৩৬৯ নং- সুওয়াল - আমরা কেন শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়েছি? অনেকে বলে থাকে যে, “একমাত্র হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মতগণই দাওয়াতী কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন এবং এই দাওয়াতী কাজ করার দরুনই আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়েছি, অন্য কোন কারণে নয়।” এটা সঠিক কিনা তা জানালে বাধিত হবো।

সুওয়াল - আমরা কেন শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়েছি? অনেকে বলে থাকে যে, “একমাত্র হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার  উম্মতগণই দাওয়াতী কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন এবং এই দাওয়াতী কাজ করার দরুনই আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়েছি, অন্য কোন কারণে নয়।” এটা সঠিক কিনা তা জানালে বাধিত হবো।
জাওয়াব - একমাত্র সাইয়্যিদুল মুরছালীন, ইমামুল মুরছালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়ার কারণেই আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়েছি। অনেকে বলে থাকেন যে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার  উম্মতই শুধুমাত্র দাওয়াতী কাজ করার অনুমতি পেয়েছেন এবং এ কারণেই আমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত হয়েছি, এ কথাটা শুদ্ধ নয়।  হাদীছ  শরীফে উল্লেখ আছে যে, “সমস্ত হযরত নবী আলাহিস সালামগণ উনারা হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার  উম্মত হবার জন্য মহান আল্লাহ্ পাক উনার নিকট আরজু করেছেন। সমস্ত নবী আলাহিস সালাম উনার দোয়াই মহান মহান আল্লাহ পাক তিনি কবুল করেছেন, তবে সরাসরি কবুল করেছেন হযরত ঈসা আলাহিস সালাম উনার দোয়া। অনেকে মনে করে থাকে বা বলে থাকে, একমাত্র হযরত ঈসা আলাহিস সালাম  ব্যতীত আর কোন নবী আলাহিস সালাম উনার দোয়াই কবুল হয়নি, এটা সঠিক নয়। কেননা দোয়া কবুল হয় তিন প্রকারে। প্রথম প্রকার- বান্দা যা চায়, মহান আল্লাহ্ পাক তিনি সরাসরি তা দিয়ে দেন। দ্বিতীয় প্রকার- বান্দা যা চায়, তার চেয়ে যা বেশী জরুরী, সেটাই মহান আল্লাহ্ পাক দিয়ে থাকেন, যে জরুরত সম্বন্ধে বান্দা নিজেই জানে না। তৃতীয় প্রকার- বান্দা যা চায়, মহান আল্লাহ্ পাক সেটা তাকে না দিয়ে তা কবুল করে তার সওয়াবটুকু পরকালের জন্য জমা করে রাখেন। বান্দা যখন হাশরের ময়দানে উপস্থিত হয়ে তার নেকী কম দেখবে, তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, “হে বান্দা! তোমার জন্য অমুক স্থানে নেকী রাখা হয়েছে,” তখন সেই বান্দা গিয়ে দেখবে যে, তার জন্য পাহাড় পাহাড় নেকী রাখা হয়েছে। সে বলবে, আয় আল্লাহ পাক! আমি তো এত নেক কাজ করিনি, আমার এত নেকী আসলো কোথা থেকে? তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি বলবেন, “তুমি যে সকল দোয়া দুনিয়াতে করেছিলে, যার বদলা দুনিয়াতে দেয়া হয়নি, সে কারণে তুমি মনে করেছিলে যে, তোমার দোয়া কবুল করা হয়নি, অথচ আমি তা কবুল করেছিলাম এবং তাই পাহাড় পাহাড় নেকী আকারে জমা হয়েছে।” তখন বান্দা বলবে, মহান আল্লাহ্ পাক! দুনিয়াতে আমার সমস্ত দোয়াগুলিরই বদলা না দিয়ে যদি পরকালের জন্য জমা রাখা হতো, তাহলে তা আমার জন্য ফায়দার কারণ হতো।
উপরোক্ত হাদীছ  শরীফ-এর মাধ্যমে এটাই সাবেত হয়, শুধুমাত্র দাওয়াতের কারণেই যদি উম্মতে মুহম্মদীর শ্রেষ্ঠত্ব হতো, তাহলে অন্যান্য নবী আলাহিস সালাম তিনি দাওয়াতের দায়িত্ব পাওয়া সত্ত্বেও হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার  উম্মত হবার জন্য দোয়া করতেন না। বরং উম্মতে হাবীবী উনার শ্রেষ্ঠত্ব দাওয়াতের কারণে নয় বরং হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হবার কারণে। আরও  কুরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে,
وكذالك جعلناكم امة وسطا لتكونوا شهداء على الناس ويكون الرسول عليكم شهيدا.
অর্থঃ- “এরূপেই আমি তোমাদেরকে উম্মতে ওয়াসাত (শ্রেষ্ঠ উম্মত) করেছি। যেন তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও, সমস্ত মানুষের জন্য এবং যাতে রসূল আলাহিস সালামগণ উনারা সাক্ষ্যদাতা হন, তোমাদের জন্য।” (সূরা বাক্বারা-১৪৩)
এ আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়, হাশরের ময়দানে যখন সমস্ত নবী আলাহিস সালামগণ উনাদের গুণাহ্গার উম্মতগণকে জিজ্ঞেস করা হবে, “তোমরা কেন নেক কাজ করনি?” তখন তারা বলবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী কিতাবও আসেনি এবং কোন হযরত নবী আলাহিস সালাম উনারা আগমন করেনি। তখন আল্লাহ্ পাক তিনি নবী আলাহিমুস সালামগণ উনাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, “আপনারা কি তাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছাননি?” তাঁরা বলবেন, “হ্যাঁ, পৌঁছিয়েছি।” তখনও অন্য নবী আলাহিমুস সালাম উনার উম্মতগণ তা অস্বীকার করবে। তখন মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলবেন, “হে নবী আলাহিমুস সালামগণ! আপনাদের সাক্ষী কোথায়?” তখন উনারা বলবেন, উম্মতে হাবীবীগণই আমাদের সাক্ষী। তখন উম্মতে হাবীবীগণকে ডেকে জিজ্ঞেস করা হলে উনারা বলবেন, “হ্যাঁ, সমস্ত নবী আলাহিমুস সালামগণ উনারা দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন এবং দায়িত্ব পালন করেছেন।” একথা শুনে অন্যান্য নবী আলাহিমুস সালামগণ উনাদের উম্মতগণ বলবেন, উম্মতে হাবীবীগণ উনারা তো আমাদের থেকে অনেক পরে এসেছে, তারা কিভাবে আমাদের সাক্ষী হয়? তখন মহান আল্লাহ্ পাক উম্মতে হাবীবীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বলবেন, “হ্যাঁ, আমরা তাদের থেকে অনেক পরে এসেছি, তবে আমাদের নিকট এসেছিলেন সাইয়্যিদুল মুরছালীন, ইমামুল মুরছালীন  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তিনি আমাদেরকে এ বিষয়ে জানিয়েছেন। আমরা উনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং উনাকে সত্য বলে জেনেছি, তাই আমাদের সাক্ষ্য সত্য। অতঃপর মহান আল্লাহ্ পাক  তিনি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন এবং তখন উম্মতে হাবীবীকে সমর্থন করে সাক্ষী দেবেন, হ্যাঁ, তারা যা বলেছে সবই সত্য এবং আমিই তাদেরকে এ তথ্য জানিয়েছি, যা আমি মহান আল্লাহ্ পাক উনার তরফ থেকে জেনেছি। (সিহাহ সিত্তাহ্ দ্রষ্টব্য)
সুতরাং উপরোক্ত আয়াত শরীফে আমাদেরকে যে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে, তা দাওয়াতী কাজ করার জন্য নয় বরং তা  হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার  প্রকৃত উম্মত হবার কারণে।
কুরআন শরীফের আয়াত এবং সহীহ্  হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, আগেকার উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিল। যেমন ‘সূরা ইয়াসীন’ উল্লেখ করা হয়েছে, “কোন এক জনপদে রসূল আলাহিস সালামগণ আগমন করলে সেখানকার অধিবাসীগণ উনাদের রিসালতকে অস্বীকার করে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলো। তখন শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি, যিনি ঈমান গ্রহণ করেছিলেন, তিনি দৌড়ে এলেন এবং তার সম্প্রদায়কে রসূল আলাহিস সালামগণকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন এবং তাঁদের অনুসরণ করার উপদেশ দিলেন।”
এটা ছাড়া হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করেন, “মহান আল্লাহ্ পাক হযরত জিবরাঈল আলাহিস সালাম উনার নিকট ওহী পাঠালেন, অমুক অমুক শহরের সমগ্র বাসিন্দাসহ উল্টাইয়া দাও।” তখন হযরত জিবরাঈল আলাহিস সালাম আরজ করলেন, “হে পরওয়ারদেগার! এ শহরে আপনার অমুক বান্দা রয়েছে, যে মুহূর্তকালও আপনার নাফরমানীতে লিপ্ত হয়নি।” তখন মহান আল্লাহ্ পাক তিনি ইরশাদ করলেন, “শহরটিকে ঐ ব্যক্তি এবং সমগ্র বাসিন্দাসহ তাদের উপর উল্টাইয়া দাও, কারণ আমার জন্য ঐ ব্যক্তির চেহারায় এক মুহূর্তের জন্য পরিবর্তন আসেনি, অর্থাৎ সে আফসোস করেনি।”
বণী ইসরাঈল আমলের অনুরূপ আরো একটি ওয়াকেয়া তাফসীরে উল্লেখ করা হয়, আল্লাহ পাক হযরত ইউশা বিন নুন আলাহিস সালাম উনার উপর ওহী নাযিল করলেন, “হে আমার নবী! আপনার উম্মতের মধ্যে এক লক্ষ লোককে ধ্বংস করে দেয়া হবে, যার মধ্যে ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুণাহে লিপ্ত (গুমরাহ)।” তখন হযরত ইউশা বিন নুন আলাহিস সালাম তিনি বললেন, “আয় আল্লাহ পাক! ৬০ হাজার লোক সরাসরি গুণাহে লিপ্ত, তাই তাদের ধ্বংস করে দেয়া হবে। কিন্তু বাকী ৪০ হাজার লোককে ধ্বংস করা হবে কেন?” তখন মহান আল্লাহ পাক তিনি বললেন, “যেহেতু তারা তাদের সাথে মিলা-মিশা, ওঠা-বসা করে এবং সম্পর্ক রাখে। আর গুণাহের কাজে বাধা প্রদান করেনা, তাই তাদেরকেসহ ধ্বংস করে দেয়া হবে।”
পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও দাওয়াতের দায়িত্ব ছিল, কেননা দায়িত্ব থাকার কারণেই তা পালন না করার জন্য ‘বনী ঈসরাইলের’ উল্লেখিত ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে শাস্তি পেতে হয়েছে।
সুতরাং উপরোক্ত আয়াত শরীফ,  হাদীছ  শরীফ এবং তার আনুষাঙ্গিক ঘটনা ব্যতীত আরও অনেক আয়াত শরীফ,  হাদীছ  শরীফ এবং ঘটনার মাধ্যমে জানা যায় যে, পূর্ববর্তী উম্মতগণ যে দাওয়াতের কাজ করেছেন, তা তাফসীরে রূহুল মায়ানী, তাফসীরে মাযহারী, তাফসীরে আমিনিয়া, তাফসীরে খাযেন, তাফসীরে মা’আরেফুল  কুরআনইত্যাদি এবং এটা ব্যতীত বিশুদ্ধ  হাদীছ  শরীফের কিতাব দ্বারাও প্রমাণিত।
মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ-এ বলেন,
كنتم خيرامة اخرجت للناس تأمرون بالمعروف وتنهون عن المنكر وتؤمنون بالله.
অর্থঃ- “তোমরা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছ। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে ও বদ কাজের নিষেধ করবে এবং মহান আল্লাহ পাক উনার প্রতি ঈমান আনবে।”
অনেকে ‘সূরা ইমরান’-এর উপরোল্লিখিত আয়াত শরীফ উল্লেখ করে বলে থাকে যে, আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলা হয়েছে, কারণ আমরা সৎ কাজের আদেশ করি এবং অসৎ কাজের নিষেধ করি। মূলতঃ তাদের এ ব্যাখ্যা ঠিক নয়, কেননা সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হওয়াটাই হলো আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ। আর এ ছাড়া আমাদের যতগুলো গুণ দেয়া হয়েছে, তাও একমাত্র  হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার  কারণে। 
অন্যান্য নবী আলাহিমুস সালামগণ, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হবার জন্য আরজু করেছেন, তাই বলে কেউ যেন এটা মনে না করে যে, উম্মতে হাবীবীর শ্রেষ্ঠত্ব অন্যান্য নবী আলাহিমুস সালামগণ হতে বেশী। বরং শুধুমাত্র হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কারণে যে উম্মতে হাবীবীর শ্রেষ্ঠত্ব, তা বুঝানোর জন্যই সমস্ত নবী আলাহিমুস সালামগণ হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উম্মত হবার জন্য আরজু করেছেন। সুবহানাল্লাহ!
আবা-২৪

0 Comments: