হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি
আলাইহি তিনি বলেন, “হযরত আব্দুর রহমান ইবনুল হারিছ ইবনে
আব্দুল্লাহ ইবনে আয়াশ ইবনে রবীয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি আমাকে আব্দুল আযীয ইবনে
আব্দুল্লাহ ইবনে আমীর ইবনে রাবীয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার বরাতে উনার মাতা উম্মু
আব্দুল্লাহ বিনতে আবু হাছামা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনার থেকে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আমরা যখন একে একে আবিসিনিয়ায়
হিজরতের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হযরত আমীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি পারিবারিক
কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। সহসা হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি এসে আমার
নিকটে দাঁড়ালেন, তখনও তিনি ঈমান গ্রহণ করেননি। হযরত উম্মু আব্দুল্লাহ
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি বলেন, আমরা উনার যুলুম অত্যাচারে অতিষ্ঠ
ছিলাম। হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, হে উম্মু আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা! আপনারা মনে
হয় চলে যাচ্ছেন। আমি বললাম, হ্যাঁ, মহান আল্লাহ পাক উনার যমীনে বেরিয়ে পড়বো। আপনারা আমাদের
অনেক কষ্ট দিয়েছেন, অনেক নির্যাতন চালিয়েছেন। মহান
আল্লাহ পাক তিনি এ কঠিন অবস্থা থেকে আমাদের হিফাজত করবেন। ইনশাআল্লাহ! হযরত উমর
ফারূক আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, মহান আল্লাহ পাক তিনি আপনাদের সাথী
হোন। উনার কথায় এমন একটি সহানুভূতির ভাব দেখতে পেলাম, যা ইতঃপূর্বে আমি কখনো দেখিনি। এরপর হযরত উমর ইবনুল খত্তাব
আলাইহিস সালাম তিনি চলে গেলেন। তবে আমার মনে হচ্ছে, আমাদের দেশ থেকে হিজরতের খবরে তিনি
মর্মাহত। রাবী বলেন, কিছুক্ষণ পর হযরত আমীর
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার প্রয়োজন সেরে ঘরে ফিরে এলেন। আমি উনাকে বললাম, ‘হে হযরত আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার বাবা!
এইমাত্র হযরত উমর আলাইহিস সালাম তিনি এসেছিলেন। আমাদের প্রতি উনার যে সহানুভূতি ও
উদ্বেগ, তা যদি আপনি দেখতেন। হযরত আমীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
তিনি বললেন, আপনি কি উনার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আশাবাদী? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বলেন, খাত্তাবের বাবা ইসলাম গ্রহণ করলেও, আপনি যাঁকে দেখেছেন তিনি অর্থাৎ খাত্তাবের ছেলে হযরত উমর
আলাইহিস সালাম তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন না। হযরত উম্মু আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহা তিনি বলেন, ইসলামের প্রতি হযরত উমর ফারূক
আলাইহিস সালাম উনার যে প্রচ- বিদ্বেষ এবং কঠোর মনোভাব দেখা যাচ্ছিলো, তার কারণে হযরত আমীর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি হতাশ
হয়ে এরূপ কথা বলেছিলেন। (সীরাতুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- হযরত ইবনে
হিশাম রহমতুল্লাহি আলাইহি)
হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি
আলাইহি তিনি বলেন, “হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস
সালাম উনার বোন হযরত ফাতিমা বিনতে খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ও উনার ছহিব
বা স্বামী হযরত সায়ীদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়িল রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
উনারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু উনারা ইসলাম গ্রহণের ব্যাপাটির হযরত উমর ইবনুল
খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন। পবিত্র মক্কা শরীফ-এর আর এক
ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন যিনি হচ্ছেন, হযরত নায়ীম ইবনে আব্দুল্লাহ নাহহাম
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু। হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার স্বগোত্রীয় অর্থাৎ
বনু আদী ইবনে কা’ব-এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি নিজ গোত্রের অত্যাচারের কারণে নিজের ইসলাম
গ্রহণের কথা প্রকাশ করেননি। হযরত খাব্বার ইবনে আরাত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
তিনি গোপনে হযরত ফাতিমা বিনতে খাত্তাব আলাইহাস সালাম উনার নিকট যাতায়াত করতেন এবং
উনাকে কুরআন শরীফ পাঠ করে শুনাতেন। এক দিন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম
তিনি উম্মুক্ত তরবারী হাত মুবারকে নিয়ে আখিরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উনার একদল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুম উনাদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি জানতে পেয়েছিলেন যে, প্রায় চল্লিশ জন পুরুষ ও নারী ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুমসহ নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী একটি ঘরে একত্রিত হয়েছেন। এ সময়
নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
সঙ্গে উনার চাচা হযরত হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব আলাইহিস সালাম, হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব ইবনে কুহাফা আলাইহিস সালাম ও হযরত
আলী ইবনে আবূ ত্বলিব আলাইহিস সালাম উনারাসহ এমন কিছু সংখ্যক মুসলমান ছিলেন, যাঁরা আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সঙ্গে পবিত্র মক্কা শরীফ-এ অবস্থান করছিলেন। যাঁরা
আবিসিনিয়ায় হিজরতকারীগণের সঙ্গে হিজরত করেননি। পথিমধ্যে হযরত নায়ীম ইবনে
আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার সঙ্গে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস
সালাম উনার দেখা হলো। তিনি উনাকে বললেন, কোথায় চলছেন, হে হযরত উমর আলাইহিস সালাম? হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস
সালাম তিনি বললেন, হযরত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনার সন্ধানে চলছি। যিনি কুরাইশ বংশে বিভেদ সৃষ্টি করেছেন। তাদের
বুদ্ধিমানদের বোকা সাব্যস্ত করেছেন। তাদের অনুসৃত ধর্মের নিন্দা করছেন এবং তাদের
দেব-দেবীকে গালি-গালাজ করছেন, আমি উনাকে শহীদ করবো। নাঊযুবিল্লাহ!
তখন হযরত নায়ীম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু তিনি বললেন, হে হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস
সালাম! মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আপনি মনে করেন, হযরত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম উনাকে শহীদ করার পর বনূ আবদে মানাফ আপনাকে ছেড়ে দিবেন, আর আপনি যমীনের উপর অবাধে বিচরণ করে বেড়াতে পারবেন? আপনার কি উচিত নয়, আগে নিজের পরিবার পরিজনদের দিকে
মনোনিবেশ করা এবং উনাদের শোধরানো? তখন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস
সালাম তিনি বলবেন, আমার পরিবার-পরিজন কে? হযরত নায়ীম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বললেন আপনার
ভগ্নিপতি ও চাচাতো ভাই হযরত সায়ীদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু
এবং আপনার বোন হযরত ফাতিমা বিনতে খাত্তাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা। মহান আল্লাহ
পাক উনার ক্বসম! উনারা উভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ
হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ধর্ম গ্রহণ করেছেন। পারলে আপনি উনাদের
সামলান। রাবী বলেন, তখন হযরত উমর ফারূক্ব আলাইহিস সালাম
উনার বোন ও ভগ্নিপতির বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন। যখন তিনি উনাদের কাছে পৌঁছলেন তখন
উনাদের কাছে হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনিও ছিলেন। তিনি
উনাদেরকে পবিত্র কুরআন শরীফ-এর একটি অংশ হাতে নিয়ে পড়াচ্ছিলেন। এই অংশটিতে ‘সূরা
ত্বহা’ লিখা ছিলো। যখন হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার পদ ধ্বনি শুনতে
পেলেন। তখন হযরত খাব্বাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ঘরের এক কোণে অবস্থান
করলেন। আর হযরত ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি কুরআন শরীফ-এর অংশটি নিজের
মধ্যে চেপে ধরে রাখলেন। ঘরের কাছাকাছি পৌঁছার পর হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম
তিনি হযরত খাব্বাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার কুরআন শরীফ পড়ার আওয়াজ
শুনছিলেন। ঘরে ঢুকে তিনি বললেন, একটি দুর্বোধ্য তেলাওয়াত বা পাঠের
আওয়াজ শুনলাম, তা কি? উনারা উভয়ে বললেন, না আপনি কিছুই শুনেননি। হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস
সালাম তিনি বললেন, নিশ্চয়ই শুনেছি। আর মহান আল্লাহ পাক
উনার ক্বসম। এটাও জেনেছি যে, আপনারা দু’জনে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
দ্বীনের অনুসারী হয়েছেন। কথাটি বলেই ভগ্নিপতি হযরত সায়ীদ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা
আনহু উনাকে প্রবলভাবে জাপটে ধরলেন। উনার বোন হযরত ফাতিমা বিনতে খাত্তাব
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তিনি উনার স্বামীকে বাঁচাতে ছুটে গেলেন। এ কঠিন ঘটনার
পর উনার বোন ও ভগ্নিপতি একযোগে উনাকে বললেন, হ্যাঁ, আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি।
মহান আল্লাহ পাক ও উনার হাবীব হুযূর
পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার প্রতি ঈমান এনেছি। এখন আপনি যা করতে চান
করুন। হযরত উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি যখন দেখলেন, উনার বোন-এর শরীর মুবারক রক্তাক্ত, তখন তিনি অনুতপ্ত হলেন। তিনি উনার বোনকে বললেন, আমাকে কপিটি দিন। যা এই মাত্র আপনাদেরকে পড়তে শুনলাম। আমি
একটু দেখবো আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি কি নিয়ামত নিয়ে এসেছেন? হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস
সালাম তিনি খুবই জ্ঞানী ছিলেন। তিনি এ কথা যখন বললেন, তখন উনার বোন উনাকে বললেন, আমার ভয় হয়, সেটি আপনি নষ্ট করে ফেলেন কি-না। হযরত উমর ফারূক আলাইহিস
সালাম তিনি বললেন, ভয় পাবেন না। এরপর তিনি নিজের
ধর্মের ক্বসম করে বললেন, তিনি তা পড়েই উনাকে ফেরত দিবেন।
হযরত উমর ফারূক ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনার একথা শুনে হযরত ফাতিমা
রদ্বিযাল্লাহু তায়ালা আনহা উনার মনে আশার সঞ্চার হলো যে, হযরত উমর ফারূক ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি ইসলাম
গ্রহণ করতে পারেন। তিনি উনাকে বললেন ভাইজান! আপনি যে অপবিত্র। অথচ এ পবিত্র
গ্রন্থকে পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করতে পারে না। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব
আলাইহিস সালাম তৎক্ষণাৎ উঠে গেলেন এবং গোসল করে এলেন।
এবার হযরত ফাতিমা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা উনাকে ছহীফাখানা দিলেন। তাতে ‘সূরা
ত্ব-হা’ লিখিত ছিলো। তিনি তা পড়লেন। প্রথম অংশটি পড়েই তিনি বললেন, আহ! কি সুন্দর কথা। কি সর্বোত্তম বাণী মুবারক। উনার এ
উক্তি শুনে হযরত খব্বাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি উনাদের সামনে বেরিয়ে এলেন।
তিনি উনাকে বললেন, হে হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব
আলাইহিস সালাম! মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আমার মনে আশার সঞ্চার হচ্ছে যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি নিশ্চয়ই আপনাকে উনার রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
দাওয়াত গ্রহণের জন্য মনোনীত করেছেন। আমি গতকাল আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনাকে এরূপ দোয়া করতে শুনেছি। হে আল্লাহ পাক! আপনি আবুল হাকাম ইবনে হিশাম অথবা উমর
ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম উনাদের দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করুন। অতএব, হে হযরত উমর ফারূক ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম! মহান
আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করুন, মহান আল্লাহ পাক উনাকে ভয় করুন। তখন
হযরত উমর ফারূক ইবনুল খাত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি উনাকে বললেন, হে হযরত খাব্বাব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু! আমাকে আখিরী
রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
সন্ধান দিন। আমি উনার নিকট গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করবো। হযরত খাব্বাব রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু তিনি বললেন, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সাফা পাহাড়ের নিকট একটি বাড়িতে অবস্থান করছেন। সেখানে
উনার সঙ্গে একদল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারাও রয়েছেন।
হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার তরবারী আগের মতোই খোলা অবস্থায়
ধরে নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উনার হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের
কাছে চললেন। তিনি সেখানে গিয়ে দরজা মুবারকে কড়া নাড়লেন। উনার আওয়াজ শুনে নূরে
মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
জনৈক ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি ভিতর থেকে দরজা মুবারকের কাছে গিয়ে
তাকিয়ে দেখলেন যে, হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব
আলাইহিস সালাম তিনি উন্মুক্ত তরবারী হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি শঙ্কিত চিত্তে
আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ, ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! এ যে হযরত
উমর ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম, একেবারে নগ্ন তরবারী হাতে!
তখন হযরত হামযা ইবনে আব্দুল
মুত্তালিব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, উনাকে ভিতরে আসার অনুমতি দিন। তিনি
যদি কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এসে থাকেন, তবে আমরা উনার সাথে ভালো ব্যবহার
করবো। পক্ষান্তরে তিনি যদি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এসে থাকেন, তাহলে আমরা উনার তরবারী দিয়েই উনাকে হত্যা করবো। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
বললেন, উনাকে ভিতরে আসতে দাও। উক্ত হযরত ছাহাবী রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু উনাকে ভিতরে আসতে দিলেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি নিজে উঠে উনার কাছে এগিয়ে গেলেন এবং হুজরা শরীফ-এ একান্তে
উনার সাথে দেখা করলেন। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার কোমর ধরে
অথবা যেখানে চাদরের দু’কোনা মিলিত হয়, সেখানটা ধরে উনাকে প্রবল
ফায়েজ-তাওয়াজ্জুহ তথা আকর্ষণ করলেন এবং বললেন, হে খাত্তাব-এর পুত্র! আপনার এখানে
আগমনের কারণ কি? মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আমার মনে হয়, মহান আল্লাহ পাক আপনাকে কোনো বিপর্যয়ে না ফেলা পর্যন্ত আপনি
ফিরবেন না। হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম! আমি আপনার কাছে এসেছি মহান আল্লাহ পাক উনার উপর এবং উনার রসূল
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার উপর ও আপনার কাছে মহান আল্লাহ পাক উনার পক্ষ
থেকে যা কিছু এসেছে তার উপর ঈমান আনার জন্য। রাবী বলেন, একথা শোনা মাত্র আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উচ্চস্বরে আল্লাহু আকবার বলে উঠলেন যে, ঐ হুজরা শরীফ-এর ভিতর হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার সমস্ত হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা সবাই
বুঝলেন যে, হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি ইসলাম
গ্রহণ করেছেন। সুবহানাল্লাহ!
এরপর আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা যার যার জায়গায় চলে গেলেন।
হযরত হামযা আলাইহিস সালাম উনার পর হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার
ইসলাম গ্রহণে উনাদের মনোবল ও আত্মমর্যাদা বেড়ে গেলো। উনারা নিশ্চিত হলেন যে, উনারা দু’জন আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার খিদমত করবেন এবং মুসলমানরা এ দু’জনের বদৌলতে শত্রুদের
থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবেন। হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার
ইসলাম গ্রহণের ঘটনা মদীনাবাসী বর্ণনাকারী উনাদের ভাষায় উপরে বর্ণিত হলো।” (সীরাতুন
নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- হযরত ইবনে হিশাম রহমতুল্লাহি আলাইহি)
হযরত ইবনে ইসহাক্ব রহমতুল্লাহি
আলাইহি তিনি বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা উনার আযাদকৃত গোলাম হযরত নাফে ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু উনার থেকে আমার কাছে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমার সম্মানিত পিতা হযরত উমর ফারূক আলাইহিস্ সালাম তিনি যখন
ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে, কুরাইশগণদের মধ্যে কোন ব্যক্তি সর্বাধিক প্রচার মুখর? উনাকে জানানো হলো, জামীল ইবনে মুয়াম্মার জুমহী। হযরত
উমর ফারূক আলাইহিস্ সালাম তা শুনে তৎক্ষণাৎ তার খোঁজে বের হলেন। হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, আমি আমার সম্মানিত পিতা হযরত উমর ফারূক আলাইহিস্ সালাম উনার
পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলাম এবং তিনি কি করেন তা আমি দেখতে লাগলাম। তখন আমি বালক
ছিলাম তারপরও যা কিছু দেখতাম সবই বুঝতে পারতাম। হযরত উমর ফারূক আলাইহিস্ সালাম
তিনি জামিলের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে জামীল! তুমি কি জানো আমি ইসলাম
গ্রহণ করেছি এবং নূরে মুজাস্সাম, আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
আনীত দ্বীন কবুল করেছি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি
বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! আমার সম্মানিত পিতা হযরত উমর
ফারূক আলাইহিস্ সালাম তিনি দ্বিতীয় বার একথা বলার পূর্বেই জামীল তার চাদর গুটিয়ে
হাঁটা শুরু করলো। হযরত উমর ফরূক আলাইহিস্ সালাম তিনি তার পিছু পিছু চললেন। আমিও
আমার সম্মানিত পিতা উনার পিছু পিছু চলমান। সে জামীল চলতে চলতে মাসজিদুল হারামের
দরজার কাছে পৌঁছে বিকট চিৎকার করে বললো- হে কুরাইশবাসী! শুনে নিন, হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস্ সালাম তিনি ধর্মচ্যুত
হয়ে গেছেন। নাউযুবিল্লাহ! এ সময় কুরাইশ সরদারদের মাজলিস পবিত্র কা’বা শরীফ-এর
চত্বরে বসেছিলো। হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস্ সালাম তার পিছনে দাঁড়িয়ে
বললেন, জামীল মিথ্যা বলছে। আমি ধর্মচ্যুত হইনি, তবে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে-
اشهد ان لااله الا الله و اشهد ان محمدا عبده و رسوله صلى الله عليه و سلم
অর্থ: “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং আমি আরো
সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই হযরত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব ও রসূল পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম।”
এই কালিমা শরীফ বলার সঙ্গে সঙ্গে
সকলে উনার দিকে মারমুখী হয়ে ছুটে এলো। হযরত উমর ফারূক আলাইহিস্ সালাম ও কুরাইশদের
মধ্যে দুপুর পর্যন্ত জিহাদ চললো।
রাবী বলেন, এক সময় হযরত উমর ফারূক আলাইহিস্ সালাম তিনি ক্লান্ত হয়ে বসে
পড়লেন। কুরাইশরা তখনও উনার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব
আলাইহিস্ সালাম তিনি বলতে লাগলেন তোমাদের সাহস থাকলে সামনে আসো। মহান আল্লাহ পাক
উনার ক্বসম! আমরা যদি তিনশত মুসলমান থাকতাম তাহলে আমরা তোমাদের জন্য মক্কা শরীফ
ছেড়ে দিতাম অথবা তোমরা আমাদের জন্য পবিত্র মক্কা শরীফ ছেড়ে দিতে।
রাবী বলেন, উভয় পক্ষ যখন জিহাদে মশগুল তখন সহসা সেখানে একজন প্রবীণ
কুরাইশ সরদারের আবির্ভাব ঘটলো, যার গায়ে মূল্যবান ইয়ামানী চাদর ও
নকশাদার জামা ছিলো। তিনি তাদের নিকটে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন- তোমাদের কি হয়েছে? সকলে বললো, সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক ইবনুল
খত্তাব আলাইহিস্ সালাম তিনি ধর্মচ্যুত হয়েছেন। নাঊযুবিল্লাহ! বৃদ্ধ লোকটি বললো, তাতে কি হয়েছে, তোমরা থামো! একজন ব্যক্তি উনার
নিজের ইচ্ছায় একটি বিষয় গ্রহণ করেছেন, তোমরা উনার কি করতে চাও? তোমরা কি চিন্তা ফিকির করেছো যে, বনূ আদ ইবনে কা’বা (হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস্
সালাম উনার গোত্র) তাদের নিজেস্ব ব্যক্তি উনাকে তোমাদের হাতে এভাবেই ছেড়ে দিবেন? উনাকে তোমরা ছেড়ে দাও। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর
রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তিনি বলেন, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! এ কথার
পর তারা গুটিয়ে নেয়া কাপড়ের ন্যায় নিজেদের ভাবাবেগকে সংযত করলো। পরবর্তীতে পবিত্র
মদীনা শরীফ-এ হিজরতের পর আমি আমার সম্মানিত পিতা সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক ইবনুল
খত্তাব আলাইহিস্ সালাম উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম- হে আমার সম্মানিত আব্বাজান! বৃদ্ধ
ব্যক্তিটি কে ছিলেন? যিনি আপনার ইসলাম গ্রহণের দিন
বিক্ষুব্ধ জনতাকে ধমক দিয়ে আপনার কাছ থেকে হটিয়ে দিয়েছিলেন? সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, হে আমার সম্মানিত পুত্র! তিনি ছিলেন, আস ইবনে ওয়াইল সাহমী। (সীরাতুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক ইবনুল
খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইসলামের খিদমত নিয়েছেন।
তিনি কোনো কাফির, মুশরিক, ইহুদী-নাছারা তথা কোনো বিধর্মীকে পরওয়া করতেন না। আখিরী
রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনার জন্য দোয়া
করেছিলেন, ইয়া বারী ইলাহী! আবু জাহিল এবং হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব
আলাইহিস সালাম উনাদের মধ্যে যে আপনার নিকট সবচেয়ে বেশি প্রিয় বা মুহব্বতের উনার
দ্বারা ইসলামকে সম্মানিত করুন। (মুসনাদে আহমদ শরীফ ও তিরমিযী শরীফ)
উল্লেখ্য যে, আখিরী নবী হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনাকে যখন মহান আল্লাহ পাক তিনি ওহীর মাধ্যমে জানালেন যে, আবু জাহিল ইসলাম গ্রহণ করবে না, তখন তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার
জন্য নির্দিষ্টভাবে দোয়া করলেন,
اللهم ايد الاسلام بعمربن الخطاب عليه السلام خاصة-
“আয় আল্লাহ পাক! খাছভাবে হযরত উমর
ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার মাধ্যমে ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করুন।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ, মুস্তাদরাকে হাকিম)
হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব
আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আমি শুরুতে আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
কঠোর বিরোধী ও দ্বীন ইসলামের কঠিন বিমুখ ও অসন্তুষ্ট ছিলাম। একদা আবু জাহিল ঘোষণা
করলো- যে ব্যক্তি আখিরী রসূল হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনাকে শহীদ করতে পারবে, তার জন্য আমি একশত উট প্রদানের যিম্মাদার
ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি সরাসরি আবু জাহিলকে প্রশ্ন করলাম, তোমার পক্ষ থেকে এ প্রতিশ্রুতি ও যিম্মাদারী কি সঠিক? আবু জাহিল বলল, হ্যাঁ। সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক
ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, আমি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উনাকে শহীদ করার উদ্দেশ্যে তরবারী নিয়ে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে একটি বাছুর নজরে
পড়লো, যেটিকে লোকেরা যবেহ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলো। আমিও দেখার
জন্য দাঁড়ালাম। কিন্তু কি দেখলাম! মনে হলো বাছুরের পেটের ভিতর থেকে কোনো আহবানকারী
আহ্বান করে বলছেন-
يا ال ذريع امر نجيح رجل- يصيح بلسان يدعو الى شهادة ان لا اله الا الله وان محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم-
“হে অনুসন্ধানকারীগণ! একটি সফল কাজ
হলো, এক সুমহান ব্যক্তি তিনি বিশুদ্ধ ভাষায় আহবান করে মানুষকে এক
মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং হযরত মুহম্মদ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তিনি উনার প্রিয়তম রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, এ সাক্ষ্য দিতে বলছেন।” (সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম তিনি
বলেন, এ আওয়াজ শোনামাত্র মনে হলো যেনো আমাকে এ আহবান করা হচ্ছে, আমিই যেনো ঐ ঘোষণাকারী উনার উদ্দেশ্যে।” (আবূ নুয়াইম, সীরাতুল মুস্তফা ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
হযরত ইবনে আব্বাস রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহু তিনি বলেন, যখন সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক
ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি
নাযিল হলেন এবং বলেন যে, ইয়া রসূলাল্লাহ! ইয়া হাবীবাল্লাহ
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! খলীফাতুল মুসলিমীন সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক
ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম উনার ইসলাম গ্রহণে সমস্ত আসমানবাসী আনন্দিত হয়েছেন।
(ইবনে মাযাহ, হাকীম, দারু কুতনী, তাবারুতে ইবনে সা’দ)
সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক ইবনুল
খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি যেদিন ইসলাম গ্রহণ করলেন, আর তখন থেকেই ইসলামের সম্মান ও
দ্বীনের অভ্যূদয় ও বিজয় ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হতে শুরু করলো। প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে
মসজিদুল হারামে নামায আদায় শুরু হলো। প্রকাশ্যভাবে ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ
তথা প্রচার-প্রসার শুরু হলো। এদিন থেকে হক্ব ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট ও
প্রকাশিত হলো। স্বয়ং আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাকে লক্বব মুবারক দিলেفاروق (ফারূক) অর্থাৎ সত্য মিথ্যার
পার্থক্যকারী। সুবহানাল্লাহ!
কবি বলেন,
چون عمر شیدا ائے ال معشوق شد+ حق وباطل را چو دل فاروق شد.
زان نشد فاروق را زھریے گزند+ کہ بدان تریان فاروق قیش قند.
অর্থাৎ “সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক
আলাইহিস সালাম তিনি যখন সেই প্রেমাস্পদের মুহব্বতে মুগ্ধ হলেন, তখন তিনি সত্য-মিথ্যার মানদ-ে পরিণত হলেন। যার ফলে
সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনাকে কোনো কিছু ক্ষতি করতে পারলো না, বরং তিনি বিষকে মিষ্টিতে পরিণত করলেন।” সুবহানাল্লাহ!
‘মাওয়াহিবুল লাদুননিয়া’ গ্রন্থে
উল্লেখ রয়েছে, সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার ইসলাম
গ্রহণের সময় মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো চল্লিশজন। মহিলা ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু
তায়ালা আনহুন্না উনাদের সংখ্যা ছিলো এগারোজন। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি ইসলাম
গ্রহণ করেছেন একটু বিলম্বে। অথচ প্রথম দিকে যখন হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্ব আলাইহিস
সালাম তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, তখনই উনার ইসলাম গ্রহণের কথা ছিলো
কিন্তু তা হয়নি। আর এই না হওয়ার মধ্যে রয়েছে মহান আল্লাহ পাক উনার বিশেষ হিকমত।
চল্লিশ সংখ্যা পূর্ণ হওয়ার বিষয়টিও প্রাণধানীয়। মহান আল্লাহ পাক তিনি আ’লাম তথা
মহান আল্লাহ পাক তিনি সর্বাধিক অবগত।
সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক ইবনুল
খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি দেরিতে ঈমান আনলেও কখনো তিনি আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
সম্পর্কে অপমন্তব্য করেননি। কখনও তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব হুযূর পাক
ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে শারীরিক বা মানসিক কষ্ট ও গালি-গালাজ
ইত্যাদি কখন করেননি।
উল্লেখ্য যে, হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, আমি ঈমান আনার পর এমন এক লোকের কাছে গেলাম যে, মানুষের গোপন বিষয় প্রকাশ করায় ছিলো ওস্তাদ। আমি তাকে বললাম, আমি আমার বাপ-দাদার ধর্ম পরিত্যাগ করেছি। লোকটি শুনে সজোরে
চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো, সাবধান! খত্তাবের পুত্র হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম তিনি
ধর্মভ্রষ্ট হয়েছেন। নাঊযুবিল্লাহ! এরপর থেকে কেউ আমাকে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করলে
আমার হাত মুবারকেই তাকে মার খেতে হতো। এক দিনের ঘটনা। আমার মামা আবু জাহিল
জিজ্ঞাসা করলো, এতো গোলমাল শুনা যাচ্ছে কিসের? লোকজন বললো, খত্তাবের পুত্র হযরত
উমর ফারূক আলাইহিস সালাম তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। একথা শুনে আবু জাহিল একটা
খচ্চরের উপর আরোহণ করে মক্কাবাসীদেরকে লক্ষ্য করে বললো, হুঁশিয়ার হয়ে যাও! আমার ভাগিনাকে আমি নিরাপত্তা দিলাম। তার
ঘোষণা শুনে লোকেরা আমার কাছ থেকে সরে গেলো।
অন্যান্য বর্ণনায় এসেছে, বদবখত আবু জাহিল তখন হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস
সালাম উনার উপর যুলুম শুরু করে দিলো। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। অবশেষে সে অত্যাচারে
ক্ষান্ত হলো। হযরত উমর ফারূক ইবনুল খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বলেন, তার পর অবস্থা এরকম দাঁড়ালো যে, আমি মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করতাম। কিন্তু তারা আমার
সঙ্গে দু’ব্যবহার করতো। এক পর্যায় মহান আল্লাহ পাক তিনি দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী
করে দিলেন। (মাদারেজুন নবুওওয়াহ)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, হযরত ইমাম আহমদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সাইয়্যিদুনা হযরত
উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার থেকে বর্ণনা করেন। হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম
তিনি বলেন, ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আমি নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার
পিছনে সবসময় থাকতাম। একদা তিনি আমার আগে কা’বা শরীফ-এ প্রবেশ করলেন। আমি পিছনে
পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সূরা ‘আল হাক্কা’ তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। আমি কুরআন
শরীফ-এর শাব্দিক গাঁথুনি মাধুর্যতা শুনে অবাক হলাম এবং কুরাইশদের মতো মনে মনে
বললাম, মহান আল্লাহ পাক উনার ক্বসম! তিনি কবি। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত
করলেন-
انه لقول رسول كريم. وما هو بقول شاعر قليلا ما تؤمنون.
অর্থ: “নিশ্চয়ই এই পবিত্র কুরআন
শরীফ একজন সুমহান সম্মানিত রসূল বা হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম উনার আনীত। এবং এটা কোনো কবির কালাম বা কথা নয়; তোমরা অল্পসংখ্যক লোকই বিশ্বাস করো।” সূরা আল হাক্কা : আয়াত
শরীফ ৪০ ও ৪১।
পুনরায় আমি ভাবলাম তিনি একজন কাহিল
বা অতীন্দ্রিয়বাদী বা গণক। এসময় তিনি এই আয়াত শরীফ তিলওয়াত করলেন-
ولا بقول كاهل. قليلا ما تذكرون.
“বরং এটা কোনো অতীন্দ্রিয়বাদী বা
গণকের কথা নয়; তোমরা কমই অনুধাবন করে থাকো।” (সূরা আল হাক্কা : আয়াত শরীফ
৪২)
সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক ইবনুল
খত্তাব আলাইহিস সালাম তিনি বললেন, এরপর আমার অন্তরের প্রতিটি কোণে
ঈমান প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো।
হযরত ইবনে আবী শায়বা রহমতুল্লাহি
আলাইহি তিনি হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে তিনি
সাইয়্যিদুনা হযরত উমর ফারূক আলাইহিস সালাম উনার থেকে, বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাতের বেলায় আমার ভাগিনীর প্রসব
বেদনা শুরু হলো, আমি আমার হুজরা থেকে বের হলাম এবং পবিত্র কা’বা শরীফ-এ চলে
এলাম। আখিরী রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সেখানে তাশরীফ আনলেন এবং নামায পড়া শুরু করলেন। আমি উনার
নিকট থেকে যা শুনলাম, ইতঃপূর্বে তা শুনিনি। এরপর আখিরী
রসূল, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
ফিরে যেতে লাগলেন। আমি উনার পিছনে পিছনে চললাম। অতঃপর নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি
আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে উমর ফারূক আলাইহিস সালাম! আপনি
দিনরাত্রি আমার পিছনে লেগে থাকেন। ব্যাপার কি?
আমি ভীত হয়ে পড়লাম, তিনি আমার জন্য যেনো বদদোয়া না করেন। তাই আমি তাড়াতাড়ি
বললাম-
اشهد ان لا اله الا الله وانك رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থ: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং নিশ্চয়ই আপনি
মহান আল্লাহ পাক উনার রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। (খছায়িছুল কুবরা, সীরাতুন নবী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)
0 Comments:
Post a Comment