গবেষণা কেন্দ্র
মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ
[সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ রব্বুল আলামীনের জন্যে এবং অসংখ্য দরূদ ও সালাম আল্লাহ্
পাক-এর হাবীব, আখিরী রসূল, হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি। মহান আল্লাহ্ পাক-এর অশেষ
রহ্মতে আমাদের গবেষণা কেন্দ্র, “মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ”-এর ফতওয়া বিভাগের তরফ থেকে, বহুল
প্রচারিত, হক্বের অতন্দ্র প্রহরী,
বাতিলের আতঙ্ক ও আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায়
বিশ্বাসী একমাত্র দলীল ভিত্তিক মুখপত্র “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায়
যথাক্রমে টুপির ফতওয়া,
অঙ্গুলী চুম্বনের বিধান, নিয়ত করে মাজার শরীফ যিয়ারত করা, ছবি ও
তার সংশ্লিষ্ট বিষয় হারাম হওয়ার ফতওয়া, জুমুয়ার নামায ফরযে আইন ও তার
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফতওয়া,
মহিলাদের মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামায পড়া মাকরূহ্ তাহ্রীমী
সম্পর্কে ফতওয়া, কদমবুছী ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তাহাজ্জুদ নামায জামায়াতে পড়া
মাকরূহ্ তাহ্রীমী ও বিদ্য়াতে সাইয়্যিয়াহ্ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ফরয
নামাযের পর মুনাজাত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, ইন্জেকশন
নেয়া রোযা ভঙ্গের কারণ ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্-এর
নামাযে বা অন্যান্য সময় কুরআন শরীফ খতম করে উজরত বা পারিশ্রমিক গ্রহণ করা জায়েয ও
তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, তারাবীহ্ নামায বিশ রাকায়াত ও তার
সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, দাড়ী ও গোঁফের শরয়ী আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে
ফতওয়া, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াত ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, আযান ও
ছানী আযান মসজিদের ভিতরে দেয়ার আহ্কাম এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, দোয়াল্লীন-যোয়াল্লীন-এর
শরয়ী ফায়সালা এবং তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া, খাছ
সুন্নতী টুপি ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং নূরে মুহম্মদী ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া এবং “ইমামাহ্
বা পাগড়ী মুবারকের আহ্কাম ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত ফতওয়া পেশ করার পর ২০তম
ফতওয়া হিসেবে “শরীয়তের দৃষ্টিতে আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্রের আহ্কাম এবং তার
সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া” পেশ করতে পারায় মহান আল্লাহ্ পাক-এর দরবারে অসংখ্য
শুকরিয়া।]
শরীয়তের দৃষ্টিতে আখিরী
যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ফতওয়া দেয়ার কারণ
সুন্নতের মূর্ত প্রতীক,
হক্বের অতন্দ্র প্রহরী, সারা জাহান থেকে কুফরী, শেরেকী ও
বিদ্য়াতের মূলোৎপাটনকারী,
বাতিলের আতঙ্ক এবং আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদায়
বিশ্বাসী একমাত্র দলীলভিত্তিক মুখপত্র- “মাসিক আল বাইয়্যিনাত” পত্রিকায়
যত লিখা বা ফতওয়াই প্রকাশ বা পত্রস্থ হয়েছে তার প্রতিটিরই উদ্দেশ্য বা মাকছুদ এক ও
অভিন্ন। অর্থাৎ “মাসিক আল বাইয়্যিনাতে”
এমন সব লিখাই পত্রস্থ করা হয়, যা মানুষের আক্বীদা ও আমলসমূহ
পরিশুদ্ধ করণে বিশেষ সহায়ক।
তদ্রুপ “মাসিক আল বাইয়্যিনাতে”
“আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়
সম্পর্কে ফতওয়া” দেয়ার উদ্দ্যেশ্য বা মাকছুদও ঠিক তাই। কেননা অনেকেই “আখিরী
যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্রের” আহকাম সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। উপরক্ত কিছু বিদ্য়াতী ও ওহাবী
মৌলভী “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” সম্পর্কে নানাবিধ বিভ্রান্তি
ছড়িয়ে থাকে। যার ফলে অনেকেই “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” সম্পর্কে
সঠিক আক্বীদা পোষণ করতে যেরূপ ব্যর্থ হয়; তদ্রুপ ব্যর্থ হয় তা আমলে
বাস্তবায়ন করতে।
যেমন, বিদয়াতী, ওহাবীরা বলে থাকে যে,
আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র বলতে শরীয়তে কোন নামায
নেই। “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” পড়া বিদয়াতে সাইয়্যিয়াহ্।” (নাউযুবিল্লাহ্
িমিন যালিক।)
মূলতঃ বিদয়াতীদের উক্ত বক্তব্য শুধু মিথ্যাই নয় বরং “আক্বীদা
ও আমল” বরবাদ হওয়ারও কারণ। কেননা যেটা শরীয়তে রয়েছে সেটাকে নাই বলা শরীয়তকেই অস্বীকার
করার নামান্তর। আর শরীয়তকে অস্বীকার করা হচ্ছে সুস্পষ্ট কুফরী। অনুরূপ জায়েয, মুস্তাহাব, মুস্তাহ্সান
তথা শরীয়ত সম্মত আমলকে বিনা দলীলে বিদয়াত বলা শুধু গোমরাহীই নয় বরং অসংখ্য লোককে
একটি মুস্তাহাব তথা ছাওয়াবের কাজ থেকে বিরত রাখার নামান্তর।
অতএব, বলার অপেক্ষাই রাখেনা যে, বিদয়াতী, ওহাবীদের উক্ত বক্তব্যের কারণে সাধারণ মুসলমানদের যেরূপ ‘আক্বীদা
বিভ্রান্ত হচ্ছে,
তদ্রুপ একটি নেক আমল থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। অথচ আক্বীদা
ও আমলই হচ্ছে মহান আল্লাহ্ পাক-এর সন্তুষ্টি লাভের একমাত্র মাধ্যম। তাই মহান
আল্লাহ্ পাক পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
والعصر ان الانسان لفى خسر الا الذين امنوا وعملوا الصلحت.
অর্থঃ- “আছরের
সময়ের কছম! সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্থের মধ্যে, একমাত্র তারা ছাড়া, যারা
ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে।” (সূরা আছর/১-৩)
উপরোক্ত আয়াত শরীফে আল্লাহ্ পাক মানব জাতির ধ্বংস হতে নাযাত পাওয়ার প্রথম উপায়
হিসেবে ঈমান (আক্বীদা)কে আখ্যায়িত করেছেন। অতঃপর আমলের প্রশ্ন। কারণ, ঈমানহীন
ব্যক্তির নেক আমলের কোন মূল্যই আল্লাহ্ পাক-এর নিকট নেই। কাজেই বান্দার জন্যে
প্রধানতম ফরয এই যে,
সে সর্বপ্রথম তার ঈমান বা আক্বীদাকে বিশুদ্ধ করবে অর্থাৎ
ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে,
আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ন্যায় আক্বীদা পোষণ করবে।
কেননা, আক্বীদাগত কারণেই ইসলামে ৭২টি বাতিল ফিরক্বার আবির্ভাব হয়েছে। যদিও তাদের
কথাবার্তা, চাল-চলন, ছূরত-ছীরত ইত্যাদি বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমানের ন্যায় বা
ইসলামসম্মত, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তারা ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ইসলাম তথা কুরআন শরীফ, হাদীস
শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াস অর্থাৎ আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার সম্পূর্ণ বিপরীত
আক্বীদা পোষণ করে থাকে,
যা সুস্পষ্ট কুফরী।
যেমন- ক্বদরিয়া সম্প্রদায়- তারা তক্বদীরকে অবিশ্বাস করে, অথচ
তক্বদীরের উপর ঈমান আনা ফরয।
খারিজী সম্প্রদায়- তাদের আক্বীদা হলো- হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমগণ কাফির।”(নাউযুবিল্লাহ্),
অথচ হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের প্রতি সুধারণা পোষণ
করা ঈমানের অঙ্গ বা ফরয।
রাফিজী বা শিয়া সম্প্রদায়- তাদের আক্বীদা মতে শিয়াদের ইমামদের মর্যাদা
নবী-রসূল আলাইহিমুস্ সালামগণের চেয়েও বেশী, বর্তমান কুরআন শরীফ পরিবর্তীত, হযরত আলী
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ব্যতীত খুলাফা-ই-রাশিদীনের সকলেই মুরতাদ।
(নাউযুবিল্লাহ)
মুশাব্বিহা বা মুনাব্বিরা সম্প্রদায়- তাদের আক্বীদা হলো, মহান
আল্লাহ্ পাক “নূর বা আলো” মহান আল্লাহ্ পাক-এর দেহ বা আকার-আকৃতি রয়েছে।
অথচ মহান আল্লাহ্ পাক উল্লিখিত সকল বিষয় থেকেই সম্পূর্ণ বেনিয়াজ ও পবিত্র।
অনুরূপ বর্তমান যামানার ভয়ঙ্কর ফিৎনা- কাদিয়ানী সম্প্রদায়। তাদের আক্বীদা হলো-
সাইয়্যিদুল মুরসালীন,
ইমামুল মুরসালীন, হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম শেষ নবী নন,
তাঁর পর আরো নবী পৃথিবীতে আসবে, তাই তারা
গোলাম কাদিয়ানীকে নবী বলে বিশ্বাস করে, যা কাট্টা কুফরী।
অথচ তারা প্রত্যেকেই বাহ্যিক দৃষ্টিতে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের
কথা বলে, টুপি, কোর্তা, পাগড়ী পরিধান করে। এতকিছুর পরও তারা আহ্লে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া
মুতাবিক কাফির বা অমুসলিম। কারণ তাদের উপরোক্ত আক্বীদাসমূহ সম্পূর্ণই কুফরী।
আর এদের প্রসঙ্গেই হাদীস
শরীফে ইরশাদ হয়েছে যে,
ستفترق امتى على ثلاث وسبعين فرقة كلهم فى النار الا ملة واحد قيل من هى يارسول الله صلى الله عليه وسلم قال ما انا عليه واصحابى.
অর্থঃ- “অতি
শীঘ্রই আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, একটি দল ব্যতীত সকল দল জাহান্নামে
যাবে। জিজ্ঞাসা করা হলো- যে দলটি (নাযাত পাবে) সেটা কোন দল ইয়া রসূলাল্লাহ্
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন, হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে (মত-পথের) উপর আমিও আমার
ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ রয়েছি, তার উপর যারা থাকবে, তারাই
সেই নাযাত প্রাপ্ত দল।”
(আহ্মদ, আবু দাউদ, মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তা’লীকুছ
ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ইসলামের যে কোন আমলই করা হোক না কেন এবং যে কেউই করুক
না কেন, তা যদি আক্বীদা শুদ্ধ রেখে শরীয়ত সম্মতভাবে করা হয়, তবে তা
গ্রহণযোগ্য। আর যদি আক্বীদার মধ্যে কোন ত্রুটি থাকে, তবে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেমন-
খারিজী, রাফিজী, কাদিয়ানী ইত্যাদি সম্প্রদায় পরিত্যাজ্য ও বাতিল।
সুতরাং সাধারণ মুসলমানগণ যেন “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” সম্পর্কে
সঠিক আক্বীদা রাখতে পারে এবং উক্ত আমলকে জায়েয বা মুস্তাহাব মনে করে আমলে
বাস্তবায়ন করে মহান আল্লাহ্ পাক ও তাঁর হাবীব নূরে মুজাস্সাম, রহমতুল্লিল
আলামীন হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খাছ রেজামন্দী হাছিল করতে
পারে, সাথে সাথে যারা “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে রয়েছে তারা
যেন বিভ্রান্তি থেকে হিদায়েতের উপর আসতে পারে, “মাসিক আল বাইয়্যিনাতে” “আখিরী
যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” সম্পর্কে বিস্তারিত ফতওয়া” দেয়ার এটাই মূলতঃ প্রধান কারণ।
আখিরী যোহ্র বা
ইহ্তিয়াত্য্ ুযোহ্র
নামায কাকে বলে এবং তা
পড়তে হয় কেন?
জুমুয়ার দিন জুমুয়ার নামাযের ফরয আদায়ের পর চার রাকায়াত ক্বাবলাল জুমুয়া ও দুই
রাকায়াত সুন্নাতুল ওয়াক্ত আদায় করার পর যোহ্রের নিয়তে চার রাকায়াত নামায আদায়
করাকে শরীয়তে “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” বলে।
ইমাম-মুজতাহিদগণ প্রধানতঃ দুটি কারণেই জুমুয়ার দিন জুমুয়ার নামায আদায় করার পর
চার রাকায়াত “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রথম কারণ
মিছর বা শহরের ব্যাখ্যায় ইমাম-মুজতাহিদগণের মধ্যে ইখতিলাফ বা মতভেদ হওয়ায়।
অর্থাৎ জুমুয়ার নামায কারো উপর ফরয হওয়ার জন্যে যেরূপ কিছু শর্ত রয়েছে তদ্রুপ
ছহীহ্ হওয়ার জন্যেও কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-
(ক)
জুমুয়া ফরয হওয়ার শর্তসমূহ
(১) مرد هونا পুরুষ হওয়া। সুতরাং মেয়ে লোকের উপর জুমুয়া ফরয নয়। এবং মেয়েলোকের
নামাযের জামায়াতে শরীক হওয়াই মাকরূহ্ তাহ্রীমী। (গায়াতুল আওতার, আইনী
ইত্যাদি)
(২) ازاد هونا আযাদ বা স্বাধীন হওয়া, কারণ ক্রীতদাস বা গোলামের উপর
জুমুয়া ফরয নয়। তবে মনীব বা মালিকের অনুমতিক্রমে আদায় করে নিলে আদায় হয়ে যাবে।
(৩) مقيم هونا মুকীম,
অর্থাৎ মুসাফির না হওয়া, কেননা মুসাফিরের উপর জুমুয়া ফরয
নয়। মুসাফির ঐ ব্যক্তিকে বলে যে ৪৮ মাইল দূরে যাবার নিয়ত করে সফর করে।
যদিও মুসাফিরের উপর জুমুয়া ফরয নয়, তবে সে যদি জুমুয়ার নামায আদায়
করে নেয় তবে আদায় হয়ে যাবে। এবং তার ইমামতি করাও জায়েয হবে।
(৪) بالغ هونا বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া, কারণ নাবালেগ বা অপ্রাপ্ত
বয়স্কদের উপর জুমুয়ার নামায ফরয নয়।
(৫) تندرست هونا সুস্থ হওয়া, অর্থাৎ এতটুকু অসুস্থ না থাকা যে, নামাযে
আসতেই অক্ষম। যেমন ল্যাংড়া,
অন্ধ অথবা খুব অসুস্থ বা বৃদ্ধ ইত্যাদি। তবে যদি ল্যাংড়া ও
অন্ধকে মসজিদে পৌঁছানোর জন্য কোন লোক থাকে আর সে জুমুয়া আদায় করে নেয় তবে তার
জুমুয়া আদায় হয়ে যাবে।
(৬) উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
জামায়াত ত্যাগ করার ওজরসমূহ না থাকা। যেমন- ঝড়, তুফান, মুষলধারে
বৃষ্টি, চোর-ডাকাতের ভয়,
রাস্তা নিরাপদ না থাকা এবং এমন রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকা, যাকে
সেবা করার মত অন্য লোক উপস্থিত নেই এবং সে জুমুয়ায় চলে আসলে রোগীর মৃত্যুর আশংকা
আছে ইত্যাদি। তবে তারা যদি জুমুয়া আদায় করে নেয়, জুমুয়া আদায় হয়ে যাবে।।
(খ)
জুমুয়া ছহীহ্ হওয়ার
শর্তসমূহ
(১) امام رهنا ইমাম বা খতীব থাকা, অন্যান্য নামাযের জন্য যে উপযুক্ত
জুমুয়ার নামাযের ইমামতির জন্যও সে উপযুক্ত হবে। সুতরাং মুসাফির, রোগী ও
গোলামের ইমামতিও জায়েয।
(২) جماعت هونا জামায়াত হওয়া, আমাদের হানাফী মাযহাব মতে ইমাম ব্যতীত তিনজন মোক্তাদী হওয়া
জামায়াতের জন্য শর্ত। এবং খুৎবার শুরু থেকে প্রথম রাকায়াতের সিজদা পর্যন্ত তিনজন
মুক্তাদী উপস্থিত থাকতে হবে। অবশ্য সিজদা করার পর মুক্তাদী চলে গেলে জুমুয়া ছহীহ
হবে।
(৩) ظهر وقت هونا যোহ্র নামাযের সময় হওয়া, যোহ্র ওয়াক্ত শুরু হবার পূর্বে ও
শেষ হবার পরে জুমুয়ার নামায আদায় করলে জুমুয়া ছহীহ বা দুরস্ত হবেনা। অর্থাৎ যোহর
ওয়াক্তের মধ্যেই জুমুয়া পড়তে হবে।
(৪) خطبه هونا খুৎবা হওয়া, অর্থাৎ জুমুয়ার ফরয নামাযের পূর্বে খতীব মুসল্লীদের দিকে
মুখ করে দাড়িয়ে আরবীতে কমপক্ষে এক তাসবীহ্ পরিমাণ পাঠ করবে। খুৎবা কমপক্ষে এক
তাসবীহ্ পরিমাণ পাঠ করা ওয়াজিব। নামাযের পরে খুৎবা পড়লে জুমুয়ার নামায ছহীহ হবেনা।
খুৎবা যোহর ওয়াক্তের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়। যোহ্র ওয়াক্তের পূর্বে বা পরে খুৎবা পাঠ
করলে জুমুয়া ছহীহ হবেনা।
(৫) اذن عام رهنا জনসাধারণের প্রবেশাধিকার থাকা, অর্থাৎ যে স্থানে জুমুয়ার নামায
পড়া হবে, সে স্থানে সকলের প্রবেশাধিকার থাকা চাই।
(৬) شهر هونا অর্থাৎ শহর হওয়া, শহর বা মিছরের তারীফ বা ব্যাখ্যা ইমাম-মুজতাহিদগণ ইজতিহাদ
করে দিয়েছেন।
“বুখারী শরীফের”
বিখ্যাত ব্যাখ্যা গ্রন্থ “আইনী” এবং
হানাফী ফিক্বাহের মশহুর কিতাব “জামিউর রুমুয”সহ আরো অনেক কিতাবেই মিছর বা
শহরের বিভিন্ন প্রকার ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে শুধু মাত্র তিনটি মত বা
ব্যাখ্যার উপরই ফতওয়া দেয়া হয়েছে। তাহলো-
১. ইমাম আ’যম আবূ
হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, যে স্থানে অনেক গুলো বাজার, গলি ও পল্লী রয়েছে, একজন
বিচারক (কাজী) রয়েছেন,
যিনি অধিবাসীদের খোঁজ-খবর নেন। এবং একজন আলিম বা মুফতী
রয়েছেন, যিনি শরীয়তের দৃষ্টিতে ফতওয়া প্রদান করেন। সে স্থানকেই মিছর বা শহর বলে।
২. ইমাম আবূ ইউসূফ
রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর একটি মত হলো-
كل موضع له امير وقاضا ينفذ الاحكام ويقيم الحدود فهو مصر جامع.
অর্থাৎ- “যে
স্থানে একজন আমীর ও একজন ক্বাজী বা বিচারক রয়েছেন, যাদের হুকুমে সেখানে হদ-কেছাছ বা
শরয়ী আইন জারী হয় সে স্থানকেই মিছর বা শহর বলে।”
৩. ইমাম আবূ ইউসূফ
রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর আরেকটি মত হলো-
لو اجتمعوا اكبر مساجدهم لم يسعهم ذالك فهو مصرجامع.
অর্থাৎ- “যে
স্থানের সমস্ত লোক তাদের স্থানীয় বড় মসজিদে একত্রিত হলে স্থান সঙ্কুলান হয়না সে
স্থানকেই মিছর বা শহর বলে।”
উল্লেখ্য, “ফতওয়ায়ে শামী, কুনিয়া, কান্জের
টিকা আইনীতে” উল্লেখ আছে যে,
“প্রথম মতটি অর্থাৎ ইমাম আ’যম রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর মতটিই
অধিক ছহীহ্।”
আর “ফতওয়ায়ে
আলমগীরী, জহিরিয়াহ ও ক্বাজীখানে”
ইমাম আবূ ইউসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর প্রথম মতটিকে “জাহেরে
রেওয়ায়েত” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। “খুলাছা ও তাতার খানিয়ায়” এ মতকে বিশ্বাসযোগ্য বলা হয়েছে।
আর ‘মুজমিরাত’ কিতাবে এ মতটিকে অধিক ছহীহ্ বলা হয়েছে।
আর ইমাম আবূ ইউসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর দ্বিতীয় মত অর্থাৎ শহরের তৃতীয়
ব্যাখ্যাটি অধিকাংশ আলিম ফতওয়া গ্রাহ্য বলে উল্লেখ করেছেন, যা
ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব “দুররুল মুখতারে”
‘মুজতবা’ হতে বর্ণনা করা হয়েছে। “ফতওয়ায়ে শামীতে ”আছে এটা
সর্বাপেক্ষা উত্তম মত। “আল ওয়ালেজিয়া,
বাহরুর রায়েকে” এমতকে ছহীহ্ বলে উল্লেখ করা
হয়েছে। “বিক্বায়া, শরহে বিক্বায়া,
দুরার ও মুখতার” কিতাবে এ মতটিকে মনোনীত বলে
উল্লেখ করা হয়েছে,
‘আরকানে আরবায়া’ নামক কিতাবে এমতকে ফতওয়াগ্রাহ্য
বলা হয়েছে।
মিছর বা শহরের ব্যাখ্যায় ইমামগণের উল্লিখিত ইখতিলাফ বা মতভেদের কারণেই পরবর্তী
ইমামগণ জুমুয়ার পর “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোর্হ” পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
দ্বিতীয় কারণ
ইমাম আবূ ই্উসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর
মধ্যে “এক শহরে একাধিক মসজিদে জুমুয়া জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ইখতিলাফ বা মতভেদ হওয়ায়।” অর্থাৎ
হযরত ইমাম আবূ ইউসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ফতওয়া হলো-
لايجوز فى مسجدين فى مصر الا ان يكون بينهما نهر كبير وايضا ........ يجوز فى موضعين اذا كان مصرا عظيما لا فى ثلاثة.
অর্থাৎ- “এক শহরে
দুই মসজিদে জুমুয়া জায়েয হবেনা, যদি দুই মসজিদের মাঝখানে বড় নদী না থাকে। তিনি আরো বলেন, .....”শহর যদি
অত্যাধিক বড় হয় তবে সেখানে দুই মসজিদে জুমুয়া জায়েয হবে, তবে
ততোধিক মসজিদ হলে জুমুয়া জায়েয হবেনা।”
আর হযরত ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ফতওয়া হলো-
يجوز تعددها مطلعا ورواه عن ابى حنيفة ولهذا قال السرخسى الصحيح فى مذهب ابى حنيفة جواز اقامتها فى مصر واحد فى مسجدين فاكثروا به نأخذ.
অর্থাৎ- “বিনা
শর্তে এক শহরে একাধিক স্থানে জুমুয়া জায়েয। এটা ইমামে আ’যম আবূ
হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন। এজন্যে ইমাম সারাখসী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ইমাম আ’যম
রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর নিকট ছহীহ্ মত হলো- এক শহরে দুই বা ততোধিক মসজিদে জুমুয়া
পড়া জায়েয। তিনি বলেন,
আমরা এমতটিকেই গ্রহণ করেছি।”
আখিরী যোহ্র বা
ইহ্তিয়াতুয্
যোহর আদায়ের কারণ
উল্লিখিত ইখতিলাফ বা মতভেদের কারণেই ইমামগণ ইজ্তিহাদ করতঃ জুমুয়ার নামাযের পর
চার রাকায়াত “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” আদায় করার ফতওয়া দেন।
মূলতঃ “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” সম্পর্কে ফিক্বাহের কিতাব সমূহে ইমামগণের
দুপ্রকার মত পরিলক্ষিত হয়। যথা- (১) ওয়াজিব, (২) মুস্তাহাব বা মুস্তাহ্সান।
যে স্থান শহর হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট সন্দেহ রয়েছে, সেখানে
জুমুয়া আদায় করা হলে,
জুমুয়ার পর চার রাকায়াত “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” পড়া
ওয়াজিব।
আর যে স্থান শহর হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই সেখানে (এক শহরে একাধিক মসজিদে
জুমুয়া জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ইখতিলাফ বা মতভেদ থাকার কারণে) ইহ্তিয়াত বা সাবধানতার
জন্য চার রাকায়াত “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” পড়া মুস্তাহাব বা মুস্তাহ্সান।
যেমন, এ
প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ আছে,
واكثرهم داموا على ادائها اولا علماء منهم بانها من اكبر شعئر الاسلام والتزموا بعدها اداء الظهر لكثرة الكوك فى شانها وغلبة الاوهام.
অর্থঃ- অধিকাংশ ফক্বীহ
আলিম জুমুয়ার নামাযকে শরীয়তের প্রধান অঙ্গ মনে করে সর্বদাই প্রথমে জুমুয়া আদায়
করেন, অতঃপর জুমুয়ার নামাযে একাধিক সন্দেহ বিরাজমান থাকায় জুমুয়ার পর ‘যোহ্র’ পড়াকে
লাযেম বা ওয়াজিব মনে করতেন। (তাফসীরে আহমদী/৭০৮ পৃষ্ঠা)
মাওলানা আব্দুল হাই লাখনবী
সাহেব “মজমুয়ায়ে ফতওয়া”
১ম খন্ডের ৩২২ পৃষ্ঠায় লিখেন,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থঃ- “.. শামী
প্রনেতা অনেক বাহাছ-মুবাহাছা ও তাহক্বীকের পর এটাই প্রমাণ করেন যে, জুমুয়া
জায়েয হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ হলে আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র পড়া ওয়াজিব।”
আর ফিক্বাহের বিখ্যাত
কিতাব “ছগীরী” কিতাবে উল্লেখ আছে,
لان الموضع وان كان مصرا بلاشبهة ولكن بقى الشبهة جواز التعدد وعدمه وان الصحيح والمتعمد جواز التعدد للضرورة للفتاوى لايمنع الشريعة الاحتياط للتقوى.
অর্থঃ- “ধরা যাক, কোন
স্থান নিঃসন্দেহে শরয়ী শহর কিন্তু ‘তে’দাদে মসজিদ অর্থাৎ এক শহরে একাধিক
মসজিদে জুমুয়ার নামায জায়েয হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ অবশ্যই রয়ে যায়। জরুরতে ঐরূপ
একস্থানে একাধিক মসজিদে ফতওয়া মতে জুমুয়া জায়েয থাকলেও তাক্বওয়ার জন্য ইহ্তিয়াত বা
সাবধানতা অবলম্বন করতঃ (চার রাকায়াত আখিরী যোহ্র পড়া) শরীয়ত বিরোধী নয় (বরং
মুস্তাহাব বা মুস্তাহ্সান)।
যেমন, এ
প্রসঙ্গে ফিক্বাহের অন্যতম কিতাব “শরহে বিকায়াতে” উল্লেখ
আছে,
উর্দূ কম্পোজ করতে হবে
অর্থাৎ- “জুমুয়ার
নামাযের পর বিনা জামায়াতে চার রাকায়াত আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র পড়া
মুস্তাহ্সান।”
উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবেই প্রমাণিত হলো যে, ইমামগণের
মতে ক্ষেত্র বিশেষে “আখিরী যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্র” পড়া ওয়াজিব। অর্থাৎ যে স্থানে
জুমুয়া জায়েয বা ছহীহ্ হওয়ার ব্যাপারে প্রবল সন্দেহ রয়েছে, সেখানে “আখিরী
যোহ্র” পড়া ওয়াজিব। আর যেস্থানে সন্দেহ নেই, (তবে মতভেদ থাকায়) সেখানে “আখিরী
যোহ্র” পড়া মুস্তাহাব,
মুস্তাহ্সান, আওলা ও আফযল, জায়েয তো
অবশ্যই।
অতএব, ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাবসমূহে এরূপ সুস্পষ্টভাবে “আখিরী
যোহ্র বা ইহ্তিয়াতুয্ যোহ্রের” কথা উল্লেখ থাকার পরও যারা বলে যে, “আখিরী
যোহ্র” বলতে শরীয়তে কোন নামায নেই, এটা পড়া নাজায়েয ও বিদয়াত। তারা যদি জেনে-শুনে এরূপ বলে
থাকে তবে তারা নিশ্চিত রূপেই গোমরাহ ও শরীয়ত অস্বীকারকারী। আর যদি তারা না জেনে
বলে থাকে তবেও তারা চরম জাহিল ও গোমরাহ। কেননা বিনা তাহক্বীকে শরীয়তের কোন বিষয়ে
মন্তব্য করা জিহালত ও গোমরাহী বৈ কিছুই নয়।
মূলতঃ এ নামাযের কথা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ না থাকলেও
শরীয়তের আরেক দলীল ইজ্মা-ক্বিয়াস তথা ফিক্বাহের কিতাবে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে। কাজেই আখিরী যোহ্র শরীয়তে নাই বলা “ইজ্মা ও
ক্বিয়াসকে” অস্বীকার করারই নামান্তর। যা সুস্পষ্ট কুফরী। কেননা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের
ন্যায় ইজ্মা ও ক্বিয়াসকে মানাও ফরয-ওয়াজিব। যেহেতু শরীয়তের দলীল হচ্ছে- ৪টি অর্থাৎ
(১) কুরআন শরীফ (২) হাদীস শরীফ (৩) ইজ্মা (৪) ক্বিয়াস।
নিম্নে এসম্পর্কে বিস্তারিত ও দলীল ভিত্তিক আলোচনা করা হলো-
আহলে সুন্নত ওয়াল
জামায়াতের
দৃষ্টিতে ইসলামী শরীয়তের উছূল
আমাদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ফতওয়া হলো, শরীয়তের কোন বিষয়ের মীমাংসা বা
ফায়সালা করতে হলে তা কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা ও ক্বিয়াসের দৃষ্টিতেই করতে হবে, এর বাইরে
কোন কথা বা কাজ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, শরীয়তের ভিত্তি বা দলীলই হলো
উপরোক্ত চারটি।
এ প্রসঙ্গে উছূলের কিতাবে
উল্লেখ আছে যে,
اصول الشرع ثلثة القران والحديث والاجماع ورابعها القياس.
অর্থঃ- “মূলতঃ
শরীয়তের ভিত্তি হলো তিনটি। কুরআন শরীফ, হাদীস শরীফ, ইজ্মা
এবং চতুর্থ হলো- ক্বিয়াস।”
(নূরুল আনওয়ার)
(১)
কুরআন শরীফ
মূলতঃ কুরআন শরীফের
সম্পূর্ণটাই আল্লাহ্ পাক-এর ওহীর অন্তর্ভূক্ত। কেননা আল্লাহ্ পাক বলেন,
وماينطق عن الهوى ان هو الا وحى يوحى.
অর্থঃ- “রসূল
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন কথাই নিজের থেকে বলেন না, ওটা ওহী
ব্যতীত কিছুই নয়।”
(সূরা নজম/৩,৪)
শুধু তাই নয়,
উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা এটা স্পষ্টই বুঝা যায় যে, হাদীস
শরীফগুলোও কুরআন শরীফের ন্যায় ওহীর অন্তর্ভূক্ত। আর তাই ওহীকে দু’ভাগে ভাগ
করা হয়েছে-
১। ওহীয়ে মাতলূ অর্থাৎ
কুরআন শরীফ, যা তিলাওয়াত করা হয়।
২। ওহীয়ে গায়রে মাতলূ
অর্থাৎ হাদীস শরীফ যা তিলাওয়াত করা হয় না।
মূলতঃ কুরআন শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল, প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য
কুরআন শরীফের হুকুম-আহ্কাম,
আদেশ-নিষেধ মেনে চলা অপরিহার্য। কারণ বিপথগামী, পথভ্রষ্ট
মানুষদেরকে হিদায়েতের পথে আনার জন্যই মহান আল্লাহ্ রব্বুল ইজ্জত পবিত্র
কালামুল্লাহ্ শরীফ অবতীর্ণ করেন।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক
কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ ফরমান,
كتب انزلنه اليك لتخرج الناس من الظلمت الى النور.
অর্থঃ- “আমি এ
কিতাবকে আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, মানুষদেরকে গোম্রাহী হতে
হিদায়েতের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।” (সূরা ইব্রাহীম/১)
সুতরাং যাঁরা এ কুরআন শরীফের আদেশ-নিষেধ, হুকুম-আহ্কামের অনুসরণ করবে, তাঁরা
হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে,
আর যারা অনুসরণ করবেনা, তারা গোম্রাহীর মধ্যে নিপতিত
থাকবে।
আর তাই কুরআন শরীফের অসংখ্য স্থানে কালামুল্লাহ্ শরীফের হুকুম-আহ্কামের অনুসরণ
করতে বলা হয়েছে। যেমন,
আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন,
فاما ياتينكم منى هدى فمن تبع هداى فلاخوف عليهم ولاهم يحزنون.
অর্থঃ- “আর যখন
আমার পক্ষ হতে তোমাদের জন্য হিদায়েতের বাণী আসবে, আর এ হিদায়েতবাণীকে (কুরআন
শরীফকে) যাঁরা অনুসরণ করবে,
তাঁদের কোন ভয় নেই এবং চিন্তা নেই।”(সুরা
বাক্বারা/৩৮)
আল্লাহ্ পাক অন্যত্র আরো
ইরশাদ করেন,
اتبعوا ما انزل اليكم من ربكم.
অর্থঃ- “তোমাদের
প্রভুর পক্ষ হতে তোমাদের নিকট যা (কুরআন শরীফ) অবতীর্ণ করা হয়েছে, তার
অনুসরণ কর।” (সুরা আ’রাফ/৩)
কালামুল্লাহ্ শরীফে এ
প্রসঙ্গে আরো ইরশাদ হয়েছে,
واتبعوا النور الذى انزل معه اولئك هم المفلحون.
অর্থঃ- “সেই
নূরের (কুরআন শরীফ) অনুসরণ কর, যা তাঁর (রসূলের) উপর অবতীর্ণ হয়েছে, (যারা
এরূপ করবে) তারাই সফলকাম।”
(সূরা আ’রাফ/১৫৭)
আর তাই আল্লাহ্ পাক ইরশাদ
করেন,
خذوا ما اتينكم بقوة.
অর্থঃ- “তোমাদেরকে
যা দিয়েছি, (কুরআন শরীফ) তা শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধর।” (সূরা বাক্বারা/৬৩)
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, কুরআন
শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং কুরআন শরীফকে অনুসরণ করা প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর
জন্য অবশ্যই কর্তব্য।
(২)
হাদীস শরীফ
কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল। কারণ হাদীস শরীফ ব্যতীত
উম্মতের জন্য কুরআন শরীফের সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করা কোন দিনও সম্ভব নয়। আর তাই
হাদীস শরীফকে কুরআন শরীফের তাফসীর বা ব্যাখ্যা বলা হয়ে থাকে। মূলতঃ হাদীস শরীফও
ওহীর অন্তর্ভূক্ত। অর্থাৎ ওহীয়ে গায়রে মাত্লূ।
অতএব, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফ মানা ও তার অনুসরণ-অনুকরণ করা অবশ্যই কর্তব্য।
আর তাই আল্লাহ্ পাক কালামুল্লাহ্ শরীফে ইরশাদ করেন,
وما اتكم الرسول فخذوه وما نهكم عنه فانتهوا.
অর্থঃ- “আমার
রসূল (ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন, তা
আঁকড়িয়ে ধর এবং যার থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, তার থেকে বিরত থাক।”(সূরা
হাশর/৭)
উপরোক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা হাদীস শরীফের অনুসরণ-অনুকরণ করা ফরয প্রমাণিত হয়।
সুতরাং যারা হাদীস শরীফ অস্বীকার করবে এবং তার অনুসরণ-অনুকরণ করবেনা, তারা
গোম্রাহ্ ও বাতিল এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
যেমন, আল্লাহ্
পাক রব্বুল আলামীন বলেন,
فليحذر الذين يخالفون عن امره ان تصيبهم فتنة اويصيبهم عذاب اليم.
অর্থঃ- “সুতরাং
যারা তাঁর (রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর) আদেশের বিরোধীতা করে, তাদের ভয়
করা উচিত যে, তাদের উপর এসে পড়বে কোন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (সূরা নূর/৬৩)
আর এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে
ইরশাদ হয়েছে,
عن ابى رافع رضى الله عنه قال قال النبى صلى الله عليه وسلم لا الفئن احدكم متكئا على اريكته ياتيه الامر من امرى مما امرت به ونهيت عنه فيقول لا ادرى ما وجدنا فى كتاب الله اتبعناه.
অর্থঃ- “হযরত আবু
রা’ফে রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত- রসূলে মকবূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমি
তোমাদের কাউকে যেন এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে।
আর তার নিকট আমার আদেশাবলীর কোন একটি আদেশ পৌঁছল, যাতে আমি কোন বিষয়ে আদেশ বা নিষেধ
করেছি। তখন সে বলবে,
আমি এসব কিছু জানিনা, আল্লাহ্র কিতাবে যা পাবো, তাই
অনুসরণ করবো।” (তিরমিযী, আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ্,
আহ্মদ, মিশকাত, মায়ারিফুস্ সুনান, বযলুল মাজহুদ, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল
লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী,
আত্ তা’লীকুছ্ ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)
হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ
হয়েছে,
عن العرباض بن سارية رضى الله عنه قال قام رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال ايحسب احدكم متكئا على اربكته يظن ان الله لم يحرم شيئا الا ما فى القران الا وانى والله قد امرت ووعظت ونهيت عن اشياء انها لمثل القران.
অর্থঃ- “হযরত
ইরবায ইবনে সারিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, একদিন রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের
মধ্যে কেউ কি তার গদীতে ঠেস দিয়ে একথা মনে কর যে, আল্লাহ্ পাক যা এ কুরআন শরীফে
অবতীর্ণ করেছেন, তা ব্যতীত তিনি আর কিছুই হারাম করেননি? তোমরা জেনে রাখ, আমি
খোদার কছম করে বলছি- নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অনেক বিষয়ে আদেশ দিয়েছি, উপদেশ
দিয়েছি এবং নিষেধও করেছি,
আমার এরূপ বিষয়ও নিশ্চয়ই কুরআন শরীফের বিষয়ের ন্যায়।” (আবূ দাউদ, মিশকাত, বযলুল
মাজহুদ, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত,
শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তা’লীকুছ্
ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)
এ হাদীস শরীফ দ্বারা বুঝা
যায় যে, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল।
কাজেই উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, কুরআন
শরীফ ও হাদীস শরীফ শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং তার অনুসরণ ও অনুকরণ করা অবশ্যই
কর্তব্য। সুতরাং যারা কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফকে অনুসরণ করবে না, দলীল
হিসেবে মানবে না,
তারা গোম্রাহ ও পথভ্রষ্ট হবে।
আর তাই হাদীস শরীফে ইরশাদ
হয়েছে,
تركت فيكم امرين لن تضلوا تمسكتم بهما كتاب الله سنتى.
অর্থঃ- “আমি
তোমাদের জন্য দু’টি জিনিস রেখে গেলাম,
যদি তোমরা এদুটিকে আঁকড়িয়ে ধরো, তবে
গোমরাহ হবেনা। একটি হলো- আল্লাহ্ পাক-এর কিতাব কুরআন শরীফ, দ্বিতীয়টি
হলো- আমার সুন্নত হাদীস শরীফ।” (মিশকাত, মিরকাত, লুময়াত, আশয়াতুল লুময়াত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তা’লীকুছ
ছবীহ্, মুযাহিরে হক্ব)
সুতরাং যারা এ দু’টোর অনুসরণ করবে,
তারা হিদায়েতপ্রাপ্ত হবে। আর যারা এর বিপরীত করবে, তারা
অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে।
অতএব, প্রমাণিত
হলো যে, কুরআন শরীফের ন্যায় হাদীস শরীফও শরীয়তের অকাট্য দলীল।
(৩)
ইজ্মা
যে বিষয়ে কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফে স্পষ্ট কোন কিছু বলা হয়নি, সে বিষয়ে
কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করতঃ হুকুম সাবিত করতে হবে। অবস্থার
প্রেক্ষিতে ও প্রয়োজনীয়তায় এ ধরণের ইজ্তিহাদ করা আল্লাহ্ পাক ও রসূলে পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এরই নির্দেশ। যেমন, কালামে পাকে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ
করেন, فاعتبروا ياولى الابصار.
অর্থঃ- “হে
চক্ষুষ্মান ব্যক্তিগণ! তোমরা গবেষণা কর।” (সূরা হাশর/২)
আর হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে ইয়েমেনের গভর্নর করে পাঠানোর প্রাক্কালে বলেছিলেন-
بم تقضى يامعاذ؟ فقال بكتاب الله فان لم تجد؟ قال بسنة رسول الله فان لم تجد قال اجتهد برائى فقال الحمد لله الذى وفق رسول رسول الله بما يرضى به رسوله.
অর্থঃ- “হে মুয়ায! তোমার নিকট কোন
মুকাদ্দমা আসলে কিভাবে তা ফায়সালা করবে? হযরত মুয়ায রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু বললেন, আল্লাহ্ পাক-এর কিতাবের দ্বারা। যদি তাতে না পাও তাহলে? আল্লাহ্
পাক-এর রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ দ্বারা। অতঃপর জিজ্ঞেস
করলেন, যদি তাতেও না পাও তাহলে? আমি কিতাব ও সুন্নাহ্র ভিত্তিতে ইজ্তিহাদ করে রায় দিবো। এ
উত্তর শুনে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সমস্ত
প্রশংসা ঐ আল্লাহ্ পাক-এর,
যিনি তাঁর রসূলের দূতকে এ যোগ্যতা দান করেছেন, যাতে
তাঁর রসূল সন্তুষ্ট হন।”
(মিশকাত, মিরকাত, শরহুত্ ত্বীবী, আত্ তালীক্বুছ্ ছবীহ্, মুযাহিরে
হক্ব, আশয়াতুল লুমুয়াত)
এটা হতে স্পষ্ট প্রমাণিত
হচ্ছে যে, মুসলমানদের কল্যণার্থে ও কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে ইজ্তিহাদ করা কুরআন ও হাদীস
শরীফেরই নির্দেশ।
উল্লেখ্য, যে ইজ্তিহাদকৃত মাসয়ালা এককভাবে রয়েছে, সেটাকে বলা হয় ক্বিয়াস। আর
ইজ্তিহাদকৃত মাসয়ালার মধ্যে যেগুলোর উপর মুজ্তাহিদগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন, শরীয়তে
তাকেই ইজ্মা বলা হয়।
ইজমার দলীল সম্পর্কে
শাফিয়ী মাযহাবের ইমাম,
ইমামুল আইম্মা, হযরত ইমাম শাফিয়ী রহমতুল্লাহি
আলাইহি বলেন, কুরআন শরীফ থেকে ইজমার দলীল বের করার উদ্দেশ্যে আমি তিন দিনে নয় বার কুরআন
শরীফ খতম করি। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনশতবার কুরআন শরীফ খতম করি।
অতঃপর আমি নিশ্চিত হই যে,
নিম্নোক্ত আয়াত শরীফখানাই “ইজমার” দলীল।
যেমন, ইরশাদ হয়েছে,
ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ماتولى ........ الخ.
অর্থঃ- “কারো
নিকট হিদায়েত বিকশিত হওয়ার পরও যদি সে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচরণ করে, আর মু’মিনগণের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথের অনুসরণ করে, আমি তাকে
সে দিকেই ফিরাবো,
যে দিকে সে ফিরেছে।” (সূরা নিসা/১১৫)
ক্ষেত্র বিশেষে ইজ্মার অনুসরণ করা প্রত্যেকের
জন্য অবশ্যই কর্তব্য। যে ব্যক্তি উক্ত ইজ্মাকে (ইজমায়ে আযীমতকে) অস্বীকার করলো, সে কুফরী
করলো।
এ প্রসঙ্গে কিতাবে উল্লেখ
আছে যে,
فيكون الاجماع حجة يكفر جاحده كالكتاب والسنة.
অর্থঃ- “ইজ্মায়ে
আযীমত কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের মতই একটি অকাট্য দলীল, যে তা
অস্বীকার করলো, মূলতঃ সে কুফরী করলো।”
(তাফসীরে আহ্মদী)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ইজ্মা শরীয়তের অকাট্য দলীল এবং তা
অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য অবশ্যই কর্তব্য।
ইজ্মার বিস্তারিত ব্যাখ্যা,
প্রকারভেদ ও আহকাম
ইজ্মার প্রকারভেদ ও আহকাম সম্পর্কে প্রখ্যাত আলিমেদ্বীন, ইমামুল
উছূলিয়্যীন হযরত আবূ সাঈদ মুল্লা জিউন রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত কিতাব “নূরুল আনওয়ারে” লিখেন,
الاجماع وهو فى اللغة الاتفاق وفى الشريعة التفاق مجتهدين صالحين من امة محمد صلى الله عليه وسلم فى عصر واحد على امر قولى او فعلى ركن الاجماع نوعان عزيمة وهو التكلم منهم بما يوجب الاتفاق اى اتفاق الكل على الحكم بان يقولوا اجمعنا على هذا ان كان ذالك الشئ من باب القول اوشروعهم فى الفعل ان كان من بابه اى كان ذالك الشئ من باب الفعل ...... ورخصة وهو ان يتكلم او يفعل البعض دون البعض اى يتفق بعضهم على قول او فعل وسكت الباقون منهم ولايردون عليهم بعد مضى مدة التامل وهى ثلاثة ايام او مجلس العلم ويسمى هذا اجماعا سكوتيا. (نور الاتوار مع ازهر الازهار – ص ৩১৬)
অর্থঃ- “ইজ্মা” শব্দের
আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ঐক্যমত। আর শরীয়তে “ইজ্মা” বলা হয়, এক
যামানায় উম্মতে মুহম্মদির সকল নেক্কার মুজতাহিদগণের কোন ক্বওল (কথা) ফে’ল
(কাজ)-এর উপর ঐক্যমত পোষণ করাকে। “ইজ্মা” দু’প্রকার-
(১)
ইজ্মায়ে আযীমত
সকল মুজতাহিদগণ কোন বিষয়ে এমন শব্দ ব্যবহার করা যদ্বারা ঐক্যমত প্রমাণিত হয়।
যেমন সকলেই বললো اجمعنا هذا অর্থাৎ আমরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত। এরূপ ইজ্মা ক্বওলী বিষয়ের
সাথে সম্পর্কযুক্ত। অথবা উক্ত বিষয়টি যদি فعلى হয়। আর সকলেই তা আমল করা শুরু করে দেয়, তবে এরূপ
ইজ্মাকেই “ইজ্মায়ে আযীমত”
বলে।
(২)
ইজ্মায়ে রোখ্সত
ইজতিহাদকৃত ক্বওল বা ফে’ল এর উপর কেউ কেউ ঐক্যমত পোষণ করা আর কেউ কেউ পোষণ না করা।
অর্থাৎ ইজতিহাদকৃত বিষয়ে কেউ কেউ ঐক্যমত পোষণ করেছে আর বাকী সকলে নিশ্চুপ রয়েছে।
সংবাদ পৌঁছার তিন দিনের মধ্যে প্রতিবাদ করেনি। এরূপ ইজ্মাকেই “ইজমায়ে
রোখসত” বলে। এর অপর নাম হচ্ছে “সূকূতী”। (নূরুল আনওয়ার মাআ আযহুরিল আযহার ৩১৬ পৃষ্ঠা)
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, মুজ্তাহিদ
অর্থাৎ যিনি ইজ্তিহাদ করবেন, তাঁকে অবশ্যই ছালিহীনগণের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে, আদিল হতে
হবে, সুন্নতের পূর্ণ পাবন্দ হতে হবে, ছগীরাহ্ গুণাহ্ও তাকে পরহেয করতে
হবে। অতএব, কোন বিদ্য়াতী ও হারাম কাজে লিপ্ত ব্যক্তির ইজ্তিহাদ শরীয়তে গ্রহণযোগ্য নয়।
যেমন, বর্তমানে
অনেক ওলামায়ে “ছূ” বা দুনিয়াদার,
তথাকথিত মাওলানারা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ছবি তোলার কাজে
লিপ্ত। অথচ শরীয়তে ছবি তোলা সম্পূর্ণ হারাম।
তারা ইসলামী হুকুমত জারী
করার দোহাই দিয়ে গণতন্ত্র ভিত্তিক আন্দোলন, নির্বাচন, ভোট, বে-পর্দা, হরতাল, কুশপুত্তলিকাদাহ্সহ
আরো বহু কাজে জড়িত। অথচ শরীয়তের দৃষ্টিতে উল্লিখিত সমস্ত কাজগুলো সম্পূর্ণই হারাম
ও নাজায়েয।
সুতরাং এ ধরণের কোন তথাকথিত মাওলানা বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতই ইল্মের দাবীদার হোক
না কেন, হাক্বীক্বতে সে মুজ্তাহিদ হওয়ার বিন্দুমাত্র উপযুক্ত নয়। এরূপ ব্যক্তির দ্বারা
ইজ্তিহাদের প্রশ্নই উঠেনা। তা সত্ত্বেও যদি সে মুজ্তাহিদ দাবী করে বা কোন প্রকার
ইজ্তিহাদ করে তবে তার মেছাল হবে- ইবলীসের মতই। কারণ ইবলীসই সর্ব প্রথম মনগড়া ও
গোমরাহীমূলক ইজ্তিহাদ করেছিল। যার ফলে সে চির লা’নতী ও জাহান্নামী হয়ে যায়।
যেমন, এ
প্রসঙ্গে পবিত্র কালামে পাকে ইরশাদ হয়েছে,
واذ قلنا للملئكة اسجدوا لادم فسجدوا الا ابليس.
অর্থঃ- “আর যখন
আপনার রব (ইবলীসসহ) সকল ফেরেশ্তাদের প্রতি হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সিজ্দা করার
নির্দেশ দিলেন; তখন ইবলীস ব্যতীত সকলেই তাঁকে সিজ্দা করলো।” (সূরা বাক্বারা/৩৪)
হযরত আদম আলাইহিস্ সালামকে সিজ্দা না করার কারণে মহান আল্লাহ্ পাক ইবলীসকে
জিজ্ঞাসা করলেন,
ما منعك الاتسجد اذ امرتك.
অর্থঃ- “(হে
ইবলীস)! কোন্ জিনিস (আদম আলাইহিস্ সালামকে) সিজ্দা করা থেকে তোকে বিরত রাখলো?” (সূরা আ’রাফ/১২)
ইবলীস তখন (মনগড়া)
ইজ্তিহাদ করে বললো,
انا خير منه خلقتنى من نار وخلقته من طين.
অর্থঃ- “(আয়
আল্লাহ্ পাক)! আমি তাঁর থেকে উত্তম। কারণ আপনি আমাকে আগুন থেকে তৈরী করেছেন, আর তাঁকে
(আদম আলাইহিস্ সালামকে) মাটি থেকে তৈরী করেছেন।” (সূরা আ’রাফ/১২)
কাজেই আগুনের স্বভাব হলো-
উপরে থাকা, আর মাটির স্বভাব হলো- নীচে থাকা, তাই আমি আগুন হয়ে মাটিকে সিজ্দা
করতে পারিনা।”
উল্লেখ্য, ইবলীসের উক্ত ইজ্তিহাদ ছিল মনগড়া ও মহান আল্লাহ্ পাক-এর হুকুমের সম্পূর্ণই
খিলাফ। যার ফলে তার সে ইজ্তিহাদই তাকে চির জাহান্নামী, লা’নতী ও
চরম গোমরাহীতে নিপতিত করেছে।
যে সম্পর্কে কালামে পাকে
ইরশাদ হয়েছে,
ابى واستكبر وكان من الكفرين.
অর্থঃ- “(ইবলীস)
সিজ্দা করতে অস্বীকার করলো এবং অহংকার করে (মনগড়া ইজ্তিহাদ করলো)। তাই সে কাফিরদের
অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।”
(সূরা বাক্বারা/৩৪)
তদ্রুপ বলতে হয়, যারা
শরীয়তের খিলাফ প্রকাশ্য হারামগুলোকে মনগড়া ও শরীয়ত বিরোধী ইজ্তিহাদ করতঃ হালাল
করতে চায়, তারাও ইবলীসের খাছ অনুসারী এবং গোমরাহ্ রূপেই সাব্যস্ত।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত
হারাম বিষয়গুলোকে মা’জুর হিসেবে গণ্য করার কোন অবকাশ নেই। আর মা’জুরের ক্ষেত্রে নতুন করে ইজ্তিহাদ
করারও কোন সুযোগ নেই। কারণ এ সম্পর্কিত ইজ্তিহাদ পূর্ব থেকেই হয়ে আছে।
সুতরাং "مجتهدين صالحين" (মুজতাহিদীনা ছলিহীনা)
“নেককার মুজতাহিদ”
বাক্য দ্বারা বিদ্য়াতী ও ফাসিক তথা ওলামায়ে “ছূ”দের মনগড়া
ইজ্তিহাদ বাতিল বলে গণ্য হয়ে।
ইজ্মার শরয়ী আহ্কাম
মূলতঃ ইজমা হচ্ছে শরীয়তের
একটি অকাট্য দলীল। ইজ্মাকে অর্থাৎ ইজ্মায়ে আযীমতকে অস্বীকার করা, কুরআন
শরীফ, হাদীস শরীফকে অস্বীকার করারই নামান্তর। যেটা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণই
কুফরী।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ পাক তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ماتولى ....... الخ.
অর্থঃ- “কারো
নিকট হিদায়েত বিকশিত হওয়ার পরও যদি সে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর বিরুদ্ধাচরণ করে, আর মু’মিনগণের পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথের অনুসরণ করে, আমি তাকে
সে দিকেই ফিরাবো,
যে দিকে সে ফিরেছে।” (সূরা নিসা/১১৫)
বিখ্যাত মুফাস্সির, আলিমে
হক্কানী, শায়খে রব্বানী,
শায়খ আহ্মদ ইবনে আবূ সাঈদ মুল্লা জিউন রহমতুল্লাহি আলাইহি
উপরোক্ত আয়াত শরীফের তাফসীরে বলেন যে,
فجعلت مخالفة المؤمنين مثل مخالفة الرسول فيكون اجماعهم كخبر الرسول حجة قطعية.
অর্থঃ- “উপরোক্ত
আয়াত শরীফ দ্বারা এটাই সাব্যস্ত হলো যে, মু’মিনগণের বিরোধীতা করা মূলতঃ রসূলে
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিরোধীতা করারই নামান্তর। তাই রসূলে পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীস শরীফের ন্যায় মু’মিনগণের
ইজ্মাও অকাট্য ও প্রামান্য দলীল বলে পরিগণিত হবে।” (নূরুল আনওয়ার)
আর সে কারণেই মুল্লা জিউন
রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ “তাফসীরে আহ্মদী”তে
ইজ্মার আহ্কাম সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় পেশ করে বলেন,
فيكون الاجماع حجة يكفر جاحده كالكتاب والسنة.
অর্থঃ- “ইজ্মায়ে
আযীমত কুরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের মতই একটি অকাট্য দলীল। যে ব্যক্তি এ ইজ্মাকে
অস্বীকার করলো, সে মূলতঃ কুফরী করলো।”
উল্লেখ্য, হুজুর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সময়ে ইজ্মার প্রয়োজনীয়তা ছিলনা। ইজ্মার
প্রচলন ও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের যুগে। উক্ত আয়াত শরীফ যেহেতু তাঁদের সময়কালে নাযিল হয়েছে, তাই হযরত
ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণই এটার খাছ লক্ষ্যস্থল।
আহ্কামে শরীয়তের দিক
নির্দেশনা ও তার ফায়সালার ক্ষেত্রে হযরত ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহুমগণের ইজ্মা বা ঐক্যমত সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ পাক কুরআন মজীদে ইরশাদ করেন,
كنتم خير امة اخرجت للناس الخ.
অর্থঃ-“তোমরা
শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের মধ্য হতে বের করা হয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান/১১০)
ইমাম ইবনে সালাহ্ রহমতুল্লাহি
আলাইহি এ আয়াত শরীফের তাফ্সীরে উল্লেখ করেন,
وقيل اتفاق المفسرين على انه وارد فى اصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থঃ-“মুফাস্সিরীনগণ
ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে,
এ আয়াত শরীফ রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছাহাবা-ই-কিরাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক
ইরশাদ করেন,
محمد رسول الله والذين معه اشداء على الكفار رحماء بينهم.
অর্থঃ- “মুহম্মদ
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাক-এর রসূল, আর তাঁর
ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের
মধ্যে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল।” (সূরা ফাত্হ্/২৯) আল্লাহ্ পাক আরো
ইরশাদ করেন,
كذلك جعلنكم امة وسطا لتكونوا شهداء على الناس.
অর্থঃ- “একইভাবে
তোমাদেরকে আমি ন্যায়পরায়ণ (মধ্যস্থতাকারী) উম্মত হিসেবে সৃষ্টি করেছি, যাতে
তোমরা (ক্বিয়ামতের দিনে) অন্যান্য উম্মতের সাক্ষী হতে পার।” (সূরা
বাক্বারা/১৪৩)
ইমাম ইবনে সালাহ
রহমতুল্লাহি আলাইহি “মুকাদ্দিমায়ে ইবনুস্ সালাহ্” কিতাবে এবং মুল্লা জিউন রহমতুল্লাহি আলাইহি “নুরুল
আনওয়ার” কিতাবে উক্ত আয়াত শরীফ দ্বারা হযরত সাহাবা-ই -কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের
ইজ্মা ছাবেত করেছেন।
অতএব, হযরত
ছাহাবা-ই-কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের ইজ্মা, তা কুরআন
শরীফের দ্বারাই প্রমাণিত। কাজেই “ইজ্মায়ে ছাহাবা” বা ইজ্মায়ে আযীমকে অস্বীকার করা
কুরআন শরীফের আয়াত শরীফকে অস্বীকার করার অনুরূপ, যা সকলের মতেই কুফরী। (অসমাপ্ত)
0 Comments:
Post a Comment