সুওয়াল : ৮ই আগষ্ট, ১৯৯৪ইং তারিখে দৈনিক ইনকিলাব ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় লিখা
হয়েছে যে, “দেশ বরেণ্য মুফতীদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লংমার্চ, হরতাল
ইত্যাদিসহ যা কিছু করা হয়েছে এবং হরতাল, লংমার্চসহ যতগুলি প্রোগ্রাম হাতে
নেয়া হয়েছে এবং তার মধ্যে যা বাস্তাবায়ন করা হয়েছে, সেগুলো দেশ বরেন্য মুফতীদের
সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করা হয়েছে, এ ব্যাপারে দ্বীমত পোষণের কোন
অবকাশ নেই।”
এখন আমরা জানতে চাচ্ছি- এ সমস্ত মুফতী সাহেব কারা এবং তাদের নাম কি? আর এ সমস্ত
মুফতী সাহেবগণ যে ফতওয়া দিয়েছেন, তা কোথায় পাওয়া যাবে? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।
জাওয়াব : উপরোক্ত প্রশ্নকারীর উচিৎ ছিল এ প্রশ্ন আমাদের কাছে না করে
যে সমস্ত দৈনিক পত্রিকায় উল্লিখিত কথা ছাপা হয়েছে, তাদের নিকট চিঠি দিয়ে জেনে নেয়া।
উপরোক্ত কথা যে দৈনিকেই ছাপানো হোক না কেন, আর যে কেউই বলে থাকুক না কেন, তা
শরীয়তসম্মত হয়নি। কেননা,
কোন বিষয়কে জায়েয বা নাজায়েয বলে ফতওয়া দিতে হলে, তা
অবশ্যই পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র
হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা
শরীফ, পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ অনুযায়ী হতে হবে। কারণ, পবিত্র কুরআনুল
কারীম উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি
ইরশাদ করেন,
ياايها
الذين امنوا اطيعوا الله واطيعوا الرسول واولى الامر منكم- فان تناز عتم فى شئى
فرذوه الى الله والرسول.
অর্থঃ- “হে
ঈমানদারগণ! তোমরা মহান আল্লাহ তায়ালা উনার আনুগত্যতা করো এবং নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইত্বায়াত কর, আর
অনুসরণ কর উলিল আমরগণ উনাদের। অতঃপর যদি কোন ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে বিরোধের
সৃষ্টি হয়, তাহলে তা মহান আল্লাহ পাক উনার ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূল
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার দিকে রুজু কর।” (পবিত্র সুরা নিসা, পবিত্র আয়াত শরীফ ৫৯)
এ পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় হযরত মুফাসসিরীনে কিরাম রহমতুল্লাহি
আলাইহিগণ বলেন, “মহান আল্লাহ পাক উনার আনুগত্যতা করতে হবে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ইত্তেবা করতে হবে, আর উলিল
আমরগণ উনাদের অনুসরণ করতে হবে। যিনি মহান আল্লাহ পাক উনার মতে এবং নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন
শরীফ, পবিত্র
হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র
ক্বিয়াস শরীফ অনুযায়ী চলেন,
তিনিই উলিল আমরের অন্তর্ভূক্ত। তবে যদি উলিল আমরগণের মধ্যে
মতবিরোধ দেখা দেয়,
তাহলে যে উলিল আমরের ফতওয়া বা মত পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার অধিক নিকটবর্তী অর্থাৎ যার ফতওয়ার দলীল-আদিল্লাহ বেশী এবং
নির্ভরযোগ্য ও সহীহ্,
উনার মতই অনুসরণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন,
لاطاعة لمخلوق فى معصية الخالق.
অর্থঃ- “মহান
আল্লাহ পাক উনার নাফরমানী করে মখলুকাতের আনুগত্যতা করা জায়েয নেই।”
আর এ পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার ব্যাখ্যায় মুজতাহীদগণ বলেন,
ان
وجوب اطاعتهم ماذاموا على الحق واذا حالفوه فلااطاعة لهم.
অর্থঃ- “যতক্ষণ
পর্যন্ত হক্বের উপর থাকবে,
ততক্ষণ পর্যন্ত অনুসরণ করা ওয়াজিব। আর যদি পবিত্র কুরআন
শরীফ, পবিত্র সুন্নাহ খিলাফ চলে, তাহলে তাদের অনুসরণ করা যাবেনা।” (তাফসীরে আহমদিয়াত)
তাফসীরে ওসমানীতে আছে, “যারা
কুরআন ও সুন্নাহ্র স্পষ্ট হুকুমের খিলাফ করে, কখনোই তাদের হুকুম মান্য করা
যাবেনা।”
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার যামানায় বাদশাহ্ শাহ্জাহান তার দরবারের আলেমকে বলেছিলেন, আমি একটু
অসুস্থ, রেশমীকাপড় ব্যতীত অন্য কাপড় পরলে শরীর চুলকায়। রেশমী কাপড় পরিধান করলে আমি
সুস্থ থাকবো। এখন আমার জন্য রেশমী কাপড় পরিধান করা জায়েয হবে কি? তখন
বাদশাহ্র দরবারের আলেম বললেন, আপনার জন্য রেশমী কাপড় পরিধান করা জায়েয। যেহেতু আপনি দেশের
বাদশাহ্, আপনি সুস্থ থাকলে,
দেশ সুষ্ঠুভাবে চলবে, আর আপনি অসুস্থ হয়ে গেলে দেশ
সুষ্ঠুভাবে চলবেনা,
তাই আপনার জন্য রেশমী কাপড় পরিধান করা জায়েয। তখন বাদশাহ্
শাহ্জাহান বললেন,
আপনার মৌখিক ফতওয়া চলবেনা, লিখিত দিতে হবে। তখন সে আলেম
লিখিত ফতওয়া নিয়ে আসেন। বাদশাহ্ সে ফতওয়া দেখে বললেন, আপনার
একার সীল ও স্বাক্ষর থাকলে চলবেনা, আরো অন্যান্য আলেমগণের সীল ও
স্বাক্ষর থাকতে হবে। এরপর সে আলেম আরো তিনশত আলেমের সীল ও স্বাক্ষরসহ বাদশাহ্
শাহ্জাহানের কাছে পেশ করলেন। অতঃপর বাদশা শাহ্জাহান সে ফতওয়া দেখে বললেন, শুধু
আপনাদের সীল ও স্বাক্ষর থাকলেই চলবে না, এতে হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার সীল ও স্বাক্ষর থাকতে হবে। তখন সে ফতওয়া হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে পেশ করা হয়, যেন তিনি
তাতে সীল ও স্বাক্ষর দিয়ে দেন যে, বাদশাহ্ শাহ্জাহানের জন্য রেশমী কাপড় পরিধান করা জায়েয আছে।
ফতওয়া পেয়ে এবং তাদের কথা শুনে হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, “দেখ আমার
মসজিদে বাদশাহ্ ও তার উজির-নাজির জুমুয়ার
নামায পড়ে থাকে,
আর আমি জুময়ার পূর্বে বয়ান করে থাকি। ইনশাআল্লাহ আমি জুময়ার
বয়ানের সময় এ ফতওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বলবো।” জুমুয়ার দিন যথাসময়ে বাদশাহ্, উজির-নাজির
ও মুছল্লীগণ সে ফতওয়া সম্পর্কে জানার জন্য মসজিদে উপস্থিত হলেন। হযরত মুল্লা জিয়ূন
রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বয়ানে বললেন, “মুফতী আওর মুস্তাফতী হার দো
কাফেরান্দ” অর্থাৎ ফতওয়া যারা দিয়েছে ও যে চেয়েছে, তারা সকলেই কাফির। কারণ মুস্তাফতী
(ফতওয়া চাহনেওয়ালা) হারামকে হালাল করতে চেয়েছে, আর মুফতী (ফতওয়া দেনেওয়ালাগণ)
হারামকে হালাল করে দিয়েছেন। কাজেই সকলেই কাফির হয়ে গিয়েছে। এরপর তিনি উনার বয়ান
যথারীতি শেষ করে নামায পড়িয়ে দেন, আর বাদশাহ্, উজির-নাজির সকলেই যথারীতি নামায
আদায় করে বাসায় চলে গেলেন এবং বাদশাহ্ দরবারে গিয়েই হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করেন। বাদশাহ্ আলমগীর, যিনি তখন
হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি
উনার ছাত্র ছিলেন এবং বাদশাহ্ শাহ্জাহানের পুত্র ছিলেন। তিনি দরবারের গ্রেফতারী
পরওয়ানা শুনে হযরত মুল্লা জিয়ূন
রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার নিকট দৌড়ে গেলেন এবং বললেন, হুজুর!
আপনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করা হয়েছে, এখনই পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেফতার
করে নিয়ে যাবে। একথা শুনে হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “এখনই
আমার ওযূর বদনা ও মিস্ওয়াক দাও, আমি মিস্ওয়াক করে ওযূ করে তোমার আব্বার রাজত্বের বিরুদ্ধে
বদ্দোয়া করে, তোমার আব্বার রাজত্ব ধ্বংস করে দেব।” কারণ,
الوضوء سلاح المؤمن.
অর্থঃ- “ওযূ হলো
মু’মিনের অস্ত্র।”
এ অবস্থা দেখে বাদশাহ্ আলমগীর, বাদশাহ্ শাহ্জাহানের কাছে চলে
গেলেন এবং বললেন,
“আপনি যে, হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বিরুদ্ধে
গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করেছেন, এটা শুনে তিনি গোস্বা করেছেন এবং বলেছেন, আপনার
বিরুদ্ধে বদ্দোয়া করে আপনার রাজত্ব ধ্বংস করে দিবেন।” তখন
বাদশাহ্ শাহ্জাহান ভীত হয়ে বললো, তাহলে কি করা যেতে পারে? তখন বাদশাহ্ আলগীর পরামর্শ দিলেন, আপনি
হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি
উনার নিকট মাফ চেয়ে এই বলে চিঠি লিখেন যে, আমার ভুল হয়েছে, আমাকে
ক্ষমা করে দিন। অতঃপর বাদশাহ্ আমলগীরের পরামর্শ অনুযায়ী বাদশাহ্ শাহ্জাহান হযরত
মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেন এবং এই চিঠি
পেয়ে হযরত মুল্লা জিয়ূন রহমতুল্লাহি
আলাইহি ক্ষমা করে দেন।
উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, একাধিক বা শতাধিক মুফতী সাহেব
ফতওয়া দিলেই, তা গ্রহণযোগ্য হবেনা,
যতক্ষণ পর্যন্ত সে ফতওয়া পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ
শরীফ, পবিত্র
ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ মোতাবেক না হবে।
আরো উল্লেখ্য যে,
হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার জামানায়
খলকে কুরআনের ফিৎনার সময় আলেমগণ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে যায়-
(১) সরকারী প্রলোভনে হক্ব মত-পথ
ত্যাগ করে দুনিয়া হাসিলের জন্য ঈমান বিকিয়ে খল্কে কুরআনের পক্ষে প্রচার-প্রসার
শুরু করে।
(২) সরকারের অত্যাচার ও জুলুমের
ভয়ে হক্বপন্থী হওয়া সত্ত্বেও খল্কে কুরআনের পক্ষে-বিপক্ষে কিছু না বলে নীরব ভূমিকা
পালন করে।
(৩) আর যাঁরা দ্বীনদার আলেম, উনারা
সরকারের বিরুদ্ধে একমাত্র মহান আল্লাহ পাক এবং নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সন্তুষ্টি মুবারক হাসিলের জন্য জান-মাল, মান-সম্মান, ইজ্জত
সমস্ত কিছু বিসর্জন দিয়ে খলকে কুরআনের কুফরী মতবাদের তীব্র প্রতিবাদ করেন। উনাদের
মধ্যে মূল ব্যক্তি হলেন,
হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি। আর উনার
সাহায্যকারী ছিলেন- হযরত মুহম্মদ বিন নূহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি।
জালিম সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি ও হযরত মুহম্মদ বিন নূহ্
রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় সরকারি বাহিনীর নির্মম ও
অসহনীয় অত্যাচারে হযরত মুহম্মদ বিন নূহ্ রহমতুল্লাহি আলাইহি শাহাদাত বরণ করেন। তখন
সমগ্র মুসলিম জাহানের মধ্যে জালিম সরকারের খলকে কুরআনের কুফরী মতবাদের বিরুদ্ধে
হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি
আলাইহি একাই প্রতিবাদ জারী রাখেন। আর তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ যে মখলুক নয়, এর প্রতিবাদে
যে ফতওয়া দেন, সে ফতওয়ার সত্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ওলামাগণ, যারা
জালিম সরকারের মদদপুষ্ট ছিল, তাদের বিরুদ্ধে বাহাস করেন। বাহাসে সরকারের মদদপুষ্ট ওলামারা পরাস্ত হয় এবং
হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি
আলাইহি বাহাসে জয়ী হন। সরকারী মদদপুষ্ট দুনিয়াদার আলেম সম্প্রদায় পরাস্ত হওয়ার পরও
হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনাকে গোমরাহ,
বিদয়াতী ও কাফির বলে আখ্যায়িত করেন। তখন ক্ষমতাসীন খলিফা
ছিল, মু’তাসিম বিল্লাহ্ এবং তার মদদপুষ্ট সমস্ত ওলামারা এ খলকে কুরআনের কুফরী মতবাদের
ধারক-বাহক ও সমর্থক ছিল। আর একা হযরত ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি
পবিত্র কুরআন শরীফ যে মখলুক নয়, তার পক্ষে ছিলেন। কাজেই সমস্ত আলেম এবং সরকার কোন বিষয়ে
একমত পোষণ করলেই যে সেটা হক্ব হবে, তা নয়। বরং হযরত ইমাম আহমদ বিন
হাম্বল রহমতুল্লাহি আলাইহি একা হওয়া সত্বেও যেহেতু উনার মত পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ অনুযায়ী ছিলো, তাই উনারটাই
সম্মানিত ইসলামী শরীয়তসম্মত হক্ব বলে প্রমাণিত হয়।
আরো উল্লেখ্য যে,
হযরত ইমাম শাফেয়ী
রহমতুল্লাহি আলাইহি- তিনি তখনো হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার
ছাত্র ছিলেন। একদিন হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি দর্স দিচ্ছিলেন, এমতাবস্থায়
এক পাখী বিক্রেতা এসে উনাকে একটা মাসয়ালা জিজ্ঞেস করলো। মাসয়ালাটি হলো- “আমি পাখী
বিক্রেতা, পাখীকে কথা শিখিয়ে বিক্রি করি। এক ব্যক্তির নিকট একটি পাখী বিক্রি করি এ শর্তে
যে, পাখীটি খুব কথা বলে। লোকটি পাখীটা খরিদ করে নিয়ে যায় এবং পরে ফেরত দেয় এই বলে
যে, পাখীটি কোনই কথা বলে না। একথা শুনে আমার খুব রাগ হলো। কারণ, আমি
নিশ্চিতভাবে জানতাম পাখীটি কথা বলে। তখন তার সাথে আমার কথা কাটাকাটি হয়। এক
পর্যায়ে আমি উত্তেজিত হয়ে বলি- পাখীটি কখনো নীরব থাকে না, আমি যদি
মিথ্যা বলে থাকি এবং পাখীটি যদি নিরব থাকে, তবে আমার স্ত্রী তালাক। তখন
ক্রেতা বলে যে, তোমার পাখী বিক্রির ব্যাপারে আলোচনা পরে হবে, প্রথমে তোমার স্ত্রী তালাক হওয়া
না হওয়ার ব্যাপারে ফায়সালা করো। তাই এসেছি আপনার কাছে, এ মাসয়ালার
ফায়সালা করার জন্য যে,
এতে আমার স্ত্রী তালাক হয়েছে কি? যেহেতু
আপনি পবিত্র মদীনা শরীফ উনার মধ্যে অন্যতম আলেম ও ফক্বিহ্।
এ মাসয়ালা শুনার পর হযরত ইমাম মালেক
রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “তাহলে তোমার স্ত্রী তালাক হয়ে
গেছে।” তখন সে ব্যক্তি নিরাশ হয়ে, দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিষন্ন মনে ফিরে যাচ্ছিল।
এমতাবস্থায় হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি (তিনি খুব মনযোগ সহকারে মাসয়ালাটি
শুনেছিলেন) দর্সগাহ্ থেকে বের হয়ে এসে খানিকদূর পাখী বিক্রেতার পিছনে পিছনে যাওয়ার
পর লোকটিকে ডাক দিলেন। বললেন, আচ্ছা বলতো- তোমার পাখীটি বেশী সময় কথা বলে, না
বেশীরভাগ সময় নীরব থাকে?
লোকটি বললো- কথাই বেশী বলে, তবে মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্য
বিরত থাকে। হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, “তুমি
নিশ্চিন্ত থাক, স্ত্রী তোমার ঠিকই আছে,
সে তালাক প্রাপ্তা হয়নি।” তবে তুমি আরেকবার ইমাম সাহেবের
কাছে যাও। গিয়ে বল যে,
তিনি যেন উনার প্রদত্ত ফতওয়া সম্বন্ধে আরেকটু চিন্তা-ভাবনা
করেন। শুনে লোকটি কিছুটা আশ্চার্যাম্বিত হয়ে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি
উনার নিকট গিয়ে বললেন,
হুযূর! আমার ব্যাপারে আপনাকে আরেকবার চিন্তা করে দেখার জন্য
অনুরোধ করছি। একথা শুনে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন, “তোমার
স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে,
চিন্তার কোন অবকাশ নেই। তখন লোকটি বললো, আপনার
মজলিসের এ ছেলেটি বলছে- “আমার স্ত্রী তালাক হয়নি।” শুনে হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি একটু আশ্চর্যবোধ
করলেন এবং বললেন,
“তুমি কিভাবে এরকম ফতওয়া দিতে পারো? এখানে
পরিমাপ করার মত দলীল আছে কি?” তখন হযরত ইমাম শাফেয়ী
রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, “আপনি আমাদেরকে একটি পবিত্র হাদীছ
শরীফ শিক্ষা দিয়েছেন,
যা হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন জিয়াদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
থেকে বর্ণিত। তা হলো- “হযরত ফাতিমা বিনতে কায়েস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু একদিন নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার খিদমতে হাজির হয়ে আরজ করেছিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! হযরত মুয়াবিয়া
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও হযরত আবু জাহাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উভয়ে আমাকে
শাদী করতে ইচ্ছুক। এমতাবস্থায় আমি কাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করবো?” এর
জাওয়াবে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
তিনি বলেছিলেন, “আবূ জাহাম তো কখনো কাঁধ হতে কাঠের বোঝা নামায় না।” (ইমাম
শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন) পবিত্র হাদীছ
শরীফ উনার এ শেষ অংশটি যদি আভিধানিক অর্থে গ্রহণ করা হয়, তাহলে
বাধ্য হয়েই বলতে হয় যে, (নাউযুবিল্লাহ্) নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার কথা সঠিক
ছিলনা। কারণ তিনি জানতেন যে, হযরত আবু জাহাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শয়ন করেন, খানাপিনা
করেন এবং অন্যান্য কাজ-কর্মও করেন। সুতরাং দেখা যায়, কথাটি প্রচলিত অর্থেই ব্যবহৃত
হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর এর অর্থ হলো- হযরত আবূ জাহাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু তিনি অধিকাংশ সময় কাঠের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পাখীওয়ালার মাসয়ালাটিও তাই, “পাখীটি
কখনো নীরব থাকেনা। এর অর্থ বেশীরভাগ সময় বা অধিকাংশ সময় কথা বলে, তবে সময়
সময় নীরবও থাকে। একথা প্রচলিত অর্থেই বলা হয়েছে এবং এ অর্থই গ্রহণ করতে হবে। অতএব
বর্ণিত মাসয়ালার ক্ষেত্রে পাখীওয়ালার স্ত্রী তালাক হয়েছে বলে আমার মনে হয়না।
হযরত ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি
স্বীয় ছাত্র, হযরত ইমাম শাফেয়ী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ফতওয়া সম্পর্কে সুক্ষ্ম চিন্তা ও
বুদ্ধিমত্তা দেখে খুশী হলেন এবং প্রশ্নকারী পাখীওয়ালাকে বললেন, “আমার
ছাত্র এ যুবকের কথাই ঠিক,
তোমার স্ত্রী তালাক হয়নি।”
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এটাই স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, রাজশক্তি
এবং আলেম তথা মুফতীদের সম্মিলিত মত বা আমল হলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে না, যতক্ষন
পর্যন্ত তা পবিত্র কুরআন শরীফ, পবিত্র হাদীছ শরীফ, পবিত্র ইজমা
শরীফ ও পবিত্র ক্বিয়াস শরীফ মোতাবেক জায়েয প্রমাণিত না হবে। তদ্রুপ ফতওয়া দিলেও, সে ফতওয়া
গ্রহণযোগ্য হবে না,
যে পর্যন্ত সে ফতওয়ার পক্ষে নির্ভরযোগ্য দলীল পেশ করা না
হবে।
কাজেই কথিত সেই মুফতীদের উচিৎ ছিল, তাদের বক্তব্যের স্বপক্ষে দলীল
পেশ করা। কেননা আমরা আমাদের “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায় ছবি, লংমার্চ, হরতাল
ইত্যাদি হারাম হওয়া সম্পর্কে বিস্তারীত ও নির্ভরযোগ্য দলীল-আদিল্লাহ পেশ করেছি।
আর কথিত দেশ বরেণ্য মুফতীদের নাম ঠিকানা ও এ সম্পর্কিত তাদের প্রদত্ত কোন
ফতওয়া আমাদের নিকট পৌঁছেনি।
আবা-১৭
0 Comments:
Post a Comment