৪৪০ নং- সুওয়াল -আখিরী যুহর কি? কখন এটি পড়তে হয়? ইসলামের প্রথম তিন যামানায় এর অস্তিত্ব ছিল কি?

সুওয়াল - মাসিক মুঈনুল ইসলাম অক্টোবর/৯৫ইং সংখ্যায় নিম্নোক্ত জিজ্ঞাসার সমাধান ছাপানো হয়-
জিজ্ঞাসাঃ- আখিরী যুহর কি? কখন এটি পড়তে হয়? ইসলামের প্রথম তিন যামানায় এর অস্তিত্ব ছিল কি?
সমাধানঃ- ইসলামে আখিরী যুহর বলতে স্বতন্ত্র কোন ইবাদত নেই। তবে কোন স্থানে জুমা শুদ্ধ হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে কারো সন্দেহের উদ্রেক হলে, উদাহরণ স্বরূপ এমন স্থান যা শহর বা শহরতলী নয় কিংবা এত বড় গ্রাম নয়, যেখানে বিচারক, চেয়ারম্যান, মেম্বার প্রভৃতি রয়েছেন অর্থাৎ অজপাড়া গাঁ, সেখানে কেউ জুমা পড়ে সন্দেহে পতিত হলে ফিক্বাহ্ শাস্ত্রবিদগণ তাকে যুহরের নামাযও পড়ে নিতে বলেছেন। এ ধরণের অবস্থায় উলামায়ে কিরামের সাথে যোগাযোগ করে সন্দেহ মুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভর করে জুমুয়ার পরে যুহরের নামায পড়া জায়েয নেই। কেননা এতে জুমা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে, যা নিতান্তই অগ্রহনীয়। সোনালী তিন যামানায় জুমার পরে যুহরের নামায পড়ার রীতি ছিলনা। (হালবী কবীর-৫৫২ পৃঃ, আহসানুল ফাতওয়া ৩/৪৮৬, মাজমুয়ায়ে ফতওয়া, কিতাবুস্ সালাত-২০৩ পৃঃ)
মুঈনুল ইসলাম পত্রিকায় প্রদত্ত আখিরী যোহর সম্পর্কিত এই সমাধান যথার্থ কিনা? নির্ভরযোগ্য দলীলসহ জানায়ে উপকৃত করবেন।


জাওয়াব - আখিরী যোহর বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহর সম্পর্কে “মুঈনুল ইসলামের” বক্তব্য শুধু অশুদ্ধই নয়, বরং মনগড়া, বানোয়াট, বিভ্রান্তিকর ও দলীলবিহীন। যা অনুসরণীয় ইমাম, মুজতাহিদ, ফক্বীহ্গণের এবং সর্বজনমান্য ও স্বীকৃত, বিশ্ববিখ্যাত ফিক্বাহ ও ফতওয়ার কিতাবসমূহের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিরুদ্ধ মত। নিম্নে মুঈনুল ইসলামের আপত্তিকর ও বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্যগুলোকে পর্যায়ক্রমে খন্ডন করা হলো-
প্রথমতঃ- উক্ত পত্রিকায় প্রথমেই বলা হয়েছে যে, “ইসলামে আখিরী যুহর বলতে স্বতন্ত্র কোন ইবাদত নেই।” 
এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, ‘মুঈনুল ইসলামের’ উক্ত বক্তব্য সম্পূর্ণই অশুদ্ধ ও জিহালতপূর্ণ। কারণ আমরা ইসলাম বলতে মূলতঃ কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াসকেই বুঝে থাকি। অর্থাৎ কোন বিষয় ইসলাম বা শরীয়তসম্মত হওয়ার মাপকাঠি হলো- উপরোক্ত চারটি বিষয়। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আখিরী যোহর বা এহ্তিয়াতুয্ যোহর অবশ্যই ইসলামের অর্ন্তভূক্ত। কেননা, যদিও কুরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফে সরাসরি আখিরী যোহরের কথা উল্লেখ নেই, কিন্তু ইজমা ও ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহের অধ্যায়ে তা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যেমন ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব “মারাক্বিউল ফালাহ্তে” উল্লেখ আছে যে,
قوله بصلاة اربع بنية اخر ظهر عليه هو الاحسن. (صفه ৩২৬)
অর্থঃ- মুছান্নেফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আখিরী যোহরের নিয়তে চার রাকায়াত নামায পড়ে নেয়া সর্বোত্তম। (পৃষ্ঠা-৩২৬)
আর মুঈনুল ইসলামের উপরোক্ত বক্তব্যের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইজমা-ক্বিয়াস ইসলামের অন্তর্ভূক্ত নয়। অর্থাৎ “আখিরী যুহর নামে স্বতন্ত্র কোন ইবাদত ইসলামে নেই।” একথা বলার অর্থই হলো- ইজমা-ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহ্ শাস্ত্রকে অস্বীকার করা। যেটা বিদ্য়াত ও গোমরাহীর লক্ষণ।
অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আখিরী যোহর ইসলাম বা শরীয়তসম্মত ইবাদত।
দ্বিতীয়তঃ- উক্ত পত্রিকায় বলা হয়েছে, “তবে ......... এমন স্থান যা শহর কিংবা শহরতলী নয় কিংবা এতবড় গ্রাম নয়, যেখানে বিচারক, চেয়ারম্যান, মেম্বার প্রভৃতি রয়েছেন অর্থাৎ অজপাড়া গাঁ, সেখানে কেউ জুমা পড়ে সন্দেহে পতিত হলে ফিক্বাহ্ শাস্ত্রবিদগণ তাকে যুহরের নামাযও পড়ে নিতে বলেছেন।”
এর জবাবে বলতে হয় যে, “মুঈনুল ইসলামের” উপরোক্ত বক্তব্যখানি সরাসরি ফিক্বাহ্ শাস্ত্রবিদগণের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়ার শামিল। কারণ যে স্থান শহর বা শহরতলী নয়, সেস্থানে তো জুমুয়া পড়াই জায়েয না। আর কোন ফিক্বাহ্ শাস্ত্রবিদই উক্ত স্থানে জুমুয়া জায়েয বলেননি। কাজেই যেখানে জুমুয়াই জায়েয না, সেখানে আখিরী যোহর পড়তে বলার স্বার্থকতা কোথায়?
তাছাড়া আখিরী যোহরের নির্দেশ শুধুমাত্র কোন স্থান শহর হওয়া বা না হওয়ার সন্দেহের কারণে দেওয়া হয়নি। বরং ইমাম-মুজতাহিদগণ মূলত আখিরী যোহর বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহর পড়ার আদেশ এ কারণেই দিয়েছেন যে, যেহেতু ইমাম আ’যম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে ইমাম আবূ ইউসুফ রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন যে, এক শহরে একের অধিক জায়গায় জুমুয়ার নামায পড়া জায়েয নেই। তবে শহর যদি বড় হয় এবং শহরের মধ্যখান দিয়ে যদি নদী-নালা প্রবাহিত হয়ে থাকে, তাহলে এক শহরে একের অধিক স্থানে জুমুয়া পড়া জায়েয। আর ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, এক শহরে একের অধিক স্থানে জুমুয়া বিনা শর্তে জায়েয এবং এটার উপরই ফতওয়া।
উপরোক্ত ইখতিলাফ বা মতভেদের কারণে পরবর্তী ইমাম-মুজতাহিদ বা ফক্বীহ্গণ ইজতিহাদ করতঃ ফতওয়া দেন যে, ইহ্তিয়াত বা সাবধানতার জন্যে জুমুয়ার নামায আদায় করার পর চার রাকায়াত ইহ্তিয়াতুয্ যোহর বা আখিরী যোহরের নিয়তে পড়া উত্তম। যেমন বিশ্ববিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য কিতাব “শরহে বেকায়াতে” উল্লেখ আছে যে,

ঊদূ লেখা ঢুকবে.....................................................................................

অর্থঃ- জুমুয়ার নামাযের পর চার রাকায়াত (আখিরী) যোহর পড়তে হবে কিনা? ফতওয়ায়ে শামী কিতাবে পড়াকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ঘরের ভিতর চুপে চুপে পড়ে নিবে। আর ওস্তাদ রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, জুমুয়ার পর বিনা জামায়াতে চার রাকায়াত (এহ্তিয়াতুয্ যোহর) পড়া মোস্তাহ্সান (উত্তম)। ১ম জিঃ পৃষ্ঠা-১৭২ উর্দূ শরাহ্)
 ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব “রদ্দুল মোহ্তারে” উল্লেখ আছে যে,
كل موضح وقع الشك فى كونه مضرا او تعدوت الجمعة ينبغى لهم ان يصلوا بعد الجمعة اربعابنية الظهر احتياطا. (ج২ صفه ১৪৫)
অর্থঃ- যে স্থান শহর হওয়ার ব্যাপারে অথবা এক শহরে একের অধিক স্থানে জুমুয়া জায়েয হওয়া না হওয়ার মতবিরোধের কারণে সন্দেহ দেখা দেয়, সেস্থানে জুমুয়ার নামাযের পর আখিরী যোহরের নিয়তে ইহ্তিয়াত বা সাবধানতার জন্যে চার রাকায়াত নামায পড়ে নেয়া উচিত।
উক্ত কিতাবে আরো বলা হয়েছে যে,
لما تبتلى اهل مرو با قامة الجمعتين فيها مع اختلاف العلماء فى جوازهما امر ائمة هم بالاربعة بعد ها احتياطا- لايمنع الشريعة الاحتياط للتقوى.
অর্থঃ- যখন ইমামগণ একের অধিক স্থানে জুমুয়া জায়েয হবার ব্যাপারে আলেমগণের মতবিরোধ জানতে পারলেন, তখন ইমামগণ জুমুয়ার নামাযের পর চার রাকায়াত ইহ্তিয়াতুয্ যোহর পড়ার হুকুম দেন। কেননা শরীয়তে তাকওয়ার জন্যে সাবধানতা অবলম্বন করতে নিষেধ করা হয়নি। (২য় জিঃ পৃষ্ঠা-১৪৫)
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইব্নে আবেদীন রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ‘ফতওয়ায়ে শামী’ কিতাবে বলেন,
قلت على انه لو سلم ضعفه فالحزوج عن حلافه اولى فكيف مع خلاف هئلاء الائمة وفى الحديث متفق عليه فمن اتقى الشبهة استبرأ لدينه وعرضه- ولذا قال بعضهم فيما يقضى صلاه عمره مع انه لم يفته منها شئ لا يكره لانه اخذ با لا حتياط.
অর্থঃ- আমি বলি, এক স্থানে একাধিক মসজিদে জুমুয়া নাজায়েয হওয়ার দলীল জঈফ হলেও যেহেতু এটাতে ইমামগণ মতভেদ করেছেন, সেহেতু চার রাকায়াত এহ্তিয়াতুয্ যোহর পড়ে নেওয়াই উত্তম। 
বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ শরীফ-এর হাদীছ শরীফ-এ উল্লেখ আছে যে, যে ব্যক্তি সন্দেহ হতে বাঁচল, সে তার দ্বীন ও সম্মান রক্ষা করলো। এর উপর ভিত্তি করে কোন কোন ফক্বীহ্ ফতওয়া দেন যে, যে ব্যক্তির নামায কাযা হয়নি, এমন ব্যক্তিও যদি উমরী কাযা আদায় করে, তবে মাকরূহ্ হবেনা। কেননা সে ওটা এহ্তিয়াত বা সাবধানতার জন্যে পড়েছে।
উপরোক্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্ব বিখ্যাত কিতাবসমূহের বরাত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইহ্তিয়াত বা সাবধানতার জন্যে জুমুয়ার নামাযের পর চার রাকায়াত আখিরী যোহর পড়ে নেওয়া জায়েয ও মোস্তাহ্সান (উত্তম)। এটাকে নাজায়েয বলা গোমরাহীর নামান্তর।
তৃতীয়তঃ- উক্ত পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, “সোনালী তিন যামানায় জুমুয়ার পরে যুহরের নামায পড়ার রীতি ছিলনা।”
এর জবাব হলো- মূলতঃ কোন বিষয় সোনালী তিন যুগে পাওয়া না গেলেই যে তা নাজায়েয, এরূপ কোন দলীল কেউ পেশ করতে পারবে কি? যদি কোন বিষয় জায়েয হওয়ার জন্যে সোনালী তিন যুগকে শর্ত করা হয়, তবে খতমে বুখারীর মাহ্ফিল, বার্ষিক ফুযালা সম্মেলন ইত্যাদি জায়েয হয় কি করে? সেগুলো কি উক্ত তিন যামানায় ছিল?
মোট কথা হলো- কোন বিষয় জায়েয হওয়া না হওয়ার মাপকাঠি হলো- কুরআন শরীফ, হাদীছ শরীফ, ইজমা ও ক্বিয়াস, এখন তা যে যুগেই উৎপত্তি লাভ করুক না কেন।
কেননা সোনালী তিন যুগেই ৭২টি বাতিল ফেরকা (যেমন- রাফেজী, খারেজী, শিয়া ইত্যাদি) উৎপত্তি লাভ করেছে, তবে কি তারা অনুসরণীয়? কখনোই নয়, বরং সোনালী তিন যুগে উৎপত্তি লাভ করা সত্বেও তারা বাতিল ও গোমরাহ্।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হলো যে, আখিরী যোহর সম্পর্কে “মাসিক মুঈনুল ইসলামের” বক্তব্য সম্পূর্ণই ভুল, আপত্তিকর ও জিহালতপূর্ণ। কারণ অসংখ্য দলীলের দ্বারা প্রমাণিত যে, আখিরী যোহর বা এহ্তিয়াতুয্ যোহর পড়া জায়েয ও মোস্তাহ্সান।
উপরোক্ত দলীল ছাড়াও নিম্নোক্ত কিতাবে আখিরী যোহর পড়া জায়েয বলা হয়েছে-
ফতওয়ায়ে আলমগীরী, বাহ্রুর রায়েক, মুহীত্ব, ফতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, কাফী, দুররুল মোখতার, আইনী, ক্বিনইয়া, গায়াতুল আওতার, কবীরী, ছগীরী, কিতাবুল ফিক্বাহ্ আলা মাযাহিবিল আরবা, শরহুন নেক্বায়া, ফতহুল ক্বাদীর, ফতওয়ায়ে আযীযী, বাহারে শরীয়ত, ইলমুল ফিক্বাহ্, রুকনুদ্দীন, ফতওয়ায়ে আমিনিয়া ইত্যাদি।
এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার ১০তম সংখ্যা পাঠ করুন। যেখানে অসংখ্য দলীল দ্বারা আখিরী যোহর পড়া জায়েয প্রমাণ করা হয়েছে।
আবা-২৮


শরীয়তের দৃষ্টিতে আখিরী যোহর বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহরের আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া-   


0 Comments: