আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার চাচা আবূ
ত্বালিব উনার ইন্তিকাল
চাচা আবূ ত্বালিব উনার ইন্তিকালের পর উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা
আলাইহাস সালাম তিনি বিছাল শরীফ লাভ করেন। কারো কারো মতে চাচা আবূ ত্বালিব উনার
পূর্বে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি বিছাল শরীফ লাভ
করেন। তবে প্রথম মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ। এই দুটি বিয়োগান্তক ঘটনা এবং শিয়াবে আবূ
ত্বালিব-এর অবরুদ্ধ ঘটনা ছিলো খুবই বেদনাদায়ক। যাকে আমুল হুযূন বা বেদনা বা
চিন্তার বৎসর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে
উল্লেখ রয়েছে,
قال حضرت ابن اسحاق رحمة الله عليه ثم إن حضرت خديحة عليها السلام وأبا طالب هلكا فى عام واحد، فتتابعت على رسول الله صلى الله عليه وسلم المصائب بهلك حضرت خديجة عليها السلام، وكانت له وزير صدق على الابتلاء يسكن اليها، وبهلك عمه أبى طالب وكان له عضدا وحرزا فى أمره، ومنعة وناصرا على قومه. وذلك قبل مهاجره إلى المدينة بثلاث سنين
অর্থ: হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম এবং আবূ
ত্বালিব উনারা দু’জন একই বছরে বিছাল শরীফ লাভ করেন। উনাদের দু’জনের অবর্তমানে
বিরামহীনভাবে আঘাতের পর আঘাত আসতে থাকে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপরে। সকল বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্টে উম্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা আলাইহাস সালাম তিনি
ছিলেন সত্যিকার ও সঠিক পরামর্শদাতা তথা খিদমতগার। উনার নিকট এসে আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি শান্তি
ও স্বস্তি পেতেন।
চাচা আবূ ত্বালিব তিনি ছিলেন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাক্বীক্বী খিদমতের আঞ্জামদাতা, বিপদাপদে হিফাযতকারী এবং আপন সম্প্রদায়ের হাত থেকে নিরাপত্তা প্রদানকারী।
উনাদের উভয়ের বিছাল শরীফ-এর ঘটনা ঘটে মদীনা শরীফ-এ হিজরতের তিন বছর পূর্বে।
فلما هلك أبو طالب، نالت قريش من رسول الله صلى الله عليه وسلم من الاذى مالم تكن تطمع به فى حياة أبى طالب حتى اعترضه سفيه من سفهاء قريش فنثر على رأسه ترابا. فحدثنى حضرت هشام بن عروة رحمة الله عليه عن أبيه. قال فدخل رسول الله صلى الله عليه وسلم بيته والتراب على رأسه فقامت اليه إحدى بناته تغسله وتبكى، ورسول الله صلى الله عليه وسلم يقول لاتبكى يا بنية فان الله مانع أباك ويقول بين ذلك ما نالتنى قريش شيئا اكرهه حتى مات أبو طالب.
وذكر حضرت ابن اسحاق رحمة الله عليه قبل ذلك أن أحدهم ربما طرح الاذى فى برمته صلى الله عليه وسلم إذا نصبت له. فيقذفه على بابه ثم يقول يا بنى عبد مناف أى جوار هذا؟ ثم يلقيه فى الطريق.
চাচা আবূ ত্বালিব উনার ইন্তিকালের পর আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর কুরাইশ কাফির, মুশরিকরা এমন অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করলো, যা আবূ ত্বালিব উনার জীবদ্দশায় তারা চিন্তাও করতে পারতো না। আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর
চড়াও হয় তাদের এক গ-মূর্খ কাফির এবং উনার পবিত্র মাথা মুবারকে সে ধূলি নিক্ষেপ
করে। নাঊযুবিল্লাহ!
হযরত হিশাম ইবনে উরওয়াহ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি উনার পিতা থেকে বর্ণনা করেন
যে, তারপর আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ধূলি ধুসরিত মাথা মুবারকে হুযরা
শরীফ-এ ফিরেন। তখন উনার এক কন্যা কেঁদে কেঁদে সম্মানিত পিতা আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার মাথা মুবারক
ধুয়ে দিচ্ছিলেন।
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ করলেন, হে
আমার প্রিয় আদরের দুলালী! আপনি কাঁদবেন না। মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনার পিতাকে
অবশ্যই হিফাযত করবেন। তিনি তখন এও বললেন যে, আমার চাচা আবূ
ত্বালিব তিনি ইন্তিকালের পূর্বপর্যন্ত কুরাইশ কাফির, মুশরিকরা
আমার সাথে এমন কোনো আচরণ করতে পারেনি, যা আমাকে কষ্ট দেয়।
হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হুজরা শরীফ-এ রান্নাবান্নার সময় কাফির,
মুশরিকদের মধ্যে এক পাপিষ্ঠ দুর্বৃত্ত উনার পাতিল মুবারক-এ আবর্জনা
নিক্ষেপ করতো। নাঊযুবিল্লাহ! নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজে লাঠি মুবারক দিয়ে তা উঠিয়ে
নিজের দরজা মুবারকের সম্মুখে ফেলে দিতেন এবং বলতেন, হে আবদে
মানাফের বংশধর! প্রতিবেশীর সাথে তোমাদের একি আচরণ? তারপর
তিনি ওই ময়লা দূরে রাস্তার পার্শে ফেলে দিতেন।
قال حضرت ابن اسحاق رحمة الله عليه ولما اشتكى أبوطالب وبلغ قريشا ثقله قالت قريش بعضها لبعض إن حضرت حمزة عليه السلام و حضرت عمر عليه السلام قد أسلما، وقد فشا أمر حضرت محمد صلى الله عليه و سلم فى قبائل قريش كلها، فانطلقوا بنا الى أبى طالب فليأخذ لنا على ابن أخيه وليعطه منا، فانا والله ما نأمن أن يبتز ونا أمرنا. قال حضرت ابن اسحاق رحمة الله عليه وحدثنى حضرت العباس بن عبد الله بن معبد رحمة الله عليه عن بعض أهله عن حضرت ابن عباس رضى الله تعالى عنه قال لما مشوا إلى أبى طالب وكلموه- وهم أشراف قومه عتبة بن ربيعة، وشيبة بن بيعة، وأبو جهل بن هشام، وأمية بن خلف، وابو سفيان بن حرب فى رجال من اشرافهم- فقالوا يا ابا طالب انك منا حيث قد علمت وقد حضرك ماترى وتخوفنا عليك وقد علمت الذى بيننا وبين ابن أخيك فادعه فخذ لنا منه وخذ له منا ليكف عنا ولنكف عنه، وليدعنا وديننا ولندعه ودينه.
হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, আবূ ত্বালিব উনার অন্তিম শয্যায় শায়িত এ সংবাদ পেয়ে কুরাইশরা
একে অপরকে বলাবলি করতে লাগলো যে, হযরত হামযা আলাইহিস সালাম ও
হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম উনারা ইতোমধ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আর আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনীত
বিষয়গুলোর কথা কুরাইশসহ সকল গোত্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন চলো, আমরা আবূ ত্বালিব উনার নিকট যাই এবং উনার সম্মানিত ভাতিজা নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
স্বার্থে তিনি আমাদের থেকে কিছু অঙ্গীকার নিক আর আমাদের স্বার্থে উনার থেকে কিছু
প্রতিশ্রুতি নিয়ে দিক। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আরববাসীগণ যে আমাদের উপর উনাকে
প্রাধান্য দিবেন না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই।
হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুআব্বিদ রহমতুল্লাহি
আলাইহি উনার থেকে, তিনি উনার এক আহাল থেকে এবং তিনি হযরত
ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণনা করেন, তারা আবূ ত্বালিব উনার নিকট গেলো এবং উনার সাথে আলাপ আলোচনা করলো। এ
প্রতিনিধি দলে ছিলো কুরাইশ বংশের নেতৃস্থানীয় নেতৃবর্গ। তাদের মধ্যে উতবা ইবনে
রাবীয়া, শায়বা ইবনে রাবীয়া, আবূ জাহিল
ইবনে হিশাম, উমাইয়া ইবনে খালফ, আবূ
সুফিয়ান ইবনে হারব প্রমুখ ছিলো। তারা বললো, হে আবূ ত্বালিব!
আমাদের মধ্যে আপনার স্থান যে কত ঊর্ধ্বে তাতো আপনি জানেন। এখন আপনার বিদায়লগ্নের
অবস্থা, তাও আপনি দেখছেন। আপনার ইন্তিকাল ঘটবে এ আশঙ্কায়
আমরা শঙ্কিত। আমাদের মাঝে এবং আপনার সম্মানিত ভাতিজা উনার মাঝে যে মতবিরোধ রয়েছে
তাতো আপনি জানেনই। আপনি উনাকে একটু ডেকে পাঠান। তারপর উনার স্বার্থে আমাদের নিকট
থেকে কিছু অঙ্গীকার নিন আর আমাদের স্বার্থে উনার নিকট থেকে কিছু অঙ্গীকার নিয়ে দিন
যাতে পরে আমরা উনার থেকে বিরত থাকি, তিনি আমাদের থেকে বিরত
থাকেন। যাতে তিনি আমাদের এবং আমাদের ব্যাপারে কোনো প্রকার আলোচনা না করেন। আর
আমরাও উনাকে এবং উনার দ্বীনকে গালমন্দ না করি।
فبعث اليه أبو طالب فجاءه فقال ياابن أخى هؤلاء اشراف قومك قد اجتمعوا اليك ليعطوك وليأخذوا منك. قال فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم ياعم كلمة واحدة تعطونها تملكون بها العرب وتدين لكم بها العجم. فقال أبو جهل نعم وأبيك وعشر كلمات. قال تقولون لاإله إلا الله وتخلعون ماتعبدون من دونه. فصفقوا بأيديهم. ثم قالوا يا حضرت محمد صلى الله عليه و سلم أتريد أن تجعل الالهة إلها واحدا؟ إن أمرك لعجب. قال ثم قال بعضهم لبعض إنه والله ماهذا الرجل بمعطيكم شيئا مماتريدون،
فانطلوا وامضوا على دين أبائكم حتى يحكم الله بينكم وبينه، ثم تفرقوا.
আবূ ত্বালিব তিনি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নিকট তাশরীফ নিলে আবূ ত্বলিব বললেন,
ভাতিজা! এরা আপনার সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। তারা আপনার
নিকট এসেছে যাতে আপনি তাদের থেকে কিছু অঙ্গীকার নিয়ে নেন এবং ওদেরকে আপনি কিছু
অঙ্গীকার দিয়ে দেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, চাচাজান! আপনারা
শুধু আমার একটি কথা মেনে নিন যার মাধ্যমে আপনারা সম্পূর্ণ আরব জাহানের অধিপতি হতে
পারবেন এবং অনারব অঞ্চল আপনাদের করতলগত থাকবে। তখন পাপিষ্ঠ আবূ জাহিল বললো,
হ্যাঁ এরূপ হলে আমরা আপনার পিতার ক্বসম! একটি কেনো দশটি কথাও মানতে
পারি। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, তবে আপনারা সবাই বলুন
لا اله الا الله
“মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।”
আর মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া যেগুলোর উপাসনা করছেন সেগুলো আপনারা ত্যাগ করুন।
উনার এ কথা মুবারক শুনে কুরাইশদের সমস্ত কাফিরেরা হাত তালি দিয়ে উঠলো এবং বললো হে
আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনি কি বহু
উপাস্যের পরিবর্তে একজন মাত্র ইলাহ সাব্যস্ত করতে চান? এতো আপনার এক আশ্চর্যজনক প্রস্তাব! এরপর তারা বলাবলি করলো,
মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! উনার নিকট তোমরা যা চাচ্ছো তার কিছুই
তিনি তোমাদেরকে দিবেন না। সুতরাং চলে যাও এবং নিজেদের পিতৃ ধর্মে অবিচল থাকো
যতক্ষণ না মহান আল্লাহ পাক তিনি তোমাদের এবং উনার মধ্যে ফায়ছালা করে দেন। এ কথা
বলে তারা নিজ নিজ পথে চলে গোলো।
“আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২য় জিলদ, মাওয়াহিবুল
লাদুন্নিয়া” গ্রন্থে হযরত হিশাম ইবনে সাইব রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার থেকে বর্ণিত
আছে যে, আবূ ত্বালিব উনার ইন্তিকালের সময় ঘনিয়ে আসলে তিনি
স্বয়ং কুরাইশ যুবক-বৃদ্ধা তথা সকলকে ডেকে আনলেন। উনাদের সকলকে ওছীয়ত করে বললেন,
হে কুরাইশ গোত্রের লোকসকল! মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনাদেরকে সারা
আলমের উপর মর্যাদা-মর্তবা দান করেছেন। আমি আপনাদেরকে যিনি আমার সম্মানিত ভাতিজা
আখিরী রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল
মুরসালীন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার সঙ্গে সদাচরণ করার এবং যথাযথভাবে খিদমত করার ব্যাপারে উপদেশ দান
করছি। কেননা কুরাইশগণের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে পরম বিশ্বস্ত এবং সমগ্র আরব জাহানে আল
আমিন (সত্যবাদী)। তাছাড়া উনার পতঃপবিত্র চরিত্র মুবারকে রয়েছে সমস্ত সদগুণাবলীর
সমাবেশ। তিনি আপনাদের নিকট এমন একটি বিষয় নিয়ে আগমন করেছেন যা সকলের অন্তরই
স্বীকার করে বটে। কিন্তু সাময়িক তিরস্কার, ভর্ৎসনার ভয়ে
উনাকে মৌখিক মর্যাদা দিতে রাজি নয়। মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম করে আমি বলতেছি,
আমি প্রত্যক্ষ করতেছি যে, আরব জাহানের নিঃস্ব,
দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত, দুর্বল
বেদুঈনগণ উনার দাওয়াত গ্রহণ করতেছেন, উনার কালাম বা কথা
মুবারককে হক্ব বা সত্য বলে জ্ঞান করতেছেন, উনাকে নিজেদের সকল
কাজেই দিশারী হিসেবে গ্রহণ করতেছেন। আমি আরো দেখতে পাচ্ছি, বয়োজ্যেষ্ঠ
কুরাইশদের মাথা অবনত হয়ে আসছে, তাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়ে
গেছে। তাদের মধ্যে দুর্বল অসহায় মজলুম ব্যক্তিগণ উনারা বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে
গেছেন। আর যে সমস্ত লোকজন বিত্ত বৈভবের মালিক ছিলো তারা এখন নিঃস্ব, দুর্বল, লাঞ্ছিত ও নীচ হয়ে গেছে। যারা একদিন উনার
নিকট থেকে অনেক দূরে ছিলেন আজ উনারা উনার নৈকট্য লাভ করে কামিয়াবী অর্জন করছেন।
যাঁরা আজ বাস্তবিকই আরব ভুমিকা নির্মল করে দিয়েছেন। উনারা আজ আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে নিজের জানের
থেকে বেশি মুহব্বত করেন এবং উনার আনুগত্যের গৌরব লাভ করেছেন। (এই সব ঘটনা ভবিষ্যতে
ঘটবে আমি যেনো দিব্য চোখে দেখতেছি।
সুতরাং হে কুরাইশগণ! আপনারা সর্বাগ্রে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে
মুহব্বত করুন। উনার সার্বিক খিদমতের জন্যে এগিয়ে আসুন। মহান আল্লাহ পাক উনার
ক্বসম! যে ব্যক্তি উনার আনুগত্য স্বীকার করবে উনার প্রতি ঈমান আনবে উনাকে
অনুসরণ-অনুকরণ করবে তিনি অবশ্যই সৎ পথের সন্ধান পেয়ে যাবেন। তিনি জীবনে হাক্বীক্বী
কামিয়াবী লাভ করবেন। আর কোনো স্বজন, কোনো চরিত্রবান লোকই
উনার পূতঃপবিত্র চরিত্র মুবারকের গুণাবলীর বিন্দু মাত্র নিন্দা করতে পারবে না। হায়!
আমি যদি আরোও কিছুদিন জীবিত থাকতাম, আমার হায়াত যদি আরো কিছু
দিনের জন্যে বাড়িয়ে দেয়া হতো তবে আমি অবশ্যই উনার খিদমতের আঞ্জাম দিতাম।
সর্বপ্রকার বিপদাপদ, দুঃখ-কষ্টে আমি উনার পার্শ্ব মুবারকে
থাকতাম উনাকে সহযোগিতা করতাম। আবূ ত্বালিব তিনি এই ওছীয়ত মুবারক করে দুনিয়ার সকল
মায়া-মমতা ত্যাগ করে বিছাল শরীফ লাভ করলেন। (মাদারিজুন নুবুওওয়াত)
উল্লেখ্য যে, চাচা আবূ ত্বালিব
তিনি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার সর্বপ্রকার খিদমতের আঞ্জামাদাতা, উনার
শান-মান, মর্যাদা-মর্তবাকে প্রকাশের প্রচেষ্টাকারী এবং উনার
প্রশংসা ফাযায়িল-ফযীলত ইত্যাদি প্রকাশকারী। আবূ ত্বালিব উনার হামদ, না’ত, কবিতা ও বর্ণনা-বিবৃতিতে চির সোনালি অক্ষরে
বিদ্যমান রয়েছে আখির রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনার বেমেছাল ছানা-ছিফত। সুবহানাল্লাহ!
আবূ ত্বালিব তিনি ঈমানের সাথে ইন্তিকাল করেছেন কিনা- এ ব্যাপারে মত পার্থক্য
রয়েছে, তবে উনার বিদায় লগ্নে তিনি বলেছিলেন,
আমি আমার পিতা সাইয়্যিদুনা হযরত আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম
উনার ধর্ম মতেই রয়েছি। (আল বিদয়া ওয়ান নিহায়া, মাদারিজুন
নুবুওওয়াত ইত্যাদি)
ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বর্ণনা করেন, হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি আখিরী
রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনাকে বললেন, আপনার চাচা আবূ ত্বালিব তিনি তো আপনার খিদমতের
আঞ্জাম দিয়েছেন আপনাকে লালন-পালন করেছেন, আপনার জন্যে কুরাইশ
কাফির, মুশরিকদের বিরাগভাজন হয়েছেন। আপনি উনার জন্যে কি
করেছেন। জবাবে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ
করেন,
هو فى ضحضاح من النار
“তিনি এখন জাহান্নামের উপরের স্তরে রয়েছেন।”
অর্থাৎ তিনি জাহান্নামের নিম্নস্তরে ছিলেন, আমি উনাকে উদ্ধার করে উপরের স্তরে নিয়ে এসেছি। (বুখারী শরীফ)
অন্য হাদীছ শরীফ-এ এসেছে, “হযরত ইবনে আব্বাস
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত; আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ
করেন,
اهون اهل النار عذابا ابو طالب متنعل بنعلين من نار يغلى منهما دماغه-
অর্থ: “জাহান্নানের সবচেয়ে হালকা ও সহজ আযাব ভোগ করছেন আবূ ত্বালিব। উনাকে
আগুনের দু’টো পাদুকা পরানো হয়েছে। তাতে উনার মাথার মগয টগবগ করে ফুটছে ।” (মুসলিম
শরীফ)
হযরত ইউনুস ইবনে বুকাইর রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার রচিত ‘মাগাযী’ গ্রন্থে আছে
“পাদুকা দু’টোর তাপে উনার মাথার মগয ফুটছে এবং গলে গলে উনার পদদ্বয় পর্যন্ত
গড়াচ্ছে।” হযরত সুহায়লী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি এটি উল্লেখ করেছেন।
হাদীছ শরীফ-এ আরো এসেছে, হযরত আলী
কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহূ আলাইহি সালাম তিনি বলেন, আবূ ত্বালিব
উনার ইন্তিকালের পর আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনার দেখা-শুনা
খিদমতদাতা অভিভাবক তিনি ইন্তিকাল করেছেন এখন উনাকে দাফন করবেন কে?
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন, আপনি যান,
আপনার পিতাকে দাফন করে ফেলুন এবং আমার নিকট না আসা পর্যন্ত কোনো
মন্তব্য করবেন না।” দাফন করে আমি উনার নিকট ফিরে আসি। তিনি আমাকে নির্দেশ দেয়ায়
আমি গোসল করি। তারপর তিনি এমন কতক দোয়া করলেন। সেগুলো দোয়ার পরিবর্তে দুনিয়ার অন্য
কোনো কিছু গ্রহণের আমি খুশি নই। (আবূ দাউদ ও নাসায়ী শরীফ)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, নূরে মুজাসসাম,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ
করেন,
غفر الله له و رحمه
অর্থ: “হে বারী ইলাহী! উনাকে আপনি ক্ষমা করুন ও রহমত করুন।”
আরো বর্ণিত রয়েছে যে, আখিরী রসূল,
হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি আবূ
ত্বলিব উনার জানাযার সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছেন এবং বলেছেন, হে
চাচাজান! আপনি তো আত্মীয়তার পূর্ণ মর্যাদা রক্ষা করেছেন। আমার খিদমতের ব্যাপারে
আপনি কোনো প্রকার ত্রুটি করেননি। মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনার এইসব আমলের উত্তম
পুরস্কার দান করুন। (মাদারিজুন নুবুওওয়াত)
মোট কথা আবূ ত্বালিব উনার ঘটনা একটি জটিল ও দুরূহ ব্যাপার। যা মহান আল্লাহ পাক
ও উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং যামানার লক্ষ্যস্থল ওলীআল্লাহ, মুজাদ্দিদে আ’যম, মামদূহ হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা
আলাইহি সালাম উনারা এ ব্যাপারে সম্যক অবগত রয়েছেন। সুবহানাল্লাহ!
তবে বর্ণিত রয়েছে, যখন উনার
ইন্তিকালের সময় কুরাইশ কাফির-মুশরিকরা এসে ঝগড়া-বিবাদ ও হৈ-চৈ শুরু করে দিলো তখন
তিনি বললেন, আমি আমার পিতা হযরত আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস
সালাম, হযরত হিশাম আলাইহিস সালাম, হযরত
আবদে মান্নাফ আলাইহিস সালাম উনাদের ধর্ম মতে অবিচল থেকে বিদায় গ্রহণ করতেছি। আর
সমস্ত ইমাম, মুজতাহিদ, আওলিয়ায়ে কিরাম
রহমতুল্লাহি আলাইহিস উনাদের মতে, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্মানিত পিতা,
পিতাসহ উনার পূর্বপুরুষগণ সকলেই শিরকের অপবিত্রতা থেকে সম্পূর্ণ
মুক্ত ছিলেন। অতএব, এ ব্যাপারে আমাদের নীরব থাকাই বাঞ্ছনীয়।
(মাদারিজুন নুবুওওয়াত)
উল্লেখ্য যে, চীশতিয়া খান্দানের
বুযুর্গানে দ্বীন রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনারা হাদীছ শরীফ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা
করেন, হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি যখন কিয়ামত
সংঘটিত হওয়ার পূর্বে হযরত ইমাম মাহদী আলাইহিস সালাম উনাকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে
উম্মতে হাবীবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হিসেবে যমীনে আগমন করবেন তখন হযরত
ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম তিনি যে হযরত ঈসা রূহুল্লাহ আলাইহিস সালাম- সেটা
প্রমাণ করার জন্য উনার সুমহান এক মু’জিযা শরীফ ‘মুর্দাকে জিন্দা করা’ সেটা
প্রকাশের জন্য তিনি আবূ ত্বালিব উনাকে উনার কবরে যেয়ে قم باذن الله বলে জিন্দা করবেন। অতঃপর আবূ ত্বালিব তিনি ঈমান এনে মুসলমান হবেন
এবং মুসলমান হিসেবে বিছাল শরীফ লাভ করবেন। সুবহানাল্লাহ!
স্মরণীয় যে, আবূ ত্বালিব উনার
ইন্তিকালের সময়টি ছিলো আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত প্রকাশের দশম বৎসর। তখন আবূ ত্বালিব
উনার বয়স ছিলো ৮৭ বৎসর। অর্থাৎ আবূ ত্বালিব তিনি হিজরতের তিন বৎসর পূর্বে নুবুওয়াত
প্রকাশের দশ বৎসরের মাঝামাঝি শাওয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন।
0 Comments:
Post a Comment