ত ধারণা ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে গেল। (তাফসীরে কবীর ২২১ পৃষ্ঠা ১ম খ-)

সুতরাং চোখের চেয়ে আদিমতর প্রতিচ্ছবি সৃষ্টিকারী যন্ত্র যদি দৈবক্রমে গড়ে উঠতে না পারে তাহলে এটা একেবারেই পরিষ্কার যে, চোখ ও চোখে বিম্বিত চিত্র দৈবক্রমে গড়ে উঠতে পারে না। কানের ব্যাপারেও একই কথা। বহিঃকর্ত শব্দ গ্রহণ করে তা মধ্যকর্ণে প্রেরণ করে, মধ্যকর্ত শব্দের স্পন্দন মতো তীব্র করে তা প্রেরণ করে অন্তঃকর্ণে, অন্তঃকর্ত শব্দের স্পন্দনকে বৈদ্যুতিক সঙ্কেতে রূপান্তরিত করে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। চোখের দর্শনকর্ম যেমন তেমনি কানের শ্রবণ কর্ম সম্পূর্ণ হয় মস্তিষ্কে, শ্রবণ কেন্দ্রে।

মস্তিষ্কের শ্রবণ কেন্দ্রের পরিস্থিতি বিক্ষণ কেন্দ্রের অনুরূপ অর্থাৎ মস্তিষ্ক যেমন আলোক প্রতিরোধী তেমনি শব্দ প্রতিরোধী। কোন শব্দই মস্তিষ্কে ঢুকতে পারে না। সুতরাং বাইরে যত কোলাহলই হোক না কেন, মস্তিষ্কের ভিতরটা সম্পূর্ণ নীরব, নিশব্দ। তথাপি তীব্রতম শব্দগুলো মস্তিষ্কে অনুভূত হয়। বিজ্ঞানের এক উৎকর্ষতার যুগে এসেও অদ্যাবধি কান দ্বারা অনুভূত শব্দের তীব্রতা ও স্পষ্টতার সমতুল্য কোন যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি।

মানব দেহের চক্ষু-কর্ত-নাসিকা থেকে উদ্ভূত প্রেরণাগুলো তড়িৎ-রাসায়নিক স্নায়বিক স্পন্দনরূপে মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছে। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে এসব ছবি, শব্দ, গন্ধ ও ইন্দ্রিয়বেদ্য ঘটনাবলীর মতো তড়িৎ-রাসায়নিক স্নায়বিক প্রেরণায় উদ্ভূত বস্তুসমগ্র দেখছে, শুনছে, উপলব্ধি করছে যে, সে কে? মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে একটি চেতনা আছে যা এ সবকিছুই উপলব্ধি করতে পারে চক্ষু-কর্ত-নাসিকার কোন প্রয়োজনবোধ না করেই। এই সচেতনতা মস্তিষ্কগঠনকারী স্নায়ুতন্ত্র, পরিবেষ্টক স্থুল স্তর ও নিউরনপুঞ্জ প্রদান করে না বরং এই সচেতনতা হচ্ছে আত্মা। আর এই কারণেই এসব প্রশ্নের জবাব দিতে অপারগ বস্তুবাদী বিবর্তনবাদীরা। কারণ তাদের বিশ্বাস সবকিছুই গঠিত হয় জড়বস্তু দ্বারা।

এছাড়াও “বিজ্ঞানীরা অনুসন্ধান আর গবেষণা চালিয়ে বলতে পেরেছে যে, মহাদেশগুলো ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, কোন এক সময় আফ্রিকা মহাদেশ দক্ষিণ মেরুর অংশ ছিল। উত্তর আমেরিকা ক্রমে ক্রমে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে যাচ্ছে। হয়ত একদিন এশিয়ার সাথে মিশে যাবে আমেরিকা। ওয়েজেনার নামক এক বিজ্ঞানী বলেছে- মহাদেশগুলো যে, আগে একে অন্যেও সাথে যুক্ত ছিল তা অনস্বীকার্য। প্রমাণস্বরূপ সে বলেছে- দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূলের সাথে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের গঠনের অপূর্ব সাদৃশ্য রয়েছে।

ব্রাজিলের কোনাটা গোল আর তা যদি গিনি উপকূলের পাশে এনে রাখা যায়, তাহলে মনে হবে- এরা আগে একই ভূখ-ের অংশ ছিল। বিভিন্ন মহাদেশের পাহাড়-পর্বতের পাথরের মিল থেকেও বিজ্ঞানীরা এ যুক্তির পক্ষে প্রমাণ পেয়েছে। ঠিক একইভাবে জীবজন্তু থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন- গিনিপিগ, চিনাচিলা যারা জঙ্গলে বাস করে এবং বিরাট আকারের সরীসৃপ যারা উইপোকার ঢিপিতে ডিম পাড়ে, তাদের শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকা আর আফ্রিকায় পাওয়া যায়। উপরন্তু, দক্ষিণ আমেরিকার মাছ এবং তাজা পানির বিভিন্ন জীবের সাথে আফ্রিকার মাছ ও তাজা পানির জীবের সাদৃশ্য আছে। যদি এ দু’টো মহাদেশ একই ভূখ-ের অংশ না হতো তাহলে দু’ জায়গার জীবজন্তুর মাঝে এত মিল হাওয়া কি করে সম্ভব।

প্রখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী প্রফেসর রোলাল্ড হুড মি ওয়েজনারের মত সমর্থন করে বলেছে যে, যদি কোন কালে মহাদশেগুলো একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত নাই ছিল, তবে বিভিন্ন মহাদেশের উদ্ভিদের মাঝে এত মিল কেন? তার মতে, গ্রীনল্যা-ে এমন কিছু উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায় যা একমাত্র হিমালয়ের উচ্চ শিখরে দেখতে পাওয়া যায়। এসব গাছের বীজ এতদূর এলো কি করে? গ্রীনল্যা- থেকে হিমালয়ের দূরত্ব ৮১২৫ কিলোমিটার প্রায়। এসব থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, উত্তর আমেরিকা ও গ্রীনল্যা- এককালে ইউরেশিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। হিমযুগের উদাহরণ দিয়েও প্রফেসর ওযেজনার প্রমাণ করতে চয়েছে যে, প্রায় ২০ কোটি বছর আগে দক্ষিণ মেরু, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতবর্ষ একই ভূখণ্ডের অংশ ছিল। তখন এ মহাদেশের নাম ছিল গ্রাণ্ডোয়াল্যাণ্ড।

প্রফেসর হুড তার প্রমাণকে আরো দৃঢ় করা জন্য বলেছে যে, গ্লোস্পটেরিস হচ্ছে এক জাতীয় ফার্ন। এর পাতা বেশ মোটা ও খসখসে। গ্লোস্পটেরিস হচ্ছে শীতপ্রধান দেশের উদ্ভিদ। আশ্চর্যের বিষয় এ উদ্ভিদের জীবাশ্ম পাওয়া গিয়েছে ভারত, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মধ্য আফ্রিকা ও দক্ষিণ মেরুতে। এ উদ্ভিদ যদি শীতপ্রধান দেশের উদ্ভিদ হয়, তাহলে এর জন্ম আফ্রিকা, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় কি করে সম্ভব? মহাদেশ স্থানান্তর সম্বন্ধে আরো অনেক প্রমাণ বিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদগণ দিয়েছে। লন্ডনের রয়েল কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক প্যাট্রিক ম্যানার্ড স্টুয়ার্ড ব্ল্যাকেট ভারতের পাথর পরীক্ষা করে বলেছে যে, ভারত উপমহাদেশ ৭ কোটি বছর আগে বিষুবরেখার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। সে আরো বলে যে, গোটা মহাদেশটাই গত ৩০ কোটি বছরে দক্ষিণ মেরুর উপর হতে সরে এসেছে। কিন্তু কি এ শক্তি যার ফলে মহাদেশগুলো একে অন্যের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে? জানা গেছে ভূগর্ভস্থ পরিচলন স্রোতের ফলেই এ স্থানান্তর সম্ভব হচ্ছে। 

অধ্যাপক ব্ল্যাকেট লন্ডনে এ সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছে যে, গত ১৫ কোটি বছরে যুক্তরাজ্য বিষুবরেখার খুব কাছাকাছি কোন স্থান থেকে উত্তরে সরে এসেছে। শুধু তাই নয়, ঘড়ির কাঁটার মতো যুক্তরাজ্য ডানদিকে ঘুরে গিয়েছে ৩০ ডিগ্রি।” (রহস্যময় পৃথিবী : আনোয়ার করিম খান : বাংলা একাডেমি, ঢাকা : পৃষ্ঠা ১৫-১৭)

পৃথিবীর মূল ভূখ- থেকে সরে যাওয়ার ফলে দেখা যাচ্ছে যে, অনেক জীবের পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তর ঘটেছে। ফলে মূল স্থান থেকে সরে যাওয়া জীবগুলো অভিযোজন করে সেখানে স্থায়ীত্ব লাভ করেছে। এই অভিযোজনের ফলে মূল ভূখ-ের জীব থেকে তাদের শারীরীক কিছু পরিবর্তন দেখা গেলেও অবয়বগত কোন পার্থক্য সূচিত হয়নি। এই বিষয়গুলো নাস্তিকরা স্বীকার না করে বরং এতে রং লাগিয়ে বিবর্তনের দোহাই তুলছে।

উপরে তথ্য বহুল আলোচনা হতে প্রমাণিত হয় যে, বিবর্তনবাদ সুস্পষ্টরূপে বৈজ্ঞানিক সত্যের সাথে সাংঘর্ষিক ও সামঞ্জ্যহীন। প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে এ মতবাদের দাবী বিজ্ঞান বিরোধী, এই মতবাদে প্রস্তাবিত বিবর্তন প্রক্রিয়াগুলোর কোন বিবর্তনী শক্তি নেই এবং জীবাশ্মের ইতিহাস প্রতিপাদন করে যে, এ মতবাদের দাবীকৃত মধ্যবর্তী রূপগুলোর কখনো কোন অস্তিত্বই ছিলো না। এ থেকে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, বিবর্তনবাদ নামক কল্পকাহিনী অবৈজ্ঞানিক ও বাতিলযোগ্য। এভাবেই ইতিহাসে অনেক ধারণা ভূকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বিজ্ঞানের বিবেচ্য বিষয় তালিকা থেকে বাতিল করা হয়েছে।


0 Comments: