৩৫২ নং- সুওয়াল - বাবা-মা জীবিত থাকলে নাকি পীর ছাহেব বা শায়খ ধরা যায় না। অনেকে বলেন, পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত কোন পীর ছাহেব বা শায়খ গ্রহণ করা যাবে না। এটা কতটুকু সত্য তা জানালে বাধিত হবো।

সুওয়াল - বাবা-মা জীবিত থাকলে নাকি পীর ছাহেব বা শায়খ ধরা যায় না। অনেকে বলেন, পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত কোন পীর ছাহেব বা শায়খ গ্রহণ করা যাবে না। এটা কতটুকু সত্য তা জানালে বাধিত হবো।

জাওয়াব - এটা একটি অবান্তর প্রশ্ন, যা শরীয়তের সাথে কোন মিল নেই। হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে,
طلب العلم فريضة على كل مسلم ومسلمة.
অর্থঃ- “প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ইল্ম অর্জন করা ফরজ।”
আরও হাদীছ শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, 
العلم علمان علم فى القلب فذاك علم النافع علم على اللسان فذالك حجة الله غزوجل على ابن ادم.
অর্থঃ- “ইল্ম দুই প্রকার। এক প্রকার হলো ক্বালবী ইল্ম, যা উপকারী ইল্ম, আরেক প্রকার হলো যবানী ইল্ম, যা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে বান্দার জন্য দলীলস্বরূপ। অর্থাৎ একটি হলো ইল্মে ফিকাহ্, আরেকটি হলো ইল্মে তাসাউফ।
হযরত ইমাম আ’যম আবু হানীফা  রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “ইল্ম শিক্ষা করা ফরজ বলতে বুঝায় ইল্মে ফিকাহ্ ও ইল্মে তাসাউফ, উভয়টাই জরূরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরজ।”
হযরত ইমাম আ’যম আবু হানীফা  রহমতুল্লাহি আলাইহি বিশ্ববিখ্যাত আলেম হওয়া সত্বেও তিনি বলেন 
لولا سنتان لهلك ابو نعمان.
অর্থঃ- “আমি ইমাম আ’যম আবু হানীফা  রহমতুল্লাহি আলাইহি ধ্বংস হয়ে যেতাম যদি দু’বছর না পেতাম।” অর্থাৎ তিনি এই দু’বছরে হযরত ইমাম জাফর সাদিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার দরবারে থেকে ইল্মে তাসাউফ হাসিল করেন। উল্লেখ্য, হযরত ইমাম আ’যম আবু হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রথমে হযরত ইমাম বাকের রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে মুরীদ হন এবং উনার ইন্তিকালের পর উনার ছেলে হযরত ইমাম জাফর সাদিক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে বাইয়াত হয়ে কামালিয়াত হাসিল করেন। যা বিশ্ব বিখ্যাত গায়াতুল আওতার ফি শরহে দুররুল মুখতার, সাইফুল মুকাল্লেদীন, (ইছনা আশারীয়াকৃত হযরত শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী  রহমতুল্লাহি আলাইহি) ইত্যাদি কিতাবে এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে।
হযরত মোল্লা আলী ক্বারী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘মিশকাত শরীফ’-এর শরাহ্ মিরকাত শরীফ-এ হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ক্বাওল উল্লেখ করেছেন যে, (যিনি মালেকী মায্হাবের ইমাম) হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহিআলাইহি তিনি বলেন, “যে ইল্মে ফিকাহ্ শিক্ষা করলো কিন্তু ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করলো না, সে ফাসিক অর্থাৎ গুণাহ্গার এবং যে শুধু ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করলো অর্থাৎ সে বলে মারেফত করি, মারেফত করি কিন্তু শরীয়তের ধার ধারে না, সে যিন্দিক কাফির। আর যে দু’টোই অর্জন করলো সে মুহাক্কিক।”
আর ইলমে ফিকাহ্ অর্থাৎ অজু, গোসল, ইস্তিঞ্জা, মোয়ামেলাত, মোয়াশেরাত ইত্যাদি শিক্ষার জন্য ওস্তাদ গ্রহণ যেমন- ফরজ (আবশ্যক) অর্থাৎ মাদ্রাসায় গিয়েই হোক অথবা ব্যক্তিগতভাবে কোন ওস্তাদের নিকট থেকেই হোক তা জরূরত আন্দাজ শিক্ষা করা ফরজ। তদ্রুপ ইল্মে তাসাউফের জন্যও ওস্তাদ গ্রহণ করা ফরজ। আর এ ওস্তাদকেই আরবীতে ‘শায়খ’ বলা হয়। আর ফারসীতে ‘পীর’ বলা হয়। দুররুল মুখতার যা বিশ্ববিখ্যাত কিতাব তার মধ্যে একটি উসুল উল্লেখ করা হয়েছে,
مالا يتم به الفرض فهو فرض ما لا يتم به الواجب فهو واجب.
অর্থঃ- “যে আমল ব্যতীত ফরজ পূর্ণ হয় না, সে আমল করাও ফরজ। যে আমল ব্যতীত ওয়াজিব পূর্ণ হয় না, সে আমল করাও ওয়াজিব।”
ইল্মে ফিক্বাহ শিক্ষা করার জন্য প্রত্যেকের পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বিগণই মাদ্রাসায় ভর্তি করায়ে থাকেন, কারো যদি পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বী জীবিত না থাকে, তাহলে তার পক্ষে ইল্মে ফিকাহ্ শিক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সময় বিশেষে অসম্ভবও হয়ে যায়। কেননা ইল্মে ফিকাহ্ শিক্ষা করার সময় যেমন থাকা-খাওয়া, লেখা-পড়া ইত্যাদির জন্য টাকা-পয়সার জরূরত হয়, সে টাকা-পয়সার আঞ্জাম দেন পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বীগণ। অনুরূপ ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করার সময়ও থাকা-খাওয়া, লেখা-পড়া ইত্যাদির জন্য টাকা-পয়সার জরূরত হয় এবং সে টাকা-পয়সার আঞ্জাম দেন পিতা-মাতা ও মুরুব্বীগণ। এটাই যদি সত্য হয় যে, পিতা-মাতা অথবা মুরুব্বীগণ জীবিত থাকা কালীন ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করা যাবে না, তাহলে যে সকল সন্তানেরা পিতা-মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় ইন্তেকাল করে, তাদের পক্ষে ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করা সম্ভব নয়। যার ফলে তারা একটি ফরজ আদায় করা হতে মাহ্রূম থেকে গুণাহ্গার হলো। আর যদি পিতা-মাতা জীবিত থাকা অবস্থায় ইল্ম অর্জন করা না যায়, তাহলে সন্তানদের ইল্ম অর্জন করার জন্য পিতা-মাতার মৃত্যু কামনা করতে হবে। কেননা যেহেতু ইল্ম অর্জন করা ফরজ এবং এই ফরজ পিতা-মাতার মৃত্যু ব্যতীত অর্জন করা সম্ভব নয়, তাই এই ফরজ আদায়ের জন্য সন্তানদের পিতা-মাতার শুধু মৃত্যু কামনা করেই নয় বরং তাদের মৃত্যুবরণ করায়ে ইল্ম অর্জন করতে হবে। অথচ পিতা-মাতার মৃত্যু কামনা করা শক্ত গুণাহ্।
যে কোন কাজ করার পূবে পিতা-মাতার অনুমতি নেয়া বরকতের কারণ। কিন্তু সেজন্য যে বিষয়ে পিতা-মাতার জ্ঞান নেই সেই বিষয়ে এজাযতের জরূরত নেই বরং বরকতের জন্য জানানো দরকার। কারণ মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন, “যদি তোমরা না জান, তাহলে যারা জানেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।” আর যদি কারো পিতা-মাতা পীর, বুযূর্গ, ওলী আল্লাহ্ অথবা হক্কানী আলেম হন, তাহলে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। যার পিতা-মাতার ইল্ম-কালাম নেই, তাদের নিকট যদি পীর ছাহেব গ্রহণ করার অনুমতি চাওয়া হয়, আর তারা অনুমতি না দেন, তথাপিও তাকে পীর ছাহেব গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু পীর ছাহেব গ্রহণ করা ফরজ। কেননা মহান আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফ-এ বলেন,
وان جاهداك على ان تشرك بى ماليس لك به علم فلا تطعهما وصا حبهما فى الدنيا معروفا.
অর্থঃ- “যদি তারা তোমাদের শরীক (শিরক) করার জন্য আদেশ করে, যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তবে তাদেরকে অনুসরণ করোনা এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে উত্তমভাবে বসবাস কর।” (সূরা লোকমান-১৫)
এবং হাদীছ শরীফে এ আয়াত শরীফ-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়,
لا طاعة لمخلوق فى معصية الخالق.
অর্থঃ- “কোন মখলুকের অনুসরণ করতে গিয়ে আল্লাহ পাক উনার হুকুমের খেলাফ করা যাবে না।”
  উপরোক্ত আয়াত শরীফ এবং হাদীছ শরীফ দ্বারা এটাই বুঝা যায় যে, পিতা-মাতা কোন আদেশ করলে যদি তা শরীয়ত সম্মত হয়, তাহলে তা মানা যাবে। আর যদি শরীয়তের খেলাফ হয়, তাহলে তা মানা যাবে না। তবে সৎভাবে তাদের সাথে জীবন-যাপন করতে হবে।
অতএব প্রত্যেক পিতা-মাতার কর্তব্য হলো- কোন হক্কানী পীর ছাহেব গ্রহণ করে ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করা, আর তাদের দায়িত্ব তারা স্বীয় সন্তানদিগকে যেভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় ভর্তি করায়ে থাকে, ঠিক সেভাবে কোন হক্কানী পীর সাহেবের দরবারে ইল্মে তাসাউফ শিক্ষা করার জন্য পৌঁছিয়ে দেয়া।
আবা-২৩

0 Comments: