৪৪৩ নং- সুওয়ালঃ- জনৈক মাওলানা সাহেব বলেন যে, চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যাভিচার, গান-বাজনা ইত্যাদি, বান্দা আল্লাহ্ পাক-এর হুকুমে করে থাকে। তার যুক্তি হলো আল্লাহ্ তায়ালার হুকুম ব্যতীত পৃথিবীতে কোন কিছু সংঘটিত হতে পারে না। যদি আল্লাহ্ তায়ালারই হুকুমে সংঘটিত না হতো, তবে আল্লাহ্ পাক তাকে এসব হারাম কাজ করা থেকে বিরত রাখেন না কেন? আরো বলেন যে, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস করতে হয়। তাই এসব কাজ বান্দার তাক্বদীরেরই লেখা। এটার সঠিক সমাধান দিয়ে ধন্য করবেন।

সুওয়ালঃ- জনৈক মাওলানা সাহেব বলেন যে, চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যাভিচার, গান-বাজনা ইত্যাদি, বান্দা আল্লাহ্ পাক-এর হুকুমে করে থাকে। তার যুক্তি হলো আল্লাহ্ তায়ালার হুকুম ব্যতীত পৃথিবীতে কোন কিছু সংঘটিত হতে পারে না। যদি আল্লাহ্ তায়ালারই হুকুমে সংঘটিত না হতো, তবে আল্লাহ্ পাক তাকে এসব হারাম কাজ করা থেকে বিরত রাখেন না কেন? আরো বলেন যে, তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস করতে হয়। তাই এসব কাজ বান্দার তাক্বদীরেরই লেখা। এটার সঠিক সমাধান দিয়ে ধন্য করবেন। 

জাওয়াব - আপনার উপরোক্ত প্রশ্নটির বক্তব্য তিন ভাগে বিভক্ত- (ক) সমস্ত কাজ মহান আল্লাহ্ পাক উনার হুকুমেই হয়, এমন কি হারাম বা অবৈধ কাজও।
(খ) হারাম কাজে মহান আল্লাহ্ পাক উনার সমর্থন যদি না থাকত, তবে তিনি বান্দাদেরকে হারাম থেকে বিরত রাখেন না কেন? 
(গ) তাক্বদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাসের অর্থই হচ্ছে- মহান আল্লাহ্ পাক উনার বান্দাদেরকে চোর-ডাকাত, যিনাকার, শরাবখোর ইত্যাদি হিসেবে তৈরি করেন।
(ক) চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যভিচার, গান-বাজনা ইত্যাদি কাজ বান্দাাহ্ মহান আল্লাহ্ পাক উনার হুকুমে করে, এরূপ বলা কুফুরী। মহান আল্লাহ্ পাক উনার হুকুম ছাড়া পৃথিবীতে কোন কাজ সংঘটিত হয় না, এটা বিশুদ্ধ কথা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক তিনি ইরশাদ করেন,  
وما تسقط من ورقة الا يعلمها ولا حبة فى ظلمات الارض ولا رطب ولا يابس الا فى كتاب مبين.
অর্থঃ- মহান আল্লাহ্ পাক উনার জানা ব্যতীত গাছের কোন পাতা ঝড়ে না বা পড়ে না। আর কোন বীজও যমিনের অন্ধকারে পতিত হয় না এবং কোন ভিজা ও শুকনা জিনিষও পতিত হয় না। (এসব কিছুই) প্রকাশ্য কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। (সূরা-আনআম, আয়াত নং-৫৯)
তবে তার অর্থ এ নয় যে, হারাম কাজ অর্থাৎ চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যাভিচার, গান-বাজনা ইত্যাদি বান্দা মহান আল্লাহ্ পাক উনার হুকুমে করে থাকে। বরং এর অর্থ হচ্ছে-
ان الله على كل شيئ قدير.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ পাক তিনি সমস্ত বিষয়ের উপর সর্ব শক্তিমান।” (সূরা বাক্বারাহ, আয়াত নং-২০)
মূলতঃ মানুষ হারাম কাজগুলি করে থাকে নফ্সের তাড়নায় ও শয়তানের ওসওয়াসায়। যার মধ্যে মহান আল্লাহ্ পাক উনার কোন মদদ বা সাহায্য থাকে না। আর মানুষ যখন ভাল কাজ করে, তখন আল্লাহ্ পাক তিনি তাকে গায়েবী মদদ করে থাকেন। সে প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন,
وما اصابك من حسنة فمن الله.
অর্থঃ- “(হে লোক সকল) তোমাদের প্রতি যে কল্যাণ বা হাসানাহ পৌঁছে, তা মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকে। অর্থাৎ বান্দাদের প্রতি যে ভালাই বা খায়ের পৌঁছে থাকে, তা শুধুমাত্র মহান আল্লাহ পাক উনার রহ্মতের কারণেই পৌঁছে থাকে।” আর মন্দ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন, 
وما اصابك من سينة فمن نفسك.
অর্থঃ- “(হে লোক সকল) তোমদের প্রতি যে মন্দ পৌঁছে বা উপস্থিত হয়, তা তোমাদের নিজের (বদ আমলের) কারণে।” (সূরা নিসা, আয়াত নং-৭৯)
তিনি আরো বলেন, 
ظهر الفساد فى البر والبحر بما كسبت ايدى الناس.
অর্থঃ- “স্থলভাগে ও পানি ভাগে যে সমস্ত ফিৎনা-ফাসাদ প্রকাশিত হয়, তা মানুষের হাতের কামাই অর্থাৎ বদ্ আমলের কারণ।” (সূরা রুম, আয়াত নং-৪১)
আক্বায়েদের কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে- যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ্ পাক-এর রহ্মতকে কোন হারাম কাজের সাথে সংযুক্ত করে, যেমন-যদি কেউ বলে যে, মহান আল্লাহ্ পাক উনার রহ্মতে বান্দা চুরি করে, শরাব পান করে ইত্যাদি, তাহলে সে কাফেরের অন্তর্ভূক্ত হবে।
(খ) মহান আল্লাহ্ পাক উনার বান্দাকে পাপ কাজ থেকে বিরত রাখেন না কেন, এ কথা বলাটাও কুফুরী। কেননা আল্লাহ্ পাক কুরআন শরীফে বলেন, 
الذى خلق الموت والحيوة ليبلوكم ايكم احسن عملا.
অর্থঃ-“যিনি (আল্লাহ্ পাক) মউত ও হায়াতকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, তোমাদের মধ্যে আমলে কে উত্তম।” (সূরা মূলুক, আয়াত নং-২)
তিনি আরো বলেন-
وهديناه النجدين.
অর্থঃ- “আমি তাঁকে (তোমাদেরকে) উভয়পথ (ভাল-মন্দ) প্রদর্শন করেছি।” (সূরা বালাদ, আয়াত নং-১০)
আল্লাহ্ পাক আরো বলেন-
فالهمها فجورها وتقواها.
অর্থঃ- “অতঃপর আমি তাকে (তোমাদেরকে) নেক বা তাক্ওয়া, বদী বা পাপ সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছি।” (সূরা শামস্, আয়াত/৮)
উপরোক্ত আয়াত সমূহের আলোকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ্ পাক তিনি মানুষকে ভাল-মন্দ উভয় পথ প্রদর্শন করেছেন এবং হায়াত-মউত সৃষ্টি করেছেন, কে আমলে উত্তম বা অধম তা পরীক্ষা করার জন্য। অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ পাক বান্দাদেরকে আমল করার ব্যাপারে এখতিয়ার দিয়েছেন। কাজেই যে ব্যক্তি নেক কাজ করবে, মহান আল্লাহ্ পাক তাকে রহ্মত বর্ষণ করবেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন-
ان رحمة الله قريب من المحسنين.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ্ পাক উনার রহ্মত নেককারগণের প্রতি।” (সূরা আ’রাফ, আয়াত নং-৫৬)
আর যারা বদ্ কাজ করে, তাদেরকে মহান আল্লাহ্ পাক তিনি মদদ বা সাহায্য করেন না। কারণ তারা শাস্তির উপযুক্ত। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন,
ان الفجار لفى جحيم.
অর্থঃ- “নিশ্চয়ই পাপী ব্যক্তিরা জাহান্নামে থাকবে।” (সূরা ইনফিতর, আয়াত নং-১৪)
যেহেতু মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বান্দাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য কে আমলে উত্তম বা অধম, আর জানিয়ে দিয়েছেন- কোনটি ভাল, কোনটি মন্দ। সেহেতু মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বান্দাকে এখ্তিয়ার দিয়েছেন আমল করার ব্যাপারে। অতএব বান্দাকে হারাম কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখার প্রশ্নই উঠে না।
(গ) হ্যাঁ, ঈমানে মুফাস্সালে রয়েছে-
والقدر خيره وشره من الله تعالى.

অর্থঃ- “অর্থাৎ তাক্বদীরের ভাল-মন্দ মহান আল্লাহ্ পাক উনার তরফ থেকে।” 
এর অর্থ হচ্ছে যেমন- ধনী-গরীব, সুস্থ-অসুস্থ, অবসর-ব্যস্ততা, সুখ-দুঃখ, কৃতকার্যতা, অকৃতকার্যতা ইত্যাদি তক্ব্দীরের অন্তর্ভূক্ত, এটা মেনে নিতে হবে। কেননা মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন-
عسى ان تكر هوا شينا وهو خير لكم وعسى ان تحبوا شيئا وهو شر لكم والله يعلم وانتم لا تعلمون.
অর্থঃ- “সম্ভবতঃ তোমরা যা খারাপ মনে কর সেটাই তোমাদের জন্য ভাল, আর যা ভাল মনে কর সেটাই তোমাদের জন্য মন্দ। মহান আল্লাহ্ পাক তিনিই জানেন কোনটি ভাল এবং কোনটি মন্দ, তোমরা জাননা।” (সূরা বাক্বারাহ্-২১৬)
হাক্বীক্বতে মহান আল্লাহ্ পাক বান্দার খারাপ চান না কিন্তু বান্দা না বুঝার কারণে নফ্সের তাড়নায় ও শয়তানের ওসওয়াসায় নিজেরা খারাপ করে থাকে। অর্থাৎ কোনটি ভাল, কোনটি ভাল নয় তা মানুষের জানা নেই। একমাত্র মহান আল্লাহ্ পাক তিনিই তা জানেন। তাই মানুষের জীবনে এ ধরণের যা কিছুই সংঘটিত হোক না কেন সেটা তাকে মেনে নিতে হবে। সেটা তার ভালোর জন্য, যা তাক্বদীরের অন্তর্ভূক্ত। এর অর্থ এই নয় যে, চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যাভিচার, গান-বাজনা ইত্যাদি পাপ কাজ করার জন্য আল্লাহ্ পাক তার তাক্বদীরে লিখে দিয়েছেন।
তাক্বদীরের অর্থ হচ্ছে- মহান আল্লাহ্ পাক উনার ইল্মে আছে বা রয়েছে। অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ পাক তিনি কোন ব্যক্তিকে জান্নাতী বা জাহান্নামী হিসেবে, নেককার বা বদ্কার হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেননি। বরং মহান আল্লাহ্ পাক উনার ইল্মে রয়েছে কে জান্নাতি হবে, কে জাহান্নামী হবে, কে নেককার হবে, কে বদ্কার হবে। যেহেতু মহান আল্লাহ্ পাক
عالم الغيب والشهادة
অর্থঃ- দৃশ্য-অদৃশ্য সব বিষয় সম্পর্কে অবহিত। 
মূলতঃ সকল মানুষকে সম্মানিত করা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন-
لقد كرمنا بنى ادم
অর্থঃ- “আমি বণী আদমকে সম্মানিত করেছি।” (সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত নং-৭০)   
 তিনি আরো বলেন-
ولكم فى الارض مشتقرومتاع الى حين.
অর্থঃ- “তোমাদের জন্য জমিনে নির্দিষ্ট অবস্থান এবং সম্পদ ভোগ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত।” 
উপরোক্ত আয়াতদ্বয় দ্বারা এটাই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বান্দাদেরকে সম্মান দান করেছেন এবং জমিনে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত অবস্থান করার জন্য সময় দিয়েছেন। আর এ সময়ে বান্দা কি আমল করবে সে প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক তিনি বলেন,
قل ان كنتم تحبون الله فا تبعونى يحببكم الله وغفرلكم ذنوبكم والله غفور الرحيم.
অর্থঃ- “(হে রাসূল) আপনি বলুন, যদি তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার মুহব্বত পেতে চাও বা মহব্বত কর, তাহলে তোমরা আমার অনুসরণ কর। তবেই মহান আল্লাহ্ পাক তিনি তোমাদের মহব্বত করবেন এবং তিনি তোমাদের গুণাহ্ খাতা ক্ষমা করবেন, আর মহান আল্লাহ্ পাক ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু।”  (সূরা আল ইমরান, আয়াত নং-৩১)
মহান আল্লাহ্ পাক তিনি আরো বলেন-
يا ايها الذين امنوا ادخلوا فى السلم كافة ولا تتبعوا خطوات الشيطان انه لكم عدو مبين.
অর্থঃ- “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাক্বারাহ্, আয়াত নং-২০৮) 
উপরোক্ত আয়াত শরীফদ্বয়ে মহান আল্লাহ পাক তিনি বান্দাদেরকে উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম অনুসরণ ও অনুকরণ করতে বলেছেন এবং ইসলামে পরিপূর্ণ দাখিল হতে বলেছেন। আরো বলেছেন, যেন শয়তানের কোনরূপ অনুসরণ না করা হয়। 
 আর হাদীছ শরীফে উল্লেখ রয়েছে- 
كل مولود يولدعلى الفطرة فابويه يهودانه اوينصر انه اوبمجسائه. (بخارى شريف)
অর্থঃ- “প্রত্যেক আদম সন্তান ফিত্রাতের উপরে অর্র্থাৎ ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা (আত্মীয়-স্বজন, সঙ্গী-সাথী ও প্রতিবেশী ইত্যাদি) তাকে ইহুদী-খৃষ্টান, অগ্নি-উপাসক (নাস্তিক, কাফির, মুরতাদ, চোর,-ডাকাত, যেনাকার, শরাবখোর ইত্যাদি) বানিয়ে দেয়। 
হাদীছ শরীফে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, “আল্লাহ্ পাক  প্রত্যেক বান্দাকে ঈমান ও ইসলামের উপরে জন্মদান করেন। তার পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ইত্যাদিগণ তার ঈমান, আমল-আখলাক, স্বভাব-চরিত্র নষ্ট করে থাকে।” 
অতএব উপরোক্ত আয়াত শরীফ এবং হাদীছ শরীফ দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ্ পাক তিনি উনার বান্দাকে মহান আল্লাহ্ পাক উনার মতে মত এবং উনার রাসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার পথে পথ হওয়ার জন্য আদেশ করেছেন এবং শয়তানের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বান্দা নফ্সের তাড়নায় এবং শয়তানের ওসওয়াসায় হারাম ও কুফরী কাজ (চুরি-ডাকাতি, যেনা-ব্যাভিচার, শরাব পান, কুফরী-শেরেকী ইত্যাদি) করে থাকে। কাজেই কেউ যদি বলে মহান আল্লাহ্ পাক উনার হুকুমে বান্দা হারাম ও কুফুরী-শেরেকী কাজ করে, তাহলে সে কাট্টা কাফিরের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে।
আবা-২৮

0 Comments: